চব্বিশ ঘণ্টার ঈশ্বর

চব্বিশ ঘণ্টার ঈশ্বর

ঘণ্টাখানেক ধরে যথেষ্ট বোঝাবার পরেও যখন স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল না, তখন মহাদেব বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘প্রত্যেক বার তুমি সমতলে যাবে আর ফিরে এসে মন খারাপ করে বসে থাকবে। তা সত্ত্বেও যাওয়া বন্ধ করবে না।’

‘আমি কি সাধে যাই, ওরা আমাকে জোর করে নিয়ে যায়।’ শিবানী বললেন।

‘কেউ কাউকে জোর করে এক বার নিয়ে যেতে পারে, বারে বারে পারে না। তা ছাড়া তুমি তো ওখানে উদ্বাস্তু। পশ্চিমবাংলা তো তোমার বাপের বাড়ি দেশ নয়। তোমার বাবা মা থাকতেন হিমালয় পাহাড়ে। তুমি পর্বতকন্যা। আয়নায় দেখো, তোমার মুখে মঙ্গোলিয়ান ছাপ, পাহাড়িদের যেমন হয়। ওরা জোর করে পশ্চিমবাংলাকে তোমার বাপের বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে, চোখ মুখ বদলে দেয়, ফিরে এলে কষ্ট তো হবেই।’ মহাদেব সপ্রেমে বললেন।

শিবানী শ্বাস ফেললেন, ‘আগে এমন হত না। তখন তো ডাকের সাজে সাজাত। চোখ মুখ তেমন পাল্টাত না। এখন ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালে প্রথম প্রথম অচেনা লাগে। বুঝতে পারি, আমার মুখও পাল্টে দিয়েছে ওরা।’
‘ভয়ঙ্কর কাণ্ড। ওই দিনগুলো মুখ বদলে থাকা কি সোজা কথা?’ মহাদেব বললেন, ‘যখন ফিরে আসো, তখন তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। কষ্ট হয়।’

শিবানী একটু ঘনিষ্ঠ হলেন, ‘তুমি আমাকে এখনও এত ভালবাসো?’
‘হুঁ।’ মহাদেব চোখ বন্ধ করলেন।
‘কিন্তু কী জানো, ওই বাঙালিরা আমার কেউ নয়, ওরা সমতলের বাসিন্দা। পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মিলেমিশে খিচুড়ি হয়ে আছে, কিন্তু সেই যে প্রথম বার ভুল করে হিমালয় না গিয়ে ওখানে নেমে পড়েছিলাম হাতির পিঠে চড়ে, তার পর থেকে ওখানে যাওয়াটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। না গেলে খুব খারাপ লাগে। ছেলেমেয়েদের এ বার বললাম: চল, এ বার তোদের নিয়ে সত্যিকারের দাদু দিদিমার বাড়িতে যাব। চার জনেই বেঁকে বসল।’ শিবানী বললেন।

‘কী বলল ওরা?’
‘কার্ত্তিক বলল, অসম্ভব। ওখানে কোনও পাবলিক দেখা যাবে না। লক্ষ্মী সরস্বতী বলল, ওই শীতে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে থাকতে পারব না। গণেশ বলল, মাইনাস তিরিশে খালি গায়ে থাকলে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।’
‘তা অবশ্য। তোমার বাপের বাড়িতে কৈলাসের চেয়ে শীত বেশি।’ মহাদেব মাথা নাড়লেন, ‘না। এ বার আর যেও না।’
‘তা কী করে হয়! ওরা তো আমার জন্যে প্যাণ্ডেল বানিয়ে ফেলেছে। আমি না গেলে কাকে না কাকে দুর্গা বানিয়ে মণ্ডপে বসিয়ে দেবে। উপদেবীগুলো তো প্রক্সি দেওয়ার জন্যে ছোঁক ছোঁক করছে।’ শিবানী বললেন।

‘তোমাকে নিয়ে পারা যাচ্ছে না। ফিরে এলে মন খারাপ করে থাকো, অথচ যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হও। ওদের ভাষা বুঝতে পারো?’
‘যখন পুরুত মন্ত্র পড়ে তখন পারি, অন্য সময় না বুঝে বোকা হয়ে হাসি। ছেলেমেয়েরা এত দিনে মাইম অ্যাক্টিং শিখে ফেলেছে বলে ! জানো, তোমার মেয়ে দুটো খুব ফাজিল হয়েছে। কার্ত্তিকটাও।’
‘কী রকম?’
‘উদ্বোধন করতে ছেলে ফিল্মস্টার এলে মেয়ে দুটো গদগদ হয়ে যায়। আর কার্ত্তিকটা মেয়ে দেখলেই হল ! তখন ইচ্ছে করে, ঠাস করে চড় মারি।’ বলে ঠোঁট ফোলালেন শিবানী, ‘একেবারে বাপের স্বভাব পেয়েছে।’
‘আবার আমাকে টানছ কেন? এখন কী আর সে বয়স আছে।’
‘আমার একটাই সমস্যা হয় ওখানে গেলে। কারও মন বুঝতে পারি না।’
‘সে কী! তুমি অন্তর্যামিনী। তোমার তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’

‘কী জানি। পশ্চিমবাংলায় পা দিয়েই দেখি ওই ক্ষমতাটা লোপ পেয়ে যায়। কী রকম বোকা বোকা লাগে তখন। যে ক’দিন থাকি কে কী ভাবছে, একদম বুঝতে পারি না। তাই ফিরে এসে মন খারাপ হয়ে যায়।’
মহাদেব হাসলেন, ‘এত স্যাটেলাইট আকাশে ঘুরলে কৈলাসের নেটওয়ার্ক ওখানে কাজ করবে কী করে। আমি একটু ভেবে দেখি, তুমি যখন যাবেই তখন একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে।’

খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছিল। শুনে কার্ত্তিকের মাথা গরম হয়ে গেল। সটান সরস্বতীর কাছে এসে বলল, ‘পিতৃদেব নাকি ইনজাংশন জারি করেছেন, আমাদের পশ্চিমবাংলায় যাওয়া চলবে না!’

সরস্বতী বলল, ‘মা বলছিল বটে, তবে মা তো বাবাকে ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। তুই ভাবিস না।’
‘ভাবব না? গত বার শুনে এসেছি, এক পুজোয় সেক্রেটারি বলছিল সামনের বার হয় মল্লিকা, নয় প্রীতি জিন্টাকে উদ্বোধনে নিয়ে আসবে। উঃ, কী জিনিস! আমি এ বারে ওদের দেখার জন্যে বসে আছি, পিতৃদেব না বললেই হল? এ রকম ডিক্টেটরশিপ সহ্য করবি?’

সরস্বতীর কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘তুই ওই মেয়েদের জিনিস বললি কেন? পশ্চিমবাংলায় গিয়ে গিয়ে তোর ভাষা খুব নিম্নমুখী হয়েছে।’

‘সরি। আমাদের রম্ভা উর্বশীরা ওদের পায়ের নখের যুগ্যি নয়। তাই মুখ ফস্কে জিনিস বলে ফেলেছি। লক্ষ্মী কোথায়?’
‘জামাইবাবুর কাছে গেছে। পারমিশন নিতে। মা যদি না যায় তা হলে আমার কী দুরবস্থা বল? জামাইবাবু ছাড়া একটাও সুপুরুষ নেই, যার দিকে এখানে তাকানো যায়। বেশি তাকালে আবার বোনে বোনে ঝগড়া হয়ে যায়। চল, মায়ের কাছে গিয়ে শুনি, আসল ব্যাপার কী?’

কিন্তু যাওয়ার আগে গণেশ এল হেলেদুলে। বলল, ‘মা বলল রেডি হতে। মামার বাড়ি যেতে হবে।’ কার্ত্তিক চিৎকার করল, ‘পিতৃদেব রাজি হয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। মা তোমাদের জানিয়ে দিতে বললেন।’ গণেশ বলল।
সরস্বতী বলল, ‘আমরা স্বর্গে থাকার সময় কেউ কারও মন জানতে পারি না। মর্তের মানুষদের মন কী ভাবছে, ঠিক টের পাই। আবার ইদানীং মর্তে গিয়ে দেখেছি, ওদের মনের কোনও খবরই বুঝতে পারি না। যাই, দিদিকে খবরটা দিই।’
কার্ত্তিক মনে মনে বলল, ‘এই সুযোগে জামাইবাবুকে এক বার দেখে আসবে। অদ্ভুত।’ যেহেতু স্বর্গে কেউ অন্তর্যামী নয়, তাই সরস্বতী বুঝতে পারল না।

কৈলাস থেকে শিবানী পুত্র কন্যাকে নিয়ে পশ্চিমবাংলায় যাত্রা শুরু করার আগে স্বামীকে প্রণাম করতে গেলেন। মহাদেব বললেন, ‘সাবধানে যাবে। বাসে বা অটোয় উঠবে না। ওরা ঠেলে ফেলে দেয়, নয় চড় মারে। একলা কোথাও যাবে না। তোমার বয়স তো শরীরে ছাপ ফেলেনি, ইভ মনে করে টিজ করবে রাস্তায়। আর হ্যাঁ, মহিষাসুর খবর পেয়েছে?’

শিবানী গলায় আঁচল জড়িয়ে প্রণাম সেরে উঠে বললেন, ‘হ্যাঁ। সে চরিত্র-সংশোধনাগার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর নভোমণ্ডলে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। গত বার খুব সমস্যা করেছিল।’
‘কী করেছিল?’

‘কিছুতেই আমার দিকে মুখ করে লড়াই করতে চায় না। গেল বার যাওয়ার সময় বলে গেছে এ বারে যেন দর্শকের দিকে তার মুখ রাখা হয়। আমার তো হাত নেই, উদ্যোক্তারা যেমন চাইবে তেমনটাই হবে। বুঝতে চায় না।’
‘ও যায় বলে আমি একটু নিশ্চিন্তে থাকি। তোমার ধারে কাছে কেউ ঘেঁষতে পারে না।’ মহাদেব বললেন।
‘আহা! তিন কুল গিয়ে এক কুলে ঠেকেছে, তবু তোমার ভয় গেল না।’ শিবানী চোখের কোণে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
‘সতীকে হারানোর যন্ত্রণা তোমাকে পেয়ে ভুলেছি। তাই ভয় তো হবেই।’

‘শোনো, দিদির শরীরের অংশ যেখানে যেখানে পড়েছিল, সেই জায়গাগুলো পবিত্র তীর্থ হয়ে গিয়েছে। লোক তাই এখনও দিদির নাম করে। আমার শুধু যাওয়া আসাই সার। আমার নামে কোনও তীর্থ নেই।’ ঠোঁট ফোলালেন শিবানী, চোখের পাতা ভিজে গেল।
‘কী যে বলো! পাঁচ ছয় দিন তো পাড়ায় পাড়ায় তোমার জন্যে তীর্থ হয়ে যায়। এ রকমটা আর কোনও দেবতা বা দেবীর বেলায় হয়েছে?’

হাসি ফুটল শিবানীর ঠোঁটে, ‘তা অবশ্য হয়নি। এই যে ছেলেমেয়েরা যখন একা একা যায়, তখন ওদের পুজো তেমন জমে না। তবে তুমি যখন আমার সতীনের সঙ্গে যাও তখন তো বাঙালি বাঁধনহারা।’

‘ভয়ে। ওই কালো রূপ, হাতে খাঁড়া, গলায় মুণ্ডুর মালা দেখে ভয় পায় ওরা। ওর গায়ের রং যদি তোমার মতো হত, তা হলে ভয়ের বদলে লোকে ভাবত ক্যাবারে দেখছি। যাক গে, এটা রাখো।’
মহাদেব একটা ফুল এগিয়ে ধরলেন।

শিবানী সেটা নিয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে ফুল দিয়ে বিদায় জানাচ্ছ?’
‘না, না। এ ফুল যে সে ফুল নয়। তোমরা যেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে, তখন গোপনে এই ফুল বের করে ঘ্রাণ নেবে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে স্যাটেলাইটগুলো আর বাধা হবে না। তোমার অন্তর্দৃষ্টি অটুট থাকবে। তুমি অন্তর্যামিনী হয়ে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারবে।’

‘উঃ। তুমি কী ভাল। আচ্ছা, ছেলেমেয়েদের ঘ্রাণ নিতে ফুলটা দেব?
‘আমার মনে হয়, না দেওয়াই ভাল। তা হলে পাবলিকের মনের কথা বুঝতে পেরে ওদের দুষ্টুমি বেড়ে যাবে।’ মহাদেব হাসলেন।
‘ঠিক বলেছ। শুনছি মল্লিকা আর প্রীতি নামের অপ্সরা আসবে উদ্বোধন করতে। ওরা কী ভাবছে, তা কার্ত্তিক জানতে পারলে মুশকিল হয়ে যাবে। আমি কাউকে ফুলটার কথা বলব না! এ বার আসি?’
মহাদেব বসে বসে হাত বাড়ালেন, ‘আয়ুষ্মতী ভব।’

‘তা হব। শোনো, এই ক’দিন একটু থিতু হয়ে থেকো। কৈলাস ছেড়ে কোথাও যেও না। ওখানে যাওয়ার পর অন্তর্দৃষ্টি থাকত না বলে জানতে পারতাম না আমি চলে গেলে তুমি কী কী করছ। এ বার তো জানতে পারব। যদি দেখি আবার কাউকে দু’দিনের জন্যে জুটিয়েছ, তা হলে আর ফিরে আসব না। এই বলে যাচ্ছি।’ শিবানী মহাদেবের সামনে থেকে বিদায় নিলেন। মহাদেবের মনে হল যেন রাজহংসী হেঁটে চলেছে। এখন বাহনদের নিয়ে যেতে হয় না। মণ্ডপে মণ্ডপে মাটির বাহন রেডি করা থাকে। উঠে বসলেই হল। যেহেতু তাদের কোনও নড়াচড়া নেই, নিয়ে যাওয়ার দরকারও পড়ে না। শিবানীর একটা পোষা সিংহ আছে। সেটা এখন এত বুড়ো হয়ে গিয়েছে হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। ইঁদুর কিংবা হাঁস ওর লেজে ঠোকর দিলেও কিছু বলতে পারে না। মাটির ময়ূরে কার্ত্তিকের খুব আপত্তি। জ্যান্ত হলে রাতবিরেতে একটু ঘোরাঘুরি করতে পারত।

লক্ষ্মী বলল, ‘মা, এ বার আমরা কীসে যাব?’
‘অদৃশ্য দোলায় চেপে।’
কার্ত্তিক গুণগুণ করল, ‘দোলা, এ দোলা, রাজা মহারাজাদের দোলা।’
সরস্বতী ধমক দিল, ‘অ্যাই! কী গাইছিস?’
‘ভূপেন হাজারিকার গান। তিরিশ বছর আগে মণ্ডপে বাজিয়েছিল ওরা। এখনও মনে আছে।’ কার্ত্তিক বলল হাসতে হাসতে।
শুভক্ষণ দেখে শিবানী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বায়ুতে শরীর ভাসিয়ে দিলেন। এখন তাঁদের শরীর অতি সূক্ষ্ম, তাই ভেসে যেতে কোনও সমস্যা হল না। যেতে যেতে তাঁরা প্রথমে গন্ধর্ব এবং অপ্সরাদের লীলা করতে দেখলেন। তারাও শিবানীকে সপরিবার দেখে দ্রুত সরে গেল।

চরিত্র সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে এক জন প্রহরী মহিষাসুরকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শিবানীকে প্রণাম জানিয়ে প্রহরী বিদায় নিলে অসুর দলে যোগ দিল। এখন কথা বলা নিষেধ। কিন্তু শিবানী দেখলেন অসুরের পরনে বিজাতীয় পোশাক।
স্যাটেলাইটগুলোকে এড়িয়ে ওরা অদৃশ্য দোলায় উঠে বসলেন। শিবানী বিরক্ত হয়ে মহিষাসুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ কী পোশাক পরেছ?’

‘কী করব? পৃথিবী থেকে কয়েক দিন আগে এক জন চরিত্র-সংশোধনাগারে এসেছে। তার মুখে শুনলুম, এ বার নাকি ওরা আমাকে এই পোশাকে পুজো করবে।’ হাসল মহিষাসুর, ‘বেশ ঢিলেঢালা, তাই না?’
শিবানী রেগে গেলেন, ‘এটার নাম কী?’

‘আলখাল্লা। আমাকে নাকি বিন লাদেনের আদলে তৈরি করেছে ওরা।’
‘সর্বনাশ! আমি বিন লাদেনকে ত্রিশূল দিয়ে হত্যা করব?’
‘বোধহয়। আপনার মুখটা আমেরিকান করে দিতে পারে ওরা।’

চমকে উঠলেন শিবানী। এক বার ভাবলেন ফিরে গেলেই ভাল হয়। এ সব খবর কৈলাসে বসে জানতে পারেননি! ওই স্যাটেলাইটগুলোর জন্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার গোলমাল হচ্ছে। এমন সময় নীচে আলোর ফোয়ারা চোখে পড়ল। এসে গেছে। সন্তর্পণে মহাদেবের দেওয়া ফুলটা বের করে নাকের তলায় নিয়ে এসে ঘ্রাণ নিতে যাবেন, অমনি গণেশ শুঁড় বাড়িয়ে সেটা ধরতে চাইল। হাত ফস্কে ফুলটা পড়ে গেল নীচে। যেখানে কলকাতা শহর সেজেচ্ছে আলোয়। আর সেই ফুলের ঘ্রাণ কলকাতার বাতাসে মিশে গেল। রাত তখন দুটো।

স্কাইল্যাণ্ড হাউসিং কমপ্লেক্সের এগারো তলার বারোশো তিরিশ ফ্ল্যাটটার দাম এখন বিয়াল্লিশ লক্ষ টাকা। সেই ফ্ল্যাটের মাস্টার বেডরুমে ঘুমাচ্ছিলেন বাহান্ন বছরের সপ্তর্ষি সেন এবং তাঁর স্ত্রী উর্বশী সেন। আজকাল সপ্তর্ষিকে অন্তত তিন বার ঘুম থেকে উঠে টয়লেটে যেতে হয়। তিনটে দশে তাঁর ঘুম ভাঙল নিম্নদেশে চাপ বৃদ্ধি হওয়ায়।

বিছানা থেকে উঠে খাটের দিকে তাকালেন, রোজ যেমন তাকান। হাল্কা নীল আলোয় উর্বশী শুয়ে আছেন। রোজ যেমন থাকেন। সপ্তর্ষি টয়লেটের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেলেন। এ কী শুনলেন তিনি? এ কণ্ঠ উর্বশীর ছাড়া হতে পারে না। তিনি তাকালেন আবার। উর্বশী পাশ ফিরে শুল। না। ঠিক শুনেছেন তিনি।

সপ্তর্ষি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলে, ‘কী বললে তুমি?’
কোনও জবাব এল না। সপ্তর্ষি একটু অপেক্ষা করে আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি জেগে আছ?’
এ বারও উত্তর নেই। টয়লেটে ঢুকলেন সপ্তর্ষি। নিজেকে হাল্কা করতে করতে মাথা নাড়লেন। কানে লেগে আছে উর্বশীর গলা। ‘টেকোটা নির্ঘাত ডায়েবেটিক পেশেন্ট হয়ে গেছে।’

‘টেকো। টেকো বলল অপ্সরা? নিজে কী? একটা ধুমসি মুটকি! বিয়াল্লিশ বছরের হস্তিনী খুকি সেজে থাকে। হুঁঃ।’ মনে মনে বলল সপ্তর্ষি। বলে খুশি হল। শুয়ে ছিল অপ্সরা। তড়াক করে উঠে বসে টয়লেটের বন্ধ দরজার দিকে বাসি মুখে তাকাল সে। সপ্তর্ষির মনে মনে বলা কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে সে।

রাত তখন তিনটে। অদৃশ্য দোলা থেকে শিবানী দেখলেন মণ্ডপটি। ইতিমধ্যে চার পাশে এত আলো জ্বলছে যে, চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। সেই আলোয় চার পাশ আলোকিত। শিবানী এবং তাঁর ছেলেমেয়েরা দেখতে পেল, তাঁরা সাহারা মরুভূমির একটি মরূদ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ এটা কলকাতা শহর। শিবানী হাসলেন। ওরা চব্বিশ ঘণ্টা জল পায় বলে মরুভূমির স্বাদ পেতে চাইছে।

তিনি কার্ত্তিকের দিকে তাকালেন। কার্ত্তিক তখন ভাবছিল আশেপাশে কোনও সুন্দরী নেই। সেই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শিবানী সেটা বুঝতে পেরে বিরক্ত হলেন। মহিষাসুর ছটফট করছে। মুশকিল হল, পৃথিবীর আকাশে ঘুরতে থাকা স্যাটেলাইটগুলোর পাশ কাটানোর সময় তাঁরা প্রত্যেকেই বাক্‌শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মন কী ভাবছে, বুঝতে পারছেন, কিন্তু কেউ কথা বলতে পারছেন না। শিবানী দেখলেন, মণ্ডপের সামনে মোটা কাপড়ের আড়াল রাখা হয়েছে। বোধহয় আগে কাউকে প্রতিমা দেখতে দেওয়া হবে না। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি সক্রিয় থাকায় শিবানী নিজের মূর্তি দেখতে পেলেন। দেখতে পেল বাকিরাও। একটু ক্ষুণ্ণ হলেন শিবানী। তাঁর গায়ের রং বিস্কুটের, চুল কাঁধ পর্যন্ত। ফিগার, বলতে নেই, ঠিকই রেখেছে। বরং সরস্বতীকে তাঁর চেয়ে বয়স্কা মনে হচ্ছে। সেটা দেখে সরস্বতী ক্ষেপে গেল। এম্মা! আমার মুখে অত বেশি ফ্যাট আছে নাকি! ওর মনের কথা বুঝে লক্ষ্মী মনে মনে বলল, ‘থাকলে খুশি হতাম। আমার স্বামী দেবতাটি মুখ ঘুরিয়ে নিত।’ সময় নেই, ওঁরা যে যার মূর্তির ভেতর প্রবেশ করলেন। সবাই জানেন এই যে, ঢোকা হলে দশমীর সকালের আগে মুক্তি নেই। এ বার মহিষাসুর বেশ খুশি। তার মুখে লাদেনের দাড়ি, পরনে আলখাল্লা। বেশ চেঞ্জ সব এ বছর।

এই পুজো কমিটির সেক্রেটারি, ট্রেজারার আর কনভেনর গত পাঁচ মাস ধরে প্রচুর খেটেছেন। থিম যাতে সুপারহিট হয় তার জন্য মরিয়া হয়েছেন। শেষ তক কলকাতার পুজোয় প্রথম বার সাহারার মরূদ্যান এনে ফেলে ভাবছেন, এ বার সব ক’টা পুরস্কার তাঁদের ভাগ্যে নাচছে। কাল বিকেলে করিনা কপূর এবং ধোনি। মার মার কাট কাট ব্যাপার হবে। কাজকর্ম সেরে তিন জনে একটু আহ্নিকে বসেছিলেন। তিরিশ লাখ টাকার পুজো বলে আজ একটু স্কচের ব্যবস্থা হয়েছিল। এখন শুয়ে পড়তে হবে। কালকের জন্যে চাঙ্গা রাখতে হবে শরীর। ওঁরা অফিসরুম থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে মণ্ডপের দিকে তাকালেন। সেক্রেটারি বললেন, ‘চল, মাকে বলে যাই যেন ফার্স্ট প্রাইজটা ম্যানেজ করে দেন।’ কনভেনর বললেন, ‘একটু নিরিবিলিতে মন দিয়ে প্রণাম করতে হবে। পরে চান্স পাব না।’ ট্রেজারার বললেন, ‘অডিটর একটু ঝামেলা করতে পারে, মাকে বলা দরকার।’

তিন জনই হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারলেন শরীরগুলো ঠিকঠাক নেই। স্কচ খাওয়ার অভ্যেস না থাকাটাই এর কারণ। যারা পাহারায় ছিল তারা বড় কর্তাদের দেখে সরে গেল। তারা বাংলা খেয়েছিল। নিয়মিত অভ্যেস থাকায় ওরা স্বচ্ছন্দ ছিল। তিন জনে পর্দার ফাঁক দিয়ে প্রতিমার সামনে পৌঁছে গিয়ে মুখ তুলে তাকালেন। কনভেনর মাথায় দু’হাত তুলে বললেন, ‘মা, আমার প্রণাম নাও। মা গো।’ ক্যাশিয়ার হাসলেন। কথা বললেন না। শিবানীকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে ভাবলেন, ‘বুক একটু ভারী হলে ভাল হত। পা দুটো বেশ সেক্সি হয়েছে।’

শিবানী চমকে উঠলেন। তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল। মনে হল ত্রিশূলটা লোকটার বুকে ঢুকিয়ে দিই। ও দিকে সরস্বতী ফিক করে মনে মনে হাসল। পৃথিবীতে এসে এই বার তারও অন্তর্দৃষ্টি এসে গিয়েছে। ঠিক হয়েছে। এত বড় বড় ছেলেমেয়ের মা হয়েও যদি ফিগার কনশাস হয়, তা হলে তো এ সব কথা শুনতেই হবে। লক্ষ্মী ভাবল, মায়ের উচিত কুচি না দেওয়া শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আসা। কার্ত্তিক আর গণেশ ভাবল, এটা মায়ের ব্যাপার। তাদের বলার কিছু নেই। মা তো একাই অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে। তাদের সাহায্য করার নিয়ম নেই।

সেক্রেটারি বললেন, ‘কার্ত্তিকটাকে ঠিক হাতকাটা দিলীপের মুখ দিয়েছে। হে হে।’
হাতকাটা দিলীপটা কে? ভাবল কার্ত্তিক। সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টির জোরে জেলখানায় বসে সেলফোনে কথা বলা একটা মুখ দেখতে পেল। রেগে কাঁই হয়ে গেল সে। এরা তাকে জেলখানায় পাঠাতে চাইছে। কার্ত্তিক চেষ্টা করল এগিয়ে যেতে, কিন্তু শরীর নড়ল না।
ট্রেজারার অনেক ক্ষণ মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে শেষ পর্যন্ত চোখ খুলে লক্ষ্মীর দিকে তাকালেন, ‘অডিটরটাকে ম্যানেজ করে দিও মা। তা হলে সামনের বার এ রকম জবুথবু হয়ে বসিয়ে রাখব না। সামনের বার গ্রিস হচ্ছে আমাদের থিম। তোমার ফিগার ক্লিওপেট্রার মতো করতে বলব। কথা দিলাম।’

লক্ষ্মী খুশি হলেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি গোলগাল। ক্লিওপেট্রার ফিগার হলে বোনের জামাইবাবু পায়ের কাছ থেকে তুলে পাশে বসাবে। সরস্বতী সেটা বুঝতে পেরে মনে মনে দাঁতে দাঁত চাপল, ছিঃ। ম্যাগো।

এগারো তলার ফ্ল্যাটে ঢাকের আওয়াজ যখন পৌঁছয়, তখন টিকটিকির ডাক তার চেয়ে বেশি জোরালো হয়ে যায়। এই এগারো তলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাটে টিকটিকি কী করে আসে কে জানে। কিন্তু আজ ওই টিকটিকির ডাকে ঘুম ভাঙল সপ্তর্ষির। ঘড়ির দিকে চোখ গেল। এখন ক’টা বাজে? সর্বনাশ! অপ্সরার উচিত ছিল তাকে ডেকে দেওয়া। ঠিক তখনই সে মনের পর্দায় অপ্সরাকে দেখতে পেল। নব্বই কেজি চর্বি পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি শরীরে ছড়িয়ে শাওয়ারের নীচে চোখ বন্ধ করে ভিজছে। বাথরুমের দরজা বন্ধ, কিন্তু নাইটিটা খোলেনি। ভাগ্যিস খোলেনি। সপ্তর্ষি স্পষ্ট বুঝতে পারল উর্বশীর ভাবনা। উর্বশী ভাবছে, টেকো বুড়োটাকে বললেই ই এম আইর দোহাই দেবে। অথচ টুবলুকে কথা দিয়েছি একটা আইপড এই পুজোয় কিনে দেব। কত আর দাম? বড় জোর দশ হাজার। টেকোটার লকারের ডুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে আছে। ও অফিসে বেরিয়ে গেলে লকার খুলে ব্ল্যাক টাকার বাণ্ডিল থেকে একটা সরিয়ে নিলে টের পাবে বলে মনে হয় না। পেলে পাবে। জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমি কী জানি!
তড়াক করে লাফিয়ে নিঃশব্দে আলমারির দরজা খুলল সপ্তর্ষি। দু’দুটো বড় লকার। একটায় উর্বশী তার গয়না রাখে। দ্বিতীয়টা খুলে সব ক’টা টাকার বাণ্ডিল বের করে লকার বন্ধ করে আলমারির দরজা ভেজিয়ে চার পাশে তাকাল। তার পর জ্যাকেটের ভেতর বাইরের চারটে পকেটে বাণ্ডিলগুলো ঠেসে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ল চোখ বন্ধ করে। তার পরেই খেয়াল হল কাল রাত্রে উর্বশীর মনের কথা সে যেমন বুঝতে পারছিল তার অনুচ্চারিত কথাও উর্বশী বুঝে গিয়েছিল। এটা কী করে যে সম্ভব হচ্ছে, কে জানে! এই যে সে কাজটা করল তা আবার উর্বশী বুঝে ফেলেনি তো! সঙ্গে সঙ্গে সে ভাবতে লাগল, উর্বশীর মতো মেয়ে হয় না। ওকে আরও আদর আরও যত্নে রাখা দরকার। পাঁচ দশটা নয়, একটাই তো বউ, তাও আবার উর্বশীর মতো হরিণ চোখের মেয়ে, নাঃ, আজ বোধনের দিনে অফিসে যাওয়ার সময় একটু আদর করে যেতে হবে।

তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে নিজেকে আয়নায় দেখে বিশ্রী লাগছিল উর্বশীর। যেই ভাবল ওই টেকোটার জন্যে সুন্দরী হওয়ার দরকার নেই, অমনি সে স্পষ্ট সপ্তর্ষির কথাগুলো শুনতে পেল। প্রথমে বিশ্বাসই হল না। সে কি ঠিক শুনেছে? এই কথাগুলো জিন্দেগিতে বলেনি সপ্তর্ষি। আয়নায় নিজের চোখ দেখল, একটু মিল আছে বলে মনে হল হরিণের সঙ্গে। তার শরীরে কদম্ব ফুল ফুটল। পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে সপ্তর্ষি। কাছে এসে অনেক চেষ্টা করে নরম গলায় বলল, ‘ডার্লিং, ওঠো, অফিসে যেতে হবে না? অষ্টমীর দিন যত ইচ্ছে ঘুমিও।’

চোখ খুলল সপ্তর্ষি, উঠে বসে বলল, ‘মাই গড। এত বেলা হয়ে গেছে, ডাকোনি কেন?’
‘ডাকতে মায়া হল। ঘুমালে তোমাকে কী দারুণ দেখায়।’
‘নটি গার্ল।’
বাথরুমে ঢুকে গান গাইতে লাগল সপ্তর্ষি। গান গাইলে ভাবা যায় না। বা ভাবলে উর্বশী কিছুই টের পাবে না। ব্রেকফাস্ট টেবিলে যত্ন করে খাওয়াচ্ছিল উর্বশী। সপ্তর্ষি বলল, ‘মা গো, আর পারব না। ও হ্যাঁ, আজ তো পুজো শুরু হয়ে গেল। টুবলুদের গিফ্‌ট দিয়েছ তো?’

‘ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না ডার্লিং।’
জ্যাকেট পরে টাই বেঁধে বাই বলে দরজার দিকে এগোচ্ছিল সপ্তর্ষি, পেছন থেকে উর্বশী বলল, ‘উঁহু!’
সপ্তর্ষি তাকিয়ে দেখল অনেক রহস্য মুখে ছড়িয়ে উর্বশী হাসছে। যদি কিছু হুট করে মাথায় এসে যায় তাই সে লতা মঙ্গেশকরের গান মনে মনে গাইতে লাগল, ‘না যেও না, রজনী এখনও বাকি।’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল উর্বশী। সাগরিকা ছবির শেষ দৃশ্যে সুচিত্রা সেন এত জোরে ছুটে উত্তমকুমারের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি। ধাক্কাটা কোনও মতে সামলাতে সামলাতে সপ্তর্ষি শুনল, ‘তুমি আমাকে একটু আদর করে যাবে বলে ভেবেছিলে, বলো, ঠিক কি না!’

‘তুমি যে আমারই ওগো, জীবনে মরণে’ গাইতে গাইতে সপ্তর্ষি উর্বশীর মাথায় চিবুক লাগিয়ে দেখেও না দেখার ভান করল। সিঁথিটা একটু চওড়া হয়েছে। তা ভাল। কে না জানে কলকাতার সবচেয়ে ভাল রাস্তার নাম রেড রোড!

সপ্তর্ষি বেরিয়ে গেলে চেয়ারে বসল উর্বশী। জীবনে এ রকম সকাল তার আসেনি। কিন্তু তিনটে ব্যাপার তার বোধগম্য হচ্ছিল না। সে কী করে সপ্তর্ষির ভাবনাগুলো বুঝে ফেলছে? গত কাল সন্ধ্যায় তো এ রকম হয়নি। এটা কি মা দুর্গা এসেছেন বলে? তা তিনি তো প্রতি বছরই আসেন, কোনও বার হয় না। দ্বিতীয়ত, আজ সকাল থেকে সপ্তর্ষি এত গান মনে মনে গাইছে কেন? ওর গলায় যে কোনও দিন গান শোনেনি। তৃতীয়ত, তার মাথায় চিবুক রেখে রেড রোড বলল কেন? সবচেয়ে ভাল রাস্তা। এটা কি কমপ্লিমেন্ট? ফোন বাজল। রিসিভার তুলতেই টুবলুর গলা, ‘ও মাসিমণি, প্রমিস রাখবে না?’
‘রাখব রাখব।’ হাসল উর্বশী।

‘কবে রাখবে? পুজো তো শুরু হয়ে গেল।’ টুবলুর কথা শুনে একটু ভাবল উর্বশী, ‘সপ্তমীর আগেই।’
টুবলু তার বোনের ছেলে। বছর বারো বয়স। উর্বশী ঠিক করল সে আইপড কিনে সোজা ওদের বাড়িতে গিয়ে টুবলুর হাতে দিয়ে দেবে। আলমারির দিকে তাকাল উর্বশী। এখনও অফিসে পৌঁছয়নি সপ্তর্ষি। সপ্তর্ষির মুখ মনে এল, কিন্তু ও এখন কী ভাবছে, বুঝতে পারল না। এটা কী হল? আউট অব সাইট হলে কি, আউট অব মাইণ্ড হয়ে যায়?

পোশাক বদলে নিয়ে সেজেগুজে আলমারি খুলল উর্বশী। তার পর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে সপ্তর্ষির লকার খুলে ডান হাতটা গর্তে ঢোকাল। এ কী! ভেতরটা একদম ফাঁকা কেন? এক টুকরো কাগজও পড়ে নেই। অথচ কাল বিকেলে অফিসের পর বাড়ি এসে বাণ্ডিলগুলোকে ঢোকাতে দেখেছে সে সপ্তর্ষিকে। তার পর আর আলমারি খোলেনি সপ্তর্ষি। সে সব সময় ওর সঙ্গে ছিল। আজ ঘুম থেকে তোলার পরও সে এই ঘরের বাইরে একা যায়নি। কেঁদে ফেলল উর্বশী। এখন টুবলুকে কী করে মুখ দেখাবে। হঠাৎ ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, সে যখন স্নান করতে করতে প্ল্যানটা ভাবছিল তখন সেই ভাবনা কি ও বুঝে ফেলেছিল? ফলে টাকা সরিয়ে বিছানায় ঘাপটি মেরে পড়েছিল? টেকো, ডায়েবেটিক, ভুঁড়িদাস, ভাড় মে যাওয়া ঘুষখোরটার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে! নিজের ব্যাঙ্ক থেকে দশ হাজার টাকা তোলার জন্যে চেক বই বের করল উর্বশী।

অফিসের লিফ্‌টে জনা আটেক মানুষ। হন্তদন্ত হয়ে সপ্তর্ষি ঢোকামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে লিফ্‌ট উঠতে লাগল ওপরে। হঠাৎ পাশের মহিলা ঘুরে দাঁড়িয়ে সপাটে চড় মারলেন এক প্রৌঢ়কে, ‘আপনি আপনি আমার সম্পর্কে…, ছি ছি।’
‘মানে, মানে… আমাকে চড় মারলেন কেন? জানেন আমি কে?’

‘একশো বার মারব। আপনি আমার বুক নিয়ে অশ্লীল কথা ভাবেননি?’ মহিলা চিৎকার করলেন, ‘দেখুন, এই আধবুড়ো আমার সম্পর্কে অশ্লীল ভাবনা ভাবছে।’

তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হতেই সপ্তর্ষি মনে মনে জনগণমন গাইতে শুরু করল। পৃথিবীতে প্রথম গান আবিষ্কার করেছিল কে? গান গাইলে মনে ভাবনা আসে না।

লিফ্‌ট ছ’তলায় উঠলে ছেঁড়া জামা নিয়ে প্রৌঢ় নেমে গেলেন সুড়ুৎ করে। মহিলা চিৎকার করলেন, ‘সকাল থেকে এটা আরম্ভ হয়েছে। প্রত্যেকটা মানুষ এত দিন মুখোশ পরে বসেছিল। অ্যাই, লিফ্‌ট চলছে না কেন?’
লিফ্‌টম্যান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সপ্তর্ষিকে দেখিয়ে বলল, ‘কী করব ম্যাডাম, সাহেব জাতীয় সংগীত গাইছেন।’
সঙ্গে সঙ্গে সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

সকাল সকাল পুজো শুরু না হলেও প্রতিমা দর্শন করে আসা কলকাতার অনেক মানুষের অভ্যাস। যাঁরা ভিড় এড়াতে চান, শান্তিতে ঠাকুর দেখতে চান তাঁরা পঞ্চমী ষষ্ঠীতেই কাজটা সেরে ফেলেন!

ভোর ছ’টায় একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল যে মণ্ডপের সামনে, তাদের থিম হল মুরগি। মণ্ডপে ডিমের প্রতিমা। এত সকালে দর্শক নেই। পুজোর উদ্বোধন সন্ধ্যায়, তাই মাইকে গান বাজছিল: হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম। গাড়ি থেকে নামল যে পরিবার, তারা এই সকালে নতুন জামা পরে এসেছে। বাবা মা যুবতী মেয়ে তরুণ ছেলে।
ডেকরেশন দেখে ছেলেটি বলল, ‘আঃ, ফ্যান্টা।’

মা বলল, ‘দুগ্গা ঠাকুরের কাছে এসে ইংরেজি বলো না ববি।’
ছেলে বলল, ‘বাট মা, চার পাশে মুরগি আর মুরগি। আচ্ছা এগুলো কি দিশি, না বয়লার?’
মা জবাব দিল না। এগোতে এগোতে ভাবল, তোমার বাবা জানে।
বাবা উদাসীন হল, ওগুলো আমি। আমাকে তোমরা মুরগি করেছ।
মেয়ে বলল, ‘বাবা, টু মাচ। মন নিচু করো না।’

তখনও মণ্ডপের সামনে পর্দার আড়াল। এক জন স্বেচ্ছাসেবক বলল, ‘সরি। আমাদের পুজো উদ্বোধন করবেন সুস্মিতা সেন। তার আগে পর্দা সরানো যাবে না।’ অনেক অনুরোধেও কাজ হল না। এই সময় স্বেচ্ছাসেবকদের নেতা এগিয়ে এসে সব শুনে বললেন, ‘পর্দা উঠবে না। তবে আপনাদের এক জনকে আমি সাইড দিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। দর্শন করে আসুন।’
দিদি বলল, ‘ভাই, আমি এটা দেখে আসি। তুই পরেরটা দেখিস। চলুন।’
পর্দার প্রান্তে নিয়ে গিয়ে নেতা বলল, ‘পাশ দিয়ে বসে যান।’

যুবতী প্রতিমার সামনে পৌঁছে গেল। ডিম কোথায়? একটু অবশ্য শরীরের মধ্যে উঁচু উঁচু হয়ে আছে। যদি ডিমগুলো ফেটে যায়? সে কার্ত্তিকের দিকে তাকাতেই শুনতে পেল, ‘কী জিনিস। যাকে বলে খাই খাই।’

মেয়েটি ভয় পেয়ে চার পাশে তাকাল। কেউ নেই। তার পরেই সে বুঝতে পারল কথাটা কার্ত্তিক ভেবেছে। সঙ্গে সঙ্গে পা থেকে হিলওয়ালা জুতো বের করে চিৎকার করল সে, ‘কী বললে? আবার বল, মুখ ভেঙে দেব।’

সঙ্গে সঙ্গে কার্ত্তিক গান ভাবল, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু…।’ উদ্যোক্তারা ছুটে এসে যুবতীকে বের করে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘জুতো ছুড়ে মারছিল ঠাকুরকে। পাবলিক জানতে পারলে কী হবে বুঝতে পারছেন? তাড়াতাড়ি কেটে পড়ুন।’ ও দিকে শিবানী স্থির হয়ে পুত্রকে ভর্ৎসনা করছেন, ‘ছিঃ। কত বার বলেছি কলকাতার ভাষায় কথা বলিস না। অবাধ্য বাঁদর কোথাকার।’

সকাল সাতটা পনেরো। কাল অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে বলে থানা এখন বিকেলবেলার টাইগার হিল। একটা দামি গাড়ি থেকে নামলেন সঞ্জয় ভাটিয়া। সঙ্গে তাঁর ভাই সুজয়। হনহন করে থানার ভেতর ঢুকে এ পাশ ও পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলেন এক জন এস আই চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, কাছে পিঠে কেউ নেই।

সুজয় তাঁর সামনে গিয়ে জিজ্ঞেসা করলেন, ‘বড়বাবু কোথায়?’ ‘ঘুমাচ্ছেন।’ চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিলেন এস আই। ‘তাঁকে ডাকুন। বলুন মিস্টার সঞ্জয় ভাটিয়া এসেছেন। খুব জরুরি।’ এস আই চোখ খুললেন। সঞ্জয় ভাটিয়ার নামটা তাঁর জানা। লোকটা টাকার কুমির। নিশ্চয়ই খুব ফেঁসে গেছে, নইলে সাতসকালে থানায় আসত না। মা মুখ তুলে তাকিয়েছেন। নইলে সাতসকালে কপাল খুলবে কেন? মুখে বললেন, ‘বসুন আপনারা।’

সঞ্জয় বসলেন। একটু বিরক্ত হয়েই বসলেন। লোকটা টাকার কুমির ভাবল কেন? টাকার বাঘ বা হাতি ভাবতে কী অসুবিধে হল? ফেঁসে তো গেছি নইলে কোন শালা থানায় আসে। তবে তোমার কপালে কী আছে, তা নির্ভর করবে কী ব্যবহার করছ, তার ওপর।

এস আই কেসটা স্পষ্ট শুনতে পেয়ে হেসে বলল, ‘চা খাবেন?’ ‘আমরা চা খেতে আসিনি। ওসি কে ডাকুন।’ সুজয় বললেন। ‘এখন ডাকলে খুব খচে যাবেন।’ এস আই বললেন, ‘আমাকে বলুন, আমি তো আপনাদের জন্যে আছি।’ সঞ্জয় বললেন, ‘আমার ছেলে সন্তোষ কিডন্যাপ্‌ড হয়েছে। ছ’টার মধ্যে তাকে ফেরত এনে দিন। আর মিডিয়া যেন টের না পায়।’

‘সে কী? দাঁড়ান, দাঁড়ান, ডায়েরি—।’ ‘নো। কাগজ কলমে কিছু লেখার দরকার নেই। দু’ঘণ্টার মধ্যে ওকে নিয়ে এলে এক পেটি পাবেন। ওকে?’ ‘দাঁড়ান স্যর। কে কিডন্যাপ করেছে?’ সঞ্জয় ভাইয়ের দিকে তাকালেন। সুজয় বললেন, ‘একটি মেয়ে। স্কুলে পড়ায়। সন্তোষের বয়স কুড়ি। তার মানে একুশ হয়নি। মেয়েটা কাল কালীঘাটে গিয়ে ওকে বিয়ে করে নিয়ে গেছে। আমরা লোক পাঠিয়েছিলাম তুলে আনতে, কিন্তু পাড়ার ছেলেরা ঝামেলা করেছে। এখন সবাই ঘুমাচ্ছে, এখনই যান।’

‘কোথায়?’ ‘তিনের বি জে ডি অ্যাভিনিউ। পাইকপাড়া।’ ‘যাচ্চলে! ওটা তো আমাদের এরিয়া নয়।’ এস আই বললেন। সঞ্জয় রেগে গিয়ে ভাইকে বললেন, ‘তোমাকে বলেছিলাম এই সব পাতি থানায় না এসে লালবাজারের কানেকশনকে ট্যাপ করতে ।’
‘কিন্তু এখন লালবাজারের অফিসাররা থুতু ফেলতে ভয় পাচ্ছে, যদি মিডিয়া সেটাকে খইনির থুতু বলে প্রচার করে!’ সুজয় বলতে বলতে দেখতে পেল এক ভদ্রলোক পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। সুজয় বললেন, ‘গুড মর্নিং, স্যর। ইনি বলছিলেন আপনি ঘুমিয়ে আছেন।’ ‘রাত তিনটে পর্যন্ত ডিউটিতে ছিলাম। টয়লেটে যাওয়ার সময় আপনাদের গলা পেলাম। আমার ঘরে আসুন।’ ওসি বললেন।

ঘরে ঢোকার পর তিনি বললেন, ‘আই অ্যাম সরি, এই পোশাকে!’ সঞ্জয় বললেন, ‘আপনি উইদআউট পোশাকে থাকলেও আমার কিছু অসুবিধে হত না। আমার ছেলে সন্তোষকে একটি মেয়ে কিডন্যাপ করে কাল বিয়ে করেছে। আমি দু’ঘণ্টার মধ্যে ওকে পেতে চাই।’

চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করলেন ওসি। এস আই টাকে এক পেটি এর মধ্যে অফার করেছে। আমি কি লঙ্কা চুষব? সঞ্জয় স্পষ্ট শুনতে পেলেন সেটা। মনে মনে বললেন, তোকে দু’পেটি দেব। ওসি মনে মনে বললেন, ওটা পাঁচ পেটি হোক। যেখান থেকে ধরব সেখানেও তো কিছু খরচ করতে হবে। কেউ কোনও কথা বললেন না। সঞ্জয় হাত বাড়িয়ে দিলেন। ওসি হাত মিলিয়ে চিৎকার করলেন, ‘দত্ত।’ এস আই ছুটে এল, ‘স্যর।’

‘যে ঠিকানা ওরা দিয়েছেন সেখানে গিয়ে সন্তোষকে বলবে ওর বাবার অবস্থা খুব খারাপ। নার্সিং হোমে আছেন। শেষ দেখা দেখতে চান। ম্যানেজ করে জিপে বসিয়ে সোজা ওঁর বাড়ি চলে যাবে। হ্যাণ্ডওভার করে দিলে উনি একটা খাম দেবেন। নিয়ে চলে আসবে।’ ওসি আদেশ দিলেন।

‘স্যর, খাম একটা না দুটো?’ এস আই মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করলেন। সঞ্জয় বললেন, ‘দুটো। কিন্তু কণ্ডিশন একটাই। মিডিয়া যেন এ সব কথা জানতে না পারে।’ দুই ভাই বেরিয়ে গেলেন। এস আই বললেন, ‘স্যর, লালবাজার কি সব সময় আমাদের জন্যে কিছু রাখে?’ ‘জলদি যাও। সময় মাত্র দু’ঘণ্টা।’

সকাল দশটার মধ্যে কলকাতা শহরের চেহারাটা বদলে গেল। সবাই সবার মনের কথা বুঝে ফেলছে। ফেলে প্রথমে মৃদু ঝগড়া, গালাগাল, শেষে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে শেষ সময়ে পুজোর শাড়ি কিনতে ঢুকেছিলেন দোকানে। স্ত্রীর যে শাড়ি পছন্দ হল স্বামী সেটি না নিতে বললেন বেশি দামের জন্যে। স্ত্রী মুখ ভারী হল। ঠোঁট টিপে বললেন, আমার বেলায় কিপ্টেমি আর নিজের বোনেদের দেওয়ার সময় দাতা কর্ণ।’

স্বামী স্পষ্ট শুনতে পেয়ে মাথা নাড়লেন, ‘তুমি একটা হিংসুক মেয়েছেলে।’ ‘আমি হিংসুক। ঘুষের টাকায় মাতব্বর হয়েছ। ছিঃ।’ দোকানদার বলল, ‘কত ঘুষ নেন দাদা?’ ‘তার মানে?’ লোকটি ক্ষেপে গেল। ‘এই যে বউদি মনে মনে ভাবলেন আপনি ঘুষের টাকায় মাতব্বর।’

শোনামাত্র হাত চালাল লোকটা। দোকানদার ছিটকে পড়তেই তার সহকর্মীরা ছুটে এল। মারপিট শুরু হয়ে গেল। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে লোকটা চেঁচাল, ‘দেখুন দেখুন, আমার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করেছে।’

দোকানের এক কর্মচারী হাসল। ওই তো জলহস্তীর মতো চেহারা, হানিটা হবে কোথায়? ভদ্রমহিলা ছুটে গেলেন তাকে মারতে। কী, আমি জলহস্তী? আশেপাশের কিছু মাস্তান ছেলে এগিয়ে এল। ও পাশে কয়েকটি মেয়ে দল বেঁধে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিল। তাদের এক জন ভাবল, ‘এই জন্যে কলকাতার রাস্তায় হেঁটে ঠাকুর দেখা যায় না।’ মাস্তানদের এক জন সেটা শুনে ফেলল মনে মনে, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই যে, কলকাতার নিন্দে হচ্ছে!’

‘বেশ করেছি। তোমার কী!’ মেয়েটা রুখে দাঁড়াল। এক জন বয়স্ক ভদ্রলোক ভাবলেন, আহা, বাচ্চা হলে কী হবে, মেয়েটার মধ্যে শক্তি আছে প্রতিবাদ করার। সঙ্গে সঙ্গে মাস্তান তার জামার কলার ধরল, ‘মেয়েমানুষের মধ্যে শক্তি দেখতে পাচ্ছ শালা। বুড়ো ভাম, আর কী দেখতে পাচ্ছ!’

এগারোটার মধ্যে কলকাতার রাস্তায় প্রথমে পুলিশ, পরে র্যাফ নামল। কলকাতার মানুষেরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। যেহেতু র্যাফের সদস্যরা বাংলা বোঝে না, তাই নীরব ভাবনাগুলো শুনতে পেলেও অর্থ বুঝতে পারছিল না। তারা লাঠি চার্জ করে বীরত্ব দেখিয়েও মানুষজনকে শান্ত করতে পারছিল না।

শেষ পর্যন্ত সব ক’টা পুজো প্যাণ্ডেল অবাঙালি র্যাফের হাতে তুলে দেওয়া হল। পাবলিককে ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিচ্ছিল না তারা। সন্ধেবেলায় উদ্বোধন হবে। মুরগি-থিমের উদ্যোক্তারা গালে হাত দিয়ে বসেছিল। মুম্বইয়ের সিনেমা আর্টিস্টরা বিকেলের ফ্লাইটে চলে আসবে। তাঁদের এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নিয়ে যাবে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা। তারাই বিভিন্ন প্যাণ্ডেল আর্টিস্টদের দিয়ে উদ্বোধন করানোর অর্ডার নিয়েছেন। মুরগির জন্যে সময় দেওয়া হয়েছে রাত দশটা।

সেক্রেটারি বললেন, ‘আমি পাগল হয়ে যাব।’ ট্রেজারার বললেন, ‘এটা কী করে হল? কেন আমরা সবাই সবার কথা শুনতে পাচ্ছি? যা ভাবছি, নিঃশব্দে ভাবছি তা ই সামনের মানুষটা জেনে ফেলছে।’ কনভেনর বললেন, ‘আমার বোধহয় ডিভোর্স হয়ে যাবে।’ সেক্রেটারি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন?’

‘আজ একটা ফোন এসেছিল। নাম জিজ্ঞাসা করতে বলল শ্যামা। আমার সঙ্গে পড়ত শ্যামাপ্রসাদ। ওকে শ্যামা বলে ডাকতাম। আজ কী হল শ্যামা শোনামাত্র আমার মনে একটি মেয়ের মুখ ভেসে এল, যে রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের শ্যামা করত। আমার সঙ্গে একটু ইয়ে হয়েছিল। সে সব বহু বছর আগের কথা। ফোন রাখতেই বউ যা নয় তাই বলতে লাগল। আমি লম্পট, কামুক, বউকে লুকিয়ে শ্যামার সঙ্গে প্রেম করছি। মাথা ঠিক রাখতে না পেরে আমিও উল্টোপাল্টা বলে ফেললাম। সে চলে গেল বাপের বাড়ি। ডিভোর্স চাইবে বলে গেল। সেই সঙ্গে ক্ষতিপূরণ’, কনভেনর বললেন।

সেক্রেটারি বললেন, ‘কেউ কোনও দিন শুনেছে যে এক জন আর এক জনের ভাবনা ঠিকঠাক বুঝে ফেলছে? এটা তো ভগবানের ক্ষমতায় ছিল। তাই তাঁকে অন্তর্যামী বলা হয়। তা হলে আমরাও কি অন্তর্যামী হয়ে গেলাম?’ ট্রেজারার হাসলেন, ‘মন্দ না। কেউ কাউকে ফাঁসাতে পারবে না।’ বলে কনভেনরের দিকে তাকালেন, ‘তোমার সঙ্গে একটু আগে যখন দেখা হল তুমি ভাবছিলে সামনের বার ট্রেজারের পোস্টটা যেমন করেই হোক ম্যানেজ করবে। আমি জেনে গেলাম। ফলে সাবধান হয়ে যাচ্ছি।’ ‘তুমি অডিটরকে ম্যানেজ করে তিন লাখ সরাবার কথা ভাবোনি?’ ‘আমি একার জন্যে ভাবিনি। আমাদের তিন জনের জন্যেই ভেবেছি।’ সেক্রেটারি বললেন, ‘প্লিজ, এখন থেকে মনে মনে কেউ কিছু ভেবো না।’

পর্দার আড়ালে যে যার মতো ভঙ্গিতে থেকে শিবানী প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। কেউ কিছু সামনে এসে ভাবলেই তিনি সেটা বুঝতে পারছেন। সকালে মাইকে যে হিন্দি গান বাজছিল, তা কার্ত্তিক আর সরস্বতী মুখস্থ করে ফেলে সমানে কানের কাছে গেয়ে চলেছে। কিন্তু তিনি কিছুতেই মহাদেবকে তৃতীয় নয়নে দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে চাইলেই চ্যানেল অফ হয়ে যাওয়া টিভি হয়ে যাচ্ছে। ভাবনাতেও পৌঁছতে পারছেন না। এসে অবধি তিনি পৌঁছসংবাদ দিতে পারেননি। অথচ পইপই করে মহাদেবকে বলেছিলেন পৃথিবীতে যাওয়ার পর যাতে তিনি কৈলাসের সব কিছু দেখতে শুনতে পান তার ব্যবস্থা করে দিতে। মহাদেব সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেননি। এই জন্যেই বলে পুরুষমানুষকে বিশ্বাস করতে নেই।

ও-পাশ থেকে গণেশের ভাবনা ভেসে এল, ‘মিছিমিছি রাগ করছ মা।’ মহিষাসুর ভাবল, ‘ছাড়ো তো। যেখানে এসেছ সেখানকার ভাবনা ভাবো।’ হঠাৎ খেয়াল হল শিবানীর। মহাদেব যে ফুল দিয়েছিলেন তার ঘ্রাণ নেওয়ার আগেই সেটা হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল পৃথিবীতে। তিনি গণেশকে ধমক দিতে যাচ্ছিলেন এই সময় সেক্রেটারি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে শিবানীর সামনে এসে হাত জোড় করে নতমস্তকে দাঁড়ালেন, ‘মা, তুমি রক্ষে করো। তোমার লীলা ছাড়া এটা সম্ভব নয়।’

শিবানী মনে মনে ভাবলেন, ব্যাপারটা কী? সেটা স্পষ্ট শুনতে পেলেন সেক্রেটারি। মা তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন? এ কী সৌভাগ্য তাঁর। সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে গেল। বললেন, ‘মা, আমরা সবাই সবার মনের কথা বুঝতে পেরে যাচ্ছি। অবশ্য সামনাসামনি হলে। যেই চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে, তখন ক্ষমতাটা থাকছে না। এই বুঝে ফেলার জন্যে কলকাতার মানুষেরা এ-ওর বিরুদ্ধে ক্ষেপে যাচ্ছে। মারপিট হচ্ছে। দোকান ভাঙছে। ভয় হচ্ছে, মণ্ডপও ভেঙে দিতে পারে। তুমি তো জানো, খ্রিস্টান বা মুসলমানদের মতো কলকাতার হিন্দুরা ধার্মিক নয়। মণ্ডপ ভাঙতে তাদের হাত কাঁপবে না। তুমি বাঁচাও মা।’

কার্ত্তিক ভাবল, দারুণ ব্যাপার। একে বলে জনযুদ্ধ। ‘অ্যাঁ?’ সেক্রেটারি তাকালেন কার্ত্তিকের দিকে। সন্দেহ হল, তাঁর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? নইলে মা, কার্ত্তিকের গলা তিনি শুনতে পাবেন কী করে? জীবনে তো কোনও ভাল কাজ করেননি। নিশ্চয়ই এই গোলমালে তাঁর মাথা খারাপ হয়েছে অথবা পেটে গ্যাস জমেছে। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলেন তিনি পর্দার আড়াল থেকে। ভাবলেন, এই কথা কাউকে বলবেন না। ভাবা মাত্র ট্রেজারার জানতে চাইলেন, ‘কী চেপে যাচ্ছেন! কি বলবেন না?’

‘না তো, কিছু না।’ সেক্রেটারি মাথা নাড়লেন। ‘এইমাত্র আপনি ভাবলেন আর মিথ্যে কথা বলছেন?’ চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। বেলা বারোটায় শহরে কার্ফু ঘোষণা করা হল। ছ’ঘণ্টার জন্যে। রাস্তাঘাট সুনসান হয়ে গেল কার্ফুর জন্যে। বেলা একটায় মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় বিশেষ মিটিং ডাকলেন। যিনি যে অবস্থাতেই থাকুন, এই জরুরি মিটিংয়ে যোগ দিতে বলা হল। কারণ, শহরের অবস্থা এখন ভয়ঙ্কর।

মহালয়ার পর থেকেই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গা ছাড়া ভাব চলে আসে। ছুটির মেজাজে থাকেন সবাই। বেশির ভাগ মন্ত্রীরাই চলে যান জেলার বাড়িতে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা জরুরি বৈঠকে আসতে পেরেছেন কলকাতা এবং কাছাকাছি জেলার মন্ত্রীরা। ইতিমধ্যে শহরে পুলিশের গুলিতে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। তৃণমূল দাবি করেছে নিহতরা তাদের পার্টির সমর্থক, পুলিশ দোষীদের আড়াল করতে নির্দোষদের মেরেছে। একাদশীর পর বন্‌ধ ডেকেছে তারা। পুলিশ কমিশনার তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করেছেন যে, নিহতরা সমাজবিরোধী। নিজেদের মধ্যে লুঠ করা জিনিসের ভাগাভাগির সময় মারামারি করে মারা গেছে। সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিল যে, ‘তা হলে আপনি বলছেন গুলি চালায়নি পুলিশ?’ পুলিশ কমিশনারের মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকটি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘আপনি আমাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখাবার কথা ভাবছেন?’ কমিশনার বলেছেন, ‘মানুষের ভাবনার স্বাধীনতা আছে। আমার ভাবনা আমি ভাবব না, কে ভাববে? পি ডব্লিউ ডি?’

টিভিতে এই সাংবাদিক সম্মেলন দেখানো হয়েছে। সব ক’টা চ্যানেল পুলিশ কমিশনারের মুণ্ডু চটকাচ্ছে। তারা পুলিশ গুলি ছুড়ে মানুষ মারছে এই দৃশ্য বারংবার দেখিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা টেলিভিশনে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, রাস্তায় নামলে পুলিশ এবং সমাজবিরোধীদের হাতে মার খেতে হবে বলে নামছেন না। কিন্তু পাবলিক খেপে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বসেছিলেন। তাঁর পাঞ্জাবি এবং ধুতির চেয়ে মাথার চুল বেশি সাদা হয়ে গিয়েছে এই ক’বছরে! মন্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি মার্ক্সবাদী। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি গত রাতের পর থেকে আমরা সবাই এক বিদিকিচ্ছিরি ক্ষমতা পেয়েছি, যা আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করছে। আমি আপনাদের অনুরোধ করব, যখন কথা বলবেন না তখন জীবনানন্দের কবিতা মনে মনে আবৃত্তি করে যান। তাতে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকবে।’

মুখ্যমন্ত্রী হাসলেন। ঠিক তখনই এক মন্ত্রী আর এক মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জীবনানন্দ কে? পার্টির কোনও কবি?’
মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি গান জানেন?’
‘একটু আধটু। শ্যামাসংগীত।’
‘তাই মনে মনে গান।’
ভদ্রলোক মনে মনে গাইতে লাগলেন, বল মা তারা দাঁড়াই কোথা?
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আপনারা জানেন কলকাতা এখন বিপন্ন। আমরা র্যাফ নামিয়েছি, মিলিটারি কার্ফু জারি করেছে। কিন্তু তারাও এখন নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় পড়েছে। একমাত্র যাঁরা বাংলা জানেন না তাঁরা ঠিকঠাক কাজ করছেন। অদ্ভুত ব্যাপার, আপনি আমার সামনে এলে যেমন আমি বুঝছি, তেমনই আপনিও আমার মনের কথা বুঝে ফেলছেন। এই অবস্থা বেশি দিন চলতে দেওয়া যাবে না।’

মুখ্যমন্ত্রী থামতেই এক জন প্রবীণ মন্ত্রী বললেন, ‘ইতিমধ্যে সাত জন মারা গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কি জানেন, ওরা কী ভাবে মারা গেল?’
‘দেখুন, লোকগুলো মারা গেছে এটাই সত্যি। কী ভাবে মারা গেল সেটা বড় কথা নয়।’ মুখ্যমন্ত্রী বলতেই এক জন টাকমাথা মন্ত্রী হাসলেন। মনে মনে বললেন, মার্ক্সবাদী মন্ত্রী পুলিশকে আড়াল করছে!

মুখ্যমন্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী ভাবলেন? বলুন কী ভাবলেন? আমি পুলিশকে আড়াল করছি? আপনাকে বলেছিলাম জীবনানন্দের কবিতা মনে করতে আর তার বদলে আপনি আমার চরিত্রহনন করছেন?’

টাকমাথা মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, ‘সেটাই তো অবাক করছে আমাকে যে, আপনি ছাত্রাবস্থায় স্লোগান দিতেন: পুলিশ তুমি যতই মারো মাইনে তোমার একশো বারো, সেই আপনি টিভিতে বারংবার দেখানো সত্ত্বেও পুলিশ কমিশনারের মিথ্যাভাষণকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এ সব কংগ্রেসি আমলে হলে মানাত। মানুষের কাছে আমরা কী কৈফিয়ত দেব?’
‘আশ্চর্য! পুলিশ কমিশনারকে আমি কেন প্রশ্রয় দেব?’ মুখ্যমন্ত্রী হাসলেন।

এ বার টুপি পরা মন্ত্রী মুখ খুললেন, ‘কারণটা আপনি ভাল জানেন। সি এ বি ইলেকশনে আমি দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, আপনি ওকে জেতাবেন বলে আমাকে দাঁড়াতে দেননি!’
‘মাফ করবেন, ভুল বললেন। আমি না। পার্টি নিষেধ করেছিল।’

টুপি পরা মন্ত্রী বললেন, ‘এক জন পার্টির প্রতি অনুগত কর্মী হিসেবে সেটা আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে পি ডব্লিউ ডি মন্ত্রী বসে আছেন। তাঁর দফতরকে অপমান করার সাহস পুলিশ কমিশনার কী করে পেল?’

পি ডব্লিউ ডি মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লোকটা কি আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে?’
মুখ্যমন্ত্রী হাত তুললেন, ‘এখন আমাদের সামনে দুটো ইস্যু। এক, যে করেই হোক মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা লোপ পাওয়াতে হবে। আমি ইতিমধ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তাঁরাও কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।’
এক জন বৃদ্ধ মন্ত্রী বললেন, ‘আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না। মা দোলায় চেপে এসেছেন। প্রলয় তো হবেই। কিন্তু একমাত্র মা-ই আমাদের রক্ষা করতে পারেন। প্রত্যেকটা পুজো কমিটিকে নির্দেশ দিন, উদ্বোধনের আগে যেন প্রতিটি মণ্ডপে যজ্ঞের আয়োজন করা হয়। মা দশভুজার স্বামী মহাদেবের কাছে এই যজ্ঞ বর প্রার্থনা করবে, যাতে প্রত্যেকটা কলকাতাবাসীকে মানুষ করে দেন তিনি।’

মুখ্যমন্ত্রী অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তার পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা সবাই কি ওঁকে সমর্থন করেন?’
বৃদ্ধ মন্ত্রী বললেন, ‘যদি পুত্রার্থে যজ্ঞ করা যায়, যদি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্ভব হয়ে থাকে, তা হলে এটাও অসম্ভব নয়।’
অন্যান্য মন্ত্রীদের অনেকেই মাথা নেড়ে সমর্থন করলেন। মুখ খুললেন না।

মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘বুঝলাম। কিন্তু আপনাদের কথা দিতে হবে এই আলোচনার কোনও কথা মিডিয়া যেন না জানে। এমনকী কেউ আজ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন না। হলেই তারা আপনাদের ভাবনা বুঝে ফেলবে। কি, রাজি?’
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।

মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমি চাই শহরে শান্তি ফিরে আসুক। বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে যেন ভুল বার্তা না পৌঁছয়। তা যদি এ ভাবে শান্তি ফিরে আসে তা হলে আমি সমঝোতায় রাজি আছি।’ তিনি টুপিমাথা মন্ত্রীর দিকে তাকালেন, ‘আপনি তো তারাপীঠে গিয়ে পুজো টুজো দিয়ে এসেছেন। পুজো কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হল।’

ভদ্রলোক প্রতিবাদ করতে গেলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘না। আপত্তি করবেন না। আপনি তো বলেছেন, একমাত্র মরা মানুষকে বাঁচানো ছাড়া সব কাজ করতে পারেন। কলকাতা এখনও মরেনি, আপনি বাঁচান।’

মণ্ডপে মা এবং তাঁর সন্তানেরা তখনও পর্দার আড়ালে। কিন্তু কলকাতার সমস্ত মণ্ডপে পুরোহিতরা যজ্ঞ শুরু করে দিলেন। এই ব্যাপারটার জন্যে কোনও বাজেট ছিল না। ফলে এলাকার ধনপতিদের কাছ থেকে মন্ত্রীর নির্দেশবলে বাড়তি টাকা নিয়ে আসা হল।
যজ্ঞ শুরু হলে মানুষ মজা পেয়ে ভিড় জমাল। টিভি চ্যানেলগুলো জানিয়ে দিল, মুখ্যমন্ত্রী সি আই ডি-কে দায়িত্ব দিয়েছেন সাত জনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে তদন্ত করতে। কিন্তু লোক আপত্তি জানাল। পুলিশ কখনও পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত করে সত্যি কথা বললে কাকেরা কাকের মাংস খাবে। তৃণমূল সি বি আই দিয়ে এনক্যুয়ারি দাবি করল। সারা দিন যজ্ঞ চলছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নানান দাবি পৌঁছেছিল। শেষ তক সন্ধের মুখে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সি আই ডি তাদের কাজ করবে, কিন্তু তিনি বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত এক জন হাইকোর্টের বিচারককে দিয়ে তদন্ত করানো হবে। টুপিপরা মন্ত্রী তাঁর বাড়ির সামনের পুজোমণ্ডপে যজ্ঞ দেখতে দেখতে খবরটা শুনে বললেন, ‘দিল জল ঢেলে।’

সামনে পর্দা। ইচ্ছে করলেও শিবানী সেটা সরাতে পারছেন না। কিন্তু তাঁরা টের পাচ্ছেন পর্দার ও পাশে মণ্ডপে হইহই করে কিছু হচ্ছে। ডালডা পোড়ার গন্ধ পাচ্ছেন, কাঠ পুড়ছে। সংস্কৃত মন্ত্র ভেসে আসছে।

সরস্বতী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভাবল, ‘মা। এটা কী হচ্ছে? এখন তোমার পুজো, আমরা তাই এসেছি, কিন্তু বাইরে বাবাকে আরাধনা করা হচ্ছে কেন? অত্যন্ত অনৈতিক কাজ।’

লক্ষ্মী ভাবল, ‘বাবা তো আর মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করেননি। মায়ের হাতে ত্রিশূল দিয়ে কৈলাসেই শুয়ে ছিলেন। তা হলে?’
কার্ত্তিক ভাবল, ‘এক বার যদি দেখে আসতে পারতাম।’

এই সময় গণেশ দেখল একটা নেংটি ইঁদুর তার মাটির ইঁদুরের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। ওটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনও গর্তে থাকে। গণেশ মনে মনে জিজ্ঞাসা করল: ‘এই তুই কে?’
সঙ্গে সঙ্গে নেংটি মুখ তুলল, ‘আজ্ঞে আমি নেংটি।’
‘তুই দেখছি আমার ভাবনা বুঝতে পারছিস!’
‘আগে পেতাম না। কাল মাঝ রাত থেকে—।’
‘মানে?’
‘হঠাৎ একটা ফুল এসে পড়ল আমার গর্তের সামনে। সেই ফুলের গন্ধ পাওয়া মাত্র সবার মনের কথা বুঝতে পারলাম। ফুলটা তুলে খেতে গিয়ে টের পেলাম অনেক দূরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। তাই না খেয়ে গর্তে ঢুকিয়ে রেখেছি।’ খুশি খুশি গলায় বলল নেংটি।

শিবানীও না বলা কথাগুলো শুনছিলেন। উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘বাইরে ও সব কী হচ্ছে?’
‘আজ্ঞে, মা, যজ্ঞ করছে। বাবা যদি তুষ্ট হয়ে ওদের ক্ষমতা কেড়ে নেন। হে হে, লোকে আগে বর চাইত, এখন এরা ছাড়তে চাইছে।’

‘তার মানে এখানকার সবাই সবার মন বুঝতে পারছে এখন?’
‘হ্যাঁ মা। তাই তো মারপিট লেগে গেছে।’
শিবানী ভাবলেন, ‘গণেশ, বল তো ও কৈলাসের কিছু দেখতে পাচ্ছে কি না, বড্ড চিন্তা হচ্ছে রে।’
নেংটি ভাবল, ‘পাচ্ছি মা। বাবা ঘুমাচ্ছেন। এই চোখ খুললেন। উঠে বসলেন। তার পর তাকালেন। একটু হাসলেন। সামনের বাগানে মা মনসা ফুল তুলছিলেন। এম্মা! না। আর বলতে পারব না। দেখতে চাই না আর।’
মা ছটফটিয়ে উঠলেন, কিন্তু প্রতিমা নড়ল না। সর্বনাশ। মনসা তো ওঁরই মেয়ে। কোনও দিন দেখেনি বলে চিনতে পারবে না। এই জন্যে আমি আসতে চাই না কৈলাস ছেড়ে। গণেশ, ওকে বল, গর্ত থেকে ফুলটা আমাকে এখনই এনে দিক। আমি স্বচক্ষে তোর বাবার পতন দেখব।

নেংটি দৌড়াল ফুল আনতে।
সন্ধের পরে বৃষ্টি আরম্ভ হল। আবহাওয়া দফতর ঘোষণা করল এটা নিম্নচাপের বৃষ্টি নয়, কিছু ক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে। যজ্ঞের আগুন বৃষ্টির জলে নিভে গিয়েছিল। উদ্যোক্তারা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল উদ্বিগ্ন হয়ে। বৃষ্টির ভেতর উদ্বোধন হবে কী করে? মুম্বইয়ের স্টাররা এসেছেন কিনা। তাঁরা জানালেন, অপেক্ষা করতে হবে। মুম্বইয়ের স্টাররা ঠিক সময়ে এসে হোটেলে উঠেছেন। কলকাতায় পা দিয়েই ওঁদের চেহারা বদলে গেল। তাঁদের সঙ্গে তো বটেই, নিজেদের মধ্যেও ঝগড়া শুরু করেছেন। মূলত কে কত পাচ্ছেন, তাই নিয়ে ঝগড়া। মন বুঝতে পেরে জেনে গেছেন কে কত বেশি বা কম পাচ্ছেন। ওঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে। একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।

বৃষ্টি থামলে নেংটি ফুল নিয়ে এল। শিবানী ভাবছেন, ‘তুমি ওই ফুল নিয়ে আমার নাকের সামনে ধরো।’
‘মা, তা হলে যে তোমার শরীরে পা রাখতে হবে’, নেংটি ভয়ে ভয়ে বলল। ‘বাচ্চার পা মায়ের শরীরে তো লাগেই। এসো।’
সিংহের ওপর উঠে মায়ের পা বেয়ে কোমর পেরিয়ে দশ হাতের একটা হাত দিয়ে কানের গহনায় দুই পা রেখে মুখের ফুল মায়ের নাকের সামনে শেষ পর্যন্ত ধরতে পারল নেংটি। মা শ্বাস নিতেই দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর কথা ভাবতেই দেখতে পেলেন মহাদেব গাঁজা খাচ্ছেন। মনসা কোথাও নেই।

মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি একটু আগে কী করছিলে?’
মহাদেব চমকে তাকালেন, ‘ও, তুমি! এত ক্ষণে ফুলটাকে পেয়েছ? ভাল। এই তো, একটু সেবন করছি।’
‘তুমি কি মনসার দিকে তাকিয়েছিলে?’
‘অ্যাঁ, কে বলল? তুমি দেখেছ?’
‘শুনেছি। সে তোমার মেয়ে।’
‘জামাই মনে করিয়ে দেওয়া মাত্র পিতৃস্নেহে তাকিয়েছি।’
‘মরণ!’

বলা মাত্র কৈলাসের ছবি চলে গেল সামনে থেকে। আবার ঘ্রাণ নিলেন শিবানী। না। যেন টিভির চ্যানেল অফ হয়ে গেছে। ভাবলেন, ‘এটা কী হল? গণেশ, নেংটিটাকে জিজ্ঞাসা কর, সে দেখতে পাচ্ছে কি না?’
কিন্তু গণেশের ভাবনা বুঝতে পারলেন না তিনি। নেংটি নেমে গেল নীচে। শিবানী বুঝতে পারলেন তাঁদের কেউ কারও মনের কথা বুঝতে পারছেন না।

বাইরে তখন উল্লসিত উদ্যোক্তারা। কেউ বুঝতে পারছেন না সামনে দাঁড়ানো লোকটা কী ভাবছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোক এল, ‘মুম্বইয়ের স্টারদের ঝামেলা মিটে গেছে। সবাই নর্মাল। পাঁচ মিনিটের বেশি আপনাদের মণ্ডপে থাকব না। তাড়াতাড়ি রেডি হন।’

পাবলিক বলতে লাগল যজ্ঞ করার ফল হাতে হাতে পাওয়া গেল। মণ্ডপে মণ্ডপে একের পর এক উদ্বোধন হয়ে গেল। কার্ত্তিক ফ্যালফ্যাল করে চিত্রাভিনেত্রীদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল। এক জন অভিনেত্রী হেসে তাকে বললেন, ‘হাই হ্যাণ্ডসাম।’
রাত তিনটে থেকে ভোরের মধ্যে সব পুজোর উদ্বোধন হয়ে গেল।

শিবানীর কান্না পাচ্ছিল। মহাদেব মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে ওই শক্তি ফুলে ভরে তাঁর হাতে দিয়েছিলেন। কী অসভ্য লোক। কিন্তু সামনের পর্দা সরে গেছে বলে তাঁকে হাসি হাসি মুখে মহিষাসুরকে মারার পোজ দিতে হল।
ঘুম ভাঙতেই মেঝেতে কার্পেট পেতে শোওয়া স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সতর্ক হলেন সপ্তর্ষি। না। ভাববেন না। তিনি মনে মনে গান ধরলেন। চোখ মেলে বিরক্ত গলায় উর্বশী বললেন, ‘এ রকম বোকা বোকা চোখে কী দেখছ?’
সপ্তর্ষি চেষ্টা করেও না ভেবে পারলেন না, আমি বোকা? তুমি কি?
‘তুমি কী ভাবছ গো?’ পাশে উঠে এল উর্বশী।
‘কেন তুমি বুঝতে পারছ না?’

‘একদম না। আচ্ছা, আমি যা ভাবছি তা বোঝ তো?’ বলে মনে মনে ভাবলেন, টেকোটা মিথ্যে বলছে না তো?
সপ্তর্ষি মাথা নাড়লেন, ‘এ কী! কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘সত্যি?’
‘সত্যি।’
সঙ্গে সঙ্গে উর্বশী স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমাকে দশ হাজার টাকা দিও, প্লিজ। তুমি ব্ল্যাক টাকা কোথায় সরিয়েছ বুঝতে পারিনি।’
‘থাক ও কথা। মুখ ধোও। আজ পুজো। চলো, মাকে সেলাম করে আসি।’ সপ্তর্ষি উঠলেন।
‘ছিঃ। সেলাম বলতে নেই। বলো, প্রণাম।’ উবর্শীর সর্বাঙ্গে এখন আনন্দ।

[শেষ]

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত