শেষ বিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল। দুপুরের পর থেকেই আকাশ মেঘলা, মাঝে মাঝে জানিলা খুললে অনেকটা দূর দেখা যায়। অনিমেষ চুপচাপ বসেছিল। এরকম মেঘের দুপুর কিংবা বিকেলে মন কেমন বিষগ্ন হয়ে যায়। খুব আলস্য লাগে তখন। চোখ বন্ধ করলেই সেই মেঘগুলোর কথা মনে পড়ে যায় যারা ভুটান পাহাড় থেকে দল বেঁধে উড়ে এসে স্বৰ্গছেড়া চাবাগানের ওপর বৃষ্টি ঝরাত। তখন সেই সব বুনো লম্বাটে গাছগুলো কী উল্লাসে আকাশটা জুয়ে রাখত। কান পাতিলেই সেই শব্দ ।
এ বছর ঘন মেঘের বিকেল এই প্রথম। মেঘেদের চেহারা কি পৃথিবীর সব জায়গায় একই রকম থাকে ? তা হলে স্বৰ্গছেড়া এমনকী জলপাইগুড়ির মেঘগুলোর চেহারা চালচলন। এখানকার থেকে একদম আলাদা কেন ? ভীষণ ময়লা আর ঠুনকো মনে হচ্ছে এদের। যেন খুব কষ্ট করে আসছে ওরা, দেয়। হয়তো ওদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই কিংবা এই বিরাট শহরে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি মেলে না। অন্তত এ পাড়ার মেয়েদের দেখলে ওর তাই মনে হয়। কিন্তু এই মেঘ-থমথমে সন্ধেবেলায় যখন সব ছাদ খালি হয়ে গেছে তখন ওই মেয়েটি ঘাড় বেঁকিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে অমন করে কী দেখছে ? খুব বিষন্ন সময় এলেই মানুষ অমান ভঙ্গিতে দাঁড়াতে পারে। মেয়েটিকে এর আগে সে কখনও দেখেনি। ওই হলুদ বাড়িটার ছাদে প্রায় সময় এক বিশাল চেহারার ফরসা মহিলা ঘোরাফেরা করেন। মেয়েটি মাথা নামিয়ে কিছু ভাবল, তারপর এ দিকে তাকাল। চোখাচে্যুখি হতেই কী হল কে জানে, একছুটা লাগাল মেয়েটি, আর দেখা হল না। অনিমেষ হেসে ফেলল। তপন থাকলে বলত, বালিকা জানে না যে ও মরে গেছে। এই সময় ছটফটয়ে বৃষ্টিটা নামল। জানলা বন্ধ করে আলো জ্বালল অনিমেষ ।
এই ঘরের অন্য খাটটায় থাকে ব্রিদিব—ত্রিদিব সেনগুপ্ত, জামশেদপুরের ছেলে । ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া অথচ বাংলা কবিতা লেখে। ব্রিদিধের বিছানার দিকে তাকালেই বোঝা যায় ওর বেড়কড়ারটা খুব দামি, একরাশ নীল রঙের পাখি সেখানে ভিড় করে আছে; দেওয়ালে আঁটা হুকে ত্ৰিদিবের যে সব জামা-কাপড় ঝুলছে সেগুলো ওর পারিবারিক সাচ্ছল্যের সুন্দর বিজ্ঞাপন। ওর টেবিলের কোণে যে সব প্রসাধনায়দ্রব্য তা কলকাতায় আসার আগে অনিমেষ দেখেনি। অনিমেষ দেওয়ালে টাঙানো ত্রিদিকের আয়নার দিকে এগিয়ে গেল । কলকাতার জল পেটে পড়লে মফস্বলেৱ মানুষ নাকি ফক্সসা হয়ে যায়। অনিমেষ নিজেকে সুন্দর দেখল। সামান্য বড় চুল, খুব অল্প এবং কালচে গোফ দাড়ি মুখের আদল পালটে দিয়েছে। চোখ আর নাকে আলো পড়তেই চট করে। ক’দিন আগে দেখা ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। যুবক রবীন্দ্রনাথের মুখ কি এরকম দেখতে ছিল ? ভাবতে গিয়েই লজ্জা পেল সে, দুর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের গায়ের রং ভগবানের মতো ছিল।
কলকাতায় দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর হয়ে গেল। কলেজের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সময়টা কম নয়। কিন্তু অদ্ভুত নির্জনতা নিয়ে এখনও সে কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে
গেল। কলেজে থাকার সময় সে বাবার আদেশ পুরোপুরি মেনে চলেছে। জলপাইগুড়ি থেকে নিয়মিত দুটাে চিঠি প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন নির্দেশ নিয়ে তার কাছে আসে। একটা ঠাকুরদা সরিৎশেখরের, অন্যটা বাবা মহীতোষের। প্রথমবার এই কলকাতায় আসামাত্রই যে ঘটনাটা ওর শরীর-মনে ছাপ রেখেছিল। পাকাপাকিভাবে তার কাঁপুনি থেকে নিজেকে সরাতে সময় লেগেছিল অনেকদিন । ফলে ওই সব চিঠিগুলোর নির্দেশ মান্য করা ছাড়া ওর কোনও উপায় ছিল না। আর তাই এই কলেজের সময়টা অদ্ভুত নিঃসঙ্গ হয়ে কলকাতায় কাটিয়ে দিল ।
এই হােষ্টেল মূলত কলেজ-ছাত্রদের, কিন্তু প্রাক্তন, যারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তারা ইচ্ছে করলে থাকতে পারে ! সেই সুবাদে অনিমেষের এখানে থাকা । ত্রিদিব এখানে নতুন এসেছে। ও কলকাতার বাইরে যে কলেজ থেকে পাশ করেছে সেই কলেজ। আর অনিমেষদের কালেঞ্জ একই মিশনারিদের সংস্থায় অন্তৰ্গত। তাই প্রাক্তন ছাত্র না হয়েও ওরা এখানে থাকতে কোনও অসুবিধে হয়নি। মিশনারি হােষ্টেল বলেই প্রতি বছর বেশ কিছু বিদেশি ছাত্র কলকাতায় পড়তে এসে এখানে থাকে; হােস্টেলের অর্ধেক তারই। বেশির ভাগই আফ্রিকার, কিছু বাৰ্মা মুলুকেরও স্বঅাছে। আফ্রিকার ছেলেদের ভাবভঙ্গিতে কোনও সঙ্কোচ নেই, বিদেশে আছে বলে মনে হয় না। বিশাল চেহারাগুলো নিয়ে সব সময় হইচই করছে। প্রথম প্রথম ওদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত অনিমেষ। যেকোনও আফ্রিকানকে দেখলেই আঙ্কল টমকে মনে পড়ে যায়। ক্রীতদাস করে রেখেছিল সাদা মানুষেরা এই সেদিন পর্যন্ত অথচ ওদের হাবভাবে সে সব কষ্টের কোনও চিহ্ন নেই। আর একটা স্মৃতি চট করে অনিমেষের সামনে উঠে আসে। আসাম রোডে ছুটে যাওয়া মিলিটারি কনভয়ের নিগ্রো অফিসারটার মুখ যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। লোকটা এখন কোথায় আছে কে জানে। আমরা কাউকে অকারণে মনে রেখে দিই চিরকাল, যার হয়তো আমাদের মনে রাখার কোনও কথাই নেই।
শব্দ করে বৃষ্টি পড়ছে একনাগাড়ে। অনিমেষ দরজা খুলে ভেতুরের বারান্দায় এল। হােস্টেলের অনেক ঘর বন্ধ, খোলা দরজাগুলো থেকে আলো এসে বাইরের বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে! ইউ প্যাটার্নের এই বাড়িটার মাঝখানের ব্রাস্কেটবল iਤ থেকে/মাউথ অর্গাঁসাঞী। আফ্রিকানদের কেউ বাজাচ্ছে, হাজার হাজার মাইল দূরে এসে যার খুব কষ্ট হচ্ছে দেশের জন্য কিংবা ফেলে আসা কোনও মানুষের কথা সে ভাবছে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে হল ছেলেটিকে একবার দেখে আসে। মুশকিল হল ওদের দেখলে সে চট করে আলাদাভাবে চিনতে পারে না, কেউ খুব লম্বা, মোটা অথবা রোগা এইভাবে বুঝতে হয়। তিনতলার বারান্দা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে সেই ঘরটার সামনে এল অনিমেষ। একটু সঙ্কোচ হচ্ছিল, গায়ে পড়ে কথা বলতে কেমন যেন লাগে।
ঘরের ভেতর ছেলেটি এক চিৎপাত হয়ে খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করে মাউথ অৰ্পন বাজাচ্ছে । বেশ চ্যাঙা চেহারা, জুতো সুন্ধু পা দুটাে খাটের বাইরে ঝুলছে। ঘরটা দারুণ অগোছালো, সাজগোছ করার কোনও চেষ্টাই নেই। কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে সে ফিরে আসছিল এমন সময় ছেলেটি বাজনা থামিয়ে উঠে বসে বলল, “হেই!” কথাটা জড়ানো, মানে না বুঝলেও অনিমেষ অনুমান করল যে ভুকু ক্ষুদ্রািট। পরমুহূর্তেই এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকল ছেলেটি, ‘’গেট ইন, প্লিজ!’
এবার বুঝতে পারলেও অনিমেষ লক্ষ করল ওর উচ্চারণে একটা মোটা আওয়াজ এমন জড়িয়ে থাকে। যেটা অন্য শব্দগুলোকে স্পষ্ট হতে দেয় না। অনিমেষ ভেতরে ঢুকতেই চকচকে সাদা দাঁতে হাসিল ছেলেটি, ইয়া–“
ওর আসার কারণটা বোঝাতে গিয়ে বিপদে পড়ল অনিমেষ। মনে মনে দ্রুত ইংরেজি করে নিয়েও ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না। সে । সঙ্কোচ হচ্ছিল ইংরেজিষ্টা ভুল হতে পারে! শেষ পর্যন্ত সহজ। রাস্তােটা বেছে নিল অনিমেষ, আঙুল তুলে মাউথ অর্গানটাকে দেখল। ছেলেটি যেন খুব খুশি হয়েছে এমন ভঙ্গিতে বাদ্যযন্ত্রটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে ফের লুফে নিয়ে বলল, “য়ু লাইক ইট ?”
“ইয়েস’ অনিমেষ ধাতস্থ হল, তারপর জুড়ে দিল, ‘ভেরি সুইট ।” “খ্যান্ধু! ইন্টস মাই ফ্রেন্ড ; মাদার গেভ ইট । সিট ডাউন, সিটি হেয়ার প্লিজ ।”
সামনে রাখা চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে খাটের পাশে রেখে সে অনিমেষকে ইঙ্গিত করলে বসার জন্য ।
এর আগে ইংরেজিতে কখনও কথা বলেনি। অনিমেষ। জলপাইগুড়িতে যখন ছিল তখন এ প্রশ্ন উঠন্তই না। ত্রিদিব যখন বাংলা হিন্দি বলতে বলতে নিজের অজান্তে অনর্গল ইংরেজি বলে যায়। তখন সেটা লক্ষ করেছে অনিমেষ ; অনেক শব্দ যার অর্থ অন্য রকম ছিল, ব্যবহারে তার চেহারা পালটে যায়। এই যেমন ছেলেটি তাকে ভেতরে আসার জন্য বলল, গেট ইন। অনিমেষ নিজে গোট কথাটা ভাবতেই পারত না, বলত কাম ইন। অথচ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য গেট আউট তো স্বচ্ছন্দে মনে আসে ; জলপাইগুড়ির স্বাঙালি স্কুলে ইংরেজি ভাষাটা যেভাবে শিখিয়েছে তাতে নিজের মতো করে কথা বলা যায় না। এই মুহুর্তে সে বিব্রত হয়ে পড়ছিল।
চতুর্দিকে ছেলেটির রংবেরঙের জামাকাপড় ঝুলছে। ওর রুমমেটটি এখনও বোধ হয় ফেরেনি । কেউ যে রঙিন জঙ্গিয়া পরে জানা ছিল না। অনিমেষের । চেয়ারে বসে ছেলেটিকে ভাল করে দেখল সে । চামড়ার রং কালো হতে হতে তা থেকে কেমন নীলচে জেল্লা বেরুচ্ছে। চোখ দুটো ছোট, মাথার চুলে চিরুনি বোলানো অসম্ভব, এত কেঁকড়া এবং পাক খাওয়া বোধ হয় চুল আঁচড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। শরীর ওর বেতের মতো হিলহিলে, সামান্য মেদ নেই কোথাও ।
“আই অ্যাম থম্বোটাে। রিয়েল গ্ল্যান্ড টু সি অ্যান ইন্ডিয়ান ইন মাই রুম।” চকচকে সাদা দান্ত একবার বিলিক খেল। এই প্রথমবায়, সে যে ইণ্ডিয়ান তা কেউ অনিমেষকে বুলল। তার হঠাৎ খেয়াল হল থম্বোটাের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়। অতএব সামান্য ভুলভাল হলে নিশ্চয়ই সে গ্ৰাহ্য করবে না। অনিমেষ নিজের নাম বলল, এখন কিছুটা স্বচ্ছন্দ হয়েছে সে।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, “তুমি তো স্কটিশেই পড়ে ?” “হ্যা, বি এসসি ফাস্ট ইয়ার, তুমি ?” ‘আমি এম.এ-তে অ্যাডমিশন নিয়েছি, এখনও ক্লাশ শুরু হয়নি। আর্টস।” ‘ও গড়, তুমি তা হলে আমার সিনিয়ার, ধািট য়ু লুক সো ইয়াং।” অবাক চোখে তাকে দেখছিল থাম্বোটো। সত্যি কি তাকে এম. এ. ক্লাশের ছাত্র বলে মনে হয় না ? কী জানি। সে জিজ্ঞাসা করল, *এখানে কেমন লাগছে তোমারঃ ?”
‘না! আমি এখান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে ডুয়ার্স বলে একটা জায়গা থেকে এসেছি।” ‘সেটা কি ভারতবর্ষ নয় ?” ‘কেন নয়? এই পশ্চিমবাংলারই একটা অংশ ;’ থাম্বোটো চট করে টেবিল থেকে একটা বড় ভারতবর্ষের ম্যাপ সামনে বিছিয়ে বলল, “শো মি হোয়ার ইট ইজ!”
অনিমেষ বুকে পড়ে পশ্চিমবাংলার মাথায় জলপাইগুড়ি লেখা অঞ্চলষ্টায় আঙুল রাখল। ও দেখল আলিপুরদুয়ার এবং ফালাকাটা ম্যাপে লেখা আছে কিন্তু স্বৰ্গছেড়ার উল্লেখ নেই। থম্বোটো জায়গাটা ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, “এ জায়গা তো হিমালয় পৰ্বতমালার নীচে, তুমি কি পাহাড়ি মানুষ ?”
‘না, না, আমি বাঙালি!” হেসে ফেলল অনিমেষ। ‘ষ্ট্রেঞ্জ! তোমাদের এই ভারতবর্ষে স্নো-রেঞ্জ আছে, সমুদ্র আছে, মরুভূমি আছে, আবার ডিফারেন্ট টাইপ অফ পিপল উইদ ডিফারেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজেস একসঙ্গে বাস করছ, কেউ বাঙালি কেউ পাঞ্জাবি আবার সকলেই ইন্ডিয়ান, তোমাদের কোনও অসুবিধে হয় না ? কী করে তোমরা ইউনাইটেড হলে ?” জানিবার আগ্রহ থাম্বোটোর মুখে ।
অনিমেষ এক মুহুর্ত চিন্তা করে বলল, “আমাদের চেহারা এবং ভাষা আলাদা হলেও কালচারের কোথাও কোথাও এবং ধর্মের মিল রুয়েছে। ত্বা ছাড়া ইতিহাস বলে, বার বার বিদেশি-আক্রমণ হয়েছিল আমাদের ওপর। বোধ হয় আক্রান্ত হলেই ইউনিটি গড়ে ওঠে।”
মন দিয়ে কথাটা শুনে থাম্বোটো বলল, “বাট দেয়ার আর হিন্দুস অ্যান্ড মুসলিমস, ক্রিশ্চিয়ানও কম নেই। এরা তো কমপ্লিট আলাদা ধর্মের মানুষ এবং প্রত্যেকের মানসিকতা আলাদা, তাই না ?”
অনিমেষ একটু থিতমত হয়ে বলল, “হ্যা, কিন্তু ধর্ম তো ঘরের ব্যাপার, বাইরে আগুন লাগলে সেটা ঘরে রেখেই মানুষ আগুন নেবাতে বেরিয়ে আসে।”
হাসল থাম্বোটো, তাই যদি হয় তোমরা এত বছর ব্রিটিশকে থাকতে দিলে কেন ? খুব্ধ দেরিতে হলেও অবশ্য তোমরা ব্রিটিশকে তাড়াতে পেরেছিলে আর এইটে আমাদের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশগুলোকে সাহায্য করেছিল।”
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে অনিমেষ বলল, “হ্যা, ওরা আমাদের হাতে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছে।”
বিস্মিত হল থম্বোটি, “ফ্রিড়াম কেউ কাউকে দেয় না, ফ্রিড়ািম আর্ন করতে হয়। তুমি কি বলতে চাইছ তোমরা ফ্রিড়াম অর্ন ফরোনি ?”
কথাটা অনিমেষকে হঠাৎ উত্তেজিত করে ফেলল। স্কুল জীবনের শেষ দিকে সুনীলদা যে সব নতুন ব্যাখ্যা ওকে শুনিয়েছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্পর্কে, কলকাতায় আসার পর হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে কোেনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সেই শোনা ব্যাখ্যাকে আরও দৃঢ় করেছে। সে বলল, “আমরা চেষ্টা করেছিলাম বিভিন্ন পথে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা আমাদের দিয়ে গেছে। রক্ত না দিলে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। আর যদি তা পাওয়াও যায় তা হলে সে স্বাধীনতা সম্পর্কে দেশের মানুষের মমতা ঘোরাফেরা করত। কিন্তু এখন বলার সময় ওর মনে হল নিজের দেশের এই রকম দুৰ্বল জায়গা নিয়ে একজন বিদেশির সঙ্গে আলোচনা করা ঠিক হচ্ছে না। থম্বোটো তার নিজের দেশের সমস্যা নিয়ে কোনও কথা বলেনি। এ সব কথা বললে ও নিশ্চয়ই ভুল বুঝবে এবং সেটা ওর দেশের মানুষ জানুক তা কাম্য নয়। অনিমেষ গলার স্বর পালটে বলল, “এর মধ্যে অনেকগুলো বছর গেছে, এ বার আমরা পুরনাে ভুলগুলো শুধরে নেব। এ বার তোমার কথা বলো, আমরা একই পৃথিবীতে থাকি অথচ তোমাদের দেশের খবর ভারতবর্ষের মানুষ কিছুই জানে না।” থম্বোটো বলল, “ওয়েল, আমাদের দেশ খুবই গরিব এবং বড়লোকেরা যাকে বলে আনডেভেলপাড় বোধ হয় তাই! প্র্যাকটিক্যালি আমরা আফ্রিকানরা এত ছোট ছোট ষ্টেট ডিভাইড্রেড যে- ”
ঠিক এ সময় একজন খৰ্ব্বকীয় মানুষ দরজায় এসে দাঁড়াল। সৰ্ব্বাঙ্গ ভেজা, পোশাক থেকে কয়েকবার দেখেছে, এর মতো
চুলে একটু বেশি স্প্রিং থাকায় বৃষ্টির জলেও এলোমেলো হয়নি। ছেলেটি ঘরে ঢুকে খুব উত্তেজিত হয়ে হাত-পা নেড়ে থাম্বোটোকে কী সব বলতে লাপল নিজের ভাষায় । থাম্বোটো হাসছে কিন্তু কোনও উত্তর দিচ্ছে না। ছেলেটা পাগলের মতো দু-তিনবার পাক খেয়েও কথা থামাচ্ছে না। ভাষা ঠাওর না হলেও অনিমেষের মনে হল ছেলেটি বোধ হয় এই ঘরে ওকে দেখে রোপে গেছে । আফ্রিকান ছেলেদের ঘরে কোনও ভারতীয়কে সে আড়ড়া দিতে দেখেনি, ওরাও কারও ঘরে যায় না । হঠাৎ ছেলেটি অনিমেষের দিকে তেড়ে এসে উলটোদিকের খাটে বসে তাড়বড় করে যে কথাগুলো বলল সেটা যে ইংরেজি ভাষায় তা বুঝতে কয়েক মুহূৰ্ত্ত লাগল। অনিমেষ দ্বিতীয়বার ওকে উচ্চারণ করতে শুনল, “ইউ মাস্ত প্রত্যেস্ত।’ বীীসের প্রতিবাদ করার কথা বলছে ও বুঝতে না পেরে অনিমেষ থাম্বোটোর দিকে তাকাতেই ছেলেটি একটা আঙুল ওর দিকে উচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইউ লিভ দিস হােস্তেল ?”
মাথা নেড়ে হ্যা বলল অনিমেষ। একটু আশ্বস্ত হল। এই ভেবে যে ওর রাগের কারণ সে নয়, তা হলে প্ৰতিবাদ করার কথা বলত না ! থাম্বোটো এ বার কথা বলল ] এই ছেলেটি ওর রুমমেট । আজ বিকেলে এক সদ্যপরিচিতা মহিলার সঙ্গে ভুঞ্জর বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৃষ্টি এসে যাওয়ায় ওরা হােষ্টেলে ফিরে এসে আড়া মারবে ঠিক করেছিল। কিন্তু গেটে যে দারোয়ান আছে সে নাকি বাগড়া দিয়েছে এই বলে যে এখানে নাকি মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। যেহেতু এখন আটটা বেজে গেছে তাই ভিজিটার্স রুমটাও বন্ধ ছিল। থম্বোটোর বন্ধু এতে ভীষণ অপমানিত বোধ করছে। তারা কেউ বাচ্চা ছেলে নয়, নিজের ভাল-মন্দ বুঝতে জানে, এই ধরনের আইন মেয়েদের হােষ্টেলে থাকতে পারে। কিন্তু ওদের ওপর প্রয়োগ করা মানে রীতিমতো অপমান করা। একটু হেসে থম্বোটাে যোগ করল, “মহিলাটি আমার বন্ধুর মুখ আর দর্শন করবে না জানিয়ে গেছে।”
ঋগ্রেটার বন্ধু এতক্ষণ চুপ করে কথাগুলাে শুনছিল, এবার চিৎকার করে বলে উঠল, “শি টােন্ড অনিমেষ হেসে ফেলল বলার ধরন দেখে থম্বোটোর বন্ধু চিট করে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত হাতে নিজের জামাকাপড় খুলতে লািগল ; গেঞ্জি-টেঞ্জি পারেনি, নির্লোেম তামাটে বুক দেখলে কেউ নিগ্রো বলে ভাবতে পারবে না। এর পর সে নির্দিধায় প্যান্টের বোতাম খুলে সেটাকে ছুড়ে দিল ঘরের এক কোনায়। অনিমেষ এতটা আশা করেনি, চট করে একটা অস্বস্তি শুকে বিব্রত করে তুলল। পরিচিত বা অপরিচিত যে-কোনও মানুষের সামনেই এইরকম জামাকাপড় ছেড়ে শুধু জাঙ্গিয়া পরে দাঁড়ানোর কথা সে চিন্তাও করতে পারে না। এদের কি কোনও সঙ্কোচের ধালাই নেই ? ওর আশঙ্কা হচ্ছিল এ বার হয়তো জাঙ্গিয়াটাও শরীরে থাকবে না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ছেলেটি খুব ঘেন্নার সঙ্গে বলে উঠল, ইউ ইন্ডিয়ান আর উইদাউট ব্যাকবোন, কাওয়ার্জ।” এ বার শব্দগুলো বুঝতে এতটুকু অসুবিধে না হওয়ায় অনিমেষের মাথায় রক্ত উঠে গেল। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেল। ওর শরীর উত্তেজনায় কঁপিছে, দুটাে হাতের আঙুল মুঠোয় ধরে রাখতে পারছে না। অনিমেষের মুখ-চোখের ভাব দেখে ছেলেটি বোধ হয়। ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে গেল। থম্বোটো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ছুটে এসে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরল। ওর বিরাট শরীরের কাছে অনিমেষ এই মুহুর্তে অসহায় হলেও প্ৰাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছিল। জোর না খাটিয়ে থাম্বোটাে বলল, “আমার বন্ধুর কথায় কান দিয়ে না, ও ঠিক জানে না। কাকে কী বলতে হয় ।” তারপর হেসে বলল, “তুমি রাগ করেছ দেখে আমি খুশি হয়েছি।”
অনেক কষ্ট্রে নিজেকে সামলে নিল অনিমেষ । এখন শরীর কেমন বিমঝিম করছে । থম্বোটো এসে বাধা না দিলে ও নির্ঘাত ছেলেটিকে মারত । উনি মেয়েদের সঙ্গে আড়া দেবেন। আর সেটা সমর্থন না করলে জাত তুলে গালাগাল দেবেন। কোনও রকমে থম্বোটোর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এল অনিমেষ। আজ অবধি কখনও কারও গায়ে হাত তোলেনি। সে, ছেলেটাকে মারলে ও নিশ্চয়ই কোনও প্রতিরোধ করতে পারত না। ওরকম দুর্বল শরীর নিয়ে এ ধরনের কথা বলার সাহস পায় কী করে! মারতে পারেনি বলে জীবনে এই প্রথমবার অফশেস হল অনিমেষের বাইরে এখনও সমানে বৃষ্টি পড়ছে। মেজাজটা খিচড়ে গেছে, আফ্রিকান ছেলেদের মানসিকতা এ রকম হয় কি না কে জানে, ভবে থাম্বোটোর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছিল। কয়েক পা এগোতে না এগোতেই পিছনে ডাক শুনতে পেল সে, “হেই, হিনিমেসি ।
এ রকম উচ্চারণ শুনে বিরক্তিটা
:”ভাল লেগেছে, তুমি কি আবার আসবে?”
কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা আন্তরিকতা ছিল যে অনিমেষ রাগ করতে পারল না । সে বলল, “আজ থাক, আর একদিন হবে।” ঠিক এই সময় খম্বোটোর ঘর থেকে একটা উদাম সুর ভেসে এল। মাউথ অর্গানটা যেন ঝড় তুলছে। হেরে যাবে নিশ্চিত জেনে মানুষ যখন মরিয়া হয়ে ওঠে, সুরাটা সেই রকম তেজি এবং উদ্দাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওরা বাজনােটা শুনল। এই শব্দ করে বৃষ্টিপাড়া রাত্রে যখন সমস্ত হােষ্টেলটা নিঝুম তখন এই রকম বিমঝিমে সুরা যেন অবশ করে ফেলছিল ওকে। নিচু স্বরে থাম্বোটো বলল, “আমার চাইতে অনেক ভাল বাজায় ও, না ?”
অনিমেষ কী বলবে ঠাওর না করতে পেরে নিজের মনে ঘাড় নেড়ে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগল। যে সুরাটা ওর পিছন পিছন আসছিল আচমকা সেটা থেমে যেতেই অনিমেষের মনে হল একটা ভারী নিস্তব্ধতা ওর চারপাশ চেপে ধরেছে। ঘরের শেকল খুলে অন্ধকারের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে সে। নিজেকে ভীষণ এক মনে হচ্ছে, এই বিরাট কলকাতা শহরে তার কোনও বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই। আলো না। ঘরে ঢুকে চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়ল সে।
অস্বস্তিষ্টা। তবু যাচ্ছিল না। কী সহজে ছেলেটি ওকে গালাগালিটা দিল! থম্বোটাে না থাকলে আজ কী হত বলা যায় না ! হঠাৎ মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ায় যে উত্তেজনা সমস্ত শরীরকে কাপাচ্ছিল তাতে সে কতখানি আঘাত করতে পারত কে জানে কিন্তু সেটা করতে পারলে বোধ হয় এখন ভাল লাগত। একটা ছেলে অত দূর থেকে কলকাতায় পড়তে এসে অমান সামান্য কারণে একটা দেশের মানুষের চরিত্র সম্পর্কে এ রকম ইঙ্গিত দিতে যাবে কোন যুক্তিতে?
নিস্তেজ হয়ে অনিমেষ শুয়ে শুয়ে দরজা দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিল। বারান্দায় জ্বেলে রাখা আলোয় বৃষ্টি মাখামাখি হয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। উত্তেজুনা কমে আসায় ক্রমশ এক ধরনের অবসাদ এল। অনিমেষ কথাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, ইউ ইন্ডিয়ানস আর উইদাউট ব্যাকবোন, কাওয়ার্ড। শব্দগুলো হঠাৎ কেমন নিরীহ হয়ে গেল, সে যেন সামান্য ওপরে উঠে এসে বুকে পড়ে শব্দগুলোকে দেখতে লাগল। এই তিন বছরে কলকাতা শহরে সে যে জীবন কাটিয়েছে, প্ৰতিদিনের খবরের কাগজে অথবা চারপাশের যে মানুষগুলোকে নিত্য সে দেখেছে তারা কী ধরনের ? জলপাইগুড়ি শহর থেকে সেই প্ৰথমবার ট্রেনে চেপে আসবার সময় ভারতবর্ষের মাটিতে নতুন কিছু গড়ার জন্য যে ভাঙচুর শুরু হয়েছে বলে উত্তেজনায় টগবগে হয়েছিল সে, এই কয় বছরে তা কোথায় মিলিয়ে গেছে। এখন এই শহরের মানুষগুলোর দিকে তাকালে মনেই হয় না। তারা বা তাদের কেউ কেউ ও সব কথা কখনও ভেবেছিল । গড্ডলিকা প্রবাহ সে বইতে পড়েছিল। কিন্তু সেটা কী জিনিস তা এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা না দেখলে বুঝত না । মেরুদণ্ডহীন কথাটা কি একদম প্রযোজ্য নয় ? এখনও ভারতবর্ষের নবাবুই ভাগ মানুষ জানে না যে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। যারা জানে তাদের অনেকেয়ু মানসিকতায় ব্রিটিশ শাসন আর স্বাধীন ভারতবর্ষের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই ।
তার কলেজে পড়ার ব্যাপারে মহীতোষের সঙ্গে কিছুটা তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। মুহীতোষ চাননি। যে অনিমেষ স্কটিশচার্চ কলেজে ভরতি হোক। ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে পড়াশুনােটা তিনি পছন্দ করেন। না। তাছাড়া হােষ্টেলটা যখন কলেজ কম্পাউন্ডে নয়। তখন কলকাতার রাস্তায় ছেলেকে হাঁটাচলা করতে দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। প্ৰায় আট মাস বিছানায় শুয়ে থেকে অনিমেষ খুব কাহিল এবং রোপা হয়ে গিয়েছিল, দ্রুত হাঁটাচলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। একটু নজর করলেই বোঝা যায় যে সে একটা পা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বস্তৃত কলকাতার কলেজে পড়তে পাঠানোর ইচ্ছাই চলে গিয়েছিল মহীতোষের । মাসকবরি রিকশার ব্যবস্থা করে জলপাইগুড়ির বাড়ি থেকে আনন্দচন্দ্র কলেজে পড়ার ব্যাপারেই জোর দিয়েছিলেন তিনি । কিন্তু মানুষের সহজে শিক্ষা হয় না, বিছানায় শুয়ে স্তয়ে অনিমেষ যে আরও একগুঁয়ে হয়ে গেছে সেটা প্ৰমাণ হল তার কলকাতায় পড়তে যাওয়ার জেদে। আর একবার ঠাকুরদা সরিৎ শেখর তাকে সমর্থন করলেন । দুর্ঘটনা বারবার ঘটে না। প্রায় বাধ্য হয়ে মহীতোষ ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় এলেন, এ বার একা ছাড়েননি। প্রেসিডেন্সির পাশেই হিন্দু হােস্টেল, কিন্তু সেখানে ভরতি হওয়ার চেষ্টা বিফল হল । প্রথম ডিভিশনে পাশ করেও যে কোনও কোনও কলেজে জায়গা পাওয়া যায় না সেটা জেনে হতবাক হয়ে গেলেন মাহীতোষ । ফলে কলকাতার তিনটি মিশনারি কলেজের দিকে কুঁকলেন মাহীতোষ, সেন্ট জেভিয়ার্সে মন মানল না । সব স্ আসল জায়গা বলে মনে হল কলেজের মধ্যেই ফুেষ্ট্রেল, রাস্তায় সুভাষচন্দ্ৰ বসু পড়েছেন। এই কথাটা বোঝাতে পারেননি। মা-মরা ছেলেরা বোধ হয় চিরকাল এ রকম জেদি হয় ; ছেলের সঙ্গে দুদিন কলেজে গিয়ে ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অসহায় বোধ করেছিলেন তিনি। গাদা গাদা মেয়ে রংবেরঙের পোশাকে জটলা করছে কলেজ চত্বরে, তাদের কারও কারও ভঙ্গি বেশ বেপরোয়া । এখানে ছেলের পড়াশুনা কতদূর হবে সন্দেহ থেকে গেল তাঁর। যে চিন্তাটা আঁকে আরও বিহ্বল করে দিচ্ছিল তা হল সায়েন্সের বদলে অনিমেষ আর্টসে অ্যাডমিশন নিয়েছে। বাবা হয়ে ছেলেকে ডাক্তার করার বাসনা জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি দেখলেন। এখানেও অনিমেষের ঠাকুরদার রায়ই শেষ কথা হল। যাওয়ার আগে বার বার তিনি ছেলেকে উপদেশ দিয়ে গেলেন। পড়াশুনা করে ভাল রেজাল্ট করতে হবে। এই কলকাতা শহর নতুন ছেলেদের নিষ্ট করে দেবার জন্য শুত পেতে থাকে, অনিমেষ যেন কখনও অসতর্ক না হয়। কোনও বন্ধুবান্ধবকে বিশ্বাস করা উচিত হবে না। কারণ বিপদের দিনে তারা কেউ পাশে থাকবে না। কলেজের ইউনিয়ন থেকে যেন সে সাত হাত দূরে থাকে কারণ মধ্যবিত্ত সংসারের ছেলের এই বিলাসিতা সাজে না। রাজনীতি যাকে নেশা ধরায় তার ইহকাল পরকাল একদম ঝরঝরে হয়ে যায়। যাদের বাপের প্রচুর টাকা আছে তারাই ও সব করুক, যেমন জওহরলাল, চিত্তরঞ্জন, সুভাষ বোস ।
ধাধায় এ সব উপদেশ অনিমেষ মন দিয়ে শুনতে বাধ্য হয়েছিল। সে লক্ষ করেছিল বাঝা যখন কথা বলেন তখন তিনি ভুলে যান ভারতবর্ষ এখন স্বাধীন। কিন্তু বাবার একটা কথার সঙ্গে সে একমত, ইতিমধ্যে তার একটা বছর নিষ্ট হয়ে গিয়েছে। মন্টু তপন অর্ক এখন সেকেন্দ্র ইয়ারে পড়ে। মানুষের জীবন বড় অল্প সময়ের, তা থেকেও যদি একটি বছর অকেজো হয়ে যায় তা হলে সেটা কম ক্ষতি নয়। অনিমেষ মহীতোষকে কথা দিয়েছিল সে সময় নষ্ট করবে না। তাই বি. এ. পাশ করা পর্যন্ত সে শুধু দেখে গেছে চারধার। স্কটিশচার্চের ছাত্র ইউনিয়ন অবশ্যই ছাত্র ফেডারেশনের দখলে কিন্তু মাঝে মাঝে মিছিল করা ছাড়া তাদের কোনও সক্রিয় ভূমিকা ছিল মা। কোন প্রান্তে কী হল তার জন্য ওরা মিছিল বের করে। অথচ কলেজের জলের কলটা তিনখারাপ হয়েছিল সে দিকে খেয়াল করেনি। অনিমেষ শুধু ওদের দেখে গিয়েছিল এই কাটি বছর।
দ্রুত হাঁটা অথবা শারীরিক উদ্যম ফিরে আসতে যে এতটা সময় লাগবে তা সে ভাবেনি, মনে মনে ভেবে যাওয়া ছাড়া তার কোনও উপায় ছিল না। আশ্চর্য, কেউ তাকে কোনও দিন জিজ্ঞাসা করেনি ऊात्र श्रांस के श्यूछ!
ত্রিদিব কখন এসেছে টের পায়নি। অনিমেষ। ঘরে আলো জ্বালাতেই চোখে লাগল, হাতের আড়ালে চোখ রাখল। ক্রিদিব এক নয়, সঙ্গে আরও দু’জন এসেছে। খাওয়ার ঘরে ওদের দেখেছে কিন্তু আলাপ হয়নি। এই হােস্টেলে দুটাে খাওয়ার ঘর, একটা বিদেশিদের অন্যটা ওদের। কে এই নিয়ম চালু করেছিল জানা নেই। তবে এখনও তা চলে আসছে। অনিমেষ উঠে বসতে একটা তীব্ৰ গন্ধ পেল ; ফ্রিদিধরা দাঁড়িয়ে আছে আর ওদের শরীর থেকে চুইয়ে পড়া জলে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। তিনজনেই ভিজে কাক । অনিমেষ ত্রিদিবকে বলল, “কী ব্যাপার, বৃষ্টিতে ভিজে এলে, অসুখ করে
ব্রিদিব হাসল। বৃষ্টিতে ভিজলে চুলগুলো এমন নেতিয়ে থাকে যে অনেক সময় মানুষের চেহারা পালটে যায় ! ত্রিদিবকে এখন অন্যরকম দেখাচ্ছে, ‘আরো এরকম ফাইন বৃষ্টির মধ্যে রোড দিয়ে হাঁটতে যে কী আরাম তা তুমি বুঝবে না। নিজেকে দেওয়ানা মনে হয়।”
“কিন্তু নিমোনিয়া হলে কী হবে ?” কথার ভঙ্গিটায় অনিমেষ মজা পেল। ‘কবিদের নিমোনিয়া হয় না ; ঈশ্বর কবিদের সিনায় এত রকমের ভালবাসা দিয়েছেন যে সেখানে নিমোনিয়া জায়গা পায় না।” কথা বলতে বলতে ব্রিদিব নিজের অস্থিরতা লুকোতে পারল না ! এ বার অনিমেষ লক্ষ করল ওরা তিনজনে ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। ত্রিদিবের গলার স্বরটা একটু অন্যরকম, অনিমেষ, মাই রুমমেট, এদের সঙ্গে তোমার আলাপ আছে ? নেই ? আমরা এই হােষ্টেলৈ থাকি। তবু কেউ কাউকে চিনি না, আমরা একই ত থাকি। তবু মানুষের আজও জানাশোনা হল না। এ হচ্ছে দুর্গা—দুর্গাপদ, গোবিন্দ।” আঙুল দ্বিতীয়জনকে দেখােল ত্রিদিব । গোবিন্দ যার নাম সে যখন কথা বলল, তখনই গান্ধটার রহস্য বুঝতে গ্লািনীমদ্যপানের প্রতিক্রিয়াপ্রতিটি শব্দেী) তাঁর থ্রাষ্টেব্রিদিব) এবং দুর্গপদ মৈদ খেয়েই এসেছে। গোবিন্দর কথায় বিদ্ররূপ থাকলেও অনিমেষ জবাব দিল না । এটা জানা কথা, মৃত্ত
হলে মানুষের চিন্তা-ভাবনা অসংলগ্ন হয়ে যায়, তখন যুক্তি অচল । সে শুধু ত্ৰিদিবকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি মদ খেয়েছ ?”
কলকাতার এই প্রবাস-জীবনে ব্রিদিবকে গৃহসঙ্গী পেয়ে খুশি হয়েছিল অনিমেষ। ছেলেটা কবিতা লেখে, অন্য রকম কবিতা, মনটা ভাল। অবশ্যই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে কিন্তু আচরণে কোনও চালিয়াক্তি নেই। শুধু, অনিমেষের ইচ্ছে হােক না হােক ত্রিদিব ওকে কবিতা শোনাবেই। কিন্তু আজ অবধি ত্ৰিদিবকে সে মদ্যপান করা অবস্থায় দেখেনি। কেউ মদ খেলেই সেই অনেক বছর আগের দেখা মহীতোষের চেহারাটা ওর সামনে উঠে আসে। মত্ত মহীতোষ আর শীর্ণ চেহারার ছোটমাকে ভুলে গেছে অনিমেষ, তবু— । মানুষ দুঃখ পেলে নাকি মদ খায়, বড়লোেকরা মেজাজ আনতে ড্রিঙ্ক করে। কিন্তু ত্রিদিকের ক্ষেত্রে তো এ দুটোর কোনও প্রয়োজন আছে তার জানা নেই। তা ছাড়া এই হােষ্টেলের যে নিয়মাবলী দরজায় টাঙানো তাতে এ ধরনের আচরণের জন্য কঠিন শাস্তির वाञ्छ् छशष्ठ् ।
ফ্রিদিব কথাটার জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জানলার দিকে। পাল্লা দুটো খুলে দিতে দিতে বলে, ‘কেন, মদ খেতে তোমার খারাপ লাগে ? পেটে মদ মাথায় বৃষ্টি—লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক সৃষ্টি। তুমি খালে ?”
না।” নিজের অজান্তেই শব্দটা জোরে বলল অনিমেষ ।
‘কোন গুড়ি বয় ? মদ খেলে মানুষ খারাপ হয়ে যায় ? গোবিন্দ টিপ্পনী কািটল জড়ানো গলায় । অনিমেষ দেখল দুর্গাপদ জামার তলা থেকে একটা চ্যাপ্টা বোতল বের করছে। নাক সিটিকে অনিমেষ বলল, মদ খেলে মানুষ কী হয়। আমি জানি, আমার দেখা আছে।”
দুৰ্গাপদ খিকখিক করে হাসল, অনেকের জামাই ষষ্ঠী থাকে না, ভাইফোঁটা নিতে নেই, তোমার বুঝি এরকম ব্যাপার—মদ খেতে নেই!”
ব্রিদিব জানােলা খুলে দিতেই হু-হু করে বৃষ্টির জল ঘরে ঢুকতে লাগল। অনিমেষ দেখল ওর পড়ার টেবিল জলে ভিজে যাচ্ছে। সে তাড়াক করে নেমে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে ত্ৰিদিবের কাছে বাধা পেল। দু’হাত দু’পাশে বাড়িয়ে ত্রিদিব খলিল, “নিয়ম না ভাঙলে নিয়মটাকে বোঝা যায় না, মাই
“আমার বইপত্র ভিজে যাচ্ছে।”
*কাল আমি শুকিয়ে দেব।”
অনিমেষ লক্ষ করল ত্রিদিব ভাবাপুপ্ত অবস্থায় কথা বললে হিন্দি শব্দ একদম বলে না । যেমন কবিতা লেখার সময় ওর হয়। হাল ছেড়ে দিয়ে সে ফিরে আসছিল এমন সময় গোবিন্দ ওর সামনে এসে দাঁড়াল, ইনড়াইরেক্ট না ডাইরেক্ট?” বোতলটি সামনে ধরে সে ইঙ্গিত করতেই অনিমেষ মাথা নাড়ল, “আমি খাব না ।”
‘তা কি হয়! এক যাত্রায় পৃথক ফল ।”
“আশ্চর্য! আমি না খেলে তোমরা জোর করে খাওয়াবে নাকি ?”
ব্রিদিব এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখল, সংস্কার ভাঙার কথা হচ্ছিল না সেদিন, তুমি নিজেই তো সংস্কারগ্রস্ত । নাও, খেয়ে নাও-লাথি মারো বিবেকের মাথায় ।”
‘ওটা শাস্তা নয়, আমি মরে গেলেও খাব না ।” অনিমেষ ফুসে উঠল। হঠাৎ কী হল ব্রিদিবোৰু, গুরু চোেখ মুখ হিংস্র হয়ে গেল। ধস্তাধস্তি শুরু হল বৃষ্টিভেজা ঘরটায়। অনিমেষ ভােবল চিৎকার করে ওঠে। সুপার ছুটে এলে এদের হাত থেকে বঁচা যাবেই। কিন্তু তারপর যেটা হবে সেটা ভেবে সে চিৎকার করল না। নিঃশব্দ ছিল বাকি তিনজনই। সে কিছুতেই ওই তিন প্রায়-মাতালের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। প্রচণ্ড শক্তিতে ওরা অনিমেষকে মাটিতে চিত করে ফেলে মুখের মধ্যে মদের বোতল গুজে দিল । গলাগলি করে নেমে আসা বিশ্ৰী স্বাদের তরল পদার্থটিকে জিভ দিয়ে প্রতিরোধ করতে পারল না। অনিমেষ। উগরে ফেলতে গিয়ে কিছুটা পেটের ভেতর চলে গেল। দুৰ্গন্ধ! অনিমেষ শেষবার দাঁতে দীত চেপে প্রতিরোধ আনিছিল। গোবিন্দ খিচিয়ে উঠল, “শালা খাচ্ছে না। ঠিক আছে, ওর শাস্তি হল আগাগোড়া ন্যাং দু’জন সুন্নত্ত্ব কিছু | ধরেছে। অন্যজন দুয়ে গেল। পরবর্তী আক্ৰমণ কী হবে সেটা ভাববার আগেই একটা অস্ফুট আৰ্তনাদ শুনতে পেল
গোবিন্দ বলছে, “আরো বাস, এ শালার থাইতে এত বড় দাগ কীসের ?” চোখ বন্ধ অনিমেষের শরীরে আচমকা সেই যন্ত্রণাটা ছড়িয়ে পড়ল। সে শূন্যে সামান্য লাফিয়েই মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। ত্রিদিব ওকে ছেড়ে দিয়ে অপারেশনের জায়গাটায় হাত দিয়ে অন্য রকম গলায় কথা বলল, “কী হয়েছিল। এখানে ? কীসের দাগ ?”
জবাব দিল, “বুলেটর।