বাস থেকে নেমে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরছিল তিতির। দেরি হয়ে গেছে। বড দেরি হয়ে গেছে। মা এত করে তিনটের মধ্যে ফিরতে বলল, সেই এখন তিনটে চল্লিশ। কী কুক্ষণে যে দেবস্মিতার বাড়ি গেল। আজ !
তিতিরের আজ বাড়ি থেকে বেরোনোর একটুও ইচ্ছে ছিল না। কি করবে, বন্ধুরা জোর করে টেনে নিয়ে গেল। মাধ্যমিক পরীক্ষা কবে শেষ হয়ে গেছে, মাসখানেক কারুর সঙ্গে যোগাযোগ নেই তাই আজি জ্যের আড্ডার আয়ােজন । দেবস্মিতাদের বাড়ি। গেটটুগেদার। লাঞ্চ । অবিরাম ভিডিও ৷ হই-হল্লা | আমন একটা দঙ্গলে গিয়ে পড়লে সহজে ছাড়ান পাওয়া যায় !
দোকানপাট এখনও খোলেনি। চৈত্রের দুপুর সবে দিবানিদ্রা সেরে আড়মোড়া ভাঙছে। রোদের বস্তািবত এখনও বেশ প্রখর হাঁপ জিরোল দুপালক । মরচে ধরা লোহার গেট হা হয়ে আছে। যেমন থাকে ! গ্যারেজঘরে প্রেস কলিজাবেল টিপতেই দরজা খুলে গেছে। খুলেছে সন্ধ্যার মা । তাকে ভেদ করে বড়ঘর টপকে
—সঙ্গে তোমার দাদা গেছে ।
—কিছু বলে গেছে ?
-কই, না তো !
সন্ধ্যার মা’র শেষ উত্তরের আগেই তিতির দোতলায় । বাঁয়ে কাকিমাদের ঘর তালা বন্ধ । ডান দিকে তিতিরদের ঘর দুটােও । মাঝখানের প্যাসেজে একা এক গড়াগড়ি খাচ্ছে রোদুর।
চাবি কোথায় আছে। তিতির জানে। প্যাসেজের মাঝামাঝি টেলিফোন স্ট্যান্ড, স্ট্যান্ডের ঢাকার নিচে চাবি রেখে যায় মা ।
ধীরেসুস্থে দুটাে ঘরেরই তালা খুলল তিতির। নিজেদের ঘরে ঢুকতে গিয়েও কি ভেবে পাশের ঘরে এসেছে। ইশ, যা ভেবেছে তাই । বিশ্ৰী ছত্রাকার হয়ে আছে গোটা ঘর। এতদিন পর বাবা বাড়ি ফিরবে, আজও এ ঘর এমন অগোছােল থাকার কোনও মনে হয় !
ঝটপট চোেখ মুখে একটু জল দিয়ে এসে কাজে নেমে পড়ল তিতির । ত্বরিত হাতে। লঘু ছন্দে । বাবার খাটে ফরসা চাদর বিছিয়ে দিল একটা । সব দিক টান করে তেশকের নিচে গুজে দিল সযত্নে । পরিষ্কার পিলোকভার বার করে ঢাকা পরাল বালিশে, পরিপাটি করে মাথার দিকে রাখল। চেপে চেপে ফুলিয়ে দিল বাবার প্রিয় গোদা) পাশবালিশ। খাটের ব্যাজুতে বাবার পাজামা পাঞ্জাবি ভাঁজ করে রাখল, সঙ্গে সাদা তোয়ালে। দ্রুত হাতে কোনার টেবিল সাফসুফ করে নিল একটু। দাদার বিদেশি ডটপেন টেবিলের তলায় গড়াচ্ছে, তুলে ড্রয়ারে ভরল। ময়ুরপাখা ঝাড়ন আলতো বোলাল কাঠের আলমারির গায়ে, টেবিলে, বুককেসে, দাদার বিছানায়। আলনাতে ডাই প্যান্টশার্ট পাজামা সবই প্ৰায় দাদার, আলগা গুছিয়ে রাখলে এক এক করে ।
উফ, দাদাটা যেন কী ! সব কিছুতে এত আমার আমার ভাব অথচ একটা জিনিসের ওপর এতটুকু মায়া নেই!! দামি অ্যাভিস জিনিসটা পর্যন্ত হেলাফেলায় মাটিতে গড়াচ্ছে। টু-ইন-ওয়ানের চতুর্দিকে গাদাখানেক ক্যাসেট যেমন তেমন ছড়ানো !
দাদার জিনস আলমারিতে তুলে তিতির দরজায় সরে এল। ঘাড় অল্প কাত করে ভুরুতে ভাঁজ ফেলে নিরীক্ষণ করল পুরো ঘরটাকে । নাহ, মোটামুটি মন্দ সাজানো হয়নি। দেরি করে বাড়ি ফেরার ঝাড়টা বোধহয় বেঁচে গেল ।
নিজেদের ঘরে এসে সালোয়ার-কামিজ ছেড়ে নাইটি পরল। তিতির । নিজেদের ঘর মানে তিতির আর তিতিরের মা’র ঘর। এ ঘরে কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা নেই। ব্রিটিশ আমলের কুড়ি বাই ষোলো ঘরে ডবল বেড খািট আলমারি ড্রেসিংটেবিল টিভি শোকেস, সবই ঝকঝকে তকতকে। শুধু আলোটাই যা কম। এ ঘরে । সকালের দিকে পুবের জানলা দুটাে দিয়ে তাও যা হােক আলো আসত, পাশেই পাঁচতলা ফ্ল্যােট উঠে রুখে দিয়েছে আলোটুকু । উত্তরের জানলারাই যা ভরসা এখন। তবে ওই দুটাে জানলা দিয়েও বাইরের খুব একটা কিছু দেখা যায় না । নীচের এক ফালি জংলা ঝোপ, ঝোপের গায়ে তিতিরদের আধভাঙা পাঁচল, তার পাশে কাচের টুকরো বসানো এক খাড়াই দেওয়াল, দেওয়ালের ওপারে রুটুদের ডানামেলা চারতলা বাড়ি আর এক চিলতে আকাশ, ব্যস।
এতে অবশ্য কাজ চলে যায় তিতিরের। জানলার সামনে চোখ বুজে দাঁড়ালে ঠিক একটা গন্ধ পেয়ে যায় সে। তাদের বাড়ির সামনের দিকের খোলামেলা জায়গািটার গন্ধ। রোদে পোড়া দুপুর ক্রমশ জুড়িয়ে আসার গন্ধ। মায়াবী বিকেল মাখা পৃথিবীর গন্ধ। ওই ব্ৰাণ বলে দেয় সামনের রাস্তায় লোক চলাচল বাড়ছে, না কমছে, উল্টো পারের লালে। লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ কতটা বুকে আছে বুড়োটে বাড়িটার দিকে, সাইকেল রিকশার অবিরাম হাঁকাহাকিতে কিভাবে টগবগ ফুটছে গোটা পাড়া, রোদূর কেমন বিরস মুখে সরে যাচ্ছে ঢাকুরিয়া ব্রিজের দিকে ।
ইচ্ছে করলে তিতির অবশ্য দৃশ্যগুলো চর্মচক্ষেও দেখতে পারে। সামনের ঝুলবারান্দায় গিয়ে। তবে এখন তার জো নেই। বারান্দাটা তার বড় কাকার । লাগোয়া ঘর দুটােতে তালা এখন । কাকিম আউট। আজ শনিবার, অ্যাটমকে নিয়ে আঁকার ক্লাসে গেছে কাকিম, সেখান থেকে সুইমিং ক্লাব ঘুরিয়ে টেবিল টেনিস কোচিং-এ নিয়ে যাবে। ফিরতে কম করে সাতটা ।
তিতির উত্তরের জানলায় এসে দাঁড়াল। গ্যারেজ ঘর থেকে একটানা শব্দ ভেসে আসছে। মোটা মোটা দেওয়াল টপকে নিচের ওই আওয়াজ দোতলার এই পিছন দিকটায় তেমন প্রকটভাবে পৌঁছয় না । তবু শব্দটা থাকে সারাদিন। ঘটাংঘট । ঘটাংঘট । কোলাহলহীন সময়ে ওই একঘেয়ে শব্দের সুরে বড় নির্জন হয়ে ওঠে বাড়িটা।
অথচ বাড়ি এখন ঠিক তত নির্জনও নয় । তিতির জানে, এ মুহূর্তে একতলার ঘরে দাদু আছে, ছোটকাকারও বাড়ি থাকা বিচিত্র নয়, সন্ধ্যার মাকে তো দেখেই এল, মিনতিদিও নিশ্চয়ই টুকটাক কাজ সারছে একতলায়। এ ছাড়া প্রেসঘরে মেশিনদাদু আর কম্পোজিটার দুজন তো আছেই। তবু যে কেন বাড়িটাকে এত নিঝুম লাগে এখন !
মেঘহীন আকাশ অনেক উচুতে উঠে আছে। রুস্টুদের রাড়ির ডগায় লেপটে আছে নিস্তেজ সূর্যরশ্মি। ভাঙা পাঁচল টপকে একটা ছােট্ট ঘূর্ণি ঢুকে পড়ল জংলী ঝোপে। কাঠিকুটি কুড়িয়ে পালাতে গিয়েও নেমে যাচ্ছে বার বার | পাক খেয়ে মরছে।
হঠাৎই তিতিরের মনের ভেতর থেকে অন্য মন কথা বলে উঠল,— তিতির, তোমার বাবা। আজ ७ञ८ • ।।
তিতির শিউরে উঠল । কেউ জানে না। তিতিরের আসল মনটার ভেতরে, অনেক অনেক ভেতরে, আলাদা একটা ছোট্ট মন ঘাপটি মেরে থাকে। খুব ছোট্ট । সৰ্যেদানার মতন । না না, তার থেকেও ছোট । পোস্তদানার মতন । হুটহাট যত সব বেয়াড়া কথা বলতে শুরু করে মনটা । যা ইচ্ছে তাই বলে । আর আশ্চর্য, কথাগুলো সব ফলেও যায় !
এই যেমন কাল রাত্রে মা খাটে বসে স্কুলের খাতা দেখছে, তিতিরের চােখ শব্দ কমানো টিভির পদায় মগ্ন, দুম করে মনটা বলে উঠল,— একটু পরেই বাড়িতে একটা হাল্লাগুল্লা হবে তিতির।
তিতির বলল,— বেট ! —বোট । হলও তাই । দাদা আডডা মেরে নটার পর বাড়ি ফিরল, ফিরেই ও ঘরে গৗকগাঁকি করে। রোলিংস্টোন চালিয়ে দিয়েছে, মা খাতা ফেলে ও ঘরে গিয়ে কি বলল, ওমনি সঙ্গে সঙ্গে ধুন্ধুমার ! দাদা কাঁই কাঁই করতে করতে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে, রাত্তির এগারোটা অবধি তার টিকিট নেই ।
গত মাসে শেষ রোববার ছোটকাকা বলল পার্ক স্ট্রিটে চাইনিজ খাওয়াবে। সন্ধে থেকে সেজেগুজে বসে আছে। তিতির, টুক করে মন বলল,— ড্রেসটা ছেড়ে ফ্যালো তিতির, ছোটকাকা আজ তোমার কথা ভুলেই গেছে।
তিতির বলল,— লাগি শর্ত ? — লাগি শর্ত। ও মা, অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল কথাটা । ছোটকাকা সেদিন বাড়িই ফিরল না। ফিরল পাঁচ দিন পর। কোন ফিল্ম-পার্টির সঙ্গে নাকি আউটডোরে চলে গিয়েছিল। চাঁদিপুর। ফিরে এসে দু হাতে কান মূলল,—এম, একদম তোর কথা মনে ছিল না রে!
পোস্তদানা মন আবার কুনকুন করছে— তোমার বাবা আজ রিলিজ হবে না। তিতির । তিতির বিড়বিড় করে বলল,— হতেই পারে না । হসপিটালে কাল আমার সামনে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে মা’র কথা হয়েছে। আজ বাবাকে ছেড়ে দেবে। মা, দাদা এক্ষুনি এসে পড়বে বাবাকে নিয়ে ।
—নো চান্স । তোমার বাবা আজ আসতেই পারে না । —ইশশ, বাবা আজ আসবেই। — বিস্বাদ মুখে জানলা থেকে ফিরল তিতির । বাবা আজ দু সপ্তাহ হল বাড়ি নেই। ঠিক ঠিক হিসেব করলে পুরো পনেরো দিন। যদি অবশ্য হসপিটালে ভর্তি হওয়ার রাতটাকে বাদ দেওয়া হয়। ক’দিন ধরেই মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা হচ্ছিল বাবার, টুকটাক পেইন কিলার খেয়ে চেপে রাখছিল। সেদিন সন্ধেবেলা যন্ত্রণায় প্রায় সেন্সলেস। ডাক্তার অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। কি কেস ? না, লিভার গেছে। তা লিভারের আর দোষ কি ! তার ওপরে তো কম অত্যাচার যায় না ! কেন যে বাবা ওসব ছাইপােশ গেলে । ভাল লাগে না, একটুও ভাল লাগে না। তিতিরের । এবার থেকে বাবাকে কড়া ওয়াচে রাখতে হবে ।
প্যাসেজে ফোন বাজছে । অন্যমনস্ক পায়ে ফোনের দিকে গেল। তিতির । —কে ? তিতির কথা বলছ ? আমি ছন্দা আন্টি । তিতির সামান্য উচ্ছসিত হল,— কেমন আছ আন্টি ? —ভাল । তোমার বাবা বাড়ি চলে এসেছেন ? —এখনও আসেনি। মা আনতে গেছে। —ও । আচ্ছা, তোমার আঙ্কল হসপিটালে গেছে কিনা জানো ? —না তো আন্টি । দাদা গেছে । আঙ্কলেরও কি হসপিটালে যাওয়ার কথা ? —ও, তুমি জানো না ? আসলে তোমার আঙ্কল, নার্সিংহােম থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল
তো, আমি ভাবলাম বোধহয় তাহলে যাবে । … দেশ থেকে লোক এসেছে জরুরি খবর নিয়ে .
—আজি আঙ্কলের ল্যান্সডাউনের চেম্বারা আছে না ?
—হাঁ । ঠিক আছে, আমি একটু পরে ওখানেই ফোন করে নিচ্ছি। তোমরা সবাই কেমন আছ ? ভাল আছ তো ?
—হা আন্টি । টেগটো কেমন আছে ?
—টােটাে আর বাড়ি থাকে কই । পরীক্ষার পর থেকে তো সারাক্ষণ উড়ছে। রাখি এখন, ?
টেলিফোন রেখেও রিসিভারটা খানিকক্ষণ খুঁয়ে রইল তিতির । ডাক্তার আঙ্কল কি গেছে হসপিটালে ? যেতেই পারে । বাবাকে নিয়ে যা ভাবনা আঙ্কলের । মা-টা যেন কী । কতবার করে। আঙ্কল বাবাকে নার্সিংহােমে ভর্তি করতে বলল, মা কেয়ারই করল না। কী এমন হাতিঘোড়া খরচা হত নার্সিংহােমে রাখলে ! ডাক্তার আঙ্কলের রেকমেন্ডেশান থাকলে ঠিক ডিসকাউন্ট পাওয়া যেত । মা কিছুতেই কথা শুনল না । এত্ত জেদ মার !
তিতিরের বাবা আর বড়কাকার পৃথক পৃথক দুই এলাকার মাঝখানে চওড়া প্যাসেজটা অনেকটা সেতুর মতো। পশ্চিমে সার সাের তিনটে কাচের জানলা, মাথায় লাল নীল সবুজ কাচের নকশা । শেষ বেলার আলো পড়ে রঙের মলিন ছটা তিরতির করে কাঁপছে প্যাসেজে ।
তিতির কপিনটা দেখছিল । দেখছিল। আর ভাবছিল নার্সিংহােমে কত আরামে থাকতে পারত। বাবা ! ধবধবে ঘর ! মিস্ক হােয়াইট নরম বিছানা ! এসি-র আরাম। সদাসতর্ক সেবা । তার বদলে হসপিটালের ওই আধানোংরা পেয়িং বেড, ছারপোকা, ধেড়ে-ইদুর আর নিমপাতা খাওয়া নার্স।
মা কি বাবাকে আরও কষ্ট দিতে চায় !
তিতির পায়ে পায়ে নেমে এল একতলায় ।
নীচে কন্দপের ঘর তালাবন্ধ । মানে ছোটকাকা হাওয়া । তিতির বড়ঘরে উকি মারল । জয়মোহন এক মনে বসে পেশেন্স খেলছেন ।
ঘরে ঢুকতে ঠিক সাহস পাচ্ছিল না। তিতির। সে নাইট পরে রয়েছে, নাইটি পরে নীচে ঘোরাঘুরি করলে তার দাদু রাগ করেন ।
জয়মোহন নাতনির উপস্থিতি টের পেয়েছেন, ডাকলেন,-আয় ।
দোনামোনা করে শেষ পর্যন্ত তিতির ঢুকেই পড়ল।
সামনের দিকের ওই ঘর এ বাড়ির যৌথ সম্পদ । আগে নাম ছিল বৈঠকখানা, এখন বলে বড়ঘর। নামই বদলেছে, চেহারা নয়। জন্ম থেকে এ ঘরের খুব একটা বদল দেখেনি। তিতির। মেঝে থেকে একটুখানি লতাপাত অাঁকা সবজে দেওয়াল। কড়ি বরগী থেকে লম্বার্ডটি ফ্যান ঝুলছে। তিন দেওয়ালে তিনটে পালিশ ওঠা কাচের আলমারি, পুতুল আর কপি-মেডেলে ঠাসা । পিছন দেওয়ালে এক অভিসারিকার অয়েল পেন্টিং। বিবর্ণ। পাশের দেওয়ালে একটা হলদেটে বাঁধানো ছবি। জয়মোহনের বাবা দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার রায়বাহাদুর কালীমোহন ব্রিটিশ গভর্নরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন । প্রখর অনুমানশক্তি ছাড়া পঞ্চান্ন বছর আগের তোলা ওই ছবির নাক মুখ চোখ কিছুই বোঝা যায় না। তবু ঝুলছে ছবিটা। ঘরের মাঝ বরাবর গোটা পাঁচেক সাবেকি আমলের টানা সোফা ইউ শেপে সাজানো । রঙ-জ্বলা কাশ্মীরি কাপেট । ঢাউস সেন্টার টেবিল ।
সেন্টার টেবিলে ছড়িয়ে রয়েছে তাস। সেদিক থেকে চোেখ না তুলে জয়মোহন বললেন, — মিনতি কী করছে রে ? এখনও আমার ছানা দিল না !
—দেবে, দেবে । ছটফট করছ, কেন ?
—আর কখন দেবে ! পাঁচটা বেজে গেল, এরপর আর হজম হবে ?
মিনতি সুদীপদের রাতদিনের কাজের লোক। জয়মোহনের দেখাশুনা করার জন্য সুদীপ একটা আলাদা টাকাও দেয় তাকে । তবু প্রয়ােজনের সময়ে জয়মোহনের সঙ্গে একটা সূক্ষ্ম লুকোচুরি খেলা চলে তার ।
তিতির হকি দিল,— মিনতিদি, দাদুকে ছানা দাওনি এখনও ?
মিনতির বদলে রান্নাঘর থেকে তিতিরদের সন্ধ্যার মা’র উত্তর ভেসে এল,— মিনতি তো এখানে gन्मदै ।
—নিঘাত মেশিনঘরে গেছে। এত চুলবুলি হয়েছে মেয়েটার ।
তিতির ফিক করে হেসে ফেলল। দাদুর মুখের যা ভাষা হচ্ছে দিনদিন । মিনতিদিও পারে। স্বামী নেয় না, দু বেলা পেটের ভাত জুটত না, কোথায় প্রাণ ঢেলে কাজ করবি, তা নয় কাকিমা না থাকলেই পুট করে প্রেসে চলে যায়। দুই কম্পোজিটারের সঙ্গেই সমান তালে মোেহব্বত চালিয়ে যাচ্ছে ।
তিতির বলল,— সন্ধ্যার মা আমাদের কি জলখাবার করছে দেখব ? খাবে কিছু ?
—দ্যাখ। যদি বেশি তেল-ফেলে ভাজা না হয় দিতে বল একটু ।
রান্নাঘর থেকে ঝপ করে ঘুরে এল তিতির,- ঘুগনি করছে। চলবে ?
—বল একটু দিতে । ক্ষিদে পেয়েছে। দীপু আসুক, ওই মিনতিটাকে আমি তাড়াচ্ছি।
—ওর পেছনে আদাজল খেয়ে লাগলে কেন ? তিতির হাসছে— ‘তাস দ্যাখো । মিলল
একবারও ?
—এবার মিলে যাবে। তুই ঘুগনিটা দ্যাখ ।
দাদুর জন্য ঘুগনি এনেও একটু সিঁটিয়ে গেল। তিতির । খুব অল্পই এনেছে, তবু কাকিম জানতে পারলে ঠিক বকবকি করবে। তিতিরদের ঘর থেকে দাদুর আবোল-তাবোল খাবার দেওয়া কাকিম একদম পছন্দ করে না । কাকিমাকেও দোষ দেওয়া যায় না। একটুতেই এমন পেটখারাপ হয়ে যায় !
জয় মোহনের শরীর ভাল মতোই গেছে। হার্টের অসুখ তাঁর বহুদিনের, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই। না ভুল হল । তার আগে থেকেই শরীর ভাঙছিল। বারো বছর আগে ব্যবসাটা পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পর থেকেই ভাঙনের শুরু । তবু তখনও বিস্তর হাঁটাচলা করতেন । ছোট্ট তিতিরকেবন্ধুবান্ধব নিকে আজ্ঞা জমাতেন। জয় মোহন।
ফিরে এসে মগ্ন থাকতেন রেডিওতে। পরের দিকে টিভিতে ॥ সনাত বছর আগে স্ত্রী গত হলেন, জয়মোহনের নিশ্বাসের কষ্টও বাড়তে লাগল। বাইরে বেরেনো কমে এল ক্রমশ । মেজাজও ক্রমে তিরিক্ষি। গত বছরের আগের বছর থেকে মানুষটা সম্পূর্ণ ঘরবন্দি। হৃদযন্ত্রে নতুন উপসর্গ এসেছে। ডাইলেটেড হার্ট। লেকের এক-আধজন পুরনাে বন্ধু তাও এখনও দেখা করতে আসেন মাঝে মাঝে । ভারী, কিন্তু বাইরের পৃথিবীর বাতাসের মতো। সারাদিন ধরে জয়মোহনের এখন তিনটিই কাজ । পেশেন্স। খিটখিটে । আর খাইখাই ।
তাস ফেলে চাকুম-চুকুম শব্দে ঘুগনি খাচ্ছেন জয়মোহন । শেষ মটরদানটাও তারিয়ে তারিয়ে চুষলেন। তারপর বাঁধানো দাঁতে একটু চিবিয়ে কোঁৎ করে গিলে ফেললেন দানাটা ।
—তোদের সন্ধ্যার মা তো বেশ বানিয়েছে রে !
—তাই ?
একটু ভাজা জিরের গুড়ো ছড়িয়ে দিলে আরও ভাল হত।
—একেই বলে নােলা ! তিতির মৃদু ধমক দিল,— তোমার তাসটা এবার মেলাও ।
জয়মোহন টাগরায় জিভ বোলাচ্ছেন,— ধুস, ও আর মিলবে না।
-হাল ছেড়ে দিলে ?
—হাল তো ছেড়ে বসেই আছি রে বুড়ি । এখন শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা। কথাটা বলেই হঠাৎ থম মেরে গেলেন জয়মোহন। খুব বেশি ভাল লাগার মুহুর্তে, অথবা খুব বিষগ্ন সময়ে জয়মোহন তিতিরকে বুড়ি বলে ডেকে ওঠেন। তিতিরের ঠাকুমার দেওয়া নামে ।
তিতির নিম্পলক দেখছিল জয়মােহনকে। এক সময়ে কত মজার মজার গল্প বলত দাদু ! নিজের ছোটবেলার গল্প । এই ঢাকুরিয়া জ্ঞায়গাটার শহর হয়ে ওঠার গল্প । কোথায় জলা ছিল, কোথায় আমবাগান ছিল, কোথায় শেয়াল ডাকত সব যেন দাদুর ঠোঁটের ডগায় ঘুরে বেড়াত সারাক্ষণ । তিতির শুনতে না চাইলেও দাদু শোনাবেই। ভাঙা রেকর্ডের মতো একই গল্প । একই ইতিহাস ।
কবে থেকে সব গল্প ফুরিয়ে গেল দাদুর । ঘরে আলো এখন অতি ক্ষীণ। চশমা খুলে চেপে চেপে দু চােখ ঘষছেন জয়মোহন। দৃষ্টি বাইরের মরা দিনের দিকে । আনমনে বলে উঠলেন,- তোর মা এখনও ফিরল না যে বড় ।
প্রশ্নটা মাকে ঘিরে নয়, বাবাকে ঘিরে । তিতির বুঝল। বাবার সঙ্গে ইদানীং দাদুর বাক্যালাপ প্ৰায় বন্ধ। কাটি। মুখোমুখি হলেই দুজনে লাল চোখে দেখে দুজনকে । গরগর। ঘড়ঘড়। তবু বাবাকে নিয়েই দাদুর সব থেকে বেশি উদ্বেগ । তিতির এ কথাও বোঝে ।
তিতির কোমল স্বরে প্রশ্ন করল,— তোমার মন কেমন করছে না। দাদু ? –উ-উ ? কই, না তো । –কার জন্য মন কেমন করবে ? ওই কুলাঙ্গারটার জন্য ? মন্দোমাতালটার জন্য ? —দাদু ভাল হবে না । তুমি যাকে গালাগাল করছ, সে কিন্তু আমার বাবা । —তোর বাবা তো আমার কি ? সে আমার ছেলে নয় ? তার সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব ! —পারবে । আমার আড়ালে । ~~~ইহহ, খুব যে বাবার জন্য দরদ ! তোর বাবা তোর দিকে তাকায় ? তোদের কথা ভাবে ? ফুলের মতো ছেলেমেয়ে দুটাে ফুটে উঠল, কোনওদিন তাদের চোখ মেলে দেখেছে ? সারাক্ষণ তো চুরু হয়ে আছে।
–আহ দাদু —তুইই শুধু ফোঁস করিস, তোর দাদা মোটেই এত সাপোর্ট করে না বাবাকে । বাপ্পা তোর বাবার নামে কত ঝুড়ি ঝুড়ি নালিশ করে যায় জানিস ?
—জানতেও চাই না । সাপোর্টও করি না । তিতির উঠে ঘরের টিউব লাইট জেলে দিল । আবার এসে বসেছে জয়মোহনের সামনে- বাবার অনেক দুঃখ আছে, এ কথা তো এগ্রি করবে ?
–তুই আর প্যােলা দিস না । কিসের দুঃখ, অষ্টা { —বা রে, বাবার একটা বিজনেসও লািগল না যে ! দুধের এজেন্সি নিল, লোকে টাকা মেরে দিল । ক্যাটারিং-এর বিজনেস ধরলা, জমল না … প্রেসটা.
—-ও ব্যবসার জানেটা কি, যে জমিবে ? জয়মোহন তপ্ত হলেন,– আমার রানিং বিজনেসটাকে এক্কেবারে শুইয়ে দিল ! লোনের পর লোন তুলে গেল ব্যাঙ্ক থেকে, ও ডি বাড়িয়েই যাচ্ছে, এদিকে পার্টিকে ক্রেডিট মাল দেওয়ার কোনও কমতি নেই। আর টাকা আদায়ের সময় বাবু চিৎপাত হয়ে শুধু ঠ্যাং নাচাচ্ছেন !
লোন, ও ডি, ক্রেডিটের মারপ্যাচ বোঝে না। তিতির। তবে হ্যা, বাবা লোকটা একটু কুঁড়ে আছে । মা বলে ঠাকুমাই নাকি পুতুপুতু করে বাবার বারোটা বাজিয়েছে। যে যাই বলুক, বারোটা বাজা লোকদের কি বাবার মতো অত বড় একটা মন থাকে ? এই দুনিয়ার সব লোকই যে ভাল এটা ভাববার মতো হার্ট কটা আছে ? বাবার ছাড়া ?
জয়মোহন সমানে গজগজ করে চলেছেন,- বাবার কথা ভুলে যা । মাকে দেখে শেখ । যে দিন থেকে তাের বাবার প্রেস্টার হাল ধরেছে সেদিন থেকেই কেমন চলছে রমরমিয়ে ! দুর্লভ তাে বলছিল, ও নাকি আর এক হাতে সামাল দিতে পারছে না, আরেকটা মেশিন বসালে ভাল হয় ।
জাগতিক সব বিষয়েই ইন্দ্ৰাণীর দক্ষতা অসীম । ইন্দ্ৰাণী অনেক বেশি হিসেখি ! গোছানো । গভীর শৃঙ্খলাপরায়ণ । আদিত্যর থেকে সে অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে। এসব তিতিরের ছোট থেকে
দেখা । তিতিরের ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর কী নিপুণ চালে সংসারটাকে ভাগ করে নিল ইন্দ্ৰাণী ! আদিত্যর প্রেসের তখন টরেটক্কা দশা, ইন্দ্রাণীর তখন শুধু স্কুলের চাকরিটাই সম্বল, তবু ইন্দ্রাণী আর দেওকের বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি। সুদীপ অনেক বড় চাকরি করে, গোটা সংসার সে মুখ বুজে টেনেণ্ডছে অনেক দিন, তাও ইন্দ্ৰাণী বুঝতে পারত সুদীপ যা করে সবটাই তার বাবা-মা’র মুখ চেয়ে করে। দাদা-বৌদিদের ভালবেসে নয়। মারি শ্রাদ্ধের সময় কথাটা বেশ ফুটে উঠেছিল তাদের হকভাবে । সুদীপেরও । রুনারও। পৃথগন্ন হওয়ার সময় সুদীপ স্বেচ্ছায় ভার নিল বাবার, চতুর খেলোয়াড়ের মতো ইন্দ্ৰাণী মেনে নিল ব্যবস্থাটাকে । আদিত্য হাউমাউ করা সত্ত্বেও । ইন্দ্ৰাণী জানত স্বশুরকে তখন তার কষ্টেশিষ্টে দু বেলা ভাত দেওয়ার ক্ষমতা হয়তো আছে, কিন্তু বুড়ো মানুষের ভােতই সব নয় । শ্বশুরমশাইয়ের হার্টের অসুখ দিন দিন বাড়ছে, তাঁর ডাক্তার ওষুধের রাজসিক খরচা চলিয়ে যাওয়া তার সাধ্যের বাইরে । যদি জোর করে ভার নেয়ও, বাপ্লা। তিতিরের টিউটর ছাড়াতে হবে, তাদের দুধটা মাছটা বন্ধ করতে হবে, আরও অনেক ছোটখাট সাধআহ্বাদ বিসর্জন দিতে হবে বহুদিনের জন্য । এত সব তথ্য তিতির জেনেছে তার মারি ক্রোধের সংলাপ থেকে ।
শুধু একটা কথাই তিতিরের মাথায় ঢোকে না । মা কেন জোর করে ছোটকাকাকে টেনে নিল
-সজ্জাক মা ফুলনি দিয়ে গেছে, তিতির অন্যমনস্ক মুখে বাটিতে চামচ ডোবাল । মা’র আরও অনেক না, নিয়েও এল না। অথচ দাদার হার কের সেকেন্ডারির সময়ে মা স্কুল থেকে ফিরেই ছেলেকে টিফিন দিতে ছুটত । পড়িমরি করে । তিতির যেদিন প্রথম বড় হল সেদিনও মা তাকে কিছুই শেখায়নি। কাকিম বুঝিয়ে দিয়েছিল সব । আদর করে । ভালবেসে ।
মা দাদাকে অনেক বেশি ভালবাসে । বাসুক গে যাক, তিতিরের বাবা আছে। বাইরে ট্যাক্সির শব্দ । তিতির লাফিয়ে উঠেও বসে পড়ল। জয়মোহনও নড়েচড়ে উঠেছেনমিটারের টুং-টুং-এ দুজনেই টানটান ।
ইন্দ্ৰাণীরা নয়, রুনা ফিরল। রুনা ঘরে ঢোকার আগে মিসাইলের বেগে ছুটে এসেছে আট বছরের অ্যাটম । ঘরে ঢুকেই সাঁ সাঁ দুটাে পাক খেয়ে নিল ।
পোস্তদানা মন কি আজও জিতে যাবে ? তিতির নিবে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে – কি রে, তোর টিটি ক্লাস আজ হল না ? —হচ্ছে। আমি করলাম না। দাদুর তাসগুলো ঘাঁটছে অ্যাটম । । তিতির চোখ নাচাল,— কেন ? —সুইমিং-এর সময় মাসলপুল হল তো, তাই। রুনা স্তব্ধ চোখে ছেলের লাফঝাঁপ দেখছিল, গটগট করে ভেতরে এল, ছেলের কান ধরে টােনল হিড়হিড়,~– এই তোমার মাসলপুল, অ্যা ? বাড়ি এসেই তিড়িংবিড়িং ? চলো, তোমার হবে আজ ।
অ্যাটম ঝাঁকি দিয়ে কান ছাড়িয়ে নিল,— আমার তখন সত্যিই পায়ে ব্যথা লািগছিল। বাড়ি এসে ভ্যানিশ হয়ে গেল ।
—পাজি কোথাকার । তিতির ভাই-এর গাল টিপে দিল,— আজি কী ড্রয়িং শিখলি রে ? —কোকোনটি ট্রি আর ভেজিটেবলস । . জয়মোহন নীরবে শুনছিলেন, টকাস করে বললেন,— বেগুন কী করে আকিতে হয় শিখেছিস ?
—বেগুন ? মানে ব্রিনজল ? বােধহয় শিখেছি। অ্যাটমকে খানিক চিন্তান্বিত দেখাল,— কেন ?
—অনেক দিন বেগুন ভাজা খাওয়া হয়নি । একটা একে দিস তো, ভেজে খাব ৷
বান ঠিক জায়গাতেই বিধেছে। রুনার ভুরুতে ভাঁজ,→ খেতে শখ হয়েছে বললেই হয়। অত প্যাচের কি দরকার ?
—থাক । জয়মোহন দামে গেলেন, — ডাক্তার বারণ করেছে, কোথেকে আবার কি হবে ।
রুনা কথা বাড়াল না । তিতিরের দিকে ফিরল,— দিদিরা এখনও ফেরেনি ?
পলকে তিতিরের মুখ আবার ফ্যাকাশে,— কি জানি কি করছে মা-র ।
রুনা অ্যাটমের হাত ধরে দরজার দিকে টানল । অ্যাটম এখনই ওপরে যেতে রাজি নয় । কাতর অনুনয় জুড়েছে,— আরেকটু থাকি না মা এ ঘরে । দাদু আমাকে কার্ডস চেনাবে।
—না । তোমাকে সামস প্র্যাকটিস করতে হবে ।
—কাল তো সানডে মা | কাল করব ।
—কালও করবে। আজও করবে। লাস্ট উইকের ক্লাস টেস্টে তুমি দুটাে কেয়ারলেস মিসটেক করেছ। টুয়েন্টিতে সিক্সটিন পেয়েছ, লজ্জা করে না ।
অ্যাটমের ঘাড় ঝুলে গেল। বােধহয় লজ্জাতেই। তাকে নিয়ে রুনা যখন প্রায় সিঁড়ির মুখে, জয়মোহন চেচিয়ে বললেন,— আজি কিন্তু মিনতি আমাকে ছানা দেয়নি ।
রুনার উত্তর উড়ে এল,— আজি দুধ আসেনি। কাগজে দেখেননি, আজ গভর্নমেন্টের দুধের গাড়ির স্ট্রাইক ।
—তাহলে তোমরা চা খােচ্ছ কী দিয়ে ?
—গুড়ো দুধ । ওতে ভাল ছানা হয় না।
জয়মোহন বিম মেরে গেলেন ।
দাদু-নাতনি বসে আছে শব্দহীন । টিউব লাইটের আলোতেও ঘরটা কেমন যেন নিম্প্রভ । বাইরের অন্ধকার থেকে একটা হাওয়া ঘুরে ফিরে আসছিল। সঙ্গে পথচলতি লোকেদের টুকরো কথাবাতা । প্রেস থেমে গেছে।
এক সময়ে জয়মোহন উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর দীর্ঘ ঋজু শরীর এখন বেশ কুঁজোটে মেরে গেছে। হাঁটার গতিও বড় মন্থর। নিজের ঘরের দিকে এগােতে এগােতে বললেন,- যাই, একটু টিভি খুলে বসি । খবর শুনব ।
তিতির বলল,— আমিও ওপরে যাচ্ছি।
—যাওয়ার আগে বাইরের দরজাটা বন্ধ করে যাস । দিনকাল ভাল নয়, হুটহাট লোক ঢুকে পড়তে পারে ।
নিজের বিছানায় শুয়ে একটা মিলস অ্যান্ড বুনের পাতা ওল্টাচ্ছিল তিতির। বইটা দারুণ রোমান্টিক । ম্যাচে হিরো বার বার নরম মেয়েটাকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। ছেলেটা যত তাকে দূরে সরায়, মেয়েটার আকর্ষণ বাড়ে তত। এরকম গল্প পড়তে পড়তে শিহরন জাগে তিতিরের শরীরে, চােখে জল এসে যায়। দুনিয়া ভোলে তিতির।
আজ বইটাতেও তিতিরের একটুও মন বসছিল না। নিচে একটা বেল বাজার প্রতীক্ষায় তার স্নায়ু সজাগ ।
সাড়ে আটটা নাগাদ বেল বাজল।। হরিণ পায়ে ছুটে যাচ্ছিল তিতির, পোস্তদানা মন ধমকে উঠিল,— থামো তিতির ।
শ্ৰান্ত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে সুদীপ । তাঁর পিছনে রেলিং ধরে এক-পা এক-পা করে রাল্পী । সবার শেষে ইন্দ্ৰাণী । তার মুখে যেন ডাঙশ মেরেছে। কেউ ।