চণ্ডীদাস

চণ্ডীদাস

শ্রীগৌরচন্দ্র

সুহই

বঁধু কি আর বলিব তোরে!
অলপ বয়সে, পিরীতি করিয়া,
রহিতে না দিলি ঘরে।।
কামনা করিয়া, সাগরে মরিব,
সাধিব মনেরি সাধা।
মরিয়া হইব, শ্রীনন্দের নন্দন,
তোমারে করিব রাধা।।
পিরীতি করিয়া, ছাড়িয়া যাইব,
রহিব কদম্ব তল।
ত্রিভঙ্গ হইয়া, মুরলী বাজাব,
যখন যাইবে জলে।।
মুরলি শুনিয়া, মোহিত হইবা,
সহজ কুলের বালা।
চণ্ডীদাস কয়, তখনি জানিবে,
পিরীতি কেমন জ্বালা।।*

———————

*এ পদটী ভাবসম্মিলনে সন্নিবেশিত হইয়াছিল।

বেহাগ

আজু কেগো মুরলী বাজায়।
এত কভু নহে শ্যাম রায়।।
ইহার গৌর বরণে করে আলো।
চূড়াটী বাঁধিয়া কেবা দিল।।
আহার ইন্দ্র-নীল কান্তি তনু।
এত নহে নন্দ সুত কানু।।
ইহার রূপ দেখি নবীন আকৃতি।
নটবর বেশ পাইল কথি।।
বনমালা গলে দোলে ভাল।
এনা বেশ কোন্‌ দেশি ছিল।।
কে বানাইল হেন রূপ খানি।
ইহার বামে দেখি চিকন বরণী।।
নীল উজলি নীলমণি।
হবে বুঝি ইহার সুন্দরী।।
সখীগণ কএ ঠারা ঠারি।
কুঞ্জে ছিল কানু কমলিনী।
কোথায় গেল কিছুই না জানি।।
আজু কেন দেখি বিপরীত।
হবে বুঝি দোঁহার চরিত।।
চণ্ডীদাস মনে মনে হাসে
এরূপ হইবে কোন্‌ দেশে?

———————
ইহা সম্ভোগ মিলনের পদ।
কথি—কোথায়। এনা—এমন। উজলি—উজ্জ্বল। কমলিনী—শ্রীরাধিকা।

নায়িকার পূর্বরাগ

* শ্রীরাধা কৃষ্ণের লীলা বর্ণ উদ্দেশ্যে শ্রীরাধাকে নায়িকা এবং শ্রীকৃষ্ণকে নায়ক সম্বোধন করা হইয়াছে।

।।কামোদ।।

সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম |
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ ||
না জানি কতেক মধু শ্যাম-নামে আছে গো
বসন ছাড়িতে নাহি পারে |
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে ||
নাম-পরতাপে যার ঐছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কি বা হয় |
যেখানে বসতি তার নয়নে দেখিল গো
যুবতী-ধরম কৈছে রয় ||
পাসরিতে করি মনে পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায় |
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে কুলবতী কুল নাশে
আপনার যৌবন যাচায় ||

———————

দেখিয়া বা গুণ শ্রবণ করিয়া সঙ্গমের (মিলনের) পূর্বে হৃদয়ে যে রাগ লোভ হয় তাহাকেই পূর্বরাগ বলা হইয়াছে।

“সঙ্গমের পূর্ব্বে যেই দেখিয়া শুনিয়া। জনমে রাগ লোভ হৃদয়ে পশিয়া।।
সেই পূর্ব্বরাগ …………………………. । ……………………………….।। ”
–ভক্তমাল

পশিল – প্রবেশ করিল। কতেক – কত। পরতাপে – প্রতাপে। ঐছন – এই রূপ। কৈছে – কি প্রকারে। পাসরিতে করি মনে – ভুলিব মনে করি। যাচায় – যাচিয়া দান করে।

।। তিরোতা (চিত্রপট দর্শন)।।

হাম সে অবলা, হৃদয় অখলা
ভাল মন্দ নাহি জানি।
বিরলে বসিয়া, পটেতে লিখিয়া
বিশাখা দেখাল আনি।।
হরি হরি! এমন কেন বা হলো!
বিষম বাড়বা অনল মাঝারে,
আমারে ডাবিয়া দিল।
বয়সে কিশোর, রূপ মনোহর,
অতি সুমধুর রূপ।
নয়ন যুগল, করয়ে শীতল,
বড়ই রসের কূপ।।
নিজ পরিজন, সে নহে আপন,
বচনে বিশ্বাস করি।
চাহিতে তা পানে, পশিল পরাণে,
বুক বিদরিয়া মরি।।
চাহি ছাড়াইতে, ছাড়া নহে চিতে,
এখন করিব কি?
কহে চণ্ডীদাসে, শ্যাম নব রসে,
ঠেকিলা রাজার ঝি।।

——————-

হাম – আমি। অখলা – সরলা। বিশাখা – শ্রীরাধিকার অষ্টসখীর মধ্যে দ্বিতীয় সখী।

“দ্বিতীয় বিশাখা ললিতার সম গুণে। প্রিয়সখী সম রয় জন্ম এক গ্রামে।।
……………………। ………………………।।
দূত কর্ম্মে পণ্ডিতা সন্ধিতে বুদ্ধিমান। চতুষ্টয় জ্ঞাতা ভেদ দণ্ড সামদান।।
পত্রাবলী রচনায়-বাদ্য-নৃত্য-গীতে। ……………………… ।।
বেণী বেশ রচনায় সূচী কর্ম্ম আদি। সূর্য্য-পূজা সামগ্রীর আবিষ্কারে সুধী।।
শ্রীরাধিকার মনোবৃত্তি কহিতে আনন্দ। গলাগলি দোঁহে কৃষ্ণ কথায় প্রবন্ধ।।
……………………। ………………………।।”
—ভক্তমাল

ডাবিয়া – নিক্ষেপ করিয়া। বিদরিয়া – ফাটিয়া। রাজার ঝি – বৃষভানু রাজার কন্যা—শ্রীরাধিকা।

নায়িকার পূর্বরাগ ।। কামোদ । (সাক্ষাদ্দর্শন)।।

জলদবরন কানু, দলিত অঞ্জন জনু,
উদয় হয়েছে সুধাময়।
নয়ন চকোর মোর, পিতে করে উতরোল,
নিমিখে নিমিখ নাহি সয়।।
সখি দেখিনু শ্যামের রূপ যাইতে জলে।
ভালে সে নাগরী, হয়েছে পাগলী,
সকল লোকেতে বলে।।
কিবা সে চাহনি, ভুবন ভুলনী,
দোলনি গলে বনমাল।
মধুর লোভে, ভ্রমরা বুলে,
বেড়িয়া তহি রসাল।।
দুইটি মোহন, নয়নের বাণ,
দেখিতে পরাণে হানে।
পশিয়া মরমে, ঘুচায়া ধরমে,
পরাণ সহিত টানে।।
চণ্ডীদাস কয়, ভুবনে না হয়,
এমন রূপ যে আর।
যে জন দেখিল, সে জন ভুলিল,
কি তার কুল বিচার?

——————-

জনু – যেন। পিতে – পান করিতে। উতরোল – উৎকণ্ঠিত হয়। নিমিখ – নিমিষ। ভালে সে – ভাগ্যে সে। তহি – তাহাকে।

নায়িকার পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।

বরণ দেখনু শ্যাম, জিনিয়াত কোটি কাম,
বদন জিতল কোটি শশী।
ভাঙ ধনুভঙ্গী ঠাম, নয়ান কোণে পূরে বাণ,
হাসিয়ে খসয়ে সুধা রাশি।।
সই এমন সুন্দর বর কান।
হেরিয়া সেই মূরতি, সতী ছাড়ে নিজ পতি,
তেয়াগিয়া লাজ ভয় মান।।
এ বড় কারিকরে, কুঁদিলে তাহারে,
প্রতি অঙ্গে মদনের শরে।
যুবতী ধরম, ধৈর্য্য-ভুজঙ্গম,
দমন করিবার তরে।।
অতি সুভোশিত, বক্ষ বিস্তারিত,
দেখিনু দর্পণাকার।
তাহার উপরে, মালা বিজারিত,
কি দিব উপমা তার।।
নাভির উপরে, লোম লতাবলী,
সাপিনী আকার শোভা।
ভূরুর বলনী, কামধনু জিনি,
ইন্দ্র ধনুকের আভা।।
চরণ নখরে, বিধু বিরাজিত,
মণির মঞ্জীর তায়।
চণ্ডীদাস হিয়া, সে রূপ দেখিয়া,
চঞ্চল হইয়া ধায়।।

——————-

ভাঙ – ভ্রু। বিধু – চন্দ্র। মঞ্জীর – নূপুর।

নায়িকার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।

শ্যামের বদনের ছটার কিবা ছবি।
কোটি মদন জনু, জিনিয়া শ্যামের তনু,
উদইছে যেন শশী রবি।।
সই, কিবা সে শ্যামের রূপ,
নয়ান জুড়ায় চেঞা।
হেন মনে লয়, যদি লোক ভয় নয়,
কোলে করি যেয়ে ধেঞা।।
তরুন মুরলী, করিল পাগলী,
রহিতে নারিনু ঘরে।
সবারে বলিয়া, বিদায় লইলাম,
কি করিবে দোসর পরে।।
ধরম করম, দূরে তেয়াগিনু,
মনেতে লাগিল সে।
চণ্ডীদাস ভণে, আপনার মনে,
বুঝিয়া করিবে যে।।

——————-

উদইছে – উদয় হইয়াছে। চেঞা – চাহিয়া। ধেঞা – ধাইয়া।

নায়িকার পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।

সুধা ছানিয়া কেবা ও সুধা ঢেলেছে রে
তেমতি শ্যামের চিকণ দেহা |
অঞ্জন রঞ্জিয়া কেবা খঞ্জন বসাইল রে
চাঁদ নিঙ্গাড়ি কৈল থেহা ||
থেহা নিঙ্গাড়িয়া কেবা মুখানি বনাইল রে
জবা নিঙ্গাড়িয়া কৈল গণ্ড |
বিম্বফল জিনি কেবা ওষ্ঠ গড়িল রে
ভুজ জিনিয়া করি-শুণ্ড ||
কম্বু জিনিয়া কেবা কণ্ঠ বনাইল রে
কোকিল জিনিয়া সুস্বর |
আরদ্র মাখিয়া কেবা সারদ্র বনাইল রে
ঐছন দেখি পীতম্বর ||
বিস্তারি পাষাণে কেবা রতন বসাইল রে
এমতি লাগয়ে বুকের শোভা |
কানড়-কুসুমে কেবা সুষমা করিল রে
এমতি তনুর দেখি আভা ||
আদলি উপরে কেবা কদলী রোপল রে
ঐছন দেখি ঊরুযুগ |
অঙ্গুলি উপরে কেবা দর্পণ বসাইল রে
চণ্ডীদাস দেখে যুগ যুগ ||

———————-

দেহা – দেহ। থেহা – স্থৈর্য্য। গণ্ড – গাল। বিম্ব ফল – তেলাকুচাফল। শুণ্ড – হাতীর শুঁড়। কম্বু – শঙ্খ। আরদ্র – হরিদ্রা। সারদ্র – সহিত আরদ্র – পীতবর্ণ। সুষমা – পরম শোভা। আদলি – (আদলা) ঘৃতকুমারী।

নায়িকার পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।

সজনি, কি হেরিনু যমুনার কূলে!
ব্রজ-কুল-নন্দন, হরিল আমার মন,
ত্রিভঙ্গ দাঁড়াঞা তরু-মূলে।
গোকূল নগর মাঝে, আর কত নারী আছে।
তাহে কেন না পড়িল বাধা।
নিরমল কুলখানি, যতনে রেখেছি আমি,
বাঁশী কেন বলে “রাধা রাধা”?
মল্লিকা চম্পক দামে, চূড়ার চালনী বামে,
তাহে শোভে ময়ুরের পাখে।
আশে পাশে ধেয়ে ধেয়ে, সুন্দর সৌরভ পেয়ে,
অলি উড়ি পড়ে লাখে লাখে।।
সে কিরে চূড়ার ঠাম, কেবল যেমন কাম,
নানা ছাঁদে বাঁধে পাকমোড়া।
শির বেড়ল বৈলান জালে, নব গুঞ্জামণি মালে,
চঞ্চল চাঁদ উপরে জোড়া।।
পায়ের উপর থুয়ে পা, কদম্বে হেলায়ে গা,
গলে শোভে মালতীর মালা।
বড়ু চণ্ডীদাস কয়, না হইল পরিচয়,
রসের নাগর বড় কালা।।
——————-

দাঁড়াঞা – দাঁড়াইয়া। বৈলান জাল – চূড়াবন্ধনবেণী। বড়ু – ব্রাহ্মণ-তনয়।

নায়িকার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।। (সখীর উক্তি)

ঘরের বাহির, দণ্ডে শতবার,
তিলে তিলে আসে যায়।
মন উচাটন, নিশ্বাস সঘন,
কদম্ব কাননে চায়।।
রাই এমন কেনে বা হলো?
গুরু দুরজন, ভয় নাহি মন,
কোথা বা কি দেব পাইল।।
সদাই চঞ্চল, বসন অঞ্চল,
সম্বরণ নাহি করে।
বসে থাকি থাকি, উঠয়ে চমকি,
ভূষণ খসিয়ে পরে।।
বয়সে কিশোরী, রাজার কুমারী,
তাহে কুলবধূ বালা।
কিবা অভিলাষে, বাড়ায় লালসে,
না বুঝি তাহার ছলা।।
তাহার চরিতে, হেন বুঝি চিতে,
হাত বাড়াইল চাঁদে।
চণ্ডীদাস ভণে, করি অনুমানে,
ঠেকেছে কালিয়া ফাঁদে।।

——————-

কোথা বা কি দেব পাইল – কোথা বা ভূতে পাইল। খসিয়ে -খুলিয়া।

রাধার পূর্বরাগ ।। সিন্ধুড়া।।

রাধার কি হৈল অন্তরের ব্যাথা |
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে
না শুনে কাহারো কথা ||
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ-পানে
না চলে নয়ান-তারা |
বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে
যেমত যোগিনী-পারা ||
এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি
দেখায়ে খসায়ে চুলি |
হসিত বয়ানে চাহে মেঘ-পানে
কি কহে দুহাত তুলি ||
একদিঠ করি ময়ূর-ময়ূরী
কণ্ঠ করে নিরিক্ষণে |
চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয়
কালিয়া-বঁধুর সনে ||

———————

একলে – একলা, একাকিনী। ধেয়ানে – ধ্যানে। “বিরতি আহারে”–পদকল্পলতিকা। পারা – মত; ন্যায়। “ফুলয়ে গাঁথনি” পাঠও আছে। চুলি – চুল।হসিত বয়ানে – হাসি মুখে। একদিঠ – এক দৃষ্টি।

রাধার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।

কালিয়া বরণ, হিরণ-পিঁধন
যখন পড়য়ে মনে।
মুরছি পড়িয়া, কাঁদয়ে ধরিয়া,
সব সখী জনে জনে।।
কেহ কহে মাই, ওঝা দে ঝাড়াই,
রাইয়েরে পেয়েছে ভূতা।
কাঁপি কাঁপি উঠে, কহিনা না টুটে,
সে যে বৃষভানু-সুতা।।
রক্ষামন্ত্র পড়ে, নিজ চুলে ঝাড়ে,
কেহ বা কহয়ে ছলে।
নিশ্চয় কহি যে, আনি দেও এবে,
কালার গলার ফুলে।।
পাইলে সে ফুল, চেতন পাইয়া,
তবে উঠবেক বালা।
ভূত-প্রেত আদি, ঘুচিয়া যাইবে,
যাইবে অঙ্গের জ্বালা।।
কহে চণ্ডীদাসে, আন উপদেশে,
কুলের বৈরী যে কালা।
দেখাও যতনে, পাইবে চেতনে,
ঘুচিবে অঙ্গের জ্বালা।।

——————-

হিরণ-পিঁধন -হিরণ্য পরিধান অর্থাৎ পীতাম্বর। দে – দিয়া। ভূতা – ভূত।

“পাইলে সে ফুল…যাইবে অঙ্গের জ্বালা”–এইটুকু একখানি হস্ত লিখিত গ্রন্থ হইতে গৃহীত। প্রাচীন কাব্য-সংগ্রহ।।

রাধার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।

ওঝা আনি গিয়া পাছে আছে ভূতা।
কাঁপি কাঁপি উঠে এই বৃষভানু সুতা।। ধ্রু।।
কালিয় কোঙর হিরণ-পিঁধন যবে পড়ে মনে।
মূরছি পড়িয়া কান্দে ধরি ভূম খানে।।
রক্ষা রক্ষা মন্ত্র পড়ে ধরি ধনীর চুলে।
কেহ বোলে আনি দেহ কালার গলার ফুলে।।
চেতন পাইয়া তবে উঠবেক বালা।
ভূত প্রেত ঘুচিবেক যাইবেক জ্বালা।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয় যারে কহ ভূত।
শ্যাম চিকণিয়া সে নন্দের ঘরের পুত।।

——————-

কোঙর – কুমার। পুত – পুত্র।

রাধার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।

সোণার নাতনী, এমন যে কেনি,
হইলা বাউরী পারা।
সদাই রোদন, বিরস বদন,
না বুঝি কেমন ধারা।।
যমুনা যাইতে, কদম্ব তলাতে,
দেখিলা যে কোন জনে।
যুবতী জনার, ধরম নাশক,
বসি থাকে সেই খানে।।
সে জন পড়ে তোর মনে।
সতীর কুলের কলঙ্ক রাখিলি,
চাহিয়া তাহার পানে।।
একে কুলনারী, কুল আছে বৈরী,
তাহে বড়ুয়ার বধূ।
কহে চণ্ডীদাসে, কুল-শীল নাশে,
কালিয়া প্রেমের মধু।।

——————-

কেনি – কেন। বাউরী – বায়ুগ্রস্থা।

রাধার পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।

সোণার নাতিনি কেন, আইস যাও পুনঃ পুনঃ,
না বুঝি তোমার অভিপ্রায়।
সদাই কাঁদনা দেখি, অঝরু ঝরয়ে আঁখি,
জাতি কুল সকল পাছে যায়।।
যমুনার জলে যাও, কদম তলার পানে চাও,
না জানি দেখিলা কোন জনে।
শ্যামল বরণ হিরণ-পিঁধন, বসি সাথে যখন তখন,
সে জন পড়েছে বুঝি মনে।।
ঘরে আসি নাহি খাও, সদাই তাহারে চাও,
বুঝিলাঙ তোমার মনের কথা।
এখনি শুনিলে ঘরে, কি বোল বলিবে তোরে,
বাড়িয়া ভাঙ্গিবে তোর মাথা।।
একে তুমি কুল নারী, কুল আছে তোমার বৈরী,
আর তাহে বড়ুয়ার বধূ।
কহে বড়ু চণ্ডীদাসে, কুল শীল সব ভাসে,
লাগিল কালিয়া-প্রেম-মধু।।

——————-

অঝরু – নির্ঝর। বুঝিলাঙ – বুঝিলাম। বাড়িয়া – বাড়ি দিয়া।

রাধার পূর্বরাগ ।। সুহই ।।

না যাইও যমুনার জলে, তরুয়া কদম্বমূলে,
চিকণকালা করিয়াছে থানা।
নব জলধর রূপ, মুনির মন মোহে গো,
তেঞি জলে যেতে করি মানা।।
ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা ভাতি বহিয়া মদন জিতি,
চাঁদ জিতি মলয়জ ভালে।
ভুবন বিজয়ী মালা, মেঘে সৌদামিনী কলা,
শোভা করে শ্যামচাঁদের গলে।।
নয়ান কটাক্ষ চাঁদে, হিয়ার ভিতরে হানে,
আর তাহে মুরলীর তান।
শুনিয়া মুরলীর গান, ধৈরজ না ধরে প্রাণ,
নিরখিলে হারাবি পরাণ।।
কানড়া কুসুম জিনি, শ্যামচাঁদের বদন খানি,
হেরিবে নয়াণের কোণে যে।
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে, চাহিয়া গোবিন্দ পানে,
পরাণে বাঁচিবে সখি কে।।

——————-

থানা – স্থান (আড্ডা)। তেঞি – তাই। করি মানা – নিষেধ করি।

রাধার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।

যমুনা যাইয়া, শ্যামরে দেখিয়া
ঘরে আইল বিনোদিনী।
বিরলে বসিয়া, কান্দিয়া কান্দিয়া
ধেয়ায় শ্যামরূপ খানি।।
নিজ করোপর, রাখিয়া কলোপ
মহাযোগিনীর পারা।
ও দুটি নয়ানে, বহিছে সঘনে,
শ্রাবণ মেঘেরি ধারা।।
হেন কালে তথা, আইল ললিতা,
রাই দেখিবার তরে।
সে দশা দেখিয়া, ব্যথিত হইয়া,
তুলিয়া লইল কোরে।।
নিজ বাস দিয়া, মুছিয়া পুছয়ে,
মধুর মধুর বাণী।
আজু কেনে ধনি, হয়েছি এমনি,
কহ না কি গালি শুনি।।
আজনম সুখে, হাসি বিধুমুখে,
কভু না হেরিয়ে আন।
আজু কেন বল, কান্দিয়া ব্যাকুল,
কেমন করিছে প্রাণ।।
চাঁচর চিকুর, কিছু না সম্বর,
কেনে হইলে অগেয়ান।
চণ্ডীদাস কহে, বেজেছে হৃদয়ে,
শ্যামের পিরীতি বাণ।।

——————-

ধেয়ায় – ধ্যান করে। কপোল – গাল। ললিতা – শ্রীরাধার অষ্ট সখীর মধ্যে আদ্যা সখী।

“শ্রীললিতা আদ্যা অষ্টমধ্যে শ্রেষ্ঠা। সতের দিনের শ্রীমদ্রাধা হৈতে জ্যেষ্ঠা।।
অনুরাধা অন্য নাম বামা প্রখরা। গোরোচনা নিন্দি কান্তি শিখিপিচ্ছম্বরা।।
সর্ব্বকর্ম্মে নিপুনতা সর্ব্বার্থ সাধিকা। সকলের মান্য ধন্য প্রাধান্যা পাত্রিকা।।
……………………………………………………।।”
—ভক্তিমাল।

অগেয়ান— অজ্ঞান।

রাধার পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

অঙ্গ পুলকিত, মরম সহিত,
অঝরে নয়ন ঝরে।
বুঝি অনুমানি, কালা রূপ খানি,
তোমারে করিয়া ভোরে।।
দেখি নানা দশা, অঙ্গ যে বিবশা,
নাহত এত বড় ভারে।
সে বর নাগর, গুণের সাগর,
কিবা না করিতে পারে।।
শুন শুন রাই, কহি তুয়া ঠাঁই,
ভাল না দেখি যে তোরে।
সতী কুলবতী, তুয়া যে খেয়াতি,
আছয় গোকুল পুরে।।
ইহাতে এখন, দেখি যে কেমন,
নাহি লাজ গুরুতরে।
কহে চণ্ডীদাসে, শ্যাম নব রসে,
বুঝিলে বুঝিতে নারে।।

——————-

খেয়াতি – খ্যাতি। আছয় – আছে।

নায়কের পূর্বরাগ

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

তড়িত বরণী, হরিণ নয়নী,
দেখিনু আঙ্গিরা মাঝে।
কিবা বা দিঞা, অমিয়া ছানিয়া,
গড়িল কোন বা রাজে।।
সই! কিবা সে সুন্দর রূপ।
চাহিতে চাহিতে, পশি গেল চিতে,
বড়ই রসের কূপ।।
সোণার কটোরি, কুচযুগ গিরি,
কনক মন্দির লাগে।
তাহার উপরেম চুড়াটি বনালে,
সে আর অধিক ভাগে।।
কে এমন কারিগর, বানাইল ঘর,
দেখিতে নারিনু তারে।
দেখিতে পাইতুঁ, শিরোপা করিতুঁ,
এমতি মন যে করে।।
হৃদয়ে আছিল, বেকত হইল,
দেখিতে পাইনু সে।
ঐছন মন্দিরে, শয়ন করে যে,
সে মেনে নাগর কে।।
হিয়ার মালা, যৌবনের ডালা,
পসারী পসারল যেন।
চাকুতে কাটিয়াম চাক যে করিয়া,
তাহাতে বসাইল হেন।।
অধর সুধা, পড়িতে জুদা,
দশন মুকুতা শশী।
চণ্ডীদাসে কয়, ও কথা কি হয়,
মরম কহিলে বটে।
আর কার কাছে, কহ যদি পাছে,
তবে যে কুৎসা রটে।।

——————-

“হরিণ নয়নী, দেখিনু আঙ্গিরা মাঝে”—“তরুণী হরিণী, রাই দেখিনু আঙ্গিনা মাঝে” পাঠও আছে।
দিঞা – দিয়া। চুড়া – চুচুক। পাইতুঁ – পাইতাম। করিতুঁ – করিতাম। বেকত – ব্যক্ত। পসারল – বিস্তার করিল। জুদা – পৃথক; আলাহিদা।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

নবীন কিশোরী, মেঘের বিজুরি,
চমকি চলিয়া গেল।
সঙ্গের সঙ্গিনী, সকল কামিনী,
ততহি উদয় ভেল।।
সই! জনমিয়া দেখি নাই হেন নারী।
ভঙ্গিম রঙ্গিম, ঘন সে চাহনি,
গলে যে মোতিম হারি।।
অঙ্গের সৌরভে, ভ্রমরা ধাওয়ে,
ঝঙ্কার করয়ে যাই।
অঙ্গের বসন, ঘুচায় কখন,
কখন ঝাঁপয়ে তাও।।
মনের সহিতে, মরম কৌতুকে,
সখীর কান্দেতে বাহু।
হাসির চাহনি, দেখাল কামিনী,
পরান হারানু তহু।।
হাসির চাহনি, দেখাল কামিনী,
পরান হারানু তহু।।
চলন ভঙ্গী, অতি সুরঙ্গী,
চাপটিলে জীবন মোর।
অঙ্গুলির আগে, চাঁদ যে ঝলকে,
পড়িছে উছলি জোর।।
চাহে যাহা পানে, বধয়ে পরাণে,
দারুন চাহনি তার।
হিয়ার ভিতরে, পাঁজর কাটিয়ে,
বিঁধিল বাণ যে মার।।
জর জর হিয়া, রহিল পড়িয়া,
চেতন নহিল মোর।
চণ্ডীদাসে কয়, ব্যাধি সমাধি নয়,
দেখিয়া হইনু ভোর।।

——————-

বিজুরি – বিজলী। ভেল – হইল। হারি – মুক্তাহার। ঝাঁপয়ে – আবৃত করে। তহু – তাহাতে। সমাধি – শেষ।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। শ্রীগান্ধার ।।

বদন সুন্দর, যেন শশধর
উদিত গগনে হয়।
ছটার ঝলকে, পরাণ চমকে,
তিমিরে লাগয়ে ভয়।।
নয়ান চাহনি, বিভঙ্গী সে যনি,
তিখিণী তিখিণী শর।
দেখিয়া অন্তর, উপজিল ডর,
মদন পাইল ডর।।
সই! কে বলে কুচযুগ বেল।
সোণার গুলি, শোভয়ে ভালি,
যুবক বধিতে শেল।।
আজানু লম্বিত, করিবর শুণ্ডিত,
কনক ভুজ যে সাজে।
হেরিয়া মদন, গেল সে সদন,
মুখ না তুলিল লাহে।।
মাঝা ডিম্বুর, সিংহিনী আকার,
নিতম্ব বিমান চাক।
চরণ কমলয়ে, ভ্রমরা বুলয়ে,
চৌদিকে বেড়িয়া ঝাঁক।।
অঙ্গুলির মাঝে, যাবক সাজে,
মিহির শোভিত জনু।
চণ্ডীদাসে কয়, কি জানি কি হয়,
লখিতে নারিনু তনু।।

——————-

যনি – যেন। তিখিণী – তীক্ষ্ণ। ভালি – ভাল। সদন – গৃহ, যাবক – আলতা। মিহির – সূর্য্য।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। শ্রীগান্ধার ।।

একে যে সুন্দরী কনক পুতলী,
খঞ্জন লোচন তার।
বদন কমলে, ভ্রমরা বুলয়ে,
তিমিত কেশের ধার।।
সই! নবীন বালিকা সেহ!
দেব উপজিল, দেখিতে না পাইল,
সুমতি না দিল সেহ।।
নজরে নজরে, পরাণে পরাণে,
ধৈরজ উঠাইল যে।
সঙ্গে কেহ নাই, শুনহ ভাই,
কাহারে সুধাবে কে।।
দন্তটি যে, দাড়িম্ব বীজে,
ওষ্ঠ বিম্বক শোভা।
দেখিয়া জুলুফে, মদন কুলুফে,
মন যে হইল লোভা।।
গলায় মাল, শোভিছে ভাল,
তাম্বুল বদনে তার।
চর্ব্বিত চর্ব্বণে, পড়িছে বদনে,
শোভিত পিন্ধন ধার।।
চণ্ডীদাস বলে, গিয়াছিল জলে,
আইল পরাণ ঘরে।
রাজার ঝিয়ারি, সুন্দরী নারী,
তুমি কি করিবে তারে।।

——————-

সেহ – সে। চর্ব্বিত – পানের পিক।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

পথে জড়াজড়ি, দেখিনু নাগরী,
সখীর সহিত যার।
সকল অঙ্গ, মদন তরঙ্গ,
হসিত বদনে চায়।।
সই! কেমন মোহিনী সেহ।
যদি সহায় পাই, এমনি হয়,
তা সহ করি যে লেহ।।
ললিত আকার, মুকুতা হার,
শোভিত দেখিনু ভাল।
যেন তারাগণ, উদিত গগন,
চাঁদেরে বেড়িয়া জাল।।
কুচ যে মণ্ডলি, কনক কটোরি,
বনালে কেমন ধাতা।
হাসির রাশি, মনে খুসি,
দান করে যদি দাতা।।
চণ্ডীদাস কহে, যদি দান নহে,
কি জানি মাগিবা তায়।
যে ধন মাগয়ে, তাহা না পাইয়ে,
অপযশঃ রহি যায়।।

——————-

লেহ – প্রীতি। “ললিত আকার, মুকুতা হার”—বিভিন্ন পাঠ—“নীল মুকুতা, হার বেকতা।”—পদকল্পতরু।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

বেলি অসকালে, দেখিনু ভালে,
পথেতে যাইতে সে।
জুড়ায় কেবল, নয়ন যুগল,
চিনিতে নারিনু কেন।।
সই! রূপ কে চাহিতে পারে।
অঙ্গের আভা, বসন শোভা,
পাসরিতে নারি তারে।।
বাম অঙ্গুলিতে, মুকুর সহিতে,
কনক কটোরি হাতে।
সীঁতার সিন্দুর, নয়ানে কাজর,
মুকুতা শোভিত নথে।।
নীল সাড়ী, মোহন কারী,
উছলিতে দেখি পাশ।
কি আর পরাণে, সোঁপিনু চরণে,
দাস করি মনে আশ।।
কুচযুগ গিরি, কনক কটোরি,
শোভিত হিয়ার মাঝে।
ধীরে ধীরে যায়, চমকিয়ে চায়,
ঘন না চাহে লোক লাজে।।
কিবা সে ভঙ্গিমা, নাহিক উপমা,
চলন মন্থর গতি।
কোন ভাগ্যবানে, পাঞাছে কি দানে,
ভজিয়া সে উমাপতি।।
চণ্ডীদাসে কয়, মূরতি এ নয়,
বধিতে রসিক জানে।
অমিয়া ছানিয়া, যতন করিয়া,
গড়িল সে অনুমানে।।

——————-

বেলি অসকালে – বেলা অবসানে। বসন – (বিভিন্ন পাঠ—“বরণ”)। মুকুর – দর্পণ। নথে – (বিভিন্ন পাঠ—“মাথে”)। নাহিক – (বিভিন্ন পাঠ—“কি দিব”)।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

চম্পক বরণী, বয়সে তরুণী,
হাসিতে অমিয়া ধারা।
সুচিত্র বেণী, দুলিছে যনি,
কপিলা চামর পারা।
সখি যাইতে দেখিনু ঘাটে।
জগত মোহিনী, হরিণ নয়নী,
ভানুর ঝিয়ারি বটে।। ধ্রু ।।
হিয়া জর জর, খসিল পাঁজর,
এমতি করিল বটে।
চলল কামিনী, বঙ্কিম চাহনি,
বিঁধিল পরাণ তটে।।
না পাই সমাধি, কি হইল বেয়াধি,
মরম কহিব কারে।
চণ্ডীদাসে কয়, ব্যাধি সমাধি হয়,
পাইবে যবে তারে।।

——————-

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। ধানশী ।। (স্নান কালে)

সজনি ও ধনী কে কহ বটে।
গোরোচনা গৌরী, নবীন কিশোরী,
নাহিতে দেখিনু ঘাটে।।
শুনহে পরাণ, সুবল সাঙ্গাতি,
কো ধনী মাজিছে গা।
যমুনার তীরে, বসি তার নীরে,
পায়ের উপরে পা।।
অঙ্গের বসন, কৈরাছে আসন,
আলাঞা দিয়াছে বেণী।
উচ কুচ মূলে, হেম হার দোলে,
সুমেরু শিখর জানি।।
সিনিয়া উঠিতে, নিতম্ব তটীতে,
পড়েছে চিকুর রাশি।
কাঁদিয়ে আঁধার, কলঙ্ক চাঁদার,
শরন লইল আসি।
কিবা সে দুগুলি, শঙ্খঝলমলি,
সরু সরু শশীকলা।
সাঁজেতে উদয়, সুধু সুধাময়,
দেখিয়ে হইনু ভোলা।।
চলে নীল শাড়ী, নিঙ্গাড়ি নিঙ্গাড়ি,
পরাণ সহিত মোর।
সেই হৈতে মোর, হিয়া নহে থির,
মনমথ জ্বরে ভোর।।
কহে চণ্ডীদাসে, বাশুলি আদেশে,
শুনহে নাগর চন্দা।
সে যে বৃষভানু রাজার নন্দিনী,
নাম বিনোদিনী রাধা।।

——————-

গোরোচনা – গোমস্তকলব্ধ পীতদ্রব্য বিশেষ। এখানে পীতবর্ণা গোরী পাঠও আছে। কৈরাছে – করিয়াছে। আলাঞা – এলাইয়া। সিনিয়া – স্নান করিয়া। সাঁজেতে – সন্ধ্যার সময়। ভোলা – (বিভিন্ন পাঠ—“ভোরা”।)

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

থির বিজুরি, বদন গৌরী,
পেখনু ঘাটের কূলে।
কানড়া ছাঁদে, কবরী বান্ধে,
নবমল্লিকার মালে।।
সই মরম কহিনু তোরে।
আড় নয়নে, ঈষৎ হাসিয়া,
আকুল করিল মোরে।।
ফুলের গেড়ুয়া লুফিয়া ধরয়ে,
সঘনে দেখায়ে পাশ।
উচু কুচ যুগ, বসন ঘুচায়ে,
মুচকি মুচকি হাস।।
চরণ কমলে, মল্ল-তাড়ল
সুন্দর যাবক রেখা।
কহে চণ্ডীদাসে, হৃদয় উল্লাসে,
পুন কি হইবে দেখা।।

——————-

থির – স্থির। বদন – (বিভিন্ন পাঠ—“বরণ”)। পেখনু – দেখিনু। কানড়া – কানড় সাপ যে প্রকার কুণ্ডুলী করিয়া থাকে সেই রূপ ভাবে। গেড়ুয়া – (হিন্দি) স্তবক। মল্ল-তাড়ল – মল বিশেষ। পশ্চিম দেশীয় কামিনীগণ চরণে অধুনাতন পরিয়া থাকে। যাবক – আলতা।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।

সখীগণ সঙ্গে, যায় কত রঙ্গে
যমুনা সিনান করি।
অঙ্গের সৌরভে, ভ্রমরা ধাবয়ে
ঝঙ্কার করয়ে ফিরি।।
নানা আভরণ, মণির কিরণ,
সহজে মলিন লাগে।
নবীন কিশোরী, বরণ বিজুরী,
সদাই মনেতে জাগে।।
সই সে নব রমণী কে।
চকিতে হেরিয়া, জ্বলত এ হিয়া,
ধরিতে নারি এ দে।।
পুন না হেরিলে, না রহে জীবন,
তোমারে কহিনু দড়।
কহে চণ্ডীদাস, পুরাহ লালস,
নাগর আতুর বড়।।

—————-
দে—দেহ। দড়—দৃঢ়। লালস—অভিলাস। আতুর—কাতর।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

কাঞ্চন বরণী, কে বটে সে ধনী,
ধীরে ধীরে চলি যায়।
হাসির ঠমকে, চপলা চমকে,
নীল শাড়ী শোভে গায়।।
দেখিতে বদন, মোহিত মদন,
নাসাতে দুলিছে দুল।
সুবিশাল আঁখি, মানস ভাবিয়া,
ছুটিছে মরাল কুল।।
আঁখি তারা দুটী, বিরলে বসিয়া,
সৃজন করেছে বিধি।
নীল পদ্ম ভাবি, লুবধ ভ্রমরা,
ছুটিতেছে নিরবধি।।
কিবা দন্ত ভাঁতি, মুকুতার পাঁতি,
জিনিয়া কুন্দক কুঁড়ি।
সীঁথায় সিন্দুর, জিনিয়া অরুণ,
কাণে কর্ণবালা ঢেঁড়ি।।
শ্রীফল যুগল, জিনি কুচযুগ,
পাতলা কাঁচলি তাহে।
তাহার উপর, মনিময় হার,
উপমা কহিব কাহে।।
কেশরী জিনি, কৃশ মাঝা খানি,
মুঠে করি যায় ধরা।
গজ কুম্ভ জিনি, নিতম্ব বলনি,
উরু করি-কর পারা।।
চরণ যুগল, জিনিয়া কমল,
আলতা রঞ্জিত তায়।
মধু মন তাহে, কাহে না ভুলব,
মদন মূরছা পায়।।
কাহার নন্দিনী, কাহার রমণী,
গোকুলে এমন কে।
কোণ পুণ্য ফলে, বল বল সখা,
সে রামা পাইল সে।।
চণ্ডীদাস বলে, ভেব না ভেব না,
ওহে শ্যাম গুণমণি।
তুমি সে তাহার, সরবস ধন,
তোমারি আছে সে ধনী।।

——————-

চপলা – বিদ্যুৎ। মানস – সরোবর। মঝু- আমার। কাহে – কেন।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। আশাবরী ।।

রমণীর মণি, পেখনু আপনি,
ভূষণ সহিত গায়।
দেখিতে দেখিতে, বিজুলি ঝলকে,
ধৈরজে ধৈরজ যায়।।
সই! চাহনি মোহনী থোর।
মরমে বান্ধিনু, হেরিয়া ভুলিনু,
রূপের নাহিক ওর।।
বসন খসয়ে, অঙ্গুলি চাপয়ে,
কর করেছে থুইয়া।
দেখিয়া লোভয়ে, মদন ক্ষোভয়ে,
কেমনে ধরিবে হিয়া।।
বদন ছাঁদ, কামের ফাঁদ,
ঝুরিয়া ঝুরিয়া কান্দে।
কেশের আগ, চুম্বয়ে টাগ,
ফিরিয়া ফিরিয়া বান্ধে।।
জলের কান্ধারে, কেশের আন্ধারে,
সাপিনী লাগয়ে মোয়।
কেমনে কামিনী, আছয়ে আপনি,
এমন সাপিনী থোয়।।
দশন কাঁতি, মুকুতা পাঁতি,
হাস উগারয়ে শশী।
পরাণ পুতলি, হইনু পাগলি,
মরমে রহিল পশি।।
শূন যে হিয়া, রহিয়া পড়িয়া,
বস্তু রহল তায়।
চণ্ডীদাসে কয়, পুন দেখা হয়,
তবে সে পরাণ বয়।।

——————-

বসন খসয়ে, অঙ্গুলি চাপয়ে, কর করেছে থুইয়া – হাতের উপর হাত রাখিয়া। টাগ – জঙ্ঘা। কান্ধারে – তীরে। কাঁতি – কান্তি। উগারয়ে – উদ্গীরণ করে। শুন – শূন্য।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।

কনক বরণ, কিয়ে দরপণ,
নিছনি দিয়ে যে তার।
কপালে ললিত, চাঁদ শোভিত,
সিন্দূর অরুণ আর।।
সই! কিবা সে মধুর হাসি।
হিয়ার ভিতর পাঁজর কাটিয়া,
মরমে রহল পশি।।
গলার উপর, মণিময় হার,
গগন মণ্ডল হেরু।
কুচ যুগ গিরি, কনক গাগরী,
উলটি পড়ল মেরু।।
গুরু সে উরুতে, লম্বিত কেশ,
হেরি যে সুন্দর ভার।
বহিয়া দুকুল বরণের ফুল,
জলদ শোভিত ধার।।
কহে চণ্ডীদাসে, বাশুলী আদেশে,
হেরিয়ে নখের কোণে।
জনম সফলে, যমুনার কূলে,
মিলারল কোন্‌ জনে।।

——————-

নিছনি – উপমা। মধুর — বিভিন্ন পাঠ—“মুখের”। গলার উপর, মণিময় হার, গগন মণ্ডল হেরু – গলার উপরিস্থিত মণিময়হার বক্ষে পতিত হওয়াতে গগণ মণ্ডলের ন্যায় বোধ হইতেছে। বক্ষ গগণ; মণিশ্রেণী তারকাবলী। হেরু—দেখাইতেছেন। মেরু – সুমেরু পর্ব্বত।

বিভিন্ন পাঠঃ
উরু সে উরুতে, লম্বিত কেশ,
হেরিয়ে সুন্দর ভার।
চরণের ফুল, হেরিয়া দুকুল,
জলদ শোভিত ধার।।

শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ ।। সুহই ।।

হেদোলা সুন্দরি, প্রেমের আগরি,
শুনহ নাগর কথা।
নিকুঞ্জে আসিয়া, তোহারি লাগিয়া,
কান্দিয়া আকুল তথা।।
রাই রাই করি, ফুকরি ফুকরি,
পড়ই ভূমিরতলে।
ধরি মোর করে, কহয়ে কাতরে,
কেমন সে ধনী মিলে।।
রাই অতএ আইনু আমি।
কানুর পীরিতি, যতেক আরতি,
যাইলে জানিবা তুমি।।
প্রেম অমিয়া, বাঢ়াও উহারে,
তোমারে কে করে বাধা।
চণ্ডীদাসে বলে, রাখি কুল শীল,
পুরাহ মনের সাধা।।

——————-

অতএ – অতএব। যতেক – যত। আরতি আশক্তি।

গোষ্ঠ বিহার

গোষ্ঠ বিহার ।। কামোদ ।।

ব্রজকুল বাল, রাজ পথে আইল,
লইয়া ধেনুর পাল।
সঙ্গে সখাগণ ভায় বলরাম,
শ্রীদাম সুদাম ভাল।।
সুবল সঙ্গেতে, তার কান্দে হাত,
আরপি নাগর রায়।
হাসিতে হাসিতে সঙ্কেত বাঁশীতে,
এ দুই আখর গায়।।
এ কথা আনেতে না পারে বুঝিতে
সুবল কিছু সে জানে।
হৈ হৈ বলি রাজপথে চলি,
কমন গরিছে বণে।।
গবাক্ষে বদন দিয়া প্রেমময়ী,
রূপ নিরীক্ষণ করে।
দোঁহার নয়নে, নয়ন মিলল
হৃদয়ে হৃদয় ধরে।।
দেখিতে শ্রীমুখ মণ্ডল সুন্দর,
ব্যথিত হইলো রাধা।
এ হেন সম্পদ, বনে পাঠাইতে,
তিলেকৈ না করে বাধা।।
কেমন যশোদা মায়ের পরাণ,
পুথলি ছাড়িয়া দিয়া।
কেমনে রয়েছে, গ্রহমাঝে বসি,
চণ্ডীদাসে কহে ইহা।।
——————-

শ্রীদাম, সুদাম, সুবল – শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় সখা। রায় – শ্রীকৃষ্ণ। দুই আখর – “রাধা” । আনেতে – অন্যলোকে। প্রেমময়ী – শ্রীরাধিকা। তিলেকৈ – তিলেকের নিমিত্ত।

গোষ্ঠ বিহার ।। ধানশী ।। (গবাক্ষ হইতে শ্রীরাধিকার আক্ষেপোক্তি।)

কি আর বলিব মায়।
কিছু দয়া নাই, তাহার হৃদয়ে,
একথা বলিব কায়।।
মায়ের পরাণ, এমন কঠিন,
এহেন নবীন তনু।
অতি খরতর, বিষম উত্তাপ,
প্রখর গগন ভানু।।
বিপিনে বেকত, ফণি কত শত,
কুশের অঙ্কুর তায়।
ও রাঙা চরণে, ছেদিয়া ভেদিবে,
মোর মনে ইহা ভায়।
ননীর অধিক, শরীর কোমল,
বিষম রবির তাপে।
কি জানি অঙ্গ গলিয়া পড়য়ে,
ভয়ে সদা তনু কাঁপে।।
কেমন যশোদা, নন্দঘোষ পিতা,
এ হেন সম্পদ ছাড়ি।
কেমন হৃদয়, ধরিয়া রয়েছে,
এই মনে আমি ডরি।।
ছারেখারে যাঙ, এ সব সম্পদ,
আনলে পুড়িয়া যাক।
হেন নবীনে, বনে পাঠাইয়া,
পায় কত সুখ পাক।।
চণ্ডীদাস বলে, শুন বিনোদিনি,
সকল সপথ মানি।
যাহার কারণে, বনেতে গমন,
আমি সে কারণ জানি।।
——————-

যাঙ – যাক।

গোষ্ঠ বিহার ।। শ্রীরাগ ।।

ঘন শ্যাম শরীর কেলিরস,
যমুনাক তীর বিহার বনি।
শ্রীদাম সুদাম, ভায়া বলরাম,
সঙ্গে বসুদাম রঙ্গে কিঙ্কিনী।।
ঘন চন্দন ভাল, কাণে ফুল ডাল,
অঙ্গে গিরি লাল, কিয়ে চলনি।
লুফিছে পাঁচনি, বাজিছে কিঙ্কিণী,
পদ নূপুর ঝুনুরুনু শুনি।।
কত যন্ত্র সুতান, কলারস গান,
বাজায়ত মান, করি সুমেলে।
যব বেনু পূরে, মৃগ পাখি ঝুরে,
পুলকে তরু পল্লব পুষ্পফলে।।
কেহ রূপ চাহে, কেহ গুণ গায়ে,
কেহ প্রেমক আনন্দে বোল কহে।
চণ্ডীদাস, মনে অভিলাষ
স্বরূপ অন্তরে জাগি রহে।।
——————-

কিঙ্কিনী – এক সখা। ভাল – গিরি মাটি। কিঙ্কিণী – ঘুঙুর। পূরে – নিনাদ করে।

রাই রাখাল

রাই রাখাল ।। ধানশী ।।

বন্ধু যদি গেল বনে শুন ওগো সখি।
চূড়া বেন্ধে যাব চল যেথা কমল-আঁখি।।
বিপিনে ভেটিব যেয়া শ্যাম জলধরে।
রাখালের বেশে যাব হরিষ অন্তরে।।
চূড়াটি বান্ধহ শিরে যত সখাগণ।
পাত ধরা পর সবে আনন্দিত মন।।
চণ্ডীদাস বলে শুন রাধা বিনোদিনি।
নয়ানে দেখিব সেই শ্যাম গুণমণি।।
——————-

কমল-আঁখি – শ্রীকৃষ্ণ। যেয়া – যাইয়া।

রাই রাখাল ।। সুহই ।।

কেহ কও দাম, শ্রীদাম সুদাম,
সুবলাদি যত সখা।
চল যাব বনে, নটবর সনে,
কাননে করিবে দেখা।।
পর পীত ধড়া, মাথে বান্ধ চূড়া,
বেণু লও কেহ করে।
হারে রে রে বোন, কর উচ্চ রোল,
যাইব যমুনা তীরে।।
পর ফুল মালা, সাজাহ অবলা,
সবারে যাইতে হবে।
দাম বসুদাম, সাজ বলরাম,
যাইতে হবে সবে।।
যোগমায়া তখন, কহিছে বচন,
রাখাল সাজহ রাই।
চণ্ডীদাসে ভণে, দেখিগে নয়নে,
আমি তব সঙ্গে যাই।।

——————-

রাই রাখাল ।। ধানশী ।।

যোগমায়া পৌর্ণমাসী সাক্ষাতে আসিয়া।
লইল হরের শিঙ্গা আপনি মাগিয়া।।
সাজল রাখাল বেশ রাধা বিনোদিনী।
ললিতারে বলরাম কানাই আপনি।।
বলরামের হেলে শিঙ্গা বলে রাম কানু।
মুরলী নহিলে কে ফিরাইবে ধেনু।।
চণ্ডীদাসে বলে যদি রাই বনমালী।
সলিল আনিয়া পত্রে করহ মুরলী।।

————–

পৌর্ণমাসী – বৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

রাই রাখাল ।। বরাড়ী ।।

আনন্দিত হৈয়া সবে পোরে শিঙ্গা বেনু।
পাতাল হইতে উঠে নব লক্ষ ধেনু।।
চৌদিকে ধেনুর পাল হাম্বা হাম্বা করে।
তা দেখিয়া আনন্দিত সবার অন্তরে।।
ইন্দ্র আইল ঐরাবতে দেখয়ে নয়নে।
হংস বাহনে ব্রহ্মা আনন্দিত মনে।।
বৃষভ বাহনে শিব বলে ভালি ভালি।
মুখ বাদ্য করে নাচে দিয়া করতালি।।
চণ্ডীদাসের মনে আন নাহি ভায়।
দেখিয়া সবার রূপ নয়ান জুড়ায়।।

————–

পোরে – নিদান করে।

রাই রাখাল ।। বিভাষ ।।

গায়ে রাঙা মাটী, কটিতটে ধটি,
মাথায় শোভিত চূড়া।
চরণে নূপুর, বাজে সবাকার,
গলে গুঞ্জমালা বেড়া।।
সবাকার কুচ, হইয়াছে উচ,
এ বড় বিষম জ্বালা।
কলমের ফুল, গাঁথি সত দল,
সবাই গাঁথিল মালা।।
ঠারে ঠারে চুড়া, গলে দিল মালা,
নাসিয়ে পড়েছে বুকে।
ফুলের চাপানে, কুচ ঢাকা গেল,
চলিল পরম সুখে।।
কেহ পীত ধটি, কেহ লয়ে লাঠি,
গর্জ্জন শব্দে ধায়।
চণ্ডীদাসে ভণে, গহন কাননে,
শ্যাম ভেটিবারে যায়।।

————–

কুচ – স্তন। উচ – উচ্চ। নাসিয়ে পড়েছে বুকে – বুকে হেলিয়া পড়িয়াছে। অদ্যপি কৃষকেরা নিম্ন জমীকে নাসা জমী বলিয়া থাকে।

রাই রাখাল ।। বিভাষ ।।

যমুনার তীরে সবে যায় নানা রঙ্গে।
সাঙলী ধবলী বলী আনন্দিত অঙ্গে।।
আসিয়া নিভৃত কুঞ্জে সবে দাঁড়াইল।
রাখাল দেখিয়া শ্যাম চমকি উঠিল।।
কোন্‌ গ্রামে বসতিরে কোন্‌ গ্রামে ঘর।
আমার কুঞ্জেতে কেন হরিষ অন্তর।।
কাহার নন্দন তোরা সত্য করি বল।
মুখে হেসে বাক্য কহে অন্তরে বিভোল।।
রাধা অঙ্গের গন্ধে কৃষ্ণের নাসিকা মাতায়।
আপাদ মস্তক কৃষ্ণ ঘন ঘন চায়।।
ললিতা হাসিয়া বলে শুন শ্যাম ধন।
রাধারে না চেন তুমি রসিক কেমন।।
চণ্ডীদাস বলে শুন রাধা বিনোদিনি।
হের গো শ্যামের রূপ জুড়াবে পরাণি।।

————–

সাঙলী ধবলী বলী – গাভীগণের নাম।

শ্রীবলরামের রূপ

শ্রীবলরামের রূপ ।। সুহিনী ।।

দেখ বলরাম ভুবন মাঝে।
রূপ দেখি কাম মরমে লাজে।।
চাঁচর চিকুরে চামরী মজে।
নানা ফুল ডাল তাহাতে সাজে।।
রজত মুকুরে মাজিয়ে মুখ।
তা দেখিয়া চাঁদের মরমে দুঃখ।।
তিলক বলিত ললিত ভালে।
মুগ্ধ ভ্রমরা অলক জালে।।
অরুণ দীঘল নয়ন দেখি।
বিকচ কমল কিসে বা লেখি।।
পাত সহিত কদম্ব ফুলে।
শ্রবণে মকর কুণ্ডল দোলে।।
তিল ফুল জিনি সুন্দর নাশা।
নাগরী জনার মনের বাসা।।
অরুণ বরণ দশনবাস।
বাঁধুলি ফুলের গরম নাশ।।
কুন্দ কোরক জিনিয়া দ্বিজ।
কি ছার তাহাতে করক বীজ।।
চণ্ডীদাস কহে হাসির কাছে।
আর কি জগতে অমৃত আছে।।

————–

চামরী – চমরী নামক গাভী। ইহার পুচ্ছে চামর হয়। মুকুরে – আয়নায়। বিকচ – প্রস্ফুটিত। দশনবাস – ওষ্ঠ। দ্বিজ – দন্ত। করক – দাড়িম্ব।

শ্রীবলরামের রূপ ।। গান্ধার ।।

ফটিক অঙ্গের জনু, রজত সুন্দর তনু,
রসে ঢল ঢল বলরাম।
বিগত কলঙ্ক চাঁদ, কোট গুঞ্জা মুখ ছাঁদ,
মৃগমদ তিলক অনুপাম।।
চাঁচর চিকুরে চূড়া, বনফুল মালা বেড়া,
টলমল শিখিদল তায়।
পরিমলে উনমত, মধুকর কত শত,
মধু পিবি মধুরিম গায়।।
পরিসর ভাল স্থল, বিলোল অলকামাল,
মুখচন্দ্র অতি অপরূপ।
হেরিতে চকিত চিত, চমকিত অতি ভীত,
কত শত মনমথ ভূপ।।
উন্নত বঙ্কিম চারু, কন্দর্প কামান উরু,
কলম পলাশ দুটি আঁখি।
বারুণী অসল ঘোরে, মেলিতে না পারে জোরে,
ঘুমে ঢুলু ঢুলু যেন দেখি।।
নাশা পুটে ঝলমল, বিলসে মুকুতাফল,
সুরঙ্গ অধরে সদা হাসি।
হেরিয়া দশন পাঁতি, সিন্দূর মুকুতা জাতি,
অমিয়া উগারে রাশি রাশি।।
বামকর্ণে ঝলমল, মণিময় কুণ্ডল,
দক্ষিণেতে নবীন মঞ্জরী।
কণ্ঠহার পরিপাটি, দেখিয়ে সোণার কাঁঠি,
উরে গুঞ্জা অতি মনোহারী।।
রঙ্গন মালতী কুন্দ, করবীর অরবিন্দ,
থরে থরে লাগয়ে তাহাতে।
কুন্দ মল্লিকা জাতী, কনক চম্পক যুথি,
রমণক তুলসীর পাতে।।
মন্দার অশোক ধুপ, শেফালিকা সাঙলা ফুল,
আর যত বনফুল ডালে।
ভ্রমিছে ভ্রমরা তায়, মধুর মধুর গায়,
উরু পর দোলে বনমালে।।
করভ শাবক শুণ্ড, সুবলিত ভুজদণ্ড,
কনক কেয়ূর তায় সাজে।
অঙ্গদ বলিয়া মণি, নীল পাটের থোপনি,
মণিবন্ধ বাহুতে বিরাজে।।
শ্রীদাম সুদাম সাথে, চলিয়া ভাণ্ডীর পথে,
চণ্ডীদাস দেখে সকৌতুকে।
দেখ দেখ রাম রায়, না ঠেলিও রাঙ্গা পায়,
চরণেতে রেখহ আমাকে।

————–

গুঞ্জা – কুঁচ। মৃগমদ – কস্তূরী। পরিমলে – সুগন্ধে। উনমত – উন্মত্ত। বারুণী – মদ্যবিশেষ। পাঁতি – পংক্তি। মঞ্জরী – মুক্তা। উরে -বক্ষস্থলে। মনোহারী – সুন্দর। অরবিন্দ – পদ্ম। করভ – হস্তীশাবক। অঙ্গদ – বাহুভূষণ। মণিবন্ধ – হাতের কবজা।

পৌঢ়ার উক্তি

পৌঢ়ার উক্তি ।। গান্ধার ।।

নিতি নিতি এসে যায়, রাধা সনে কথা কয়,
শুনিয়াছিলাম পরের মুখে।
মনে করি কোন দিনে, দেখা হবে তার সনে,
ভাল হইল দেখিলাঙ তোকে।।
চেট্টে নেট্টে যায় চলে, তারে তুমি ধর চুলে,
এমত তোমার কোন্‌ রীত।
যার তুমি ধর চুলে, সেই এসে মোরে বলে,
নহিলে নহিতাম পরতীত।।
সুজন কখন নও, পরনারী নিতে চাও,
এমতি তোমার অভিলাষ।
আমি ত শুনিলাম ভালে, যদি শুনে তার জনে,
শুনিলে হইবে অপভাষ।।।
নিশ্বাস প্রশ্বাস কর, কাছাড় খাইঞা পড়,
বুঝিলাম তোমার মনের কথা।
নহে কেনে ঘাটে মাঠে, তোমার অপযশ রটে,
শুনিবার পাই সব কথা।।
আমার কথাটী শুন, না করিহ ইহা পুনঃ,
না মজে নন্দের কুল গারি।
চণ্ডীদাসেতে কয়, একথা কি মনে লয়,
নাগরীর পরি হইল বৈরী।।

————–

চেট্টে নেট্টে – তরুণী বধূগণ। অদ্যাপি চেটো বৌ বলিয়া থাকে। নহিলে নহিতাম পরতীত – নতুবা বিশ্বাস করিতাম না। ভালে – ভাগ্যে। অপলাষ – অপমান। গারি – গৌরব। বৈরী – শত্রু।

শ্রীকৃষ্ণের আপ্তদূতী

শ্রীকৃষ্ণের আপ্তদূতী ।। তিরোতা ধানশী ।।

সে যে নাগর গুণধাম। জপয়ে তোহারি নাম।।
শুনিতে তোহারি বাত। পুলকে ভরয়ে গাত।।
অবনত করি শির। লোচনে ঝরয়ে নীর।।
যদি বা পিছয়ে বাণী। উলট করয়ে পাণি।।
কহিয়ে তোহারী রীতে। আন না বুঝতে চিতে।।
ধৈরজ নাহিক তায়। বড়ু চণ্ডীদাসে গায়।।
————–
জপয়ে – জপ করে। তোহারি – তোমার। ভরয়ে – পরিপূর্ণ হয়। গাত – গাত্র।

শ্রীকৃষ্ণের আপ্তদূতী ।। শ্রীরাগ ।।

এধনি এধনি বচন শুন।
নিদান দেখিয়া আইনু পুন।।
নাবাঁধে চিকুর নাপরে চীর।
নাখায় আহার নাপিয়ে নীর।।
দেখিতে দেখিতে বাঢ়ল ব্যাধি।
যত তত করি নহিয়ে সুধি।।
সোণার বরণ হইল শ্যাম।
সোঙরি সোঙরি তোহার নাম।।
নাচিহ্নে মানুখ নিমিখ নাই।
কাঠের পুতলি রহিছে চাই।।
তুলাখানি দিলে নাসিকা মাঝে।
তবে সে বুঝিনু শোয়াস আছে।।
আছয়ে শ্বাস নারহে জীব।
বিলম্ব নাকর আমার দিব।।
চণ্ডীদাস কহে বিরহ বাধা।
কেবল মরমে ঔখদ রাধা।।
————–
চীর – বস্ত্র। সোঙরি – স্মরণ করিয়া। নাচিহ্নে – চিনিতে পারে না। মানুখ – মানুষ। শোয়াস – শ্বাস। ঔখদ – ঔষধ।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। বরাড়ী ।।

বাদিয়ার বেশ ধরি, বেড়ায় সে বাড়ী বাড়ী,
আইলেন ভানুর মহলে।
খুলি হাঁড়ি ঢাকনি, বাহির করয়ে ফণী,
তুলিয়া লইল এক গলে।।
বিষহরি বলি দেয় কর।
শুনিয়া যতেক বালা, দেখিতে আইল খেলা,
খেলাইছে মাল পুরন্দর।।
সাপিনীরে দেয় থোব, সাপিনী বাঢ়য়ে কোব,
দন্ত করি উঠি ধরে ফণা।
অঙ্গুলী মুড়িয়া যায়, সাপিনী ফিরিয়া চায়,
ছুঁয়ে যায় বাদিয়ার দাপনা।।
খেলা দেখি গোপীগণ, বড় আনন্দিত মন,
কহে “তুমি থাক কোন্‌ স্থানে”?
“থাকি বনের ভিতরে, নাগদমন বলে মোরে,
নাম মোর জানে সব জনে।।
বসন মাগিবার তরে, আইনু তোমার ঘরে,
বস্ত্র দেহ আনিয়া আপনি।
ছেঁড়া বস্ত্র নাহি লব, ভাল একখানি পাব,
দেখি দেও শ্রীঅঙ্গের খানি।”
“বটের ভিখারী হও, বহু মূল্য নিতে চাও,
নহিলে শোভিত চায় বটে।
বনে থাক সাপ ধর, তেনা পরিধান কর,
সদাই বেড়াও নদীতটে।”
বেদে কহে ধীরে ধীরে, “তোমার বস্ত্র নিব শিরে,
মনে মোর হবে বড় সুখ।
তোমার সঙ্গ করিতে, অভিলাষ হয় চিতে,
তুমি যদি না বাসহ দুখ।।”
“চুপ করে থাক বেদে, যা পাও তা নেও সেধে,
ভরমে ভরমে যাও ঘরে।”
“চুরি চারি নাহি করি, ভিক্ষা করি পেট ভরি,
আমি ভয় করিব কাহারে?
তোমা লঞা করি ক্রীড়া, তুমি কেন মান পীড়া।
সুখী কর এ দুখিয়া জনে।”
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, বাদিয়া যে এই নয়,
বুঝিয়া দেখহ আপন মনে।।

————–

ভানুর মহলে – বৃষভানু রাজার বাড়ীতে। পুরন্দর – বিষ্ণু। থাবা। থোব – কোপ, রাগ। নাগদমন – কালীয় দমন–সাপুড়ে। বটের – কড়ি। তেনা – ছেঁড়া বস্ত্র। ভরমে ভরমে – (এখানে) মানে মানে।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। বালা ধানশী ।।

গোকুল নগরে, ইন্দ্র পূজা করে,
দেখি আইল যত নারী।
নগর ভিতর, মহা কলরব,
নাগর হইল পসারী।।
দোকান দাকান, মেলিল তখন,
দেখিয়া গাহকীগণ।
কহয়ে পসারী, “বহু দ্রব্য আছে,
যে নিতে চাহে যে ধন।।
মুকুতা প্রবাল, মণিময় হার,
পোতিক মাণিক যত।
বহু দিন মেনে, আনিনু যতনে,
তোমাদের অভিমত।।”
খন্তিক পুতিয়া, মুকুতা ঝুলায়া,
কহয়ে গাহকী আগে।
শুনি গাহকিনী, আসিয়া আপনি,
দোকান নিকটে লাগে।।
সুমধুর বাণী, বলে সে দোকানী,
কিসের লইবে ছড়া।
মুকুতা মাল, লইবে ভাল,
কড়ি যে লাগিবে বাড়া।।
শুনি নারীগণ, বলয়ে বচন,
“গাহকী নহি যে মোরা।”
“কিবা ভাগ্য মেনে, দেখিছি জনমে।
এমন ধন যে তোয়া।।”
যুবতী রসাল, নিল এক মাল,
দিল এক সখী গলে।
পরিমাণ হলো, আনন্দ বাড়িল,
“কতেক লইবে” বলে।।
আর এক জনে, সাধ করি মনে,
লইল সোণার সূচ।
লই চলি যায়, বেতন না দেয়,
পসারী ধরিল কুচ।।
ফেরা ফেরি করে, কুচ নাহি ছাড়ে,
কহে “মূল্য দেহ মোর।”
সঘন বদন, করয়ে চুম্বন,
“এমতি কাজ যে তোর।”
কাড়াকাড়ি ঘন, না মানে বারণ,
অজারক হলো পারা।
যাহার যে ধন, কাটে সেই জন,
রক্ষক হইবে কারা!
রজকী সঙ্গতী, চণ্ডীদাস গতি,
রচিল আনন্দ বটে।
দোকান দাকান, হলো সমাধান,
সকল গেল যে লুটে।।

————–

পসারী – দোকানী। খন্তিক – খন্তা। পরিমাণ হলো – মাপে ঠিক হলো। বেতন – মূল্য। সমাধান – শেষ।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। তুড়ি ।।

কানুর পিরীতি, কুহকের রীতি,
সকলি মিছাই রঙ্গ।
দড়াদড়ি লৈঞা, গ্রামেতে চড়িয়া,
ফিরয়ে করিয়ে সঙ্গ।।
সই! কানু বড় জানে বাজি।
বাঁশ বংশীধারি, মদন সঙ্গে করি,
ঢোলক ঢালক সাজি।।
মদন ঘুরিয়া, বেড়ায় ফিরিয়া,
যুবতী বাহির করে।
দুইটী গুটিয়া, ফেলাঞা লুফিয়া,
বুকের উপর ধরে।।
ধীরি ধীরি যায়, ভঙ্গী করি চায়,
রঙ্গ দেখে সব লোকে।
দড়ায়ে পায়ে, উঠয়ে তাহে,
থাকি থাকি দেহ ঝোঁকে।
মুকুতা প্রবাল, উগরে সকল,
আর বহুমূল্য হীরা।
একবার আসি, উগরে রাশি,
নাচিয়া বেড়ায় ফিরা।
কতক্ষণ বই, বাঁশ হাতে লই,
যুবতী হিয়ার পাড়ে।
জঙ্ঘে জঙ্ঘ দিয়া, পায়েতে ছান্দিয়া,
বাঁশের উপর চড়ে।।
চড়িয়া উপরে, ঝুলিয়া পড়য়ে,
চুম্বই যুবতী মুখে।
মুখে মুখ দিয়া, পান গুয়া নিয়া,
ঘুরিয়া বেড়ায় সুখে।।
লোক নহে রাজি, কেমন সে বাজি,
রমণী ভুলাবার তরে।
চণ্ডীদাস কয়, বাজি মিছে নয়,
রঙ্গ কে বুঝিতে পারে।

————–

কুহক – বাজিকর। লৈঞা – লইয়া। দড়ায়ে পায়ে – পায়ে দড়ি জড়াইয়া। উগরে – উদ্গীরণ করে। কতক্ষণ বই – কতক্ষণ পরে।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। কামোদ ।।

নামিল আসিয়া, বসিল হাসিয়া,
কহয়ে বেতন দেও।
বেতনের কালে, হাত দিয়া গালে,
যুবতী সকলে কয়।।
সই! বাজিকরে নিবে যে কি?
যত কিছু দেই, কিছুই না লয়,
(বলে) আমারে জিজ্ঞাস কি?
মনে এই কই, দেহ কুচ-গিরি,
আর তব মুখ-সুধা।
আর এক হয়, মোর মনে লয়,
তাহা মোরে দেহ জুদা।।
সুন্দরীগণে বুঝিল মনে,
ইহার গ্রাহক তুমি।
চিটের চিটানি খেতের মিঠানি,
সকলি জানি যে আমি।।
চণ্ডীদাস কয়, তবে কেন নয়,
জানিয়া চতুরপণা।
বুঝিলে না বুঝে, কহিলে না সুঝে,
তাহার বলি যে কালা।।

————–

জুদা – স্বতন্ত্র, পৃথক। চিটের চিটানি – চতুরের চাতুর্য্য। মিঠানি – মিষ্টরস।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ধানশী ।।

না ভাঙ্গিল মান দেখি চতুর নাগর।
বিশাখারে ডাকি কহে বচন উত্তর।।
শুনহ আমার কথা বিশাখা সুন্দরী।
আমারে সাজায়ে দেহ নবীন এক নারী।।
চূড়া ধড়া তেয়াগিয়া কাঁচলি পরিল।
নাপিতিনী বেশ ধরি নাগর দাঁড়াইল।।
জয় রাধে শ্রীরাধে বলি করিল গমন।
রাইয়ের মন্দিরে আসি দিল দরশন।।
“কি লাগিয়ে ধূলায় পড়ে বিনোদিনী রাই।
হের এস তুয়া পায়ে যাবক পরাই।।”
চরণ মুকুরে শ্যাম নিজ মুখ দেখে।
যাবকের ধারে ধারে নিজ নাম লেখে।।
সচকিত হয়ে ধনী অরণ পানে চায়।
আচম্বিতে শ্যাম অঙ্গের গন্ধ কেন পায়।।
ইঙ্গিতে কহিল তখন বিশাখা সুন্দরী।
নাপিতিনী নহে তোমার নাগর বংশীধারী।।
বাহু পসারিয়া নাগর রাই নিল কোলে।
“আর না করিব মান” চণ্ডীদাসে বলে।

————–

যাবক – আলতা।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ধানশী ।।

ধরি নাপিতিনী বেশ, মহলেতে পরবেশ,
যেখানেতে বসিয়াছে রাই।
হাতে দিয়া দরপণী, খোলে নখ-রঞ্জণী,
বোলে বৈস, দেই কামাই।।
বসিলা যে রসবতী নারী।
খুলিল কনক বাটী, আনিয়া জলের ঘটী,
ঢালিলেক সুবাসিত বারি।।
করে নখ-রঞ্জণী, চাঁছয়ে নখের কণি,
শোভিত করিল যেন চাঁদে।
আলসে অবশ-প্রায়, ঘুম লাগে আধ গায়,
হাত দিলা নাপিতিনী কাঁধে।।
নাপিতিনী একে শ্যামা, ননীর পুতলী, ঝামা
বুলাইছে মনের আনন্দে।
ঘসি ঘসি রাঙ্গা পায়, আলতা লাগায় তায়,
রচয়ে মনের হরষেতে।।
রচয়ে বিচিত্র করি, চরণ হৃদয়ে ধরি,
তলে লিখে আপনার নাম।
কত রস পরকাশি, হাসয়ে ঈষৎ হাসি,
নিরখি নিরখি অবিরাম।।
নাপিতিনী বলে “ধনি, দেখহ চরণ খানি,
ভাল মন্দ করহ বিচার।”
দেখি সুবদনী কহে, “কি নাম লিখা উহে,
পরিচয় দেও আপনার।।”
নাপিতিনী কহে “ধনি, শ্যাম নাম ধরি আমি,
বসতি যে তোমার নগরে।”
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়, এই নাপিতিনী নয়,
কামাইলা যাও নিজ ঘরে।।

————–

যাবক – আলতা। নখ-রঞ্জণী – নরুণ। চাঁছয়ে – বিভিন্ন পাঠ “চাঁকয়ে।” একে – “বরণ একে” পাঠান্তর। প্রা, কা, সং। আনন্দে – “আকুতে” পাঠও আছে।

নাপিতিনী বলে “ধনি, দেখহ চরণ খানি,
ভাল মন্দ করহ বিচার।”
দেখি সুবদনী কহে, “কি নাম লিখা উহে,
পরিচয় দেও আপনার।।”
বিভিন্ন পাঠঃ
নাপিতিনী বাণী শুনি, দেখিয়া চরণ খানি,
তলে লেখা দেখে শ্যাম নাম।
তবে বুঝি আপন মনে, চাহে নাপিতিনী পানে,
বলে তুমি কহ আপন নাম।।
–প্রা, কা, সং।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। সুহিনী ।।

নাপিতিনী কহে “শুন লো সই।
অনাথী জনের বেতন কই?
কহ তুমি যাই রাইয়ের কাছে।
বেতন লাগিয়া বসিয়া আছে।।
যদি কহে তবে নিকটে যাই।
যে ধন দেন তা সাক্ষাতে পাই।।”
শুনি সখী কহে রাইয়ের কাছে।
“নাপিতিনী বসি আছয়ে নাছে”।।
রাই কহে “তবে আনহ তায়।
কতেক বেতন আমায় চায়?”
সখী যাই কবে ডাকয়ে “আইস।
আসিয়া রাইয়ের নিকটে বৈস।”
বসিল দুঃখিনী নাপিতিনী শ্যামা।
“কহয়ে বেতন দেহ যে রামা।।”
রাই কহে “কিবা হইবে তোর।”
সে কহে বেতন নাহিক ওর।।”
হাসিয়া কহয়ে সুন্দরী রাই।
“হেন নাপিতিনী দেখি যে নাই।।
এমতে ধন যে করেছ কত?”
সে কহে, “ভুবনে আছয় যত।।
এক ধন আছে তোমার ঠাঁই।
সে ধন পাইলে ঘরকে যাই।।
হৃদয়ে কনক কলস আছে।
মণিময় হার তাহার কাছে।।
তাহার পরশ রতন দেহ।
দরিদ্র জনারে কিনিয়া লহ।।”
হাসিয়া কহয়ে সুন্দরী গৌরী।
“ভাল নাপিতিনী পরাণ চুরি।।
পরশ রতন পাইবা বনে।
এখনে চলহ নিজ ভবনে।।”
চণ্ডীদাস কহে না কর লাজ।
নাপিতিনী নহে রসিক রাজ।।

————–

নাছে – পশ্চাদ্বার।

বসিল দুঃখিনী নাপিতিনী শ্যামা।
“কহয়ে বেতন দেহ যে রামা।।”
কথান্তরঃ
আসি নাপিতিনী কহয়ে তায়।
বেতন কেন না দেও আমায়।।
–প, ক, ত।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। সুহিনী ।।

এক দিন মনে রভস কাজ।
মালিনী হইল রসিক রাজ।।
ফুলমালা গাঁথি ঝুলায়ে হাতে।
“কে নিবে, কে নিবে” ফুকারে পথে।।
তুরিতে আইলা ভানুর বাড়ী।
রাই কহে “কত লইবে কড়ি?”
মালিনী লইয়া নিভৃতে বসি।
মালা মূল করে ঈষৎ হাসি।।
মালিনী কহয়ে “সাজাই আগে।
পাছে দিবা কড়ি যতেক লাগে।।”
এত কহি মালা পরায় গলে।
বদন চুম্বন করিল ছলে।।
বুঝিয়া নাগরী ধরিলা করে।
“এত টীটপনা আসিয়া ঘরে?”
নাগর কহয়ে “নহি যে পর।”
চণ্ডীদাস কহে কি কর ডর।।

————–

রভস – রহস্য। রাজ – কৃষ্ণ। ফুকারে – চিৎকার করে। মূল – মূল্য, দাম। টীটপনা – চতুরতা।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ভাটিয়ারী ।।

“গোকুল নগরে, ফিরি ঘরে ঘরে,
বেড়াই চিকিৎসা করি।
যে রোগ যাহার, দেখি একবার,
ভাল যে করিতে পারি।।
শিরে শির শূল, পিরিতের জ্বর,
হয়ে থাকে যে রোগীর।
বচন না চলে, আঁখি নাহি মেলে,
তাহারে পিয়াই নীর।।
কেবল একান্ত ধম্বন্তরি।
নাহি জানে বিধি, এমন ঔষধি,
পিয়াইলে যায় জ্বরি।।
ঔষধ খেয়ে, ভাল যে হয়ে,
বট দিও তবে পাছে।”
একজন তথা, শুনিয়া সে কথা,
কহিল রাধার কাছে।।
পরের মুখে, শুনিয়া সুখে,
হরষিত হলো মন।
বলে যে “যাইয়া, আনহ ডাকিয়া,
দেখি সে কেমন জন।।”
এ কথা শুনিয়া, বাহির হইয়া
কহে এক সখী ধাই।
“মোদের ঘরে, রোগী আছে জ্বরে,
দেখ একবার যাই।।”
এই বাড়ী হইতে, আসিছি তুরিতে,
কহে “হেথা থাক বসি।”
সাজ সাজাইতে, চলিল নিভৃতে,
চণ্ডীদাস কহে হাসি।।

————–

ফিরি ঘরে ঘরে – বিভিন্ন পাঠ–“প্রতি ঘরে ঘরে” প, ক, ত। জ্বরি – জ্বর। বট – কড়ি।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ভাটিয়ারী ।।

আপন বসন ঘুচায়ে তখন,
লেপয়ে কেশেতে মাটী
তবল্লক ছাঁদে, বসন পিঁধে,
সঙ্গে চলয়ে হাঁটি।।
মনোহর ঝুলি কাঁধে।
তাহার ভিতর, শিকড় নিকর,
যতন করিয়া বাঁধে।।
ঘুচাইয়া লাজে, চিকিচ্ছার কাজে,
বসিলা রোগীর কাছে।
ঘুচায়ে বসন, নিরখে বদন,
(বলে) “রোগ যে ইহার আছে।।”
বাম হাত ধরি, অঙ্গুলি মোড়ি,
দেখে ধাতু কিবা বয়।
“পিরিতের জ্বরে, জ্বরেছে ইহারে,
পরাণ রহে কি না রয়।।”
হাসিয়া নাগরী, উঠি অঙ্গ মোড়ি,
“ভাল যে কহিলা বটে।
বল কি খাইলে, হইলে সবলে,
বেয়াধি কেমনে ছুটে।।”
“ঔষধ যে হয়, মনে করি ভয়,
এখনি খাওয়ায়ে যেতেম।
ভাল যে হইত, জ্বর যে যাইত
যদি সে সময় পেতেম।।”
তখন নাগরী, বুঝিলা চাতুরী,
টীট নাগররাজ।
বাশুলী নিকটে, চণ্ডীদাস রটে,
এমন কাহার কাজ।।

————–

বসন – পাঠান্তর–“বরণ”। তবল্লক – তকল্লুবী। নিকর – রাশি। পিরিতের জ্বরে – পাঠান্তর–“পিরিতের বিষে” (প, ক, ত)।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। বরাড়ী ।।

দেয়াশিনী বেশ সাজি বিনোদ রায়।
ধীরি ধীরি করি চলে হরষ অন্তর।।
গোকুল নগরে এই শব্দ উঠিল।
এক জন দেয়াশিনী ব্রজেতে আইল।।
তাহারে দেখিবার তরে লোকের গহন।
সব ব্রজবাসী চলে হরষিত মন।।
প্রণমিল দেয়াশিনীর চরণ কমলে।
বয়ান ভাসিল প্রেমে নয়নের জলে।
দ্বিজ চণ্ডীদাসের মনে আনন্দ বাড়িল।
কোথা হইতে আইলা তুমি এ ব্রজ মণ্ডল।।

————–

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। শ্রীরাগ ।।

মধুরা পুরেতে ধাম, কপটে বলয়ে শ্যাম,
আইলাম এই বৃন্দাবনে।
মম মনে বাঞ্ছা এই, সকল তোমারে কই,
শুন শুন বলি তোমা স্থানে।।
দেবী আরাধনা করি, ভিক্ষার লাগিয়া ফিরি,
আর করি তীর্থেতে ভ্রমন।
হই আমি তীর্থবাসী, সদাই আনন্দে ভাসি,
এই সত্য বলিহে বচন।।
জিজ্ঞাসা করিলা যেই, তাহাতে তোমারে কই,
ব্রজমাঝে রব কিছুকাল।
ইহা বলি দেয়াশিনী, চলে পুন একাকিনী,
ঘন ঘন বাজাইয়া গাল।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে ভণে, আনন্দিত হয়ে মনে,
জিজ্ঞাসিল কোথা ভানুপুর।
দেখিব তাহার ধাম, কপটে বলয়ে শ্যাম,
রস লাগি রসিক চতুর।।

————–

ভানুপুর – বৃষভানু রাজার বাড়ী।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। সিন্ধুড়া ।।

দেয়াশিনী বেশে, মহলে প্রবেশে,
রাধিকা দেখিবার তরে।
সুরক্ত চন্দন, কপালে লেপন,
কুণ্ডল কাণেতে পরে।।
নাগর সাজী বাম করে ধরে।
পিঁধিয়া বিভূতি, সাজল মূরতি,
রুদ্রাক্ষ জপয়ে করে।।
কহে “জয় দেবী ব্রজপুর সেবি,
গোকুল রক্ষক নীতি।
গোপ গোয়ালিনী, সুভাগ্য দায়িনী,
পূজ দেবী ভগ্যবতী।।”
আশীর্ব্বাদ শুনি, গোপের রমণী,
আইলা দেয়াশিনী কাছে।
জিজ্ঞাসা করয়ে, যত মনে লয়ে,
বোলে ‘গোপ ভাল আছে।।
সবাকার জয়, শত্রু হবে ক্ষয়,
মনে ভয় না ভাবিবে।
তোমাদের পতি, সুন্দর সুমতি,
সবাকার ভাল হবে।।”
সঙ্গেতে কুটিলা, আসিয়া জটিলা
পড়য়ে চরণে ধরি।
“আমার বধূর, পতির মঙ্গল,
বর দেহ কৃপা করি।।”
শুনি দেয়াশিনী, হরষিত বাণী,
জটিলা সমুখে কয়।
“বর যে লইবে, ভালই হইবে,
নিকটে আনিতে হয়।।”
জটিলা যাইয়া, আনিল ধরিয়া,
আপন বধূর হাতে।
বসিলা হরষে, দেয়াশিনী পাশে,
ঘুচায়া বসন মাথে।।
দেখি দেয়াশিনী, বলে শুভ বাণী,
“সব সুলক্ষণযুতা।
গন্ধর্ব্ব পাবনী, যশোদা নন্দিনী,
রাধা নাম ভানুসুতা।।”
ধরি ধনির হাতে, মনের আকুতে,
নিরখে বদন তার।
দেখিতে দেখিতে, আনন্দিত চিতে,
মদন কৈল বিকার।।
সাজিটি খুলিয়া, ফুলটি তুলিয়া,
বাঁধেন নাগরী চুলে।
“আনন্দে থাকিবে, সকলি পাইবে,
কলঙ্ক নহিবে কুলে।।”
শুনিয়া সুন্দরী, কহে ধীরি ধীরি,
“এ কথা কহবি মোয়।
আমার হিয়ার, ব্যথাটি ঘুচয়ে,
তবে সে জানি যে তোয়।।”
“একটি শপথি, রাখহ যুবতী,
কহিতে বাসি যে ভয়।
পরপতি সনে, বেঁধেছ পরাণে,
ইহাই দেবতা কয়।।”
হাসিয়া নাগরী, চাহে ফিরি ফিরি,
“দেয়াশিনী ঘর কোথা?”
“আমার ঘর হয় যে নগর।
কহিব বিরল কথা।।”
সঙ্কেত বুঝিয়া, নয়ান ফিরিয়া,
তাক করে এক দিঠে।
নিরখি বদন, চিহ্নল তখন,
শ্যাম নাগর টীটে।।
ধীরি ধীরি করি, বসন সম্বরি,
মন্দিরে চলিলা লাজে।
চণ্ডীদাস কয়, সুবুদ্ধি যে হয়,
বেকত করয়ে কাজে।।

————–

বিভূতি – ভষ্ম। কুটিলা – শ্রীরাধিকার ননদিনী। জটিলা – শ্রীরাধিকার শ্বশ্রূ। বধূর – শ্রীরাধিকার। সুলক্ষনযুতা – সুলক্ষনযুক্ত। আকুতে – আগ্রহে। পরপতি – উপপতি।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। সিন্ধুড়া ।।

নাগর আপনি হৈলা বণিকিনী,
কৌতুক করিয়া মনে।
চুয়া যে চন্দন, আমলকী-বর্ত্তন,
যতন করিয়া আনে।।
কেশর, যাবক, কস্তূরী, দ্রাবক,
আনিল বেণার জড়।
সোন্ধা সুকুঙ্কুম, কর্পূর চন্দন,
আনিল মূথা শিকড়।।
থালিতে করিয়া, আনিল ভরিয়া,
উপরে বসন দিয়া।
মিছামিছি করি, ফিরে বাড়ী বাড়ী,
ভানুর দুয়ারে দিয়া
চুকব লইয়ে, ফুকরি কহয়ে,
আইস দাসী যে তবে।
“মোদের মহলে, অসি দেহ” বোলে
“অনেক নিতে যে হবে।।
থালিতে ধরিয়া, আনিল লইয়া,
যেখানে নাগরী বসি।
“চুয়া, সুচন্দন, করহ রচন”
বেণ্যানী মনেতে খুসি।।
“চন্দন চুবক, লইবে কতেক,
জানিতে চাহি যে আমি।”
“সকলি লইব, বেতন সে দিব,
যতেক আনহ তুমি।।”
আমলকী হাতে, দিল যে মাথে,
ঘসিতে লাগিল কেশ।
ঘসিতে ঘসিতে, শ্রম যে হইল,
নাগরী পাইল ক্লেশ।।
সুমধুর বাণী, কহে বে বেণ্যানী,
চুয়া মাখিবার তরে।
চুল যে ঝাড়িয়া, হাত নামাইয়া,
মাখায় হৃদয়পরে।।
পরশে নাগরী, হইলা আগরী,
পড়িলা বেণ্যানী কোরে।
নিন্দ সে আইল, অতি সুখ হইল,
সব শ্রম গেল দূরে।।
বেণ্যানী বলে, “গেল সে বেলে,
যাইতে চাহি যে ঘরে।”
উঠিলা নাগরী, বসন সম্বরী,
কহে “কি লাগিবে মোরে।।”
বট আনিবারে কহিলা সখীরে,
শুনিয়া নাগর রাজে।
কহে “না লইব, আর ধন নিব,
না কহি তোমারে লাজে।।”
“কহ না কেনে, কি আছে মনে,
শুনিতে চাহি যে আমি।
থাকিলে পাইবে, নতুবা যাইবে,
থির হইয়া কহ তুমি।।”
বেণ্যানী কহয়ে, “হিয়ার ভিতরে,
বড় ধন আছে সেহ।
কৃপা যে করিয়া, বাস উঘারিয়া,
সে ধন আমারে দেহ।।”
তখনে নাগরী, বুঝিলা চাতুরী,
হাসিয়া আপন মনে।
“গন্ধের বেতন, হইল এমন,
জীবন যৌবন টানে।।
কর সমাধান, বুঝিলাম কান’,
আর না বলিহ মোরে।
এতেক গুণে, মারহ পরাণে,
কেবা শিখাইল তোরে।।
পরের নারী, আশয়ে করি,
মরয়ে আপন মনে।
কোথা বা হৈয়াছে, কেবা বা পেয়েছে,
না দেখি যে কোন স্থানে।।”
চণ্ডীদাস কয়, কত ঠাঁই হয়,
যাহাতে যাহাতে বনে।
যৌবন ধনে, কিবা বা মানে,
সুঁপে সে প্রাণে প্রাণে।।

——————-

আমলকী-বর্ত্তন – আমলকীর গুলি; ইহা মাথা ঘসিবার নিমিত্ত অদ্যাপি ব্যবহৃত হয়। কেশর – নাগকেশর (গন্ধদ্রব্য)। নিন্দ – নিদ্রা। সেহ – সেই। উঘারিয়া – খুলিয়া। সমাধান – অবধান। কান’ – কানু—শ্রীকৃষ্ণ। বনে – যাহার সহিত মনের মিল হয়।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ধানশী ।।

শুনিয়া মালার কথা রসিক সুজন।
গ্রহ বিপ্র বেশে যান ভানুর ভবন।।
পাঁজি লয়ে কক্ষে করি ফিরে দ্বারে দ্বারে।
উপনীত রাই পাশে ভানু রাজ পুরে।।
বিশাখা দেখিয়া তবে নিবাস জিজ্ঞাসে।
শ্যামল সুন্দর লহু লহু করি হাসে।।
বিপ্র কহে ঘর মোর হস্তীনা নগর।
বিদেশে বেড়ায়ে খাই শুন হে উত্তর।।
প্রশ্ন দেখাবার তরে যে ডাকে আমারে।
তাহার বাড়ীতে যাই হরষ অন্তরে।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে বলে এই গ্রহাচার্য্য!
প্রশ্নেতে পারগ বড় গণনাতে আর্য্য।।
তোমাদের মনেতে যে আছে যে বলিবে।
ইহারে জড়ায়ে ধর উত্তর পাইবে।।

——————-

রসিক সুজন – শ্রীকৃষ্ণ। বিপ্র – আচার্য্য। লহু লহু করি হাসে – অল্প অল্প হাসে—মুচকিয়া হাসে।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। তুড়ি ।।

একদিন বর, নাগর শেখর,
কদম্ব তরুর তলে।
বৃষভানু সূতে, সখীগণ সাথে,
যাইতে যমুনাজলে।।
রসের শেখর, নাগর চতুর,
উপনীত সেই পথে।
শির পরশিয়া, বচনের ছলে,
সঙ্কেত করল তাতে।।
গোধন চালায়ে, শিশুগণ লয়ে,
গমন করিলা ব্রজে।
নীর ভরি কুম্ভে, সখীগণ সঙ্গে,
রাই আইলা গৃহমাঝে।।
কহে চণ্ডীদাসে, বাশুলী আদেশে,
শুন লো রাজার ঝিয়ে।
তোমা অনুগত, বঁধুর সঙ্কেত,
না ছাড় আপন হিয়ে।।

——————-

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ধানশী ।।

যাইতে জলে, কদম্বতলে,
ছলিতে গোপের নারী।
কালিয়া বরণ, হিরণ পিঁধন,
বাঁকিয়া রহিল ঠারি।।
মোহন মুরলী হাতে।
যে পথে যাইবে, গোপের বালা,
দাঁড়াইল সেই পথে।।
“যাও আন বাটে, গেলে এ ঘাটে,
বড়ই বাধিবে লেঠা।”
সখী কহে “নীতি, এ পথে যাই,
আজি ঠেকাইবে কেটা?”
হয় বোলা বুলি, করে ঠেলাঠেলি,
হৈল অরাজক পারা।
চণ্ডীদাস কহে, কালিয়া নাগর,
ছি ছি! লাগে মরি মোরা।

————–

ঠারি – দাঁড়াইয়া। আন বাটে – অন্যপথে। বোলা বুলি – বলাবলি।

প্রেম বৈচিত্ত

প্রেম বৈচিত্ত ।। সুহিনী ।।

পিরীতি বলিয়া, এ তিন আঁখর,
ভুবনে আনিল কে।
মধুর বলিয়া, ছানিয়া খাইনু,
তিতায় তিতিল দে।।
সই এ কথা কহন নহে।
হিয়ার ভিতর, বসতি করিয়া,
কখন কি জানি কহে।।
পিয়ার পিরীতি, প্রথম আরতি,
তাহার নাহিক শেষ।
পুন নিদারুণ, শমন সমান,
দয়ার নাহিক লেশ।।
কপট পিরীতি, আরতি বাঢ়ায়া,
মরণ অধিক কাজে।
লোক চরচায়, কুলে রক্ষা দায়,
জগত ভরিল লাগে।।
হইতে হইতে, অধিক হইল,
সহিতে সহিতে মনু।
কহিতে কহিতে, তনু জর জর,
পাগলী হইয়া গেনু।।
এমনি পিরীতি, না জানি এ রীতি,
পরিণামে কিবা হয়।
পিরীতি পরম, দুখময় হয়,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।

————–

তিতায় তিতিল দে – দেহ তিক্ত হইয়া গেল। আরতি – আশক্তি; অনুরক্তি।

প্রেম বৈচিত্ত লক্ষণঃ–

“প্রিয়ের নিকটে বসি প্রেমময়ী ধনী।
প্রেমের বিহ্বলে প্রিয় কোথা মনে গণি।।
চৌদিকে নেহারি কান্দে বিরহ হুতাশে।
প্রেম বৈচিত্ত ইহ হেরি হরি হাসে।।”
–ভক্তমাল

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

পিরীতি সুখের সাগর দেখিয়া
নাহিতে নামিলাম তায়।
নাহিয়া উঠিয়া, ফিরিয়া চাহিতে,
লাগিল দুখের বায়।।
কেবা নিরমিল, প্রেম সরোবর,
নিরমল তার জল।
দুখের মকর, ফিরে নিরন্তর,
প্রাণ করে টলমল।।
গুরুজন জ্বালা, জলের শিহালা,
পড়সী জীয়ল মাছে।
কুল পানীফল, কাঁটা যে সকল,
সলিল বেড়িয়া আছে।।
কলঙ্ক পানায়, সদা লাগে গায়।
ছাঁকিয়া খাইল যদি।
অন্তর বাহিরে, কুটু কুটু করে,
সুখে দুখ দিল বিধি।।
কহে চণ্ডীদাস, শুন বিনোদিনি
সুখ দুখ দুটি ভাই।
সুখের লাগিয়া, যে করি পিরীতি,
দুখ যায় তার ঠাঞি।।

————–

বায় – হাওয়া। ঠাঞি – স্থান।

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

পিরীতি বলিয়া, একটি কমল,
রসের সাগর মাঝে।
প্রেম পরিমল, লুবধ ভ্রমর,
ধায়ল আপন কাজে।।
ভ্রমরা জানয়ে, কমল মাধুরী,
তেঁহ সে তাহার বশ।
রসিক জানয়ে, রসের চাতুরী,
আনে কহে অপযশ।।
সই! একথা বুঝিবে কে?
যে জন জানয়ে, সে যদি না কহে,
কেমনে ধরিবে দে।। ধ্রু।
ধরম করম, লোক চরচাতে,
এ কথা বুঝিতে নারে।
এ তিন আখর, যাহার মরমে,
সেই সে বলিতে পারে।।
চণ্ডীদাসে কহে, শুনল সুন্দরী
পিরীতি রসের সার।
পিরীতি রসের, রসিক নহিলে,
কি ছার পরাণ তার।।

————–

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

পিরীতি পিরীতি, এ রীতি মূরতি,
হৃদয়ে লাগল সে।
পরাণ ছাড়িলে, পিরীতি না ছাড়ে,
পিরীতি গঢ়ল কে।।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আঁখর,
না জানি আছিল কথা।
পিরীতি কণ্টক, হিয়ায় ফুটিল,
পরাণ পুতলী যথা।।
পিরীতি পিরীতি, পিরীতি অনল,
দ্বিগুণ জ্বলিয়া গেল।
বিষম অনল, নিবাইল নহে,
হিয়ায় রহিল শেল।।
চণ্ডীদাস বাণী, শুন বিনোদিনি,
পিরীতি না কহে কথা।
পিরীতি লাগিয়া, পরাণ ছাড়িলে,
পিরীতি মিলায় তথা।।

————–

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

সই! পিরীতি আখর তিন।
জনম অবধি, ভাবি নিরবধি,
না জানিয়ে রাতি দিন।।
পিরীতি পিরীতি, সব জনা কহে,
পিরীতি কেমন রীত।
রসের স্বরূপ, পিরীতি মূরতি,
কেবা করে পরতীত।।
পিরীতি মন্তর, জপে যেই জন,
নাহিল তাহার মূল।
বন্ধুর পিরীতি, আপনা বেচিনু,
নিছি দিনু জাতি কূল।।
সে রূপ সায়রে, নয়ন ডুবিল,
সে গুণে বাহিল হিয়া।
সে সব চরিতে, ডুবল যে চিতে,
নিবারিব কিনা দিয়া।।
খাইতে খেয়েছি, শুইতে শুয়েছি,
আছিতে আছিয়ে ঘরে।
চণ্ডীদাস কহে, ইঙ্গিত পাইলে,
অনল দিয়ে দুয়ারে।।

————–

পরতীত – প্রত্যয়। নিছি – জলাঞ্জলি।

প্রেম বৈচিত্ত ।। ধানশী ।।

পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
সিরজিল কোন ধাতা।
অবধি জানিতে, সুধাই কাহাতে,
ঘুচাই মনের ব্যথা।।
পিরীতি মূরতি, পিরীতি রতন,
যার চিতে উপজিল।
সে ধনী কতেক, জনমে জনমে,
যজ্ঞ করিয়াছিল।।
সই! পিরীতি না জানে যারা।
এ তিন ভুবনে, জনমে জনমে,
কি সুখ জানয়ে তারা।।
যে জন যা বিনে, না রহে পরাণে,
সে যে হৈল কুলনাশী।
তবে কেনে তারে, কলঙ্কিনী বলে,
অবোধ গোকুলবাসী।।
গোকুল নগরে, কেবা কি না করে,
অবুধ মূঢ় সে লোকে।
চণ্ডীদাসে ভনে, মরুক সে জনে,
পর চরচায় থাকে।

————–

সিরজিল – সৃজন করিল। যজ্ঞ করিয়াছিল — পাঠান্তর–“ভাগ্যে করিয়াছিল” (প, ক, ত)। অবুধ – নির্বোধ। পর চরচায় – পরনিন্দায়।

প্রেম বৈচিত্ত ।। ধানশী ।।

সুখের লাগিয়া, পিরীতি করিনু,
শ্যাম বন্ধুয়ার সনে।
পরিণামে এত, দুখ হবে বলে,
কোন্‌ অভাগিনী জানে।।
সই পিরীতি বিষম মানি।
এত সুখ এত, দুখ হবে বলে,
স্বপনে নাহিক জানি।।
সে হেন কালিয়া, নিঠুর হইল,
কি শেল লাগিল যেন।
দরশন আশে, যেজন ফিরয়ে,
সে এত নিঠুর কেন।।
বলনা কি বুদ্ধি, করিব এখন,
ভাবনা বিষম হৈল।
হিয়া দগদগি, পরাণ পোড়নি,
কি দিলে হইবে ভাল।।
চণ্ডীদাস কহে, শুন বিনোদিনি,
মনে না ভাবিহ আন।
তুমি যে শ্যামের, সরবস ধন,
শ্যাম সে তোমার প্রাণ।।

————–

সরবস – সর্ব্বস্ব।

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

সুখের লাগিয়া, রন্ধন করিনু,
জ্বালাতে জ্বলিল সে।
স্বাদু নহিল, জাতি সে গেল,
ব্যঞ্জন খাইবে কে।।
সই! ভোজন বিস্বাদ হৈল।
কানুর পিরীতি, হেন রসবতী,
স্বাদ গন্ধ দূরে গেল।। ধ্রু।
পিরীতি রসের, নাগর দেখিয়া,
আরতি বাঢ়াইনু তাতে।
তবে সে সজনি, দিবস রজনী,
অনল উঠিল চিতে।।
উঠিতে উঠিতে, অধিক উঠিল,
পিরীতে ডুবিল দেহ।
নিমে সুধা দিয়া, একত্র করিয়া,
ঐ ছন কানুর লেহ।।
চণ্ডীদাস কয়, হিয়ায় সহয়,
সকলি গরল হৈল।
কিছু কিছু সুধা, বিষগুণা আধা,
চিরঞ্জীবী দেহ কৈল।।

————–

জ্বালাতে জ্বলিল সে — পাঠান্তর-“জ্বালাতে জ্বলিল দে।” লেহ – পিরীতি।

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

সুখের পিরীতি, আনন্দ যে রীতি,
দেখিতে সুন্দর হয়।
মধুর পীযুষে, মদন সহিতে,
মাখিলে সে রসময়।।
সই! কিবা কারিগর সে।
এমত সংযোগে, করি অনুরাগে,
কেমতে গঠিল দে।। ধ্রু।
তিন তিন গুণে, বান্ধিলেক ঘুণে,
পাঞ্জর ধসিয়া গেল।
যতন করিয়া, অবলা বধিতে,
আনিল এমনি শেল।।
এমত অকাজ, করে কোন রাজ,
বুঝিতে নারিনু মোরা।
কুলের ধরমে, ত্যজিনু মরমে,
এমনি হউক তারা।।
চণ্ডীদাস কয়, মিছা গালি হয়,
না দেখি জনেক লোকে।
আপনা আপনি, বলহ কাহিনী,
আপন মনের সুখে।।

————–

পীযুষে – অমৃতে।

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

আপনা খাইনু, সোণা যে কিনিনু,
ভূষণে ভূষিতে দেহ।
সোণা যে নহিল, পিতল হইল,
এমতি কানুর লেহ।।
সই! মদন সোণারে না চিনে সোণা।
সোণা যে বলিয়া, পিতল আনিয়া,
গড়ি দিল যে গহনা। ধ্রু।।
প্রতি অঙ্গুলিতে, ঝলক দেখিতে,
হাসয়ে সকল লোকে।
ধন যে গেল, কাজ না হইল,
শেল রহি গেল বুকে।।
যেন মোর মতি, তেমনি এগতি,
ভাবিয়া দেখিনু চিতে।
খলের কথায়, পাথারে সাঁতারি,
উঠিতে নারিনু ভিতে।।
অভাগিয়া জনে, ভাগ্য নাহি জানে,
না পূরয়ে সব সাধ।
খাইতে নাহিক ঘরে, সাধ বহু করে,
বিহি করে অনুবাদ।।
চণ্ডীদাস কহে, বাশুলী কৃপায়ে,
আর নিবেদিব কায়।
তবুত পিরীতি, নাহি পায় যদি,
পরাণে মরিয়া যায়।।

————–

ভিতে – ধারে, কিনারায়। বিহি – বিধি।

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

কানুর পিরীতি, চন্দনের রীতি,
ঘষিতে সৌরভ ময়।
ঘষিয়া আনিয়া, হিয়ায় লইতে,
দহন দ্বিগুণ হয়।।
সই! কে বলে পিরীতি হিরা!
সোণায় জড়িয়া হিয়ায় করিতে,
দুখ উপজিলা ফিরা।।ধ্রু।
পরশ পাথর, বড়ই শীতল,
কহয়ে সকল লোকে।
মুঞি অভাগিনী, লাগিল আগুনি,
পাইনু এতেক দুখে।।
সব কুলবতী, করয়ে পিরীতি,
এমন না হয় কারে।
এ পাড়া পড়সী, ডাকিনী সদৃশী,
এমত না খায় তারে।।
গৃহের গৃহিণী, আর ননদিনী,
বোলয়ে বচন যত।
কহিলে কি যায়, কি করি উপায়,
পরাণে সহিবে কত।।
নান্নুরের মাঠে, গ্রামের হাটে,
বাশুলী আছয়ে যথা।
তাহার আদেশে, কহে চণ্ডীদাস,
সুখ যে পাইব কোথা।।

————–

মুঞি – আমি।

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

কানুর পিরীতি, মরমে বেয়াধি,
হইল এতেক দিনে।
মৈলে কি ছাড়িবে, সঙ্গে না যাইবে,
কি না করিব বিধানে।।
সই! জীয়ন্তে এমন জ্বালা।
জাতি কুলশীল, সকলি ডুবিল,
ছাড়িলে না ছাড়ে কালা।। ধ্রু।
শয়নে স্বপনে, না করিয়া মনে,
ধরম গণিয়ে থাকি।
আসিয়া মদন, দেয় কদর্থন,
অন্তরে জ্বালায় উকি।।
সরোবর মাঝে, মীন যে থাকয়ে,
উঠে অগ্নি দেখিবারে।
ধীবর কাল, হাতে লই জাল,
তুরিতে ঝাপয়ে তারে।।
কানুর পিরীতি, কালের বসতি,
যাহার হিয়ায় থাকে।
খলের খলনে, জারে সেই জনে,
কলঙ্ক ঘোষয়ে লোকে।।
চণ্ডীদাস মন, বাশুলী চরণ,
আদেশে রহুক নারী।
সহিতে সহিতে, কিছু না ভাবিবে,
রহিবে একান্ত করি।।

————–

মৈলে – মরিলে। কদর্থন – কুৎসিত অর্থকরণ।

প্রেম বৈচিত্ত ।। ধানশী ।।

আমরা সরল পিরীতি গরল,
লাগিল অমিয়াময়।
মহানন্দ রতি বিছুরিনু পতি
কলঙ্ক সবাই কয়।।
সই! দৈবে হৈল হেন মতি।
অন্তর জ্বলিল পুরাণ পুড়িল,
ঐছন পিরীত রীতি।। ধ্রু।
মাটি খেদাইয়া, খাল বানাইয়া,
উপরে দেওল চাপ।
আহার দিয়া, মারয়ে বান্ধিয়া,
এমন করয়ে পাপ।।
নৌকাতে চড়াঞা, দরিয়াতে লৈঞা,
ছাড়য়ে অগাধ জলে।
ডুবু ডুবু করি, ডুবিয়া না মরি,
উঠিতে নারি যে কূলে।।
এমতি করিয়া, পরাণে মারিয়া,
চলিল আপন ঘরে।
চণ্ডীদাস কয়, এমতি সে নয়,
তুমি সে ভাবহ তারে।।

————–

বিছুরিনু – ত্যাগ করিলাম। খেদাইয়া – কাটিয়া তুলিয়া। চড়াঞা – চড়াইয়া। দরিয়াতে – সমুদ্রে।

প্রেম বৈচিত্ত ।। সুহিনী ।।

শুন সহচরি না কর চাতুরী,
সহজে দেহ উত্তর।
কি জাতি মূরতি কানুর পিরীতি,
কোথাই তাহার ঘর।।
চলে কি বাহনে, ঠিকে কোন স্থানে,
সৈন্যগণ কেবা সঙ্গে।
কোন অস্ত্র ধরে, পারাবার করে,
কেমনে প্রবেশে অঙ্গে।।
পাওয়া সন্ধান, হব সাবধান,
না লব তাহার বা।
নয়নে শ্রবণে, বচনে তেজিব,
সোঙরি তাহার পা।।
সখী কহে সার দেখি নরাকার,
স্বরূপ কহিবে কে।
অনুরাগ ছুরী বৈসে মনোপরি,
জাতির বাহির সে।
মন তার বাহন, রক্ষক মদন,
ভাবগণ তার সঙ্গে।
সুজন পাইলে না দেয় ছাড়িয়ে,
পিরীতি অদ্ভুত রঙ্গে।।
কহে চণ্ডীদাসে, বাশুলী আদেশে,
ছাড়িতে কি কর আশ।
পিরীতি নগরে বসতি করেছ,
পরেছ পিরীতি বাস।।

————–

ঠিকে – থাকে; অবস্থান করে। বা – হাওয়া। সোঙরি – স্মরণ করিয়া।

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

বিধির কুসুম, যতনে আনিয়া,
গাঁথিনু পিরীতি মালা।
শীতল নহিল, পরিমল গেল,
জ্বালাতে জ্বলিল গলা।।
সেই মালী কেন হেন হৈল।
মালায় করিয়া, বিষ মিশাইয়া,
হিয়ার মাঝারে দিল।।
জ্বালায় জ্বলিয়া, উঠিল যে হিয়া,
আপাদ মস্তক চুল।
না শুনি না দেখি, কি করিব, সখি!
আগুণ হইল ফুল।।
ফুলের উপর, চন্দন লাগল,
সংযোগ হইল ভাল।
দুই এক হৈয়া, পোড়াইলা হিয়া,
পাঁজর ধসিয়া গেল।।
ধসিতে ধসিতে, সকলি ধসিল,
নির্ম্মল হইল দেহ।
চণ্ডীদাসে কয়, কহিলে না হয়,
ঐছন কানুর লেহ।।

————–

প্রেম বৈচিত্ত ।। শ্রীরাগ ।।

ভুবন ছানিয়া, যতন করিয়া,
আনিনু প্রেমের বীজ।
রোপন করিতে, গাছ সে হইল,
সাধল মরণ নিজ।।
সই! প্রেম তনু কেন হৈল।
হাম অভাগিনী, দিবস রজনী,
সিঁচিতে জনম গেল।।
পিরীতি করিয়া, সুখ যে পাইব,
শুনিনু সখীর মুখে।
অমিয়া বলিয়া, গরল কিনিয়া,
খাইনু আপন সুখে।।
অমিয়া হইত, স্বাদু লাগিত,
হইল গরল ফলে।
কানুর পিরীতি, শেষ হেন রীতি,
জানিনু পুণ্যের বলে।।
যত মনে ছিল, সকলি পূরিল,
আর না চাহিব লেহা।
চণ্ডীদাস কহে, পরশন বিনে,
কেমনে ধরিব দেহা।।

————–
সম্ভোগ মিলন

সম্ভোগ মিলন ।। ধানশী ।।

শারদ পূর্ণিমা, নিরমল রাতি,
উজর সকল বন।
মল্লিকা মালতী, বিকশিত তথি,
মাতল ভ্রমরাগণ।।
তরুকুল ডাল, ফুল ভরি ভাল,
সৌরভে পূরিল তায়।
দেখিয়া সে শোভা, জগমনোলোভা,
ভুলিল নাগর রায়।।
নিধুবনে আছে, রতন বেদিকা,
মণি মাণিক্যেতে বাঁধা।
ফটিকের তরু, শোভিয়াছে চারু,
তাহাতে হীরার ছাঁদা।।
চারিপাশে সাজে, প্রবাল মুকুতা,
গাঁথনি আঁটনি কত।
তাহাতে বেড়িয়া, কুঞ্জ-কুটীর,
নিরমাণ শত শত।।
লেতের পতাকা, উড়িছে উপরে,
কি তার কহিব শোভা।
অতি রম্য স্থল, দেব অগোচর,
কি কহিব তার আভা।।
মাণিকের ঘটা, কিরণের ছটা,
এমতি মণ্ডপ ঘর।
চণ্ডীদাস বলে, অতি অপরূপ,
নাহিক তাহার পরে।।

————–

উজর – উজ্জ্বল। তথি – তথায়।

সম্ভোগ মিলন ।। কামোদ ।।

রমণী মোহন, বিলসিতে মন,
হইল মরমে পুনি।
গিয়া বৃন্দাবনে, বসিলা যতনে,
রমিতে বরজধনী।।
মধুর মুরলী, পূরে বনমালী,
রাধা রাধা বলি গান।
একাকী গভীর, বনের ভিতর,
বাজায় কতেক তান।।
অমিয়া নিছনি, বাজিছে সঘন,
মধুর মুরলী গীত।
অবিচল কুল, রমনী সকল,
শুনিয়া হরল চিত।।
শ্রবণে যাইয়া, রহল পরশিয়া,
বেকতে বাজিছে বাঁশী।
আইস আইস বলি, ডাকয়ে মুরলী,
যেন ভেল সুখ রাশি।।
আনন্দ অবশ, পুলক মানস,
সুকুমারী ধনী রাধে।
গৃহ কর্ম্ম যত, হৈল বিসরিত,
সকল করিল বাধে।।
রাইয়ের অগ্রেতে, যতেক রমণী,
কহয়ে মধুর বাণী।
ওই ওই শুন, কিবা বাজে তান,
কেমন করিছে প্রাণী।।
সহিতে না পারি মুরলীর ধ্বনি,
পশিল হিয়ার মাঝে।
বরজ তরুণী, হইল বাউরী,
হরিল কুলের লাজে।।
কেহ পতি সনে, আছিল শয়নে,
ত্যজিয়া তাহার সঙ্গ।
কেহ বা আছিল, সখির সহিত,
কহিতে রভস রঙ্গ।।
কেহ বা আছিল, দুগ্ধ আবর্ত্তনে,
চুলাতে রাখি বেসালি।
ত্যজি আবর্ত্তন, হই আগুয়ান,
ঐছন সে গেল চলি।।
কেহ শিশু লয়ে, কোলেতে করিয়া,
দুগ্ধ করায় পান।
শিশু ফেলি ভূমে, চলি গেল ভ্রমে,
শুনি মুরলীর গান।।
কেহ বা আছিল, শয়ন করিয়া,
নয়নে আছিল নীদ।
যেমন চোরাই, হরণ করিল,
মানসে কাটিল সীঁদ।।
কেহ বা আছিল, রন্ধন করিতে,
তেমনি চলিয়া গেল।
কৃষ্ণমুখী হৈয়া, মুরলী শুনিয়া,
সব বিসরিত ভেল।।
সকল রমণী ধাইল অমনি,
কেহ কাহা নাহি মানে।
যমুনার কূলে, কদম্বের মূলে,
মিলল শ্যামের সনে।।
ব্রজ নারীগণে দেখিয়া তখন,
হাসিয়া নাগর রায়।
রাস বিলসন, করল বচন,
দ্বিজ চণ্ডীদাস গায়।।

————–

পুনি – পুনঃ। বরজধনী – ব্রজাঙ্গনা। পূরে – শব্দ করে। বনমালী – শ্রীকৃষ্ণ। অবিচল কুল – রমণী সকল যাহারা কুলভ্রষ্টা নহে। বেকতে – ব্যক্তে–স্ফূত ধ্বনিতে। ভেল – হইল। বিসরিত – বিস্মৃত। রভস – রহস্য। আগুয়ান – অগ্রসর। মানসে কাটিল সীঁদ – মনের ভিতর সীঁদ কাটিয়া চোরে যেন হৃদয় চুরি করিল। কাহা – কাহাকে।

সম্ভোগ মিলন ।। সুহই ।।

কদম্বের বন হৈতে,
কিবা শব্দ আচম্বিতে
আসিয়া পশিল মোর কাণে।
অমৃত নিছিয়া ফেলি,
কি মাধুর্য্য পদাবলী,
কি জানি কেমন করে মনে।।
সখিরে! নিশ্চয় করিয়া কহি তোরে।
হাহা কুলাঙ্গনাগণ,
গ্রহিবারে ধৈর্য্যগণ,
যাহে হেন দশা হৈল মোরে।।
শুনিয়া ললিতা কহে,
অন্য কোন শব্দ নহে,
মোহন মুরলী ধ্বনি এহ।
সে শব্দ শুনিয়া কেনে,
হৈলা তুমি বিমোহনে,
রহ নিজ চিতে ধরি থেহ।।
রাই কহে কেবা হেন,
মুরলী বাজায় যেন,
বিষামৃতে একত্র করিয়া।
জল নহে হিমে জনু,
কাঁপাইছে সব তনু,
শীতল করিয়া মোর হিয়া।।
অস্ত্র নহে মন ফুটে,
কাটারিতে যেন কাটে,
ছেদন না করে হিয়া মোর।
তাপ নহে উষ্ণ অতি,
পোড়ায় আমার মতি,
চণ্ডীদাস ভাবি না পায় ওর।।

————–

আচম্বিতে – আচম্‌কায়, হঠাত। বিমোহনে – বিমোহিত। রহ নিজ চিতে ধরি থেহ – নিজের চিত্ত স্থির করিয়া থাক।

সম্ভোগ মিলন ।। ললিত ।।

এক শয়নে, ননদিনী সনে,
শুতিয়া আছিনু, সই!
যে ছিল মরমে, বঁধুর ভরমে,
মরম তাহারে কই।।
নিদের আলসে, বঁধুর ধাধসে,
তাহারে করিনু কোরে।
ননদী উঠিয়া, রুষিয়া বলিছে,
বঁধুয়া পাইলি কারে।
এত টীটপনা জানে কোন্‌ জনা,
বুঝিনু তোহারি রীতি।
কুলবতী হইয়া, পরপতি লৈয়া,
এমতি করহ নিতি।।
যে শুনি শ্রবণে, পরের বদনে,
নয়ানে দেখিনু তাই।
দাদা ঘরে এলে, করিব গোচর,
ক্ষণেক বিরাজ রাই।।
নিঠুর বচনে, কাঁপিছে পরাণ,
মরিয়া রহিনু লাজে।
ফিরাইয়া আঁখি, গরবেতে থাকি,
সঘনে আমারে যজে।।
এক হাতে সখী, কচালিয়া আঁখি,
নয়ানে দেখি যে আর।
চণ্ডীদাস কয়, কিবা কুল ভয়,
কানুর পিরীতি যার।।

————–

শুতিয়া – শুইয়া। বঁধুর ধাধসে – বঁধু ভ্রমে অর্থাৎ বঁধু মনে করিয়া। কোরে – কোলে। রুষিয়া – রাগ করিয়া। যজে – তর্জ্জন গর্জ্জন করে।

সম্ভোগ মিলন ।। ললিত ।।

আর একদিন সখি শুতিয়া আছিনু।
বঁধুয়ার ভরমে ননদী কোরে নিনু।।
বঁধু নাম শুনি সেই উঠিল রুষিয়া।
কহে তোর বঁধু কোথা গেল পলাইয়া?
সতী কুলবতী কুলে জ্বালি দিলি আগি।
আছিল আমার ভালে তোর বধভাগী।।
শুনিয়া বচন তার অথির পরাণি।
কাঁপয়ে শরীর, দেখি আঁখির তাজনি।।
কেমনে এড়াব সখি! তাপিনীর হাতে।
বনের হরিণী থাকে কিরাতের সাতে।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে বলে পিরীতি এমতি।
যার যত জ্বালা তার ততই পিরীতি।।

————–

নিনু – লইলাম। আগি – আগুণ। অথির – অস্থির। তাজনি – তর্জ্জন। কিরাতের – ব্যাধের।

সম্ভোগ মিলন ।। বিভাস ।।

পরাণ বঁধুকে, স্বপনে দেখিনু,
বসিয়া শিয়র পাশে।
নাসার বেশর, পরশ করিয়া,
ঈষৎ মধুর হাসে।।
পিঙল বরণ, বসন খানি,
মুখানি আমার মুছে।
শিথান হইতে, মাথাটী বাহুতে,
রাখিয়া শুতল কাছে।।
মুখে মুখ দিয়া, সমান হইয়া
বঁধুয়া করল কোলে।
চরণ উপরে, চরণ পসারি,
পরাণ পাইনু বোলে।।
অঙ্গ পরিমল, সুগন্ধি চন্দন,
কুঙ্কুম কস্তূরী পারা।
পরশ করিতে, রস উপজিল,
জাগিয়া হইনু হারা।।
কপোত পাখীরে, চকিতে বাঁটুল,
বাজিলে যেমন হয়।
চণ্ডীদাস কহে, এমতি হইলে,
আর কি পরাণ রয়।।

————–

সম্ভোগ মিলন ।। গান্ধার ।।

সাত পাঁচ সখী করে, বসিয়া ছিলাম রঙ্গে,
হেন কালে পাপ ননদিনী।
দেখিয়া আমাকে, তার কাছে ডাকে,
“আইসহ শ্যাম সোহাগিনী।।”
রাধা বিনোদিনি! তোমারে বলিতে কি?
চাই দুই তিন কথা, যে কথা তোমার,
বড়ই শুনিয়াছি।।
তুমি কোন দিনে, যমুনা সিনানে,
গিয়াছিলা নাকি একা?
শ্যামের সহিতে, কদম্ব তলাতে,
হৈয়াছিল নাকি দেখা?
সেই দিন হৈতে, সেইত পথেতে,
করে নাকি আনাগোনা?
রাধা রাধা বলি, বাজায় মুরলী,
তাহে হৈল জানা শুনা।।
যে দিন দেখিব, আপন নয়নে,
তা সঞে কহিতে কথা।
কেশ ছিঁড়ি বেশ, দূরে তেয়াগিব,
ভাঙ্গিব বাড়িয়া মাথা।।
একি পরমাদ, দেহ পরিবাদ,
এছার পাড়ার লোকে।
পর চরচায়, যে থাকে সদায়,
সাপে খাক্‌ তার বুকে।।
গোকুল নগরে, গোপের মাঝারে,
এত দিন বসি মোরা।
কভু না জানিনু, কভু না শুনিনু,
শ্যাম কাল কি গোরা।।
বড়ুয়ার ঝিয়ারী, বড় নাম ধরি,
তাহে বড়ুয়ার বৌ।
নিরমল কুলে, এ কথা যে তোলে,
সেই নারী গরল খাউ।।
চিত দড় করি, থাকলো সুন্দরী,
যেন কভু নাহি টলে।
কাহার কথায়, কার কিবা হয়,
বড়ু চণ্ডীদাস বলে।

————–

আইসহ – আইস। আনাগোনা – যাতায়াত। সঞে – সঙ্গে। চরচায় – চর্চ্চায়।

সম্ভোগ মিলন ।। সুহই ।।

একদিন যাইতে ননদিনী সনে।
শ্যাম বন্ধুর কথা পড়ি গেল মনে।।
ভাবে ভরল মন চলিতে না পারি।
অবশ হইল তনু, কাঁপে থর হরি।।
কি করিব সখি সে হইল বড় দায়।
ঠেকিনু বিপাকে আর না দেখি উপায়।।
ননদী বোলয়ে হেঁলো কি না তোর হইল?
চণ্ডীদাস বলে উহার কপালে যা ছিল।।

————–

সম্ভোগ মিলন ।। শ্রীরাগ ।।

আমার পিয়ার কথা কি কহিব সই।
যে হয়, তাহার চিতে স্বতন্তরী নই।।
তাহার গলার, ফুলের মালা,
আমার গলায় দিল।
তার মত, মোরে করি,
সে মোর মত হৈল।।
তুমি সে আমার, প্রাণের অধিক,
তেঞি সে তোমারে কহি।
এ যে কাজ, কহিতে লাজ,
আপন মনেই রহি।।
তাহার প্রেমের, বশ হৈয়া,
যে কহে তাহাই করি।
চণ্ডীদাস, কহয়ে ভাষ,
বালাই লইয়া মরি।।

————–

স্বতন্তরী – ছাড়া, বিচ্ছিন্না। তেঞি – তাই।

সম্ভোগ মিলন ।। সিন্ধুড়া ।।

এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি।
নিমিখে মানয়ে যুগ, কোরে দূর মানি।।
সমুখে রাখিয়া করে বসনের বা।
মুখ ফিরাইলে তার ভয়ে কাঁপে গা।।
এক তনু হৈয়া মোরা রজনী গোঙাই।
সুখের সাগরে ডুবি, অবধি না পাই।।
রজনী প্রভাত হৈলে কাতর হিয়ায়।
দেহ ছাড়ি যেন মোর প্রাণ চলি যায়।।
সে কথা কহিতে সই বিদরে পরাণ।
চণ্ডীদাস কহে ধনি সব পরমাণ।।

————–

নিমিখে মানয়ে যুগ, কোরে দূর মানি – চক্ষের নিমিষ পড়িলে যুগ বলিয়া মনে করে এবং এমন কি কোলে করিয়াও দূর মনে করে। বা – হাওয়া, বাতাস। গোঙাই – কাটাই। পরমাণ – প্রামাণ্য।

* পদসমুদ্র গ্রন্থে জ্ঞানদাসের ভণিতাযুক্ত দৃষ্ট হয়।

সম্ভোগ মিলন ।। সিন্ধুড়া ।।

“আমি যাই যাই” বলি বোলে তিন বোল।
কত না চুম্বন দেই, কত দেই কোল।।
পদ আধ যায় পিয়া, চায় পালটিয়া।
বয়ান নিরখে কত কাতর হইয়া।।
করে করে ধরি পিয়া শপথি দেয় মোরে।
পুনঃ দরশন লাগি কত চাটু বোলে।।
নিগূঢ় পিরীতি পিয়ার আরতি বহু।
চণ্ডীদাস কহে হিয়ার মাঝারে রহু।।

————–

পদ আধ যায় পিয়া, চায় পালটিয়া – পিয়া এক পা আধ পা যায় এবং ফিরিয়া ফিরিয়া চায়।
চাটু – প্রিয় বাক্য।

সম্ভোগ মিলন ।। মল্লার ।।

এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা,
কেমনে আইল বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে, বঁধুয়া ভিজিছে,
দেখিয়া পরাণ ফাটে।
সই! কি আর বলিব তোরে।
বহু পুণ্য ফলে, সে হেন বঁধুয়া,
আসিয়া মিলল মোরে।।
ঘরে গুরুজন, ননদী দারুণ,
বিলম্বে বাহির হৈনু।
আহা মরি মরি, সংকেত করিয়া
কত না যাতনা দিনু।
বঁধুর পিরীতি, আরতি দেখিয়া,
মোর মনে হেন করে
কলঙ্কের ডালি, মাথায় করিয়া,
আনল ভেজাই ঘরে।।
আপনার দুঃখ সুখ করি মানে,
আমার দুখের দুখী।
চণ্ডীদাস কহে, বঁধুর পিরীতি,
শুনিয়া জগৎ সুখী।।

————–

বাটে – পথে।
আঙ্গিনার মাঝে, বঁধুয়া ভিজিছে – পাঠান্তর–“আঙ্গিনার কোণে, তিতিছে বঁধুয়া”।–প্রা, কা, সং।
ঘরে গুরুজন, ননদী দারুণ – বিভিন্নপাঠ–“নহি স্বতন্তরী, গুরুজন ডরে”।–প্রা, কা, সং।
আনল ভেজাই ঘরে – ঘরে আগুণ দিই।

সম্ভোগ মিলন ।। বিভাস ।।

শ্যামলা বিমনা, মঙ্গলা অবলা,
আইল রাইয়ের পাশে।
যদি স্বতন্তরে, তথাপি রাধারে,
পরাণ অধিক বাসে।।
দেখি সুবদনী, উঠিলা অমনি,
মিলিল গলায় ধরি।
কত না যতনে, রতন আসনে,
বসায় আদর করি।।
রাই মুখ দেখি, হৈয়া মহাসুখী,
কহয়ে কৌতুক কথা।
রজনী-বিলাস, শুনিতে উল্লাস,
অমিয় অধিক গাথা।
হাস পরিহাসে, রসের আবেশে,
মগন হইলা রাধা।
চণ্ডীদাস বাণী, নিশির কাহিনী,
শুনিতে লাগয়ে সাধা।।

————–

শ্যামলা বিমনা, মঙ্গলা অবলা – রাধার সখীগণ। অমিয় – অমৃত। সাধা – সাধ।

সম্ভোগ মিলন ।। বিভাস ।।

একলি মন্দিরে, আছিলা সুন্দরী,
কোরহি শ্যামর চন্দ।
তবহু তাহার, পরশ না ভেল,
এ বড়ি মরম ধন্ধ।।
সজনী পাওল পিরীতি ওর।
শ্যাম সুন্দর, পিরীতি শেখর,
কঠিন হৃদয় তোর।।
কস্তূরী চন্দন, অঙ্গের ভূষণ,
দেখিতে অধিক জোরি।
বিবিধ কুসুমে, বাঁধিল কবরী,
শিথিল না ভেল তোরি।।
এমন কমল, বিমল মধুর,
না ভেল পুলক সাজ।
হেরইতে বলি, কবরী হেরলী,
বুঝি না করলি কাজ।।
কিয়ে ঋতুপতি, বসতি বিষয়,
তেজিয়া, দেয়লি ভঙ্গ।
চণ্ডীদাস কহে, এ দোষ কাহার,
দৈবে সে না ভেল সঙ্গ।।

————–

কোরহি শ্যামর চন্দ – কোলে শ্যামচাঁদ। তবহুঁ – তথাপি। বড়ি – বড়। ওর – সীমা। হেরলী – দেখিলি।

সম্ভোগ মিলন ।। সওয়ারি ।।

নিতই নূতন, পিরীতি দুজন,
তিলে তিলে বাঢ়ি যায়।
ঠাঞি নাহি পায়, তথাপি বাড়ায়,
পরিণামে নাহি খায়।।
সখি হে! অদ্ভুত দুহুঁ প্রেম।
এত দিন ঠাঞি, অবধি না পাই,
ইথে কি কষিল হেম।।
উপমার গণ, সব কৈল আন,
দেখিতে শুনিতে ধন্দ।
একি অপরূপ, তাহার স্বরূপ,
সবারে করিল অন্ধ।।
চণ্ডীদাস কহে, দুহুঁ সম নহে,
এখানে সে বিপরীত।
এ তিনভুবনে, হেন কোন জনে,
শুনি না দরবে চিত।।

————–

নিতই – নিত্য। ঠাঞি – স্থান। দরবে – দ্রবীভূত।

সম্ভোগ মিলন ।। সিন্ধুড়া ।।

এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি।
নিমিখে মানয়ে যুগ, কোরে দূর মানি।।
সমুখে রাখিয়া করে বসনের বা।
মুখ ফিরাইলে তার ভয়ে কাঁপে গা।।
এক তনু হৈয়া মোরা রজনী গোঙাই।
সুখের সাগরে ডুবি, অবধি না পাই।।
রজনী প্রভাত হৈলে কাতর হিয়ায়।
দেহ ছাড়ি যেন মোর প্রাণ চলি যায়।।
সে কথা কহিতে সই বিদরে পরাণ।
চণ্ডীদাস কহে ধনি সব পরমাণ।।

————–

নিমিখে মানয়ে যুগ, কোরে দূর মানি – চক্ষের নিমিষ পড়িলে যুগ বলিয়া মনে করে এবং এমন কি কোলে করিয়াও দূর মনে করে। বা – হাওয়া, বাতাস। গোঙাই – কাটাই। পরমাণ – প্রামাণ্য।

* পদসমুদ্র গ্রন্থে জ্ঞানদাসের ভণিতাযুক্ত দৃষ্ট হয়।

সম্ভোগ মিলন ।। সুহই ।।

একে কুলবতী ধনী তাহে সে অবলা।
ঠেকিল বিষম প্রেমে কত সবে জ্বালা।।
অকথন বেয়াধি এ, কহা নাহি যায়।
যে করে কানুর নাম, ধরে তার পায়।।
পায়ে ধরি কাঁদে সে চিকুর গড়ি যায়।
সোণার পুতলি যেন ভূমেতে লোটায়।।
পুছয়ে কানুর কথা ছল ছল আঁখি।
কোথায় দেখিলা শ্যাম কহ দেখি সখি।।
চণ্ডীদাস কহে কাঁদ কিসের লাগিয়া।
সে কালা আছয়ে তোর হৃদয়ে জাগিয়া।।

————–

পুছয়ে – জিজ্ঞাসা করে।

কুঞ্জভঙ্গ

কুঞ্জভঙ্গ ।। সুহই ।।

পদউধ কাক, কোকিলের ডাক,
জানাইল রজনী শেষ।
তুরিতে নাগরী, গেলা নিজ ঘরে,
বাঁধিতে বাঁধিতে কেশ।।
অবশ আলিসে, ঠেসনা বালিসে,
ঘুমে ঢুলু ঢুলু আঁখি।
বসন ভূষণ, হৈয়াছে বদল,
তখন উঠিয়া দেখি।।
ঘরে মোর বাদী, শাশুড়ী ননদী
মিছা তোলে পরিবাদ।
জানিলে এখন, হইবে কেমন,
বড় দেখি পরমাদ।।
চণ্ডীদাস কহে, শুনলো সুন্দরি,
তুমি সে বড়ুয়ার বহু।
শ্যামের মোহন, গুণের কারণ,
লখিতে নারিবে কেহু।।

————–

পদউধ – দৈয়াল।
জানাইল রজনী শেষ – পাঠান্তর–“জাগিয়া যামিনী শেষ।”–প, ক, ত।
জানিলে এখন, হইবে কেমন, বড় দেখি পরমাদ – পাঠান্তর–“কানুর পিরীতি, কি জানি হইল, বড় দেখি পরমাদ।।”-প্রা, কা, সং।
বহু – বধু।
গুণের – পাঠান্তর-“মায়ার।” প্রা, কা, সং।
লখিতে নারিবে কেহু – বিভিন্নপাঠ–“রাখিতে না পারে কেহ।।”–প, ক, ত।

কুঞ্জভঙ্গ ।। ধানশী ।।

প্রভাতকালের কাক, কোকিল ডাকিল
দেখিয়া রজনী শেষ।
উঠিয়া নাগর, তুরিত গেল যে,
বাঁধিতে বাঁধিতে কেশ।।
সই তোরে সে বলিয়া কথা।
সে বঁধু কালিয়া, না গেল বলিয়া,
মরমে রহল ব্যথা।।
রহিয়া আলিসে, ঠেসনা বালিসে,
ঢুলু ঢুলু দুটি আঁখি।
বসনে বসনে বদল হৈয়াছে,
এখন উঠিয়া দেখি।।
ঘরে মোর বাদী, শ্বাশুড়ী ননদী,
মিছা করে পরিবাদ।
ইহাতে এমন, করিব কেমন,
কি হইল পরমাদ।।
চণ্ডীদাস কহে, মনের আহ্লাদে,
শুনহে রসিক জন।
সদা জ্বালা যার, তবে সে তাহার,
মিলয়ে পিরীতি ধন।।

————–

কুঞ্জভঙ্গ ।। সিন্ধুড়া ।।

আজুকার নিশি, নিকুঞ্জে আসি,
করিল বিবিধ রাস।
রসের সাগরে, ডুবাইল মোরে,
বিহানে চলিল বাস।।
শুনহে সুবল সখা।
সে হেন সুন্দরী, গুণের আগরি,
পুন কি পাইব দেখা?
মদনে আগুলি, গলে গলে মিলি,
চুম্বন করিল যত।
কেশ বেশ যদি, বিথার হইল,
তাহা বা কহিব কত?
অশেষ বিশেষ, বচন কহিয়া,
আবেশে কইয়া কোরে।
অঙ্গের পরশে, হিয়া ডুবাইল,
কেমনে পাসরি তারে?
চণ্ডীদাস কহে, শুনহে নাগর!
এ বড় লাগল ধন্ধ।
সে রাধা রমণী, রস শিরোমণি,
তোমারে করল বন্ধ।

————–

আগরি – আগার–ডালি। বিথার – বিস্তার–বিস্তৃত।

রসোদ্গার

রজনী বিলাস কহয়ে রাই।
সব সখীগণ বদন চাই।।
আঁখি ঢুলু ঢুলু অলস ভরে।
ঢুলিয়ে পড়িল সখীরে কোরে।।
নয়নের জলে ভাসয়ে মুখ।
দেখি সখী কহে, কহনা দুঃখ।।
ফুঁপায়ে ফুঁপায়ে কাঁদয়ে রাধা।
কহে চণ্ডীদাস নাগর ধান্দা।।

————–

রসোদ্গার ।। ধানশী ।।

রসোদ্গার ।। সিন্ধুড়া ।।

রাই, আজু কেন হেন দেখি।
আঁখু ঢুলু ঢুলু, ঘুমেতে আকুল,
জাগিয়াছ বুঝি নিশি।।
রসের ভরেতে, অঙ্গ নাহি ধরে,
বসন পড়িছে খসি।
স্বরূপ করিয়া, কহনা আমারে,
মনের মরম সখি।।
এক কহিতে, আন কহিতেছে,
বচন হইয়া হারা।
রসিয়ার সনে, কিবা রস রঙ্গে,
সঙ্গ হয়েছে পারা।।
ঘন ঘন তুমি, মুড়িতেছ অঙ্গ,
সঘনে নিশ্বাস ছাড়।
স্বরূপ করিয়া, কহনা কহসি,
কপট কেন বা কর।।
ভালের সিন্দূর, আধেক আছয়ে,
নয়নে আধ কাজল।
চাঁদ নিঙ্গাড়িয়া, এমন করিয়া,
কেবা নিল এ সকল।।
চণ্ডীদাসে কয়, যেবা সেই হয়,
ভালে ভুলাইলে কাজ।
সঙ্গের সঙ্গিনী, বঞ্চিতে নারিবে,
কিবা কর আর লাজ।।*

————–

রসিয়ার – রসিকের।

* পদকল্পতরুতে কৃষ্ণপ্রসাদের ভণিতাযুক্ত দৃষ্ট হয় বস্তুতঃ তাহা নহে। পদসমুদ্রগ্রন্থে চণ্ডীদাসের ভণিতা আছে। পদসমুদ্র ১৬০৫।

রসোদ্গার ।। ধানশী ।।

ঐছন শুনইতে, মুগধ রমণী।
সখীগণ ইঙ্গিতে, অবনত বয়নী।।
লাগে বচন নাহি করে পরকাশ।
সখীগণে কহইতে, প্রিয়তম ভাষ।।
কহইতে না কহসি, রজনীকো কাজ।
আমার শপথি তোয়ে যদি কর লাজ।।
পহিল সমাগমে, হইল যত সুখ।
পুনহি মিলনে পাওব কত সুখ।।
ঐছন বচন শুনি, কহে মৃদু ভাষি।
চণ্ডীদাস ইহ রস পরকাশী।।*

————–

পহিল – প্রথম।

* পদসমুদ্র ১৬০৬।

রসোদ্গার ।। সুহই ।।

কহে সুবদনী, শুন গো সজনি,
দুঃখ কি বলিব আর।
কি করি এখন, জুড়াই জীবন,
বদন দেখিব তার।।
তাহার আরতি কিবা দিবা রাতি,
ভুলিতে নাহিক পারি।
মনে হলে মুখ, ফাটে মোর বুক,
গুমরে গুমরে মরি।।
সহেনাক আর, করি অভিসার
আজি হই বলরাম।
যশোদা মন্দিরে, যাইব সত্ত্বরে,
ভেটিব নাগর কান।।
শুনিয়া ললিতা, হাসি কহে কথা,
বলাই সাজিলে পরে।
চণ্ডীদাস ভণে, যশোদা যতনে
সঁপিবে তোমার করে।।

————–

আরতি – আশক্তি; আদর। অভিসার – নায়ক সহবাসার্থ সঙ্কেত স্থানে গমন। ভেটিব – সাক্ষাৎ করিব।

প্রথম পহর নিশি, সুস্বপন রাশি। ধ্রু।
সব কথা কহিয়ে তোমারে।
বসিয়া কদম্ব তলে, সে কানু করিছে কোলে,
চুম্ব দিছে বদন কমলে।।
অঙ্গে দেই চন্দন, বলে মধুর বচন,
আরে বাঁশী বায় সুমধুরে।
চাহিলেন সুরতি, না দিনু যে পাপমতি,
দেখিনু কানু দোয়জ পহরে।।
তৃতীয় পহর নিশে, শ্যামের কোলেতে বসি,
নেহারনু সে চাঁদ বদনে।
ঈষৎ হাসন করি, প্রাণ মোর নিল হরি,
বেয়াকুলি হইনু মদনে।।
চতুর্থ পহরে কান, করিল অধর পান,
মোরে ভেল রতি অশোয়াসে।
দারুণ কোকিল নাদে, ভাঙ্গিল মোহর নিদে,
রহ গাইল বড়ু চণ্ডীদাসে।।

————–

রসোদ্গার ।। বিভাস ।।

বায় – বাজে। সুরতি – রতিক্রীড়া। দোয়জ – দ্বিতীয়।

অনুরাগ–নায়ক সম্বোধনে

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

ভাদরে দেখিনু নটচাঁদে।
সেই হৈতে উঠে মোর কানু পরিবাদে।।
এতেক যুবতীগণ আছয়ে গোকূলে।
কলঙ্ক কেবল লেখা মোর সে কপালে।
স্বামী ছায়াতে মারে বাড়ী।
তার আগে কুকথা কয় দারুন শ্বাশুডী।।
ননদিনী দেখয়ে চোকের বালী।
শ্যাম নাগর! তোমায় পাড়ে গালি।।
এ দুঃখে পাঁজর হৈল কাল।
ভাবিয়া দেখিনু এবে মরণ সে ভাল।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে পুনঃ কয়।
পরের বচনে কি আপন পর হয়?

————–

ভাদরে – ভাদ্রে। নটচাঁদে – নষ্টচন্দ্রে।

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

যখন পিরীতি কৈলা, আনি চাঁদ হাতে দিলা,
আপনি করিতা মোর বেশ।
আঁখির আড় নাহি কর, হিয়ার উপরে ধর,
এবে তোমা দেখিতে সন্দেশ।।
একে হাম পরাধিনী, তাহে কুল কামিনী,
ঘর হৈতে আঙ্গিনা বিদেশ।
এত পরমানে প্রাণ, না যায় তবুত আন,
আর কত কহিব বিশেষ।।
ননদী বিষের কাঁটা, বিষ মাখা দেয় খোঁটা,
তাহে তুমি এত নিদারুণ।
কবি চণ্ডীদাস কয়, কিবা তুমি কর ভয়,
বন্ধু তোর নহে অকরুন।।

————–

এবে তোমা দেখিতে সন্দেশ – এখন তোমার সস্বাদ পাওয়া যায় না।

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

যখন নাগর, পিরীতি করিলা,
সুখের না ছিল ওর।
সোতের সেঁওলা, ভাসাইয়া কালা,
কাটিলা প্রেমের ডোর।।
মুঞিত অবলা, অখলা হৃদয়,
ভাল মন্দ নাহি জানি।
বিরলে বসিয়া, চিত্রেতে লিখিয়া,
বিশাখা দেখালে আনি।।
পিরীতি মূরতি, কোথা তার স্থিতি,
বিবরণ কহ মোরে।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
এত পরমাদ করে।।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
ভুবনে আনিল কে?
অমৃত বলিয়া, গরল ভক্ষিণু,
বিষেতে জ্বারিল দে।।
নদীর উপরে, জলের বসতি,
তাহার উপরে ঢেউ।
তাহার উপর, রসিকের বসতি,
পিরীতি না জানে কেউ।।
চণ্ডীদাস কয়, দুই এক হয়,
ভাবে সে পিরীতি রয়।
(নতু) খলের পিরীতি, তুষের আনল,
ধিকি ধিকি যেন বয়।।

————–

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। পঠমঞ্জরী ।।

তোমার প্রেমে বন্দী হৈলাম শুন বিনোদ রায়!
তোমা বিনে মোর চিতে কিছুই না ভায়।।
শয়নে স্বপনে আমি তোমার রূপ দেখি।
ভরমে তোমার রূপ ধরণীতে লেখি।।
গুরু জন মাঝে যদি থাকিয়ে বসিয়া।
পরসঙ্গে নাম শুনি দরবয়ে হিয়া।।
পুলকে পূরয়ে অঙ্গ, আঁখে ঝরে জল।
তাহা নেহারিয়ে আমি হইয়ে বিকল।।
নিশি দিশি বন্ধু তোমায় পাসরিতে নারি।
চণ্ডীদাস কহে হিয়ায় রাখ স্থির করি।।

————–

ভায় – দীপ্তি পায়।
দরবয়ে – দ্রব হয়। “দড়বড়ে” পাঠও আছে।
পূরয়ে – পূরণ করে।
নেহারিয়ে – দেখিয়া।
বিকল – বিহ্বল, কাতর।

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। সুহই ।।

কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি।
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি।।
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।।
কোন বিধি সিরজিল সোতের সেঁওলি।
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।।
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও।
মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।।
বাশুলী আদেশে দ্বিজ দণ্ডীদাস কয়।
পরের লাগিয়ে কি আপন পর হয়।।

————-

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

তোমারে বুঝাই বঁধু তোমারে বুঝাই।
ডাকিয়া সুধায় মোরে হেন জন নাই।।
অণুক্ষণ গৃহে মোর গঞ্জয়ে সকলে।
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।।
এ ছার পরাণে আর কিবা আছে সুখ?
মোর আগে দাঁড়াও তোমার দেখিব চাঁদ মুখ?
খাইতে সোয়াস্তি নাই নাহি টুটে ভুক।
কে মোর ব্যথিত আছে কারে কব দুখ।।
পরের বোলে কেবা প্রাণ ছাড়িবার চায়?
চণ্ডীদাস কহে রাই ইহা না যুয়ায়।।

————–

গঞ্জয়ে – গঞ্জনা দেয়। নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে – নিশ্চয় জানিও আমি বিষ খাইব।

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। সুহই ।।

হেদে হে বিনোদ রায়।
ভাল হৈল ঘুচাইল পিরীতের দায়।।
ভাবিতে গণিতে তনু হৈল অতি ক্ষীণ।
জগ ভরি কলঙ্ক রহিল চির দিন।।
তোমার সনে প্রেম করি কি কাজ করিনু।
মৈলাম লাগে মিছা কাজে দগদগি হৈনু।।
না জানি অন্তরে মোর হৈল কিবা ব্যথা।
একে মরি নানা দুঃখে আর নানা কথা।।
শয়নে স্বপনে বন্ধু সদা করি ভয়।
কাহার অধীন যেন তোমার প্রেম নয়।।
ঘায়ে না মরিয়ে বন্ধু মরি মিছা দায়।
চণ্ডীদাস কহে কার কথায় কিবা যায়।।

————–

জগ ভরি কলঙ্ক রহিল চির দিন – বিভিন্নপাঠ–“জগভরি কলঙ্ক রহিল এই চিন।” প, ক, ত। জগ – জগৎ।
একে মরি নানা দুঃখে আর নানা কথা – বিভিন্নপাঠ–“একে মরি মনোদুখে আর নানা কথা।” প, ক, ত।

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

সকলি আমার দোষ, হে বন্ধু,
সকলি আমার দোষ।
না জানিয়া যদি, কৈরাছি পিরীতি,
কাহারে করিব রোষ।।
সুধার সমুদ্র, সমুখে দেখিয়া
আইনু আপন সুখে।
কে জানে খাইলে, গরল হইবে,
পাইব এতেক দুখে।।
সো যদি জানিতাম, অলপ ইঙ্গিতে,
তবে কি এমন করি।
জাতি কুল শীল, মজিল সকল,
ঝুরিয়া ঝুরিয়া মরি।।
অনেক আশার, ভরসা মরুক,
দেখিতে করয়ে সাধ।
প্রথম পিরীতে, তাহার নাহিক
বিভাগের আধের আধ।।
যাহার লাগিয়া, যে জন মরয়ে,
সেই যদি করে আনে।
চণ্ডীদাস কহে, এমনি পিরীতি,
করয়ে সুজন সনে।।

————–

সো যদি জানিতাম – পাঠান্তর–“মো যদি জানিতাম।” প, ক, ত।

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। কামোদ ।।

বন্ধু কহিলে বাসিবে মনে দুখ।
যতেক রমণী ধনী, বৈঠয়ে জগত মাঝে,
না জানি দেখয়ে তুয়া মুখ।।
লোক মুখে জানিনু, লখি আগে না দেখিনু,
আমারে কুমতি দিল বিধি।
না বুঝিয়া করে কাজ, তার মুণ্ডে পড়ে বাজ,
দুঃখ রহে জনম অবধি।।
কেন হেন বেশ ধর, পরের পরাণ হর,
স্ত্রী বধিতে ভয় নাহি কর?
গগন ইন্দু আনিয়া, করে করে দর্শাইয়া,
এবে কেন এমনি আচর?
পিরীতি পরশে যার, হিয়া নাহি দরবয়ে,
সে কেনে পিরীতি করে সাধ?
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, মোর মনে হেন লয়,
ভাঙ্গিলে গড়িতে পরমান।।

————–

লখি- লক্ষ করিয়া।

অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। ভাটিয়ারি ।।

তুমি ত নাগর, রসের সাগর,
যেমত ভ্রমর রীত।
আমি ত দুঃখিনী, কুল কলঙ্কিনী,
হইনু করিয়া প্রীত।।
গুরু জন ঘরে, গঞ্জয়ে আমারে,
তোমারে কহিব কত।
বিষম বেদন, কহিলে কি যায়,
পরাণ সহিছে যত।।
অনেক সাধের, পিরীতি বন্ধু হে,
কি জানি বিচ্ছেদ হয়।
বিচ্ছেদ হইলে, পরাণে মরিব,
এমনি সে মনে লয়।।
চণ্ডীদাস কহে, পিরীতি বিষম,
শুনহ বড়ুয়ার বহু।
পিরীতি বিষদ হইলে বিপদ,
এমন না হউ কেহু।

————–

বিষদ – বিষদাতা।

অনুরাগ—সখী সম্বোধনে

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

কানড় কুসুম জিনি, কালিয়া বরণ খানি,
তিলেক নয়নে যদি লাগে।
ছাড়িয়া সকল কাজ, জাতি কুল শীল লাজ,
মরিবে কালিয়া অনুরাগে।।
সই! আমার বচন যদি রাখ।
ফিরিয়া নয়ন কোণে, না চাহিও তার পানে,
কালিয়া বরণ যার দেখ।।
পিরীতি আরতি মনে, যে করে কালিয়া সনে,
কখন তাহার নহে ভাল।
কালিয়া ভূষণ কালা, মনেতে গাঁথিয়া মালা,
জপিয়া জপিয়া প্রাণ গেল।।
নিশি দিশি অনুক্ষণ, প্রাণ করে উচাটন,
বিরহ অনলে জ্বলে তনু।
ছাড়িলে ছাড়ন নয়, পরিণামে কিবা হয়,
কি মোহিনী জানে কালা কানু।।
দারুণ মুরলী স্বর, না মানে আপন পর,
মরমে ভেদিয়া যার থাকে।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, তনু মন তার নয়,
যোগিনী হইবে সেই পাকে।।

————–

কালিয়া ভূষণ কালা – পাঠান্তর–“কালিয়া রভস কালা”। প, ক, ত।
জপিয়া জপিয়া প্রাণ গেল – পাঠান্তর–“জাগিয়া জপিয়া প্রাণ গেল।” ঐ।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

সজনি লো সই!
ক্ষণেক বৈসহ শ্যামের বাঁশীর কথা কই।।
শ্যামের বাঁশিটি, দুপুরে ডাকাতি,
সরবস হরি হৈল।
হিয়া দগদগি, পরাণ পোড়নি,
কেন বা এমতি কৈল।।
খাইতে শুইতে, আন নাহি চিতে,
বধির করিল বাঁশী।
সব পরিহরি, করিল বাউরী,
মানয়ে যেমন দাসী।।
কুলের করম, ধৈরজ ধরম,
সরম মরম ফাঁসী।
চণ্ডীদাসে ভণে, এই সে কারণে,
কানুর সরবস বাঁশী।

————–

সরবস হরি হৈল – সর্ব্বস্ব হরণ করিয়া লইল।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।

বিষম বাঁশীর কথা কহন না যায়।
ডাক দিয়া কুলবতী বাহির করয়।।
কেশে ধরি লৈয়া যায় শ্যামের নিকটে।
পিয়াসে হরিণ যেন পড়য়ে শঙ্কটে।।
হারে সই শুনি যবে বাঁশীর নিশান।
গৃহকাজ ভুলি প্রাণ করে আনচান।।
সতী ভুলে নিজপতি মুনি ভুলে মৌন।
শুনি পুলকিত হয় তরুলতাগণ।।
কি হবে অবলা জাতি সহজে সরলা।
কহে চণ্ডীদাস সব নাটের গুরু কালা।।

————–

করয় – কবে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

কুলের বৈরী, হইল মুরলী,
করিল সকল নাশে।
মদন কিরাতি, মধুর যুবতী,
ধরিতে আইল দেশে।।
সই জীবন মন নেয় বাঁশী।
পিরীতি আটা, ননদী কাঁটা,
পড়সি হইল ফাঁসি।।
বৃন্দাবন মাঝে, বেড়ায় সাজে,
ধরিতে যুবতী জনা।
যমুনার কূলে, গাছের তলে,
বসিয়া করিল থানা।।
এক পাশ হৈয়া, থাকি লুকাইয়া,
দেখি যে বসিল পাখী।
ধীরে ধীরে যাই, তাহা পানে চাই,
আনলা চালায় দেখি।।
গাছের ডালে, বসিয়া ভালে,
তাক করে এক দিঠে।
জড়াল আটা, লাগায় কাঁটা,
লাগিল পাখীর পীঠে।।
পড়িয়া ভূমেতে, ধর-ফড়াইতে,
কিরাতে ধরিল পাখে।
পাখে পাখা দিয়া, বাঁধিল টানিয়া,
ঝুলিতে ভরিয়া রাখে।।
চণ্ডীদাস কয়, মহাজন হয়,
কিনিয়া লয় সে পাখী।
ছাড়িয়া দেয়, পাখায় ধোয়ায়,
তবে সে এড়ান দেখি।।

————–

মদন কিরাতি – মদন ব্যাধ।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

মুরলীর স্বরে, রহিবে কি ঘরে,
গোকুল যুবতীগণে?
আকুল হইয়া, বাহির হইবে,
না চাবে কুলের পানে।।
কি রঙ্গ লীলা, মিলায় শিলা,
শুনিলে সে ধ্বনি কাণে।
যমুনা পবন, স্থগিত গমন,
ভুবন মোহিত গানে।।
আনন্দ উদয়, শুধু সুধাময়,
ভেদিয়া অন্তর টানে।
মরমে জ্বালা, জীয়ে কি অবলা,
হানয়ে মদন বাণে।।
কুলবতী কুল, করে নিরমূল,
নিষেধ নাহিক মানে।
চণ্ডীদাস ভণে, রাখিও মরমে,
কি মোহিনী কালা জানে।।

————–

শুনিলে সে ধ্বনি কাণে – পাঠান্তর–“শুনিতে সুন্দর কাণে”। প, ক, ত।
স্থগিত গমন – পাঠান্তর–“থাকিত গগন”। প, ক, ত। “চৌদিকে গগন”। প্রা, কা, সং।
হানয়ে – হানে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

কালা গরলের জ্বালা, আর তাহে অবলা,
তাহে মুঞি কুলের বৌহারী।
অন্তরে মরম ব্যথা, কাহারে কহিব কথা,
গুপতে গুমরি মরি মরি।।
সখিহে বংশী দংশিল মোর কাণে।
ডাকিয়া চেতন হরে, পরাণ না রহে ধড়ে,
তন্ত্র মন্ত্র কিছুই না মানে।।
মুরলী সরল হয়, বাঁকার মুখেতে রয়ে,
শিখিয়াছে বাঁকার স্বভাব।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, সঙ্গ দোষে কিনা হয়,
রাহু মুখে শশী মসি লাভ।।

————–

বৌহার – বধু।
কাহারে কহিব কথা – পাঠান্তর–“না শুনে ধরম কথা।”- প্রা, কা, সং।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

মন মোর আর নাহি লাগে গৃহ-কাজে।
নিশি দিশি কাঁদি, কিন্তু হাসি লোক লাজে।।
কালার লাগিয়া হাম হব বনবাসী।
কালা নিল জাতি কুল, প্রাণ নিল বাঁশী।।
হাঁরে সখি কি দারুণ বাঁশী।
যাচিয়া যৌবন দিয়া হনু শ্যামের দাসী।
তরল বাঁশের বাঁশী নামে বেড়া জাল।
সবার সুলভ বাঁশী রাধার হৈল কাল।।
অন্তরে অসার বাঁশী বাহিরে সরল।
পিবয়ে অধর সুধা উগারে গরল।।
যে ঝাড়ের তরল বাঁশী তারি লাগি পাও।
ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাও।।(১)
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে বংশী কি করিবে।
সকলের মূল কালা তারে না পারিবে।।(২)

————–

অসার – পাঠান্তর–“কঠিন”। প্রা, কা, সং।

(১) পাঠান্তর–
“যে না দেশে বাঁশীর ঘর সেই দেশে যাব।
ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাব।।”–প্রা, কা, সং

(২) পাঠান্তর–
“দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে বংশী যে কি করে।
আপন করম দোষ, দোষ দিবে কারে।।”–প্রা, কা, সং

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

তোমরা মোরে, ডাকিয়া সুধাও না,
প্রাণ আন চান বাসি।
কেবা নাহি করে প্রেম,
আমি হইলাম দোষী।।
গোকুল নগরে, কেবা কি না করে,
তাহে কি নিষেধ বাধা।
সতী কুলবতী সে সব যুবতী,
কানু কলঙ্কিনী রাধা।।
বাহির হইতে, লোক চরচায়,
বিষ মিশাইল ঘরে।
পিরীতি করিয়া, জগতের বৈরী,
আপনা বলিব কারে।।
তোমরা পরাণের, ব্যথিত আছিলা,
জীবন মরণে সঙ্গ।
অনেক দোষের, দোষিণী হইলে,
কে ছাড়ে আপন সঙ্গ।।
নন্দের নন্দন, গোকুল কানাই,
সবাই আপনা বলে।
সোপনু ইছিয়া, নিছিয়া লইনু,
অনাদি জনম কালে।।
রাধা বলি আর, ডাকি না সুধাও,
এখনি এখানে মৈলে।
চণ্ডীদাস কহে, সকলি পাইবা,
বঁধুয়া আপন হৈলে।।

————–

ইছিয়া – ইচ্ছা করিয়া।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

দেখিলে কলঙ্কীর মুখ কলঙ্ক হইবে।
এ জনার মুখ আর দেখিতে না হবে।।
ফিরি ঘরে যাও নিজ ধরম লইয়া।
দেশে দেশে ভরমিব যোগিনী হইয়া।।
কাল মাণিকের মালা গাঁথি নিব গলে।
কানু গুণ যশ কাণে পরিব কুণ্ডলে।।
কানু-অনুরাগ রাঙ্গা বসন পরিব।
কানুর কলঙ্ক ছাই অঙ্গেতে লেপিব।।
চণ্ডীদাস কহে কেন হইলা উদাস।
মরণের সাথি যেই, সে কি ছাড়ে পাশ!

————–

ভরমিব – ভ্রমিব।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

আগুনি জ্বালিয়া, মরিব পুড়িয়া,
কত নিবারিব মন।
গরল ভখিয়া মো পুনি মরিব,
নতুবা লউক সমন।।
সই! জ্বালহ অনল চিতা!
সীমন্তিনী লইয়া, কেশ সাজাইয়া,
সিন্দুর দেহ সে সীঁথায়।। ধ্রু।
তনু তেয়াগিয়া, সিদ্ধ যে হইব,
সাধিব মনের যত।
মরিলে সে পতি, আসিবে সংহতি,
আমারে সেবিবে কত।।
তখন জানিবে, বিরহ বেদনা,
পরের লাগিয়া যত।
তাপিত হইলে, তাপ যে জানয়ে,
তাপ হয় যে কত।।
বিরহ বেদন, না জানে আপন,
দরদের দরদী নয়।
চণ্ডীদাস ভণে, পর দরদের,
দরদী হইলে হয়।

————–

আগুনি – আগুন। মো – আমি। সীমন্তিনী – সধবা স্ত্রী। দরদের – ব্যথার।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

সই না কহ ও সব কথা।
কালার পিরীতি, যাহার লাগিল,
জনম হইতে ব্যথা।।
কালিন্দীর জল, নয়ানে না হেরি,
বয়ানে না বলি কালা।
তথাপি সে কালা, অন্তরে জাগয়ে,
কালা হৈল জপমালা।।
বঁধুর লাগিয়া, যোগিনী হইব,
কুণ্ডল পরিব কাণে।
সবার আগে, বিদায় হইয়া,
যাইব গহন বনে।।
গুরু পরিজন, বলে কুবচন,
না যাব লোকের পাড়া।
চণ্ডীদাস কহে, কানুর পিরীতি,
জাতি কুলশীল ছাড়া।

————–

কালিন্দীর – যমুনার।
বয়ানে – বদনে।
অন্তরে জাগয়ে – পাঠান্তর–“অন্তর না ছাড়ে।” প্রা, কা, সং।
বিদায় হইয়া – পাঠান্তর–“কহিয়া বলিয়া।” প্রা, কা, সং।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।

কাস জল ঢালিতে সই কালা পড়ে মনে।
নিরবধি দেখি কালা শয়ন স্বপনে।।
কাল কেশ এলাইয়া বেশ নাহি করি।
কাল অঞ্জন আমি নয়ানে না পরি।।
আলো সই মুঞি শুনিলাম নিদান।
বিনোদ বঁধুয়া বিনে না রহে পরাণ।।
মনের দুখের কথা মনে সে রহিল।
ফুটিল সে শ্যাম শেল বাহির নহিল।।
চণ্ডীদাস কহে রূপ শেলের সমান।
নাহি বাহিরায় শেল দগধে পরাণ।।

————–

বাহিরায় – বাহির হয়।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। বড়ারী ।।

কাল কুসুম করে, পরশ না করি ডরে,
এবড় মনের মনো ব্যথা।
যেখানে সেখানে যাই সকল লোকের ঠাঁই,
কাণাকাণি শুনি এই কথা।।(১)
সই! লোকে বলে কালা পরিবাদ।
কালার ভরমে হাম, জলদে না হেরি গো,
ত্যজিয়াছি কাজরের সাধ।।(২)
যমুনা সিনানে যাই, আঁখি মেলি নাহি চাই,
তরুয়া কদম্ব তলা পানে।
যথা তথা বসে থাকি, বাঁশীটি শুনিয়ে যদি,
দুটি হাত দিয়া থাকি কাণে।।
চণ্ডীদাস ইথে কহে, সদাই অন্তর দহে,
পাসরিলে না যায় পাসরা।
দেখিতে দেখিতে হরে, তবু মন চুরি করে,
না চিনি যে কালা কিংবা গোরা।।

————–

(১) পাঠান্তর–“সদাই শুনিতে পাই, কাণে কাণে কহে তুয়া কথা।” প্রা, কা, সং।
(২) শ্রীকৃষ্ণের রূপ মেঘের মত সেই জন্য লজ্জায় আমি মেঘের দিকে তাকাই না। কাজরও আর পরি না, কেন না কাজর দেখিতে শ্রীকৃষ্ণকে মনে পড়ে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

পাসরিতে চাহি তারে পাসরা না যায় গো।
না দেখি তাহার রূপ মনে কেন টানে গো।।
খাইতে বসি যদি খাইতে কেন নারি গো।
কেশ পানে চাহি যদি নয়ান কেন ঝুরে গো।।
বসন পরিয়া থাকি চাহি বসন পানে গো।
সমুখে তাহার রূপ সদা মনে ঝাপে গো।।
ঘর মোর সাধ নাই কোথা আমি যাব গো।
না জানি তাহার সঙ্গ কোথা গেলে পাব গো।।
চণ্ডীদাস কহে মন নিবারিয়া থাক গো।
সে জনা তোমার চিতে সদা জাগি আছে গো।*

————–

* লীলাসমুদ্র।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।

এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে।
না জানি কানুর প্রেম তুলে জনি ছুটে।।
গড়ন ভাঙ্গিতে সই আছে কত খল।
ভাঙ্গিয়া গড়িতে পারে সে বড় বিরল।।
যথা তথা যাই আমি যতদূরে পাই।
চাঁদমুখের মধুর হাসে তুলেক জুড়াই।।
সে হেন বন্ধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়।
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়।।
চণ্ডীদাস কহে রাই ভাবিছ অনেক।
তোমার পিরীতি বিনে সে জীয়ে তিলেক।।

পাঠান্তর—গড়ন ভাঙ্গিতে সই আছে কত’জন। প্রা, কা, সং।
পাঠান্তর—“ভাঙ্গিয়া গড়িতে পারে সে বড় সুজন”। ঐ
বিভিন্ন পাঠ—“সে হেন বন্ধুরে মোর যে জন ভাঙ্গিবে।/অবলা রাধার বধ তাহারে লাগিবে।।”

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

কানু পরিবাদ, মনে ছিল সাধ,
সফল করিল বিধি।
কুজন বচনে, ছাড়িতে নারিব,
সে হেন গুণের নিধি।।
বঁধুর পিরীতি, শেলের ঘা,
পহিলে সহিল বুকে।
দেখিতে দেখিতে, ব্যথাটী বাড়িল,
এ দুখ কহিব কাকে।।
অন্য ব্যথা নয়, বোধে শোধে যায়,
হিয়ার মাঝারে থুয়া।
কোন কুলবতী, কুল মজাইয়া,
কেমনে রৈয়াছে শুয়া?
সকল ফুলে, ভ্রমরা বুলে,
কি তার আপন পর।
চণ্ডীদাস কহে, কানুর পিরীতি,
কেবল দুঃখের ঘর।।

————–

পহিলে – (হিন্দী) প্রথমে। কেমনে রৈয়াছে শুয়া – কেমনে শুইয়া রহিয়াছে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

সখিরে! মনের বেদনা, কাহারে কহিব,
কেবা যাবে পরতীত।
কানুর পিরীতে, ঝুরি দিবা রাতে,
সদাই চমকে চিত।।
কুল তেয়াগিনু, ভরম ছাড়িনু,
লইনু কলঙ্কের ডালা।
যে জন যে বল, আমারে বল,
ছাড়িতে নারিব কালা।।(১)
সে ডালি মাথায় করি, দেশে দেশে ফিরি,
মাগিয়া খাইব যবে।
সতী চরাচর, কুলের বিচার,
তবে সে আমার যাবে।।
চণ্ডীদাস কয়, কলঙ্কে কি ভয়,
যে জন পিরীতি করে।
পিরীতি লাগিয়া, মরে সে ঝুরিয়া,
কি তার আপন পরে।।

————–

ভরম – পাঠান্তর–“ধরম”। প্রা, কা, সং।

(১) বিভিন্ন পাঠ–
সই ছাড়িতে নারিব কালা।
কুল তেয়াগিনু, ভরম ছাড়িনু,
লইনু কলঙ্কের ডালা। লী, স।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

আগো সই কে জানে এমন রীত।
শ্যাম বঁধুর সনে, পিরীত করিয়া,
কেবা যাবে পরতীত।।
খাইতে পিরীতি, শুইতে পিরীতি,
পিরীতি স্বপনে দেখি।
পিরীতি লহরে, আকুল হইয়া,
পরাণ পিরীতি সাক্ষী।।
পিরীতি আঁখর, জপি নিরন্তর,
এক পণ তার মূল।
শ্যাম বন্ধুর সনে, পিরীতি করিয়া,
নিছিয়া দিলাম কুল।।
চণ্ডীদাস কয়, অসীম পিরীতি,
কহিতে কহিব কত।
আদর করিয়া, যতেক রাখিবে,
পিরীতি পাইবা তত।।

————–

নিছিয়া – জলাঞ্জলী।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

আমার মনের কথা শুন গো সজনি।
শ্যাম বঁধু পড়ে মনে দিবস রজনী।।
কিবা গুণে কিবা রূপে মোর মন বান্ধে।
মুখেতে না স্বরে বাণী দুটি আঁখি কান্দে।।
চিতের অনল কত চিতে নিবারিব।
না যায় কঠিন প্রাণ কারে কি বলিব।।
চণ্ডীদাস বলে প্রেমে না কুটিলতা রীত।(১)
কুল ধর্ম্ম লোক লজ্জা নাহি মানে চিত।

————–

(১) পাঠ দুর্বোধ্য ছিল। কাছাকাছি পাঠ নেয়া হয়েছে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

জাতি জীবন ধন কালা।
তোমরা আমারে, যে বল সে বল,
কালিয়া গলার মালা।।
সই! ছাড়িতে যদি বল তারে।
অন্তর সহিত, সে প্রেম জড়িত,
কে তারে ছাড়িতে পারে।।
যেদিন যেখানে, যে সব পিরীতি
লীলা করয়ে কানু।
সঙ্গের সঙ্গিনী, হৈয়া রহিনু,
শুনিতাম মধুর বেণু।।
এত রূপ নহে, হিয়া পরতীত,
যাইতাম কদম্বের তলা।
চণ্ডীদাস কহে, এত প্রাণে সহে,
বচন বিষের জ্বালা।

————–

বেণু – বাঁশী।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

বলে বলুক মোরে মন্দ আছে যত জন।
ছাড়িতে নারিব মুই শ্যাম চিকণ ধন।।
সে রূপ লাবণ্য মোর হৃদয়ে লাগি আছে।
হিয়া হৈতে পাঁজর কাটী লইয়া যায় পাছে।।
সই অই ভয় মনে বড় বাসি।
অচেতন নাহি থাকি জাগি দিবানিশি।।
অলস আইসে, নিদ যদি আইসে ইথে,
শয়ন করিয়া থাকি ভুজ দিয়া মাথে।।
এমত পিয়ারে মোর ছাড়িতে লোকে বলে।
তোমরা বলিবে যদি খাইব গরলে।।
কালা রূপের নিছনি নিছিয়া দিনু কুলে।
এত দিন বিহি মোহে হৈল অনুকূলে।।
পূরুক মনের সাধ, ধরম যাউক দূরে।
কানু কানু করি প্রাণ নিরবধি ঝুরে।।
চণ্ডীদাস কহে রাই ভাল ভাবিয়াছ।
মনের মরম কথা কারে জানি পুছ।।

————–

নিছনি – বালাই; ছবি। নিছিয়া – জলাঞ্জলী। বিহি মোহে – বিধি মোরে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। দাস পাড়িয়া ।।

দূর দূর কলঙ্কিনী বলে সব লোকে গো।
না জানি কাহার ধন নিলাম আমি গো।।
কার সনে না কহি কথা থাকি ভয় করি গো।
তবুত দারুণ লোকে কহে সেই কথা গো।।
তার সনে মোর দেখা নাই, রটে মিছা কথা গো।
দেখা হইলে কইত যদি তার বোলে সইত গো।।
মিছা কথা কহিয়া পরের মন ভারি করে গো।
পর কুচ্ছা অধর্ম্ম বিনা কেমন করে রহে গো।।
চণ্ডীদাস কয় লোকে মিছা কয় কয় গো।
হয় কি না হয় মনে আপনি বুঝে দেখ গো।।*

————–

পর কুচ্ছা – পর কুৎসা।

* লীলা সমুদ্র।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

সুজন কুজন, যে জন না জানে,
তাহারে বলিব কি?
অন্তর বেদনা, যে জন জানয়ে,
পরাণ কাটিয়া দি।।
সই কহিতে যে বাসি ডর।
যাহার লাগিয়া, সব তেয়াগিনু,
সে কেন বাসয়ে পর।।
কানুর পিরীতি, বলিতে বলিতে,
পাঁজর ফাটিয়া উঠে।
শঙ্খ বণিকের, করাট যেমতি,
আসিতে যাইতে কাটে।।
সোণার গাগরি, যেন বিষভরি,
দুধেতে পুরিয়া মুখ।
বিচার করিয়া, যে জন না খায়,
পরিণামে পায় দুঃখ।।
চণ্ডীদাসে কয়, শুনহ সুন্দরি,
এ কথা বুঝিবে পাছে।
শ্যাম বন্ধু সনে, করিয়া পিরীতি,
কেবা কোথা ভাল আছে?*

————–

* পদসমুদ্র।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

পিয়ার পিরীতি লাগি যোগিনী হৈনু।
তবুত দারুণ চিতে সোয়াস্তি না পানু।।
কি হইল কলঙ্ক রঙ্গ শুনি যথা তথা।
কেন বা পিরীতি কৈনু খাইয়া আপন মাথা।।
না বল, না বল সই সে কানুর গুণ।
হাতের কালি গায়ে দিলাম মাখিলাম চূণ।।
আর না করিব পাপ পিরীতির লেহা।
পোড়া করি সমান করিনু নিজ দেহা।।
বিধিরে কি দিব দোষ করম আপনা।
সুজনে করিনু প্রেম হইল কুজনা।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে না কর ভাবনা।
সুজনে সুজন মিলে, কুজনে কুজনা।।*

————–

* পদসমুদ্র।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

এক জ্বালা গুরু জন আর জ্বালা কানু।
জ্বালাতে জ্বলিল দে সারা হৈল তনু।।
কোথায় যাইব সই কি হবে উপায়?
গরল সমান লাগে বচন হিয়ায়।।
কাহারে কহিব কেবা যাবে পরতীত।
মরণ অধিক হৈল কানুর পিরীত।।
জারিলেক তনু মন কি করে ঔষধে।
জগত ভরিল কালা কানু পরিবাদে।।
লোক মাঝে ঠাঁই নাই অপযশ দেশে।
বাশুলী আদেশে কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।

————–

এক জ্বালা গুরু জন – বিভিন্ন পাঠ–“এক জ্বালা ঘরে হৈল”। প, ক, ত।
দে – দেহ। পাঠান্তর–“প্রাণ”। প্রা, কা, সং।
কোথায় যাইব সই – পাঠান্তর–কোথা যাব কি করিব”। ঐ।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

এ দেশে বসতি নৈল যাব কোন্‌ দেশে।
যার লাগি প্রাণ কাঁদে তারে পাব কিসে?
বল না উপায় সই বল না উপায়।
জনম অবধি দুকঝ রহল হিয়ায়।।
তিতা কৈল দেহ মোর ননদী বচনে।
কত না সহিব জ্বালা ও পাপ পরাণে।।
বিষ খায়া দেহ যাবে রব রবে দেশে।
বাশুলী আদেশে কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।

————–

নৈল – পাঠান্তর–“নাহি”। প্রা, কা, সং।
ননদী বচনে – পাঠান্তর–“ননদীর রোলে”। প, ক ত।
পাপ পরাণে – পাঠান্তর–“শাশুড়ীর বোলে”। ঐ।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

সই! একি সহে পরাণে।
কি বোল বলিয়া, গেল ননদিনী,
শুনিলা আপন কাণে।।
পরের কথায়, এত কথা কহে,
ইহাতে করিব কি?
কানু পরিবাদে, ভুবন ভরিল,
বৃথায় জীবনে জী।।
কানুরে পাইত, এ সব কহিত,
তবে বা সে বোলে ভাল?
মিছা পরিবাদে, বাদিনী হইয়া,
জর জর প্রাণ হৈল।।
কে আছে বুঝায়া, শ্যামেরে কহিয়া,
এ দুখে করিবে পার?
চণ্ডীদাস কহ, ধৈর্য্য ধরি রহ,
কে কিবা করিবে কার?

————–

বৃথায় জীবনে জী – বৃথা বাঁচিয়া আছি।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

পর পুরুষে, যৌবন সঁপিলে,
আশা না পূরয়ে তায়।
আপন পতি, বিছুরিলে কতি,
দ্বিগুণ সুখ সে পায়?
সই! বিধি করিল এমত রীতি!
কুলবতী হইয়া, পতি তেয়াগিয়া,
পর পতি সনে প্রীতি।।
পড়সী সকল এবে সে জানিল,
দুকুল ভাসিল জলে।
পিরীতি করিতে, আসিবে চটাই,
দুই কুল ফাক্‌ হলে।।
দুদিকে ভাসিতে, উঠু ডুবু করিতে,
কিনারা হইল দেখি।
মহাজন ঘরে, চোরে চুরি করে,
পড়সী দেয় সে সাখী।।
তলাস করিয়া, বেড়ায় ফিরিয়া,
ধনের না পায় লেশ।
মনে যে বুঝিয়া, দেখিনু ভাবিয়া,
তাহারি কপাল দোষ।।
এমন তাকতি, কানুর পিরীতি,
হরি’নিল মোর মন।
আপন পর যে, দূষিল সব,
তেজিল গৃহ গুরু জন।।
রাখ চিহ্ন পায়, চণ্ডীদাস হিয়ায়,
দোসর বোধিক জনা।
সকলি পাইবে, কুশলে রহিবে,
আসিবে নন্দনন্দনা।।*

————–

* পদসমুদ্র

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

গোকুল নগরে, আমার বন্ধুরে,
সবাই ভাল বাসে।
হাম অভাগিনী, আপন বলিলে,
দারুণ লোকেতে হাসে।।
সই! কি জানি কি হইল মোরে।
আপন বলিয়া, দুকুল চাহিয়া,
না দেখি দোসর পরে।।
কুলের কামিনী, হম অভাগিনী,
নহিল দোসর জনা।
রসিক নাগর, গুরু জনা বৈরী
এ বড় মুখরপণা।।
বিধির বিধান, এমন করল,
বুঝিনু করম দোষে।
আগে পাছে বুঝি, না কৈলে সমঝি,
কহে চণ্ডীসাসে।।*

————–

* পদসমুদ্র

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। গান্ধার ।।

পিরীতি লাগিয়া হম্‌ সব তেয়াগিনু।
তবুত শ্যামের সঙ্গে গোঙা’তে নারিনু।।
বিধিরে কি দিব দোষ আপন করম।
না খেনে করিনু প্রেম না জানি মরম।।
ঘরে পরে বাহিরে কুলটা বলি খ্যাতি।
কানু সঙ্গে প্রেম করি না পোহা’ল রাতি।।
চল চল আর দেখি ওঝা বাড়ী যাও।
কালকুট বিষ আনি হাতে তুলি দাও।।
পিরীতি মরতে করিতে যে বা করে আশ।
পিরীতি লাগিয়ে মরে দ্বিজ চণ্ডীদাস।।*

————–

* পদসমুদ্র

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। পঠ মঞ্জরী ।।

নিশ্বাস ছাড়িতে না দেয় ঘরের গৃহিণী।
বাহিরে বাতাসে ফাঁদ পাতে ননদিনী।।
বিনি ছলে ছলয়ে, সদাই ধরে চুলি।
হেন মনে করে জলে প্রবেশিয়া মরি।।
সতী সাধে দাঁড়াই যদি সখীগণ সঙ্গে।
পুলকে পূরয়ে তনু শ্যাম পরসঙ্গে।।
পুলক ঢাকিতে নানা করি পরকার।
নয়নের ধারা মোর বহে অনিবার।।
পোড়া লোক না জানে পিরীতি বোলে কারে।
তুমি যদি বল, সমাধান দেই ঘরে।।
চণ্ডীদাস বলে শুন আমার যুকতি।
অধিক জ্বালা যার তার অধিক পিরীতি।।

————–

পরকার – প্রকার।
পোড়া – পাঠান্তর–“পাড়ার” প, ক, ত এবং লী স।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

তাহারে বুঝাই সই! পেলে তার লাগি।
ননদী-বচনে যেন বুকে উঠে আগি।।
কাহারে না কহি কথা রহি দুখে ভাসি।
ননদী দ্বিগুণ বাদী এ পোড়া পড়সি।।
কাহারে কহিব দুখ যাব আমি কোথা।
কার সনে কব আর কালা কানুর কথা?
যত দূরে যায় মন তত দূরে যাব।
পিরীতি পরাণভোগী কোথা গেলে পাব।।
তাহারে কহিব দুখ বিনয় করিয়া।
চণ্ডীদাস কহে তবে জুড়াইবে হিয়া।।

————–

আগি – আগুন।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

কানু সে জীবন, জাতি প্রাণধন,
এ দুটি নয়ান-তারা।
হিয়ার মাঝারে, পরাণ পুতলি,
নিমিখে নিমিখ হারা।।
তোরা কুলবতী, ভজ নিজ পতি,
যার মনে যেবা লয়।
ভাবিয়া দেখিলাম, শ্যাম বঁধু বিনে,
আর কেহ মোর নয়।।
কি আর বুঝাও, ধরম করম,
মন স্বতন্তরী নয়।
কুলবতী হইয়া, পিরীতি আরতি,
আর কার জানি হয়।।
যে মোর করম, কপালে আছিলা,
বিধি মিলাওল তায়।
তোরা কুলবতী, ভজ নিজ পতি,
থাক ঘরে কুল লয়।।
গুরু দূরজন, বলে কুবচন,
সে মোর চন্দন চুয়া।
শ্যাম অনুরাগে, এ তনু বেচিনু,
তিল তুলসী দিয়া।।
পড়ছি দুর্জ্জন, বলে কুবচন,
না যাব সে লোক পাড়া।
চণ্ডীদাসে কয়, কানুর পিরীতি,
জাতি কুল শীল ছাড়া।।

————–

স্বতন্তরী – স্বতন্ত্র।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

কে আছে বুঝিয়া, শুঝিয়া বলিবে,
আমার পিয়ার পাশে?
গোপত পিরীতি, না করে বেকতি,
শুনিয়া লোকেতে হাসে।।
গোপত বলিয়া, কেন বা বলিলে,
এমন করিল কেনে।
এমত ব্যাভার, না বুঝি তাহার,
পিরীতি যাহার সনে।।
সই! এমতি কেন বা হৈল।
পরের নারী, মনে যে হরি,
নিচয় ছাড়িয়া গেল।।
মোরা অভাগিনী, দিবস রজনী,
সোঙরি সোঙরি মরি।
কুলের কলঙ্ক, করিনু সালঙ্ক,
তবু যে না পানু হরি।।
পুরুষ পরশ, হইল দুরস,
বিছুরিলে আপন রীতি,
জনম অবধি, না পাই সোয়াতি,
কাঁদিয়া মরি যে নিতি।।
চণ্ডীদাস কয়, সুজন যে হয়,
এমতি না করে সে।
তাহার পিরীতি, পাষাণে লেখতি,
মুছিলেও নাহি ঘুচে।।

————–

পাশে – নিকটে। গোপত – গুপ্ত, গোপনীয়। সালঙ্ক – অলঙ্কার। সোয়াতি – সোয়াস্তি। লেখতি – লিখিত।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

সই! কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া, আন বাড়ি যায়,
আমার আঙিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া, না চায় ফিরিয়া,
এমতি করিল কে?
আমার অন্তর, যেমন করিছে,
তেমতি হউক সে।।
যাহার লাগিয়া, সব তেয়াগিনু,
লোকে অপযশ কয়।
সেই গুণ নিধি, ছাড়িয়া পিরীতি,
আর জানি কার হয়?
আপনা আপনি, মন বুঝাইতে,
পরতীত নাহি হয়।
পরের পরাণ, হরণ করিলে,
কাহার পরাণে সয়?
যুবতী হইয়া, শ্যাম ভাঙাইয়া,
এমতি করিল কে?
আমার পরাণ, যে মতি করিছে,
সে মতি হউক সে।।
কহে চণ্ডীদাস, করহ বিশ্বাস,
যে শুনি উত্তম মুখে।
কেবা কোথা ভাল, আছয়ে সুন্দরী,
দিয়া পরমনে দুখে।।

————–

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। গান্ধার ।।

দেখিব যে দিনে, আপন নয়নে,
কহিতে তা সনে কথা।
বেশ দূর করিব, কেশ ঘুচাইব,
ভাঙ্গিব আপন মাথা।।
সই! কেমনে ধরিব হিয়া।
এত সাধের বন্ধুয়া আমার,
দেখিলে না চায় ফিরিয়া।।
সে হেন কালিয়া, যা বিনেক হিয়া,
এমতি করিলে কে।
হৃদি সীদতি, আমার যে মতি,
তেমতি পুড়ুক সে।।
কহে চণ্ডীদাস, কেন কর ত্রাশ,
সে ধন তোমারি বটে।
তার মুখে ছাই, দিয়া সে কানাই,
আসিবে তোমা নিকটে।

————–

হৃদি সীদতি – হৃদয় শিহরিতেছে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

সই! তাহারে বলিব কি?
যেমতি করিয়া, শপথি করিল,
বৃথায় জীবন জী।।
ধরম গুণে, ভয় না মানে,
এমন ডাকাতি সেহ।
বুঝিলাম মনে, ডাকাতিয়া সনে,
ঘুচিল ভাল যে দেহ।।
বিনি যে পখরি, রূপ যে দরখি,
ভুলিনু পরের বোলে।
পিরীতি করিয়া, কলঙ্ক হইল,
ডুবিনু অগাধ জলে।।
গুরুর গঞ্জন, সহি সদাতন,
না জানিনু সেই রসে।
অমিঞা হইয়া, গরল হইল
এমতি বুঝিলাম শেষে।।
আগে যদি জানিতুঁ, সতর্কে থাকিতুঁ,
এমত না করিতুঁ মনে।
সে হেন পিরীতি, হবে বিপরীতি,
এমন মনে কে জানে।।
চণ্ডীদাস কহ, ধৈর্য্য ধরি রহ,
কাহারে না কহ কথা।
কথা যে কহিবে, যথা সে যাইবে,
মনেতে পাইবে ব্যথা।।

————–

সদাতন – সর্ব্বদা। জানিতুঁ – জানিতাম। থাকিতুঁ – থাকিতাম। করিতুঁ – করিতাম।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

পিরীতি পসার, লইয়া ব্যভার,
দেখি যে জগৎ ময়।
যতেক নাগরী, কুলের কুমারী,
কলঙ্কী আমারে কয়।।
সই! জানি কি হইবে মোর?
সে শ্যাম নাগর, গুণের সাগর,
কেমনে বাসিব পর?
সে গুণ সোঙরিতে, যাহা করে চিতে,
তাহা বা কহিব কত।
গুরু জনা কুলে, ডুবাইয়া মুলে,
তাহাতে হইত রত।।
থাকিলে যে দেশে, আমার হাসে,
কহিতে না পারি কথা।
অযোগ্য লোকে, তত দেয় শোকে,
সে আর দ্বিগুণ ব্যথা।।
কহে চণ্ডীদাস, বাশুলীর পাশ,
এমন যদি হয় মনোরীত।
যার সনে হয়, পিরীতি করয়,
কহিলে সে হয় পরতীত।।

————–

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

সই! মরম কহিএ তোকে।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
কভু না আনিব মুখে।।
পিরীতি মূরতি, কভু না হেরিব,
এ দুটি নয়ান কোণে।
পিরীতি বলিয়া, নাম শুনইতে,
মুদিয়া রহিব কাণে।।
পিরীতি নগরে বসত তেজিয়া,
থাকিব গহন বনে।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
যেন না পড়য়ে মনে।।
পিরীতি পাবক, পরশ করিয়া
পুড়িছি এ নিশি দিবা।
পিরীতি বিচ্ছেদ, সহনে না যায়,
কহে চণ্ডীদাস কিবা।।

————–

পাবক – আগুন।

শুন শুন সই! কহি তোরে।
পিরীতি করিয়া কি হৈল মোরে।।
পিরীতি পাবক কে জানে এত। সদাই পুড়িছে সহিব কত।।
পিরীতি দুরন্ত কে বলে ভাল। ভাবিতে পাঁজর হইল কাল।।
অবিরত বহে নয়ানে নীর। নিলাজ পরাণে না বান্ধে থির।।
দোষর ধাতা পিরীতি হইল। সেই বিধি মোরে এতেক কৈল।।
চণ্ডীদাস কহে সে ভাল বিধি। এই অনুরাগে সকল সিধি।।

————–

নিলাজ পরাণে না বান্ধে থির – নির্লজ্জ প্রাণ স্থির হয় না। সিধি – সিদ্ধি।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

ও সই! আর না বলিহ মোরে।
পিরীতি বলিয়া, দারুণ আখর,
বলিতে নয়ন ঝুরে।।
পিরীতি আরতি, কভু না স্মরিব,
শয়ন স্বপন মনে।
পিরীতি নগরে, বসতি তেজিব,
রহিব গহন বনে।।
পিরীতি অবশ, পরাণ লাগিয়া,
তেজিব নিকুঞ্জ বাস।
পিরীতি বেয়াধি, ছাড়িলে না ছাড়ে
ভালে জানে চণ্ডীদাস।।

————–

ভালে – ভাল।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। পঠমঞ্জরী ।।

কি বুকে দারুণ ব্যথা!
সে দেশে যাইব, যে দেশে না শুনি,
পাপ পিরীতির কথা।।
সই! কে বলে পিরীতি ভাল?
হাসিতে হাসিতে, পিরীতি করিয়া,
কাঁদিতে জনম গেল।।
কুলবতী হৈয়া, কুলে দাঁড়াইয়া,
যে ধনী পিরীতি করে।
তূষের অনল, যেন সাজাইয়া,
এমতি পুড়িয়া মরে।।
হাম অভাগিনী, এ দুখে দুখিনী,
প্রেমে ছল ছল আঁখি।
চণ্ডীদাস কহে, যেমতি হইল,
পরাণে সংশয় দেখি।।

————–

ধনী – পাঠান্তর–“জন”–প্রা, কা, সং।
প্রেমে ছল ছল আঁখি – পাঠান্তর–“সদাই ঝরয়ে আঁখি”–পদকল্পলতিকা।
চণ্ডীদাস কহে, যেমতি হইল, পরাণে সংশয় দেখি – পাঠান্তর–“চণ্ডীদাস কহে, যে দুখ উঠিল, জীবন-সংশয় দেখি”–পদকল্পলতিকা।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

এ দেশে না রব সই দূর দেশে যাব।
এ পাপ পিরীতির কথা শুনিতে না পাব।।
না দেখিব নয়নে পিরীতি করে যে।
এমতি বিষম চিতা জ্বালি দিবে সে।।
পিরীতি আখর তিন না দেখি নয়ানে।
যে কহে তাহারে আর না হেরি বয়ানে।।
পিরীতি বিষম দায়ে ঠেকিয়াছি আমি।
চণ্ডীদাসে কহে রামি ইহার গুরু তুমি।।

————–

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

সুখের লাগিয়া, এ ঘর বাঁধিনু,
আগুণে পুড়িয়া গেল।
অমিয়া সাগরে, সিনান করিতে,
সকলি গরল ভেল।।
সখি! কি মোর কপালে লেখি!
শীতল বলিয়া, চাঁদ সেবিনু,
ভানুর কিরণ দেখি।।
উচল বলিয়া, অচলে চড়িনু,
পড়িনু অগাধ জলে।
লছমী চাহিতে, দারিদ্র বেঢ়ল,
মাণিক হারানু ছেলে।।
নগর বসালেম, সাগর বাঁধিলাম,
মাণিক পাবার আশে।
সাগর শুকাল, মাণিক লুকাল,
অভাগীর করম দোষে।।
পিয়াস লাগিয়া, জলদ সেবিনু,
বজর পড়িয়া গেল।
কহে চণ্ডীদাস, শ্যামের পিরীত,
মরমে বহল শেল।।

————–

কপালে – পাঠান্তর–“করমে”–প্রা, কা, সং।
উচল বলিয়া, অচলে চড়িনু – পাঠান্তর–“উচল হইতে, নিচলে চাপিয়া”–প্রা, কা, সং।
চাহিতে – পাঠান্তর–“সেবিতে”–প্রা, কা, সং।
এই পদটি জ্ঞানের বলিয়া উল্লেখিত আছে–প, ক, ত; লী, স।
জ্ঞানদাসের ভণিতা এইরূপ–

“পিয়াস লাগিয়া, জলদ সেবিনু,
পাইনু বজর তাপে।
জ্ঞানদাস কহে, পিরীতি করিয়া,
পাছে কর অনুতাপে।।”
–প, ক, ত; লী, স।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

যাবত জনমে, কি হৈল মরমে,
পিরীতি হইল কাল।
অন্তরে বাহিরে, পশিয়া রহিল,
কেমতে হইলে ভাল?
সই! বল না উপায় মোরে।
গঞ্জনা সহিতে, নারি আর চিতে,
মরম কহিনু তোরে।।
ননদী বচনে, জ্বলিছে পরাণে,
আপদ মস্তক চুল।
কলঙ্কের ডালি, মাথায় করিয়া,
পাথারে ভাসাব কুল।।
ভাসিয়া যায়, ঘুচবে দায়,
এ বোল এ ছার লোকে।
চণ্ডীদাস কহে, এমতি হইলে,
মরিবে তাহার শোকে।।

————–

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।

পাপ পরাণে কত সহিবেক জ্বালা!
শিশুকালে মরি গেলে হইত যে ভালা।।
এ জ্বালা জঞ্জাল সই তবে সে পরিহরি।
ছেদন করিয়া দেও পিরীতের ডরি।।
তেমতি নহিলে, যার এমতি ব্যভার।
কলঙ্ক-কলসী লৈয়া ভাসিব পাথার।।
চণ্ডীদাস কহে ইহা বাশুলী কৃপায়।
পিরীতি লাগিয়া কেন ভাসিবে দরিয়ায়।।

————–

পরিহরি – ভুলিতে পারি। ডরি – দড়ী। দরিয়ায় – সমুদ্রে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

শুন গো মরম সই!
যখন আমার, জনম হইল,
নয়ন মুদিয়া রই।।
দিতে ক্ষীর সর, জননী আমার,
নয়ন মুদিত দেখি।
জননী আমার করে হাহাকার,
কহিল সকলে ডাকি।।
শুনি সেই কথা, জননী যশোদা,
বঁধুরে লইয়া কোরে।
আমারে দেখিতে, আইল তুরিতে,
সুতিকা মন্দির ঘরে।।
দেখিয়া জননী, কহিছেন বাণী,
এই কি ছিল কপালে।
করিয়া সাধনা, পেলেন অন্ধকন্যা,
বিধি এত দুখ দিলে।।
উঠ উঠ বলি, করে ধরি তুলি,
বসান যতন করে।
হেনই সময়ে, মায়ে তেয়াগিয়ে,
বন্ধু পরশিল মোরে।।
গায়ে দিতে হাত, মোর প্রাণনাথ,
অন্তরে বাঢ়ল সুখ।
হাসিয়া কান্দিয়া, আঁখি প্রকাশিয়া,
দেখিনু বঁধুর মুখ।।
ঘুচিল অন্ধ, বাঢ়িল আনন্দ,
জননী যশোদার মনে।
আমার কল্যানে, আনন্দিত মনে,
করিল বিবিধ দানে।।
সুজন যে জন, জানে সেই জন,
কুজন নাহিক জানে।
অনুরাগে মন, সদাই মগন,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে ভণে।।

————–

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।

শুন কমলিনি, চল কুল রাখি,
আর না করিও নাম।
সে যে, কালিয়া মূরতি, কালিয়া প্রকৃতি,
কালা খল নাম শ্যাম।।
জনক জননী, তেজিয়া আপনি,
অন্যের হইয়া মজে।
রাম অবতারে, জানকি সীতারে,
বিনি অপরাধে ত্যজে।।
উহার চরিত, আছয়ে বিদিত,
বালী বধিবার কালে।
বলীকে ছলিয়া, পাতালে লইল,
কি দোষ উহার পেলে?
উহার চরিত, আছয়ে বিদিত,
হৃদয় পাষাণ ময়।
উহার শরণে, যে মত রাবণে,
যোই সে শরণ লয়।।
চণ্ডীদাস ভণে, মরুক সে জনে,
যেবা পর চরচায় থাকে।
পিরীতি লাগিয়া, মরে সে ঝুরিয়া,
কুলেতে কি করে তাকে?

————–

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

আপনা আপনি, দিবস রজনী
ভাবিয়ে কতেক দুখ।
যদি পাখা পাই, পাখী হয়ে যাই,
না দেখাই পাপ মুখ।।
সই বিধি দিল মোরে শোকে।
পিরিতি করিয়া, আশা না পুরল,
কলঙ্ক ঘোষিল লোকে।।
হাম অভাগিনী, তাতে একাকিনী,
নহিল দোসর জনা।
অভাগিয়া লোকে, যত বোলে মোকে,
তাহা যে না যায় শুনা।।
বিধি যদি শুনিত, মরণ হইত,
ঘুচিত সকল দুখ।
চণ্ডীদাসে কয়, এমতি হইলে,
পিরীতির কিবা সুখ।।

————–

ঘোষিল – ঘোষণা করিল।

হাম অভাগিনী, তাতে একাকিনী – পাঠান্তর–“এতেক কামিনী, আমি অভাগিনী”–প্রা, কা, সং।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

পরের রমনী, ঘুচিবে কখনি,
এমনি করিবে ধাতা।
গোকুল নগরে, প্রতি ঘরে ঘরে,
না শুনি পিরীতি কথা।।
সই যে বোল সে বোল মোরে।
শপতি করিয়া, বলি দাঁড়াইয়া,
না রব এ পাপ ঘরে।।
গুরুর গঞ্জন, মেঘের গর্জ্জন,
কত না সহিব প্রাণে।
ঘর তেয়াগিয়া, যাইব চলিয়া,
রহিব গহন বলে।।
বনে যে থাকিব, শুনিতে না পাব,
এ পাপ জনের কথা।
গঞ্জন ঘুচিবে, হিয়া জুড়াইবে,
ঘুচিবে মনের ব্যথা।।
চণ্ডীদাস কয়, স্বতন্তরী হয়,
তবে সে এমন বটে।
সে সব কহিলে, করিতে পারিলে,
তবে সে এ পাপ ছুটে।।

————–

কখনি – কখন। ধাতা – বিধাতা। শপতি – শপথ।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সুহই ।।

না জানে পিরীতি যারা নাহি পায় তাপ।
পরসে পিরীতি আঁধার ঘরে সাপ।।
সই পিরীতি বড়ই বিষম।
না পাই মরমি জনা কহিতে মরম।।
গৃহে গুরু গঞ্জর কুবচন জ্বালা।
কত না সহিবে সুখ পরাধিনী বালা?
পিরীতি বেয়াধি যদি অন্তরে শ্যামাইল।
ঔষধ খাইতে তবে পরাণ জারি গেল।।
চণ্ডীদাস কহে প্রেম বড়ই বিষম।
জীয়ন্তে এমন করে, লউক শমন।।

————–

পরসে – (সে–হিন্দী–)পরে সঙ্গে অথবা পর হইতে। প্রা, কা, সং।
শামাইল – প্রবেশ করিল।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

দৈব যুকতি, বিশেষ গতি,
যাহারে লাগয়ে তায়।
আন আন জনে, করিয়া যতনে,
প্রেমেতে গড়ায়ে দেয়।।
সই! এমনি কানুর রসে।
জনম অবধি, রহিবে পিরীতি,
বিচ্ছেদ না হবে শেষে।।
যেই মনে ছিল, তাহা না হইল,
সোঙরিতে প্রাণ কাঁদে।
লেহ দাবানলে, বন যেন জ্বলে,
হরিণী পড়িল ফাঁদে।।
পলাইতে চায়, পথ নাহি পায়,
দেখে যে আনলময়।
বনের মাঝারে, ছটফট করে,
কত বা পরাণে সয়।।
বাহিরে আসিয়া, বাণ যে খাইয়া,
পশিতে তাহাতে পুন।
গরল আনলে, শরীর বিবল,
শামাইতে নারে যেন।।
করীবর আদি, না পায় সমাধি,
ফিরিয়া চীৎকার করে।
একে কুল নারী, ফুকারিতে নারি,
ননদী আছয়ে ঘরে।।
এমতি আকার, পিরীতি তাহার,
বহিয়া দহিছে মনে।
ননদী বচনে, দগধে পরাণে,
পাঁজর বিধিল ঘুণে।।
নয়নে নয়নে, নজর পীঁজরে,
রাখয়ে আপন কাছে।
জলে যাই যবে, সঙ্গে চলে তবে,
শ্যামেরে দেখি যে পাছে।।
চণ্ডীদাস কয়, বাশুলীর সায়,
মনেতে থাকয়ে যদি।
যে জন যা বিনে, না জীয়ে পরাণে,
তার কি করে ননদী।।

————–

বহিয়া দহিছে মনে – পাঠান্তর–“রহিতে সহিছে মনে”–প্রা, কা, সং।
পীঁজরে – খাঁচায়। যা বিনে – যাহা বিহনে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

জনম অবধি, পিরীতি বেয়াধি,
অন্তরে রহিল মোর।
থেকে থেকে উঠে, পরাণ ফাটে,
জ্বালার নাহিক ওর।।
সই! এ বড় বিষম কথা।
কানুর কলঙ্ক, জগতে হইল,
জুড়াইব আর কোথা?
বেয়াধি অবধি, সমাধি করিয়ে,
পাই এবে যার লাগি।
এমতি ঔষধ হয়, অল্প মূল্য লয়,
হিয়ার ঘুচায় আগি।।
জনম অবধি, কণ্টক ননদী,
জ্বালাতে জ্বালাল মন।
তাহার অধিক, দ্বিগুণ জ্বালায়,
খলের পিরীতি শুন।।
খলের সংহতি, ছাড়িনু পিরীতি,
ছাড়িনু সকল সুখ।
চণ্ডীদাস কয়, যদি দেখা হয়,
এবে কেন বাস দুখ?

————–

ওর – সীমা। সংহতি – সঙ্গে।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

সখি! কেমনে জীব গো আর!
বুকে খেয়েছি, শ্যামের শেল,
পীঠে হৈল পার।।
মনু মনু মৈলাম, গো সখি,
কালিয়া বাঁশীর গানে।
সুজন দেখিয়া, পিরীতি করিনু,
এমতি হবে কে জানে?
সকল গোকুল, হইল আকুল,
শুনিয়া বাঁশীর কথা।
খলের সহিতে, পিরীতি করিয়া,
কি হৈল অন্তরে ব্যথা।।
স্থিত হৈতে নারি, প্রাণের সখি গো,
বুকে খেয়েছি ঘা।
আঁখির জলে, পথ নাহি দেখি,
মুখে না নিঃসরে রা।।
পিরীতি রতন, করিব যতন,
পিরীতি গলার হার।
শ্যাম বঁধুয়ার নিদারুণ বাঁশী,
পরাণ বধে আমার।।
কে জানে কেমন, পিরীতি এমন,
পিরীতে কৈল সব নাশ।
গঞ্জে গুরু জনে, আনন্দিত মনে,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস।

————–

রা – বাক্য।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।

যতন করিয়া, বেসালি ধুইয়া,
সাঁজে সাজাইনু দুধ।
দধি সে নহিল, জল সে হইল,
পাইনু বড়ই দুঃখ।।
সই দধি কেন ছিঁড়ি গেল?
কানুর পিরীতি, কুলের করাতি,
পরাণ টানিয়া নিল।।
পিরীতি ঘুচিল, আরতি না পূরিল,
না ঘুচিল কলঙ্ক জ্বালা।
তবু অভাগিনী, না ঘুচায় কাহিনী,
পরিবাদ হৈল কালা।।
বুঝিলাম যতনে, প্রবোধিনু পরাণে,
ছাড়িনু তাহার আশ।
চিতে আর কত, ভাবি অবিরত,
দৈবে করিল নৈরাশ।।
আর কেহ বলে, ঝাঁপ দিব জলে,
তেজিব এ পাপ দেহ।
চণ্ডীদাস কহে, ছাড়িলে ছাড়ন নহে,
শুধু সুধাময় লেহ।

————–

বেসালি – দুগ্ধ আবর্ত্তনের নিমিত্ত মৃত্তিকার পাত্র বিশেষ।
সাঁজে – সন্ধ্যার সময়।
সাজাইনু – পাতিলাম।
সই দধি কেন ছিঁড়ি গেল – সই দধি কেন নষ্ট হইল?

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

না বল না বল সখি না বল এমনে।
পরাণ বান্ধিয়া আছি সে বন্ধুর সনে।।
ত্যজিলে কুল শীল এ লোক লাজ।
কি গুরু গৌরব গৃহের কাজ।।
ত্যজিয়া সব লেহা পিরীতি কৈনু।
যে হইবে বিরতি ভাবে ত্যজিয়া মৈনু।।
যে চিতে দাড়াঞাছি সই সে হয়।
ক্ষেপিল বাণ যে রাখিল নয়।।
ঠেকিল প্রেম ফাঁদে সকলি নাশ।
ভালে সে চণ্ডীদাস না করে আশ।।*

————–

লেহা – সাধ।
* গীতকল্পতরু এবং পদকল্পতরু গ্রন্থে এই পদটি জ্ঞানদাসের ভণিতা যুক্ত দেখিতে পাওয়া যায়।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। ধানশী ।।

ইক্ষু রোপিনু, গাছ যে হইল,
নিঙ্গাড়িতে রসময়।
কানুর পিরীতি, বাহিরে সরল,
অন্তরে গরল হয়।।
সই কে বলে ইক্ষুরস গুড়!
খাইনু আপন মুড।।
চাকিতে চাকিতে, লাগিল জিহ্বাতে,
পহিলে লাহিল মীঠ।
মোদক আনিয়া, ভিয়াঁন করিয়া,
এবে সে লাগিল সীঠ।।
মশল্লা আনিনু, আগুনে চঢ়ানু,
বিছুরিনু আপন ভাব।
কানুর পিরীতি, বুঝিনু এমতি,
কলঙ্ক হইল লাভ।।
আপন করমে, বুঝিনু মরমে,
বস্তুর নাহিক দোষ।
চণ্ডীদাস কহে, পিরীতি করিয়া,
কেবা পাইল কোথা যশ?

————–

মুড় – মাথা। মীঠ – মিষ্ট। সীঠ – সার বিহীন দ্রব্য। মশল্লা – মসলা।

অনুরাগ।–সখী সম্বোধনে ।। মল্লার ।।

দিবস রজনী, গুণ গণি গণি,
কি হৈল অন্তরে ব্যথা।
খলের বচনে, পাতিয়া শ্রবণে,
খাইনু আপন মাথা।।
কে বলে পিরীতি ভাল গো সখি
কে বলে পিরীতি ভাল?
সে ছার পিরীতি, ভাবিতে ভাবিতে,
সোণার বরণ কাল।।
সোণার গাগরী, বিষ জল ভরি,
কেবা আনি দিল আগে।
করিনু আহার, না করি বিচার,
এ বধ কাহারে লাগে।।
নীর লোভে মৃগী, পিয়াসে ধাইতে,
ব্যাধ শর দিল বুকে।
জলের সফরী, আহার করিতে,
বঁড়শী লাগিল মুখে।।
নবঘন হেরি, পিয়াসে চাতকী,
চঞ্চু পসারল আশে।
বারিক কারণ, বহল পবন,
কুলিশ মিলল শেষে।।
লাখ হেম পায়া, যতনে বাঁধিতে,
পড়ল অগাধ জলে।
হেন অনুচিত, করে পাপ বিধি,
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে।।

————–

গাগরী – কলস; পশ্চিম অঞ্চলে এখনও লোকে গাগরী কহিয়া থাকে।
নবঘন – মেঘ।
চঞ্চু পসারল – ঠোঁট বাড়াইল।
বারিক কারণ – জলের নিমিত্ত।
কুলিশ – বজ্র।

অনুরাগ—আত্ম প্রতি

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। ধানশী ।।

হিয়ার মাঝারে, যতনে রাখিব,
বিরল মনের কথা।
মরম না জানে, ধরম বাখানে,
সে আর দ্বিগুণ ব্যথা।।
যারে না দেখি, জনম স্বপনে,
না দেখি নয়ন কোণে।
অবুধ সে জানি, দিবস রজনী,
সদাই পড়িছে মনে।।
হাম অভাগিনী, পরের অধিনী,
সকলি পরের বশে।
সবাই এখনি, পরাণ পোড়নি,
ঠেকিনু পিরীতি রসে।।
অনুক্ষণ মন, করে উচাটন,
মুখে না নিঃসরে কথা।
চণ্ডীদাসের মন, অরুণ নয়ন,
ভাবিতে অন্তরে ব্যথা।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। গান্ধার ।।

কেন বা পিরীতি কৈনু কালা কানুর সনে।
ভাবিতে রসের তনু জারিলেক ঘুণে।।
কত ঘর বাহির হইব দিবা রাতি।
বিষম হইল কালা কানুর পিরীতি।।
না রুচে ভোজন পান কি মোর শয়নে।
বিষ মিশাইল মোর এ ঘর করণে।।
ঘরে গুরু দুরজন ননদিনী আগি।
দু আঁখি মুদিলে বলে কাঁদে শ্যাম লাগি।।
আকাশ যুড়িয়া ফাঁদ যাইতে পথ নাই।
কহে বড়ু চণ্ডীদাস মিলিবে হেথাই।।

————–

ঘর করণে – অদ্যপি লোকে “ঘরকরণা” শব্দ প্রয়োগ করিয়া থাকে।
হেথাই – হেথায়; এখানে।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সুহই ।।

ধরম করম গেল গুরু গরবিত।
অবশ করিল কালা কানুর পিরীত।।
ঘরে পরে কি না বলে করিব হাম কি।
কেবা না করয়ে প্রেম আমি সে কলঙ্কী।।
বাহির হইতে নারি লোক চরচাতে।
হেন মনে করে বিষ খাইয়া মরিতে।।
একে নারী কুলবতী অবলা বলে লোকে।
কানু পরিবাদ হৈল পুড়িয়া মরি শোকে।।
খাইতে নারি যে কিছু রহিতে নারি ঘরে।
ভাবিতে ভাবিতে ব্যাধি সাঁধাইল অন্তরে।।
জ্বারিলেক তনু মন ব্যাপিল শরীর।
চণ্ডীদাস বলে ভাল হইবে সুস্থির।।

————–

বাহির হইতে – পাঠান্তর–“বাহিরে বেড়াতে”–প্রা, কা, সং।
হেন মনে করে বিষ খাইয়া মরিতে – পাঠান্তর–“এমতি করয়ে মন বিষ খাই জীতে”–প্রা, কা, সং।
একে নারী কুলবতী অবলা বলে লোকে। কানু পরিবাদ হৈল পুড়িয়া মরি শোকে।। – পাঠান্তর–“একে নারী কুলবতী পুড়ে মরি শোকে। তাহে কানু পরিবাদ দেয় পাপ লোকে।।”–প্রা, কা, সং।
সাঁধাইল – প্রবেশ করিল।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। তুড়ি ।।

কি হৈল কি হৈল মোর কানুর পিরীতি।
আঁখি ঝুরে পুলকেতে প্রাণ কাঁদে নিতি।।
শুইলে সোয়াস্তি নাই নিদ গেল দূরে।
কানু কানু করি প্রাণ নিরবধি ঝুরে।।
নবীন পানীর মীন মরণ না জানে।
নব অনুরাগে চিত ধৈরজ না মানে।।
এ না রস যে না জানে সে না আছে ভাল।
হৃদয়ে রহিল মোর কানু প্রেম শেল।।
নিগূঢ় পিরীতি খানি আরতির ঘর।
ইথে চণ্ডীদাস বড় হইল ফাঁফর।

————–

নবীন পানীর মীন – নূতন জলের মাছ।
ধৈরজ – পাঠান্তর–“নিষেধ”–প্রা, কা, সং।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। ধানশী ।।

সেই হইতে মোর মন,
নাহি হয় সম্বরণ,
নিরন্তর ঝুরে দুটি আঁখি!
একলা মন্দিরে থাকি,
কভু তারে নাহি দেখি,
সে কভু না দেখে আমারে।
আমি কুলবতী বামা,
সে কেমনে জানে আমা,
কোন ধনী কহি দিল তারে।।
না দেখিয়া ছিনু ভাল,
দেখিয়া অকাজ হলো,
না দেখিলে প্রাণ কেন কান্দে।
চণ্ডীদাস কহে ধনি,
কানু সে পরশমণি,
ঠেকে গেলা মোহনিয়া ফান্দে।।
————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। গান্ধার ।।

জনম গোঙানু দুখে, কত বা সহিব বুকে,
কানু কানু করি কত নিশি পোহাইব।
অন্তরে রহিল ব্যথা, কুলশীল গেল কোথা,
কানু লাগি গরল ভখিব।।
কানু দিনু তিলাঞ্জলি, গুরু দিঠে দিনু বালি,
কানু লাগি এমতি করিনু।
ছাড়িনু গৃহের সাধ, কানু কৈল পরিবাদ,
তাহার উচিত ফল পাইনু।।
অবলা না গণে কিছু, এমতি হইবে পিছু,
তবে কি এমন প্রেম করে।
ভাল মন্দ নাহি জানে, পর মুখে যেবা শুনে,
তেঁঞিত অনলে পুড়ে মরে।।
বড়ু চণ্ডীদাসে কয়, প্রেম কি আনল হয়,
শুধুই সে সুধাময় লাগে।
ছাড়িলে না ছাড়ে সেহ, এমতি দারুণ লেহ,
সদাই হিয়ার মাঝে জাগে।।

————–

গোঙানু – কাটাইলাম। তেঁঞিত – সেইত।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। ধানশী ।।

কাহারে কহিব, মনের মরম,
কেবা যাবে পরতীত?
হিয়ার মাঝারে, মরম বেদনা,
সদাই চমকে চিত।।
গুরু জন আগে, দাঁড়াইতে নারি,
সদা ছিল ছিল আঁখি।
পুলকে আকুল, দিক নেহারিতে,
সব শ্যামময় দেখি।।
সখীর সহিতে, জলেরে যাইতে,
সে কথা কহিবার নয়।
যমুনার জল, করে ঝল মল,
তাহে কি পরাণ রয়? (১)
কুলের ধরম, রাখিতে নারিনু,
কহিলাম সবার আগে।
কহে চণ্ডীদাস, শ্যাম সুনাগর,
সদাই হিয়ায় জাগে।।

————–

(১) এখানে যমুনার জলের সহিত শ্রীকৃষনের রূপের তুলনা করা হইয়াছে এবং সেই জন্য শ্রীরাধিকা যমুনার জল ঝলমল করা দেখিয়া এত অস্থির।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সুহই ।।

আনিয়া অমিঞা পানা দুধে মিশাইয়া।
লাগিল গরল যেন মীঠ তেয়াগিয়া।।
তিতায় তিতিল দেহ মীঠ হবে কেন।
জ্বলন্ত অনলে মোর পুড়িছে পরাণ।।
বাহিরে অনল জ্বলে দেখে সর্ব্ব লোকে।
অন্তর জ্বলিয়া উঠে তাপ লাগে বুকে।।
পাপ দেহের তাপ মোর ঘুচিবেক কিসে?
কানুর পরশে যাবে কহে চণ্ডীদাসে।।

————–

অমিঞা – অমিয়া।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সুহই ।।

একে কাল হৈল মোর নয়লি যৌবন।
আর কাল হৈল মোর বাস বৃন্দাবন।।
আর কাল হৈল মোর কদম্বের তল।
আর কাল হৈল মোর যমুনার জল।।
আর কাল হৈল মোর রতন ভূষণ।
আর কাল হৈল মোর গিরি গোবর্দ্ধন।।
এত কাল সনে আমি থাকি একাকিনী।
এমন ব্যথিত নাই শুনয়ে কাহিনী।।
দ্বিজ চণ্ডীদাস কহে না কহ এমন।
কার কোন দোষ নাই সব এক জন (১)।।

————–

নয়লি – নূতন।
(১) শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ করিতেছেন।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সুহই ।।

কেন বা কানুর সনে পিরীতি করিনু।
না ঘুচে দারুণ লেহা ঝুরিয়া মরিনু।।
আর জ্বালা সৈতে নারি কত উঠে তাপ।
বচন নিঃসৃত নহে বুকে খেলে সাপ।।
জন্ম হইতে কুল গেল ধর্ম্ম গেল দূরে।
নিশি দিশি প্রাণ মোর কানু গুণে ঝুরে।।
নিষেধিলে নাহি মানে ধরম বিচার।
বুঝিনু পিরীতির হয় স্বতন্ত্র আচার।।
করমের দোষে এ জনমে কিবা করে।
কহে বড়ু চণ্ডীদাস বাশুলীর বরে।।

————–

বচন নিঃসৃত নহে – বাক্য সরে না।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

যাহার সহিত, যাহার পিরীতি,
সেই সে মরম জানে।
লোক চরচায়, ফিরিয়া না চাই,
সদাই অন্তরে টানে।।
গৃহ কর্ম্মে থাকি, সদাই চমকি,
গুমরে গুমরে মরি।
নাহি হেন জন, করে নিবারণ,
যেমত চোরের নারী।।
ঘরে গুরুজনা, গঞ্জয়ে নানা,
তাহা বা কহিব কি।
মরণ সমান, করে অপমান,
বন্ধুর কারণ সে।।
কাহারে কহিব, কেবা নিবারিবে,
কে জানে মরম দুখ।
চণ্ডীদাস কহে, করহ ঘোষণা,
তবে সে পাইবে সুখ।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। গান্ধার ।।

ধিক রহুঁ জীবনে যে পরাধীন জীয়ে।
তাহার অধিক ধিক পরবশ হয়ে।।
এ পাপ কপালে বিধি এমতি লিখিল।
সুধার সাগরে মোর গরল হইল।।
অমিয়া বলিয়া যদি ডুব দিনু তায়।
গরল ভরিয়া যেন উঠিল হিয়ায়।।
শীতল বলিয়া যদি পাষাণ কৈনু কোলে।
এ দেহ অনল তাপে পাষাণ সে গলে।।
ছায়া দেখি যদি যদি তরুলতা বনে।
জ্বলিয়া উঠয়ে তনু লতা পাতা সনে।।
যমুনার জলে যদি দিয়ে হাম ঝাঁপ।
পরাণ জুড়াবে কি অধিক উঠে তাপ।।
অতএ সে এ ছার পরাণ যাবে কিসে।
নিচয়ে ভখিমু মুই এ গরল বিষে।।
চণ্ডীদাস কহে দৈব গতি নাহি জানে।
দারুণ পিরীতি মোর বধিল পরাণে।।

————–

ধিক রহুঁ জীবনে যে পরাধীন জীয়ে – পরের অধীন হইয়া যে বাঁচিয়া থাকে তাহার জীবনে ধিক।
অতএ – অতএব।
নিচয়ে ভখিমু মুই – আমি নিশ্চয় খাইবে।
দারুণ পিরীতি মোর বধিল পরাণে – পাঠান্তর–“দারুণ পিরীতি সেই ধরয়ে পরাণে”–প, ক, ত।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

কালিয়া কালিয়া, বলিয়া বলিয়া,
জনম বিফল পাইনু।
হিয়া দগদগি, পরাণ পোড়নি,
মনের অনলে মৈনু।।
মরিনু মরিনু, মরিয়া গেনু,
ঠেকিনু পিরীতি রসে।
আর কেহ জানি, এ রসে ভুলে না,
ঠেকিলে জানিবে শেষে।।
এ ঘর করণ, বিহি নিদারুণ,
বসতি পরের বশে।
মাগো এই বর, মরণ সফল,
কি আর এ সব আশে।।
অনেক যতনে, পেয়েছি সে ধনে,
তাহা জানে চণ্ডীদাসে।
এখনি জানিলে, আর কি জানিবে,
জানিবে পিরীতি শেষে।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সুহই ।।

পিরীতি লাগিয়া দিনু পরাণ নিছনি।
কানু বিনু দোসর দুকাণে নাহি শুনি।।
মনোদুখে হৃদয়ে সদাই সোঙরিয়ে।
কানু পরসঙ্গ বিনু তিলেক না জীয়ে।।
যাহার লাগিয়া আমি কাঁদি দিবা রাতি।
নিছিয়া লৈয়াছি তারে কুলশীল জাতি।।
আর যত অভিমান দিনু বঁধুর পায়।
বড়ু চণ্ডীদাস কহে যেবা যারে ভায়।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। গান্ধার ।।

যদি বা পিরীতি সুজনের হয়।
নয়ানে নয়ন, হইল মিলন,
তবে কেন প্রেম ফিরিয়া না লয়।।
যে মোর পরাণে, মরম ব্যথিত,
তারে বা কিসের ভয়?
অতি দুরন্তর, বিষম পিরীতি,
সকলি পরাণে সয়।।
অবলা হইয়া, বিরলে রহিয়া,
না ছিল দোসর জনা।
হাসিতে হাসিতে, পিরীতি করিয়া,
পরাণ উপরে হানা।।(১)
যেন মলয়জ, ঘসিতে শীতল,
অধিক সৌরভ ময়।
শ্যাম বঁধুয়ার, পিরীতি ঐছন,
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়।।

————–

(১) পাঠান্তর–
“হাসিতে হাসিতে গীতের ঝমরু,
এ বড় সুগড় পনা।”
– প্রা, কা, সং।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সিন্ধুড়া ।।

এমত ব্যাভার, না জানি তাহার,
পিরীতি যাহার সনে।
গোপত করিয়া, কেনে সে রাখিলে,
বেকত করিলে কেনে।।(১)
মনের মরম জানিবে কে।
সেই সে জানে, মনের মরম,
এ রসে মজিল যে।।
চোরের মা যেন, পোয়ের লাগিয়া,
ফুকরি কাঁদিতে নারে।
কুলবতী হৈয়া, পিরিতি করিলে,
এমতি শঙ্কট তারে।।
কে আছে ব্যথিত, যাবে পরতীত,
এ দুখ কহিব কারে।
হয় দুখ ভাগি, পাই তার লাগি,
তবে সে কহি যে তারে।।
পর কি জানয়ে, পরের বেদন,
সে রত আপন কাজে।
চণ্ডীদাস কহে, বনের ভিতরে,
কভু কি রোদন সাজে?

————–

(১) পদকল্পতরুতে এই পদটি পাওয়া যায়। অন্য গ্রন্থে পাওয়া যায় না।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। গান্ধার ।।

যত নিবারিয়ে তায় নিবার না যায় রে।
আন পথে যাই সে কানু পথে ধায় রে।।
এ ছার রসনা মোর হইল কি বাম রে।
যার নাম নাহি লই লয় তার নাম রে।।
এ ছার নাসিকা মুই কত করু বন্ধ।
তবুত দারুণ নাসা পায় তার গন্ধ।।
সে না কথা না শুনিব করি অনুমান।
পরসঙ্গে শুনিতে আপনি যায় কাণ।।
ধিক রহুঁ এ ছার ইন্দ্রিয় মোর সব।
সদা সে কালিয়া কানু হয় অনুভব।।
কহে চণ্ডীদাসে রাই ভাল ভাবে আছ।
মনের মরম কথা কাহে জানি পুছ।।

————–

করু – করি।
তবুত দারুণ নাসা পায় তার গন্ধ – পাঠান্তর–“তবু ত দারুণ নাসা পায় শ্যাম গন্ধ”।-প, ক, ত।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

কোন বিধি সিরজিল কুলবতী নারী!
সদা পরাধীন ঘরে রহে একেশ্বরী।।
ধিক রহুঁ হেন জন হ’য়ে প্রেম করে।
বৃথা সে জীবন রাখে তখনি না মরে।।
বড় ডাকে কথাটী কহিতে যে না পারে।
পর পুরুষেতে রতি ঘটে কেন তারে।।
এ ছার জীবনের মুঞি ঘুচাইনু আশ।
চণ্ডীদাস কহে কেন ভাবহ উদাস?

————–

রতি – আশক্তি।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। বিহাগড়া ।।

ধাতা কাতা বিধাতার কপালে দিয়াছি ছাই।
জনন হৈতে একা কৈল দোসর দিল নাই।।
না দিল রসিক মূঢ়, পুরুষের সনে।
এমতি আছয়ে ত এ পাপ বিধানে।।
যার লাগি প্রাণ কাঁদে তার নাই দেখা।
এ পাপ করমে মোর এমতি লেখা জোকা।।
ঘর দুয়ারে আগুণ দিয়া যাব দূর দেশে।
আরতি পূরিবে কহে দ্বিজ চণ্ডিদাসে।।

————–

ধাতা কাতা বিধাতার কপালে দিয়াছি ছাই – পাঠান্তর–“ধাতা কাতা বিধাতার বিধানে দিয়াছি ছাই”।-প, ক, ত।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

কাহারে কহিব দুঃখ কে জানে অন্তর?
যাহারে মরমী কহি সে বাসয়ে পর।।
আপনা বলিতে বুঝি নাহিক সংসারে।
এত দিনে বুঝিনু সে ভাবিয়া অন্তরে।।
মনের মরম কহি জুড়াবার তরে।
দ্বিগুণ আগুণ সেই জ্বালি দেয় মোরে।।
এত দিনে বুঝিলাম মনেতে ভাবিয়া।
এ তিন ভুবনে নাহি আপন বলিয়া।।
এ দেশে না রব একা যাব দূর দেশে।
সেই সে যুকতি কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। ধানশী ।।

শিশুকাল হৈতে, শ্রবণে শুনিনু,
সহজে পিরীতি কথা।
সেই হইতে মোর, তনু জর জর,
ভাবিতে অন্তর ব্যথা।।
দৈবের ঘটিতে, বন্ধুর সহিতে,
মিলন হইবে যবে।
মান অভিমান, বেদের বিধান,
ধৈরজ ভাঙ্গিবে তবে।।
জাতি কুল বলি, দিলাম তিলাঞ্জলি,
ছাড়িনু পতির আশ।
ধরম, করম, বলি দেয় গালি,
গুরু পরিজন মেলি।
কাতর হইয়ে, আদর কইয়ে,
লইনু কলঙ্কের ডালি।।
চোরের মা যেন, পোয়ের লাগিয়া,
ফুকরি কান্দিতে নারে।
কুলবতী হয়ে, পিরীতি করিলে,
এমতি ঘটিবে তারে।।
মুঞি অভাগিনী, কেবল দুখিনী,
সকলি পরের আশে।
আপনা খাইয়া, পিরিতি করিনু,
লোকে শুনি কেন হাসে।।
চণ্ডীদাস বলে, পিরীতি লক্ষণ,
শুন গো বরজ নারী।
পিরীতি ঝুলিটি, কান্ধেতে করিয়া,
পিরীতি নগরে ফিরি।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

কালার পিরীতি, গরল সমান,
না খাইলে থাকে সুখে।
পিরীতি অনলে, পুড়িয়া মরে যে,
জনম যায় তার দুখে।।
আর বিষ খেলে, তখনি মরণ,
এ বিষে জীবন শেষ।
সদা ছটফট, ঘূরুণি নিপট,
লট পট তার বেশ।।
নয়নের কোণে, চাহে যাঁহা পানে,
সে ছাড়ে জীবনের আশ।
পরশ পাথর, ঠেকিয়া রহিল,
কহে বড়ু চণ্ডীদাস।।

————–

নিপট – নিতান্ত।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সিন্ধুড়া ।।

যে জন না জানে, পিরীতি মরম,
সে কেন পিরীতি করে?
আপনি না বুঝে, পরকে মজায়,
পিরীতি রাখিতে নারে।।
যে দেশে না শুনি, পিরীতি মরম,
সেই দেশে হাম যাব।
মনের সহিত, করিয়া যতন,
মনকে প্রবোধ দিব।।
পিরীতি রতন, করিয়া যতন,
পিরীতি করিব তায়।
দুই মন এক, করিতে পারিলে,
তবে সে পিরীতি রয়।।
কহে চণ্ডীদাসে, মনের উল্লাসে,
এমতি হইবে যে।
সহজ ভজন, পাইবে সে জন,
সহজ মানুষ সে।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সিন্ধুড়া ।।

পিরীতি বিষম কাল।
পরাণে পরাণ, মিলাইতে জানে,
তবে সে পিরীরি ভাল।।
ভ্রমরা সমান, আছে কত জন,
মধু লোভে করে প্রীত।
মধু ফুরাইলে, উড়ি যায় চলি,
এমতি তাদের রীত।।
হেন ভ্রমরার, সাধ নহে কভু,
সে মধু করিতে পান।
অজ্ঞানী পাইতে, পারয়ে কি কভু,
রসিক জ্ঞানীর সন্ধান।।
মনের সহিত, যে করে পিরীতি,
তারে প্রেম কৃপা হয়।
সেই সে রসিক, অটল রূপের,
ভাগ্যে দরশন পায়।।
মনের সহিতে, করিয়া পিরীতি,
থাকিব স্বরূপ আশে।
স্বরূপ হইতে, ও রূপ পাইব,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। বরাড়ী ।।

কেনে কৈনু পিরীতের সাধ!
পিরীতি অঙ্কুর হৈতে, যত দুখ পাইনু চিতে,
শুনিলে গণিবে পরমাদ।।
মুঞি যদি জানিতুঁ এত, তবে কেন হব রত,
না করিতুঁ হেন সব কাজ।
ভুলিনু পরের বোলে, কুলটা হইনু কুলে,
জগৎ ভরিয়া রইল লাজ।।
যখন পিরীতি কৈল, আনি চাঁদ হাতে দিল,
পুন হাতে না পাই দেখিতে।
কি করিতে কি না করি, ঝুরিয়া ঝুরিয়া মরি,
অবশেষে প্রাণ চায় নিতে।।
পিরীতি আখর তিন, যাহার হৃদয়ে চিন,
কিবা তার লাজ কুল ভয়।
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস, যে করে পিরীতি আশ,
তার বুঝি এই সব হয়।।

————–

চিন – চিহ্ন।
তার বুঝি এই সব হয় – পাঠান্তর–“তার বুঝি এই দশা হয়”।-লী, স।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
এ তিন ভুবন সার।
এই মোর মনে, হয় রাতি দিনে,
ইহা বই নাহি আর।।
বিধি এক চিতে ভাবিতে ভাবিতে,
নিরমাণ কৈল “পি”।
রসের সাগর, মন্থন করিতে,
তাহে উপজিল “রী”!
পুনল যে মথিয়া, অমিয়া হইল,
তাহা ভিয়াইল “তি”।
সকল সুখের, এ তিন আখর,
তুলনা দিব যে কি?
যাহার মরমে, পশিল যতনে,
এ তিন আখর সার।
ধরম করম, সরম ভরম,
কিবা জাতি কুল তার।।
এ হেন পিরীতি, না জানি কি রীতি,
পরিণামে কিবা হয়।
পিরীতি বন্ধন, বড়ই বিষম,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।

————–

বিধি এক চিতে – বিধি এক মনে।
উপজিল – উৎপত্তি হইল।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

পিরীতি পিরীতি, মধুর পিরীতি,
এ তিন ভুবনে কয়।
পিরীতি করিয়ে, দেখিলাম ভাবিয়ে,
কেবল গরল ময়।।
পিরীতেরি কথা, শুনিব হে যেথা,
তথাতে নাহিক যাব।
মনের সহিত, করিয়া পিরীত,
স্বরূপে চাহিয়া র’ব।।
এমতি করিয়া, সু মতি হইয়া,
রহিব স্বরূপ আশে।
স্বরূপ প্রভাবে, সে রূপ মিলিবে,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

শ্যামের পিরীতি, মূরতি হইলে,
তবে কি পরাণ ফলে!
পরাণ পিরীতি, সমান করিলে,
কে তারে জীয়ন্ত বলে?
যদি হায় শ্যাম, বঁধু লাগি পাউ,
তবে সে এ দুখ দুটে।
আন মত গুণি, মনের আগুণি,
ঝলকে ঝলকে উঠে।।
পরাণ রতন, পিরীতি পরশ,
জুকিনু হৃদয় তুলে।
পিরীতি রতন, অধিক হইল,
পরাণ উঠিল চুলে।।
জাতি কুল বলি, দিনু জলাঞ্জলি,
আর সতী চরচাতে।
তনু ধন জন, জীবন যৌবন,
নিছিনু কালা পিরীতে।।
হিয়ায় রাখিব, কারে না কহিব,
পরাণে পরাণ যোড়া।
কি জানি কি ক্ষণে, কি দিয়া কি কৈল,
মরিলে না যায় ছাড়া।।
তিলেকে মরিয়ে, যদি না দেখিয়ে,
শয়নে স্বপনে বন্ধু।
কহে চণ্ডীদাস, মরমে রহল,
পিরীতি অমিয়া সিন্ধু।।

————–

পাউ – পাই।

পরাণ রতন, পিরীতি পরশ – পাঠান্তর–“পরাণ সমান, পিরীতি রতন”।-প, ক, ত।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। তিওট, বিহাগরা ।।

বিধির বিধানে হাম আনল ভেজাই।
যদি সে পরাণ বঁধু তার লাগি পাই।।
গুরু দুরজন যত বঁধুর দ্বেষ করে।
সন্ধ্যাকালে সন্ধ্যামুনি তার বুকে পড়ে।।
আপন দোষ না দেখিয়া পরের দোষ গায়।
কাল সাপিনী যেন তার বুকে খায়।।
আমার বন্ধুকে যে করিতে চাহে পর।
দিবস দুপরে যেন পুড়ে তার ঘর।।
এতেক যুবতী আছে গোকুল নগরে।
কে না বঁধুরে দেখে বুক ফেটে মরে।
বাশুলী আদেশে দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে।
তোমার বঁধু তোমার আছে গালি পাড়িছ কেনে?

————–

বিধির বিধানে হাম আনল ভেজাই – বিধির বিধানে আমি আগুন দিই।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

এ ছার দেশে বসতি নৈল নাহিক দোসর জনা।
মরমের মরমী নহিলে না জানে মরমের বেদনা।।
চিত উচাটন সদা কত উঠে মনে।
ননদী বচনে মোর পাঁজর বিঁধে ঘুণে।।
জ্বালার উপরে জ্বালা সহিতে না পারি।
বঁধু হইল বিমুখ ননদী হৈল বৈরী।।
গুরুজন কুবচন সদা শেলের ঘায়।
কলঙ্কে ভরিল দেশ কি করি উপায়?
বাশুলী আদেশে কবি চণ্ডীদাসের গীত।
আপনা আপনি চিত করহ সম্বিত।।

————–

চিত উচাটন সদা কত উঠে মনে – পাঠান্তর–“রহিতে না পারি ঘরে চিত উচাটনে”।-প্রা, কা, সং।
সম্বিত – সম্বরণ।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

পিরীতি পিরীতি, সব জন কহে,
পিরীতি সহজ কথা!
বিরিখের ফল নহেত পিরীতি,
নাহি মিলে যথা তথা।।
পিরীতি অন্তরে, পিরীতি মন্তরে,
পিরীতি সাধিল যে।
পিরীতি রতন লভিল যে জন,
বড় ভাগ্যবান সে।।
পিরীতি লাগিয়া, আপনা ভুলিয়া,
পরেতে মিশিতে পারে।
পরকে আপন, করতে পারিলে,
পিরীতি মিলয়ে তারে।।
পিরীতি সাধন বড়ই কঠিন
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস।
দুই ঘুচাইয়া এক অঙ্গ হও
থাকিলে পিরীতি আশ।।

————–

বিরিখের ফল – বৃক্ষের ফল।
মন্তরে – মন্ত্রে।

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

পিরীতি বলিয়া, এ তিন আঁখর,
বিদিত ভুবন মাঝে।
তাহে কি পশিল, সেই সে জানিল,
কি তার কুল ভয় লাজে!
বেদ বিধি পর, সব অগোচর,
ইহা কি জানে আনে।
রসে গর গর, রসের অন্তর,
সেই স মরম জানে।।
দুহুঁক অধর, সুধারস বাণী,
তাহে উপজিল পি।
হিয়ায় হিয়ায়, পরশ করিতে,
তাহার তুলনা কি।।
কহে চণ্ডীদাস, শুন বিনোদিনি,
পিরীতি রসেতে ভোর।
পিরীতি করিয়া, ছাড়িতে নারিবে, আ
আপনি হইবে চোর।।

————–

অনুরাগ।–আত্ম প্রতি ।। সুহিনী ।।

পিরীতি পিরীতি, কি রীতি মূরতি,
হৃদয়ে লাগল সে।
পরাণ ছাড়িলে, পিরীতি না ছাড়ে,
পিরীতি গড়ল কে?
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
না জানি আছিল কোথা?
পিরীতি কণ্টক, হিয়ায় ফুটল,
পরাণ পুতলী যথা।।
পিরীতি পিরীতি, পিরীতি অনল,
দ্বিগুন জ্বলিয়া গেল।
বিষম অনল, নিভাইলে নহে,
হিয়ায় রহল শেল।।
চণ্ডীদাস বাণী, শুন বিনোদিনি,
পিরীতি না কহে কথা।
পিরীতি লাগিয়া, পরাণ ছাড়িলে,
পিরীতি মিলয়ে তথা।।

————–

অনুরাগ—আত্মপ্রতি ।। শ্রীরাগ ।।

পিরীতি নগরে, বসতি করিব,
পিরীতে বাঁধিব ঘর।
পিরীতি দেখিয়া, পড়শী করিব,
তা বিনু সকলি পর।।
পিরীতি দ্বারের, কবাট করিব,
পিরীতে বাঁধিব চাল।
পীরিতি আসকে, সদাই থাকিব,
পিরীতে গোঙাব কাল।।
পিরীতি পালঙ্কে, শয়ন করিব,
পিরীতি শিথান মাথে।
পিরীতি বালিসে, আলিস করিব,
থাকিব পিরীতি সাথে।।
পিরীতি সরসে, সিনান করিব,
পিরীতি অঞ্জন লব।
পিরীতি ধরম, পিরীতি করম,
পিরীতে পরাণ দিব।।
পিরীতি নাসার, বেসর করিব,
দুলিবে নয়ণ কোণে।
পিরীতি অঞ্জন, লোচনে পরিব,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে ভনে।।

———————-
তা বিনু—তাহা বিনে। আসকে—আশক্তিতে। শিথান—মাথার বালিস। আলিস—আলস্য।

বাসক সজ্জা

বাসক সজ্জা ।। গান্ধার ।।

রধিকা আদেশে, মনের হরষে,
কুসুম রচনা করে।
মল্লিকা মালতি, আর জাতী যূথি,
সাজাইছে থরে থরে।।
আজ রচয়ে বাসক শেজ।
মুনিগণ চিত, হেরি মূরছিত,
কন্দর্পের ঘুচে তেজ।।
ফুলের আচির, ফুলের প্রাচীর,
ফুলেতে ছাইল ঘর।
ফুলের বালিস, আলিস কারণ,
প্রতি ফুলে ফুলশর।।
শুক পিক দ্বারী, মদন প্রহরী,
ভ্রমর ঝঙ্কারে তায়।
ছয় ঋতু মত্ত, সহিত বসন্ত,
মলয় পবন বায়।।
উজোরল রাই, মণিময় বাতি
কর্পূর তাম্বুল বারি।
চণ্ডীদাস ভণে, রাখি স্থানে স্থানে,
শয়ন করিল গোরি।।

————–

হরষে – আনন্দে। শেজ – শয্যা। পিক – কোকিল। উজোরল – উজ্জ্বল হইল।

বাসক সজ্জা লক্ষণঃ–
“প্রিয়ার সহিত বিলাসের আশ করি। গৃহ শয্যা মাল্য তাম্বুল সিগ্ধ বারি।।
চন্দনাদি মালা গন্ধ বসন ভূষণ। সাজায় করিয়া সাধ প্রিয়ার কারণ।।”
–ভক্তমাল।

বিপ্রলব্ধা

বিপ্রলব্ধা ।। ধানশী ।।

বন্ধুর লাগিয়া, শেজ বিছাইনু,
গাঁথিনু ফুলের মালা।
তাম্বুল সাজনু, দীপ উজারিনু,
মন্দির হইল আলা।।
সই! পাছে এ সব হবে আন।
সে হেন নাগর, গুণের সাগর,
কাহে না মিলল কান?
শাশুড়ী ননদে, বঞ্চনা করিয়া,
আইনু গহন বনে।
বড় সাধ মনে, এ রূপ যৌবনে,
মিলিব বন্ধুর সনে।।
পথ পানে চাহি, কত না রহিব,
কত প্রবোধিব মনে?
রস শিরোমণি, আসিবে এখনি,
বড়ু চণ্ডীদাস ভণে।।

————–

শেজ – শয্যা। তাম্বুল সাজনু – পান সাজিলাম। উজারিনু – উজ্জ্বল করিলাম। কান – কানু।

বিপ্রলব্ধা লক্ষণঃ–
“সখীর আশ্বাসে ধনী স্থির করি মন। প্রিয় আগমন পথ করি নিরীক্ষণ।।
বৃক্ষের পত্রে পত্রে যদি শব্দ হয়। এই আইসে প্রিয় বলি উঠিয়া বৈঠয়।।
দূতী পাঠাইয়া দিলা প্রিয়ার কারণে। ফিরিয়া আইলা দূতী বজ্র হেন মনে।।
এই রূপ বিচ্ছেদ বিষাদে নিশি যায়। …………।।”
–ভক্তমাল।

বিপ্রলব্ধা ।। শ্রীরাগ ।।

দ্বারের আগে, ফুলের বাগ,
কি সুখ লাগিয়া রুইনু।
মধু খাইতে খাইতে, ভ্রমর মাতল,
বিরহ জ্বালাতে মৈনু।।
জাতী রুইনু, যূথি রুইনু,
রুইনু গন্ধ মালতী।
ফুলের বাসে, নিদ্‌ নাহি আসে,
পুরুষ নিঠুর জাতি।।
কুসুম তুলিয়া, বোঁটা তেয়াগিয়া,
শেজ বিছাইনু কেনে?
যদি শুই তাই, কাঁটা ভুকে গায়,
রসিক নাগর বিনে।।
রতন মন্দিরে, সখীর সহিতে,
তা সনে করিনু প্রেম।
চণ্ডীদাস কহে, কানুর পিরীতি,
যেন দরিদ্রের হেম।।*

————–

বাসে – সুবাসে; সৌগন্ধে।

* পদসমুদ্র

বিপ্রলব্ধা ।। ধানশী ।।

দুকাণ পাতিয়া, ছিল এতক্ষণ,
বঁধু পথ পানে চাই।
পরভার নিশি, দেখিয়া অমনি,
চমকি উঠিল রাই।।
পাতায় পাতায়, পড়িছে শিশির,
সখীরে কহিছে ধনী।
বাহির হইয়া, দেখলো সজনি,
বঁধুর শবদ শুনি।
পুন কহে রাই, না আসিল বঁধু,
মরমে রহল ব্যথা।
কি বুদ্ধি করিব, পাষাণে ধরিয়া,
ভাঙ্গিব আপন মাথা।।
ফুলের এ ডালা, ফুলের এ মালা,
শেজ বিছাইনু ফুলে।
সব হৈল বাসি, আর কেন সই,
ভাসাগে যমুনাজলে।।
কুঙ্কুম কস্তূরী, চুবক চন্দন,
লাগিছে গরল হেন।
তাম্বুল বিরস, ফুলহার ফণী,
দংশিছে হৃদয়ে যেন।।(১)
সকল লইয়া, যমুনায় ডার (২),
আর ত না যায় দেখা।
ললাটের সিন্দূর, মুছি কর দূর,
নয়ানের কাজর রেখা।।
আর না রাখিব, এছার পরাণ,
না যাব লোকের মাঝে।
থর হও রাই (৩), চলু চণ্ডীদাস,
আনিতে নিঠুর রাজে (৪)।।

————–

(১) ফুলের হার সর্প হইয়া যেন হৃদয়কে দংশন করতেছে।
(২) ফেলিয়া দাও।]
(৩) স্থির হও রাই।
(৪) নিষ্ঠুর রাজা–শ্রীকৃষ্ণ।

বিপ্রলব্ধা ।। সুহিনী ।।

সে যে বৃষভানু সুতা।
মরমে পাইয়া ব্যথা।।
সজল নয়ান হৈয়া।
রহে পথপানে চাইয়া।
ফুল শেজ বিছাইয়া।
রহয়ে ধেয়ানী হৈয়া।।
উজর চাঁদনি রাতি।
মন্দিরে রতন বাতি।।
কহে সব ভেল আন।
কাহে না মিলল কান।।
সকল বিফল হৈল।
আধ রজনী গেল।।
শ্যাম বঁধুয়ার পাশ।
চলু বড়ু চণ্ডীদাস।।
————–

বিপ্রলব্ধা ।। সুহিনী ।।

রহয়ে ধেয়ানী হৈয়া – মৌনী হইয়া রহে। চলু – চলিল।

খণ্ডিতা

খণ্ডিতা ।। চন্দ্রাবলীর উক্তি ।। কামোদ ।।

এই পথে নিতি, কত গতায়তি,
নূপুরের ধ্বনি শুনি।
রাধা সঙ্গে বাস, আমারে নৈরাশ,
আমি বঞ্চি একাকিনী।।
বন্ধু হে! ছাড়িয়া নাহিক দিব।
হিয়ার মাঝারে, রাখিব তোমারে,
সদাই দেখিতে পাব।।
শুন সখীগণ, করিয়া যতন,
লয়ে চল নিকেতনে।
আজকার নিশি, রাধিকা রূপসী,
বঞ্চুক নাগর বিনে।।
এতেক শুনিয়া, করেতে ধরিয়া,
লইয়া চলিল বাস।
রাধা ভয়ে হরি, কাঁপে থরথরি,
ভণে দ্বিজ চণ্ডীদাস।।

————–

গতায়তি যাতায়াত। বঞ্চি – কাটাই।

খণ্ডিতা লক্ষণঃ–
“অন্য নায়িকা ভোগ করিয়া নায়ক। আইছে অঙ্গেতে নখ চিহ্নাদি যাবক।।
দেখিয়া কুপিত মনে ভর্ৎসনাদি করি। উপেক্ষা করয়ে খণ্ডিতাবনতা নারী।।”
–ভক্তমাল।

খণ্ডিতা ।। শ্রীরাগ ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)

চন্দ্রাবলী! আজি ছাড়ি দেহ মোরে।
শ্রীদাম ডাকিছে, যাব তার কাছে,
এই নিবেদন তোরে।।
কাল আসি হাম, পুরাইব কাম,
ইথে নাহি কর রোষ।
চন্দ্রাবলী নাথ, ভুবনে বিদিত,
জগতে ঘোষয়ে দোষ।।
তুমি যে আমার, আমি যে তোমার,
বিবাদে কি ফল আছে?
লোক জানাজানি, কেন কর ধনি!
পিরীতি ভাঙ্গিবে পাছে?
দাদা বলরাম, করে অম্বেষণ,
ভ্রময়ে নগর মাঝে।
চণ্ডীদাসে কয়, সে যদি জানয়,
সবাই পড়িবে লাজে।।

————–

চন্দ্রাবলী – বৃষভানু রাজার ভ্রাতা রত্নভানু রাজার কন্যা।
কাম – কামনা।
ইথে – ইহাতে।

খণ্ডিতা ।। বিহাগড়া ।। (চন্দ্রাবলীর উক্তি)

কে বলে আমার, তুমি সে রাধার,
তাহার দুখের দুখী।
করিয়া চাতুরী, যাবে বুঝি হরি,
রাধারে করিতে সুখী।।
বঁধু হে! তুমি রাধার নাথ!
তব ভারিভূরি, ভাঙ্গিব মুরারি,
রাখিব আপন সাথ।।
এতেক বলিয়া, করেতে ধরিয়া,
চুম্বয়ে বদন চাঁদে।
রসিক নাগর, হইয়া ফাঁকর,
পড়িল বিষম ফাঁদে।।
হেথা সুবদনী, সখী সঙে বাণী,
কহয়ে কাতর ভাষে।
নিশি পোহাইল, পিয়া না আইল,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।

————–

ভারিভূরি – আত্ম শ্লাঘা, জাঁক। সুবদনী – শ্রীরাধিকা। সঙে – সঙ্গে।

খণ্ডিতা ।। ধানশী ।।

চন্দ্রাবলী সনে, কুসুম শয়নে,
সুখেতে ছিলেন শ্যাম।
প্রভাতে উঠিয়া, ভয়ে ভীত হৈয়া,
আসিলা রাধার ঠাম।।
গল পীতবাস, করিয়া সাহস,
দাঁড়াইল রাইয়ের আগে।
দেখে ফুলমালা, তাম্বুলের ডালা,
ফ্রিয়াছে রাই রাগে।।
নাগরে দেখিয়া, মানিনী না চান,
আছেন আপন কোপে।
ভয়ে যে ভূরুর, ভঙ্গিম দেখিয়া
নাগর তরাসে কাঁপে।।
রোষেতে নাগরী, থাকিতে না পারি,
নাগরেরে পাড়ে গালি।
চণ্ডীদাস ভণে, লম্পটের সনে,
কথা কৈলে তবু ভালি।।

————–

ঠাম – নিকটে। তরাসে – ত্রাশে, ভয়ে। নাগরেরে পাড়ে গালি – শ্রীকৃষ্ণকে গালি দেন। ভালি – ভাল।

খণ্ডিতা ।। ললিত ।।

ভাল হৈল আরে বঁধু আসিলা সকালে।
প্রভাতে দেখিলাম মুখ দিন যাবে ভালে।
বঁধু তোমায় বলিহারি যাই।
ফিরিয়া দাঁড়াও তোমার চাঁদ মুখ চাই।।
আই আই পড়েছে মুখে কাজরের শোভা।
ভালে যে সিন্দূর তোমার মুনির মনোলোভা।।
খর নখ দশনে অঙ্গ জর জর।
ভালে সে কঙ্কণ দাগ হিয়ার উপর।।
নীল পাটের শাটী কোচার বলনী।
রমণী রমণ হৈয়া বঞ্চিলা রজনী।।
সুরঙ্গ যাবক রঙ্গ উরে ভালে সাজে।
এমন কহ মনের কথা আইলা কিবা কাযে।।
চারি দিকে চায় নাগর আঁচলে মুখ মুছে।
চণ্ডীদাস কহে লাজ ধুইলে না ঘুচে।।

————–

শাটী – শাড়ী। যাবক – আলতা। উরে – বক্ষঃস্থলে।

খণ্ডিতা ।। রামকেলী ।।

ছুঁইওনা ছুঁইওনা বন্ধু ঐখানে থাক।
মুকুর লইয়া চাঁদ মুখ খানি দেখ।। ধ্রু।।
নয়ানের কাজর, বয়ানে লেগেছে,
কালের উপরে কাল!
প্রভাতে উঠিয়া, ওমুখ দেখিলাম,
দিন যাবে আজ ভাল।।
অধরে তাম্বুল, বয়ানে লেগেছে,
ঘুমে ঢুলু ঢুলু আঁখি।
আমা পানে চাও, ফিরিয়া দাঁড়াও,
নয়ন ভরিয়া দেখি।।
চাঁচর কেশের, চিকণ চূড়া।
সে কেন বুকের মাঝে।
সিন্দূরের দাগ, আছে সর্ব্বগায়,
মোরা হলে মরি লাজে।।
নীলকমল, ঝামরু হইয়াছে,
মলিন হইয়াছে দেহ।
কোন রসবতী, পেয়ে সুধানিধি,
নিঙড়ে লয়েছে সেহ।।
কুটিল নয়ানে, কহিছে সুন্দরী,
অধিক করিয়া ত্বরা।
কহে চণ্ডীদাস, আপন স্বভাব,
ছাড়িতে না পারে চোরা।।

————–

মুকুর – দর্পন; আয়না। ঝামরু – মলিন। নিঙড়ে – নিঙ্গাড়িয়া।

খণ্ডিতা ।। বিভাস ।।

হেদে হে নিলাজ বঁধু লাজ নাহি বাস।
বিহানে পরের বাড়ী কোন্‌ লাজে আস?
বুক মাঝে দেখি তোমার কঙ্কণের দাগ।
কোন কলাবতী আজি পেয়েছিল লাগ?
নখ পদ বিরাজিত রুধিরে পূরিত।
আহা মরি কিবা শোভায় করিল ভূষিত।।
কপালে সিন্দূর রেখা অধরে কাজল।
সে ধনী বিহনে তোমার আঁখি ছল ছল।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে শুন বিনোদিনি।
না ছুঁইও আমি ইহার সব রঙ্গ জানি।।

————–

বিহানে – প্রাতে; সকালে। কলাবতী – রসিকা।

খণ্ডিতা ।। সিন্ধুড়া ।।

বঁধু কহনা রসের কথা শুনি!
কেমন কামিনী সঙ্গে, যাপিলা যামিনী রঙ্গে,
কত সুখে পোহালা রজনী?
নীল নলিনী আভা, কে নিলে অঙ্গের শোভা,
কাজরে মলিন অঙ্গ খানি।
চিকণ চূড়ার ছাঁদ, কে নিলে বরিহা ফাঁদ,
আজি কেন পিঠে দোলে বেণী?
ধন্য সে বরজ বধু, যে পিয়ে অধর মধু,
পাষাণে নিশান তার সাখী।
রক্ত উৎপল ফুলে, যৈছে ভ্রমর বুলে,
ঐছন ফিরয়ে দুন আঁখি।।
রচিয়া সিন্দূরের বিন্দু, কে নিল অমিয়া সিন্ধু,
নাসার ছলে নাকের মুকুতা।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, এ কথা অন্যথা নয়,
ভালে জানে বৃষভানু সুতা।।

————–

যাপিলা – কাটাইলা। বহিলা – (হিন্দি) উৎকৃষ্ট। সাখী – সাক্ষী।

খণ্ডিতা ।। রামকেলী ।।

এস এস বন্ধু, করুণার সিন্ধু,
রজনী গোঙালে ভালে।
রসিকা রমণী, পেয়ে গুণমণি,
ভালত সুখেতে ছিলে?
নয়নে কাজর, কপালে সিন্দুর,
ক্ষত বিক্ষত হে হিয়া।
আঁখি ঢর ঢর, পরি নীলাম্বর,
হরি এলে হর সাজিয়া।।
ধিক্‌ ধিক্‌ নারী, পর আশাধারী,
কি বলিব বিধি তোয়।
এমত কপট, ধৃষ্ট, লম্পট, শট,
হাতেতে সোঁপিলি মোয়।।
কাঁদিয়া যামিনী, পোহালাম আমি,
তুমিত সুখেতে ছিলে?
রতি চিহ্ন সব, লইয়া মাধব,
প্রভাতে দেখাতে এলে?
এই মিনতি রাখ, ঐ খানেতে থাক,
আঙ্গিণাতে না আইস।
ছুঁইলে তোমারে, ধরমে আমারে,
না করিবে পরশ।।
লোক মুখ কত, শুনিতাম যত,
প্রতীত আজি হ’ল সব।
চণ্ডীদাস কয়, নাগর দয়াময়,
এত দয়ার স্বভাব।।

————–

খণ্ডিতা ।। ললিত ।।

আরে মোর আরে মোর সোণার বঁধুর।
অধরে কাজর দিল কপালে সিন্দূর।।
বদনকমলে কিবা তাম্বিল শোভিত।
পায়ের নখর ঘায় হিয়া বিদারিত।।
না এস না এস বঁধু আঙ্গিণার কাছে।
তোমারে দেখিলে (১) মোর ধরম যাবে পাশে।।
শুনিয়া পরের মুখে নহে পরতীত।
এবে সে দেখিনু তোমার এই সব রীত।।
সাধিলা মনের সাধ যে ছিল তোমারি।(২)
দূরে রহু দূরে রহু (৩), প্রণাম হামারি।।(৪)
চণ্ডীদাস কহে ইহা বলিলা কেমনে?
চোর ধরিলেও এত না কহে বচনে।।

————–

(১) পাঠান্তর–“ছুঁইলে”।-প্রা, কা, সং।
(২) বিভিন্ন পাঠ–“সাধিলা মনের সাধ কি আর বিচার।”-প, ক, ত।
(৩) পাঠান্তর–“দূরে দূরে রহু বঁধু”।-প্রা, কা, সং।
(৪) বিভিন্ন পাঠ–“প্রণতি আমার”।-প, ক, ত।

খণ্ডিতা ।। ললিত ।।

আহা আহা বঁধু তোমার শুকায়েছে মুখ।
সে সাজাল হেন সাজে হেরে বাসি দুখ।।
কপালে কঙ্কন দাগ আহা মরি মরি!
কে করিল হেন কাজ কেমন গোঁয়ারী?
দারুণ নখের ঘা হিয়াতে বিরাজে।
রক্তোৎপল ভাসে যেন নীল সরঃ মাঝে।।
কেমন পাষাণী যার দেখি হেন রীতি।
কে কোথা শিখাল তারে এ হেন পিরীতি।।
ছল ছল আঁখি দেখি মনে ব্যথা পাই।
লাচজে ব’স আঁচলেতে মুখানি মুছাই।।
বড় কষ্ট পাইয়াছ রজনী জাগিয়া।
চণ্ডীদাস কহে শোও হিয়ায় আসিয়া।।

————-

শুন শুন সুনয়নি আমার যে রীত।
কহিতে প্রতীত নহে জগতে বিদিত।।
তুমি না মানিবে তাহা আমি ভাল জানি।
এতেক না কহ ধনি অসম্ভব বাণী।।
সঙ্গত হইলে ভাল শুনি পাই সুখ।
অসঙ্গত হইলে পাইব বড় দুখ।।(১)
মিছা কথায় কত পাপ জানহ আপনি।
জানিয়া না মানে যে সেইত পাপিনী।।
পরে পরিবাদ দিলে ধরমে সহে কেনে?
তাহার এমত বাদ হইবে তখনে।।
চণ্ডীদাস বলে যেবা মিছা কথা কবে।
সেই সে ঠেকিবে পাপে তোমার কি যাবে।।

————–

(১) পাঠান্তর–“অসঙ্গত কৈলে কি লাভ শুনিতে না হয় সুখ”।-প্রা, কা, সং।

খণ্ডিতা ।। রামকেলী ।। (শ্রীরাধিকার প্রত্যুত্তর)

ভাল ভাল, কালিয়া নাগর,
শুনালে ধরম কথা?
পরের রমণী মজালে যখন,
ধরম আছিল কোথা?
চোরার মুখেতে, ধরম কাহিনী,
শুনিয়া পায় যে হাসি।
পাপ পূণ্য জ্ঞান, তোমার যতেক,
জানয়ে বরজবাসী।।
চলিবার তরে, দেও উপদেশ,
পাতর চাপিয়া পিঠে।
বুকেতে মারিয়া চাবুক ঘা,
তাহাতে লুণের ছিটে।।
আর না দেখিব, ওকাল মুখ,
এখানে রহিলে কেনে।
যাও চলি যথা, মনের মানুষ,
যেখানে মন যে টানে।।
কেন দাঁড়াইয়া, পাপিনীর কাছে,
পাপেতে ডুবিবা পাছে!
কহে চণ্ডীদাস, যাও চলি যথা,
ধরমের থলী আছে।।

—————

খণ্ডিতা ।। ধানশী ।। (পুনঃ শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)

না কর না কর ধনি এত অপমান।
তরুণী হইয়া কেনে একে দেখ আন?
বংশী পরশি আমি শপথ করিয়ে।
তোমা বিনু দিবা নিশি কিছু না জানিয়ে।।
ফাগু বিন্দু দেখি সিন্দূর বিন্দু কহ।
কণ্টকে কঙ্কন দাগ মিছাই ভাবহ।।
এত কহি বিনোদ নাগর চলি যায় ঘর।
চণ্ডীদাস কহে রাই কাঁপে থর থর।।

—————

ফাগু – আবীর।

খণ্ডিতা ।। ধানশী ।।

ললিতা কহয়ে শুনহে হরি।
দেখে শুনে আর রহিতে নারি।।
শুন শুন ওহে রসিক রাজ।
এই কি তোমার উচিত কাজ।।
উচিত কহিতে কাহার ডর।
কিবা সে আপন কিবা সে পর।।
শিশু কাল হ’তে স্বভাব চুরি।
সে কি পারে রহিতে ধৈর্য্য ধরি।।
এক ঘরে যদি না পোশে তায়।
ঘরে ঘরে ফিরে পায় কি না পায়।।
সোণা লোহা তামা পিতল কি বাছে।
চোরের কি কখন নিবৃত্তি আছে।।
এ রস দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়।
চোরের কখন মন শুদ্ধ নয়। *

——————-

* পদার্ণব সারাবলী।

খণ্ডিতা ।। ধানশী ।।

কনক — বরণ করিয়া মনে।
ভ্রমই মাধব গহন বনে।।
হিমকর হেরি মূরছি পড়ি।
ধূলায় ধূসর যাওত গড়ি।।
অপরাধী আমি কোথায় যাব?
রাই সুধামুখী কেমনে পাব?
এতেক কহিতে মিললি রাই।
চণ্ডীদাস তব জীবন পায়।। *

——————-
কনক-বরণ – রাধিকা।
হিমকর হেরি মূরছি পড়ি – চন্দ্রকে দেখিয়া শ্রীরাধার মুখচন্দ্র মনে উদয় হইয়া শ্রীকৃষ্ণ মূচ্ছিত হইলেন।
* লীলাসমুদ্র।

মান

মান ।। ভাটিয়ারি ।।

রামা হে কি আর বলিব আন।
তোহারি চরণে শরণ সো হরি
অবহুঁ না মিটে মান।।
গোবর্দ্ধন গিরি বাম করে ধরি,
যে কৈল গোকুল পার।
বিরহে সে ক্ষীণ, করের কঙ্কণ
মানয়ে গুরুয়া ভার।।
কালীয় দমন করল যেমন,
চরণ যুগল বরে।
এবেসে ভুজঙ্গ, ভরমে ভুলল,
হৃদয়ে না ধরে হারে।।
সহজে চাতক না ছাড়য়ে প্রীত,
না বৈসে নদীর তীরে।
নব জলধর, বরিখন বিনু,
না পিয়ে তাহার নীরে।।
যদি দৈব দোষেম অধিক পিয়াসে,
পিবয়ে হেরিয়ে থোর।
তবহুঁ তাহারি নাম সোঙরিয়া,
গলয়ে শতগুণ লোর।।
চণ্ডীদাস বাণী, শুন বিনোদিনি,
কি আর করহুঁ মান।
তুয়া অনুগত, শ্যম মরকত,
তো বিনু ভাবে না আন।। (১) *

——————-
(১) পাঠান্তর—
চণ্ডীদাস ভনে, শুন বিনোদিনী, কি আর বলিব তোয়।
শ্যাম রতন, জগত জীবন, না ঠেল মানেতে মোয়।।

* হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ।

মান ।। সুহই ।।

শুনলো রাজার ঝি।
লোকেনা বলিবে কি?
মিছই করসি মান।
তোবিনু জাগল কান।।
আনত সঙ্কেত করি।
তাহা জাগাইলা হরি।।
উলটি করসি মান।
বড়ু চণ্ডীদাস গান।।

—————-

মান ।। বসন্ত ।।

এ ধনি মানিনি মান নিবার।
আবীরে অরুণ শ্যাম অঙ্গ মুকুর পর,
নিজ প্রতিবিম্ব নেহার।।
তুহুঁ এক রমণী, শিরোমণি রসবতী,
কোন্‌ ঐছে জগমাহ?
তোহারি সমুখে, শ্যাম সহ বিলসব,
কৈছন রস নিরবাহ?
ঐছন সহচরী বচন হৃদয়ে ধরি,
সরমে ভ্রমে মুখ ফেলি।
ঈষৎ হাসি সনে, মান তেয়াগল,
উলসিত দুহেঁ দোঁহা হেরি।।
পুন সব জন মেলি করয়ে বিনোদ কেলি,
পিচকারি করি হাতে।
দ্বিজ চণ্ডীদাস* আবীর যোগাওত,
সকল সখীগণ সাথে।।

——————-

নিবার – নিবারণ কর; ত্যাগ কর। নেহার – দেখ।

*গীতরত্নাবলী এবং পদসমুদ্র গ্রন্থে দ্বিজ হরি দাসের ভণিতাযুক্ত দৃষ্ট হয়।

মান ।। ধানশী ।।

আপন শির হাম, আপন হাতে কাটিনু,
কাহে করিনু হেন মান?
শ্যাম সুনাগর, নটবর শেখর,
কাঁহা সখি করল পয়ান?
তপ বরত কত, করি দিন যাপিনী,
যো কানু, কো নাহি পায়।
হেন অমূল ধন, মঝু পদে গড়ায়ল,
কোপে মুঞি ঠেলিনু পায়।।
আরে সই! কি হবে উপায়?
কহিতে বিদরে হিয়া, ছাড়িনু সে হেন পিয়া।
অতি ছার মানের দায়।।
জনম অবধি মোর, এশেল রহিবে বুকে,
এ পরাণ কি কাজ রাখিয়া?
কহে বড়ু চণ্ডীদাস কি ফল হইবে বল,
গোড়া কেটে আগে জল দিয়া?

——————-

কাহে – কাকে। কাঁহা সখি করল পয়ান – সখী কোথায় গমন করিল? যো – যে। কো – কেহ। মঝু – আমার।

মান ।। শ্রীরাগ ।।

রাই মুখে শুনল ঐছল বোল।
সখীগণ কহে ধনি নহ উতরোল।।
তুয়া মুখ দরশন পায়ল সেহ।
কৈছে আছল কছু সমুঝল এছ।।
তুঁহু কাহে এত উৎকণ্ঠিত ভেল।
তোহে হেরি সো আকুল ভৈ গেল।।
ঐছে বিচার করত যাঁহা রাই।
তুরিতহি এক সখী মিলল তাই।।
এ ধনি পদুমিনি কর অবধান।
তোহারি নিয়ড়ে মুঝে ভেজল কান।।
চণ্ডীদাস কহে বিধুমুখী রাই।
অতিশয় ব্যাকুল ভেল কানাই।*

——————-

নহে উতরোল – ব্যাকুল হইও না। ভৈ গেল – হইয়া গেল। পদুমিনি – পদ্মিনী। নিয়ড়ে – নিকটে।

* হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ।

মান ।। ধানশী ।।

রাইক ঐছন সকরূণ ভাব।
শুনি সখী আয়ল কানুক পাশ।।
কহইতে সকল সম্বাদ।
গদ গদ করই বিষাদ।।
চল চল নাগর রস শিরোমণি।
তুয়া বিনু রাধিকা অধিক সাপিনী।।
চণ্ডীদাস কহে বিনোদ রায়।
ঝাট চল রাইক মাঝ হৃদয়।।*

——————-

* হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ।

মান ।। শ্রীরাগ ।।

আসি সহচরী, কহে ধিরি ধিরি,
শুনহ নাগর রায়।
অনেক যতনে, ঘুচাইলাম মানে,
ধরিয়া রাইয়ের পায়।।
তবে যদি আর, মান থাকে তার,
মানবি আপন দোষ।
তোমার বদন, মলিন দেখিলে,
ঘুচিবে এখনি রোষ।।
তুরিত গমনে, এস আমা সনে,
গলেতে ধরিয়া বাস।
সো হেন নাগর, হইয়া কাতর,
দাঁড়াইলা রাইয়ের পাশ।।
রাই কমলিনী, হেরি গুণমণি,
বঁধুয়া লইল কোলে।
দুহুঁক হৃদয়ে আনন্দ বাড়িল,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে বলে।

—————-

মান ।। ধানশী ।।

ললিতার বাণী, শুনি বিনোদিনী
প্রসন্ন বদনে কয়।
আমিত কেবল তোদের অধীন,
যা বল শুনিতে হয়।।
সখি তোরা মোর কর এহি হিতে!
আর যেন কখন, না করে এমন,
পুছ উহায় ভাল মতে।।
পুন যদি আর এমত ব্যাভার
করয়ে এ ব্রজ ভূমে।
উহার প্রণতি শ্রবণ গোচরে
না করিব এ জনমে।
এত শুনি হরি গলে বাস ধরি
কহয়ে কাতর বাণী!
শুন বিনোদিনি জনমে জনমে
আমি আছি প্রেমে ঋণী।।
এত শুনি গোরি, দু বাহু পসারি
বঁধুয়া করিল কোলে।
এই খানে হয়, রসামৃত ময়,
চণ্ডীদাসে ইহা বলে।।

—————-

মান ।। ধানশী ।।

ছিছি মানের লাগি, শ্যাম বঁধুরে,
হারাইয়া ছিলাম।
শ্যামল সুন্দর, মধুর মূরতি,
পরশে শীতল হৈলাম।।
শ্রীমধুমঙ্গলে, আন কুকূহলে,
ভুঞ্জাও ওদন দধি।
হারাধন যেন, পুনহি মিলল,
সদয় হইল বিধি।।
নিজ সুখরসে, পাপিনী পরশে,
না জানে পিয়াক সুখ।
কহে চণ্ডীদাসে, এ লাগি আমার,
মনেতে উঠয়ে দুখ।।

——————-

শ্রীমধুমঙ্গল :–
“বিশেষ রহস্যকারী বিদূষক দল। তার মধ্যে বিশেষতঃ শ্রীমধুমঙ্গল।।
শ্রীকৃষ্ণ থাকেন যবে প্রিয়গণ সনে। তথায় যাইতে নারে নর্ম্ম সখাগণে।।”
—ভক্তমাল।
ভুঞ্জাও – ভোজন করাও। ওদন – অন্ন।

মান ।। সুহই ।।

ছিছি দারূণ, মানের লাগিয়া,
বন্ধুরে হারাইয়া ছিলাম।
শ্যাম সুন্দর, রূপ মনোহর,
দেখিয়া পরাণ পেলাম।।
সই! জুড়াইল মোর হিয়া।
শ্যাম অঙ্গের, শীতল পবন,
তাহার পরশ পাইয়া।। ধ্রূ।
তোরা সখিগণ, করাহ সিনান,
আনিয়া যমুনা নীরে।
আমার বন্ধুর, যত অমঙ্গল,
সকল যাউক দূরে।।
শ্রীমধু মঙ্গলে, আহন সকলে,
ভুঞ্জাহ পায়স দহি।
বন্ধুর কল্যাণে, দেহ নানা দানে,
আমার সদয় বিধি।।
কহে চণ্ডীদাস, শুনহ নাগর,
এমত উচিত নয়।
না দেখিলে যুগ, শতেক মানয়,
ইথে কি পরাণ রয়।।

——————-

শ্রীমধুমঙ্গল :–
“বিশেষ রহস্যকারী বিদূষক দল। তার মধ্যে বিশেষতঃ শ্রীমধুমঙ্গল।।
শ্রীকৃষ্ণ থাকেন যবে প্রিয়গণ সনে। তথায় যাইতে নারে নর্ম্ম সখাগণে।।”
—ভক্তমাল।
ভুঞ্জাও – ভোজন করাও। দেহ নানা দানে – না প্রকারে দান কর।

মান ।। শ্রীরাগ ।।

রাইয়ের বচন, শুনি সখীগণ,
আনল যমুনা বারি।
নাগর সুন্দর, সিনান করল,
উলসিত ভেল গোরি।।
ললিতা আসিয়া, হাসিয়া হাসিয়া,
পরায়ল পীত বাস।
পরিয়া বসন, হরষিত মন,
বসিলা রাইয়ের পাশ।।
রাই বিনোদিনী, তেড়ছ চাহনি,
হানল বন্ধুর চিতে।
নাগর সুন্দর, প্রেমে গর গর,
অঙ্গ চাহে পরশিতে।।
মনে আছে ভয়, মানের সঞ্চয়,
সাহস নাহিক হয়।
অতি সে লালসে, না পায় সাহসে,
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়।।

——————-

উলসিত ভেল গোরি – শ্রীরাধিক পুলকিত হইলেন।

কলহান্তরিতা

কলহান্তরিতা ।। ধানশী ।।

আসিয়া নাগর, সমুখে দাঁড়াইল,
গলে পীতবাস লৈয়া।
সোচান্দ বদনে, ফিরি না চাহলি,
তো বড়ি নিঠুর মায়্যা।।
সো শ্যাম নাগর, জগত দুর্ল্লভ,
কিসের অভাব তার।
তোমাহেন কত, কুলবতী সতী,
দাসী হইয়াছে যা’র।
তার চূড়া মেনে, সুখেতে থাকুক,
তাহে ময়ুরের পাখা।
তোমা হেন কত, কুলবতী সতী,
দুয়ারে পাইবে দেখা।।
অভিমানী হৈয়া, মোরে না কহিয়া,
তেজলি আপন সুখে।
আপনার শেল, যতনে আপনি,
হানিলি আপন বুকে।।
মনের আগুণে, মরহ পুড়িয়া,
নিভাইবা আর কিসে?
শ্যাম জলধর, আর না মিলিবে,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।

——————-

তো বড়ি নিঠুর মায়্যা – তুই বড়ই নিঠুর মেয়ে। তেজলি – ত্যাগ করিলি।

কলহান্তরিতা :—
“মান অন্তে প্রিয়ের বিচ্ছেদে যে সূচন।
অনুতাপে সেই কলহান্তরিতার লক্ষণ।।”
—ভক্তমাল

কলহান্তরিতা ।। বিভাস ।।

উহাঁর নাম করো না নামে মোর নাহি কাজ।
উনি করেছেন ধর্ম্ম নষ্ট ভুবন ভরি লাজ।।
উনি নাটের গুরু সই উনি নাটের গুরু।
উনি করেছেন কুলের বাহির নাচাইয়া ভুরু।।
এনে চন্দ্র হাতে দিল যখন ছিল উহাঁর কাজ।
এখন উহাঁর অনেক হলো আমরা পেলাম লাজ।।
কহে বড়ু চণ্ডীদাস বাশুলী আদেশে।
উহাঁর সনে লেহ করে তনু হইল শেষে।।*

——————-

লেহ – পিরীত।
* হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ।
প্রবাস

প্রবাস ।। ধানশী ।।

ললিতার কথা শুনি, হাসি হাসি বিনোদিনী
কহিতে লাগিল ধনী রাই।
“আমারে ছাড়িয়া শ্যাম, মধু পুরে যাইবেন,
এ কথাত কভু শুনি নাই।।
হিয়ার মাঝারে মোর, এ ঘর মন্দিরে গো,
রতন পালঙ্ক বিছা আছে।
অনুরাগের তুলিকায়, বিছান হয়েছে তায়,
শ্যাম চাঁদ ঘুমায়ে রয়েছে।।
তোমরা যে বল শ্যাম, মধুপুরে যাইবেন,
কোন পথে বন্ধু পলাইবে।
এ বুক চিরিয়া যবে, বাহির করিয়া দিব,
তবে ত শ্যাম মধুপুরে যাবে?”
শুনিয়া রাইয়ের কথা, ললিতা চম্পকলতা,
মনে মনে ভাবিল বিস্ময়।
চণ্ডীদাসের মনে, হরষ হইল গো,
ঘুচে গেল মাথুরের ভয়।। *

——————-

প্রবাস লক্ষণ :—
“প্রিয়সী ছাড়িয়া প্রিয় দূর দেশে যায়।
তাহাকেই রীত এই প্রবাস কহয়।।”
—ভক্তমাল।

* পদসমুদ্র।

প্রবাস ।। ধানশী ।।

সখিরে মধুরা মণ্ডলে পিয়া।
আসি আসি বলি, পুন না আসিল,
কুলিশ-পাষাণ হিয়া।।
আসিবার আশে, লিখিনু দিবসে,
খোয়াইনু নখের ছন্দ।
উঠিতে বসিতে, পথ নিরখিতে,
দু’আঁখি হইল অন্ধ।।
এ ব্রজ মণ্ডলে, কেহ কি না বলে,
আসিবে কি নন্দ লাল?
মিছা পরিহার, ত্যজিয়া বিহার,
রহিব কতেক কাল?
চণ্ডীদাস কহে মিছা আসা আশে,
থাকিব কতেক দিন?
যে থাকে কপালে, করি একেকালে,
মিটাইব আখর তিন।।

——————–

প্রবাস ।। সুহই ।।

কানু অঙ্গ পরশে শীতল হ’ব কবে।
মদন দহন জ্বালা কবে সে ঘুচিবে?
বয়ানে বয়ান হরি কবে সে ধরিবে?
বয়ানে বয়ান দিলে হিয়া জুড়াইবে।।
কবে ধরি পয়োধর কবে সে চাপিবে?
দুখ দশা ঘুচি তবে সুখ উপজিবে।।
বাশুলী এমন দশা কবে সে করিবে?
চণ্ডীদাসের মনোদুঃখ তবে সে ঘুচিবে।।

——————

প্রবাস ।। সিন্ধুড়া ।।

পিয়া গেল দূর দেশ হম অভাগিনী।
শুনিতে না বাহিরায় এ পাপ পরাণি।।
পরশে সোঙরি মোর সদা মন ঝুরে।
এমন গুণের নিধি লয়ে গেল পরে।।
কাহারে কহিব সই আনি দিবে মোরে।
রতন ছাড়িয়া গেল ফেলিয়া পাথারে।।
চণ্ডীদাস কহে কেন এমতি করিবে।
কানু সে প্রাণের নিধি আপনি মিলিবে।। *

——————-

* পদসমুদ্র।

প্রবাস ।। সুহই ।।

অগৌর চন্দন চুয়া দিব কার গায়।
পিয়া বিনু হিয়া মোর ফাটিয়া যে যায়।।
তাম্বুল কর্পূর আদি দিব কার মুখে।
রজনী বঞ্চিব আমি কারে ল’য়া সুখে।।
কার অঙ্গ পরশে শীতল হবে দেহা।
কান্দিয়া গোঙাব কত না ছুটিল লেহা।।
কোন্‌ দেশে গেল পিয়া মোরে পরিহরি।
তুমি যদি বল সই বিষ খাইয়া মরি।।
পিয়ার চূড়ার ফুল গলায় গাঁথিয়া।
আনহ অনল সই মরিব পুড়িয়া।।
সে গুণ সোঙরি মোর পাঁজর খসি যায়।
দহনে দগধে মোর এ পাপ হিয়ায়।।
তোমরা চলিয়া যাহ আপনার ঘরে।
মরিব অনলে আমি যমুনার তীরে।।
চণ্ডীদাসে বলে কেন কহ হেন কথা।
শরীর ছাড়িলে প্রীতি রহিবেক কোথা।।*

——————-

* পদসমুদ্র।

প্রবাস ।। তুড়ি।।

অকথ্য বেদন সই কহা নাহি যায়।
যে করে কানুর নাম ধরে তার পায়।।
পায়ে ধরি কান্দে তার চিকুর গড়ি যায়।
সোণার পুতলি যেন ধূলায় লুটায়।।
পুছয়ে পিয়ার কথা ছল ছল আঁখি।
“তুমি কি দেখছ কালা কহনারে সখি।।”
চণ্ডীদাস কহে কান্দ কিসের লাগিয়া।
সে কালা রহেছে তোমার হৃদয়ে লাগিয়া।।*

——–

*পদসমুদ্র

প্রবাস ।। ধানশী ।।

কালি বলি কালা, গেল মধুপুরে,
সে কালের কত বাকি?
যৌবন সায়রে, সরিতেছে ভাঁটা,
তাহারে কেমনে রাখি?
জোয়ারের পানী, নারীর যৌবন,
গেলে না ফিরিবে আর।
জীবন থাকিলে, বঁধুরে পাইব,
যৌবন মিলন ভার।।
যৌবনের গাছে, না ফুটিতে ফুল,
ভ্রমরা উড়িয়া গেল।
এ ভরা যৌবন, বিফলে গোঙানু,
বঁধু ফিরে নাহি এল।।
যাও সহচরি, জানিয়া আসহ,
বঁধুয়া আসে না আসে।
নিঠুরের পাশ, আমি যাই চলি,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।

—————-

প্রবাস ।। সিন্ধুড়া ।।

সখিরে, বরষ বহিয়া গেল, বসন্ত আওল,
ফুটল মাধবী লতা।
কুহু কুহু করি, কোকিল কুহরে,
গুঞ্জরে ভ্রমরী যতা।।
আমার মাথার কেশ, সুচারু অঙ্গের বেশ,
পিয়া যদি মথুরা রহিল।
ইহ নব যৌবন, পরশ রতন ধন,
কাচের সমান ভেল।।
কোন্‌ সে নগরে, নাগর রহল,
নাগরী পাইয়া ভোর।
কোন গুণবতী, গুণেতে বেঁধেছে,
লুবধ ভ্রমর মোর।।
যাও সহচরি, মথুরা মণ্ডলে,
বলিও আমার কথা।
পিয়া এই দেশে, আসে বা না আসে,
জানিয়া আইস হেথা।।
বিধুমুখী বোলে, সহচরী চলে,
নিদয় নিঠুর পাশ।
সহচরী সনে, ভণয়ে ভর্ত্‌সয়ে,
কবি বড়ু চণ্ডীদাস।।

———————-

প্রবাস ।। কানড়া ।।

সখি, কহবি কানুর পায়।
সে সুখ সায়র, দৈবে শুকায়ল,
তিয়াষে পরাণ যায়।।
সখি ধরবি কানুর কর।
আপনা বলিয়া, বোল না তেজবি,
মাগিয়া লইবি বর।।
সখি, যতেক মনের সাধ।
শয়নে স্বপনে, করিনু ভাবনে,
বিহি সে করল বাদ।।
সখি, হাম সে অবলা তায়।
বিরহ আগুণ, হৃদয়ে দ্বিগুণ,
সহন নাহিক যায়।।
সখি, বুঝিয়া কানুর মন।
যেমন করিলে, আইসে, কইবে,
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণ।।

——————-

হৃদয়ে দ্বিগুণ – পাঠান্তর—“দহনে দ্বিগুণ”। – প, ক, ত।
আইসে কইবে – বিভিন্ন পাঠ—“আইসে সে জন”। – ঐ।

মাথুর

মাথুর ।। ধানশী ।।

শ্যাম শুকপাখী, সুন্দর নিরখি,
রাই ধরিল নয়ান ফান্দে।
হৃদয় পিঞ্জরে, রাখিল সাদরে,
মনোহি শিকলে বান্ধি (১)।।
তারে প্রেম সুধা নিধি দিয়ে।
তারে পুষি পালি, ধরাইল বুলি,
ডাকিত রাধা বলিয়ে।।
এখন হয়ে অবিশ্বাসী, কাটিয়া আকুসি (২),
পলায়ে এসেছে পুরে (৩)।
সন্ধান করিতে, পাইনু শুনিতে,
কুবুজা (৪) রেখেছে ধরে।।
আপনার ধন, করিতে প্রার্থন,
রাই পাঠাইল মোরে।
চণ্ডীদাস দ্বিজ, তব তজবিজে (৫),
পেতে পারে কি না পারে।।

——————-

(১) তাহাকে হৃদয় পিঞ্জরে মন শিকলে বাঁধিয়া অতি আদর করিয়া রাখিল।
(২) শিকলের কড়া যাহা দ্বারা পাখীর পা আবদ্ধ রাখা হয়।
(৩) মথুরাপুরে।
(৪) সাধারণী রসের পাত্রী।
(৫) বিচারে।

মাথুর ।। শ্রীরাগ ।।

বিরহ কাতরা, বিনোদিনী রাই,
পরাণে বাঁচে না বাঁচে।
নিদান দেখিয়া, আসিয়া হেথায়,
কহিনু তোহারি কাছে।।
যদি দেখিবে তোমার প্যারী।
চল এইক্ষণে, রাধার শপথ,
আর না করিও দেরি।।
কালিন্দী পুলিনে, কমলের শেজে,
রাখিয়া রাইয়ের দেস।
কোন সখী অঙ্গে, লিখে শ্যাম নাম,
নিশ্বাস হেরয়ে কেহ।।
কেহ কহে তোর, বঁধুয়া আসিল,
সে কথা শুনিয়া কাণে।
মেলিয়া নয়ন, চৌদিশ নেহারে,
দেখিয়া না সহে প্রাণে।।
যখন হইনু, যমুনা পার,
দেখিনু সখীরা মেলি।
যমুনার জলে, রাখে অন্তর্জলে,
রাই দেহ হরি বলি।।
দেখিয়া যদ্যপি, সাধ থাকে তবে,
ঝাট চল ব্রজে যাই।
বলে চণ্ডীদাসে, বিলম্ব হইলে,
আর না দেখিবে রাই।।

——————-
নিদান – অবসান, অন্তিমকাল। তোহারি – তোমার। প্যারী – শ্রীরাধিকার অপর নাম। রাধার শপথ – রাধার দিব্য। কালিন্দী পুলিনে – কালিন্দী তীরে। কালিন্দী – যমুনা। চৌদিশ নেহারে – চৌদিকে তাকায়। ঝাট – শীঘ্র।

মাথুর ।। শ্রীরাগ ।।

ধিক্‌ ধিক্‌ ধিক্‌, তোরে রে কালিয়া,
কে তোরে কুবুদ্ধি দিল?
কেবা সেধে ছিল, পিরীতি করিতে,
মনে যদি এত ছিল।
ধিক্‌ ধিক্‌ বঁধু, লাজ নাহি বাস,
না জান লেহের লেশ।
এক দেশে এলি, অনল জ্বালায়ে,
জ্বালাইতে আর দেশ।।
অগাধ জলের, মকর যেমন,
না জানে মিঠ কি তীত।
সুরস পায়স, চিনি পরিহরি,
চিটাতে আদর এত?
চণ্ডীদাস ভণে, মনের বেদনে,
কহিতে পরাণ ফাটে।
তোমার সোণার প্রতিমা, ধূলায় গড়াগড়ি,
কুবুজা বসিল খাটে।।

——————-

লেহের – পিরীতের, স্নেহের।

মাথুর ।। শ্রীরাগ ।।

ধিক্‌ ধিক্‌ ধিক্‌, নিঠুর কালিয়া,
তোরে যে এ বুদ্ধি দিল।
কেবা সেধে ছিল পিরীতি করিতে,
মনে যদি এত ছিল।।
ধিক্‌ ধিক্‌ ধিক্‌, নিঠুর কালিয়া
লাজের নাহিক লেশ।
এক দেশে এলি অনল জ্বালায়ে,
জ্বালাইতে আর দেশ।।
জনম অবধি, কালিয়া বদন,
না ধুলি লাজের ঘাটে হে।
ব্রহ গোপীদে’ হ’তে, মথুরা নাগরী,
কত রূপে গুণে বটে হে।।
কিম্বা কুবুজা, নামে কুবুজিনী,
তেঞি সে লেগেছে মনে।
আপনি যেমন ত্রিভঙ্গ মুরারী,
বিহি মিলায়েছে জেনে।।
কিম্বা কুবুজা গুণে গুণবতী,
গুণেতে করেছে বশ।
পিরীতি সুখের, কি জানে যজিতে,
কিবা সে রেখেছে যশ।।
যতেক তোমারে, পিরীতি করুক,
তেমন পিরীতি হ’বে না।
রাধা নাথ বিনে, কুবুজার নাথ,
কেহ ত তোমারে ক’বে না।।
কি আর কহিব, মনের বেদনা,
কহিতে যে দুখ পাই।
চণ্ডীদাস কহে, কহিতে বেদনা,
পরাণ ফাটিয়া যায়।। *

——————-

* হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ।

মাথুর ।। সুহিনী ।।

হে কুবুজার বন্ধু। (১)
পাসরেছ রাই মুখইন্দু।। (২)
হে পাগধারী। (৩)
পাসরেছ নবীন কিশোরী।।
রাই পাঠা’ল মোরে।
দাসখত (৪) দেখাবার তরে।।
যাতে মোরা আছি সাখী (৫)।
পদতলে নাম দিলে লেখি।।
তুমি ব্রজে যা’বে যবে।
করতালি বাজাইব সবে।।
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে।
গালি দিব যত আছে মনে।।

——————-

(১) সখীরা শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীরাধিকার বন্ধু ভিন্ন জানিতেন না, মথুরাতে শ্রীকৃষ্ণ কুবুজাকে রাণী করিয়াছিলেন দেখিয়া সখীশ্লেষপূর্ব্বক “কুবুজার বন্ধু” বলিয়া সম্বোধন করিতেছেন।
(২) রাই মুখ চন্দ্রমা কি তোমার নেই—ভুলিয়া গিয়াছ?
(৩) মথুরাতে শ্রীকৃষ্ণ রাজবেশে রহিয়াছেন। সখীরা সে বেশ কখন দেখেন নাই, সেই জন্য ব্যঙ্গছলে সখী ‘পাগধারী” সম্বোধন করিতেছেন।
(৪) শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকার নিকট দাসখত লিখিয়া দিয়াছিলেন।
দাসখত বর্ণনা—
“ইয়াদি কিদ্দ, গুণ সমুদ্র, শত সাধু শ্রীরাধা।
সদুদারস্য, চরিত, তস্য, পুরাহ মনের সাধা।।
তস্য খাতক, হরি নায়ক, বসতি ব্রজপুরি।
কস্য করজ, পত্রমিদং লিখিলাম সুকুমারি।।
ইহার লভ্য, পাইবা ভব্য, বাঞ্ছা তিন করিয়া।
সুদ সমেত, শোধ করিব, সব কলিযুগ ভরিয়া।।
এই করারে, রাই তোমারে, খত দিলাম লিখি।
ললিতাদি, মঞ্জরি সখী, রহল ইহাতে সাক্ষী।।”
– গী, র, ব।
(৫) সাক্ষী।

মাধুর ।। বেলাবলী ।।

রাই’র দশা সখীর মুখে।
শুনিয়া নাগর মনের দুখে।।
নয়নের জলে বহয়ে নদী।
চাহিতে চাহিতে হরল সুধী।।
অব্‌ যতনে ধৈরজ ধরি।
বরজ গমন ইচ্ছিল হরি।।
আগে আগুয়ান করিয়া তার।
সখী পাঠাওল করিয়া সার।।
“এখনি আসিছি মথুরা হৈতে।
অথে আন ভাব না ভাব চিতে।।
অধিক উল্লাসে সখিনী ধায়।
বড়ু চণ্ডীদাস তাহাই গায়।।

————–

দশা – অবস্থা। সুধী – জ্ঞান; বুদ্ধি।
অব্‌ – পাঠান্তর–“অনেক”।-প, ক, ল।
আগুয়ান – অগ্রসর।

মাধুর ।। ধানশী ।।

সই জানি কু-দিন সু-দিন ভেল।
মাধব মন্দিরে, তুরিতে আওব,
কপাল কহিয়া গেল।। ধ্রু।
চিকুর ফুরিছে, বসন খসিছে,
পুলক যৌবন ভার।
বাম অঙ্গ আঁখি, সঘনে নাচিছে,
দুলিছে হিয়ার হার।।
প্রভাত সময়ে, কাক কোলাকুলি,
আহার বাঁটিয়া খায়।
পিয়া আসিবার, নাম সুধাইতে,
উড়িয়া বসিল তায়।।
মুখের তাম্বুল, খসিয়া পড়িছে,
দেবের মাথার ফুল।
চণ্ডীদাস কহে, সব সুলক্ষণ,
বিহি ভেল অনুকূল।।

————–

ভেল – হইল। তুরিতে – শীঘ্র। ফুরিছে – স্ফুরণ হইতেছে।
বাম অঙ্গ আঁখি, সঘনে নাচিছে – স্ত্রীলোকের বাম অঙ্গ ও বাম আঁখি নৃত্য করা শুভ লক্ষণ।
সুধাইতে – জিজ্ঞাসা করিতে।
বিহি ভেল অনুকূল – বিধি অনুকূল হইল।

ভাবসম্মিলন

ভাব সম্মিলন ।। বেলাবলী ।।

নন্দের নন্দন চতুর কান।
মিলিল আসিয়া হৃদয়ে জান।।
যাহার যেমত পিরীতি গাঢ়া।
তাহারে তেমতি করিলা বাঢ়া।।
মধুরা হৈতে এখনি হরি।
আইল বলিয়া শবদ করি।।
আপন ঘরে আপনি গেলা।
পিতা মাতা জনু পরাণ পাইলা।।
কোলেতে করিয়া নয়ান জলে।
সেচন করিয়া কাঁদিয়া বলে।।
আর দূর দেশে না যাবে তুমি।
বাহির আর না করিব আমি।।
এত বলি কত দেওল চুম্ব।
বারে বারে দেখে মুখারবিন্দ।।
ঐছন মিলল সকল সখা।
আর কত জন কে করু লেখা।।
খাওয়াইয়া পিয়াইয়া শোয়াল ঘরে।
ঘুমাক বলিয়া যতন করে।।
তখন বুঝিয়া সময় পুন।
আওল যমুনা তীরক বন।।
রাইয়ের নিকটে পাঠাইলা দূতী।
বড়ু চণ্ডীদাস কহয়ে সতি।।

————–

ভাব সম্মিলন – বিচ্ছেদান্তে মিলন।
কান – কানাই। গাঢ়া – গাঢ়। জনু – যেন।
বাহির আর না করিব আমি- পাঠান্তর–“মরিব তবে এবারে আমি”।-পদামৃত সমুদ্র।
চুম্ব – চুম্বন।
আর কত জন কে করু লেখা – আর কত জন কে তাহার সংখ্যা করে।
সতি – সত্য।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

কিয়ে শুভ দরশনে, উলসিত লোচনে,
দুহুঁ দোহুঁ হেরি মুখ ছাঁদে।
তৃষিত চাতক, নব জলধরে মিলল,
ভুখিল চকোর চান্দে।।
আধ নয়ানে, দুহুঁ রূপ নিহারই,
চাহনি আনহি ভাঁতি।
রসের আবেশে, দুহুঁ অঙ্গ হেলাহেলি,
বিছুরল প্রেম সাঙ্গাতি।।
শ্যাম সুখময় দেহ, গোরী পরশে সেহ,
মিলায়ল যেন কাঁচা ননী।
রাই তনু ধরিতে নারে, আলাইল আনন্দ ভরে,
শিরিশ কুসুম কমলিনী।।
অতসি কুসুম সম, সম শ্যাম সুনায়র,
নায়রী চম্পক গোর।
নব জলধরে জনু, চাঁদ আগোরল,
ঐছে রহল শ্যাম কোর।।
বিগলিত কেশ কুন্তল, শিখি চন্দ্রক,
বিগলিত নিতল নিচোল।
দুহুঁক প্রেম রসে, ভাসল নিধুবন
উছলল প্রেম হিলোল।।
চণ্ডীদাস কহে, দুহুঁ রূপ নিরখিতে,
বিছুরল ইহ পরকাল।
শ্যাম সুঘড় বর সুন্দর রস রাজ,
সুন্দরী মিলই রসাল।।*

————–

* হস্তলিখিত পুস্তক।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

শতেক বরষ পরে, বঁধুয়া মিলল ঘরে,
রাধিকার অন্তরে উল্লাস।
হারানিধি পাইনু বলি, লইয়া হৃদয়ে তুলি,
রাখিতে না সহে অবকাশ।।
মিলল দুহুঁ তনু কিবা অপরূপ!
চকোর পাইল চাঁদ, পাতিয়া পিরীতি ফাঁদ,
কমলিনী পাওল মধুপ।।
রস ভরে দুহুঁ তনু, থর থর কাঁপই,
ঝাঁপই দুহুঁ দোঁহা আবেশে ভোর।
দুহুঁক মিলনে আজি, নিভাওল আনল,
পাওল বিরহক ওর।।
রতন পালঙ্ক পর, বৈঠল দুহুঁ জন,
দুহুঁ মুখ হেরই দুহুঁ আনন্দে।
হরষ সলিল ভরে, হেরই না পারই,
অনিমিষে রহল ধন্দে।।
আজি মলয়ানীল, মৃদু মৃদু বহত,
নিরমল চাঁদ প্রকাশ।
ভাব ভরে গদগদ, চামর ঢূলায়ত,
পাশে রহি চণ্ডীদাস।।

————–

পাওল বিরহক ওর – বিরহ দূরে গেল।
বৈঠল – বসিল।
নিরমল চাঁদ প্রকাশ – এত দিন শ্রীকৃষ্ণের মথুরা গমন হেতু মলয়ানীল বহে নাই এবং নির্ম্মল চন্দ্র উদয় হয় নাই, আজ তাঁহার আগমনে যেন মলয়ানীল মৃদু মৃদু বহিতেছে এবং নির্ম্মল চন্দ্র উদয় হইয়াছে।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

ভালোল্লাসে ধনী, বঁধুরে পাইয়া,
ভাবে গদ গদ কয়।
ব্রজ পিরীতের, প্রদীপ জ্বালিয়ে,
দীপ কি নিভা’তে হয়।।
কালিয়া কুটিল স্বভাব তোমার,
কপট পিরীতি যত।
ভূরু নাচাইয়ে, মুচকি হাসিয়ে,
অবলা ভুলাইলে কত।।
পিরীতি রসের রসিক বোলাও,
পিরীতি বুঝিতে নার।
মথুরা নগরের, যত নাগরীর,
পিরীতের ধার ধার।।
শুন গিরি ধারী, মথুরা বিহারী,
নারী বধে নাহি ভয়।
পিরীতি করিয়ে, তোমারে ভজিলে,
শেষে কি এই দশা হয়।।
পিরীতি করিলে, কেন দগধিলে,
বিরহ বেদনা দিয়ে।
কালীয়া কঠিন, দয়া হীন জন,
তোর নিদারুণ হিয়ে।।
সোই রসিকতা, পিরীতি মমতা,
সমতা হইলে রাখে।
পিরীতি রতন, রসের গঠন,
কুটিলাতে নাহি থাকে।।
পিরীতির দায়, প্রাণ ছাড়া যায়,
পিরীতি ছাড়িতে নারে।
পিরীতি রসের পসরা তা নাকি,
রাখালে বহিতে পারে।।
যে জনা রসিক, রসে ঢর ঢর,
মরমি যে জন হয়।
হেরে রেরে করে, ধবলী চড়ায়,
সে জনা রসিক নয়।।
রসিকের রীতি, সহজ সরল
রাখালে তাই কি জানে।
চণ্ডীদাস কহে, রাধার গঞ্জনা (১),
সুধা সম কানু মানে।।*

————–

(১) পাঠান্তর–“রাধার ভর্তসনা।”
* হস্তলিখিত পুস্তক।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

শুন শুন হে রসিক রায়।
তোমারে ছাড়িয়া, যে সুখে আছিনু,
নিবেদি যে তুয়া পায়।।(১)
না জানি কি ক্ষণে, কুমতি হইল,
গৌরবে ভরিয়া গেনু।
তোমা হেন বঁধু হেলায় হারায়ে,
ঝুরিয়া ঝুরিয়া মনু।।
জনম অবধি, মায়ের সোহাগে,
সোহাগিনী বড় আমি।
প্রিয় সখীগণ, দেখে প্রাণসম,
পরাণ বঁধুয়া তুমি।।
সখীগণে কহে, শ্যাম সোহাগিনী,
গরবে ভরয়ে দে।
হামারি গৌরব, তুহুঁ বাঢ়ায়লি,
অব্‌টুটায়ব কে!
তোহারি, গরবিনী হাম,
গরবে ভরল বুক।
চণ্ডীদাস কহে, এমতি নহিলে,
পিরীতি কিসের সুখ?(১)

————–

নিবেদি – নিবেদন। দে – দেহ। গৌরব – সম্মান।
হামারি গৌরব, তুহুঁ বাঢ়ায়লি, অব্‌টুটায়ব কে – আমার সম্মান তুমিই বাড়াইয়াছ, কে এখন তাহা লাঘব করিতে সক্ষম?
তোহারি – পাঠান্তর–“তোহারি গরবে”।-প, ক, ল।
(১) পাঠান্তর–“তোমা উপেখিয়া, যে সুখে গোঞাইনু”–পদার্ণব সারাবলী।
(২) পাঠান্তর–“চণ্ডীদাস কহে, মরিয়াছিলাম, না দেখি তোমার মুখ।।”-প, ক, ল।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

বঁধু কি আর বলিব আমি।
জনমে জনমে, জীবনে মরণে,
প্রাণ বন্ধু হইও তুমি।।
অনেক পূণ্যফলে, গৌরী আরাধিয়ে,
পেয়েছি কামনা করি।।
না জানি কি ক্ষণে, দেখা তব সনে,
তেঞি সে পরাণে মরি।।
বড় শুভ ক্ষণে, তোমা হেন ধনে,
বিধি মিলাওল আনি।
পরাণ হইতে, শত শত গুণে,
অধিক করিয়া মানি।।
গুরু গরবেতে, তাহা বলে কত,
সে সব গরল বাসি।
তোমার কারণে, গোকুল নগরে,
দুকুল হইল হাসি।।
চণ্ডীদাস বলে, শুনহ নাগর,
রাধার মিনতি রাখ।
পিরিতি রসের, চূড়ামণি হয়ে,
সদাই অন্তরে থাক।।

—————

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

শুনহে চিকণ কালা!
বলিব কি আর, চরণে তোমার,
অবলার যত জ্বালা।।
চরণ থাকিতে, না পারি চলিতে,
সদাই পরের বশ।
যদি কোন ছলে, তব কাছে এলে,
লোকে করে অপযশ।।
বদন থাকিতে, না পারি বলিতে,
তেঞি সে অবলা নাম।
নয়ন থাকিতে, সদা দরশন,
না পেলেন নবীন শ্যাম।।
অবলার যত দুঃখ, প্রাণনাথ!
সব থাকে, মনে মনে।
চণ্ডীদাস কয়, রসিক সে হয়,
সেই সে বেদনা জানে।।

————————–

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

বঁধু কি আর বলিব আমি!
যে মোর ভরম, ধরম করম,
সকলি জানহে তুমি।।
যে তোর করুণা, না জানি আপনা,
আনন্দে ভাসি যে নিতি।
তোমার আদরে, সবে স্নেহ করে,
বুঝিতে না পারি রীতি।।
মায়ের যেমন, বাপার তেমন,
তেমতি বরজপুরে।
সখীর আদরে, পরাণ বিদরে,
সে সব গোচর তোরে।।
সতী বা অসতী, তোহে মোর মতি,
তোহারি আনন্দে ভাসি।
তোমারি বচন, সালঙ্কার মোর,
ভূষণে ভূষণ বাসি (১)।।
চণ্ডীদাস বলে, শুনহ সকলে,
বিনয় বচন সার।
বিনয় করিয়া, বচন কহিলে,
তুলনা নাহিক তার।।

————–

(১) শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয়ের প্রতিপাদিত অর্থ এইরূপ–তোমার সালঙ্কার বচনই আমার অঙ্গরাগ জন্য ভূষণ স্বরূপ; আমি অন্য অলঙ্কার চাহি না।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

শুন সুনাগর, করি জোড় কর,
এক নিবেদিয়ে বাণী।
এই কর মেনে, ভাঙ্গে নাহি জেনে,
নবীন পিরীতি খানি।।
কুল শীল জাতি, ছাড়ি নিজ পতি,
কালি দিয়ে দুই কুলে।
এ নব যৌবন, পরশ রতন,
সঁপেছি চরণ তলে।।
তিনহি আখর, করিয়ে আদর,
শিরেতে লয়েছি আমি।
অবলার আশ, না কর নৈরাশ,
সদাই পুরিবে তুমি।।
তুমি যশরাজ, রসের সমাজ,
কি আর বলিব আমি।
চণ্ডীদাস কহে, জনমে জনমে,
বিমুখ না হোয় তুমি।।

————–

পুরিবে পাঠান্তর–“পুরাইবে”।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

নিবেদন শুন শুন বিনোদ নাগর।
তোমারে ভজিয়া মোর কলঙ্ক অপার।।
পর্ব্বত সমান কুল শীল তেয়াগিয়া।
ঘরের বাহির হইলাম তোমার লাগিয়া।।
নব রে নব রে নব নব ঘনশ্যাম।
তোমার পিরীতি খানি অতি অনুপাম।।
কি দিব কি দিব বঁধু মনে করি আমি।
যে ধন তোমারে দিব সেই ধন তুমি।।
তুমি আমার প্রাণবঁধু আমি হে তোমার।
তোমার ধন তোমারে দিতে ক্ষতি কি আমার।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে শুন শ্যাম ধন।
কৃপা করি এ দাসীরে দেহ শ্রীচরণ।।*

————–

* পদার্ণব সারাবলী।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

বঁধু তুমি সে পরশ মণি হে
বঁধু তুমি সে পরশ মণি।
ও অঙ্গ পরশে, এ অঙ্গ আমার,
সোণার বরণ খানি।।
তুমি রস শিরোমণি হে
বঁধু তুমি রস শিরোমণি।
মোরা অবলা অখলা, আহিরিণী বালা,
তো’ সেবা নাহি জানি।।
তোঁহার লাগিয়া, ধাই বনে বনে,
আমি সুবল বেশ ধরি হে।
এক তিলে শত যুগ, দরশনে মানি,
ছেড়ে কি রইতে পারি হে।।
অঙ্গের বরণ, কস্তূরী চন্দন,
আমি হৃদয়ে মাখিয়ে রাখি।
ও দুটি চরণ, পরাণে ধরিয়া,
নয়ান মুদিয়া থাকি।।
চণ্ডীদাস কহে, শুন রসবতি,
তুহুঁ সে পিরীতি জান হে।
বঁধু সে তোমার, এক কলেরব,
দুহুঁ সে এক প্রাণ হে।।*

————–

* হস্তলিখিত পুস্তক।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।

বঁধু তুমি সে আমার প্রাণ!
দেহ মন আদি, তোহারে সঁপেছি,
কুল শীল জাতি মান।।
অলিলের নাথ, তুমি হে কালিয়া,
যোগীর আরাধ্য ধন।
গোপ গোয়ালিনী, হাম অতি হীনা,
না জানি ভজন পূজন।।
পিরীতি রসেতে, ঢালি মোর গতি,
মন নাহি আন ভায়।।
কলঙ্কী বলিয়া, ডাকে সব লোকে,
তাহাতে নাহিক দুখ।
তোমার লাগিয়া, কলঙ্কের হার
গলায় পরিতে সুখ।।
সতী বা অসতী, তোমাতে বিদিত,
ভাল মন্দ নাহি জানি।
কহে চণ্ডীদাস, পাপ পূন্য সম,
তোহারি চরণখানি।।

———————

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উত্তর)

রাই! তুমি সে আমার গতি।
তোমার কারণে, রসতত্ত্ব লাগি,
গোকূলে আমার স্থিতি।।
নিশি দিশি সদা, বসি আলাপনে,
মুরলী লইয়া করে।
যমুনা সিনানে, তোমার কারণে,
বসি থাকি তার তীরে।।
তোমার রূপের, মাধুরী দেখিতে,
কদম্বতলাতে থাকি।
শুনহ কিশোরি, চারি দিক হেরি,
যেমত চাতক পাখী।।
তবরূপ গুণ, মধুর মাধুরী,
সদাই ভাবনা মোর।
করি অনুমান, সদা করি গান,
তবে প্রেমে হৈয়া ভোর।।
চণ্ডীদাস কয়, ঐছন পিরীতি,
জগতে আর কি হয়?
এমত পিরীতি, না দেখি কখন,
কখন হবার নয়।।

———————–

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীরাধিকার উক্তি)

অনেক সাধের, পরাণ বঁধুয়া,
নয়ানে লুকায়ে থোব।
প্রেম চিন্তামণির, শোভা গাঁথিয়া,
হিয়ার মাঝারে লব।।
তুমি হেন ধন, দিয়াছি যৌবন,
কিনেছি বিশাখা জানে।
কিবা ধনে আর, আধিকার কার,
এ বড় গৌরব মনে।।
বাড়িতে বাড়িতে, ফল না বাড়িতে,
গগণে চড়ালে মোরে।
গগণে হইতে, ভূমে না ফেলাও,
এই নিবেদন তোরে।।
এই নিবেদন, গলায় বসন,
দিয়া কহি শ্যাম পায়।
চণ্ডীদাস কয়, জীবনে মরণে,
না ঠেলিবে রাঙ্গা পায়।।

——————

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীরাধিকার উক্তি)

বঁধু হে নয়নে লুকায়ে থোব।
প্রেম চিন্তামণি, রসেতে গাঁথিয়া,
হৃদয়ে তুলিয়া লব।
শিশু কাল হৈতে, আন নাহি চিতে,
ও পদ করেছি সার।
ধন জন মন, জীবন যৌবন,
তুমি সে গলার হার।।
শয়নে স্বপনে, নিদ্রা জাগরণে,
কভু না পাসরি তোমা।
অবলার ত্রুটি, হয় শত কোটি,
সকলি করিবে ক্ষমা।।
না ঠেলিও বলে, অবলা অখলে,
যে হয় উচিত তোর।
ভাবিয়া দেখিলাম, তোমা বঁধু বিনে,
আর কেহ নাহি মোর।।
তুলে আঁখি আড়, করিতে না পারি,
তবে যে মরি আমি।
চণ্ডীদাস ভণে, অনুগত জনে,
দয়া না ছাড়িও তুমি।।

——————–

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)

আর এক বাণী, শুন বিনোদিনি,
দয়া না ছাড়িও মোরে।
ভজন সাধন, কিছুই না জানি,
সদাই ভাবিহে তোরে।।
ভজন সাধন, করে যেই জন,
তাহারে সদয় বিধি।
আমার ভজন, তোমার চরণ,
তুমি রসময়ী নিধি।।
ধাওত পিরীতি, মদন বেয়াধি,
তনু মন হলো ভোর।
সকল ছাড়িয়া, তোমারে ভজিয়া,
এই দশা হৈল মোর।।
নব সন্নিপাতি, দারুণ বেয়াধি,
পরাণে মরিলাম আমি।
রসের সায়রে, ডুবায়ে আমারে,
অমর করহ তুমি।।
যেবা কিছু আমি, সব জান তুমি,
তোমার আদেশ সার।
তোমারে ভজিয়া, নায়ে কড়ি দিয়া,
ডুবে কি হইব পার।।
বিপদ পাথার, না জানি সাঁতার,
সম্পত্তি নাহিক মোর।
বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে,
যে হয় উচিত তোর।।

—————-

ভাব সম্মিলন ।। ভূপালী ।। (শ্রী্রাধিকার উক্তি)

বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে।
দেখা না হইত পরাণ গেলে।।
এতেক সহিল অবলা বলে।
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হলে।।
দুখিনীর দিন দুঃখেতে গেল।
মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল?
এ সব দুঃখ গেল হে দূরে।
হারাণ রতন পাইলাম কোরে।।
এখন কোকিল আসিয়া করুক গান।
ভ্রমরা ধরুক তাহার তান।।
মলয় পবন বহুক মন্দ।
গগণে উদয় হউক চন্দ।।
বাশুলী আদেশে কহে চণ্ডীদাসে।
দুঃখ দূরে গ্লে সুখ বিলাসে।।

—————

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)

জপিতে তোমার নাম, বংশীধারি অনুপম,
তোমার বরনের পরি বাস।
তুয়া প্রেম সাধি গোরি, অইনু গোকুলপুরী,
বরজ মণ্ডলে পরকাশ।।
ধনি তোমার মহিমা জানে কে!
অবিরাম যুগ শত, গুণ গাই অবিরত,
গাহিয়া করিতে নারি শেষ।।
গঞ্জন বচন তোর, শুনি সুখে নাহি ওর,
সুধাময় লাগয়ে মরমে।
তরল কমল আঁখি, তেরছ নয়নে দেখি,
বিকাইনু জনমে জনমে।।
তোমা বিনু যেবা যত, পিরীতি করিনু কত,
সে পিরীতে না পুরিল আশ।
তোমার পিরীতি বিনু, স্বতন্ত্র না হইল তনু,
অনুভবে কহে চণ্ডীদাস।।

————–

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীরাধিকার উক্তি)

শ্যাম সুন্দর, স্মরণ আমার,
শ্যাম শ্যাম সদা সার।
শ্যাম সে জীবন, শ্যাম প্রাণধন,
শ্যাম সে গলার হার।।
শ্যাম সে বেশর, শ্যাম বেশ মোর,
শ্যাম শাড়ী পরি সদা।
শ্যাম তনু মন, ভজন পূজন,
শ্যাম দাসী হলো রাধা।।
শ্যাম ধন বল, শ্যাম জাতি কুল,
শ্যাম সে সুখের নিধি।
শ্যাম হেন ধন, অমূল্য রতন,
ভাগ্যে মিলাইল বিধি।।
কোকিল ভ্রমর, করে পঞ্চস্বর,
বঁধুয়া পেয়েছি কোলে।
হিয়ার মাঝারে, রাখিছ শ্যামেরে,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে বলে।।

————–

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)

উঠিতে কিশোরী, বসিতে কিশোরী,
কিশোরী হইল সারা।
কিশোরী ভজন, কিশোরী পূজন,
কিশোরী নয়ানতারা।।
গৃহ মাঝে রাধা, কাননেতে রাধা,
রাধাময় সব দেখি।
শয়নেতে রাধা, গমনেতে রাধা,
রাধাময় হলো আঁখি।।
স্নেহেতে রাধিকা, প্রেমেতে রাধিকা,
রাধিকা আরতি পাশে।
রাধারে ভজিয়া, রাধাবল্লভ নাম,
পেয়েছি অনেক আশে।।
শ্যামের বচন, মাধুরি শুনিয়া,
প্রেমানন্দে ভাসে রাধা।
চণ্ডীদাস কহে, দোঁহার পিরীতি,
পরাণে পরাণ বাঁধা।।

————–

সারা – সার।

ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)

উঠিতে কিশোরী, বসিতে কিশোরী,
কিশোরী গলার হার।
কিশোরী ভজন, কিশোরী পূজন,
কিশোরী চরণ সার।।
শয়নে স্বপনে, গমনে কিশোরী,
ভোজনে কিশোরী আগে।
করে করে বাঁশী, ফিরে দিবানিশি,
কিশোরীর অনুরাগে।।
কিশোরী চরণে, পরাণ সঁপেছি,
ভাবেতে হৃদয় ভরা।
দেখহে কিশোরী, অনুগত জনে,
করোনা চরণ ছাড়া।।
কিশোরী দাস, আমি পীতবাস,
ইহাতে সন্দেহ যার।
কোটি যুগ যদি, আমারে ভজয়ে,
বিফল ভজন তার।।
কহিতে কহিতে, রসিক নাগর,
তিতল নয়ন জলে।
চণ্ডীদাস কহে, নবীন কিশোরী,
বঁধুরে করিল কোলে।।*

————–

* হস্তলিখিত পুস্তক।

ভাব সম্মিলন ।। কন্যাণী

উঠিতে কিশোরী, বসিতে কিশোরী,
কিশোরী নয়ান তারা।
কিশোরী ভজন, কিশোরী পূজন,
কিশোরী গলার হারা।।
রাধে! ভিন না ভাবিহ তুমি।
সব তেয়াগিয়া, ও রাঙ্গা চরণে,
শরণ লইনু আমি।।
শয়নে স্বপনে, ঘুমে জাগরণে,
কভু না পাসরি তোমা।
তুয়া পদাশ্রিত, করিয়ে মিনতি,
সকলি করিবা ক্ষমা।।
গলায় বসন, আর নিবেদন,
বলি যে তুঁহারি ঠাঁই।
চণ্ডীদাসে ভণে, ও রাঙ্গা চরণে,
দয়া না ছাড়িও রাই।।

রাগাত্মিক পদ

রাগাত্মিক পদ ।।

নিত্যের আদেশে, বাশুলী চলিল,
সহজ জানাবার তরে।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে, নান্নুর গ্রামেতে,
প্রবেশ যাইয়া করে।।
বাশুলী আসিয়া, চাপড় মারিয়া,
চণ্ডীদাসে কিছু কয়।(১)
সহজ ভজন, করহ যাজন,
ইহা ছাড়া কিছু নয়।।
ছাড়ি জপতপ, করহ আরোপ,
একতা করিয়া মনে।(২)
যাহা কহি আমি, তাহা শুন তুমি,
শুনহ চৌষট্টি সনে।।(৩)
বসুতে গ্রহেতে, করিয়া একত্রে,
ভজহ তাহারে নিতি।(৪)
বাণের সহিতে,(৫) সদাই যুজিতে,
সহজের এই রীতি।।
দক্ষিণ দেশেতে, না যাবে কদাচিতে,
যাইলে প্রমাদ হবে।
এই কথা মনে, ভাব রাত্রি দিনে,
আনন্দে থাকিবে তবে।।
রতি পরকীয়া, যাহারে কহিয়া,
সি সে আরোপ সার।(৬)
ভজন তোমারি,(৭) রজক ঝিয়ারি,
রামিনী নাম যাহার।।
বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে,
শুনহ দ্বিজের সুত।
একথা ল’বে না, না জানে যে জনা,
সেই সে কলির ভূত।।

————–

রসিক ভক্তগণের সাধন প্রণালীর নাম “রাগাত্মক।”
রসিক ভক্তরা “রাগানুগ” ভক্ত।

(১) জীবনী দ্রষ্টব্য।
(২) বৈধি ধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া প্রকৃতি ভাবে কৃষ্ণ ভজনা কর।
অনুরাগ–কল্পনা বা এক বস্তুতে অন্য বস্তুর স্থাপন।
যথা–রজ্জুতে সর্পারোপ। ভজন মার্গে গোপী অনুগতি বা আপনাকে গোপীজনের দাসী মনে করাই আরোপ। শ্রীকৃষ্ণকে যাঁহারা পতিরূপে ভজন করেন তাঁহাদের এরূপ আরোপ ব্যতীত উপায় নাই। ঠাকুর মহাশয় স্বীয় প্রার্থনা এবং প্রেমভক্তি চন্দ্রিকায় এই আরোপের কথা বহুস্থানে বলিয়াছেন।
(৩) চৌষট্টি রস সহিত। বিধ্যুদিত নিরসভাবে নহে, রসিক শেখরকে সরস উপাশনাই কর্ত্তব্য। তন্ত্রে ৬৪ কলার সহ ভজন বিধি কথিত আছে। কলা শব্দে–কামকলা, শিল্পকলা ইত্যাদি।
(৪) বসু ৮, গ্রহ ৯, একত্রে ১৭। খুব সতরের ঘরে অর্থাৎ বিশেষ সতর্কতার সহিত তাঁহাকে প্রত্যহ ভজন কর।
নিতি–নিত্য, প্রত্যহ।
ভাষা কথায় আছে–‘সতরর ঘরে বিনাশ নাই”।
(৫) বান, পাঁচ। মদন, মাদন, স্তম্ভন, শোষণ ও মোহন। অর্থাৎ মধুর রসে উপাসনা।
(৬) ব্রজভাবানুসারে যে ভজন তাহাই সার অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ ব্রজ গোপীর ন্যায় পরকীয়া ভাবের যে ভজন তাহাই শ্রেষ্ঠ।
(৭) চণ্ডীদাস রামিনীকে মধুর ভজনে সাহায্যকারিণী গুরুরূপিণী বলিয়া “ভজন তোমার” বলিতেছেন। বিল্বমঙ্গল ঠাকুরও এইরূপ চিন্তামণিকে গুরুরূপে বন্দনা করিয়াছেন।

—————

রাগাত্মিক পদ ।।

শুন রজকিনি রামি।
ও দুটি চরণ, শীতল বলিয়া,
শরণ লইনু আমি।।
তুমি বেদ রাগিনী, হরের ঘরণী,
তুমি সে নয়নের তারা।
তোমার ভজনে, ত্রিসন্ধা যাজনে,
তুমি সে গলার হারা।।
রজকিনী রূপ, কিশোরী স্বরূপ,
কাম গন্ধ নাহি তায়।
রজকিনী প্রেম, নিকষিত হেম,
বড়ু চণ্ডীদাসে গায়।।

————-

রাগাত্মিক পদ ।।

এক নিবেদন, করি পুনঃপুন,
শুন রজকিনি রামি।
যুগল চরণ, শীতল দেখিয়া,
শরণ লইলাম আমি।।
রজকিনী রূপ, কিশোরী স্বরূপ,
কাম গন্ধ নাহি তায়।
না দেখিলে মন, করে উচাটন,
দেখিলে পরাণ জুড়ায়।।
তুমি রজকিনী, আমার রমণী,
তুমি হও মাতৃ পিতৃ।
ত্রিসন্ধ্যা যাজন, তোমারি ভজন,
তুমি বেদমাতা গায়ত্রী।।
তুমি বাগবাদিনী, হরের ঘরণী,
তুমি সে গলার হারা।
তুমি স্বর্গ মর্ত্ত, পাতাল পর্ব্বত,
তুমি সে নয়ানের তারা।।
তোমা বিনা মোর, সকল আঁধার,
দেখিলে জুড়ায় আঁখি।
যে দিনে না দেখি, ও চাঁদ বদন,
মরমে মরিয়া থাকি।।(১)
ওরূপ মাধুরী, পাসরিতে নারি,
কি দিয়ে করিব বশ।
তুমি সে তন্ত্র, তুমি সে মন্ত্র,
তুমি উপাসনা রস।।
ভেবে দেখ মনে, এ তিন ভুবনে,
কে আছে আমার আর।
বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে,
ধোপানি চরণ সার।।

————–

(১) অপর একখানি হস্তলিখিত গ্রন্থ হইতে সংগৃহীত।

রাগাত্মিক পদ ।।

পুন আর বার, আসি তরাতর,
রামিনী জগতমাতা।
ধরিয়া রামিনী, কহিছেন বাণী,
শুনহ আমার কথা।।
যাহা কহি বাণী, শুনহ রামিনি,
এ কথা ভুবন পার।
পরকিয়া রতি, করহ আরতি,
সেই সে ভজন সার।।
চণ্ডীদাস নামে, আছে এক জন,
তাহারে আরোপ কর।
অবশ্য করিলে, নিত্যধাম পাবে,
আমার বচন ধর।।
নেত্রে বেদ দিয়া,(১) সদাই ভজিবা,
আনন্দে থাকিবা তবে।
সমুদ্র(২) ছাড়িয়া, নরকে যাইবা,
ভজন নাহিক হবে।।
আর তিন দিয়, বেদে মিশাইয়া,(৩)
সতত তাহাই যজ।
নিত্য এক মনে, ভাব রাত্রি দিনে,
মম পদ সদাভজ।।
ব্যভিচারী হইলে, প্রাপ্তি নাহি মিলে,
নরকে যাইবে তবে।
রতি স্থির মনে, ভাব রাত্রি দিনে,
সহজ পাইবে তবে।।
আর এক বানী, শুনহ রামিনি,
এ কথা রাখিও মনে।
বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে,
এ কথা পাছে কেহ শুনে।।

————–

(১) “নেত্রে বেদ দিয়া” ইত্যাদি–রাধাকৃষ্ণ প্রীতি দিয়া সদাই ভজন করিলে আনন্দে থাকিবে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১০ম অধ্যায়ে ভগবানের এই প্রকার উক্তি আছে, যথা–“তেষাং সতত যুক্তানাং ভজতাং প্রীতি পূর্ব্বকম্‌। দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপয়ান্তি তে।।”
“নেত্র”–তিন, — পিরীতি।
“বেদ”–চারি, — রাধাকৃষ্ণ।
(২) “সমুদ্র ছাড়িয়া নরকে যাইবে” ইত্যাদি–ঐ রাধাকৃষ্ণ প্রীতি যদি ত্যাগ কর, নরকে যাইতে হইবে।
“সমুদ্র”–সাত, — রাধাকৃষ্ণ পিরীতি।
(৩) “আর তিন দিয়া বেদে মিশাইয়া” ইত্যাদি–অর্থাত শ্রীকৃষ্ণকে সদাই ভজনা কর।
“তিন”–রমণ, — শ্রীকৃষ্ণ।
“বেদ”–চারি, বৃন্দাবন — শ্রীকৃষ্ণ।

———–
রাগাত্মিক পদ ।।

কহিছে রজকিনী রামী, শুন চণ্ডীদাস তুমি,
নিশ্চয় মরম কহি জানে।
বাশুলী কহিছে যাহা, সত্য করি মান তাহা,
বস্তু আছে দেহ বর্ত্তমানে।।
আমি ত আশ্রয় হই, বিষয় তোমারে কই,
তমণ কালেতে গুরু তুমি।
আমার স্বভাব মন, তোমার রতি ধ্যান,
তেঞি সে তোমায় গুরু করি মানি।।
সহজ মানুষ হব, রসিক নগরে যাব,
থাকিব প্রণয় রস ঘরে।
শ্রীরাধিকা হবে রাজা, হইব তাহার প্রজা,
ডুবিব রসের সরোবরে।।
সেই সরোবরে গিয়া, মন পদ্ম প্রকাশিয়া,
হংস প্রায় হইয়া রহিব।
শ্রীরাধা মাধব সঙ্গে, আনন্দ কৌতুক রঙ্গে,
জনমে মরণে তুয়া পাব।।
শুন চণ্ডীদাস প্রভু, ভজন না হয় কভু,
মনের বিকার ধর্ম্ম জানে।
সাধন শৃঙ্গার রস, ইহাত হইবে বশ,
বস্তু আছে দেহ বর্ত্তমানে।।

—————-

রাগাত্মিক পদ ।।

চণ্ডীদাসে কহে তুমি সে গুরু।
তুমি সে আমার কল্পতরু।।
যে প্রেম রতন কহিলে মোরে।
কি ধন রতনে তুষিব তোরে।।
ধন জন দারা সোঁপিনু তোরে।
দয়া না ছাড়িও কখন মোরে।।
ধরম করম কিছু না জানি।
কেবল তোমার চরণ মানি।।
এক নিবেদন তোমারে কব।
মরিয়া দোঁহেতে কি রূপ হব।।
বাশুলী কহিছে কহিব কি।
মরিয়া হইবে রজক ঝি।।
পুরুষ ছাড়িয়া প্রকৃতি হবে।
এ দেহ হয়ে নিত্যতে যাবে।।
চণ্ডীদাস প্রেমে মূর্চ্ছিত হইলা।
বাশুলী চলিয়া নিত্যতে গেলা।।

———–

রাগাত্মিক পদ ।।

চণ্ডীদাসে কহে শুনহ মাতা।
কহিলে আমারে সাধন কথা।।
সাতাশী উপরে তিনের স্থিতি।
সে তিন রহয়ে কাহার গতি।।
এ তিন দুয়ারে কি বীজ হয়।
কি বীজ সাধিয়া সাধক কয়।।
রতির আকৃতি বলিয়ে যারে।
রসের প্রকার কহিব মোরে।।
কি বীজ সাধিলে সাধিব রতি।
কি বীজ ভজিলে রসের গতি।।
সামান্য রতিতে বিশেষ সাধে।
সামান্য সাধিতে বিশেষ বাধে।।
সামান্য বিশেষ একতা রতি।
এ কথা শূনিয়া সন্দেহ মতি।।
সামান্য রতিতে কি বীজ হয়।
বিশেষ রতিতে কি বীজ কয়।।
সামান্য রসকে কি রস যজে।
কি বীজ প্রকারে বিশেষ মজে।।
তিনটি দুয়ারে থাকয়ে যে।
সেই তিন জন নিত্যের কে।।
চণ্ডীদাস কহে কহবে মোরে।
বাশুলী কহিছে কহিব তোরে।।

—————-

এ দেহে সে দেহে একই রূপ।
তবে সে জানিবে রসেরই কূপ।।
এ বীজ সে বীজে একতা হবে।
তবে সে প্রেমের সন্ধান পাবে।।
সে বীজ যজিয়ে এ বীজ ভজে।
সেই সে প্রেমের সাগরে মজে।।
রতিতে রসেতে একতা করি।
সাধিবে সাধক বিচার করি।।
বিশুদ্ধ রতিতে বিশুদ্ধ রস।
তাহাতে কিশোরা কিশোরী বশ।।
বিশুদ্ধ রতিতে করণ কি।
সাধহ সতত রজক ঝি।।
সাতাশী উপরে তাহার ঘর।
তিনটি দুয়ার তাহার পর।।
বীজে মিশাইয়া রামিনী যজ।
রসিক মণ্ডলে সতত ভজ।।
বিশুদ্ধ রতিতে বিকার পাবে।
সাধিতে নারিলে নরকে যাবে।।
বাশুলী কহয়ে এই সে হয়।
চণ্ডীদাস কহে অন্যথা নয়।।

————–

“সাতাশী”–
পঞ্চবাণ, অর্থাৎ মদন, মাদন, শোষণ, উন্মাদন ও স্তম্ভন।
পঞ্চপ্রাণ, অর্থাৎ প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যাণ।
পঞ্চভূত, অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম।
পঞ্চভাব, অর্থাৎ সান্ত, দাস্য, সৌখ্য, বাৎসল্য, মাধুর্য্য।
পঞ্চগুণ, অর্থাৎ শব্দ, গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ।
দশ ইন্দ্রিয়।
দশ দিক।
দশ দশা। যথা–“চিন্তাত্র জাগরূদ্বেগৌ তানবং মলিনাঙ্গতা। প্রমাদো ব্যাধিরুম্মাদৌ মোহ মৃত্যু দশাদশঃ।।
নবধাঙ্গ ভক্তি ও আত্মভাব, এই দশ। যথা–শ্রবণ, কীর্ত্তন, স্মরণ, অর্চ্চন, বন্দন, পদসেবন, দাস্য, সৌখ্য, নিবেদন, এবং স্বীয় ভাব।
অষ্টদিক। যথা–উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব্ব, পশ্চিম, নৈঋত, বায়ু, অগ্নি ও ঈশান।
অষ্টকাল/অষ্টপ্রহর। যথা–প্রাতঃ, পূর্ব্বাহ্ন, মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন, অপরাহ্ন, প্রদোষ, মধ্যরাত্রি, নিশান্তক।
এবং ছয় রিপু।
সাতাশী উপর “তিন”–(রতি) সামর্থা, সাধারণী ও সামঞ্জসা।
“গতি”–অধিকার।
“সামার্থা”–শ্রীরাধিকা ও গোপীগণ।
“সাধারণী”–কুব্জা ও কুব্জিকাগণ।
“সামঞ্জসা”–রুক্ষ্মিণী প্রভৃতি।

—————–

রাগাত্মিক পদ ।।

বাশুলী কহিছে শুনহ দ্বিজ।
কহিব তোমারে সাধন বীজ।।
প্রথম(১) দুয়ারে মদের গতি।
দ্বিতীয়(২) দুয়ারে আসক স্থিতি।।
তৃতীয়(৩) দুয়ারে কন্দর্প রয়।
কন্দর্প রূপেতে শ্রীকৃষ্ণ কয়।।
আসক রূপেতে শ্রীরাধা কই।
মদরূপ ধরি আমি সে হই।।
সাতাশী আখরে সাধিবে তিনে(৪)।
একত্র করিয়া আপন মনে।।
রতির আকৃতি কন্দর্প হয়।।
তিনটি(৫) আখরে রতিকে যজি।
পঞ্চম আখরে (৬) বাণকে(৭) ভজি।।
দ্বিতীয়(৮) আসকে সামান্য রতি।
তবে সে পাইবে বিশেষ স্থিতি।।
চতুর্থ(৯) আখর সামান্য রস।
তাহাতে কিশোরা কিশোরী বস।।
বাশুলী কহয়ে এই সে সার।
এ রস সমুদ্র বেদান্ত পার।।

————–

(১) “প্রথম দুয়ারে”–সামর্থা।
(২) “দ্বিতীয় দুয়ারে”–সাধারণী।
(৩) তৃতীয় দুয়ারে” সামঞ্জসা।
(৪) “তিন”–পিরীতি।
(৫) “তিনটী আখর”–কন্দর্প।
(৬) “পঞ্চম আখর”–শান্ত, দাস্য, সৌম, বাৎসল্য, ও মাধুর্য্য।
(৭) “বাণ”–মদন।
(৮) “দ্বিতীয় আসক”–রাগাত্মিক ও রাগানুগা।
(৯) “চতুর্থ আখর”–রস ও রতি।

—————-

“সাতাশী”–
পঞ্চবাণ, অর্থাৎ মদন, মাদন, শোষণ, উন্মাদন ও স্তম্ভন।
পঞ্চপ্রাণ, অর্থাৎ প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যাণ।
পঞ্চভূত, অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম।
পঞ্চভাব, অর্থাৎ সান্ত, দাস্য, সৌখ্য, বাৎসল্য, মাধুর্য্য।
পঞ্চগুণ, অর্থাৎ শব্দ, গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ।
দশ ইন্দ্রিয়।
দশ দিক।
দশ দশা। যথা–“চিন্তাত্র জাগরূদ্বেগৌ তানবং মলিনাঙ্গতা। প্রমাদো ব্যাধিরুম্মাদৌ মোহ মৃত্যু দশাদশঃ।।
নবধাঙ্গ ভক্তি ও আত্মভাব, এই দশ। যথা–শ্রবণ, কীর্ত্তন, স্মরণ, অর্চ্চন, বন্দন, পদসেবন, দাস্য, সৌখ্য, নিবেদন, এবং স্বীয় ভাব।
অষ্টদিক। যথা–উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব্ব, পশ্চিম, নৈঋত, বায়ু, অগ্নি ও ঈশান।
অষ্টকাল/অষ্টপ্রহর। যথা–প্রাতঃ, পূর্ব্বাহ্ন, মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন, অপরাহ্ন, প্রদোষ, মধ্যরাত্রি, নিশান্তক।
এবং ছয় রিপু।
সাতাশী উপর “তিন”–(রতি) সামর্থা, সাধারণী ও সামঞ্জসা।
“গতি”–অধিকার।
“সামার্থা”–শ্রীরাধিকা ও গোপীগণ।
“সাধারণী”–কুব্জা ও কুব্জিকাগণ।
“সামঞ্জসা”–রুক্ষ্মিণী প্রভৃতি।

————-

রাগাত্মিক পদ ।।

স্বরূপে আরোপ যার, রসিক নাগর তার,
প্রাপ্তি হবে মদন মোহন।
গ্রাম্য দেব বাশুলীরে, জিজ্ঞাসগে কড় যোড়ে,
রামী কহে শৃঙ্গার সাধন।।
চণ্ডীদাস কর যোড়ে, বাশুলীর পায় ধরে,
মিনতি করিয়া পুছে বাণী।
শুন মাতা ধর্ম্মমতি, বাউল হইনু অতি,
কেমনে সুবুদ্ধি হবে প্রাণী।।
হাসিয়ে বাশুলী কয়, শুনি চণ্ডী মহাশয়,
আমি থাকি রসিক নগরে।
সে গ্রাম দেবতা আমি, ইহা জানে রজকিনী,
জিজ্ঞাসগে যতনে তাহারে।।
সে দেশে রজকিনী, হয় রসের অধিকারী,
রাধিকা স্বরূপ তার প্রাণ।
তুমি ত রমণের গুরু, সেহ রসের কল্পতরু,
তার সনে দাস অভিমান।।
চণ্ডীদাস কহে মাতা, কহিলে সাধন কথা,
রামী সত্য প্রাণপ্রিয়া হৈল।
নিশ্চয় সাধন গুরু, সেহ রসের কল্পতরু,
তার প্রেমে চণ্ডীদাস মৈল।।

————–

বাউল – ক্ষিপ্ত; ব্যাকুল।

রাগাত্মিক পদ ।।

এই সে রস নিগুঢ় ধন্য।
ব্রজ বিনা ইহা না জানে অন্য।।
দুই রসিক হইলে জানে।
সেই ধন সদা যতনে আনে।।
নয়নে নয়নে রাখিবে পিরীতি।
রাগের উদয় এই সে রীতি।।
রাগের উদয় বসতি কোথা।
মদন মাদন শোষণ যথা।।
মদন বৈসে বাম নয়নে।
মাদন বৈসে দক্ষিণ কোণে।।
শোষণ বাণেতে উপান চাই।
মোহন কুচেতে ধরয়ে ভাই।।
স্তম্ভন শৃঙ্গারে সদাই স্থিতি।
চণ্ডীদাস কহে রসের রতি।।

———–

রাগাত্মিক পদ ।।

কাম আর মদন দুই প্রকৃতি পুরুষ।
তাহার পিতার পিতা সহজ মানুষ।।
তাহা দেখে দূর নহে আছয়ে নিকটে।
ব্রহ্মাণ্ড ভিতরে তেঁহ রহে চিত্রপটে।।
সর্পের মস্তকে যদি রহে পঞ্চ মণি।
কীটের স্বভাব দোষ তাহে নহে ধনী।।
গোরোচনা জন্মে দেখ গাভীর ভাণ্ডারে।
তাহার যতেক মূল্য সে জানিতে নারে।।
সুন্দর শরীরে হয় কৈতবের বিন্দু।
কৈতব হইলে হয় গরলের সিন্ধু।।
অকৈতবের বৃক্ষ যদি রহে এক ঠাঁই।
নাড়িলে বৃক্ষের মূল ফল নাহি পাই।।
নিদ্রার আবেশে দেখ কপাল পানে চেয়ে।
চিত্রপটে নৃত্য করে তার নাম মেয়ে।।
নিশি যোগে শুক সারী যেই কথা কয়।
চণ্ডীদাস কহে কিছু বাশুলীর কৃপায়।।

————–

কৈতব – কপট।

রাগাত্মিক পদ ।।

শৃঙ্গার রস বুঝিবে কে?
সব রস সার শৃঙ্গার এ।।
শৃঙ্গার রসের মরম বুঝে।
মরম বুঝিয়া ধরম যজে।।
রসিক ভকত শৃঙ্গারে মরা।
সকল রসের শৃঙ্গার সারা।।
কিশোরা কিশোরী দুইটি জন।
শৃঙ্গার রসের মূরতি হন।।
গুরু বস্তু এবে বলিব কায়?
বিরিঞ্চি ভবাদি সীমা না পায়।।
কিশোরা কিশোরী যাহাকে ভজে।
গুরু বস্তু সেই সদা যজে।।
চণ্ডীদাস কহে না বুঝে কেহ।
যে জন রসিক বুঝয়ে সেহ।।

———–

রাগাত্মিক পদ ।।

রসিক রসিক, সবাই কহয়ে,
কেহত রসিক নয়।
ভাবিয়া গণিয়া, বুঝিয়া দেখিলে,
কোটিতে গোটিক হয়।।
সখিহে রসিক বলিব কারে!
বিবিধ মশলা, রসেতে মিশায়,
রসিক বলি যে তারে।।
রস পরিপাটি, সুবর্নের ঘটী,
সম্মুখে পূরিয়া রাখে।
খাইতে খাইতে, পেট না ভরিবে,
তাহাতে ডুবিয়া থাকে।।
সেই রস পান, রজনী দিবসে,
অঞ্জলী পূরিয়া খায়।
খরচ করিলে, দ্বিগুণ বাড়ায়ে,
উছলিয়া বহি যায়।।
চণ্ডীদাস কহে, শুন রসবতি,
তুমি সে রসের কূপ।
রসিক জনা, রসিক না পাইলে,
দ্বিগুণ বাড়য়ে দুখ।।

রাগাত্মিক পদ ।।

রসিকা নাগরী রসের মরা।
রসিক ভ্রমর প্রেম পিয়ারা।।
অবলা মূরতি রসের বাণ।
রসে ডুবু ডুবু করে পরাণ।।
রসবতী সদা হৃদয়ে জাগে।
দরশ বাঢ়ায়া পরশ মাগে।।
দরশে পরশে রস প্রকাশ।
চণ্ডীদাস কহে রস বিলাস।।

রাগাত্মিক পদ ।।

রসের কারণ, রসিকা রসিক,
কায়াটি ঘটনে রস।
রসিক কারণ, রসিকা হোয়ত,
যাহাতে প্রেম বিলাস।।
স্থলত পুরুষে, কাম সূক্ষ্ম গতি,
স্থলত প্রকৃতি রতি।
দুঁহুক ঘটনে, যে রস হোয়াত,
এবে তাহে নাহি গতি।।
দুঁহুক যোটন, বিনহি কখন,
না হয় পুরুষ নারী।
প্রকৃতি পুরুষে, যো কছু হোয়ত,
রতি প্রেম পরচারি।।
পুরুষ অবশ, প্রকৃতি সবশ,
অধিক রস যে পিয়ে।
রতি সুখ কালে, অধিক সুখহি,
তা নাকি পুরুষে পায়ে।।
দুঁহুক নয়নে, নিকষয়ে বাণ,
বাণ যে কামের হয়।
রতির যে বাণ, নাহিক কখন,
তবে কৈছে নিকষয়।।
কাম দাবানল, রতি সে শীতল,
সলিল প্রণয় পাত্র।
কুল কাঠ খড়, প্রেম যে আধেয়,
পচনে পিরীতি মাত্র।।
পচনে পচনে, লোভ উপজিয়া,
যবে ভেল দ্রব ময়।
সেই বস্তু এবে, বিলাসে উপজে,
তাহারে রস যে কয়।।
বাশুলী আদেশে, চণ্ডীদাস তথি,
রূপ নারায়ণ সঙ্গে।
দুঁহু আলিঙ্গন, করল তখন,
ভাসল প্রেম তরঙ্গে।।

————–

পরচারি – প্রচার করি।

রাগাত্মিক পদ ।।

প্রেমের আকৃতি, দেখিয়া মূরতি,
মন যদি তাতে ধায়।
তবে ত সে জন, রসিক কেমন,
বুঝিতে বিষম তায়।।
আপন মাধুরী, দেখিতে না পাই,
সদাই অন্তর জ্বলে।
আপনা আপনি, করয়ে ভাবনি,
কি হৈল কি হৈল বলে।।
মানুষ অভাবে, মন মরিচিয়া,
তরাসে আছাড় খায়।
আছাড় খাইয়া, করে ছট ফট,
জীয়ন্তে মরিয়া যায়।।
তাহার মরণ, জানে কোন জন,
কেমন মরণ সেই।
যে জনা জানয়ে, সেই সে জীয়য়ে,
মরণ বাঁটিয়া লেই।।
বাঁটিলে মরণ, জীয়ে দুই জন,
লোকে তাহা নাহি জানে।
প্রেমের আকৃতি, করে ছট
চণ্ডীদাস ইহা ভণে।।

———–

রাগাত্মিক পদ ।।

প্রেমের যাজন, শুন সর্ব্বজন,
অতি সে নিগূঢ় রস।
যখন সাধন, করিবা তখন,
এড়ায় টানিবা শ্বাস।।
তাহা হইলে, মন বায়ু সে,
আপনি হইবে বশ।
তা হইলে কখন, না হইবে পতন,
জগৎ ঘোষিবে যশ।।
বেদ বিধি পার, এমন আচার,
যাজন করিবে যে।
ব্রজের নিত্য ধন, পায় সেই জন,
তাহার উপর কে।।
সদানন্দ হৃদয়ে, নয়নে দেখয়ে,
যুগল কিশোর রূপ।
প্রেমের আচার, নয়ন গোচর,
জানয়ে রসের কূপ।।
চণ্ডীদাস কয়, নিত্য বিলাসময়,
হৃদয় আনন্দ ভোরা।
নয়নে নয়নে, থাকে দুই জনে,
যেন জীয়ন্তে মরা।।

————-

রাগাত্মিক পদ ।।

শুন শুন দিদি, প্রেম সুধা নিধি,
কেমন তাহার জল।
কেমন তাহার, গভীর গম্ভির,
উপরে শেহালা দল।।
কেমন ডুবারু, ডুবেছে তাহাতে,
না জানি কি লাগি ডুবে।
ডুবিয়ে রতন, চিনিতে নারিলাম,
পড়িয়া রহিলাম ভবে।।
আমি মনে করি, আছে কত ভারি,
না জানি কি ধন আছে।
নন্দের নন্দন, কিশোরা কিশোরী,
চমকি চমকি হাসে।।
সখীগণ মেলি, দেয় করতালি,
স্বরূপে মিশায়ে রয়।
স্বরূপ জানিয়ে, রূপে মিশাইলে,
ভাবিয়ে দেখিলে হয়।।
ভাবের ভাবনা, আশ্রয় যে জনা,
ডুবিয়ে রহিল সে।
আপনি তরিয়ে, জগত তরায়,
তাহারে তরাবে কে।।
চণ্ডীদাস বলে, লাখে এক মিলে,
জীবের লাগয়ে ধান্ধা।
শ্রীরূপ করুণা, হারে হইয়াছে,
সেই সে সহজ বান্ধা।।

————–

রাগাত্মিক পদ ।।

আপনা বুঝিয়া, সুজন দেখিয়া,
পিরীতি করিব তায়।
পিরীতি রতন, করিব যতন,
যদি সমানে সমানে হয়।।
সখী হে পিরীতি বিষম বড়।
যদি পরাণে পরাণে, মিশাইতে পারে,
তবে সে পিরীতি দড়।।
ভ্রমরা সমান, আছে কত জন,
মধু লোভে করে প্রীত।
মধু পান করি, উড়িয়ে পলায়,
এমতি তাহার রীত।।
বিধুর সহিত, কুমুদ পিরীতি,
বসতি অনেক দূরে।
সুজনে সুজনে, পিরীতি হইলে,
এমতি পরাণ ঝুরে।।
সুজনে কুজনে, পিরীতি হইলে,
সদাই দুখের ঘর।
আপন সুখেতে, যে করে পিরীতি,
তাহারে বাসিব পর।।
সুজনে সুজনে, অনন্ত পিরীতি,
শুনিতে বাড়ে যে আশ।
তাহার চরণে, নিছনি লৈয়া,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস।

—————

রাগাত্মিক পদ ।।

সুজনের সনে, আনের পিরীতি,
কহিতে পরাণ ফাটে।
জিহ্বার সহিত, দন্তের পিরীতি,
সময় পাইলে কাটে।।
সখী হে কেমন পিরীতি লেহা।
আনের সহিত, করিয়া পিরীতি,
গরলে ভরিল দেহা।।
বিষম চাতুরী, বিষের গাগরী,
সদাই পরাধীন।
আত্ম সমর্পন, জীবন যৌবন,
তথাচ ভাবয়ে ভিন।।
সকাল লাগিয়া, ফেরয়ে ঘুরিয়া,
পর তত্ত্বে নাহি চায়।
করিয়া চাতুরী, মধু পান করি,
শেষে উড়িয়া পলায়।।
সখী না কর সে পিরীতি আশ।
ঝটিয়া পিরীতি, কেবল কুরীতি,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস।।

———–

রাগাত্মিক পদ ।।

শুন গো সজনি আমারি বাত।
পিরীতি করবি সুজন সাত।।
সুজন পিরীতি পাষাণ রেখ্‌।
পরিণামে কভু না হবে টোট্‌।।
ঘষিতে ঘষিতে চন্দন সার।
দ্বিগুণ সৌরভ উঠয়ে তার।।
চণ্ডীদাস কহে পিরীতি রীতি।
বুঝিয়া সজনি করহ প্রীতি।।

———–

রাগাত্মিক পদ ।।

নিজ দেহ দিয়া ভজিতে পারে।
সহজ পিরীতি বলিব তারে।।
সহজে রসিক করয়ে প্রীত।
রাগের ভজন এমন রীত।।
এখানে সেখানে এক হইলে।
সহজ পিরীতি না ছাড়ে মৈলে।।
সহজ বুঝিয়ে যে হয় রত।
তাহার মহিমা কহিব কত।।
চণ্ডীদাস কহে সহজ রীত।
বুঝিয়ে নাগরী করহ প্রীত।।

————-

রাগাত্মিক পদ ।।

পিরীতি করিয়া ভাঙ্গয়ে যে।
সাধনা অঙ্গ পায় না সে।।
প্রেমের পিরীতি মাধুরীময়।
নন্দের নন্দন কয়েক কয়।।
রাগ সাধনের এমতি রীত।
সে পথি জনার তেমতি চিত।।
সকল ছাড়িল যাহার তরে।
তাহারে ছাড়িতে সাহস করে।।
আদি চণ্ডীদাসে চারু সুবুঝান।
দাউ উঠাইল যেমন মান।।*

————–

* পদসমুদ্র

রাগাত্মিক পদ ।।

প্রেমের পিরীতি, কিসে উপজিল,
প্রেমাধরে নিব কারে!
কেবা কোথা হইল, কেবা সে দেখিল,
এ কথা কহিব কারে।।
পাতের ফুলে, ফুলের কিরণ,
আথার মাঝারে যেই।
তাহারে অনেক, যতনে নিঙ্গাড়ে,
চতুর রসিক সেই।।
প্রেমের চাতুরি, চতুর হইয়া,
তিনের কাছেতে থাকে।
চারিটি আঁখর, হরিলে পূরিলে,
তাহে যেবা বাকি থাকে।।
তাহার বাকিতে, প্রেমের আখর,
পিরীতি আখর জড়।
সকল আখর, এক করি দেখ,
প্রেমের কথাটী দড়।।
ছয়টী আখর, মূল করি দেখ,
তাহার ঘুচাই দুই।
চণ্ডীদাস কহে, এ কথা বুঝয়,
রসিক হইবে সেই।।*

————–

* পদসমুদ্র

রাগাত্মিক পদ ।।

পিরীতি উপরে, পিরীতি বৈসয়ে,
তাহার উপরে ভাব।
ভাবের উপরে, ভাবের(১) বসতি,
তাহার উপর লাভ (২)।।
প্রেমের মাঝারে,(৩) পুলকের স্থান,
পুলক উপরে ধারা(৪)।
ধারার উপরে, ধারার বসতি,
এ সুখ বুঝয়ে কারা।।(৫)
কুলের(৬) উপরে, ফুলের বসতি,
তাহার উপরে গন্ধ।।
গন্ধ উপরে, এ তিন আখর,
এ বড় বুঝিতে ধন্ধ।।
কুলের উপরে, ফুলের বসতি,
তাহার উপরে ঢেউ।
ঢেউর উপরে, ঢেউই বসতি,
ইহা জানে কেউ কেউ।।
দুখের উপরে, দুখের বসতি,
কেহ কিছু ইহা জানে(৭)।
তাহার উপরে, পিরীতি বৈসয়ে,
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে।।

————–

(১) “ভাব”–মধুর। মাধুর্য্য।
(২) “লাভ”–প্রেম।
(৩) “ধারা”–কারুণ্যামৃত, লাবণ্যামৃত, তারুণ্যামৃত।
(৪) পাঠান্তর–“ভাবের মাঝারে”–বি, প্রি, প।
(৫) বিভিন্ন পাঠ–“ধারার উপরে, রসের স্থান, এমন জানিয়ে মোরা।।”-ঐ।
(৬) পাঠান্তর–“ফলের”–ঐ।
(৭) পাঠান্তর–“দুয়ের উপরে, দুয়ের বসাত, কেহ কিছু তাহা জানে।”–ঐ।

রাগাত্মিক পদ ।।

সতের সঙ্গে, পিরীরি করিলে,
সতের বরণ হয়।
অসতের বাতাস, অঙ্গেতে লাগিলে,
সকলি পলায়ে যায়।।
সোণার ভিতরে, তামার বসতি,
যেমন বরণ দেখি।
রাগের ঘরেতে, বৈদিক থাকিলে,
রসিক নাহিক লেখি।।
রসিকের প্রাণ, যেমতি করয়ে,
এমতি কহিব কারে।
টলিয়া না টলে, এমতি বুঝায়া,
মরম কহিব তারে।।
এমতি করণ, যাহার দেখিব,
তাহার নিকটে বসি।
চণ্ডীদাস কয়, জনমে জনমে,
হয়ে রব তার দাসী।।

——————

রাগাত্মিক পদ ।।

সহজ আচার, সহজ বিচার,
সহজ বলি যে কায়।
কেমন বরণ, কিসের গঠন,
বিবরিয়া কহ তায়।।
শুনি নন্দ সুত, কহিতে লাগিল,
শুন বৃষভানু ঝি।
সহজ পিরীতি, কোথা তার স্থিতি,
আমি না জেনেছি শুনেছি।।
আনন্দের আলস, ক্ষীরোদ সায়র,
প্রেম বিন্দু উপজিল।
গদ্য পদ্য হয়ে, কামের সহিতে,
বেগেতে ধাইয়া গেল।।
বিজুরী জিনিয়া, বরণ যাহার,
কুটিল স্বভাব যার।
যাহার হৃদয়ে, করয়ে উদয়,
সে অঙ্গ করয়ে ভার।।
এমতি আচার, ভজন যে করে,
শুনহ রসিক ভাই।
চণ্ডীদাস কহে, উহার উপরে,
আর দেখ কিছু নাই।।

—————-

রাগাত্মিক পদ ।।

সহজ (১) সহজ, সবাই কহয়ে,
সহজ জানিবে কে।
তিমির অন্ধকার, যে হইয়াছে পার,
সহজ জেনেছে সে।।
চান্দের (২) কাছে, অবলা (৩) আছে,
সেই সে পিরীতি সার।
বিষে অমৃতেতে, মিলন একত্রে,
কে বুঝিবে মরম তার।।
বাহিরে তাহার, একটি দুয়ার,
ভিতরে তিনটি আছে।
চতুর হইয়া, দুইকে ছাড়িয়া,
থাকিবে একের কাছে।।
যেন আম্র ফল, অতি সে রসাল,
বাহিরে কুশী ছাল কষা।
ইহার আস্বাদন, বুঝে যেই জন,
করই তাহার আশা।।
অভাগিয়া কাকে, স্বাদু নাহি জানে,
মজয়ে নিম্বের ফলে।
রসিক কোকিলা, জ্ঞানের প্রভাবে,
মজয়ে চ্যূত মুকুলে।।
নবীন মদন, আছে এক জন,
গোকুলে তাহার থানা।
কামবীজ সহ, ব্রজ বধূগণ,
করে তার উপাসনা।।
সহজ কথাটী, মনে করি রাখ,
শুনলো রজক ঝি।
বাশুলী আদেশে, জানিবে বিশেষে
আমি আর বলিব কি।।
রূপ করূনাতে, পারিবে মিলিতে, (৪)
ঘুচিবে মনেরি ধান্দা।
কহে চণ্ডীদাস, পুরিবেক আশ,
তবে ত খাইবে সুধা।।(৫)

————–

(১) প্রণয়।
(২) “চান্দ”–কৃষ্ণচন্দ্র।
(৩) “অবলা”–গোপীগণ।
(৪) পাঠান্তর–“আপনা বুঝিলে, লাখে এক মিলে”–বি, প্রি, প।
(৫) বিভিন্ন পাঠ–“চণ্ডীদাস বলে, পাবে হাতে হাতে, চারি অক্ষরে থাক বাঁধা।।”-ঐ।

রাগাত্মিক পদ ।।

ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া, আছয়ে যে জন,
কেহ না দেখয়ে তারে।
প্রেমের পিরীতি, যে জন জানয়ে,
সেই সে পাইতে পারে।।
পিরীতি পিরীতি, তিনটী আখর,
জানিবে ভজন সার।
রাগ মার্গে যেই, ভজন করয়ে,
প্রাপ্তি হইবে তার।।
মৃত্তিকার উপরে, জলের বসতি,
তাহার উপরে ঢেউ।
তাহার উপরে পিরীতি বসতি,
তাহা কি জানয়ে কেউ।।
রসের পিরীতি, রসিক জানয়ে,
রস উদ্গারিল কে?
সকল ত্যজিয়া যুগল হইয়া,
গোলোকে রহিল সে।
পুত্র পরিজন, সংসার আপন,
সকল ত্যজিয়া লেখ।
পিরীতি করিলে, তাহারে পাইবে,
মনেতে ভাবিয়া দেখ।।
পিরীতি পিরীতি, তিনটী আখর,
পিরীতি ত্রিবিধ মত।
ভজিতে ভজিতে, নিগূঢ় হইলে,
হইবে একই মত।।
পরকীয়া ধন, সকল প্রধান,
যতন কইয়া লই।
নৈষ্ঠিক হইয়া, ভজন করিলে,
পদ্ধতি সাধক হই।।
পদ্ধতি হইয়া, রস আস্বাদিয়া,
নৈষ্ঠিকে প্রবৃত্ত হয়।
তাহার চরণ, হৃদয়ে ধরিয়া,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।

————–

রাগাত্মিক পদ ।।

সাধন শরণ, এ বড় কঠিন,
বড়ই বিষম দায়।
নব সাধু সঙ্গ, যদি হয় ভঙ্গ,
জীবের জনম তার।।
অনর্থ নিবৃত্তি, সভে দুরগতি,
ভজন ক্রিয়াতে রতি।
প্রেম গাঢ় রতি, হয় দিবা রাতি,
হয়ে যে যাহাতে প্রীতি।।
আসক উকত, সবে দুরগত,
সদগুরু আশ্রয়ে হবে।
রতি আস্বাদন, করহ বতন,
সখীর সঙ্গিনী হবে।।
দেহ রতি ক্ষয়, কুপত রতি হয়,
সাধক সাধন পাকে।
চণ্ডীদাসে কয়, বিনা দুঃখে নয়,
কিশোরী চরণ দেখে।।

—————–

রাগাত্মিক পদ ।।

কাতরা অধিকা, দেখিয়া রাধিকা,
বিশাখা কহিল তায়।
চিতে এত ধনি, ব্যাকুল হইলে,
ধরম সরম যায়।।
পাইয়া কামরতি, হবে অন্য পতি,
তাহাতে বলাব সতী।।
স্নান না করিব, জল না ছুঁইব
আলাইয়া মাথার কেশ।
সমুদ্রে পশিব, নীরে না তিতিব,
নাহি সুখ দ্যঃখ ক্লেশ।।
রজনী দিবসে, হবে পরবশে,
স্বপনে রাখিব লেহা।
একত্র থাকিব, নাহি পরশিব,
ভাবিনী ভাবের দেহা।।
অন্যের পরশে, সিনান করিব,
তবে সে রীতি সাজে।
কহে চণ্ডীদাস, এ বড় উল্লাস,
থাকিব যুবতী মাঝে।।

————–

অন্য পতি – প্রেম।
সমুদ্রে – প্রেম সমুদ্রে।
পরবশে–শ্রীকৃষ্ণের বশে।
অন্যের পরশে সিনান করিব – অন্যের স্পর্শে তৎক্ষণাৎ দান করিব অর্থাৎ ভ্রষ্টা হইব না।

রাগাত্মিক পদ ।।

হইলে সুজাতি, পুরুষেরি রীতি,
যে জাতি নায়িকা হয়।
আশ্রয় লইলে, সিদ্ধ রতি মিলে,
কখন বিফল নয়।।
তেমতি নায়িকা, হইলে রসিকা,
হীন জাতি পুরুষেরে।
স্বভাব লওয়ায়, স্বজাতি ধরায়,
যেমত কাচপোকা করে।।
সহজ করণ, রতি নিরুপণ,
যে জন পরীক্ষা জানে।
সেইত রসিক, হয় ব্যবসিক,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে ভনে।।

রাগাত্মিক পদ ।।

মিলা অমিলা দুই রসের লক্ষণ।
নায়ক নায়িকা নাম লক্ষণ কথন।।
পূর্ব্বরাগ হইতে সীমা সমৃদ্ধিমান আদি।
রসের ভঞ্জিত ক্রমে যতেক অবধি।।
পতি উপপতি ভাবে দ্বাদশ যে রস।
পুন যে দ্বিগুণ হইয়া করয়ে প্রকাশ।।
কন্যার বিবাহ আর অন্যের উপপতি।
ভাব ভেদে এই হয় চব্বিশ রস রীতি।।
পুন চারি গুণ করি হয় ছেয়ানই।
অনুকূল দক্ষিণ ধৃষ্ট আর শট তাই।।
এই সব নাম ভেদে নায়কের ভেদ।
পুন হয় তাহার লক্ষণ বিভেদ।।
এই সব্র গুণ কৃষ্ণ চন্দ্রে একা বর্ত্তে।
চণ্ডীদাস কহে রস ভেদ এক পাত্রে।।

রাগাত্মিক পদ ।।

প্রবর্ত্ত দেহের সাধনা করিলে কোন্‌ বরণ হব।
কোন্‌ কর্ম্ম যাজন করিলে কোন্‌ বৃন্দাবনে যাব।।
নব বৃন্দাবনে নব নাম হয়, সকল আনন্দময়।
কোন্‌ বৃন্দাবনে ঈশ্বর মানুষে মিলিত হইয়া রয়।।
কোন্‌ বৃন্দাবনে বিরজা বিলাসে, তরুলতা চারি পাশে।
কোন্‌ বৃন্দাবনে কিশোর কিশোরী, শ্রীরূপমঞ্জরী সাথে।।
কোন্‌ বৃন্দাবনে রস উপজয়ে সুধার জনম তায়।
কোন্‌ বৃন্দাবনে বিকশিত পদ্ম, ভ্রমরা পশিছে তায়।।
গোপতের পথ, না হয় বেকত রসিক জনার সনে।
উপাসনা ভেদ যাহার হয়েছে সেই সে মরম জানে।।
দ্বিজ চণ্ডীদাস না জানিয়ে তত্ত্ব কেমনে হইবে পার।
উত্তম কুলেতে, লভিয়ে জনম ছি নীচ সহ ব্যবহার।।*

————–

* পদসমুদ্র

রাগাত্মিক পদ ।।

নায়িকা সাধন, শুনহ লক্ষণ,
যে রূপে সাধিতে হয়।
শুষ্ক কাষ্ঠের সম,
আপন দেহ করিতে হয়।।
সে কালে রমণ, অতি নিত্য করণ,
তাহাতে যে সাধন হবে।
মেঘের বরণ, রতির গঠন,
তখন দেখিতে পাবে।।
সে রতি সাধন, করেন যে জন,
সেই সে রসিক সার।
ভ্রমর হইয়া, সন্ধান পুরিয়া,
মরম বুঝয়ে তার।।
তাহার উপর, জলদ বরণ,
রতির বরণ হয়।
সাধিতে সে রতি, কাহার শকতি,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।

—————–

রাগাত্মিক পদ ।।

সজনি শুনগো মানুষের কাজ।
এ তিন ভুবনে, সে সব বচনে,
কহিতে বাসিবেক লাজ।।
কমল উপরে, জলের বসতি,
তাহাতে বসিল তারা।
তাহাদের তাহাদের, রসিক মানুষ,
পরাণে হানিছে হারা।।
সুমেরু উপরে, ভ্রমর পশিল,
ভ্রমর ধরি ফুল।
তাহাদের তাহাদের, রসিক মানুষ,
হারায়েছে জাতি কুল।।
হরিণ দেখিয়া, বেয়াধ পলায়,
কমলে গেল সে ভৃঙ্গ।
যমের ভিতরে, আলসের বসতি,
রাহুতে গিলিছে চন্দ্র।।
সুমেরু উপরে, ভ্রমর পশিল,
এ কথা বুঝিবে কে?
চণ্ডীদাস কহে, রসিক হইলে,
বুঝিতে পারিবে সে।।

————-

রাগাত্মিক পদ ।।

সে কেমন যুবতী, কুলবতী সতী,
সুন্দর সুমতি সার।
হিয়ার মাঝারে, নায়কে লুকাইয়া,
ভব নদী হয় পার।।
ব্যভিচারী নারী, না হবে কাণ্ডারী,
নায়কে বাচিয়া লবে।
তার অবছায়া, পরশ করিলে,
পুরুষ-ধরম যাবে।।
সে কেমন পুরুষ, পরশ রতন,
সেবা কোন্‌ গুণে হয়।
সাতের বাড়ীতে, পাষাণ পড়িলে,
পরশ পাষাণময়।।
সাতের বাড়িতে, ক্ষীরোদ নদী,
নারায়ণ শুভ যোগ।
সেই যোগেতে, স্থাপন কইলে,
হয় রকনী মনহ যোগ।।
রমণ ও রমণী, তারা দুই জন,
কাঁচা পাকা দুটী থাকে।
এক রজ্জু, খসিয়া পড়িলে,
রসিক মিলয়ে তারে।।
মনের আগুন, উঠিছে দ্বিগুণ,
তোলা পাড়া হবে সার।
চণ্ডীদাস কহে, ধন্য সে নারী,
তলাটে নাহিক আর।।

রাগাত্মিক ।।

নারীর সৃজন, সে অতি কঠিন,
কেবা সে জানিবে তায়।
জানিতে অবধি, নারিলেক বিধি,
বিষামৃতে একত্রে রয়।।
যেমত দ্বীপিকা, উজরে অধিকা,
ভিতরে অনল-শিখা।
পতঙ্গ দেখিয়া, পড়য়ে ঘুরিয়া,
পুড়িয়া মরয়ে পাখা।।
জগত ঘুরিয়া, তেমতি পড়িয়া,
কামানলে পুড়ি মরে।
রসজ্ঞ যেজন, সে করয়ে পান,
বিষ ছাড়ি অমৃতেরে।।
হংস চক্রবাক, ছাড়িয়া উদক,
মৃণাল দুগ্ধ সদা খায়।
তেমতি নাহিলে, কোথা প্রেম মিলে,
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়।।

রাগাত্মিক ।।

এ তিন ভুবনে ঈশ্বর গতি।
ঈশ্বর ছাড়িতে পরে শকতি।।
ঈশ্বর ছাড়িলে দেহ না রয়।
মানুষ ভজন কেমনে হয়।।
সাক্ষাত নহিলে কিছুই নয়।
মনেতে ভাবিলে স্বরূপ হয়।।
কহয়ে চণ্ডীদাস বুঝয়ে ঞে।
ইহার অধিক পুছয়ে যে।।

রাগাত্মিক ।।

রাগের ভজন, শুনিয়া বিষম,
বেদের আচার ছাড়ে।
রাগানুগমেতে, লোভ বাড়ে চিতে,
সে সব গ্রহণ করে।।
ছাড়িতে বিষম, তাহার করণ,
আচার বিষম না পারে।
অতি অসম্ভব, অলৌকিক সব,
লৌকিকে কেমনে করে।। (১)
করিয়া গ্রহণ, না করে যাজন,
সে কেন সাধন করে।
বুঝিতে না পারে, আনা গোনা করে,
ফাঁফরে পড়িয়া মরে।।
তার একুল ওকুল, দুকুল গেল,
পাথারে পড়িল সে।
চণ্ডীদাস কয়, সে দেব নয়,
তাহারে তরাবে কে।।

—————–

(১) বিভিন্ন পাঠ—
“যজিতে বিষম, করণ তাহার,
আচার বিষম বড়।
দেখিয়া শুনিয়া, মায়াতে ভুলিয়া,
করিতে না পারে দিঢ়।।”
-হ, লি, পু।

রাগাত্মিক ।।

এরূপ মাধুরী যাহার মনে।
তাহার মরম সেই সে জানে।।
তিনটী দুয়ারে যাহার আশ।
আনন্দ নগরে তাহার বাস।।
প্রেম সরোবরে দুইটী ধারা।
আস্বাদন করে রসিক যারা।।
দুই ধারা যখন একত্রে থাকে।
তখন রসিক যুগল দেখে।।
প্রেমে ভোর হয়ে করয়ে আন।
নিরবধি রসিক করয়ে পান।।
কহে চণ্ডীদাস ইহার সাক্ষী।
এরূপ সাগরে ডুবিয়া থাকি।।

———-

রাগাত্মিক ।।

স্বরূপ বিহনে, রূপের জনম,
কখন নাহিক হয়।
অনুগত বিহনে, কার্য্য সিদ্ধি,
কেমনে সাধকে কয়।।
কেবা অনুগত, কাহার সহিত,
জানিব কেমনে শুনে।
মনে অনুগত, মুঞ্জরী সহিত,
ভাবিয়া দেখহ মনে।।
দুই চারি করি, আটটা আঁখর,
তিনের তিনের জনম তায়।
এগার আঁখরে, মূল বস্তু জানিলে,
একটি আঁখর হয়।।
চণ্ডীদাস কহে শুনহ মানুষ ভাই।
সবার উপর, মানুষ সত্য,
তাহার উপর নাই।।

——————-

স্বরূপ – প্রকৃতি পুরুষ—রাধাকৃষ্ণ।
আটটা আখর – অষ্ট সখী। ললিতা, বিশাখা, চম্পকলতা, চিত্রা, তুঙ্গবিদ্যা, ইন্দুলেখা, রঙ্গদেবী, ও সুদেবী—এই অষ্টসখী।
তিন – পিরীতি।
এগার আখর – দশ ইন্দ্রিয় ও মন।
মূল বস্তু – সেবা।
একটি আখর – ক, (কৃষ্ণ)।

রাগাত্মিক ।।

প্রবর্ত সাধিতে বস্তু অনায়াসে উঠে।
নামাইতে বস্তু সাধক বিষম সঙ্কটে।।
নামান আনন্দ মন কহিয়া নির্দ্ধারি।
পৌষ মাঘ মাসের শিশির কুম্ভে ভরি।।
সেই পূর্ণ কুম্ভ যৈছে সেবে পাতে ঢালি।
সর্ব্বাঙ্গে মস্তকে পাদ করয়ে শীতলি।।
তৈছে সাধকের সেই সন্ধানের কার্য্য।
তারণ্যামৃত ধারা তার নাম কৈল ধার্য্য।।
লাবণ্যামৃত ধারা কহি সিদ্ধে সঙ্কেতে।
কারুণ্যামৃত স্নান কহি প্রবর্ত্ত দশাতে।।
সংক্ষেপে কহিল তিন স্নানের বিধান।
সম্যক্‌ কহিতে নারি বিদরে পরাণ।।
অটল পরেতে এই পদ গুরু মর্ম্ম।
চণ্ডীদাস লেখে ব্যক্ত আপনার ধর্ম্ম।। *

——————-

* শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী মহাশয়ের শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যখণ্ড অষ্টম পরিচ্ছেদের মহাভাব বর্ণনের বোধ হয় ইহাই অবলম্বন।

রাগাত্মিক ।।

পুরুষ প্রকৃতি, দোঁহে এক রীতি,
সে রতি সাধিতে হয়।
পুরুষেরি যুতে, নায়িকার রীতে,
যেমতে সংযোগ পায়।।
পুরুষ সিংহেতে, পদ্মিনী নারীতে,
সে সাধন উপজয়।
স্বজাতি অনুগা, সোণাতে সোহাগা,
পাইলে গলিয়া যায়।।
যে জাতি যুবতী, সাধিতে সে রতি,
কুজাতি পুরুষে ধরে।
কণ্টকে যেমত, পুষ্প হয় ক্ষত,
হৃদয় ফাটিয়া মরে।।
পুরুষ তেমতি, নারী হীন জাতি,
রতির আশ্রয় লয়।
ভূতে ধরে তারে, মরে ঘুরে ফিরে,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।

রাগাত্মিক ।।

আমার পরাণ, পুতলী লইয়া,
নাগর করে পূজা।
নাগর পরাণ, পুতলী আমার,
হৃদয় মাঝারে রাজা।।
আনের পরান, আনে করে চুরি,
তিন আনে নাহি জানে।
আগন নিগম, দুর্গম সুগম,
শ্রবণ নয়ন মনে।।
এই সাত নদী, অনন্ত অবধি,
এই সাত যে দেশে নাই।
সে দেশে তাহার, বসতি নগর,
এ দেশে কি মতে পাই।।
এ সব করণ, করে যেই জন,
সে জন মাথার মণি।
মরিলে সেজন, জীয়াতে পারে,
অমৃত রস আনি।।
হ্রীং সে অক্ষর, তাহার উপর,
নাচে এক বাজীকর।
এক কুমুদিনী, দুন্দুভি বাজায়,
বাঁশী জিনি তার স্বর।
দুন্দুভি বাঁশীটী, যখন বাজিবে,
তা শুনে মরিবে যে।
রসিক ভকত, ভুবনে ব্যক্ত,
সখীর সঙ্গিনী সে।।
এ সব ব্যবহার, দেখিব যাবার,
তাহার চরণ সার।
মন-সূতা দিয়া, তাহার চরণ,
গাথিয়া পরিব হার।।
বাশুলী আদেশে কহে চণ্ডীদাসে,
কাঁচা পাকা দুই ফল।
যে ফল লইবে, সে ফল পাইবে,
তেমতি তাহা বিরল।।

————–

রাগাত্মিক ।।

সদা বল তত্ত্ব তত্ত্ব কত তত্ত্ব শুন।
চব্বিশ তত্ত্বে হয় দেহের গঠন।।
পঞ্চভূত ক্ষেত্র তেজ মরুৎ ব্যোম আপ।
ষড় রিপু কাম ক্রোধ লোভ মদ মাৎসর্য্য দম্ভ।।
দশ ইন্দ্র ক্ষত তারা হয়ত পৃথক্‌।
জ্ঞানেন্দ্রিয় কর্ম্মেন্দ্রিয় দ্বিবিধ নামাত্মক।।
জ্ঞানেন্দ্রিয় জীহ্বা কর্ণ নাসাত্বক চক্ষু।
কর্ম্মেন্দ্রিয় হস্ত পদ গুহ্য লিঙ্গ বপু।।
মহ্যভূত অহঙ্কার আর হয় জ্ঞান।
এইত হয় চব্বিশ তত্ত্ব নিরূপণ।।
কিবা কারিকরের আজব কারিকুরি।
তার মধ্যে ছয় পদ্ম রাখিয়াছে পুরি।।
সহস্রারে হয় পদ্ম সহস্রক দল।
তার তলে মণিপুর পরম শিবের স্থল।।
নাসামূলে দ্বিদল পদ্ম খঞ্জনাক্ষী।
কণ্ঠে গাঁথি ষোড়শ দল পদ্ম দিল রাখি।।
হৃদ-পদ্ম নির্ম্মিত আছে শত দলে।
কুল কুণ্ডলিনী দশ দল হয় নাভি মূলে।।
নাভির নিম্নভাগে প্রেম সরোবর।
অষ্টদল পদ্ম হয় তাহার ভিতর।।
তস্য পরে নাড়ী ধরে সার্দ্ধ তিন কোটি।
স্থূল সূক্ষ্ম বত্রিশ তারা কিবা পরিপাটি।।
লিঙ্গ মূলে ষড়দলাম্বূজ নিযোজিত।
গুহ্য মূলে চতুর্দ্দল পদ্ম বিরাজিত।।
এই অষ্ট পদ্ম দেহ মধ্যেতে আছয়।
মতান্তরে হৃদপদ্ম দ্বাদশ দল কয়।।
সহস্র দল অষ্টদল দেহ মধ্যে নয়।
এই দুই পদ্ম নিত্য বস্তুর আধার হয়।।
ষট চক্রের মূল মৃণাল হয় মেরুদণ্ড।
শিরসি পর্য্যন্ত সে ভেদ করি অণ্ড।।
দন্ত দুই পার্শ্বেতে ঈড়া পিঙ্গলা রহে।
মধ্যেস্থিত সুষমণা সদা প্রবল বহে।।
মূল চক্র হয় হংস যোগের আধার।
অষ্টদল চক্রে লীলার সঞ্চার।।
দ্বিদল চক্রেতে হয় অমৃত নির্ভর।
আর পঞ্চ চক্রে পঞ্চ বায়ুর সঞ্চার।।
প্রাণ অপান ব্যান উদান সমান।
কণ্ঠাম্বুজবধি চতুর্দ্দলে অবস্থান।।
কণ্ঠ পরে উদান হৃদিতে বহে প্রাণ।
নাভির ভিতরে সমান করে সমাধান।।
চতুর্দ্দলে অপান সর্বভূতেতে ব্যান।
মুখ্য অনুলোম বিলোম সকল প্রধান।।
অজপা নামেতে তারা কুম্ভক রেচক।
অনুলোম ঊর্দ্ধরেতা বিলোম প্রবর্ত্তক।।
প্রবর্ত্ত সাধক হৃদ-নাভি পদ্মের আশ্রয়।
সিদ্ধার্থ সহস্রারে আছয়ে নিশ্চয়।।
রতি স্থির প্রেম সরোবর অষ্টদলে।
সাধনের মূল এই চণ্ডীদাসে বলে।।

————

রাগাত্মিক ।।

মতান্তরে যে কহয়ে শুনহ নিশ্চয়।
মস্তক উপরে সহস্র দল পদ্ম কয়।।
ভ্রূ মধ্যে দ্বিদল কণ্ঠে ষোলদল।
হৃদি মধ্যে দ্বাদশ নাভিমূলে দশদল।।
লিঙ্গমূলে ষড়দল চতুর্দ্দশ গুহ্যমূলে।
বস্তু ভেদ আছে তার চণ্ডীদাস বলে।।
সাধন তত্ত্বে তার যোগ নাহি হয়।
বৈধিযোগ এই তত্ত্বে হয় ত নিশ্চয়।।

————–

রাগাত্মিক ।।

চৌদ্দ ভুবনে ভুবন তিন।
সপ্ত আখর তাহার চিন।।
দুইটী আখরে সদা পিরীতি।
তিনটী পরশে উপজে রতি।।
নির্জ্জন কাননে আছয়ে ঘর।
দুইটী আখর পাঁচের পর।।
কনক আসন আছয়ে তাতে।
মনসিজ রাজা বৈসয়ে যাতে।।
কর্পূর চন্দন শীতল জলে।
যেমন আনন্দ লেপন কালে।।
তাপিত জনে সে আনন্দ পায়।
শীত ভীত জন ভয়ে পলায়।।
পঞ্চ রস আদি একত্রে মেলি।
যে যার স্বভাব আনন্দে কেলি।।
অষ্ট আখর একত্র যবে।
কনক আসন জানিবে তবে।।
পঞ্চ রস অনুবাদ যে হয়।
আদি চণ্ডীদাস বিধেয় কয়।।

——————-

বীরভূম জেলার অন্তঃপাতি সিউড়ি নিবাসী শ্রীযুক্ত কুঞ্জলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রতিপাদিত অর্থ এইরূপ, যথা—
চৌদ্দ ভুবন – সপ্ত স্বর্গ ও সপ্ত পাতাল।
ভুবন তিন – ব্রজ, গোলক ও দ্বারকা।
সপ্ত আখর – রাধা, রমণ, কুঞ্জ।
দুইটী আখর – রাধা।
তিনটী আখর – রমণ।
নির্জ্জন কানন – রাধারমণ, পরে কুঞ্জ।
অষ্টম আখর – “স্থ” অর্থাৎ রাধারমণ কুঞ্জস্থ।

শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয়ের প্রতিপাদিত অর্থ এই :—

চৌদ্দ ভুবন – চতুর্দ্দশ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট দেহ। চতুর্দ্দশ ইন্দ্রিয়, অর্থাৎ পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্ম্মেন্দ্রিয়, চারি অন্তরেন্দ্রিয়।
ভুবন তিন – ভাব, কান্তি ও বিলাস। ইহা সপ্তাক্ষর বিশিষ্ট। কবির রীত্যানুসারে এ স্থলে অক্ষর গণনা হইয়াছে; তৎপ্রমাণ “পিরীতি—আখর তিন”।
দুইটী আখর – ভাব। ইহাএ সর্ব্বদা প্রীতি বিরাজ করে।
তিনটী আখর – বিলাস। ইহাই রতির কারণ।
নির্জ্জন কানন ইত্যাদি – হৃদয়রূপ নির্জ্জন কাননস্থিত পঞ্চভূত আত্মার পর; বা কান্তি বিলাসের পর দুইটী আখর “ভাব”।
কনক আসন ইত্যাদি – ষট্‌চক্রমতে হৃদয়স্থিত রত্নবেদিকায় অভিন্ন মদন শ্রীকৃষ্ণ রাধা সহ বিরাজ করেন।
পঞ্চ রস – শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য, মাধুর্য্য।
অষ্টম আখর – ভাব কান্তি বিলাসের পর “জ্ঞা” এই বর্ণ যুক্ত হইয়া “ভাব কান্তি বিলাসজ্ঞ” শ্রীকৃষ্ণকেই বুঝাইতেছেন এবং তদীয় অধিষ্ঠান বশতঃই হৃদয় “কনক আসন” রূপে ব্যক্ত হয়।
পঞ্চ রস ইত্যাদি – প্রাগুক্ত পঞ্চরস মধ্যে, চণ্ডীদাসের মতে মাধুর্য্য বা শৃঙ্গার রস প্রধান। তৎপ্রমাণ, “সব রস সার শৃঙ্গার এ” ইত্যাদি পদ।

বীরভূমের অন্তর্গত সাঁকুলিপুর গ্রামবাসী শ্রীযুক্ত জীউলাল মজুমদারের প্রতিপাদিক অর্থের কতকাংশ এই :—
চৌদ্দ ভুবন – সপ্ত স্বর্গ ও সপ্ত পাতাল। ভূলোক, ভূবর্লোক, স্বর্লোক, মহল্লোক, জনলোক, তপলোক ও সত্যলোক, এই সপ্ত স্বর্গ। অতল, বিতল, সুতল, তল, তলাতল, রসাতল ও পাতাল, এই সপ্ত পাতাল।
ভুবন তিন – গোলোক, বৈকুণ্ঠ, শ্রীবৃন্দাবন।
মনসিজ রাজা – অপ্রাকৃত মদন শ্রীকৃষ্ণ।

রাগাত্মিক ।।

ব্রহ্ম রন্ধ্রে সহস্র দল পদ্মে রূপের আশ্রয়।
ইষ্টে অধিষ্ঠাতা তার স্বরূপ লক্ষণ হয়।।
সেই ইষ্টে যাহার হয় গাঢ় অনুরাগ।
সেই জন লোক ধর্ম্মাদি সব করে ত্যাগ।।
কায় মন বাক্যে করে গুরুর সাধন।
সেই ত করণে উপজয়ে প্রেম ধন।।
তাতে যদি কোন বাধা মনে উপজিবে।
চণ্ডীদাস বলে সে নরকে ডুবিবে।। *

——————-

* পদসমুদ্র।

পরিশিষ্ট (চণ্ডীদাসের পদাবলী)

অনুরাগ—আত্মপ্রতি ।। সুহই ।।

জনম গেল পর দুঃখে কত বা সহিব।
কানু কানু করি কত নিশি পোহাইব।।
অন্তরে রহিল ব্যথা কুলে কি করিবে।
অনুরাগে কোন দিন গরল ভখিবে।।
মনেতে করেছি কুলে দিব তিলাঞ্জলী।
দেশান্তরি হ’ব গুরু দিঠে দিয়া বালি।।
ছাড়িনু গৃহের সাধ কানুর লাগিয়া।
পাইনু উচিৎ ফল আগে না বুঝিয়া।।
অবলা কি জানে এমত হইবে পাছে।
তবে এমন প্রেম করিবে কেন যেচে।।
ভাল মন্দ না জানিয়া সুঁপেছি হে মন।
তেঞি সে অনলে পুড়ি যায় দেহ প্রাণ।।
চণ্ডীদাস কয় প্রেম হয় সুধাময়।
কপাল ক্রমে অমৃতেতে বিষ উপজয়।। *

——————-

* পদসমুদ্র।

অনুরাগ—আত্মপ্রতি ।। ধানশী ।।

হলধর ভয়ে মালা নাহি পারে দিতে।
ফিরিয়া আইল সুখী করিয়া সঙ্কেতে।।
হেন কালে আইল কাক খাদ্য দ্রব্য বলে।
সেই হেতু নিল মালা ওষ্ঠে করি তুলে।।
আহার নাহিক হলো দিল ফেলাইয়া।
পবনে দিলেক তাহা বেগে উড়াইয়া।।
আসিয়া পড়িল ঠোঙ্গা চন্দ্রাবলী ঘরে।
খুলিয়া দেখিল মালা অতি মনোহরে।।
সঙ্কেত জানিয়া এথা খুঁজে শ্যাম রায়।
দেখিতে না পায় পুন সাতলী খেয়াল।।
এথা সেই মালা লয়ে আনন্দে পুরিল।
চন্দ্রাবেশ করি সেই মালা পরি এল।।
রাইকে দেখিবার তরে এল তার পাশ।
প্রশ্নেতে জানিল ভাল কহে চণ্ডীদাস।।

—————–

নায়িকার প্রতি সখী বাক্য ।। বালা-ধানশী ।।

এ সখি সুন্দরি কহ কহ মোয়।
কাহে লাগি তুয়া অঙ্গ অবশ হোয়।।
অধর কাঁপয়ে তুয়া ছল ছল আঁখি।
কাঁপিয়া উঠয়ে তনু কণ্টক দেখি।
মৌন করিয়া তুমি কি ভাবিছ মনে।
এক দিঠি করি রহ কিসের কারণে।।
বড়ু চণ্ডীদাসে কহে বুঝিলাম নিশ্চয়।
পশিল শ্রবণে বাঁশী অতত্ত্ব সে হয়।। *

——————-

* বি, প্র, প।

নায়িকার বাক্য ।। বিভাষ ।।

আমিত অবলা, তাহে এত জ্বালা, বিষম হইল বড়।
নিবারিতে নারি গুমরিয়া মরি, তোমারে কহিল দঢ়।।
সহজে আপন, বয়স যেমন, আর নহে হাম জানি।
স্বপনে ভালিয়া, সে রূপ কালিয়া, না রহে আপন প্রাণী।।
সই! মরণ ভাল।
সে বর নাগর, মরমে পশিল, ভাবিতে হইল কাল।।
কহে চণ্ডীদাসে, বাশুলী আদেশে, এইত রসের কূপ।
এক কীট হয়ে, আর দেহ পায়ে, ভাবিয়ে তাহার রূপ।। *

——————-

* বি, প্র, প।

নায়ক বাক্য ।। বিভাষ ।।

সেই কোন বিধি, আনি সুধানিধি, থুইল রাধিকা নামে।
শুনিতে সে বাণী, অবশ তখনি, মুরছি পড়ল হামে।।
সই! কি আর বলিব আমি।
সে তিন আখর, কৈল জ্বর জ্বর হইল অন্তর গামী।।
সব কলেরব, কাঁপে থর থর ধরণ না যায় চিত।
কি করি কি করি, বুঝিতে না পারি, শুনহ প্রাণ মিত।।
কহে চণ্ডীদাএ, বাশুলী আদেশে, সেই যে নবীন বালা।
তার দরশনে, বাড়িল দিগুণে, পরশে ঘুচব জ্বালা।। *

——————-

* বি, প্র, প।

অনুরাগ— সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

কি রূপ দেখিনু সই কদম্বের তলে।
লখিতে নারিনু রূপ নয়নের জলে।।
কি বুদ্ধি করিব সই কি বুদ্ধি করিব।
নিতি নব অনুরাগে পরাণ হারাব।।
কিবা নিশি কিবা দিশি কালা পড়ে মনে।
দেখিলে এমন হবে জানিব কেমনে।।
গৃহকাজে নাহি মন কর নাহি সরে।
শ্যাম নাম শুনিতে পুলকে অঙ্গ ভরে।
তাহে সে মোহন বাঁশী রাধা রাধা বাজে।
পরাণ কেমন করে মনু লোকে লাজে।।

——————-

লখিতে নারিনু – দেখিতে পারিলাম না।
মনু – মরিলাম।

অনুরাগ— প্রকারান্তরে ।। শ্রীরাগ ।।

যাবট নিকট দিয়া, যায় বেণু বাজাইয়া,
তখন আমি দুয়ারে দাঁড়ায়ে।
দেখি বলি আইনু আমি, ফিরিয়া না চাহিলে তুমি,
আঁখি রহিল চাঁদ মুখ চেয়ে।।
শ্রীদামের সঙ্গে সঙ্গে, নাচিতে নাচিতে রঙ্গে,
দাঁড়াইলে হলধরনের বামে।
কাঁদিতে কাঁদিতে হাম, হয়ে বাউরী নিয়ম,
প্রবেশিলাম ললিতার ধামে।।
তোঁহা রূপ গুণ স্মরি, ধৈরজ ধরিতে নারি,
মূরছিত মুরলীর গানে।
হৃদয়ে বাঢ়য়ে রতি, যে না মিলে পতী সতি,
কুলের ধরম নাহি জ্ঞানে।।

——————-

যাবট – বৃন্দাবনের একটি পল্লী।
হয়ে বাউরী নিয়ম – পাগলের মত হইয়া।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত