জন্ম
কী হল ব্যাপারটা মেকু ঠিক বুঝতে পারল না—প্রথমে টানা হ্যাঁচড়া চিৎকার হইচই তারপর হঠাত করে মনে হল কেউ যেন কুসুম কুসুম গরমের আরামের একটা জায়গা থেকে তাকে টেনে ঠাণ্ডা একটা ঘরে এনে ফেলে দিল। মেকু গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেবে কি না চিন্তা করল। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক ভদ্রতা হবে না বলে মাড়িতে মাড়ি চেপে পুরো যন্ত্রণাটা সহ্য করে অপেক্ষা করতে থাকে। আশেপাশে কিছু উত্তেজিত গলা শোনা যেতে থাকে—মানুষগুলি কী নিয়ে এরকম খেপে গেছে দেখার জন্যে মেকু খুব সাবধানে চোখ খুলে তাকাতেই প্রচণ্ড আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মেকু তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করল, কী সর্বনাশ! এত আলো কোথা থেকে এসেছে?
চারপাশের লোকজন এখনো খুব চেঁচামেচি করছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে ভয় পেয়েছে। কী নিয়ে ভয় পেয়েছে কে জানে। মেকু শুনল কেউ একজন বলল, “কী হল? বাচ্চা কাঁদে না কেন?”
কোন বাচ্চার কথা বলছে কে জানে! বাচ্চা কান্নাকাটি না করাই তো ভালো, এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কী আছে? কোন বাচ্চা কাঁদছে না মেকু সেটা চোখ খুলে একবার দেখবে কি না ভাবল কিন্তু চোখ ধাঁধানো আলোর কথা চিন্তা করে আর সাহস পেল না। শুনতে পেল ভয় পাওয়া গলায় মানুষটা আবার বলল, “সর্বনাশ! বাচ্চা যে এখনো কাঁদছে না!”
মোটা গলায় একজন বলল, “বাচ্চাটাকে উলটো করে ধরে পাছায় জোরে থাবা দাও।”
কোন বাচ্চার কপালে এই দুর্গতি আছে কে জানে। ছোট একটা বাচ্চাকে উলটো করে ধরে তার পাছায় থাবা দিয়ে কাঁদিয়ে দেওয়া কোন দেশী ভদ্রতা? এরা কি ধরনের মানুষ? মেকু চোখ খুলে এই বেয়াদব মানুষগুলিকে এক জনরে দেখবে কী না ভাবল, তার আগেই হঠাত করে কে যেন তার দুই পা ধরে তাকে চ্যাং দোলা করে উপরে তুলে ফেলল। তারপর উলটো করে ঝুলিয়ে কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড জোরে তার পাছায় একটা ভয়াবহ থাবড়া মেরে বসে। মেকুর মনে হল শুধু তার পাছা নয় শরীরের হাড়, মাংস, চামড়া সবকিছু চিড়বিড় করে জ্বলে উঠেছে।
ভয় পাওয়া মানুষটা এবারে চিৎকার করে উঠল, “কী সর্বনাশ! এখনো দেখি কাঁদছে না।”
মেকু প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু যে ধরেছে তার হাত লোহার মতো শক্ত, সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। কিছু বোঝার আগেই শক্ত লোহার মতো হাত দিয়ে আবার তার পাছায় কেউ একজন একটা ভয়াবহ থাবড়া বসিয়ে দিল, সেই থাবড়া খেয়ে মেকুর মনে হল তার শরীরের ভিতর সবকিছু বুঝি ওলট পালট হয়ে গেল। হঠাত করে মেকু বুঝতে পারল যে বাচ্চাটা কাঁদছে না বলে সবাই খুব ভয় পেয়ে গেছে সেই বাচ্চাটা সে নিজে, এবং যতক্ষণ সে তার গলা ছেড়ে বিকট গলায় কাঁদতে শুরু না করবে ততক্ষণ শক্ত লোহার হাত দিয়ে তার পাছায় একটার পর একটা থাবড়া মারতেই থাকবে।
মেকু আর দেরি করল না, গলা ফাটিয়ে বিকট গলায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল, সাথে সাথে ঘরে একটা আনন্দধ্বনি শোনা যায়। মোটা গলায় মানুষটা বলল, “আর ভয় নাই। বাচ্চা কেঁদেছে।”
ভয় যখন নেই এখন কাঁদা থামাবে কিনা মেকু বুঝতে পারল না। কিন্তু শেষে সে কোনো ঝুঁকি নিল না, চোখ পিট পিট করে তাকাতে তাকাতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। মোটা গলার মানুষটা খুশি খুশি গলায় বলল, “ওয়ান্ডারফুল! কী চমৎকার কাঁদছে দেখ। কী শক্ত লাংস!”
মেকু বুঝতে পারল না কাঁদা কেমন করে চমৎকার হয় আর তার সাথে শক্ত লাংসের কী সম্পর্ক। সে শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এতদিন মায়ের পেটে কী আরামে ছিল, খাওয়ার চিন্তা নেই, ঘুমানোর চিন্তা নেই, বাথরুম যাবার সমস্যা নেই, আর সেখান থেকে বের হতে না হতেই এ কী সমস্যা?
মেকু টের পেল কেউ একজন তাকে আচ্ছা করে দলাই মলাই করে মুছোমুছি করছে। শরীর মুছে একটা কাপড়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েলি গলায় কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “দেব এখন মায়ের কাছে?”
মেকু প্রায় চিৎকার করে বলেই ফেলছিল, “দেবো না মানে? এক শ বার দেবে—” কিন্তু এখানকার ব্যাপার-স্যাপার ভালোমতো না বুঝে কিছু বলা উচিত হবে বলে মনে হয় না। মেকু চুপ করে রইল, শুনল ভারী গলায় একজন বলছে, “না এখন মায়ের কাছে দেবেন না। মা খুব টায়ার্ড। পাজি ছেলেটার ডেলিভারিতে মায়ের কী কষ্ট হয়েছে দেখছেন না?”
মেকু খুব চটে উঠল, তাকে পাজি বলছে কত বড় সাহস? রেগেমেগে সে কিছু একটা বলেই ফেলছিল কিন্তু লোহার মতো শক্ত হাতের সেই ভয়ংকর থাবড়ার কথা মনে করে চুপ করে রইল। চোখ পিট পিট করে সে মানুষটাকে এক নজর দেখে নিল, শুকনো মতন একজন মানুষ, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ।
গোলগাল মোটা সোটা একজন নার্স মেকুকে বুকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “হি হি হি ডাক্তার সাহেব দেখছেন? কেমন চোখ কটমট করে আপনার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি পাজি বলেছেন, সেটা বুঝতে পেরেছে!”
শুকনো মতন মানুষটা—যার গোঁফের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছ! এই ছেলে জন্মের সময় মা’কে যত কষ্ট দিয়েছে মনে হচ্ছে সারা জীবনই কষ্ট দেবে!”
মেকু কিছু না বলে চুপ করে শুয়ে রইল। সত্যিই সে মা’কে কষ্ট দিয়েছে নাকি? সে ইতি উতি করে দেখার চেষ্টা করল, মা মনে হয় পাশের বিছানায় নেতিয়ে শুয়ে আছে। এখান থেকে ঝাঁপিয়ে মায়ের বুকে পড়ার ইচ্ছে করছে কিন্তু তাকে যেতে দেবে বলে মনে হয় না। ঝাঁটার মতো গোঁফের ডাক্তার বলল, “বাচ্চাটাকে নিয়ে নার্সারিতে রাখেন, মা খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিক।”
নার্স ইতস্তত করে বলল, বাচ্চার নানি, খালা, দাদি, চাচা-চাচি সবাই বাচ্চা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
“করুক। বলনে জানালা দিয়ে দেখতে।”
মেকু টের পেল নার্স তাকে জড়িয়ে ধরে নার্সারি নিয়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে সে তার মা’কে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু ভালো করে দেখতে পেল না।
নার্সারি ঘরে সারি সারি ছোট ছোট বিছানা, সেখানে আরো কিছু বাচ্চা কাদার মতো ঘুমিয়ে আছে। নার্স মেকুকে খালি একটা বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে গেল। খালি ঘর, আশে পাশে আর কেউ নেই। মেকু এদিক ওদিক তাকাল এবং তখন তার নজরে পড়ল আশেপাশে ছোট ছোট বিছানাগুলিতে একটা করে বাচ্চা শুয়ে আছে। মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখল ঠিক তার পাশের বিছানাতেই গাবদাগোবদা একটা বাচ্চা শুয়ে আছে। সে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “এই। এই বাচ্চা—”
বাচ্চাটা কো কো করে একটু শব্দ করল কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। মেকু আবার ডাকল, “এই বাচ্চা। উঠ না—”
বাচ্চাটা এবারে চোখ পিট পিট করে তাকাল, মেকু জিজ্ঞেস করল, “কী হল? কথা বল না কেন? কী নাম তোমার?”
বাচ্চাটা বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর জন্যে প্রস্তুত হয়। মেকু রেগে গিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলল, “বেশি ঢং হয়েছে নাকি? একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, কানে যায় না?”
মেকুর ধমক খেয়ে বাচ্চাটা হঠাত চমকে উঠে ঠোঁট উলটে কাঁদতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর গলা ফাটিয়ে। তার কান্না শুনে পাশের জনও জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করল এবং তার দেখাদেখি অন্য সবাই। মনে হল ঘরে বুঝি কান্নার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
এতজনের কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে নার্স ছুটে এসে বাচ্চাগুলিকে শান্ত করতে থাকে। একজন একজন করে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন মেকু নার্সকে বলল, “এই যে, শুনেন।”
নার্স হঠাত করে ভয়ে একটা চিৎকার করে উঠে, তার কথায় এভাবে চিৎকার করে ওঠার কী আছে মেকু বুঝতে পারছে না। মেকু তার হাত নাড়ার চেষ্টা করে আবার ডাকল, “এই যে, এদিকে—”
নার্স আবার একটা চিৎকার করে উঠে—এখনো মেকুকে দেখতে পায় নি। মেকু আবার ডাকার আগেই নার্স হঠাত করে গুলির মতো ছুটে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল। কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে, হঠাত করে কী দেখে ভয় পেল কে জানে। মহা মুশকিল হল দেখি, মেকু খুব বিরক্ত হল। প্রচণ্ড বাথরুম পেয়েছে কিন্তু ঠিক কীভাবে করবে বুঝতে পারছে না, যেভাবে বাথরুম চেপেছে, জামাকাপড় ভিজিয়ে ফেলার একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে—তা হলে কী লজ্জারই না একটা ব্যাপার হবে।
মেকু দরজায় একটা শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, দেখতে পেল নার্সটা আবার ফিরে এসেছে এবারে সাথে বয়স্কা আরেক জন নার্স। বয়স্কা নার্সটা বলল, “এখানে কেউ একজন তোমাকে ডেকেছে?”
“হ্যাঁ।”
“এখানে কে ডাকবে? কেউ তো নেই। শুধু বাচ্চাগুলি।”
“আমি স্পষ্ট শুনলাম। প্রথমে বলল, ‘এই যে শুনেন’। তারপর বলল, ‘এই যে, এদিকে—’”
“কী রকম গলা?”
“ছোট বাচ্চার মতো গলা।”
বয়স্কা নার্সটা এবার হো হো করে হেসে বলল, “তুমি বলছ কোনো একটা বাচ্চা তোমাকে ডেকেছে?”
ভয় পাওয়া নার্সটা ইতস্ততঃ করে বলল, “না, মানে ইয়ে—”
বয়স্কা নার্সটা ভয় পাওয়া নার্সটার হাত ধরে বলল, “আসলে আজকে ডাবল ওভার টাইম করে তুমি বেশি টায়ার্ড হয়ে গেছ, তাই এরকম মনে হচ্ছে। বাসায় গিয়ে একটা টানা ঘুম দাও দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ। তাই করতে হবে।”
“কথাটা আমাকে বলেছ ঠিক আছে। আর কাউকে বল না। বাচ্চারা জন্মানোর সাথে সাথে তোমাকে ডাকাডাকি করছে শুনলে সবাই ভাববে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।”
নার্স দুই জন নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মেকু এবারে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, নার্স দুজনের কথা শুনে মনে হচ্ছে তার কথা বলার ব্যাপারটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। কী কারণ? অন্য পাশের বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করে দেখবে নাকি? মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখল একেবারে কাদার মতো ঘুমাচ্ছে ডেকে লাভ হবে মনে হয় না। এরকমভাবে ঘুমাচ্ছে যে দেখে মেকুরও নিজের চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে, জেগে থাকাই মনে হয় মুশকিল হয়ে যাবে। তার সাথে এখন আরেক যন্ত্রণা শুরু হল, বেশ কিছুক্ষণ থেকেই টের পেয়েছে এখন সেটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। চেপে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কী করবে বুঝতে না পেরে সে ছটফট করতে থাকে এবং কিছু বোঝার আগেই হঠাত করে তার বাথরুম হয়ে গেল। নিজের কাপড়ে বাথরুম? কী লজ্জা! কী লজ্জা! যখন অন্যেরা বুঝতে পারবে তখন কী হবে? জন্ম হয়েছে এখনো এক ঘণ্টা হয়নি তার মাঝে সে এরকম একটা লজ্জার কাজ করে ফেলল? সর্বনাশ!
মেকু অত্যন্ত অশান্তিতে খানিকক্ষণ ছটফট করে ভেজা কাপড়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখতে পেল নার্স আর ডাক্তার মিলে তার কাপড় খুলে ফেলেছে, কী লজ্জার কথা। যখন দেখবে সে নিজের জামা কাপড়ে বাথরুম করে ফেলেছে নিশ্চয়ই কী রকম রেগে যাবে। আবার ধরে একটা থাবড়াই দেয় নাকি কে জানে! মেকু ভয়ে ভয়ে নার্স আর ডাক্তারের দিক তাকিয়ে রইল।
কিন্তু ঠিক উলটো ব্যাপার হল, ডাক্তার খুশি খুশি গলায় বলল, “পারফেক্ট! বাচ্চা পেশাবও করে ফেলেছে। ভেরি গুড! শুকনো একটা ডাইপার পরিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে যান। বেচারি মা আর অপেক্ষা করতে পারছে না।”
মেকু লজ্জার মাথা খেয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল, নার্স তাকে পুরো ন্যাংটো করে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে, কী লজ্জার কথা। একজন অপরিচিতা মহিলা তাকে এভাবে ন্যাংটো করে ফেলছে, ছিঃ ছিঃ ছিঃ! মেকু লজ্জায় লাল হয়ে শুয়ে রইল। শুকনো কাপড় পরিয়ে নার্স তাকে তুলে নেয় তারপর বুকে চেপে হেঁটে যেতে থাকে। মেকু একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, ভুল করে তাতে অন্য কোনো মায়ের কাছে দিয়ে দেবে না তো?
মা বিছানায় আধ-শোয়া হয়ে শুয়েছিলেন, নার্স মেকুকে মায়ের বুকের ওপর শুইয়ে দিল। মেকু একবার বুক ভরে ঘ্রাণ নেয়। কোনো সন্দেহ নেই—এই হচ্ছে তার মান—তাকে ভুল করে অন্য কোনো মায়ের কাছে দিয়ে দেয় নি। মায়ের শরীরের ভিতরে সে কতদিন কাটিয়েছে, কী পরিচিত মায়ের শরীরের এই ঘ্রাণ—আহা! কী ভালোই না লাগল মেকুর। মা মেকুকে বুকে চেপে ধরে তার গালে ঠোঁট স্পর্শ করে আদর করলেন। মেকু চেষ্টা করল হাত দিয়ে মা’কে ধরে ফেলতে কিন্তু হাত-পা-গুলি এখনো ঠিক করে ব্যবহার করা শেখে নি, ডান দিকে নিতে চাইলে বাম দিকে চলে যায়, বাম দিকে নিতে চাইলে ওপরে ওঠে যায়, তাই মা’কে ধরতে পারল না। মা মেকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, আঙুলগুলি মেলে ধরলেন, পায়ের পাতায় চুমু খেলেন, নাক টেনে দিলেন, পেটের মাঝে কাতকুতু দিলেন। মেকু চোখ খোলা রেখে পুরো আদরটা উপভোগ করল। জন্মের পর থেকে যে তার ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা ছিল, দুশ্চিন্তা ছিল—এখন সব কেটে গেছে। এখন আর তার ভিতরে কোনো চিন্তা নেই। সে জানে তার মা তাকে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষ করবে। খিদে পেলে খেতে দেবে, ঘুম পেলে বুকে চেপে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, বাথরুম পেলে বাথরুম করিয়ে দেবে আর যখন সেই খারাপ খারাপ ডাক্তারগুলি শক্ত লোহার মতো হাত দিয়ে থাবড়া দিতে আসবে তাদের হাত থেকে রক্ষা করবে। পৃথিবীর কারো কোনো সাধ্যি নেই এখন তার কোনো ক্ষতি করে। আসুক না সেই ব্যাটাম যে তার পাছায় থাবড়া দিয়েছিল, মা একেবারে তার বারটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে না?
নার্স বলল, “আপনার ছেলের চোখগুলি দেখেছেন?”
মা মাথা নাড়লেন, “দেখেছি।”
“দেখে মনে হয় সবকিছু বোঝে।”
মা কিছু বললেন না, একটু হেসে মেকুকে আবার সাবধানে বুকে চেপে আদর করলেন। নার্স বলল, “আপনার সব আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা করছে। আসবে বলব?”
মা তার গায়ের কাপড় টেনে টুনে ঠিক করে বললেন, “বলেন।”
নার্স বের হয়ে যাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই অনেকগুলি মানুষ এসে ঢুকল। নানা বয়সের মানুষ, কেউ মোটা, কেউ চিকন, কেউ বয়স্ক, কেউ বাচ্চা, কেউ পুরুষ এবং কেউ মহিলা। সবাই একসাথে কথা বলতে বলতে মেকু আর তার মায়ের কাছে ছুটে আসতে শুরু করে দিল কিন্তু নার্স পুলিশ সার্জেন্টের মতো দুই হাত তুলে তাদের মাঝপথে থামিয়ে দিল। মুখ শক্ত করে বলল, “আপনারা কেউ বেশি কাছে আসবেন না।”
বয়স্কা একজন মহিলা বলল, “কেন কাছে আসব না? আমরা নাতিকে দেখবে না?”
“আগে ভালো করে হাত ধুয়ে আসেন। ওই যে বেসিন আছে। বেসিনে সাবান রাখা আছে।”
“কেন? হাত ধুতে হবে কেন?”
“কারণ আপনারা বাইরে থেকে এসেছেন। আর যাকে দেখতে এসেছেন তার মাত্র কিছুক্ষণ হল জন্ম হয়েছে।”
“আমাদের কি বাচ্চাকাচ্চা হয় নি?” বয়স্কা মহিলাটি খনখনে গলায় তর্ক করতে লাগল, “আমরা কি বাচ্চা মানুষ করি নি?”
নার্সটি বলল, “অবিশ্যিই করেছেন। আপনারা করেছেন আপনাদের মতো, আর আমরা করছি আমাদের মতো। এটাই আমাদের নার্সিং হোমের নিয়ম।”
“কী রকম নার্সিং হোম এটা? বাচ্চা জন্মানোর পর আলাদা ফেলে রাখল, এখন ধরতে দেবে না।”
“এটাই নিয়ম। আপনারা এই নিয়ম মেনেই আমাদের নার্সিং হোমে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন।” নার্স কঠিন মুখ বলল, “সবাই হাত ধুয়ে আসেন। যারা ছোট তারা যেন কাছাকাছি না আসে।”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল ফরসা মতন একজন মানুষ সবার আগে হাত ধুয়ে এগিয়ে এল। মানুষটা মায়ের কাছে এসে মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওমা! শানু, দেখতে দেখি একেবারে তোমার মতো হয়েছে!”
মা একটু হেসে বললেন, “কে বলেছে আমার মতো?”
“হ্যাঁ। একেবারে তোমার মতো। এই দেখ একেবারে তোমার মতো নাক।”
মেকু তাকিয়ে মায়ের নাকটা দেখল, কী সুন্দর মায়ের নাক। যদি সত্যি মায়ের মতো নাক হয়ে থাকে তাহলে তো ভালোই হয়। মেকু নিজের নাকটা দেখার চেষ্টা করল কিন্তু দেখতে পেল না। মানুষ নিজের নাক নিজের কেমন করে দেখে কে জানে।
খনখনে গলায় সেই বয়স্কা মহিলাটি বলল, “কে বলেছে তোমার বউয়ের মতো নাক? এর তো দেখি নাকই নাই।”
মহিলার কথা শুনে ঘরের অনেকে হি হি করে হেসে উঠে। মেকু চোখ পাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল কে কথাটা বলেছে আর কারা কারা হাসছে। তাকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে দেখে সবাই আবার হি হি করে হেসে উঠল, মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফরসা মতন মানুষটা বলল, “দেখেছ? মনে হচ্ছে সবার কথা বুঝতে পারছে।”
মেকু একবার ভাবল বলেই ফেলে, “অবশ্যি বুঝতে পারছি! বুঝতে পারব না কেন? আমাকে কি গাধা পেয়েছ না বেকুব পেয়েছ?” কিন্তু সে কিছু বলল না, তার মাত্র জন্ম হয়েছে, পৃথিবীর নিয়ম কানুন সে কিছুই জানে না, উলটা পালটা কাজ করে সে কোনো ঝামেলায় পড়তে চায় না।
খনখনে গলায় বয়স্কা মহিলাটি বলল, “দেও দেখি বউমা তোমার বাচ্চাটা একটু কোলে নিয়ে দেখি।”
পিছন থেকে একজন বলল, “না চাচি, আগে বাবার কোলে দেয়া যাক, দেখি বাবা কী করে!”
বয়স্কা মহিলাটি একটু অসন্তুষ্ট হল মনে হল, কিন্তু মুখে জোর করে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, “হ্যাঁ হাসান, তুই আগে কোলে নে। তুই যখন বাবা, ছেলেকে তো তুইই আগে কোলে নিবি।”
মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাবাটা কে। দেখল মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফরসা মতন মানুষটাই হচ্ছে বাবা। বাবাকে কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সে ঠিক বুঝতে পারল না। বাচ্চাকে শরীরের ভিতরে রেখে বড় করার পুরো কাজটা তো মা একাই করেছে, আর কাউকে তো তখন আশেপাশে দেখে নি। এখন হঠাত করে বাহাবা নেওয়ার জন্যে অনেকে এসে হাজির হচ্ছে মনে হল।
মা সাবধানে ফরসা মতন মানুষটার কাছে মেকুকে তুলে দিল। মানুষটা যত্ন করে দুই হাতে ধরে মেকুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “ওমা। এইটুকুন একজন মানুষ।”
বয়স্কা মহিলাটা খনখনে গলায় বলল, “এই টুকুনই ভালো। যখন বড় হবে তখন দেখবি গাঞ্জা খাওয়া শিখবে, ফেনসিডিল খাওয়া শিখবে, মাস্তানি করবে, চাঁদাবাজি করবে—”
বাবা মেকুকে বুকে চেপে ধরলেন, বললেন, “কী বলছেন চাচি! আমার ছেলে মাস্তানি করবে?”
বয়স্কা মহিলাটি হড়বড় করে কথা বলতে লাগল, মেকু সেদিকে কান না দিয়ে তার বাবার দিকে তাকাল। মানুষটা ভালোই মনে হচ্ছে, তার জন্যে অনেক আদর রয়েছে। মেকুর বেশ পছন্দই হল মানুষটাকে।
বয়স্কা মহিলাটা এবারে একটু কাছে এগিয়ে এসে বাবাকে বলল, “দে হাসান আমার কাছে দে দেখি। পাজি ছেলেটাকে একবার কোলে নেই।”
মেকু তার বাবাকে ধরে রাখার চেষ্টা করল, এই বুড়ির কাছে তার একটুও যাবার ইচ্ছে নেই। কিন্তু সে এখনো হাত দুটি ভালো করে ব্যবহার করা শেখে নি, বাবাকে ভালো করে ধরতে পারল না, শুধু হাত দুটি ইতস্তত নড়তে লাগল। বুড়ি মহিলাটি আরো একটু এগিয়ে এল, হাত বাড়িয়ে মেকুকে ধরতে ধরতে বলল, “ওই তোরা ক্যামেরা এনেছিস না? একটা ছবি তুলিস না কেন?”
কে একজন ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে এল, বুড়ি মেকুর আরো একটু কাছে এসেছে। তখন মেকু প্রথমবার তার পা ব্যবহার করল। বুড়ির মুখটা কাছাকাছি আসতেই দুই পা ভাঁজ করে আচমকা বুড়ির নাকে শক্ত করে লাথি কষিয়ে দিল—ঠিক তখন ক্যামেরায় ফ্লাশ জ্বলে উঠল। মনে হল একেবারে মোক্ষম লক্ষভেদ হয়েছে, কারণ মেকু শুনতে পেল ঘরের সবাই হি হি করে হেসে উঠেছে। বুড়ি মহিলাটি নিজের নাক চেপে ধরে পিছিয়ে যায়, এখনো সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, কয়েক ঘণ্টা বয়স হয়েছে একটা ছেলে এত জোরে তাকে লাথি মেরে বসেছে। বুড়ি নিজের নাকে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “আমি বলেছি না ছেলে বড় হয়ে মাস্তানী করবে। এখনই তার নিশানা দেখাতে শুরু করেছে, লাথি ঘুষি মারতে শুরু করেছে।”
বাবা বললেন, “না চাচি। আপনি তো বলেছেন আমার ছেলে বড় হয়ে মাস্তান হবে সেজন্যে রেগে গিয়েছে!”
বুড়ি খনখনে গলায় বলল, “নে অনেক হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা হলো বাপ হয়েছিস, এখনই ছেলের হয়ে দালালি শুরু করে দিয়েছিস।”
বুড়ি আবার দুই হাত বাড়িয়ে মেকুর কাছে এগিয়ে আসে। মেকু তক্কে তক্কে ছিল, হাত দিয়ে কিছু ধরাটা এখনো শেখে নি। কিন্তু দুই পা দিয়ে শক্ত করে একটা লাথি মেরে দেওয়াটা মনে হয় সে শিখেই গিয়েছে। বুড়ি আরেকটু নিচু হয়ে যখন কাছাকাছি চলে এল তখন আচমকা দুই পা ভাজ করে একেবারে সমস্ত শক্তি দিয়ে আবার লাথি কষিয়ে দিল, আগের চেয়ে অনেক জোরে। বুড়ি এবারে কোঁক করে একটা শব্দ করে পিছিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে পা বেধে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক জন সময়মতো তাকে ধরে না ফেললে সত্যি সত্যি একেবারে মেঝেতে লম্বা হয়ে পড়ে যেত।
আগের বার সবাই যেভাবে জোরে হেসে ওঠেছিল এবার কেউ সেভাবে জোরে হাসল না, মুখে কাপড় দিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। বুড়ি চেয়ারে বসে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেয়। শাড়ির আঁচল দিয়ে খানিকক্ষণ নাক ঢেকে রাখে, তারপর উঠে দাঁড়ালো, তার মুখ এবারে হিংস্র হয়ে ওঠেছে। চোখ দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হচ্ছে, বুড়ি নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসে। মেকুর বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। এই বুড়ি এখন তার কোনো ক্ষতি করে ফেলবে না তো? এখন একটাই উপায়, সেটা হচ্ছে মায়ের কাছে চলে যাওয়া। মা’ই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে। মেকু এবারে সারা শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, মুখ হা করে জিভ বের করে এত জোরে কাঁদতে আরম্ভ করল যে বাবা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি মেকুকে মায়ের হাতে দিয়ে দিলেন। মেকু সাথে সাথে মাকে শক্ত করে ধরে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। হাত পুরোপুরি ব্যবহার করা শেখে নি তবু কষ্ট করে সে মায়ের কাপড় এখানে সেখানে ধরে ফেলল। মা মেকুকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কাঁদিস না বাবা! আমি আছি না?”
মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফেলল, সত্যিই তো, তার মা আছে না? কার সাধ্যি আছে ধরে কাছে আসে।
ঘরে যারা আছে তাদের একজন বলল, “দেখেছ, দেখেছ—মা’কে কেমন চিনেছে? মায়ের কাছে গিয়েই একেবারে শান্ত হয়ে গেল।”
বুড়ি দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে কী একটা কথা বলতে এসেছিল, কিন্তু ঠিক তখন দরজা খুলে ডাক্তার এসে ঢুকল। শুকনো মতন ডাক্তার, কাঁচাপাকা চুল এবং নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ। ঘরের ভেতরে এত মানুষ দেখে ডাক্তার বলল, “আপনারা কিন্তু এখানে ভিড় করবেন না। বাচ্চাকে সবার কোলে নেওয়ার দরকার নেই। দূর থেকে একবার দেখে চলে যান।”
বুড়ি গজগজ করে বলল, “বাচ্চার যা মেজাজ, কোলে নেয়ার ঠ্যালা আছে।”
ডাক্তার বাবার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই মি. হাসান। কংগ্র্যাচুলেশন।”
বাবা একটু হেসে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
“কী চেয়েছিলেন আপনি? ছেলে না মেয়ে?”
“আমি আর কী চাইব! আমার স্ত্রী আগের থেকেই জানত যে তার ছেলে হবে!”
“তাই নাকি? অ্যামনিওসিণ্টোসিস করেছিলেন নাকি?”
“না না, সেরকম কিছু না। কোনো মেডিক্যাল ডায়াগনসিস না। তার এমনিতেই নাকি মনে হত যে বাচ্চাটা ছেলে!”
বাবা যেন খুব একটা মজার কথা বলেছেন সেরকম ভান করে ডাক্তার হা হা করে হেসে উঠে। হাসি থামিয়ে সে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। একটু ঝুঁকে পড়ে মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ডেলিভারির পর যা ভয় পেয়েছিলাম!”
“কেন? কী হয়েছিল?”
“ডেলিভারির পর বাচ্চা বাতাসের অক্সিজেন দিয়ে তার লাংস ব্যবহার শুরু করে। সেটা শুরু হয় বিকট একটা কান্না দিয়ে! সেই জন্যে সব বাচ্চা জন্মানোর পর কেঁদে ওঠে। কিন্তু আপনার বাচ্চা জন্মানোর পর কাঁদছিল না।”
“সর্বনাশ! তারপর?”
“তারপর আর কী? উলটো করে ধরে পাছায় একটা থাবা মেরে দিলাম—দুই নম্বর থাবাটা খেয়েই বাচ্চার সে কী চিৎকার!” ডাক্তার যেন খুব মজার একটা গল্প বলছে সেইরকম ভাব করে হা হা করে হাসতে লাগল।
মেকু চোখের কোনা দিয়ে ডাক্তারকে দেখতে লাগল। এই তা হলে সেই ডাক্তার যে লোহার মত শক্ত হাত দিয়ে তার পাছায় এত জোরে থাবড়া মেরেছিল। কত বড় সাহস একবার কাছে এসে দেখুক না। বুড়িকে যেভাবে জোড়া পায়ে লাথি মেরেছিল সেইভাবে একটা লাথি বসিয়ে দেবে।
ডাক্তার অবিশ্যি বেশ কাছে এসে তাকে পরীক্ষা করতে লাগল কিন্তু মাথার কাছে থাকায় মেকু বেশি সুবিধে করতে পারল না। হাত দিয়ে অন্তত একটা খামচি দিতে পারলেও খারাপ হয় না। কিন্তু এখনো হাতের ব্যবহারটা ভালো করে শিখতে পারে নি। মেকু তবু একবার চেষ্টা করল, ডাক্তারের মুখটা কাছে আসতেই তার নাকে একটা খামচি দেওয়ার চেষ্টা করল, খামচিটা লাগল না। কিন্তু কিছু একটায় তার হাত লেগে যাওয়ায় সে শক্ত করে ধরে ফেলল।
ডাক্তার অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, “কী আশ্চর্য! আমার চশমাটা ধরে ফেলেছে।”
মেকু মনে মনে বলল, তোমার কপাল ভালো যে নাকটা ধরতে পারি নি। ধরতে পারলে দেখতে কী মজা হত। কিন্তু এই চশমাও আমি ছাড়ছি না।
খুব একতা মজা হচ্ছে এরকম ভান করে ডাক্তার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মেকু চশমা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল এবং চশমাটা ডাক্তারের নাক থেকে ছুটে এল। মেকু এখনো তার হাত আর হাতের আঙুলকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে শিখে নি। তাই চশমাটা ধরে রাখতে পারল না, হাত থেকে সেটা ছুটে গেল এবং শূন্যে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল, শব্দ শুনে মনে হল কাচ ভেঙ্গে এক শ টুকরো হয়ে গেছে।
ডাক্তার কাতর গলায় বলল, “চশমা! আমার চশমা!”
কে একজন তুলে এনে চশমাটা ডাক্তারের হাতে দেয়, একটা কাচ ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে, অন্যটা তিন টুকরো হয়ে কোনো মতে ঝুলে আছে। ডাক্তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। দুর্বল গলায় বলল, “আমার এত দামি চশমা! আমেরিকা থেকে আনিয়েছিলাম, সিংগল লেন্স, বাইফোকাল, ননস্ক্রেচ গ্লাস। চার শ ডলার দিয়ে কিনেছিলাম।”
বাবা এগিয়ে এসে অপরাধীর মতো বললেন, “আমি খুবই দুঃখিত ডাক্তার সাহেব। আপনার চশমাটা এইভাবে ভেঙে ফেলবে—”
ডাক্তার সাহেব চশমাটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে জন্মের পর কখনো কখনো প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা ছোট বাচ্চাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো থাকে। আপনার এই বাচ্চার মনে হয় রিফ্লেক্স খুব ভালো। কীভাবে তাকিয়ে আছে দেখছেন? যেন সবকিছু বুঝতে পারছে!”
সবাই চলে যাবার পর মা বাবাকে বললেন, “ডাক্তার সাহেব বলছেন না জন্মের পর প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা বাচ্চাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো থাকে?”
“হ্যাঁ।”
“আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
মা লাজুক মুখে হেসে বললেন, “আমার এই বাচ্চার শুধু যে রিফ্লেক্স ভালো তা নয়, আসলে—”
“আসলে কী?”
“আসলেই সে সব বুঝতে পারে।”
বাবা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “আসলে সব বুঝতে পারে?”
“হ্যাঁ। তোমার চাচি সব খারাপ খারাপ কথা বলছিল তাই তাকে কেমন শাস্তি দিল দেখলে না? কিছুতেই তার কাছে যেতে রাজি হল না।”
বাবা মুখ হাঁ করে কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঢোক গিলে বললেন, “তুমি বলতে চাইছ সে সবকিছু বুঝে করেছে? ডাক্তার সাহেবের চশমা ভাঙার ব্যাপারটাও?”
“হ্যাঁ। যখন শুনল পাছায় থাকা দিয়েছেন তখন রেগে গেল। তার ভালোর জন্যেই করেছেন সেটা বুঝতে পারে নি। ছেলে মানুষ তো! মেকুর জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা—”
“মেকু?”
মা লাজুকভাবে হেসে বললেন, “হ্যাঁ। আমি ওকে সবসময় মেকু ডাকি।”
“সবসময়? ওত তো জন্ম হল মাত্র ঘণ্টা।”
“তাতে কী হয়েছে? মেকু আমার পেটে ছিল না নয় মাস? তখন থেকে তাকে আমি মেকু ডাকি।”
বাবা হাত নেড়ে কথা বলার জন্য কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে কিছুই খুঁজে পেলেন না। একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “যখন পেটে ছিল তখন থেকে তাকে ডাকাডাকি করেছে?”
“মনে নেই তোমার?” মা চোখ বড় বড় করে বললেন, “মেকুকে গান শোনাতাম, কথা বলতাম, বই পড়ে শোনাতাম!”
বাবার মনে পড়ল, তখন ভেবেছিলেন এক ধরনের কৌতুন—এখন দেখা যাচ্ছে মোটেও কৌতুক নয়, মা ব্যাপারটিতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাবা খানিকক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন, “তুমি তো জান, বাচ্চারা যখন জন্ম নেয় তখন তারা কিছুই বুঝে না। তারা তখন অপারেটিং সিস্টেম বিহীন একটা কম্পিউটারের মতো। যখন বড় হয় তখন তারা সবকিছু শিখে—”
মা বাধা দিয়ে বললেন, “আমি সব জানি। ডক্টর স্পকের বই আমি গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি।”
“তা হলে?”
“তা হলে কী?”
“তা হলে তুমি কেমন করে বলছ তোমার ছেলে সব কিছু জানে?”
মা হাসলেন, বললেন, “সেই জন্যে তুমি হচ্ছ বাবা আর আমি হচ্ছি মা! মা তাদের বাচ্চাদের সবকিছু জানে। বাবারা জানে না।”
বাবা কী বলবেন, বুঝতে পারলেন না। তাই বললেন, “ও।”
মা মেকুকে বুকে চেপে ধরে বললেন, “আমি জানি আমার মেকু হচ্ছে অসাধারণ।”
বাবা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “পৃথিবীর সব বাবা মা জানে যে তাদের বাচ্চারা অসাধারণ। সেটা কোনো দোষের ব্যাপার না।”
মা বললেন, “শুধু এখানে পার্থক্য হল যে আমার মেকু আসলেই অসাধারণ। আমি যদি এখন মেকুকে বলি, বাবা মেকু তুমি হাস, তা হলেই দেখতে সে মাড়ি বের করে হাসবে। যদি বলি বাবা মেকু তুমি তোমার পা উপরে তুলো, সে তুলবে। যদি বলি—”
বাবা বাধা দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তা হলে বল দেখি মাড়ি বের করে হাসতে—”
মা বাবার দিকে আহত চোখে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সত্যিই মনে কর আমি আমার নিজের বাচ্চাকে বিশ্বাস করব না? তাকে পরীক্ষা করে দেখব?”
বাবা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তুমি যা বলছ আমি তাই বিশ্বাস করছি। শুধু একটা কথা।”
“কী?”
“তুমি সত্যিই আমাকের বাচ্চাকে মেকু বলে ডাকবে?”
মা চোখ বড় বড় করে বললেন, “কেন? অসুবিধে আছে?”
বাবা মাথা চুলকালেন, বললেন, “না, তোমার নাম যদি ঘিড়িংগা সুন্দরী হত তা হলে কি অসুবিধা হত?”
মা কঠিন মুখে বললেন, “তার মানে তুমি বলতে চাইছ মেকু নামটা তোমার পছন্দ হয় নি। তুমি তা হলে আগে বল নি কেন?”
“আগে আমি কেমন করে বলব? বাচ্চার জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, এখন শুনছি তার নাম মেকু।”
“আগে যখন তাকে মেকু বলে ডেকেছি তখন তো তুমি আপত্তি কর নি।”
বাবা মাথা নেড়ে বললেন, “তখন তো আমি বুঝতে পারি নি যে তুমি সত্যি সত্যি ডেকেছ। তখন তো বাচ্চা ছিল তোমার পেটের ভিতরে। আমি ভেবেছি তুমি ঠাট্টা করছ।”
মা কঠিন মুখে বললেন, “তুমি যদি মা হতে তা হলে বুঝতে, মায়েরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে কখনো ঠাট্টা তামাশা করে না।”
আব্বা ভয়ে ভয়ে বললেন, “তা হলে আমাদের ছেলের পুরো নাম কী হবে? মেকু আহমেদ?”
মা বললেন, “না। তুমি তোমার পছন্দ মতো ভালো একটা নাম রাখতে পার। সমুদ্র আহমেদ কিংবা তরঙ্গ আহমেদ কিংবা সৈকত আহমেদ। তবে আমার কাছে আমার ছেলে হবে মেকু। মেকু, মেকু এবং মেকু।”
বাবা এবং মা’র মাঝে যখন কথা হচ্ছিল তখন মেকু পুরো কথা বার্তাটি চুপ করে শুনেছে। মাঝে মাঝেই যে তার মা’র পক্ষে একটা-দুইটা কথা বলার ইচ্ছে করে নি কিংবা হাত পা নেড়ে কিছু একটা করার ইচ্ছে করে নি তা নয়, কিন্তু সে কিছু করে নি। খুব ধৈর্য্য ধরে চুপ করে থেকেছে। বাবা নামক মানুষটা তার মা’র সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলেছে সেটা থেকে মেকু দুইটা জিনিস বুঝতে পেরেছে। এক: বাবা মানুষটা তাদের দুই জনেরই খুব আপনজন। দুই: মানুষটা মন্দ না, ভালোই। কাজেই সে চুপচাপ কথাবার্তা শুনে গেছে, আপত্তি করে নি। রাত্রি বেলা মেকু যখন তার মা’র শরীর লেপটে ঘুমানোর জন্যে তৈরি হচ্ছিল তখন তার মনে হল পৃথিবী জায়গাটা মনে হয় খারাপ না। সে এসেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা হয়েছে কিন্তু এর মাঝেই জায়গাটাকে সে পছন্দ করে ফেলেছে। যদি তার জন্ম না হত তা হলে সে কি কখনো এর কথা জানতে পারত?
জন্মের তিন দিনের পর মেকুকে বাসায় নিয়ে আসা হল। মগবাজারে তিনতলায় একটা ফ্ল্যাট। আব্বা আম্মা আর মেকু এই তিন জনের সংসার। আগে যখন দুজন ছিলেন তখন কাজকর্মে সাহায্য করার জন্যে একজন মহিলা বিকেল বেলা কয়েক ঘণ্টার জন্যে আসত। এখন হয়তো সারাদিনের জন্যেই লাগবে। পরিচিত অপরিচিত সবাই ভয় দেখাচ্ছে যে একটা ছোট বাচ্চা নাকি দশ জন বড় মানুষের সমান। সারা দিনে বাচ্চা নাকি শুধু পেশাব করেই ন্যাপি আর কাঁথা ভেজাবে কমপক্ষে এক ডজন। সময়ে অসময়ে খিদে লাগার কথা তো ছেড়েই দেওয়া যাক। সারা রাত নাকি চিৎকার করে কাঁদবে। নিজে ঘুমাবে না অন্য কাউকেও ঘুমাতে দেবে না। অসুখবিসুখ লেগে থাকবে, কান পাকা হবে তার মাঝে এক নম্বর। এগুলি দিয়ে শুরু, বাচ্চা যখন আরেকটু বড় হবে তখন আরো নতুন নতুন ঝামেলা তৈরি হবে এবং সেইসব ঝামেলা শুধু বাড়তেই থাকবে।
আম্মা আর আব্বা অবিশ্যি আবিষ্কার করলেন মেকুকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কোনো ঝামেলা হল না। শুধু কাজের মহিলাটি হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল, কেন উধাও হয়ে গেল সেটি কেউ বুঝতে পারল না। ব্যাপারটি যে ব্যাখ্যা করতে পারত সেটি হচ্ছে মেকু কিন্তু সে চুপচাপ ছিল বলে কেউ কিছু জানতেও পারল না। ব্যাপারটি ঘটেছিল এভাবেঃ আম্মা মেকুকে তার ছোট রেলিং দেওয়া বিছানায় শুইয়ে বাথরুমে গিয়েছেন। মেকু ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে তার বিছানায় সাজিয়ে রাখা খেলনা, বাসার ছাদ, দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ক্যালেন্ডার, জানালার পাখিগুলির কিচির মিচির সবকিছু দেখে শেষ করে ফেলে একটু বিরক্তি বোধ করতে শুরু করেছে। ঠিক তখন দেখতে পেল বাসায় কাজের মহিলাটি ঘর মোছার জন্যে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। মেকুর বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ মেকুর সাথে হাসি মশকরা করল, মেকু এতদিনে টের পেয়েছে ছোট বাচ্চাকে দেখলেই সবাই তাদের সাথে হাসি মশকরা করতে শুরু করে, অর্থহীন শব্দ করে নিজেদেরকে একটা হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে একটা ধমক লাগিয়ে দিতে কিন্তু মহা ঝামেলা হয়ে যাবে বলে কিছু বলে না।
কাজের মহিলাটা মেকুর গাল টিপে দিয়ে পেটে খানিকক্ষণ সুড়সুড়ি দিন এবং মেকু অনেক কষ্ট করে সেটা সহ্য করল। তখন মহিলাটি মেকুকে ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে শুরু করল, ঘরের আসবাবপত্র মুছতে মুছতে আম্মার ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে মহিলাটা কাজ বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে শুরু করে। নানা রকম ভঙ্গি করে আয়নার সামনে দাঁড়ায় শাড়িটা নানাভাবে পেঁচিয়ে পরে শরীর বাঁকা করে দাঁড়াল। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে আম্মার পাওডার নিয়ে নিজের মুখে, গলায়, শরীরে ঢালতে থাকে। একটা ক্রিম নিয়ে মুখে মেখে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখে। মেকু অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখল। কাজের মহিলাটা তখন একটু পারফিউম নিয়ে কানের লতিতে লাগাল। সেটাও মেকু সহ্য করল। কিন্তু মহিলাটা যখন ড্রেসিং উপর থেকে আম্মার লিপস্টিকটা নিয়ে নিজের ঠোটে ঘষতে থাকে তখন সে আর সহ্য করতে পারল না, ধমক দিয়ে বলল, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে?”
কাজের মহিলাটি এত জোরে চমকে উঠল যে তার হাতের ধাক্কায় পাউডারের কৌটা আর ক্রিমের শিশি নিচে পড়ে যায়। সে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে চারিদিকে তাকাল, কে ধমকে উঠেছে সে বুঝতে পারে না। গলার স্বরটি যে মেকু থেকে আসতে পারে সেটা তার একবারও মনে হয় নি। চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে না দেখে সে আবার লিপস্টিকটা নিয়ে নিজের ঠোটে লাগাতে শুরু করে তখন মেকু আবার গর্জন করে উঠে বলল, “ভালো হবে না কিন্তু ”
কাজের মহিলাটি এবারে একটা আর্ত চিৎকার করে ফ্যাকাসে মুখে ঘুরে তাকাল, মেকু তখন আবার ধমক দিয়ে বলল, “লিপস্টিক লাগাবেন না, ভালো হবে না কিন্তু ”
মহিলাটি সাথে সাথে লিপস্টিকটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে দেয়। তার হাত থেকে মোছার কাপড় নিচে পড়ে যায়। সে গলায় হাত দিয়ে নিজের একটা তাবিজ বের করে তাবিজটা চেপে ধরে বিড় বিড় করে সুরা পড়তে থাকে। ভয়ে তার হার্টফেল করার অবস্থা হয়ে যায়। মেকু তখন কঠিন গলায় বলল, “ আবার করলে আমি বলে দেব কিন্তু ”
মেকুর কথা শেষ হবার আগেই কাজের মহিলা সবকিছু ফেলে দিয়ে ছুটে যায়। নিজের বিছানায় শুয়ে মেকু শুনতে পেল ঘরের দরজায় ধাক্কা খেয়ে সে একটা আছাড় খেল, সেই অবস্থায় বাইরের দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে দুদ্দাড় করে ছুটে পালাচ্ছে। কী কারণে এত ভয় পেয়েছে মেকু বুঝতে পারল না।
খানিকক্ষণ পর আম্মা বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হয়ে এসে কাজের মহিলাকে না পেয়ে খুব অবাক হলেন। এদিক সেদিক খুঁজে না পেয়ে বাইরের দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরে এলেন। প্রত্যেকবার মুখ খুলতেই সবাই ভয় পাচ্ছে দেখে মেকু আর মুখ খুলল না, তার নিজের আম্মাও যদি তাকে ভয় পেয়ে যান তখন কী হবে?
দুদিন পর জাঁদরেল ধরনের একজন মহিলা মেকুকে দেখতে এলেন। মেকুর জন্মের পর থেকে অসংখ্য মানুষ তাকে দেখতে এসেছে, বলতে গেলে তাদের সবাই মেকুকে দেখে খুশি হয়েছে। মেকুর গাল টিপে দিয়েছে, পায়ে সুড়সুড়ি দিয়েছে, মাথায় হাত বুলিয়েছে। তার চোখগুলি কত বড় এবং কর সুন্দর সেটা নিয়ে কিছু না কিছু মন্তব্য করেছে। মেকুর প্রায় অসহ্য হয়ে যাবার অবস্থা কিন্তু সে কষ্ট করে সহ্য করে যাচ্ছে, সে এর মাঝে আবিষ্কার করে ফেলেছে মানুষের ভালবাসা অসহ্য মনে হলেও সেটা সহ্য করতে হয়।
জাঁদরেল মহিলার মাঝে মেকু অবশ্যি কোনো ভালবাসা খুঁজে পেলেন না। তিনি ভুরু কুঁচকে মেকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই বুঝি তোর ছেলে? এত শুকনো কেন? আমার মেয়ের বাচ্চা ছিল চার কেজি।”
আম্মা কিছু বললেন না, মেকু মনে মনে বলল, ওজন বেশি হউয়াই যদি ভালো হয়ে থাকে তা হলে মানুষের বাচ্চা না পুষে হাতির বাচ্চাকে পুষলেই হয়।
জাঁদরেল মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “রাতে ঘুমায়?”
আম্মা মাথা নাড়লেন, “ঘুমায়।”
“খাওয়া নিয়ে যন্ত্রণা করে?”
“না।”
“কলিক আছে?”
“না।”
“নাম কী রেখেছিস?”
“ভালো নাম এখনো ঠিক করি নি, আমি মেকু বলে ডাকি।”
“মেকু?” জাঁদরেল মহিলা হঠাৎ হায়েনার মত হেসে উঠলেন, “মেকু আবার কী রকম না? এই নামের জন্যে বড় হলে তোর মেকুর বিয়ে হবে না। যার নাম মেকু তাকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে?” জাঁদরেল মহিলা আবার হায়েনার মতো খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করলেন।
মেকু দেখল তার আম্মা চুপ করে রইলেন কিছু বললেন না। মেকুর ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে, “আমি বিয়ে করার জন্যে মারা যাচ্ছি না।’ কিন্তু সে কিছু বলল না। যে বাচ্চার বয়স এখনো এক সপ্তাহও হয় নি তার মনে হয় বিয়ে নিয়ে কথা বলা ঠিক না।
জাঁদরেল মহিলা উবু হয়ে মেকুকে দেখে বললেন, “সারা দিনে কয়বার ন্যাপি-কাঁথা বদলাতে হয়?”
আম্মা ইতস্তত করে বললেন, “আসলে বদলাতে হয় না।”
জাঁদরেল মহিলা এবারে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, আম্মার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, “তোর বেকুর হিসি করতে হয় না?”
“বেকু না, মেকু।”
“ওই হল। মেকু হিসি করে না? বাথরুম করে না?”
“করে! আমি তার পটিতে বসিয়ে হিসি করতে বলি সে তখন হিসি করে। বাথরুম করে।”
জাঁদরেল মহিলা কেমন জানি রেগে উঠলেন, বললেন, “আমার সাথে মশকরা করছিস?”
“না খালা। সত্যি বলছি।”
“তুই বললেই আমি বিশ্বাস করব? সাত দিনের একটা বাচ্চা যার এখনো ঘাড় শক্ত হয় নি সে পটিতে বাথরুম করে।”
আম্মা কেমন জানি হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ ঠিক আছে খালা তুমি যা বল তাই।”
“কিন্তু তুই আমার সাথে মিথ্যে কথা বলবি কেন? আমি তোর খালা না? তোর মা আর আমি এক মায়ের পেটের বোন না?”
আম্মা কেমন জানি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “খালা, আমি তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলি নি।”
“তা হলে দেখা। দেখা তোর পেকু না মেকু সাত দিন বয়সে পটিতে বসে হিসি করে।”
‘সেটা আমি করতে পারি না খালা। আমার সাত দিনের বাচ্চাকে এখন তোমার সামনে পরীক্ষা দেওয়াতে পারি না।”
“কেন পারিস না?”
আম্মা কঠিন মুখে বললেন, “সেটা তুমি বুঝবে না খালা।”
জাঁদরেল মহিলার মুখ কেমন জানি থম থমে হয়ে উঠল, বাঘের মতো নিশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে! আমিই তা হলে দেখব।”
“কী দেখবে?”
“তোর ফেকু না খেকুকে পটিতে বসিয়ে দেখব কী করে।”
“না খালা। ওটা করতে যেও না।” আম্মার নিষেধ না শুনেই জাঁদরেল খালা মেকুর কাছে এগিয়ে গেলেন এবং একটান দিয়ে মেকুর ন্যাপি খুলে তাকে ন্যাংটো করে ফেললেন, ঠিক সাথে সাথে দুর্ঘটনাটি ঘটল। মেকু একেবারে নিখুঁত নিশানা করে জাঁদরেল খালার চোখে মুখে হিসি করে দিল। জাঁদরেল খালা একটা চিৎকার দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তার মুখ চোখ শাড়ি ব্লাউজ ভেজা, মুখের রং খানিকটা উঠে এসেছে, সব মিলিয়ে তাকে অত্যন্ত হাস্যকর দেখাতে লাগল।
আম্মা হতাশভাবে মাথা নেরে বললেন, “এই জন্যে তোমাকে না করেছিলাম খালা।”
খালা দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ফোঁস করে একটা শব্দ করে বললেন, এই জন্যে তুই না করেছিলি?”
আম্মা দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন। জাঁদরেল খালা মেঘ স্বরে বললেন, “তুই জানতি যে তোর গেকু আমার শরীরে হিসি করে দিবে?”
আম্মা মুখ শক্ত করে বললেন, “জানতাম।”
“কেন?”
“কারণ তুমি একবার তাকে বেকু ডেকেছ, একবার পেকু ডেকেছ একবার ফেকু ডেকেছ, খেকু দেখেছ গেকু ডেকেছ, কিন্তু ঠিক নামতা ডাক নাই। সেই জন্যে সে তোমার উপর রেগে আছে। আমার বাচ্চার নাম হচ্ছে মেকু। মেকু মেকু মেকু। মেকুকে যদি রাগিয়ে দাও তা হলে সে কঠিন শাস্তি দেয়।”
জাঁদরেল খালা প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ে কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, আম্মা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “যাও খালা বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নাও। তোমাকে দেখতে বিদঘুটে দেখাচ্ছে।”
জাঁদরেল খালা কোনো কথা না বলে পা দাপিয়ে বাথরুমের দিকে গেলেন। আম্মা মেকুর কাছে গিয়ে বললেন, বাবা মেকু। তুই এই কাজটা কি ঠিক করলি?”
মেকু তার মাড়ি বের করে হাসল, সে একেবারে এক শ ভাগ নিশ্চিত কাজটা সে ঠিকই করেছে।
দুদিন পর মেকুকে দেখতে এলেন তার বড় মামা। সাথে এলেন মামি আর তার দুই ছেলে মেয়ে। বড় ছেলের নাম সুমন বয়স দশ। ছোট জনের নাম লিপি বয়স চার। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে যেসব আহা উঁহু করতে হয় সবকিছু করে বাচ্চাকে তার বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছে তখন বড় মামার ছোট মেয়ে লিপি বলল, “ফুপু, আমি মেকুর সাথে খেলি?”
মামি বললেন, “কেমন করে খেলবি মা? মেকু তো অনেক ছোট।”
মামা বললেন, “এখন মেকু শুধু তিনটা কাজ করে। একটা হচ্ছে খাওয়া আরেকটা হচ্ছে ঘুম, আরেকটা হচ্ছে – ”
মামার বড় ছেলে সুমন ঠোঁট উলটে বলল, “বাথরুম!”
লিপি বলল, “তা হলে আমি কাছে বসে থাকি?”
মামি একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, “জ্বালাতন করবি না তো?”
লিপি মাথা নেড়ে বলল, “না মা । একটুও জ্বালাবো না। খালি দেখব।”
“কী দেখবি?”
লিপি হেসে বলল, ছোট বাবু দেখতে আমার ভালো লাগে আম্মু। একেবারে পুতুলের মতো। যাই, দেখি?”
“যা।”
লিপি তখন মেকুকে দেখতে গেল। মেকু বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার হাতটা ব্যাবহার করে শিখছিল, একটা আঙুল সোজা করে রেখে অন্য হাত দিয়ে সেটা ধরে ফেলার চেষ্টা করে। এমনিতে মনে হয় কী সোজা কিন্তু মেকুর জান বের হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই হাতের মাঝে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আসছে না। লিপি মেকুর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বলল,
“ইশ! এই বাবুটাকে কী আদর লাগে!”
মেকুর একটু লজ্জা লজ্জা লাগে, একটা ছোট বাচ্চার সামনে সে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে কিছু করতে পারছে না, বাচ্চাটা তাকে এমনভাবে দেখছে যেন সে একটা দর্শনীয় জিনিস। লিপি মেকুর বিছানা ঘিরে রাখা রেলিং ধরে তাকে বলল,
“এই বাবু তোমার নাম কী? বল তোমার নাম কী? বল। বল না।”
মেকু মাথা ঘুরিয়ে লিপিকে দেখার চেষ্টা করল, লিপির চোখে চোখ পড়তেই সে হাত নেড়ে একটু হেসে দেয়। লিপি আবার হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করে,
“বাবু। এই বাবু , তুমি কথা বল না কেন?”
মেকু কিছু বলল না। লিপি তখন মুখ সুচালো করে মেকুকে আদর করার চেষ্টা করতে থাকে, “কুচু কুচু বুগু বুগু ওরে ওরে ওরে –”
মেকু আর সহ্য করতে পারল না হঠাৎ করে বলে বসল, “আমাকে জ্বালিও না বলছি – ” বলেই সে চমকে উঠে, সর্বনাশ! এখন এই বাচ্চাটি চিৎকার করে সবাইকে বলে দেবে। মেকু নিঃশ্বাস বন্ধ করে লিপির দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু লিপি চিৎকার করে উঠল না, বরং ভুরু কুচকে বলল, “কে বলছে আমি তোমাকে জ্বালাচ্ছি? আমি তোমাকে আদর করছি না?” বলে সে আবার আদর করার ভঙ্গি করে বলল, “কুচু কুচু কুচু বুগু বুগু বুগু ওলে ওলে ওলে – ”
মেকু খুব সাবধানে তার বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়, এই বাচ্চাটা তার কথা বলাটা খুব সহজভাবে নিয়েছে। একটুও অবাক হয় নি। ছোট বাচ্চারাই ভালো, সব কিছু সহজ ভাবে নিতে পারে, এটা যদি একটা বড় মানুষ হত তা হলে এতক্ষণে চিৎকার করে হই চই করে একটা কেলেংকারী করে ফেলত।
লিপি আরো কিছুক্ষণ অর্থহীন শব্দ করে মেকুকে আদর করে বলল,
“তোমার নাম কী বাবু?”
মেকু ভয়ে ভয়ে বলল, “মেকু।”
“মেকু! ইশ তোমার নামটা শুনলে কী আদর লাগে।”
মেকু সাবধানে আবার একটা নিশ্বাস ফেলল, এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যে তার নামটাকে পছন্দ করেছে।
লিপি রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মেকুকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে বলল,
“তুমি আমার সাথে খেলবে?”
মেকু বলল, “কেমন করে খেলব? দেখছ না আমি ছোট। শুধু শুয়ে থাকতে হয়।”
লিপি গম্ভীর মুখে বলল, “ও।” একটু পড়ে বলল, “তা হলে শুয়ে শুয়েই খেলি?”
“শুয়ে শুয়ে কেমন করে খেলে?”
“ওই যে হাচুতানী খেলাটা?”
“হাচুতানী খেলাটা কেমন করে খেলে?”
লিপি চোখ বড় বড় করে বলল, “আমি বলব হাচুতানী হাচুতানী, সামনে পিছে হাচুতানী, ডাইনে বামে হাচুতানী – তারপর আমি তোমার কান ধরব।”
“কান ধরবে?”
“হ্যাঁ তারপর তুমি আমার কান ধরবে। তারপর আমরা কান ধরে টানাটানি করব। কী মজা হবে!”
মেকু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তো ছোট, আমি কানও ধরতে পারি না।”
লিপি এবারে খানিকটা অভিমান নিয়ে বলল, “তুমি দেখি কিছুই করতে পার না –”
মেকু উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বলল না, হঠাৎ করে দেখতে পেল বসার ঘর থেকে সবাই হেঁটে হেঁটে আসছে। বড় মামা লিপিকে জিজ্ঞেস করলেন, “লিপি সোনামণি, তুমি কী করছ?”
“কথা বলছি আব্বু।”
“কার সাথে কথা বলছ?”
“মেকুর সাথে।”
“মেকুর সাথে কী নিয়ে কথা বলছ লিপি?”
“এই তো কেমন করে হাচুতানী খেলব সেটা বলেছি।”
বড় মামা হাসি হাসি মুখে বললেন, “মেকু কী বলেছে?”
“মেকু বলেছে সে ছোট তাই সে কান ধরতে পারবে না।”
“তাই বলেছে?”
“হ্যাঁ আব্বু। মেকু সব কথা বলতে পারে।”
বড় মামা হাসি হাসি মুখে বললেন, “নিশ্চয়ই পারে। পারবে না কেন?”
লিপির বড় ভাই সুমন হাসি চেপে বলল, “লিপি, মেকু কি উড়তে পারে?”
লিপি একটু রাগ হয়ে বলল, “মেকু উড়বে কেমন করে? মেকু কি পাখি?”
লিপির আম্মু সুমনকে ধমক দয়ে বললেন, “কেন ওকে জ্বালাতন করছিস?” তারপর ঘুরে লিপিকে বললেন, “আয় লিপি আজ বাসায় যাই।”
লিপি মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আরেকদিন এসে তোমার সাথে খেলব। ঠিক আছে?”
মেকু চুপ করে রইল, তার চারপাশে এত মানুষ সে কোনো কথা বলার ঝুঁকি নিল না। সুমন বলল, “কী হল লিপি, তোর মেকু কথা বলছে না কেন?”
লিপির আম্মা বললেন, “আহ সুমন! কেন জ্বালাতন করছিস মেয়েটাকে?”
সুমন বলল, “ওকে সত্যি মিথ্যা শিখতে হবে। প্রত্যেকদিন রাতে উঠে বলে ওর টেডি বিয়ার ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছে। এখন বলছে মেকু ওর সাথে গল্পগুজব করছে। আরেকদিন বলবে সে উড়তে পারে। আরেকদিন বলবে –”
বড় মামা বললেন, “আহ সুমন। এটা মিথ্যা কথা না। এটা হচ্ছে ওর কল্পনার জগৎ!”
সুমন বলল, “কল্পনার জগৎ না হাতী!”
মেকু শুয়ে শুয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাউকে যদি জানাতেই না পারে টা হলে তার এই কথা বলার ক্ষমতা দিয়ে সে কী করবে?”
কয়েকদিন পর মেকু টের পেল কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আম্মা খানিকটা অস্থির হয়ে আছেন। একটু পরে পরে টেলিফোন এসে, আম্মা সেই টেলিফোনে কথাবার্তা বলতে বলতে মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করেন, তারপর টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে মাথার চুল টানাটানি করেন। ব্যাপারটা কী মেকু ঠিক বুঝতে পারে না, তবে তার নিজের জন্মের সাথে কিছু একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। একদিন আব্বা আর আম্মার মাঝে ব্যাপারটা নিয়ে লম্বা একটা আলোচনা হল তখন মেকু খানিকটা বুজতে পারল। আব্বা বললেন, “শানু, আমাদের মেকুর জন্ম হয়েছে এখনো এক মাস হয় নি এর মাঝে তুমি যদি তোমার অফিসের কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে শুরু কর তা হলে তো হবে না।’
আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “আমি দুশ্চিন্তা শুরু করি নি। আমি এখন ছুটিতে আছি। কিন্তু আমাকে পনের মিনিট পরে পরে টেলিফোন করলে আমি কী করব?”
“তুমি টেলিফোন ধরবে না। তুমি বলবে তুমি ছুটিতে।”
আম্মা একটা নিশ্বাস ফেলেল বললেন, “এমন এক একটা সমস্যা নিয়ে ফোন করে যে না করতে পারি না।”
“তোমাকে না করতে শিখতে হবে।”
আম্মা অনেকটা নিজের মনে বললেন, “এত বড় একটা প্রজেক্ট সেটার উপরে এত মানুষের রুজি রোজগার নির্ভর করছে, সেটা তো এভাবে নষ্ট করা ঠিক না।”
আব্বা বললেন, “নষ্ট কেন হবে? অন্যেরা প্রজেক্ট শেষ করবে।”
আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “পারছে না তো! বুঝেছ হাসান, এটা মানুষকে নিয়ে প্রজেক্ট, মানুষকে দিয়ে কাজ করার প্রজেক্ট এটা সবাই পারে না। মানুষ তো যন্ত্রপাতি না যে সুইচ টিপলেই কাজ করে। এমন একটা সময়ে মেকুর জন্ম হল আর আমি বাসায় আটকা পড়ে গেলাম।”
শুনে মেকুর একটু মন খারাপ হয়ে যায়, সত্যিই তো আরো কয়দিন পরে জন্ম নিলে কী ক্ষতি হত? সেটা কী কোনোভাবে ব্যবস্থা করা যেত না?
পরের দিন আব্বাকে ডেকে আম্মা বললেন, “আমি একটা জিনিস ঠিক করেছি।”
“কী জিনিস?”
“কয়েক ঘণ্টার জন্যে অফিসে যাব।”
আব্বা চোখ কপালে তুলে বললেন, “অফিসে যাবে? আর মেকু?”
“আমার পরিচিত একজন মহিলা আছে তাকে বলব বাসায় এসে থাকতে। মেকুকে দেখতে।”
আব্বা ভয়ে ভয়ে বললেন, “সেই মহিলা কী পারবে? মনে আছে মেকু জোড়া পায়ে কেমন লাথি দিয়েছিল তোমার চাচিকে?”
আম্মা ইতস্তত করে বললেন, “পারবে কী না এখনো জানি না। কিন্তু চেষ্টা করে দেখি। যদি রাখতে পারে তা হলে আমি মাঝে মাঝে অফিসে যাব।”
আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “এর চাইতে আমি বাসায় থাকি। অপরিচিত একজন থেকে আমি ভালো পারব।”
আম্মা হেসে বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই অনেক ভালো পারবে কিন্তু সেটা তো সমাধান হল না। তোমার ইউনিভার্সিটি ক্লাস সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে বাসায় বসে থাকবে?”
আম্মা মাথা চুলকে বললেন, “ ইউনিভার্সিটির যে অবস্থা যে কোনো সময় সেটা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। সেখানে খালি স্লোগান আর মিছিল।”
“কিন্তু এখনো তো আর বন্ধ হয় নি। আগে বন্ধ হোক, তারপর দেখা যাবে।”
কাজেই পরদিন মেকু আবিষ্কার করল পাহাড়ের মতো বিশাল এক মহিলা তাকে দেখে শুনে রাখতে এসেছে। আম্মা সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার মেকু খুব বুদ্ধিমান ছেলে, দেখবেন কোনো সমস্যা হবে না।”
পাহাড়ের মতো মহিলা বললেন, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ছোট বাচ্চা আমি খুব ভালো দেখতে পারি।”
আম্মা বললেন, ভেরি গুড। আমি তিন ঘণ্টার মাঝে চলে আসব। মেকুকে ভালো করে খাইয়ে দিয়েছি। খিদে লাগার কথা না। তারপরেও যদি লাগে ফ্রিজে দুধ তৈরি করে রাখা আছে। একটু গরম করে –”
মহিলা বাধা দিয়ে বললেন, আমাকে বলতে হবে না। আমি সব জানি। কত বাচ্চা মানুষ করেছি।”
আম্মা বললেন, “তবু বলে রাখছি। বেশি গরম করবেন না। হাতের চামড়ায় লাগিয়ে দেখবেন বেশি গরম হল কি না। মেকু সাধারণত কাপড়ে বাথরুম করে না। যদি তবুও করে ফেলে তা হলে এই কাবার্ডে শুকনো ন্যাপি আছে –”
মহিলা আবার বাধা দিয়ে বললেন, “আমাকে বলতে হবে না। আমি সব জানি। আমি কত বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করেছি।”
“তবু সব কিছু শুনে রাখেন। এই যে আমার অফিসের টেলিফোন নাম্বার। কোন ইমারজেন্সি হলে ফোন করবেন।”
মহিলা হাত নেড়ে বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি এসব জানি।”
আম্মা বললেন, “আপনার যদি খিদে লাগে, কিছু খাওয়ার ইচ্ছা করে ফ্রিজে খাবার আছে -।”
পাহাড়ের মতো মহিলার চোখ দুটি হঠাৎ করে এক শ ওয়াট লাইট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। সুড়ুৎ করে মুখে লোল টেনে বললেন, “কোথায় ফ্রিজটা? কত বড় ফ্রিজ? কত সি.এফ.টি.?”
আম্মা কিছু বলার আগেই পাহাড়ের মতো মহিলা কুকুর যেভাবে গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাড় বের করে ফেলে অনেকটা সেভাবে পাশের ঘরে গিয়ে ফ্রিজটা বের করে ফেললেন। তারপর একটান দিয়ে ফ্রিজের দরজাটা খুলে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসলেন। ফ্রিজের ভেতর রাখা খাবার গুলি দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললেন, মোরগের মাংস, চকলেট কেক, মুড়িঘণ্টা, পাউরুটি, পুডিং, ডাল, সব্জি, কোল্ড ড্রিংস, দই – আ হা হা হা!”
আম্মা কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন মহিলা বাধা দিয়ে বললেন, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তিন ঘণ্টা কেন, দরকার হলে আপনি ছয় ঘণ্টা পরে আসেন।”
মাকু লক্ষ্য করল আম্মা চলে যাবার পর পরই মহিলা একটা থালায় চার টুকরা চকলেট কেক, এক খাবলা দই এবং দুইটা মুরগির রান নিয়ে সোফায় বসে টেলিভিশনটা চালিয়ে দিলেন। মেকু জানে তাদের বাসায় একটা টেলিভিশন আছে কিন্তু সেটাকে কখনোই খুব বেশি চালাতে দেখে নি। টেলিভিশনে মোটা মোটা মহিলারা শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচতে লাগল আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর মোটা মোটা গোঁফ ওয়ালা মানুষেরা প্রচণ্ড মারপিট করতে লাগল, সেটা দেখতে দেখতে পাহাড়ের মতো মহিলা খেতে লাগলেন। খাওয়া শেষ হলে মহিলা আবার গিয়ে ছয় টুকরো পাউরুটি, আধাবাটি মুড়িঘণ্ট আর বড় এক গ্লাস কোল্ড ড্রিংস নিয়ে বসলেন। সেটা শেষ হবার পর দুইটা বড় বড় কলা আর ছয়টা টোস্ট বিস্কুট খেলেন। তারপর টেলিভিশন দেখতে দেখতে সোফায় মাথা রেখে বাঁশির মতো নাক ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে গেলেন।
মেকু মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তার আম্মা যদি এই পাহাড়ের মতো মহিলার হাতে তাকে প্রত্যেক দিন রেখে যান তা হলে বড় বিপদ হবে। মেকুকে প্রত্যেক দিন তাকিয়ে তাকিয়ে মহিলার এই রাক্ষুসে খাওয়া দেখতে হবে। মহিলাকে রাখা হয়েছে মেকুকে দেখে শুনে রাখার জন্য কিন্তু তিনি একবারও তার খাওয়া ছেড়ে এসে মেকুকে দেখেন নি। মেকুর যদি এখানে কোনো বিপদ হত, কিংবা কোনো ছেলেধরা এসে জানালার গ্রিল কেটে তাকে চুরি করে নিয়ে যেত তা হলেও এই মহিলা টের পেতেন না। মহিলা টেলিভিশন চালু করে রেখেছেন মেকুকে সবকিছু শুনতে হচ্ছে আর দেখতে হচ্ছে। কোন সাবার মাখলে গায়ের চামড়া নরম হয়, কোন টুথপেস্ট নিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত চকচক করে, কোন পাওডার গায়ে দিলে শরীরে ঘামাচি হয় না মেকুর মুখস্ত হয়ে গেছে। মুখস্ত হয়ে যাওয়া জিনিস বারবার শুনলে মাথার ভিতরে সবকিছু জট পাকিয়ে যায়। কাজেই মেকু সিদ্ধান্ত নিল পাহাড়ের মতো এই মহিলাকে ঘর ছাড়া করতে হবে।
মেকু আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তার কাজ শুরু করে দিল। বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে সে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে পাহাড়ের মতো মহিলা চমকে উঠে লাফ দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলসহ হুড়মুড় করে নিচে আছাড় খেয়ে পড়লেন। টেবিলের উপর রাখা থালা, বাসন, গ্লাস সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। পাহাড়ের মতো মহিলা কোনো মতে উঠে দাঁড়িয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে মেকুর কাছে এসে হাজির হলেন। মেকু আরো একবার বাঁকা হয়ে গলা ফাটিয়ে দ্বিতীয়বার চিৎকার দিল। মহিলা কী করবে বুঝতে না পেরে হাত বাড়িয়ে মেকুকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। মেকু হাত পা ছুঁড়তে থাকে এবং মহিলা তার মাঝে সাবধানে কোনো মতে হাচড় পাচড় করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। মহিলা নেংচাতে নেংচাতে ফ্রিজের কাছে ছুটে গেলেন, দরজা খুলে মেকুর দুধের শিশি বের করে সেটা তার মুখে ঠেসে ধরার চেষ্টা করেন। মেকু শান্ত হয়ে যাবার ভান করে দুধ টেনে মুখ ভর্তি করে পুরোটা মহিলার মুখে কুলি করে দিল। তারপর আবার বাঁকা হয়ে ভয়ংকর চিৎকার শুরু করে দিল। দুধে মহিলার চোখ মুখ ভেসে গেল এক হাতে চোখ মুছে মহিলা কোনোভাবে মেকুকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ছোট শিশুকে হয়তো কোনোভাবে শান্ত করা সম্ভব কিন্তু যে পণ করেছে শান্ত হবে না তাকে শান্ত করবে সেই সাধ্যি কার আছে?
মহিলা কী করবে বুঝতে না পেরে দুধের শিশিটা দ্বিতীয়বার তার মুখে লাগালেন, মেকুও শান্ত হয়ে মুখ ভরে দুধ টেনে নিয়ে আবার মহিলার মুখে কুলি করে দিল। মহিলা চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না, চোখ বন্ধ করে হাঁটতে গিয়ে নিচে পড়ে থাকা টেবিলে পা বেঁধে হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন। দুই হাতে মেকুকে ধরে রেখেছিলেন – তাকে বাঁচাবেন না নিজেকে রক্ষা করবেন চিন্তা করতে করতে দেরি হয়ে গেল, মেকুকে নিয়ে তিনি ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন, হাত থেকে মেকু পিছলে বের হয়ে পাশে গড়িয়ে পড়ল। তার বিশাল দেহ নিচে পড়ে যে শব্দ করল তাতে মনে হল পুরো বিল্ডিং বুঝি কেঁপে উঠেছে।
ঠিক এরকম সময় আম্মা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন, প্রথমেই তিনি আবিষ্কার করলেন মেকুকে, সে মেঝেতে উপুর হয়ে শুয়ে চোখ বড় বড় করে তার পাশেই পড়ে থাকা পাহাড়ের মতো মহিলাটিকে দেখছে। আম্মা ছুটে গিয়ে মেকুকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন – তার কাছে মনে হল ঘরটির মাঝে রিক্টর স্কেলে আট মাত্রার একটা ভূমিকম্প ঘটে গেছে। সোফার টেবিলটা ঠিক মাঝখানে ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেছে। চারপাশে ভাঙা কাচের গ্লাস, থালা বাসন এবং বাটি। বাচ্চার দুধের শিশি ভেঙে দুধ ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ের মতো বিশাল মহিলা উপুড় হয়ে পড়ে আছে, বেকায়দায় পড়ে গিয়ে কপালের কাছে ফুলে একটা চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে। আম্মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে এখানে?”
মহিলাটি হামাগুড়ি দিয়ে উঠার চেষ্টা করে আবার ধপাস করে পড়ে গেলন। আম্মা তখন ঘুরে মেকুর দিকে তাকালেন, তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মেকু, তুই করেছিস?”
মেকু কোনো কথা না বলে তার মায়ের চোখের দিকে অপরাধীর মতো তাকিয়ে রইল। আম্মা হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “মেকু। কাজটা কিন্তু একটুও ভালো করিস নি!”
মেকু তার মাড়ি বের করে হাসল – তার ধারণা অন্যরকম।
সন্ধেবেলা খেতে বসে আবিষ্কার করা হল ফ্রিজে কোনও খাবার নেই সেটা ধু ধু ময়দান। পাহাড়ের মতো মহিলা সেটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছেন। আম্মা একটু ভাত ফুটিয়ে দুটি ডিম ভেজে নিয়ে আব্বাকে নিয়ে খেতে বসলেন। খেতে খেতে তাদের ভেতর যা কথাবার্তা হল মেকু সেটা কান পেতে শুনল। আব্বা বললেন, “তোমার পরিকল্পনাটা তা হলে মাঠে মারা গেল?”
“শুধু মাঠে না, মাঠে-ঘাটে খালে বিলে মারা গেল।”
“বাসার ভিতরে মনে হয়েছে টর্নেডো হয়েছে। ব্যাপারটা কী?”
আম্মা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি যখন দেখেছ তখন তো আমি পরিষ্কার করে এনেছি। আমি যখন দেখেছি তখন যা অবস্থা ছিল!” আম্মা দৃশ্যটা কল্পনা করে একবার শিউরে উঠলেন।
“কেউ যে ব্যাথা পায় নি সেটাই তো বেশি।”
“কে বলেছে কেউ ব্যাথা পায় নি? সে মহিলা তো ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে বাসায় ফিরে গেল। দুজনে মিলে টেনে রিক্সায় তুলতে হয়েছে।”
আব্বা চিন্তিত মুখে বললেন, “ব্যাপারটা কী হয়েছিল আমাকে বুঝিয়ে বলবে?”
“আমি জানলে, তা হলে তো তোমাকে বলব! অনুমান করছি আমাদের মেকুর কাণ্ড। মেকু কোনো কারণে মহিলাকে অপছন্দ করেছে, ব্যাস!”
“এই টুকুন মানুষ এরকম পাহাড়ের মতন একজন মহিলাকে এভাবে নাস্তানাবুদ করে কীভাবে?”
আম্মা চিন্তিত মুখে বললেন, “সেটাই তো আমার চিন্তা! এই ছেলে বড় হলে কী হবে?”
আব্বা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তা হলে আমি ধরে নিচ্ছি এখন তোমার মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়ার পরিকল্পনাটা বন্ধ?”
আম্মা মাথা নাড়লেন, “উঁহু।”
“মানে?”
“আজকে অফিসে গিয়ে আমার মাথা ঘুরে গেছে। পুরো প্রজেক্টের অবস্থা কেরোসিন। কিছু একটা করা না হলে সব শেষ হয়ে যাবে তখন স্যালাইন দিয়েও বাঁচানো যাবে না।”
আম্মা চিন্তিত মুখে বললেন, “তা হলে কী করবে বলে ঠিক করেছ?”
“কাল থেকে নিয়মিত অফিসে যাব।”
আব্বা আঁতকে উঠে বললেন, “আর মেকু?”
আম্মা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “মেকুকে তো আর বাসায় একা একা রেখে যেতে পারব না। তাকেও নিয়ে যাব অফিসে?”
আব্বা খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “তুমি এত বড় সফটওয়ার কোম্পানির একটা প্রজেক্ট ডিরেক্টর তুমি একটা গ্যাদা বাচ্চাকে বগলে ঝুলিয়ে অফিসে যাবে? বোর্ড অফ ডিরেক্টরের মিটিঙয়ের মাঝখানে মেকু শরীর বাঁকা করে চিৎকার করে উঠবে তখন তুমি তাকে দুধ খাওয়াবে?”
আম্মা গম্ভীর মুখে বললেন, “সেটাই যদি একমাত্র সমাধান হয়ে থাকে তা হলে তো সেটাই করতে হবে।” তারপর এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “আর আমার মেকু কখনোই বোর্ড অফ ডিরেক্টরের মিটিঙয়ের মাঝখানে বাঁকা হয়ে চিৎকার করবে না।”
আব্বা আর কিছু বললেন না। চোখ বড় বড় করে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেকু বিছানায় শুয়ে হাত শুন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মনে মনে বলল, “ইয়েস!”
পরদিন সবাই দেখল আম্মা এক হাতে তার ব্যাগ এবং অন্য হাতে বগলের নিচে মেকুকে ধরে অফিসে গিয়ে ঢুকলেন। অফিসের এক কোণায় একটা চাদর বিছিয়ে সেখানে মেকুকে ছেড়ে দেওয়া হল, তার চারিদিকে বই এবং ফাইল রেখে একটা দেওয়ালের মতো করে দেওয়া হল যেন সে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে না পারে। এক মাসের বাচ্চারা সাধারণত নিজে থেকে বেশি নাড়াচাড়া করতে পারে না, কিন্তু মেকুকে কোনো বিশ্বাস নেই। মেকু তার জায়গায় শুয়ে শুয়ে দুই হাতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা টেনে এনে মুখে পুরে চুষতে চুষতে আম্মার কাজ কর্ম দেখতে লাগল। আম্মাও মেকুকে নিয়ে সব দুশ্চিন্তা ভুলে কাজ শুরু করে দিলেন।
আম্মা যে কয়দিন ছিলেন না তখন কাজকর্ম কোনদিকে গিয়ে সমস্যাটা তৈরি হয়েছে সেটা বোঝার জন্যে পুরোনো কাগজপত্র ঘাটতে লাগলেন। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাদের ডেকে কথা বলতে লাগলেন। হই চই চেঁচামেচি দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মাঝে পুরো অফিসে একটা নতুন ধরনের জীবন ফিরে এল।
দুপুর বেলা আম্মা মেকুকে বগলে নিয়ে বের হলেন, তাকে খাওয়ানোর সময় হয়েছে, কোনো একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে দুধ খাওয়ানোর আগে নিচে ডাটা-এন্ট্রি ঘরে যে সব মহিলারা কাজ করছে তাদের এক নজর দেখে আসতে চান।
নিচের ঘরটিতে প্রায় পঞ্চাশটা কম্পিউটার টার্মিনালের সামনে বসে মহিলারা কাজ করছে, আম্মা ভিতরে ঢুকেছেন সেটা কেউ লক্ষ্য করল না। আম্মা মেকুকে বগলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে তাদের কাজ দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ করে কমবয়সী একজন তরুণী মাথা ঘুরিয়ে আম্মাকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “আপা, আপনি এসেছেন?”
তরুণীর চিৎকার শুনে প্রায় সবাই মাথা ঘুরিয়ে আম্মার দিকে তাকাল, আম্মাকে দেখে তারা আনন্দের একটা শব্দ করল এবং মেকুকে দেখে তারা আনন্দের একটা চিৎকার করল। আম্মা হাসিমুখে তাদের আনন্দটুকু গ্রহণ করে বললেন, “তোমাদের কাজ কর্ম কেমন চলছে?”
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে । আমতা আমতা করে একজন বলল, “মোটামুটি ভালোই হচ্ছিল, কিন্তু —”
“কিন্তু কী?”
একজন ইতস্তত করে তার সমস্যাটি বলতে শুরু করে তখন আরেক জন তার সমস্যাটা বলতে শুরু করে, সে শুরু করার আগেই আরেক জন তার সমস্যা বলতে শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মাঝেই ঘরের সবাই কিছু না কিছু বলতে আরম্ভ করে। আম্মা হাত তুলে থামালেন, বললেন, “মনে হচ্ছে কাজে কিছু সমস্যা আছে।”
সবাই মাথা নাড়লেন। আম্মা বললেন, “সেটা নিয়ে চিন্তা করো না, এখন আমি এসেছি দেখব যেন কোনো সমস্যা না হয়।”
সবাই মিলে আবার একটা আনন্দধ্বনি করল, আনন্দধ্বনিটা নিশ্চয়ই একটু জোরে হয়ে গিয়েছিল কারণ সেটা শেষ হবার সাথে সাথে একটা বাচ্চার কান্না শোনা গেল। আম্মা মাথা ঘুরিয়ে মেকুর দিকে তাকালেন। মেকু নয় অন্য কোনো বাচ্চা কাঁদছে। আম্মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে, কাঁদে?”
কম বয়সী একটা মেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল, দুর্বল গলায় বলল, “আমার মেয়ে!”
“কোথায় তোমার মেয়ে?”
মেয়েটি নিচু হয়ে তার টেবিলের তলা থেকে একটা বড় কার্ডবোর্ডের বাক্স বের করল, সেখানে কাঁথা মুড়ি দিয়ে একটা ছোট বাচ্চাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। উপস্থিত সবার মুখ থেকে একটা বিস্ময়ের ধ্বনি বের হয়ে আসে। আম্মা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলেন। কমবয়সী মেয়েটি অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, “ভুল হয়ে গেছে আপা, আর কোনোদিন আনব না। আজকের মতো মাপ করে দেন।”
আম্মা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, তিনি নিজের বাচ্চাকে বগলে ধরে আছেন এরকম অবস্থায় আরেক জন মা’কে তার বাচ্চা আনার জন্যে দোষী করতে পারেন না। কার্ডবোর্ডের বাক্সে বাচ্চাটা গলা ফাটিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, এবং সেটা দেখে মেকুকে খুব উত্তেজিত দেখা গেল। সে যে কোনোভাবেই আম্মার বগল থেকে মুক্তি পেয়ে বাচ্চাটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। আম্মা অবশ্যি মেকুকে ছাড়লেন না, কম বয়সী মা’টিকে বললেন, “তোমার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শান্ত কর।”
কম বয়সী মা সাথে সাথে নিচু হয়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিতেই বাচ্চাটি ম্যাজিকের মতো শান্ত হয়ে গেল। আম্মা সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের আর কতজনের এরকম বাচ্চা আছে?”
পাঁচজন হাত তুলল। আম্মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তাদের কার কাছে রেখে এসেছ?”
একেক জন একেক রকম উত্তর দিল। কেউ নানির কাছে, কেউ পাশের বাসায়, কেউ ছোট মেয়ে কিংবা ছেলের কাছে। শুনে আম্মা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন। কাছাকাছি বসে থাকা একজন মহিলা বলল, আমাদের দুইজন কোনো উপায় না দেখে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
আম্মা মেকুকে বগলে নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। বললেন, কাল থেকে সবাই নিজের ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আসবে, আমরা নিচে একটা ঘর ঠিক করব সেখানে আমরা সবাই আমাদের ছোট বাচ্চাদের রাখব। আমাদের ভিতর থেকে একজন সেই বাচ্চাদের দেখে রাখবে।”
বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মা এবং অন্য পাঁচ জন আনন্দে এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে কোলের বাচ্চাটি ভয় পেয়ে আবার তারস্বরে কাঁদতে শুরু করল।
রাত্রিবেলা আম্মা আব্বাকে বললেন, “মেকুকে দেখে শুনে রাখার সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি।”
আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “কীভাবে?”
আম্মা সবকিছু খুলে বলে চিন্তিত মুখে বললেন, “শুধু একটা জিনিস নিয়ে আমার চিন্তা।”
“কী নিয়ে চিন্তা?”
“মেকুকে নিয়ে। সে যে কী অঘটন ঘটাবে কে জানে!”
আম্মা মেকুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে তোর মাথায় কি কোনো দুষ্টু মতলব আছে?”
মেকু কোনো কথা বলল না, মাড়ি বের করে হাসল। আম্মা সেই হাসি দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলেন।
আম্মার অফিসের নিচে একটা ঘর পরিষ্কার করে সেখানে মেঝেতে নরম কার্পেট বসানো হয়েছে। খানিকটা অংশ ঘিরে রেখে সেখানে আটটা বাচ্চা ছেড়ে দেওয়ার পর সেখানে বিচিত্র একটা দৃশ্য দেখা গেল। বাচ্চাগুলি কিলবিল করে সেখানে নড়তে শুরু করে। যেগুলি বেশি ছোট সেগুলি চিৎ হয়ে শুয়ে রইল। যেগুলি একটু বড় হয়েছে তার উপুড় হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কেউ কেউ উপুড় হয়ে সাংঘাতিক একটা কাজে করে ফেলেছে সেরকম ভান করে মাথা নাড়াতে শুরু করল। যারা আরো একটু বড় হয়েছে তারা হাচড় পাচড় করে কিংবা গড়িয়ে গড়িয়ে নড়তে চড়তে শুরু করে। আকজনের উপর দিয়ে আরেক জন পিছলে বের হয়ে যাচ্ছে, একজন গড়িয়ে যাচ্ছে, এক জন আরেক জনের পা ধরে রেখেছে, কান মাড়ি দিয়ে কামড়ে ধরার চেষ্টা করছে, নাকের মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে – সব মিলিয়ে একটি অত্যন্ত বিচিত্র দৃশ্য। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকেক শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত সবাই এই মজার দৃশ্য দেখতে এল। এসে কেউ সেখান থেকে সরে যেতে চাইল না, দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসতে লাগল। শেষ পর্যন্ত আম্মা এসে সবাইকে বললেন, “এখানে কী হচ্ছে? সবাই মনে হচ্ছে তামাশা দেখতে এসেছেন? আপনারা কখনো বাচ্চা দেখেন নি?”
বয়স্ক ম্যানেজিং ডিরেক্টর হি হি করে হাসতে হাসতে কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললেন, “দেখব না কেন? এক শ বার দেখেছি। কিন্তু আটটা এক সাথে ছেড়ে দিলে যে এরকম মজা হয় তা কখনো দেখি নি!”
দেখা গেল এরকম সময়ে একটা ছোট বাচ্চার উপর চেপে বসে আরেকটা বাচ্চা তার নাক কামড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। নেহায়েৎ ছোট বাচ্চা বলে দাঁত গজায় নি এবং মাড়ি দিয়ে কোনো কিছু কামড়ে ধরা বেশ কঠিন ব্যাপার কাজেই সে বিশেষ সুবিধে করতে পারল না, এবং সেই দৃশ্য দেখে ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকেক শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আম্মা তখন রেগে উঠে বললেন, “ব্যাস অনেক হয়েছে। এখন সবাই নিজের কাজ কর্ম করতে যান।”
সবাই বেশ মনক্ষুণ্ণ হয়েই নিজের কাজে ফিরে গেল। এই ঘরটিতে আটটা বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখার জন্যে রেনু নামে কমবয়সী মা’টিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে খুব খুশি হয়ে এই কাজটি করতে রাজি হয়েছে। কাজ শুরু করার একটু পরেই অবশ্য রেনু আবিষ্কার করেছে কাজটি খুব সহজ নয়। আট জন বাচ্চার মাঝে একজন না হয় অন্য একজন খানিকক্ষণ পর পরই কোনো কারণ ছাড়াই গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। তাকে দেখে বা তার কান্না শুনে তখন অন্য আরেক জন কাঁদতে শুরু করে এবং তাকে দেখে আরেকজন। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই মিলে গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে, তখন তাদের সামলানো খুব দুরূহ ব্যাপার। রেনু অবশ্যি বাচ্চাদের শান্ত করার কায়দা কানুন খুব ভালো জানে কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের শান্ত করে ফেলতে পারে। এক দুই দিনের মাঝেই সে আট জন বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখার ব্যাপারে মোটামুটি একটা রুটিন দাঁড় করিয়ে ফেলল। কখন কে ঘুমাবে কে জেগে থাকবে, কার মা এসে দুধ খাওয়াবে এই ব্যাপারগুলিও সে আগে থেকে ঠিক করে ফেলল। দেখতে দেখতে কোম্পানির সবাই ব্যাপারগুলিতে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেল। আম্মাও মেকুকে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। রোজ অফিস থেকে বাসায় যাবার সময় মেকুকে বগল দাবা করে নিয়ে যান। গাড়িতে বসে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কীরে মেকু সোনা? তোদের বাচ্চাদের হাট কেমন চলছে?”
মেকু তখন মাড়ি বের করে একটা হাসি আম্মাকে উপহার দেয়। আম্মা বুঝতে পারে সবকিছু ভালোভাবে চলছে।
তবে দেখা গেল পৃথিবীতে কোনো ভালো জিনিসই একটানা চলতে পারে না। মেকুর বেলাতেও সেটা সত্যি প্রমাণিত হল। সপ্তাহ দুয়েক পর দেখা গেল প্রজেক্ট শেষ করার জন্যে কাজের চাপ অনেক বেড়েছে, রেনুকে আর বাচ্চাদের কাছে বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না – তাকেও ডাটা এন্ট্রি শুরু করতে হবে। বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখার জন্যে সেলস ডিপার্টমেন্ট থেকে দুরানী নামে এক মহিলাকে আনা হল, কাজ বুঝিয়ে দিতে এল অফিস সেক্রেটারি। দুরানী ছোট ঘরটিতে আটটি বাচ্চাকে এভাবে কিলবিল করতে দেখে রীতিমত আঁতকে উঠল, বলল, “এগুলি কী?”
সেক্রেটারি মহিলাটি বলল, “বাচ্চা।”
“বাচ্চা এত ছোট হয় নাকি?”
“হ্যা। আরো ছোট হয় এখন একটু বড় হয়েছে।”
“এদেরকে এখানে আনার দরকার কী ছিল?”
সেক্রেটারি মহিলা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “আরেকটু হলে আমাদের প্রজেক্টের বারটা বেজে যেত। শাহানা ম্যাডাম এই ব্যবস্থা করে কোনোমতে কাজ উদ্ধার করেছেন।”
দুরানী মাথা নাড়ল, বলল, “আমার আন্দাজ করা উচিত ছিল। নিশ্চয়ই শাহানা ম্যাডামের কাণ্ড।” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “পুরোপুরি মাথা খারাপ।”
“কেন? মাথা খারাপ হবে কেন?”
“আরে, তিন মাসের ম্যাটারনিটি লিভ পেয়েছে, কোথায় শুয়ে বসে কাটাবে তা না একমাস পরে বাচ্চাকে বগলে নিয়ে অফিসে চলে এসেছে!”
“না এলে কী বিপদ হত, জান?”
“আমার এত কিছু জানার দরকার নেই। কী করতে হবে বল?”
“এই বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখ। ঘুমের সময় হলে ঘুম পাড়িয়ে দাও। বাথরুম করে দিলে কাপড় বদলে দাও।”
দুরানী চিৎকার করে বলল, “বাথরুম করে দিলে – এই গুলি বাথরুমও করে নাকি?”
সেক্রেটারি মেয়েটা হেসে বলল, “ছোট বাচ্চা বাথরুম করবে না? ঘণ্টায় ঘণ্টায় এরা বাথরুম করে।”
দুরানী মুখ শক্ত করে বলল, “ছোট বাথরুম নাকি বড় বাথরুম?”
“ছোট বড় মাঝারী সবরকম বাথরুম।”
“মাঝারী? মাঝারী মাথ্রুম আবার কোনটা?”
“খাওয়ার সময় ছোট বাচ্চাদের কোনো হিসেব থাকে না, যেটুক দরকার তার থেকে বেশি খেয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে। তখন ঢেকুর তোলাতে হয়, ঢেকুর না তুললে অনেক সময় খাবার উগলে দেয়।”
দুরানী কেমন যেন শিউরে উঠল। বলল, “ তার মানে দাঁড়াল এই বুয়াদের আণ্ডা বাচ্চাদের পেশাব বাথরুম বমি আমাকে পরিষ্কার করতে হবে?”
“বুয়া? বুয়া বলছ কেন? শাহানা ম্যাডামের বাচ্চাটাও আছে এখানে।”
“শাহানা ম্যাডামের বাচ্চার কথা ছেড়ে দাও। শাহানা ম্যাডাম হচ্ছে পাগল। বাচ্চার নাম রেখেছে মেকু। মেকু একটা নাম হল?”
সেক্রেটারি মহিলা বলল, “কেন? খারাপ কী নামটা। মেকু শুনতে তো আমার ভালোই লাগে।”
“তোমার ভালো লাগলেই তো হবে না। সবার ভালো লাগতে হবে। শুধু মেকু নাম রাখে নি, মেকু নাম রেখে সেই বাচ্চাকে বুয়াদের বাচ্চাদের সাথে ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে অন্য বাচ্চাদের সাথে কিলবিল করছে!” দুরানী আঙুল দিয়ে বাচ্চাদের দেখিয়ে বলল, “ দেখো, এখানে দেখে বোঝা যায় কোনটা শাহানা ম্যাডামের বাচ্চা আর কোনটা বুয়াদের বাচ্চা? বোঝা যায়?”
সেক্রেটারি মহিলা মাথা নেড়ে বলল, “না, বোঝা যায় না। গরিবের বাচ্চা আর বড়লোকের বাচ্চার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।”
“ছিঃ ছিঃ ছিঃ ! বুয়াদের বাচ্চার সাথে কামড়া কামড়ি করছে।”
সেক্রেটারি মহিলা ভুরু কুঁচকে বলল, “আমি একটা জিনিষ বুঝতে পারছি না। তুমি একটু পরে পরে বুয়াদের বাচ্চা বলছ কেন? এরা কেউ বুয়া নয়। সবাই ডাটা এন্ট্রি অপারেটর।”
দুরানী নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, “রাখো তোমার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর। এরা সবগুলি ছিল কাজের বুয়া। তোমার মাথা খারাপ শাহানা ম্যাডাম ট্রেনিং দিয়ে এদেরকে তৈরি করেছে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর। লাভের মাঝে লাভ কী হল? এখন ঢাকা শহরে আর কাজের বুয়া পাওয়া যায় না।”
সেক্রেটারি মহিলা বলল, “তোমার যা খুশি হয় বল। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে তোমাকে তোমার কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। তুমি এই বাচ্চাগুলি দেখে রাখ।”
সেক্রেটারি মহিলা চলে যাবার পর দুরানী চোখে বিষ ঢেলে বাচ্চাগুলির দিকে তাকাল। ঠিক তখন একটি বাচ্চা আরেকটি বাচ্চার পেটে খামচি দিয়ে তাকে কাদিয়ে দিল। তার কান্না শুনে পাশের বাচ্চাটি কেঁদে উঠল, এবং এই দুজনের কান্না শুনের এক সাথে অন্য সবাই কাঁদতে শুরু করে – একেবারে শেয়ালের ডাকের মত। দুরানী কী করবে বুঝতে না পেরে মুখ বিকৃত করে একটা ধমক দিয়ে বলল, “চোপ । আমি বলছি চোপ! টু শব্দ করলে আমি কিন্তু গলা চেপে ধরব।”
বাচ্চাগুলি দুরানীর কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে মুখ হাঁ করে বিকট গলায় কাদতেই লাগল।
সেদিন সন্ধেবেলা বাসায় যাবার সময় আম্মা মেকুকে বগলদাবা করে জিজ্ঞেস করলেন, “ মেকু, তোদের নতুন মহিলাটি কী রকম?”
মেকু মুখ ভেংচে জিব বের করে ভ্যারররররররর ধরনের একটা শব্দ করল। আম্মা বুঝতে পারলেন দুরানীকে পছন্দ হয় নি – হওয়ার কথাও না। সব সময়ে সবজায়গাতেই যে পছন্দের মানুষ পাওয়া যাবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।
পরদিন সকাল বেলাতেই দুরানী চেষ্টা করল আটটা বাচ্চাকে আলাদা জায়গায় শুইয়ে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিতে। ছোট বাচ্চারা দিনের বড় একটা সময় ঘুমিয়ে কাটায় কিন্তু দেখা গেল যখন তাদের জোর করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করানো হয় তখন কেউই ঘুমাতে চায় না। তাদের একজনকে শোয়ানোর চেষ্টা করানো হলে অন্য আরেক জন উঠে পড়ে এবং তারস্বরে চিৎকার শুরু করে। দুরানী খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সেদিনের মতো হাল ছেড়ে দিল।
পরদিন দুরানী সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিকল্পনা করে এল। বাচ্চাগুলিকে রেখে যাওয়ার সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে তার ব্যাগ খুলে একটা ওষুধের শিশি বের করল। ওষুধটি কাশির ওষুধ – খেলে নাকি ঝিমুনির মতো হয়। ছোট বাচ্চাদের এক চামুচ খাইয়ে দিলে তারা নাকি কলাগাছের মতো ঘুমায়। ব্যাপারটা এখনি পরীক্ষা হয়ে যাবে। দুরানী একটা একটা বাচ্চাকে ধরে তার মুখে এক চামুচ করে ওষুধ ঢেলে দিলে এবং বাচ্চাগুলি সেটা কোঁত করে গিলে নিল। কফ সিরাপের ঝাঁজালো স্বাদে মুখ বিকৃত করে একটু আপত্তি করলেও কোনো কান্নাকাটি করল না। কিন্তু মেকুকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়েই দুরানী বিপদে পড়ে গেল। মেকুর যে এ ব্যাপারে আপত্তি থাকতে পারে সে ব্যাপারে দুরানীর সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না, মুখের কাছে চামুচটা নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে চুপ করে শুয়ে রইল। শেষ মুহূর্তে সে তার জোড়া পায়ের লাথি দিয়ে ওষুধের চামুচ এবং বোতলটা এক সাথে ফেলে দিল। চটচটে ওষুধে দুরানীর শাড়ি এবং ঘরের কার্পেট মাখামাখি হয়ে যায়।
দুরানী চিৎকার করে বলল, “পাজি ছেলে।”
মেকু তার জিব বের করে, ভ্যাররররররর করে একটা বিদঘুটে শব্দ করল। দুরানী তার শরীর এবং কার্পেট থেকে ওষুধ মোছার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না, সবজায়গায় কটকটে একটা লাল রং লেগে যায়। দুরানী এবারে চামুচে কফ সিরাপ নিয়ে দ্বিতীয়বার এগিয়ে এল। আগে থেকে পা এবং হাতকে চাপা দিয়ে রেখে সে মেকুর মুখের কাছে এগিয়ে গেল কিন্তু মেকু কিছুতেই মুখ খুলতে রাজি হল না। মাড়িতে মাড়ি চেপে মুখ বন্ধ করে রাখল, জোর করে খাওয়াতে গিয়ে মেকুর মুখে এবং শরীরে ওষুধে মাখামাখি হয়ে গেল।
দুরানী এবারে কেমন জানি খেপে যায়, যেভাবেই হোক ওষুধ খাইয়ে ছাড়বে। তাকে কোলে তুলে নিয়ে দুই পা বগলে চেপে ধরল, শরীর দিয়ে দুই হাত আটকে রাখল এবং এক হাত দিয়ে গালে চাপ দিয়ে মুখ খুলে অন্য হাত দিয়ে মুখের ভিতরে ওষুধ ঢেলে দিল। দুরানী যখন যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গি করে মেকুকে ছেড়ে দিচ্ছিল মেকু তখন খুব নিশানা করে পুরো কফ সিরাপটুকু দুরানীর চোখে কুলি করে দিল। দুরানী মেকুকে কার্পেটে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ছোটাছুটি করতে থাকে, চোখ ধোয়ার জন্যে দরজা খুলে বাথরুমে ছুটে যায়। চোখ মুছে যখন ফিরে এসেছে ততক্ষণে কফ সিরাপের শিশি উপুড় করে পুরো ওষুধটা ঢেলে দেওয়া হয়েছে – সেই চটচটে কফ সিরাপে একাধিক বাচ্চা গড়াগড়ি খাচ্ছে, সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে মেকু।
দুরানীর রাগ এবার দুশ্চিন্তায় রূপ নিল। তার পরিকল্পনায় ছিল সবাইকে এক চামুচ কফ সিরাপ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া – তিনজনকে সে খাইয়েও দিয়েছিল, তারা বেশ শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরেই মেকুকে খাওয়াতে গিয়ে বিপত্তি, খাওয়ানো তো যায়ই নি উলটো সেই কফ সিরাপ মাখামাখি করে একটা বিতিকিচ্ছি অবস্থা করে ফেলেছে। বাচ্চাদের মায়েরা যখন আসবে তখন ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়বে। দুরানী কী করবে বুঝতে পারল না, ইচ্ছে করছিল দুই হাতে মেকুর গলা চেপে ধরে দেওয়ালে তার মাথা আচ্ছা মতন ঠুকে দেয়। অন্য কোনো বাচ্চা হলে অন্তত কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মেকুর চোখের দিকে তাকিয়ে দুরানী সেরকম সাহস পেল না। এই বাচ্চাটি যে একটা মিচকে শয়তান সে ব্যাপারে এখন তার আর কোনো সন্দেহ নেই।
দুরানী বুঝতে পারল বাচ্চাদের মায়েরা আসার আগেই তাদের পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। চটচটে কফ সিরাপে তারা কেন মাখামাখি হয়ে আছে সেটা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। সে এক টুকরা কাপড় ভিজিয়ে তাদের পরিষ্কার করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কাজটা খুব সহজ হল না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বিরুদ্ধে তাদের একটা গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হয়, কিছুতেই সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চায় না। তাদের শরীরে হাত দেওয়া মাত্রই তারা তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করে। এ ব্যাপারে মেকু মনে হয় একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে, শুধু তার গায়ে হাত দিলে যে সে চিৎকার করছে তা নয়, অন্য কোনো বাচ্চার গায়ে হাত দিলেও সে বিকট চিৎকার শুরু করে দিচ্ছে। এর মাঝেই দুরানী যেটুকু পারল বাচ্চাগুলিকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল, খুব একটা লাভ অবশ্যি হল না। কাপড়ে ক্যাটক্যাটে লাল রং এবং শরীরে কফ সিরাপের ঝাঁঝালো গন্ধ।
ব্যাপারটা আরো গুরুতর হয়ে গেল যখন আম্মা দুপুর বেলা দেখতে এসে আবিষ্কার করলেন মেকু উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আম্মা অবাক হয়ে বললেন, “মেকু ঘুমিয়ে আছে? এরকম সময় তো সে কখনোই ঘুমায় না।”
দুরানী অত্যন্ত অবাক হয়ে বলল, “এতক্ষণ তো জেগে ছিল। আপনাকে দেখেই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।”
কথাটি সত্যি। মেকু চোখের কোণা দিয়ে তার আম্মাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করল আম্মা তার ঘুমের ভানটি ধরতে পেরেছেন কি না।
আম্মা অবশ্যি ঘুমটি খাঁটি না ভেজাল সেটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না, নাক কুঁচকে একটু ঘ্রাণ নিয়ে বললেন, “এখানে ওষুধের গন্ধ পাচ্ছি? কী ওষুধ?”
দুরানী আমতা আমতা করে বলল, “না মানে ইয়ে কোথায় ওষুধ? আমি তো মানে –”
মেকু এতক্ষণ উপুড় হয়েছিল ঠিক তখন সে গড়িয়ে চিৎ হয়ে গেল এবং আম্মা অবাক হয়ে দেখলেন সে দুই হাতে কফ সিরাপের শিশিটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। আম্মা আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! মেকু এই শিশি কোথায় পেল?”
আম্মা যেটুকু আঁতকে উঠেছেন দুরানী তার থেকেও বেশি আঁতকে উঠল, ওষুধের শিশিটা যে এখানে রয়ে গেছে সেটা তার মনে ছিল না, মেকু যে সেটা এভাবে ধরে পুরো ব্যাপারটা ফাঁস করে দিতে পারে সে আশঙ্কাটাও তার মাথায় খেলা করে নি। আম্মা ‘ঘুমন্ত’ মেকুর হাত থেকে কফ সিরাপের বোতলটা নিয়ে সেটা এক নজর দেখে মেকুর উপর ঝুঁকে পড়লেন, তার শরীরে ওষুধ লাগানো, কফ সিরাপের ঝাঁঝালো গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। আম্মা ঘুমিয়ে থাকা আরো তিন জন বাচ্চার কাছে গেলেন, তাদের দেখে আবার মেকুর কাছে ফিরে এলেন। মেঘস্বরে বললেন, “মেকু কী এই ওষুধ খেয়েছে?”
দুরানী দুর্বল গলায় বলল, “জি না খায় নাই।”
“নিশ্চয়ই খেয়েছে তা না হলে এই অসময়ে এভাবে ঘুমাচ্ছে কেন?”
দুরানী জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “জি না খায় নাই।”
“তা হলে মুখে গলায় কাপড়ে ওষুধ লাগানো কেন?”
“লাথি মেরে সবকিছু ফেলে দিল তাই শরীরে লেগেছে।”
“লাথি মেরে ফেলে দেওয়ার জন্যে ওষুধ পেল কোথায়?”
“এই চামুচে করে যখন একটু নিচ্ছিলাম — ”
“চামুচে করে ওষুধ নিচ্ছিলেন? কেন?”
“না মানে ইয়ে এই তো — ” দুরানী কথা বন্ধ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
আম্মা কঠিন গলায় বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই কফ সিরাপ খাইয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছিলেন। তাই না?”
দুরানী দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।
“কাজটি খুব অন্যায় করেছেন। ছোট বাচ্চাদের এভাবে ওষুধ খাওয়ানো শুধু অন্যায় নয়। খুব বিপজ্জনক।”
মেকু চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “তুই মাথা নাড়ছিস কেন?”
মেকু সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে আবার গভীর ঘুমের ভান করতে লাগল। আম্মা দুরানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে ছোট বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখার কাজটা ঠিক পছন্দ করছেন না।”
দুরানী মাথা নাড়ল, বলল, “জি । কাজটা খুব কঠিন।”
আম্মা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “ ছোট বাচ্চদের পছন্দ করলে কাজটা খুব সহজ না, কাজটা আনন্দের। কিন্তু আপনি যেহেতু ছোট বাচ্চদের পছন্দ করে না কাজটা আপনার জন্যে কঠিন এবং কষ্টের। আপনাকে এতগুলি বাচ্চার দায়িত্ব দেওয়া ঠিক না। এখানে রেনুকেই আবার নিয়ে আসতে হবে।”
মেকু তার মাড়ি বের করে আনন্দে হেসে ফেলল। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “তুই হাসছিস কেন?”
মেকু আবার মুখ বন্ধ করে ঘভির ঘুমের ভান করতে লাগল। কাজেই পরদিন থেকে আবার রেনুকে বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখার কাজে বহাল করা হল।
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে বলে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রাখা হয়েছে। মোমবাতির আলোতে টেবিল ঘিরে বসে থাকা তিন জনকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে, আলো নিচ থেকে এলে সবসময়েই চেহারা একটু অন্য রকম দেখায়, চেনা মানুষকেও তখন অচেনা মনে হয়। আজ অবশ্য অন্য ব্যাপার, যে তিনজন এখানে একত্র হয়েছে তারা একে অন্যকে খুব ভালো করে চেনে, একজনের কাছে অন্যজনকে অচেনা মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। মাঝামাঝি বসে থাকা মানুষটির নাম মতি, সে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে বলল, “আমরা তা হলে কাজ শুরু করি।”
মতির ডান দিকে বসেছে বদি, সে খুব বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে পরিচিত নয়। তবে মানুষটি খুব বিশ্বস্ত এবং বুদ্ধি বেশি নয় বলে বিপজ্জনক কাজগুলিতে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। বদি নাক দিয়ে একটা শব্দ করল, যেটাকে সম্মতি বলে ধরে নেওয়া যায়।
মতির বাম দিকে বসেছে জরিনা – যদিও মতির ধারণা এটা তার আসল নাম নয়। জরিনাকে দেখে তার বয়স বোঝা যায় না, এটা চব্বিশ থেকে চুয়াল্লিশের ভিতর যে কোনো একটা কিছু হতে পারে। মতিকে দেখে বলা যেতে পারে তার চেহারা ভালো, বদিকে দেখে সেরকম বলা যেতে পারে তার চেহারাটা বিশেষ সুবিধেয় নয় কিন্তু জরিনাকে দেখে বলার উপায় নেই চেহারাটা ভালো না খারাপ! মনে হয় এক সময় তার চেহারাটা ভালোই ছিল কিন্তু নানা অপকর্মের সাথে জড়িত থাকায় চেহারার মাঝে একটা খারাপ ছাপ পড়েছে সে কারণে চেহারাটা আর ভালো লাগে না। জরিনা টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিজের কাছে এনে একটা সিগারেট বের করে ঠোটে লাগিয়ে ফস করে একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “শুরু কর।”
বদি বিরস মুখে জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়ে মানুষের সিগারেট খাওয়া ঠিক না।”
জরিনা ঠোটের ডগা থেকে সিগারেটটা না সরিয়েই বলল, “আর একবার মেয়েদের সম্পর্কে এরকম একটা কথা বললে এই সিগারেট দিয়ে এরকম একটা ছ্যাকা দিব – ।”
বদি বলল, “আমি খারাপ কী বলেছি? মেয়েরা সিগারেট খেলে দেখতে ভালো লাগে?”
জরিনা ভুরু কুঁচকে বলল, “তোমার ধারণা মেয়েদের একমাত্র কাজ দেখতে ভালো লাগা?”
মতি বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! কী শুরু করেছ তোমরা? কাজের মাঝে গোলমাল।”
বদি আবার নাক দিয়ে একটা শব্দ করল, জরিনা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “নাও শুরু কর।”
মতি কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “মানুষটার নাম ইলিয়াস আলী, তার মশলার বিজনেস। থাকে নিউ ইয়র্ক। বড় মালদার পার্টি। দেশে দুই সপ্তাহের জন্যে আসে। এই দুই সপ্তাহ থাকার জন্যে মগবাজারে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে। সারা বছর এই ফ্ল্যাট তালা দেওয়া থাকে, ইলিয়াস আলী যখন ঢাকা আসে তখন এখানে দুই সপ্তাহ থাকে।”
বদি জিজ্ঞেস করল, “মশলার বিজনেস করে মানুষ কীভাবে মালদার পার্টি হয় বুঝতে পারি না।”
মতি বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “সেইটা তুমি বুঝতে পারছ না কারণ তোমার মাথায় কোনো ঘিলু নাই। পৃথিবীতে যে দুইটা জিনিষ সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট তার একটা হচ্ছে খাওয়া। আর খাওয়ার জন্যে দরকার রান্না। রান্নার জন্যে দরকার মশলা। যে মশলার বিজনেস করে তার মার্কেট কোঁত বড় জান?”
মতি ইতস্তত করে বলল, অন্য ইম্পরট্যান্ট জিনিসটা কী?”
“বাথরুমে গিয়ে তুমি যে কাজটা কর সেইটা।”
“বাথরুমে গিয়ে আমি কী করি?”
মতি ধমক দিয়ে বলল, “সেটা আমার বলে দিতে হবে?”
জরিনা বলল, “এসব ছেড়ে কাজের কোথায় আস।”
“হ্যাঁ। যেটা বলছিলাম। এই ইলিয়াস আলী এক সপ্তাহ আগে ঢাকা এসেছে। এবারে তার সাথে আছে তার নূতন বউ এবং নূতন বাচ্চা। বিয়ে হয়েছে এক বছর। বাচ্চা হয়েছে এক মাস।”
জরিনা জিজ্ঞেস করল, “এটা কী তার দ্বিতীয় বউ?”
“না। এটা চতুর্থ। ইলিয়াস আলীর হবি এন্টিক গাড়ি সংগ্রহ করা আর বিয়ে করা।”
জরিনা নারী জাতির পক্ষ থেকে ইলিয়াস আলীকে এবং সমগ্র পুরুষ জাতিকে একটা গালি দিল। মতি সেটা না শোনায় ভালো করে বলল, আমরা ইলিয়াস আলীর এই বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করব। বেশি বয়সের বাচ্চা – আমার ধারণা এই বাচ্চার জন্যে এই লোক কম করে হলেও দশ লাখ টাকা দেবে। এই টাকার মাঝে ভাগ বসানোর কেউ নেই, পুলিশকে দিতে হবে না, লোকাল মাস্তানকে দিতে হবে না, ইনকাম ট্যাক্সও দিতে হবে না।” মতি হা হা করে হাসল – তার ধারণা ইনকাম ট্যাক্সের কথা বলাটা খুবই উঁচু ধরনের রসিকতা হয়েছে।
জরিনা বলল, “টাকা রোজগার করা যদি এত সোজা হত তা হলে সবাই করত।”
মতি বলল, “যদি তোমার বুদ্ধি আর সাহস থাকে, ভালোমন্দ নিয়ে যদি মাথা না ঘামাও আর যদি কপাল খুব বেশি খারাপ না হয় তা হলে টাকা রোজগার করা খুব সোজা।”
বদি আধা দার্শনিক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাল না, সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এল, “বাচ্চাটারে কিডন্যাপ করবে কীভাবে?”
“আমি সব খোঁজ নিয়েছি। দুপুর দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত এই একঘণ্টা সময় বাচ্চাটাকে ফ্ল্যাটে একজন মহিলার কাছে রেখে ইলিয়াস আলী আর তার বউ বাইরে বের হয়। এই সময় আমরা যাব, মহিলাকে একটা দাবড়ানি নিয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে বের হয়ে আসব।”
বদি জানতে চাইল, “দাবড়ানি মানে কী? মেরে ফেলব?”
মতি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, “বদি, পারতপক্ষে মানুষ মারবে না। মানুষ মারলেই এক শ ঝামেলা। রিভলভারটা মাথায় ধরে ভয় দেখিয়ে বাথরুমে আটকে রাখবে।”
“ও।”
“কাজ পানির মতো সহজ। জরিনাকে সাথে নিতে হবে, বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হেঁটে নেমে আসবে। মায়ের কোলে শিশুর মতো নির্দোষ দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু নাই। কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।”
“নিয়ে আসার পর পালাবে কেমন করে?”
“আমি গাড়ি নিয়ে থাকব। বদি হবে বাচ্চার বাবা, জরিনা হবে বাচ্চার মা আর আমি হব গাড়ির ড্রাইভার।”
বদি ইতস্তত করে বলল, “তোমার চেহারা ছুরত ভালো, তুমি হও বাচ্চার বাবা, আমাই ড্রাইভার হিসেবে গাড়ি নিয়ে থাকি।”
“উঁহু।” মতি মাথা নাড়ল, “পালানোর গাড়িটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ঠিকমতো করতে না পারলে পুরো পরিকল্পনাটা মাঠে মারা যাবে। সেই দায়িত্ব আর কাউকে দেওয়া যাবে না। আমাকে নিতে হবে।”
বদি গজগজ করে বলল, “আসলে আমাদের কোনো ঝামেলা হলে তুমি যেন পালাতে পার সেইজন্যে –”
মতি মৃদুস্বরে বলল, “বদি। পার্টনারকে যদি বিশ্বাস না কর তা হলে এই লাইনে আসবে না। এই লাইন হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিশ্বাসের লাইন। এই লাইন হচ্ছে –”
জরিনা খেঁকিয়ে ওঠে বলল, “এই সব ঢং বাদ দিয়ে ঠিক করে প্ল্যানটা করবে? ভিতরে যাব আমি আর বদি?”
“হ্যাঁ।”
“গাড়ি নিয়ে থাকবে তুমি?”
“হ্যাঁ।”
“বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে আমরা এইখানে ফেরত আসব?”
“হ্যাঁ।”
“কোনো কিডন্যাপ নোট দেব না?”
“না।”
“এখান থেকে ফোন করে টাকা চাইব?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে এখন তা হলে ডিটলসে যাওয়া যাক।” জরিনা মুখ শক্ত করে বলল, “ একশানে যাওয়ার সময় অস্ত্র হার্ডওয়ার পোশাক কী হবে?”
“দুইজনের কাছে দুইটা ছোট রিভলবার। একটা মোবাইল ফোন। ভদ্র পোশাক।”
বদি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেশ করল, “ভদ্র পোশাক মানে কি স্যুট?”
মতি হাত নেড়ে বলল, “আরে না। স্যুট হচ্ছে বকাদের পোশাক। মফস্বলের বিজনেসম্যান ছাড়া আর কেউ স্যুট পরে না। ভদ্র মানে ক্যাজুয়েল। জিন্স আর হাওয়াই সার্ট। জরিনার জন্যে সুতি শাড়ি।”
“সুতি শাড়ি? যদি দৌড়াতে হয়?”
“দৌড়াতে হলে দৌড়াবে।”
জরিনা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুমি কখনো কাউকে শাড়ি পরে দৌড়াতে দেখেছ?”
“দেখি নাই। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। প্রকাশ্য দিনের বেলা একটা বাচ্চাকে কিডন্যাপ করতে হলে সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে। সেখানে পোশাক ইম্পরট্যান্ট। এটা মাস্তানি না। এটা ছিনতাই না। একটা উঁচুদরের কাজ। এইটা আর্ট।”
বদি নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে বলল, “আর্ট?”
মতি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। মানুষ নাটক সিনেমা করার আগে যেরকম রিহার্সেল দিয়ে রেডি হয় আমাদেরও সেই রকম রিহার্সেল দিতে হবে। খুঁটিনাটি দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে এর মাঝে ফাঁকি দেওয়ার জায়গা নেই। এটা হবে নিখুঁত একটা শিল্প কর্ম। এটা হবে –”
জরিনা তার সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি বড় বেশি কথা বল, মতি।”
মতি একটু থতমত খেয়ে থেমে গেল।
আম্মা মেকুর গাল টিপে দিয়ে বললেন, “তুই শুয়ে থাক বাবা। আমি চট করে গোসল করে আসি।”
মেকুর হঠাৎ করে খুব ইচ্ছে হল উত্তরে আম্মাকে কিছু বলে। “ঠিক আছে আম্মা” কিংবা, “চমৎকার” কিংবা “তোমার গোসল আনন্দময় হউক” কিংবা এইধরনের কোন কথা। কিন্তু মেকু সাহস করল না। এই পর্যন্ত যতজন বড় মানুষ তাকে কথা বলতে শুনেছে ভয়ে তাদের সবার পেটের ভাত চাল হয়ে গেছে। তার আম্মাও যদি ভয় পেয়ে যান? ভয় পেয়ে তাকে যদি আর কোলে না নেন? যদি আর আদর না করেন? মেকু কিছুতেই আর সেই ঝুঁকি নিতে পারে না। কিন্তু যদি সে আম্মার সাথে কথা বলতে পারত তা হলে কী মজাটাই না হত! মেকু শুয়ে শুয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু পরেই বাথরুমে পানি ঢালার এবং তার সাথে আম্মার মৃদু গলার গান শুনতে পেল।
শুয়ে শুয়ে মেকুর চোখে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল, হঠাৎ করে সে দরজায় একটা শব্দ শুনতে পেল। মনে হল কেউ বাইরের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। মেকু কান খাড়া করে শুয়ে থাকে, তাদের বাসায় কেউ এলে বেল বাজায়, নিজে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করে না। আব্বার কাছে চাবি আছে কিন্তু আব্বাও প্রথমে বেল বাজান।
মেকু শুনতে পেল দরজায় ঘটাং করে একটা শব্দ হল তারপর ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। মাকু শুনল ভিতরে কয়েক জন মানুষ এসে ঢুকছে, ব্যাপারটা আর যাই হোক ভালো হতে পারে না। এইভাবে দরজা খুলে ভিতরে বাইরের থেকে মানুষজন কোনো ভালো উদ্দেশ্যে ঢুকে যায় না। মেকুর বুকের ভিতর ধকধক শব্দ করতে থাকে, এই দুষ্টু মানুষগুলো যদি তার আম্মার কোনো ক্ষতি করে?
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল তার ঘরে দুজন মানুষ এসে ঢুকেছে, একজন পুরুষ বেশ লম্বা চওড়া, দেখতে খানিকটা ডাকাতের মতন। সাথে আরেক জন মহিলা, দেখতে শুনতে ভালোই। কিন্তু মানুষগুলি ভালো নয়, ভালো মানুষের হাতে রিভলবার থাকে না। পুরুষ মানুষটা নিচু গলায় বলল, “বুয়া কোথায়?”
মহিলা বলল, “বাথরুমে মনে হয়।”
“তা হলে দাবড়ানি দেব কেমন করে?”
“দেওয়ার দরকার কী? আমাদের কাজ শেষ করে আমরা চলে যাই।”
মেকু ঠিক বুঝতে পারল না তার আম্মাকে এই পাজি মানুষ দুই জন বুয়া মনে করছে কেন, আর কী কাজ শেষ করে তারা চলে যেতে চাইছে। মেকু ঘুমের ভান করে চোখের কোনা দিয়ে লম্বা চওড়া ডাকাতের মতো মানুষটি আর সাথের মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ দুইজন হেঁটে তার বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মেকু শুনতে পেল পুরুষ মানুষটা বলছে, “বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। জেগে থাকলে হয়তো চিৎকার করত।”
মহিলা বলল, “এক মাসের বাচ্চা কিছু বুঝেসুঝে না। ময়দার প্যাকেটের মতো – চিৎকার করার কথা নয়।”
“তা হলে তুলে নাও।”
মাকু চমকে উঠল। তাকে তুলে নেওয়ার কথা বলছে। কেন তাকে তুলে নিতে চাচ্ছে। সে টের পেল একজন তার নিচে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলছে, মেকু কী করবে বুঝতে পারল না, সে কী একটা চিৎকার দেবে? ইচ্ছা করলেই সে এত জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে পারে যে বাথরুম থেকে তার আম্মা ছুটে বের হয়ে আসবেন, কিন্তু এই খারাপ মানুষগুলি যদি তার আম্মার কোনো ক্ষতি করে? গুলি করে দেয়?
মেকু তাই কোনো শব্দ করল না। সে বুঝতে পারল মহিলাটি তাকে কোলে তুলে নিয়েছে তারপর নিচু গলায় সঙ্গী মানুষটাকে বলছে, “চল।”
ঠিক তখন মোবাইল ফোনে মৃদু শব্দ হল। মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল পুরুষ মানুষটি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে চাপা গলায় বলল, “হ্যালো।”
অন্য পাশে কে কী বলেছে মেকু শুনতে পেল না। সে শুনল পুরুষ মানুষটা বলছে, “ কোনো সমস্যা নাই। আমরা আসছি। রেডি থাক।”
মেকু বুঝতে পারল তার ওপরে মহা বিপদ নেমে আসছে – এখনো তার বয়স দুই মাসও হয় নি, তার মাঝে তার উপর এরকম বিপদ? সে কী করবে বুঝতে পারল না। মাথা ঠাণ্ডা করে কিছু একটা করতে হবে, তবে এই ঘরে সে চিৎকার করে তার আম্মাকে বিপদে ফেলবে না – মরে গেলেও না। মহিলাটি তাকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে, তার ডান হাতটি ঝুলে আছে, সে চেষ্টা করল ডান হাত দিয়ে কিছু একটা ধরতে। ড্রেসিং টেবিলের কাছে দিয়ে যাবার সময় সে টেবিলের উপর একটা প্যাকেট দেখে সেটাই ধরে ফেলল, প্যাকেটের ভিতরে কী আছে কে জানে। প্যাকেটটা সে তার শরীরের ভিতরে লুকিয়ে ফেলল। এখনো সে জানে না কিসের প্যাকেট কিন্তু যতদূর মনে হয় এটা তার ফটোর একটা প্যাকেট। তার আব্বা আম্মার এখন প্রধান কাজ হচ্ছে তার ফটো তোলা – এখন পর্যন্ত যত ছবি তোলা হয়েছে সেগুলো দিয়ে মনে হয় একটা মিউজিয়াম ভর্তি করে ফেলা যাবে।
মহিলাটি মেকুকে কোলে নিয়ে সামনে এবং তার পিছু পিছু পুরুষ মানুষটি বের হয়ে এল। এই ফ্ল্যাটটাতে লিফট আছে কিন্তু মানুষ দুজন সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। সিঁড়িতে কারো সাথে দেখা হল না, এখন একমাত্র ভরসা গেটের দারোয়ান। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মহিলাটি এবং তার পিছু পিছু মানুষটা বের হয়ে আসে। দুজনে খুব সহজ স্বাভাবিক থাকার ভান করছে কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুজনেই খুব উত্তেজিত। মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল পুরুষ মানুষটার ডান হাত পকেটের মাঝে, সেটা দিয়ে নিশ্চয় রিভলবারটা ধরে রেখেছে।
মেকু আশা করছিল গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানটা বুঝি তাদেরকে থামাবে, কিন্তু ঠিক উলটো ব্যাপার হল, দারোয়ান হাত তুলে তাদেরকে একটা লম্বা সালাম দিল। মেকু তখন বুঝল এখন তার একটা কিছু করার সময় হয়েছে, সে আচমকা তার সমস্ত শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে আরেকটু হলে মহিলাটা মেকুকে নিচে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেত, কিন্তু শেষ মুহূর্ত সে সামলে নিল। পুরুষ মানুষটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “দেখেছ খোকার খিদে পেয়েছে?”
পুরুষ মানুষটি মহিলার মতো এত চালু নয়, সে আমতা আমতা করে বলল, “এ্যাঁ, ইয়ে-খোকা? মানে – ইয়ে – খিদে?”
“হ্যাঁ।” মহিলাটি মেকুর গলার স্বর ছাপিয়ে যায় চিৎকার করে বলল, “খোকার দুধের বোতলটা কোথায়?”
পুরুষ মানুষটা আবার হতচকিত হয়ে যায়, আমতা আমতা করে বলে, “দুধ? মানে দুধের বোতল? মানে- ইয়ে –কিন্তু তা হলে দুধ-মানে, যে সাদা রংয়ের –”
মেকু শুনল, মহিলাটি বলছে, “নিশ্চয়ই গাড়িতে রেখে এসেছি। চল তাড়াতাড়ি চল –”
দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে বলল, “কোথায় স্যার, গাড়ি কোথায়? ড্রাইভার সাহেব কোথায়? তারপর গলা উচিয়ে চিৎকার করতে লাগল, “ড্রাইভার সাহেব। ড্রাইভার সাহেব।”
মেকু বুঝতে পারল তার চিৎকার করে আর লাভ হবে না, মায়ের কোলে ছোট বাচ্চার চিৎকার খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তা হলে কী সে এখন কথা বলে চেষ্টা করবে? তাতে কী লাভ হবে? কিছু একটা সে বলেই ফেলত কিন্তু তার আগেই তাদের পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল, এবং কিছু বোঝার আগে দরজা খুলে এক পাশ দিয়ে মেকুকে নিয়ে মহিলা অন্যপাশ দিয়ে পুরুষ মানুষটি উঠে বসল। সাথে সাথে গাড়িটা ছেড়ে দিল। গাড়ি চালাতে চালাতে ড্রাইভার বলল, “কংগ্রাচুলেশান্স জরিনা। কংগ্রাচুলেশান্স বদি। চমৎকার ভাবে বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করেছ। নিখুঁত কাজ। স্টেট অফ দি আর্ট।”
বদি বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, “আরেকটু হলেই তো বিপদ হয়ে যেত! শেষ মুহূর্তে বাচ্চাটা হঠাৎ করে যা চিৎকার শুরু করল!” বদি মেকুর দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এক থাবড়া দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেব, বদমাইশ ছেলে।”
মতি গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, “সাবধান বদি। এই ছেলের গায়ে হাত দেবে না। এই ছেলের এখনো দাঁত উঠে নি কাজেই থাবড়া দিয়ে দাঁত ফেলতে পারবে না। তুমি তোমার নিজের বাচ্চাকে যত যত্ন করে রাখ এই বাচ্চাকে তার থেকে বেশি যত্ন করে রাখতে হবে। কারণ তোমার নিজের বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে তুমি দশ টাকাও পাবে না, কিন্তু এই বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে আমরা কমপক্ষে দশ লাখ টাকা পাব!”
মেকু একটু চমকে উঠল। তার আব্বা আম্মা তো বড়লোক নয়, দশ লাখ টাকা কেমন করে দেবে?
জরিনা বলল, “আমরা শুধু বাচ্চাটাকে তুলে এনেছি। বাচ্চাটার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কয়দিন রাখতে হবে জানি না, জামা কাপড় লাগবে। ন্যাপি লাগবে।”
মতি বলল, “ঠিক বলেছ। এলিফ্যান্ট রোডে বাচ্চাদের জিনিসপত্রের একটা দোকান আছে। সেখানে থামছি।”
গাড়ি থামার পর মতি আর জরিনা নেমে গেল। বদি থাক্ল পাহারায়। মেকুকে গাড়ির পিছনে শুইয়ে বদি গাড়ি থেকে নামল সিগারেট খেতে। মেকু একা একা শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। কোনোভাবে সে কী কাউকে কিছু বলতে পারে না? আশে পাশে কেউ এসে থামলে সে চেষ্টা করে দেখত, কিন্তু থামল না।
বেশ খানিকক্ষণ পর কেনাকাটা শেষ করে জরিনাকে নিয়ে মতি ফিরে আসে। তিন জন গাড়িতে বসে আবার রওনা দিয়ে দেয়, জরিনা গজ গজ করতে করতে বলল, “ইস কতগুলি টাকা বের হয়ে গেল। বাচ্চার জামা কাপড়ের এত দাম কে জানত।”
মতি বলল, “ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিও না, এই টাকা সুদে-আসলে উঠে আসবে।”
বদি বলল, “তাড়াতাড়ি বাসায় চল। এই বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে থাকা ঠিক না। হঠাৎ করে যদি বিকট গলায় চিৎকার করে দেয় তখন কী হবে? আমি কিন্তু তা হলে সোজাসুজি বাচ্চার গলা টিপে ধরব।”
মতি কঠিন গলায় বলল, “খবরদার বদি, তুমি এই বাচ্চার গায়ে হাত দেবে না। এই বাচ্চা এখন সোনার খনি।”
গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মেকু তার জামার নিচে লুকিয়ে রাখা প্যাকেটটা নিচে ফেলে দিল। মেকুর কপাল ভালো কেউ সেটা লক্ষ করল না। কেউ একজন এখন এটা পেয়ে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করলেই হয়।
দরজার তালা খুলে প্রথমে মতি, তারপর মেকুকে কোলে নিয়ে জরিনা এবং সবশেষে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বদি এসে ঢুকল। মেকুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জরিনা বলল, “মিশন কমপ্লিট।”
মতি শুদ্ধ করিয়ে দিয়ে বলল, “প্রথম অংশটা কমপ্লিট।”
জরিনা বলল, “প্রথম অংশটাই আসল।”
মতি বলল, “তা ঠিক। কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশ হচ্ছে পরের অংশ। যখন আমি টেলিফোন করে ইলিয়াস আলীকে বলব তার বাচ্চা আমার কাছে তখন সে কী কাউ মাউ করে কাঁদবে! আমি হব তার হর্তা কর্তা বিধাতা। আমার উপরে নির্ভর করবে তার সবকিছু। আমি ইচ্ছা করলে হাসব, ইচ্ছা করলে ধমক দেব, ইচ্ছা করলে ব্যাটাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব – ” মতি আনন্দে হা হা করে হাসতে লাগল।
বদি তার পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে মতিকে দিয়ে বলল, “নাও। টেলিফোন কর।”
মতি টেলিফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “আস্তে বদি আস্তে! একটু সময় দিতে হবে। এই সব কাজে তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই।”
জরিনা একটা সিগারেট ধরিয়ে বল্ল,”হ্যা। আগে কিছু খেয়ে নিই। খুব খিদে লেগেছে।”
“ঠিকই বলেছ।” বদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এত খিদে লেগেছে যে মনে হচ্ছে একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।”
জরিনা বিরক্ত মুখে বলল, “বাজে কথা বল না। মানুষের খিদে লাগলে কখনো ঘোড়া খায় না। বুঝেছ?”
ঘণ্টা খানেক পর মতি টেলিফোন করল। টেলিফোনের অন্যপাশে ইলিয়াস আলীর চিৎকার এবং আহাজারি শোনার কথা ছিল। কিন্তু খুব পরিতৃপ্ত একজন মানুষের গলা শোনা গেল। মানুষটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “হ্যালো।”
“ইলিয়াস আলী সাহেব।”
ইলিয়াস আলী বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ । কে আপনি কী চান?”
“প্রশ্নটা কী আমারই করার কথা না? কী চান?”
ইলিয়াস আলী ধমক দিয়ে বললেন, “ঢং রেখে কী বলতে চান বলে ফেলেন।”
মতি থতমত খেয়ে বলল, “আমি আপনার ছেলের কথা বলতে চাচ্ছি।”
“আমার ছেলের কী কথা?”
মতি হঠাৎ করে চুপ করে যায়। মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। ইলিয়াস আলী টেলিফোনে আবার ধমক দিল, “কী হল? কথা বলছেন না কেন?”
“আপনার ছেলে কোথায়?”
“আমার ছেলে আমার পেটের উপর শুয়ে আছে। কেন?”
মতির মুখ হাঁ হয়ে গেল, “আপনার ছেলে আপনার পেটের উপর শুয়ে আছে?”
“হ্যাঁ। কেন কী হয়েছে?”
“আপনি – আপনি কী মগবাজারের তারানা ফ্ল্যাটে থাকেন?”
“হ্যাঁ। কেন কী হয়েছে?”
“তিন তলায়? লিফট থেকে নেমে বাম দিকে?”
“তিন তলায় না থার্ড ফ্লোরে। তার মানে চার তলায়। লিফট থেকে নেমে বাম দিকে।”
মতির চোয়াল ঝুলে পড়ল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “থা-থা-থার্ড ফ্লোর? তা হলে তি-তি-তিন তলায় কে থাকে?”
“জানি না। আপনার এত খোঁজ নিয়ে কী দরকার?”
“আ-আ-আপনি জানেন না কে থাকে?”
“না। আমি এখানে থাকি না, কে কোথায় থাকে জানি না – আপনার জানার দরকার থাকে আপনি নিজে গিয়ে খোঁজ নেন।” কথা শেষ করার আগেই ইলিয়াস আলী খট করে টেলিফোনটা রেখে দিল।
মতি কিছুক্ষণ মোবাইল টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল, তার মুখ দেখে মনে হতে লাগল এই টেলিফোনটা বুঝি সব সর্বনাশের মূল। জরিনা কোমরে দুই হাত রেখে মতির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ বাসাটা ছিল চার তলায় তুমি আমাদের পাঠিয়েছ তিন তলায়?”
মতির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে মানে আমি তো থার্ড ফ্লোরই বলেছিলাম। কিন্তু আসলে থার্ড ফ্লোর মানে যে চার তলা – ”
বদিও মতির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “তুমি থার্ড ফ্লোর বল নাই, তুমি তিন তলা বলেছ। আমার স্পষ্ট মনে আছে বলেছ তিন তলা।”
মতি কঠিন মুখে বলল, “চিৎকার করছ কেন?”
“চিৎকার করব না তো কী গান গাইব? লাইফ রিস্ক নিয়ে গেলাম বাচ্চা কিডন্যাপ করতে এখন তুমি বলছ ভুল বাসা থেকে ভুল বাচ্চা নিয়ে এসেছি। রং করার জায়গা পাও না? ঢং করার জায়গা পাও না?”
“দেখ বদি, মুখ সামলে কথা বলবে।”
“কেন আমি মুখ সামলে কথা বলল? তুমি কে যে তোমার সামনে আমার মুখ সামলে কথা বলতে হবে?” বদি চিৎকার করে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে নিচে কথাবার্তা শোনা যায়। জরিনা জানালার কাছে গিয়ে হঠাৎ করে চাপা স্বরে বল, “চুপ।”
সাথে সাথে ভিতরে দুজনেই চুপ করে গেল। মতি ফিসফিস করে বলল, “কে?”
জরিনা নিচু গলায় “পুলিশ”
মতি এক লাফে জানালার কাছে এসে বলল, “পুলিশ কী করছে?”
“গাড়িটাকে দেখছে।”
তিন জনেই জানালায় পর্দার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকে। অনেকগুলি পুলিশ বাসার সামনে, কয়েক জন তাদের বাসার দিকেতাকিয়ে আছে কয়েকজন গাড়িটাকে দেখছে। বদি মুখ শুকনো করে বলল, “ব্যাপারটা কী?”
মতি বলল, “বুঝতে পারছি না। বদি তুমি যাও তো নিচে গিয়ে দেখে আস ব্যাপারটা কী?”
“আমি? আমি কেন?”
“তা হলে কে যাবে?”
বদি বলল, “তুমি যাও।”
মতি চোখ লাল করে বলল, “যদি কোনো ইমারজেন্সি হয় তা হলে কে সামলাবে? তুমি? তোমার মাথায় সেইটুকু ঘিলু আছে? যাও, দেখে আস। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার। পুলিশ মনে হয় কোনো কিছু রুটিন চেক করতে এসেছে।”
বদি গজ গজ করতে করতে নিচে নেমে গেল এবং দুই মিনিট না যেতেই প্রায় ছুটে উপরে উঠে এল। তার মুখ ফ্যাকাশে এবং রক্ত শুন্য। মতি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“পুলিশ আমাদের খুঁজেছে।”
“আমাদের? আমাদের কেন খুঁজেছে? কোথা থেকে খবর পেল?”
“এই বাসার সামনে নাকি একটা প্যাকেট খুঁজে পাওয়া গেছে। সেই প্যাকেটে বাচ্চার ছবি আর বাসার ঠিকানা লেখা ছিল।”
মতি দুর্বল গলায় বলল, “বাসার সামনে প্যাকেট কীভাবে এল?”
জরিনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তিন তলা আর থার্ড ফ্লোর যেভাবে হয়েছে সেইভাবে!”
মতি বিষ দৃষ্টিতে জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজের কথা যদি কিছু বলতে পার তা হলে বল।”
বদি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, “মগবাজারের সেই ফ্ল্যাটের সামনে যে দারোয়ান ছিল সেই ব্যাটা পুলিশের কাছে আমাদের বর্ণনা দিয়েছে, আমাদের গাড়ির বর্ণনা দিয়েছে।”
“সর্বনাশ!” মতি বলল, “তা হলে এই গাড়িটাও গেল!”
জরিনা বলল, “শুধু গাড়ি না আমরাও গেছি।”
“তা হলে?”
“এক্ষুনি পালাতে হবে। তাড়াতাড়ি চল, পিছন দিকে একটা রাস্তা আছে।”
তিন জন ছুটে পালাতে গিয়ে থেমে গেল, বিছানায় শুয়ে থাকা মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এই বাচ্চাটাকে কী করব?”
জরিনা বলল, “সাথে নিতে হবে।”
বদি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “সাথে নিতে হবে ? কেন?”
“যদি পুলিশ এসে বাচ্চাটাকে পেয়ে যায় তা হলে আমাদের কোনো উপায় নাই। যদি না পায় তবু একটা আশা আছে। তা ছাড়া – ”
“তা ছাড়া কী?”
“বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করেছি, কিছু টাকাও আদায় করব না? দশ লাখ না হোক পাঁচ লাখ। পাঁচ লাখ না হোক দুই লাখ? বাবা-মা কি বাচ্চার জন্যে দুই লাখ টাকাও দেবে না?”
মতি মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছ।”
বদি ভয়ে ভয়ে বলল, “কিন্তু মনে নাই বাচ্চা কীভাবে চিৎকার দেয়? শরীর বাঁকা করে এখন যদি একটা চিৎকার দেয় তা হলে পুলিশ জেনে যাবে না?”
জরিনা বলল,”সেইটা তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও। হাতটা রাখব এর গলায়, যদি চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করে সাথে সাথে গলা চেপে ধরব। দেখি বাচ্চার কত তেজ।”
মেকু বিছানায় শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল, পুলিশ এসেছে শুনে মনে মাঝে একটু আশাও হয়েছিল কিন্তু জরিনার কথা শুনে তার সব আশা শেষ হয়ে গেল। এই মহিলার চোখের দিকে তাকালেই কেমন জানি ভয় করে, মেরুদণ্ড শির শির করতে থাকে। তার গলায় হাত রেখে দরকার হলে চাপ দিয়ে একেবারে মেরে ফেলতেও তার কোনোই সমস্যা হবে না।
দরজা খুলে বের হতে গিয়ে মতি হঠাৎ থেমে গেল। বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “বদি, একটা কাজ করে?”
“কী?”
“বাচ্চার জিনিসপত্র গুলি নিয়ে এস।”
“কেন?”
“তা না হলে আবার কিনতে হবে। এখন যেরকম অবস্থা কেনা-কাটা করার জন্যে আর বাইরে যেতে পারব না।”
বদি গজ গজ করে বলল, “আমাকে কেন আনতে হবে? তুমি কেন আনতে পারবে না?”
“কারণ কোনো ইমারজেন্সি হলে কে দেখবে? তুমি? তোমার মাথায় সেই পরিমাণ ঘিলু আছে?”
কথায় কথায় তার মাথায় ঘিলু নিয়ে খোঁটা দেওয়াটা বদির একেবারেই পছন্দ হল না। কিন্তু এখন আর সেটা নিয়ে তর্ক করার সময় নেই।
একটু পর দেখা গেল বাসার পিছনে একটা গলি দিয়ে প্রথমে মতি তারপর মেকুকে কোলে নিয়ে জরিনা এবং সবার শেষে এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে এক কাঁদি কলা নিয়ে বদি হন হন করে ছুটে যাচ্ছে। বড় রাস্তায় এসে তারা একটা স্কুটার থামিয়ে সেটাতে উঠে পড়ল। তিন জন বড় মানুষ এবং একটা ছোট বাচ্চা বেশ গাদাগাদি করে স্কুটারে বসেছে। হাতের ব্যাগটাও চাপাচাপি করে রাখা হল। কিন্তু কলার কাঁদিটা রাখার জায়গা হচ্ছিল না। জরিনা বিজলি দিয়ে বলল, “তুমি এই কলাগুলি কোন আক্কেলে নিয়ে এসেছ?”
“খিদে লেগেছে তাই এনেছি।”
“তুমি দশ মিনিট হল ঠেসে খেয়েছ। এখন আমার খিদে লেগেছে?”
“আমি টেনশনে থাকলেই আমার বেশি খিদে লাগে।”
কথাটা সত্যি প্রমাণ করার জন্যে বদি একটা কলা ছিঁড়ে খেতে শুরু করল। স্কুটারের গাদাগাদি ভিড় এবং ঝাঁকুনির মাঝে কলা খাওয়ার ব্যাপারটি এত সোজা নয় কিন্তু বদির নিশ্চয়ই বেশ ভালোই খুদে পেয়েছে সে দেখতে দেখতে কলাটা শেষ করে ফেলল। সে মাঝে বসেছে বলে কলার ছিলকেটা ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে বেশী সুবিধে করতে পারল না। মতি ধমক দিয়ে বলল, এখন স্কুটার থেকে কলার ছিলকে ফেল না, কেউ একজন আছাড় খাবে।”
“আছাড় খেলে খাবে।”
“না । কোনো সন্দেহজনক কাজকর্ম না।”
বদি ঠিক বুঝতে পারল না কলার ছিলকে ফেলা কেন সন্দেহজনক কাজকর্ম হবে, কিন্তু সেটা নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে করল না। সে এক হাতে কলার কাঁদি অন্য হাতে কলার ছিলকে নিয়ে বসে রইল। মেকু কিছুক্ষণ কলার ছিলকেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্ত্র হিসেবে কলার ছিলকে জিনিসটা মন্দ নয়, এটা হাতে নিয়ে রাখলে ভালই হয়। মেকু হাত বাড়িয়ে কলার ছিলকেটা নেওয়ার চেষ্টা করল, কাজটি খুব সোজা নয় কিন্তু ঝাঁকুনির কারণে একটা সুযোগ পেয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছিলকেটা নিজের কাছে নিয়ে নিল।
জরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হল? এই বাচ্চাটার হাতে তুমি কলার ছিলকে দিয়েছ কেন?”
“আমি দেই নাই সে নিয়েছে।”
“এই বাচ্চার বয়স মাত্র দুই মাস, সে নিজে থেকে কিছু নিতে পারে না। কিছু করলে সেটা না বুঝে করে।”
“ঠিক আছে বাবা নিয়ে নিচ্ছি।” বলে বদি কলার ছিলকেটা নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মেকু তখন তার শরীর ঝাঁকিয়ে গলা ফাটিয়ে সেই ভয়ংকর চিৎকারটা শুরু করল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে স্কুটার ড্রাইভার তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে স্কুটার থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
বদি তাড়াতাড়ি কলার ছিলকে থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “না, না কিছু না।”
কাজেই মেকু কলার ছিলকেটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখল। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে এটা কাজে লাগাবে।
মেকুকে নিয়ে এই তিন জন মহাখালীর কাছে একটা ঘিঞ্জি হোটেলে এসে থামল। তিন তলায় দুইটা রুম ভাড়া করে তিন জন উপরে উঠতে শুরু করে। মেকু তখনো দুই হাতে কলার ছিলকেটা ধরে রেখেছে, এটাকে ঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে। সিঁড়িতে ওঠার সময় মেকু সেই ‘ঠিক সময়’টা পেয়ে গেল। সিঁড়িতে প্রথমে জরিনা মেকুকে নিয়ে উঠেছে, তারপর বদি এবং সবশেষে মতি। মেকু চোখের কোনা দিয়ে পুরো অবস্থাটা দেখল তারপর হাত থেকে ছিলকেটা ঠিক বদির পায়ের তলায় ফেলেল দিল।
তখন যা একটা ঘটনা ঘটল তার কোনো তুলনা নেই। সমান জায়গাতেই কলার ছিলকে নিয়ে মানুষ ভয়ংকর আছাড় খেয়ে থাকে। খাড়া সিঁড়িতে সেই আছাড় আরো এক শ গুণ বেশী ভয়ংকর। বদির পায়ের নিচে কলার ছিলকে পড়ার সাথে সাথে হঠাৎ করে পা হড়কে সে মুখ থুবরে নিচে পড়ল, শক্ত সিঁড়িতে মুখ লেগে সাথে সাথে তার একটা দাঁত ভেঙে গেল। বদির হাতের ব্যাগ এবং কলার কাঁদি শুন্যে উড়ে যায় এবং সে নিজে উলটে পালটে নিচে পড়তে থাকে। ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মতি বদির প্রচণ্ড ধাক্কায় গড়িয়ে পড়ল এবং তারপর কখনো মতি এবং কখনো বদি এইভাবে তারা খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে থাকে। মেকু জরিনার কোলে বসে তাদের আর্তচিৎকার শুনতে থাকে। একটা মাত্র কলার ছিলকে দিয়ে এত বড় একটা কাণ্ড করা যেতে পারে সেটা মেকুর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
দুর্ঘটনাটা ঘটেছে তিন তলার কাছাকাছি, বদি আর মতি সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে প্রথমে দুইতলা এবং শেষে এক তলায় এসে থামল। তাদের কপাল ভালো দুইজনকে চিৎকার করে গড়িয়ে পড়তে দেখে হোটেলের একজন কর্মচারী কোলাপসিবল গেইটটা বন্ধ করে দিয়েছিল, তা না হলে দুইজনেই গড়িয়ে গড়িয়ে একেবারে বাইরে রাস্তায় গিয়ে পড়ত এবং একটা দোতলা বাস চাপা দিয়ে তাদের চেপটা করে ফেলত।
হোটেলের কর্মচারী এবং বোর্ডাররা সবাই ভিড় করে দেখতে এল, জরিনাও ওপর থেকে আবার নিচে নেমে আসে। মতি এবং বদি নাম মুখ খিচিয়ে অনেক কষ্টে উঠে বসে। বদি থুঃ করে থু তু ফেলতেই একটা দাঁত বের হয়ে এল। মতি উঠে বসে আবিষ্কার করল কপালের কাছে ফুলে গিয়ে তার বাম চোখটা বুজে এসেছে। তার ডান হাতটা নাড়তে পারছিল না, মনে হয় সকেট থেকে খুলে এসেছে। বদি দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার বসে পড়ল, তার পা মচকে গিয়েছে।
হোটেলের ম্যানেজার বলল, “এই রকম ঘটনা আর দেখি নাই। এক সাথে দুইজন আছাড় খেয়ে তিন তলা থেকে একেবারে একতলায়!”
জরিনা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বদি আর মতির দিকে তাকিয়ে বলল, “বুড়োধাড়ি দুই জন মানুষ কখনো এইভাবে আছাড় খায়?”
বদি হিংস্র চোখের মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বদমাইস বাচ্চা ইচ্ছা করে এইটা করেছে। আমি স্পষ্ট দেখেছি ইচ্ছা করে আমার পায়ের তলায় কলার ছিলকা ফেলেছে!”
জরিনা ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলো না। দুই মাসের বাচ্চার কোন মোটর কো অর্ডিনেশান থাকে না।”
বদি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “ এই পাজি ছেলের শুধু মোটর কো অর্ডিনেশান না ট্যাংক কো অর্ডিনেশান আর প্লেন- কো অর্ডিনেশানও আছে। আমি এই বাচ্চারে গলা টিপে শেষ করব।”
হোটেলের ম্যানেজার বলল, “এই বাচ্চা আপনাদের কী হয়? মাসুম একটা বাচ্চাকে গলা টিপে মারতে চাচ্ছেন কেন?”
বদি আমতা আমতা করতে লাগল, জরিনা সামলে নিয়ে বলল, “এটা আমার বাচ্চা। কেউ বাচ্চাকে মারতে চাইছে না, রেগে গেছে বলে এরকম বলছে।”
“মাসুম বাচ্চাকে নিয়ে এরকম কথা বলা ঠিক না।”
জরিনা বদি আর মতির কাছে গিয়ে বলল, “তোমরা দাঁড়াতে পারবে কি? নাকি টেনে তুলতে হবে?”
দুজনে অনেক কষ্টে দাঁড়াল। মতি মুখ বিকৃত করে বলল, “হাঁটতে পারব বলে মনে হয় না।”
হোটেলের ম্যানেজার তার কয়েক জন কর্মচারীকে বলল, “এই স্যারদের ওপরে তুলে দিয়ে আয়।”
দুই জন মতিকে চ্যাংদোলা করে ওপরে তুলতে থাকে। বদিকে দুজন মিলে টানাটানি করে বেশী সুবিধে করতে পারে না, শেষ পর্যন্ত জরিনাও হাত লাগায় এবং অনেক কষ্টে তাকে টেনে ওপরে নিয়ে যায়। হোটেল রুমের দরজা খুলে তিন জন যখন মেকুকে বিয়ে ভিতরে ঢুকেছে তখন কারো গায়ে আর কোন ও শক্তি অবশিষ্ট নেই।
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে বলে আবার একটা মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। মেকুকে বিছানায় শুইয়ে রেখে আবার মতি, বদি আর জরিনা গোল হয়ে বসেছে। চব্বিশ ঘণ্টা আগে তারা যখন এভাবে বসেছিল তখন তাদের মাঝে উৎসাহ ছিল। এখন তাদের মাঝে উৎসাহের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই।
বদি চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে পারছিল না, খানিকটা বাঁকা হয়ে বসে বলল, “আমি এখনো বলছি এই হতচ্ছাড়া পাজি বাচ্চাটাকে জানালা দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি যাই।” তার মুখের সামনের একটা দাঁত পরে যাওয়ায় কথাগুলি বলার সময় মুখ থেকে বাতাস বের হয়ে কথাটা কেমন যেন বিচিত্র শুনায়।
জরিনা বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বললে? বাড়ি যাবে? তোমার বাড়িতে গিয়ে দেখ এখন পুলিশ বসে আছে!”
বদি হতাশভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছ।” তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “এই কিডন্যাপ করতে গিয়ে আমাদের কী লাভ হয়েছে?”
মতি তার বুজে যাওয়া চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “এখনো হয় নাই। কিন্তু -”
জরিনা বলল, “আমার হিসাবে মাইনাস তিন লাখ টাকা।”
“মাইনাস?”
“হ্যাঁ। কারণ এখন পর্যন্ত শুধু ক্ষতি। বাড়ি গেছে, গাড়ি গেছে এখন তোমাদের দুই জনের চিকিৎসা করতে গিয়ে কত যাবে কে জানে!”
বদি তার একটা পা সোজা করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “ঠিকই বলেছ।”
জরিনা মতির দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন কী করবে বল?”
“প্রথমে এই বাচ্চার বাসার টেলিফোন নম্বর দরকার।”
“হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে পাবে সেটা? তোমাদের যে অবস্থা এখান থেকে তো বেরই হতে পারবে না।”
মতি পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে বলল, “বের হতে হবে নয়া। এখান থেকেই বের করতে পারব। তিন চারটা টেলিফোন করলেই বের হয়ে যাবে।”
গত কয়েক ঘণ্টায় অবস্থা যেদিকে গিয়েছে মতির কাজকর্মে কারো সেরকম বিশ্বাস নেই কিন্তু দেখা গেল মতি সত্যি সত্যি মেকুর আব্বা আম্মার টেলিফোন নম্বর বের করে নিল। টেলিফোন নম্বরটা একটা কাগজে লিখে মতি যখন সেই নম্বরে ডায়াল করতে যাচ্ছিল তখন বদি বলল, “মতি তুমি করো নয়া। তুমি হচ্ছ কুফা।”
মতি খুব রেগে গেল, বলল, “কুফা? আমি কুফা? তুমি যান আমি এই পর্যন্ত কয়টা কিডন্যাপ কেস করেছি?”
“করে থাকলে করেছ। কিন্তু এই কেসটা তো দেখছ কী হচ্ছে।”
“সেটা কী আমার দোষ?”
“কার দোষ আমি জানি নয়া, কিন্তু তুমি টেলিফোন করতে পারবে নয়া। কারণ তুমি হচ্ছ কুফা। হয় আমি টেলিফোন করব নয়া হয় জরিনা।”
জরিনা বলল, “ঠিক আছে আমিই করছি।”
মতি অত্যন্ত বিরস বদনে টেলিফোনটা জরিনার কাছে এগিয়ে দিল। জরিনা ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করতে গিয়ে থেমে গেল, মতি এবং বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “ইলিয়াস আলীর বাচ্চাটা ছেলে ছিল। এইটা কী ছেলে ননা মেয়ে?”
তিন জনেই মেকুর দিকে তাকাল, সত্যি সত্যি কারো এটা জানা নেই। ছোট বাচ্চার চেহারা দেখে সে ছেলে না মেয়ে বোঝার কোনো উপায় নেই, সেটা নিঃসন্দেহ হতে হলে ন্যাপি খুলে দেখতে হবে। বদি বলল, “দাঁড়াও দেখছি।”
বদি তার মচকে যাওয়া পায়ে ভর দিয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে মেকুর কাছে এগিয়ে যায়, তার ন্যাপি ধরে টানাটানি করতে থাকে। মেকু এত বড় অপমান এত সহজে মেনে নিতে রাজি হল না, সে দুই পা একত্র করে অপেক্ষা করতে থাকে। বদির মুখটা নাগালের মাঝে আসতেই জোড়া পায়ে সমস্ত গায়ের জোরে সেখানে প্রচণ্ড একটা লাথি কষিয়ে দিল। বদির মুখে এমনিতেই ব্যথা, দাঁত ভেঙে সেখানে ফুলে উঠেছে, তার উপর মেকুর জোড়া পায়ে লাথি খেয়ে সে যন্ত্রণায় কোঁক করে শব্দ করে পিছনে গড়িয়ে পড়ল। মুখে এবং মচকে যাওয়া পায়ে চেপে ধরে সে চিৎকার করে ওঠে। মতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “এই টুকুন বাচ্চার লাথি খেয়ে গড়িয়ে পড়লে এই লাইনে এসেছ কেন? তোমার হওয়া উচিত ছিল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।”
বদি মুখে হাত চেপে রেখে হিংস্র গলায় বলল, “এই বাচ্চা সাক্ষাৎ ইবলিশ! আমি একে খুন করে ফেলব।”
মতি ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বল না। দুই মাসের বাচ্চা বুঝে শুনে কিছু করে না। ওরা তো হাত পা ছুঁড়বেই তুমি দূরে থাকতে পার না। মুখ নিয়ে এত কাছে যাবার দরকার কী?”
মতি এবারে নিজেই এগিয়ে গেল। নিজের মাথাটা মেকুর শরীর থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে রেখে সে সাবধানে তার ন্যাপি খুলে ফেলল। মেকু গত কয়েক ঘণ্টা থেকে বাথরুম করার সুযোগ পায় নি তলপেটে প্রচণ্ড চাপ নিয়ে বসে আছে। নিজের কাপড়েরও কিছু করে ফেলতে সাহস পাচ্ছে না, হয়তো ভিজে কাপড়েই সারা রাত শুয়ে থাকতে হবে। এইবার তলপেটের চাপ কমানোর সুযোগ পেয়ে আর দেরি করল না, মতির মুখের দিকে নিশানা করে কাজ সেরে ফেলল। মতি লাফিয়ে সসরে যাবার আগে সে ভিজে চুপসে গিয়েছে, এত যন্ত্রণার মাঝেও বদি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, “এখন বিশ্বাস হয়েছে; এই ছেলে কত পাজি?”
জরিনাও হি হি করে হেসে বলল, “এই বাচ্চাও তা হলে ছেলে।”
মতি বিষ দৃষ্টিতে মেকুর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “হ্যাঁ, এই বাচ্চাও ছেলে। মহা বিচ্ছি ছেলে।”
জরিনা এইবারে টেলিফোনে ডায়াল করল, প্রায় সাথে সাথেই অন্য পাশে মেকুর আব্বার উদ্বিগ্ন গলার স্বর শোনা গেল, “হ্যালো।”
জরিনা বলল, “আমি কী প্রফেসর হাসান সাহেবের সাথে কথা বলতে পারি ?”
“জি। কথা বলছি।”
“চমৎকার হাসান সাহেব। আমি আপনার ছেলের বিষয় নিয়ে কথা বলতে ফোন করেছি।”
টেলিফোনের অন্যপাশে হঠাৎ করে আব্বা চুপ করে গেলেন, কয়েক মুহূর্ত পরে ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “আপনি কে বলছেন?”
“সেটা জেনে আপনি কী করবেন।” আপনার ছেলে নিয়ে কথা বলতে চাইছি সেটা নিয়েই বলা যাক।”
“কোথায় আমার ছেলে? কোথায়?”
“আছে আমাদের কাছে।”
আব্বা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, তার আগেই আম্মা আব্বার হাত থেকে টেলিফোন কেরে নিয়ে চিৎকার করে বললেন, “কে? কে আমার মেকুকে নিয়ে গেছে? কে?”
জরিনা শুকনো গলায় বলল, “আপনি কে?”
“আমি মেকুর মা। তুমি কে?”
জরিনা আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে, আমি মানে ইয়ে -”
“তোমার কত বড় সাহস যে আমার বাসা থেকে তুমি মেকুকে চুরি করে নিয়ে যাও?” আম্মা হুংকার দিয়ে বললেন, “তোমার মাথার চুল আমি ছিঁড়ে ফেলব। ঘুষি মেরে তোমার সব কয়টা দাঁত আমি ভেঙে ফেলব। লাথি মেরে আমি তোমার পাঁজরের হাড্ডি একটা একটা করে ভাঙব। কত বড় সাহস তোমার যে তোমরা আমার মেকুকে চুরি করে নিয়ে যাও?”
জরিনা এই ধমক খেয়ে একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কারো বাচ্চা কিডন্যাপ করে নেওয়ার পর সে যে এরকম খেপে যেতে পারে তার এরকম ধারণা ছিল না। সে কী বলবে বুঝতে পারল না। আম্মা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন তোমরা আমার ছেলেকে চুরি করেছ? কেন?”
জরিনা মিন মিন করে বলল, “ইয়ে মানে, মুক্তিপণ – মানে – ”
আম্মা চিৎকার করে বললেন, “কত বড় ছোটলোক তুমি মুক্তিপণের জন্যে বাচ্চা চুরি কর? লজ্জা করে না বেহায়া বেশরম ধড়িবাজ? তোমার মা বাবা নাই? তোমার বাচ্চা কাচ্চা নাই? কুকুর বিড়াল পর্যন্ত অন্যের বাচ্চা টানাটানি করে না, আর তুমি মানুষ হয়ে আমার বাচ্চা চুরি করেছ? তুমি কুকুর বিড়ালের অধম – ”
জরিনার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না। সে ফ্যাকাসে মুখে টেলিফোনটা মতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও। তুমি কথা বল।”
“কেন?”
“বড় গালাগাল করছেন।”
মতি অবাক হল, তার সুদীর্ঘ কিডন্যাপ জীবনে অভিজ্ঞতায় দেখেছে এরকম অবস্থায় সাধারণত কেউ গালাগালা করে না। সে টেলিফোনটা নিয়ে মধুর, গলায় বলল, “হ্যালো।”
আম্মা এবারে আরো রেগে গেলেন, চিৎকার করে বললেন, “তুমি আবার কোথা থেকে হাজির হয়েছ? তুমি কে?”
“সেটা নিয়ে কথা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আগে আমরা যে জন্যে ফোন করেছি সেটা নিয়ে কথা বলি।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার মেকুকে ফিরিয়ে দাও।”
“কী বললেন? মেকু?”
আম্মা বললেন, “হ্যাঁ। মেকু। আমার ছেলের নাম মেকু।”
“মেকু আবার কী রকম নাম?”
“সেইটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। এই মুহূর্তে আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।”
মতি আরো মধুর গলায় বলল, “সেই জন্যেই তো আপনার কাছে ফোন করেছি। আপনার মেকুকে কীভাবে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব সেটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে না? সবাই যেন খুশি থাকে সেটা একটু দেখবেন না?”
“সবাই যেন খুশি থাকে?”
“হ্যাঁ। আপনার মেকুর যদি কিছু একটা হয়ে যায় তা হলে সেটা কী আপনার ভালো লাগবে?”
আম্মা একেবারে বোমার মতো ফেটে পড়লেন। “কী বললে? তোমরা বদমাইশের দল, চামচিকার দল, খাটাসের দল, তোমরা কী আমার মেকুর গায়ে হাত দিয়েছ?”
মতি মিন মিন করে বলল, “এখনো দেই নাই।”
“খেতে দিয়েছ? বাথরুম করিয়েছ? শুকনো কাপড় পরিয়েছ?”
“না, মানে – ।”
“ঘুমাতে দিয়েছ?”
“ইয়ে – ”
আম্মা মেঘস্বরে বললেন, “আমি বলেছি টেলিফোনটা আমার মেকুকে দাও।”
মতি অবাক হয়ে বলল, “আপনার মেকুর বয়স মাত্র দুই তিন মাস – ”
আম্মা শুদ্ধ করে দিয়ে বললেন, “দুই মাস এগারো দিন।”
“ওই হল। দুই মাস এগারো দিন। দুই মাস এগারো দিনের বাচ্চা কী টেলিফোনে কথা বলতে পারে?”
“তুমি মেকুর কানে টেলিফোনটা লাগাও। আমি তার সাথে কথা বলল।”
“আপনার মেকু টেলিফোনে কথা শুনে কি কিছু বুঝবে?”
“সেইটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। চুরি-চামারি করতে নেমেছ, চুরি চামারি নিয়েই থাক। মা কীভাবে বাচ্চার সাথে কথা বলে সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। টেলিফোনটা মেকুর কানে লাগাও। আমি দেখতে চাই আমার মেকু ভালো আছে কি না।”
মতি কী করবে বুঝতে পারল না। অনেকটা বোকার মতন সে টেলিফোনটা মেকুর কাছে নিয়ে তার কানে লাগাল। আম্মা টেলিফোনে চিৎকার করে ডাকলেন, “মেকু! মেকু – বাবা তুই ভালো আছিস?”
মেকুর ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে, “হ্যাঁ মা ভালো আছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি এই বদমাইশগুলিকে এমন শিক্ষা বেদ যে এরা জন্মের মতো সিধে হয়ে যাবে।” কিন্তু সে এসব কিছুই বলতে পারল না, মায়ের গলার আওয়াজ শুনে দুই মাসের বাচ্চার আনন্দে যেরকম শব্দ করার কথা সেরকম একটা শব্দ করল।
“মেকু বাবা তোকে ব্যথা দিচ্ছে না তো? কোনো যন্ত্রণা দিচ্ছে না তো?”
মেকু “ভ্যারররররর” করে মুখ দিয়ে একটা শব্দ করে মাথা নাড়ল।
“তুই যেখানেই থাকিস না কেন আমি তোকে নিয়ে আসব।”
মেকু আবার মুখ দিয়ে তার শব্দটা করে সম্মতি জানাল। মতি তখন টেলিফোনটা সরিরে নিজের কানে লাগিয়ে বলল, “ছেলের কথা শুনলেন?”
আম্মা বললেন, “হ্যাঁ শুনেছি।”
“চমৎকার। এবার তা হলে বিজনেস সেরে দেখা যাক।”
“বিজনেস?” আম্মা চিৎকার করে বললেন, “আমার ছেলে কি সিমেন্টের বস্তা নাকি গাড়ির পার্টস যে তাকে নিয়ে বিজনেস করবে?”
মতি গলায় স্বরে মধু ঢেলে বলল, “আমার মন হয় আপনি ব্যাপারটার গুরুত্ব ধরতে পারছেন না। হাজার হলেও আপনি তো মা ব্যাপারটা খুব ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে নিচ্ছেন। এটাকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনার সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আপনার ছেলের সাথেও নেই -”
আম্মা ধমক দিয়ে বললেন, “খবরদার তুমি আমার ছেলের কথা মুখে নেবে না। তোমার দুর্গন্ধ ভরা মুখ তোমার নোংরা মুখ – ”
মতি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমি কী আপনার স্বামী প্রফেসর সাহেবের সাথে কথা বলতে পারি?”
“কেন? হাসানের সাথে কেন কথা বলতে হবে?”
“কারণ ব্যাপারটা জরুরি। আমরা আপনাদের মেকুকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাই। ব্যাপারটা যত সহজে করা যায় ততই ভালো। আমি সেটা নিয়ে আপনার স্বামী প্রফেসর হাসানের সাথে কথা বলতে চাই।”
“আমার সাথেই বল ব্যাটা ধড়িবাজ।”
“না, আপনার সাথে বলা যাবে না। চেষ্টা করেছি এতক্ষণ থেকে, আপনি শুধু গালাগাল করছেন।”
“তোমাদের গালাগাল করব না তো কি মাথায় তুলে নাচব? তোমাদের জুতিয়ে সিধে করা দেওয়া দরকার – ”
হঠাৎ করে আম্মার কথা বন্ধ হয়ে গেল, এবং আব্বার গলা শোনা গেল। মনে হল আব্বা এক রকম জোর করে আম্মার হাত থেকে টেলিফোনটা কেড়ে নিয়েছেন। আব্বা বললেন, “হ্যালো।”
“প্রফেসর হাসান সাহেব?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলা খুব কঠিন, খুব অল্পে রেগে যান। আপনার সাথে কথা বলতে আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।”
“কী বলতে চান বলে ফেলেন।”
“মুক্তিপণের টাকার পরিমাণটা আপনাকে জানাই।”
“কত?”
“দশ লক্ষ টাকা।”
আব্বা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “দেখেন, আমাদের ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্যে আমাদের যা আছে সব দিয়ে দেব। কিন্তু আমরা তো আসলে চাকরিজীবী আমাদের হাতে কোনো ক্যাশ টাকা নেই। আমি জীবনে একসাথে দশ লক্ষ টাকা দেখি নি। আমরা – ”
মতি বাধা দিয়ে বলল, “এই সব খুঁটিনাটি নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। আপনারা নিজেদের মাঝে আলোচনা করেন। শুধু একটা ব্যাপার – ”
“কী ব্যাপার?”
“পুলিশকে কিছু জানাতে পারবেন না। পুলিশ আমাদের ধরে ফেলবে সেটা নিয়ে আমরা একবারও মাথা ঘামাচ্ছি না, কিন্তু তাদেরকে জানালে টাকার একটা ভাগ তো তাদেরকেও দিতে হবে কাজেই আপনাদের উপর চাপটা একটু বেশি পড়বে। এই হচ্ছে ব্যাপার।”
আব্বা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু মতি বাধা দিয়ে বলল, “আমি এখন আর কিছুই বলতে চাই না। একটু পরে আবার ফোন করব। শুভ সন্ধ্যা প্রফেসর সাহেব।”
টেলিফোনটা বন্ধ করে মতি যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গি করে বদি এবং জরিনার দিকে তাকাল, বলল, “দেখেছ? কেমন চমৎকার প্রফেশনাল ভাবে কাজ করলাম!”
বদি তার ফুলে যাওয়া মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “কী মনে হয় তোমার, দেবে টাকা?”
“নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু কত দিতে পারবে সেটা হচ্ছে কথা ইউনিভার্সিটির মাষ্টারদের বেতন আর কত? বেচারারা প্রাইভেট টিউশানিও করতে পারে না। কাজেই তাদের কাছে ক্যাশ টাকা কম।”
“যতই হোক, কিছু তো নিশ্চয়ই দেবে।”
“তা দেবে।”
টেবিলে রাখা মোমবাতিটা প্রায় শেষ হয়ে নিভু নিভু হয়ে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে জরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, “কী যন্ত্রণা – ইলেক্ট্রিসিটি আসছে না, গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।”
জরিনার কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ করে লাইট জ্বলে উঠল। আবছা অন্ধকারে সস্তা হোটেলটার দৈন্য দশা বোঝা যাচ্ছিল না, কর্কশ উজ্জ্বল আলোতে হঠাৎ করে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। মলিন বিছানা, নোংরা মশারি, রং ওঠা দেওয়াল এবং সেটাকে আরো প্রকট করার জন্যে ঘরের দেওয়ালে গোবদা একটা মাকড়শা তার পা ছড়িয়ে বসে আছে।
মেকুর খিদে পেয়েছে, কোনো রকম সঙ্কেত না দিলে এরা খেতে দেবে বলে মনে হয় না। সব সময়েই মায়ের দুধ খেয়ে এসেছে এখন কী খেতে দেবে কে জানে। কিন্তু কিছু একটা তো খেতে হবে। মেকু তখন খাবার জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করে একটু কাঁদবে বলে ঠিক করল, তারপর সত্যি সত্যি কাঁদতে শুরু করল।
বদি মতি আর জরিনা তিন জনেই এক সাথে মেকুর দিকে তাকাল, মেকুর কান্নাকে তারা খুব ভয় পায়। বদি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল? কাঁদে কেন?”
মতি বলল, “ছোট বাচ্চার কাজ তিনটা, খাওয়া ঘুম আর বাথরুম। এই মাত্র সে আমার মুখে বাথরুম সেরেচে। কাজেই বাথরুম করতে হবে না। ঘুমের দরকার হলে ঘুমাতে পারে, সে তো শুয়েই আছে। তা হলে বাকি থাকল খাওয়া।”
“কীভাবে খাওয়াবে?”
“ফিডার বোতল কিনে এনেছি, বাচ্চার পাওডার দুধ কিনে এনেছি। পানির সাথে দুধ মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। দুধের কৌটায় লেখা আছে।”
বদি জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “জরিনা, তুমি তা হলে এই বাচ্চাকে একটু খাওয়াবে। এর চিৎকার শুনলে আমার এত ভয় লাগে!”
জরিনা বলল, “কেন? আমি কেন খাওয়াব?”
“ছোট বাচ্চাদের তো মহিলারাই দেখে শুনে রাখে।”
জরিনা নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলেল বলল, “আমাকে কী তোমার সেরকম মহিলা মনে হচ্ছে? বাচ্চা কাচ্চাই যদি আমার জীবনের উদ্দেশ্য হতো তা হলে বিয়ে শাদী করে সংসার করতাম, এই লাইনে আসতাম না।”
মতি বলল, “তর্ক করে লাভ নেই। আছাড় খেয়ে বদি আর আমার দুজনেরই বারটা বেজে গেছে, আমরা খুব বেশি নাড়াচাড়া করতে পারছি না। জরিনা, এখন তোমাকেই কিছু কাজ কর্ম করতে হবে।”
জরিনা গজ গজ করতে করতে উঠে গেল। ফিডার বোতল বের করে তার মাঝে পানি ঢালল, দুধের কৌটা খুলে সেখান থেকে পাওডার দুধ বের করে মিশিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে বোতলটা মেকুর মুখে ধরিয়ে দিল। মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফিডার বোতল টানতে থাকে কিন্তু এক মুহূর্ত পর বোতল থেকে মুখ সরিয়ে বিকট স্বরে চিৎকার করতে শুরু করে।
বদি ভয় পেয়ে বলল, “কী হল? কাঁদছে কেন? এভাবে কাঁদলে তো লোক জমা হয়ে যাবে।”
জরিনা বলল, “বুঝতে পারছি না কেন কাঁদছে।”
মেকুর ইচ্ছে হল দশ কেজি একটা ধমক দিয়ে বলে, “বেকুবের দল, দুধ খেতে হলে নিপলে ফুটো করতে হয়।” কিন্তু সেটা বলতে পারল না, দুই মাসের বাচ্চার যেরকম ভঙ্গিতে কান্নাকাটি করা দরকার ঠিক সেই রকম ভঙ্গিতে চিৎকার করতে লাগল।
জরিনা কী করবে বুঝতে না পেরে ফিডার বোতলটা আবার মেকুর মুখে ঠেসে ধরল। মেকু এক দুইবার চুষে মুখে থেকে বের করে দিয়ে আবার তার স্বরে চিৎকার করতে থাকে।
জরিনার পাশাপাশি বদি এবং মতি এসে দাঁড়াল। মতি চিন্তিত মুখে বলল, “এ তো ঝামেলা হল দেখছি। কী করা যায়?”
বদি মাথা চুলকে বলল, “এর মা’কে ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায় না?”
মতি বলল, “হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। তাই করা যাক।”
বদি জরিনার দিকে টেলিফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও টেলিফোন কর।”
জরিনা ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি করব? যদি আবার গালাগাল শুরু করে দেয়?”
মতি বলল, “দিলে দেবে। তুমিও উলটো গালাগাল করবে। কিন্তু এই বাচ্চার কান্না থামানো না গেলে আমরা বিপদে পরে যাব।”
জরিনা বলল, “টেলিফোন নাম্বারটা জানি কত?”
মতি বলল, “টেলিফোন নাম্বার লাগবে না। মাঝখানের হলুদ বাটনটা চাপ দিলেই লাস্ট নাম্বার রিডায়েল হয়ে যাবে।”
জরিনা হলুদ বোতাম টিপে দিতেই ফোন ডায়াল হয়ে গেল এবং প্রায় সাথে সাথেই মেকুর আম্মার গলার স্বর শোনা গেল, “হ্যালো।”
জরিনা ভয়ে ভয়ে বলল, “আপনি মেকুর মা?”
“হ্যাঁ। আপনি কে?”
“আমি একটু আগে ফোন করেছিলাম, মনে নেই?”
“মনে নেই আবার? একশ বার মনে আছে। কী চাও এখন? আমার মেকুকে ফেরত দেবে কখন? তাকে খাইয়েছ? তার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি কেন, কী হয়েছে?”
“সেই জন্যেই ফোন করেছি। খাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে, খেতে চাচ্ছে না। কী করা যায় জানার জন্যে ফোন করেছি।”
“মেকু খেতে চাচ্ছে না?”
“না।”
“দুধ বেশি গরম হয় নাই তো?”
“না।”
“কতটুকু পানিতে কয় চামুচ দুধ দিয়েছ?”
“সেটা মাপ মতো দিয়েছি, কৌটায় যা লেখা আছে।”
“একেবারেই খেতে চাচ্ছে না? না কি একটু খেয়ে এর খেতে চাচ্ছে না?”
জরিনা বলল, “একেবারেই খেতে চাচ্ছে না।”
আম্মা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, “ফিডার বোতলের নিপলে ফুটো আছে তো?”
জরিনা বলল, “দাঁড়ান দেখি।” বোতলটা হাতে নিয়ে নিপলটি দেখল, সত্যি সত্যি নিপলে ফুটো নেই।
আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, “কী ? আছে?”
“না, নেই।”
আম্মা আবার মহা খাপ্পা হয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, “তোমরা কী রকম কিডন্যাপ করো যে একটা বাচ্চাকে কীভাবে দুধ খাওয়াতে হয় সেটা পর্যন্ত জানো না? মাথার মাঝে কী ঘিলু নেই? সেখানে কী গোবর ভরা আছে? তোমরা কী ভাত খাও নাকি ঘাস খেয়ে থাকো – ”
রাগারাগি এবং গালাগালি আরো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবার আগে জরিনা তাড়াতাড়ি টেলিফোনের কানেকশান কেটে দিল।
নিপলের মাঝে ফুটো করে ফিডারটি মেকুর মুখে ধরে দেবার পর সে এবারে চুক চুক করে চুষতে শুরু করল। ঘরের ভেতরে শেষ পর্যন্ত এবারে শান্তি ফিরে আসে।
মেকু দুধ খেতে খেতে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে। জরিনা টেলিফোনটা রেখেছে একেবারে তার হাতের কাছে। একটু চেষ্টা করলেই সে নাগাল পেয়ে যাবে, আর হলুদ বোতামটা চেপে ধরলেই তার আম্মার কাছে টেলিফোন চলে যাবে। ব্যাপারটা মন্দ নয়।
মেকু শান্ত হয়েছে আবিষ্কার করার পর মতি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “ এবারে তা হলে আমরা ঠিক করে নিই এখন কী করব।”
“হ্যাঁ। বদিও মাথা নাড়ল, “মনে হচ্ছে কিডন্যাপ করাটা পুরোটা জলে যায় নাই। কিছু টাকা বের করা যাবে।”
জরিনা ঠোটে একটা সিগারেট চেপে ধরে ফস করে ম্যাচ জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ, এই অংশটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। ধরা পড়ার আশঙ্কা এই খানে সবচেয়ে বেশি।”
তখন তিন জন মিলে কথাবার্তা বলতে শুরু করে। মেকুকে কোথায় রেখে যাবে। যেহেতু গাড়িটা পুলিশ নিয়ে গেছে আবার নতুন একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে কার কাছ থেকে সেই গাড়ি নেওয়া যায়। মুক্তিপণটা ঠিক কোথায় হস্তান্তর হবে এই রকম খুঁটিনাটি।
আলোচনাটা শুরু হবার সাথে সাথে মেকু বুঝতে পারল এই কথাবার্তাগুলি তার আম্মা আব্বার শোনা দরকার। তার হাতের কাছাকাছি মোবাইল টেলিফোন, মেকু একটু গড়িয়ে সেই টেলিফোনটার কাছে পৌঁছে হলুদ বোতামটা চেপে ধরল। তার আর কিছুই করতে হবে না। আব্বা-আম্মা বাসায় বসে এখন এদের সব কথাবার্তা শুনতে পাবেন।
আসল ব্যাপারটা হল তার থেকে অনেক ভালো। কিডন্যাপ করে ফোন করেছে শুনে পুলিশ রেকর্ড করার যন্ত্র নিয়ে বসেছিল। ফোন বাজার সাথে সাথে তারা রেকর্ড করতে শুরু করল – আম্মা টেলিফোন তুলে বার কতক “হ্যালো হ্যালো” বললেন কিন্তু অন্য পাশে কেউ উত্তর দিল না। টেলিফোনটা রেখে দিতে গিয়ে আম্মা থেমে গেলেন হঠাৎ করে শুনতে পেলেন খুব আবছাভাবে কিছু মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। কথা খুব স্পষ্ট নয় কিন্তু ভাসা ভাসা বোঝা যায়। একটু কান পেতে শুনে আম্মা চমকে উঠলেন – মানুষগুলি কথা বলছে মেকুকে নিয়ে, কিডন্যাপ করার পর মুক্তিপণটা কীভাবে আদায় করবে সেটাই হচ্ছে আলোচনার বিষয়। আম্মা একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন।
পুলিশ সাথে সাথে কাজ শুরু করে দিল, আলাপ আলোচনা থেকে জানতে পারল এখানে তিন জন মানুষ একজনের নাম বদি একজন মতি এবং আরেকজন জরিনা। ফাইল ঘেটে ঘণ্টাখানেকের মাঝেই তাদের ছবিও বের হয়ে গেল, তিনজনেই ঘাঘু আসামি আগেও কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। আগামী কাল মুক্তিপণ আদায় করার জন্যে কোথা থেকে তারা গাড়ি ভাড়া করে কোথায় কীভাবে যাবে সেটাও পুলিশ জেনে গেল।
আধা ঘণ্টা পরে মতি যখন আবার টেলিফোন করে মুক্তিপণ কীভাবে দিতে হবে সেটা নিয়ে মেকুর আব্বা আম্মার সাথে আলোচনা করছিল সে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে নি ততক্ষণে তাদের সব খুঁটিনাটি বের হয়ে গেছে। মুক্তিপণের টাকার পরিমাণ নিয়ে মেকুর আব্বা আম্মা যে ডর কষাকষি করলেন সেটাও যে পুলিশের শেখানো সেটাও সে বুঝতে পারল না। মেকুর আব্বা আম্মা যেটুকু টাকা দিতে রাজি হলেন সেটা যে তাদের মতো কারো মতো কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় সেটা নিয়েও তাদের মনে কোনো সন্দেহ হল না। লোভ বড় ভয়ানক জিনিস, এর কারণে সব কাণ্ডজ্ঞান হঠাৎ করে লোপ পেয়ে যায়।
খাওয়া শেষ করে বদি শব্দ করে একটা ঢেকুর তুলল। মতি তার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলল, “ঢেকুর তোলা অভদ্রতা তুমি জান না?”
“অভদ্রতা?” বদি অবাক হয়ে বলল, “ভালো খেলে মানুষ সব সময় ঢেকুর তুলে।”
জরিনা অর্ধভুক্ত খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই খাবার তোমার কাছে ভালো লেগেছে?”
বদি দ্বিতীয় আরেকটা ঢেকুর তুলে বলল, “খিদে পেলে আমার সব খাবার ভালো লাগে।”
জরিনা এর কিছু বলল না। মতি বলল, “খাবারের ভালোমন্দ নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। বাইরে না গিয়ে ঘরে বসেই যে খেতে পেরেছি সেটাই বেশি।”
“তা ঠিক। পায়ের যা অবস্থা ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে নিচে যেতে হলে অবস্থা কেরোসিন হয়ে যেত।”
“এখন ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”
মতি বলল, “পাশাপাশি দুইটা রুম নিয়েছি। একটাতে আমি আর বদি অন্যটাতে জরিনা আর মেকু।”
জরিনা দেওয়ালে বসে থাকা গোবদা মাকড়শাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ব্যাটা মাকড়শাকে দেখে কী ঘেন্না লাগে, ছিঃ!”
বদি আর মতি দুজনেই মাকড়শাটার দিকে তাকাল, তাদের কাছে সেটা এমন কিছু ঘেন্নার জিনিস মনে হল না। বদির বরং দেখতে ভালোই লাগল, কেমন সুন্দর ফুলের মতো পা ছড়িয়ে আছে। জরিনা বলল, “আমি এই রুমে এই মাকড়শার সাথে থাকব না।”
মতি তার জুতো খুলে দেওয়ালে মাকড়শার দিকে ছুঁড়ে মারতেই মাকড়শাটা তার লম্বা পা ফেলে তিরতির করে দৌড়ে ঘুলঘুলির দিকে পালিয়ে গেল। বদি বলল, “ভালোই হয়েছে, লাগে নাই।”
“কেন? লাগলে কি হত?”
“মাকড়শা মারলে গুনাহ হয়।”
মতি একটু অবাক হয়ে বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা মানুষের বাচ্চা কিডন্যাপ করতে তোমার আপত্তি নেই, তখন গুনাহ নিয়ে চিন্তা হয় না?”
“ওইটা হচ্ছে বিজনেস। বিজনেসে গুনাহ-সওয়াব নাই।”
“ও।”
বদি মেকুর পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে একটা সিগারেট ধরাল। জরিনা অবাক হয়ে বলল, “তুমিও সিগারেট খাও নাকি?”
“সব সময় খাই না। যখন টেনশান হয় তখন খাই।”
“এখন টেনশান হচ্ছে?”
“হ্যাঁ।”
মতি বলল, “তাড়াতাড়ি সবাই শুয়ে পড়। আগামী কাল অনেক কাজ।”
জরিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মনে হয় এত সহজে ঘুম আসবে না।”
মতি পকেট হাতড়ে একটা শিশি বের করে বলল, “ এই যে আমার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে। ঘুমানোর আগে একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিও, দেখ ভালো ঘুম হবে।”
“দেখি কী টেবলেট?”
জরিনা ওষুধের শিশিটা নিয়ে দেখতে থাকে। মতি বলল, “কড়া ওষুধ, একটা খেলেই রাত কাবার হয়ে যায়। গোটা দশেক খেলে হাসপাতালে নিতে হবে।”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে ওষুধের শিশিটা দেখার চেষ্টা করল, এই ট্যাবলেট কয়েকটা যোগাড় করতে পারলে মন্দ হয় না। সকাল বেলা কোনো একজনের চায়ের মাঝে দিয়ে দিতে পারলে ঘুমে কাদা হয়ে থাকবে!
মেকু হঠাৎ বাঁশির মতো একটা শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার জন্যে সে এদিক ওদিক তাকায়, তখন জরিনার হাসি শুনতে পেল। জরিনা বলল, “বদির কাণ্ড দেখেছ? এর মাঝে শুয়ে নাক ডাকতে আরম্ভ করেছে!”
মতিও একটু হাসল, বলল, “হ্যাঁ, বদি খুব সহজে ঘুমিয়ে যেতে পারে। যে কোনো জায়গায় বসে বসে ঘুমিয়ে নেয়।”
মেকু বদির দিকে তাকাল, একটা সিগারেট টানতে টানতে ঘুমিয়ে গেছে, সিগারেটের হাতটা একেবারে মেকুর কাছে। সিগারেটের বাজে একটা গন্ধ আসছে। তার আম্মা কাছাকাছি থাকলে এ জন্যে বদির মুণ্ডুই মনে হয় আলাদা করে ফেলতেন। সিগারেটের গন্ধটা খুব খারাপ লাগছে, মেকু একবার সিগারেটের দিকে তাকাল, ইচ্ছে করলে হাত থেকে টেনে নিয়ে নিচে ছুঁড়ে দিতে পারে। চেষ্টা করে দেখবে নাকি?
মেকু এদিক সেদিক তাকাল, জরিনা আর বদি অন্য দিকে তাকিয়ে আছে, তাকে খেয়াল করছে না। সে সাবধানে সিগারেটটা ধরে বদির হাত থেকে নিয়ে আসে, এখন একটু চেষ্টা করলেই দূরে ছুঁড়ে দিতে পারবে। মেকু ছুঁড়তে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল, ছুঁড়তেই যদি হয় তা হলে বদির উপরে ছুড়লেই তো হয়, তিরিং বিড়িং করে যা একটা লাফ দেবে সেটা নিশ্চয়ই দেখার মতো একটা ব্যাপার হবে। মেকু বদির বুকের উপর নিশানা করে সিগারেটটা ছুঁড়ে মারল। শুয়ে থেকে মেকু ঠিক দেখতে পেল না সিগারেটটা বুকে পড়ে গড়িয়ে তার সার্টের বুক পকেটে ঢুকে গেছে, সেখানে তার ম্যাচটা রয়েছে। মেকু একটা চিৎকার এবং লাফ ঝাপ আশা করছিল কিন্তু তার কিছুই হল না। মেকু যখন প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেল সিগারেটটা সে ঠিকমতো বদির উপরে ফেলতে পারে নি ঠিক তখন ব্যাপারটি ঘটল, হঠাৎ করে বদির বুক পকেটের পুরো ম্যাচটাই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। বদি ভয়ংকর একটা চিৎকার করে উঠে বসে, হঠাৎ করে তার বুকের মাঝে কেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে বুঝতে পারে না, সে মিছাই বুকে থাবা দিয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পাগলের মতো লাফাতে থাকে, বিছানায় পা বেঁধে সে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে, সেখান থেকে মচকে যাওয়া পা নিয়ে সে আবার তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে তারপর ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে সারা ঘরে ছোটাছুটি করতে থাকে।
জরিনা এবং মতিও বদির পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকে – পলিস্টারের সার্ট আগুন ধরে গেলে নেভানো কঠিন, টান দিয়ে বোতাম ছিঁড়ে সার্টটা খুলতে হল এবং পা দিয়ে তার উপর লাফিয়ে সেই আগুন নেভাতে হল। বদির বুকের কাছে খানিকটা জায়গা পুড়ে গেছে, বুকের লোম পুড়ে সারা ঘরে একটা বোটকা গন্ধ। সব মিলিয়ে একটা ভয়ংকর অবস্থা। চেচামেচি এবং হই চই নিশ্চয়ই বেশি হয়ে গিয়েছিল কারণ হোটেলের লোকজন এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে জানতে চাইল কী হয়েছে। জরিনা দরজা ফাঁক করে মধুর হাসি হেসে বলল, “কিছু হয় নাই। তেলাপোকা উড়ছিল দেখে ভয় পেয়েছে।”
“তেলাপোকা দেখে এত ভয়?”
“কেউ তেলাপোকা দেখে ভয় পায়। কেউ মাকড়শা ভয় পায়। কেউ ইঁদুর ভয় পায়। যার যেটাতে ভয়।”
“কিন্তু পোড়া গন্ধ কিসের?”
“ভয় পেয়ে সিগারেট ছুঁড়ে দিয়েছে, চুলে এসে পড়েছে। চুল পোড়া গন্ধ।”
ব্যাখ্যাটুকু মানুষগুলির কতটুকু বিশ্বাস হয়েছে ঠিক বোঝা গেল না, কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তারা চলে গেল। মতি আর জরিনা তখন বদির দিকে নজর দিল। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“বু-বুকে আগুন লেগে গেছে!”
“সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।” জরিনা রেগে মেগে বলল, “শুধু বাংলা সিনেমায় শুনেছি বুকে আগুন লেগে যায়। তোমার বুকে কেমন করে আগুন লাগল?”
বদি নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে মুখে বলল, “মনে হয় ঘুমের মাঝে সিগারেটটা শরীরে পড়ে গেছে!”
মতি হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, “ শুধু মাত্র পুরোপুরি গবেট হলে মানুষ সিগারেট খেতে খেতে ঘুমিয়ে যায়।”
বদি মিন মিন করে বলল, “ইচ্ছে করে তো আর ঘুমাই নাই। হঠাৎ কেমন যেন ঘুম এসে গেল। টেনশান হলেই আমার বেশি ঘুম পায়।”
জরিনা মাথা নেড়ে বলল, “আমি জন্মেও এরকম কথা শুনি নি, টেনশান হলে বেশি ঘুম পায়!”
মতি বলল, “যার যেরকম নিয়ম।”
বদি মেঝে থেকে তার সার্টটা তুলে দেখে পকেট পুরোটা জ্বলে গিয়ে বুকের মাঝে পোড়া একটা গর্ত। স্থানে স্থানে পুড়ে পুরো সার্টটা কুঁকড়ে গেছে। বদি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কোনো কাপড় জামা আনি নাই কাল এই সার্ট পড়ে বের হব কেমন করে?”
মতি একটা নিশ্বাস ফেলেল বলল, “সেটা কাল দেখা যাবে, এখন ঘুমানোর ব্যবস্থা করা যাক।”
বদি মুখ বিকৃত করে বলল, “বুকের ভিতর যা জ্বালা করছে!”
জরিনা মুখ ভেংচে বলল, “ একেবারে বাংলা নাটকের ডায়ালগ!”
“সত্যি বলছি! মনে হয় ফোসকা পড়ে যাবে।”
“এখন কিছু করার নেই।” মতি বলল, “রাতটা কোনোভাবে কাটিয়ে দাও, কাল ভোরে দেখা যাবে।”
মেকুকে একটা বিছানায় শুইয়ে তার পাশে জরিনা বসে একটা সিগারেট টানছে। সিগারেটের দুর্গন্ধে মেকুর নাড়ি উলটো আসতে চায় কিন্তু কিছু করার নেই। মানুষ কেন যে এই দুর্গন্ধের জিনিসগুলি খায় কে জানে। সিগারেট টানা শেষ করে জরিনা তার ব্যাগ থেকে ওষুধের শিশিটা বের করল, শিশিটা খুলে সেখান থেকে একটা ট্যাবলেট হাতে নিয়ে শিশিটা বন্ধ করার জন্যে ছিপিটা লাগানর চেষ্টা করছিল, মেকু তখন বিছানায় শুয়ে থেকেই জরিনার হাতের কবজিতে গায়ের জোরে একটা লাথি কষালো। ওষুধের শিশিটা শুন্যে উড়ে গিয়ে সবগুলি ট্যাবলেট চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ট্যাবলেট এসে পড়ল তার শরীরে, কিছু তার আশেপাশে।
জরিনা একটা চিৎকার করে মেকুর দিকে ছুটে এসে বলল, “বদমাইশ পাজি ছেলে! গলাটিপে মেরে ফেলব। একেবারে জানে শেষ করে ফেলব।”
মেকুর এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল সত্যিই বুঝি জরিনা তার গলা টিপে ধরবে, সে তাড়াতাড়ি তার মাড়ি বের করে একটা হাসি দিল এবং এই হাসি দেখে জরিনা শেষ পর্যন্ত একটু নরম হল। সে নিচু হয়ে গজ গজ করতে করতে ট্যাবলেটগুলি তুলে নিতে শুরু করে। মেকু সেই ফাকে তার আশেপাশে পড়ে থাকা ট্যাবলেটগুলি তুলে নিতে শুরু করে, সব মিলিয়ে পাঁচটা ট্যাবলেট সে তার দুই হাতে মুঠি করে লুকিয়ে ফেলল। জরিনা মেঝে থেকে ট্যাবলেটগুলি তুলে বিছানায় পড়ে থাকা ট্যাবলেটগুলিও তুলে শিশিতে ভরে শিশিটা আবার ব্যাগে ভরে নেয়।
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল জরিনা একটা ট্যাবলেট খেয়ে লাইট নিবিয়ে তার বিছানায় গিয়ে শুয়েছে। ওষুধ খেয়ে শুয়েছে। নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মাঝে ঘুমিয়ে পড়বে। মেকু ইয়ে ইয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এখনো তার দুই মাস হয় নাই আর মাঝে সে একি বিপদে পড়ল? তার আম্মা সত্যি সত্যি তাকে উদ্ধার করতে পারবেন তো?
মেকু শুনল জরিনা তার বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। মনে হচ্ছে ঘুম আসছে না। হোটেলের ঘরটা ছোট, দুটি বিছানা বেশ কাছাকাছি, আলো নিবিয়ে দেওয়ার পরও জানালা দিয়ে অল্প আলো এসে ঘরের মাঝে একটা আলো আঁধারি ভাব চলে এসেছে। কত রাত হয়েছে কে জানে, চারিদিক খানিকটা চুপচাপ হয়ে এসেছে। মেকুর কেমন জানি ভয় ভয় করতে থাকে। একা একা শুয়ে তার মন খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে একটু কেঁদে নেয়, মনে হয় শব্দ করে একটু কেঁদেও ফেলেছিল কারণ হঠাৎ জারিনা লাফিয়ে বসে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কে?”
ঠিক তখন মেকুর মাথায় বুদ্ধিটা এল। আগে যতবার সে কথা বলেছে ততবারই মানুষেরা ভয় পেয়েছে, এখন ভয় দেখানোর জন্যেই কথা বললে কেমন হয়? মেকু চিন্তা করল কী বলা যায় – মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে কী বলতে হয় কে জানে? জরিনার নাম ধরে ডাকাডাকি করে দেখা যাক। মেকু যতটুকু সম্ভব গলার স্বর মোটা করে বলল, “ জরিনারে জরিনা —”
তখন যা একটা কাণ্ড হল সেটা আর বলার মতো না! জরিনা লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে ভাঙা গলায় বলল, “কে? কে?”
মেকু গলার স্বর মোটা করে বলল, “আমি!”
“আমি কে?”
“আমারে তুমি চেনো না, হি- হি- হি –”
জরিনা তখন লাফিয়ে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করতে গিয়ে মশারিতে পা বেঁধে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল। একটা চিৎকার করে উঠতে গিয়ে টেবিলে মাথা ঠুকে গেল, অন্ধকারে কোনোমতে সে দরজার দিকে ছুটে যেতে থাকে, মেকু তখন আবার সুর করে গাইতে লাগল,
“জরিনারে জরিনা
কেন তরে ধরি না
ধরে কেন মরি না
ও জরিনারে জরিনা!”
জরিনা দরজায় মাথা ঠুকে খামচা খামচি করতে করতে কোনমতে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। একটু পরে মেকু শুনতে পেল জরিনা পাশের ঘরে গিয়ে হাউ মাউ করে কান্নাকাটি করছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই মতি এবং বদিকে নিয়ে জরিনা ফিরে এল। তিনজন খুব সাবধানে দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকল, মতি এবং বদি দুজনের হাতেই একটা করে রিভলবার। জরিনা লাইট জ্বালাতেই মেকু চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাবার ভান করল। মতি এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, “ এই ঘরে কেউ নাই।”
জরিনা বলল, “আমি জানি কেউ নাই।”
“তা হলে কে কথা বলবে?”
“আমি জানি না।”
“কোথা থেকে শব্দটা এসেছে?”
জরিনা মেকুর বিছানা দেখিয়ে বলল, “ওইদিক থেকে।”
“ওই দিকে তো কেউ থাকতে পারে না, খালি বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে।”
বদি মাথা নিচু করে মেকুর বিছানার নিচে তাকিয়ে বলল, “এই ঘরে কেউ নাই জরিনা। তুমি ভুল শুনেছে।”
“আমি ভুল শুনি নাই। আমি স্পষ্ট শুনেছি। বলেছে, জরিনারে জরিনা –”
মতি ভুরু কুঁচকে বলল, “গলার স্বর কী রকম?”
জরিনা দুর্বল গলায় বলল, “নাকী গলার স্বর। মেয়েদের মতন।”
“মেয়েদের মতন?” মতি অবাক হয়ে বলল, “মেয়েদের গলায় কে কথা বলবে?”
জরিনা কাঁপা গলায় বলল, “আমার মনে হয় এই ঘরটায় দোষ আছে।”
বদি অবাক হয়ে বলল, “ঘরের আবার দোষ থাকে কেমন করে?”
মতি গম্ভীর গলায় বলল, “ কোনো ঘরে ভূত প্রেত থাকলে বলে ঘরে দোষ আছে।”
বসি এবারে ঘাবড়ে গেল, বলল, “এই ঘরে ভূত আছে?”
“ধুর!” মতি হাত এরে বলল, “ভূত আবার কোথেকে আসবে?”
“তা হলে আমি কী শুনেছি?”
“ভুল শুনেছ।”
জরিনা রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল, “আমি ভুল শুনি নাই। স্পষ্ট শুনেছি।”
মতি ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল, “আস্তে কথা বল। এই বাচ্চা ঘুমিয়েছে, ওঠে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে।”
জরিনা গলা নামিয়ে বলল, “আমি স্পষ্ট শুনেছি। কোনো ভুল নাই।”
মতি বলল, “তুমি কী ঘুমের ওষুধটা খেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। একটা ট্যাবলেট খেয়েছি।”
মতি গম্ভীভাবে মাথা নেড়ে বলল, “মনে হয় ওষুধের জন্যে হয়েছে। হেলুসিনেশান হয়েছে।”
জরিনা মুখ শক্ত করে বলল, “আমার হেলুসিনেশান হয় নাই।”
বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “ তাহলে কী তুমি বলতে চাও এই বাচ্চাটা ঘুমের মাঝে তোমাকে নিয়ে গান গাইছে?”
জরিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, আমি সেটা বলছি না।”
“তা হলে এটা নিয়ে আর কথা বলে কাজ নেই। কাল অনেক কাজ, এখন ঘুমাও। তোমার যদি ভয় লাগে তা হলে আমি এই ঘরে ঘুমাই।”
ভয় লাগার কথা বলায় জরিনার আত্মসম্মানে একটু আঘাত লাগল। সে বলল, “না, ঠিক আছে। আমিই ঘুমাব।”
বদি আর মতি বের হয়ে যাবার পড় জরিনা দরজা বন্ধ করে পুরো ঘরটা আবার ভালো করে পরীক্ষা করে বিছানায় বসে একটা সিগারেট খেল। তারপর লাইল নিভিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। মেকু আবার চোখ খুলে তাকাল, ভয় দেখানোর ব্যাপারটি সে যতটুকু আশা করছিল তার থেকে অনেক ভালোভাবে কাজ করেছে। ঘুমানোর আগে আরো একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
মেকু বেরশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। যখন মনে হল জরিনা প্রায় ঘুমিয়ে যাচ্ছে তখন সে আবার সুর করে ডাকল, “জরিনা-আআআআআআ—-”
মেকুর ডাক শুনে জরিনা এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে বসে। এবারে সে আগেরবার থেকেক বেশি ভয় পেয়েছে। মেকু আবার সুর করে গাইল,
“জরিনা…আ্…আ…আ…আ…আ…আ………”
তোরে ছাড়া নড়ি না…আ…আ…আ…আ…আ…আ…………”
মেকুর কথা শেষ হবার আগে জরিনা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বিছানা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে তারপর হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়, কোনোভাবে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরের দরজায় দমাদম লাথি মারতে থাকে। হাসির চোটে মেকুর প্রায় পেট ফেটে যাবার অবস্থা হল, সে পেট চেপে একা একাই খিক খিক করে হাসতে লাগল।
কিছুক্ষণের মাঝেই মতি বদি এবং তাদের পিছু পিছু জরিনা এসে ঢুকল। ঘরে এসে আলো জ্বালিয়ে আবার ঘরের চারিদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হল, কোথাও কিছু নেই। জরিনা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলেল বলল, “আমি এই ঘরে থাকব না। এই ঘরের দোষ আছে।”
মতি বলল, “এই ঘরে থাকবে না কারণ এইখানে ভূত আছে। ওই ঘরে থাকবে না কারণ সেখানে মাকড়শা আছে। তুমি তা হলে থাকবে কোথায়?”
“আমি মাকড়শার সাথেই থাকব। কিন্তু ভূতের সাথে থাকব না।”
“ঠিক আছে তুমি তা হলে বাচ্চাটাকে নিয়ে ওই ঘরে যাও। আমি আর বদি এই ঘরে থাকি।”
জরিনা মাথা নাড়ল, “না না। আমি একলা থাকতে পারব না। আমার সাথে বড় একজনের থাকতে হবে। এই দেখ ভয়ে এখনো আমার হাত-পা কাঁপছে।”
বদি এবং মতি দুজনেই দেখল জরিনার হাত তির তির করে কাঁপছে, মুখ ফ্যাকাশে, উসকোখুসকো চুল এবং কিছুক্ষণের মাঝেই চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। মতি চিন্তিত মুখে বলল, “ঠিক আছে বদি তুমি জরিনার সাথে ওই ঘরে থাক। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে এই ঘরে থাকি।”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল জরিনা আর বদি পাশের ঘরে গিয়েছে। মতি তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। হাতের রিভলবারটা টেবিলের ওপর রেখে ঘরের আনাচে কানাচে পরীক্ষা করে লাইট নিবিয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে ঢুকে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। পুরো ব্যাপারটা যেভাবে যাওয়ার কথা সেটা মোটেও সেভাবে যাচ্ছে না। পদে পদে বাধা।
মতির চোখে যখন প্রায় ঘুম নেমে এসেছে হঠাৎ করে সে একটা বিচিত্র শব্দ শুনল, একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ। তারপর মেয়েলি গলায় কে যেন স্পষ্ট গলায় ডাকল, “মতি, এই মতি—”
মতি লাফিয়ে উঠে বসে। ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কে?”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে মতিকে লক্ষ করল, তার কাছে একটা রিভলবার আছে আবার গুলি না করে দেয়। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে সুর করে বলল,
“মতি রে মতি
তোর নাই গতি
এক কামড়ে ছিঁড়ে নিব
তোর কানের লতি—”
মেকুর গানের গলা ভালো না, সুরও খুব আছে বলে মনে হয় না, গানের কথাও খুব উচু দরের না কিন্তু সব মিলিয়ে তার ফল হল ভয়ানক। মতি চিৎকার করে কলমা পড়তে পড়তে দরজার দিকে ছুটে গেল, দরজাটা বন্ধ সে কথাটা তার মনে নেই সেখানে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে সে উলটো দিকে আছাড় খেয়ে পড়ল। কাছাকাছি একটা পলকা চেয়ার ছিল সেটা ভেঙে মতি একেবারে মেঝেতে কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল। মেকু সুযোগ ছাড়ল না, আবার নতুন উৎসাহে গেয়ে উঠল,
“মতি মতি মতি
তুই যদি তেলাপোকা হতি
কী হতো রে ক্ষতি?”
মতি শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে আবার দরজার দিকে ছুটে গেল। প্রচণ্ড জোরে দরজায় আঘাত করে এবারে দরজার ছিটকিনি ভেঙে বের হয়ে গেল। “আঁ আঁ আঁ” করে চিৎকার করে সে পাশের ঘরের দরজার সামনে আছাড় খেয়ে পড়ল। সেখানে হাঁটু ভেঙে পড়ে থাকা অবস্থায় অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো কলমা পড়তে লাগল।
দরজা খুলে বদি এবং জরিনা বের হয়ে আসে, মতির বিকট চিৎকার এবং ছিটকিনি ভেঙে বের হয়ে আসার শব্দে হোটেলের আশেপাশের লোক এবং নিচে থেকে হোটেলের কর্মচারীরাও উঠে এল। জরিনা চাপা গলায় বলল, “মতি! কী শুরু করেছ? মানুষের ভিড় জমে যাচ্ছে দেখেছ?”
মতি তখনো থর থর করে কাঁপছে, কথা বলতে পারছে না। হাতের রিভলবারটা সেই অবস্থায় লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। বদি বলল, “মতি, আল্লাহ্র কালাম পড়ছ, ওজু আছে তো?”
মতি সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল, যা ব্যাপার ঘটেছে তাতে ওজু থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। হোটেলের একজন কর্মচারী এগিয়ে এসে বলল, “কী ব্যাপার? মাতলামী করছে কেন?”
বদি বলল, “মাতলামী না। ভয় পেয়েছে।”
“ভয় পেয়েছে? কী দেখে ভয় পেয়েছে?”
জোড়ীণা বোল্ল, “ভূত।”
হোটেলের কর্মচারী অবাক হয়ে বলল, “ভূত?”
“হ্যাঁ। এই ঘরে কে যেন নাকী সুরে কথা বলে। ডাকাডাকি করে।”
মানুষজন হঠাৎ করে পিচিয়ে গেল। এক-দুইজন অনুচ্চ স্বরে আয়াতুল কুরসি পড়ে নিজেদের বুকে ফুঁ দিয়ে দিল। হোটেলের কর্মচারী আমতা আমতা করে বলল, “ভূত কীভাবে আসবে?”
জরিনা কঠিন গলায় বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে এই ঘরে কিছুক্ষণ থাকেন। পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবে।”
“আপনার বাচ্চাটা কোথায়?”
তখন সবার মেকুর কথা মনে পড়ল। জরিনা বলল, “ওই ঘরে।”
“ভূতের সাথে রেখে এসেছেন? বাচ্চা ভয় পাবে না।”
মেকু তখন তার শরীর বাঁকা করে ভয়ংকর চিৎকারটা দেওয়া শুরু করল। তার মনে হল এরকম অবস্থায় এ ধরনের একটা ভয়ংকর চিৎকার দেওয়া হলে পরিবেশটা আরো জমজমাট হবে। বাচ্চা বিপদে পড়লে মায়েরা নিজের জীবন বিপন্ন করে ছুটে যায় কিন্তু এখানে সেরকম কিছু ঘটল না। জরিনা বদিকে খোঁচা দিয়ে বলল, “বদি যাও, দেখ কী হয়েছে।”
“আমি কেন যাব? তুমি যাও।”
হোটেলের কর্মচারী অবাক হয়ে বলল, “আপনারা কী রকম বাবা মা? নিজের বাচ্চার জন্যে কোনো মায়া দয়া নাই?”
বদি এবং জরিনা তখন একসাথে আমতা আমতা করতে শুরু করল, বলল, “না-মানে-ইয়ে-আসলে – কিন্তু—ইয়ে—মানে—”
হোটেলের কর্মচারী মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আপনাদের সবকিছুই কেমন জানি সন্দেহজনক। কোথা থেকে একটা বাচ্চা এনেছেন। কে বাচ্চার মা কে বাবা তাও ঠিক করে বলতে পারেন না। একবার সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েন। একবার ঘরে আগুন দিয়ে দেন। একবার বলেন ভূতের ভয় পেয়েছেন। আপনাদের বাচ্চা একা একা ঘরে চিৎকার করে কাঁদছে কেউ একবার দেখতেও যাচ্ছেন না। কী হচ্ছে এখানে?”
উপস্থিত অন্য সবাই মাথা নাড়ল এবং হঠাৎ করে মতি বদি জরিনা বুঝতে পারল ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। জরিনা বদিকে নিয়ে গেল মেকুকে দেখতে আর মতি নিজেকে সামলে নিয়ে যেটুকু অঘটন ঘটেছে সেটা সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। হোটেলের কর্মচারী অবিশ্যি সোজা মানুষ নয়, আরেকটু হলে সে পুলিশকেই খবর দিয়ে দিতে যাচ্ছিল, একেবারে কড়কড়ে দুইটা পাঁচ শ টাকার নোট দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে শান্ত করতে হল।
গভীর রাতে মেকুকে একটা বিছানায় শুইয়ে অন্যেরা কেউ মেঝেতে, কেউ চেয়ারে এবং কেউ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ঘরে আলো জ্বলছে, আলো নিভিয়ে অন্ধকার করার কারো সাহস নেই। আজ রাতে কারো চোখে আর ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। মেকু অবিশ্যি মজা দেখার জন্যে আর জেগে থাকতে পারল না, ঘুমে তার দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, সে ঘুমিয়ে পড়ল, আগামী কাল মেকুর অনেক কাজ – ভালো করে ঘুমিয়ে না নিলে কেমন করে চলবে? ঘুমের মাঝেও সে তার দুই হাত শক্ত করে মুঠি করে রাখল, সেখানে পাঁচটা ঘুমের ট্যাবলেট ধরে রেখেছে, ভোর বেলা কায়দা করে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে।
জরিনা ঢুলু ঢুলু চোখে কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ মতির দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হেসে ফেলল। মতি একটু গরম হয়ে বলল, “কী হল, হাস কেন?”
“তোমাকে দেখে।”
“আমাকে দেখে হাসির কী হয়েছে?”
“তুমি যখন দরজা ভেঙে বের হয়ে এসেছ তখন তোমার আরেকটা জিনিস ভেঙ্গেছে।”
“কী?”
“নাক। নাক্তা দেখেছ তোমার? এখন এক পাশে কাৎ হয়ে আছে।”
মতি নিজের নাকটা স্পর্শ করে একটা নিশ্বাস ফেলল, সত্যি সত্যি সে নিজের নাকটা নিজে ভেঙে ফেলেছে।
“শুধু যে কাৎ হয়ে আছে তাই না, লাল হয়ে টমেটোর মতো ফুলে উঠেছে। হি হি হি!” জরিনা আবার হাসতে থাকে।
মতি রেগে মেগে বলল, “এখন এইটা নিয়ে রাত দুপুরে হাসাহাসি করতে হবে?”
“কী করব? ঘুমাতে যখন পারবই না এই গুলি নিয়েই গল্প-গুজব করি। হাসি তামাশা করি।”
“ঠিক আছে। তা হলে আমিও তোমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করি। তোমাকে দেখতে কী রকম লাগছে জান? তোমাকে দেখাচ্ছে ঠিক একটা পেত্নীর মতো। পেত্নী চিন তো? ওই যে গাব গাছে শুকনো ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে থাকে- ”
“কী বললে তুমি? আমি পেত্নী?” জরিনা সোজা হয়ে বসে একটা গ্লাস তুলে বলল, “এই গ্লাসটা ছুঁড়ে তোমার চোখ আমি কানা করে দেব।”
বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “এই মাঝরাতে তোমরা এটা কী শুরু করলে বাচ্চা পোলাপানের মতো?”
জরিনা ক্রুদ্ধ গলায় বদিকে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি চুপ কর হোঁদল কুতকুত কোথাকার –”
“কী বললে? কী বললে আমাকে?”
“আমি বলেছি হোঁদল কুতকুত।”
“আমি যদি হোঁদল কুতকুত হই তা হলে তুমি হচ্ছ মাকড়শার ঠ্যাং –”
“কী বললে?” জরিনা আগুন হয়ে বলল, “কী বললে আমাকে? আমি মাকড়শার ঠ্যাং —”
মতি হাত তুলে বলল, “চুপ, চুপ সবাই চুপ। হোটেলের কর্মচারী এসে আমাদের বের করে দিলে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই রাতে আমাদের কিন্তু আর থাকার জায়গা নেই। মহা কেলেংকারি হয়ে যাবে।”
কথাটা একেবারে পুরোপুরি সত্যি কাজেই বদি এবং জরিনা চুপ করে গিয়ে ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। মতি বলল, “এখন সবাই একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। কালকে আমাদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। সারারাত বসে বসে ঝগড়াঝাঁটি করলে সকালে কিছুই করতে পারব না।”
জরিনা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলেল মেকুর দিকে তাকাল, কী আরামে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে দেখে হিংসায় তার চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়।
আগামী কালের জন্যে মেকু কী পরিকল্পনা করে রেখেছে জানলে জরিনার অবশ্যি তখন তখনই হার্টফেল হয়ে যেত।
ভোরবেলা মেকু ভরপেটে দুধ খেয়ে, বাথরুম সেরে শুকনো পরিষ্কার কাপড় পরে ফিটফাট হয়ে নিল। মতি বদি আর জরিনার অবস্থা অবশ্যি এত ভালো হল না। তিন জন সারা রাত ঘুমাতে পারে নি চেহারায় তাই একটা ঝড়ো কাকের ভাব চলে এসেছে। জরিনার চুল নোংরা পাটের দড়ির মতো হয়ে গেছে। না ঘুমিয়ে চোখ গভীর গর্তে ঢুকে গেছে, চোখের নিচে কালি, চোখ টকটকে লাল, মনে হচ্ছে চোখের পাতিগুলি শিরীষ কাগজ দিয়ে তৈরি, প্রত্যেক বার চোখের পাতি ফেললেই চোখের ভেতর কড় কড় করে উঠে।
গত রাত্রে ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করার সম্য নানাভাবে আছাড় খেয়ে পড়েছে, তখন বুঝতে পারে নি কিন্তু এখন টের পাচ্ছে যে জরিনা অনেক খারাপভাবে ব্যথা পেয়েছে। ঠিক কপালের উপরে একটা জায়গা ঢিবির মতো ফুলে আছে। বাম কান দিয়ে মনে হয় ভালো করে শুনতে পাচ্ছে না, মাঝে মাঝে ভোঁ ভোঁ করে বোলতার পাখা ঝাপটানোর মতো একটা শব্দ হয়। ডান হাতটা ভালো করে নাড়াতে পারছে না, কনুইটা লাল হয়ে ফুলে ওঠেছে। বাম পা’টা একটু অকেজো হয়ে গেছে, হাঁটার সময় পা’টা ভিতরের দিকে চলে এসে এবং কনকন করে কোথায় জানি ব্যথা করে ওঠে।
বদির মচকে ওঠা পা’টা এখন ফুলে উঠেছে, সেই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। গরকাল সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে তার যে দাঁতটা ভেঙে গিয়েছিল সেটা এখন প্রচণ্ড ব্যথায় কন কন করছে, পুরো মুখটাই ফুলে উঠেছে। সার্টের পকেটে আগুন লেগে বুকের ছাল চামড়ার যে অংশটা পুড়ে গিয়েছিল সেখানে এখন দগদগে ঘা, শুধু বুক নয় শরীরে চিঞ্চিনে ব্যথা। সারা রাত ঘুমাতে পারে নি বলে গা গুলিয়ে বমি বমি ভাব, মনে হচ্ছে হড় হড় করে বমি করে দেবে।
মতির অবস্থা আরো খারাপ, কপালের কাছে আগেই ফুলে উঠে একটা চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল, তার উপর নাকটা ভেঙে গিয়ে চেহারায় কেমন যেন হাস্যকর একটা ভাব চলে এসেছে। ডান হাতটা মোটামুটি অকেজো হয়ে আছে – মনে হয় সেটা সকেটের ভেতর থেকে যে কোনো মুহূর্তে খুলে আসবে, কেমন জানি ঢল ঢল করছে। সারা রাত না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালি, সেটাকে পরিপূর্ণ করার জন্যে মুখের অর্ধেক অংশ কালশিটেতে ঢেকে আছে। হঠাৎ করে দেখলে কেমন জানি আঁতকে উঠতে হয়।
তিন জন এক জন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। নিচে নাস্তা দেওয়ার জন্যে খবর দেওয়া হয়েছিল, নাস্তা খেয়েই তারা রওনা দেবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই এক জন নাস্তা দিয়ে গেল। সবারই খুদে লেগেছে কিন্তু সারা রাত না ঘুমিয়ে খাওয়ায় রুচি নেই। যেটুকুই রুচি ছিল মুখের নানা জায়গায় প্রচণ্ড ব্যথার কারণে কেউ ভালো করে কিছু খেতে পারল না। মেকুর হাতে ঘুমের ওষুধ সে চোখের কোনা দিয়ে দেখছিল, চা খাবার সময় সেগুলো দিয়ে দেবার চেষ্টা করতে হবে, সুযোগ না পেলে কী হবে সেটাই হচ্ছে কথা।
নাস্তা শেষ করে তিন জন চা খেতে শুরু করেছে, মেকু তখন একটু অস্থির হয়ে পড়ল। কাছাকাছি না গিয়ে তো সে চেষ্টাও করতে পারবে না। কাছে যাওয়ার একটিই উপায়, সেটা হচ্ছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা – কাজেই মেকু হঠাৎ সারা শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করল। জরিনা বলল, “কেউ একজন বাচ্চাটাকে কোলে নাও।”
বদি বলল, “আমি পারব না। এই বাচ্চাকে দেখলেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়।”
মতি বলল, “দুই মাসের ছোট একটা বাচ্চার ওপরে মানুষ আবার রাগ করে কেমন করে?”
বদি বলল, “এই বাচ্চার জন্যে তোমার যদি এত দরদ তা হলে তুমি কোলে নাও না কেন?”
মতি বিরক্ত হয়ে মেকুর কাছে এগিয়ে গেল এবং তার ব্যথা পাওয়া হাতে খুব সাবধানে মেকুকে কোলে নিল, মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফেলে। মতি বলল, “দেখেছ? ছোট বাচ্চাদের এক ধরনের সাইকোলজি থাকে, একটুখানি আদর করলেই তারা খুশি হয়ে উঠে।”
বদু মুখ ভেংচে বলল, “ভালো। এই ছোট বাচ্চাকে তুমি যদি এত ভালো বুঝতে পার তা হলে তুমিই রাখ, আমি এই ফিচকে বদমাইশের ধারে কাছে নেই।”
মতি হতাশ হওয়ার চান করে বলল, “বদি, তুমি যতক্ষণ ছোট শিশুকে ভালবাসতে পারবে না ততক্ষণ তুমি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারবে না।”
বদি ফোঁস ক্রেও একটা নিশ্বাস ফেলেল বলল, “ সেটাই যদি সত্যি হয় তা হলে আমি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতেও চাই না। বনমানুষ হয়েই থেকে যাবো।”
মতি এক হাতে মেকুকে কোলে ধরে রেখে অন্য হাতে চায়ের কাপটা তুলে নিল, সাবধানে এক চুমুক খেয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, “এইটা কি চা নাকি ইঁদুর মারার বিষ।”
জরিনা বলল, “জোর করে খেয়ে নাও, সারা রাত ঘুমাও নি কাজে দেবে।”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে চায়ের কাপটা লক্ষ করল, একেবারে তার হাতের নাগালে চলে এসেছে, একটু সময় পেলেই সে তার হাতে ধরে রাখা পাঁচটা ট্যাবলেট চায়ের কাপে ছেড়ে দিতে পারে। মেকু তক্কে তক্কে রইল এবং মতি একটু অন্য দিকে তাকাতেই মেকু তার হাতের মুঠোয় ধরে রাখা ট্যাবলেটগুলি মতির চায়ের কাপে ছেড়ে দিল, কেউ টের পেল না।
মতি আবার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “চা’টা কী বিস্বাদ দেখেছ? শুধু যে বিষের মতো কড়া তাই না কেমন ওষুধ ওষুধ গন্ধ।”
বদি বলল, “জরিনা ঠিকই বলেছে, জোরে করে খেয়ে নাও। ফ্রেশ লাগবে।”
মতি জোরে করে চায়ের কাপ শেষ করে ফেলল। মেকু একটু কৌতূহল নিয়ে মতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে – এই ওষুধের কাজ শুরু হতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে!
কিছুক্ষণের মাঝেই মেকুকে নিয়ে তিনজনের দলটা বের হয়ে গেল, তাদেরকে দেখে আর যাই হোক দুর্ধর্ষ কোনো অপরাধীর দল মনে হচ্ছিল না – প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনোভাবে ঘায়েল হয়ে আছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিংবা ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে কিংবা কোঁকাতে কোঁকাতে যাচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বদির, তার সার্টে বুকের কাছাকাছি অর্ধেক পুড়ে গেছে সেই পোশাকে তাকে একটা কাক তাড়ুয়ার মতো দেখাতে থাকে। বদি মুখ কালো করে মাথা নেড়ে বলল, “আমি তো এই পোশাকে বের হতে পারি না।”
জরিনা বলল, “তা হলে কোন পোশাকে বের হবে?”
বদি মাথা চুলকে বলল, “ একটা সার্ট কিনতে হবে।”
“কোথা থেকে কিনবে? আশেপাশে কোনো সার্টের দোকান নেই।”
বদি মুখ ভারী করে বলল, “ এই সার্ট পরে বের হওয়ার থেকে খালি গায়ে বের হওয়া ভালো।”
বদির কথাটি কিছুক্ষণের মাঝেই সত্যি প্রমাণিত হল। নিচে হোটেলের ম্যানেজার বদির দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে উঠল। বলল, “আরে ভাই আপনার হৃদয়ের আগুন দেখি বড় গরম। সার্ট পর্যন্ত পুড়ে গেছে।”
বদি অনেক কষ্ট করে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখল। হোটেলের বিল মিটিয়ে বাইরে বের হবার পর রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা ফাজিল ছেলে বলল, “মিয়া ভাইয়ের বুকের মাঝে কী আগ্নেয়গিরি?”
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা টোকাই হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “স্যার কী বুক দিয়ে পেট্রল বোমা মারেন?”
রিকশা দিয়ে যেতে যেতে দুটি কমবয়সী মেয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বদিকে দেখে হাসতে লাগল, কী বলছে সেটা সৌভাগ্যক্রমে বদি শুনতে পেল না।
এর মাঝে বদি পুরোপুরি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে – কাজেই যখন ঠিক তার সামনে একটা গাড়ি ব্রেক কষে থেমে গেল এবং ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বদির দিকে তাকিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল বদি এর সহ্য করতে পারল না, মচকে যাওয়া পায়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে মানুষটার কলার ধরে টেনে গাড়ি থেকে বের করে ফেলল। জরিনা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “আরে বদি, তুমি কী করছ?”
“এই মানুষটাকে মজা দেখাচ্ছি – কত বড় সাহস, আমাকে দেখে হাসে!”
“এইটা কী মজা দেখানোর সময়?”
মতি বলল, “খারাপ কী? আমরা এই গাড়িটাই নিয়ে নিই।”
কেউ কিছু বলার আগে মতি গাড়ির পিছনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। তার হঠাৎ ভয়ানক ঘুম পেতে শুরু করেছে।
জরিনা বলল, “এই গাড়িটা?”
“হ্যাঁ।” মতি ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, “খামোখা গাড়ি ভাড়া করে পয়সা নষ্ট করে কী হবে? উঠ সবাই।”
জরিনা একবার অবাক হয়ে বদির দিকে আরেকবার মতির দিকে তাকাল। বদিও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে, মতি কী চাইছে বুঝতে তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। গাড়ির মালিক হঠাৎ করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চিৎকার শুরু করে দিল, “ফাজলেমি পেয়েছেন? এইটা রং তামাশার জায়গা? নামেন আমার গাড়ি থেকে।”
মতি বলল, “বদি গাড়িতে ওঠ। চালাও।”
বদি বলল, “দাঁড়াও।” তারপর সে পকেট থেকে তার রিভলবার বের করে মানুষটার মাথায় ধরে বলল, “চোপ শালা। একটা কথা বললে খুলি ফুটো করে দেব।”
মানুষটা হঠাৎ করে একেবারে ঠাণ্ডা মেরে গেল।
বদি বলল, “সার্ট খোল।”
মানুষটা তোতলাতে তোতলাতে বলল, “কী-কী-কী-খুলব?”
“সার্ট।”
মানুষটা সার্ট খুলতে শুরু করে। বদি ধমক দিয়ে বলল, “সাবধানে খুলিস। ইস্তিরি যেন নষ্ট না হয়।”
কাজেই কিছুক্ষণের মাঝে দেখা গেল বদি ইস্ত্রি কড়া সার্ট পরে একটা টয়োটা টার্সেল গাড়ি এয়ারপোর্ট রোড ধরে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির পিছনের সিটে জরিনা মেকুকে কোলে নিয়ে বসেছে। জরিনার পাশে মতি, সে গাড়ির সিটে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।
গাড়ি বাংলা-মোটরের কাছাকাছি এসে বামে ঘুরে গেল। বদি বলল, “আমাদের হাতে অনেক সময়।”
জরিনা বলল, “হ্যাঁ। খামোখা ঘুরাঘুরি না করে কোথাও বসে পুরো ব্যাপারটা একবার ঝালাই করে নিলে হয়।”
বদি বলল, “এইখানে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। ফাস্ট ক্লাস পরটা এর খাশির কলিজা বানায়।”
“এখনো তোমার খিদে আছে?”
“টেনশান হলেই আমার খিদে পায়।” বলে বদি একটা বড় রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে বলল, “চল,নামি।”
বদি গাড়ি থেকে নেমে মতির দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে! মতি দেখি ঘুমিয়ে গেছে! এরকম সময় মানুষ ঘুমায় কেমন করে?”
জরিনা মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, “টেনশান হলে তোমার যেরকম খুদে পায় মতিরও মনে হয় সেরকম ঘুম পায়!”
বদি গাড়ির ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “মতি। এই মতি ওঠো।”
মতি অনেক কষ্ট করে চোখ খুলে আমতা আমতা করে কিছু একটা বলে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল। জরিনা অবাক হয়ে বলল, “আরে! এ দেখি কাদার মতো ঘুমিয়ে আছে!”
বদি মতিকে জোরে ধাক্কা দিতেই সে এবারে চোখ খুলে তাকাল, বলল, “কী হয়েছে?”
“কিছু হয় নাই। ঘুম থেকে উঠো।”
“কেন?”
“কেন মানে? এখন কী ঘুমানোর সময়?”
মতি ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, “আমি একটু ঘুমিয়ে নিই তোমরা যাও।”
বদি এবারে রেগে উঠে মতিকে ধরে প্রায় টেনে বের করে ফেলল, “ফাজলেমি পেয়েছ? আমরাও তো সারা রাত ঘুমাই নি – আমরা কি এত ঢং করছি?”
মতি কোন উত্তর দিল না, বদিকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা ঈদের কোলাকুলির মতো ভঙ্গি করে আবার ঘুমিয়ে গেল, শুধু যে ঘুমিয়ে গেল তাই নয়, বদি স্পষ্ট শুনতে পেল মতি নাক ডাকতে শুরু করেছে। একজন মানুষ যে এভাবে নাক ডেকে ঘুমাতে পারে বদি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না।
বদি ঘুমন্ত মতিকে টেনে হিঁচড়ে কোনো মতে রেস্টুরেন্টের মাঝে এনে ঢোকালো। আলাদা একটা কেবিনের মতো জায়গায় মতিকে বসাতেই মতি টেবিলে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেল। জরিনা এর বদি দুজনেই অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মতির দিকে তাকিয়ে থাকে, ঘুম নিয়ে কেউ যে এত বাড়াবাড়ি করতে পারে সেটা তারা একেবারেই বিশ্বাস করতে পারে না।
একজন বয় এসে জানতে চাইল তারা কী খাবে, অর্ডার দিয়ে বদি জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মতি এটা কী শুরু করেছে বল দেখি?”
“আমি বুঝতে পারছি না। মতি তো এরকম মানুষ না।”
“হ্যাঁ। আমি বেশ ঘুমাই বলে সব সময় আমাকে বকাবকি করে। এখন নিজেই কলাগাছের মতো ঘুমাচ্ছে।”
“জোর করে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে এনে কড়া লিকারের দুই কাপ চা খাওয়াও।”
বদি তখন মতিকে অনেক কষ্টে ধাক্কাধাক্কি করে জাগিয়ে তুলল। বলল, “কী হল মতি? তুমি এখন ঘুমাচ্ছ কেন?”
মতি কোনো মতে চোখ খোলা রেখে বলল, “বুঝতে পারছি না। ঘুমে চোখ ভেঙে যাচ্ছে।”
“বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দাও।”
“ঠিক আছে” বলে মতি আবার ঘুমে কাদা হয়ে টেবিলে মাথা রাখতে যাচ্ছিল বদি ধাক্কা দিয়ে তুলে ফেলল। তারপর টেনে সোজা করে বাথরুমে ঠেলে নিতে থাকে। বাথরুমের ভিতরে ঠেলে দিয়ে বদি খুব চিন্তিত মুখে ফিরে এল।
রেস্টুরেন্টের কেবিনের ভিতর জরিনার কোলে মেকুকে নিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে। মুক্তিপণ নেবার সময় তিন জনেরই দরকার – মতি যদি এভাবে ঘুমাতে থাকে তা হলে কীভাবে কী হবে সে বুঝতে পারছে না। বদি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল জরিনা বাধা দিয়ে বলল, “একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ?”
“কী জিনিস?”
জরিনা চোখের কোনা দিয়ে দেখিয়ে বলল, “রেস্টুরেন্টের মানুষগুলি আমাদের দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কেন?”
বদি নিজের মুখে হাত বুলিয়ে বলল, “এমনভাবে ঘায়েল হয়েছি, চোখ মুখ ফুলে আছে, জামা কাপড়ের ঠিক নাই সেই জন্যে।”
“উঁহু। সবাই খবরের কাগজের দিকে তাকাচ্ছে এর আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।”
বদি চমকে উঠল, “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। বদি, তুমি যাও দেখি, একটা খবরের কাগজ কিনে আন।”
বদি হেঁটে হেঁটে খবরের কাগজ কিনতে গেল কিন্তু ফিরে এল দৌড়াতে দৌড়াতে। জরিনা অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
বদি খবরের কাগজটা জারিনার সামনে রেখে বলল, “এই দেখ।”
জরিনা দেখল খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নিচের অংশে ডান দিকে তাদের তিন জনের ছবি, উপরে বড় বড় করে হেডিং “শহরে দুর্ধর্ষ শিশু অপহরণকারী!”
জরিনা কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না,খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে থেকে বলল, “আমাদের ছবি কোথায় পেয়েছে?”
“ফাইল থেকে। মনে নাই, প্রত্যেকবার এরেস্ট করলে একটা ছবি তুলে?”
“কী লিখেছে?”
বদি চাপা গলায় বলল, “পড়ি নাই। সময় কই পড়ার, এখনি পালাতে হবে। তাড়াতাড়ি।”
জরিনা মেকুকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটতে থাকে, পিছনে পিছনে খবরের কাগজ হাতে বদি। মাঝপথে রেস্টুরেন্ট বয়ের সাথে দেখা হল, পরটা আবনং খাসির কলিজা নিয়ে আসছে। সে অবাক হয়ে বলল, “স্যার আপনার খাবার!”
বদি ছুটতে ছুটতে বলল, “তুমি খেয়ে নাও। আমাদের সময় নাই।”
গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে বদির মনে পড়ল মতিকে বাথরুমে রেখে এসেছে, তখন সে আবার ছুটল মতিকে আনতে। রেস্টুরেন্টের মানুষেরা সবাই ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার মাঝে বদি বাথরুমে গিয়ে দেখল মতি বেসিনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। মতিকে টেনে সোজা করে বদি তাকে জাগানোর চেষ্টা করল, কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে দুই গালে বার কয়েক শক্ত চড় মারার পর মতি কোনোমতে চোখ খুলে জড়ানো গলায় বলল, “কী হল বদি, আমাকে মারো কেন?”
“সর্বনাশ হয়েছে!”
কি জিনিস সর্বনাশ হয়েছে সেটা জানতে মতি খুব একটা উৎসাহ দেখাল না, বদির ঘাড়ে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করল, বদি তখন চুলের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করল। মতি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমি কী করেছি ভাই, আমাকে ব্যথা দেও কেন?”
“ব্যথা দিচ্ছি না, জাগানোর চেষ্টা করছি। তোমার কী হয়েছে?”
“কিছু হয় নি।”
“তুমি জান পত্রিকায় আমাদের ছবি চাপা হয়েছে?”
মতি বলল, “বাহ, কি মজা!” তারপর মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বদির ঘাড়ে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
বদি আর কোনো উপায় না দেখে মতিকে ধরে প্রায় টেনে হেঁচড়ে নিতে থাকে। রেস্টুরেন্টের বেশ কিছু লোকজন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক জনের হাতে পত্রিকা। বদি কারো চোখের দিকে না তাকিয়ে মতিকে টানতে টানতে প্রায় দৌড়িয়ে গিয়ে গাড়িতে ঢুকল এবং গাড়ি স্টার্ট করে সাথে সাথে বের হয়ে গিয়ে বলল, “ওহ! কী বাঁচা বেঁচে গেছি।”
জরিনাও বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “একেবারে কানের কাছে দিয়ে গুলি গেছে।”
বদি বলল, “পত্রিকায় কী লিখেছে পড় দেখি।”
জরিনা বলল, “গাড়ি চালাতে চালাতে আমি পড়তে পারি না, আমার মাথা ঘোরায়।”
বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! ঢং করো না। কী লিখেছে পড়।”
জরিনা তখন পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করে। তারা খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তাদের গোপন শলাপরামর্শের একটি অডিও ক্যাসেট বিশ্লেষণ করে পুলিশ নাকি তাদের সম্পর্কে সকল গোপন তথ্য যোগাড় করেছে। বদি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “অসম্ভব! আমাদের গোপন শলা পরামর্শের অডিও ক্যাসেট পুলিশের কাছে যেতেই পারে না।”
“কিন্তু নিশ্চয়ই গিয়েছে তা না হলে আমাদের তিন জনের কথা জানল কেমন করে?”
“কিন্তু এই কিডন্যাপের ব্যাপারটা কী আমরা তিন জন ছাড়া আর কেউ জানে?”
“না।”
“তা হলে কী তুমি বলতে চাও আমাদের তিন জনের মাঝে একজন ঘিড়িংগাবাজি করেছে?”
জরিনা কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণ চোখে একবার বদির দিকে আরেকবার মতির দিকে তাকাল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলেল বলল, “যাই হোক, এখন আর পেছানোর কোনো রাস্তা নেই। কেউ গিড়িংগাবাজি করলে করেছে। যেভাবে পুরোটা প্ল্যান করেছি, এখন সেইভাবে এগুতে হবে।”
“মতিকে নিয়ে কী করব?”
“আরেকটু ঘুমাতে দাও তারপর নিশ্চয়ই ওঠে যাবে।”
“যদি না উঠে?”
“না উঠবে কেন? ঘুম থেকে তুলে দিলেই তো উঠবে।”
মেকু এরকম সময় তার মাড়ি বের করে হেসে মনে মনে বলল, “না গো সোনার চাঁদ এই মক্কেল আজ কিংবা আগামী কাল এই ঘুম থেকে উঠবে না! পরশু উঠলেও উঠতে পারে তবে কোনো গ্যারান্টি নাই।”
বদি পরবর্তী এক ঘণ্টা গাড়িতে ঘুরে বেড়াল, তার কোথাও থামতে সাহস হয় না, যেখানেই থামে সেখানেই মনে হয় কেউ একজন খবরের কাগজ হাতে তাদের দিকে সরু চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঢাকা শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে তাদের কোনো লুকানোর জায়গা নেই – ব্যাপারটা এখনো তাদের বিশ্বাস হয় না।
শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা মতো বদি মীরপুর রোডে একটা শপিং সেন্টারের সামনে গাড়ি থামালো। এখানে মেকুকে কোলে নিয়ে জরিনা নেমে গেল।বদি চাপা গলায় বলল, “মোবাইলটা ঠিক আছে তো?”
জরিনা মাথা নাড়ল, বলল, “আছে।”
“আমার টেলিফোন পেলেই বাচ্চাটারে ছেড়ে দেবে।”
“ঠিক আছে। বদি এদিক সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “রিভলবারটা আছে তো?”
জরিনা ব্যাগ খুলে দেখে বলল, “আছে।”
“ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।”
“সাবধানে কাজ করো। ভয়ের কিছু নাই।” জরিনা মেকুর পিছনে একটা থাবা দিয়ে বলল, “এই ট্রাম্প কার্ড আমাদের কাছে, যতক্ষণ এই চিড়িয়া আমাদের হাতে আছে কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না।”
বদি মাথা নাড়ল, “কেউ কিছু করতে পারবে না।”
“যাও দেরি করো না।”
“যাচ্ছি।”
“শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখবে, কেউ যেন চেহারা দেখতে না পারে।”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।” জরিনা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, শুধু চোখ গুলি দেখা যাচ্ছে, এখন কেউ চেহারা দেখতে পারবে না।
“আমি গেলাম।”
“যাও।”
বদি জোর করে হাসার চেষ্টা করে গাড়ি স্টার্ট দিল, মুক্তিপণের টাকাটা তাদের কাছে দেওয়ার কথা নিউ মার্কেটে। সকাল বেলা এখনো নিশ্চয়ই সেখানে ভিড় শুরু হয় নি। ঠিকমতো কাজটা উদ্ধার করতে পারলে হয়।
গাড়িটা বাইরে পার্ক করে বদি মতিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তলার চেষ্টা করল, চুলের ঝুঁটি ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দেওয়ার পড় মতি চোখ খুলে তাকাল, জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, “কী হয়েছে বাবা? আমাকে মার কেন?”
“নিউ মার্কেট এসে গেছি।” বদি চাপা গলায় বলল, “এখন উঠ।”
“আমি তো উঠেই আছি।”
“ড্রাইভিং সিটে বস।” বদি চাপা গলায় বলল, “আমি যখন মুক্তিপণ নিয়ে আসব, তখন তুমি ড্রাইভ করবে।”
মতি আধো আধো চোখ খুলে বলল, “ঠিক আছে।”
বদি তাকে ঠেলে গাড়ি থেকে বের করে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিল। মতি স্টিয়ারিঙে মাথা রেখে আমার ঘুমিয়ে পড়ল। বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “এখন ঘুমালে হবে না, জেগে থাকতে হবে।” মতি চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে বলল, “আমি তো জেগেই আছি।”
“ঠিক আছে। জেগেই থাক।”
বদি গাড়ি থেকে নামল। এক পকেটে রিভলবার অন্য পকেটে মোবাইল টেলিফোন। এই অপারেশনে দুটোই দরকার হবে। বদি লম্বা লম্বা পা ফেলে নিউমার্কেটের ভিতরে ঢুকল, কিছুক্ষণের মাঝেই বছর খানেক নিশ্চিন্তে থাকার মতো টাকা এসে যাবে। ঠিক মতো পুরো ব্যাপারটা করতে পারবে তো? বদির বুকের ভিতর ধুক ধুক করতে থাকে। সে হেঁটে হেঁটে পশ্ছিম পাশে বইয়ের দোকানগুলির দিকে যেতে থাকে, টাকার ঝোলা নিয়ে সেখানেই আসার কথা।
জরিনা কোলে ধরে রাখা মেকুর দিকে তাকাল, বাচ্চাটা বেশ নির্লিপ্তভাবে শুয়ে আছে। ছোট বাচ্চা বলে রক্ষা, কোথায় কার কাছে আছে কিছু বুঝতে পারছে না। তাই কান্নাকাটি করছে না। মাঝে মাঝে অবশ্যি কোনো কারণ ছাড়াই বিকট চিৎকার করে ওঠে – সেটাই যন্ত্রণা। ছোট বাচ্চা বলে সেটা কখন করে বসবে জরিনার কোনো ধারণা নেই, সেটা একটা সমস্যা। আর কিছুক্ষণ এভাবে শান্ত হয়ে থাকলেই অবশ্যি কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে।
জরিনা শপিং সেন্টারের ভিতরে ঢুকল। পাশাপাশি কয়েকটা শাড়ির দোকান, তার পাশে একটা গয়নার দোকান। শাড়ি গয়নায় জরিনার বেশি উৎসাহ নেই কিন্তু দেখতে ভালোই লাগে। বিশেষ করে সোনার গয়না। সব গয়না ডাকাতি করে নিয়ে নেবে এরকম একটা কল্পনা করে তার মুখে মাঝে মাঝে পানি এসে যায়। জরিনা গয়নার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শোকেসে সাজিয়ে রাখা ভারী ভারী গয়নাগুলি দেখতে লাগল, এগুলি ডাকাতি করে নিতে পারলে কত টাকায় বিক্রি করা যাবে আন্দাজ করার চেষ্টা করল।
গয়নার দোকানের সামনে থেকে সরে যেতেই জরিনা দেখল পাহাড়ের মতো একটা পুলিশ হেলতে হেলতে হেঁটে যাচ্ছে। পুলিশ দেখেই জরিনা একটু শিটিয়ে যায়, সে দাঁড়িয়ে গেল যেন পুলিশটা হেঁটে চলে যেতে পারে। কিন্তু ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যপার ঘটল, জরিনা শুনতে পেল কে যেন তার খুব কাছে থেকেক বলল, “এই ভটকু মিয়া।”
কথাটি বলল মেকু, কিন্তু দুই মাসের একটা বাচ্চা কথা বলতে পারে সেটা ঘুণাক্ষরেও জরিনার মাথায় আসে নি বলে সে সেটা ধরতে পারল না।
পাহাড়ের মতো পুলিশটা সাথে সাথে ঘুরে জরিনার দিকে তাকাল, চোখ লাল করে বলল, “কী বললেন?”
জরিনা থতমত খেয়ে বলল, “আমি বলি নাই।”
“তা হলে কে বলেছে?”
জরিনা ঘুরে পিছনে তাকাল, আশেপাশে কেউ নাই, সে একা দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিই তো, তা হলে কে পুলিশটাকে ভটকু মিয়া ডেকেছে? মোটা মানুষকে ভটকু মিয়া ডাকলে রাগ তো করতেই পারে, আর সেই মোটা মানুষটি যদি পুলিশ হয় তা হলে তো কোনো কথাই নেই।
পুলিশ গর্জন করে বলল, “আপনি কেন আমাকে ভটকু মিয়া ডাকলেন?”
জরিনা আবার চিঁ চিঁ করে বলল, “আমি ডাকি নাই।”
পুলিশটা কিছুক্ষণ চোখ লাল করে জরিনার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “খবরদার, কখনো এভাবে কথা বলবেন না।”
জরিনা মিনমিন করে বলল, “বলব না।”
পুলিশটা ঘুরে আবার হাঁটতে থাকে, ফাঁড়া কেটেছে মনে করে জরিনা বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করতে যাচ্ছিল কিন্তু মেকু সে সুযোগ দিল না, আবার পুলিশটাকে ডাকল, বলল, “ভোটকা মিয়ার, তেজ দেখো!”
এত বড় পাহাড়ের মতো পুলিশটা সাথে সাথে পাই করে ঘুরে জরিনার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “কী বললেন? কী বললেন আপনি? আমি ভোটকা মিয়া? আমার তেজ হয়েছে?”
জরিনা একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কে কথা বলছে? সে কি বলবে বুজতে পারল না কিন্তু তার আগেই স্পষ্ট মনে হল এই বাচ্চাটা কথা বলেছে! এটা কি সম্ভব?
পুলিশটা মহা তেড়িয়া হয়ে প্রায় জরিনার উপর ঝাপিয়ে পড়ল, চিৎকার করে বলল, “কী বললেন আপনি? আপনার কত বড় সাহস একজন পুলিশ অফিসারের সাথে এইভাবে কথা বলেন? মুখ ঢেকে রেখেছেন বাঁদরামো করার জন্যে?”
জরিনা বিস্ফোরিত চোখে মেকুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে – এই বাচ্চাকে কিডন্যাপ করার পর থেকে তাদের দুর্গতি, রাতে ভূতের কথা বলা, সবকিছু হঠাৎ যেন পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকে। ভয়ে আতঙ্কে জরিনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পুলিশ অফিসারটা একেবারে জরিনার গায়ের উপর উঠে হুংকার দিল, বলল, “কী হল? কথা বলেন না কেন?”
জরিনার হয়ে মেকু কথার উত্তর দিল, বলল, “এই তো বলছি। আমাকে চেনো না ভোটকা মিয়া? আজকের পত্রিকায় আমার ছবি দেখ নাই?”
“কী ছবি?” পুলিশ আরো একটু এগিয়ে এল।
“দূর থেকে কথা বল। বেশি কাছে আসলে ঘুষি মেরে তোমার দাঁত ভেঙে ফেলব।”
“কী বললেন? কী বললেন আপনি?” পুলিশ অফিসার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আপনি ভাবছেন মহিলা হয়েছেন দেখে আপনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবেন? আপনাকে এরেস্ট করে এমন কোৎকা দেব –”
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল তাদের ঘিরে বেশ একটা ভিড় জমে উঠেছে। শুধু তাই নয় মনে হয়, একজনের হাতে আজকের পত্রিকাও আছে। সে বলল, “চোপ কর ব্যাটা বদমাইশ । পত্রিকায় আমার ছবি দেখলে তোমার কাপড়ে বাথরুম হয়ে যাবে।”
যার হাতে পত্রিকাটি ছিল সে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আজকের পত্রিকায় বাচ্চা কিডন্যাপের ছবি ছাপা হয়েছে।”
পুলিশ অফিসার বলল, “আপনি কী বলতে চান আপনি সেই কিডন্যাপার?”
এতক্ষণে জরিনা নিজেকে একটু সামলাতে পেরেছে। কাঁদো কাঁদো হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মেকু বলল, “হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে আরেকটু কাছে আস – ভোটকা মিয়া। ব্যাগ থেকে রিভলবার বের করে তোমার মাথা ফুটো করে দেব।”
“কী বললেন?” পুলিশ অফিসার হুংকার দিয়ে চোখের পলকে তার কোমরে ঝোলানো রিভলবারটা হাতে নিয়ে নিল। জরিনার দিকে তাক করে বলল, “কত বড় সাহস – একজন পুলিশ অফিসারকে গুলি করার ভয় দেখায়!”
জরিনা এবারে মোটামুটি ভেঙে পড়ল, কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “দেখেন, আমি আপনাকে কিছুই বলি নাই।”
পুলিশ অফিসার মুখ খিঁচিয়ে বলল, “এখন আমার হাতে রিভলবার দেখে ভয় পেয়ে সিধে হয়ে গেছেন!”
“না না সেটা নয়। আমি আপনাকে কিছু বলি নাই।”
“তা হলে কে বলেছে?”
“আমার মুখ ঢাকা তাই আপনি ভেবেছেন আমি কথা বলছি। আসলে আমি বলি নাই।”
পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “তা হলে কে বলেছে?”
জরিনা মেকুকে দেখিয়ে বলল, “এই যে, এই বাচ্চাটা।”
পুলিশ অফিসার এবং চারপাশে থাকা মানুষগুলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ এক সাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে সবাই একবারে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
জরিনা চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যিই বলছি! খোদার কসম!”
পুলিশ অফিসার হাসি থামিয়ে উপস্থিত মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, “ড্রাগস খেয়েছে। ড্রাগস খেয়ে মাতলামি করছে।”
জরিনা বলল, “আমি মাতলামি করছি না। সত্যি কথা বলছি এই বাচ্চা কথা বলতে পারে। মহা ত্যাঁদড় –”
পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “চুপ করেন। ফাজলেমি করবেন না।”
“খোদার কসম।”
মেকু তখন ঠিক ছোট বাচ্চারা যেভাবে কাঁদে সেরকম ভান করে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদতে লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, “এই যে বাচ্চা কথা বলছে!”
আরেকজন টিটকারী করে বলল, “হ্যাঁ! একেবারে ব্যান্ড সংগীত!”
উপস্থিত সবাই আবার হা হা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠে – জরিনা ঠিক বুঝতে পারল না, এই কথাটার মাঝে এত হাসির কী আছে!
জরিনা মেকুর দিকে তাকাল, মেকু তার মাড়ি বের করে হেসে জরিনার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপে দেয়! কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, এইটুকু পুঁচকে ছোঁড়া তাকে এভাবে নাকানী চুবানী খাইয়েছে? এটা কী সম্ভব? সে অবিশ্বাস করবে কেমন করে একেবারে নিজের চোখে দেখছে! জরিনা চারিদিকে তাকাল, একেবারে নাকের ডগায় রিভলবার ধরে একটা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, চারিদিকে মজা দেখার জন্যে মানুষের ভিড় এবং মানুষগুলির একজনেও তার কথা বিশ্বাস করছে না। সে হেরে গেছে এবং হেরেছে দুই মাসের একটা পুঁচকে ছোঁড়ার কাছে। পুঁচকে ছোঁড়াটাকে উপরে তুলে একটা আছাড় দিলে হয়তো মনে ঝাল একটু মিটবে। জরিনা মুখ শক্ত হয়ে আসে, নিশ্বাস দ্রুততর হয়, চোখ থেকে আগুন বের হতে থাকে – কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে। মেকু জরিনার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে, সে তার দুই পা জোড়া করে জরিনার মুখের উপর গায়ের জোরে লাথি বসিয়ে দিল – জরিনা কোঁক করে একটা আর্ত শব্দ করে পড়ে যাচ্ছিল, পুলিশ অফিসারটা খপ করে ধরে ফেলল, ভিড়ের মাঝে থেকে একজন এসে মেকুকে ধরল। টানাটানিতে জরিনার মুখের উপর থেকে কাপড় স্বরে এসেছে, খবরের কাগজ হাতে মানুষটি বিস্ময়ের শব্দ করে বলল, “ব্যাপারটা দেখ! এই মহিলা তো ডেঞ্জারাস মহিলা। পত্রিকায় তো এরই ছবি!”
জরিনার মাথা ঘুরছে তার মাঝে ব্যাগ খুলে সে রিভলবারটা বের করার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই পুলিশ অফিসার তার হাত থেকে ব্যাগটা চিনিয়ে নিয়েছে। মানুষজন আরো ভিড় করে এগিয়ে আসে। ব্যাগের ভিতর থেকে একটা রিভলবার আর একটা মোবাইল ফোন বের হয়ে এসেছে। জরিনা মোবাইল ফোনটা দেখে একটা নিশ্বাস ফেলল, বদি হয়তো এক্ষুনি ফোন করবে, তখন কী হবে?
বদি বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকাল। চারপাশে যারা আছে তারা কী নিউমার্কেটের সাধারণ মানুষ নাকি সাদা পোষাকের পুলিশ বোঝা মুশকিল। বদি ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল এবং মুক্তিপণের টাকা নিয়ে কে আসতে পারে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। তারা বলে রেখেছে পলিথিনের ব্যাগে করে টাকা আনতে হবে কিন্তু কোনো মানুষের কাছেই পলিথিনের ব্যাগ নেই। বদি একটু অধৈর্য হয়ে এদিক সেদিক তাকাল এবং দেখতে পেল একজন মহিলা হাতে একটা বড় পলিথিনের ব্যাগ বোঝাই কিছু নিয়ে এগিয়ে আসছে। মহিলাটিকে দেখে মনে হল কাউকে খুঁজছে – তা হলে কি এই মহিলাই মুক্তিপণের টাকা এনেছে? এরকম একটা কাজে কি একজন মহিলা আসতে পারে? মহিলাটা দ্বিতীয়বার বদির সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বদি চাপা গলায় বলল, “আপনি কী মেকুর কিছু হন?”
মহিলাটি – যিনি আসলে মেকুর আম্মা, চমকে উঠে বদির দিকে তাকালেন, মুহূর্তে মুখের মাঝে একসাথে ঘৃণা এবং রাগ ফুটে উঠে। তারপর চোখে আগুন ঢেলে বললেন, “ও! তুমি কিডন্যাপার?”
বদি ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ-স-স-স। আস্তে।”
“কেন আস্তে কেন? আমার বাচ্চাকে কিডন্যাপ করার সময় মনে থাকে না? এখন আস্তে!”
বদি শুকনো গলায় বলল, “লোকজন শুনলে আপনারই অসুবিধা হবে।”
“কী অসুবিধে হবে?”
“আপনার বাচ্চা অন্য জায়গায় আছে- তার ভালোমন্দের ব্যাপার আছে।”
আম্মা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, “কী? কী বললে তুমি বদমাইশ? পাজির পা ঝাড়া? আমার বাচ্চার ভালো মন্দের ব্যাপার? তোমার কত বড় সাহস–”
বদি অস্বস্তিতে বলল, “আ-হা-হা! আস্তে বলেন, কেউ শুনে ফেলবে।”
“কোথায় আমার মেকু?”
বদি চাপা গলায় বলল, “আপনি টাকা বুঝিয়ে দেন – আমি বাচ্চা বুঝিয়ে দেব।”
আম্মা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “আমার সাথে তুমি মামদোবাজি কর? তোমরা নর্দমার কীট,সাপের বাচ্চা। তুমি ভাবছ আমি তোমাদের চিনি না? জুতো দিয়ে পিটিয়ে তোমাদের সিধে করা দরকার।”
বদি একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “আপনি কী বলছেন?”
“মিথ্যে বলেছি? আমি মিথ্যে বলেছি?”
“সত্যি মিথ্যে জানি না। আপনি পলিথিনের ব্যাগটা দেন। টাকা সব এনেছেন তো?”
আম্মা গরম হয়ে বলল, “আমি আগেই দেব না। আমার মেকু কোথায় আছে না বললে দেব না।”
“আগে টাকা দেন। তারপর অন্য কথা।”
“আগে মেকুকে দাও। তারপর অন্যকথা।”
বদি বিরক্ত হয়ে বলল, “সেটা কেমন করে হয়? বইপত্রে কখনো কিডন্যাপের গল্প পড়েন নাই? টাকা না দিলে কেউ কখনো কাউকে ফেরত দেয়?”
“অশিক্ষিত মূর্খ চোরের দল। তুমি আমাকে বইপত্র শিখিও না। বল, কোথায় আছে আমার মেকু?”
“ঠিক আছে। আপনাকে যদি মেকুর সাথে কথা বলতে দেই তা হলে আপনি টাকা দেবেন?”
“আগে আমাকে কথা বলতে দাও তারপর দেখি।”
বদি বিরক্ত হয়ে তার পকেট থেকে টেলিফোন বের করে ডায়াল করে টেলিফোনটা আম্মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেন। আমার পার্টনারের সাথে কথা বলেন।”
“তোমার পার্টনার কে?”
বদি মুখ শক্ত করে বলল, “দুর্ধর্ষ মহিলা। তিন বার এরেস্ট হয়েছে। দুই বার জেল খেটেছে। নাম জরিনা।”
আম্মা টেলিফোনটা কানে লাগিয়ে বললেন, “হ্যালো।”
অন্যপাশ থেকে একটা মোটা এবং ভারি পুরুষ মানুষের গলা শোনা গেল, “হ্যালো।”
আম্মা একটু অবাক হলেন, বললেন, “আপনি কে বলছেন?”
মোটা এবং ভারি গলা বলল, “আপনি কে বলছেন?”
“আমি আমার ছেলের খবর নেওয়ার জন্যে জরিনার খোঁজ করছি। তারা আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করেছে।”
“ও! আপনার ছেলে কিডন্যাপ করেছে। সে ভালোই আছে – কোনো চিন্তা করবেন না। কিন্তু জরিনার সাথে তো এখন কথা বলতে পারবেন না।”
“কেন?”
“কারণ, তার দুই হাত পিছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগানো হয়েছে। এখন তো ফোন ধরতে পারবে না। তা ছাড়া তার মেজাজ খুব খারাপ, কাছে গেলে কামড় দেবে মনে হয়।”
আম্মা একটা নিশ্বাস ফেলেল বললেন, “তা হলে আপনি বলছেন আমার ছেলে ভালো আছে?”
“হ্যাঁ। ভালো আছে। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর। আমি বলছি ভালো আছে।”
“দেখেন তো তার ন্যাপি শুকনো না ভিজা।”
“কী বললেন?”
“বলেছি, দেখেন দেখি ন্যাপিটা শুকনো না ভিজা।”
কিছুক্ষণ পর মোটা এবং ভারী গলা বলল, “শুকনো।”
“আপনি আমার ছেলেকে বলেন হিসি করতে।”
মোটা এবং ভারী গলা অবাক হয়ে বলল, “কী বললেন?”
“বলেছি, আমার ছেলের কাছে গিয়ে তাকে বলেন হিসি করতে।”
“হিসি?”
“হ্যাঁ, বলেন, তোমার আম্মু বলেছে হিসি করতে।”
আবার কয়েক মুহূর্ত নীরবতা তারপর ভারী আবনফ মোটা গলা বলল, “বলেছি।”
“গুড। আমার ছেলে হিসি করেছে?”
“আবার কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, তারপর ভারী এবং মোটা গলা আনন্দময় সুরে বলল, “করেছে।”
“গুড। ভেরি গুড।” আম্মার আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন – কিন্তু বদি বাধা দিল। বলল, “কী হয়েছে?” কার সাথে কথা বলছেন?”
আম্মা হাতের ব্যাগটা তুলে বদির মাথায় এক ঘা বসিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিয়ে বললেন, “পুলিশের সাথে। তোমার দুর্ধর্ষ পার্টনার চতুর্থবার এরেস্ট হয়েছে। খুব নাকি মেজাজ গরম। যেই কাছে আসছে তাকেই কামড় দিচ্ছে।”
বদির চোয়াল হঠাৎ ঝুলে গেল। সে চোখের কোনা দিয়ে চারিদিকে তাকাল তারপর হঠাৎ আম্মার উপর ঝাপিয়ে পড়ে পলিথিনের ব্যাগটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, আম্মা বাধা দিতে গিয়ে থেমে গেলেন, কারণ – প্রথমত বদি এক হাতে তার পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে এনেছে। দ্বিতীয়ত পলিথিনের ভিতরে নোটের বান্ডিলের মতো জিনিসগুলিতে আসলে টাকা নেই। কাগজের বান্ডিল!
বদি পলিথিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে দৌড়াতে থাকে, পিছু পিছু বেশ কিছু মানুষ একটু দূরত্ব নিয়ে তার পিছু পিছু যেতে থাকে, হাতে রিভলবার বলে কেউ কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
বদি ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পলিথিনের ব্যাগটা পিছনের সিটে রেখে মতিকে বলল, “মতি! চালাও – জলদি ।”
মতি স্টিয়ারিঙে মাথা রেখে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে, গাড়ি চালানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। বদি মতিকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিতেই মতি চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে বদি?”
“মানুষ ধরতে আসছে! চালাও গাড়ি। জলদি।”
মতি স্টীয়ারিং ঘোরাতে শুরু করে, হর্ন দেয়, গীয়ার পালটে এক্সেল্টরে চাপ দিয়ে গাড়ি চালানোর ভান করে বলল, “কী গাড়ি এটা? নড়ে না কেন?”
বদি চিৎকার করে বলল, “আগে গাড়ি স্টার্ট দেবে না?”
“দেই নাই?”
মতি চাবিটা বদির হাতে দিয়ে বলল, “তুমি স্টার্টটা দাও দেখি – আমি ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নেই –”
কথা শেষ করার আগেই মতি স্তিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে গেল। বদি সামনে এবং পিছনে তাকাল; দুই পাশেই অনেক পুলিশ, রীতিমতো অস্ত্র তাক করে আসছে। তাদের পিছনে মানুষ। তাদের পিছনে মেকুর আম্মা। মনে হচ্ছে বদির মাথাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবেন।
বদি গাড়ির ড্যাশবোর্ডে একটা ঘুষি মেরে মাথা নেড়ে হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “ধরা পড়ে গেলাম!”
মতি চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, “সত্যি?”
বদি মুখ খিঁচিয়ে বলল, “সত্যি কি না চোখ খুলে দেখ।”
মতির মুখে শিশুর মতো একটা হাসি ফুটে উঠে, সে চোখ বুজে বলল, “ভালোই হল, এখন আরামে ঘুমাতে পারব। তুমি বড় ডিস্টার্ব কর বদি। ঘুমাতে দেও না।”
একটা বাঁশির মতো শব্দ আসে সেটা কি মতির নাক ডাকার শব্দ নাকি পুলিশের বাঁশির শব্দ বদি ঠিক বুঝতে পারল না।
দুর্ধর্ষ শিশু অপহরণ মামলাটি নিয়ে কিছু মজার ব্যাপার হল। জরিনা মেকু নামের আড়াই মাসের একটা বাচ্চার নামে কোর্টে কেস করার চেষ্টা করল, বাচ্চাটি নাকি তাদের নানাভাবে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়েছে, এমনকি খুন করে ফেলার চেষ্টা করেছে। পুলিশ অবশ্যি কেসটি নেয় নি। শেষ পর্যন্ত কোর্টে যখন মামলা উঠেছে তখনো জরিনা সাক্ষী হিসেবে মেকুকে কোর্টে আনার চেষ্টা করেছিল, মেকু নাকী মূল্যবান তথ্য দিতে পারবে। জজ সাহেব রাজী হন নি – জরিনা তবুও অনেক চেষ্টা করেছে। তাতে অবিশ্যি জরিনার একটু লাভ হয়েছে – তাকে পাগল ভেবে জজ সাহেব শাস্তিটা একটু কমিয়ে দিয়েছেন। তারা তিন জনই এখন জেলে আছে, ছাড়া পেলে কী করবে সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। তবে তারা কান ধরে প্রতিজ্ঞা করেছে আর কখনো বাচ্চা-কাচ্চা কিডন্যাপ করবে না। মরে গেলেও না।
মেকু ভালোই আছে। তার বয়স এখন এক বছর তিন মাস। তার প্রিয় লেখক য়োহান ভোলফ গাঙ ফন গ্যাতে। প্রিয় বিজ্ঞানী স্টিফান হকিং, প্রিয় খেলা দাবা, প্রিয় শিল্পী পাবলো পিকাসো। এই বয়সেই তার নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার বয়স যখন ছয় মাস এগারো দিন, তখন একদিন হঠাৎ করে –
না, থাক । শুরু করলে সেটা আবার একটা বিরাট ইতিহাস হয়ে যাবে ।
(সমাপ্ত)