সেদিন দোকান থেকে ফিরে জামাকাপড় ছাড়ছিল অনির্বাণ। শুভেন্দু পর্দা সরিয়ে এসে ঢুকলেন, “এটা কী রে, অনি? বেশ দরকারিই তো মনে হয়। এভাবে ছাদে ফেলে চলে গেলি!”
কথাটা কানে যেতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল অনির্বাণের। চকিতে পেছন ফিরে তাকিয়েই বাবার হাতের আধখোলা তালু থেকে জিনিসটা খপ করে তুলে নিতে গিয়েও সামলে গেল ও। মনের কোণে দুঃস্বপ্নের ছোবলের মতো এক অভিজ্ঞতা ঘাপটি মেরে আছে ঠিক এভাবেই আগে একদিন তুলে নিতে গিয়ে এই বিপজ্জনক জিনিসটাকে। দিশেহারা অনির্বাণ চোখ গোল গোল করে বলল, “আরে আরে, করেছ কী বাবা, তুমি ওটা হাতে করে নিয়ে এলে!”
“হ্যাঁ, কেন? হাতে করে আনলে কী?” পাল্টা অবাক হলেন শুভেন্দু।
অপ্রতিভ অনির্বাণ নিজেকেই গাল দিল মনে মনে। বাবাকে এই প্রতিক্রিয়াটা দেখানো ঠিক হয়নি। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, “না মানে, ইলেকট্রনিক জিনিস, কী থেকে কী হয়ে যায়…”
“জিনিসটা কী রে? খেয়েদেয়ে দুপুরের পর আমি ছাদে উঠে দেখতে পেলাম রোদে পড়ে আছে। দেখে বেশ দামিই মনে হল। ভাবলাম, তোর দোকানের যন্ত্রপাতি কিছু হবে একটা।”
“ঠি-ঠিক আছে বাবা, ওই টেবিলের ওপর রেখে দাও।”
শুভেন্দু টেবিলটার কাছে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, “একটা অবাক কাণ্ড হয়েছে জানিস! হাতে তুলে নিতেই দেখলাম হঠাৎ এই, ঠিক এই জায়গাটা জ্বলে উঠল আর কীসব হার্ট কিডনির ছবিটবি ফুটে উঠতে লাগল। একটু পরেই কীসব হিজিবিজি লেখা উঠতে শুরু করল অনবরত। সাথে আবার কেমন যেন বীপ বীপ শব্দ। আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না।” গলার স্বরটা কৈফিয়তের মতো শোনাল শুভেন্দুর। যেন একটা অপরাধ করে ফেলেছেন।
অনির্বাণ ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জিনিসটার দিকে। আর পাশে দাঁড়িয়ে একরাশ কৌতূহল নিয়ে উদগ্রীব হয়ে রইলেন শুভেন্দু ছেলের জবাবের অপেক্ষায়। হতভম্ব ভাবটা এবার প্রকাশ না করে ভেতরে ভেতরে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল অনির্বাণ। একটুক্ষণ আনমনা থেকে হঠাৎ জিগ্যেস করল, “তাই নাকি! তো এখন জ্বলছে না বা শব্দ করছে না কেন?”
শুভেন্দু উৎসাহ পেলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, “এই এখানটায় একটা স্যুইচমতন আছে, দ্যাখ না। এই যে। অনবরত শব্দ করে যাচ্ছে দেখে ছাদ থেকে নামার সময় ভয়ে ভয়ে বোতামটা টিপে দিয়েছিলাম। বন্ধ হয়ে গেল, আলো আর শব্দ দুটোই।”
দ্বিধাগ্রস্ত মনে বাবার হাত থেকে জিনিসটা তুলে নিল অনির্বাণ। শুভেন্দু কৌতূহল চেপে রাখতে পারছেন না কিছুতেই। ঠোঁটে একটা স্মিতহাসি টেনে গলার স্বরটা যথাসম্ভব মোলায়েম করে আবার জিগ্যেস করলেন, “এটা কী কাজে লাগে রে অনি? বললি না তো!”
বাবা তখনও হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে অনির্বাণ ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল, “ঠিক জানি না এখনও। একটা ফার্মা কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার এসে দিয়ে গেল দোকানে। বলল, ডাক্তারবাবু ফিরলে পৌঁছে দিতে ওনার হাতে।”
“তবে জিনিসটা কিন্তু দেখতে খাসা, আর যাই বলিস। হঠাৎ দেখলে তো হাতঘড়িই মনে হয়। দু’দিকে দুটো বেল্ট রয়েছে, ঘড়ির মতো কবজিতে পরারও ব্যবস্থা রয়েছে। কত কী যে বেরিয়েছে আজকাল! মেডিক্যাল সায়েন্সের স্বর্ণযুগ চলছে রে।”
অনির্বাণ এবার যেন একটু বিরক্ত হল। বলল, “ওটা ঠিক কী আমি এখনও জানি না বাবা। আর মেডিক্যাল সায়েন্সের সাথে আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি না তাও বলতে পারছি না। অন্যের জিনিস…”
কথাগুলো বলেই চোখের দৃষ্টি লুকিয়ে বাবাকে পাশ কাটিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল ও। বালতি ভরে রাশি রাশি জল ঢেলেও এলোমেলো চিন্তাগুলো জলের স্রোতের সাথে ভাসিয়ে দিতে পারছে না কিছুতেই। জিনিসটা আসলে কী? হার্ট-কিডনির ছবি, হিজিবিজি লেখা, এগুলো কী? বাবা হাতে নিতেই ওটা অ্যাক্টিভ হয়ে গিয়েছিল কী করে?
।। দুই।।
পাশ করে বসে না থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে গিয়ে একটা ফার্মেসি খুলেছিল অনির্বাণ। গেঁয়ো যোগী ভিখ পাবে না ধরে নিয়ে গাছপালার আলোআঁধারিতে উঁকিঝুঁকি মারা ওই নিশানপুরেই আস্তানা গেড়েছে। এখানকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির ঠিক সামনেই ছোট্ট ওষুধের দোকান ওর। হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন এলে সার্ভ করে আর টুকটাক নিজেও একটু আধটু প্র্যাকটিস করে ডাক্তারবাবুর অবর্তমানে। ওষুধের দোকান করতে গেলে প্রেসক্রিপশন ছাড়াও নিরীহ শিডিউলের কিছু কিছু ওষুধ বিক্রি করতেই হয় মৌখিক চাহিদায়। বারণ করা যায় না। যাকে ওরা বলে ওভার দ্য কাউন্টার সেল।
ডঃ সামন্ত শহরে দারাপুত্র সংসার ফেলে সপ্তাহে তিনদিনের বেশি থাকতে অক্ষম এই গণ্ডগ্রামে। হাসপাতালটা মূলত ফার্মাসিস্ট দিব্যেন্দুর ওপরেই চলে। আর বাকিটা হাসপাতালের চৌহদ্দির বাইরে থেকে অনির্বাণ যতটুকু ম্যানেজ করে। দিব্যেন্দুও নাকি ডাক্তারবাবু না থাকলে লুকিয়ে চুরিয়ে নিজের কোয়ার্টারে এক আধজন রোগী-টোগি দেখে বলে কানাঘুষা চলে নিন্দুকদের মধ্যে। দিব্যেন্দু আর অনির্বাণ একই সাথে পাশ করেছে। দিব্যেন্দু কিন্তু কলেজ থেকে বেরিয়ে বছরখানেকের মধ্যেই চাকরিটা বাগিয়ে নিয়েছে। হেলথ মিনিস্ট্রিতে ওর এক কাকা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সুযোগটা সরাসরি কাজে লাগিয়েছে।
অনির্বাণের সে কপাল না থাকলেও ব্যবসাটা আজকাল অবশ্য মিটার গেজ ছেড়ে ব্রড গেজে চলতে শুরু করেছে ওর। হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর উপস্থিতি অনুপস্থিতির ওপর ভরসা না রেখে রোগী এখন অনির্বাণের দোকানেই ভিড় করছে বেশি। এ নিয়ে ডাক্তারবাবু সরাসরি কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে যে খেপে রয়েছেন তা দিব্যেন্দু একদিন অবশ্য ঠারেঠোরে বলে ফেলেছে অনির্বাণকে।
অনেকটা পথ, তাই সাধারণত সন্ধে সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই দোকান বন্ধ করে বাড়ির পথে রওনা হয়ে যায় অনির্বাণ। মাঝে মধ্যে অবশ্য রোগী বা খদ্দের-টদ্দের বেশি থাকলে ন’টা সাড়ে ন’টাও বেজে যায়। সেদিনও তাই হল। দোকানে তালা মেরে মোবাইল জ্বালিয়ে দেখল ন’টা ছত্রিশ। হেলমেটটা গলাতে গিয়ে মাথাটা উঁচু করতেই নজরে এল আকাশটা বেশ গুমোট হয়ে আছে। একটাও তারা নেই কোনওদিকে। চৈত্রের আকাশ, মহিমা বোঝা দায়। গরম একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে ধীর লয়ে। দেরি না করে বাইক স্টার্ট করে নিয়ে চটজলদি বাড়িমুখো রওনা হয়ে গেল অনির্বাণ।
রাস্তা তখন কিলোমিটার পাঁচেকও ফুরোয়নি। এখানে ওখানে খাবলে-খুবলে যাওয়া রাস্তার ছোটো একটা গর্তে পড়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে ওঠেই হেঁচকি তুলে বন্ধ হয়ে গেল ওর বাইকটা। ঝুপ করে নিকষ অন্ধকার ছেঁকে ধরল চারদিক থেকে। হতভম্ব অনির্বাণ অনেক চেষ্টা করেও বাইকটাকে আর সচল করতে পারল না। সেলফ স্টার্ট তো নিচ্ছেই না, কিকারেও কাজ হচ্ছে না। কিক মারতে মারতে ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে বাইকের স্ট্যান্ড ফেলে নেমে এসে জিরোতে লাগল একটু। একে চারদিকে শুধু বনজঙ্গল তায় আবার রাত বাজে প্রায় দশটা। গ্রামের পথ, জনমনিষ্যির চিহ্নও নেই যে একটু সাহায্য চাইবে।
অন্ধকার যতই কালো হোক না কেন তার নিজস্ব একটা আলো থাকেই। সেই আলোয় চোখ সইয়ে একটু দম নিয়ে আবার ওর দ্বারা যা যা চেক করা সম্ভব করে নিয়ে বাইকটাকে স্টার্ট করার নিষ্ফল চেষ্টা করে গেল মিনিট দশেক ধরে ও। শেষে সেখানেই বাইকটাকে লক করে হাঁটা লাগাবে কি না ভাবতে না ভাবতেই সুতীক্ষ্ণ ফলার মতো বড়ো বড়ো ফোঁটা নেমে এল আকাশ থেকে নাকেমুখে কাঁধে মাথায়। চারদিকে হতাশ দৃষ্টি মেলে শুধু ঝড়ো হাওয়ায় হেলতে দুলতে থাকা কালো কালো ঘন গাছপালাগুলো ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না অনির্বাণ। সামনে পেছনে আরও কিলোমিটার দুয়েক কোনও বাড়িঘর নেই যে মাথাটা বাঁচাবে। চিড়িক করে একটা তীব্র আলোর ঝলকানির পর ক্ক-কড়াৎ শব্দে একটা বাজ পড়তেই দৌড়ে অন্ধকারে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াল ও। যদিও এমন ঝড়জলের সময় গাছের নীচে থাকতে নেই, কিন্তু এ মুহূর্তে এছাড়া উপস্থিত আর কোনও উপায়ও নেই।
মিনিট দশেকের একটা কালবৈশাখী এসে উলটপালট করে দিয়ে চলে গেল সবকিছু। গাছটার নীচে থেকে বেরিয়ে এসে অনির্বাণ ঝড়ো কাকের মতো যখন রাস্তায় উঠে এল ক্লান্ত বাইকটা ততক্ষণে রাস্তায় শুয়ে পড়েছে। ফুয়েল ট্যাঙ্ক থেকে তেলটেল চুঁইয়ে রাস্তায় তেলেজলে ছড়িয়ে একেবারে বিচ্ছিরি অবস্থা। বাইকটাকে কোনওমতে টেনে তুলে বাড়ি যাবার তেলটুকু বেঁচে আছে কি না যাচাই করতে ফুয়েল ইন্ডিকেটরটা জ্বালাতেই একটু দূর থেকে আরেকটা বেশ জোরালো আলো এসে চোখে লাগল ওর। আলোটার চারপাশে কীসের একটা অবয়ব ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে। ভালো করে লক্ষ করতেই মনে হল ঝোপের আড়ালে একটা বাঁদর একতাল আলো নিয়ে খেলছে যেন। এ কী অদ্ভুত ব্যাপার! একরাশ কৌতূহলের পাশাপাশি সামান্য ভয়ও হল ওর। কাছে গেলে বাঁদরটা যদি আঁচড়ে বা কামড়ে দেয়! তবে আলোটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখ টানছে ভীষণ। একটুক্ষণ ওই আলো আর বাঁদরের বাঁদরামি উপভোগ করল ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বাঁদরটা আলোটাকে মাটি থেকে তুলতে যাচ্ছে আর সাথে সাথেই ছিটকে পিছিয়ে যাচ্ছে। একবার, দু’বার, বারবার। খেলাটা চলছেই।
কৌতূহল বড়ো নাছোড়বান্দা জিনিস। একবার জন্ম নিলে মৃত্যু ঘটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনির্বাণও আর আটকে রাখতে পারল না নিজেকে। পায়ে পায়ে ঝোপটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বাঁদরটা চকিতে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে একদৌড়ে জঙ্গলের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। যাবার সময় দুটো হলদে জ্বলন্ত চোখের একটা আক্রোশের চাউনি রেখে গেল অনির্বাণের ভয় খাওয়া চোখদু’টোতে। ওটার চোখদু’টো অমন করে জ্বলছিল কেন কুকুর বেড়ালের মতো? বাঁদরের চোখের অক্ষিপটের পেছনেও ট্যাপেটাম লুসিডাম কেলাস লেয়ার থাকে তা তো জানা ছিল না! দূর থেকে বাঁদর মনে হলেও তখন কাছে আসার পর আকৃতিটা আর একটু বড়োই লাগল যেন। তবে কি হনুমান-টনুমান?
হতভম্ব অনির্বাণের মনোযোগটা অচিরেই হনুমানটাকে ছেড়ে আলোটার ওপর গিয়ে পড়ল। হালকা সবুজ চৌকোমতো একটা আলো দপদপ করছে লম্বা লম্বা ঘাসের ফাঁকে। অত্যন্ত মোহময়ী একটা রশ্মির জাল বিছিয়ে রেখেছে চারদিকে। ঝিঁঝিঁর একটানা চিৎকারে ক্লান্ত অন্ধকারটুকুও যেন তন্ময় হয়ে আছে ওই ঠিকরে বেরনো হালকা সবুজ রশ্মিতে। জোরালো আলোটা এতটাই চোখ ধাঁধানো যে জিনিসটা ঠিক কী এবং আকার আকৃতি কিছুই নজরে আসছে না। মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনের আলোটা জ্বালালেও অস্পষ্ট আলোয় দু’দিকে দু’টো কালো বেল্টের মতো ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না জিনিসটায়। হাতঘড়ি যেমন হয়। মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে খাবলা মেরে জিনিসটা তুলতে গিয়েই ধড়াম করে দু’তিন হাত পেছনে ছিটকে পড়ল অনির্বাণ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উঠে বসতেই টের পেল মাথাটা ভোম হয়ে আছে আর হাতটা যেন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ছ্যাঁকা লেগে। কেমন যেন ঘোর লেগে আছে দু’চোখে। এ কী সর্বনেশে জিনিস এল এখানে!
যতই সময় যাচ্ছে ঘোরটা যেন আরও ঘন হয়ে আসছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে গিয়ে আবার হাত লাগাতে সেই একই পরিণতি। ছিটকে তিনহাত দূরে। এবার রোখ চেপে গেল ওর। জিনিসটা কোনও সাধারণ কিছু হতে পারে না। এটা ওর চাই। কিন্তু যেভাবে জোরালো শক মারছে একেকটা তাতে তো হাত লাগানোই মুশকিল! শেষে বাইকের টুলবক্স খুলে একটুকরো শুকনো কাপড় আর ভেহিক্যাল ডকুমেন্টগুলো পাকিয়ে নিয়ে এসে অনেক কায়দা করে জিনিসটাকে কাপড়ে বেঁধে বাইকের আংটায় ঝুলিয়ে ফেলল ও। জিনিসটার যা তাপমাত্রা তাতে প্লাস্টিকের টুলবক্সে রাখলে গলে যেতে পারে বক্সটা। দোনামনা করে অনিশ্চিতভাবে একটা কিক দিতেই আশ্চর্য ব্যাপার! বাইক এবার এক কিকেই স্টার্ট।
।। তিন।।
সুহাসিনী ব্রিক্স ইন্ডাস্ট্রির মালিক তারক হালদার নিশানপুরের একজন ডাকসাইটে লোক। মাঝারি গড়নের গমরঙা লোকটার মুখে মিষ্টি একচিলতে হাসি ঠোঁটদু’টোতে খেলে বেড়ায় সবসময়। স্কুল ফাংশনে, মাঠে ময়দানে, এলাকার যে কোনও আচার অনুষ্ঠানে বা বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণী সভাতেও তার বিনম্র আমন্ত্রণ নিশ্চিত। উইয়ে ধরা দরমার বেড়ার পার্টি অফিসটাতেও দরাজ হাতে চাঁদা দেন সময়ে সময়ে। নিশানপুর উচ্চ বিদ্যালয়কে বেড় দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে, সেটা ধরে অল্প এগিয়ে একটা বাঁক পেরোলেই তার ইটভাটার চুল্লিটা দেখা যায়। হেমন্তের দুর্গাপুজোর দশমীর দিন যাত্রা করে আগুন দেয় আগুনমিস্ত্রি। নেভে বাসন্তীপুজোর অষ্টমীর দিন। শ্রমিক আনান সেই বিহারের গাঁ-গঞ্জগুলো থেকে। এ তার বাবার আমলের বিধান।
সুহাসিনী তারকের মায়ের নাম। বাবা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভাটাটা চালু করলেও লাভের মুখ দেখে যেতে পারেননি তেমন। ব্যবসাটা আসলে বাড়িয়েছেন তারকই। তারকের বণিকসুলভ বুদ্ধিমত্তা আর পরিশ্রমের গুণে এস.বি.আই.-য়ের ইট আজ শহরের বিভিন্ন প্রমোটারদের তো বটেই সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদেরও প্রথম পছন্দ। তাছাড়া তারক নিজেও একজন দাপুটে প্রমোটার। বাবা মা গত হওয়ার পর গাঁ ছেড়ে এখন শহরের ফ্ল্যাটবাড়িতে সংসার গুছিয়ে নিয়েছেন। গাঁয়েও মহল বানিয়ে রেখেছেন একটা।
বৃহস্পতিবারটা সকালের দিকে একটু ফাঁকা থাকে অনির্বাণ। নিশানপুরে হাটবার এদিন। অবশ্য বিকেল তিনটের আগে হাট জমে না এ গাঁয়ে। তাই এই দিনটায় বেশ বেলাতেই দোকান খোলে ও। অন্যদিন সকালে আউটডোরের সময় মোটামুটি লোকজন থাকলেও বৃহস্পতিবারে হাটের আগে আসে না তেমন। ডাক্তারবাবুও থাকেন না বিশেষ এদিনে হাসপাতালে। তাই রোগীর বা প্রেসক্রিপশনের চাপটাও প্রায় থাকে না বললেই চলে। তবে হাটের সময় নিজের প্র্যাকটিসটা বেশ জমে ওঠে ওর।
বেলা এগারোটা নাগাদ দোকান খুলে কাউন্টারের ওপর উলটে রাখা টুলদু’টো এনে বারান্দায় পাততে না পাততেই তারক হালদারের তিনটে গাড়ির সবচেয়ে দামিখানা এসে দাঁড়াল ডানদিকের কৃষ্ণচূড়াগাছটার ছায়ায়। হালদারবাবু গাড়ি থেকে নেমেই বারান্দায় একটা টুলে এসে বসে পড়লেন ধপ করে। অনির্বাণ লজ্জায় পড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের চেয়ারটা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই আমায়িক হেসে বাধা দিলেন তারক, “আরে আরে, কি করছটা কী? এটা তোমার চেয়ার না? মানে এই দোকানের মালিকের তো?”
অনির্বাণ লাজুক হেসে চুপ করে রইল। তারক স্নেহমাখা ধমকের সুরে বললেন, “আর কক্ষনও ওর’ম করবে না, বুয়েছ? ড্রাগ ইনস্পেক্টর এলেও ভদ্রলোককে আলাদা চেয়ারে বসাবে। নিজের চেয়ার এগিয়ে দেবে না। নিজের সম্মান নিজেই ঠিক রাখতে হয়। বুঝলে?”
“আসলে মিস্ত্রিকে দু’টো চেয়ারের কথা বলে রেখেছি মাস খানেক আগে। এই আজ দেবে, কাল দেবে বলে…”
“তা যাক গে, ইয়ে, শোনো অনির্বাণ, এসেছি একটা দরকারে। তোমায় একটু কষ্ট করতে হবে যে ভাই, দাদার জন্যে।”
লাজুক হাসি মিলিয়ে গিয়ে এবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল অনির্বাণের। বলল, “কী কষ্ট, বলুন না।”
“সপ্তাহে একটিবার ভাটায় গিয়ে একটু হেলথ চেকআপ করে আসতে হবে লেবারদের। তোমার সুবিধে মতো, লক্ষ্মী ভাইটি। ক্যামন? আসা যাওয়ার কথা ভেবো না, ওটা থাকবে,” বলে নিজের গাড়িটা আঙুল তুলে দেখালেন তারক।
অনির্বাণ বিচলিত হয়ে বলল, “দাদা, কী যে বলি আপনাকে! দোকানের চাপটা তো নিজের চোখেই দেখছেন, একা চালাই। আউটডোর খোলা থাকলে হিমশিম খেতে হয় রীতিমতো। একটা পড়াশোনা জানা চালাক চতুর গোছের ছেলে-ছোকরাও পাচ্ছি না ত্যামন যে স্টাফ হিসেবে রেখে দেব। এই অবস্থায়… আমায় মাপ করতে হবে তারকদা।”
অনির্বাণের আর্তিটুকু গায়েই মাখলেন না তারক। অনির্বাণের কথার পিঠেই বললেন, “সে তো ঠিকই অনির্বাণ। তোমার খুব খাটুনি যায় দোকানে। হবেই তো, এত বড়ো এলাকায় আছেই সবে দু’টো কাউন্টার। তোমার আর ওই লোকেশের। চাপ তো থাকবেই। তবে একেকটা শিশি-বোতল যে দেখছ তোমার ওই তাকে, কত বড়ো বড়ো হয়। সবগুলো কিন্তু ফ্যাক্টরিতে ওই চাপের কেরামতিতেই, জানো তো। আসল জিনিসটা তো হয় তোমার ওই একটা অ্যান্টাসিড ট্যাবলেটের সাইজের।”
তারপর উঠে এসে মুখটা অনির্বাণের খুব কাছে বাড়িয়ে গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন, “তুমি হয়তো এখুনি বলবে যে লোকেশকে বলে দেখছি না কেন। কিন্তু ওই লোকেশ ছোঁড়াকে ঠিক পছন্দ নয় আমার। কোত্থেকে কী সার্টিফিকেট এনে দোকান খুলে বসেছে কে জানে। একটা ইঞ্জেকশন পুশ করলে রোগী তিনদিন কাতরায়,
এমনি হাত।”
“কিন্তু তারকদা, হেলথ চেক-আপ তো কোনও ডাক্তারবাবু ছাড়া…”
“কেন? একজন প্লেন এমবিবিএস কি কোনও ইয়ে নাকি একেবারে? তুলনায় একজন বি.ফার্মার বাস্তব অভিজ্ঞতাও ফেলনা নয়। তোমারও তো রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। তাছাড়া তোমার যা হাতযশ… তুই ভাই আর অমত করিস না অনি। লেবার অফিস থেকে প্রেশার রয়েছে। তাছাড়া লেবাররা অসুস্থ থাকলে আমারও তো প্রোডাকশনে ক্ষতি হয় ভীষণ। বুঝতেই পারছিস, বছরে হাতেগোনা ক’টা মাস, তার ওপর যদি সবাই কাজ করতে না পারে, সুস্থ না থাকে…” প্রথমে হা হা করে কথাগুলো বলে ফেলে শেষে কাঁদো কাঁদো মুখে অনির্বাণের হাতদু’টো চেপে ধরলেন তারক।
এই আরেক মহাগুণ লোকটার। কাজ আটকে গেলে কাউকে আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে সেকেন্ডে তুইয়ে নেমে গিয়ে ভাইবন্ধু বানিয়ে নিতে মোটেও সময় খরচ করেন না তারক।
।। চার।।
এই নিয়ে মোট তিনদিন তারকের ইটভাটায় শ্রমিকদের চেক-আপ করে এসেছে অনির্বাণ। সেদিন তারকের অনেক পীড়াপীড়ির পর ও রাজি হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল ছাড়া পারবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল। স্বস্তির হাসি টেনে বড়ো করে ঘাড় কাত করেছিলেন তারক। বৃহস্পতিবার সকাল আটটা নাগাদ অনির্বাণ ইটভাটায় ম্যানেজারের অফিসের বারান্দায় টেবিল পেতে বসে। ঘণ্টা খানেক লাগে লিকলিকে হাত পা পেট ফোলা কুচোকাঁচা আর কষ্টিপাথরের সুঠাম মেয়ে-মরদগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে। পিঠ ব্যথা, হাঁটু ব্যথা, জ্বরজারি, পেটখারাপ আর ভিটামিনের অভাব, ক্রিমি, বদহজম এসব কেসই বেশি। সম্ভাব্য ওষুধপত্র সব ব্যাগেই থাকে ওর। দুয়েকটা দরকার পড়লে ম্যানেজারবাবু পরে দোকান থেকে আনাবার ব্যবস্থা করেন।
সেদিন টেবিলে গিয়ে বসতেই লাইন ঠেলে বুড়ো লেবার সর্দার তার দশ এগারো বছরের নাতি ভুলুয়াকে কোলে করে এনে হাজির করল অনির্বাণের সামনে। পাশের বেঞ্চটায় শুইয়ে দিতে দিতে হাউমাউ করে বলতে লাগল, “হামার নাতি কো বচাইয়ে ডগদর সাহেব। রাত দো বজনে কে বাদ সে বহুত বুখার আছে। সুবহ সে তো আঁখ ভি খোলছে না!”
অনির্বাণ উঠে গিয়ে ভুলুয়ার গায়ে হাত দিয়েই সরিয়ে নিল। বিচলিত হয়ে বলল, “আরে সব্বোনাশ! গা তো পুড়ে যাচ্ছে একেবারে। এখানে এনেছেন কেন? প্রয়োজনে আমিই যেতাম নয় আপনার ঘরে। যান যান, শুইয়ে আসুন শিগগির। আর গামছা ভিজিয়ে সারা শরীর মুছে দিতে বলুন একটু পর পর।”
সর্দার নাতিকে ঘরে শুইয়ে আবার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই অনির্বাণ জিগ্যেস করল, “জ্বর কখন থেকে বললেন যেন, রাত দু’টো? কাশি আছে বা পেচ্ছাপের সময় জ্বালাপোড়া হয়? ভিজেছিল দুয়েকদিনের মধ্যে?”
সর্দার সবেতেই মাথা নেড়ে শেষে বলল, “কাল শাম কো কুথা সে দওড়ে দওড়ে এল আঁখ বঢ়া বঢ়া কোরে। আতে হি বিস্তর পকঢ় লিয়া।”
অনির্বাণ একটু হতাশ হয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। এই বড়িটা আটঘণ্টা পর পর খাওয়াবেন। আর এটা দিনে দু’বার। মনে থাকবে তো? ভুল করবেন না যেন। আর শুনুন, রাতের মধ্যে যদি জ্বর না কমে তবে কিন্তু হাসপাতালে দেখাতে হবে। কাল সকালে ডাক্তারবাবু এসে যাবেন হাসপাতালে। আর ওই জলপট্টিটা কিন্তু চলবে। ঠিক আছে?”
কাঁচুমাচু হয়ে হাত কচলে সর্দার বলল, “ঠিক হ্যায় ডগদরসাব, লেকিন এক সুই লগা দেতে তো…”
অস্থিরভাবে মাথা নাড়ল অনির্বাণ। এই এক জ্বালা ব্রিক ফিল্ডের লেবারদের নিয়ে। দু’টোর বেশি তিনটে হাঁচি এল কি এল না সুই নেওয়া চাই। যতই ওর্যাল ফর্মে ওষুধ দাও না কেন, ইঞ্জেকশন ছাড়া মন ভরে না ওদের। আর দরকার পড়লে দোকানে গিয়ে নাম ছাড়া লাল কালা পিলা গোলি খুঁজবে। বিরক্তিটা চেপে রেখে সর্দারকে হাত তুলে নিরস্ত করল অনির্বাণ।
না, ভুলুয়ার সুই লাগেনি। হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হয়নি। রাত বাড়তেই জ্বরটা পড়ে গিয়ে খিদের জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়েছিল বেচারা। মাঝে একটা দিন দম নিয়েই আবার দৌড়ঝাঁপ শুরু। এখন অনির্বাণ ইটভাটায় গেলেই আশেপাশে ঘুরঘুর করে ও। লুকিয়ে চুরিয়ে তাকায় আর মুচকি মুচকি হাসে। একদিন কাজ শেষ করে বেরোবার মুখে ভুলুয়াকে ডেকে অনেক গল্পগাছা করল অনির্বাণ। ছেলেটার বাপ মা কেউ নেই। বছর তিনেক আগে এখানে আসার সময় বাসের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল ওরা। লেবার কনট্রাক্টরের কাছে সবার পারমিট ছিল না। তাই চেকপোস্টে গাড়ি ঢোকার আগেই জনাপাঁচেক শ্রমিককে ধমকে-ধামকে জোর করে বাসের খোলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সে। তারপর অন্তত কিলোমিটার পঞ্চাশেক পেরিয়ে আসার পর ড্রাইভারের যখন হুঁশ হল তখন যথারীতি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে সবক’টা শ্রমিক। পত্রপত্রিকাগুলো বেশ সোরগোল তুলেছিল খবরটা নিয়ে ক’দিন। মনে পড়ল অনির্বাণের।
ভুলুয়া তাই এখন দাদুর কাছেই থাকে। সারাদিন শক্ত কাদার তাল থেকে পরিমাণমতো দলা পাকিয়ে শুকনো বালিতে গড়াগড়ি খাইয়ে দাদুর হাতে এগিয়ে দেয় আর সন্ধের পর সামনে খোলা বই পেতে ঢুলতে থাকে। মাঝে মাঝে কাজ ফেলে বা বিশেষ করে সন্ধের দিকে কে জানে কোথায় উধাও হয়ে যায়। দাদুকে তো প্রশ্নই নেই, নয়া দোস্ত ডগদরসাবকেও ভাঙে না এই ব্যাপারটা। ইদানীং ভুলুয়ার সাথে খুব দোস্তি হয়ে গেছে অনির্বাণের। প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে ওদের দেখা হওয়াটা রুটিনে দাঁড়িয়েছে। তারপর মাঝে মাঝে দাদুর সাথে বিকেলে হাটে এলেও একদৌড়ে অনির্বাণের দবাইর দোকানে এসে দেখা করে যায় কয়েক মিনিটের জন্যে। মৌমাছির মতো ব্যস্ত অনির্বাণ তখন এক ফাঁকে একটা চকলেট কিংবা চিপসের প্যাকেট আর একচিলতে হাসি ধরিয়ে দেয় বন্ধুর হাতে। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে একছুটে গিয়ে ফলমূলের দোকানগুলোর সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় ভুলুয়া। দাদুকে বড়ো উত্যক্ত করে ওকে কিছু ফল-পাকড়া কিনে দেবার জন্যে। দাদুর অবশ্য আপত্তি থাকে না তেমন। কিন্তু ওগুলো ভুলুয়া খেলে তো! এক দু’টো যাই খেল না খেল, বাকিগুলো কোথায় হাপিস করে দেয় কে জানে। দাদু কখনও সখনও আপত্তি করলে সোজা অনির্বাণকে এসে ধরে। অনির্বাণও একগাল হেসে কিছু টাকা গুঁজে দেয় অনিচ্ছুক সর্দারের হাতে।
।। পাঁচ।।
ছেলে বাড়ি ফেরার পর শুভেন্দু যখন ওই হাতঘড়িমতো জিনিসটা ছেলের হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন তখন বেশ ভয়ে ভয়েই হাতে নিল অনির্বাণ ওটা। স্বাভাবিক কৌতূহলবশত শুভেন্দু জিনিসটা সম্পর্কে জানতে চাইলেও ভাসা ভাসা একটা জবাব দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল ছেলে। অবশ্য সে নিজেও জিনিসটা সম্পর্কে এখনও অতল জলে।
যদিও সকালে ওটা আর শক দিচ্ছিল না, তবুও ড্রয়ার খুলে প্রথমে ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে চেক করে পরে ভয়ে ভয়ে হাত লাগিয়েছিল অনির্বাণ। তাই হয়তো বাবাও শক খায়নি। তবে কি… কিন্তু সেদিন তো এমন শক্ত শক্ত দু’টো শক দিয়েছিল যে…
কোনওমতে নাকেমুখে দু’টো গিলে এবার নিজের ঘরে খিল দিয়ে জিনিসটাকে নিয়ে পড়ল ও। সেদিন ঝড়জলের রাতে ওটা কুড়িয়ে এনে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে রেখেছিল। পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে প্রথমেই জিনিসটার গায়ে আগাটা ছোঁয়াতেই লাল আলো জ্বলে উঠেছিল ইলেকট্রিক টেস্টারটায়। অদ্ভুত জিনিসটার হালকা সবুজ আলোটা জ্বলেই আছে। ভয় পেয়ে আর হাত দেয়নি ওতে অনির্বাণ।
পরের দু’দিনও একই অবস্থা। তারপর তারক হালদারের চাপাচাপিতে ওর ব্রিক ফিল্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আর তার ড্রাগ লাইসেন্সটার রিনিউর ঝামেলায় আবছা মনে থাকলেও ওটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার তেমন অবকাশ হয়নি। দোকানেও বেশ চাপ যাচ্ছিল ক’দিন। উৎসাহটাও আর আগের মতো তাজা ছিল না। ড্রয়ারেই পড়ে ছিল জিনিসটা। হঠাৎ আজ সকালে বেরিয়ে যাবার মুখে একটা জরুরি কাগজ ড্রয়ার থেকে বের করতে গিয়ে চোখ পড়ল জিনিসটায়। সবুজ আলোটা কখন বন্ধ হয়ে গেছে কে জানে। তাড়াতাড়ি টেস্টারটা এনে পরীক্ষা করে দেখল এখন আর কারেন্ট দেখাচ্ছে না। কারণটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল হল, আরে! এমন নয় তো যে সেদিন বৃষ্টির জল ঢুকে জিনিসটায় শর্ট সার্কিট হয়ে ছিল এ ক’দিন। যেমনটা হয়ে থাকে ইলেকট্রনিক্স জিনিসগুলোর ক্ষেত্রে। একটু রোদে দিলে কেমন হয়? ওর ব্যাটারির ডিজিটাল হাতঘড়িটাও তো জলেটলে ভিজে বন্ধ হয়ে গেলে পেছনের ডালাটা খুলে রোদেটোদে শুকিয়ে সচল করেছে দুয়েকবার। দেখাই যাক না। তবে যদি শর্ট সার্কিটের ব্যাপারই হয়, তবে বলতে হবে এ জিনিস খুব শক্তিশালী আর বিপজ্জনকও বটে। ওষুধের একটা খালি কার্টন উলটে জিনিসটা রেখে ছাদে জলের ট্যাঙ্কের আড়ালে শুকোতে দিয়ে দোকানে চলে গিয়েছিল অনির্বাণ। ছাদটা শক্ত লোহার রডে ঢাকা ওদের, দাদুর আমল থেকেই। তাই চোরছ্যাঁচড়ের ভয় নেই। আর জিনিসটা কাকপক্ষীতে ঠোঁটে করে নিয়ে যাবে অতটা হালকাও নয়।
ভুলেই গিয়েছিল বেমালুম ও। ফিরে এসে একবারের জন্যেও মনে পড়েনি জিনিসটার কথা। শুভেন্দুর চোখ না পড়লে থেকেই যেত ওটা সারারাত ছাদে। কিন্তু জিনিসটা কী বা কোত্থেকে এল কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। বড়ো ডায়ালের ঘড়ির মতো একটা জিনিস, দু’দিকে আবার দুটো বেল্টও আছে যাতে হাতের কবজিতে পরা যায়। ডায়ালটা একটা চৌকো মনিটরের মতো। হার্ট কিডনির ছবি আর হিজিবিজি লেখা ফুটে ওঠার কথা যখন বলল বাবা তখন ততটা বিপজ্জনকও নয় বোধহয় জিনিসটা। অন্ততপক্ষে কোনও অস্ত্রশস্ত্র নয় নিশ্চয়ই। নিজেকেই নিজে আশ্বস্ত করল অনির্বাণ। বাবা আবার একটা বোতামও খুঁজে পেয়েছে যেটা ওর নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। একটু ইতস্তত করে বোতামটা টিপে দিতেই পী করে কয়েক সেকেন্ড লম্বা একটানা একটা হালকা শব্দ করে খুদে মনিটরটায় সেই সবজে আলোটা জ্বলে উঠল।
দোনামনা করতে করতেই একটুক্ষণ অপেক্ষা করে ওটা বাঁহাতের কবজিতে লাগিয়ে বেল্টটা বাঁধার চেষ্টা করতে না করতেই কমলা রঙের একটা স্ক্রল বার চালু হয়ে গেল স্ক্রিনটাতে। বারটার নিচেই কী যেন হিজিবিজি একটা লেখা স্থির হয়ে আছে। পড়া যাচ্ছে না। বেল্টটা বেঁধে অন্যমনস্কভাবে ডায়ালটা আঙুলের প্যাঁচে ডানে বায়ে নাড়িয়ে একটু ঠিক করে নিতেই আরেক কাণ্ড! উপরের দিকের ডালামতো অংশটা সরে গিয়ে নীচে ছোট্ট ক্যালকুলেটরের মতো অনেকগুলো বোতাম বেরিয়ে পড়ল। ততক্ষণে কমলা রঙের স্ক্রলিংটা অদৃশ্য হয়ে গিয়ে আরেকটা পার্পল বার স্ক্রল করতে শুরু করেছে। নীচে আবারও সেই অবোধ্য ভাষায় কিছু অক্ষর ফুটে আছে। মন থেকে ভয়ডর মুছে গিয়ে এবার কৌতূহলের পারদ চড়তে শুরু করেছে অনির্বাণের। সম্মোহনী সবজে আলোটা থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। মনটা একান্তভাবে মনিটরটার ওপরেই নিবিষ্ট হয়ে আছে। জোর করেও অন্যদিকে ফেরানো যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে চারদিক থেকে একটা ঘোরের আবেশ যেন ছেঁকে ধরছে ওকে।
অনির্বাণ অবাক হয়ে দেখল, মনিটরটায় ফুটে উঠেছে একটা মানব-শরীরের ডানপায়ের ছবি। কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময়। তারপরই পুরোটা পা থেকে মাত্র হাঁটুটা জুম করে গিয়ে শুধু একটা বিশেষ অংশ অ্যানালাইজ করতে লাগল পুরোটা মনিটর জুড়ে যন্ত্রটা। আর সাথে সেই অচেনা অক্ষরের খেলা। কত কী ফুটে উঠছে, কত কী মুছে যাচ্ছে। মুহূর্তে চিড়িক করে উঠল মাথাটা অনির্বাণের।
বছর দুই আগে স্কুলমাঠে পনেরোই আগস্টের দিন ফুটবল ম্যাচে ডানহাঁটুর অ্যান্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্টটা খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ওর। হেড করে গোল করতে লাফিয়ে ওঠার সময় কনুই দিয়ে জোর মেরেছিল প্রতিপক্ষের কেউ একজন। এখনও মাঝাসাঝে বা অমাবস্যা পূর্ণিমায় অল্পস্বল্প ব্যথাবেদনা টের পাওয়া যায়। তবে কি যন্ত্রটা ওর নিজেরই হাঁটুর সমস্যাটাই…!
এক মুহূর্তও দেরি না করে সোজা দরজা খুলে মুখটা বাড়িয়ে উত্তেজিত গলায় ডাকতে লাগল অনির্বাণ, “বাবা, ও বাবা, শিগগির দেখে যাও তো একবার।”
শুভেন্দু ঘরে ঢুকতেই নিজের হাত থেকে যন্ত্রটা খুলে বাবার হাতে পরিয়ে দিয়ে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করতেই মনিটর নিজের কাজ শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে হার্ট অ্যানালাইজ করে পরে একটা কিডনিও অ্যানালাইজ করল। অবাক অনির্বাণের মুখে এবার একটা দুর্ভাবনার কালো মেঘ ছায়া ফেলল। বাবার হার্টের সমস্যা আছে আর তা মিলেও যাচ্ছে যন্ত্রটার বিশ্লেষণের সাথে হুবহু। লেখাগুলো পড়া না গেলেও ছবি, ডায়াগ্রাম, সমস্যার পিন-পয়েন্ট সব মিলে যাচ্ছে অক্ষরে অক্ষরে। শুভেন্দুর হার্টের করোনারি আর্টারিতে কিছুটা প্লাক রয়েছে এটা বাড়ির সবাই জানে। কিন্তু কিডনির ছবি কেন? যদিও এটা বিশ্লেষণ করেনি মেশিনটা। কিন্তু বাবার তো কিডনিতে কোনও সমস্যা ছিল না এ যাবৎ। তবে কি নতুন করে শুরু হল? নাকি আগাম ভবিষ্যৎবাণী? অবিলম্বে একটা চেক-আপ দরকার বাবার।
শুভেন্দু চলে যাওয়ার পর আরও কয়েকবার যন্ত্রটা নিজের হাতে লাগিয়ে দেখল অনির্বাণ। কাঁটায় কাঁটায় একইরকম বিশ্লেষণ। এ কী যন্ত্র রে বাবা! কেই বা ফেলে গেল জঙ্গলের মধ্যে এমন মূল্যবান একটা জিনিস! মানুষের শরীরে কোথাও কিছু সমস্যা বা গণ্ডগোল আছে কি না কয়েক মিনিটেই বলে দিচ্ছে যন্ত্রটা! তাও কেবল কবজিতে বেঁধে নিলেই শরীরের যেকোনও জায়গার সমস্যা ডিটেক্ট করে দিচ্ছে! ভয় ইতস্ততা ঝেড়ে ফেলে এখন খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছে ওর মন।
কিন্তু একটাই সমস্যা, ওই হিজিবিজি লেখাগুলোকে নিয়ে। ওগুলোর মানে কী আর ভাষাটাই বা কোন দেশের কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। অথচ এগুলো পাঠোদ্ধার করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। মনে হচ্ছে শুধু রোগবালাইগুলো চিনিয়ে দিয়েই কাজ শেষ নয় যন্ত্রটার। পাশাপাশি প্রত্যেকটা সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের বিবরণ ফুটে উঠছে হয়তো মনিটরটাতে। হয়তো বা সমাধান কিবা চিকিৎসাও। কিন্তু লেখাগুলোর মর্মোদ্ধার না করতে পারলে তো…
কী একটা মনে পড়তেই চমকে উঠল অনির্বাণ। আচ্ছা, লেখাগুলো কোনও প্যালিওগ্রাফি নয়তো? তড়াক করে উঠেই বইয়ের তাক ঘেঁটেঘুঁটে দু’চারটে বই ঝেড়েঝুড়ে আনল ও। কলেজে একবার একটা সম্পূর্ণ আলাদা মেরুর বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিয়েছিল সে। নিতান্ত শখের বশেই প্যালিওগ্রাফি নিয়ে মেতে উঠেছিল কয়েকমাস। তারপর পরীক্ষার টার্মগুলো এসে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছিল প্যালিওগ্রাফিকে। এই প্যালিওগ্রাফির দৌলতেই প্রফেসর বিনায়ক রুদ্রর অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিল অনির্বাণ। প্রফেসর রুদ্র তখন ওদের কলেজের ফিজিওলজির হেড। কিন্তু মনপ্রাণ জুড়ে একটাই জিনিস ভদ্রলোকের, প্যালিওগ্রাফি। মুখে পাইপ কামড়ে প্রাচীন থেকে প্রাচীনতম হস্তলিপি নিয়ে দিনরাত এক করে ফেলতেন এই জাঁদরেল প্রফেসর। অনির্বাণ ও আরও দু’চারজন সহপাঠীও আস্তে আস্তে এই বিদ্যায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল স্যারের সংস্পর্শে এসে।
এপাতা ওপাতা উলটে হতাশ হতে হল শেষে। নিজের বইগুলোর কোথাও এই উদ্ভট লিপিগুলোর মিল বা উল্লেখ নেই। এই মুহূর্তে শুধু একটাই চেহারা চোখে ভাসছে – প্রফেসর রুদ্রর।
।। ছয়।।
ভুলুয়া আজকাল দিনের বেলা কাজের সময়ও ভাটায় থাকছে না প্রায়দিনই। দাদুর ফর্মা বাক্সের ওঠানামার ফাঁক গলে কখন যে কোথায় গায়েব হয়ে যায়! নাতির সঙ্গে না পেরে উঠে অনির্বাণকেও একদিন অনুযোগ করছিল সর্দার। ওর আশকারা পেয়েই নাকি ছেলেটা আরও বাঁদর হয়ে যাচ্ছে। শেষে ভুলুয়াকে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজে মন ফেরাতেও অনুরোধ করল বুড়ো। অনির্বাণ ইটভাটায় গেলে পেছন পেছন এখন আর আগের মতো ঘুরঘুর করে না ভুলুয়া।
সেদিন ভিজিটে গিয়ে চেক-আপ করতে করতেই চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ভুলুয়াকে খুঁজছিল অনির্বাণের চোখ। পাত্তা নেই বিচ্ছুটার। ভিজিট সেরে বেরিয়ে আসতেই দেখা গেল গাড়ির সামনে ভুলুয়া দাঁড়িয়ে। লাজুক মুখে মিষ্টি হেসে তাকাতেই কান পাকড়ে কপট ধমক লাগাল অনির্বাণ, “কী রে দুষ্টু, আজকাল তোর টিকিটাও দেখা যায় না কেন রে? কোথায় থাকিস সারাদিন? দাদু বলল, কাজকর্ম বাদ দিয়ে নাকি সারাদিন টো টো করিস, হুম? বুড়ো মানুষটাকে কি জ্বালাতে আছে রে!”
ভুলুয়ার হাসিটুকু ফুরিয়ে গিয়ে চিবুকটা আস্তে আস্তে বুকের কাছে নেমে এসেছে ততক্ষণে। টলটলে চোখে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “হামি স্কুল মে পড়ব ডগদরবন্ধু। হামি জুবান শিখব। বহুত জুবান। নহি তো হামি কুছুই সমঝতে পারছি না…”
একটা ঢোঁকের সাথে বাকি কথাটা গিলে ফেলে মাটির দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে রইল ভুলুয়া। অনির্বাণ বলল, “কী বুঝতে পারছিস না ভুলুয়া? এই তো দিব্যি সবার সাথে কথা বলিস টকটক করে, আবার কী ভাষা শিখবি তুই?”
ভুলুয়া গোমড়া মুখে চুপ করে আছে দেখে অনির্বাণ তাড়াতাড়ি বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। পড়িস তুই। তবে কী জানিস তো, এখানকার স্কুলে তুই পড়তে পারবি না রে। তোকে নেবেও না। এক কাজ করিস, আমার দোকানে রোজ বিকেলের দিকে নয় একবার… আচ্ছা, আমি কথা বলব সর্দারের সাথে এ ব্যাপারে। কেমন?”
কয়েকমাসে বেশ মায়া পড়ে গেছে বাপ মা হারা ছেলেটার ওপর অনির্বাণের। জন্ম থেকেই অনিশ্চয়তার জীবন কাটাচ্ছে ওরা। কতো কতো ছেলে স্কুলে যায় ওর বয়সি। আর এই ছেলেটার বর্তমান ভবিষ্যৎ সব অনিশ্চিতের অতল গহ্বরে।
গত পাঁচ সাতদিনে একটিবারের জন্যেও দেখা হয়নি ভুলুয়ার সাথে অনির্বাণের। কোথায় বেপাত্তা হয়ে থাকে কে জানে। সেদিন সন্ধের পর কাউন্টারের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওষুধপত্রগুলো গুছিয়ে তুলছিল অনির্বাণ। এবার বাড়ি যাবে। হঠাৎ একটা হল্লা চিৎকারে গলাটা বাড়াতেই দেখল একজন কাউকে পাঁজাকোলা করে হাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে আসছে এদিকেই। আরও কয়েকজনও দল পাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সাথে সাথে এগিয়ে আসছে ওর দোকানের দিকেই। অনির্বাণ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতেই সর্দারের আতঙ্কিত চেহারাটা চোখে পড়ল। পাঁজাকোলা করে ধরে রেখেছে নাতিকে ক্লান্ত দেহে। দাদুর কোল বেয়ে ঘাড় হাত পা এদিক ওদিক ঝুলে আছে ভুলুয়ার। দোকানের বারান্দায় টুলে শুইয়ে দিতেই চোখে পড়ল সারা গায়ে অসংখ্য দগদগে ক্ষত। কোনও হিংস্র জন্তু রোষের বশে আঁচড়ে কামড়ে দিলে যেমন হয়।
“হামার নাতি কো বচা লো ডগদর। নহি তো মর যায়েগা!” অনির্বাণের হাতদু’টো চেপে ধরে ভেঙে পড়ল সর্দার।
“ওর’ম করো না সর্দার। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ওকে। এখানে কিছু করা যাবে না। তাড়াতাড়ি করো। রক্ত অনেক বেরিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু হল কী করে এসব? চল চল, দেরি করো না,” বেশ বিচলিত হয়ে পড়ল অনির্বাণ। বুকটা শুধু ধীর লয়ে ওঠানামা করছে ভুলুয়ার। আর সারা দেহ অসাড়, জ্ঞান নেই। ভেতরটা মুচড়ে উঠল ওর।
“রমিয়া ছড়ায় বাসন মাজতে গিয়ে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ পেয়ে…” হাসপাতালে ঢুকতে ঢুকতে কে একজন বলল জটলাটা থেকে।
“ছড়ার পাড়ে? ঘাটটা বাদ দিলে চারপাশে তো জঙ্গল! ভুলুয়া ওখানে কী করছিল?” অনির্বাণের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ার আগেই ডাক্তার সামন্ত এসে ঢুকে পড়লেন ইমারজেন্সিতে।
চারদিন বাদে আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে ভুলুয়া। এই চারদিন যখনই সুযোগ পেয়েছে এক পলক চোখের দেখা দেখে এসেছে ওকে অনির্বাণ দোকান থেকে বেরিয়ে। কখনও সকাল সকাল বা রাতে বাড়ি যাওয়ার সময় দু’দণ্ড বসেও গিয়েছে ভুলুয়ার বেডে। তবে ছাড়া পাওয়ার আগের রাতে অনেক খোঁচাতে খোঁচাতে আসল কথাটা বের করে ফেলেছে ও ভুলুয়ার মুখ থেকে।
ঘটনাটা শোনার পর এখনও থম মেরে আছে অনির্বাণ। ভুলুয়াকে আদৌ বিশ্বাস করা যায় কি না এই নিয়ে পেন্ডুলামের মতো দুলছে ওর মন, বিচার বুদ্ধি। তবে এ ধরনের অবিশ্বাস্য ব্যাপার তো ওর সাথেও হয়েছে সেদিন ঝড়জলের রাতে। খুব ছোটোবেলায় খবরের কাগজের একটা তোলপাড় করা খবরের কথাও যেন আবছা মনে আসছে। তবে কি ভুলুয়া সত্যি বলছে? দেখা যাক, ভুলুয়া তো বলেছে ছাড়া পেয়েই অনির্বাণকে নিয়ে যাবে জঙ্গলে। যদিও অনির্বাণ ঠিক করে রেখেছে আরও একটু সুস্থ না হলে ভুলুয়াকে ঘর থেকে বের করা ঠিক হবে না। এখনও বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে বেচারা।
ইতিমধ্যে একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করে ওই যন্ত্রটা দোকানে নিয়ে এসেছে অনির্বাণ। একবার রোগীর শরীরের ছোঁয়া পেলে রোগের ঠিকুজি কোষ্ঠী সব এবার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। বড়ো বড়ো ডিগ্রিধারীরা যেখানে ডায়াগনসিসে ফেল মেরে যাবেন সেখান থেকেই শুরু হবে অনির্বাণের জয়যাত্রা। তবে কাজটা সঠিক হচ্ছে কিনা তা নিয়ে মনটা এখনও খচখচ করছে ঠিকই। কিন্তু সাফল্যের স্বপ্ন অতি সুমিষ্ট বস্তু। আর যেখানে প্রায় একশ শতাংশ সুযোগ রয়েছে নাম যশ হাতের মুঠোয় বন্দি করার সেখানে অনুচিত শব্দটার জোর কমে যায় আপনা থেকেই।
কিন্তু যন্ত্রটা ব্যবহার করতে হবে খুব গোপনে। সবার অলক্ষে। কোনও অর্থেই রোগী কিংবা অপর কোনও ব্যক্তিকে এর আভাস পর্যন্ত পেতে দেওয়া যাবে না বিন্দুমাত্রও। যন্ত্রটার দু’দিকে দুটো ফিতে আলাদা করে এমনভাবে লাগানো আছে যাতে প্রয়োজনে খুলে ফেলা বা লাগিয়ে নেওয়া যায়। তাই দু’দিকের ফিতে দু’টো খুলে ফেলে একটা স্টেথোস্কোপের ডায়াফ্রাম আর বেলটা বাদ দিয়ে স্টেমের গোড়ায় যন্ত্রটা ফিট করে দিয়েছে ও। যাতে হঠাৎ দেখলে ওটা সাধারণ একটা স্টেথোস্কোপ বলেই মনে হয়। তারপর পেশেন্টকে দেখার সময় পিঠের দিকে আড়াল করে যন্ত্রটা আগে থাকতেই অন রেখে বসিয়ে দিলেই হল। যন্ত্রটার একটা নামও দিয়েছে অনির্বাণ। ‘ইনস্ট্যান্ট ডায়াগনসিস অ্যান্ড ইলূসিডেটরি অ্যানালাইজার’ বা সংক্ষেপে আইডিয়া। শুধু স্ক্রিনে ফুটে ওঠা লেখাগুলোর হরফগুলো চিনতে পারলেই হত। তা যখন আপাতত হচ্ছে না তখন ছবি বা ডায়াগ্রাম দেখেই কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। আর সে মোতাবেক তৈরি হবে নিখুঁত প্রেসক্রিপশন। অনির্বাণ মোটামুটি নিশ্চিত যে লেখাগুলো আসলে রোগ নির্ণয়ের বিবরণ বা চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্যই। অন্যকিছু হতে পারে না।
আইডিয়ার মোহে পড়ে ভুলুয়ার কথা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল অনির্বাণ। আইডিয়া কাজও করছে দুর্দান্ত। দোকানে ভিড়ও বাড়ছে দিন কে দিন। ডঃ সামন্তকে লুকিয়ে রোগী দেখার ক্ষেত্রে আগের সাবধানতাটা জোরদার হয়ে এখন সন্ত্রস্ততার পর্যায়ে পৌঁছেছে। একদিকে কেউ যাতে ঘুণাক্ষরেও টের না পায় এই আইডিয়ার কথা আর অন্যদিকে ডাক্তারবাবু যেন অসন্তুষ্ট না হন দোকানে বসে প্র্যাকটিসের। সবদিক সামলেই চলেছে অনির্বাণ।
ভুলুয়া সেদিন বাজারে এসেই অনির্বাণের দোকানে চলে এল। ইঙ্গিতে জঙ্গলে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। অনির্বাণ কিছু কেনাকাটার অজুহাতে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে দু’জনে মিলে আগামীদিন দুপুরের দিকে জঙ্গলে ঢোকা স্থির করল।
।। সাত।।
“আরে ইয়ে, অনির্বাণবাবু, আপনাকেই খুঁজছিলাম মনে মনে। দেরি করছেন দেখে ভাবছিলাম আসবেন কি না।”
“না, ওই গুছিয়ে-গাছিয়ে বেরোতে বেরোতে একটু… তা খুঁজছিলেন কেন স্যার?”
ডঃ সামন্ত একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন অনির্বাণের কনুইয়ে আঙুলের ডগা ছুঁইয়ে। হলঘরটায় গিজ গিজ করছে লোকজন। পার্টি-নেতা, বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী, দু’চারজন পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের ওপরের দিকের চাকুরে, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কেউই বাদ যাননি তারক হালদারের বাড়িতে আজকের এই পার্টিতে। আজ বাসন্তীপুজোর অষ্টমী। তারকের ইটভাটার আগুনে জল ঢালার দিন। পুরো সিজনের লাভের একটা অংশ এই পার্টিতে ব্যয় করেন তারক আজকের দিনে। লেবার কনট্রাক্টর আর লেবার সর্দারেরও নেমন্তন্ন থাকে প্রতিবছর।
ডঃ সামন্ত একটু যেন অস্থির হয়ে আছেন। কিছু একটা হয়তো অনির্বাণকে বলবেন, আবার কোথাও যেন একটা বাধাও অনুভব করছেন। অনির্বাণ হালকার ওপর তাড়া দিল, “কিছু বলবেন স্যার?”
“হ্যাঁ, না মানে, আপনি, মানে আপনার ওই হাসপাতালের একেবারে নাকের ডগায় ওভাবে প্র্যাকটিস করাটা ঠিক… কী জানেন তো, উপরমহলে খবর চলে যায় ঠিক। সপ্তাহে এক দু’দিন আমি থাকতে পারি না এখানে, তারপর সিএমও অফিস থেকে চাপটাপ এলে তো… বুঝতেই তো পারছেন,” বলেই একটু দূরে স্মিত হেসে কথা বলা একজন স্থানীয় নেতার দিকে এক পলক আড়চোখে তাকিয়েই দৃষ্টিটা আবার ফিরিয়ে আনলেন ডঃ সামন্ত।
অনির্বাণের তা নজর এড়াল না। খানিকটা রাগও হল। তারপর নাকটা চুলকে নিয়ে বলল, “সে ঠিক আছে স্যার। তবে আমি কিন্তু কাউকে ডেকে আনি না। কিছুটা আপনার অনুপস্থিতিতে আর খানিকটা ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে তাড়াতাড়ি পেশেন্টের ব্যবস্থাপত্র করতেই হয়তো আমার কাছে চলে আসে ওরা।”
তারকের বছর ছয়েকের জার্মান শেফার্ডটা ঘুরঘুর করছিল এ জন ও জনের পায়ের ফাঁক গলে এদিক ওদিক। ডঃ সামন্তর পা ঘেঁষে এসে দাঁড়াতেই ছিটকে অনির্বাণের পাশাপাশি সরে এলেন উনি। বিরক্ত মুখে বললেন, “গুচ্ছের টাকা খরচ করে কেন যে লোকে এসব কুকুর বেড়াল…। যাক গে, আর তাই বলে আপনিও এদের আশকারা দিয়ে যাবেন? এ রাইট তো আপনাকে দেয়নি মশাই ড্রাগ কন্ট্রোল! শুনলাম ডাক্তারিটা তো ইদানীং বেশ জাঁকিয়েই করছেন। আমি তবে চেম্বার আর আউটডোরে তালা ঝুলিয়ে দিই, কী বলেন?”
“রাইটটা এই অবধি হাতে নেই স্যার ঠিকই। তবে খুব শিগগিরিই আসতে চলেছে। আর আধা-খ্যাচড়া হসপিটাল ডিউটি সেরে চেম্বার করাটা কি ঠিক আপনার রাইটের মধ্যে পড়ে ডঃ সামন্ত?” বেশ ঝাঁঝিয়েই এবার জবাব দিল অনির্বাণ।
ডঃ সামন্তর মুখখানা থমথম করছে। হয়তো কল্পনাও করেননি যে অনির্বাণ এভাবে একটা সোজাসাপটা জবাব দিয়ে দেবে মুখের ওপর। পাল্টা আক্রমণের জন্য তৈরি হতে না হতেই ভিড়ের ফাঁক গলে দিব্যেন্দু এগিয়ে এসে বলল, “একটা আর্জেন্ট কল আছে স্যার, ডিউটি রুম থেকে। ড্রাইভার এসে বলে গেল। মোবাইলটা নাকি টেবিলেই ফেলে এসেছেন?”
ডঃ সামন্ত একটা বিষাক্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে রওনা দিতেই দিব্যেন্দু খাটো গলায় বলল, “আমি তখন থেকেই নজর করছিলাম। শেষে স্যারের হাত পা ছোঁড়া দেখে এগিয়ে এলাম। প্র্যাকটিসটা তুই ছেড়েই দে অনির্বাণ। মিছিমিছি জলে থেকে কুমিরের সাথে…”
অনির্বাণের সারাটা শরীর অশান্ত হয়ে উঠেছে ভেতরে ভেতরে। এ ব্যাপারে দিব্যেন্দুর সাথে সময় করে আলোচনা করতে হবে একদিন। কিন্তু শেষপর্যন্ত আটকে রাখতে পারল না নিজেকে। দিব্যেন্দুর চোখে চোখ রেখে জিগ্যেস করল, “ডঃ সামন্ত সেদিনের পর আর এ ব্যাপারে বলেছেন নাকি তোকে কিছু?”
দিব্যেন্দু উত্তর দেওয়ার আগেই তারকের ম্যানেজার এসে অনির্বাণকে নজর করে বলল, “দাদাবাবু আপনাকে একটু ওপরে আসতে বললেন।”
“আমায় ডাকলেন, তারকদা? আসব?”
তারক অল্প সময়ের জন্য নিজের রুমে ঢুকেছেন কিছু চেক সই করে নীচে নিয়ে যাওয়ার জন্য। চেক-বই থেকে দৃষ্টি তুলে বললেন, “ও হ্যাঁ, বসো। তোমার চেকটা নিয়ে যাও।”
“এ বাবা, সে তো কাল বা যে কোনও দিন দিলেও হত। নীচে লোকজন সবাইকে ছেড়ে এসে…” জোর করে একটু হাসল অনির্বাণ।
“উঁহু উঁহু, পাওনাগণ্ডাগুলো সঠিক সময়ে মিটিয়ে দিতে পারলেই সম্পক্ক ঠিকঠাক থাকে, বুঝলে? এই নাও তোমার অনারিয়মটা।”
চেকটা হাতে নিয়ে লিখিত অঙ্কটার দিকে চোখ ফেলতেই ভুরু কুঁচকে উঠল অনির্বাণের। এমনিতেই একটু আগে অপমানিত হতে হয়েছে ডাক্তারবাবুর হাতে। মাথাটা গরম হয়ে আছে। এখন আবার এই কীর্তি তারকের। যদিও আশঙ্কা একটা ছিলই বরাবর। এবার কোনও কিছু রাখঢাক না রেখেই শান্ত-কঠিন গলায় অনির্বাণ বলল, “আমি মান্থলি পাঁচ হাজার ডিমান্ড করেছিলাম তারকদা। বারোশো টাকা নয়। প্রত্যেক সপ্তাহে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকাও যদি ধরি তবুও এর চেয়ে অনেক বেশি দাঁড়ায়। আপনি এটা কী দিলেন বলুন তো? মাসে চার থেকে পাঁচদিন, অন্তত হাজার চারেক তো দেবেন!”
তারকের মন ভোলানো হাসিটা এবার মিইয়ে গিয়ে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বললেন, “ও তাই নাকি? তবে তো শহরের বড়ো বড়ো সব ডাক্তার দিয়েই কাজটা করালে পারি। খামোখা তোমাকে কেন অনির্বাণ? ভাবলাম এলাকার ছেলে, এক্সট্রা হিসেবে কিছু পেয়ে গেলে… কোথায় খুশি হবে তা না, দেড় হাত জিহ্বা মেলে দিয়েছ? ছিঃ ছিঃ, এজন্যেই, ঠিক এজন্যেই বাঙালি জাতিটার কোনও ইয়ে হয় না।”
অনির্বাণ উঠে দাঁড়াল। চেকটা টেবিলে রেখে দিয়ে বলল, “ও টাকা আপনি রেখে দিন তারকদা। আগামী মাসে লোকেশদার কাজে লাগবে। শুনলাম তো ওকেও নাকি মোটামুটি প্রস্তাবটা দিয়ে রেখেছেন।”
“কে বলল তোমায় এসব? লোকেশ?” তারক এবার গলা চড়ালেন। প্রাণপণে গাম্ভীর্য বজায় রাখতে গিয়ে কথাগুলো হুঙ্কারের মতো শোনাল।
“এ আপনার চেয়ে আর কে ভালো জানবে তারকদা? আমার হাত খারাপ, লেবাররা খুব একটা খুশি নয় – ওগুলো বলেননি আপনি লোকেশদাকে? লোকেশদা আপনার ওই বারোশো টাকায় মানবে তো? তবে এটা ওকেই দেবেন।”
শব্দের সাথে বিষ মিশিয়ে মনের ঝালটুকু উগড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল অনির্বাণ। পেছন থেকে আবার একটা হুঙ্কার কানে আসছিল, “বড্ড বেড়ে গ্যাছো তুমি। ওষুধ তো বিক্রি করছই, সামন্তর ভাতটা পর্যন্ত মারার তাল করছ। দাঁড়াও। ও দোকান একটা তুড়ি মেরেই আমি…”
তারক হালদারের বাড়ির গেট পেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়তেই লেবার সর্দারের মুখোমুখি হয়ে গেল অনির্বাণ। সর্দার যেন বেশ নিশ্চিন্ত হল ওকে দেখে। বলল, “আরে ডগদর সাহাব, দবাইখানে পে ঢুঁন্ডে এলাম আপকো। ইখানে মিল জায়েঙ্গে সোচ কে সিধা চলে এলাম।”
“কেন, কোনও ওষুধ-বিষুধ চাই নাকি? ভুলুয়া ঠিক আছে তো এখন?”
উজ্জ্বল মুখখানা নিমেষে ছাই হয়ে গেল সর্দারের। কপালের ভাঁজে দুশ্চিন্তা এসে বাসা বেঁধেছে মুহূর্তেই। বলল, “ওউকে লিয়েই তো ইখুন চিন্তা ডগদর। হর রোজ কিমুন যেন হুয়ে যাচ্ছে পোতা হামার। সেদিন ঠিক শামকো লাপাতা হুয়ে গেল, মিলা আখির খুন সে লতপত ঢুঁন্ডতে ঢুঁন্ডতে। অউর ইখুন হোলো আরেক পড়েশানি।”
“কেন সর্দার? কী হয়েছে আবার? ড্রেসিংটা ঠিকঠাক করছো তো?” একরাশ উদ্বেগ ঝরে পড়ল অনির্বাণের গলা দিয়ে।
“নহি নহি, উওহ তো য্যায়সে দেখিয়েছিলেন সিভাবেই কর কে দিচ্ছি। ঘাও ভি ভরে গিছে বহুত। লেকিন ডগদরসাব, ভুলুয়া আজ কোদিন সে সো নহি পা রহা একদম হি।”
“সে কী! কেন, ঘুমোতে পারছে না কেন?”
“কী জানি, সারি রাত বোসে থাকে ঘুটনো কে বীচ মুহ ঘুসাকে বিস্তর পে। অউর ডর ডর কে ইধর উধর আঁখ ঘুমাতা হ্যায় সির্ফ। ঘুম টুটে গেলে পতা চলতা হ্যায় হমে। পুছতা হু তো কুছ নহি বতাতা হ্যায়। সারি সারি রাত জেগে দিনের ওয়ক্ত সোতা রহতা হ্যায়।”
“ও কোথায় এখন? ঘরেই আছে?”
সর্দার কাতর গলায় বলল, “হাঁ জি, বুধুয়া কো পহেরে মে বইঠাকে রেখে আপুনার খোঁজ মে বেরিয়েছি। নহি তো মওকা পেলেই নিকল যাবে চুপকে চুপকে। ইধর মেরি আঁখ লগি নহি, উধর আধি রাত কো চোর কি তরহা নিকল যাতা হ্যায় দো একদিন সে তো। বুড়হে হো গয়ে হম, কব তক পহেরা…”
“আচ্ছা চলো তো দেখি,” বলে পা বাড়িয়েই আবার ঘুরে দাঁড়াল অনির্বাণ। বলল, “ওহো, তোমার তো নেমন্তন্ন রয়েছে নিশ্চয়ই। যাবে না তারকদার ওখানে?”
“নহি নহি, হামি আপুনার তলাশ মে হি এসেছি, দাবৎ পে নহি। মন মে শান্তি নহি হ্যায় তো দাবৎ। সির সে তো বাপ মা কা সায়া উঠ গয়া কব কে হি, অব মেরি পোতে কো অ্যায়সা ভেয়সা কুছ হ গয়া তো…”
আবছা অন্ধকারে কেঁপে কেঁপে উঠল সর্দারের দেহটা কান্না চাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায়।
সর্দারকে পেছনে বসিয়ে ভাটার গেটের সামনে এসে বাইকটা লক করে রেখে ঝুপড়ির উঠোনে পা দিতেই গাটা ছমছম করে উঠল অনির্বাণের। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দরজার সামনে পাশাপাশি দু’টো মার্বেলের গুলির মতো কী যেন জ্বলছে দপদপ করে। সর্দারের হাতে টর্চ ছিল। তাক করে আলো ফেলতেই ভুলুয়ার শরীরটা ঝলসে উঠল। একগাল হেসে তিন লাফে অনির্বাণকে জড়িয়ে ধরল এসে। অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছে নিথর হয়ে। সেই ঝড়জলের রাতে ‘আইডিয়া’টা কুড়িয়ে পাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল মুহূর্তেই। সেই অবিকল জ্বলন্ত দু’টো হলদে চোখ।
।। আট।।
“স্যার, আসব?”
“ওহ, অনির্বাণ! ওরে বাবা! এসো এসো। বসো। কী খবর বলো। কোথায় থাকো-টাকো আজকাল, অ্যাঁ? তোমাদের গ্রুপের বাকিরা তো আসে মাঝেসাঝে, দেখা করে যায়। তুমি তো একেবারে ভুলেই গেলে হে!”
“ঠিক তা নয় স্যার। ওই দোকান-টোকান সামলে আর… তা আপনার শরীর-টরির ভালো তো?”
“তা আছি হে একরকম অনির্বাণ, ভালোই আছি। তারপর বল।”
টেবিলের ও প্রান্তে সামনের দিকে ঝুঁকে খুব মনোযোগ সহকারে অনির্বাণের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রফেসর বিনায়ক রুদ্র। চোখদু’টো গোল গোল হয়ে আছে বিস্ময়ে। বাঁহাতে ধরা পাইপটা পর্যন্ত টানতে ভুলে গেছেন। অনির্বাণ শোনাচ্ছে হাড় হিম করা অদ্ভুত এক বর্তমানের ঘটনা। যার সাথে প্রতিমুহূর্তেই অতীতের কিছু ইতিহাস ধাপে ধাপে যোগ করে নিচ্ছেন বিনায়ক রুদ্র মনে মনে। ইতিহাসের সাথে বর্তমানের যোগসূত্রটা ক্রমশ এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে তিনি চেষ্টা করতে বাধ্য হচ্ছেন একের পর এক ঘটনাবলী সাজিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ মালা তৈরি করতে। হঠাৎ খেয়াল হতেই বললেন, “এ কি, চা যে জুড়িয়ে গেল তোমার অনির্বাণ! খেয়ে নাও আগে।”
কাপটা তুলে নিতে নিতে অনির্বাণ বলল, “আমার সবকিছু ক্যামন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে স্যার। ক’দিন ধরে মাঝে মাঝে এত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছি যে কোথায় আছি, কী করছি তাও ঠাহর করতে সময় নিতে হচ্ছে।”
“সে তো হবেই, সে তো হবেই। তবে কী জানো তো, পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা ঘটে চলেছে। তবে তোমার এই ঘটনার সাথে যে একটা ভূত মানে একটুকরো ইতিহাস জড়িয়ে আছে সেটা জান?”
“না তো! কী ইতিহাস, স্যার?” উৎসুক দৃষ্টি মেলে হাতের কাপটা নামিয়ে রাখল অনির্বাণ।
“তবে যেতে হবে অনেকদূর। মানে সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ের জমিদারি আমলে।”
নিভে যাওয়া পাইপটা আয়েস করে আবার ধরিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে বিনায়ক বলতে লাগলেন, “সংক্ষেপে বলছি শোনো। সালটা চট করে মনে পড়ছে না এখন, বইপত্র ঘাঁটতে হবে। তার আগে বল, ওই গাঁয়ের নাম নিশানপুর কী করে হল জান?”
অনির্বাণ দু’দিকে মাথা নাড়তেই প্রফেসর বলতে শুরু করলেন, “এলাকাটা ছিল জমিদার দীপেন্দ্রনাথ হালদারের খাস তালুক। মানে, এই গ্রামে একটা বিলাসমহল ছিল তার। মাঝে মাঝে এসে থাকতেন, আমোদ আহ্লাদ করতেন। ওই যে নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা এবড়ো-খেবড়ো ঢিবিটা, লক্ষ করেছ বোধহয়। তো এই দীপেন্দ্রনাথ করেছিলেন কী, এই গ্রামের চৌহদ্দির চারকোণায় চারটে মিনারমতো তুলে চারটে তামার পাতলা তেকোনা পতাকা বসিয়ে দিয়েছিলেন মাথায় মাথায়। তাঁর খাস এলাকার সীমানা বন্ধন করেছিলেন এইভাবে কোনও খেয়ালের বশে। সেই থেকে এই এলাকার আলাদা নাম হয় নিশানপুর। এই হচ্ছে নিশানপুরের নামকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
“এবার যাচ্ছি অতীতে। খুব বেশিদিনের কথা নয়। বাহান্ন কি তেপ্পান্ন সাল নাগাদ যদ্দুর মনে পড়ছে। তোমাদের তো জন্মানোর প্রশ্নই নেই, আমিও খুব ছোট তখন। আমার বাবা ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর আর এই নিশানপুরও বাবার কর্মক্ষেত্রের আওতায় ছিল। তাঁর মুখেই শোনা ঘটনাটা। একদিন ভোরবেলা একদল জেলে এক অদ্ভুত কাণ্ড দেখেছিল নিশানপুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণার মিনারটার কাছে যেতেই। কোন এক মহা বলশালী দৈত্য যেন তাণ্ডব চালিয়ে মিনারটা দুরমুশ করে দিয়ে গেছে রাত্তিরে। রাশি রাশি ইট বালি আর পাথরের চাঁই স্তূপ হয়ে পড়ে আছে মিনারের জায়গায় শুধু। এত বড়ো জিনিসটা ধুলিস্যাৎ হয়ে আছে কোন মন্ত্রবলে। চারপাশের আগাছাগুলো কিছু ঝলসে গিয়ে আর কিছু জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে আছে। অথচ আগের রাত্তিরে তিল পরিমাণ ঝড়-তুফান বা আগুন কেউ দেখেনি কোথাও। আর ভূমিকম্প তো দূরে থাক একটা পাতাও নড়েনি। শেষে অনেক ঘেঁটেঘুঁটে তামার পতাকাটা উদ্ধার করা হয়েছিল। আর কিছু ট্রেস পাওয়া যায়নি। তবে আশ্চর্যের বিষয় কী জানো তো, ওই পতাকায় কিছু সংকেতলিপি দেখতে পাওয়া গিয়েছিল যা আজ অবধি মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তামার প্লেটটা খুব সম্ভব এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে থাকার কথা। আমি অনেক পুরনো পত্রপত্রিকা ঘেঁটে ঘটনাটা মোটামুটি এরকম একটা সারসংক্ষেপে দাঁড় করাতে পেরেছি।”
“আশ্চর্য!” নিজের অজান্তেই অস্ফুটে বেরিয়ে এল শব্দটা অনির্বাণের মুখ দিয়ে। তারপর গলাটা ঝেড়ে বলল, “আচ্ছা স্যার, আপনি ঠিক কী ধারণা করছেন? ওই পতাকার লিপিগুলোর সাথে কি আমার ‘আইডিয়া’র লেখাগুলোর মিল থাকতে পারে?”
“অসম্ভবের কিছু নেই অনির্বাণ। থাকাটাই স্বাভাবিক। দু’টো জিনিস একই অঞ্চলে পাওয়া গেছে আর দু’টোর লিপিই দুর্বোধ্য। অবিশ্যি তোমার জিনিসটা আমি দেখিনি এখনও। নিয়ে এলে পারতে সাথে করে।”
“আমি এর মধ্যেই একদিন সময় করে দেখিয়ে যাব স্যার আপনাকে। আসলে জিনিসটা আর আগের শেপে নেই ঠিক। আমি ফিতে দু’টো বাদ দিয়ে মনিটরটা একটা স্টেথোস্কোপে ফিট করে নিয়েছি।” অপরাধীর মতো মুখ করে বলল অনির্বাণ।
“কেন কেন?” প্রায় লাফিয়ে উঠলেন প্রফেসর রুদ্র।
অনির্বাণ আমতা আমতা করে ওর প্র্যাকটিসের কথা বলতেই প্রায় ধমকে উঠলেন বিনায়ক রুদ্র, “এটা তুমি কী করলে অনির্বাণ? আমি মোটেও এটা আশা করিনি তোমার কাছ থেকে। লোভে পড়েছিলে, না? জিনিসটার আর্কিওলজিক্যাল ভ্যালু সম্পর্কে ধারণা আছে তোমার কোনও? না না অনির্বাণ, এটা তুমি মোটেও ভালো করনি।”
চোখ তুলে স্যারের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না অনির্বাণ। তাড়াতাড়ি বলল, “আমি স্যার কাল পরশুর মধ্যেই নিয়ে আসব এটা। আর ফিতেদুটো ইচ্ছে করলেই আবার জুড়ে দেওয়া যাবে।”
“এনো। আচ্ছা, সেই যে দেহাতি ছেলেটা, ভুলু না কী যেন নাম বললে, ও কি…”
প্রফেসর রুদ্রর মুখের কথাটা মুহূর্তে লুফে নিয়ে অনির্বাণ বলল, “হ্যাঁ স্যার ভুলুয়া, আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না প্রথমে। সেদিন রাতে ওদের ঝুপড়ির ঘরে বাতি নিভিয়ে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে বসে আছি আমি আর সর্দার। ভুলুয়া মনের আনন্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঘরময়। একটা ইঁদুর কি টিকটিকিরও উপস্থিতি আর সঠিক অবস্থান বলে দিচ্ছে নির্ভুলভাবে। আমি সাথেসাথেই টর্চ মেরে ভেরিফাই করেছি কয়েকবার। ও এই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পারছে! আর এটা দাঁড়িয়েছে ওর কাল হয়ে এখন। শরীর নরম হয়ে এলেও দিনের বেলা ছাড়া রাতে এখন আর ঘুমুতেই পারছে না বেচারা। চোখ বুজলেই নানান দৃশ্য নাকি ফুটে উঠছে।”
“ভেরি স্ট্রেঞ্জ! মানুষ কী করে রাতের বেলা অন্ধকারের মধ্যেও… আচ্ছা, ও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে? মানে ঠিক কবে থেকে বা কীভাবে…”
“আমি ওই চেষ্টাই করে যাচ্ছিলাম সেই হাসপাতালে ওর ভর্তি হওয়া থেকে। ছাড়া পাওয়ার আগেরদিন ও যা বলল আমায়, আমার তো… এই দেখুন স্যার, এখনও গায়ে ক্যামন কাঁটা দিচ্ছে।”
চেয়ারের হেলান থেকে চট করে শরীরটা উঠিয়ে এনে টেবিলে ঝুঁকে বসলেন বিনায়ক রুদ্র। জিগ্যেস করলেন, “কী, কী বলল ও?”
“ওর নাকি এক বন্ধু আছে জঙ্গলে, ওই ভেঙে পড়া মিনারটার কাছে। আপনার আমার মতো নাকি মানুষ নয় ও। কথাও বলতে পারে না বা যা বলে কিছুই বোঝা যায় না। ওরা দু’জন নাকি আকারে ইঙ্গিতে কথা বলে। ভুলুয়া ওর সাথেই দেখা করতে যায় জঙ্গলে সময়ে অসময়ে। আকার আকৃতি অনেকটা হনুমানের মতো। চেহারাটাও ঠিক আমাদের মতো নয়। অন্ধকারেও খুব ভালো দেখতে পায়।”
“বলো কী! তাহলে সেই ঝড়জলের রাতে তোমার দেখা প্রাণীটা…”
“হ্যাঁ স্যার, এই ভেবেই তো শিউরে উঠছি যখনই ভুলুয়ার কথা মনে পড়ছে আমার। ছুটে এলাম আপনার কাছে।”
“দাঁড়াও দাঁড়াও। ওই প্রাণীটা রাতে দেখতে পায় বলে ভুলুয়াও কেন… উঁহু, কোথাও কিছু একটা সমস্যা বা ঘটনা আছে আড়ালে। বা ছেলেটা কোনও মনগড়া কথা বা মিথ্যে বলছে না তো? মনে রেখো, এই বয়সে ছেলেপুলেরা কিন্তু ফ্যান্টাসি, অ্যাবসার্ড এসব নিয়ে ভাবে বেশি। আর এই ভাবা থেকেই নিজের অজান্তেই মনের গভীরে বিভিন্ন অসম্ভব গালগল্প দানা বাঁধে। আচ্ছা এক কাজ করো তো, ছেলেটাকে একটিবার নিয়ে এসো তো আমার কাছে।”
“নিশ্চয়ই আনব স্যার। তবে আমি ভুলুয়ার মুখের কথায় ভরসা না রেখে ওর সাথে জঙ্গলে গিয়েছিলাম কয়েকদিন পর এক বিকেলে।”
“তাই নাকি! দেখেছিলে ওটাকে?” এবার টানটান হয়ে বসলেন প্রফেসর।
“না স্যার। ভুলুয়া অনেক ডাকাডাকি করল। কোনও সাড়া না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি আর অপেক্ষা করে ফিরে এসেছিলাম। তবে একটা জিনিস দেখে কিছু একটার উপস্থিতি কিন্তু আমি টের পেয়েছিলাম।”
“কী সেটা?”
“ভুলুয়া ইদানিং প্রচুর ফলমূল কিনতে শুরু করে দিয়েছিল। বলল, ওর বন্ধু নাকি ফলমূল ছাড়া কিছুই খায় না। ওর জন্যেই ওগুলো কিনে এনে তুলে দেয় বন্ধুর হাতে। তা ওই ফলমূলের কিছু খোসা আমায় দেখিয়েছিল ভুলুয়া। শুনলে আশ্চর্য হবেন স্যার, দেখলে মনে হবে গোটা ফলটাই পড়ে আছে মাটিতে, সে আপেল কমলাই বলুন আর কলাই বলুন। কিন্তু হাতে নিয়ে দেখলাম ভেতরটা একদম ফাঁপা। খোসাটা অবিকল রেখে দিয়ে মাত্র ছোট্ট একটা ছিদ্রের সাহায্যে কে যেন কোন মন্ত্রবলে ভেতরের শাঁস বা জিনিসটা বের করে নিয়েছে।”
ঘর কাঁপিয়ে এবার হেসে উঠলেন প্রফেসর। কোনওমতে হাসির দমক থামিয়ে বললেন, “আরে সে তোমার ভুলুয়ারই কারসাজি দ্যাখো গে।”
চিন্তিত মুখে অনির্বাণ সাথে সাথেই বলল, “না স্যার, আমিও তাই সন্দেহ করেছিলাম প্রথমে। কিন্তু ফলগুলোর যা অবস্থা দেখলাম তাতে ওটা ভুলুয়ার কাজ বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আর তাছাড়া ওকে আমি অনেক জেরা করেছি বিভিন্নভাবে। মনে হচ্ছে ভুলুয়া সত্যি কথাই বলছে।”
ফের নিভে যাওয়া পাইপটা আবার ধরিয়ে গম্ভীর মুখে চোখ বুজে রইলেন প্রফেসর বিনায়ক রুদ্র।
।। নয়।।
ভুলুয়াকে সঙ্গে করে আজ ফের সন্ধের পর জঙ্গলে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে সেদিনের জায়গাটায় এসে দাঁড়াল অনির্বাণ। দু’দিন আগে প্রফেসরের সাথে কথা বলার পর অনির্বাণের উৎসাহটা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ভুলুয়ার বন্ধু জঙ্গলের সেই অদ্ভুত প্রাণীটাকে একটিবারের জন্যে দেখতেই হবে যেভাবেই হোক। এ ধরনের গল্পগাছা সে বইয়ে পড়েছে, সিনেমায় দেখেছে। কিন্তু বাস্তবে সত্যি সত্যিই এমন ধরনের প্রাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যেতে পারে এ ছিল তার ধারণার বাইরে। নিশানপুরের জঙ্গলে জমিদার দীপেন্দ্রনাথের তৈরি শেষ নিদর্শন হিসেবে মিনারটার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল দু’জনে। কালের দাপটে বাকি তিনটে মিনার আগেই মাটির সাথে মিশে গেছে। ন্যূনতম ধ্বংসাবশেষও নেই এখন আর। এর মধ্যে একটা মিনার তো রহস্যজনক ইতিহাসও সৃষ্টি করেছিল। প্রফেসরের কথাগুলো একে একে আরেকবার মনে পড়ল অনির্বাণের। সেদিন দেখা হয়নি ভুলুয়ার বন্ধুর সাথে। সাথে অপরিচিত লোক দেখে বোধহয় ভুলুয়ার সামনে আসেনি জীবটা। আজও আসবে কি না কে জানে।
ফলমূলে ভর্তি হাতের প্যাকেটটা উঁচু করে ধরে চাপাস্বরে ‘দোস্ত দোস্ত’ বলে একটানা ডেকে চলেছে ভুলুয়া বন্ধুকে। দোস্তের এখনও পাত্তা নেই। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর অনির্বাণ হঠাৎ টের পেল তার ঠিক পেছনে কী যেন একটা এসে উপস্থিত হয়েছে। হালকা খসখস শব্দে মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো আগন্তুকের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল কয়েক সেকেন্ড আগে থেকেই। অনির্বাণের দৃষ্টি অনুসরণ করে ভুলুয়া হঠাৎ পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়েই আতঙ্কে নীল হয়ে গেল যেন। আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে ছেলেটা চিৎকার করার। কিন্তু ঠোঁটদু’টো একেকটা বিশমণি পাথর হয়ে আছে। শেষে হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণস্বর আচমকা ছিটকে এল ওর গলা থেকে, “ভাগো, ভাগো জলদি। শের আ গয়া, চিতা আ গয়া…”
পরিস্থিতিটা ঠিক করে বুঝে ওঠার আগেই ক্ষিপ্রগতিতে যেন একটা ছোটখাটো বাঘ লাফিয়ে পড়ল অনির্বাণের ঘাড়ে পিঠে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল হুটোপাটি, ধস্তাধস্তি। অবিরাম গ্ররর গ্রররর শব্দে দানবীয় হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে জানোয়ারটা আঁচড়ে খামচে ফালা ফালা করে দিচ্ছে ওর নাক মুখ গাল কপাল। ধস্তাধস্তির সময় অনির্বাণ টের পেল কপাল আর গাল থেকে রক্ত বেয়ে এসে ওর চোখেমুখে ঢুকে যাচ্ছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে একটু একটু করে। মুখে নোনতা স্বাদ। পাশে ভুলুয়া কাতরাচ্ছে পড়ে পড়ে। সারা শরীরের শক্তি এক করেও জানোয়ারটাকে বাধা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সুতীক্ষ্ণ দাঁত খিঁচিয়ে অদম্য আক্রোশে পালা করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দু’জনের ওপর বারবার। অন্ধকারে নিজের অবয়বটাকেও ঠিক করে যাচাই করে নিতে সুযোগ দিচ্ছে না কাউকে।
এরই মধ্যে যেন ভোজবাজি ঘটে গেল একটা। কোন এক অদৃশ্য শক্তি বলে যেন প্রায় দশ বারো হাত দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ল হঠাৎ জন্তুটা। এই আকস্মিক ধাক্কায় একটুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা মেরে পড়ে থেকেই আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য লাফ দিতেই অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে ফেলল নিজের অজান্তেই। আবার দু’মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সুরক্ষিত অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকিয়ে রক্ত হিম হয়ে এল তার। কয়েক হাত সামনেই দুই শত্রুতে চলছে যুযুধান লড়াই। কেউ কারও চেয়ে কম নয়। হাতের চেটো আর জামার খুঁট দিয়ে চোখের রক্ত খানিকটা পরিষ্কার করে নিতেই অনির্বাণ আবছা দেখতে পেল যে জন্তুটাকে বাঘ বলে চিৎকার করছিল ভুলুয়া সেটা আসলে একটা বিদেশি বড়ো জাতের কুকুর। মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আরেকটা প্রাণীর সাথে যেটাকে না মানুষ বলা চলে না বানর বা শিম্পাঞ্জি। শারীরিক গঠন মানুষের মতোই কিন্তু যে জিনিসটা মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়ার পক্ষে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় তা হল সেটার মস্ত লম্বা এক লেজ। দু’পেয়ে জীবটা এই লম্বা লেজের প্যাঁচেই চারপেয়েটাকে কাবু করে ফেলল একসময়। অদ্ভুত একটা লেজ। আগায় ঠিক মানুষের হাতের মতো পাঁচটা আঙুলও রয়েছে। দৈর্ঘ্যেও সাধারণ জীবজন্তুর লেজের তুলনায় অনেকটাই লম্বা। কায়দায় পেয়ে লেজের আঙুলগুলো দিয়ে কুকুরটার টুঁটি টিপে ধরে নিজে অনেক দূরে সরে রইল জীবটা। অল্পক্ষণের মধ্যেই সারাদেহ নিস্তেজ হতে হতে ছটফট করতে লাগল কুকুরটা। তবে দম ছাড়েনি তখনও। কোনওমতে সামনের পাদু’টো দিয়ে আঁচড়ে শত্রুর লেজের আঙুলের ফাঁস ছাড়িয়ে আবার আক্রমণে উদ্যত হতেই অনেকটা দূর থেকে ভেসে এল এক তীক্ষ্ণ শিসের সুর। জলন্ত চোখে একটা হিংস্র দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে কুকুরটা রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে গেল। শিসের আওয়াজটা যেন চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেল ওটাকে। অনির্বাণ নিশ্চিত হয়ে গেল, এই অচেনা জীবটা যেটা ওদের জীবন বাঁচিয়েছে ভুলুয়ার জঙ্গলের দোস্ত ছাড়া আর কেউ নয়। ও হাঁ করে তাকিয়েই রইল ভুলুয়ার দোস্তের দিকে নির্নিমেষ।
সম্বিৎ ফিরে পেল পিঠের দিকে মৃদু ধাক্কায়। লক্ষ করল অল্প দূরে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা ভুলুয়া কখন এসে তাকে ঠেলছে। ভুলুয়ার চোখেমুখে এখনও আতঙ্ক লেগে রয়েছে। অনির্বাণ হাতড়ে দেখল চেন আঁটা পকেটে টর্চটা জায়গাতেই আছে। বের করে চারদিকে আলো ফেলতেই দেখা গেল ভুলুয়ার দোস্ত এদিক ওদিক ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে থাকা ফলমূলগুলো কুড়োচ্ছে ক্ষিপ্রহাতে। লেজটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। হয়তো গুটিয়ে নিয়েছে। ভীষণ অবাক হল অনির্বাণ। একটা হিংস্র জানোয়ারের সাথে এত ধস্তাধস্তি গেল, অথচ সারা গায়ে একটাও আঁচড় বা কামড়ের দাগ নেই! প্রাণীটার শরীরে কি তবে রক্তই নেই! ও কি সত্যি সত্যিই অন্য গ্রহ থেকে নেমে আসা কোনও এলিয়েন! অসাবধানতায় মুখের ওপর এলফালি আলো পড়তেই চোখদু’টো নিমেষে ঝলসে উঠল প্রাণীটার। সেই গা হিম করা হলুদ চোখ। চকিতে মনে পড়ে গেল ঝড়জলের সেই রাতের কথা, যেদিন প্রথম দেখেছিল একে। শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি টর্চটা নামিয়ে রেখে দিল ও।
ফলগুলো একপাশে জড়ো করে অনির্বাণের সামনে এসে বসল ভুলুয়ার দোস্ত এবার। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল চোখে চোখ রেখে। এতক্ষণ ধস্তাধস্তির পরও যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল শরীরে এখন যেন তাও রইল না আর অনির্বাণের। মাথাটা প্রথমে ঝিম ধরে গিয়ে আস্তে আস্তে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গেল ওর চোখেমুখে। নিজে থেকে একচুল নড়ার ক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। অনেক কষ্টে নার্ভগুলোকে সজাগ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। ঝিম ধরা অনুভূতি নিয়েই টের পেল একটা ভারি স্যুট ঢেকে রেখেছে জীবটার আপাদমস্তক। থার্মাল স্যুট যেমন হয়। ভুলুয়ার দোস্ত ডানহাতের তর্জনীটা একবার ওর বাঁহাতের কবজিতে ছুঁইয়ে পরক্ষণেই আবার তাক করল অনির্বাণের দিকে। জীবটার সাঙ্কেতিক জিজ্ঞাসা বুঝতে অসুবিধে হল না ওর। সামনে পেছনে দু’বার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই জীবটার সারামুখে খুশির অভিব্যক্তি ফুটে উঠল সাথেসাথে। এবার ভুলুয়ার দোস্ত একটা হাত বাড়িয়ে অনির্বাণের একটা হাত ধরতেই সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন আচমকা ওর। রাতের জঙ্গলের অন্ধকার যেন আস্তে আস্তে বিদায় নিতে শুরু করল। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল চোখের দৃষ্টি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল এই আশ্চর্য প্রাণীটার দিকে ও। চোখদু’টো অসম্ভব উজ্জ্বল, নাকের কোনও অস্তিত্বই নেই। বদলে দু’টো ছিদ্র আছে কেবল পাশাপাশি। তাও ভেতর থেকে প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো বন্ধ করে নিতে পারে। মুখের জায়গাটায় একটা অক্সিজেন মাস্কের মতো দেখা যাচ্ছে, সে থেকে ঝুলছে একটা সূচালো নল। মাথায় চুলের লেশমাত্রও নেই।
হাতটা ধরে আলতো করে টান দিতেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো পেছনে পেছনে হেঁটে চলল অনির্বাণ আর ভুলুয়া প্রাণীটার। একটু পরেই দাঁড়িয়ে থাকা মিনারটা থেকে কিছুদূরে একটা মোটা গাছের গুঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তিনজন। প্রাণীটা ঝুঁকে মাটিতে পড়ে থাকা লতাপাতা সরাতে লাগল দু’হাত আর লেজ দিয়ে। লেজটা আবার বেরিয়ে এসেছে কখন। হাতের চেয়ে লেজের আঙুলগুলোর ক্ষিপ্রতা অনেক বেশি। অনির্বাণের মাথাটা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে এসেছে। লতাপাতা সরানোর পর যখন গর্তের দেখা মিলল তখন ও বুঝে গেল যে এই পথেই কোনও এক গুহায় ঢুকতে চলেছে ওরা। হলও তাই। নাতিদীর্ঘ অন্ধকারাচ্ছন্ন আর এবড়োখেবড়ো একটা রাস্তা পেরিয়ে চারদিকে গোল করে ইট গাঁথা একটা বেশ বড়সড় গুহায় এসে দাঁড়াল সবাই। একে রাত তায় আবার গুহা, কিন্তু অনির্বাণ সবকিছু দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ভুলুয়া আর ওর দোস্তের চোখের দিকে পরপর তাকিয়ে যাচাই করে নিল অনির্বাণ। না, এখন দুজনের মধ্যে কারোরই চোখে হলুদ আলো জ্বলছে না। তার মানে ওর চোখও… তবে সেও কি এখন থেকে ভুলুয়ার মতো অন্ধকারে দেখতে পাবে? একটা অজানা আতঙ্ক আর উল্লাস মিশে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি হল ওর মনে। দেখল, সামনেই দেওয়ালের পাশে অবিকল দেখতে আরেকটা প্রাণী শুয়ে আছে। পরনে সেই থার্মাল স্যুটের মতো আপাদমস্তক ঢাকা জ্যাকেট। ভুলুয়ার দোস্তের মতোই শুধু চোখ নাক মুখ আর হাত পায়ের আঙুলগুলো খোলা। তবে শারীরিক ভাষা অসুস্থতার ইঙ্গিত করছে যেন।
ভুলুয়ার দোস্ত এগিয়ে গিয়ে ওর সঙ্গীর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে ফিরে এল। অনির্বাণের সামনে দাঁড়িয়ে করুণ চোখে তাকিয়ে কী যেন ইশারায় বলতে শুরু করল। অনির্বাণ বুঝল ওর কুড়িয়ে পাওয়া ‘আইডিয়া’টা ফেরত চাইছে জীবটা। হয়তো সঙ্গীর চিকিৎসার প্রয়োজনে। ও ঠোঁট কামড়ে ধরে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। শেষে ইশারায় প্রতিশ্রুতি দিল যন্ত্রটা ফিরিয়ে দেওয়ার।
।। দশ।।
রোগীবাড়ি থেকে ফিরে দোকানে আসতেই অনির্বাণ দেখল দিব্যেন্দু বসে আছে টুলে। ঘণ্টা দুয়েক আগে একটা স্যালাইন লাগিয়ে এসেছিল রোগীকে। অনেক বয়স হয়ে গেছে, মরণযাত্রার পথিক। ডাক্তাররাও জবাব দিয়ে দিয়েছেন। মাঝেমাঝে দুয়েকটা স্যালাইন পুশ করতে হয় অনির্বাণকে গিয়ে গিয়ে। এখন খুলে দিয়ে এসেছে। দিব্যেন্দু ভনিতায় না গিয়ে সরাসরি বলল, “সেদিন কি খুব বেশি কথা কাটাকাটি হয়েছিল রে স্যারের সাথে তোর, অনি?”
“কেন বল তো?” অনির্বাণের চোখমুখ মুহূর্তেই সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল।
“না, আজ সকাল থেকেই তোকে খবর দিতে বলছেন অনবরত। যা, গিয়ে দেখা করে আয় একটু। আর শোন, ওসব ঝুট ঝামেলা আর বাড়াস-টাড়াস না ভাই। চল, দেখ গিয়ে কেন খোঁজ করছেন। ও হ্যাঁ, তারক হালদার এসেছিলেন তোর খোঁজে। দেরি করছিস দেখে বেরিয়ে গেলেন।”
চিন্তার ভাঁজ পড়ল অনির্বাণের কপালে। চোখমুখ কুঁচকে জিগ্যেস করল, “হঠাৎ? বলেছে কিছু?”
“না, তবে তুই নাকি ইদানীং ভাটায় আর ভিজিটে যাচ্ছিস না? অনুযোগ করে গেলেন।”
কথা শেষ করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখা মোবাইলটার দিকে থম মেরে তাকিয়েছিলেন ডাঃ সামন্ত। স্ত্রী ফোন করেছিলেন। ছেলেটার আবার ব্যথা বেড়েছে। ঘাড়ের লাম্পগুলোও বড়ো হতে শুরু করেছে আবার। ছটফট করছে বিছানায় পড়ে। স্থিরভাবে কিচ্ছু সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ডাঃ সামন্ত। একটাই মাত্র সন্তান, তাও ‘নিউরোব্লাস্টোমা’-তে ভুগছে। বাচ্চাদের একটা রেয়ার ডিজিজ। এটা এমন একটা রোগ যে আজও এর নির্দিষ্ট কোনও কারণ খুঁজে উঠতে পারেননি কেউ। সুতরাং চিকিৎসাও ক্যানসারের সেই পুরনো থিওরি অনুযায়ীই করা হচ্ছে। সেই কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইম্যুনোথেরাপি এসবই। ছেলের ক্যানসারটা ‘স্টেজ এম’-এ আছে ডাঃ সামন্তর, যখন তখন একটা খারাপ খবর আসতেই পারে। এক কোনও মিরাকল ছাড়া আর কোনও আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না উনি। আজকাল বাড়ি থেকে ফোন এলেই আতঙ্কে নীল হয়ে ওঠেন ডাক্তারবাবু।
অনির্বাণের সাথে তার কথা কাটাকাটি চলছে খানিকক্ষণ ধরেই। হাসপাতালে না পেয়ে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারে দেখা করতে এসেছে অনির্বাণ।
“আপনি বুঝতে পারছেন না কেন অনির্বাণবাবু, আমারও তো ওপরে লোক রয়েছে, জবাবদিহি করতে হয়!” অধৈর্য হয়ে উঠে পড়লেন ডঃ সামন্ত চেয়ার ছেড়ে।
“আমি কিন্তু কোনও অপরাধ করিনি স্যার। আর যদি করেই থাকি নিজের অজান্তে তবে…’’
“আহা সে কথা হচ্ছে না। আপনি অপরাধ করছেন কি না সেটা আমার বিষয় নয়, আর করে থাকলে প্রমাণও করা যাবে না। আপনি তো আর প্রেসক্রিপশন প্যাডে লিখে চিকিৎসা করেন না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়। সিএমও শোকজ পাঠিয়েছেন। আমি নাকি ডিউটি আওয়ারে থাকছি না ঠিকমতো। থাকি না আমি? আপনিই বলুন। আচ্ছা, সপ্তাহে এক দু’দিনও কি ফ্যামেলির সাথে কাটাতে পারব না? পারলেন আমার এই ক্ষতিটা করতে?”
“মানে? কী বলছেন আপনি? আমি আপনার কী ক্ষতি করলাম?” চমকে উঠল অনির্বাণ।
ডঃ সামন্ত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “সত্যিই বুঝতে পারছেন না? নাকি ভান করছেন না বোঝার? আপনাদের কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ডেপুটেশন দ্যায়নি সিএমওর কাছে গত মঙ্গলবারে?”
“ওহ, তাই বলুন। দিয়েছিল, কিন্তু আমি থাকতে পারিনি।”
“সে কি মশাই! সারাদিন দোকান বন্ধ করে কোথায় ছিলেন তবে? আপনি ছিলেন না বললে বিশ্বাস করা যায়?”
“আমায় একটা বিশেষ কাজে বিশেষ জায়গায় যেতে হয়েছিল ডঃ সামন্ত। ফিরতে রাত হয়েছিল,” অনির্বাণের দৃঢ় গলার স্বরে একটু থমকে গেলেন ডঃ সামন্ত।
সত্যিই সেদিন ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল অনির্বাণের। ভুলুয়াকে সঙ্গে করে প্রফেসর রুদ্রর বাড়িতে গিয়েছিল ও। উনি ভুলুয়ার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আর সেই স্টেথোস্কোপটাও নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে করে। স্যার ক’দিন নিজের কাছে রাখতে চান ওটা। কথাবার্তা শেষ হতে হতে রাত এগারোটা প্রায়। ফিরতে হবে অনেকটা পথ। সাথে ভুলুয়া থাকায় একটু ভয় ভয়ও করছিল। আজকাল ভুলুয়ার সাথে একা থাকলেই গাটা একটু ছমছম করে ওর। হয়তো ভুলুয়া আগের মতোই তাকাল বা আগের মতোই জড়িয়ে ধরল, অনির্বাণ কিন্তু আগের মতো আর স্বভাবিক হতে পারে না, অস্বস্তি একটা থেকেই যায়। সেদিন জঙ্গলের গুহা থেকে বেরিয়েই ভুলুয়ার দোস্তটা চোখদু’টোতে আচমকা হাত বুলিয়ে দিয়েছিল অনির্বাণের। চোখ খুলতেই চারদিকে আবার নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। খানিকটা রাগও হয়েছিল ওই প্রাণীটার ওপর তার। এই বিশেষ শক্তিটা ওর চোখে থাকলে কী এমন ক্ষতি হত জীবটার!
একরাশ অস্বস্তি নিয়েই রাত হয়ে যাওয়াতে ও নিজের বাড়িতেই নিয়ে এসেছিল ভুলুয়াকে সেদিন প্রফেসরের বাড়ি থেকে ফেরার সময়। অনেকটা ঘুরতি পথ ঠেঙিয়ে ইটভাটাতে দাদুর কাছে আর ফেরত দিয়ে আসেনি। খেয়েদেয়ে নিজের ঘরেই বিছানা পেতে দিল ভুলুয়াকে। এটা ওটা কথার পর ভুলুয়াকে সেদিন পানিঘাটের পাশে আধমরা অবস্থায় পাওয়ার কথাটা পাড়ল ও। প্রফেসর অনেক চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে মুখ খোলাতে পারেননি ভুলুয়ার। এবার ডগদর বন্ধুর মুখে প্রশ্নটা ফের শুনতেই ভুলুয়ার চোখদু’টো কেমন যেন হয়ে গেল আস্তে আস্তে। একটা ভয় এসে গ্রাস করল ওকে। অনেকক্ষণ থম মেরে থেকে তারপর বলল, “হামি তো জঙ্গল সে ফিরছিলাম। উওহ টুটা হুয়া মিনার কে পাস সে। থোড়ি দের বাদ একঠো খসখসওয়া আওয়াজ কান মে এল। বহুত সাবধানি সে কোই সুখা পত্তা মচল নে কা জ্যায়সা। হামি গর্দন ঘুমানে সে পহেলে হি অন্ধের সে নিকল কে এক চিতা উছল কে গিরা মেরে উপর। ফির মুঝে… ম্যায় তো চিল্লানা ভি ভুল গয়া থা।”
অনির্বাণ চোখ গোল্লা গোল্লা করে একটা ঢোঁক গিলে জিগ্যেস করল, “তারপর?”
“তারপর কোই এক পেড় কে পিছে সে ‘মাগো মাগো’ বোলকে চিল্লায়া অউর উওহ চিতা ফির একবার মুঝে দাঁত দিখাকে চলা গয়া। আঁখে জ্বল রহা থা উসকা।”
“চিতা! কিন্তু… তুই ঠিক দেখেছিলি ভুলুয়া?”
“হ্যাঁ, বিলকুল। গলে মে এক বেল্ট জ্যায়সা ভি কুছ বন্ধা হুয়া থা শায়দ।”
“তারপর তুই পানিঘাটের কাছে এসে পড়ে গেলি?”
“নহি, ম্যায় খুদ নহি আয়া। উওহ চিতা চলে যানে কে বাদ ম্যায় বহুত কোশিশ সে ভি উঠ নহি পা রহা থা। থোড়ি দূর ফির সে উওহ চিতা গুররা রহা থা। ইস কে বাদ দোস্ত দওড়কে আয়া অউর মুঝে জকর লিয়া। ম্যায়নে দেখা উস কে হাত পয়ের মে খুন লগা হুয়া হ্যায়। মুঝে উঠাকে পানিঘাট কে পাস লে গয়ে অউর ইস কে বাদ মুঝে কুছ পতা নহি। বহুত নিন্দ আ রহি থি তব মুঝে।”
।। এগারো।।
অনির্বাণ তখন খবর দেখছিল দোকানে বসে। আড়াইটে বাজে প্রায়। উঠি উঠি করেও টিফিনের বাক্সটায় গিয়ে হাত লাগাতে দেরি করছে। এই সময়টা পুরোটাই ফাঁকা থাকে দোকান। এমন সময় একজন লম্বা চওড়ামতো লোক এসে দাঁড়ালেন সামনে। একপলক তাকিয়ে আবার টিভির পর্দায় চোখ রেখেই হাতটা বাড়িয়ে দিল অনির্বাণ, “দিন।”
আগন্তুকের তরফে কোনও সাড়া না পেয়ে এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু অধৈর্য হল, “কই, দিন না প্রেসক্রিপশনটা!”
পরিবর্তে লোকটা একটা কার্ড ধরিয়ে দিলেন পকেট থেকে বের করে। ওতে এক নজর দৃষ্টি ফেলেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল অনির্বাণ। বিস্ময়ে চোখ গোল গোল করে জিগ্যেস করল, “আপনি, আপনি ডিটেকটিভ?”
মুচকি হাসলেন আগন্তুক, “উম… ঠিক জানি না, তবে কোনও স্বাভাবিক অস্বাভাবিক সবকিছুর পেছনেই আসল কারণটা খুঁজে বেড়াই। তাতে অনেক সময় কিছু রহস্যজনক তথ্য বেরিয়েও পড়ে। আমি অভিমন্যু, অভিমন্যু রক্ষিত। নমস্কার।”
অনির্বাণও হাতদুটো জড়ো করে বুকের কাছে তুলে বলল, “আমি অনির্বাণ দত্ত।”
“সে অবশ্য জানি অনির্বাণবাবু। প্রফেসর বিনায়ক রুদ্র নিশ্চয়ই আপনাকে বলে থাকবেন আমার আসার কথা। ভেতরে আসতে পারি তো?”
“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আসুন।”
দিব্যেন্দু তখন খেয়ে দেয়ে আবার হাসপাতালে ফেরার উদ্যোগ করছিল। লাঞ্চ আওয়ার শেষের পথে। সারাদিনের টেস্টের অ্যানালিসিসগুলো ল্যাবের ফর্মাতে লিখে ডেসপ্যাচ কাউন্টারে পাঠিয়ে দিতে হবে বিকেলের মধ্যেই। এমন সময় দরজায় খটখট আওয়াজ করে ঘরে এসে ঢুকলেন অভিমন্যু।
একগাল হেসে এগিয়ে এল দিব্যেন্দু, “আরে আসুন আসুন। মিঃ রক্ষিত তো?”
অভিমন্যু পাল্টা হেসে ঘাড়টা সামান্য কাত করতেই দিব্যেন্দু বলে উঠল, “অনি মানে অনির্বাণ একটু আগেই ফোন করল। বলল, আপনি ডঃ সামন্তর সাথে দেখা করতে চান।”
কথার ফাঁকে রান্নাঘর থেকে কাজের মেয়ে মালতী এসে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “বাসনকোসন মেজে গেছি দাদা। রান্না যা আছে আজ বোধহয় আর বিকেলে রাঁধতে হবে না।”
অভিমন্যু কথার খেই ধরে বললেন, “হ্যাঁ, আসলে সরাসরিই চলে যেতে পারতাম। তবে লাঞ্চ আওয়ার, কোথায় আছেন না আছেন, তাই আপনার শরণাপন্ন না হয়ে পারলাম না। আছেন তো উনি কোয়ার্টারে?”
“আছেন। আপনি বসুন না প্লিজ! আসলে আমি ওরকম সরাসরি কোনও ডিটেকটিভকে আজ অবধি চোখের সামনে… তাছাড়া সাধারণ একটা স্টেথোস্কোপ চুরি যাওয়া নিয়ে আপনাকে ডেকে আনা… কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু ভীষণ।”
“আসলে চুরিটা হয়তো খুবই সাধারণ। কিন্তু আরেকজনের রেখে যাওয়া জিনিস প্রফেসর রুদ্রর কাছ থেকে চুরি যাওয়াটা উনি মেনে নিতে পারছেন না। প্রেস্টিজে লেগেছে ভীষণ। আর আমি যেহেতু ওনার বাড়ির ঠিক তিনটে বাড়ি পরেই থাকি, তাই আমাকেই দায়িত্বটা দিলেন খুঁজে বের করার। আমারও একটা দুর্বলতা আছে ওই জ্ঞানী বৃদ্ধটির ওপর। এই হচ্ছে আসল ঘটনা।”
ডঃ সামন্ত চেম্বারেই ছিলেন। দিব্যেন্দু অভিমন্যুকে সঙ্গে করে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেল। হাসিমুখে সামনের চেয়ারখানা অভিমন্যুকে ইশারা করলেও মনে মনে যে খুব একটা খুশি হননি তা টের পেতে কষ্ট হয়নি মোটেও অভিমন্যুর।
“কিছু মনে করবেন না প্লিজ, আমার সাথে আপনার ঠিক কী দরকার থাকতে পারে মাথায় ঢুকছে না।”
অভিমন্যু একটু গুছিয়ে বসে একটু মুচকি হেসে জবাব দিলেন, “তেমন কিছু নয় ডঃ সামন্ত। কিছু জানতে এসেছি, কিছু শিখতে এসেছি মাত্র।”
এবার একটু নড়েচড়ে বসে অভিমন্যু জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা ডঃ সামন্ত, একটা স্টেথোস্কোপে কী এমন স্পেসিফিকেশন থাকে যে সেটা চুরি করতে হয়?”
“তা আমি কী করে জানব চোরের মনের কথা, কী মুশকিল!” এবার প্রকাশ্যে বিরক্ত হলেন ডঃ সামন্ত।
“আপনি প্রফেসর বিনায়ক রুদ্রর আলমারি থেকে একটা স্টেথোস্কোপের চুরি যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন আশা করছি।”
“হ্যাঁ, শুনেছি। দিব্যেন্দু বলেছে।”
“ওতে তো ইয়ারটিপস, টিউব, স্টেম, বেল, ড্রাম, ডায়াফ্রাম এসব ছাড়া তো আর বিশেষ কিছু থাকে না বলে জানি। আর দুই আড়াইশো টাকার জিনিসটা খুব মূল্যবান কিছুও নয়। আপনি কী বলেন?”
“তা ঠিক। কিন্তু এই চুরির সাথে আমার কী সম্পর্ক? কী আশ্চর্য!”
“চুরির ঠিক আগেরদিন রাতে আপনি প্রফেসরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন কি ডঃ সামন্ত?”
“হ্যাঁ, তা… ওই তারক হালদারের পাল্লায় পড়ে। কোয়ার্টারে এসে প্রায় জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন একটু হাওয়া খেতে বেরোবেন বলে। সোজা গিয়ে থামলেন প্রফেসর রুদ্রর বাড়ির সামনে। আমি জানতাম না উনি ওখানে যাবেন,” একটু থতমত খেয়ে কথাগুলো একশ্বাসে বলে দম নিলেন ডঃ সামন্ত।
“কেন গিয়েছিলেন?”
“সে আমি জানি না মিঃ রক্ষিত। আমায় বসিয়ে রেখে দু’জন প্রফেসরের স্টাডি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে…”
কথাটা যেন লুফে নিলেন অভিমন্যু। পলকেই পাল্টা জিগ্যেস করলেন, “তবে?”
“তবে, তারকবাবুর মুখটা আগে যেমন থমথমে দেখাচ্ছিল সেটা বেরোবার মুখে ছিল না। বরং বেশ হাসিখুসিই দেখাচ্ছিল।”
হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে চেয়ার থেকে ওঠতে ওঠতে অভিমন্যু বললেন, “থ্যাঙ্কস ডঃ সামন্ত! আসব এখন।”
মোবাইলে কাকে একটা ফোন করে নিয়ে ড্রাইভারকে তারক হালদারের বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছতে নির্দেশ দিলেন অভিমন্যু।
তারক বাড়িতেই ছিলেন। বেল টিপতেই দরজা খুলে ভেতরে আপ্যায়ন করে নিয়ে গেলেন অভিমন্যুকে। বললেন, “নিশ্চয়ই ওই স্টেথোস্কোপের ব্যাপারটার কাজেই এসেছেন, নাকি?”
“হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।”
“বলুন, কী জানতে চান। আমি অবশ্য এ ওর মুখ থেকে শুনে শুনেই যতটুকু জানি। অবশ্য প্রফেসর রুদ্রকেও ফোন করেছিলাম একবার। ধরেননি।”
“তাই! তা এ ও কারা কারা?”
তারক বিগলিত হেসে বললেন, “ওই ডঃ সামন্ত, আর ফার্মাসিস্ট দিব্যেন্দুবাবুর সাথেও দেখা হয়েছিল সকালে।”
তারকের কথা শুনতে শুনতেই হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন অভিমন্যু, “বাহ! আপনার জার্মান শেফার্ডটা তো বেশ হয়েছে দেখতে। কী নাম ওর?”
“ওহ, মার্কোর কথা বলছেন? হি ইজ জেম অফ আ বয়!”
“ওকে। তো মিঃ হালদার, সেদিন হঠাৎ প্রফেসর বিনায়ক রুদ্রর ওখানে কেন গেলেন জানতে পারি কি? ওনার আলমারি থেকে স্টেথোস্কোপ চুরির ব্যাপারে আমায় নিযুক্ত করেছেন তিনি। নইলে আপনি কোথায় যাবেন, কী করবেন সে তো সম্পূর্ণই আপনার ব্যক্তিগত। আমায় জবাবদিহি করতে যাবেন কেন?”
“দেখুন মিঃ রক্ষিত, আপনি যেহেতু কেসটা ইনভেস্টিগেট করছেন তাই বলা। আসলে নিশানপুর ছিল আমার পূর্বপুরুষদের জমিদারির একটা বিশেষ অঞ্চল। জানেন বোধহয় অনেকটাই।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রফেসর রুদ্র বলেছেন কিছু কিছু,” সোজা হয়ে বসলেন অভিমন্যু।
“তো এই নিশানপুরেই অনেক আগে, জমিদার দীপেন্দ্রনাথ হালদারেরও দুই পুরুষ বাদে গোলক হালদারের আমলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে এখানে। এক রাতে কী এক অজানা রহস্যে চারটে মিনারের একটি পুরো ধ্বংস হয়ে যায়। কারণটা আজও অজ্ঞাত। সেই নিয়ে আলোচনা করতেই মাঝে মাঝে আমি প্রফেসর রুদ্রর বাড়িতে যাই। তিনি তো একজন পুরনো লিপি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। আর সেই মিনারটার ধ্বংসস্তূপ থেকে মিনারটার মাথায় লাগানো যে তামার পাতের পতাকাটা উদ্ধার হয়েছিল তাতে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু লেখা ছিল।”
“তো উনি পারলেন মর্মোদ্ধার করতে?”
“নাহ, অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু খুব গোপনে।”
“কেন? গোপনে কেন?”
“প্রফেসর আমায় বলেছিলেন যে ওটা আর্কিওলজিতে জমা করে দিতে। আমি দিইনি। দেবও না। তাই এই সাবধানতা। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না আমি মিঃ রক্ষিত। একটা সাধারণ স্টেথোস্কোপ নিয়ে এমন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?”
অভিমন্যু এবার হেসে ওঠে বললেন, “মিঃ হালদার, একটা সাধারণ তামার পতাকা যখন আপনার কাছে এতটাই মূল্যবান, যেটা রাষ্ট্রীয় গবেষণার কাজে ব্যবহার করার জন্যেও আপনি জমা করে দিতে রাজি হননি তখন একটা সাধারণ স্টেথোস্কোপও কারও কাছে মূল্যবান হতে পারে বৈকি। কী বলেন?”
তারক হালদার একবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই মাথাটা নামিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “তা ঠিক, তা ঠিক।”
।। বারো।।
থানার জীপটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই সচকিত হয়ে উঠল অনির্বাণ। ওসি থেকে শুরু করে থানা-ক্যান্টিনের হারুদা অবধি সবাই অনির্বাণেরই খদ্দের। সম্পর্কও বেশ মাখোমাখো। তবুও শব্দটা পুলিশ, খাকি জামা। যতই খাতির থাকুক এদের দেখলে একটু হলেও মনে অস্বস্তি হয় বৈকি। আপনা থেকেই ভুরু কুঁচকে উঠল ওর। কাল সন্ধেতেই তো একগাদা ওষুধপত্র নিয়ে গেলেন বড়বাবু কনস্টেবল পাঠিয়ে। আজ আবার এখন কী মনে করে!
কাউন্টারের ওপর ডায়েরিটা নামিয়ে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে বড়বাবু বললেন, “একটিবার থানায় যেতে হবে অনির্বাণবাবু। দোকানটা বন্ধ করে ফেলুন।”
“আবার কী হল? কোনও ক্যাজুয়েলটি নাকি?” অনির্বাণ শুকনো হাসি টেনে জিজ্ঞেস করল। মাঝেমধ্যে গজ, তুলো, টক্সয়েড পকেটে পুরে থানায় যেতে হয় বৈকি। অনুরোধের ছদ্মবেশে তলব আসে কখনও সখনও থানা থেকে।
“না, এবারে বিষয়টা ভিন্ন। ও হ্যাঁ, ভুলে গেছলাম, এই নিন,” বলে একখানা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে তাড়া দিলেন বড়বাবু, “একটু তাড়াতাড়ি করুন। যত ভিড় জমে যাবে ততই আপনার খারাপ লাগবে।”
কাগজটা হাতে নিয়ে দুয়েক ছত্র পড়েই শরীরটা কেমন টলে উঠল অনির্বাণের। আস্তে করে চেয়ারে বসে থমথমে মুখে পুরোটা পড়ল একবার। ওর নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। সত্তরোর্দ্ধ এক বৃদ্ধ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের চিকিৎসায় গাফিলতি এবং তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে অভিযোগ আনা হয়েছে ওর বিরুদ্ধে।
পরদিন কোর্টে চালান হওয়ার পর টানা সাতদিন পুলিশ রিমান্ডে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে অনির্বাণ। চোখের কোণে পুরু কালি। কিছুদিন ঘরে গুম মেরে বসে থেকে আরও দিন দশেক বাদে দোকানে এসে বসল ও। এই ক’দিনে লোকেশ বেশ জমিয়ে নিয়েছে বিক্রিবাটাটা। অনির্বাণ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না যে এতদিন ধরে পেশেন্টটাকে স্যালাইন ইঞ্জেকশন পুশ করে আসছে অথচ সেদিন কী করে এয়ার এম্বোলিজম হয়ে গেল। আর এম্বোলিজমটা এতটাই হল যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভদ্রলোক মারা গেলেন! যদিও শেষ সময়ের দিকে এক পা বাড়িয়ে রেখেছিলেন বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। তারপরও…
অনির্বাণ যে পেশেন্টটাকে মাঝেমধ্যেই বাড়ি গিয়ে স্যালাইন ইঞ্জেকশন পুশ করে আসত তাকে সেদিনও একটা ডেক্সট্রোজ চড়িয়ে এসেছিল ও। মুখে খাবার খেতে পারতেন না ভদ্রলোক পরিমাণমতো। তাই মাঝেমাঝে ইন্ট্রাভেনাসলি গ্লুকোজের প্রয়োজন পড়ত। ড্রিপ লাগিয়ে বেরিয়ে আসার আধঘণ্টার মধ্যেই নাকি রামকৃষ্ণবাবুর শারীরিক অবস্থার সাংঘাতিক অবনতি হতে শুরু করে। ছেলেরা নিশানপুরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওপর ভরসা না করে সোজা জেলা হাসপাতালে নিয়ে যায় তড়িঘড়ি। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের সাথে হার্টের কর্মক্ষমতাও হ্রাস পেতে শুরু করে দ্রুত। অনির্বাণের লাগিয়ে আসা স্যালাইনের সূত্র ধরে সিটি স্ক্যান করে ডাক্তাররা এই ট্রমার উৎসের কারণ খুঁজে বের করেন। ভেনাস এয়ার এম্বোলিজম। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ভদ্রলোক। ছেলেরা সেদিনই থানায় অনির্বাণের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করে দেয়।
ওদিকে হয়েছে আরেক বিপদ। খবরের কাগজ আর নিউজ চ্যানেলের দল নিশানপুরে আস্তানা গেড়ে বসেছে তিনদিন হল। লক্ষ্য নিশানপুরের শেষ নিশান দীপেন্দ্রনাথের সেই মিনার। কোত্থেকে তারা খবর পেয়েছে জঙ্গলে ওই মিনারের তলায় বা তার আশেপাশে অপার্থিব কিছু আনাগোনা করছে বা লুকিয়ে আছে। ভ্যানের ওপর স্যাটেলাইট ডিশ ফিট করে, গোটাকতক হ্যালোজেন জ্বালিয়ে ক্যামেরা তাক করে বসে আছে দিনরাত। যাকে হাতের কাছে পাচ্ছে তারই বাইট নিচ্ছে চ্যানেলের লোকেরা। তারক হালদার তো রেগে কাঁই। তিনি চান না তার পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে এভাবে জলঘোলা হোক। যদিও তেমন কিছুই ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়েনি এখনও অবধি।
অনির্বাণের পইপই করে বারণ করা সত্ত্বেও ভুলুয়াকে শহরের আই হসপিটালে ভর্তি করে দিয়েছে লেবার সর্দার। ডাঃ সামন্তর চেম্বারে নিয়ে যেতেই উনি সোজা রেফার লিখে দেন আই হসপিটালে। সেখান থেকেই কে জানে কেমন করে মিডিয়া খবর পেয়ে যায়। শেষে সর্দার আর ভুলুয়াকে কথার কায়দায় ফেলে খবর বের করে নেয়।
।। তেরো।।
ভুলুয়া হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে। প্রশাসনের তরফে নিরাপত্তার নামে ওকে নজরবন্দী করে রাখার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হতেই পালিয়েছে ও। ইটভাটার ঝুপড়িতে ফেরেনি সে। কেউ তার খোঁজও জানে না। লেবার সর্দারও যেন নির্বিকার।
মিডিয়ার লোকজনের ঘাঁটি আস্তে আস্তে পাতলা হতে শুরু করেছে নিশানপুর থেকে। খালি হাতে আর কতদিন বসে থাকা যায়! ভিনগ্রহের কোনও জীবজন্তুর টিকির নাগালও পাওয়া যায়নি এ যাবত। বিহারী দেহাতি ছেলেটা নিশ্চয়ই মনগড়া গল্প ফেঁদেছে একটা। অনেকেই পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে। নয়তো অন্যদিকে বিট করতে সমস্যা হচ্ছে।
অঝোর বৃষ্টি। সাথে রাতের আকাশ থেকে নেমে আসা অন্ধকারের মোটা কালো পর্দাটা ফালাফালা করে দিচ্ছে বিদ্যুতের সর্পজিহ্বা। থেকে থেকেই চমকে উঠছে পৃথিবী। বিলাসবহুল একটা বাড়ির প্রাচীর ঘেঁষা একটা ঝাঁকড়া গাছে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে এক মূর্তি। উদ্দেশ্য বাড়ির আশেপাশে আর বিশেষ কোনও ব্যক্তির গতিবিধির ওপর নজর রাখা। বেশ ক’দিন ধরেই চলছে এই পাহারা। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে এক আগন্তুক এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে রাস্তায় আজ। পাতার আড়ালে খানিকটা নড়েচড়ে বসল সেই মূর্তি।
গায়ে প্রায় গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা মোটা রবারের বর্ষাতি। মাথায় কান ঢাকা টুপি। পায়ে গামবুট। আগন্তুক গেটের কাছে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে একবার এপাশ ওপাশ তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেল বাড়ির ভেতরে। লুকিয়ে থাকা মূর্তিটাও সাবধানে গাছ থেকে নেমে অন্ধকারে মিশে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট চল্লিশেক পরেই আগন্তুক আবার রাস্তায় এসে দাঁড়াল। চারদিকে আবারও সন্ত্রস্ত দৃষ্টি ফেলে জঙ্গলের পথ ধরল। এই দুর্যোগের রাতে কেউ তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করতে পারে এ তার হয়তো ঘুণাক্ষরেও মনে আসেনি।
রাত তিনটে নাগাদ মিডিয়া শিবিরকে দূর থেকেই পাশ কাটিয়ে খানিক ঘুরপথে গুঁড়িয়ে যাওয়া মিনারটার কাছে এসে দাঁড়াল একটা লোক। এ পথ তার চেনা। আগ রাত্তিরে একজনকে অনুসরণ করে চিনে গিয়েছিল পথঘাট, গুহার মুখ, ঢোকার রাস্তা। তখন বর্ষাতি পরা লোকটা ফেরত যাওয়ার অনেক পরে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে গিয়েছিল সে। একটা বড়ো গাছের গুঁড়ির সাথে লেপটে থাকা পাথরটাকে মোটা শাবলের চাড় মেরে সরিয়ে তারপর লতাপাতা ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে হয়। চৌকো আকৃতির শাবলটা পাশেই একটা কাঁটাঝোপে লুকোনো থাকে। সাবধানে বের করে আনতে হয়।
হামাগুড়ি দিয়ে গুহার মুখটা পেরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই হাত তিনেক দূরে সামনে পড়ল এক লোহার দরজা। হালকা টুকি মেরে বোঝা গেল দরজার পাত বেশ পুরুই। ডানপাশে লেটারবক্সের আকারের কী একটা লাগানো রয়েছে। ডালাটা খোলা হুকে আটকানো। লোকটা একটু ভেবে নিয়ে হুকটা আলগা করে ডালাটা আলগোছে টেনেই মুচকি হাসল একটু। যা আন্দাজ করা হয়েছিল তাই সঠিক। ওটা একটা ইলেকট্রনিক কোড লক সিস্টেম, অ্যালফাবেটিক্যাল। কিন্তু কোড তো জানা নেই! এলোপাথাড়ি কোড দিতে গেলে হয়তো তিনবার বা পাঁচবারের মাথায় নিজে থেকেই ব্লকড হয়ে যেতে পারে। এই জঙ্গলের যিনি মালিক তিনি কি জানেন যে তাঁর সম্পত্তিতে কেউ এমন একটা আস্তানা গেড়েছে? নিশ্চয়ই জানেন। ওই বাড়িটা থেকে বেরিয়ে সোজা এখানে এসে ঢোকা তো তারই ইঙ্গিত দেয়।
গোঁফে বাঁহাতের আঙুলগুলো বোলাতে বোলাতে মনগড়া একটা কোড ডায়াল করল সে। উঁহু, অ্যাকসেস ডিনাইড। ঠোঁট বেঁকিয়ে একটুক্ষণ কী ভেবে নিয়ে লোকটা লিখল, এম এ আর সি ও। সাথে সাথেই লাল হয়ে গেল মনিটরটা। আবারও অ্যাকসেস ডিনাইড। শেষে মরিয়া হয়ে ‘এস এইচ ই পি এইচ ই আর ডি’ লিখতেই কামাল হয়ে গেল। খুব মৃদু একটা পী শব্দ করে গ্রীন সিগন্যাল দেখাল মনিটর। কোড অ্যাকসেপ্টেড। কিন্তু অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও দরজার পাল্লা একচুলও নাড়ানো গেল না।
লোকটা বুঝে গেল যে দরজা খুলতে গেলে ওটুকুই যথেষ্ট নয়। আরও কিছু আছে নিশ্চয়ই। মোবাইলের ফ্ল্যাশটা বারবার জ্বালিয়ে নিভিয়ে অপর পাশে ছোট্ট একটা গর্তমতো হাতে ঠেকল। তর্জনী দিয়ে অন্ধকারে পরিমাপটা আন্দাজ করতেই মনে হল গর্তটা চৌকোণামতো। মোবাইলের ফ্ল্যাশটার মতো মস্তিষ্কের আলোটাও ফ্ল্যাশ করে গেল সঙ্গে সঙ্গে এক চিড়িক। দ্বিতীয় কোনও ভাবনাচিন্তা না করে চৌকোণা শাবলটার পেছন দিকটা ঢুকিয়ে সজোরে একটা মোচড় দিতেই খুটুং করে হালকা শব্দ হল একটা। উত্তেজনায় দরজার পাল্লা ধরে ফাঁক করার চেষ্টা করতেই পাল্লাদুটো খানিকটা করে ঢুকে গেল গুহার দু’পাশের দেওয়ালে।
ঘরটাতে ঢুকতেই একটা রিনরিনে ক্লান্ত স্বর কানে এসে ঠেকল আচমকা, “মুঝে মত মারো, মত মারো। মার্কোকো লে যাও, হঠাও উসে।”
এককোণে হাত পা বাঁধা অবস্থায় কাঁদতে থাকা ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুহূর্তেই।
ঘরের ভেতরটা মোটামুটি সাজানো গোছানো আর মাঝারি পরিসর। হাঁটাচলা করা যায় স্বছন্দে। পড়াশুনো করার জন্যে চেয়ার টেবিলও রয়েছে। টেবিলের ওপর একটা বহু পুরনো তাম্রলিপি আর একটা মজবুত কাঠের বাক্সে রয়েছে বড়সড় আকারের একটা হাতঘড়ির ডায়াল। বেল্টদুটোর অস্তিত্ব নেই। পিঠের ব্যাকপ্যাকটায় জিনিসগুলো ভরতে ভরতেই নজর গেল টেবিলের আরেক কোণায় রাখা দুটো মোটা মোটা বই। প্যালিওগ্রাফির ওপর লেখা। বেরোবার মুখে আরেকটা জিনিস এককোণে একটা তেপায়া টুলের ওপর পড়ে থাকতে দেখে সাংঘাতিক আশ্চর্য হয়ে ওটাও তুলে নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল লোকটা। একটা টোব্যাকো পাইপ।
দু’দিন যেতে না যেতেই পিঁপড়ের লাইনের মতো গাড়ি করে সব মিডিয়া হাউস আবার জড়ো হল নিশানপুরের জঙ্গলে। এবারে বিশাল বড়ো আর তাজা খবর। আগেরদিন রাতে নিশানপুরের শেষ নিশান হিসেবে টিকে থাকা মিনারটা গুঁড়িয়ে গেছে কখন। হতাহতের কোনও খবর নেই যদিও। ভোরবেলা গুলতি দিয়ে জঙ্গলে পাখি, কাঠবেড়ালি মারতে ঢোকা ইটভাটার শ্রমিকদের তিন চারজনের একটা দল প্রথম দেখতে পায় ব্যাপারটা। পাথরের চাঁই, ইট, কাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। একপাশের আগাছাগুলো যেখানে বড়সড় গাছগাছড়া নেই তেমন জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে আছে, ধোঁয়া উঠছে তখনও হালকা হালকা। ঝলসে যাওয়া জায়গার আয়তনটা একটা বড়সড় পুকুরের আকারের। পরেরদিন সবার হুঁশ হয় যে গতরাতে যাদের যাদের বৈদ্যুতিন জিনিসপত্র যেমন, লাইট পাখা সমেত টিভি ফ্রিজ মোবাইল চার্জার চালু ছিল বা স্যুইচবোর্ডে লাগানো ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে।
।। চৌদ্দ।।
এক রবিবারের সকাল। তারক হালদারের গেটের সামনে প্রফেসর বিনায়ক রুদ্রর গাড়িটা থামতেই অভিমন্যু এগিয়ে এলেন দরজার কাছে। একগাল হেসে বললেন, “এসো এসো জেঠু, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি সবাই।”
বিনায়ক রুদ্র ঘরে ঢুকতেই তারক সোফা ছেড়ে উঠে এসে নিজের পাশে বসালেন। গুছিয়ে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে একে একে সবার দিকে দৃষ্টি ফেললেন বিনায়ক চশমার মোটা কাঁচের আড়াল থেকে। সবাই উপস্থিত আগে থেকেই। তারপর অভিমন্যুর দিকে চোখ রাখতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সবার মুখের দিকে একটা দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বললেন, “ঘটা করে সবাইকে একজায়গায় জড়ো করে কোনও একটা রহস্য উন্মোচন করার স্টাইলটা বেশ পুরনো হলেও ব্যাপারটা কিন্তু খুব কাজে দেয়। তাই আমিও এই কাজটা না করে থাকতে পারলাম না, মাপ করবেন। অনির্বাণবাবু, আপনার কেসের তারিখ যেন কবে আবার নেক্সট?”
অনির্বাণ অন্ধকার মুখে জবাব দিল, “আজ্ঞে, সামনের বুধবার।”
মুচকি হেসে অভিমন্যু বললেন, “আই সি। তবে এই কেসে আপনি ছাড়া আর একমাত্র আমিই জানি যে আপনি সম্পূর্ণ নির্দোষ।”
মুহূর্তে চোখদুটো চকচক করে উঠল অনির্বাণের। অভিমন্যুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ।
অভিমন্যু হাত তুলে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, “ও রহস্যের কিনারা হয়েছে অনির্বাণবাবু, দুশ্চিন্তা করবেন না। তবে ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের মৃত্যুটা কিন্তু নির্ভেজাল একটা খুনই ছিল। আচ্ছা, হিউম্যান বডিতে এয়ার বা গ্যাস এম্বোলিজম সম্বন্ধে খানিক আলোকপাত করতে পারেন?”
জবাবটা বিনায়ক রুদ্রই দিলেন। গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললেন, “অ্যান এয়ার এম্বোলিজম অকারস হোয়েন ওয়ান অর মোর এয়ার বাবল্স এন্টার আ ভেন অর আর্টারি অ্যান্ড ব্লক ইট। অসাবধানতাবশত বা ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ যদি কায়দা করে কিছুটা এয়ার কারও ভেন বা আর্টারিতে ঢুকিয়ে দিতে পারে তবে তা তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে।”
বলে ডাঃ সামন্তর দিকে তাকাতেই উনি ঘাড় কাত করে সহমত পোষণ করলেন। প্রফেসরের ব্যাখ্যার সাথে যোগ করলেন, “সেক্ষেত্রে ভিকটিমের হার্ট ব্লক হয়ে যেতে পারে, স্ট্রোক হতে পারে, আবার তার রেস্পিরেটরি সিস্টেম কলাপসও করতে পারে।”
“আপনার কেসে খুনটা কিন্তু সেম প্রসেসেই হয়েছে অনির্বাণবাবু, বেশ পরিকল্পিতভাবে,” বলেই আবার মুচকি হাসলেন অভিমন্যু।
“মানে?”
“মানে, ড্রিপটা ফিট করে আপনি বেরিয়ে আসার একটু পরই কেউ চ্যানেলটা খুলে ঠিক এই কাজটাই করেছে। কে করেছে বলছি একটু পরে।”
“নিশ্চিন্ত হলাম খানিকটা অভি, ওয়েল ডান! কিন্তু আসল জিনিসটার কোনও খোঁজখবর…”
প্রফেসরের মুখের কথাটা শেষ করার আগেই অভিমন্যু বললেন, “হ্যাঁ, সেটাও হয়েছে জেঠু, ভেবো না। তবে ও নিয়ে বলার আগে তারকবাবুকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আচ্ছা তারকবাবু, আপনি কি মার্কোকে মানে আপনার জার্মান শেফার্ডটাকে নিয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে রোজই জঙ্গলে মিনারের কাছে যান?”
তারকের পিঠে যেন চাবুক পড়ল একটা। সাংঘাতিক হকচকিয়ে গিয়েও সামলে নিলেন শেষটায়। বললেন, “না মানে, রোজ নয়। মাঝেমধ্যে ইভনিং ওয়াকে যাই। কেন বলুন তো? আর লুকিয়ে যাই কেন বলছেন?”
“না, ভাবলাম যেহেতু বেশ শক্তপোক্ত ব্যবস্থা করে সুরক্ষিত একটা গোপন আস্তানা তৈরি করেছেন সেই ভাঙা মিনারটার নীচে, তবে তো রোজই যান হয়তো একবার ওখানে। আর গোপন জায়গায় কি কেউ প্রকাশ্যে যায়, বলুন? কিন্তু এন্ট্রান্সের সিকিউরিটি সিস্টেমটা ততটা পোক্ত নয়, যাই বলুন।”
“ও, চেম্বারটার হদিশ পেয়ে গেছেন দেখছি। তা যেতে হয় বৈকি। নিজের পৈতৃক সম্পত্তি, কোথায় যাব না যাব সে কি অন্য কারোর কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে বলছেন? আর ওই সিকিউরিটি ভাঙে নিশানপুরের কারও কম্ম নয়। আপনার মতো আউট সাইডারদের কথা ভেবে দেখিনি,” আস্তে আস্তে ক্রুর হাসিটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তারক হালদারের।
অভিমন্যু মিষ্টি হেসে ঘাড় নেড়ে বললেন, “ওকে। সোজা পয়েন্টেই আসি তাহলে। অনির্বাণবাবুর কাছে যে একটা অদ্ভুত যন্ত্র রয়েছে তা টের পেলেন কী করে?”
তারক একটু ইতস্তত করে দিব্যেন্দুর দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন, “দিব্যেন্দুই বলল একদিন।”
“বেশ। দিব্যেন্দুবাবু, আপনি কোত্থেকে হদিস পেলেন?”
দিব্যেন্দু ভড়কেই ছিল, চোখে সন্দেহের দৃষ্টি। আমতা আমতা করে বলল, “সেদিন ডাক্তারবাবুর তলব নিয়ে অনির্বাণের দোকানে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল। ওর স্টেথোটা ঠিক নর্মাল ঠেকল না চোখে। হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই…”
“মানে দেখলেন যে ওটা আপনার শরীরের কোনও ডিসঅর্ডার বা রোগের হদিস দিয়ে দিচ্ছে। তাই তো? অনির্বাণবাবু কোথায় ছিলেন তখন?”
“দোকানে ছিল না। রোগী দেখতে গিয়েছিল, যিনি সেদিনই খুন হন বা মারা যান।”
“আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হয় মশাই। এখানে এই সিচুয়েশনে বসেও অবলীলায় মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছেন!”
দিব্যেন্দু চোখ নামিয়ে ফেলল সাথেসাথেই। অভিমন্যু বলল, “যন্ত্রটা তো এর দু-চারদিন আগে প্রফেসর বিনায়ক রুদ্রর হাতে চলে যায়। আপনি সেদিন দোকানে সেটা দেখলেন কী করে?”
মাথা নিচু করে চোখেমুখে আতঙ্ক মেখে বসে আছে দিব্যেন্দু। কোনও জবাব নেই।
অভিমন্যু আবার প্রশ্ন করলেন, “মালতী আপনার ওখানে কতদিন ধরে কাজ করছে দিব্যেন্দুবাবু? আর ও যে রামকৃষ্ণবাবুর বাড়িতেও কাজ করত সে খবরই বা পেলেন কীভাবে?”
“মালতীই বলেছিল একদিন কথায় কথায়,” জবাব দিতে কথা আটকে যাচ্ছে গলায় দিব্যেন্দুর।
“হুম। অনির্বাণবাবু, ড্রিপ চ্যানেলে মালতীই এয়ার ঢুকিয়েছিল সেদিন। কায়দাটা দিব্যেন্দুবাবুই পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওকে। মোটা টাকা আর হাসপাতালে একটা ছোট চাকরির প্রতিশ্রুতির লোভে পড়ে গিয়েছিল মালতী।”
তারক হালদারের ড্রয়িংরুমটা থমথম করছে। প্রত্যেকের নিঃশ্বাসের শব্দগুলো পর্যন্ত যেন টের পাওয়া যাচ্ছে। পুরোদমে এসি চলছে, তবুও প্রত্যেকের কপাল গলা নাক চিকচিক করছে। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না ভুলেও। যেন তাকালেই নিজের কুকীর্তি ফাঁস করে দেবে অপরপক্ষ।
অভিমন্যু নিজের জায়গা ছেড়ে দিব্যেন্দুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। ইস্পাত-কঠিন স্বরে জানতে চাইলেন, “আমি যতটুকু জেনেছি, আপনার সাথে অনির্বাণবাবুর পরিচয় ফার্মা কলেজের প্রথমদিনেই। তারপর থেকেই আপনাদের মধ্যে গাঢ় সখ্যতা। দুজনেই জেঠু মানে প্রফেসর রুদ্রর প্রিয় ছাত্র। তা, বন্ধুর জীবনটা নিয়ে অমন ছিনিমিনি খেলায় মেতে উঠলেন কেন হঠাৎ দিব্যেন্দুবাবু? কোনও বিশেষ কারণ?”
“না, তেমন বিশেষ কারণ নেই।”
“তবে? বলুন দিব্যেন্দুবাবু, নষ্ট করার মতো সময় এখানে কারও নেই।”
দিব্যেন্দু তারক হালদারের দিকে চকিতে একবার তাকিয়েই দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। বলল, “তারকবাবুর প্ল্যান ছিল। তবে রাস্তাটা আমিই বের করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, উনি মারাই যাবেন এমন কেউ ভাবিনি আমরা।”
“ভেবেছিলেন অল্পের ওপর দিয়ে কুকীর্তিটা করে অনির্বাণবাবুর সুনামটা একেবারে শেষ করে দেবেন। যাতে ড্রাগ লাইসেন্সটা নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি পড়ে যায়। কী, তাই তো, তারকবাবু?”
তারক হালদার মুখে সেই ক্রুর হাসিটা ঝুলিয়েই বসে রইলেন। কোনও উত্তর দিলেন না। ভাবখানা এরকম, যেন যা করেছি বেশ করেছি।
অভিমন্যু মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে পায়চারি করতে লাগলেন। হঠাৎ প্রফেসর রুদ্রর সামনে এসে থেমে বললেন, “কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে কী হয়েছিল জেঠু? তোমার পাইপ, বইপত্র তারকবাবুর ওই ডেরায় কেন? তুমিও শেষে তারকবাবুদের দলে গিয়ে ভিড়লে? কিন্তু জিনিসটা নিজেরাই চুরি করে আবার আমাকেই কেন বা এটা খোঁজার জন্য ডাকলে এই ব্যাপারটা মাথায় আসছে না।”
“মানে? কি, বলতে চাইছিস কী তুই?”
অভিমন্যু ব্যাগ হাতড়ে একটা টোব্যাকো পাইপ বের করে এনে জিজ্ঞেস করলেন, “চিনতে পারছ তো? তোমার নয়?”
“হ্যাঁ, দেখে তো আমারই মনে হচ্ছে। মুখের কাছে সোনালি বেড়টাও রয়েছে… কিন্তু এটা তুই…?” সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন বিনায়ক রুদ্র।
অভিমন্যু হিমশীতল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসরের মুখের দিকে। প্রফেসর দৃষ্টিটার মর্ম বুঝতে পেরেই যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। বললেন, “তোকে আমার আর তারকের মধ্যে সম্পর্কটা পুরোটা বলা হয়নি। বলা উচিত ছিল। আর সেজন্যেই তুই বোধহয় এই সন্দেহটা করতে পারলি আজ। সে যাক গে, শোন। তারকের সাথে আমার পরিচয় সেই তামার পতাকায় লেখা অবোধ্য লিপির সূত্রে। তারক অনেক খোঁজখবর করে আমার কাছে এসেছিল গোপনে। উদ্দেশ্য ওই লিপির মর্মোদ্ধার করা। আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি। তবে তারক কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি। আসা যাওয়া লেগেই ছিল। ওর কেমন করে একটা বদ্ধমূল ধারণা হল জানি না, যে ওই লিপি উদ্ধার করলে একমাত্র আমিই করতে পারব।
“আমিও ওর কনফিডেন্সে চলে এলাম আস্তে আস্তে একসময়। নতুন উদ্যমে শুরু করলাম আবার কাজ। মাঝেসাঝে অনির্বাণ আর দিব্যেন্দুকে ডেকে এনে টুকিটাকি কাজের সাহায্য নিতাম। নতুন করে এই কাজের শিটগুলো আমি আমার একটা অব্যবহৃত পাইপে ঢুকিয়ে রাখতাম বিশেষ কায়দায়। পরেরদিন নতুন কিছু ক্লু পেলে আগেরদিনের কাগজটা পুড়িয়ে ফেলতাম। আমি ছাড়া এই পাইপের কথা আর কেউ জানত না। দিব্যেন্দু বা অনির্বাণও নয়, তারকের তো প্রশ্নই নেই। কারণ, ইতিমধ্যে তারকের হাবভাব আর কথাবার্তায় আমার কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছিল যে ও যতই বলুক কাজটা নিতান্ত কৌতূহলের বশে আমায় দিয়ে করাচ্ছে, আসলে তেমনটা হয়তো নয়। ও লিপিটার মর্মোদ্ধার করিয়ে সুযোগ এবং সুবিধেমতো হয়তো ওটা নিয়ে বিদেশীদের সাথে ডিল করতে চাইছে। তাই আমি সাবধান হয়ে গেলাম।
“তাছাড়া আমার একটা দৃঢ় ধারণা জন্মেছিল যে শুধু তামার পাতটাই নয়, তারক হয়তো আরও কিছু জিনিস খুঁজে পেয়েছে যেগুলো সে এখনই প্রকাশ্যে আনছে না। কারণ, মিনারটার ডেব্রিসের নীচে স্বাভাবিকভাবেই আরও কিছু না কিছু জিনিসপত্র থাকতে পারে বলে আমার বারবার মনে হচ্ছিল। তারক পরে সেগুলো খুঁজে পেয়েছে আর তামার পতাকাটা যেহেতু অনেক আগেই প্রকাশ্যেই পড়েছিল তাই এটাই একমাত্র পাওয়া গেছে বলে রটাচ্ছে। বহুবার অনুরোধ করেছি যে লিপিটা যেন প্রশাসনের হাতে তুলে দেয় ও। তারক কানে তোলেনি সে কথা। পুলিশের তরফে তদন্তে সে বেমালুম মিথ্যে বলে দিল যে বাবার আলমারিতে জিনিসটা একবার চোখের দেখা দেখেছিল ঠিকই, তবে এরপরের খোঁজ সে জানে না।”
“কিন্তু তুমি তো নিজে থেকেও পুলিশকে জানাতে পারতে জেঠু! জানালে না কেন?”
প্রফেসর তারক হালদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “গোটা ব্যাপারটা যে তারক সাপলুডোর নিরানব্বইয়ের ঘর বানিয়ে রেখেছে অভি। ওতে গুটি পড়লে আবার ছয়ের ঘরে। পুলিশ জিনিসটা সীজ করলেও দুয়েকদিনের মধ্যেই ওটা আবার তারকের হাতে চলে যাবে। একটা প্রহসন হবে মাত্র। মাঝে নিজে রিসার্চটা থেকে বঞ্চিত হব।”
“তবে কি তারকবাবুই পাইপটা সরিয়ে নিজের ডেরায় নিয়ে রাখলেন? আর এই বইদুটো?” অভিমন্যু ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে প্যালিওগ্রাফির দুটো বই বের করে প্রফেসরের হাতে দিলেন।
বইদুটো হাতে পেয়ে চোখদুটো চকচক করে উঠল প্রফেসরের। বললেন, “আমিও বলি, বইদুটো রাখলাম কোথায়। শেলফে নেই, টেবিলে নেই, কোথাও নেই! কিন্তু জিনিসগুলো তারকের ডেরায় গেল কী করে? আর কবেই বা সরাল? আমি তো কিছুই টের পাইনি। কী, তারক?”
“আমিই বলছি। এক সপ্তাহও হয়নি। তুমি হয়তো এর মধ্যে তেমন কাজ করনি, নইলে পাইপটার অনুপস্থিতিটাও চোখে পড়ত। আয়াম এক্সট্রিমলি সরি জেঠু, তোমায় সরাসরি চার্জ না করলে অনেককিছুই হয়তো অজানা থেকে যেত।”
বিনায়ক স্মিত হেসে হাত তুলে নিরস্ত করলেন অভিমন্যুকে। অভিমন্যু বললেন, “বাকিটা আপনার মুখে শুনতে চাই তারকবাবু। উইল ইউ প্লীজ কো-অপারেট?”
তারক একটু নড়েচড়ে বসলেন। মুখের গোঁয়ার্তুমি ভাবটা কেটে গেছে অনেকটাই। বললেন, “সবকথা ইচ্ছে করলে কোর্টেই জবানবন্দি হিসেবে দিতে পারি, তবুও আপনি যখন ভদ্রভাবে জানতে চাইছেন তখন… মানীর মান রাখে না এ তারকের শত্তুরেও উচ্চারণ করতে পারে না।”
“প্লীজ। আশা করছি কোনও কথা গোপন করবেন না।”
“নাহ্, আর…। শুনুন, পরিষ্কারভাবে অল্প কথাতেই বলছি। প্রফেসর যা আন্দাজ করেছিলেন তা অনেকটাই সত্যি। লিপিটা আমি আগেই বেচে দিতে পারতাম। প্রাথমিকভাবে সেরকম একটা কথাবার্তাও হয়ে রয়েছে এক ফরেন এজেন্টের সাথে। কিন্তু চাইছিলাম খুব শিগগিরই এটার মর্মোদ্ধার করে কী লেখা আছে জেনে নিতে। তাই প্রফেসরকে ধরেছিলাম গিয়ে। কিন্তু প্রফেসর ধারণা করছিলেন আমার কাছে আরও কিছু জিনিস রয়েছে। ওগুলো দেখতে চাইতেন প্রায়ই। কিন্তু সত্যিই আমার কাছে আর কিছু ছিল না বা নেই। কয়েকদিন আগে আমি একটা ফেক ডিল করি ওনার সাথে যে রিসেন্টলি যে জিনিসটা উনি হাতে পেয়েছেন ওটার সম্পর্কে ডিটেলে জানতে পারলে আর একবার চোখের দেখা দেখতে পেলেই বাকি সবকিছু আমি প্রফেসরের হাতে তুলে দেব। কারণ, ইতিমধ্যে দিব্যেন্দু মারফত আমি খবরটা পেয়ে গিয়েছিলাম যে এমন এক অদ্ভুত জিনিস অনির্বাণ প্রফেসরকে দিয়েছে যেটা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে।”
আশ্চর্য চোখে তারককে একবার আপাদমস্তক পরখ করে নিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিল দিব্যেন্দু।
“জিনিসগুলো কে সরাল তারকবাবু? দিব্যেন্দু, না আপনি নিজেই?”
“বইগুলো আমি আর দিব্যেন্দু ওই ঘড়িমতো জিনিসটা আর পাইপটা।”
“বেশ। তবে বয়ানে একটু জল যে মিশে গেল তারকবাবু। অবশ্য ভুলটা আমারই, আমি রিকোয়েস্ট করেছিলাম যে কোনোকিছু গোপন না করতে। মিথ্যে বলতে তো বারণ করিনি।”
“মানে?”
এবারে চোখমুখ পালটে গিয়ে কঠিন স্বরে বললেন অভিমন্যু, “মানেটা হচ্ছে, প্রফেসর রুদ্রর গোপন ড্রয়ার থেকে বের করে আনার আগ পর্যন্ত দিব্যেন্দুবাবু জানতেনই না জিনিসটা ঠিক কী। জেঠু বলেননি কাউকেই। আপনার ডিলেও হয়তো সম্মত হননি। কী, জেঠু? আপনি জিনিসটার খবর পেয়েছিলেন আপনার ম্যানেজার মারফত। ভুলুয়া একদিন ওর বন্ধুদের সাথে খেলার ছলে বলে ফেলেছিল কথাটা। ম্যানেজার শুনতে পেয়ে আপনার কানে তোলেন। ভুলুয়াও জিনিসটা প্রথমবার দেখেছিল প্রফেসরের বাড়িতেই, অনির্বাণের সাথে যেদিন গিয়েছিল। তারপর আপনি ভুলুয়াকে হাসপাতাল থেকে একরকম কিডন্যাপ করে ওই জঙ্গলের ডেরায় ঢুকিয়ে মার্কো মানে আপনার জার্মান শেফার্ডটাকে দিয়ে মৃত্যুভয় দেখিয়ে খবরটা উগড়ে নিয়েছিলেন। লেবার সর্দারকে বেনামে ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন যে ভুলুয়া দুয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে তার কাছে। অযথা খোঁজাখুঁজি বা থানা পুলিশ করলে ভুলুয়ার লাশ ফিরে আসবে। ভুল বলছি কি?”
তারক জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অভিমন্যু পায়চারির ভঙ্গীতে আস্তে আস্তে দরজার পাশে রাখা জুতোর র্যাকটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। গলাটা খানিকটা চড়িয়ে বললেন, “আচ্ছা তারকবাবু, র্যাকে মোট পাঁচটা জুতোর বাক্স কেন? আরেকটা কোথায় গেল? সেদিন যখন আপনার বাড়িতে এলাম তখন তো আরেকটা বেশ পুরনো বাক্স ছিল এতে।”
“কী যা তা বলছেন! যা ছিল তাই আছে। যত্তোসব ইয়ে…” বেশ বিরক্ত হলেন তারক।
“উঁহু, বাক্স তো আরেকটা ছিলই এবং তা নতুন করেই রাখা হয়েছিল। কারণ, আগের এবং এখনকার পাঁচটা বাক্সের তলাগুলো র্যাকের দাগের সাথে খাপে খাপে মিলে আছে এখন। সেদিন ছিল না। পাঁচটার জায়গায় ছ’টা রাখতে গিয়ে দাগ আর বাক্সের পজিশনের মধ্যে মিল ছিল না। ইয়ে মানে, জিনিসগুলো এনে প্রথমে ঠিক এখানেই লুকিয়ে রাখেননি তো, তারকবাবু? ওই জুতোর বাক্সে? কী ভেবেছিলেন, এত প্রকাশ্যে রাখাটাই সেফ? পরে সুযোগমতো জঙ্গলের ডেরায় রেখে আসবেন?”
তারক একটু বিচলিত হলেও এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।
অভিমন্যু ফের বলতে শুরু করলেন, “আমি সেদিনই কিছু একটা ছুতোনাতায় বাক্সটা ঘেঁটে দেখতে পারতাম। কিন্তু সে ছিল আমার অনুমান মাত্র, হাতে কোনও প্রমাণ ছিল না। যাক গে, আমি ভুলুয়ার নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে গোপনে খবর পাই অনির্বাণবাবুর কাছ থেকে। কেমন সন্দেহ হয়, আর কেন জানি না মনে প্রথম মুখটা আপনারই ভেসে ওঠে সেই মুহূর্তে। নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলাম আপনার বাড়ির বাইরের গাছে বসে। উদ্দেশ্য, আপনার রাতের গতিবিধি ফলো করা। তিনদিন গেল, চারদিনের মাথায় রাত এগারোটার পর প্রচণ্ড ঝড়জল উপেক্ষা করে একজনকে আপনার সাথে দেখা করে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। আর আশ্চর্যজনকভাবে ফিরতি পথে না গিয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরলেন উনি। পিছু নিলাম নিঃশব্দে। কী দিব্যেন্দুবাবু, আমি ঠিক যাচ্ছি তো?” বলেই ফিরে দাঁড়ালেন দিব্যেন্দুর দিকে।
“কিন্তু ভুলুয়াকে তো সে রাতেই… দিব্যেন্দু, ছেড়ে দাওনি ওকে?” তারক কটমট করে তাকালেন দিব্যেন্দুর
দিকে।
“না মানে, সেদিন এত পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছিল যে…”
“এতসব মারাত্মক কাজের পেছনে আপনার স্বার্থটা কী ছিল দিব্যেন্দুবাবু? ওই আশ্চর্য জিনিসটা?”
“টাকা, টাকা, মোটা টাকা। ও জিনিস আমার,” দাঁত খিঁচিয়ে প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন তারক হালদার।
“ভুলুয়া এখন কোথায়, অভি? সে ঠিক আছে তো?” বিনায়ক রুদ্র অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন।
“সে তার দাদুর কাছেই আছে জেঠু। সকালেই নামিয়ে দিয়ে এলাম। কাল রাত অবধি আমার কাছেই ছিল। সর্দারকে অবশ্য খবর পাঠানো হয়েছিল।”
“ওর চোখটা…” ডাঃ সামন্ত বেশ কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
“সে এখন ঠিকঠাক আছে, মানে আগের মতোই নর্মাল। অনির্বাণবাবু হয়তো আগেই আন্দাজ করেছিলেন যে ভুলুয়ার এই হলুদ চোখ একমাত্র ওর ভিনগ্রহের বন্ধুই ঠিক করতে পারবে। এ এক কঠিন রহস্য বটে! ওর চোখ ওর বন্ধুই ঠিক করে দিয়েছে ফিরে যাওয়ার আগে।”
“মানে, কী বলতে চাইছিস তুই? তুই, তুই দেখা পেয়েছিলি ওদের? মানে…” বিনায়ক রুদ্র সোফা ছেড়ে প্রায় দাঁড়িয়েই পড়লেন।
“না, আমি জঙ্গলের ভেতরে ঢুকিনি। উচিত মনে করিনি। কিছু রহস্য রহস্য হিসেবেই থাকলে মঙ্গল বোধহয়। আমাদের বিজ্ঞান ততটা উন্নত হয়নি এখনও। অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটি করলে উলটে বিপদ হতে পারে।”
“আর ওই জিনিসটা?” উত্তেজিত তারক ছিটকে উঠলেন সোফা থেকে।
অভিমন্যু শান্ত গলায় বললেন, “ওটা এক বন্ধুর হাতে আরেক বন্ধুর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তারকবাবু। ওটা আবার এক অজানা দুনিয়ায় চলে গেছে। হয়তো চিরতরেই। অনির্বাণবাবুর কাছ থেকে বেল্টদুটো লাগিয়ে নিয়ে যার জিনিস তার হাতে অক্ষত অবস্থাতেই ফেরত দেওয়া হয়েছে।”
কথাগুলো বলতে বলতেই মোবাইলটা বের করে কাকে যেন ফোন করলেন একটা অভিমন্যু। মিনিট দশেকের মধ্যেই থানার জীপটা এসে দাঁড়াল তারক হালদারের গেটের সামনে।