পাঁচকড়ি রচনাবলী-২য় খণ্ড

পাঁচকড়ি রচনাবলী-২য় খণ্ড

পঞ্চ ‘ম’কার

মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন–ইহাই তন্ত্রসাধনার পঞ্চ মকার বা পঞ্চ তত্ত্ব। শ্লীলবাদী বাবুরা জিজ্ঞাসা করিয়া থাকেন যে, এই পঞ্চ তত্ত্বের কি কোন আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আছে, কোন esoteric অর্থ আছে, না উহা সোজাসুজি সাধারণ ভাবে বুঝিতে হইবে? এই জিজ্ঞাসার সহিত এটুকু ইঙ্গিতও করা হয়, যেন সোজা অর্থে উহা বেজায় মন্দ, ধৰ্ম্মের নামে পাপের প্রশ্রয় দেওয়া হয়, উহা Black Art বা কালা বিদ্যা, বামমার্গ বা সজ্জন-সমাজের হেয় ব্যাপার। তন্ত্রগ্রন্থসকল পাঠ করিয়া আমাদের যাহা ধারণা হইয়াছে, তাহাতে ত আমরা বুঝি–পঞ্চ তত্ত্বের তিন প্রকারের প্রয়োগ আছে। (১) এক, মোটামুটি সোজাসুজি অর্থ; মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন বাহ্য পূজায় এবং স্কুল সাধনায় উহার নিয়মিত প্রয়োগ আছে; (২) মানস পূজায় উহার অর্থ স্বতন্ত্র নহে, তবে তাহা কাল্পনিক ব্যাপার মাত্র; মনে মনে কল্পনা করিতে হইবে যে, আমি সাধক দেবীকে সুরার সাগর, মাংসের পর্বত, মৎস্যের স্তৃপ, মুদ্রার সম্ভার দিতেছি এবং পদ্মিনী নারীর সহিত মৈথুন সাহায্যে কুণ্ডলিনীকে জাগরিতা করিতেছি; (৩) ষট্‌চক্রভেদে পঞ্চ তত্ত্বের অর্থ স্বতন্ত্র, প্রয়োগও স্বতন্ত্র, সেখানে উহার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বা ইসটরিক অর্থ আছে। কিন্তু তন্ত্রের পদ্ধতিমত ষট্‌চক্ৰভেদ কয় জন করিতে পারে? কয় জন বাহিরের শক্তির সহায়তা ব্যতিরেকে কুণ্ডলিনীর উদ্বোধন ঘটাইতে পারে? পারে না-সচরাচর হয় না বলিয়াই উহার সোজা অর্থ ধরিতে হয়, সাধারণতঃ লোকে পঞ্চ মাকারে যাহা বুঝে, তাহাই ধরিয়া লইতে হয়। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ইহাতে লজার বা সঙ্কোচের বিষয় কি আছে? তন্ত্রধৰ্ম্ম প্রচারের ধৰ্ম্ম নহে, উহা গুপ্ত—গোপ্য সাধনার ধৰ্ম্ম; যাহার যেমন শক্তি, যাহার যেমন অধিকার, তাহাকে তেমনই কৰ্ম্মপদ্ধতি দেখাইয়া দিয়া তন্ত্র, জীবমাত্রেরই উদ্ধারের পথ প্রশস্ত করিয়া দিয়াছেন। তন্ত্র ভাবের ঘরে চুরি করে না, ভিতরের পর্দা ও বাহিরের পর্দা রাখে না; তুমি যেমন, তোমার প্রবৃত্তি যেমন, তেমনই সাধনপদ্ধতির ব্যবস্থা করিয়া থাকে। সুতরাং পঞ্চ মাকারে লজাবোধ করিবার ত কোন হেতু দেখি না।

পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছি যে, আত্মশক্তি, উম্মেষ সাধনই তন্ত্রসাধনা। তন্ত্র নিজের দেহস্থ আত্মা ছাড়া অন্য কোন বাস্থ শক্তিকে দেবতা, ঈশ্বর বলিয়া মানে না। তন্ত্র বলেন যে, আমার দেহমধ্যে যে এক জন বিরাজ করিতেছেন, তাহা আমি বুঝি; তিনি জগৎকে বুঝিতে চাহেন, সৃষ্টিপ্ৰহেলিকাকে উদঘাটন করিতে চাহেন। তাই অনুমান করিতে হয় যে, যিনি আমার ভিতরে আছেন, তিনিই বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে আছেন। আমার ভিতরের ঠাকুরকে আমি চিনিতে পারিলে বাহিরের ঠাকুরটি আপনি আসিয়া ধরা দিবেন। এখন দেখিতে হইবে, আমার ভিতরের ঠাকুরের বিকাশ কেমন করিয়া হয়। আহারে বিহারে, জীবনের উপভোগে ভিতরের ঠাকুরটি যেন একটু জাগিয়া উঠেন। বিশেষতঃ কাম ও মদনের চেষ্টায় ভিতরের ঠাকুরের যেন কতকটা নাগাল পাওয়া যায়; কারণ, কামচৰ্চার ফলে নরনারীর সংযোগে একটা নূতন জীবের সৃষ্টি হইতেছে। অতএব মৈথুন হইতেই কুণ্ডলিনীর জাগরণের পদ্ধতি অনেকটা বুঝা যায়। তন্ত্র স্পষ্ট বলিয়াছেন, সিস্মৃক্ষ বা সৃজন ইচ্ছা কামের নামান্তর মাত্র। যে পরমাত্মা ‘এক আমি বহু হইব’ বলিয়া সৃষ্টিপ্ৰহেলিকার বিকাশ করিয়াছিলেন, সেই পরমাত্মা তোমার দেহস্থ থাকিয়া এক আমি বহু হইবার সাধ অন্য নারীতে উপগত হইয়া মিটাইয়া থাকে। অ্যাদি সৃষ্টিতে যেমন আদ্যা শক্তির জাগরণের ফলে বিশ্বাত্মার মনে সিস্বাক্ষা জাগিয়া উঠিয়াছিল, তেমনই নারীদেহাভ্যন্তরে আদ্যা শক্তি কুণ্ডলিনী জাগিয়া উঠিলে, তবে সে নারী পুরুষকে আকর্ষণ করে এবং সেই আকর্ষণের ফলে, স্ত্রীত্ব-পুত্বের সংযোগে নূতন জীবসৃষ্টি হয়। কুণ্ডলিনী না জাগিলে কোন স্ত্রীই গর্ভবতী হইতে পাৱে না, কুণ্ডলিনী না জাগিলে কোন পুরুষের রেতঃপ্রবাহের সহিত আত্মশক্তির নিঃসরণ হয় না, নারীর জরায়ুতে নব জীবের আধান হয় না। অতএব প্রকৃত মৈথুনপদ্ধতির বিশ্লেষণ করিতে পারিলে আত্মশক্তির কতকটা পরিচয় পাওয়া যায়।

ইহাই হইল তন্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্বের থিওরি বা সিদ্ধান্তকথা। একা তন্ত্র কেন—উপনিষদে, পুরাণে, বৈষ্ণব শৈব সকল শাস্ত্রে এই একই সিদ্ধান্ত নানা ভাবে, নানাপ্রকারের ভাষায় বর্ণিত আছে। অন্য সকল শাস্ত্ৰ যাহা থিওরির হিসাবে ব্যাখ্যা করিয়া নিরস্ত আছেন, তন্ত্র তাহাকে করিয়া কৰ্ম্মিয় দেখাইয়া দিয়াছে। এইখানে একটা কথা বলিব। আমাদের দেশে কতকটা হঠযোগের প্রভাবে, কতকটা খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের প্রভাবে নারী বা স্ত্রীজাতি সমাজে যেন একটু নিম্ন স্থান অধিকার করিয়াছেন। অথচ বেদ হইতে পুরাণ তন্ত্ৰ পৰ্য্যন্ত সকল ঋষিপ্রণীত শাস্ত্রই বার বার বলিয়া রাখিয়াছে যে, নারী নরের অৰ্দ্ধাঙ্গস্বরূপিণী, ধৰ্ম্মকৰ্ম্মের সহচরী! বেদের কোন যজ্ঞই পত্নী ব্যতীত হইবার জো নাই; অগ্নিহোত্ৰী হইতে হইলে পত্নী চাহি। পৌরাণিক ক্রিয়াকৰ্ম্ম পত্নীর সহিত করিতে হয়; পত্নীসঙ্গবৰ্জিত হইয়া তীর্থদর্শন করিলে সে দর্শন ব্যর্থ হয়; শ্ৰাদ্ধ শান্তিও পত্নী সহ করিতে হয়। শক্তিশূন্য হইয়া কোন যজ্ঞ করিবার উপায় নাই। দীক্ষা গ্ৰহণ করিতে হইলে পতি পত্নী একসঙ্গে লইতে হইবে; জপ যজ্ঞ করিতে হইলে পতি পত্নী একসঙ্গে করিতে হইবে; মহানির্বাণতন্ত্র স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, ভৈরবীচক্ৰে পত্নীকে শক্তিরূপে পাইলে অন্য নারীর প্রয়োজন হয় না। অন্য নারীকে শক্তি করিতে হইলে শৈব পদ্ধতিমতে তাহাকে বিবাহ করিয়া, পত্নীর পদে বরণ করিয়া, তবে চক্ৰে বসিতে হইবে। যাহার পত্নী নাই, তাহার কোন বৈধ কৰ্ম্মে অধিকার নাই; সে গৃহস্থাশ্রমে থাকিতেই পারে না। তাহাকে হয় প্ৰব্ৰাজ্য গ্ৰহণ করিতে হইবে, নহিলে বানপ্ৰস্থ অবলম্বন করিতে হইবে। গৃহস্থাশ্রমে থাকিতে হইলে বিপত্নীক পুরুষকে বিবাহ করিতেই হইবে। অবশ্য যদি কোন গৃহীর পঞ্চাশ বৎসর বয়স অতিক্রান্ত হইলে স্ত্রীবিয়োগ হয়, তাহা হইলে তিনি ইচ্ছা করিলে বানপ্ৰস্থ আশ্রম অবলম্বন করিতে পারেন। কিন্তু গৃহী কািন্ত্রী থাকিতে হইলে তাঁহাকে শৈব মতে বিবাহ করিয়া ঘর সংসার চালাইতে হইবে। ইহাই তন্ত্রের আদেশ। শঙ্করাচাৰ্য্য নারীকে নরকের দ্বার বলিয়াছেন, এই হেতু ব্ৰহ্মানন্দ গিরি শঙ্করাচাৰ্যকে খুব একহাত তিরস্কার কুরিয়াছেন। তন্ত্রমতে নারীই আদ্যাশক্তিস্বরূপিণী—জগন্ময়ী—জগজ্জননী; সুতরাং নারী পূজনীয়া, অৰ্চনীয়া, সাদরে রক্ষণীয়া। খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মে নারীকে শয়তানের প্রলুব্ধ জীব বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্ম অনুসারে নারীসঙ্গ শয়তানের প্ররোচনায় হইয়া থাকে। অতএব মেয়েমানুষ ও মৈথুন খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের সিদ্ধান্ত অনুসারে মহাপাপজ। মনীষী শ্ৰীযুত রামেন্দ্রসুন্দর ত্ৰিবেদী বলেন যে, খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের এবং হঠযোগী নিষ্কামধৰ্ম্মীদিগের নারীর প্ৰতি এই বিতৃষ্ণার ভাব গোড়াকার বৌদ্ধধৰ্ম্মের প্রভাবেই ঘটিয়াছিল। আমরা এ সিদ্ধান্ত অমান্য করিতে পারি না। কিন্তু মজা এই, যে ধৰ্ম্ম বা সাধনপদ্ধতিতে নারীর অত্যন্ত নিন্দা আছে, সেই ধর্মের ধাৰ্ম্মিকগণ পরে লাম্পট্যদোষে দুষ্ট হইয়া অধঃপাতে গিয়াছে। বৌদ্ধ ধর্মের অধঃপতন লাম্পট্যদোষেই ঘটিয়াছিল; খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের অধঃপতনও ঐ লাম্পট্যদোষেই ঘটে। পরে প্রটেষ্টাণ্ট ধৰ্ম্মের প্রচার হইলে খ্ৰীষ্টান ইউরোপ একটু সামলাইয়াছিল বটে, পরন্তু আবার বর্তমান বিলাসপ্রধান সভ্যতার দংশনে আধুনিক ইউরোপে লাম্পট্যের অতিবিস্তার ঘটিয়াছিল। এখন যে ভয়ানক যুদ্ধ চলিতেছে, তাহার পরিণামে ইউরোপের লাম্পট্যদোষের কতকটা সংবরণ হইতে পারে।

সে যাহা হউক, এই নারীর নিন্দা হইতেই আমরা মৈথুন কাৰ্য্যের নিন্দা করিতে শিখিয়াছি। যে কাৰ্য্যের ফলে জীবসৃষ্টি হইবে, প্ৰজাবৃদ্ধি হইবে,–প্ৰজাবৃদ্ধি ও জীবসৃষ্টির জন্যই যাহার বিধান, তাহার নিন্দা করিতে নাই; উহাকে একটা গুপ্ত কাণ্ড বলিয়া উহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে নাই। উহাকে চাপিলেই-লুকাইলেই লাম্পটার বৃদ্ধি হইবে, লোকে গুপ্ত পিশাচে পরিণত হইবে। কেবল তাহাই নহে, নরনারীর সঙ্গমটাকে জঘন্য ব্যাপার বলিয়া পরিচিত করিলেই, তাহার পর হইতে দুর্বল পুত্ৰ কন্যা উৎপন্ন হইবে, যথাশাস্ত্ৰ বংশরক্ষা দুষ্কর হইবে। জৰ্ম্মন মনীষিগণ এইটুকু বুঝিতে পারিয়াই গত কুড়ি বৎসর কাল জৰ্ম্মানির চিকিৎসকগণ মৈথুনের সায়ান্স-সম্মত পদ্ধতি প্ৰকাশ্যভাবেই ব্যাখ্যা করিতেছেন। অধ্যাপক শেঙ্ক ইহার প্রধান ব্যাখ্যাতা। চিকিৎসক ও তত্ত্বজ্ঞগণের পরামর্শ অনুসারে পরিচালিত হওয়ায় জৰ্ম্মন জাতির মধ্যে বন্ধ্যা নাই বলিলে অত্যুক্তি হইবে না; তাই আজ সংখ্যায় জৰ্ম্মান জাতি ইউরোপের শিরোমণি; কেবল তাঁহাই নহে, সুপুষ্ট সবলকায় পুত্র কন্যায় আজ জৰ্ম্মনি পূর্ণ। জৰ্ম্মনির বিদ্বজ্জনসমাজে জীবসৃষ্টির পদ্ধতির ব্যাখ্যা লজ্জাজনক নহে। আমাদের দেশে যখন তন্ত্রধৰ্ম্ম প্রবল ছিল, তখন মৈথুনটা গোপ্য, নিন্দনীয় ও জঘন্য ব্যাপার বলিয়া পরিচিত ছিল না। খ্ৰীষ্টানী বুদ্ধিতে এখন তন্ত্রের পঞ্চ মকারের নিন্দা করিলে চলিবে কেন? আবার মজা এই, যাঁহারা প্রকাশ্যে পঞ্চ মকারের নিন্দা করেন, তাঁহাদের অনেকে ভিতরে ভিতরে এক একজন মিথুন-মাস্টার। কাহারও পত্নী প্রতি একাদশ মাসের শেষে এক একটি নব কুমার বা কুমারী স্বামিচরণে উপঢৌকন দিতেছেন এবং বর্ষে বর্ষে এমনই উপঢৌকন দিতে দিতে শেষে ক্ষয়রোগে তনু ত্যাগ করিতেছেন। কেহ বা গুপ্তভাবে দুই তিনটি কামপত্নী রাখিয়াছেন; কেহ বা পরনারী দেখিলে নয়নপথে তাঁহাদের আড়ে গিলিতে চাহেন। তন্ত্রের দৃষ্টিতে এবম্প্রকারের লাম্পট্য অতিপাতক, মহাপাতক বলিয়া পরিচিত। বাহিরের লেপাফাদোরস্ত সাধুতা তন্ত্রের হিসাবে বেজায় দোষের—মহাপাপজ। তন্ত্র ভাবের ঘরে চুরি করিতে, প্রবৃত্তি লইয়া লুকাচুরি করিতে বার বার নিষেধ করিয়াছেন। তন্ত্র, প্ৰকাশ্য দুষ্ট নষ্ট নর নারীকে ক্ষমা করিতে পারেন, পরন্তু কপট শঠকে কখনই ক্ষমা করেন না। তন্ত্র বলেন, গুরুর কাছে হৃদয়ের কপাট খুলিয়া দেখাইবে, লজ্জাবোধ করিবে না। তাই তন্ত্র শিষ্যের কাছে—তন্ত্রপাঠকগণের কাছে কিছুই লুকাইয়া রাখেন নাই। ইহা দোষের নহে, বরং শ্লাঘার বিষয়।

অবশ্য ইহা স্বীকাৰ্য যে, তন্ত্রধৰ্ম্মের বেজায় অধঃপতন ঘটিয়াছিল। মানুষের ব্যবহারে ধৰ্ম্মমত উন্নত হয় বা অধঃপতিত হয়। মানুষ ভাল হইলে ধৰ্ম্ম ভাল হয়, মানুষ মন্দ হইলে ধৰ্ম্মকৰ্ম্মও মন্দ হইয়া যায়। মানুষের প্রকৃতি ও প্ৰবৃত্তির দোষে পৃথিবীর সকল প্ৰধান ধৰ্ম্মই নষ্ট হইয়াছে, মানুষের ব্যবহারের গুণে অনেক সামান্য ধৰ্ম্ম উন্নত হইয়াছে। জাতির অধঃপতন ধৰ্ম্মের দোষে ঘটে না। বিলাসে মানুষকে নষ্ট করে, হীন হেয় করিয়া তোলে; মন্দ লোকের প্রভাবে ধৰ্ম্ম ও কপটতার আশ্রয় হইয়া উঠে। ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়া কত বিলাসী জাতি যে কত পাপ করিয়াছে, কত পশুত্বের প্রচার করিয়াছে, তাহা হিসাব করিয়া বলা যায় না। জাতি বিলাসী না হইলে ধৰ্ম্ম বিলাসের আশ্রয় হয় না। সুতরাং ধৰ্ম্মকে নিন্দা করিতে নাই; যেমন মানুষে যে ধৰ্ম্মের। যেমন ভাবে আচরণ করিবে, সেই ধৰ্ম্ম তেমনই ভাবে ফুটিয়া উঠিবে। মানুষের দোষে তন্ত্রধৰ্ম্ম নষ্ট হইয়াছে, মানুষের দোষে ভারতবর্ষের অন্য সকল ধৰ্ম্মও নষ্ট হইয়া গিয়াছে। তবে এখনও যেখানে সাধনা, যেখানে আরাধনা, সেইখানেই তন্ত্রের প্রভাব পরিস্ফুট। আত্মশক্তির উন্মেষ যিনিই করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, তাঁহাকেই তন্ত্রের আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে হইয়াছে। ইসলাম ধৰ্ম্মের সুফীগণ, খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের মঙ্কগণ-যাহারাই সাধনা করিয়াছেন, র্তাহাদিগকেই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তন্ত্রের আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে হইয়াছে। অর্থাৎ সাধনার একটা পদ্ধতিই এখন পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই প্ৰচলিত আছে। সে পদ্ধতি আমাদের দেশে তন্ত্রপদ্ধতি বলিয়া। পরিচিত, অন্য সকল দেশে অন্য নামে পরিচিত; পরস্তু আসলে সকল দেশের সাধনাই একই রকমের। এই যে পঞ্চ তত্বের বা পঞ্চ মকারের সাধনা, ইহা তান্ত্রিকদিগের মধ্যে যেমন ভাবে প্ৰচলিত, অন্য সকল ধৰ্ম্মাবলম্বীদিগের মধ্যেও দেশভেদে ও রুচিভেদে কিঞ্চিৎ আকারান্তরিত হইয়া প্ৰচলিত আছে। কেহ বা মোটামুটি বাহিক হিসাবে করে, কেহ বা মানস পূজার হিসাবে করে, কেহ বা ষট্‌চক্ৰ ভেদের পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া করে। আবার তন্ত্রে পঞ্চ মকারের অনুকল্পের ব্যবস্থাও আছে। যথা-সুরার পরিবর্তে ডাবের জল, মিছরির সরবৎ, এমন কি, তাম্রাধারে জল পৰ্য্যন্ত অনুকল্প বিধান করা হইয়াছে। যাহার যেটা সহে, যাহার যেমন জীবন, যেমন রুচি প্ৰবৃত্তি, তাহার জন্য তেমনই ব্যবস্থা করা হইয়াছে। তন্ত্র বলেন-তোমার আত্মা যখন তোমার ইষ্ট, তখন আত্মতৃপ্তির জন্য তুমি যাহা করি, তাহাই ইষ্টদেবকে নিবেদন করিয়া করিবে। তুমি মদ্যপান নিয়মিত করিয়া থাক, মদ্যপানে বেশ আনন্দ বোধ করিয়া থাক, অথচ তুমি সুরা নিবেদন করিয়া পান কর না। যদি সত্যই বুঝিয়া থাক যে, মদ্যপান করিলে পাপ হয়, তাহা হইলে উহার পরিহার কৰ্ত্তব্য। তেমনই মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, যাহাঁই তুমি উপভোগ করিবে, তাহাই দেবতার প্রসাদ করিয়া খাও,–ইষ্টদেবীকে দিয়া আত্মতুষ্টি সাধন কর। দেবতাকে উপভোগ করাইয়া, অর্থাৎ দেবতাকে নিবেদন করিয়া, প্ৰসাদবোধে সকল সামগ্ৰী উপভোগ করিলে, উপভোগের মুখে একটা গণ্ডী পড়ে। মানুষের মধ্যে যে পশু আছে, সে পশু অবাধে প্ৰবৃত্তির পথে নাচিয়া খেলিয়া বেড়াইতে পারে না। তুমি তখন যেখানে সেখানে মদ্যপান করিয়া বেড়াইতে পরিবে না। যেখানে সেখানে মৎস্য, মাংস, মুদ্রার উপভোগ করিতে পারিবে না। সংযমের পক্ষে ইহা একটা প্রশস্ত উপায়। তন্ত্র বলিতেছেন, তোমার সঙ্গেই তোমার দেবতা ফিরিতেছেন, তোমার দেহাভ্যন্তরেই আছেন। তাঁহাকে তোমার সকল উপভোগ্য সামগ্ৰী নিবেদন করিতেই হইবে; কারণ, মায়ের ছেলেকে মায়ের প্রসাদ ছাড়া অন্য কিছু খাইতে নাই। যেমন করিয়া প্ৰসাদ করিতে হয়, তাহার পদ্ধতি তন্ত্রে লেখা আছে; সেই পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া তোমার উপভোগ্য সকল সামগ্ৰী প্ৰসাদ করিয়া লইবে। তন্ত্রের এই আদেশ মান্য করিয়া চলিলে, যেখানে সেখানে, যখন তখন মদ্যপান করা বা মৎস্য মাংস,মুদ্রার উপভোগ করা চলে না। মৈথুনেরও বেজায় বন্ধন আছে, সে সব জপ তপ করিয়া, মন্ত্র পাঠ করিয়া লতাসাধনা যে-সে মানুষের কৰ্ম্ম নহে।

ইহা ত গেল এক পক্ষের কথা। সাধনার হিসাবে, আত্মশক্তির উন্মেষের হিসাবে এই সকল সামগ্রীর একটা উপযোগিতা আছে। যে সাধনার পথে অগ্রসর হয় নাই, বস্তুতত্ত্বের খবর রাখে না, তাহদের সে উপযোগিতার কথা ভাষার সাহায্যে বুঝান যায় না। আত্মশক্তির উন্মেষ কেবল মনুষ্যদেহেই হয় না, জীব জন্তুর দেহেতেও আত্মার বিকাশ ঘটে, এক একটা অপূর্ব শক্তির উন্মেষ হয়। সাধকের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সেই সকল শক্তির প্রয়োজন হইয়া থাকে। তখন সাধক বিশেষকে জীববিশেষের জীবন-সাধন করিতে হয়। যাঁহারা শিবাসাধনা করেন, তাহারা শৃগালের ন্যায় কিছু কাল অবস্থিতি করেন। ইহা অঘোরপন্থার কথা। কোথায়—কোন জীবে কোন আত্মশক্তি কেমন ভাবে ফুটিয়াছে, তাহা ত আমরা জানি না; যখন যেটা জানিতে পারি, তখন সেইটার সাধন করিয়া আয়ত্ত করিবার চেষ্টা করি। ঠিকমত, আয়ত্ত হইলে একটা সিদ্ধির লাভ হয়। এক একটি করিয়া সিদ্ধি সঞ্চয় করিয়া যখন বিশেষ ঐশ্বৰ্য্যশালী হওয়া যায়, তখনই তামসুদৰ্শন ঘটে, দেহগত আত্মার এবং বিশ্বব্যাপী আত্মার পরিচয় হয়। শক্তি সর্বত্র সমানভাবে ছড়ান আছে,–সর্ববস্তুতে, সর্বপদার্থে শক্তি আছেই। কোথায় সে শক্তির কেমন ক্রিয়া হইতেছে, তাহা কে বলিতে পারে? বিষ্ঠা মনুষ্যদেহে থাকিলে মহাবিষে পরিণত হয়, কিন্তু মাটিতে পড়িলে উহা শ্ৰেষ্ঠ সার, শূকরের উহা প্রধান ভোজ্য। তোমার পক্ষে যাহা হেয়, অন্যের পক্ষে তাহা শ্ৰেয়:। অতএব সংসারে হেয় শ্ৰেয়; কিছু নাই, পাপ পুণ্য কিছু নাই। অবস্থা গতিকে পাত্রের হিসাবে কোনটা কখন বা হেয়, কখন বা শ্ৰেয়ঃ, কখন বা পাপজ, কখন বা পুণ্যাত্মক। এই সংসারে তোমার আমার বুদ্ধির মাপকাঠিতে যাহা কিছু সদসৎ আছে, তাহদের মধ্যে যে শক্তি আছেন, তিনিই আৰ্দ্ধাশক্তি, তিনিই মহামায়া। তাঁহাকে যেখান হইতে পার, সেইখান হইতে টানিয়া বাহির করিতে হইবে। এই শক্তিসংহরণের নামই সাধনা। মাতাল না হইলে গোটকয়েক আত্মশক্তির বিকাশ হয় না-তা ভাবেই মাতাল হও, ভক্তিতেই মাতাল হও, কীৰ্ত্তনানন্দে মাতাল হও, তোমাকে মাতাল হইতে হইবে,–নইলে শক্তির বিকাশ ঘটিবে না। তন্ত্র এক সম্প্রদায়ের সাধকের জন্য সোজাসুজি মদের ব্যবস্থাই করিয়াছেন। রিরংস হইতে আর এক শ্রেণীর শক্তির বিকাশ হয়; এ কথাটা সকল সম্প্রদায়ই স্বীকার করেন। সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কৰ্ত্তাভজা, পরকীয়া সাধনা—সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত। তন্ত্র উহার উপর ভাবের আবরণ রং চড়াইয়া, উহাকে মধুরতর না করিয়া, সোজাসুজি পঞ্চতত্ত্বে মৈথুনের ব্যবস্থা করিয়াছেন। ইঙ্গিতে যতটুকু পারিলামবলিলাম; ইহার অধিক আর বলা যায় না, বলিতে নাই। আবার বলিয়া রাখি, তন্ত্রের মধ্যে শক্তিসাধনার অসংখ্য ও অনন্ত পদ্ধতি নির্দিষ্ট আছে। যাহা তোমার ভাল লাগে, তাহা তোমার পক্ষে ভাল; যাহা আমার ভাল লাগে বা উপযোগী, তাহা আমার পক্ষে ভাল। তুমি নিজের পন্থার যশ কীৰ্ত্তন করিতে পার, আমি আমার পন্থার বিজয় ঘোষণা করিতে পারি; কিন্তু আসলে সব এক, সেই আত্মদর্শনচেষ্টা, ইষ্টের সাক্ষাৎকার।

(‘প্রবাহিণী’, ২৭ আষাঢ় ১৩২২)

প্ৰবাহিণী
আশা

কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্!–দুঃখ দারিদ্র্যের, হতাশা ও নৈরাশ্যের উপলখণ্ডময় আমার বন্ধুর জীবন-পথের উপর দিয়া চল প্ৰবাহিণী-তরল তরঙ্গে স্ফটিকস্বচ্ছ জলকণা বিকিরণ করিয়া, চল প্রবাহিণী–তোমার স্পর্শে, এ দগ্ধ জীবনের মরু-মারুত আশা-স্নেহের শীকর-সম্পউক্ত হউক! তোমার কোটিতরঙ্গ-কল্লোল-কোলাহলে জীবনের নীরব বেদনাসকল, মুখর হউক! চল প্রবাহিণী,–পৰ্ব্বত ভেদ করিয়া, স্থবিরকায় তুষাররাশিকে বিগলিত করিয়া, নৈরাশ্যের বালুক-বিস্তারকে স্নেহ-সেচনে কোমল ও সরস করিয়া, চল প্রবাহিণী,—আগে চল।

কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্! কোটি বীচি-বল্লরীর ঘাত-প্ৰতিঘাতে আশার রজতনিক্কণ শুনিতে শুনিতে আমার জীর্ণ দেহ তোমার তরঙ্গে ভাসিয়া চলুক। প্রবাহিণী, ভাসিয়া চল!—আগে চল! ঐ দেখ,–ঐ দূরে মহাশ্মশান-কোটি চিতার চটপটারবে নিত্য শব্দময় ঐ শ্মশানে রাবণের চিতা জ্বলিতেছে। কোটি কল্পের গৌরব-স্মৃতি, দশস্কন্ধ রাবণরূপে ঐখানে অহরহঃ জ্বলিতেছে! ঐখানেই সীতার অগ্নিপরীক্ষা হইয়াছিল,—লঙ্কার ঐ মহাশ্মশানেই ধরা-কন্যা নিষ্কলঙ্কা হইয়াছিলেন;-সনাতন কালের, সনাতনী কথার চন্দন-চুল্পী ঐখানেই জ্বলিতেছে! চল প্রবাহিণী, —ঐ ভীম। ভৈরব শ্মশানের তিন দিক বেড়িয়া আমরা উভয়ে ভাসিয়া যাই। চল, চল, আগে চল!

‘যমুনে! এই কি তুমি সেই যমুনা প্রবাহিণী–
যার বিমল তটে রূপের হাটে বিকাত নীলকান্ত মণি।’

কাল ও কালিন্দী–ভাই ও ভগ্নী। যম যমুনার সহোদর–কাল ভাবস্রোতে বিশ্বগতির ভিতর দিয়া ছুটিয়াছেন;–কালিন্দী রসের তরঙ্গে প্রেমের ব্ৰজমণ্ডল দ্বিখণ্ডিত করিয়া অনন্ত রস-সাগরের দিকে ছুটিয়াছেন। চল প্রবাহিণী-সেই রকম কুলু কুলু ধ্বনি করিয়া চল! যে ধ্বনি গোপীদিগের নূপুর-শিল্পনের প্রতিধ্বনি বলিয়া এখনও রসিকে মনে করেন! যমুনার সেই রস-তরঙ্গভঙ্গের অভিব্যঞ্জনা করিয়া গুপ্ত বৃন্দাবনের শ্যাম-শোভা দেখিতে দেখিতে, চল প্ৰবাহিণী—সেই সনাতন যামুন খাত বাহিয়া চল;–সেথায় রূপের হাট দেখিবে! তোমার গর্ভসঞ্চিত কোটি নীল জলকণাকে নয়নীরূপে পরিণত করিয়া,–চল প্ৰবাহিণী, রূপের হাট বাহিয়া আমরা চলিয়া যাই! তোমার চঞ্চল গতিতে আবার যমুনা উজান বহিবে। সেই নীলকান্ত মণির তনু-কান্তি-প্ৰতিচ্ছায়ায় তোমার অঙ্গ নীল বরণ ধারণ করবে। চল—চল—আগে চল!

কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্! আর বিলম্ব সহে না! জীবনের পাড়ি প্রায় শেষ করিয়াছি। সন্ধ্যার ঘন তমিস্রা ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, অজ্ঞাতসারে চারি দিকে আসিয়া যবনিকার মত ঝুলিয়া পড়িতেছে! সন্ধ্যার মঙ্গল-তারা ঐ দূরে চক্রবালের উপর, কাৰ্ত্তিকের নদী-প্রদীপের মত টিপি টিপি ফুটিয়া উঠিতেছে। অস্তমিত সূৰ্য্যের সপ্ত দীপ্তি ক্ৰমে অন্ধকারের ক্ৰোড়ে লুকাইল। এইবার গৃহস্থের সান্ধা মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়া উঠিবে। আর বিলম্ব সহে না। চল প্রবাহিণী—আগে চল! এখনও যতটুকু সময় বাকী আছে, সেই সময়টুকুর মধ্যে তোমার কৃপায় যত দূর পারি, আগাইয়া যাই! জানি বটে, অনন্ত সাগরের অসীমতায় ডুবিবার অবসর হইবে। না।;-জানি বটে, ‘এবার বা আসা হয় বিফল।’ এবারকার যাত্রা, শুভ যাত্রা নহে। এ দুৰ্গম পথ হাটিয়া শেষ করিতে পারিব না। অনন্তের দেখা পাইব না। তবুও আশা ত ছাড়িতে ‘পারি না! তবুও মনে হয়, প্রদোষের এই মুহূৰ্ত্তকালের মধ্যে তোমার কুপাস্রোতের—করুণার তরল তরঙ্গের উপর গা ভাসাইয়া যাইতে পারিলে, হয়ত বা অনেকটা পথ আগাইয়া যাইব! সাগর-সঙ্গমে পৌঁছিতে না পারি। —মুক্ত-বেণীর মোহনাও ত দেখিতে পাইব! চল প্রবাহিণী–আগে চল। আর যে বিলম্ব সহে না।

মনে পড়ে কত কথা! একে একে স্মৃতির সরোবরবক্ষে কত ব্যথা বুদ্ধদের আকারে ফুটিয়া উঠিতেছে,–নৈরাশ্যের পবন-তাড়নে আবার তাহারা ফাটিয়া গালিয়া কোথায় বিলীন হইয়া যাইতেছে! এই নৈরাশ্যজাডো তুমি আশার গতি! তুমি চলিয়াছ বলিয়া আমিও চলিতে পারিব। তোমার গতি আছে বলিয়া আমার স্থিতির বিসৰ্পণ সম্ভবপর হইবে। আমার অতীতের কালরাত্ৰি অনাগতের উষার দু্যতিতে প্ৰফুল্ল হইয়া উঠিবো! চল, চল প্ৰবাহিণী! স্নেহময়ী-কোটি-আশাবলয়িত তরঙ্গিণী-চল! ভাবের জলরাশি শত উচ্ছাসে উচ্ছাসিত করিয়া তুমি আগে চল! আমার নিথর নিষ্কম্প নৈরাশ্য-সরোবরে গতির শত-তরঙ্গপ্ৰফুল্লিত আশা-মেখলা পরিস্ফুট হইয়া উঠক! চল, চল—আগে চল।

এই সাধ–এই বাসনা—এই আকাঙ্ক্ষা।

“আমি রূপ-সাগরে, পালের ভরে ভেসে যাব।
তরঙ্গ-তুফানে পড়ে ডুবিয়া মরিব।”

ডুবিয়া মরিব,–ভাসিব না! অতল তলে একেবারে মিশিয়া যাইব। আমার আছে নাম,–আর আছে রূপ! সে নাম স্মৃতির চিন্তা-চুল্লীতে অহরহঃ পুড়িতেছে! সে রূপ চিন্তা-অঙ্গের কোটি অগ্নি-জিহবার বেষ্টনে লোল তরঙ্গে ফুটিয়া উঠিতেছে! থাকিবে না কিছু। সব পুড়িয়া ভস্ম হইবে। সে ভস্ম শ্মশান-বায়ুবিতাড়নে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িলে আমি মরমে মরিব। কিন্তু সে ভস্ম, সে বিভূতি আনন্তের নীল অঙ্গে মিশাইয়া দিতে পারিলে কোটি জন্মের তপস্যা সিদ্ধ হইবে। চল চল প্রবাহিণী-ফেব্রুপালের হা-হা রবকে স্তব্ধ করিয়া, শুষ্ক বায়ুর স্বনানকে নিঃশব্দ করিয়া তোমার রসের তরল তরঙ্গের কোটিকণ্ঠে উল্লাস-গীতি গায়িতে গায়িতে—চল প্রবাহিণী-রূপ-সাগরের দিকে অগ্রসর হও! তোমার প্রত্যেক তরঙ্গাভিঘাতে নামের প্রতিধ্বনি জগন্ময় হইয়৷ উঠক! তোমার স্বচ্ছ সলিল বিস্তারে রূপের অমল ধবল সুন্দর রেখা-উদ্ধে ও নিয়ে যুগল ইন্দ্ৰধনুর ন্যায় ফুটিয়া উঠক! আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হউক! মিটবে না কি ? এ সাধ—এ বাসনা মিটবে না কি ? আশা মিটে না,–আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না। গগনোেপাস্তরেখার মত-যত ধরিতে যাইবে, ততই ছুটিয়া পালাইবে ; কিন্তু চেষ্টায় যে সুখ আছে-ছুটাছুটিতে যে উন্মাদনা আছে—ধরি। ধরি করি ধরিতে নারি, এই প্রয়াসে যে তৃপ্তি আছে, তাহা ত জীবনে আর কিছুতে নাই! তাই বলি, চল প্রবাহিণী, আগে চল। কুল কুল, কুল কুল, কুল কুল,–রজতকিঙ্কিণীর এই নিকণে আমায় আশা-সুখে মুগ্ধ করিয়া চল প্রবাহিণী—আগে চল।

(প্রবাহিণী, ৩ মাঘ ১৩২০)

রূপোল্লাস

‘রসো বৈ সঃ’—শ্ৰীভগবান রসময় এবং রসগ্ৰাহ্য। এই রস নাম এবং রূপের সাহায্যে অনুভূতিগম্য। এই রসকে বুঝিতে পারিলে শ্ৰীভগবানকে বুঝা যায়। সুতরাং নাম ও রূপ না বুঝিলে ভগবৎ-অনুভূতি সম্ভবপর হয় না। ইংরেজীনবীস দার্শনিকগণকে দুইটি ইংরেজী প্রতিশব্দে নাম ও রূপের মৰ্ম্মের কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত করা সম্ভবপর হইতে পারে। ইংরেজী দার্শমিক ভাষায় নামকে Concept বলিয়া ভাষান্তরিত করিতে পারি; রূপের প্রতিশব্দ Percept বলিলেই বোধ হয়, পৰ্যাপ্ত হইতে পারে। Concept এবং Percept এই দুই বিষয়ে সমন্বয় সাধন করিতে পারিলে ভগবৎবিভূতির আংশিক অনুভূতি হইতে পারে।

বিষয়টা আরও একটু খুলিয়া বলিবার চেষ্টা পাইব। কেন না, ভক্তিশাস্ত্র এবং ভগবদ্যারাধনাপদ্ধতি এই নাম ও রূপের বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। ভারতবর্ষের উপাসনাপদ্ধতি ঠিকমত বুঝিতে হইলে, নাম ও রূপের–অন্তর্নিহিত গুপ্ত কথা কিছু বুঝিতেই হইবে। অম্ভণকন্যা বাককথিত দেবীসুক্তের আত্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা অবলম্বন করিয়া শাণ্ডিল্য ও নারদ ভক্তিসূত্র রচনা করিয়াছেন–সেই ব্যাখ্যার বিবৃতি মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে সম্যক ভাবে করা হইয়াছে। —তন্ত্রের সকল সিদ্ধান্তগ্রন্থেই ঐ ব্যাখ্যাই হেঁট মুণ্ডে গ্ৰহণ করা হইয়াছে;-বৈষ্ণব ভক্তিসাধনপদ্ধতিতে ঐ ব্যাখ্যা অগ্ৰাহ করা হয় নাই। দেবীসূক্ত না বুঝিলে ভক্তিশাস্ত্র বুঝা যায় না। মনীষী শ্ৰীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্ৰিবেদী ‘কালস্রোত’ নামক একখানি পুস্তকের সূচনা লিখিতে যাইয়া দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিতে প্ৰয়াস পাইয়াছেন। ‘সাহিত্য’ নামক মাসিক পত্রে গত দুই বার দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে এই সন্দর্ভলেখকও দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিতে যত্নশীল হইয়াছেন। এই সকল গোড়ার কথার একটু পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন; কেন না, নাম ও রূপ বুঝিতে হইলে একটু গোড়ার কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক।

এই সৃষ্টিপ্ৰহেলিকার মধ্যে এক জ্ঞাত আমি; আমি ছাড়া আর যাহা কিছু, তাহা আমারই জ্ঞেয়; জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের সম্বন্ধ যাহার দ্বারা সাধিত হয়, তাহাই জ্ঞান। সুতরাং সৰ্ব্বাগ্রে জ্ঞাতাকে বুঝিতে হইবে। জ্ঞাতা আমি–দশোন্দ্ৰিয়সংযুক্ত, শ্রবণ-মনন-নির্দিধ্যাসনসমেত, একাদশ আসক্তিসমন্বিত দেহী আমিই জ্ঞাত। আমি কে? বলিতে পারিলাম না। আমি কে। তবে এইটুকু বুঝি যে, আমি সর্বময় ও সর্বব্যাপী। দর্শন, শ্রবণ, আস্বাদন, আত্মাণ প্ৰভৃতির সাহায্যে আমি যাহাদের বা যে সকল বিষয়ের অনুভূতি সাধন করিয়া থাকি, সে সকলই আমিময়, আমার আমিত্বে মাখা, আমার বৈশিষ্ট্যবিজড়িত। অম্ভণকন্যা বাক শ্রুতির অপূর্ব ভাষায় এই সিদ্ধান্তটি মানবসমাজকে এবং সাধকবর্গকে বুঝাইয়া দিয়াছেন। শ্ৰীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর যে প্ৰকার সরল ভাষায় দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা অধিকতর সরল ভাযায়। উহার ব্যাখ্যা সম্ভাবে না। বাহুল্যভয়ে আমি তাহার সন্দর্ভের পুনরুদ্ধার করিলাম না, এবং গত কার্ত্তিক মাসের ‘সাহিত্যে’ প্ৰকাশিত “উপাসনাতন্ত্ৰ” শীৰ্ষক আমার লিখিত সন্দর্ভের অংশবিশেষ উদ্ধার করিলাম না। সুধী পাঠক এই দুইটি সন্দর্ভ পড়িয়া লইলে, লেখকের পরিশ্রমের লাঘব হইবে। ঐ দুইটি সন্দর্ভের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করিয়া আমরা নাম ও রূপের আলোচনা করিব।

বলিয়াছি ত, নাম concept অর্থাৎ যাহা চিন্তার অভিজ্ঞান, যাহা নিজে বুঝি, পরকে নিজের মতন করিয়া বুঝাইতে পারি না,-যাহ ভিতরে ফুটিয়া উঠে, বাহিরে শব্দমাত্রে অভিব্যক্ত হয়,-যাহা অনেকটা মূকাস্বাদনবৎ, বোবার মিষ্টান্ন আস্বাদনের মতন, ভোজনান্তে যে আহিলাদের প্রকটন হয়, তাহা কদাচিৎ একটা চীৎকারে অভিব্যক্তি হইলেও হইতে পারে,-তাহাই নাম। শিশুকে দাম্পত্য রসের আস্বাদন দেওয়া যায় কি? যে জন্মমাত্রেই পিতৃহীন, তাহাকে পিতৃস্নেহের মৰ্ম্ম বুঝান যায় কি? সূৰ্য্যোদয়, সূৰ্য্যাস্ত প্রভৃতি নৈসৰ্গিক লীলা তুমি আমি সবাই দেখি-নয়ন ভরিয়া দেখি। পরন্তু সে রূপ দেখিয়া উভয়ের মনে যে ভাবোদয় হয়, তাহ কেহই কাহাকেও ঠিকমত বুঝাইতে পারি না। বুঝাইতে পারি না বটে, তবে বুঝাইবার চেষ্টায় ইঙ্গিত করিয়া থাকি। তুমি আমার ভাবের ভাবুক হইলে সে ইঙ্গিত কতকটা বুঝিলেও বুঝিতে পার। এই ইঙ্গিতই নাম। অন্তরঙ্গ ভাবের দ্যোতনাকেই নাম বলা যায়। তাই নাম বড়, রূপ তদপেক্ষা ছোট। তাই কৃষ্ণ অপেক্ষা কৃষ্ণনামের গুরুত্ব অধিক। রূপবিলাসিনী সত্যভামা এইটুকু বুঝিতে পারেন নাই,–কেবল রূপসাগরেই ডুবিয়াছিলেন, রূপের মহত্ত্বে বিমূঢ় ছিলেন ; দৰ্পহারী মধুসূদন অপুর্ব ছলে সত্যভামার সে ভ্রম অপসারণ করিয়াছিলেন। মহাভারতের পারিজাতহরণ এবং সত্যভামার দর্পচূৰ্ণ আখ্যায়িকা, নামের মাহাত্ম্যই, অর্থবাদের সাহায্যে বুঝাইয়াছেন।

রূপ–percept। যাহা রসগ্রাহ্য, তাহাই রূপ; যাহা অনুরাগ ও বিরাগের বিষয়ীভূত, তাহাই রূপ; যাহা অনুভবীর মানস পটে ফুটিয়া উঠে, যাহা ছায়া প্ৰতিচ্ছায়ার হিসাবে ভিতরে ও বাহিরে-বাহিত্যু প্ৰকৃতিতে এবং অন্তঃপ্রকৃতিতে প্রকট হয়, তাহাই রূপ। কেবল বাহ প্ৰকৃতি রূপ নহে, দশোন্দ্ৰিয়গ্ৰাহী যাহা, কেবল তাহাই রূপ নহে। প্রকৃতির আস্তরণে রসের বিকাশ হইলেই রূপ ফুটিয়া উঠে। রূপ ফুটে বটে, পরন্তু উহার উপভোগে তৃপ্তি নাই৷

“জনম অবধি হাম সে রূপ নেহারিনু
নয়ন না তিরপিত ভেল।“

তৃপ্তি হয় না, যত দেখি, তত আরও দেখিতে সাধ যায়,–নয়নময় হইয়া মীনের ন্যায় নির্নিমেষ নয়নে অনবরত দেখিতে থাকিলেও দেখার সাধ মিটে না। কেন না, অনুরাগাপিপাসার উপর দর্শন স্পৰ্শন আদি ক্রিয়ার প্ৰতিষ্ঠা। এই গতিশীল সৃষ্টিচাতুরীর মধ্যে স্থির কিছু নাই; সব চলিতেছে, ক্ষণে ক্ষণে সকলের পরিবর্তন হইতেছে। কাজেই যাহা দেখিতে সাধ যায়, নয়ন পালটিলে বা ক্ষণকাল অতিবাহিত হইলে তাহা ত আর থাকে না।–যে ছবি নিমেষের জন্য নয়নের উপর পাড়িয়াছিল, তাহা ত আর থাকে না-তাই দেখার সাধ আর মিটে না। অনুভূতিতে তৃপ্তি নাই। — রসের পিপাসা মিটে না। তাই রূপের সাগর-অনন্ত উৰ্ম্মিমালায় আন্দোলিত, কোটি বীচিবল্লৱীখচিত, তরঙ্গভঙ্গবাকুল রূপের সাগর। এ সাগরে স্থির থাকে কাহার সাধ্য! স্থির থাকে না, স্থির থাকা যায় না। বলিয়াই সাধ মিটে না। ‘লাখ লাখ যুগ’ সে রূপ হেরিলেও উহা নিতুই নূতন一ক্ষণে নূতন, পলে পলে নূতন। নবীনতার অসংখ্যা ও অব্যয় আন্দোলনে–প্ৰকম্পিনে–শিহরণে রূপের বিকাশ। ফলে সে রূপে তৃপ্তি নাই।

কিন্তু আছে—তুমি আমায় দেখ, আমি তোমায় দেখি-উভয়ের নবীনতা উভয়ের ভাবে ডুবিয়া যাউক—তাহা হইলেই রূপের তৃপ্তি নাই।

কিন্তু আছে—তুমি আমায় দেখ, আমি তোমায় দেখি—উভয়ের নবীনতা উভয়ের ভাবে ডুবিয়া যাউক—তাহা হইলেই তৃপ্তি সম্ভবপর হয়।

“তুয়া অপরূপ রূপ হেরি দূর সঞে,
লোচন মন দুঁহু ধাব।“

যখন লোচন ও মন-দু-ই রূপ দেখিবার জন্য ধাবিত হইবে, তখন প্ৰাণ হইতে ঝঙ্কার উঠিবে,

‘সজনি, ভাল করি পেখন না ভেল।
মেঘমালা সঞে তড়িতলতা জনু,
হৃদয়ে শেল দেই গেল।।“

এই অতৃপ্তি উভয়ের মনে জাগিয়া উঠিবে। যখন উঠিবে, তখন দেখিবে এবং বুঝিবে,–

‘যত রূপ তত বেশ ভাবিতে পাঁজর শেষ,
পাপ চিতে নিবারিতে নারি।“

তখন মনে মনে স্বতই এই ভাব জাগিয়া উঠিবে, —

‘দুঁহু মুখ সুন্দর কি দিব তুলনা।
কানু মরকত মণি, রাই কাঁচা সোনা ৷।”

তখনই রূপের তৃপ্তি। বিভোরতায়—বিহ্বলতায়—বিমূঢ়তায়—রূপসাগরে ডুবিয়া অতল তলে ডুবিয়া যাওয়ায় রূপের পরিতৃপ্তি। উপভোগ এবং আস্বাদনে নহে। একেবারে আত্মহারা হইয়া পাথরের মত ডুবিতে হইবে, তবে তৃপ্তি সম্ভবপর হইবে।

বিকাশে ও বিলাসে রূপ, সঙ্কোচে এবং কেন্দ্রীকরণে নাম। নাম–বংশীরব; রূপ–ব্ৰজবিলাস। নাম–অনাহত ধ্বনি; রূপ–ধ্যানগম্য বিকাশ। নাম—শ্ৰীরাধা; রূপ–শ্ৰীমতী। নামের আহ্বানে রূপের বিকাশ। প্রথমে বংশীধ্বনি, তবে অভিসার। আর কেমন করিয়া বুঝাইব—নাম ও রূপ কি ও কেমন? জানি তোমায় নামে; সেই নামের উপর রসের ঢেউ খেলিয়া রূপের কোটিবালেন্দুবিকাশ হয়। গায়ত্রীর ঝঙ্কারে জগজ্যোতির অপরূপ রূপ ফুটিয়া উঠে। সে রূপ দেখিয়া তবে ‘তৎসবিতুৰ্বরেণ্যং’কে খুঁজিবার সাধ হয়। শিশু মহাঘোরে মা বলিয়া–ক্ৰন্দনের নাম-রোলে ভূমিষ্ঠ হয়; তাহার পর ধীরে ধীরে বয়ঃপ্ৰাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মাতৃরূপ দেখিতে পায়। নব বসন্তের সূচনার পূর্বেই ভিতরে ও বাহিরে কিসের ও কাহার ডঙ্কা বাজিয়াছে, কাহার কাড়া-নাকার পড়িয়াছে, তাই বৃক্ষচৰ্ম্ম ভেদ করিয়া নব কিশলয়সকল নবানুরাগে লোহিতাভ হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে, কোকিলের রবে পঞ্চমের শব্দমদিরা কে যেন ঢালিয়া দিতেছে,–আমি নয়নময় হইয়া তোমার নূতন রূপ দেখিতেছি। তুমিও আমায় দেখিতেছ। তোমার নবীনতার আপ্লাবনে আমিও ত নিতুই নৃতন; তুমি নবীন কিশোর, রসের সাগর; নবীনা কিশোরীর নবীনতার সুষম তুমিও ত দেখিবে! আমারই মতন নয়নময় হইয়া পলকহীন নয়নে তুমিও ত দেখিবে! আমি গাছভরা ফুলের আলোয় মুগ্ধ হইয়া,দেখিতে থাকি। ফুল কি আমায় দেখে না? নিশ্চয়ই দেখে; নহিলে আমি দেখিব কেন? আমি যাহাকে দেখিয়া পাগল হই, সে নিশ্চয়ই আমাকে দেখিয়া পাগল হয়। চাদ দেখে, সূৰ্য্য দেখে, তারকাগণ। দেখে,–গগনের কোটি শোভা কোটি নয়নে দেখে-তরু লতা পাতা, পুষ্প ফল কোরক,–আব্রহ্ম তৃণ পৰ্য্যন্ত সবাই দেখে। কেন না, আমি যে সকলকে দেখি-বিস্ময়বিস্মফারিত নেত্ৰে কেবলই দেখি। এই দেখাদেখিই রূপোল্লাস, এই নয়নে নয়নে মেশামিশিই রূপোল্লাস।

তুমি আমি দেখাদেখির ব্যাপারে মাতিয়া থাকিলে এ দেখাদেখির মাধুৰ্য্য উপভোগ করিবে কে? সাধকের সেইটুকুই লাভ। সাধক তৃতীয় ব্যক্তি হইয়া দূরে দাঁড়াইয়া কেবল দেখেন। এই মাধুৰ্য্য উপভোগ বৈষ্ণব ভক্তিশাস্ত্রের বিশিষ্টতা; এই তৃতীয়ের অবধারণই ভক্তিশাস্ত্রের মৌলিকতা। তৃতীয় ব্যক্তি না থাকিলে সাধনা যে দুষ্কর হইয়া পড়ে; বিশেষতঃ মধুর রসের সাধনা-প্রেমের উন্মেষ ঘটাইতে হইলে কিছু কালের জন্য তৃতীয় ব্যক্তি হইয়া দাঁড়াইতেই হইবে। দূতী না থাকিলে রসের বিকাশ ঘটবে কেমন করিয়া! ভক্তি এবং প্রেমের এই বিভিন্নতা বুঝিবার ও বুঝাইবার বিষয়। প্রয়োজন হইলে ইহার আলোচনা পরে করিব। আপাততঃ নাম ও রূপের বিবৃতি সংক্ষেপে দিয়া রূপোল্লাসের চিত্ৰ দেখাইলাম। বলিবার কথা বলা হইল না; যিনি বলাইবার মালিক, তিনি কুপা না করিলে বলা হইবে না।

“মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম।
যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম৷।“

(‘প্রবাহিণী, ১০ মাঘ ১৩২০)

ভূমিকা

পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলী বহু দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রে বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে। আমরা দুই খণ্ডে আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত নির্বাচন ও সঙ্কলন করিলাম। বহু প্ৰবন্ধ, নিবন্ধ ও রসরচনা এখনও অবশিষ্ট রহিল, কয়েকটি সাময়িক-পত্ৰ এখনও সংগ্ৰহ করিতে পারা যায় নাই। ভবিষ্যতে সেগুলি হইতে সঙ্কলন করিয়া তৃতীয় খণ্ড রচনাবলী প্ৰকাশ করিবার পথ খোলা রহিল।

আমরা বৰ্ত্তমান খণ্ডে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী যোজনা করিয়া দিলাম; বিস্তৃততর পরিচয় ‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’র ৮২ সংখ্যক গ্রন্থে মিলিবে।

জীবনকথা

১৮৬৬ সনের ২০ এ ডিসেম্বর (৬ পৌষ ১৭৮৮ শক, বৃহস্পতিবার) ভাগলপুরে পাঁচকড়ির জন্ম হয়। তাঁহার পিতা হালিশহর-নিবাসী বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ভাগলপুরে কালেক্টরী আপিসে ওয়ার্ডস ক্লার্ক ও বাটোয়ারী ক্লার্কের পদে নিযুক্ত ছিলেন।

পাঁচকড়ি ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র আদরের সন্তান; তাঁহার শিক্ষা-দীক্ষা পিতার সান্নিধ্যে ভাগলপুরেই সমাধা হয়। তিনি ১৮৮২ সনে ভাগলপুর জিলা-স্কুল হইতে প্ৰবেশিকা পরীক্ষা (১ম বিভাগ), এবং ১৮৮৫ ও ১৮৮৭ সনে পাটনা কলেজ হইতে এফ. এ. (২য় বিভাগ) ও বি. এ. (২য় বিভাগ, সংস্কৃত অনার্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

তরুণ বয়সে পাঁচকড়ি ধৰ্ম্মপ্রচারক শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্ন সেনের দ্বারা বিলক্ষণ প্রভাবিত হইয়াছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্নের ‘ভারতবর্ষীয় আৰ্য্যধৰ্ম্মপ্রচারিণী সভা’ ও ‘সুনীতিসঞ্চারিণী সভা’র জন্য এক সময়ে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়াছিলেন। কিছু দিন পরে মনের অকুশল ঘটায় তিনি শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্নকে ছাড়িয়া পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হন। পাঁচকড়ি লিখিয়াছেন :–’বি.এ. পাস করিয়া কলিকাতায় আসিয়াছিলাম; পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি মহাশয়ের হিন্দুধৰ্ম্ম প্রচারকার্য্যে লেখক ও বক্তারূপে সহায়তা করিতাম।…১৮৮৭ খ্ৰীঃ অব্দ হইতে ১৮৯১ খ্ৰীঃ অব্দ পৰ্য্যন্ত আমি কলিকাতায় আসিতাম যাইতাম, সাহিত্য-চৰ্চা করিতাম, মাসিক ও সাপ্তাহিকে লিখিতাম, তখন আমাদের একটা বড় দল ছিল, সে দলের আনুকূল্য লাভ করিবার জন্য অনেকে আমার আনুগত্য করিতে বাধ্য হইতেন।‘

সম্ভবতঃ ১৮৯২ সনে পাঁচকড়ি ভাগলপুরে টী. এন. জুবিলী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক-পদ গ্ৰহণ করেন। এইখানে ঔপন্যাসিক শরৎ চন্দ্ৰ তাহার ছাত্র ছিলেন। কয়েক বৎসর শিক্ষকতা করিবার পর তিনি সাংবাদিকের ব্ৰত বরণ করেন।

সংবাদপত্র-সেবায় পাঁচকড়ির হাতে খড়ি—‘বঙ্গবাসী’তে। তিনি ১৮৯৫ সনের শেষাশেষি* ‘বঙ্গবাসী’র সম্পাদক হন। স্বনামধন্য ইন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ই ‘বঙ্গবাসী’র সহিত তাহার সংযোগ ঘটান। ‘বঙ্গবাসী’র সংস্রবে। আসিয়া পাঁচকড়ি আত্মোন্নতির প্রভূত সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। ‘বঙ্গবাসী’র প্রতিষ্ঠাতা যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুকে স্মরণ করিয়া তিনি বলিয়াছেন–’আপনার ‘বঙ্গবাসী’র সেবায় নিযুক্ত থাকিয়া আমি বাঙ্গালা। লিখিতে শিখিয়াছি, আপনার ‘বঙ্গবাসী’র সম্পাদক-পদে উন্নীত হইয়া আমি বাঙ্গালীর সাহিত্য-সমাজে সুপরিচিতৃ হইয়াছি।’ কিন্তু এ সকলের মূলে ছিলেন ইন্দ্রনাথ,–’বঙ্গবাসী’র হিতৈষী, পরামর্শদাতা ও লেখক। পাঁচকড়ি সাহিত্য-গুরু হিসাবে তাঁহাকে স্বীকার করিতে কোন দিনই কুষ্ঠিত হন নাই। তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে লিখিয়া গিয়াছেন :–

‘তিনি আমার খাঁটি গুরু মহাশয় ছিলেন, হাতে ধরিয়া লিখিতে শিখাইয়াছিলেন, কত ভঙ্গী করিয়া পড়িতে, বুঝিতে এবং বুঝাইতে শিখাইয়াছিলেন।… এখনও তাঁহারই কথা বেচিয়া খাইতেছি, তাঁহারই সিদ্ধান্তসকল ব্যাখ্যা করিয়া সমাজে স্থান পাইয়া আছি। গুরু, বন্ধু, সখা, ভ্রাতা, পরিচালক-তিনি আমার সব।’।

বিশেষ যোগ্যতার সহিত চারি বৎসর কংগ্রেস-বিরোধী ‘বঙ্গবাসী’ সম্পাদন করিয়া পাঁচকড়ি ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ হইতে কংগ্রেস-সমর্থনকারী ‘বসুমতী’র সম্পাদক নিযুক্ত হন। ইহার দুই বৎসর পরে স্বত্বাধিকারীর সহিত মতবিরোধের ফলে তিনি অমরেন্দ্রনাথ দত্ত-প্ৰবৰ্ত্তিত ‘রঙ্গালয়’ পত্রে যোগদান করেন। পাঁচকড়ি স্বদেশী-আন্দোলনের যুগে ব্ৰহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সন্ধ্যা’তেও নিয়মিতভাবে লিখিতেন। ১৯০৮ সনে তিনি ‘হিতবাদী’র সম্পাদক হন। তিনি আরও কয়েকখানি পত্র-পত্রিকা সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন; ইহার মধ্যে সাপ্তাহিক ‘প্রবাহিণী’ (১৩২০-২২) ও দৈনিক ‘নায়কে’র নাম উল্লেখযোগ্য; শেষোক্ত পত্ৰখানির সহিত তিনি দীর্ঘ কাল যুক্ত ছিলেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মৃত্যু হইলে পাঁচকড়ি সুহৃদের সাধের ‘সাহিত্য’কে কিছু দিন বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন; ১৩২৭ সালের পৌষ-মাঘ সংখ্যা হইতে তিনি ‘সাহিত্যে’র সম্পাদন-ভার নিজ স্বন্ধে গ্ৰহণ করেন।

পাঁচকড়ি দীর্ঘায়ু ছিলেন না। ১৯২৩, ১৫ই নবেম্বর (২৯ কাৰ্ত্তিক ১৩৩০), ৫৭ বৎসর বয়সে, বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও পত্নীকে শোক-সাগরে ভাসাইয়া ইহলোক হইতে বিদায় গ্ৰহণ করেন।

পাঁচকড়ির রচিত ও সম্পাদিত গ্ৰন্থ :–১। আইন-ই-আকবরী ও আকবরের জীবনী (বসুমতী, ইং ১৯০০); ২। শ্ৰীশ্ৰীচৈতন্যচরিতামৃত (বসুমতী, ইং ১৯০০); ৩। উমা (গৃহচিত্র), ইং ১৯০১; ৪। রূপ-লহরী বা রূপের কথা, ইং ১৯০২; ৫। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস (হিতবাদী, ইং ১৯০৯); ৬। বিংশ শতাব্দীর মহাপ্ৰলয় (বসুমতী, ইং ১৯১৫); ৭। সাধের বউ (উপন্যাস), ইং ১৯১৯; ৮। দরিয়া (উপন্যাস), ইং ১৯২০৷

——————–

* ১৮৯৬, ৭ই আগষ্ট ‘টি. এন. জুবিলী কলেজিয়েট ছাত্রবৃন্দ’ ভাগলপুরে তাঁহাকে বিদায় অভিনন্দন দিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে যে ‘শোকোচ্ছ্বাস’ মুদ্রিত হইয়াছিল, তাহাতে প্ৰকাশ–

‘গিয়াছিলে দেব, নয় মাস তরে
আশা ছিল প্ৰাণে ইহা,
হেরিব চরণ, কিন্তু আজি হায়
ভাসিয়া ডুবিল তাহা।।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত