দ্বিতীয় ভাগ
প্রথম পরিচ্ছেদ – রসময় রায়
সেইদিন আমি কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম। তাহার পর ছুটি ফুরাইলে আমি পুনরায় ব্রহ্মদেশে যাইলাম। প্রথম প্রথম কুসী ও বাবুকে সর্বদাই মনে হইত। বাবু আমাকে চিঠি লিখিবে বলিয়াছিল। কিন্তু তাহার নিকট হইতে চিঠিপত্র কিছুই পাইলাম না। তাহার নাম-ধাম ঠিকানা আমাকে বলে নাই। আমি যে কোন অনুসন্ধান করিব, সে উপায়ও ছিল না; সুতরাং যত দিন গত হইতে লাগিল, ততই তাহারা আমার স্মৃতিপথ হইতে অন্তর্হিত হইতে লাগিল। অবশেষে আমি তাহাদিগকে একেবারেই ভুলিয়া যাইলাম। কুসী ও বাবু বলিয়া পৃথিবীতে যে কেউ আছে, তাহা আর আমার মনে বড় হইত না।
দুই বৎসর কাটিয়া গেল। ১৩০৩ সালে আমি সরকারী কর্ম পরিত্যাগ করিলাম। পেনসন লইয়া কিছুদিন দেশে আসিয়া স্বগ্রামে বাস করিলাম। কিন্তু চিরকাল বিদেশে থাকা আমার ভাল লাগিল না। তার পর ম্যালেরিয়া জ্বরের উপদ্রবেও বিলক্ষণ উৎপীড়িত হইলাম। সেজন্য ১৩০৪ সালের শীতকাল আমি বায়ু পরিবর্তন ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের নানা স্থান দর্শন করিবার নিমিত্ত ঘর হইতে বাহির হইলাম। এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, আগ্রা, দিনী, অমৃতসর প্রভৃতি নানা স্থান হইয়া অবশেষে লাহোরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। লাহোরে আসিয়া খাইবার প্রভৃতি সীমান্তের গিরিসঙ্কট দেখিতে আমার বড়ই সাধ হইল। কিন্তু দুরন্ত পাঠানদিগের গল্প শুনিয়া সে বাসনা আমাকে পরিত্যাগ করিতে হইল। গ্রীষ্মকাল পড়িলেই কাশ্মীর যাইব। এইরূপ মানস করিলাম।
চৈত্র মাসের প্রথমে একদিন আমি লাহোরের পথে বেড়াইতেছি, এমন সময় রসময়বাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। অনেক দিন ব্ৰহ্মদেশে আমরা একসঙ্গে একস্থানে ছিলাম। তাহার সহিত আমার বিশেষ বন্ধুতা ছিল না, কারণ, তাহার প্রকৃতি একরূপ, আমার প্রকৃতি অন্যরূপ। তবে বিদেশে একসঙ্গে অল্পসংখ্যক বাঙ্গালী থাকিলে পরস্পর অনেকটা ঘনিষ্ঠতা হয়। ব্রহ্মদেশে থাকিতে রসময়বাবুর সহিত আমার সেইরূপ ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল। অবশ্য একথা বলা বাহুল্য যে, তাহার নাম প্রকৃত রসময় নহে। এই গল্পে যে, সমুদয় নামের উল্লেখ হইতেছে তাহা প্রকৃত নহে। কারণ, অন্ততঃ দুইটি সংসারের কথা ইহাতে রহিয়া কত নাম দিয়া লোকের সংসারের কথা সাধারণের সমক্ষে প্রকাশ করা উচিত নহে।
দুর হইতে রসময়বাবু আমাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া আমার হাত ধরিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, রসময়বাবু। আপনি এখানে কি করিয়া আসিলেন?
রসময়বাবু–উত্তর করিল,–কেন? আপনি শুনেন নাই? আমি পাঞ্জাবে বদলি হইয়াছি। প্রথম একটি বড় ছাউনিতে আমাদের অফিস ছিল। এক্ষণে সীমান্তে সামান্য একটি স্থানে আছি। কিন্তু যাদববাবু! আপনি এ স্থানে কি করিয়া আসিলেন?
আমি বলিলাম,–পেনসন লইয়া আপনাদের নিকট হইতে চলিয়া আসিলাম। তাহার পর দিনকতক দেশে রহিলাম। ম্যালেরিয়া জ্বরে বড়ই ভুগিতেছিলাম, সেইজন্য পশ্চিম বেড়াইতে আসিয়াছি।
রসময়বাবু পুনরায় বলিলেন,–আর শুনিয়াছেন? না,—বলিলে আপনি উপহাস করিবেন, আপনাকে সে কথা বলিব না।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–কি কথা? উপহাস করিবার কি কথা আছে?
রসময়বাবু উত্তর করিলে,—আমি পুনরায় বিবাহ করিয়াছি। এই বয়সে পুনরায় বিবাহ করিয়াছি।
আমি বলিলাম,–তবে বর্মাণীকে ভুলিয়া গিয়াছেন? তাহার শোকে সেদিন যে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়াছিলেন?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – এত বড় কন্যা
ব্রহ্মদেশে থাকিতে রসময়বাবুর স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ছিল না। বহুদিন পূর্বে তাহার স্ত্রী বিয়োগ হইয়াছিল। ব্রহ্মদেশে একজন স্ত্রীলোক লইয়া সে স্থানে তিনি ঘরসংসার করিয়াছিলেন। রসময়বাবুর আর একটি দোষ ছিল। অতিরিক্ত পান দোষটাও তাঁহার ছিল। সেইজন্য পূর্বেই বলিয়াছি যে আমার সহিত তাহার বিশেষ মিত্ৰতা ছিল না। তাহার স্বভাব একরূপ, আমার স্বভাব অন্যরূপ! ব্রহ্মদেশে থাকিতে পুনরায় বিবাহ করিবার নিমিত্ত দুইএকবার তাঁহাকে আমরা অনুরোধ করিয়াছিলাম; কিন্তু বর্মাণী তাঁহার সংসারে সদাচারে থাকিয়া একপ্রকার স্ত্রীর ন্যায় ঘরকন্না করিতেছিল। পাছে তাহার প্রতি নিষ্ঠুরতা হয়, সেজন্য রসময়বাবুকে বিবাহ করিবার নিমিত্ত আমরা জোর করিয়া বলিতে পারি নাই। আর জোর করিয়া বলিলেই বা তিনি আমাদের কথা শুনিবেন কেন? আমি পেনসন লইয়া ব্রহ্মদেশ হইতে চলিয়া আসিবার অল্পদিন পূর্বে বর্মাণীর মৃত্যু হয়। সেই শোকে রসময়বাবু ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়াছিলেন।
রসময়বাবু বলিলেন,–সত্য বটে, বর্মাণীর শোকে আমি ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়াছিলাম। পুনরায় বিবাহ করিবার কারণও তাই। মন আমার যেন সর্বদাই উদাস থাকিত। সংসারে আমার কেহ নাই, সর্বদাই যেন সেইরূপ বোধ হইত। পরিবার বিয়োগ হইলে লোকে যে বলে, গৃহ-শূণ্য হইয়াছে, সে সত্য কথা। গৃহ-শূণ্য হওয়ার ভোগও আমি একবার ভুগিয়াছি। আমার শরীরটা কিছু মায়াবী। সহজেই আমি কাতর হইয়া পড়ি। আমার প্রথম পত্নীর যখন বিয়োগ হয়, তখনও আমি পাগলের ন্যায় হইয়া পড়িয়াছিলাম।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–কবে সে ঘটনা ঘটিয়াছিল?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,—সে অনেক দিনের কথা। তখন আপনার সহিত আমার আলাপ হয় নাই। সেই পরিবারের শোকে আমি দেশত্যাগী হই। নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া অবশেষে ব্ৰহ্মদেশে গিয়া উপস্থিত হই। কমিসেরি বিভাগে ভাল কর্ম মিলিল, সেজন্য সেই স্থানেই রহিয়া যাইলাম। আপনি এখন এ স্থানে কিছুদিন থাকিবেন?
আমি উত্তর করিলাম,না শীঘ্রই কাশ্মীরে যাইব বলিয়া মানস করিতেছি। সীমান্তের কথা খবরের কাগজে অনেক পড়িয়াছি। সেই সীমান্ত কিরূপ, তাহা দেখিবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সে দিকে কাহাকেও আমি জানি না। পাঠানদের উপদ্রবের কথা শুনিয়া অপরিচিত স্থানে একেলা যাইতেও সাহস করি না। সেজন্য কাশ্মীর যাইব মনে করিতেছি।
রসময়বাবু বলিলেন,—তার ভাবনা কি? আমি উজিরগড়ে থাকি। সে স্থান একেবারে সীমান্তে। আমাদের পল্টন এখন সেই স্থানে রহিয়াছে গুিজিরগড় ছোট একটি ছাউনি চৌকি বলিলেও চলে। সে স্থানে বাঙ্গালী অধিক নাই, আমরা কেবল আটজন সেখানে আছি। আপনাকে অতি আদরে রাখিব। দেখিবার যাহা কিছু আছে তাহা দেখাইব। আমি বিবাহ করিতে কলিকাতা গিয়াছিলাম। নববিবাহিতা স্ত্রী লইয়া উজিরগড়ে প্রত্যাগমন করিতেছি! আপনি আমার বাসায় থাকিবেন। কি বলেন? উজিরগড়ে যাইবেন তো?
আমি উত্তর করিলাম,—আচ্ছা, যাইব। কিন্তু কাশ্মীর দেখিতে আমার মন হইয়াছে। কাশ্মীর হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আপনার নিকটে যাইব।
রসময়বাবু বলিলেন,–১৫ই বৈশাখের পূর্বে যদি আমার নিকট গমন করেন তাহা হইলে আমার বড় উপকার হয়। সেইদিন আমার কন্যার বিবাহ হইবে। আপনারা পাঁচজনে দাঁড়াইয়া থাকিলে সেই কাজ সুচারুরূপে নির্বাহিত হইবে।
আমি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কন্যা? আপনার আবার কন্যা কোথা হইতে আসিল? সগর্ভা সপুত্ৰা সকন্যা স্ত্রী বিবাহ করিয়া আনিলেন না কি?
রসময়বাবু একটু হাসিয়া উত্তর করিলেন,—তা নয়। এ আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কন্যা।
আমি বলিলাম, আপনার প্রথম পক্ষের স্ত্রী তো বহুকাল গত হইয়াছে। বর্ষায় তেরচৌদ্দ বৎসর আমরা একত্রে ছিলাম। আপনি এই বলিবেন, তাহার পূর্বে আপনার স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছিল। এত বড় অবিবাহিতা কন্যা আছে? ব্রহ্মদেশে থাকিতে আপনার এ কন্যার কথা কখনও শুনি নাই।
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,—সে সকল কথা আমি আপনাকে পরে বলিব। কন্যা বড় হইয়াছে সত্য। এদেশে একটি ভাল পাত্র স্থির করিয়াছি। বিবাহ করিতে তিনি দেশে যাইতে পারিবেন না। তাই আমি কন্যা আনিতে গিয়াছিলাম। দেশে সেইজন্যই আমি গিয়াছিলাম। নিজে বিবাহ করিব বলিয়া যাই নাই। কিন্তু দেশে উপস্থিত হইয়া একটি বড় পাত্রী মিলিয়া গেল। আমার মন উদাসী ছিল। আমি নিজেও বিবাহ করিলাম। বিদেশে বিবাহ দিবার নিমিত্ত কেবল কন্যাকে ঘাড়ে করিয়া আনা ভাল দেখায় না, সেই কারণে নববিবাহিতা স্ত্রীকে সঙ্গে করিয়া আনিলাম। তবে কেমন? বৈশাখ মাসের প্রথমে আপনি উজিরগড়ে যাইবেন তো?
আমি বলিলাম,—যাইতে খুব চেষ্টা করিব।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রসময়ের অনুতাপ
এইরূপ কথাবার্তার পর রসময়বাবু প্রস্থান করিলেন। চৈত্র মাসের প্রথমে লাহোরে রসময়বাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। দুই-চারি দিন পরে আমি কাশ্মীর গমন করিলাম। কাশ্মীরে পর্বত, হ্রদ, বন, উপবনের সৌন্দর্য দেখিয়া বড়ই বিস্মিত হইলাম। বৈশাখ মাসের প্রথমে কাশ্মীর হইতে প্রত্যাগমন করিলাম, ৫ই বৈশাখ উজিরগড়ে গিয়া উপস্থিত হইলাম। অতি সমাদরে রসময়বাবু আমাকে তাহার বাসায় স্থান দিলেন। ১৫ই বৈশাখ রসময়বাবুর কন্যার বিবাহ হইবে। আমি যখন উজিরগড়ে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন বিবাহের আয়োজন হইতেছিল।
সেইদিন সন্ধ্যাবেলা রসময়বাবু আমাকে বলিলেন,–আপনি এ স্থানে আসায় আমার আর একটি উপকার হইয়াছে। দুই-চারি দিন বিশ্রাম করিয়া আপনার পথশ্রান্তি দূর হইলে, আমার কন্যাকে একবার দেখিতে হইবে। কন্যার ভাবগতিক আমি কিছুই বুঝিতে পারি না। তাহার শরীরে কোনরূপ পীড়া আছে বলিয়া বোধ হয়। মুখ মলিন, শরীর রূগ্ন ও কৃশ। তাহার পর কোনরূপ বায়ুর ছিট আছে কি না, তাহাও জানি না; মুখে তাহার কথা নাই, সর্বদাই ঘাড় হেঁট করিয়া থাকে, সর্বদাই যেন ঘোর চিন্তায় মগ্ন। ইহার পূর্বে আমি আমার কন্যাকে কখন দেখি নাই।।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—আপনার কন্যা এতদিন কোথায় ছিল?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,—আপনারা সকলেই জানেন যে, আমি নিতান্ত সাধু ছিলাম না। এই ন্যার প্রতি আমি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছি সেজন্য এখন আমার বড়ই অনুতাপ হয়। নিজের দোষ স্বীকার করাই ভাল, একঝুড়ি মিথ্যা কথা বলিয়া তাহা আর গোপন করা উচিত নয়।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–কন্যার প্রতি আপনি কি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছিলেন?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,—এই কন্যা যখন ছয় দিনের, তখন আমার স্ত্রী সুতিকাগারে পরলোকপ্রাপ্ত হয়। শোকে আমি অধীর হইয়া পড়িলাম। আমার এক আত্মীয় ও তাহার স্ত্রী নিঃসন্তান ছিলেন। নব-প্রসূতা শিশুকে তাঁহাদের হস্তে সমর্পণ করিয়া আমি দেশ হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। নানা স্থান ভ্রমণ করিয়া অবশেষে ব্রহ্মদেশে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কন্যার প্রতিপালনের নিমিত্ত প্রথম প্রথম তাহাদিগের নিকট কিছু খরচ পাঠাইতাম। তাহার পর বন্ধ করিয়া দিলাম।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার সে আত্মীয় কি সঙ্গতিপয় লোক?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন, কিছুমাত্র নয়। সামান্য একটু চাকরী করিয়া তিনি দিনযাপন করিতেন। যখন কন্যা বিবাহযোগ্যা হইল, তখন তিনি আমাকে বার বার পত্র লিখিলেন। আমি পত্রের উত্তর দিলায় না। বিবাহের নিমিত্ত একটি টাকাও প্রেরণ করিলাম না। তিনি গরীব, টাকা কোথায় পাইবেন যে, আমার কন্যার বিবাহ দিবেন। শেষকালটায় তিনি রোগগ্রস্ত হইয়া অনেকদিন শয্যাশায়ী হইয়াছিলেন। এইসব কারণে আমার কন্যা বড় হইয়া পড়িয়াছে; আজ পর্যন্ত তাহার বিবাহ হয় নাই। তাহার পর আমার সেই আত্মীয়ের পরলোক হয়। তাহার স্ত্রী আমার কন্যাটিকে লইয়া একেবারে নিঃসহায় হইয়া পড়েন। তিনি পুনরায় আমাকে পত্র লিখিলেন সেই সময় বর্মাণীর মৃত্যু হইয়াছিল। আমার চক্ষু উন্মুক্ত হইয়াছিল। আমি খরচপত্র পাঠাইয়া দিলাম ও একটি সুপাত্র অনুসন্ধান করিতে আমার সেই আত্মীয়কে লিখিলাম। কিন্তু ভালরূপ পাত্রের সন্ধাহইল না। এই সময়ে আমি পাঞ্জাবে বদলি হলাম। মনে করিয়াছিলাম যে, এ স্থানে আসিবার সময় কলিকাতায় দিনকত থাকিব। সেই স্থানে থাকিয়া, ভাল একটি পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া, কন্যার বিবাহ দিয়া তবে পাঞ্জাবে আসিব। কিন্তু কলিকাতায় কিছুদিন অবস্থিতি করিবার নিমিত্ত ছুটি পাইলাম না। বরাবর আমাকে পঞ্জাবে আসিতে হইল। প্রথম একটি বড় ছাউনিতে আমাদের অফিস হইয়াছিল। সেই স্থানে দিগম্বরবাবুর সহিত আমার আলাপ হয়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – কন্যা আমার সুখে থাকিবে
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–দিগম্বরবাবু কে? রসময়বাবু উত্তর করিলেন,—দিগম্বরবাবু কে? কেন, ফোক্লা দিগম্বর। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–ফোক্লা দিগম্বর কে?
রসময়বাবু কিছু বিস্মিত হইয়া উত্তর করিলেন,—ফোক্লা দিগম্বর কে? ফোক্লা দিগম্বরের নাম শুনেন নাই? তাহার যে অনেক টাকা। এ অঞ্চলে সকলেই যে তাহাকে
জানে।
আমি বলিলাম,–না, আমি কখনও ফোক্লা দিগম্বরের নাম শুনি নাই। তিনি কে?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,—দিগম্বরবাবু আমার হবু জামাতা। তিনিও কমিসেরি বিভাগে কর্ম করেন। কিছুদিন পূর্বে এলাহাবাদ কি আগ্রা হইতে পঞ্জাবে আসিয়াছেন। বিলক্ষণ সঙ্গতি করিয়াছেন। আমি যখন পাঞ্জাবে আগমন করি, সেই সময় তাহার পত্নীবিয়োগ হইয়াছিল।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–দিগম্বরবাবু সুপাত্র?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,–দেখিতে তিনি সুপুরুষ নহেন, বয়সও হইয়াছে, তবে সঙ্গ তিশম লোক। কন্যা আমার সুখে থাকিবে।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–আর-পক্ষের তাহার পুত্রাদি আছে?
রসময়বাবু বলিলেন,–আছে। পুত্র-কন্যা কেন, শুনিয়াছি, পৌত্র-দৌহিত্রও আছে। পাছে এ বিবাহে তাহারা আপত্তি করে, সেইজন্য দিগম্বরবাবু দেশে গিয়া বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিলেন না। সেইজন্য আমাকেও এই স্থানে কন্যার বিবাহ দিতে হইল।
আমি বলিলাম,–এরূপ পাত্রের সহিত কন্যার বিবাহ দেওয়া কি উচিত হয়?
রসময়বাবু বলিলেন,–কি করি! সেদিন হিসাব করিয়া দেখিলাম যে আমার কন্যার বয়ঃক্রম বোল বৎসর হইয়া থাকিবে। দেশে আমার এমন কোন অভিভাবক নাই যে, তাঁহাকে ভাল পাত্রের অনুসন্ধান করিতে বলি। চাকরী ছাড়িয়া আমি নিজেও যাইতে পারি না। তাহা ভিন্ন ভাল পাত্রের সহিত বিবাহ দিতে অনেক টাকার প্রয়োজন। সে টাকা আমার নাই। দিগম্বরবাবু বৃদ্ধই হউন আর যাহাই হউন, কন্যার বিবাহ না দিয়া আর আমি রাখিতে পারি না।।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–দিগম্বরবাবুর বয়স কত হইবে?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,–তা ঠিক বলিতে পারি না। ষাট হইয়াছে কি হয় নাই।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–তাঁহার দাঁত নাই সেইজন্য লোকে তাহাকে ফোক্লা দিগম্বর বলে?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,–কেবল তা নয়। তাহার দন্তহীন মাড়ি কৃষ্ণবর্ণ ও কিছু উচ্চ। অল্পবয়স্ক যুবকের মত দেখাইবে বলিয়া সর্বদা তিনি হাস্য-পরিহাস করিয়া থাকেন। সেইসময় মাড়ি দুইটি বাহির হইয়া পড়ে। সেইজন্য লোক তাঁহাকে ফোল্লা দিগম্বর বলে। কিন্তু তাঁহার অনেক টাকা আছে। কন্যা আমার সুখে থাকিবে। আমি আর কি বলিব! আমি চুপ করিয়া রহিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – আমার স্মরণ হইল
দিগম্বরবাবু বৃদ্ধই হউন আর যুবাই হউন, তাহার প্রাণে যে সখ আছে, পরদিন তাহা আমি জানিতে পারিলাম। কারণ, প্রাণে সখ না থাকিলে, কেহ আর হবু স্ত্রীর ফটোগ্রাফ দর্শন করিতে ইচ্ছা করে না। এ পর্যন্ত তিনি রসময়বাবুর কন্যাকে দেখেন নাই। কন্যা না দেখিয়াই সম্বন্ধ স্থির হইয়াছিল। মনে করিলেই এ স্থানে আসিয়া অনায়াসে কন্যা দেখিয়া যাইতে পারিতেন; কিন্তু তাহা তিনি করেন নাই।।
রসময়বাবু কন্যা আনিতে যখন দেশে গিয়াছিলেন, তখন কন্যার ফটোগ্রাফ লইবার নিমিত্ত তিনি অনুরোধ করিয়াছিলেন। কলিকাতায় সেই ফটোগ্রাফ গৃহীত হইয়াছিল। আজ ডাকে সেই ফটোগ্রাফ আসিয়া উপস্থিত হইল পুলিন্দাটি খুলিয়া সেই ছবি সকলে দেখিতে লাগিলেন। তাহাতে রসময়বাবুর নিজের তাহার নববিবাহিতা পত্নীর ও কন্যার ছবি এ স্থানে রসময়বাবুর সংসারে অভিভাবকস্বরূপ একজন বয়স্কা বিধবা স্ত্রীলোক ছিলেন। তিনি কে, তখন তাহা আমি জানিতে পারি নাই। তাহার ফটোগ্রাফ ছিল না। এক-একজনের ছয় ছয়খানি করিয়া ছবি ছিল। একখানি ছবি আমার হাতে দিয়া রসময়বাবু বলিলেন,–ইহা আমার কন্যার ছবি। কেমন, আমার কন্যা সুন্দরী নয়?
ছবিখানি হাতে লইয়া আমি চমকিত হইলাম। যাহার ছবি, তাহাকে যেন কোথায় দেখিয়াছি, এইরূপ আমার মনে হইল। কিন্তু কবে কোথায় দেখিয়াছি, তাহা আমি স্মরণ করিতে পারিলাম না। চিন্তা করিয়া স্মরণ করিতে চেষ্টা করিতেছি, এমন সময় রসময়বাবু পুনরায় বলিলেন,–চুপ করিয়া রহিলেন যে? কন্যা আমার সুন্দরী নহে?
আমি বলিলাম,–সুন্দরী। চমৎকার রূপবতী কন্যা। ছবিখানি তুলিয়াছেও ভাল। কিন্তু বাম গালের এই স্থানে একটু যেন মুছিয়া গিয়াছে। আর একখানি দেখি?
রসময়বাবু কন্যার আর পাঁচখানি ছবি আমার হাতে দিলেন একে একে সকল গুলিরই বাম গালের এক স্থানে সেই মোছা দাগটি দেখিতে পাইলাম। তখন রসময়বাবু হাসিয়া বলিলেন,–বাম গালে এ স্থানটা মুছিয়া যায় নাই আমার কন্যার এই স্থানে ক্ষুদ্র একটি আঁচিল আছে, ইহা তার দাগ।
যাহার এ ফটোগ্রাফ, তাহাকে কোথায় যে দেখিয়াছি তবুও আমার মনে হইল না। সকলের দেখা হইলে রসময়বাবু দুইখানি ছবি সেই দিনের ডাকেই দিগম্বরবাবুর নিকট প্রেরণ করিলেন। তাহার পরদিন রসময়বাবু পরিবারবর্গ নদীতে স্নান করিতে গিয়াছিলেন। বেলা প্রায় এগারটা বাজিয়া গিয়াছিল। রসময়বাবু আফিসে গিয়াছিলেন। বাহিরের ঘরে আমি একাকী বসিয়া আছি, এমন সময় রসময়বাবুর পরিবারবর্গ যে এক্কাতে স্নান করিতে গিয়াছিলেন, সেই এক্কা ফিরিয়া আসিল। রসময়বাবুর বাসার সম্মুখে সামান্য একটু বাগানের মত ছিল। বাগানের পর বাড়ী। প্রথম বৈঠকখানা, তাহার পশ্চাতে অন্দরমহলে যাইবার নিমিত্ত বাগানের ভিতর বৈঠকখানার পার্শ্বে একটি খিড়কি দ্বার ছিল। এক্কা সেই খিড়কির দ্বারে গিয়া লাগিল। এক্কা হইতে নামিয়া স্ত্রীলোকেরা একে একে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। স্ত্রীলোকেরা সকলেই এতক্ষণে বাটীর ভিতর গিয়া থাকিবে, এই মনে করিয়া, আমি বৈঠকখানার বারান্দায় দাঁড়াইলাম। এক্কা চলিয়া যায় নাই। বৈঠকখানার বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেই এক্কা, তাহার গেড়াও ভীমসদৃশ দেহবিশিষ্ট সেই এক্কাওয়ালাকে দেখিতে লাগিলাম। এমন সময় সেই খিড়কি দ্বারের নিকট বাটীর ভিতর হইতে কে বলিল,–ও কুসুম! একার উপর ভিজা গামছাখানা পড়িয়া আছে। নিয়ে এস তো মা?
রসময়বাবুর পরিবারের মধ্যে যে অভিভাবক স্বরূপ একজন বয়স্কা বিধবা স্ত্রীলোক আছেন, এ কণ্ঠস্বর তাহার। তিনি রসময়বাবুর ভগিনী কি কে, এখন পর্যন্ত তাহা আমি জানিতে পারি নাই।
তাহার সেই কথা শুনিয়া একটি যুবতী স্ত্রীলোক বাটীর ভিতর হইতে ধীরে ধীরে ঘাড় হেঁট করিয়া বাহির হইল। এক্কার পর্দা তুলিয়া তাহার ভিতর হইতে গামছাখানি লইয়া পুনরায় সেইরূপ ঘাড় হেঁট করিয়া বাটীর ভিতর সে চলিয়া গেল। গামছা লইয়া যাইতে এক মিনিট কালও অতিবাহিত হয় নাই। কিন্তু তাহার ঘোমটা ছিল না, মাথায় কাপড় পর্যন্ত ছিল না। মাথা হেঁট করিয়া ছিল বটে, তথাপি আমি তাহার মুখ দেখিতে পাইলাম। তাহার মুখ দেখিয়া আমার আঁৎ করিয়া পূর্বকথা সমুদয় স্মরণ হইল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ -কাশীর কুসী বটে
এইমাত্র আমি যাহাকে দেখিলাম, সে কুসী ভিন্ন আর কেহ নয়। সেদিন যাহার ছবি দেখিয়াছিলাম, সে-ও কুসী ব্যতীত আর কেহ নয়। সেই মুখ, সেই বাম গালে আঁচিল।
কুসী বটে, কিন্তু সে কুসী আর নাই! কেবল তিন বৎসর পূর্বে তাহাকে আমি দেখিয়াছিলাম। ইহার মধ্যেই সে বিশ্রী হইয়া গিয়াছে। সে পুরন্ত গাল তাহার নাই। রক্তিমআভা-সম্বলিত সে বর্ণ এখন নাই। চক্ষু বসিয়া গিয়াছে, চক্ষের কোলে কালি মাড়িয়া দিয়াছে। সঙ্কটাপন্ন পীড়া হইলে লোক যেরূপ হয়, কুসীর আকার এখন সেইরূপ হইয়া গিয়াছে।
এ কি সেই কাশীর কুসী? ঠিক সেইরূপ মুখ বটে, কিন্তু কুসীর বিবাহ হইয়া গিয়াছে। পুনরায় তাহার বিবাহ কি করিয়া হইবে? এ কুসী কি না, এই বিষয়ে আমার মনে বড় সন্দেহ উপস্থিত হইল। একবার মনে হয়, এ আর কেহ নহে, নিশ্চয় কুসী। আবার মনে হয় যে, না, তা নয়, কুসীর সহিত রসময়বাবুর কন্যার সাদৃশ্য আছে, এই মাত্র। সেই সাদৃশ্য দেখিয়া আমি এইরূপ ভ্রমে পতিত হইতেছি। আবার মনে হয় যে, কেবল মুখশ্রীর সাদৃশ্য নয়,–তাহার নাম কুসী, ইহার নাম কুসুম কুসুমের সংক্ষেপে কুসী। তাহার পর, সেই বাম গণ্ডদেশে আঁচিল। নাম এক, বয়স এক, মুখশ্রী এক, ঠিক এক স্থানে এক প্রকার আঁচিল। এ নিশ্চয় আমার সেই পাতানো কন্যা কুসী।
কিন্তু আবার যখন ভাবি যে, তবে পুনরায় বিবাহ হইতেছে কেন, তখন আবার মনে বড় সন্দেহ হয়! বয়স অধিক হইয়াছিল, সেজন্য রসময়বাবুর কন্যা কাহারও সম্মুখে বাহির হয় না। গোপনে যে তাহার সহিত কোন কথা কহিব, সে উপায় ছিল না। আমি বাটীর ভিতর যখন আহার করিতে যাই, কুসী তখন অবশ্য আমায় দেখিতে পায়। যদি প্রকৃত সে কুসী হয়, তাহা হইলে আমার সহিত সে দেখা করে না কেন? পুনরায় বিবাহ করিতেছে; সেই লজ্জায় দেখা করে না? যাহা হউক, রসময়বাবু যখন কন্যাকে দেখাইবেন, তখন এ রহস্য ভেদ করিতে চেষ্টা করিব।
রসময়বাবু বাটী আসিলে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম,—কৈ আপনার কন্যাকে দেখাইলেন না?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,–পথশ্রমে আপনি শ্রান্ত ছিলেন, সেইজন্য দেখাই নাই; তাহার পর, আজ তাহারা নদীতে স্নান করিতে গিয়াছিল। সন্ধ্যার সময় দেখাইব।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কন্যার কি হইয়াছে, ভাল করিয়া বলুন দেখি, শুনি।
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,–কি হইয়াছে, তাহা আমি নিজেই জানি না। সেদিন কলিকাতায় তাহার সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হইল। শুনিয়াছি যে, দুই বৎসর পূর্বে তাহার জ্বর-বিকার হইয়াছিল; তাহার পর, একপ্রকার পাগলের মত হইয়া আছে। শরীর দিন দিন শুষ্ক হইয়া যাইতেছে। কাহারও সহিত সে কথা কয় না। আমার সহিত এ পর্যন্ত সে একটিও কথা কয় নাই। তবে সেদিন আমার নিকট আসিয়া বলিল—বাবা আমার বিবাহ দিবেন না; বিবাহের পূর্বেই আমি মরিয়া যাইব। সকলের সাক্ষাতে সে ক্রমাগত এই কথা বলিতেছে! কিন্তু বিবাহ হইলেই বোধ হয়, সব ভাল হইয়া যাইবে। সেইজন্য বিবাহের নিমিত্ত আমি তারও ব্যস্ত হইয়াছি।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–আপনার কন্যার নাম কুসুম?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,–হাঁ।
সেইদিন সন্ধ্যাবেলা রসময়বাবু ও আমি দুইজন্নে বৈঠকখানায় বসিয়াছিলাম। সেই সময় তিনি কন্যাকে ডাকিয়া আনিলেন। কুসুম অবগুণ্ঠিত হয় নাই সত্য, কিন্তু যতদূর পারিয়াছিল, ততদূর শরীরকে বস্ত্র দ্বারা আবৃত করিয়াছিল। অতি ভয়ে ভয়ে মস্তক অবনত করিয়া সে আমার সম্মুখে দাঁড়াইল। সেই কাশীর কুসী বটে, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু সে কুসী আর নাই তাহার ছায়া মাত্র রহিয়া গিয়াছে। তাহার শরীর অতিশয় কৃশ হইয়া গিয়াছে। চক্ষু বসিয়া গিয়াছে। তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। যেন ঠিক মৃত লোকের আকার হইয়াছে। কতবার তাহাকে আমি মস্তক তুলিতে বলিলাম। কিন্তু কিছুতেই সে মস্তক উত্তোলন করিল না, ঘাড় হেঁট করিয়া মাটির দিকে চাহিয়া রহিল। আমি নানারূপ প্রশ্ন করিলাম। কিন্তু সকল কথাতেই হয় হ্যাঁ, আর না হয় নাএইরূপ উত্তর দিল। আমার দিকে একবার চাহিয়া দেখিল না। অবশেষে সে কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার শরীরের অবস্থা দেখিয়া আমার বড় দয়া হইল। সে কোন কথা বলিবে না, সুতরাং আর তাহাকে কষ্ট দেওয়া বৃথা। সে নিমিত্ত আমি তাহাকে বাটীর ভিতর যাইতে বলিলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – আমি করি কি
কুসী বাটীর ভিতর চলিয়া যাইলে, তাঁহার পিতা আমাকে বলিলেন,—দেখিলেন তো মহাশয়! ইহার মনের গতিক ভাল নহে। সেই বিকারের পর হইতে ইহার বুদ্ধিভ্রংশ হইয়া গিয়াছে; কিয়ৎ পরিমাণে বায়ুগ্রস্ত হইয়াছে। বিবাহ হইয়া গেলে, নানারূপ বসন-ভূষণ পাইয়া, বোধহয় সারিয়া যাইবে।
আমি উত্তর করিলাম,বায়ুগ্রস্ত হইয়াছে কি না, তাহা আমি জানি না, কিন্তু ইহার মনের অবস্থা যে নিতান্ত মন্দ, তাহা নিশ্চয় কথা। সে নিমিত্ত শরীরের অবস্থাও ভাল নহে। আপনার কন্যা যাহা বলে, সত্য সত্য তাহাই বা ঘটে।
যাহা হউক, আমি ঔষধাদি প্রদান করিলাম না। কোনরূপ ঘোরতর দুশ্চিন্তার নিমিত্ত শরীরের এইরূপ অবস্থা হইয়াছে, তাহাতে ঔষধ দিয়া কি হইবে? বোধ হয়, দ্বিতীয়বার এই বিবাহই যত অনর্থের মূল। রসময়বাবু কেন এ কাজ করিতেছেন তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না। কুসীর স্বামী বাবু কোথায় গেল, তাহাও জানি না। এ বিধবা বিবাহ নহে। তাহা যদি হইত, তাহা হইলেও না হয়, এ ব্যাপারে অর্থ বুঝিতে পারিতাম। কুসীর যে একবার বিবাহ হইয়াছে, সে কথা গোপন রাখা হইতেছে। কাশীতে কুলীর সহিত যখন আমার সাক্ষাৎ হয়, রসময়বাবু সে সময় ব্রহ্মদেশে ছিলেন। কুসীর যে একবার বিবাহ হইয়াছে তিনি কি তা জানেন না? ফল কথা, ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। যাহা ইচ্ছা হউক, আমার এত ভাবনার আবশ্যক কি? এই বিবাহের শেষ পর্যন্ত দেখিয়া, আমি এ স্থান হইতে চলিয়া যাইব। এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি চুপ হইয়া রহিলাম, আর কুসীকে দেখিতে চাহিলাম না। তবে কুসী কেমন আছে, সে কথা প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করিতাম। রসময়বাবু প্রতিদিন বলিতেন,–সেইরকম আছে; কথা তো সে কয় না, তবে মাঝে মাঝে বলে যে,তাহার বিবাহ দিতে হইবে না, বিবাহের পূর্বেই সে মরিয়া যাইবে। বৃথা সকল আয়োজন হইতেছে।
আমি চুপ করিয়া রহিলাম বটে, কিন্তু মন আমার বড়ই উদ্বিগ্ন হইল। এ বিবাহ যাহাতে না হয় সম্পূর্ণ সেই ইচ্ছা হইল। কাশীর কথা প্রকাশ করিয়া এ বিবাহ নিবারণ করি, সে ইচ্ছা বার বার আমার মনে উদয় হইল। কিন্তু বাবু যদি ইহার যথার্থ স্বামী না হয়? সে বিষয়েও যদি কোনরূপ গোল থাকে? তাহা হইলে, কাশীর কথা প্রকাশ করিয়া আমি নিজেই ঘোর বিপদে পড়িব। মাঝে মাঝে এ সন্দেহ আমার মনে উদয় হইল বটে, কিন্তু কুসী যে দুশ্চরিত্রা, সে কথা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হইল না। যাহা হউক, আমি দুইদিনের জন্য এ স্থানে বেড়াইতে আসিয়াছি। পরের কথায় হস্তক্ষেপ করিয়া কেন আমি সকলের বিরাগভাজন হইব? কুসীর প্রতি কোনরূপ অত্যাচার কি হইতেছে? তাহা যদি হয়, আর কুসী যদি একটা কথা আমাকে বলে, তাহা হইলে, যেমন করিয়া পারি, আমি এ বিবাহ নিবারণ করিব! কুসী আমাকে হয় চিঠি লিখিবে, না হয় গোপন কিছু বলিবে, প্রতিদিন এই আশা করিতে লাগিলাম। কিন্তু দিনের পর দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল। বিবাহের দিন নিকটবর্তী হইল। তবুও কুসী আমাকে কিছু বলিল না। এ অবস্থায় আমি কি করিতে পারি? ভগবানের যাহা ইচ্ছা তাহাই হইবে, এই কথা ভাবিয়া আমি চুপ করিয়া রহিলাম।
বিবাহের আয়োজন হইতে লাগিল। বরযাত্রীদিগের থাকিবার নিমিত্ত রসময়বাবু নিকটে একখানি বাটী ভাড়া করিলেন। বিবাহের পূর্বদিন বর ও বরযাত্রিগণ আসিয়া উপস্থিত হইবে। খাদ্যসামগ্রী প্রভৃতির তদনুযায়ী আয়োজন হইতে লাগিল। উজিরগড়ে পুরোহিত ছিল না যে স্থান হইতে বর আসিবে, কন্যাপক্ষের পুরোহিতও সে স্থান হইতে আসিবে। রসময়বাবুর বৈঠকখানাটি বড় ছিল তাহার একপার্শ্বে কন্যাদান হইবে। অপর পার্শ্বে ও বারান্দায় সভা হইবে।
ক্রমে বিবাহের পূর্ব দিন উপস্থিত হইল। অপরাহ্ন চারিটার গাড়ীতে বর ও বরযাত্রিগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বরের পরিধানে মূল্যবান চেলি, গায়ে ফুলকাটা কামিজ, গলায় দীর্ঘ সোনার চেন হাতে পাথর বসান পানিপথের যাঁতি। ফল কথা, বরসজ্জার কিছুমাত্র ত্রুটি হয় নাই। যুবা বর হইলে এরূপ সজ্জা করে কি না, সন্দেহ। কিন্তু সজ্জা হইলে কি হয়, বরের রূপ দেখিয়া আমার ভক্তি উড়িয়া গেল। বয়স ষাট বৎসরের কম নহে, কৃষ্ণকায়, মুখে একটিও দাঁত নাই, মাথায় একগাছি কাল চুল নাই; অতি কদাকার বৃদ্ধ। তাহার পর সেই ফোল্লা মাড়ি বাহির করিয়া বিবাহের আনন্দে যখন তিনি রসিকতা করিয়া হাস্য করিতেছিলেন, তখন এরূপ কিম্ভূত কদাকার রূপ বাহির হইতেছিল সে সত্য কথা বলিতে কি, তাহার দুই গালে দুই থাবড়া মারিতে আমার নিতান্ত ইচ্ছা হইতেছিল। দিগম্বরবাবু আমার কি ক্ষতি করিয়াছেন যে, তাহার উপর আমার এত রাগ? আমার পাতানো মেয়ে কুসী,বাবু হেন সুন্দর সুশীল যুবকের হাত হইতে এইরূপ কদাকার হোদল কুকুতের হাতে গিয়া পড়িবে, সেই চিন্তা আমার অসহ্য হইয়াছিল। যাহা হউক, এসব চিন্তা আমি মন হইতে দূর করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলাম।
বিবাহ সম্বন্ধে কোন কথায় লিপ্ত না থাকিয়া, কেবল অভ্যাগত বরযাত্রীদিগের যাহাতে কোন কষ্ট না হয়, সে কার্যে ব্যস্ত রহিলাম।
বর ও বরযাত্রিগণ তাহাদিগের বাসায় উপবেশন করিলে, সে স্থানে সহসা একটু গোলযোগ উপস্থিত হইল। কি হইয়াছে, জানিবার নিমিত্ত তাড়াতাড়ি আমি সে স্থানে গমন করিলাম। সে স্থানে গিয়া দেখিলাম যে, ফোল্লা মহাশয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া একজন যুবক বরযাত্রীকে ভৎসনা করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া তিনি কিছু অপ্রস্তুত হইয়া ধীরভাবে মিনতি করিয়া সে যুবককে বলিলেন,–দে না ভাই, রসিক এ কি তামাসার সময়?
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,কি হইয়াছে মহাশয়?
বর উত্তর করিলেন,এই দেখুন দেখি মহাশয়! আমার যাতিখানি লুকাইয়া রাখিয়াছে। যাঁতিখানি, এই এই এই এমনি করিয়া ট্যাকে পুঁজিয়া রাখিতে হয়। যাঁতিখানি ট্যাকে খুঁজিয়া
রাখিলে বরের অকল্যাণ হয়।
কি করিয়া যতিখানি ট্যাকে গুজিয়া রাখিতে হয়, বর আমাকে দেখাইলেন। আমি দেখিলাম বরযাত্রিগণ সকলেই চুপে চুপে হাসিতে ছিলেন। বর পুনরায় আমাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,–মহাশয়! যাঁতিখানি ফিরাইয়া দিতে আপনি রসিককে বলুন। এ সময় কিছু লোহার দ্রব্য শরীরে না রাখিলে ভূতে পায়।
একজন বরযাত্রী আস্তে আস্তে বলিলেন,–ভূত,আপনার চেহারা দেখিলে ভয়ে পলাইবে না?
আমি আর কি বলিব, লজ্জায় ঘৃণায় আমি সে স্থান হইতে চলিয়া আসিলাম। মনে মনে কহিলাম, হায় হায়! কুসীর কপালে কি এই ছিল!
অষ্টম পরিচ্ছেদ – মাসীর খেদ
সন্ধ্যার পর রসময়বাবু বরযাত্রীদিগের বাসায় আসিয়া, হব জামাইবাবুকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার নিজের বাটীতে গমন করিলেন। তাঁহাকে বাটীর ভিতর লইয়া অতি সমাদরের সহিত জলখাবার খাইতে দিলেন। জলযোগ করিয়া দিগম্বরবাবু বৈঠকখানায় আসিয়া বসিলেন। সেই সময় আমিও সে স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বৈঠকখানার ভিতর অন্তঃপুরের দিকে দ্বারের নিকট আমি গিয়া দণ্ডায়মান হইয়াছি, এমন সময় বাড়ীর ভিতর হইতে অল্প অল্প ক্রন্দনের শব্দ আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। রসময়বাবুর সংসারে অভিভাবকস্বরূপ সেই যে বয়স্কা স্ত্রীলোকটি আছেন, তিনিই কাঁদিতেছিলেন। কাঁদিয়া কাঁদিয়া তিনি বলিতেছিলেন,–হতভাগি! কেন যে এত রূপ লইয়া জগতে আসিয়াছি। তোকে ছয়দিনের রাখিয়া তোর মা আঁতুড়ঘরে মরিয়া গেল। সেইদিন হইতে তোকে আমি প্রতিপালন করিলাম। তোর বাপ তোকে ফেলিয়া চলিয়া গেল। নিজে না খাইয়া তোকে আমি মানুষ করিলাম। একবার যা তোর কপালে ছিল, তা হইল। তোর জন্য ধর্ম কর্ম সব জলাঞ্জলি দিলাম। কত মিথ্যা কথা বলিলাম। কত কথা মনে রাখিলাম। তোর সুখের জন্য আমি ইহকাল পরকাল সব নষ্ট করিলাম, শেষে একটা বুড়ো চাড়ালের হাতে পড়িবি বলিয়া কি, আমি এতসব করিলাম? ছিঃ! ছিঃ কি তোর অদৃষ্ট।
দিগম্বরবাবু এ কথা শুনিতে পাইলেন কি না, তাহা আমি বলিতে পারি না। বোধ হয়, তিনি শুনিতে পান নাই; কারণ, সেই সময় তিনি রসময়বাবু প্রভৃতির সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন। আমি নিজেও সকল কথা শুনিতে পাই নাই; কেবল গুটিকতক কথা আমার কানে প্রবেশ করিয়াছিল। কিন্তু তাহাতেই আমি বুঝিলাম যে এই স্ত্রীলোক রসময়বাবুর ভগ্নী নহেন; ইনি তাহার সেই আত্মীয়ের স্ত্রী, যিনি কুসীকে প্রতিপালন করিয়াছিলেন। ফল কথা, ইনি আর কেহ নহেন, ইনি কুসীর মাসী,—যাহার কথা কাশীতে যখন আমি খবর দিতে ইচ্ছা করি, তখন কুসী ও বাবু আমাকে বলিয়াছিল যে, মেসোমহাশয় ও মাসী ভিন্ন সংসারে কুসীর আর কেহ নাই; তাহারাই বাবুর সহিত কুসীর বিবাহ দিয়াছিলেন। সেই সময় আরও শুনিয়াছিলাম যে কুসীর মেসোমহাশয় পীড়িত ছিলেন। রসময়বাবুও সেদিন এই কথা বলিয়াছিলেন কুসীর প্রতিপালকদিগকে তিনি কেবল আমার আত্মীয় এই বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। এখন আমি বুঝিলাম যে, সেই আত্মীয় তাহার ভায়রাভাই ও প্রথমপক্ষের শালী ব্যতীত অন্য কেহ নহে।
বিবাহের দিন বৈকাল বেলা রসময়বাবু আমাকে বলিলেন যে,–কুসুম আজ সমস্ত দিন বিছানায় পড়িয়া আছে, কিছুতেই উঠিতেছে না। ক্রমাগত বলিতেছে যে, এ সব উদ্যোগ বৃথা, বিবাহের পূর্বেই সে মরিয়া যাইবে। আপনি পূর্বে বলিয়াছিলেন যে তাহার আকার ঠিক মৃতলোকের ন্যায়। কিন্তু আজ একবার দেখিবেন চলুন। সত্য সত্যই সে মরিয়া যাইবে না কি?
রসময়বাবুর সহিত আমি বাটীর ভিতরে যাইলাম। কুসী বিছানায় পড়িয়া আছে। কিন্তু তাহার চক্ষে জল নাই। মুখ পূর্বেই বিবর্ণ ছিল, আজ আরও হইয়াছে। আমাকে দেখিয়া সে চক্ষু মুদ্রিত করিল। তাহাকে আরও শবের ন্যায় দেখাইতে লাগিল। কুসীকে বিছানা হইতে উঠিতে আমি বার বার অনুরোধ করিলাম।
তাহার পিতার সাক্ষাতেই আমি তাহাকে বলিলাম,–কুসুম! আমি ডাক্তার! বুড়ো মানুষ। আমার এখন কাশীবাস হইলেই হয়। কাশী জান তো? সেই কাশীতে গিয়া থাকিলেই হয়। তোমার মনে যদি কোন কথা থাকে তো চুপি চুপি আমাকে বল আমি সত্য করিয়া বলিতেছি যে, নিশ্চয় তোমার মত আমার একটি পাতানো কন্যা ছিল। তাহাকে আমি বড় ভালবাসিতাম। তাহার জন্য আমি সর্বস্বান্ত হইতে প্রস্তুত আছি কুসুম, মা যদি তোমার মনে কোন কথা থাকে, তাহা হইলে আমাকে গোপনে বল। তোমার পিতাকে বাহিরে যাইতে বলি।
এই শেষকালেও যদি বিবাহ নিবারণ করিতে পারি, সেই আশায় আমি এত কথা বলিলাম। কিন্তু এই ঘটনার প্রকৃত অর্থ কি, তাহা আমি জানিতে না পারিলে, কি করিয়া আমি প্রতিবন্ধকতা করি? আমার প্রতি কুসীর বিশ্বাশ হইবে, নির্ভয়ে সে আমাকে মনের কথা বলিতে সাহস করিবে, সেই জন্য আমি কাশী শব্দ কয়বার উচ্চারণ করিলাম, সেই জন্য পাতানো মেয়ের কথা উল্লেখ করিলাম। কিন্তু কুসী চক্ষু উন্মীলিত করিল না, একটি কথাও বলিল না, চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ঠিক যেন মৃতলোকের মত পড়িয়া রহিল আমি কুসীর হাত দেখিলাম, নাড়ী অতি দুর্বল বটে, কিন্তু তাহাতে কোনরূপ রোগের চিহ্ন অথবা আশু মৃত্যলক্ষণ কিছুই দেখিতে পাইলাম না। বাহিরে আসিয়া রসময়বাবুকে বলিলাম যে, আপনার কন্যার যেরূপ নাড়ী আমি দেখিলাম, তাহাতে মৃত্যু হইবার কোন ভয় নাই।
নবম পরিচ্ছেদ – কিঁষ্টা। কিঁষ্ট কুঁথায় রে
কুসীর যে আর একবার বিবাহ হইয়াছে, কাশীতে তাহার পতিকে যে আমি দেখিয়াছি, সেই সব কথা প্রকাশ করিবার নিমিত্ত সে দিনও আমার বার বার ইচ্ছা হইল। কিন্তু রসময়বাবু সে কথা অবগত আছেন কি না-আছেন, তাহা আমি জানিতে পারি নাই। সকল কথা প্রকাশ করিলে কুসীর পক্ষে ভাল হইবে কি মন্দ হইবে, তাহাও আমি স্থির করিতে পারিলাম না। তাহার পর ইহাদের সহিত আমার কোন সুবাদ সম্পর্ক নাই। বৃথা পরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন কি? এরূপ ভাবিয়া-চিন্তিয়া আমি চুপ করিয়া রহিলাম। কিন্তু এই কয় দিন ধরিয়া, যাহাতে এ বিবাহ না হয়, সে নিমিত্ত নিয়তই ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিতেছিলাম। কোনরূপ দৈবঘটনা সূত্রে এ বিবাহ নিবারিত হইবে, কয় দিন ধরিয়া সেই আশা আমার মনে বলবতী ছিল। কিন্তু বিবাহলগ্ন যতই নিকটবর্তী হইতে লাগিল, ততই সে আশা আমার মন হইতে তিরোহিত হইতে লাগিল। তবুও সন্ধ্যা পর্যন্ত, একটু কোনরূপ শব্দ হয়, কি কেহ উচ্চৈঃস্বরে কথা কয়, কি কেহ কোন স্থান হইতে দৌড়িয়া আসে, আর আমার হৃৎপিণ্ড দুড় দুড় করিয়া উঠে, আর আমি মনে ভাবি, এইবার বুঝি এই কাল-বিবাহ-নিবারণের ঘটনা ঘটিল।
আর একটি কথা। বাবুর সহিত হয় তো কুসীর বিবাহ হয় নাই। এই সব ব্যাপারের ভিতর হয় তো কোন মন্দ কথা আছে। সে সন্দেহও আমার মনে বার বার উদয় হইতে লাগল। কিন্তু যখন আবার কুসীর সেই মধুমাখা মুখ আর বাবুর সেই সরল ভাব চিন্তা করিয়া দেখি, তখন সে সন্দেহ আমার মন হইতে তিরোহিত হয়। ফল কথা, আমি কিনুই বুঝিতে পারিলাম না।
কোনরূপ দৈব ঘটনা ঘটিয়া এ কাল-বিবাহ বন্ধ হইয়া যাইবে, অনুক্ষণ আমি সেই আশা করিতেছিলাম; কিন্তু আমার সকল আশা বৃথা হইল। সন্ধ্যা উপস্থিত হইল, বিবাহ নিবারণের নিমিত্ত কোনরূপ ঘটনা ঘটিল না। বিবাহের লগ্ন উপস্থিত হইল।
যথাসময়ে সভায় বরকে আনিবার নিমিত্ত রসময়বাবু আমাকে প্রেরণ করিলেন। বরযাত্রীদিগের বাসায় গমন করিয়া বর ও বরযাত্রীদিগকে আমি গাত্রোখান করিতে বলিলাম। আর সকলে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, বর উঠিলেন না। তিনি চীৎকার করিয়া বলিলেন,–কিঁষ্টা। ও কিঁষ্টা।
আমি হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। ইহার অর্থ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। মনে মনে কহিলাম যে, এ হতভাগা ফোলার সব বিটকেল!
বর পুনরায় চীৎকার করিয়া উঠিলেন,–কিঁষ্টা! কিঁষ্টা কুঁথায় রে! যে বাটীতে বরযাত্রীদিগের বাসা হইয়াছিল, সেই স্থানে ফুলের বাগান ছিল। বৈশাখ মাস। সেই বাগানে অনেক যুঁই, চামেলি, বেলা প্রভৃতি ফুটিয়া ছিল। সেই ফুলবাগান হইতে এক জন চীৎকার করিয়া উঠিল,–ঐঃ! এই পদাই আজ্ঞে।
তখন আমি বুঝিতে পারিলাম যে, দিগম্বরবাবুর সঙ্গে যে বাঙ্গালী চাকর ছিল, তাহার নাম কিঁষ্টা বা কৃষ্ণ। তাহাতে তিনি ডাকিতেছিলেন। কিঁষ্টার বাড়ী বোধ হয় পশ্চিমবংগে। দিগম্বরবাবু পুনরায় চীৎকার করিয়া বলিলেন, ঐঃ। শীগগির আয়! লগ্ন ভষ্ম হয় যে রে।
কিঁষ্টা তাড়াতাড়ি আসিয়া তাহার হাতে একছড়া ফুলের মালা দিল। বাগান হইতে ফুল লইয়া চুপি চুপি একছড়া মালা গাঁথিতে চাকরকে তিনি আজ্ঞা করিয়াছিলেন। সেই মালার জন্য ব্যস্ত হইয়া তিনি চাকরকে ডাকিতেছিলেন। মালা পাইয়া হৃষ্টচিত্তে তাহা গলায় পরিয়া বর গাত্রোত্থান করিলেন।
বর গাত্রোত্থান করিয়াছেন এমন সময় রসময়বাবু হাঁপাইতে হাঁপাইতে দৌড়িয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন ঠিক সন্ধ্যা হইয়াছিল; সন্ধ্যার পরেই বিবাহের লগ্ন ছিল। রাত্রি দশটার পর আর এক লগ্ন ছিল। রসময়বাবু আমার কানে কানে বলিলেন,–কুসুম কিরূপ করিতেছে, শীঘ্র চলুন।
তাহার পর বরযাত্রীদিগকে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলিলেন—মহাশয়গণ! আমার কন্যার শরীর সহসা কিছু অসুস্থ হইয়াছে। এ প্রথম লগ্নে বোধ হয় বিবাহ হইবে না। রাত্রি দশটার পর যে লগ্ন আছে, সেই লগ্নে বিবাহ হইবে।
রসময়বাবুর সহিত তাড়াতাড়ি আমি তাহার বাটীতে যাইলাম। যে ঘরে কুলী শয়ন করিয়াছিল, সেই ঘরে তিনি আমাকে লইয়া গেলেন। আমি দেখিলাম যে, কুসীর মুখ নিতান্ত রক্তহীন হইয়া বিবর্ণ হইয়াছে। চক্ষু বুজিয়া সে শয়ন করিয়া আছে। ডাকিলে উত্তর প্রদান করে না। হাত ধরিয়া দেখিলাম যে, তাহার নাড়ী আরও দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। ঘর হইতে বাহির হইয়া আমি রসময়বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম,—আপনার বাড়ীতে অভিভাবক-স্বরূপ যে স্ত্রীলোকটি আছেন, তিনি কি আপনার শালী, কুসুমের মাসী? তিনিই কি কুসুমকে প্রতিপালন করিয়াছেন?
রসময়বাবু উত্তর করিলেন,–হাঁ! তিনিই কুসুমের মাসী, তিনিই কুসুমকে প্রতিপালন করিয়াছেন।
আমি বলিলাম,–আপনার কন্যার লক্ষণ আমি ভাল দেখিলাম না। তাহাকে কিছু ঔষধ দিতে হইবে। কিন্তু কুসুমের মাসীকে আমি গোপনে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি। স্ত্রীলোকদিগের নানা প্রকার রোগ হয়। ডাক্তার ভিন্ন অন্য লোকের সে সব কথা শুনিয়া আবশ্যক নাই। কুসুমের মাসীকে জিজ্ঞাসা করিয়া, তাহার পরে আমি ঔষধের ব্যবস্থা করিব।
বাড়ীর ভিতর একপার্শ্বে ছোট একটি ঘর ছিল, সেই ঘরে আলো জ্বলিতেছিল। দুই জন পাঞ্জাবী খ্রীলোক তাহার ভিতর বসিয়া কি করিতেছিল। রসময়বাবু তাহাদিগকে সে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিলেন। ঘরের ভিতর দ্বারের নিকট একখানি চারপাই ছিল। আমাকে সেই চারপাইয়ে বসিতে বলিয়া রসময়বাবু চলিয়া গেলেন।
অল্পক্ষণ পরে কুসুমের মাসী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সম্পূর্ণভাবে নয়, কিন্তু ঘোমটা দ্বারা কতকটা তিনি মুখ আবৃত করিয়াছিলেন।
আমি তাঁহাকে বলিলাম,–কুসুমের প্রাণ সংশয় হইয়াছে। আপনি বোধ হয় জানেন যে, আমি একজন ডাক্তার। আপনাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি তাহাকে ঔষধ দিতে পারিতেছি না। তাহার সম্বন্ধে অনেক কথা আছে। আপনি বসুন। দাঁড়াইয়া থাকিলে হইবে না।
মাসী মৃদুস্বরে উত্তর করিলেন,–কুসুমকে তুমি ভাল কর, বাবা! কুসুমকে লইয়া আমি সংসারে আছি। ছয় দিনের মেয়েকে আমার হাতে দিয়া তাহার মা মারা পড়িয়াছে। সেই অবধি আমি তাহাকে মানুষ করিয়াছি। তুমি তাকে ভাল কর, বাবা!
আমি উত্তর করিলাম,–রসমময়বাবুর সহিত আমার ভাই সম্পর্ক। কুসুমকে আমি কন্যার মত দেখি। সে জন্য আপনি আমাকে বাবা বলিতে পারেন না। কুসুমকে ভাল করিতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। তাহার রোগের কারণ কি, তাহা জানিতে না পারিলে কি করিয়া আমি ঔষধ দিব?
মাসী বলিলেন,–আর বৎসর এই সময় তাহার জুর-বিকার হয়। তাহার পর–
আমি বলিলাম,–সে কথা নয়। আমি আপনাকে যে যে কথা জিজ্ঞাসা করিব, তাহার উত্তর ঠিক দিবেন কি না?
মাসী উত্তর করিলেন,—তা কেন দিব না। আমার কুসীর প্রাণ বড়, না আর কিছু বড়।
আমি বলিলাম,–তবে আপনি বসুন। অনেক কথা আমি জিজ্ঞাসা করিব।
মাসী দ্বারের নিকট ভূমিতে উপবেশন করিলেন। আমি চারপাইয়ের উপর বসিয়া রহিলাম।
আমি বলিলাম,–কুসুমকে আমি ইহার পূর্বে দেখিয়াছি। দুই বৎসরের অধিক হইল, তাহার সহিত কাশীতে আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তাহার সহিত সে সময় একজন অল্পবয়স্ক পুরুষ মানুষ ছিল। কুসুম তাকে বাবু বলিয়া ডাকিত। কুসুম আমাকে বলিয়াছিল যে, বাবু তাহার স্বামী। সে কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এ সব আবার কি?
আমার পা দুইটি ভূমিতে ছিল। কুসুমের মাসী শশব্যস্ত হইয়া সেই পা জড়াইয়া ধরিলেন।
মাসী বলিলেন,–পাপ হউক, পূণ্য হউক, কুসীর ভালর জন্য আমি কাজ করিতেছি। তোমার পায়ে পড়ি, তুমি কোন কথা প্রকাশ করিও না। প্রকাশ করিলে বড় কেলেঙ্কারি হইবে। পৃথিবীতে আমি আর মুখ দেখাইতে পারিব না। যতক্ষণ না তুমি আমার কথা স্বীকার করিবে, ততক্ষণ আমি তোমার পা ছাড়িব না।
ও কি করেন? ও কি করেন! বলিয়া আমি আমার পা সরাইয়া লইতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু মাসী কিছুতেই আমার পা ছাড়িলেন না। আমি বড় বিপদে পড়িলাম।
আমি বলিলাম,–আপনি স্থির হউন। কেহ যদি এ স্থানে আসিয়া পড়ে, তাহা হইলে সে কি মনে করিবে! যদি কুসুমের প্রতি নিতান্ত কোনরূপ অন্যায় না দেখি, তাহা হইলে আমি প্রকাশ করিব না। আপনাদের ঘরের কথায় আমার প্রয়োজন কি? পাপ হয়, পূণ্য হয়, তাহার জন্য আপনারা দায়ী। আমার হাতে কি? কিন্তু কুসীর প্রতি আপনারা কোন অত্যাচার করিতেছেন কি না, তাহা আমাকে বুঝিয়া দেখিতে হইবে।
মাসী উত্তর করিলেন,—কুসীর প্রতি অত্যাচার! যাহার জন্য এই কলঙ্কের পসরা আমি মাথায় লইতেছি, তাহার প্রতি আমি অত্যাচার করিব! রায় মহাশয় কোন কথা জানে না।
আমি বলিলাম,–রসময়বাবু যে কিছু জানেন না, তাহা আমি বুঝিতে পারিয়াছি। এখন বলুন, সে বাবু কে? সে প্রকৃত কুসুমের স্বামী কি না? যদি কুসুমের সহিত তাহার বিবাহ হইয়া তাকে, তাহা হইলে পুনরায় বিবাহ দিতেছেন কেন?
ইতিপূর্বে মাসী আমার পা ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। এখন তিনি পুনরায় দ্বারের নিকট গিয়া বসিলেন। কাহাকেও আসিতে দেখিলে তিনি সাবধান হইতে পারিবেন, সে নিমিত্ত দ্বারের একটু বাহিরে বারেতে তিনি উপবেশন করিলেন! তাহার পর তিনি পুর্ব বৃত্তান্ত আমাকে বলিতে লাগিলেন।
এই পূর্ব বৃত্তান্ত আমি আমার নিজের কথাতে বলিব; কুসুমের মাসী যে ভাবে বলিয়াছেন, সে ভাবে বলিব না। তাহার কারণ এই যে তিনি সংক্ষেপে সকল কথা বলিয়াছিলেন।
এই সমুদয় ঘটনার পরে অন্যান্য লোকের মুখ হইতে আমি যে সকল কথা সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহাও আমি এই বিবরণে যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিলাম।