বাবা যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলো তখন আমার বয়স এগারো বছর। আমি সেদিন একদমই ভেঙ্গে পরি। কারণ আমি পরিবারের বড় মেয়ে আর আমার আরো দুই ভাই বোন আছে। একজন ভাই ও আমার থেকে তিন বছরের ছোট তারপর আমার ছোট বন। মা বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকে। বাবা যখন মারা গেলো তখন আমার উপর পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পরে। আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু আমার লেখাপড়া করার অনেক ইচ্ছা ছিলো। হয়তো আমি সে কপাল নিয়ে জন্মাইনি।
বাবা মারা যাওয়ার এক মাস পর থেকে আমি মানুষের বাসায় কাজ করতে শুরু করলাম। কারণ আমি ছাড়া আমার পরিবার অচল আর কোন আয়ের উৎস ও নেই। আর কাজ না করলে তো কেউ খেতেও পাবো না।
আমার ইচ্ছে ছিলো আমি রোজকার করে আমার ছোট ভাইটাকে মানুষের মতো মানুষ করবো কিন্তু ও লেখাপড়ায় এতো খারাপ ছিলো যে ক্লাস থ্রির দরজা পার হতো পারেনি। আমার আর একটা ইচ্ছা মাটি চাপা পড়ে গেলো। নিজে তো পারলাম না সাথে ছোট ভাইটাকেও মানুষ করতে পারলাম না।
মিরপুর এ একটা বাসায় কাজ করতাম তখন মাস এ দুই হাজার টাকা দিতো। আমার কাছে কিছু টাকা রাখতাম কিছু মায়ের মেডিসিন কিনতে আর পরিবারের অন্যান্য খরচ করতে গিয়ে কোন রকমেই পেরে উঠতাম না।
খুব কষ্ট হতো ভালো কিছু খেতে পেতাম না, ভালো একটা জামা পরতে পারতাম না। বাসায় যে একটু টিভি দেখবো সে সুযোগ টা পেতাম না। ফ্লোর এ এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত পার করতাম। মশার কামড় খেতে খেতে সহ্য হয়ে গেছে এখন।
একদিনের ঘটনা আমি রাতের কাজ শেষ করে ঘুমাতে যাবো কিন্তু হঠাৎ গায়ে জ্বর অনুভব করি। ভাবলাম আজকের রাতটা সোফায় ঘুমাই। রাত দুটা নাগাদ ঘুম আসলো না। ফজরের আগে যখন চোখটা একটু লেগে আসলে তখন “আদিরা” বলে কেউ যেন ডাক দিলো। আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি ম্যাডাম দাড়িয়ে আছে। ডাইনিং এর আলোতে ম্যাডাম এর অগ্নি চেহারা বলছে কি ব্যাপার তুই এখানে কেন। আমি তার আগেই বললাম।
“কাল রাতে আমার গায়ে জ্বর আসে তাই সোফায় শুয়েছিলাম।
“উঠ এক্ষুনি উঠ সোফাগুলো ময়লা হয়ে যাবে। যা পাকঘরে গিয়ে শো।
আমি চুপ করে গিয়ে পাকঘরের ফ্লোরে শুয়ে পরলাম। তারপর আসতে আসতে জ্বর কমে যায়। আমিও সুস্থ হয়।
মাসের বেতন পেলে ভাবলাম বাড়ি যাবো। মাকে দেখে আসবো আর ভাবলাম একটা মোবাইল কিনবো। মায়ের সাথে কথা বলার জন্য। ওরা আমাকে ভালোভাবে কথা বলতে দেয়না। মাসের শেষে বেতন পেয়ে ছুটি নিয়ে বাসায় গেলাম। মাকে দেখে মনে হলো মার কোন উন্নতি হয়নি। মাকে দেখার পর মার সামনে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। কান্না চলে আসে।
আমি আবার চার দেয়ালে বন্দি হয়ে গেলাম। মাসের বেতন দিয়ে ছোট একটা ফোন কিনেছি। একদিন অচেনা এক নাম্বার থেকে ফোন আসে। আমি প্রথমে ভাবলাম রিসিভ করবো না কিন্তু আবার ভাবলাম যদি মা কারে ফোন থেকে ফোন করে তাই রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে একটা ছেলের কন্ঠ শোনা গেল। আমি চুপ করে আছি কিন্তু একটু পরে দেখলাম কেটে গেছে। আমিতো কাউকে নাম্বার দেইনি তাহলে কিভাবে পেল?
আমি যখন কাজ শেষ করে ঘুমোতে যাবো তখন আবার ফোনটা বেজে উঠলো ওই একই নাম্বার থেকে।
“কে আপনি?
“আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চায়।
“আমি আপনাকে চিনিনা। দোয়া করে আর ফোন দিবেন না।
একথা বলেই ফোনটা রেখে দিলাম। এভাবে প্রায় রাতে ওই ছেলেটা ফোন দিতো। এক সময় আমি কথা বলি একটু কিন্তু পরে ওর কথা বার্তা ভালো মনে হয়নি। খারাপ কিছু প্রস্তাব করে আমায়।
.
কিছুদিন পর দেখলাম অনেক নাম্বার থেকে ফোন আসতে শুরু করল। আমি বাধ্য হয়ে নাম্বার টা পরিবর্তন করলাম। সাথে সাথে বাসটাও। এখানের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিনা। খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট, আমার বেতনের টাকা দিয়ে যদি একটা ভালো জামা কিনে পড়তাম ওরা এসব সহ্য করতে পারেনা। আমার কি শখ নেই? নাকি আমি মানুষ না।
বাসায় এসে প্রায় একমাস ছিলাম এর মধ্যে আমার হাতে যা টাকা ছিলো সব খরচ হয়ে যায়। আবার সেই কাজ। মিরপুর তিনে।আমার দুর সম্পর্কের চাচার মাধ্যমে কাজটা পেয়েছি। এ বাসার লোকেরা আসলেই অন্যরকম ছিলো। জীবনভর অপমান, আর কটু কথা শুনে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। আমি ভাবতাম এই পৃথিবীতে বোধহয় ভালো মানুষ নেই। কিন্তু এ বাসায় কাজে এসে আমার চিন্তাধারা পুরো পরিবর্তন হয়ে গেছে।
ম্যাডাম যদি কোথাও বের হতো আমাকে তার সাথে নিয়ে যেত। সব সময় বলতো “তোর যখন যে জিনিস লাগবে আমাকে শুধু একবার বলবি। আমি তোর কোন ইচ্ছায় অপূর্ণ রাখতে চায়না। আমি মাঝেমাঝে বিশ্বাস করতে পারতাম না। এসব কি সত্যি নাকি সপ্ন?
ভালোই কাটলো তিনটা মাস। কিন্তু ম্যাডাম এর ভাই আসলো কিছুদিনের জন্য ম্যামের বাসায় তখন ঘটলো বিপদ। যেমন আমাকে উনি সবসময় ফলো করতো। আমি কি করি না করি দেখতো।
একদিন উনার ঘরে আমি চা দিতে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার হাত ধরে। আমার সাথে জোরাজুরি করে কিন্তু আমি সেদিন রক্ষা পাই।
তারপর আমি ম্যাম কে মিথ্যে বলি যে আমার মা অসুস্থ এবং বাড়িতে চলে আসি। আমি বুঝিনা আমি গরিব বলে মানুষের বাসায় কাজ করি কিন্তু সেইখানেও আমার নিরাপত্তা নেই। সেখানে আমাকে এতোটুকু ভালো চোখে দেখে না। কাজের মেয়ে মানেই কি খারাপ?