এক ছিলেন সওদাগর— তাঁর একটি সামান্য ক্রীতদাস তাঁর একমাত্র ছেলেকে জল থেকে বাঁচায়। সওদাগর খুশি হয়ে তাকে মুক্তি তো দিলেনই, তা ছাড়া জাহাজ বোঝাই ক’রে নানা রকম বাণিজ্যের জিনিস তাকে বকশিশ দিয়ে বললেন, “সমুদ্র পার হয়ে বিদেশে যাও— এই সব জিনিস বেচে যা টাকা পাবে, সবই তোমার।” ক্রীতদাস মনিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে চড়ে রওনা হল বাণিজ্য করতে।
কিন্তু বাণিজ্য করা আর হল না। সমুদ্রের মাঝখানে তুফান উঠে জাহাজটিকে ভেঙ্গে-চুরে জিনিসপত্র লোকজন কোথায় যে ভাসিয়ে নিল, তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
ক্রীতদাসটি অনেক কষ্টে হাবুডুবু খেয়ে, একটা দ্বীপের চড়ায় এসে ঠেকল। সেখানে ডাঙ্গায় উঠে সে চারিদিকে চেয়ে দেখল, তার জাহাজের চিহ্নমাত্র নাই, তার সঙ্গের লোকজন কেউ নাই। তখন সে হতাশ হয়ে সমুদ্রের ধারে বালির উপর বসে পড়ল। তারপর যখন সন্ধ্যা হয়ে এল, তখন সে উঠে দ্বীপের ভিতর দিকে যেতে লাগল। সেখানে বড় বড় গাছের বন— তারপর প্রকাণ্ড মাঠ, আর তারই ঠিক মাঝখানে চমৎকার শহর। শহরের ফটক দিয়ে মশাল হাতে মেলাই লোক বার হচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই সেই লোকেরা চীৎকার ক’রে বলল, “মহারাজের শুভাগমন হোক। মহারাজ দীর্ঘজীবী হউন।” তারপর সবাই তাকে খাতির ক’রে জমকালো গাড়িতে চড়িয়ে প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে নিয়ে গেল। সেখানের চাকরগুলো তাড়াতাড়ি রাজপোশাক এনে তাকে সাজিয়ে দিল।
সবাই বলছে, ‘মহারাজ’,’মহারাজ’, হুকুম মাত্র সবাই চট্পট্ কাজ করছে, এসব দেখেশুনে সে বেচারা একেবারে অবাক। সে ভাবল সবই বুঝি স্বপ্ন— বুঝি তার নিজেরই মাথা খারাপ হয়েছে তাই এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে সে বুঝতে পারল সে জেগেই আছে আর দিব্যি জ্ঞানও রয়েছে, আর যা যা ঘটছে সব সত্যিই। তখন সে লোকদের বলল, “এ কি রকম হচ্ছে বল তো? আমি তো এর কিছুই বুঝছি না। তোমরা কেনই বা আমায় ‘মহারাজ’ বলছ আর কেনই বা এমন সম্মান দেখাচ্ছ?”
তখন তাদের মধ্যে থেকে এক বুড়ো উঠে বলল, “মহারাজ, আমরা কেউ মানুষ নই— আমরা সকলেই প্রেতগন্ধর্ব— যদিও আমাদের চেহারা ঠিক মানুষের মতো। অনেক দিন আগে আমরা, ‘মানুষ রাজা’ পাবার জন্য সবাই মিলে প্রার্থনা করেছিলাম; কারণ মানুষের মতো বুদ্ধিমান আর কে আছে? সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের মানুষ রাজার অভাব হয়নি। প্রতি বৎসরে একটি ক’রে মানুষ এইখানে আসে আর আমরা তাকে এক বৎসরের জন্য রাজা করি। তার রাজত্ব শুধু ঐ এক বৎসরের জন্যই। বৎসর শেষ হলেই তাকে সব ছাড়তে হয়। তাকে জাহাজে ক’রে সেই মরুভূমির দেশে রেখে আসা হয়, সেখানে সামান্য ফল ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না— আর সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বালি না খুঁড়লে এক ঘটি জলও মেলে না। তারপর আবার নূতন রাজা আসে— এই রকমে বৎসরের পর বৎসর আমাদের চলে আসছে।”
তখন দাসরাজা বললেন, “আচ্ছা বল তো— এর আগে তোমাদের রাজারা কি রকম স্বভাবের লোক ছিলেন?” বুড়ো বলল, “তাঁরা সবাই ছিলেন অসাবধান আর খামখেয়ালি। সারাটি বছর সবাই শুধু জাঁকজমক আমোদে আহ্লাদে দিন কাটাতেন— বছর শেষে কি হবে সে কথা ভাবতেন না।”
নতুন রাজা মন দিয়ে সব শুনলেন, বছরের শেষে তাঁর কি হবে এই কথা ভেবে ক’দিন তাঁর ঘুম হল না।
তারপর সে দেশের সকলের চেয়ে জ্ঞানী আর পণ্ডিত যারা, তাদের ডেকে আনা হল, আর রাজা তাদের কাছে মিনতি ক’রে বললেন, “আপনারা আমাকে উপদেশ দিন— যাতে বছর শেষে এই সর্বনেশে দিনের জন্য প্রস্তুত হতে পারি।”
তখন সবচেয়ে প্রবীণ বৃদ্ধ যে, সে বলল, “মহারাজ, শূন্য হাতে আপনি এসেছিলেন, শূন্য হাতেই আবার সে দেশে যেতে হবে— কিন্তু এই এক বছর আপনি আমাদের যা ইচ্ছা তাই করাতে পারেন। আমি বলি— এই বেলা রাজ্যের ওস্তাদ লোকদের সে দেশে পাঠিয়ে, সেখানে বাড়ি ক’রে, বাগান ক’রে, চাষবাসের ব্যবস্থা ক’রে চারিদিক সুন্দর করে রাখুন। ততদিনে ফলে ফুলে দেশ ভরে উঠবে, সেখানে লোকের যাতায়াত হবে। আপনার এখানকার রাজত্ব শেষ হতেই সেখানে আপনি সুখে রাজত্ব করবেন। বৎসর তো দেখতে দেখতে চলে যাবে, অথচ কাজ আপনার ঢের; কাজেই বলি, এই বেলা খেটে-খুটে সব ঠিক ক’রে নিন।” রাজা তখনই হুকুম দিয়ে লোকলস্কর, জিনিসপত্র, গাছে চারা, ফলের বীজ, আর বড় বড় কলকব্জা পাঠিয়ে, আগে থেকে সেই মরুভূমিকে সুন্দর ক’রে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলেন।
তারপর বছর যখন ফুরিয়ে এল, তখন প্রজারা তাঁর ছত্র মুকুট রাজদণ্ড সব ফিরিয়ে নিল, তাঁর রাজার পোশাক ছাড়িয়ে এক বছর আগেকার সেই সামান্য কাপড় পরিয়ে, তাঁকে জাহাজে তুলে সেই মরুভূমির দেশে রেখে এল। কিন্তু সে দেশ আর এখন মরুভূমি নেই— চারিদিকে ঘর বাড়ি, পথ ঘাট, পুকুর বাগান। সে দেশ এখন লোকে লোকারণ্য। তারা সবাই এসে ফুর্তি ক’রে শঙ্খ ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে নিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিল। এক বছরের রাজা সেখানে জন্ম ভরে রাজত্ব করতে লাগলেন।