( জীবন থেকে নেয়া)
বাংলায় একটা কথা আছে ’ যে থালায় খাও, সেই থালায় ছিদ্র করা’ । এহেন কাজ করা লোকের সংখ্যা কম নয় এই দুনিয়ায় । তাই বলে ভালো মানুষ ও একেবারে অপ্রতুল নয় । ভালমানুষদের জাদুঘরে সাজিয়ে রাখার যুগ এখনো আসেনি , যদিও সবাই এই সময়টাকে কলিযুগ বলে আখ্যায়িত করে থাকে । কিছু নি:স্বার্থ ভাল মানুষ আছে বলে দুনিয়াটা এখনো টিকে আছে । তারা শুধু নিজেদের ভাল নিয়ে ভাবে না, আশেপাশের মানুষ গুলোর ভালোর কথাও তারা ভাবে । শুধু ভাবে না, করে ও দেখায় । বিনিময়ে কি পেল তা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই । কারন তারা দু:খ পেতে চায় না । ভালবাসায় দু:খ না পাওয়ার একটা উপায় হল ‘পাওয়ার আশা না করে ভালবেসে যাওয়া’ ।
.
সাতাশতম রমজান চলছে । আলিফের দুদিন ধরে জ্বর । কোনমতেই জ্বর কমছে না । সকালের দিকে তার জ্বর টা হালকা কম মনে হচ্ছে । সময়মত ওষুধ খেতে হয় তাই তার রোজা রাখা হচ্ছে না । সে সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র । মা তাকে খেতে দিল । খাওয়ার সময় সে খেয়াল করল মায়ের মুখটা খুব বিষন্ন মনে হচ্ছে । সে আরেকটা জিনিস খেয়াল করল, তাদের দালানের উপর থেকে নিচে মানুষ ছুটাছুটি করছে । সে সিড়িতে লোকজনের পায়ের আওয়াজ শুনতে পারছে । তার কিছুটা খটকা লাগল ব্যাপারটা । সে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মা কিছু হয়েছে নাকি?’ মা তার বন্ধুর মত ছিল । তিনি বললেন ‘ তোর চাচার দোকানে যে ছেলেটা রোজা একমাসের জন্য রাখা হয়েছিল , সে সেহেরীর পর ঘুমের মধ্যে মারা গেছে ।’ কথাটা শুনে আলিফ একটু চমকিত হল ‘সে এখন কোথায় ?’
‘তাকে সিএনজিতে করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে ।’
বাড়ির সবার মধ্যে একটা ভয় কাজ করছিল । এখন যদি পুলিশ কেস হয় তাহলে পরিবারের সবাই ফেসে যাবে । ছেলেটা এক মাসের জন্য রাখা হয়েছিল বিধায় তার সম্পর্কে তার চাচারা নাম ছাড়া তার বিশেষ কিছু জানত না । তার চাচাদের একটা বিশেষ গুণ হল , তারা সবসময় মানুষকে হেয় করে কথা বলে আর অতি অহংকারী । এজন্য প্রতিবেশীদের সাথে ও তাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল না এমনকি আশেপাশের দোকানীদের সাথে ও না । তারা শুধু একটা কথাই বারবার বলছিল , ‘আমরা কেন ভয় পাবো, আমরা কিছু করিনি । ছেলেটা স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ।’ কে কি করেছে বা করেনি , তা বের হবে তদন্তের পর । আলিফ সব হিসাব করে দেখলে তার চাচাদের ডুব মারা চান্স শতভাগ ।
.
কথায় বলে বিপদ যখন আসে তখন চতুর্দিকে আসে । যে ছেলেটা মারা গেছিল তার নাম ছিল হাফিজ । তার বাবা একজন অবসর প্রাপ্ত আর্মি ছিলেন । বর্তমানে চৌকিদারির কাজ করেন একটা শপিং কমপ্লেক্সে । তিনি ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে শহর থেকে ছুটে এলেন সদর হাসপাতালে । এসে দেখলেন , ছেলের জায়গা হয়েছে হাসপাতালের মেঝেতে । একটা পাটির উপরে । মাছি উড়ছে তার ছেলের শরীরে । ছেলের আশেপাশে পাহারায় কেউ ছিল না । পড়েছিল বেওয়ারিশ অবস্থায় । ছেলের এহেন অবস্থা দেখে উনার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল । হোক না স্বাভাবিক মৃত্যু অন্তত দোকানের মালিক থাকলেও তিনি শান্তি পেতেন । তিনি মনে মনে এর উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার জন্য মনস্থির করলেন । আলিফের চাচারা তখন তাদের কথিত এক বসের সাথে পরামর্শ করতে গেছেন । মৃত হাফিজ কে যখন পোস্টমর্টেম করানোর জন্য নেয়া হচ্ছিল তখনও দোকানের মালিক মানে আলিফের দুজন চাচা হাসপাতালে ছিলেন না । They are still discussing and thinking…. মৃত হাফিজের বাবা জানতেন তার ছেলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে । তাই পোস্টমর্টেম করেও কোন লাভ হবে না । তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন কিছু একটা করার । সুযোগ পেয়ে গেলেন । পোস্টমর্টেম ডাক্তার আসার আগে তিনি হাসপাতালের এক ঝাড়ুদাড় কে টাকা খাওয়ালেন । ঝাড়ু দেয়ার বাহানায় ঝাড়ুদাড় ওয়ার্ডে ঢুকে বাবার কথামত ডেড বডির মাথার পেছনে রড দিয়ে আঘাত করল । ব্যস কাজ শেষ ।
.
মৃত হাফিজের বাবা আলিফের শত্রু আবার পাড়াপড়শি ও দোকানদার রা ও চাচার শত্রু । শত্রুর শত্রু এখন পরম বন্ধু হয়ে গেল । খুঁটিনাটি যত ধরনের তথ্য আছে সব মৃত হাফিজের বাবাকে শেয়ার করল ।ওনার আর্থিক সমস্যা ছিল , দোকানদার সবাই মিলে লাখ খানেক টাকা তুলে উনাকে দিলেন । পাশাপাশি উনাকে উস্কে দিলেন কেস করার জন্য । উনি ভেতর থেকে সাহস পেলেন । চাচারা তখনো বুক ফুলিয়ে হাটত, অহমিকা কিঞ্চিত কমেনি । যেন কিছুই হয়নি । যদি উনারা কিছুটা ছেলের বাবাকে সাহায্য করতেন, মৃত ছেলের মেজবানের জন্য একটা গরু দিতেন তাহলে তিনি অতটা কঠোর হতেন না । an eye for an eye… প্রয়োজনীয় তথ্য উনার হাতে ছিল । তিনি একটা কাহিনী সাজালেন কেসের জন্য । তাদের বড় ভাইয়ের মেয়ে আফসানার সাথে আমার ছেলে হাফিজের সম্পর্ক ছিল । তাই ভাইরা মিলে আমার ছেলেকে রড দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছেন । কেস টা শক্তিশালী হয়ে গেল । পুলিশ যখন পাড়ায় ঘটনাটা সত্যি কিনা যাচাই করতে আসে তখন সবাই তা সত্যি বলে মত দেয় । কারন তারাই ত কাহিনী টা রটিয়েছিল । কাহিনী টা তখন জনশ্রুতিতে পরিণত হল । আলিফের বাবা করিম সাহেবের দোকান আলাদা ছিল । তাছাড়া তিনি তার দোকানের গুদামে রাত কাটান । তাই তিনি এ কেস থেকে বেঁচে গেলেন । বিনা কারনে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হতে যাচ্ছে । তার ভাতিজীর এমন পরিনতি তিনি মেনে নিতে পারলেন না । তিনি তার ভাতিজীর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করে দিলেন । কারন তার বড় ভাই তখন সৌদি আরবে ছিলেন । বড় ভাইয়ের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন নিজের মেয়ে মনে করে ।
.
কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে করিম সাহেব উনার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন । শেষপর্যনন্ত উনি একটা ভাল সম্বন্ধ পেয়ে গেলেন । মামলার এক বছরের মাথায় তিনি নিজে দাড়িয়ে থেকে ভাতিজীর বিয়ে দিলেন । মামলা তখনও ঢিলেঢালা ভাবে চলছিল । করিম সাহেব নিজের মত চলতেন । খেতেন বড় ভাইয়ের পরিবারের সাথে আলাদা । কিন্তু বিধিবাম । বেশিদিন বাঁচতে পারলেন না মামলা থেকে । কাপড়ের দোকানের অপর দুভাইয়ের চামচার অভাব ছিল না, কৌশলে উনার নাম মামলায় ঢুকিয়ে দিল। ভাতিজীকে ও করা হল প্রধান সাক্ষী । কিন্তু ভাতিজী তখন অন্য পরিবারের ঘরনী । শুধু ভাতিজী আফসানা কে কোর্টে না তোলার জন্য তিনি কতবার যে এসপির পা ধরেছেন তার কোন হিসেব নেই । তিনি সফল হয়েছিলেন । আর আফসানা ও মানহানি থেকে বেঁচে গেল ।
.
আলিফের বাবা করিম সাহেব ধর্মভীরু মানুষ ছিলেন । উপকার করতে না পারুক অন্তত তিনি অন্যের অনিষ্ট করার কথা কখনও ভাবেন না । তিনি ছিলেন তার অপর দুভাইয়ের ব্যতিক্রম । সমাজের মানুষ তাকে কম বেশি ভালবাসত । অপর দোকানদার ও বাজারের মসজিদ কমিটির সাথেও তার একটা সুসম্পর্ক বজায় ছিল । নিয়মিত মসজিদে চাঁদা দিতেন আর ইমাম-মুয়াজ্জিনের খরচ চালাতেন পালাক্রমে । মামলা প্রায় নয়বছর চলেছিল । কথায় আছে, মানিকে মানিক চেনে । করিম সাহেবের অপর দুভাই যেমন ঠক, জোচ্চুর তেমনি তাদের সাথে হাটা লোক গুলোও ওরকম ছিল । তাদের তোষামুদের কারনে মামলা টা পরিনতির মুখ দেখেনি । এরমধ্যে করিম সাহেব কে নির্দোষ হওয়া সত্তেও দুবার জেল কাটতে হয়েছে । অবশেষে করিম সাহেবের অপর সৌদিআরব ফেরত ছোট ভাই মামলাটা চালানোর দায়ভার নিলেন । সবার দোয়া ছিল বিধায় করিম সাহেব বেখসুর খালাস পেলেন । আর অপর দুজন যাবজ্জীবন । তার মধ্যে একজন ফেরারী আসামী । আলিফ যাকে বিল ক্লিনটন বলে ডাকত । তার দেশ ছেড়ে পালানোর কাহিনী ছিল বেশ চাঞ্চল্যকর । নিজের স্বশুরের নাম ঠিকানা ব্যবহার করে , গোফ দাড়ি রেখে তিনি সৌদিআরব পাড়ি দিয়েছেন । আর তার দোকানের অপর পার্টনার ভাই জেলে পঁচছে । এই সুযোগে তার ভাইয়ের মাল কড়িও হাতিয়েছেন । কারন দোকানের কেশের দায়িত্বে সে ছিল। অপর ভাইয়ের চেয়ে বয়সে ছোট হলে কি হবে , চিকন বুদ্ধিতে তার মস্তক টুইটুম্বুর ।
.
করিম সাহেবের নিজের মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে । বিয়ের জন্য নানা সম্বন্ধ আসতে লাগল । ভাল সম্বন্ধও বেশ কয়েকটা এসেছে । কিন্তু কোন শেষ কথা না বলে মানে পছন্দ হয়েছে কিনা তা না বলেই তারা চুপ মেরে যেত । করিম সাহেবের দোকানে নানা মানুষের আগমন হয় । অনেক বৃদ্ধরাও তার সাথে আড্ডা দিতে চলে আসে দোকানে । একদিন জানতে পারেন যে তার ভাবী মানে আফসানার মা এসবের জন্য দায়ী কারন সম্বন্ধের বাড়িতে গিয়ে আফসানার মা তার মেয়ের নামে কুকথা রটাচ্ছেন । কথাটা তিনি প্রথমে বিশ্বাস করেননি । সম্বন্ধগুলোর বারবার চুপ করে যাওয়া দেখে তিনি কথাটা বিশ্বাস করলেন । মানুষ এমনটা অকৃতজ্ঞ কেমনে হতে পারে? বড় ভাই দেশের বাইরে থাকাকালীন নিজ দায়িত্বে তার মেয়ে দুটো বিয়ে দিলাম সে বড় ভাই ও তার স্ত্রী আমার মেয়ের বিরুদ্ধে কুকথা রটাচ্ছে । আল্লাহ এর বিচার করবে । আমি কিছু করব না, কিছু বলব না। সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলাম । আমার মেয়ের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে । কাউকে কিছু বলব না। তিনি মনে মনে বললেন । উনার নিজেকে খুব আহত মনে হল । কারন ঘরের শত্রু বিভীষন ।
গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প