অনেক ছোট থাকতে বাবা আমাকে লন্ডনে পাঠিয়েছিলো লেখাপড়া করার জন্য । কতোই বা বয়স হবে তখন, হয়তো আঁট কিংবা দশ হবে । লন্ডনে মামার কাছে থেকেছি। লেখাপড়াটাও ঐখানে শেষ করেছি। বাবা মায়ের আদর কি জিনিস সেটা খুব কাছে থেকে বোঝা হয়ে ওঠে নি। মামাও ব্যবসায়ীক কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
রং, বে-রং এর বড় বড় অট্টালিকা দেখতে দেখতে আর পিচঢালা রাস্তায় চলতে চলতে বড় হয়েছি আমি।
অবশেষে দেশে ফেরার পালা। আকাশ পথে পাড়ি জমিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের জন্মস্থানে প্রত্যাবর্তন। ইচ্ছা আছে দেশের প্রতিটা গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করার। কিন্তু বাবা তা চান না। বাবা চান তার বিশাল ব্যবসার দায়িত্ব আমার উপর চাপিয়ে দিতে ।।
কখনও বাবার কথার অবাধ্য হয় নি। মা, মারা যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি কখনও বাবার কথার অমান্য করি নি। মা, বেচে থাকা কালিন আমি খুবই চঞ্চল স্বভাবের ছিলাম। বাবা হাজারটা উপদেশ, আদেশ, নির্দেশ দিলেও একটা শুনেছি কি না আমার সন্দেহ হয়। কিন্তু মায়ের মৃত্যু পর বাবার কথামতো লন্ডনে চলে গিয়েছিলাম।আজও বাবার কথার অবাধ্য হতে পারলাম না।
বাবার বিশাল ব্যবসা ছাড়াও দুইটা বৃদ্ধাশ্রম আছে। হটাৎ একদিন কাজের প্রয়োজনে বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শনে গেলাম। তাদের অনেকের সাথে কথা বললাম। সুখ-দুঃখের কথা শুনতে লাগলাম। এভাবে আমার এক ধরনের ভালো লাগা শুরু করল। নেশা ধরে গেল, প্রায় প্রতিনিয়ত বৃদ্ধাশ্রমে যেতাম।
যেতে যেতে সকলের সাথে আমার এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল।
তাদের ভালোবাসা আমায় খুব কাছে টানত। একটা জিনিস বুঝতে আমার খুবই কষ্ট লাগত, বৃদ্ধা বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সন্তান কিভাবে রাত কাটায়, কিভাবে নরম বিছানায় ঘুমায় , এদের চোখে কি ঘুমম আসে ?
প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে থাকলে কষ্টে চোখের নিচে জ্বল জমতে থাকে।।
এখানে আমার মায়ের অভাবটা পূরন হয়ে যায়।
একবার এক বৃদ্ধ দম্পতির কাছে জানতে চায়লাম তাদের এখানে রেখে যাওয়ার পেছনের রহস্যটা কি….?
বলতে লাগল,…… আমাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনের সংসারে আলো হয়ে আসল ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান। মাথার ঘামকে পায়ে ফেলে সন্তানটির জন্য উপার্জন করেছি। সন্তানকে ভালো খবার, কাপড়-চোপড়, লেখাপড়া সব কিছুর খরচ মিটিয়ে বড় করতে লাগলাম। কষ্ট কি জিনিস কখনও বুঝতে দেয় নি। ছেলে আমার বড় হলো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে। বেশ কাটছিলো আমাদের দিন। হটাৎ ছেলেটি আমাদের না জানিয়ে পরীর মতো সুন্দরী এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনলো। কিছু মনে করি নি। । মেনে নিয়েছি। এভাবে কয়েকটা মাস কেটে গেল। আমার স্বামী প্যারালাইজড হয়ে গেল। আর এদিকে আমার শ্বাসকষ্টটাও বেড়ে গেল। সাথে কাঁশিটাও বেড়ে গেল।
আমার বউমার বিরক্তের কারণ হয়ে দাড়ালাম আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি। দিন কে দিন আমার ছেলের আচরণের পরিবর্তন দেখতে পেলাম।
অবশেষে কলিজার টুকরা ছেলে আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়ার পরিকল্পনা করল। আমার স্বামী চায় নি ছেলে এবং ছেলের বউয়ের কষ্ট হোক। তাই তো আর না করতে পারলাম না। শেষমেষ এই বৃদ্ধাশ্রমে ঠায় হয়। শুনেছি ছেলে আমার প্রতি মাসে ১০,০০০ টাকা করে দিয়ে যায়। একবারও আমাদের দেখতে আসে না। তবুও আমরা ছেলের কোন অমঙ্গল কামনা করি না। সব সময় চায় এবং চায়বো ও যেখানেই থাকুক না কেন, সব সময় যেন সুস্থ থাকে, ভালো থাকে। মায়ের দোয়া ওর সাথে সর্বক্ষণ থাকবে ।
দেখলাম বৃদ্ধা দম্পতির দুজনেই কাঁদছে। চোখের পানিগুলা ঠিকই বলে দিচ্ছে ছেলের থেকে আলাদা থাকার কষ্ট কতোটা বেদনার। আমার দুচোখের কোণায় পানি জমে টলমল করছে। জানি, চোখের পাপড়ি বন্ধ করলেই টুপ করে নিচে গড়িয়ে পড়বে।
আর এক মুহুর্ত এখানে থাকতে পারলাম না। ক্রন্দনরত চোখে বের হয়ে গেলাম।
পরেরদিন আবারও এলাম। এবার অন্য এক দম্পতির কাছে জানতে চায়লাম ঠিক একই রহস্য।।
বলতে লাগল, আজকের এই অবস্থার জন্য তারা নিজেরায় দায়ী । যৌবনকালে তারা তাদের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছিলো। ঠিক একই ভাবে বৃদ্ধ বয়সে তাদের ছেলেরাও তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছে ।
আমার এখানে কিছু বলার নেয়। শুধু একটা কথায় বলতে ইচ্ছা করছে —-
” পাপ, কখনও কখনও বাপকেও ছাড়ে না ”
কয়েকদিন পর খবর আসলো বৃদ্ধশ্রমে কেও একজন মারা গিয়েছে। খোজ নিতে গিয়ে দেখলাম সেই দম্পতির স্বামী মারা গিয়েছে। বৃদ্ধা লাশের পাশে বসে আছে কিন্তু আশ্চার্য্যের বিষয় বৃদ্ধার চোখে কোন পানি নেয়। বৃদ্ধা নিরবে বসে আছে। জানতে চায়লাম তাদের ছেলে কিংবা পরিবার থেকে কেও আসছে কি না।
কেয়ারটেকার জানালো, ছেলেকে রাতেই জানানো হয়েছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেও আসে নি । শুনে খুবই অবাক লাগলো।
এবার আমি নিজেই ফোন করলাম। ফোন দুবার বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল । তিনবারের মাথায় ফোনটা রিসিভ করল। তার বাবার মৃত্যুর কথা বলতেই বলে, জরুরি মিটিং এ আছি। বিকালে এসে লাশ নিয়ে যাবো ।
বড় ধরনের শখ লাগল মনে। এ কেমন সন্তান, বাবার মৃত্যুর সংবাদের থেকে তার মিটিংটায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ । সত্যি বড্ড ভাবাচ্ছে এরা কি আসলেই সন্তান।
বৃদ্ধা মহিলা রিকুয়েস্ট করল ছেলে আসার আগেই তার স্বামীর লাশটা দাফনের ব্যবস্থা করার জন্য। কথামতো বৃদ্ধাশ্রমের পাশেই সামান্য জায়গা করে দাফন-কাফনের কাজটা সমাপ্ত করলাম।
বৃদ্ধার ছেলে বিকালের দিকে আসল। বৃদ্ধা কথা বলল না। অতঃপর ছেলেটি চলে গেল।
আমি রাতে গেলাম বৃদ্ধার কাছে সান্তনা দেওয়ার জন্য। কিন্তু কি বলে তাকে সান্তনা দিবো সেই ভাষাটায় খুজে পাচ্ছি না।
বৃদ্ধা আমাকে আবারও আমাকে একটা রিকুয়েস্ট করল ।
” আমার মৃত্যুর খবর যেন আমার ছেলের কানে না পৌছায়। সে যেন কোনভাবেই জানতে না পারে যে আমি মারা গেছি। আর আমার লাশটা আমার স্বামীর কবরের পাশে দাফন করবে ”
এটাই ছিলো বৃদ্ধা মহিলার শেষ অনুরোধ।
একসপ্তাহ পর বৃদ্ধা মহিলাও মারা গেল। বৃদ্ধার কথা মতো তার ছেলেকে মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া হয় নি। এবং মৃত দেহটা তার স্বামীর কবরের পাশেই দাফন করে দিলাম।
আজ কেমন যেন মনে শূন্যতা অনুভব করছি। খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে চোখে জ্বলধারার সৃষ্টি হয়েছে।
বৃদ্ধার জন্য কেও কাঁদার মতো না থাকলেও আমি কাঁদছি। জানি না কেন, কিন্তু মেনে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে ।।
যাদের বাবা-মা নেই, তারাই বুঝে বাবা-মা না থাকার কষ্ট কেমন। আবার অনেকেরই বাবা-মা থেকেও বুঝতে পারে না তাদের গুরুত্ব। বড়ই আজব দুনিয়া। আজব তার মানুষগুলো। উপরে ভদ্রতা, আর ভেতরে নোংরা।
আজ এই গল্পটি পড়ে অনেকেই বলবে, ভাববে, বাবা-মা কে আর কষ্ট দিবো না। জানি না, কতোজন তাদের কথা রাখবে।।
আমাদের ভাবতে হবে, একদিন আমাদেরও বৃদ্ধ হতে হবে। আজ আমরা আমাদের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছি একদিন হয়তো আমাদেরও আশ্রয় হতে পারে এই বৃদ্ধাশ্রম।
আসুন বৃদ্ধাশ্রমকে না বলি। এবং বাবা-মাকে ভালোবাসি। তাদের শ্রদ্ধা করি। বৃদ্ধ বয়সে সঠিকভাবে পরিচর্যা করি। যত্ন নেয়। সর্বদা ভালো রাখি, সুস্থ রাখি।।