একবিংশ শতাব্দীর অপু

একবিংশ শতাব্দীর অপু

(১)
প্রচন্ড রুপবতী হওয়ায় আমার পেছনে পাড়ার সকল ছেলেদের নজর ছিল আমার চৌদ্দ পার হবার পর থেকেই।কত চিঠিযে আমাকে পোড়াতে হয়েছে উনুনে তার শেষ নেই।মায়ের আদেশ ছিল কোন ছেলেকে আঘাত করে কথা বলা যাবেনা।তাতে নাকি ছেলের মনে জেদ জমতে পারে আর সে আমার ক্ষতি করে দিতে পারে।গরীবেরতো আবার সম্পদ একটাই।ইজ্জত!
তাই অামি সবার সাথে ভাল ব্যবহার করতাম।তাদের চিঠি দাঁত কটমট করে হাতে নিতাম ঠিকই কিন্তু বাড়িতে এসেই সেটা জ্বালিয়ে দিতাম।পড়াতো দূরের কথা কোনদিন ভাঁজ খোলেও দেখিনি কারো চিঠি।অাসল কথা হচ্ছে অামাদের পাড়ার কোন ছেলেই অামাকে মায়ায় ফেলতে পারেনি কোনদিন।অার ওদের ভালবাসাটাও চিঠি দেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।অাজ অামি পাত্তা দিলামনাতো দেখা যাচ্ছে কাল অরেকজনের পিছু ঘুরছে।

ষোড়শী আমার মনের ক্যানভাস সারাক্ষন রকমারি রঙ খেলা করে যেত।তার মধ্যে সবচেয়ে গাঢ় রঙটা ছিল আমার ভবিষ্যৎ প্রিয়জন।যাকে ভেবে ভেবে উতলা হতাম।শুধু ভাবতাম কবে আসবে সে এই ষোড়শীর জীবনটা কানায় কানায় পূর্ন করে দিতে।কবে আসবে সে?আর কত দিন পর!কখনোবা এসব ভাবতে ভাবতে বোর হয়ে ধ্যাত্তেরি বলে ভাবনার অবসান ঘটাতাম।

আবারো ক’দিন পর ভাবনার মোড় ঘুড়তো!কল্পনার রাজপুত্রকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাতাম।নতুন করে আবার সাজাতাম বৃষ্টিবিলাসের খোয়াব!ভোড় বেলায় ফোঁটা শিউলিফুলটাতে পরম মমতায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতাম, এমনই কোন এক সজীব সতেজ ভোরে আমার রাজকুমার আমাকে এই শিউলি ফুলটার মত করে ছুঁয়ে দিবে।এরপর কত দিন গেছে রাত ভোর হয়েছে আমার স্বপ্ন পুরুষের আগমনের অপেক্ষায়।

এরই মধ্যে পাড়ায় কানাঘুষা শুরু হল,মেয়ের বয়স এক কুড়ির উপরে হয়ে গেছে
বিয়ে শাদী কি দিতে হবেনা!যদিও মনে মনে এক রাজপুত্রের প্রার্থনায় দিনাতিপাত করছিলাম তবুও পাড়া প্রতিবেশীর এহেন কটুকথায় ভীষন রাগ চেপেছিল মাথায়।
.
অবশেষে বাবারও টনক নড়লো।শুরু হল আমার জন্য পাত্র দেখা।
.
আমার অনুভূতিগুলো যেন অনূরনিত হতে থাকল।এই বুঝি রাজপুত্র এল বলে…..।
হৃদয় মন্দিরের ঘন্টাগুলো টুং টাং শব্দে বাজতে থাকলো।শেষবারের মত নিজের ভেতর শুরু হল নতুন সম্পর্কের ডালা সাজিয়ে নেয়ার প্রস্ততি।
.
হঠাৎই একদিন প্রথমবারের মত পাত্রপক্ষের আগমন ঘটলো আমার বাবার কুড়েঘরে আমাকে দেখার জন্য।
.
যেহেতু রুপে গুনে স্বয়ংসম্পূর্ন ছিলাম তাই আমাকে অপছন্দ হওয়ার তেমন কোন কারন ছিল না তাদের কাছে।আমি মাথা নীচু করে বসেছিলাম মেহমানদের সামনে।হৃৎপিন্ডের ঢিব ঢিব শব্দ ক্রমশ বাড়ছিল।ভয় আর লজ্জা যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিল অামাকে। অনেকবার মন চেয়েছে মাথা উঁচু করে পাত্রকে একবার দেখতে কিন্তু দুই পক্ষের মুরব্বীদের সামনে সে সাহস করে উঠতে পারিনি।
.
যখন আমাকে আর পাত্রকে আলাদা কথা বলতে দেয়া হল তখনি আমি শত লজ্জার মাথা খেয়ে তার পানে তাকালাম।প্রথমেই আমার চোখ দুটো তার চোখে পড়লো!এমনভাবে চোখাচোখি হল যেন শুভদৃষ্টি হল!কিছুতেই চোখ নামাতে পারছিলাম না।ছেলেটার চোখ দুটো
ধূসর বর্নের।কি মায়াভরা চোখ!যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকরা কত নারীর চোখের সৌন্দর্যের বর্ননা দিয়ে গেছে তাদের লেখনীতে!আমি নিশ্চিত যদি কোন কবি সাহিত্যিক আমার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই ধূসর মানবকে এক নজর দেখতো তবে তারা পুরুষেরও যে মায়াভরা চোখ হয় সেটা বিশাল বিশাল কাব্য লিখে হলেও প্রমান করে দিত।আমি কিছুতেই নিজের চোখ নামাতে পারছিলাম না।ধূসর মানবের চোখ আমার চোখ দুটোকে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষিত করছিল।ধূসর মানবকে এক নজর দেখেই আমার মনের অজান্তে ঠোঁটের কোন বিরবির করে যেন বলে উঠলো,”ধূসর মানব আমার,কেবলই আমার”।সে যেন আমার হতেই জন্মেছে।দুজনেই স্বলজ্জ নীরবতায় কিছুটা সময় পার করলাম।শুভক্ষনের শেষ সময়টাতে এসে সে নীরবতা ভাঙলো।হালকা গলা খাকারি দিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল-

-কেমন আছেন?

তার কথা শুনে বুকের ভেতরটা ধরফরিয়ে উঠলো।মনের ভেতর যেন একটা দুষ্ট টুনটুনি পাখি প্রবল গতিতে ডানা ঝাপ্টাতে লাগলো।আবারো ঢিব ঢিব করে হৃৎপিন্ডের শব্দ ক্রমশ বাড়ছিল।এতটা অস্থিরতা সহ্য করতে পারছিলাম না আমি।তার প্রশ্নের জবাবে কেবল “ভাল” বলেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম তার সামনে থেকে।নিজের রুমে গিয়ে দরজায় খিল দিয়ে দরজায় দু হাত চেপে হেলান দিলাম।আমার ভেতরে তখন প্রথম ভাল লাগার আনন্দ ইতল বিতল করে গান গাইছিল।আমি ধূসর মানবের পুরু জীবনের সাথী হব ভাবতেই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম।আয়নার সামনে দাড়িয়ে বার বার নিজের রুপ সৌন্দর্য নিজেই খুঁটিয়ে দেখছিলাম।আমিতো এখন পূর্নযৌবনা ভাবতেই লজ্জায় দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলছিলাম।আবারো আস্তে আস্তে আঙ্গুল ফাঁক করে নিজেকে আয়নায় দেখছিলাম।

বার বার মনে প্রশ্ন জাগছিল আচ্ছা,আমি কি ধূসর মানবের প্রেমে পড়ে গেছি?এক দেখাতেই কি কাউকে ভালবেসে ফেলা যায়?এই ধূসর চোখের অধিকারী ছেলেটাই কি আমার এতদিন ধরে মনে পোষে রাখা স্বপ্নকুমার হবে?
.
পাত্রপক্ষ যাবার আগে বলে গেছে,মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে।তবু বিয়ে শাদীর ব্যাপার।বাড়িতে সবার সাথে কথা বলে এক সপ্তাহ পর খবর জানাবে।
.
আমি মনে মনে বেশ খুশি হলাম।আমার মনে পোষে রাখা নিষ্প্রান মানুষটি এবার প্রান পেল।আমার অখন্ড অবসরে আমি ধূসর মানবকে চোখ বুজে কল্পনা করি।কারনে-অকারনে,কাজে-অকাজে সারাক্ষন তারই ধ্যান করি।ধ্যান করি একজোড়া ধূসর চোখ, পরম মমতায় আমার কাজল লেপ্টে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।নিমিষেই ধ্যানে ভগ্ন ঘটে এই ভেবে যে,আচ্ছা আমার ধূসর মানব কি কাজল কালো চোখ পছন্দ করে?আমারতো চোখে কাজল পড়া সেই ছোটকালের অভ্যাস।কাজল না দিলে চোখ কেমন খালি খালি লাগে।
শুনেছি পুরুষেরা নাকি কাজল কালো চোখ পছন্দ করে।তবুও যদি আমার ধূসর মানব তার ব্যতিক্রম হয় তাহলে বিয়ের পর কাজল পড়া ছেড়ে দেব।তার জন্য আমি সব করতে পারি।তাছাড়া বিয়ের পরতো তার ভালবাসার কাজলেই আমি চোখ রাঙাবো!তবে আর কৌটোর কাজলের কি প্রয়োজন?
.
সপ্তাহখানেক পরে আমার হৃদয় মন্দির ভেঙে গেল মায়ের সাথে বাবার কথোপকথন শুনে।ওদের নাকি আমাকে পছন্দ হয়েছে ঠিকই কিন্তু তারা তাদের ছেলেকে পণ নিয়ে বিয়ে করাবে।ছেলে পড়াশুনা করাতে তাদের অনেক খরচা হয়েছে।এখন ছেলের চাকুরীর জন্য মোটা অংকের টাকা ঘুষ প্রয়োজন।ছেলের বাবা সে টাকা ছেলের শ্বশুড়ের থেকে উসুল করতে চায়।
.
আমার বাবার পক্ষে যে পণ দিয়ে বিয়ে দেয়া সম্ভব নয় সেটা আমি ঢের জানতাম।তাই একটু আগেই শখ করে অনেকটা সময় নিয়ে যত্নসহকারে আমার চোখে লাগানো কাজল নোনাজলে ধুয়ে গেল।মনের মধ্যে শুধু একটুকুন আশাই জেগেছিল,আমি যেমন ধূসর মানবকে অন্তরে গেঁথেছি তেমনি যদি সেও অামাকে মনে গেঁথে থাকে তাহলে সে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।
.
দিন যায় মাস যায়।আমাকে আরো কয়েক জায়গা থেকে দেখে গেছে ইতিমধ্যে।কোন না কোন কারনে একটা সম্বন্ধও জোড়া লাগে না।অবশ্য এতে আমার কোন আফসোস নেই।আমিতো কেবল ধূসর মানবের জন্য অপেক্ষা করতাম।

দেখতে দেখতে পুরু একটা বছর পেরুলো কিন্তু ধূসর মানব এল না।বার বার নিজের মনকে প্রশ্ন করি,আচ্ছা সেতো শিক্ষিত মানুষ ছিল,আমি যে কিছুক্ষনের জন্য কি আকুলতা নিয়ে তার চোখে হারিয়ে গিয়েছিলাম সেটা কি সে বুঝতে পারেনি?ভেতর থেকে কোন টান না আসলে একটা মেয়ে কি করে একটা অপরিচিত ছেলের চোখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে পারে,সেটা কি তার বুঝা উচিত ছিল না?তার কি বুঝতে পারার কথা ছিলনা যে,একটা মেয়ে একটা ছেলের ছোট্র একটা প্রশ্নে(কেমন আছেন আপনি? এতটা লজ্জা কেন পায়?

তাকেতো আমি প্রচন্ড উষ্ঞতম দিনে বৃষ্টি চাওয়ার থেকেও বেশী করে চেয়েছিলাম।এক বছরেও যখন সে ফিরে এলনা তখনি বুঝেছিলাম যে,প্রথম দেখায় সে অামার মত অামার প্রেমে মজে যায়নি যে সে ফিরে অাসবে।একটা এক তরফা ভালবাসা বয়ে বেড়ানো যে কি দুঃসহ সেটা আমি তাকে ভাল না বাসলে কোনদিন বুঝতে পারতাম না। ঐ ধূসর চোখের মালিক যদি আমার চোখের ভাষাটা বুঝতে পারতো কখনো তাহলে বুঝতে পারত যে, আমার চোখের কাজলে শুধু সেই লেপ্টে ছিল।কোন একদিন যদি ভুল করেও তার সাথে দেখা হয়ে যেত তাহলে তাকে বলতাম যে, তাকে ভালবেসে না পাওয়ার যাতনায় কত নির্ঘুম রাত্রিকে নির্লিপ্ত বিষন্নতায় মুড়িয়ে দিয়েছি!আমার ডান চোখের কোনের ছোট্র তিলটা যে পুরু এক বছরের হাহাকার ভরা রজনীর স্বাক্ষী! ওকে মনের কথাটা জানাতে পারলে মনে হয় তবু মনটা হালকা হতো!মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি যে,সে এই জনমে কেন কবি হয়ে জন্মালো না? কি দোষ হত একটাবার কবি হয়ে জন্মালে?সে কবি হলেইতো সেদিন অামার মনের কথাটা বুঝে ফেলতো! ঐ ধূসর দুটো চোখ আমার আঁখিপানে তাকিয়ে রচনা করে ফেলতো শত সহস্র কবিতা।আমায় নিয়ে রচনা করতো গান!আহা!খুব আফসোস হয়,খুব!কেন অামার ধূসর মানব কবি হলনা!ইশ!ও যদি আমাকে একটু ভালবাসতো,ওর কাছে আমি আর কিচ্ছুটি চাইতাম না।কিচ্ছু না।নীল শাড়ী,লাল গোলাপ,হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি কিচ্ছুনা।
.
অবশেষে পুরু এক বছর অামাকে বিয়ে দেয়ার চেস্টা করে অামার কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা পণ ছাড়া নিজের মাথার বোঝা হালকা করতে আমাকে যার হাতে সমর্পন করেছিলেন তিনি ছিলেন বিশাল ধনী একজন মানুষ।তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা গেছেন বছর খানেক অাগে।তার দশ বছর বয়সের একটা মেয়েও অাছে।।বিশাল ধনী সেই মানুষটার বয়স ছিল অামার দ্বিগুন।অামার তখন বাইশ ছিল। বাবার ভাষায়,পুরুষ মানুষের বয়সে কি যায় আসে অার একটা বিয়ে করলেই বা কি যায় অাসে?প্রথম স্ত্রীতো বেঁচে নেই।একটা মেয়ে অাছে,তাকে বিয়ে দিয়ে দিলেতো সব সংসার অামার জীম্মায়।অামি শুধু বাবার এই সিদ্ধান্ত শুনে একটা উপহাসের হাসি দিয়েছিলাম,না করতে পারিনি যে অামি বিয়ে করবনা।
.
বাবার ধনী জামাই সুগারের রুগী ছিলেন।কোনদিন ঘুম থেকে উঠে আমি তাকে বিছানায় পাইনি

তিনি রোজ সকালে জগিং করতে বেরিয়ে যেতেন।সকালে উনাকে নাস্তা খাওয়াতে বসে প্রায়ই চোখে জল আসতো।না!এই জল তার মায়াভরা খাওয়া দেখে আসতো না।বরং এটা ছিল অনুশোচনার জল।কারন এই জায়গাটাতে আমি এই লোকটাকে না,দেখতে চেয়েছিলাম ধূসর চোখের সেই মানবকে।

বিয়ের পরও যখন ধূসর মানবকে নীরবে একতরফা ভালবেসে যাচ্ছিলাম আর মনে মনে তাকে কোনদিন সামনে পেলেই মনের কথাটা জানিয়ে মনের বোঝাটা হালকা করে নিব টাইপ চিন্তা করছিলাম তখনি একদিন একটা মীরাক্কেল ঘটে গেল।সেদিন বাসায় স্বামীর এক আত্নীয়ের আসার কথা ছিল।একটা চাকুরি সংক্রান্ত ব্যাপারে সে এখানে কিছুদিন থাকবে বলে আমার হাজব্যান্ড আমাকে জানায়।এক কাক ডাকা দুপুরে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে কপালের ঘাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে বিরক্তি নিয়ে দরজা খোলেই থমকে গেলাম।আমার ধূসর মানব আমার সামনে দাড়িয়ে…..।আমার চোখ যেন চড়কগাছ!কিন্তু তাকে অামি বিন্দু পরিমানও অবাক হতে দেখলাম না।ভাব দেখে মনে হল অামাকে ভুলে গেছে।অামার মনটা যেন দ্বিতীয়বারের মত ভাঙল।অামি যাকে এক নজর দেখে এতটা ভালবাসলাম,সে অামাকে অাজ দেখে চিনতে পর্যন্ত পারল না।অার চিনবেই বা কি করে!একটা ছেলে বিয়ের জন্য কত পাত্রী দেখে……সবাইকে কি অার মনে রাখা সম্ভব।সে যেহেতু অামাকে চিনতেই পারেনি তাহলে তাকে অার মনের কথা জানিয়ে লাভ কি!দরকার নেই মনের কষ্ট জানিয়ে মনের বোঝা হালকা করার।বাকীটা জীবন না হয় এভাবেই কেটে যাবে।

(২)
জীবনের প্রথম এমনটা হয়েছিল অামার।

একটা ঘোর যেন কিছুক্ষনের জন্য আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল আমাকে যেদিন তাকে বিয়ের পাত্রী হিসেবে দেখতে যাই।
এক সুনয়না,না না ঠিক সুনয়না না,কাজল নয়না এক যুবতী ঠিক যেন রাঁধা সেজে এসেছিল আমার সম্মুখে।মেয়েরা চোখে কাজল পড়লে তাদের সৌন্দর্য অনেকখানি বেড়ে যায়।খুব মায়াবতী মায়াবতী লাগে।মসৃন স্নিগ্ধ বিকেলে অপরাহ্নের ঝির ঝির বাতাস যখন জানালা দিয়ে এসে তার শাড়ীর আঁচল উড়িয়ে দিচ্ছিল,তখন আমি আরেকবার ঘোরে ডোবে যাই।আমার আবারো ঘোর লাগে যখন দেখি কাজল নয়নার নয়ন দুটি আমার চোখে আটকে গেছে।কাজলনয়না লজ্জা পেলে যে তাকে কত দারুন লাগে সেটা কি সে জানে?সে যখন দৌড়ে চলে যাচ্ছিল আমার তখন তার শাড়ীর সবুজ আঁচলখানা টেনে ধরতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল।কিন্তু সে অধিকারতো আমার ছিল না।পাছে কাজলনয়না যদি আমায় খারাপ ভাবে!
.
কাজলনয়নাদের বাড়ি থেকে চলে আসার সময় তাকে আরেকটাবার দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল।ঘরের ভেতর লুকিয়ে উঁকিঝুঁকিও দিয়েছিলাম।কিন্তু লজ্জাবতী বোধ হয় নিজের ঘরে খিল দিয়েছে।আমাদের সবারই পাত্রী পছন্দ হয়েছিল।তাই ধরেই নিয়েছিলাম যে কাজলনয়না আমার ঘরে আসছে।কাজল নয়নাকে দেখে আসার পর থেকে ঠিকমত খেতে পারতাম না,ঘুমোতে পারতাম না।জাগরনে, স্বপনে কেবল তাকেই দেখতাম।একজোড়া কাজলকালো চোখ যেন আমার চোখের দিকে অনেকটা ভালবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে!
.
কাজলনয়নার জন্য বাজার থেকে এক কৌটো কাজল কিনেছিলাম।ইচ্ছে ছিল বাসর ঘরে নিজ হাতেই অপ্সরীকে কাজল পড়িয়ে দেব।সেই কাজলের কৌটাকে যে কতবার বুকে চেপে ধরেছি কাজলনয়না ভেবে।

আমার কলিজা ভাগ হয়ে গিয়েছিল যখন শুনেছিলাম যে বাবা আমার হবু শ্বশুড়ের কাছ থেকে কমপক্ষে পাঁচলক্ষ টাকা যৌতুক চান।শুনেছি কাজলনয়নার বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল নয়।তাহলে কি আমি কাজলনয়নাকে পাব না?না না,এ কথা আমি ভাবতেই পারছিলাম না।কাজলনয়না আমার হবেনা ভাবতেই চোখ দুটো ভারী হয়ে আসছিল।বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস আমার ছিল না অপরদিকে কাজলনয়নাকে ছাড়ার কথা কল্পনাও করতে পারছিলাম না।তিন দিন তিন রাত অনেক ভেবে বাবার সহজ সরল ছেলেটা প্রথমবারের মত বাবার মুখের উপর কথা বলেছিল সেদিন।বাবা আমাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল যে,যদি তার অবাধ্য হই তাহলে আমি আর কোনদিন তার ভিটাতে পা ফেলতে পারবো না।কাজলনয়নাকে পেতে আমি তাতেও রাজী ছিলাম।কিন্তু আমার কঠিন মন মানসিকতার অধিকারী বাবা যখন আমার মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার হুমকি দিলেন তখন আমার পৃথিবী ছোট হয়ে গেল।এমনিতেই বাবা মায়ের মধ্যে তেমন বনিবনা ছিল না।বাবার মত কুৎসিত মন মানসিকতার মানুষ যে ইচ্ছে করলে এই জঘন্য কাজটা করতে পারবে,সে ব্যাপারে অামার কোন সন্দেহ নেই।
.
এক বছরে বাবা আমার জন্য অনেক মেয়ে দেখেছে।আমার আর কোন মেয়েকে দেখার শখ হয়নি।আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়েতো কেবল মিশে আছে কাজলনয়না।কেবল একটা চাপা কষ্ট আমাকে সব সময় যন্ত্রনা দিচ্ছিল।কাউকে আমার কষ্টটা বোঝাতে পারতাম না।মাঝে মাঝে ভাবতাম,আকাশের সাথে কথা বলা যায়না কেন?দূরের ঐ আকাশটা বন্ধু হলে কি খুব বেশী ক্ষতি হতো!ওর সাথে নিজের কষ্টটা শেয়ার করে হালকা হতাম।বিধাতা আমাকে ডানা দিলেন না কেন,উড়ে গিয়ে নিজের সবটা কষ্ট আকাশের বুকে মিশিয়ে না হয় পুরু আকাশটাকেই নিজের মাঝে ধারন করতাম!আমার মনে হয় মানুষকুলে জন্ম না নিয়ে চাঁদ হলেই ভাল হত!বুকে কলঙ্ক ধারন করেও নীরবে আলো ছড়িয়ে যেতে পারতাম।অথবা ছোট্র পাখি হয়ে জন্মালে সারাদিন উড়ে উড়ে নিজের কষ্টগুলো বাতাসের সাথে মিশিয়ে দিয়ে এক জনমের প্রথম ভালবাসার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারতাম।এই পৃথিবীতে কত মানুষের কত স্বপ্ন পূরন হয় অথচ আমি কিনা একটা স্বপ্ন পূরনের অভাবে একটা জীবনে অদৃশ্য পঙ্গু হয়ে গেলাম।মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে,ভালবাসা তুমি এমন কেন?এতটা যন্ত্রনা কি না দিলেই নয়!
.
সম্প্রতি বাবা এক মেয়ে দেখেছেন।মেয়ের বাবা পণ দিয়ে বিয়ে দিতে রাজী।বাবাতো মহাখুশি। সামনের সপ্তাহে বিয়ে।এরই মাঝে শুনলাম আমাদের দুঃসম্পর্কের এক ধনী আত্নীয়ের সাথে কাজলনয়নার বিয়ে হয়েছে।ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল তাই চাকুরির ইন্টারভিউ দেয়ার মিথ্যে উছিলায় সেই আত্নীয়ের বাসায় গেলাম।কাজলনয়নাই দরজা খোলে দিল।তাকে দেখে কলিজাটা ফেটে যাচ্ছিল।তাকে একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল।কিন্তু তার সামনে এমন একটা ভাব করলাম যেন তাকে আমি চিনতেই পারিনি।ঐ বাসা থেকে চলে অাসার সময় গোপনে কাজলনয়নার বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের উপর এক বছর অাগে কিনা কাজলের কৌটোটা রেখে অাসলাম।কি জানি, ওর বড়লোক স্বামীর কিনে দেয়া এত এত কসমেটিক্সের ভীড়ে ছোট্র কাজলের কৌটোটা কখনো ওর নজরে পড়বে কিনা! কাজলনয়না হয়তো কোনদিন জানতে পারবেনা যে, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও রবীন্দ্রনাথের অপু চরিত্রটা এখনো বেঁচে আছে।হৈমন্তী গল্পটা যখন পড়েছিলাম তখন মনে মনে অপুকে অনেক গালাগাল করেছিলাম।হৈমীর মৃত্যুর জন্য আমার অপুকেই বেশী দায়ী মনে হয়েছিল।ওপরওয়ালা বোধ হয় সেদিন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে উপহাসের হাসি হেসেছিলেন।তাইতো একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাকেই অপু বানিয়ে দিলেন।না না উপরওয়ালার দোষ দেব না,আমি নিজেই অপু হয়ে গেলাম… …

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত