পান্তাবুড়ি-কুঁজোবুড়ি-উকুনেবুড়ি এবং আমাদের প্রবীণারা

পান্তাবুড়ি-কুঁজোবুড়ি-উকুনেবুড়ি এবং আমাদের প্রবীণারা

নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রবীণারা চরম দুঃখ-কষ্ট আর সীমাহীন লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে প্রবীণ জীবন অতিবাহিত করেন। সব পর্যায়ে প্রবীণারা সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের তেমন সুযোগ পায় না। সহায়সম্পদ থাকলে তা হাতছাড়া হয়ে যায়। পরিবারের সদস্য কিংবা কাজের লোকের দ্বারা শারীরিক নিপীড়নের শিকার হতে দেখা যায়। ঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন। আপনজনদের একান্ত সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ নেই। এমনকি মৃত্যুর সময় কেউ কেউ আপনজনের হাতে হাত রেখে মরতে পারেন না

ছেলেবেলায় পান্তাবুড়ি-কুঁজোবুড়ি-উকুনেবুড়ির গল্প শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগত। আমার সন্তানদের আমি এসব গল্প শুনিয়েছি। তারাও খুব হেসেছে। এখনও শিশু-কিশোররা পান্তাবুড়ির গল্প মন দিয়ে শোনে। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর এসব শিশুতোষ সাহিত্য সময়কে অতিক্রম করে আজও দাপটের সঙ্গে বইয়ের দোকান এবং পাঠাগারে শোভা পাচ্ছে। পাঠক আছে তাই বিক্রিও প্রচুর। অতি সম্প্রতি পান্তাবুড়ি-কুঁজোবুড়ি-উকুনেবুড়ির গল্প পড়ে আমার দুই চোখে পানি চলে আসে। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী বুড়িদের যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, বর্তমান সময়ে পরিস্থিতির তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায় না। পান্তাবুড়ির পান্তা চোর খেয়ে যেত। বুড়ি নালিশ করতে রাজার কাছে যাচ্ছিল। পথে শিং মাছ, বেল, গোবর, ছুরির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তারা বুড়িকে যাওয়ার পথে দেখা করে যেতে অনুরোধ করেছিল। বুড়ি রাজার কাছে বিচারপ্রার্থী হয়েছিল; কিন্তু বিচার পায়নি। ফেরার পথে বুড়ি শিং মাছ, বেল, গোবর, ছুরিকে সঙ্গে নিল। শিং মাছকে পান্তা ভাতের পাতিলে রাখল। বেলকে চুলার ভেতর, গোবরকে পিঁড়িতে, ছুরিকে ঘাসের ভেতর রাখল। রাতে চোর এসে পান্তার পাতিলে হাত দিলে শিং মাছ কাঁটা ফুটালো, আগুনে হাত সেকতে গিয়ে বেল ফুটে চোখে-মুখে আঘাত করল। দৌড়ে পালাতে গিয়ে গোবরে পিছলে পড়ল। পা মুছতে গিয়ে ঘাসের ভিতর রাখা চুরিতে পা কাটল। আমার প্রশ্ন, বুড়ি পান্তা খায় কেন? নিশ্চয়ই খাবারের সংকট ছিল। বুড়ি একা থাকে। গল্পে বুড়ির আত্মীয়-স্বজনকে আনা হয়নি। বুড়ির ঘরটা এমন ছিল, যাতে চোর সহজেই ঢুকে যেত। বুড়ির কোনো সাহায্যকারী নেই। সমাজে বিচার পায়নি, তাই রাজার কাছে বিচারপ্রার্থী হয়েছিল। সেখানে বিচার পায়নি। কাল্পনিক বিষয় দিয়ে বুড়ি চোরের বিচার সম্পন্ন করেছে। প্রকৃতি পান্তা চোরকে শাস্তি দিয়েছে, তার মানে সমাজের শৃঙ্খলা এমন ছিল যে, বুড়ির পান্তার নিরাপত্তা ছিল না। অথবা এমন ভয়ানক খাদ্য সংকট ছিল একজন চোর ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বুড়ির পান্তা চুরি করেছিল। বুড়ি অসহায়, নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। যার খাদ্যের নিরাপত্তা নেই। বসবাস উপযোগী ঘর নেই। কুঁজোবুড়ির আপনজন বলতে কেউ নেই। আছে দুইটি কুকুর। একটির নাম রঙ্গা আরেকটির নাম ভঙ্গা। বুড়ির প্রচ- অভাব, নিয়মিত খাবার জোটে না। বুড়ি শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। একমাত্র স্বজন হলো বুড়ির এক নাতনি। বুড়ি শরীরটাকে একটু তাজা করতে নাতনির বাড়ি যাওয়ার জন্য মনস্থির করল। একদিন রঙ্গ-ভঙ্গাকে বাড়ি রেখে নাতনির বাড়ি রওনা হলো। পথে শিয়াল, ভালুক, বাঘের সঙ্গে দেখা, তারা সবাই বুড়িকে খেতে আগ্রহ প্রকাশ করল। বুড়ি সবাইকে আশা দিল নাতনির বাড়ি খেয়েদেয়ে মোটাতাজা হয়ে যখন ফিরবে তখন খেতে পারবে। শিয়াল-ভালুক-বাঘ বুড়ির কথায় ভরসা পেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বুড়ি নাতনির বাড়ি ক্ষীর-দই খেয়ে মোটাতাজা হয়ে লাউয়ের খোলের ভেতর ঢুকে বাড়ি রওনা দিল, যাতে শিয়াল-ভলুক-বাঘ বুড়িকে দেখতে না পায়। ভালুক এবং বাঘের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও শিয়ালের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি বুড়ি। বুড়ি লাউয়ের খোল থেকে বেরিয়ে এলো। শিয়ালের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করল। শিয়ালকে একটা গান শোনানোর কথা বলে নিজের কুকুর দুইটিকে তু-উ-উ করে ডেকে এনে রক্ষা পেল। এখানে কুঁজোবুড়ি অসহায়, নিঃসঙ্গ, অভাবী মানুষ। ঠিকমতো খাবার না পেয়ে গায়ের চামড়া হাড্ডির সঙ্গে লেগেছে। একটু ভালো খাবারের আশায় নাতনির বাড়ি গিয়েছে। গল্পে কুঁজোবুড়ির ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজনের কথা বলা হয়নি, শুধু নাতনির কথা ছাড়া। উকুনেবুড়ির গল্প হলো, উকুনেবুড়িকে তার স্বামী পিটিয়েছে। কারণ রান্নার সময় খাবারে উকুন পড়েছিল বুড়ির মাথা থেকে। বুড়ি শারীরিকভাবে দুর্বল। নিজের যতœ নিতে পারেন না, তাই মাথায় উকুন। অথবা যতœ নেয়ার কেউ নেই, যারা অন্তত বুড়ির মাথার উকুন বেছে দিতে পারে। বুড়ি স্বামীর হাতে পিটুনি খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। বুড়ির কোথাও আশ্রয় মেলেনি। পথে বকের সঙ্গে দেখা হলো। বক সব ঘটনা শুনে বুড়িকে সে রাঁধুনি হিসেবে নিজের বাড়ি নিয়ে এলো। বক বুড়িকে জানালো উকুন তার প্রিয়, এতে কোনো সমস্যা নেই। বক একদিন শোলমাছ এনে বুড়িকে রাঁধতে দিল। বুড়ি রান্না করতে গিয়ে চুলায় পড়ে মৃত্যুবরণ করে। বক সাতদিন না খেয়ে ছিল। পরে গল্পটিকে আরও বড় করা হয়। উপরের তিন গল্পের মধ্য থেকে আমরা দেখতে পাই তিনজন বুড়ি অসহায়, নিঃসঙ্গ এবং খুবই দরিদ্র। তাদের ছেলেমেয়ে আছে কিনা জানা যায়নি। একজন স্বামী পরিত্যক্তা আর দুইজনের স্বামীর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারা পরিবারের বা সমাজের সহযোগিতা পাননি। তিনজনই আশ্রয়হীন। তাদের কষ্টে-অপমানে পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, শিং মাছ, বেল, গোবর, ছুরি, বক, রঙ্গা-ভঙ্গা, লাউয়ের খোলÑ এই তিনটি গল্পের প্রতি এত আগ্রহ আমাদের কেন হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর আমার নিজের মতো করে খুঁজে বেড়াই। গল্প শুনে কেন এত হাসি পেত? অন্যের অক্ষমতা দেখে মজা পেতাম। তিনজন বুড়ির দৈন্যদশা আমাকে কেন আনন্দিত করে? পান্তা চোরের প্রতি কেন সহানুভূতি সৃষ্টি হয় না? তিন বুড়িকে নিষ্ঠুর নির্মমভাবে উপস্থাপন বয়সবিদ্বেষী মনোভাব কিনা, সে প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে। আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমানও ‘উকুনেবুড়ি’ নামে একটি ছড়া লিখেছেন। অবাক করা বিষয় হলো, আমাদের শিশু-সাহিত্যে বুড়োদের তেমন অসহায়-নিঃসঙ্গ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়নি। বরং জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একতাই বলÑ এই গল্পে বুড়ো তার ছেলেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ থামানোর জন্য সবাইকে একটা করে লাঠি নিয়ে আসতে বলল। সব লাঠি একত্রে বেঁধে দিয়ে প্রত্যেক ছেলেকে লাঠির আঁটি ভাঙতে বলল। সবাই চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। অবশেষে বুড়ো আঁটি খুলে প্রত্যেক লাঠিকে আলাদা করে ছেলেদের হাতে দিল। এবার বুড়ো ছেলেদের লাঠি ভাঙতে বলল। সবাই লাঠি ভাঙতে পারল। বুড়ো বলল, তোমরা একত্রে থাকলে শক্তিশালী থাকবে এবং উন্নতি করতে পারবে। আর আলাদা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বুড়োকে জ্ঞানী ব্যক্তি এবং শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এখানেও আমরা বৈষমের চেহারা দেখতে পাই। বুড়ো সম্মানের সঙ্গে এবং বুড়ি অসম্মানের সঙ্গে পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়েছেন। শিশুদের জন্য যেসব বই প্রকাশ হয়েছে, তার কিছু অংশ আমি দেখেছি, তাতে প্রবীণদের সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়নি। বরং উপহাসের পাত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে আমার ধারণা। ছোট বেলায় গ্রামে শুনতাম, ‘চাল নষ্ট মুড়ি, পাড়া নষ্ট বুড়ি।’ আমাদের ভাবনার জগতে বুড়ি নিঃস্ব-অসহায়, করুণার পাত্রী হিসেবে বিরাজ করছে। আমরা বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে দেখি প্রবীণারা কমবেশি অবহেলার শিকার। সুষম খাবার, ওষুধপত্র, সেবাযতœ, চিকিৎসাসেবা, বিনোদন থেকে প্রবীণারা মোটামুটি বঞ্চিত। উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রবীণারা নিঃসঙ্গ এবং সেবাযতœ থেকে বঞ্চিত। পরিবারে নিকটতম সদস্যদের সঙ্গে আনন্দঘন পরিবেশে থাকার সুযোগ কম। পেশাদার ‘বার্ধক্য সেবাকর্মী’ পর্যাপ্ত না থাকায় বার্ধক্যসেবা পাওয়া যায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারে টানাপড়েন চলে প্রবীণাকে কেন্দ্র করে। কোথায় থাকবে, কার সঙ্গে থাকবে, কে টাকা দেবে, কত টাকা দেবে, কে সেবাযতœ করবে এসব বিষয়ে মনোমালিন্য চলতে তাকে। এই টানাপড়েনে শেষ পর্যন্ত প্রবীণা সংকটে পড়েন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মনোমালিন্য তীব্র থেকে তীব্রতর হতে তাকে। নিম্নমধ্য পরিবারে প্রবীণাদের সংকট ক্রমেই বাড়তে থাকে। চিকিৎসাসেবা, পর্যাপ্ত খাবার ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রবীণারা চরম দুঃখ-কষ্ট আর সীমাহীন লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে প্রবীণ জীবন অতিবাহিত করেন। সব পর্যায়ে প্রবীণারা সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের তেমন সুযোগ পান না। সহায়সম্পদ থাকলে তা হাতছাড়া হয়ে যায়। পরিবারের সদস্য কিংবা কাজের লোকের দ্বারা শারীরিক নিপীড়নের শিকার হতে দেখা যায়। ঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন। আপনজনদের একান্ত সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ নেই। এমনকি মৃত্যুর সময় কেউ কেউ আপনজনের হাতে হাত রেখে মরতে পারেন না।

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত