শরীরটা পড়ে আছে খাটের ওপর। কি আশ্চর্য, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,সম্পুর্ণ নিস্পন্দ,আধবোজা চোখ, মুখটা সামান্য ফাঁক। কয়েক মুহূর্ত আগেই প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছিল এই দেহ,আর এখন সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন।আমি কেমন করে যেন বেরিয়ে পড়েছি ঐ বদ্ধ খাঁচাটা থেকে,এখন জানলার গ্রিলের কাছটায় ভাসছি।হ্যাঁ,ভাসছিই তো।কারণ,কোন ভর অনুভূত হচ্ছে না আমার,কেমন যেন পালকের মত,অথবা তার চেয়েও সূক্ষ। ঠিক বেরিয়ে আসার মুহূর্তটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না।তবে তার আগের মুহূর্তেও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল প্রচন্ড,আর এখন শ্বাস নেওয়ার চেষ্টাও করতে হচ্ছে না কোন,বাতাস যেন আমাকে আলিঙ্গন করে রেখেছে,অথবা,যেন আমিই মিশে গেছি বাতাসে।দুলছি,ভাসছি।ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গেলাম ঐ পড়ে থাকা শরীরটার কাছে।আমার প্রিয় শরীর।কত যত্নে,কত আবদারে ধরে রেখেছিলাম প্রতিটি শিরা-উপশিরায় সংবেদন, উপলব্ধি,স্পর্শ,অনুভুতি,ব্যাধি।এক মুহূর্তের তফাৎ,সম্পূর্ণ মুক্ত আমি! আঁধারবিহীন আমি এখনও পৃথিবীর বায়ুস্তর ভেদ করে এগিয়ে যেতে পারিনি,ঘুরে বেড়াচ্ছি মাটির কাছাকাছিই।কোন বন্ধন নেই কোথাও,তবু একটা অনুচ্চারিত টান অনুভব করতে পারছি ঐ পড়ে থাকা শরীরটার জন্য। অনুভুতি! কিন্তু,আমার এই অনুভুতির অস্তিত্ব এল কোথা থেকে! এখন তো আমি হাওয়ার মত স্বচ্ছ,তাতে অনুভুতির স্থান কোথায়! এ নিশ্চয়ই আমার মনের ভুল। মন! সেটাই বা এখন কিভাবে থাকতে পারে আমার জীবনে! জীবন! কোথায়! ভাবনাগুলো সব তালগোল পাকিয়ে গেল কোথাও একটা।তবু,শরীরটা ছুঁতে ইচ্ছে করল,কিন্তু পারলাম না।অথবা,হয়ত পারলাম,কিন্তু কোন স্পর্শ উপলব্ধি হল না। ঘরটা জুড়ে লোকে লোকারণ্য। ঐ তো আমার ছেলে বাবাই,আমার শরীরটায় মুখ গুঁজে কেঁদে চলেছে অনবরত,পায়ের কাছটায় মাথা নিচু করে বসে রয়েছে অমিত,স্পর্শ করে আছে আমার শরীর। কিন্তু,আশ্চর্য! ঐ মানুষগুলোর জন্য একবিন্দু সহানুভুতি নেই আমার বায়বীয় অস্তিত্বের কোন খাঁজে। অথচ,কয়েক মুহূর্ত আগেই এই মানুষগুলোই ছিল আমার জীবিত অবস্থান একমাত্র অবলম্বন।ঐ যে শরীর,ঐ আঁধারে অবস্থানের মুহূর্ত পর্যন্তই ছিল ওরা আমার সাথে,এখন আমি একা,বাস্তবিকই একা।পার্থিব যতটুকু মায়া তা ঐ শরীরের পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই কাটিয়ে উঠতে পারব। হঠাৎ একটা শোরগোল, জানলা দিয়ে বেড়িয়ে দেখলাম একটা শববাহী গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির গেটের সামনে। একদল মানুষ,কিছু পরিচিত কিছু অপরিচিত,ঐ পড়ে থাকা দেহটাকে তুলে নিয়ে যেতে এগিয়ে এল। অমিত সরে দাঁড়িয়েছে একপাশে,কিন্তু,বাবাই কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না শরীরটা,শক্ত করে জাপটে ধরে রয়েছে যেন ঐ শরীরটাই ওর মা। অদ্ভুত ব্যাপার,আমার কষ্ট হল না একটুও,বরং একটু হাসিই পেল,ওরা ভাবছে ঐ শরীরটাই আমি,অথচ আমি তো এখন সম্পূর্ণ সতন্ত্র।ওরা সেটা বোঝে না।মৃত্যুর আগে আমিও কি ছাই বুঝতাম! কত প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমিও তো বাবাইয়ের মতই করেছি একসময়।অবশেষে ঐ মানুষের দল সফল হল শরীরটা বের করে শববাহী গাড়িতে তুলতে।ধূপ-চন্দন-ফুল-মালা পরিবৃত হয়ে রয়েছে শরীরটা,বেশ একটা পূজো পূজো ব্যাপার।কিন্তু,বুঝতে পারলাম আমার ঘ্রাণশক্তিও আর নেই এখন,কোন কিছুর গন্ধই আর আমি পাই না। গাড়ি ছেড়ে দিল একসময়,আমি আমার অস্তিত্বকে ভাসিয়ে দিলাম কাঁচের ঘরের চারিপাশে,ভিতরে আমার শরীর, বাইরে আমি।পৌঁছে গেলাম শ্মশানযাত্রার অন্তিমলগ্নে, যাত্রা শেষ হল,দেহটা নামিয়ে আনা হল শ্মশানচত্বরে। আমি ভেসে বেড়াচ্ছি এধার ওধার। আমার মৃতদেহ ঘিরে তখন কি বিরাট আয়োজন! জীবিত অবস্থায় আমি কখনোই মৃত্যু নিয়ে এসব আড়ম্বর পছন্দ করতাম না। এখন আমি সমস্ত পছন্দ অপছন্দের ঊর্ধে। তাই ভাবনায় এল না এতকিছু।আমার মুক্তির শেষ সীমানা আসন্নপ্রায়। ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল আমার দেহ, আমিও ঢুকে পড়লাম হাওয়ার সাথে মিলেমিশে।পুড়ছে দেহ,আমিও মুক্ত হচ্ছি ক্রমশ,আরও মুক্তি,আরও আরও! পুড়তে পুড়তে একসময় ছাই হয়ে গেল আমার আঁধার,এবার আমি সম্পূর্ণ মুক্ত। কি আনন্দ,কি অপার আনন্দ!আনন্দে আমি ভেসে বেড়াচ্ছি চারিধার।আমার বিগত জীবনের মানুষজন বেড়িয়ে যাচ্ছে শ্মশান ছেড়ে,বাবাই তো কেঁদে ভাসাচ্ছে এখনো।আমি ওঁদের সাথে চলার কোন তাগিদ অনুভব করলাম না, বরং এখন আমার উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে বায়ুস্তর পেরিয়ে, অসীমে। চেনা মানুষগুলোকে ফেলে, শ্মশানচত্বর ছাড়িয়ে আমি ভেসে চললাম, ট্রপোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে, ওজোনস্ফিয়ার-আয়োনোস্ফিয়ার অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছি আমি। কি অসম্ভব দ্রুতগতি আমার! এ কি আলোর গতিবেগ,না কি তার চেয়েও বেশি! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুস্তর ভেদ করে পৌঁছে গেলাম মহাশূণ্যে। মহাশূণ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম শূণ্য অঙ্কে। এই শূণ্য থেকেই একদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম পৃথিবীর কোন এক মাতৃগহ্বরে, মধ্যিখানে এত টানাপোড়েন, জীবনের হিসাবনিকাশ, মৃত্যুর পরেও আবার সেই শূণ্য। শূণ্যতে শুরু, শূণ্যতেই শেষ। হিসাব তো এত সহজ। তবে কেন এই পার্থিব জটিলতা! এসব বোঝার শক্তি আমার নেই, আছে শুধু একটা অনুভুতি, আর সেই অনুভুতির পুরোটাই ঘিরে রয়েছে শুধু অসীম আনন্দ,মুক্তির আনন্দ,শূণ্যতার আনন্দ। মহাশূণ্যে ছুটতে ছুটতে ক্রমশ আমার সমস্ত অনুভুতি যেন মিশে যাচ্ছে চারিধারে,ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে আমার অস্তিত্ব। বায়বীয় পিন্ড থেকে বাতাস নিষ্ক্রমণের সাথে সাথে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে পড়ছি আমি,মিলিয়ে যাচ্ছি অসীমে। আরও ক্ষুদ্রতর, আরও আরও। ক্রমে মেলাতে মেলাতে সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে গেলাম আমি, ক্ষুদ্রতম আমার শেষ কণাটুকুও হারিয়ে গেল মহাজাগতিক অসীমতায়, ‘আমি’র অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল মহাশূণ্যের গহ্বরে। আমি নিঃশেষিত,আমি সমাপ্ত।
‘মা,ও মা,কি গো? কি হয়েছে তোমার! উঠছ না কেন?’-ক্ষীণ আওয়াজটা কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে। আরও একটু জোরে,একসময়ে কানের মধ্যে দিয়ে মাথায় গিয়ে ধাক্কা মারল সপাটে। ধরমর করে উঠে বসলাম আমি,শরীরসুদ্ধু আমি! তাকিয়ে দেখলাম,সামনে বাবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে,বাবাইয়ের গলার আওয়াজে অমিতও দৌঁড়ে এসেছে খবরের কাগজ হাতে, গলায় আতঙ্ক –‘শরীর খারাপ করছে নাকি তোমার!’ একটু ধাতস্থ হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি বেঁচে আছি শরীরসুদ্ধু! কি আশ্চর্য! তবে এতক্ষণ কি ঘটে চলেছিল আমার সাথে! স্বপ্ন! নাকি শূণ্য পরিমাপের সহজ খেলাটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল কোন মহাজাগতিক শক্তি, যার অস্তিত্ব আজও অধরা আমাদের কাছে!
গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প