দুবাই হইতে বড়ভাই আলালের জন্য একখানা ট্যাব পাঠাইলেন। ট্যাব পাইয়া আলালের সাহিত্য প্রতিভা কোঁত করিয়া বাড়িয়া উঠিল। প্রথমে মুখবই খুলিয়া তাতে অতিশয় পোজের সহিত সেলফি আপলোড করিয়া তাহাতে একখানা গল্প জুড়িয়া দিল। মন্তব্যে সবাই ‘মারহাবা’, ‘মারহাবা’ করিতে লাগিল। এইভাবে আলাল সেলফির সহিত প্রায়শই একটা করিয়া গল্প জুড়িয়া মুখবইতে বদনখানা দেখাইবার পাশাপাশি নিজের সাহিত্য প্রতিভার জানান দিতে থাকিল।
কিন্তু শুধু ‘মারহাবা’তে আলালের মন ভরিল না। মন আরো কিছু চায়। আলাল স্বপ্নে দেখে সে বাংলা একাডেমি হইতে একুশে পদক গ্রহণ করিতেছে। ‘একুশে পদক’খানা আলালের গলা হইতে মস্তকের মধ্যে ঝুলিতে লাগিল। আরেহ মস্তক মানে মনের অলিগলিতে…তাহাও কি আরো ব্যাখ্যা করিয়া আপনাদিগকে বুঝাইতে হইবে?
মুখবইতে ‘গল্প লিখিয়ে’ পৃষ্ঠা হইতে গল্প লেখিবার আহবান জানানো হইলো। আহা আলাল এই বেলা সেলফির খ্যাতা পুড়িয়া গল্পে মনোনিবেশ করিল। এই দফায় একখানা মারদাঙ্গা গল্প লেখিয়া পুরস্কারখানা বাগাইতে হইবে। যেই ভাবা সেই কাজ। দুই দিনের আদাজল চেষ্টায় আলাল লিখিয়া ফেলিল একখানা ফাটাফাটি গল্প। এইবার তাহার পুরস্কার পাওয়া ঠেকায় কে?
নখ কামড়াইতে কামড়াইতে আলাল তাহার হাতের নখের অস্তিত্ত্ব শেষ করিয়া ফেলিতেছে তথাপি ফলাফল প্রকাশ হইতে বিলম্ব হইতেছে। অবশেষে চাতকের প্রতীক্ষা শেষ করিয়া ফলাফল প্রকাশ হইল। হায় ! আলাল নিজের চর্মচক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না! ইহা কেমন করিয়া সম্ভব? প্রথম দশজনের মধ্যেও তাহার নাম নাই!
আলাল ভাবিতে লাগিল কী লিখিলে পাঠক খাইবে?
পরেরবার খুব রস লাগাইয়া গল্প লিখিল। এইবার অনেকের রসময় মন্তব্য পাইয়া ভাবিল নিশ্চয়ই অনেক ভোট পাইয়াছে। কিন্তু হায় ফলাফল যেই লাউ সেই কদু!
এই পৃষ্ঠাতে ভোট দেওয়ার নিয়ম বড়ই কড়াকড়ি! একজন একটার বেশি ভোট প্রদান করিতে পারেনা।
অনেক ভাবিয়া আলাল একটা উপায় আবিষ্কার করিল।
আলাল আপাতত তাহার আবিস্কার লইয়া ব্যস্ত থাকুক সেই কথা পরে হইবেক।
আমরা ততক্ষণে একজন সুন্দরী নারীর কিছু কথা জানিয়া লই।
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে বসবাস করা দুলালীর সময় কিছুতেই কাটিতে চাহেনা। টিভি বিজ্ঞাপনে অপি করিমের ‘সময় যেনো কাটেনা, বড় একা একা লাগে…’ তাহার চেয়েও দুলালীর অবস্থা শোচনীয়। পেশাগত জীবনে দুলালী অধ্যয়ন করিতেছে নাকি কোন অফিসে কর্মরত আছে তাহা জানিতে পারিনাই। কারণ দুলালীকে জানিবার মানসে বন্ধু হইবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলাম, সুন্দরী আমাকে বাদুরঝোলা করিয়া রাখিয়াছেন। হয়তো যাহারা বন্ধু হইবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছে তাহারা নিশ্চয় জানিতে পারিয়াছে দুলালী কী করেন।
অলস সময় পার করিবার জন্য মুখবইয়ের বিকল্প বোধকরি বর্তমান সময়ে আর কিছু নাই। বারান্দায় বসিয়া থাকিলে যেমন আশেপাশের বাড়ির, সড়কের তামাশা অবলোকন করা যায় মুখবইয়ের ‘হোমপেজ’-এ প্রবেশ করিলে তেমনই তামাশা দেখিতে দেখিতে আপনার সময় কোথা হইতে পলাইয়া যাইবে আপনি বুঝিতেই পারিবেন না। আর এই বুঝিতে না পারিয়াই কিশোর বয়সী নর-নারী নিজেদের অধ্যয়নের চৌদ্দটা বাজাইয়া পরে ফলাফল ভালো করিতে না পারিয়া বা ভালো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সুযোগ না পাইয়া শিক্ষাব্যবস্থার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করিয়া স্ট্যাটাস প্রকাশ করিয়া হাজার হাজার লাইক কামাইয়া হালের সেলিব্রেটি হইয়া উঠে।
যাহা হউক। সেলিব্রেটিদের কথা পারিতে এই গল্প নহে। বলিতেছিলাম দুলালীর কথা।
‘দুলালী’ তাহার নিজের নামে মুখবইতে একখানা হিসাবের খাতা খুলিয়া তাহাতে জবর সুন্দর, নয়নভোলানো একখানা ফটো জুড়িয়া দিল। কিন্তু সেই ফটোতে দুলালীর সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হইলেও পুরো মুখাবয়ব তাহাতে অবলোকন করা যায়না। অমন সুন্দর মুখখানায় রহস্য ভরিয়া রাখা হইয়াছে। কী তাজ্জব ব্যাপার, ইহা কেমন করিয়া সম্ভব! মুখবই খুলিয়া সারিতে পারেনাই এর মধ্যেই অনুরোধ আসিয়া পরিয়াছে। সবাইকে বাদুড়ঝোলা ঝুলাইয়া দুলালী তাহার অনুসরণকারী বাড়াইতে লাগিল।
দুলালীর সকল ভাব, আবেগের কথা স্ট্যাটাস আকারে জনসমক্ষে প্রকাশিত হইতে লাগিল।
‘আজ বড্ড মনটা কেমন কেমন করিতেছে…পাশে কোন রাজপুত্রকে ভাবিতে মন চাহিতেছে।’
হ্যাঁ, রাজকন্যাতো রাজপুত্রকেই ভাবিবে। মন্তব্য পড়িতে লাগিল, ‘সুন্দরী, তোমার হৃদয়ের রাজপুত্র হইতে চাহি, অনুমতি দাও।’ ‘ঘোড়া লইয়া আসিতেছি অপেক্ষা করো…’ দুলালীও বড় রং, ঢং করিয়া সেই সমস্ত মন্তব্যের জবাব দিতে থাকে।
‘আজ খুব গল্প পড়িতে মন আনচান করিতেছে। বন্ধুরা তোমাদিগের মধ্যে যাহারা গল্প লেখো তাহারা জলদি তোমাদিগের গল্পের লিঙ্ক দাও, পড়িব।’ দুলালীর এহেন স্ট্যাটাসে মন্তব্যে ভাসিয়া যাইতে লাগিল গল্পের লিঙ্কে।
‘গল্প লিখিয়ে’ পৃষ্ঠায় পুরস্কার না পাইলেও আলাল দমিয়া যাইবার পাত্র নহে। এইবার নিজের ভিত্তি আগে শক্তপোক্ত, মজবুত করিয়া লইতে হইবে। তাহার পরে প্রতিযোগিতায় গল্প পাঠাইলে তাহার পুরস্কার কে লয় তাহা দেখিয়া ছাড়িবে-এমন মানসে ‘গল্প লিখিয়ে’ পৃষ্ঠায় প্রতিযোগিতা ছাড়াই নতুন একখানা গল্প দিয়া তাহাতে আলাল খুব নিশ্চিন্তের সহিত সময় কাটাইতে লাগিল।
এদিকে আলালের লেখার প্রেমে পড়িয়া সুন্দরী দুলালী হাবুডবু, নাকানিচুবানি কোন কিছু খাইতে, পান করিতে বাকি রাখিল না।
আলালের লেখার প্রসারের দুশ্চিন্তা সমস্ত গিয়া পড়িল দুলালীর ঘাড়ে। গল্প প্রকাশ করিতে দেরী হইতে পারে কিন্তু দুলালীর মন্তব্য প্রকাশ হইতে দেরী হয়না। ‘আহা কী অসাধারণ গল্প লিখিয়াছ, তুমি। পাঠ করিয়া আমার অন্তর উদ্ভাসিত হইয়া গেল। পাঠক এমন আরো শত শত গল্প তোমার নিকট হইতে আশা করে।’
অমন সুদর্শনা এক যুবতীর এহেন মন্তব্যে পাঠক থমকিয়া ভাবিতে লাগিল তাহারা নির্ঘাত এই গল্পের আসল রসাস্বাদন করিতে পারে নাই। নিশ্চয়ই উহা দারুণ কিছু হইবে। বেশ কিছু ‘আহা’ ‘উহু’ মন্তব্য এইবেলা আলালের ঝুলিতে জুটিয়া গেল। এর মধ্যে দুলালী আবার মন্তব্য করিল,’আমি তোমার গল্প পড়িবার জন্য চাতকের মতো অপেক্ষায় থাকি। সারাজীবন তোমার গল্প পড়িয়া কাটাইয়া দিতে চাই, প্রাণসখা।
পাঠক ঠোট কামড়াইয়া নির্লজ্জ দুলালীর প্রতি শ্যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া ভাবিতে লাগিল বেশি সুন্দরীরা যে বোকা হয় এই দুলালী তাহার বড় প্রমাণ। নইলে আলালের মতো কারো লেখার প্রেমে পড়ে! না আছে ছোট গল্পের নিয়ম মানা, না আছে লেখার বিশেষ চমক। এদিকে সুন্দরী দুলালীর ভক্ত, অনুসারী সংখ্যা বাড়িতেই লাগিল। ইনবক্সে প্রেম নিবেদন করিয়া মেসেজ আসে নিয়মিত। বাংলা সাহিত্যের এমন অন্তিম সময়ে আলালের লেখা মুক্তির বার্তা লইয়া হাজির হইয়াছে-এমন কথা লিখিয়া দুলালী জনসমক্ষে আলালের লেখার শেয়ার দিতে লাগিল।
বান্ধবীর দাওয়াতে গতমাসে মালয়েশিয়া ভ্রমনের সুযোগ হইয়াছিল। দুলালীকে মুখবইয়ে বার্তা পাঠাইলাম, ‘ আমি মালয়েশিয়া ভ্রমণে আসিতেছি। আপনার সহিত সাক্ষাত করিয়া গর্বিত হইতে চাহি।’ বার্তা তো ‘সিন’ হয়না! বাদুরঝোলা হইয়া আছি তাহাতে আক্ষেপ কিয়ৎ পরিমাণ থাকিলেও বার্তা ‘সিন’ হয়না দেখিয়া আমার তৃষ্ণা বাড়িতে লাগিল। আহা সুন্দরী, তুমি বন্ধু বলিয়া গ্রহণ না করো বার্তা তো দেখিবা! নাহ্ সুন্দরী কোনমতেই বার্তা দেখিতেছে না! খোঁজ লইয়া জানিলাম দুলালীকে মালয়েশিয়া বা দেশে কেউ কোনদিন দেখিয়াছে বলিয়া মনে করিতে পারেনা।
রহস্যময়ী নারী হওয়াতে পুরুষকুলের আগ্রহ বোধকরি আরো বেশি। কোন ছবি প্রোফাইল হিসাবে ব্যবহার করিলে ভক্তকুল হামলে পরে বলে, আধেক কেন পুরো চেহারাই দেখতে চাই।
‘গল্প লিখিয়ে’ পৃষ্ঠার সার্ভার নাকি খুবই শক্তিশালী। কে কোন জায়গা হইতে লেখা পাঠাইতেছে, মন্তব্য করিতেছে তাহা কর্তৃপক্ষ খুব ভালো করিয়াই জানিয়া ফেলেন। আর কাহারো চাতুরী সুনিপুণভাবে সনাক্ত করিয়া তাহাকে ‘ডলা’ দিতেও কার্পণ্য করে না।
কানে কানে একখানা কথা বলিয়া রাখি। আমার গল্প আসলে নিকটের, পার্শ্বের মানুষগুলোর জীবন হইতে লওয়া। যাহা আমাকে কোন না কোনভাবে ভাবাইতে বাধ্য করে। কলমের খোঁচায় তাহাই গল্পাকারে লিখিয়া মনের ভার হালকা করিবার প্রয়াস চালাই। গল্প লিখাটা আমার কাছে খেলার মতো মনে হয়। যেমনটি সুইমিং পুলের জলে সন্তরন করিয়া খেলার আনন্দ লাভ করি, ঠিক তেমনি জীবনের কথাও গল্পের মতো করিয়া প্রকাশ করিয়া স্বস্তি অনুভব করি। তাহা পাঠক কীভাবে নিল পাঠকের বিষয়। কিন্তু আমি বড়ই প্রশান্তি অনুভব করি।
‘গল্প লিখিয়ে’ প্রতিযোগিতায় এইবার নিশ্চিত ছিলাম আলাল পুরস্কার না পাইয়াই ছাড়িবে না। কিন্তু কিসে কী! আলালের লেখা প্রথম দশজনতো দুরের কথা বিচারক বিচারই করেনি! হায় হায় ঘটনা কী?!
দুলালীকেও আর চোখে পড়ে না।
আলালের প্রেমিকা এইভাবেই কর্তৃপক্ষের কোপে পড়িয়া অন্তর্জালিক অক্কা পাইবে ভাবিনাই। ভাবিনাই আলালের আবিষ্কার এইভাবে বৃথা যাইবে। বড়ই পরিতাপের বিষয়!