“খুব সখ ছিল তোমার সন্তানের বাবা হব”
গোটা গোটা অক্ষরে কাগজ টাতে লেখা। কাগজটা যেখানে পরে আছে তার থেকে কয়েক হাত দূরে পরে আছে লাশটা। কাক ডাকা ভোরে জগিং করার জন্য ফজরের নামাজ পড়ে সবেমাত্র পার্কে এসে দাড়িয়েছি। দৌড়াদৌড়ির পর যে বেঞ্চটাতে এসে রোজ বসি ঠিক ওই বেঞ্চটাতেই পরে আছে লাশটা!! উচু লম্বা স্বাস্থ্যবান ও গোল গাল চেহারার ছেলেটার বয়স আনুমানিক ২৭-২৮ হবে। নিথর দেহটার পাশেই পরে আছে একটা সিরিন্জ!! ওটাতেই হয়তো কোন বিষাক্ত কেমিক্যাল নিয়ে পুস করেছে নিজের শরীরে। নিশ্চয়ই লাভ কেস!!! বেশ রাগ হল ছেলেটার উপর!! বেঁচে থাকলে হয়তো কষে কয়েকটা থাপ্পড় মারতাম!! পোশাক আশাক দেখে তো মনে হচ্ছে মোটামুটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের ছেলে! আবার কপালের সদ্য কালচে ছোপ ছোপ দাগ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় মরার আগে বেশ কয়েকদিন নামাজও পড়তো ছেলেটা!! দাগটা অবশ্য এখনো খুব বেশি গারো হয়ে পারেনি। আল্লাহর প্রেমে পুরোপুরি মশগুল হওয়ার আগেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে সে! নাহলে হয়তো কোন মানুষের প্রেমে অন্ধ হয়ে আত্মহত্যা করত না!! কিন্তু তার বাপ, মা? তারা তো কোন অন্যায় করেনি!! তাদের প্রতি কি কোন প্রেম ভালবাসা ছিলনা তার? ইচ্ছে করছে ওকে ডেকে তুলে বলি –
“তুই তো কোন না কোন মায়ের সন্তান!! কোন না কোন বাবার সাত রাজার ধন!! যারা তোকে এই দুনিয়া দেখাল, বুকের মধ্যে আগলে রেখে এতগুলো বছর নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসলো তাদের সেই ভালবাসার থেকে দুই দিনের প্রেম তোর কাছে এত বেশি প্রাধান্য পেল??? থুহ্!! ধিক্ তোকে ধিক্!! তুই মরেছিস ভাল করেছিস!! কোন অধিকার নেই তোর এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার!!”
হঠাৎ কি হল আমার জানিনা। কেন এত ক্ষেপে গেলাম তাও বুঝতে পারছি না!! নিশ্চয়ই সাত সকালে এধরনের কোন দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও আগে থেকে প্রস্তুত ছিলাম না আমি। তার উপরে মুখোমুখি হলাম আরো এক ভয়াবহ বিব্রতকর পরিস্থিতির!! জীবনে কোনদিন চিন্তাও করিনি এধরনের পরিস্থিতির সামনে পরতে হবে আমাকে!!
আস্তে আস্তে দিনের আলো পরিষ্কার হচ্ছে আর আমার মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে!! হা হয়ে তাকিয়ে আছি আমি ছেলেটার মুখের দিকে। এতক্ষণে তার চেহারাটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে হতে পরিষ্কার হয়ে এলে একটা চরম ধাক্কা খেতে বাধ্য হলাম আমি!! ছেলেটা দেখতে হুবহু আমার মত!! জমজ বললেও ভুল হবে!! মনে হচ্ছে আমার আরেকটা কপি পরে আছে!! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!!!
ঠিক কতটা সময় পার হয়েছে বা কতক্ষণ ওভাবে লাশটার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে ছিলাম বলতে পারব না, সম্মোহন ভাঙ্গলো আশপাশের লোকজনের কথপকথনে। ধীরে ধীরে উৎসুক জনতার ভীড়ে সরগরম হয়ে উঠলো পার্কের ভিতরটা। পাছে লাশটার চেহারার সাথে আমার চেহারার মিল পেয়ে আমাকে মৃতের আপন কেও না ভাবে তাই ভীড় থেকে বেরিয়ে সামান্য দূরে গিয়ে অবস্থান নিলাম। সবাই লাশটাকে উদ্যেশ্য করে দুঃখ প্রকাশ করছে আর আহারে উহুরে করছে। এর ভিতরেই দুজনের কথপোকথন শুনলাম –
-“আহারে!! ছেলেটার বাড়ি কই ভাই?”
-“এই তো পাশেই। একই পাড়ায় থাকি আমরা”
-“কি হয়েছিল ওর? আত্মহত্যা করল কেন?”
-“জানিনা ভাই, তবে কয়দিন ধরেই লক্ষ্য করতাম খুব চিন্তিত ও অসুস্থ দেখাত ছেলেটাকে। একবার ফোনে তার প্রেমিকার সাথে উচ্চস্বরে কথাও বলতে শুনেছি!!”
এতক্ষণে একটা পুলিশের গাড়ি এসে লাশ ও তার পাশের আলামত সংগ্রহ করছে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে। আমি বুক পকেটে কাগজটা ঢুকিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছি ঘটনাস্থল থেকে বেশ খানিকটা দূরে। স্পষ্ট করে কোন কারণ বলতে পারব না, তবে কেন জানিনা ওই কাগজটা নিজের কাছে রাখতে ইচ্ছা করল। যদিও আমি জানি আমি অন্যায় করছি, তবুও!!
এরপর পুলিশ লাশটা গাড়িতে তুলে চলে গেল মর্গের দিকে। আমিও যাচ্ছি পিছু পিছু!!
কিন্তু কেন যাচ্ছি, কি জন্য যাচ্ছি জানিনা !!… তবে যাচ্ছি…
মর্গে পৌঁছে কিছুক্ষণ বাদে দেখলাম দুজন ডোম লাশটাকে একটা লাশকাটা ঘরে ঢুকাল। আমিও তা নিজের চোখে দেখার জন্য ছোট্ট একটা জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালাম এবং দেখলাম কি বিভৎস ভাবে লাশটাকে তারা কাটাছেঁড়া করল ও শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ সংরক্ষণ করলো। বেচারির প্রতি খুব মায়া জন্মালেও চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর যেন কিছুই করার ছিলোনা আমার। যদিও কেন দেখছি, কি কারনেই বা দেখতে হচ্ছে তার সদুত্তর নেই আমার কাছে!!
তারপর, লাশটাকে তার আপনজনদের কাছে হস্তান্তর করা হলে দেখলাম কি পাগলের মত কান্নাকাটি ও প্রলাপ শুরু করে দিল ছেলেটার মা, বোন আরও কতজন। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আমি …!!
এরপর আসলো জানাজা ও দাফন কাফনের পালা। কাফন পরিয়ে জানাজা শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হল কবরস্থানের দিকে। আমি মন্ত্র মূগ্ধের মত এখনো ছুটছি লাশটার পিছু পিছু!! মনে হচ্ছে দাফন কর্ম সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমি সস্থি পাবোনা!! আর তাই সেই সস্থি হাছিল করার জন্যই হয়তো আমিও এগোলাম লাশবাহী খাটিয়ার পিছু পিছু…
এবার আমি চরম একটা বিভিষিকাময় ভয়ের মুখোমুখি হলাম যখন দাফন শেষে কবরস্থান থেকে বের হয়ে আসতে গেলাম ঠিক তখন !!! একে একে সবাই মাটি দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় আমিও তাদের সাথে বের হতে চাইলেও আর বের হতে পারলাম না …!!! কবরস্থানের দরজার কাছে আসতেই একটা অদৃশ্য দেয়াল আমার পথ রোধ করে দাড়ালো!! আমি পাগলের মত খোলা দরজা দিয়ে বের হতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না!!! অদৃশ্য কিছু একটা ঠেলে আবার আমাকে ভিতরের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে …!! আমার গলা শুকিয়ে এলো … মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো … চিৎকার করতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না ….!!! যদিও বা কিন্চিত শব্দ গলা দিয়ে বের হল বটে কিন্তু সব থেকে কাছের লোকটিও তা শুনতে পেলনা !! আমি উন্মাদ হয়ে গেলাম … শরীরের সমস্ত শক্তি খাটিয়েও ভেদ করতে পারলাম না ওই অদৃশ্য দেয়াল … এমন সময় হঠাৎ কে যেন আমার নাম ধরে পিছন থেকে ডাক দিলো এবং সেদিকে চাইতেই চমকে উঠলাম …!!! একি!!! আমার বাবা!!! তিনি তো মারা গেছেন প্রায় বছর খানেক হল!! তাহলে কিভাবে আবার বেঁচে উঠলো!! আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে বললাম –
-“আব্বু আমি বের হতে পারছিনা কেন!! প্লিজ আমাকে এখান থেকে বের হবার উপায় বলে দাও!! প্লিজ …”
কিন্তু আব্বু কেমন যেন শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলল –
-“খোকা, কেন আত্মহত্যা করলি? তুই কি জানতিস না আত্মহত্যা মহা পাপ?”
-“আত্মহত্যা!!! কি বলছো এসব?? আমি আত্মহত্যা করলাম কখন?? আমি তো নামাজ পড়ে পার্কে গেছিলাম জগিং করতে!! তুমি এসব কি বলছ আব্বু!!”
-“আমি ঠিকই বলছি বাপ। তুই আজ ভোরে নামাজ পড়ে পার্কের ওই বেঞ্চের উপরে বসে আত্মহত্যা করেছিস!!”
-“কি বলছ এগুলো?? আমি আত্মহত্যা করলাম আর আমার মনে নেই??”
-“না মনে নেই!! মারা যাবার সাথে সাথে দুনিয়ার আর কিচ্ছুই মনে থাকেনা মানুষের!! তারা তখন কেবল মৃতব্যক্তিদেরই চিনতে পারে। যেমন – তোর মা যখন তোর লাশ ধরে কাঁদছিল তুই তাকেও চিনতে পারিসনি!!”
আকাশ ভেঙে পরল আমার মাথায়!! মাটিতে ধপাস করে বসে পরলাম আমি …!! কাদতেঁ চাচ্ছি কিন্তু কাদতেঁ পারছিনা …। কাদতেঁ চাইলেও কাদতেঁ না পারার যন্ত্রণা এই প্রথম অনুভব করলাম। অনুভব করলাম বুকের ভিতরে যেন প্রাণ নেই!! খুব শুন্যতা … আর থাকবেই বা কি করে! ধীরে ধীরে তো আমার সব মনে পরতে শুরু করেছে … মনে পরতে শুরু করেছে কিভাবে এবং কি কারণে আমি আত্মহত্যা করেছিলাম!! শান্ত হয়ে গেলাম আমি …. একদম শান্ত ….! ঠিক আমার বাবার মত শান্ত … কিন্তু আফসোস দুনিয়ার মানুষ কে জানাতে পারলাম না যে আত্মহত্যা কত বড় গর্হিত অন্যায় … বলে আসতে পারলাম না-
-“ওহে বোকা মানুষ, কি করছো এসব? অযথাই ছুটছো টাকার পিছে, নারীর পিছে, ক্ষমতার পিছে!! হাহাহা … ভুলে যাও কেন তুমি সামান্য এক দুষিত শুক্রকীট!! নাপাক এক ফোটা পানি থেকে তোমার জন্ম …!! কিসের দেমাগ তোমার? এসো নত হই যার যার প্রভুর কাছে”
-“খোকা, তোর ডাক এসেছে, এবার যা তোর ঘরে”
বাবার কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম এবং উঠে দাড়িয়ে ধীর গতিতে নির্বিকার ভঙ্গিতে এগোতে থাকলাম আমার কবরের দিকে। যেতে যেতে শুনতে পেলাম আশপাশের কবরগুলো থেকে কি বিভৎস আর ভয়ঙ্কর আর্তনাদ ও গোঙরানির শব্দ ভেসে আসছে … কেঁপে উঠলো বুকটার ভিতর … এক সেকেন্ডের জন্য যেন জীবনের সমস্ত পাপ গুলো চোখের সামনে উকি দিয়ে গেল ….!! আমি নির্বিকার … তবুও নির্বিকার … কিছুই করার নেই আর আমার… কিছুই নাহ…!! এগিয়ে চলেছি আমার কবরের দিকে… অন্ধকার কবরের দিকে…।