বৃষ্টি দিন পেরিয়ে এলো হেমন্ত… হাল্কা শীত গায়ে মেঘেই জব্বার মাঠে বেড়িয়ে পড়লো যাবার আগে খেয়ে নিল পান্তাভাত
আর দুইটা পেয়াজ একটা কাচাঝাল… ভাতের থেকে পানির অংশ বেশি ছিল…. তারপর জব্বারের স্ত্রী উনুনে ভাত চেপে ডাকতে
গেলেন তার মেয়ে মায়া বয়স ৯ বছর আর ডাকলেন ছোট ছেলে কানু কে, বসয় কম ছোকরা… এদিকে রান্না প্রায় শেষ…
মায়া আর কানু উঠে তাদের কবুতর গুলো কে ছেড়ে দিলো! তারপর মুরগীগুলো ধরে রাখল!! জব্বার গরিব মানুষ এখন বতোরের
সময় বলে অন্যের জমির ধান কেটে দেন!! আর তার স্ত্রী মতিবানু মানুষের বাড়িতে কাজ করে দেন বলে সংসারের বাড়তি কিছু
টাকা আয় হয়… যা দিয়ে এই শৈবালের সংসার টা চলে….
—–
মায়া ওঠে ধোয়া ওঠা গরম ভাত আর সাথে বেগুন ভর্তা দিয়ে পেট পুড়ে ভাত খেয়ে নেই!! তারপর জব্বারকে মাঠে ভাত খেতে দিতে যায়!!
সাথে কানুও যায়.. মায়ার বয়সি অনেকে এখানে আসে ধান কুড়াতে.. কানুও মায়া একটা ঝাকা নিয়ে আইয়ের ধার বেয়ে হেটে যায়!!
শিশির কনাগুলো সূয্যের আলোতে চকচক করে ওঠে…. মায়ার পরনে একটা ময়লা ফ্রক যা রংচঙ ওঠে বিবর্ণ হয়ে গেছে!!
কানুর পরনে হাফ প্যান্ট গায়ে একটা কাটাছেরা গেঞ্জি… জব্বার কে ভাত দিয়ে মায়া ও কানু বেড়িয়ে পরে তাদের কাজে….
—–
মাঠে এখন মায়ার মতো অনেকে এসেগেছে ঝাকা কুলো নিয়ে ধান কুড়াতে! তায় মায়া আগেভাগে কানুকে নিয়ে ধান কুড়িয়ে টপাটপ ঝাকায় রাখে!!
যে যতসকালে আসতে পারবে তারই বাজিমাত!! কানু ধানের ছড়া তুলে তুলে ঝাকায় রাখছে!! যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ
পাকের ধানের গন্ধে মায়ার নাক ভরে ওঠে!! সোনালী ধানের শীসের উপর রোদ পরতেই তা জ্বলজ্বল করে ওঠে…!!
কানু ঝাকা থেকে ঝাটাটা নামিয়ে নিল তারপর মায়া ঝাটা দিয়ে কিছু ধান তুলে নিলো!! চিকণ লম্বা লম্বা ধান দেখতে খুব ভাল…
এর ভাত খেতেও মনেহয় মিষ্টি ভাবে কানু…
—–
বিকালে বাবার সাথে বাড়ি এলো মায়া ও কানু!! ঝাকা পূর্ন হবার কারনে তার বাবা জব্বার সেটা বয়ে বাড়ি ফিরল… সূর্য্য তখন প্রায় ডুববে!
এখুনি হাল্কা শীত লাগে!! আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় তারা…
—–
রাতে মতিবানুও ঘড়ে ফিরে আচলে কছড়ি কাচকলা আর দুটো ডিম নিয়ে!! রাতে ডিম খেতে পারবে বলে কানুর মুখে হাসি আসে!
তারপর সবায় মিলে বাড়ির কাজ করে! সারাদিন কিছুই করা হয়নি কারন এই সকালে মতিবানু উঠান ঝাড়ু দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে কাজে
তারপর একেএকে সবায় বাড়িতে কেউ থাকেনা!! আর বাড়িতে তেমন কিছুই নেই চুরি হবার মতো! উনুনে মতিবানু ভাত চেপে অন্যান্য
কাজ করলেন! মায়া ও কানু তাদের লাগানো মরিচ গাছ ২ টা বেগুন গাছ ৪টা আর ক’টা টমাটো গাছের গোড়ায় পানি দেই!! কানুর ওর
একটা পেয়ারার চারার বেশি যত্ন নেই!! পানি দেই!! তারপর গবরের সার দেই!! গাছে খুটি বেধে দেই!! মায়া কিন্তু সব গাছ কে সমান দেখে….
তারপর জব্বারের ডাকে বাড়ির মধ্যে যায়….
—–
রাতে খাবারের সময় সবায় মিলে খুব মজা করে খায় দুটো ডিম অর্ধেক করে চারজন খেয়ে নেই হাসিমুখে! তারপর সবার ক্লান্ত দেহ বিছানায়
যাওয়া মাত্র নেতিয়ে পড়ে…..
—
মায়ার চোখে ঘুম আসেনা… সকালে সে সবার আগে ঘুম থেকে উঠবে তারপর যারা ধান কেটেছে সেখানে ঘুরেঘুরে ধানেই বাইল কুড়াবে সেই
চিন্তায় ঘুম আসতে চাইনা!! কারন মায়ার মতো অনেকে সকালে ধান কুড়াই। কানুর এত বুদ্ধি এখনো হয়নি! সে চুপচাপ মায়ার পাশে ঘুমিয়ে পড়ে!!
মায়া বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে যায়….
—-
প্রতিদিনের মতো আজও মতিবানু উনুনে ভাত চেপে ওদের ডেকে তোলে!! তারপর ওরা জব্বারের জন্য ভাত নিয়ে মাঠের দিকে ছুটে…
সূর্য্য উকি মেরেছে পূর্বাকাশে… হাল্কা মিষ্টি রোদ বেশ লাগছে কানুর শরিরে… মায়া কানুর সাথে হেটেহেটে জব্বার কাছাকাছি চলে আসে!
এরপরে তারা ঝাকা কাধে বেড়িয়ে পড়ে ধান কুড়াতে.. কিছু মানুষ আছে যারা মায়াকে জমিতে নামতে দেইনা আগে থেকেই তারিয়ে দেই!
কানু দেখে মনেমনে বলে– এরা অনেক খারাপ মানুষ!!
—
হেমন্তকালের প্রায় শেষের দিকে এখন… মায়া অনেক ধান কুড়িয়েছে এবার কানুকে সাথে নিয়ে… প্রতিদিন ধান জব্বার বয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আসে…
রোদে পুড়ে তার সুন্দর ছেলের মুখ কালো হয়ে গেছে জব্বার বোঝে!! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জব্বার এটা বুঝে তার মেয়েও কষ্ট করে!!
জব্বার আর মতিবানুর খুব ইচ্ছা ছিল মেয়েকে শিক্ষিত বানাবে কিন্তু অভাবের তারনায় আজ তা হয়নি… নদী ভাঙ্গনে জব্বারের সবকিছু তলিয়ে যায়!!
জব্বারের আগে জমিজমা ছিল গোয়ালে গরু ছিল!! কিন্তু আজ নিশ্ব!!
——
একদিন মায়া ও কানু ধান কুড়াচ্ছে হঠাৎ কানু বললঃ
কানু– দ্যাখ মায়া এখানে কি…
মায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল– কি রে ওখানে???
কানু আঙ্গুল দিয়ে একটা ইদুরের গর্ত দেখাল…
মায়া হকচকিয়ে সেদিকে তাকাল! তারপর হাল্কা খুরে বুঝল শুধু ধান আর ধান… তাড়াতাড়ি গর্তের মুখ মাটি দিয়ে এটে দিল যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে!!
তারপর রোদে পোড়া কাল মুখে হাসি ফুটিয়ে ঘড়ে ফিরল….!!
—
একথা কেউ জানল নাহ!! মায়া মনেমনে ভাবল যা ধান হয় সে বিক্রি করে একটা নতুন ফ্রক কিনবে!! আর কানুর জন্য সোয়েটার কারন সামনে শীতকাল!!
যে ধান আছে মায়া দেখেছে তাতে অনেক কিছুই হবে!! মায়া সেরাতে মিটমিটে হেসেই পার করে…. সকালে পান্তাভাত খেয়েই মাঠে
চলে যায় আর কানুকে বলে ভাত নিয়ে যেতে! মায়ার মনে ভয় যদি কেউ দেখে ফেলে?? আজ খুব দ্রুত মায়া মাঠের কাছে চলে আসে!
এরপরে পুরাতন একটা খুন্তা দিয়ে আস্তে আস্তে গর্তের মুখ খুড়তে থাকে!! অনেকক্ষন খুরার পর মায়া ক্লান্ত হয়ে যায়!! গা দিয়ে ঘাম ছুটে!
কানুর চোখ জ্বলজ্বল করে!! তারপর মায়া শেষ বিকালে গর্তের নিচে যেতে স্বার্থক হয়!! অনেকে দেখে কিন্তু আগাতে পারেনা কারন আগে
এটা মায়াদের জমিছিল!! এখন মোল্লা বাড়ির মানুষ করে!!
—-
বিকালে মায়া দেখে সুন্দর করে ইদুর সাজিয়ে রেখেছে ধান গুলোকে!! মায়া সব ধান কুড়িয়ে তোলে বেশ দুই ঝাকা ধান পেলো মায়া!!
এতো ধান কারন ইদুর সারাবছরের ধান সংগ্রহ করেছে…..
—-
সূর্য্য আর বেশি নেই!! মায়া দ্রুত কাজ করতে লাগলো!!!
—–
হঠাৎ মোল্লাবাড়ির দুষ্টু ছেলে মেঘ তাদের জমি থেকে সোনালি ধান কুড়াতে দেখে!! রেগে যায় তারপর সব ধান নিজের করে নিয়ে মায়া ও কানুকে তারিয়ে দেই!!
আঁজলা ধান মায়ার ঝাকাই দেই সারাদিন খুরেছে তাই…..
—-
মায়া ও কানু কান্নাচোখে বাড়ি ফিরে এলো!!! ফ্রক ও সোয়েটার কেনার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল এক নিমিষে!! যা কেউ দেখেনি!! কেউ বুঝেনি……
মায়াদের স্বপ্ন গুলো কখনো পূরণ হয়না…..