ঈশ্বর নামে আমার এক বন্ধু ছিল।ঈশ্বর দাশ, রাঙ্গালির বস, রায়গঞ্জ।জাতে নমশূদ্র— অথচ ব্যাটা পদবিতে তালব্য-শ লিখত।
নাম দিয়ে জাতে ওঠার পায়তারা আর কী। আমি কখনওই তাকে ঈশ্বর ডাকতাম না। মকতবের হুজুর আমায় বলেছিল ঈশ্বর ডাকলে শিরক হয়।
শিরক করা মহাপাপ। এই পাপের ভয়েই ঈশ্বরকে কখনও ঈশ্বর ডাকা হয়নি। ঈশ্বরের ডাক নাম আমার জানা ছিল না—
তাই ওকে ”কাডুয়া” ডাকতাম।.আমাদের স্কুলে ঈশ্বরই একমাত্র হিন্দু ছিল। আমি ছাড়া অনেকেই তাকে “কাডুয়া হিন্দু” ডাকত।
এতে ঈশ্বর রাগ-টাগ করত না— উল্টো হাসিমুখে সাড়া দিত। ছেলেটার অমায়িক ব্যবহার দেখে বারবার চমকে যেতাম।
কৈশোরে প্রায় প্রতিটা মানুষের পুঁজি হয়— রাগ। কিন্তু ঈশ্বরের মাঝে রাগের ছিটেফোঁটাও ছিল না। কতশত বার তাকে রাগানোর
চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি!.একবার কালীপূজোয় ঈশ্বরকে বলেছিলাম, “আচ্ছা তোদের কালী ন্যাংটো থাকে ক্যান, বল তো?
তোরা কিছু করতে পারিস না? খুব বিশ্রী লাগে দেখতে!”.ঈশ্বর তখন হাসিমাখা সরল মুখে বলেছিল, “কী জানি কালীর গরম মনে হয় খুব বেশি।
কাপড়ে অ্যালার্জিও থাকতে পারে।”.ঈশ্বরের উত্তরে আমি হতভম্ব নাকি মুগ্ধ হয়েছিলাম এখন আর মনে নেই। তবে সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু।
একটা মলিন, কলার ছেঁড়া শার্ট গায়ে যে ছেলেটা প্রতিদিন ক্লাস করত— অথচ দিব্যি হাসিমুখ; তাকে ভালো-না-বেসে উপায় আছে?.
ঈশ্বর দেখতে অসুন্দর ছিল। কালো, চোয়ালভাঙা, রোগাপটকা শরীর; সামনের পাটির দাঁতগুলো এতটা উঁচু ছিল
যে— ঈশ্বর ভালো করে দুঠোঁট কখনওই এক করতে পারত না। ক্লাসের অনেকেই তাকে ‘দাঁতাল’ বলে খ্যাপানোর চেষ্টা করত।
তাতে ঈশ্বরের বয়েই গেছে! কে জানে, ওর অসুন্দর চেহারার ঘাটতি হয়তো অসাধারণ ব্যবহার দিয়ে পূরণ করতে চাইত।.
ঈশ্বর দারুণক্রিকেট খেলত। রোগাপটকা চেহারায় ব্যাটিং বোলিং অসাধারণ পার্ফমেন্স করত। ধীরেধীরে টের পেলাম ঈশ্বর আমার
বন্ধু থেকে হঠাৎ করেই বান্ধব হয়ে গেছে!.তখন সবেমাত্র নাইন পাশ করেছি। আমার ঠোঁটের ওপর ঘন লোমের রেখা পড়ছে, গালের
আনাচেকানাচে কালো রঙের ঘাসও গজিয়েছে। ততদিনে ঈশ্বরের ডাক নাম আমি জেনে গেছি। বাড়িতে ওকে কালু নামে ডাকে।
ঈশ্বরের চেয়ে কালুকেই বড় আপন ডাক মনে হতো। ঈশ্বরের মা-বাবার পর একমাত্র আমিই ওকে কালু নামে ডাকতাম।.
সেবার লক্ষ্মীপূজোর বিকেলে ঈশ্বর আমায় প্রথম ওর বাড়ি নিয়ে যায়। সেই প্রথম কোনো হিন্দু বাড়িতে আমার প্রবেশ। মকতবের
হুজুরের শাসানির ভয় আমার তখনও কাটেনি। হিন্দু বাড়িতে পা রাখলে যদি পাপ হয়! আমার খোদা কি আমায় ক্ষমা করবে?
খড়ের ছাউনি আর চটায় ঘেরা ঈশ্বরের ছোট ঘর। ঘরের উঠোনে তুলসি মঞ্চ। ঈশ্বরের মা গোবরে ঘরের পৈঠা লেপছিলেন।
উঠোনে পা দিতেই কাকিমা আঁচলে শরীর ঢেকে হাসিমুখে ছুটে এলেন। সেদিন কাকিমার গোবরে ডোবানো হাত দেখে ঘেন্নায়
আমার শরীর গুলিয়ে উঠেছিল। কাকিমা যখন পূজোর নাড়ু খেতে দিলেন— অভক্তিতে সে নাড়ু আমি ছুঁতেও পারিনি।
বাড়িময় গোবর আর অসুখ-অসুখ গন্ধ। ঈশ্বরের পরিবারের প্রতি সেদিন আমার করুণা হয়েছিল।তারপর কত দিন পার হলো।
আমি মাঝেমাঝে ঈশ্বরের বাড়ি যেতাম। আর প্রতিবার একরাশ করুণা নিয়ে ফিরতাম।.ওর একটা বোন ছিল। আমাদের চেয়ে
বছর পাঁচেকের বড়। নাম পার্বতী। কী সুন্দর নাম! অথচ বোবাকালা মেয়েটার কোমরের নিচের অংশটা পোলিও রোগীর মতন বাঁকানো।
কোন একটা এনজিও থেকে হুইল চেয়ার দিয়েছিল— ওটাতেই সারাক্ষণ বসে থাকত। পার্বতীর মুচি বাবা মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসতেন।
প্রায়ই দেখতাম পার্বতীর চুল আঁচড়ে বেণী করে দিচ্ছেন। দেখে বড় ভালো লাগত!.পার্বতী নিজেও সাজতে পারত। চোখে কাজল দিত, কপালে টিপ।
দেখে মনে হতো হুইল চেয়ারে এক বিরহী রাই বসে আছে। আঁটসাঁট ফ্রকে ওর বিশ বছরের উদ্ধত স্তন জাম্বুরা ফলের মতন তাকিয়ে থাকত সবসময়।
অথচ পার্বতীর চোখের কোণে জমা পিচুটি কিংবা ঠোঁটের কষ দেখে ঘেন্নায় কতবার গা গুলিয়ে উঠেছিল!তবুও জানি না কবে,
পার্বতীকে আমি ভালোবেসে ফেললাম। একটা প্রতিবন্ধী যুবতির সুন্দর স্তন নাকি গোটা পার্বতীকেই ভালোবাসতাম এখন আর মনে নেই।
শুধু মনে আছে, একবার নদীর ঘাটে বসে পার্বতীর জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে কেঁদেছিলাম। ওই অশ্রু পবিত্র ছিল কি না—
তা কেবল ফুলকুমার নদীই বলতে পারবে।সেইসব টালমাটাল দিনগুলোতে আড়চোখে যতবার পার্বতীর বুকের দিকে তাকিয়েছি—
ততবার হিসাব তুলতে গিয়ে হয়তো ক্বিরামন-কাতেবিনও হাঁপিয়ে গেছে।.ঈশ্বর আমায় প্রায় বলত, “জানিস আরিফ, দিদির কখনও বিয়ে হবে না।
গরীব ঘরের প্রতিবন্ধী মেয়ের কখনও বিয়ে হয় না। শুনেছি বিদেশে নাকি প্রতিবন্ধীদেরও বিয়ে হয়। আমি একদিন ঢাকা যাব,
ঢাকা গিয়ে অনেক টাকা আয় করব তারপর দিদিকে বিদেশে পাঠিয়ে দেব।”ঈশ্বরকে তখন বলতে ইচ্ছে হতো, ”কালু রে, চিন্তা করিস না!
দেখিস একদিন বড় হয়ে আমিই তোর বোনকে ভালোবাসব, বিয়ে করব।”.ক্বিরামন-কাতেবিন আমার খাতায় পাপ লিখবে বলে
সে কথা কালুকে কখনওই বলা হয়নি। তবুও প্রতিদিনের কল্পনায় আমি পার্বতীকে পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী রমনীর বেশে সাজাতাম।
তারপর এক বর্ষা পার হয়ে শীত এসে গেল।একদিন ভেজা কুয়াশার ভোরে ফুলকুমার নদীর তীরে আমি আর ঈশ্বর শপথ করেছিলাম—
জীবনের বাকি দিনগুলো আমরা একসাথে থাকব। আমি তখনও বলতে পারিনি, কালু রে, আমি পার্বতীকে ভালোবাসি।.দেখতে-দেখতে
মেট্রিক পরীক্ষা চলে এলো। বাবা আমার জন্য তিনটে টিচার রেখে দিলেন। ওদিকে চারপাশের পৃথিবীতে কত কী ঘটে গেল!
ঈশ্বরের বাবা ফর্মফিলাপের টাকা জোগাড় করতে পারেনি, পার্বতীও ভীষণ অসুস্থ— যমে মানুষ টানাটানি। অথচ আমি আদাজল
খেয়ে পড়ার টেবিলে ডুবে আছি। আমায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে, বড় মানুষ হতে হবে, ঈশ্বরকে সাহায্য করতে হবে।
একবার ভয়ে-ভয়ে আমার ব্যবসায়ী ধর্মপ্রাণ বাবাকে বলেছিলাম ঈশ্বরের ফর্মফিলাপের টাকা দিয়ে দিতে। বাবা রাজি হয়নি।.
“মালাউনের ব্যাটারা পাশ কইরলে আমগো কী? সব নেমোকহারাম, ট্যাকাপয়সা হইলে সব হিন্দুস্থান পাচার করবেইক…
“বাবা তার সুন্নতি দাড়িতে হাত বুলিয়ে তিক্তস্বরে এটুকুই বলেছিলেন। আমার আর দ্বিতীয়বার বলার সাহস হয়নি।.মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল।
আমার খুব ভালো পরীক্ষা হয়েছে। কার সাধ্যি আছে ফার্স্টক্লাস আটকায়? অথচ ঈশ্বর পরীক্ষায় বসতেই পারেনি।
আমার একমাত্র বান্ধব ঈশ্বর, কালু; যার সাথে সারাজীবন থাকব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, একদিন অভিমান করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল।
আমায় একটিবার জানায়ওনি! শুনেছি সে ঢাকায় কোন একটা গাড়ির হেলপার হয়েছে। আর আমি মেট্রিকে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছি।
বাবা পুরো রায়গঞ্জের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন।.একদিন লজ্জানত মুখ নিয়ে ঈশ্বরের বাড়িতে গেলাম। ঈশ্বর সেখানে থাকে না,
কিন্তু আমার পার্বতী তো আছে! কতদিন দেখা হয়নি তাকে!.কাকিমা সেদিনও গোবরের মুঠি বানাচ্ছিলেন। কাকা এগুলো দোকানে বিক্রি করেন।
জ্বালানি হিসাবে কিছু দাম পাওয়া যায়।আর পার্বতী! সে এখন আর হুইল চেয়ারে বসে না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে।
বিছানায় শুয়ে থাকতে-থাকতে ওর বেডশোর হয়ে গেছে। শরীরের আনাচেকানাচে চাকাচাকা ঘায়ে ছেয়ে গেছে। ঘরজুড়ে তীব্র মাংস পচা গন্ধ!
শরীরে কাপড় ছোঁয়ালেই কাপড়ে মাংস লেগে যায়— তাই এক টুকরো কাপড়ে কোমরের নিচটুকু লজ্জাস্থান ঢাকা। যেন বিছানায় দেবী কালি শুয়ে আছে।
নিথর কষ্টিপাথরের দেবী, যাঁর কাপড়ে অ্যালার্জি আছে!.পার্বতী! আমার পার্বতী কী ভয়ানক কষ্টটাই না পাচ্ছে! আড়চোখে যে স্তনজোড়া
দেখে নিজেকে পাপী করেছিলাম, সেই জাম্বুরার মতন স্তন আজ আমার দুচোখের সামনে উন্মুক্ত! একজোড়া পচে যাওয়া বাতাবি লেবুর মতন স্তন,
যার বৃন্তের চারপাশে ঘা দেখে আজ আর আমার ঘেন্না হয়নি! শুধু এক সমুদ্র অশ্রু গলার কাছে দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল কে যেন আমার হৃৎপিণ্ডটা পাঁজর থেকে খুবলে নিচ্ছে! আমি কেবল হাত বাড়িয়ে পার্বতীর স্তন স্পর্শ করেছিলাম।
স্যাঁতস্যাঁতে আঠালো স্তন, অথচ কী উষ্ণ! শ্বাসের সাথে সাথে ফুলে ফুলে উঠছে!.আমার ক্বিরামন-কাতেবিন সাক্ষী,
সেদিন যদি খোদা আমার মেট্রিক পাশের সার্টিফিকেট কিংবা আমার গোটা প্রাণটার বিনিময়ে পার্বতীকে সুস্থ করে দিত,
আমি তাতেও হাসিমুখে রাজি হয়ে যেতাম। কিন্তু আমার খোদা রহম করেনি। পার্বতী তো অন্য দেবতার পূজারী ছিল।
আমার স্রষ্টা কেন তাকে দয়া করবে?উল্টো ক্বিরামন-কাতেবিন আমার খাতায় হয়তো অনেকগুলো পাপ লিখে রেখেছে।.
আমি চাইনি পার্বতী চোখ মেলে আমার কান্নাভেজা চোখ দেখুক— তাই ঘর ছেড়ে ছুটিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। নদীর সাঁকো
পার হতেই টের পেলাম কাকিমা পিছুপিছু ছুটে আসছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম, আমার বান্ধবের ঘর ছেড়ে পালাচ্ছি, এই হয়তো শেষ,
আর ফিরে আসা হবে না। কাকিমা হাঁপাতে-হাঁপাতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তার হাত তখন পরিষ্কার, গোবরের ছাপ নেই একটুও!
কাছুমাছু মুখে আঁচলের তলা থেকে একটা লাল আপেল বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ”পার্বুকে দেইখতে ম্যালা মাইনষে আসে,
কতেক ফল-টল আনে। তুমি এইলে কিন্তুক কিছু খাতি দিবার পারি নাই, এই আপেলডা তুমি খেইয়ো। ঘরে তো ম্যালা গন্ধ তাই…”
.আমি কাঁপাকাঁপা হাতে আপেলটা নিয়ে এক ছুটে পালিয়ে এসেছিলাম। কাকিমা শুধু পেছন থেকে একবার বললেন, “মাঝেমইধ্যে এইসো বাজান,
তোমায় দেইখলে কালুর কতা…”.বাকিটুকু আমার আর শোনা হয়নি। আমি শুধু ছুটছিলাম, দিগভ্রান্তর মতন। মকতবের হুজুর আমায় বলেছিল,
ঈমান না আনলে সবাইকে জাহান্নামে পোড়ানো হবে। আচ্ছা আমার পার্বতীকেও কি পোড়ানো হবে? বেচারি তো কথাও বলতে পারে না।
ওর কি দোষ? দুনিয়ায় ও তো কেবল কষ্টই পেয়েছে! ওকে কি আমার খোদা ক্ষমা করবেন না?.ঈশ্বর তুই ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেই গেছিস।
শুধু আমায় বড় যন্ত্রণায় রেখে গেছিস রে! তুই কি জানিস, তুই চলে যাবার পর এই বিশাল দুনিয়ায় আমার আর একটাও বন্ধু হয়নি!
পার্বতীর মতন আর কাউকে কখনওই ভালোবাসতে পারিনি! ওরকম ব্যাকুল হয়ে প্রেমিকার স্তনও কখনও স্পর্শ করিনি!
মানুষ হবার বড় কষ্ট রে, বড় কষ্ট! জানিস এখনও মাঝেমাঝে রাস্তায়, ফুটপাতে তোকে খুঁজি?তুই হয়তো ভুলেই গেছিস,
আমাদের সারাজীবন একসাথে থাকবার কথা ছিল। স্বার্থপর রে তুই, বড় বেশি স্বার্থপর! দিব্যি সব কথা ভুলে গেলি।
আর আমায় রেখে গেলি রক্ত মাংসের কিছু হোমোসেপিয়েন্সের ভিড়ে। যেখানে কেবল হিন্দু আছে, মোছলমান আছে, মানুষ নেই একজনও,
বান্ধবও হয় না কেউ! ঈশ্বর রে, বলতে পারিস, কত জন্মের পাপের দায়ে মানব জন্ম পেয়েছিলাম?