মুছা মিয়া এক মনে পাট ক্ষেতের আগাছা সাফ করছে। মাথার উপর সূর্য । কাঠ ফাটা রোদ । বাতাসে জলীয় বাষ্প নেই বললেই চলে। তবু তাঁর ক্লান্তি নেই। আসলে ক্লান্তি শব্দটাই তাঁর অভিধানে নেই। ছোট ছোট পাটের চারা গুলো যেন হাসছে। মৃদু দখিনা বাতাসে ক্ষেতের উপর যেন সাগরের ঢেউ। আর সেই ঢেউয়ের আঁচড় আঁচড়ে পড়ছে মুসা মিয়ার বুকের ভিতর। মুছা মিয়া জানে, পাট আর সোনালি আঁশ নেই। তবু পাটের চাষ ছাড়তে পারে না। অন্তত: সারা বছরের লাকড়ির চাহিদার কথা ভেবে। একসময় হাওরে প্রচুর বড় বড় ঘাস হত। শুষ্ক মৌসুমে সেগুলো কেটে এনে লাকড়ি বানানো যেত। তাছাড়া গোয়াল ভরা গরু ছিল। গোবর শুকিয়েও রান্না করা যেত। গাছের শুকনো পাতাও ভালই সাপোর্ট দিত। আজ আর সেদিন নেই। মুছা মিয়ার বুক ছিঁড়ে নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘ শ্বাস দ্রুত বেরিয়ে যায়।
মুছা মিয়া সজ্জন মানুষ। সহজ সরল। ধর্ম পরায়ণ। পাঁচ ওয়াক্ত নামায কালাম পড়েন। লেখাপড়া জানেন না। ছোট বেলায় স্কুলে গিয়েছিলেন কিনা মনে নেই। অবশ্য পাড়ার ছেলে ছোকরাদের আগ্রহে কয়েকদিন নৈশ বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সে সুবাদে নাম দস্তখত করতে পারেন। বয়স কত সঠিক জানেন না। শুধু মনে আছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের কথা। তখন তিনি তাগড়া জোয়ান। গায়ে অসুরের মত শক্তি। একবার এক পাক সেনাকে খালি হাতেই নাকাল করেছিলেন। কমান্ডার এ আর সাইদ তাঁর পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, সাবাস, বাপের বেটা, সাবাস।
আজ দেশ স্বাধীন । বিজয়ের আনন্দ এখনও মুছা মিয়ার শরীরে শিহরণ জাগায় । সেদিনের কথা মনে হলেই মুছা মিয়া যেন বদলে যান । গায়ে অন্যরকম শক্তি অনুভব করেন । সে শক্তির তুলনা বুঝি ত্রিভুবনে নেই !
মুছা মিয়ার সংসার ছোট নয় ; আবার খুব বড়ও নয় । মজার ব্যাপার হল , প্রথম স্ত্রী আদুরীর সন্তান না হওয়ায় ; আদুরী নিজেই তার চাচাত বোন কমলার সাথে মুছা মিয়ার বিয়ে দেন । তারপর কমলার যেদিন মেয়ে হল ; সেদিনই আদুরীরও ছেলে হল । একদিনে দুই সন্তানের পিতা ! গাঁয়ে এ নিয়ে হাসাহাসির অন্ত ছিল না । অবশ্য মুছা মিয়ার মনে সেদিন আনন্দের সীমা ছিল না । আদুরী এবং কমলার মাঝে খুবই সদ্ভাব । সাধারণত দুই সতীনের ঘরে যতটা অশান্তি হওয়ার কথা ; তার ছিটে ফোঁটাও মুছা মিয়ার সংসারে ছিল না । এখনও নেই । প্রথম তরফের তিন ছেলে । আর দ্বিতীয় তরফের তিন মেয়ে । ছেলেরা সবাই লেখাপড়া জানে । তবে লোকে বলে, সবার ছোট ছেলেটা নাকি অসাধারণ মেধাবী । আর মেয়ে গুলো পড়াশুনায় বেশি দুর এগুতে পারেনি । তবে মুছা মিয়ার চেষ্টার কোন ঘাটতি ছিল না ।
দূরের মসজিদে মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠ ভেসে আসে । মুছা মিয়ার মন নামাজের জন্য আকুল হয়ে উঠে । এখনও কাজের অনেক বাকি । সংসারের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে কামলা নেয়নি । উৎপাদন খরচ অনেক বেশি । পোষায় না । মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেই কোন রকমে চালিয়ে নেয় । ছেলেরা মাঝে মাঝে সাহায্য করে । দুপুরের খাবার সাথে নিয়েই আসে । মনে মনে ঠিক করে, নামাজ শেষে ক্ষেতের উত্তর দিকেই বরই গাছের নিচে বসে ভাত খাবে । তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করবে । মুছা মিয়া খাবারের পুটলি আর নিড়ানিটা হাতে নিয়ে উঠে পড়ে । ওযু করার জন্য আবার একটু দূরে যেতে হবে ।
নামাজ এবং খাওয়া দাওয়া সেরে ক্লান্ত অবসন্ন মুছা মিয়া বরই গাছের শীতল ছায়ায় একটু গা এলিয়ে দেয় । ঝিরি ঝিরি বাতাস বইছে । কয়েকটি পাখির কিচির মিচির শব্দ শুনা যাচ্ছে । কিছু দূরে হাওরের চারণ ভূমিতে কয়েকটি রাখাল ছেলে ডাংগুলি খেলছে । মুছা মিয়ার দু চোখে হঠাত রাজ্যের ঘুম নেমে আসে ।
কথায় আছে, ঘুম আসলেই স্বপ্ন আসে । স্বপ্ন আসলেই তুমি আস । ঘুম নাই, স্বপ্নও নাই ; তুমিও নাই । মুছা মিয়া ঘুমের মধ্যে একটি স্বপ্ন দেখলেন । পবিত্র কাবা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ করছেন । সাফা ও মারওয়া সায়ী করছেন । অঞ্জলি ভরে যমযমের পানি পান করছেন । তাঁর চোখে মুখে স্বর্গীয় জ্যোতি । মুছা মিয়ার মন চলে যায় সোনার মক্কা – মদিনায় । তাঁর আর কিছুই ভাল লাগছে না । কাজ -কর্ম, সংসার, টাকা – পয়সা, স্ত্রী – সন্তান সব কিছুকে অর্থহীন মনে হয় । আজ আর কাজ করার মত মানসিকতা নেই । মুছা মিয়া বাড়ির দিকে পা বাড়ায় । আর একটু পরে পরে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় ।
০২
মুছা মিয়ার বড় ছেলে আবুল মিয়া । শিক্ষিত । শান্ত ও ভদ্র । তার মনে কষ্টের অন্ত নেই । আজ যদি তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট থাকত ! একটি চাকুরীর জন্য তার এত পথ মাড়াতে হত না । একদিন আবুল মিয়া বাবাকে বলল ,
বাবা, সার্টিফিকেট নিলেন না কেন ?
মুছা মিয়া ভাব লেশহীন । কোন জবাব দেয় না ।
আবুল মিয়া আবার জিজ্ঞেস করে, বাবা, সার্টিফিকেট নিলেন না কেন ?
উত্তরে মুছা মিয়া বলল, সেইটা আরার কি জিনিস ? সেইটা দিয়া কি অইব ?
কেন, সরকার আপনেরে ভাতা দিব ।
ভাতা নেওয়ার জন্য তো দেশ স্বাধীন করি নাই । মুছা মিয়ার স্পষ্ট উত্তর ।
আবুল মিয়া আমতা আমতা করে আবার বলল, আমার চাকরি পাইতে সহজ হইত । মুক্তিযোদ্ধার কোটা পাইতাম ।
মুছা মিয়া বলে, কি পড়াশুনা করলা মিয়া ! চাকরির জন্য কোটা ধরবার চাও ।
এই উত্তর আবুল মিয়া বুঝে । আর কথা বাড়ায় না । চলে যেতে চায় ।
মুছা মিয়া বলে, শুন মিয়া ! তোমার লগে আমার একটা কথা কইবার আছে ।
কি কথা ?
আমি এইবার হজ্বে যাবার চাই । তোমার কি মতামত ?
আবুল মিয়া একটু চিন্তায় পড়ে যায় । কষ্টের সংসার । হজ্বে যাওয়ার মত টাকা কি তাদের আছে ? কিন্তু বাবাকে কোন মতেই না বলা যাবে না । বাবা বড় আঘাত পাবে । আর সে আঘাত লাগবে কাবার ঘরে । এই মানুষটি ফেরেশতার মতন । সারা জীবন শুধু কষ্ট করেছেন । পরিবারের কারো গায়ে এত টুকু আঁচড় লাগতে দেননি । আবুল মিয়া আর ভাবতে পারে না । দু চোখ জলে ভিজে উঠে । বলে,
বাবা, আমার কোন আপত্তি নেই । কিন্তু এত টাকার জোগাড় কিভাবে হবে !
ছেলের মনের অবস্থা মুছা মিয়া বুঝতে পারে । বলে, টাকা নিয়ে তুমি কোন চিন্তা করবা না বাপ । আল্লাহর কাছে যাওনের নিয়ত করছি । টাকার ব্যবস্থা আল্লাহই করব ।
এ সময় ঘরের এক কোনে একটা টিক টিকি শব্দ করে উঠে । মুছা মিয়ার মনে হয়, সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে । এ সময় রান্নাঘর থেকে বড় বউ আদুরীর গলা শুনা যায় ।
বাপ বেটা মিইল্যা কি কথা অইতাছে শুনি ? বলি, শুক্রবারের কথা কি আপনেরা ভুইল্যা গেছেন ? নামাজে যাওন লাগব না ?
বড় বউয়ের কথায় মুছা মিয়ার মন খুশীতে ভরে উঠে । বলে , ভুলি নাই গো বড় বউ, ভুলি নাই ।
আর আবুলের দিকে তাকিয়ে বলে চল বাপ, গতর ধুইবার যাই ।
আবুল প্রিয় মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে বাবাকে অনুসরণ করে । এদিকে আজ পাড়ার মাঠে একটি ফুটবল খেলা । এলাকার চেয়ারম্যান সাহেব খেলা দেখতে আসবেন ।
আবুলের মুখ কিছুটা চিন্তা ক্লিষ্ট । সে এই সংসারের বড় ছেলে । তারও তো কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ আছে । আজ যদি সে চাকরি করত ! বাবার হাতে তুলে দিতে পারত কিছু টাকা । বাবা খুশী হতেন ; সেই সাথে খুশী হতেন আল্লাহ । কিন্তু আজ তার কিছুই করার নেই । আবুলের নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় ।
০৩
সারা গ্রামে সাড়া পড়ে গেছে । মুক্তিযোদ্ধা মুছা মিয়া এবার হজ্বে যাচ্ছেন । গ্রামবাসী বেজায় খুশী । তাঁর মত সাদা মনের মানুষ হজ্বে যাবেন না তো কে যাবেন ! তিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন । সংসারের জন্য নিজের সুখ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়েছেন । মানুষের উপকার করেন । জীবনে কাউকে কখনও কালা মুখ করেননি । বিপদে আপদে তিনি সবার পাশে থেকেছেন । ছেলে মেয়েদের মানুষের মত মানুষ করেছেন । এই বলে সারা গাঁয়ের মানুষ ধন্য ধন্য করতে লাগল ।
এদিকে মুছা মিয়ার ঘুম নেই । হজ্বে যাব বললেই তো আর হজ্বে যাওয়া যায় না । কত টাকা পয়সা লাগব ! জমি জিরাত কিছু বিক্রি করতে অইব । আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে অইব । সবার কাছে মাফ চাইতে অইব । এত দূরের পথ । জীবন মরণের কথা কওন যায় না ।
কার সাথে যাবে, কিভাবে যাবে, কিভাবে আসবে —– ইত্যাদি নানা রকম চিন্তা মুছা মিয়াকে সারা ক্ষণ ব্যাকুল করে তুলছে । তাছাড়া মরিয়ম বিবির এখনও বিয়ে বাকি ।
মরিয়ম মুছা মিয়ার ছোট মেয়ে । সর্ব কনিষ্ঠ। অত্যন্ত দস্যি প্রকৃতির । ছোট বেলায় একবার রাগ করে গাছে উঠেছিল । আর নামে না । সারা রাত গাছেই ছিল । কেউ গাছে উঠতে চাইলেই বলত , এই আমি লাফ দিলাম ! পাড়া প্রতিবেশী সকলে মিলে মাছ ধরার জাল পেতে সারারাত দাঁড়িয়ে ছিল !
ছোট বউ কমলা হজ্বে যাওয়ার কথা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । এই মেয়েটার মন খুব নরম । একদম কাদা মাটির মতন । বাসর ঘরে মুছা মিয়া কৃত্রিম একটু রাগ করতেই সে কী কাণ্ড ! বলে কিনা আমার লগে রাগ করলে অহনই আমি বাপের বাড়ি চইল্যা যামু — এই বলে মুছা মিয়ার পায়ে পড়ে সে কি কান্না । সেদিন থেকে কমলার উপর মুছা মিয়ার খুব মায়া পড়ে গেছিল । আসলে মুছা মিয়ার বউ ভাগ্যের কোন তুলনা নেই । আদুরী – কমলা মিলে মিশে মুছা মিয়ার সংসারটিকে যেন এক খণ্ড স্বর্গে রূপান্তরিত করেছে । আর সে স্বর্গের অধীশ্বর মুছা মিয়া ।
০৪
হজ্বে যাওনের সমস্ত আয়োজন শেষ । মোটামুটি ভাল দামেই জমি বিক্রি করা হয়েছে । পাড়ার টুনু মিয়ার চাকরি জীবি ছেলে রফিক মিয়ার সাথে মরিয়মের বিয়েটাও ভালই ভালই হয়ে গেছে । হঠাত করে একজন ভাল মতাওয়াল্লি পাওয়া গেছে । নাম মাওলানা আবু সাঈদ । কী সুন্দর চেহারা ! মনে হয় যেন নূরের ঝলক ! ইয়া লম্বা দাঁড়ি । উঁচু বাঁশির মত নাক । দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হয় । প্রতিবছরই অনেক মানুষকে হজ্ব করিয়ে আনেন । তিনি বলেছেন , অন্যদের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিই । আপনি মুক্তিযোদ্ধা । ভাল মানুষ । আপনার কাছ থেকে তিন লাখ নিব না । আপনি দুই লাখ দিলেই চলবে । আপনার পাসপোর্ট, ভিসা, কুরবানি, বিমান ভাড়া ও খাওয়া দাওয়া সব আমার । আমি নিজে এসে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাব । আপনার কোন চিন্তা নাই ।
মুছা মিয়া মাওলানা সাহেবের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যায় । এত ভাল মানুষ ! মনে মনে মহান আল্লার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় । কপাল ভাল না হলে এমন মানুষ পাওয়া যায় না !
০৫
সারা গ্রামে উৎসবের আমেজ । হবেই বা না কেন ? মুছা মিয়াই এই অচিন্ত্যপুর গ্রামের প্রথম হজ্ব যাত্রী । এর আগে এই গ্রাম থেকে কেউ কখনও হজ্বে যাননি । আজ মুছা মিয়া মহান আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন । আকাশ খুব পরিষ্কার । সকাল থেকেই বাড়িতে মানুষের ভিড় লেগে আছে । সকলেই মুছা মিয়ার সাথে মসাফা করছেন । দোয়া চাইছেন । মুছা মিয়া বিনয়ের সহিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন ।
মুছা মিয়া পদব্রজে রওনা হলেন । সাথে হাজার হাজার মানুষ । নারায়ে তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত । গন্তব্য গচিহাটা রেল ষ্টেশন । সেখান থেকে আন্তঃনগর এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেসে ঢাকা বিমান বন্দর । তারপর হাজী ক্যাম্প । সেখান থেকে পরদিন সোনার মদিনার উদ্দেশ্যে বিমানে চড়বেন । সমস্ত টাকা মাওলানা আবু সাঈদ সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়েছেন ।
দুপুর বার ঘটিকায় ট্রেন গচিহাটা ষ্টেশন ছাড়ল । মুছা মিয়া জীবনে কখনও ট্রেনে উঠেননি । ট্রেন ছুটে চলছে । মুছা মিয়ার মনে হল, ট্রেনের সাথে সাথে আকাশের সাদা মেঘ গুলো যেন পাল্লা দিয়ে চলছে । ঘর বাড়ি ও রাস্তার দু পাশের গাছের সারি যেন দুরন্ত বালকের মত দৌড়াচ্ছে । মুছা মিয়ার প্রথমে একটু ভয় ভয় লাগলেও এখন আর ভয় করছে না । মাওলানা সাহেব দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন । ভয়ের সময় ইন্না লিল্লাহে অইন্না ইলাইহে রাজীউন পড়তে হয় । মুছা মিয়া এক মনে দোয়া পড়ছেন ।
আবুল মিয়া বাবার সাথে এসেছে । বড় ছেলে বলে কথা ! তার উপর অনেক দায়িত্ব । বাবার অবর্তমানে সে – ই সংসারের কর্তা । তাছাড়া বাবাকে সে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালবাসে । মুছা মিয়াও তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন । যাওনের আগে মুছা মিয়া তাঁর প্রাণাধিক সন্তান আবুল মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল ,
বাপ, তোমার জন্য হজ্ব থেকে কী আনব ?
আবুল মিয়া কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেছিল — কিছু আনতে হবে না বাবা । শুধু আপনি ভাল ভাবে ফিরে আসলেই আমার হবে । আমি এর বেশি আর কিছুই চাই না । সে কথা শুনে মুছা মিয়া ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন ।
০৬
বিকেল পাঁচটা । ট্রেন বিমান বন্দর রেল স্টেশনে এসে থেমেছে । যাত্রীরা যে যার মত করে নামছে । মাওলানা সাহেব মুছা মিয়া ও আবুল মিয়াকে নিয়ে নেমে পড়লেন । আবুল মিয়া বাবাকে বিমানবন্দর চিনিয়ে দিলেন । ঢাকা শহরের অপরূপ রূপ দেখে মুছা মিয়া অবাক হয়ে গেলেন । এত গাড়ী এক সাথে তিনি জীবনে কখনও দেখেননি । বিমান বন্দর রোডের গাছ গুলোকে দেখে মুছা মিয়ার সৌদি আরবের খেজুর গাছের কথা মনে পড়তে লাগলো ।
অবশেষে তারা হাজী ক্যাম্পে এসে পৌঁছলেন । হাজারে হাজারে হজ্ব যাত্রীর সমাগমে এক উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে । স্বর্গীয় আবহ বিরাজ করছে । মুছা মিয়ার মনের সমস্ত দুঃচিন্তা দূর হয়ে গেল । তিনি এক মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন । লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক , লা শারিকা লাব্বাইক —— ।
মাওলানা সাহেব মুছা মিয়া ও তাঁর ছেলে আবুল মিয়াকে বললেন, আপনারা এইখানে চেয়ারে বসুন । আমি ভিসা, পাসপোর্ট ইত্যাদি কাগজ পত্র ঠিক করে নিয়ে আসি । যাব আর আসব । বেশি দেরি হবে না । এই বলে মাওলানা সাহেব চলে গেলেন । মুছা মিয়া ও আবুল মিয়া তার গমন পথের দিকে থাকিয়ে রইলেন ।
রাত বারটা বাজে । মাওলানা সাহেব সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না । বাপ বেটা দু জনেই অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন । এদিক সেদিক খুঁজাখুঁজি করছেন । না, মাওলানা সাহেবের কোন পাত্তাই নেই । একদম লা পাত্তা । ক্ষুধায় একেক জনের পেট জ্বলছে । সাথে সামান্য ক টা টাকা ।
আবুল শিক্ষিত ছেলে । তার কেমন জানি সন্দেহ হতে লাগলো । সে বিষয়টি একজনের সাথে আলাপ করল । তিনি তাকে অনুসন্ধান কক্ষে খোঁজ নিতে বললেন । আবুল মিয়া অনুসন্ধান কক্ষে গিয়ে যা জানতে পারল — তাতে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল । তার বাবার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে । কিন্তু এই লোকটি প্রতারণা করতে পারে — এ কথা আবুল মিয়ার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে । পূর্ব আকাশে ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে । যে কোন সময় আকাশের চোখে জল নামবে । কিন্তু সেই জল কি পারবে আবুল মিয়ার মনের আগুন নিবাতে ?
০৭
আবুল মিয়া যতটা ভেবে ছিল তার বাবা মুছা মিয়া ততটা আপসেট হননি । অসম্ভব শক্ত নার্ভ লোকটার । তিনি মুখে কিছুই বললেন না । শুধু কিছুক্ষণ পরে পরে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছেন ।
আবুল মিয়া রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় মাওলানারে বাপ তুলে গালি দিল । মুছা মিয়া অত্যন্ত শান্ত ও কোমল স্বরে ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন ,
বাপরে, মাওলানারে গালি দিলে কি অইব ! আল্লায় আমার কপালে হজ্ব লেখেন নাই, সেইটাই আসল কথা । চল বাপ, বাড়ি নিয়া চল ।
আবুল মিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ।।