আরিফা সেদিন ফুফু’র বাড়ি যাবার জন্য খুব কাঁদছিলো।
সে কি কান্না! রীতিমত মাটিতে গড়াগড়ি।
ফুফু খুব ভালোবাসে
তাকে। কয়দিন আগে ফুফু নাইওর এসে গতদিনই মাত্র গেলো। ফুফু নেওটা মেয়েটির আবার ফুফুকে চায়।
আঞ্জুমান খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে কিভাবে, কাকে দিয়ে পাঠায়! বাসায় পুরুষ বলতে মেয়ের বাপ, সে তো সদরে। মেয়েও বড় জিদ্দি, কিছুতেই বেড়ানোর কথা ভুলেনা।
শেষে পাড়ার চাচাতো দেবর আকবর এসে বলে, “ভাবি, কাপড় পরিয়ে দাও, আমি দিয়ে আসি।”
আরিফার দুই আড়াই বছরের বড় শরিফা, মা সাথে তাকেও যেতে বলেন। সে রাজি হয়না। সে তার পুতুল সাজাতে ব্যস্ত, ফুফু’র বাড়ি গিয়ে কাজ নাই।
আকবরের বয়স প্রায় কুড়ি হবে। আঞ্জুমানের তিন বছরের ছোট।
আটবছর আগে আঞ্জুমান যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে, তখন সে ছিলো বারো বছরের কিশোর। আঞ্জুমানের খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায় তখন। মুখে ভাবি ডাকলেও, মাথার কাপড় টেনে ফেলে দৌড় দেয়া, গাল টেনে দেয়া এসব ছোটমানুষি মশকারা এখনো ভুলেনি আকবর। ঘরের ছোটখাটো কাজ, দোকানে যাওয়া, বাজার করা তাও করে দেয় কখনো।
এম্নিতে কোথাও কোনো কাজ করেনা সে, টুঁ টুঁ করে ঘুরে বেড়ানোই শুধু তার কাজ। বেশি হলে তার বাপের সাথে চাষবাসে সাহায্য করে কখনো, সেকাজও তার পছন্দ নয়।
ক্ষেত খামার করা ঘরের ছেলে, তরি তরকারি দিয়ে দুইবেলা খেতে পায় পেটভরে, আর কোনো টেনশন নাই।
তো সেদিন আঞ্জুমান মেয়ের হাত পা ধুয়ে, গায়ের ফ্রক বদলিয়ে আরেকটা জামা পরিয়ে আকবরের সাথে পাঠিয়ে দেয়। যাবার সময় দুইটা টাকাও গুঁজে দেয় আকবরের পকেটে, নৌকা করে পাড় হতে লাগবে।
আরিফা ফুফুকে পেয়ে খুব খুশি। পাড়ার ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খেলায় মেতে উঠে সে। বিকেল হতে সে বাড়ি আসার জন্য ছটফট করতে থাকে। দাদি ছাড়া রাতে কখনো ঘুমায়নি । দাদি তাকে জড়িয়ে ধরে কিচ্ছা বলে বলে ঘুম না পাড়ালে, সে কিভাবে ঘুমুবে!
আকবরও সাথে আছে ওখানে।
হঠাৎ আকবর আরিফাকে ঝোপ দেখে ওখানে সাথে যেতে বলে। নতুন কোনো খেলা ভেবে আরিফা নিশ্চিন্তে পেছন পেছন দৌড়ে যায়। আকবর তো বলতে গেলে ঘরের মানুষ।
আকবরের মনে কি আসে কি জানি, হঠাৎ আরিফাকে কোলে নিয়ে প্যান্টের ভেতর যেই হাত দেয়, আরিফা চিল্লানি দিয়ে উঠে।
আকবর ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। আরিফা এভাবে চিল্লাবে বুঝতে পারেনি সে। ব্যাপারটা ভুলে যাবার জন্য আরিফাকে দোকান থেকে আচার কিনে খাওয়াতে চায়। কিন্তু আরিফা নাছোড়বান্দা, আকবরের কোনো কথা সে আর শুনবেনা, এখনই বাসায় যাবে সে। অগত্যা আরিফা’র ফুফুকে বলে তারা বাড়ি চলে আসে।
ভাগ্যিস, আরিফা আসার আগে ফুফুকে কান্নাকাটি’র কারণ বলে নাই। আকবর নিশ্চিন্ত বোধ করে।
আরিফা ঘরে এসেই কাঁদতে কাঁদতে দাদিকে বলে, “আকবর চাচা বেয়াদপ, প্যান্টের ভেতর হাত ঢুকিয়েছে। তুমি এখনই তাকে মারবে।”
দাদি তার মুখ চেপে ধরে।
“এসব বলতে নেই নাতিন, চুপ কর চুপ কর। কসম খা, আর কাউকে বলবিনা।”
“কেন কসম খাবো?”
“এসব গুনাহর কথা।” দাদি বলেন।
“আকবর চাচারে বকবেনা, মারবেনা?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, মারবো, তার মাকে কালই বলে দেবো। তুই কাউকে বলিসনা।”
দাদি আরিফা’র ছোট্ট হাত তার মাথায় ছোঁয়ায়।
“কসম বল, কাউকে বলবিনা, বললেই আমি মরে যাবো কিন্তু।”
আরিফা’র মনে অনেক রাগ জমে। আকবর চাচা’র কথা আর কাউকে বললেই দাদি মরে যাবে, এ কেমনতর কথা! এরপরেও প্রিয় দাদি’র কথা ফেলতে পারেনা সে।
কাউকেই বলেনা সে কথা। কিন্তু ছোট্ট আরিফা আকবর বাসায় আসলে চোখমুখ শক্ত করে রাখে। মায়ের কাছে জানতে চায়,
“আকবর চাচা আমাদের বাসায় আসে কেনো? মানা করবে যেন আর না আসে।”
মা অবাক হোন,
এই পিচ্চি মেয়ে বেয়াদপের মতো কি বলে!
মা তাকে ধমক দেন,
“তোমার আকবর চাচা কি এই ঘরে নতুন আসছে? সে তো তোমার চাচা, এসব কি বলো? আর কখনো পঁচা কথা বলবেনা। তোমার চাচা কি ভাববে, তোমাদের কতো ভালোবাসে, আদর করে।”
“আমি তার আদর চাইনা।”
আরিফা দুই তিনদিন আকবরকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আঞ্জুমান, স্বামীকে বলে দেয়।
“কিরে মা, তোমার আকবর চাচা আসলে তুমি রাগ করো কেনো?”
বাপ জানতে চায়, আরিফার কাছে।
“চাচাকে ভালো লাগেনা।”
“সে কি কখনো তোমাকে বকেছে, মেরেছে?”
“না।” আরিফা জবাব দেয়।
“তাহলে?”
“এমনিই তাকে ভালো লাগেনা আমার।”
“শোন আরিফা, এসব আর যেন না শুনি, এরপর আমি কিন্তু তোমাকে খুব মারবো। মনে থাকে যেন।”
আরিফা চুপ করে থাকে। মনে মনে সবার উপর তার খুব রাগ লাগে। মায়ের উপর, বাবার উপর এমনকি দাদি’র উপরও! দাদি নিশ্চয়ই চাচার মাকে কিছুই বলেনি। নইলে পঁচা মানুষটা এরপরেও বাসায় আসে কিভাবে?
আর দাদি কসমও দিলো। কসম না দিলে আজ বাবাকে বলে দিতে পারতো। আকবর চাচা যা করেছে, তা নিশ্চয় পঁচা কাজ। বাবা অবশ্যই বকতো তাকে। হয়তো মারতোও।
মা সবসময় বলেছে, কখনোই ছোট বড়, ছেলেমেয়ে কারো সামনেই যেন প্যান্ট খুলে পেশাব করতে বসে না যায় তারা, দুইবোন। খুবই শরমের কথা। আর আকবর চাচা কিনা….
আকবর চাচা ঘরে আসলেই আরিফা তাকে পাহারা দিয়ে রাখে। বড়বোন শরিফাকে চোখেচোখে রাখে, যাতে চাচা, তার আশেপাশে আসতে না পারে।মাকেও চোখেচোখে রাখে, যাতে চাচা মাকে কোনো উছিলায় স্পর্শ না করে। কখনো গাল টেনে দিতে মায়ের কাছে গেলে, সে মাকে কোন একটা কাজ দেয়।
“মা এদিকে আসো, পানি নিতে পারিনা বা খিদে লাগছে মা, আমাকে ভাত দাও। ”
এমন কিছু বলে মাকে আকবরের কাছাকাছি থেকে সরিয়ে নেয়।
পরে মায়ের কাছে জানতে চায়,
“চাচা তোমার মাথার কাপড় টান দেয় কেনো?”
এ কেমন কথা! ও আমার দেবর না? মশকরা করে। দেবর মানেই তো ছোট ভাই, জানোনা?”
আরিফার এরপরেও ভালো লাগেনা।
পাঁচ বছরের শিশু হলেও আরিফা যেন ঐদিনের পর থেকে অনেকবেশি বুঝদার আর বড় হয়ে গেছে।
সময় গড়িয়ে যায়। আরিফাও আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। কিন্তু সেই স্মৃতি সে ভুলতে পারেনা। নিজের সাথে সাথে শরিফা আর মাকেও সে ঐ কুত্তা থেকে বাঁচাবে এমনই প্রতিজ্ঞা তার। মা টা বেশি সহজ সরল কিছুই বুঝেনা।
একসময় আকবরের জন্য বউ আনা হয়। বছর পেরুতেই তার এক ছেলের জন্ম হয়।
ঐ বাচ্চা দেখে পুরো বাড়ির সবার মন খারাপ হয়ে যায়। শারীরিক প্রতিবন্ধী এক শিশুর জন্ম দেয় তার বউ!
কিশোরী আরিফা’র একটু কষ্ট লাগলেও মনে মনে কি সে খুশি হয়না, তাকে দু:সহ এক স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই আকবর চাচা’র জন্যই তো।
পরের বছর আরেকটা প্রতিবন্ধী সন্তান! এভাবে তিন তিনটা অপূর্ণ সন্তান জন্ম দিয়ে আকবর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে, আর্থিকভাবেও সচ্ছল নয় সে।
এদিকে শরিফার বিয়ে হয়ে যায়। আরিফারও একসময় বিয়ের কথাবার্তা হয়, বিয়েও হয়ে যায়। তার স্বামী তাকে বিদেশে নিয়ে যায়, রাজকপাল তার।
পাঁচ বছর পর দুই বাচ্চা নিয়ে আরিফা দেশে আসে। সাথে স্বামী’র আসার কথা থাকলেও শেষপর্যন্ত ছুটি পায়না সে।
আরিফার বাপ বড় একটা সাত সিটের কার ভাড়া করে মেয়েকে আনতে যায়।
আরিফা সন্তানদের নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, দেখে ওখানে আকবর বসা!
পুরনো স্মৃতি মাথায় এসে ভর করে, অনেকদিন ভুলে গিয়েছিলো সে।
বাপ একা না এসে সাথে একজন সাথী নিয়ে এসেছে।
আরিফা বাপকে একপাশে ডেকে নিয়ে যায়। বলে,
“বাবা, আকবর চাচা এই গাড়িতে করে গেলে আমি কিন্তু যাবোনা।”
“কি বলছিস এসব! ওকে ফেলে যাবো নাকি! আকবর থাকলে কি সমস্যা?”
“আমার সমস্যা আছে। আমি তাকে পছন্দ করিনা। কিছু টাকা দিয়ে তাকে অন্য গাড়ি করে চলে যেতে বলো।”
আরিফার বাপ, আকবরকে গাড়ি থেকে নামতে বলে। রোগে শোকে এখন প্রায় বৃদ্ধ একজন মানুষ সে , যার পায়ে গভীর ক্ষত, পা টেনে টেনে গাড়ি থেকে নামে সে।
আরিফা’র তা দেখেও দয়া হয়না। দয়া যে একেবারে হয়না, তা কিন্তু নয়, সে তা পাত্তা দিতে চায়না ।
এই ক্ষোভ যে খুবই ছোটবেলা থেকে! মা, বাবা, দাদি’র যা করা উচিৎ ছিলো, পিচ্চি তার থেকে খুঁটিয়ে জানা দরকার ছিলো, কেনো আকবর চাচাকে তার এতো অপছন্দ, তা তারা করেননি! উল্টো আরিফাকে ভুল বুঝে বকা দিয়েছেন, বেয়াদব বলেছেন , কখনো বাড়াবাড়ি করলে মেরেছেনও!
আজ যেন আরিফা তার সাথে হওয়া ঘটনার প্রতিশোধ নিলো।
পা টেনে টেনে, মুখে একরাশ অপমান আর বিষণ্ণতার কালো রঙ মেখে আকবরের চলে যাবার দৃশ্য আরিফাকে খুব বেশি ভাবায়না।
“জাহান্নামে যাক,” মনে মনে বলে সে।
আচ্ছা, আকবরেরও কি সেই স্মৃতি মনে আছে? সে কি অনুতপ্ত? নাকি আরো অনেকের সাথে এমনতর ব্যবহার করেছে যে, সে তা ভুলেই গেছে! কি জানি!
বাপও তার উপর নাখোশ। এরপরেও জোর করে জানতে চাননা কারণ কি!
বাড়িতে গিয়ে মায়ের হাত দিয়ে, আকবরের দুখিনী বউটার জন্য কিছু উপহার আর টাকা পাঠিয়ে মনটা কিছুটা হালকা করে সে। আকবর অনুতপ্ত না হোক, কিন্তু অসহায় আকবরকে অপমান করে আরিফা যেন তৃপ্ত হতে পারেনা, মনের মধ্যে কিছু একটা খচখচ করতে থাকে। অপমান করতে হয়, প্রতিশোধ নিতে হয় সবল থেকে, তাতেই শান্তি, তৃপ্তি।
যদিও আরিফা এখন জানে,অপূর্ণ সন্তান হওয়াটা আকবরের শাস্তি কিছুতেই হতে পারেনা, তার বৈজ্ঞানিক একটা ব্যাখ্যা আছে এবং আল্লাহ এমন সন্তান দিয়ে বান্দাদের ধৈর্য পরীক্ষা করেন হয়তো। তাছাড়া আকবরের দোষে তার বউ বাচ্চা কষ্ট পাবে কেনো?
তবুও আরিফা ভেবে শান্তি পায়,
সবল আকবরের প্রতিশোধ প্রকৃতি নিয়ে নিয়েছে, তার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে অভাব, দুশ্চিন্তা আর অসুস্থতায়।
২৭.০৭.১৮
ফারহানা বহ্নি শিখা