কালের পরিবর্তন

কালের পরিবর্তন

জরিনাকে বউ করে ঘরে তুলে নেবার এক সপ্তাহের ভেতর কাজের মেয়ে রাশুনিকে বিদায় করে দিলেন, শ্বাশুড়ী খতিজা বানু।
বিনা বেতনে নতুন কাজের মেয়ে পেলো, টাকা খরচ করে কে আর কাজের মেয়ে পুষে, চুরিও করে ওরা,দুইবার চা বানাতে গিয়ে দুধ চুরি করে খেয়েছে রাশুনি।কত্ত সাহস! বিদায় না করে উপায় আছে! তাছাড়া রহমানের বউকে বসিয়ে বসিয়ে সুন্দর দেখবার আর খাওয়াবার জন্য এনেছে নাকি?

যাবার আগে, এত্তোগুলো বদ দোয়া দিতে দিতে রাশুনি কাজ থেকে বিদায় নিলো।
-কাজ করেছি নাম নাই,একফোঁটা ছানা খেয়ে দেখেছি, তাতেই চুরি নাম দিয়ে দিলো। সোনা চুরি করিনি,টাকা চুরি করিনি,সামান্য দুধের ছানা! মাগনা কাজের বেটি পাইছে,তাই এই রাশুনির আর কদর নাই….
বেয়াদব মেয়ে,চুরি করিস তা বলতেও পারবোনা! বিদায় করে ভালো কাজ করেছে,খতিজা বানু।
বউও যে চুরি করবেনা,তারও কোনো গ্যারান্টি নাই,তবুও চোখে চোখে রাখা যাবে।

তার তেত্রিশ বছরের জোয়ান ছেলের জন্য দেখে শুনে এইট পাশ,পনের বছরের মেয়ে এনেছেন তিনি, বুড়া মেয়ে আনলে কথা শুনবেনা,মুখে মুখে তর্ক করবে।এখন ছোট মেয়ে,সে যেমন চালাবে চলবে। অনেকটা নরম মাটির মতন, যা আকার দিবে,সে হিসেবে তৈরি হবে। তাকেও কি তার শ্বাশুড়ী তৈরি করেন নি? তার বয়স তো তখন আরো কম ছিলো। কখনো তাকে চড় থাপ্পড়ও দিয়েছেন শ্বাশুড়ী।
প্রয়োজনে তিনিও জরিনাকে দেবেন, স্কুলে কি শিক্ষক মাইর ছাড়া ছাত্র মানুষ করতে পারে! শ্বশুড়বাড়ি হলো সবচেয়ে বড় স্কুল,সবচেয়ে বড় পাশ,ফেল।

খতিজা বানু’র কন্যা শাহেদাকে কি তার সামনেই তার শ্বাশুড়ী থাপ্পড় মারেননি! দোষ করলে দু’একটা থাপ্পড় দেয়া যায়। শাহেদা সেদিন ভাত পুড়ে ফেলেছিলো। যদিও মেয়েকে অন্যের হাতে থাপ্পড় খাওয়া দেখতে তার বুকে খুব লেগেছিলো। কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি। কিছু বলা সাজেনা,মেয়ে লাই পেয়ে যাবে,তিনি লাই দিয়ে মাথায় তুলবেন, অমন মা নন। যেখানে নিজের মেয়েকে মাথায় তুলেননি,সেখানে জরিনা তো অনেক পর!

রহমান বিয়ের কুড়ি দিন পরই আবার আরব দেশে চলে যায়। দশ বছরে খুব একটা কম আয় করেনি খতিজা বানু’র একমাত্র ছেলে। ঘর বেধেছে, ছোট দুই বোন বিয়ে দিয়েছে,বাপের চিকিৎসা চালাচ্ছে, জমি আর চাষ বাড়ালো,ঘর খরচ,বিয়ে করলো। কম নাকি!
বিয়েটা সামান্য দেরিতে,তাতে কি! ছেলেদের রঙ আর বয়স দেখতে নাই।
তাছাড়া, তিনি প্রায় ফ্রিতে মেয়ে আনলেন,শুধু ক’টা ফার্নিচার ছাড়া আর কিছু কি দিলো মেয়ের হাড় কিপটে বাপ!

তবে মেয়ে খারাপ না,মাটির কাই যেন,যা বলে মুখ নিচু করে নিখুঁত ভাবে করে নেয়।
গরুকে ঘাস খাওয়ানো, দুধ ধোয়ানো, ধান শুকানো, রান্নাবাড়া সব করে সে। অবশ্য এসব একদিনে সে শিখেনি। খতিজা বানু হাত ধরে ধরে শিখিয়েছেন। এখানে তার ক্রেডিট ১০০ ভাগ।
দেড় দুই বছর পর পর রহমান দেশে আসে। প্রতিবার একটা করে নাত নাত্নিও পেটে দিয়ে যায়। তাতে অবশ্য খুব একটা কাজের ব্যাঘাত ঘটেনা,বাচ্চা পেটে কাজ করার সুবাদে সহজে বাচ্চা জন্ম নেয়,তাতো আর মিথ্যে কথা নয়! সেও তো কাজ করেছে,যখন পোয়াতি ছিলো।
সে তো অন্য শ্বাশুড়ীদের মতো ভুখা পেটে রাখেনাই , প্লেট ভরে ভাত দেয়,তাও লাভের আশায়।

না, তার লাভ না,জরিনা’র লাভ। পোয়াতি মাইয়া বেশি বেশি খেলে বাচ্চা পেটে বড় হতে পারেনা,খাবারের জন্য বড় হবার সুযোগ পায় না,তাতে করে সহজে বের হয়,তার শ্বাশুড়ী তাকে শিখিয়েছেন,এখন সে তা জরিনাকে।
কিন্তু এতো নিয়ম কানুন চালিয়েও বাচ্চাগুলো কেমনে এতো মোটা সোটা গাব্দাগোবদা হয়ে জন্ম নেয়,খতিজা বানু’র মাথায় ঢুকেনা।

পঁচিশ বছর বয়সেই নয়, সাত আর পাঁচ বছর বয়সি দুই ছেলে, এক মেয়ের মা হয় জরিনা।
তিনটা বাচ্চাই মায়ের চেয়ে দাদা দাদি’র ভক্ত বেশি। তারা যা বলে সে মোতাবেক চলে। জরিনা বাপের বাড়ি নাইওর গেলে তিনি যেমন শিখিয়ে দেন,তেমনি করে আসা মাত্র দাদা দাদি’র কাছে দৌঁড়ে এসে মায়ের সব কথা বলে দেয়।
মা কার কার সাথে কথা বলেছে,বাসায় আর কোন খালা নাইওর এসেছে,দাদা দাদির কোনো বদনাম করেছে কিনা,সবই বলে দেয়।
তারপর তিনি জরিনাকে চেপে ধরেন,বকা দেন।
সেবার জরিনা পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করেছে বাপের বাড়ি।
-অ বউ,তোমার কি লাজ লজ্জা কিছু নাই?
-কি করছি মা?
-তুমি নিজে চিন্তা করে দেখো, বয়স তো তোমার কম হয়নি, এই বয়সে বাপের বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটো!!
জরিনা চুপচাপ সব শুনে নেয়। কথা সত্য,কিন্তু এটা যে কোনো অপরাধ হবে তা তার জানা ছিলোনা। ঘরের পেছনে পুকুর,তাও বেড়া দিয়ে ঘেরা, শ্বাশুড়ী দেখেছেন।
থাক,নিশ্চয় তার অপরাধ মনে হয়েছে,তাই বকছেন। আর ছেলে মেয়েগুলোই বা কেমন! সব বলে দেয়….
-আর হ্যাঁ,ঘরে তোমার বাপ ভাই থাকেনা?
-জ্বি থাকেন
-তবে মাথায় কাপড়ের ঠিক থাকেনা কেন? এমন হলে নাইওর আর যেতে দেবো না।

পরের বার নাইওর গেলে,তার বড় বোন তার ছেলেমেয়েদের অনেক বুঝিয়ে বলেন,সে বললে হয়তো বুঝবেনা। ভাববে,প্রিয় দাদা দাদির বদনাম করছে।
-তোমরা তোমাদের মাকে ভালোবাসোনা?
-বাসি তো।
-তবে দাদিকে সব কথা বলে দাও কেনো?
-দাদি বলতে বলেছে।
-মাকে বকা দেয়, তোমাদের কষ্ট হয়না?
বাচ্চারা কিছু ভাবে,হয়তো ঐ কষ্ট উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট বড় তারা এখনো হয়নি।তবুও একটা জবাব দেবার জন্যই বলা..
-হ্যাঁ,হয়তো।
-তবে আর বলোনা।
তোমার মা তো কোনো খারাপ কাজ করছেনা। তোমার নানা নানু খালাদের সাথেই কথা বলে, পুকুরে গোসল করার সময় সাঁতার কাটে কখনো। তোমরা সাঁতার কাটোনা?
-হ্যাঁ
-তোমার আম্মু বলে দেয়?
-না
-তবে?
-আর বলবো না খালা।
-হুম,আজ তোমরা সবাই মাঠে খেলতে যেও, কেমন?
খুশি হয়ে যায় বাচ্চারা,মাঠে দাদি যেতে বারণ করেছে রোদে পুঁড়ে গায়ের রঙ ময়লা হয়ে যাবে তাই,তবে তাদের ওখানে যাবার খুব লোভ।

এখন সব বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে। শ্বশুড়ও মারা গেছে অনেক বছর। পাঁচ বছর হয়, মেয়েটার বিয়ে দিয়েছে চব্বিশ বছর বয়সে। এতো পড়া লেখা করিয়েছে,সেজন্য শ্বাশুড়ীর কম কথা শুনতে হয়নি। তবে তার আর আগের মতো বয়স,শক্তি কিছুই নেই,শুধু মুখটাই শক্ত। জরিনা এখনো তাকে আগের মতো সম্মান করে,ভয় পায়,তবে তার সন্তানদের মানুষ করার ব্যাপারে তার কোনো কথা কানে তোলেনি।

-বউ,মেয়েকে এতো পড়াচ্ছো, আইবুড়ো বানাচ্ছো,বিয়ে দিতে পারবে? কে করবে তোমার বুড়ি মেয়েকে বিয়ে? মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। ওর এই বয়সে তুমি তিন বাচ্চার মা হয়েছো,ভুলে গেলে?
-না,মা ভুলিনি তবে যুগ পালটেছে মা। পড়া লেখা ছাড়া গতি নাই।
-ছেলেদের করাচ্ছো,মেয়েকে কেনো?
-মেয়েদের বেশি দরকার মা।
-কি করবে এতো পড়া দিয়ে? চুলায় তো গুঁতোবে।
-তা তো করবেই মা। বাচ্চা মানুষ করতে পড়া লেখা দরকার,স্বামীর কাজে সাহায্য করতে,তারপর বিপদ আপদে….
-বিপদ আপদ আবার কি?
-ধরেন,স্বামী মারা গেলো কিংবা তালাক হলো,তখন মেয়ে কাজ করে সংসার চালাতে পারবে
-শুভ শুভ বলো বউ,খারাপ চিন্তা, বিপদ ভাবলে খারাপই হবে,আমরা ভাবি নাই,তাই হয় নাই।
-না মা,বিপদ কি কাউকে বলে আসে, তাও আল্লাহর হুকুমেই আসে,তাই তা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সবসময় প্রস্তুত থাকা ভালো।
-হুম কি জানি, তোমাদের মনে কি আছে…
এরপরও খুব ভালো প্রস্তাব পেয়ে এম এ পরীক্ষা’র আগে মেয়েকে বিয়ে দিতে হয় রহমানের জোরাজুরিতে। বিয়ের পরে অবশ্য সে পরীক্ষা দিয়ে ভালোভাবে পাশ করেছে।

এবার ছেলের জন্য মেয়ে দেখা চলছে,ছেলের বয়স ঊনত্রিশ, আরো আগে বিয়ে করাতে চেয়েছিল জরিনা। ছেলে পাশ করে তিন বছর চাকরি করে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করবেই না। এখন ছেলে বিয়েতে মত দিয়েছে।
-অ বউ, বুড়ি মেয়ে আনবেনা,ষোল সতের বছরের বেশি বড় আনলে মেয়ে তোমার কথা শুনবেনা।
জরিনা শ্বাশুড়ীর কথা শুনে যায়,কিন্তু সে অতো ছোট মেয়ে আনতে রাজি না। অনার্স দিয়েছে, রেজাল্টের অপেক্ষা করছে, এমন এক মেয়ে তার খুব পছন্দ হয়। কিন্তু ওদের শর্ত মেয়েকে পড়াতে হবে। জরিনা ও তার ছেলে তা হাসি মুখে মেনে নেয়।

জরিনা দুইটি কাজের মেয়ে রাখে,বিয়ে বাড়ির ঝামেলা,কত্তো কাজ,তাছাড়া নতুন বউ।
-অ বউ,কাজের মেয়ে রাখলে কেনো আবার? টাকা কেনো নষ্ট করছো? ছেলে বিয়ে করালে,বউ কাজ করবে।
-মা,এক মেয়ে বিদায় করে,আরেক মেয়ে আনলাম,ও তো কাজের মেয়ে না। ওর যদি টুকটাক কখনো করতে মন চায়, করবে।আর পড়া লেখা করে সময় পেলেই না করবে।
– কি বলো,এতো বুড়া বউ আনলে,আরো পড়বে!
– মা,এরচেয়েও বেশি বয়সে আমার মেয়ে বিয়ে দিয়েছি।
– তা ওরা কই যাচ্ছে? কই পাঠাচ্ছো তাদের?
-যাক,ক’দিন ঘুরে আসুক। স্বামী স্ত্রী দুইজন দুইজনকে ভালোভাবে চিনুক জানুক।
-অ মা,এসব কি বলো,ঘোরাঘুরি করা ছাড়া, আমরা কি সংসার করিনি!!
জরিনা জবাব দেয়না। ওরও ইচ্ছে হয়, রহমানের সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে।।

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত