সকাল ৭টা বাজে ট্রেন ছাড়বে, রাস্তায় জ্যাম না থাকায় সি এন জি ৬.৩৫
মি: স্টেশনে নামিয়ে দিল।আমি ডব্লিউ-১ সীট খুঁজে পেয়ে
বসে পড়লাম আর জানালা দিয়ে বাহিরের স্টেশনের দৃশ্য দেখছি।
কাল সরকারী চাকরীর একটা পরীক্ষা আছে ,আমি যাচ্ছি সেই
যুদ্ধে অংশ নিতে বাহিরে যে যাত্রীদের দেখছি তাদের
বেশিরভাগ হচ্ছে এই যুদ্ধের যোদ্ধা। এখন অবস্থা এমন
হয়েছে যে একজন সরকারী পিওন নিয়োগের পরীক্ষা
দিতেও আমাদের ঢাকার ট্রেন ধরতে হয়।আর টিকেট কিনতে
গেলে ৩দিন আগেই সব টিকেট শেষ হয়ে যায়। আজকের
টিকেট কালোবাজারী থেকে নিলাম ৭৪০ টাকায় অথচ টিকেটের
দাম লেখা আছে ৩৪৫ টাকা।
বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি হঠাৎ এই যে এই যে ডাক শুনে
ভেতরে তাকিয়ে দেখি এক মেয়ে দাড়িয়ে আছে। দেখতে
স্লীম সুন্দরী।
-জ্বী বলুন।
-এটা আমার সীট।
আমার টিকেট টা পকেট থেকে বের করে আরেকবার সিউর
হয়ে নিলাম ডব্লিউ মানে উইন্ডো।মেয়েটি কে দেখালাম তবু
বলল না এটা আমার, আপনার এটা পাশের সীট টা দেখিয়ে বলল।সাদা
পোশাকের এক ক্যান্টিন বয় যাচ্ছিলো তাকে আমার টিকেট
দেখালাম সে বলল আমি যে সীটে বসে আছি সেটাই আমার
এই কথাটা বলে সে চলে গেল।
– আমাকে আপনার সীটে বসতে দিবেন? প্লীজ।
আমার হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা বাণী মনে পড়ে গেল, ”
রূপবতী নারীদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে নেই ।
প্রত্যাখ্যান করলে অভিশাপ লাগে।রূপের অভিশাপ । রূপ তখন ধরা
দেয় না । রূপের অভিশাপে পরা ভয়াবহ ব্যাপার ।” তাই তাকে আর না
করতে পারলাম না যদি আবার রুপের অভিশাপ লাগে। তখন দেখা
যাবে পরীক্ষাতে আসছে বাংলাদেশের রাজধানী কোথায়?
আমি ঢাকা না লিখে নোয়াখালী লিখে দিব।
-এক্সকিউজ মি আমার ব্যাগ টা একটু উপরে উঠিয়ে দিবেন?
অভিশাপের কথা মাথায় রেখে তাও করলাম একটা থ্যাংকস ও দিল না।
আমি তার সীটে বসে পড়লাম আর সে আমার সীটে বসে
বাহিরের দৃশ্য দেখছে।ট্রেন ছেড়ে দিল চলতে চলতে
স্টেশনকে পেছনে ফেলে আসল।
আমি কামড়ার ভিতরে যাত্রীদের আসা যাওয়া দেখছি।আমার
সামনের দুটা সীটে বসে পড়ল দুজন ছেলে শিক্ষার্থী
একজন নাফিস আরেকজন শাহরিয়ার ।অল্প কিছু সময়ের মধ্যে
আমরা তিনজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম।আমাদের তিন জনের ই
পরীক্ষার আসন পড়ল তিতুমীর কলেজে । আমরা তিনজন বিভিন্ন
বিষয় নিয়ে গল্প করছি আর মেয়ে টি একটা গল্পের বই পড়ছে।
নাফিসের চোখে পড়ল মেয়েটির ঠিক মাথার উপরে লেখা
নিলীমা- ০১৬৮….. নাম্বারটি সে মোবাইলে টুকে ডায়াল করতে
যাবে আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম আমার একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা
শেয়ার করছি তোমাদের সাথে।
৩বছর আগে বন্ধু আরিফকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম নাস্তা
করতে। নাস্তা শেষে বিল দিলাম বয় কিছু টাকা ফেরৎ দিল তার
মধ্যে ২০ টাকার একটা নোটে লেখা ছিল যয়তুন- ০১৮…… নাম্বার ।
আরিফ নাম্বারটা নিয়ে ফোন করে স্পিকার অন করে দিল।১ম বার রিং
পড়তে পড়তে কেটে গেল।আবার ফোন দিল।এবার রিসিভ
করে ওপাশ থেকে ভারী এক মহিলার কন্ঠ।
-হ্যালো।
আরিফ- যয়তুন আছে?
-দেখা করবেন? ঠিকানা দিচ্ছি লিখে নিন।
আরিফ- লিখতে হবে না কল রেকর্ডার আছে বলে ফেলুন।
সে ঠিকানা বলে লাইন টা কেটে দিল।
আরিফ- দোস্ত এই মেয়েটা তো ডেঞ্জার কিছু না শুনেই
দেখা করতে চাইছে।ঠিক আছে আজকে বিকালে দেখা করব
রেডি থাকিস।
ঠিকানা বের করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগল গলির শেষ মাথায় একটা
দোতলা বিল্ডিং এর দোতলায় দরজা নক করতেই একজন মহিলা
এসে দরজা খুলে বাসায় ঢুকতে বললেন ।
-আপনারাই ফোন করেছিলেন, তাই না?
-হুম।
-একটু বসুন আমি আপনাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।
আমরা রুমের এদিক ওদিক তাকাচ্ছি । বাসাটা এলোমেলো হয়ে
আছে।দেয়ালে একটা ছবি টাঙানো আছে। আমি আরিফ কে
ছবিটির দিকে তাকাতে বললাম।এই মহিলা আর একজন পুরুষ বসে
আছে তাদের পেছনে একটা সুন্দরী মেয়ে দাড়িয়ে আছে।
এটাই হবে যয়তুন। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি যয়তুনের জন্য।
নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকলেন মহিলা।
-যয়তুনের নাম্বারটা কোথায় পেয়েছেন।
আরিফ- টাকাতে পেয়েছি।
ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন এ হচ্ছে যয়তুন , আমার একমাত্র
মেয়ে।একটা মহিলা কলেজে অনার্স পড়ত।
আরিফ- তিনি বাসায় নেই?
-না, গতবছর সে আত্মহত্যা করেছে।পাড়ার এক বখাটে ছেলে
রাস্তায় যয়তুনকে পেলেই দলবল নিয়ে শুধু জ্বালাতন করত। খারাপ
খারাপ কথা বলত।অনেক দিন ঐ ছেলের জন্য কলেজে যাওয়া
বন্ধ করে দিয়েছিল তাতে কোন লাভ হয়নি , বাসার সামনে এসে
উৎপাত করা শুরু করলো।সে আমার কাছে যয়তুন কে বিয়ে করার
প্রস্তাব পাঠাল আমি না করলাম।এই না টাই আরো কাল হয়ে দাঁড়াল।
তখন সে ওর মোবাইল নাম্বার এমন কোন জায়গা বাদ রাখেনি যে
লিখে রাখেনি সারাদিন শুধু ফোন আসত আজে বাজে কথা বলত
রিসিভ করার পর যেটা এখনো আসে। যয়তুন মানসিকভাবে খুব
ভেঙ্গে পরল। মনে করলাম যয়তুন কে অন্য ছেলের সাথে
বিয়ে দিলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু নাহ ঐ ছেলে শ্বশুর
বাড়িতে গিয়ে অনেক আজে বাজে কথা বলে আসে তার
উপরে ফোনের উৎপাত তো ছিলই। শ্বশুর বাড়ির লোকরা
যয়তুন কে সন্দেহ করতো । যয়তুনের স্বামী, তার সাথে
ভালো ব্যবহার করতো না । গতবছর এসব কিছু থেকে সবাইকে
মুক্তি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল।
আমরা মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনছিলাম নিজেদের মধ্যে একটা
অপরাধবোধ কাজ করছিল । যয়তুনের মা কে স্যরি বলে বাহিরে
বের হয়ে আসলাম।এরপর থেকে এই ধরনের নাম্বার
যেখানেই পাই তা মুছে ফেলি।শাহরিয়ার তার মার্কার পেন টা
আমাকে দিল নীলিমার নাম্বারটা মুছে ফেলার জন্য । আমিও তাই
করলাম।
ট্রেন কমলাপুর স্টেশনের কাছাকছি চলে আসল। আমরা সবাই যার
যার জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছি । মেয়েটার ব্যাগটা নামিয়ে তাকে দিলাম ।
সে এবার থ্যাংকস দিল আর বলল তোমাদের সব কথাই আমি শুনেছি।
ভালো থাকো তোমরা সবাই। আমার নাম কনক। আমি তোমাদের
সবার নাম জানি তাই আর নাম জিজ্ঞেস করলাম না।বেঁচে থাকলে
আবার দেখা হবে।
আমরা ট্রেন থেকে নেমে যার যার মত করে চলে গেলাম।