“শোনো, এই যে তুমি রোজ় রোজ এত দেরী করে বাড়ী ফেরো, আমার একদম ভালো লাগে না। রাস্তা ঘাটে এখন খুন-খারাবী লেগেই আছে, বাড়ীতে দু-দন্ড বসে ছেলেটাকে ‘আ-আ-ক-খ’ দেখিয়ে দিলেও তো পারো?……” সকালের খাবার দিতে দিতে এক নাগাড়ে বলেই চলেছে সাবিনা। মুখে টু শব্দটি না করে রূটী-আলুর তরকারী মন দিয়ে খাচ্ছে ইসমাইল, জানে মুখ খুললেই দিলেই বিপদ।
ইসমাইলের সাথে যখন বিয়ে হয় তখন কতই বা বয়স সাবিনার, খুব বেশী হলে ১৫, ইসমাইল কুড়ি ছুই ছুই। বিয়ের কদিনের মধ্যে দাদারা সব আলাদা হয়ে গেলে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ইসমাইল স্বাভাবিক ভাবেই আলাদা পড়েগেল। বাবা-মা অনেকদিন আগেই ইসমাইলকে ফেলে চলে গেছেন। আলাদা সংসার সাবিনাকে ওই বয়সেই গিন্নি সাজিয়ে দিয়েছিল। চাষাবাদ ছিল একমাত্র পারিবারিক জীবিকা, ভাগ হিসেবে বিঘা সাতেক পৈতৃক জমিও পেয়েছিল। বাড়ীর ছোট ছেলে হওয়ার সুবাদে চাষের কাজে তেমন হাত লাগাতে হয়নি, স্কুলে যেত, তবে নন-ম্যাট্টিক এর পর আর এগোয়নি। এখন তো আর চাষ না দেখে উপায় নেই, একা তো নয় সঙ্গে বউ উল্টে আলাদা সংসার। ধীরে ধীরে চাষের কাজে লেগে পড়তে হয়েছিল।
বন্যা-খরা’র সাথে মোকাবিলা করতে সাত বিঘে জমির মধ্যে বিঘে তিনেকের পাখনা গজিয়েছে। বুঝে গেছে চাষ করে বিশেষ সুবিধা হবে না, এদিকে সংসারও বেড়েছে। গ্রামের নন-ম্যাট্টিক মানে খুব একটা মন্দ না, সেটাকে কাজে লাগিয়ে জীবন বিমার সাব-এজেন্ট হিসাবে যোগদেয়, এজেন্ট কে খদ্দের ধরে এনে দেওয়া, দিলেই জনা প্রতি কিছু কমিশন। কিন্তু এমনিতেই গ্রামের তেমন অবস্থা সম্পন্ন লোকের অভাব, তার উপর গ্রামেরদিকে জীবন-বিমা ব্যাপারটা খুব একটা জমে উঠেনি। তবে জীবন বিমার কাজে এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে কিছু সমাজবিরোধী লোকের সাথে ভাব হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তাদের অনেকটা কাছে চলে যায় ইসমাইল, যার বিন্দুমাত্র খবর জানেনা সাবিনা।
“কি হল, কথা বলছ না যে?” বলে সামনে থেকে আলুর বাটিটা সরিয়ে নিলে ইসমাইল হেসে বলল – “তোমার সাথে কথা বলতে গেলে সে কথা কি শেষ হবে?”
সাবিনা বাটিটা আবার যথাস্থানে রেখে মিষ্টী হেসে বলল – “আমি তো সেটাই চাই, কিন্তু আমার পোড়া কপাল, টানা ৬ বছর ধরে তোমার শুধু এখানে সেখানে যাওয়া, আমার দিকে তাকানো তো দূর, কথা বলারই সময় নেই”
ইসমাইল একটুকরো রুটীতে খানিকটা আলুর তরকারী নিয়ে সাবিনা’র মুখে পুরে দিয়ে বলল – “আমার উপর খুব রাগ হয় না? কিন্তু কি করি বল, যা দিনকাল পড়েছে বাড়িতে বসে থাকলে পেটের ভাত জুটবে? আমার কি ইচ্ছে হয় এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে?”
– “তা আজকে কোথায় যাওয়া হবে শুনি?” রুটি মুখে চিবোতে চিবোতে বলল সাবিনা।
হাত ধুতে ধুতে ইসমাইল বলল – “কোথায় আর যাবো, দেখি খোশবাস পুরের দিকে দুটো খদ্দের পাওয়ার আশা আছে, গিয়ে ধর্না দিয়ে দেখি যদি হয়ে যায়”
দুর্লভপুরের আবু বক্কার কে কদিন আগে জীবন বিমা’র নিয়ম-কানুন বোঝাতে নাকানি-চোবানি খেয়েছে সে। সমাজ বিরোধী হিসেবে আবু-বক্কারের খ্যতি আছে এলাকায়। নামে খানকতক খুনের কেশও ঝুলে আছে। খুন হলেও জীবন বীমা’য় টাকা পাওয়া যায় বোঝাতে চেয়েছিল ইসমাইল কিন্তু খুন হয়েগেলে সে তো টাকা পাবে না, পাবে তো বউ-বাচ্চা তাহলে তার লাভ কি হবে সে প্রশ্নের উত্তর দিলেও ঠিক বোঝাতে পারেনি।
খোশবাস পুরের খদ্দের দুটি মন্দ না পেটে বিদ্যে তেমন না থাকলেও ঘটে বুদ্ধি আছে, এক জনের মুদিখানার দোকান আরেক জন বেশ জমি-জায়গাওয়ালা চাষী। তাদের কে বিশেষ
খুঁটিনাটি বোঝাতে হল না, মানে বুঝতেই চাইলো না। একজন বলল তিনমাস অন্তর ২৫০ টাকা করে জমা দিতে পারবে অন্যজন ৭৫০ টাকা জমা দেবে। বড্ড খুশী ইসমাইল অনেক দিন পর দুটো খদ্দের পেয়ে। সেদিন ছেলেটার জন্য একটা চকচকে পাতাওয়ালা অজগর-আমের ছবিসহ ছড়ার বই কিনে নিয়ে গেল। ছেলের জন্যে বই কিনে এনেছে দেখে সাবিনা আড়চোখে ইসমাইলকে দেখে একটা স্মিত হাসি দিয়ে বলল – “ ছেলের জন্য মনে আছে দেখছি”
সকালে বুঁচীর মা বলে গেল দুর্লভপুরের আবু বক্কার তাকে আজকে বিকেলে বারবার করে দেখা করতে বলেছে, মেয়ের বাড়ী থেকে ফেরার সময় দেখা হয়েছিল তার সাথে। ইসমাইল ভাবল ব্যাটা আবার যাচ্ছেতাই রকমের প্রশ্ন করে বিরক্ত করবে। ও ব্যাটার হাতে কাঁচা টাকা আছে, এদিক ওদিক করে আসে, বছরে হাজার চারেকের একটা পলিসি করতেই পারতো কিন্ত কে বোঝাবে তাকে। বিকেলের দিকে পৌঁছেগেলে আজ তাকে বাড়ীর ভেতর ডেকে নিয়ে বসতে দিল। টিনের ছাউনি দেওয়া দোতলা মাটির বাড়ী চারিদিকে মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরাও আছে।ঐ গ্রামের পাকা বাড়ী নেই বললেও চলে। মাটীর বাড়ীই পাকা বাড়ীর থেকে কোন অংশে কম না। প্লাস্টার করে রীতিমত পেইন্ট করা। একটা মোড়া এগিয়ে দিয়ে বসতে দিল ইসমাইল কে।
“না হে তুমি ঠিক ই বলছ, জীবন বিমা একটা থাকা ভালো, শহরের সবার আছে শুনেছি” পান চিবতে চিবতে জানাল আবু বক্কার সাথে ছেলেকে ডেকে বলেদিল তাদের জন্য দুকাপ চা করতে। শুনে ইসমাইলের মনে হল দেরিতে হলেও লোকজন বুঝছে।
রাতের ঘুমোতে যাবার সময় এ নিয়ে সাবিনা’র সাথে গল্প করতে গেলে বলল – “তুমি সবার জীবন বীমা করিয়ে দিচ্ছো আর নিজেদের বেলা?”
“আমাদের তিনটে জীবন কোনক্রমে টিকে আছে, বীমা করার মত আমাদের কি ক্ষমতা আছে?” মাটির শিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বলল ইসমাইল।
ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে, সাবিনা তাকে মুখটা ধরে তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল – “আমি তো তোমাকে এমনিই বললাম, তুমি থাকতে আমার কিচ্ছু চাইনা, জীবনই সব, সেটা না থাকলে তার বদলে টাকা, সেই টাকার মুখে ঝাঁটা মারি”। বলতে বলতেই চোখ থেকে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ল। ইসমাইল একটু আদর করতে করতে বলল – “এই পাগলী, কিহল হঠাৎ চোখে জল কেনো?”
সাবিনা আদর মাখানো গলায় বলল – “সে তোমাকে জানতে হবে না, ব্যাটাছেলেদের অত না বুঝলেও চলে”
এখন ইসমাইল পুরো এজেন্ট হয়েগেছে। ছেলে প্রায় ছ-বছরের হয়ে গেছে গ্রামের ফ্রী প্রাইমারী স্কুলে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছে। মাঝে আরো একদুটো খদ্দেরো জুটেছে, চাষাবাদও মন্দ হচ্ছে না, বেশ দিন কেটে যাচ্ছে তিন জনের সংসার। এখন আরো দূরে দূরে যাচ্ছে সে খদ্দেরের আশায়। ব্যাপারটা মন্দ লাগছে না, একবার বীমা করিয়ে দিলে কমিশন পাচ্ছে।
সেদিন সকালে ছেলেকে “আতাগাছে তোতাপাখী…” পড়াচ্ছিল, সাবিনা এসে বলল – “এই শুনছো, সেই মজিরণ বিবি’কে গুলি লেগেছে একাবারে যাই যাই অবস্থা, হাসপাতালে আছে”
ইসমাইলের পায়ের তলার মাটি যেন কেমন করে সরে যাচ্ছে, শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল – “কে বলল, কি করে গুলি লাগলো?”
-“ওর স্বামীকে তো চেনই দাগী লোক, লোকে বলাবলি করছে, কেউ তাকেই মারতে এসেছিল রাতে ঘুমিয়েছিল, ওকে গুলি করতে গিয়ে ওর বউকে গুলি করে দিয়ে পালিয়েছে। ওর স্বামী পিছু তাড়া করে গেছিল তাকেও গুলি করেছিল কিন্তু তাকে নাকি লাগেনি পালিয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বলছে ওর স্বামীটাই নাকি গুলি করেছে ওদের বনিবনা হচ্ছিল না, তাই নিজেকে বাঁচাতে বাইরে গিয়ে ফাঁকা গুলি চালিয়েছে”
ইসমাইল হাসপাতালে গেলে দেখল মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে মজিরণ বিবি, পুলিশ বারবার জিজ্ঞেস করছে, জানতে চাইছে সে কাউকে দেখেছে কিনা গুলি করতে। মজিরণ বিবি’র চোখের কোনা বেয়ে ঝরে চলেছে জল, শেষ বারের মত সামনে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকা স্বামী আবু বক্কারের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল সে কাউকে দেখেনি।
আবু বক্কারের দিকে রাগে ঘেন্নায় তাকাতে ইচ্ছে করেনি ইসমাইলের। জীবন বিমা’র সংজ্ঞা যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল ইসমাইলের কাছে। বাড়ী ফিরতে রাত হয়ে গেল, ফিরে সাবিনাকে বলল – “ভাবতেই পারছি না, লোকটা এতটা পাষাণ, বর্বর। সেদিন যেভাবে নিজের বউয়ের নামে মোটা টাকার জীবন বীমা করাল, ভেবেছিলাম লোকে তাকে সমাজবিরোধী বললেও তার পরিবারের প্রতি কর্তব্য একজন সাধারণ স্বামীর মতই। নিজের নামে জীবন বিমা করতে কি আনন্দেই না সেদিন মজিরণ বিবি বানান করে করে নিজের নাম সই করল…” বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।
ইসমাইলের মাথাটাকে ধরে নিজের কোলে রেখে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সাবিনা বলল – “ওসব ভেবে মন খারাপ করতে নেই, এখন একটু ঘুমোও তো দেখি”