বাবার জন্য লিখা চিঠি

বাবার জন্য লিখা চিঠি

প্রিয় বাবা,

অনেকদিন দিন ধরে ভাবতেছি তোমাকে নিয়ে একটি চিঠি লিখবো। চিঠিটা পাঠিয়ে দিবো অজানা ঠিকানায়।
কিন্তু যখনই লিখতে বসি হাতটা কাঁপতে থাকে। আর অশ্রুজলে ভরে যায় নয়ন দুটি। অশ্রু-চোখে আর কাঁপা কাঁপা হাতে কি চিঠি লেখা যায় বলো?!

তোমাকে নিয়ে হাজারো স্মৃতি মনের গহীনে জমা হয়ে আছে। জানো বাবা?! যখন খুব একা থাকি, যখন আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যায়। তখন তোমাকে খুব মনে পড়ে। ইচ্ছে করে তোমায় চিৎকার দিয়ে বাবা বলে ডাকি। কিন্তু আমি জানি আর আমার ডাকে সাড়া দিবেনা তুমি।

প্রতিটি সন্তান হয়তো একদিন বাবা শূর্নতায় ভুগে। তখন খুব মিস করে বাবা নামক মানুষটিকে। সবাই একদিন বাবার অকৃক্রিম ভালোবাসার স্পর্শ খুব বেশি মিস করে হয়তো!!

জানো বাবা,
এখন আমি তোমার সেই ভালোবাসার স্পর্শ গুলো খুব মিস করছি। সেই ছোটবেলার কথা আজো মনে পড়ে যায়। যখন পড়ার টেবিলে বসতে চাইতাম না। তখন পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে “তোমাকে পড়তে হবে, অনেক বড় হতে হবে”।

আমি ভাবতাম, সবার বাবা ছেলেদের শাসন করে আর তুমি শাসন তো দূরের কথা কখনো গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে না। সব সময় শুধু আঁধর আর ভালোবাসাই দিয়েছো। তখন অবশ্য তোমার শাসনটা অনেক মিস করতাম বাবা।

একদিন মা আমাকে খুব মেরেছিলো। তখন তুমি বাসায় ছিলে না, বাসায় আসার পর যখন আমাকে কান্নারত অবস্থায় দেখলে। তোমার মাথাটা গরম হয়ে যায়, অমনি তুমি মাকে একটি ছড় মেরেছিলে। আর বলছিলে, “ছেলেকে কেউ এভাবে মারে?!” সেদিন রাগ করে তোমরা কেউ কিছু খেলে না। অথচ, আমাকে ঠিকই খাইয়ে দিলে। বাবা মা বুঝি এমনই হয়?!

প্রতিটি ছেলে মেয়ের প্রথম শিক্ষা গ্রহন করে বাবা মায়ের কাছ থেকে। আমারও প্রথম শিক্ষা তোমার কাছ থেকে। তুমি তোমার আদর্শে বড় করতে ছেয়েছো আমায়। শুধু একটি কথাই বারবার বলতে “বাবা, কখনো কারো উপকার করতে না পারো, ক্ষতি করো না”। জানো বাবা, তোমার কথাটা মনের মাঝে গেঁথে নিয়েছি। কখনো কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করিনি।

আমার যতো রাগ ছিলো সব তুমি সহ্য করে নিয়েছিলে। আজো মনে পড়ে সেই কথা। নবম শ্রেনীতে উঠলাম, বন্ধুরা সবাই স্কুল হোস্টেলে থাকবে। আমিও বায়না ধরলাম হেস্টেলে থাকবো। কিন্তু তুমি না করলে। খুব রাগ হয়েছিলো তোমার প্রতি। ভাবলাম হোস্টেলে না দিলে পড়ালেখাই করবো না। রাগ করে দুইদিন না খেয়ে ছিলাম। সেদিন রাতে তুমি আম্মুর সাথে কথা বলতেছো। আমি পাশেই শুয়ে আছি, তোমরা ভাবলে আমি ঘুমিয়ে।

কিন্তু আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। আম্মু তোমাকে বললো “ছেলের শখ স্কুল হোস্টেলে থাকার, তুমি ওকে হোস্টেলে দিয়ে দাও, শখটা পূরন হোক”। আর তুমি একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আম্মুকে বললে “ছেলে হোস্টেলে থাকলে আমি ঘরে কিভাবে থাকবো, ছেলেকে না দেখলে আমার ভালো লাগেনা, ছেলেটা যে আমার কলিজার টুকরা”।

জানো বাবা, সেদিন তোমার একটি দীর্ঘশ্বাসে আমার চোখে জল চলে আসলো। কোন বাবা ছেলেকে এতোটা ভালোবাসতে পারে। তোমায় বাবা হিসেবে না পেলে বুজতাম না হয়তো।

এসএসসি শেষ করলাম রেজাল্ট শুনার পর তোমায় যতটা খুশি দেখলাম তারচেয়ে বেশি হতাশা দেখলাম তোমার চোখে মুখে। তখন বুজিনি কেনো এই হতাশা।

তখন আমি তো শহরে যাবো, আর কলেজে ভর্তি হবো এটা ভেবেই আনন্দে আত্মহারা। তোমার হতাশার কারনটা পরে ঠিকই বুজতে পারলাম। আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য দূরে চলে যাবো। এজন্য তোমার হতাশার শেষ নেই। কিন্তু তোমার স্বপ্ন আমি পড়ালেখা করে অনেক বড় হবো। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও দূরের কলেজে ভর্তি করালে।

জানো বাবা, যেদিন বাড়ি ছেড়ে কলেজে নতুন একটি অচেনা জায়গায় পা বাড়ালাম। সেদিন বুকটা হাহাকার করছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার সব চেয়ে মূল্যবান জিনিসটা বাড়ীতে রেখে যাচ্ছি। মূল্যবান জিনিসটা যে তুমি ছিলে বাবা।

গাড়ীতে করে শহরের নতুন কলেজে যাচ্ছি। তুমি আমার সাথে আসতে চাইলে কিন্তু বড় একটা সমস্যার কারনে আর পারলে না। মাত্র তিন ঘন্টার রাস্তা, অথচ এই তিন ঘন্টায় প্রায় ত্রিশ বার কল দিলে “কতটুকু আসলাম, আর কতক্ষন, সাবধানে যাবি, গিয়ে আবার ফোন দিবি” আমাকে নিয়ে চিন্তার কোন শেষ নেই তোমার।

কলেজ হোস্টেলে আসার দুইদিন পরই তোমাকে না জানিয়ে ছুটি নিয়ে চলে গেলাম তোমার কাছে। তুমি হঠাৎ আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলে। কতো ভালোবাসা আর মমতা তোমার স্পর্শে সেদিন ভালো করেই বুজেছিলাম।

একটু একটু করে আরো বড় হতে লাগলাম। পড়ালেখায় ব্যস্ত সময় পার করতে লাগলাম। দূরের শহর হয়ে গেলো আমার স্থায়ী ঠিকানা। মাসে একবার তোমাদের কাছে যেতাম। তবে প্রতিদিন মুঠো ফোনে তোমার আর মায়ের সাথে কথা হতো। কিন্তু তোমাদের দেখার জন্য মনটা হাহাকার করতো। তা কখনো বুজতে দিতাম না।

এমন একটা সময় আসলো এতোটা ব্যস্ত হয়ে গেলাম যে ফোনে কথা বলার সময়টুকুও পেতাম না। তুমি কল দিলে বলতাম পরে কথা বলবো। পরে আর নিজে থেকে কল দেয়া হতো না। জানো বাবা, তখন খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম। পড়া-লেখা আর বন্ধুদের আড্ডায় ভুলেই যেতাম তোমাদের কথা।

কলেজ লাইফ শেষ করে ভার্সিটি লাইফে পা রাখলাম। নিজেকে তৈরী করার লক্ষে ছুটতে গিয়ে তোমাদের থেকে কখন যে দূরে সরে গেলাম বুজতেও পারিনি। এক সময় আসলো শুধু টাকার প্রয়োজন হলে কথা বলতাম তোমার সাথে। তোমাদের মনটা ছেলের জন্য কতটা হাহাকার করতো তা বুঝার চেষ্টাও করতাম না তখন। তুমি শুধু ফোনে কথা হলে বলতে, “যাই করিস বাবা, পড়ালেখাটা ঠিক মতো করিস”। তখন এতোটাই স্বার্থপর হয়ে গেলাম তোমার কথা শুনারও প্রয়োজন মনে করতাম না!!

হঠাৎ একদিন,
একটি খবরে সব কিছুই থমকে গেলো। হঠাৎ শুনি তুমি মরন ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। আর অল্প কয়দিন দিন তোমার পৃথিবীতে থাকার অনুমতি আছে।

জানো বাবা, সেদিন পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি তোমার এমন কিছু হয়েছে। ডাঃ যতসব ভুল-বাল রিপোর্ট দিয়েছে হয়তো। তোমাকে নিয়ে পাগলের মতো ছুটতে লাগলাম এদিক সেদিক। কিন্তু সবখানে একই রিপোর্ট। আর নাকি কিছুই করা সম্ভব না।

এমন খবর কি মেনে নেয়া যায় বলো?! কোন ছেলে কি ভাবতে পারে?! তার বাবাটা আর অল্প কিছুদিন পর অজানার দেশে পাড়ি দিবে!! পারে না বাবা, সেদিন আমিও পারিনি। আমি তখনো নিরাশ হইনি। আশার পথে চেয়ে ছিলাম মনে বিশ্বাস নিয়ে। তোমার কিছুই হবে না। আল্লাহ্‌ তোমাকে সুস্থ করে দিবে এই বিশ্বাসটা সব সময় ছিলো।

কিন্তু নাহ, শেষ বিশ্বাসটা একদিন শেষ হয়ে গেলো। অজানার পথে ঠিক পাড়ি দিলে। জানো বাবা, যখন তোমার নীথর দেহটা আমার সামনে পড়ে ছিলো। তখন একটুও কাঁদিনি, একটুও না। সবাই হাউ মাউ করে কেঁদেই চলেছে। অথচ, আমার মুখে কান্নার কোন শব্দ নেই।

তোমার শেষ গোসলটাও আমি করিয়েছি। ছোট বেলায় তুমি আমাকে গোসল করিয়ে দিতে। আর তোমার বিদায় বেলায় গোসল করলাম। কতটা ভাগ্যবান আমি, তাই না বাবা?!

যখন তোমাকে সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে রাখলাম। তখনো মনে হয়নি তুমি আর পৃথিবিতে আসবে না। আমি আর বাবা বলে ডাকলে তুমি আর জবাব দিবে না।

তোমাকে শেষ বিদায় জানিয়ে যখন ঘরে আসলাম। এসেই দেখি মা সাদা শাড়ী পরে বসে আছে। আর মায়ের চারপাশে কত মহিলা বসে আছে। জানো বাবা, মায়ের গায়ে সাদা শাড়িটা দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। তখন হাউ মাউ করে অনেক কেঁদেছি। চিৎকার দিয়ে কেঁদেছি। শুধু তখনই অনুভব হয়েছিলো তুমি আর আসবে না এই ঘরে। তোমার স্থায়ী ঘরে আমিই তো একটু আগে রেখে এসেছি।

বাবা, গলাটা ভারি হয়ে আসছে। চোখ গুলো আবারো ঝাপসা হয়ে গেলো। অনেক কিছু লেখার ছিলো, কিন্তু পারবো না আর কিছু লেখতে। তুমি ভালো থেকো বাবা, তোমার নতুন ভুবনে। আল্লাহ্‌ তোমাকে বেহেস্ত নসীব করুক এই দোয়া করা ছাড়া আর কি বা করার আছে!!

পরিশেষে শুধু এতোটুকু বলবো তুমি এখনো আছো। আমার মাঝেই তুমি বেঁচে আছো, কারন আমি’ই তো বাবা। আমার আত্মায় মিশে আছো তুমি, থাকবে যতদিন আমি আছি এই ধরণীতে!!

ইতি,
তোমার কলিজার টুকরা

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত