প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর ‘হ্যালোইন’ উৎসব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ পশ্চিমের অধিকাংশ দেশেইপালিত হয়। বছরের এই দিনটি নিবেদন করা হয় মৃত, সাধু (হ্যালোজ), শহীদ এবং বিশ্বস্ত বিদেহী বিশ্বাসীদের স্মরণ করে। যে মূল ধারণা বা থিমকে কেন্দ্র করে হ্যালোইন উৎসব উদযাপন করা হয়, তা হলো—‘মৃত্যুকে হাস্যরস ও উপহাসের মাধ্যমে উদযাপন করা’। আগামীকাল হ্যালোইন উৎসব।
মায়া থেকে মেসোপটেমিয়া, মিশর থেকে রোম, প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রগুলো অনেক বদলে গেছে। রাজতন্দ্র ভেঙে এসেছে গণতন্ত্র, নগরের নাম মুছে দিয়েছে শহর। সভ্যতার পালা বদলে মুছে গেছে অজস্র প্রাচীন প্রথা-বিশ্বাস। যে প্রথা বা বিশ্বাস একটি সময়ে একটি সমাজ বা জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছিল অথচ আজকের পৃথিবীতে তা অস্তিত্বহীন। সেই সংখ্যাটিও প্রায় সহস্রাধিক। বিলুপ্ত সেই প্রথা বা বিশ্বাসের হিসাব মেলানোটা বেশ দুরহ। কিন্তু সেই প্রাচীন মায়া, মেসোপটেমিয়া থেকে আজকের আধুনিক নিউইয়র্ক, লন্ডন ও সিউল-এ আজও একটি বিশ্বাস ঘুরছে। ব্রিটিশ সূর্য আজ অস্তমিত, পতন হয়েছে বিশাল সামাজ্রের কিন্তু এতটুকুও বদল হয়নি সেই বিশ্বাসের। অজস্র গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্রে বারবার চির-পুরাতন একটি নাম নতুন আবরনে ফিরে এসেছে। সেই নামটি ভূত।
ভূতের ইংরেজি ঘোস্ট, এই শব্দটি পোর্তো-জার্মিক গেইটাজ শব্দ থেকে এসেছে। শব্দের উৎপাত্ত বিশ্লেষণ আমি করব না। আমার আলোচনার ভূতের বিশ্বাসকে ঘিরে। মজার ব্যাপার হল ভূতে বিশ্বাস এমন একটি প্রাচীন বিশ্বাস, বিশ্বব্যাপী যা আজও সমান প্রতাপে দন্ডায়মান। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ভূতে বিশ্বাস প্রায় সভ্যতার শুরু থেকেই মোটামুটি সবখানেই ছিল এবং এখনো তা প্রায় একই রূপে বিরাজমান। সহজ করে বলতে গেলে বাংলাদেশের একটি মানুষ, ভূত বলতে যা বোঝে এবং যে কারণে ভয় পায়, আমেরিকা, জার্মানি বা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষও ভূত বলতে একই রকমের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে এবং একইভাবে ভয় পায়। আজকের মতো প্রাচীনকালে ভূত বিশ্বাসের ব্যাপারটি প্রায় অভিন্ন ছিল।
মেসোপটেমিয়ানরা বিশ্বাস করত মৃত্যু হলো জীবনের শেষ অধ্যায়। সেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। পরকাল নিয়ে তারা যে রাজত্বগুলো বিশ্বাস করতো তাদের মধ্যে একটি হল ‘ইরকাল্লা’। এই ইরকাল্লার তলদেশ মেসোপটেমিয়ানদের কাছে পরিচিত ছিল ‘না ফেরার দেশ’ নামে। যেখানে মৃতের আত্মা অধিষ্টিত হয় বিষন্ন অন্ধকার, ময়লার বন্ধতায়, মাটির ডোবায় (গিলগামেশে যা বর্ণিত হয়েছে)। যতই মহান বা গরীবানা জীবন পার করে আসা হোক না কেন আত্মার এই অস্তিত্বই ছিল মানব জীবনের শেষ পরিসমাপ্তি। ‘দ্য ডিসেন্ট অব ইনানা’ কবিতায় ইরকাল্লার বিভিন্ন বর্ণনার স্পষ্টতা পাওয়া যায়—একবার স্বর্গের রানী ইনানাকে পৃথিবীতে আরোহনের জন্য তার পরিবর্তিত কাউকে রাজ্য চালনার জন্য খুঁজে বসাতে হয়েছিল। তার বিশেষ বিধানে লেখা ছিলো—আত্মাকে কখনও কখনও অনুমতি দেয়া হয় পৃথিবীতে যাবার জন্য। তবে তা অবশ্যই কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এবং সেই কাজ শেষে তাকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে এই শর্তে।
এই যে বিশেষ শর্তে আত্মারা পৃথিবীতে ফিরে যাবার জন্য অনুমতি পায়, মূলত এখান থেকে মেসোপটেমিয়ানদের ভূত বিশ্বাসের জন্ম। তারা চিন্তা করত যে ভূত তখনই মানুষের সামনে আসবে যখন তার কোন বিশেষ উদ্দেশ্য বা অধিকার আছে।
জীবিত অবস্থায় যাদের মাঝে বিভিন্ন রকম অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতা ছিল তাদের আত্মার বেলাতেই এই ফিরে আসার ব্যাপারটি তারা বিশ্বাস করতো। স্কলার রবাট ডি বিগার, মেসোপটেমিয়ানদর ভূত বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন, ‘মৃত বিশেষত মৃতের সাথে সম্পর্কিত এবং সম্ভবত সমস্যা করে জীবিতের। বিশেষ করে পরিবার থেকে অর্ঘ্য দানের যে দায়িত্ব, তা প্রদানে যদি অবহেলা করা হয় অথবা যার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় বা ঠিকমত শেষক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় না তারাই ভূত রূপে ফিরে এসে জীবিতের বিঘ্ন ঘটাতে চায়। যেমন ডুবে মরা বা যুদ্ধক্ষেত্রে মরা।’
মেসোপটেমিয় সভ্যতায় ডাক্তাররা আসু ও আসিপু নামে পরিচিত ছিল। যারা জাদুমন্ত্র দিয়ে ভূতকে শান্ত করার কাজ করত। কিন্তু এই কাজ শুরুর আগে তারা রোগীর কাছে স্বীকারোক্তি জানতে চাইত যে, এমন কোন পাপ আছে কিনা যা ভূত বা আত্মাকে বিশেষ উদ্দেশ্যে অভ্যন্তরের সেই পৃথিবী থেকে বের করে এনেছে। অবাক করার মত বিষয় হল, অসুস্থতাকে মেসোপেটেমিয়ানরা পাপের বাহ্যিক প্রকাশ বলে গণ্য করত। তাই অসুস্থতার ফলে কারো মৃত্যু হলে তাকেও শাস্তি প্রদান করা হত এবং ভাবা হতো তার শাস্তি বিধান স্বয়ং ঈশ্বর করেছেন।
মেসোপটেমিয়ানদের কাছে আত্মা পরিচিত ছিল গিডিম নামে। তাদের বিশ্বাস ছিলো গিডিম বা আত্মা মৃতের ব্যক্তিগত পরিচয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মৃত্যু ভূমি দিয়ে ভ্রমন করে, যদি মৃত্যুর পর কারো কবর বা শেষকৃত্য সঠিকভাবে সম্পন্ন না হয় অথবা মৃত্যুর সাথে কোন বেআইনী ঘটনা বা অন্যায় জড়িত থাকে তবে গিডিম বা আত্মা ফিরে আসতে পারে পৃথিবীতে। এই বিশেষ উদ্দেশ্যে ফিরে আসা গিডিম বা আত্মাই পরিলক্ষিত হত ভূত হিসাবে। শিলালিপিতে পরিষ্কার বর্ণিত আছে যে, ‘যদিও কখনও কখনও গিডিম মারাত্মকভাবে বিপথগামী হয়ে পৃথিবী ঘুরবে বলে ইরাকাল্লা থেকে বেরিয়ে যায় যেখানে তারা জীবিতের দ্বারা কোন কারণ ছাড়াই হয়রানির শিকার হয়েছিল। তবে বিপথগামী এইসব প্রেতাত্মার শাস্তি হতে পারে সূর্যদেবী ‘শামস’ দ্বারা। আরবি ‘শামস’ শব্দের অর্থ সূর্য। এমনকি, তারা মনে করতো, যাদের পৃথিবীতে মনে করার কেউ নেই ঐসব গিডিমদেরকে সূর্যদেবী তাদের সমাদ্ধিস্থ উপহারসমূহ কেড়ে নিয়ে পুরষ্কৃত করতে পারে । যদিও লিপিবদ্ধ আছে যে, অনেকেই পরকালের সর্তকতা ও উপদেশে নিয়ে ফিরে এসেছে। তবে সাধারণত মেসোপটেমিয়ার ভূতেদেরকে স্বাগত জানানো হত না বরং তাদের ফেরত পাঠান হত তাবিজকবজ, প্রার্থনা বা জাদুমন্ত্রের মাধ্যমে।
অন্যদিকে মিশরীয় সভ্যতায় আত্মার ফিরে আসাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হতো। মিশরীয়দের জন্য অনুপস্থিতি একটি অসহনীয় ধারণা এবং মৃত্যু বিষয়ে এটা বিশ্বাস করা হতো যে— আত্মা সত্যের ঘরে ভ্রমন করে এবং সেখানে ‘ওসিরিস’ দ্বারা তার বিচার হয়। ৪২জন বিচারক দ্বারা শুভ্র সত্যের পালকের সাথে আত্মার ভারসাম্যের পরিমাপ কর হয়। যদি আত্মা পালকের তুলনায় হালকা হয় তবে সেই আত্মাকে পরকালের দিকে যেতে দেওয়া হয় আর যদি আত্মা ভারি হতো তবে তাকে মাটিতে নিক্ষেপ করা হয় এবং একটি দানব সেই আত্মাগুলোকে খেয়ে ফেলতো। মনে করা হতো এভাবেই তার অস্তিত্ব শেষ। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো, কেউ যদি ভালভাবে জীবন ধারণ করে তবে তার আত্মা শুভ্র সত্য পালকের তুলনা হালকা হবে আর খারাপ জীবন যাপনের ফলশ্রুতিতে আত্মা ভারি হয়ে ওঠে।
পরকাল মিশরীয়দের কাছে পরিচিত ছিল নলখগড়ার মাঠ হিসেবে। সেই পরকালের জীবন যন্ত্রনাকাতর ছিল না বরং অনেকাংশেই সেই স্থান যে কারো জন্যই উপভোগ্যই ছিল। কারণ, তারা মনে করতো সেখানে বাড়িগুলোতে জলস্রোত আছে, আছে পছন্দের কুকুর ও গাছ। তাই কোন কারণ নেই যে, আত্মা পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাইবে; যদি না তার খুব প্রয়োজনীয় কিছু করার তাগিদ না থাকে।
মিশরীয় সভ্যতার প্রথমদিকে আত্মাকে বিবেচনা করা হত একটি স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসাবে যা ‘খু’ নামে পরিচিত ছিল। একটি সময় পর্যন্ত স্বতন্ত্র হিসেবে ভাবা হলেও পরবর্তীতে বিশ্বাস করা হতো, আত্মা ৫টি ভিন্ন উপাদান নিয়ে গঠিত। যার দুটি হল ‘বা’ এবং ‘কা’ (আত্মা ও ব্যক্তিত্ব)। তারা মনে করতো কখনো কখনো মৃত্যুর পর এই ‘বা’ ও ‘কা’ একত্রিত হয়ে আখ (Akh) এর আকারে পরিণত হয়। এবং এটা বিশ্বাস করা হতো যে এই ‘বা’ ও ‘কা’ এর মিলিত রূপ ‘আখ’ হল সেই আত্মা যা ভূত রূপে ফিরে আসে।
যদি শেষকৃত্যের আচার অনুষ্ঠান সঠিকভাবে পালন না করা হয় বা কিছু পাপ জীবিতের মৃত্যুর আগে বা পরে সংগঠিত হয়, তখন ঐ আখ (Akh) কে ঈশ্বরের বিধান মতে পাপের প্রতিকার করতে পৃথিবীতে ফেরত আসতে হয়। যে সব জীবিত প্রাণী ভূত দ্বারা হয়রানি হয়, যুক্তিযুক্ত সাড়া পাবার আশায় ঐসব আত্মার কাছে নিজেকে সমর্পন করতে হবে । যদি তাতে কাজ না হয় তবে একজন যাজক এখানে হস্তক্ষেপ করবেন এবং জীবিত ও মৃত্যের মাঝে বিচার করবেন। যার উদাহরন হিসাবে আমরা নিউ কিংডমের কবরে মৃত স্ত্রীর উদ্দেশ্যে লেখা এক বিপত্নীকের চিঠিতে বর্ণিত কাহিনী উল্লেখ করতে পারি। কবরের উপর পাওয়া সেই চিঠিতে লেখা ছিল কিভাবে কখন দুর্ভাগ্য একজন বিপত্নীকের উপর এসে পড়ে। এটা হল তার সেই প্রথম পাপ, যা স্ত্রীর কাছে লুকিয়ে রেখেছিল এবং যা পরবর্তীতে মৃত্যুপুরীতে এসে জানতে পেরেছে এবং এর জন্য তার শাস্তি হয়েছিল।
মিশরীয় সভ্যতায় এই বিশ্বাসেরও প্রচলন ছিল যে— যদি যথেষ্ঠ আচারের সাথে সমাধি হয় এবং নিয়মিত মনে করা হয় তবে আত্মা জীবিতের জন্য অনেক উপকারী হতে পারে এবং সারাজীবন তাদের উপর নজর রাখতে পারে। তবে আত্মার এই জীবিতের জন্য উপকারী হয়ে ওঠার ব্যাপারটিকে জড়িয়ে নানা রকম জটিল বিশ্বাসের প্রচলন ছিল। যদিও মিশরীয়রা বিশ্বাস করত আত্মা শুধুমাত্র তারাই যারা শান্তিপূর্ণ ভাবে মৃত্যুপুরীর নলখগড়ার বনে বাস করে। আর যারা ফিরে আসে পৃথিবীতে তাদের ভূত বলে বিবেচনা করতো।