অধরার একটি বাজে সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটি ঘটে রাতে। বাতি নিভিয়ে সে বিছানায় শুয়ে আছে, হঠাৎ চোখ বুজতেই মনে হবে কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ ঘরে দ্বিতীয় কেউ নেই। চোখ মেলে তাকালেও সে কাউকে দেখে না। অধরার বয়স পনেরো। এই বয়সে এমন সমস্যা রীতিমত ভয়ের উদ্রেক ঘটায়, চাইলেই এটাকে হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ব্যাপারটা নিয়ে কারও সাথে শেয়ার করতে মন চায়। কিন্তু ঘটনাটি মনের ভুল ভেবে সবাই হেসে উড়িয়ে দেবে, এ কারণেই নিজের ভেতরে এটা সে চেপে রেখেছে।
তবে অধরার বয়সটা যেহেতু সংক্রামক, সেহেতু এই বয়সের কোনো কিছুই সচরাচর গোপন থাকে না। কাজেই দেখা গেল অধরার মা অধরার মধ্যে ইতস্তত ভাব লক্ষ্য করলেন কয়দিন ধরে। একদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় অধরার মা দুলারী বললেন, “অধরা.. তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”
অধরা প্রায় বলেই ফেলছিলো রাতে সে কিছু একটার অস্তিত্ব টের পায়। কিন্তু সে নিজেকে সামলালো। বলল, “মা, আজ ফিজিক্সের পড়াটা তেমন ভাল হয়নি। তাই একটু চিন্তিত।”
“না না, তুমি কিছু লুকাচ্ছো।”
অধরা ফ্যাকাসে হাসি দিলো। যে হাসির অর্থ দুলারী জানেন। অধরা আর কিছু বলতে চায় না। দুলারীও তাকে আর ঘাটালেন না। সেদিনই একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটলো। স্কুলে যাবার জন্য অধরা গাড়িতে উঠেছে। গাড়ি কিছুদূর যাবার পর সে লক্ষ্য করলো ড্রাইভিং সীটে কেউ নেই। অথচ গাড়ি চলছে, স্টিয়ারিং ঘুরছে। ড্রাইভার করিম চাচাকে দেখা যাচ্ছে না। ভয়ের দরুন অধরা স্কুলে পৌঁছেও ঠিকমত ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারলো না। তার মনে হল টিফিন পিরিয়ডেই দরখাস্ত লিখে চলে যাবে। অকারণে ক্লাস করে লাভ কী?
কিন্তু টিফিন পিরিয়ডে তার যাওয়া হল না। হঠাৎ তার সামনে ক্লাসমেট বাপ্পি এসে দাঁড়ালো। বলল, “অধরা, একটা কবিতা লিখেছি। কেমন হয়েছে বল তো?”
“তোর বস্তাপচা কবিতা শোনার ইচ্ছে আমার নেই।”
“ও আচ্ছা।”
অধরা দেখলো বাপ্পির চেহারায় অভিমানের ছাপ পড়েছে। তাই দেখে অধরার খারাপই লাগলো। বলল, “ঠিক আছে.. তোর কবিতাটা বল।”
“না থাক। তুই যখন ডিস্টার্ব ফিল করছিস।”
“আসলে একটা ব্যাপারে আমি খুব চিন্তিত।”
“কোন ব্যাপার?”
অধরা খানিকক্ষণ কী ভাবলো। তারপর প্রতিরাতে অবিরত ঘটতে থাকা ঘটনাটি এবং আজ সকালে ড্রাইভারের অদৃশ্য হবার ঘটনা বলল। সব শুনে বাপ্পি বলল, “সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম।”
“কী বলতে চাস?”
“স্কিতজোফ্রেনিয়া হতে পারে। প্যারানয়ার এফেক্টও আছে।”
“প্যারানয়া কী?”
“অলীক কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে ভেবে বসা যে, কেউ আমাকে মারতে চাই—এটাই প্যারানয়া।”
“আমি কখন বললাম, কেউ আমায় মারতে চাই?”
“অবচেতনভাবে তুই এটা ভাবিস তাই এ ধরনের এফেক্ট তোর ওপর পড়েছে।”
“তোর কাছে ব্যাপারটা ডিসকাস করাটাই ভুল হয়েছে।”
“কিন্তু এটাই সত্যি।”
অধরা কিছু বলল না। রেগেমেগে ক্লাসে ঢুকে নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসলো।
সেদিন রাতের বেলা বাপ্পি টেলিফোন করলো অধরাকে।
“হ্যালো।”
“হুম।”
“অধরা, আমি সরি।”
“সরি বলার দরকার নেই।”
“দরকার আছে।”
“আর কিছু বলবি তুই?”
“হ্যা।”
“কী?”
“একটা পাখি চারটা পাখি তিনটা পাখি।”
“মানে?”
“আগামীকাল স্কুলে আয় বলব।”
খট করে ফোন রাখলো বাপ্পি।
পরদিন আর স্কুলে যাওয়া হল না অধরার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে জানলো ড্রাইভার করিম চাচা দেশের বাড়ি যাবার পথে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর স্কুলে অধরার এক প্রিয় ম্যাডাম যখন ক্লাস নিচ্ছিলেন অধরা তখন আবিষ্কার করলো সেই ম্যাডামটিকে সে দেখতে পাচ্ছে না। ঠিক যেমনটি করিম আংকেলের সাথে ঘটেছিলো। অদ্ভূত ব্যাপার, একটা চক শূন্যে ভেসে ব্ল্যাকবোর্ডে আচড় কাটছে। কিন্তু বাস্তবিকই ঘটনা তা নয়। বরং ম্যাডাম হাতে চক নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছেন। অধরা ভয়ের দরুন বলে চলল বিড়বিড় করে, “এটা ভুল! এটা ভুল!”
টিফিন পিরিয়ডে সেদিন বাপ্পি একটা বই অধরার হাতে তুলে দিলো—হুমায়ূন আহমেদের ‘আঙুল কাঁটা জগলু’। অধরা বলল, “বইটা কীসের জন্য?”
“এখানে একটি কথার ব্যাখ্যা দেয়া আছে।”
“কী কথা?”
“একটা পাখি চারটা পাখি তিনটা পাখি।”
অধরার কোনো ভাবান্তর হল না বাপ্পির কথাতে।
সেদিন রাতে ডিনারের সময় দুলারীর কাছ থেকে অধরা জানতে পারলো তাদের স্কুলের একজন শিক্ষিকা মারা গেছেন। ইনি হলেন সেই শিক্ষিকা যাকে ক্লাসে বসে অধরা দেখতে পায়নি। সে নিজেকেই মনে মনে বলতে থাকে, “সামথিং ইজ রং।”
দিনকয়েকের ব্যবধানে অধরা বুঝে যায় মানুষের মৃত্যু অবলোকন করবার একটা ইঙ্গিত সে বরাবরই পেয়ে আসছে। আজ অবধি যাকেই সে চোখের সামনে অদৃশ্য হতে দেখছে পরবর্তীতে সে-ই মারা যাচ্ছে। ব্যাপারটা তাকে ভীষণ পীড়া দিতে থাকে। কেন এমন হবে? কিন্তু ভূতুরে ব্যাপারটি ঘটে চলছিলো অবিরত। এম্নি করে একদিন বাপ্পিও চোখের আড়াল হল।
সেদিন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বাপ্পি অধরাকে দেখে ডাকলো, “অধরা! এই অধরা?”
অদ্ভূত ব্যাপার, অধরা তাকে সেদিন দেখতেই পেল না। বাপ্পি হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। সেরাতেই বাপ্পির রহস্যজনক মৃত্যু হল।
***
ঘুমিয়ে পড়েছিলো অধরা। মাঝরাতে কান্নার শব্দে তার ঘুম ভাঙলো। চেয়ে দেখে অন্ধকারে এক ছায়ামূর্তি তার শয্যাপাশে বসে কাঁদছে। টেবিলল্যাম্প জ্বালতেই অধরা বাপ্পিকে দেখতে পায়।
“তুই?”
“অধরা, জানিস.. আমি স্বাভাবিকভাবে মরিনি। আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে।”
“কারা মেরেছে?”
–
বাপ্পি তার জবাব না দিয়ে জানালা দিয়ে দাঁড়কাক হয়ে উঁড়ে চলে যায়। যাবার আগে বলে যায়, “একটা পাখি চারটা পাখি তিনটা পাখি।”
অধরা, বাপ্পির দেয়া বইটা হাতে তুলে নেয়। সাংকেতিক কথাটির অর্থ মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে সে। পাতা উল্টেপাল্টে পড়তে পড়তে শেষের পাতায় ব্যাখ্যা খুঁজে পায় সে। একটা পাখি হল ইংরেজি শব্দ আই, চারটি পাখি অর্থ লভ এবং তিনটা পাখি অর্থ ইউ। অধরা ঝাপসা চোখে বইয়ের দিকে চেয়ে থেকে বলে, “আই লভ ইউ টু।”
পরদিন সকালে দুলারী চিন্তিতভঙ্গিতে মেয়ের ঘরের দিকে হাঁটা দেন। চিন্তিত হবার কারণ সকাল নয়টা বাজা সত্ত্বেও অধরা ঘর থেকে বের হয়নি। দুলারী দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলে, “অধরা, স্কুলে যাবে না?”
“মা, একটু এদিকে এসো।”
দুলারী এগিয়ে যেতেই অধরা ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখো মা, আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না।”
“কী আবোলতাবোল বকছো? আমি তো দেখতে পাচ্ছি তোমায়।”
“কিন্তু আমি পাচ্ছি না।”
চিন্তার ভাজে জড়িয়ে গেলেন দুলারী। সেরাতে স্বামীর সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলেন তিনি। তার স্বামী বললেন, “ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত।”
অতঃপর একজন মাঝবয়সী সাইকিয়াট্রিস্ট এলেন একদিন বাড়িতে। অধরার ঘরে ঢুকে তিনি দরজা ভিজিয়ে দিলেন। আর বললেন, “শুরু থেকে বলো তোমার যত সমস্যা আছে।”
“এটা কোনো মানসিক সমস্যা নয়।”
“ঘটনাটা না জানলে তো বুঝবো না তোমার সমস্যাটি মেন্টালি কিনা।”
সাইকিয়াট্রিস্টের চাপে অধরা সবই বলল। একেকজন চোখের আড়াল হলেই মৃত্যু কীভাবে অনিবার্য হয়ে ওঠে সবই বলল। তখন সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে অধরা রীতিমত অবাক। তার সামনে যে বসে আছে সে সাইকিয়াট্রিস্ট নন, বাপ্পি! অধরা বলল, “তুই!”
“হ্যা। তোকে নিতে এলাম।”
“বাপ্পি?”
“হুম।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“সবকিছু না বুঝলেও চলে।”
দুলারী অনেকক্ষণ অতিবাহিত হবার পর অধরার ঘরের ভেজানো দরজা খুললেন। যা দেখলেন তার জন্য তার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। দেখলেন, অধরার নিশ্চল দেহ পড়ে আছে বিছানায়। মেঝেতে পড়ে আছে দাঁড়কাকের কিছু পালক।