পুরো গ্রামের মুরুব্বীরা তাকে মেঝোবউ নামেই চিনে। কেননা বাড়ির মেঝো ছেলের সাথেই তার বিয়ে হয়। অন্যরা ডাকে মেঝোকাকি, মেঝোপা, মেঝো ভাবী নামেও। ডাক নাম শানু। গায়ের রং ফর্সা, মাঝারি গড়নের স্বাস্থ্য, খর্বাকৃতি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। একজন আদর্শ জননী, সু-গৃহিনী, বন্ধুসুলভ আর অতিথিপরায়ন নারী। যে কিনা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আজ সবার নয়নের মনি।
নবম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় বিয়ে হয়েছিলো শানুর। বিয়ে মানেই নারীর নতুন করে স্বপ্ন দেখা। নতুন কিছু অনুভুতির সাথে নিজেকে জড়ানো। সংসারের দায়িত্বে নিজেকে বিসর্জন দেওয়া। যৌথ পরিবারে স্বামীর উপার্যন কম হওয়ায় অনেক ধকল যেতো শানুর উপর। যেহেতু তার কৃষক স্বামীর আয় উপার্জন কম তাই দাসী বান্দির মতো সংসারের যাবতীয় কাজ শানুর উপরেই বর্তাতো। একটা সময় সব দেবর ভাসুররা আলাদা হয়ে যায়। শ্বশুর শাশুরীর সেবা যত্নের দায়িত্ব পরে শানুর উপর। যার টাকা নাই তার নাকি শরীর খাটিয়ে মন যোগাতে হয়। জগৎ সংসারে এই নিয়ম কি বহাল আছে এখনো?
নতুন সংসার নতুন জীবন। বিয়ের পর অনেক শখ আহ্লাদের মৃত্যু ঘটেছিলো শানুর জীবনে। তার স্বামীর সামান্য উপার্যনে চার জনের সংসার চলা খুব দুস্কর আর ভীষণ কষ্টসাধ্য। তবুও শানু হাল ছাড়তে নারাজ। বিয়ের সময় তাকে বলে দেওয়া হয়েছিলো স্বামীর ঘর-ই তোমার ঘর। কখনো খেয়ে আবার নাখেয়ে সংসারে জোরাতালি দিয়ে চালিয়েছে। চাইলেও কোনোদিন একটা দামি শাড়ি পড়তে পারেনি শানু। একটা সময় শানুর ঘর আলো করে কোলজুড়ে সন্তান। প্রথম মা হবার অনুভুতি কি হতে পারে শানু তা আজো ভাষায় প্রকাশ করতে পারেনি। কোনো নারীর পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব না। মার্তৃত্ব নাকি নারী জন্মের সার্থকতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। নিজেই নাম পছন্দ করেছিলো সন্তানের জন্যে।
সংসারে নতুন মুখের আহার জোগাতে ব্যস্ত শানু আর মনু দম্পতী। কিন্তু ছোটো বাচ্চাদের জন্যে ভালো পুষ্টিকর খাবার দরকার হলেও তা জোগাতে ব্যর্থ। কখনো ভাতের মার কখনো সস্তা কলের সেমাই আর সর্বশ্রেষ্ঠ ভালো পুষ্টিকর খাবার বলতে অই যে পালের গরুর দুধ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি বাচ্চাটার। বছরে কোনো সময় ১/২ টার উপর নতুন কাপড় শানুর স্বামী দিতে পারেনি। যেখানে পেটের ভাত যোগার করতে হিমশিম খেতে হয় নতুন শাড়ি যেন এক দিবাস্বপ্ন!
এতো কিছুর পরেও শানুর কোনোদিন নামাজ বন্ধ থাকেনি। শানু নিয়মিত কোরান পড়তো। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে অনেক রাতেই তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতো। অভাবের সংসারে খারারের, পোষাকের, ঘুমানোর যায়গার স্বল্পতা ছিলো সত্যি কিন্তু কারুর ই ভালবাসা আর বিশ্বাসের অভাব ছিলোনা। শানু খুব বুদ্ধিমতী ছিলো। নিজেই বাড়তি উপার্জনের আশায় কাথা সেলাই, হাস-মুরগীর খামার ও সবজি বাগান করে চালিয়ে নিতো কিছুটা সংসারের খরচ।
শ্বশুরের সেবায় শানু ছিলো একনিষ্ঠ প্রান। ফজরের নামাজে অজুর পানি গরম করে দেওয়া। শরীর অসুস্থ হলে সেবার কোনো ত্রুটি সে করেনি। শ্বশুরের চোখে শানু ছিলো নয়নের মনি। হাজার কষ্টের মাঝেও কোনোদিন শ্বশুরের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেনি। অনেক রাত গেছে খাবারের স্বল্পতার কারনের নিজে না খেয়ে শ্বশুর কে খাইয়েছে। অন্য ছেলের বউদের সেবাযত্নের আশা ছেড়েই দিয়েছিলো শানুর শ্বশুর। শানু তার শ্বশুর কে নিজের বাবা বলেই মানতো। কখনো শ্বশুর বলে ভাবেনি। এতো যুদ্ধ সংগ্রামের মাঝেও কোনোদিন শ্বশুরের কাপড়ে ময়লা লাগতে দেয়নি। জামা কাপড় নিজ হাতে ধুয়ে দিতেন। পায়ের নখ কেটে দিতেন। হাতে পায়ে তেল মালিশ করেছেন। শরীর অসুস্থ হলে জানপ্রান উজার করে সেবা করতেন। ছেলের বউ নিজের মেয়ের থেকেও এতো আপন হতে পারে তা কখনো ভাবেনি শানুর শ্বশুর।
একটা সময় শানুর শ্বশুর অসুস্থ হয়ে যায়। খুব অসুস্থ, এতোটাই অসুস্থ যে বিছানা থেকে উঠতে পারেনা। সেখানেই শুয়ে বসে পায়খানা প্রসাব করতো। বয়সের ভারে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে মৃতপ্রায় অবস্থা। অন্যান্য ছেলের বউরা একদিন দেখতে এসে শ্বশুরের পায়খানা প্রসাবের দুর্গন্ধে নাক শিটকে বেড়িয়ে গিয়ে আর ফিরেন। শানু শ্বশুরের লুঙ্গী কাপড় পড়িয়ে দিতো। তাতে পায়খান প্রসাব থাকলেও নিজ হাতে সব পরিষ্কার করতো। কোনোদিন সামান্য দুর্গন্ধ তার নাকে লাগেনি। বাবার জন্যে মেয়ে খেদমত করতে গেলে কি কারুর নাকে লাগে? এভাবে হাড়াভাঙা খাটুনি ছয়মাস চলতে থাকে। একদিকে সংসার আরেক দিকে মৃতপ্রায় অসুস্থ শ্বশুর আর ঘরে ছোট বাচ্চা। সব মিলিয়ে শানুর জীবন তখন দুর্বিষহ অবস্থা ।
শানুর শ্বশুর মারা যাবার আগে শানুকে সবার সামনেই বলেন ”বৌমা আমি হয়তো আর বেশি বাচবো না। তোমার সুখের দিন গুলো আমার দেখা হলোনা। আমি আমার জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে আল্লাহর কাছে খাস দিলে দোয়া করলাম আল্লাহ যেন তোমার এই সেবার উত্তম প্রতিদান দেয়। তুমি শুধু আমার ছেলের বৌ না, তুমি আমার মেয়ে হয়ে বাবার সেবা করেছো। একজন মৃত্যু পথ্যাযাত্রীর সেবা করেছো। দোয়া রইলো আজীবন তুমি এর থেকে বেশি সেবা আর সম্মান পাবে। আমার একটা আকুতি আমি যেন শেষ নিশ্বাস টা তোমার সামনে ত্যাগ করি। এই ঘটনার অল্প কয়েকদিন পরেই ঠিক সত্যি ই শানুর শ্বশুর শানুর হাতে সেবারত অবস্থায় হাসিমুখে কলেমা পড়ে মৃত্যুবরন করেন। শানুর শ্বশুর বলেছিলো বৌমা কথা দাও এই সেবা যত্নের ধারাটা তুমি কোনোদিনই বন্ধ রাখবেনা। শানু কথা দিয়েছিলো আর কথা রেখে চলছে এখনো।
দিন বদলেছে, শানুর এখন সুখের সংসার ছেলেরা ভালোই উপার্জন করে। আজ শানুর শ্বশুরের দোয়া কাজে লেগেছে। গ্রামের মুরুব্বিরা নামাজ শেষে মেঝো বউয়ের হাতের পান খেতে আসে। বউঝিরা খোজ নেয়, কেউ শানুর কাছে লাউশাক ডাটাশাক, পুইশাক বিভিন্ন রকম সব্জী নিতে আসে ফ্রিতে। ছোট বড় সবাই আসে তার কাছে গল্প করতে কাথা সেলাই শিখতে আসে। পাড়ার নতুন বৌঝি সবাই আসে মেঝোচাচী শ্বাশুড়ি সাথে দেখা করতে। নানান রকম কাজে কিংবা খোশগল্প করতে একটাই নাম শানু। যার যতো বিপদ আপদ আবদার চাহিদা আছে শানুর কাছে সবাই হাজির। আর শানু আজো তার শ্বশুরের কথা রক্ষা করে চলছে। সেবার দরজা এখনো খোলা শানুর এখন সুখের সংসার। শানুর বিশ্বাস সেবার অপর নাম ধর্ম। আর পর কে আপন করাই নারীর সহজাত বৈশিষ্ট্য ।
সারকথাঃ
এটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। যার চাক্ষুষ সাক্ষী আমি। এখনকার যুগে অনেক ছেলের বৌ’রা শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করত অনিহা বোধ করে। তারা বলে আমি আপনার দাসীবাঁদী কিংবা বাধ্য নই। এই নিয়ে পারিবারিক কলহ আর মানসিক অশান্তিকর গল্প আছে হাজার হাজার। ঘরে অসুস্থ শ্বশুর শ্বাশুড়ি থাকা সত্ত্বেও আলাদা থাকতেই পছন্দ করে। অনেক ছেলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের সাথে মিশেনা। একটা কথা মনে রাখা উচিৎ এক মাঘে শীত যায়না। একটা সময় আসবে যখন সে নিজে শ্বশুর শাশুরি হবে, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে কাতরাবে, কিন্তু দেখার কেউ থাকবেনা। যে যেখানেই থাকুন না কেন মা বাবা শ্বশুর শাশুড়ি সবাই কে যথাসাধ্য সেবা/সাহায্য করুন। মনে রাখবেন যতনে রতন মিলে। যেমন টা মিলেছে শানুর।