গল্পটা ছিলো অহংকারের

গল্পটা ছিলো অহংকারের

সুনিতা প্রথম যেদিন ক্লাসে এসেছিল সেদিন অন্য সবার মত আমিও তাকে স্প্যানিশ ভেবে ভুল করেছিলাম। সুনিতা স্প্যানিশ না হোক, নিদেনপক্ষে কলম্বিয়ান তো হতে পারতো। এমনটা হয়নি। সুনিতা একজন নাক উঁচু দক্ষিণ ভারতীয় ছিল।
উপমহাদেশীয় মেয়েদের ভাব গায়ের রং এর সমানুপাতে পরিবর্তিত হয়। ওর আবার ছিল বাড়তি সুবিধা। সুনিতার চোখ টানা টানা না হলেও সে চোখের গভীরতার জন্য তাকে অনায়াসে দশে সাড়ে আট দিয়ে দেওয়া যায়। নীল চোখের মেয়েদের প্রেমে পড়ে যাওয়াটা যাদের অভ্যাস ছিল, তারা অন্তত সুনিতার কালো চোখের দিকে তাকিয়ে অভ্যাস পরিবর্তনের একটা চেষ্টা করে ফেলতে পারতো। সুনিতা রজনীকান্ত সাহেবের এলাকার লোক হলেও আমরা কখনো তাকে রজনীকান্তের মত কালো সানগ্লাস পড়তে দেখিনি। সে প্রতিদিন খোলা চোখে ভারত মহাসাগরের গভীরতা নিয়ে ক্লাসে আসতো। তাই ঘুম ঘুম ক্লাসগুলোতে সুনিতার চোখে হারিয়ে যাওয়াটা অন্তত আমার কাছে দোষনীয় কিছু মনে হয়নি।
ক্লাসে আমি ছাড়া সুনিতার কাছের কেউ ছিল না। কেরালা থেকে ঢাকা তো খুব একটা বেশি দূরের পথ না, তাই না?? কিন্তু সুনিতার ভূগোল জ্ঞান খুব খারাপ ছিল। তাই ব্রেকের সময়গুলোতে সুনিতাকে তার মতই খাড়া নাকের ডাচ কিংবা বেলজিয়ান ছেলেগুলোর সাথে কফি হাতে বেশি দেখা যেতো। নির্ভাব সহজ সরল এই বাংলাদেশীকে সুনিতার চোখে পড়েনি।
সুনিতার সাথে আমার প্রথম কথা হয় ‘ইনফ্লুইয়েন্সিং অডিয়েন্সেস’ নামের নিদারুণ ঘুমবান্ধব একটি ক্লাসে। বরাবরের মত বিরক্তিকর একটি গ্রুপ প্রজেক্টের কাজে মিস্টার ফার্ন্সেন সুনিতাকে আমার গ্রুপে দিয়ে দিলেন। মিস্টার ফার্ন্সেন হয়তো ভেবেছিলেন, এতে সুনিতার সবিধা হবে। উপমহাদেশীয় লোকজন কী ধরনের খবর শুনতে পছন্দ করেন, এই বিষয়ে আমরা দুইজন মিলে হয়তো বিস্তর গবেষণা করে চমৎকার একটা প্রজেক্ট দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারবো। আর হাজার হলেও ঢাকা থেকে দিল্লী তো খুব একটা দূরের পথ না, তাই না??
সুনিতা আমাকে প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছিল, পাকিস্তানী মনে করে। হায়! হায়! মেয়ে বলে কি? ইতিপূর্বে ছোট ছোট চোখ হওয়ার জন্য ইন্দোনেশিয়ান কেউ কেউ বলেছে। সে অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না হলেও গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু একী হায়?? পাকিস্তানী কেন!! পরিচয় পর্বের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠানোর পর একটা বিশেষ ব্যাপারে আমার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল। সেটা হচ্ছে-সুনিতাকে বাংলাদেশ চেনাতে হবে।
সুনিতার সাথে আমার কিছু ব্যাপারে মিল ছিল। আমার মত সুনিতাও হিন্দী বুঝতে পারে কিন্তু বলতে পারে না। আমি অবশ্য হিন্দী যে বুঝতে পারি, এই ব্যাপারটাও চেপে গিয়েছিলাম। আমাদের কথা হতো অন্য সবার মত ইংরেজিতে। ক্লাসে একদিন এই ব্যাপারটা নিয়ে এক জার্মান ছেলে একটু কৌতূহলী হয়ে ওঠে। জার্মান ওই ছেলের ধারণা ছিল সুনিতা আর আমার ভাষা বোধহয় একই হবে। সে বলেই ফেলে, ‘কী ব্যাপার তোমরা তোমাদের নিজেদের ভাষায় কেন কথা বলছো না? তোমাদের বলিউডের ভাষাটা তো ‘প্রীটি কুল’।
সুনিতা কিছু বলার আগেই আমি বলে ফেললাম, “ক্লাসটা পড়াশুনার জায়গা। নাচ-গানের না। নাচ-গানের সময় হলে হিন্দী আসবে।”
কথাটা বলে ফেলেই বুঝলাম বোকামি হয়েছে। আমি আমার নিজের ভাষা যে বাংলা শুধু এইটুকু বলাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। অযথা অন্য একজনের ভাষাকে কটাক্ষ করে কথা বলা টা ঠিক হয়নি। আমি আর কথা না বাড়িয়ে কাজে ফিরে গেলাম। সুনিতাও কিছু বললো না। পরে ক্লাস ব্রেকের সময় সুনিতা আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি আসলেই হিন্দী জানো না??
আমি উত্তর দিলাম, আসলেই জানিনা।
-আমার তো মনে হয় তুমি ভুল বলছো। তোমার দেশের অধিকাংশ মানুষই হিন্দী জানে। এবং পুরোপুরি হিন্দীভাষী এমনদের সংখ্যাও খুব একটা কম না।
-তোমার এমন ধারণা হওয়ার কারণ কী?
– তুমি হয়তো জানো না, আমি এখানে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে এসেছি। সুইডেনের যে এলাকায় আমার ইউনিভার্সিটি সেখানকার উপমহাদেশীয়’রা খুব ভাল হিন্দী বলতে পারে। সেখানে অনেক হিন্দীভাষী বাংলাদেশীকে দেখেছি আমি।
আমি সুনিতার এই কথার উত্তর দেওয়ার মত তাৎক্ষণিক কিছু পেলাম না। কথাটা সত্যি। প্রবাসী বাংলাদেশী যারা আছেন, তারা সময় অসময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে হিন্দী বলে থাকেন। বিশেষ করে যাদের ব্যবসা আছে তারা। এদিকের অধিকাংশ বাঙ্গালী রেস্তোরাঁর নাম খানিকটা ভারতীয় গোছের। নামগুলো হয় তাজমহল, নাহয় ইন্ডিয়া প্যালেস! দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের উপমহাদেশীয়দের সাথে উঠা বসা, সেই ক্ষেত্রে হিন্দী হচ্ছে ব্যবসার ভাষা। এই সত্যটা আমিও জানি। আমার সামনে কোন বাংলাদেশী চমৎকার হিন্দীতে যখন অন্যান্য উপমহাদেশীয়দের সাথে কথা বলল, তখন অন্য সবার মত আমারও হয়তো মেজাজ চড়ে যায়। কিন্তু এই মানুষগুলোই ক্ষেপে গেলে যখন বাংলায় গালি দেয় কিংবা আবেগতাড়িত হলে সে শুদ্ধ আবেগের ভাষাটা যখন বাংলা হয়, তখন আবার মনটা ভরে যায়।
আমার কেন যে মনে হলো, সুনিতাকে একটা গল্প শোনাতে হবে। আমি একটা গল্প শুরু করলাম।
একবার বাঘ আর ছাগলের মধ্যে সন্ধি হলো। বাঘদের শরীর খারাপ করেছিল। বাঘ হয়ে তো আর বাঘের দুধ খাওয়া যায় না। তাই বাঘ ঠিক করলো তারা এখন থেকে তিনবেলা নিয়ম করে ছাগলের দুধ খাবে। বাঘদের সরকার দলীয় প্রধান নেতা এবং বিরোধী দলীয় বাঘ নেতা একমত হলেন যে, যেকোন মূল্যে ছাগল রক্ষা করতে হবে। এখন থেকে নির্বিচারে ছাগল খাওয়া ব্যান।
এতে ছাগলরাও খুব খুশি হলো। যাক, এখন থেকে মনের আনন্দে এখানে সেখানে ঘাস খাওয়া যাবে। এর বাইরে সময় পেলে উইকেন্ডের দিকে ছাগীকে নিয়ে নদীর ধারে যাওয়া যেতে পারে। নদীর পাড়ের বাতাস স্বাস্থ্যকর, ঘাসগুলিও খেতে চমৎকার।
কিন্তু সমস্যা হলো-আপামর ছাগল সমাজ বাঘ দেখলেই ভয় পায়। বাঘরা যখন তাদের দুধ খাবে সে আশায় ডাক দেয়, তখন তারা উল্টা ঘুরে দৌড় দেয়। বাঘের ডাক মানেই হুংকার, ছাগলরা এমনই ভাবতো। ফলে তাদের ভয়ও কমলো না, বাঘদেরও আর ছাগলের দুধ খাওয়া হলো না।
এই দূরাবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য ঈশ্বর বাঘদের স্বপ্ন দেখালেন। সকল বাঘ একসাথে স্বপ্নাদৃস্ট হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে-যে করেই হোক, তাদের ছাগলদের ভাষা শিখতেই হবে। এতে আরেকটা সুবিধা ছিল, সেটা হলো-ভেড়াদের এবং ছাগলদের ভাষা প্রায় একই। শুধু ভেড়াদের বর্ণমালাটা একটু আলাদা ছিল, এই যা পার্থক্য। তাই ছাগভাষা শেখার সুফল ছিল বহুমুখী এবং অবশ্যই সুদূরপ্রসারী।
অতঃপর বাঘেরা মনের আনন্দে ছাগভাষা শিখতে লাগলো। বলাবাহুল্য,স্বল্পতম সময়ের মাঝে বাঘেরা তাদের হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছিল। কারণ ছাগলের দুধ ছিল খুবই পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্তভাবে বল বৃদ্ধিকারক।
আমি গল্প শেষ করে সুনিতার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বলতো এই গল্প থেকে আমাদের শিক্ষা কী?”
সুনিতা উত্তর দেয়, “কোন শিক্ষা নাই। বাড়াবাড়ি রকমের অবাস্তব গল্প।”
আমি বললাম, “সন্দেহাতীতভাবে এটা একটা অবাস্তব গল্প, এতে আমারও দ্বিমত নাই। কিন্তু এই গল্পের একটা শিক্ষা আছে। শিক্ষাটা হলো- বাঘদেরও ছাগলের দুধ দরকার হতে পারে। সে জন্য তারা ছাগলের ভাষায় ছাগলদের সাথে কথাও বলতে পারে। কিন্তু বাঘ যখন হুংকার দেয়, তখন সেটা সে তার নিজের ভাষাতেই দেয়। ছাগলের ভাষায় হুংকার সম্ভব না।”
সুনিতা বলে,”এই গল্পের সাথে আমাদের সাথে আমাদের আলোচনার বিষয় কিভাবে সম্পর্কিত?”
আমি উত্তর বললাম, “ওই যে তুমি হিন্দীভাষী বাংলাদেশীদের কথা বললে, সে জন্য বলা। তোমার হয়তো ধারনা-যেসব বাংলাদেশী হিন্দীতে কথা বলছে, তারা বহুকাল ধরে আবহমান এই উপমহাদেশীয় বলয়ে থাকায় এখন তাদের ভাষা হয়ে গিয়েছে হিন্দী। ব্যাপারটা এমন না। এই ক্ষেত্রে হিন্দী বলাটা নিছক ব্যবসা প্রসারের একটা কৌশল ছাড়া আর কিছু না। অনেকটাই বাঘদের ছাগলের ভাষায় কথা বলার মত। বাঘদের দুধ দরকার আর ধূর্ত বাংলাদেশীদের টাকা।”
আমার অবাস্তব গল্প সুনিতা কতটা বিশ্বাস করেছিল, সেটা আমার জানা জানা হয়নি। তবে সুনিতাকে আমি পরে, যেচে পড়ে কিছু তথ্য দিয়েছিলাম। ওকে জানিয়েছিলাম যে ভাষাটায় আমি কথা বলি, সেটা ভাষাভাষী জনসংখ্যার হিসাবে পৃথিবীতে চতুর্থ। পৃথিবীর অভিজাত অনেক ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। আমাদের নিজেদের একটা বর্ণমালা আছে। এবং গঠনতন্ত্রের দিক থেকে আমার ভাষাটাকে ধরা হয়, পৃথিবীর অন্যতম সুগঠিত একটি ভাষা হিসেবে।
আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই ভাষাটা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যাকে অন্য একটি দেশ ভালোবেসে তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে। তুমি যদি ‘সিয়েরা লিওন’ নামের পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটায় কখনো যাও, তাহলে দেখবে সেখানের রাস্তাগুলোর নাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা।
অতঃপর…
সুনিতা আমাদের ক্লাসে তিনমাস ছিল। এই তিনমাস তার সাথে আমার বিশেষ কোন কথা হয়নি। সুনিতাকে আমি প্রথম দিকে নাক উঁচু দক্ষিণ ভারতীয় বলেছিলাম। আমার মনে হয় শেষের দিকে আমার সম্পর্কেও সুনিতা ঠিক এমন ধারণাই পোষণ করতো।
আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত