কোনো এক বিকেলে খোলা মাঠের কোণে থাকা পুকুরপাড় বসে আছে রফি।পাশে রাখা সিগারেট এবং নেশাযুক্ত কোকের বোতল।
আনমনে সে পুকুরের দিকে চেয়ে থেকে সিগারেটের সাথে কোক পান করছে।মূল্যবান জীবন যেন অযথা নষ্ট করতে ব্যস্ত।
এরূপ সময় পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো ইমন সাহেব।ব্যাপারটা তাঁর চোখ এড়ায়নি।সামনে এভাবে একজনের অধঃপতন দেখে ইমন সাহেব চুপ থাকতে পারলেন না।এগিয়ে গিয়ে নরম স্বরে বললেন “যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা বলার ছিলো?”
রফি পেছন ফিরে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জবাবে বললো “জ্বি বলুন?”
– সিগারেট,বিষ পান করার চেয়ে কম কিছু নয়।তাই অনুগ্রহ করে এভাবে জিবনটা শেষ করবেন না।
– দশ বছর যাবৎ পাণ করছি ভাই,যদি এমন হতো তবে সেই কবে উপর ওয়ালার কাছে চলে যেতাম।
– কি আছে সিগারেটের মাঝে!
– বেদনা ভুলে থাকার স্বল্প ঔষধ।
– বেদনার কারণটা জানতে পারি?
– সে অনেক কথা।
– শুনতে পারলে ভালো লাগবে।
– আমি তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি।বাবা মা এবং ভাই নিয়ে আমাদের ছোট্ট পরিবার।খুব সুখে কাটছিলো দিনগুলো।কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেলো যেদিন বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোথাও বেড়াতে যাবে।মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করায় মাও সম্মতি জানান।বড় ভাইয়ের জোরাজুরিতে পরেরদিনি তাঁরা সকাল সকাল বেরিয়ে পরে।পরীক্ষা থাকার কারণে আমায় রেখে যায়।আমিও জেদ করিনি,কারণ লেখাপড়া তখন আমার কাছে সবকিছু।
কথা গুলো বলার সাথে রফি সিগারেট টেনে চলেছে।এরূপ আচরণে ইমন সাহেব সাই না দিয়ে বললেন “অনুগ্রহ করে সিগারেট ফেলে বললে হয়তো বেশী ভালো হতো।”
রফি কিছুটা লজ্জিত প্রকাশ করে সিগারেট ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন “পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে এক বড় ধরণের ধাক্কা খাই।এটা কোনো শারীরিক ধাক্কা নয়,ছিলো মানসিক ধাক্কা।উঠানে বাবা মা এবং বড় ভাইয়ের লাশ,তাদের ঘিরে শত মানুষ দাঁড়িয়ে।আমায় দেখে বড় কাকা এগিয়ে এলেন।নির্বাক স্রোতার ন্যায় আমার তখন চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরানো ছাড়া কিছু করার ছিলো না।সবাই বলাবলি করছিলো এক্সিডেন্টে তাদের মৃত্যু হয়েছে।”
কথাগুলো ইমন সাহেব শুনে বুকের মাঝে এক চাপা ব্যথা অনুভব করলেন।তারপর নিজেকে কোনোভাবে সামলে পরে কি হলো জানতে চাইলেন।
রফি হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললো “বাবা মা ছাড়া যে জীবন কতটা তুচ্ছ তা বুঝতে পারি তাদের মৃত্যুর দুদিন পর।অনাথ ভেবে আশ্রয় দিয়েছিলেন বড় কাকা।কিন্তু কাকী তা মেনে নিতে পারেনি।অঢেল অত্যাচারের পর বুদ্ধিমত্তার সাথে হঠাৎ একদিন কাকাকে দিয়ে অপমান করিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।অপবাদ ছিলো,আমি কাকীর দিকে খারাপ নজর দিই।যখন বয়স সবেমাত্র পনের।
মাথার নিচে ছাদ হারানোর পর দিশেহারা হয়ে যাই।সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন রূপ নেয় বাস হেল্পারিতে।সারাদিন এই শহর থেকে ওই শহরে দৌড়ে যা টাকা পেতাম তাতে কোনো মতে খেতে পেতাম।এর মাঝে এলোমেলো জিবনে স্বল্প সময়ের জন্য আসে নিধী।কতো স্বপ্ন,কতো আশা,অন্তহীন ভালবাসা দিয়ে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যাওয়া হাসি আবার ফিরিয়ে দেয়।নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়।”
ইমন সাহেব কথাগুলো মন দিয়ে শুনে,রফির থেমে যাওয়া দেখে বলেন “তারপর!”
রফি জোরে হেসে বলে “ছলনা করে বড়লোক ঘরে পারি জমিয়েছে।রেখে গেছে এই নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া।কি করবো!একবারে তো পারিনা,তাই ধীরে ধীরে জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছি।”
ইমন সাহেব কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বললেন “ভাই এই পৃথিবীতে কেউ সার্থপর কেউ বা বিশ্বাসঘাতক,তাই বলে নিজেকে শেষ করে দিতে হবে!কি লাভ তাতে!এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহ্কে একবার স্বরণ করে দেখেন।তাঁর দেখানো পথে চলেন।কোথাও গিয়ে ঠিক শান্তি খুঁজে পাবেন।”
– হয়তো বা।
– হয়তো বা নয়,পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সুখ সবার উপভোগে থাকেনা।নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া দিয়ে কষ্ট ভুলে থাকার অনেক তো চেষ্টা করেছেন একবার আল্লাহ্র কাছে তওবা করে নতুন ভাবে শুরু করে দেখুন কষ্ট গুলো মরিচিকা হয় কি না।
– চেষ্টা করে দেখবো।
– চেষ্টা না ভাই,প্রথমে আল্লাহ্র ওপর বিশ্বাস রাখুন তারপর নিজের ওপর ইনশাল্লাহ যেকোনো কিছু সম্ভব হবে।
রফি কিছুসময় ভেবে বললো “সত্যি বলতে আপনার সাথে কথে বলে মন অনেকটা হালকা হয়েছে।আবার আগের মতন অন্তঃ বিশ্বাস ফিরে এসেছে।অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই আপনায়।”
ইমন সাহেব মুচকি হাসির সাথে বললেন “স্বাগতম,মাগরিবের সময় হয়ে এসেছে।আশাকরি আপনায় মসজিদে পাবো।”
রফি “হ্যা” সূচক মাথা নাড়িয়ে সিগারেট এবং কোকের বোতল পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেয়।
ব্যাপারটায় ইমন সাহেব খুশি হয়ে চলে গেলেন।
.
সন্ধ্যা নেমে আসতে রফি মসজিদের দিকে পা বাড়ায়।
তারপর ওযু করে আল্লাহ্র কাছে সব ভুলের ক্ষমা চেয়ে নেয়।
এর মাঝে ইমন সাহেব মসজিদে এসে উপস্থিত হলেন।সেখানে রফির দেখা পেয়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে বাহবা জানালেন।
অতঃপর মাগরিবের আযান শুনে একসাথে নামাজও আদায় করলেন।
নিমেষে রফি মনে শান্তিময় শীতল হাওয়া বয়ে গেলো।যেটার খোঁজে সে ব্যাকুল হয়ে আছে।
বাড়ি ফিরবার পথে রফির উদ্দেশ্য করে ইমন সাহেব বললেন “আপনার নাম ঠিকানা কিন্তু জানা হয়নি।”
– নাম রফি,ঠিকানা বলতে বাস স্টান্ডে থাকা যেকোনো একটি বাস।
– বাসা নেই?
– আছে,কাকাদের দখলে।
– ওহ্,একটা কথা বলবো?
– জ্বি,অবশ্যই।
– আপনি চাইলে আমার বাসায় থাকতে পারেন।ছোট্ট দুই ছেলে এবং এক বোন ছাড়া আমারো কেউ নেই।
– কিন্তু!
– আমি বুঝতে পারছি।বাজারে বড় একটি দোকান রয়েছে আমার।আপনি আমায় সাহায্য করলে মন্দ হবেনা।ভাইয়ের মতন নাহয় থাকবো দুজন।আপনার সত্যতা এবং নিষ্ঠা আমার ভালো লেগেছে।
– আপনার ঋণ আমি শোধ করবো কি করে!
– কাল রমজান মাসের প্রথম দিন।অনেক বাজার করতে হবে চলুন।
অতঃপর রফি ইমন সাহেবের সাথে গেলেন।তাঁর মাঝে যেনো খুঁজে পেলো হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইয়ের ভালবাসা।
রমজান মাসে ত্রিশটা রোজা এবং আল্লাহ্র পথে চলার মধ্য দিয়ে কখন সিগারেটের সাথে বেদনা গুলো হারিয়ে গেছে,রফির অজানা।
জীবন মোড় নিয়ে,আল্লাহ্র পথ এবং ইমানের সাথে বড় ভাইয়ের ব্যাবসা যেনো তাঁর জীবন অতিবাহিত এক মূল মন্তব্য।
যা ইমন সাহেবের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।সে বুঝতে পারে “তাঁর ছোটো বোনের জন্য রফি ঠিক উপযুক্ত।”
তাই ইমন সাহেব তাঁর ছোটো বোনের থেকে অনুমতি নিয়ে রফির কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখে।
রফি না বলতে পারেনি।
যে তাকে বাঁচতে শিখিয়েছে,তাকে কি করে না বলা সম্ভব!
……………………………………….<সমাপ্ত>………………………………………