মানুষ পৃথিবীতে চিরদিন থাকতে আসেনি।
মৃত্যুর সিড়ি বেয়ে একদিন সবাইকে পরোপারে চলে যেতে হবে।
এ পৃথিবী মূলতঃ পরোকালের কর্মক্ষেত্র।
মহান স্রষ্টা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য, কে ভালো কাজ করে আর কে মন্দ কাজ করে তা যাচাই করার জন্য।
কোন মানুষ ভালো কাজ করলে যেমন তার ভালো ফল প্রাপ্ত হয়, তেমনি মন্দ কাজ করলে মন্দ ফল প্রাপ্ত হয়।
পৃথিবীতে তাকে ভালো বা মন্দের কর্মফল দেয়া হয় যতটুকু,তা সীমিত।
কিন্তু মৃত্যু পরবর্তী জীবনে যে কর্মফল দেয়া হবে তা অফুরন্ত।
পার্থিব প্রতিদান দেয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার,তা হলো- সৎকাজে উৎসাহ দেয়া এবং অসৎ কর্মে নিরুৎসাহিত করা।
যাতে করে পার্থিব জীবনে মানুষ সতর্ক হয় এবং সঠিক পথে কর্ম সম্পাদনে সচেষ্ট হয়।
অথচ নাদান মানুষগুলো পরোকাল বিস্মৃত হয়ে পার্থিব জগতে তন্ময় হয়ে আছে।
মৃত্যুর দূতের আগমনেই একমাত্র এ নিদ্রা ভাঙ্গবে।
রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার মধ্যবর্তী ছোট একটি গ্রাম,দাদপুর।
এ গ্রামেই বসবাস করে তায়্যেব ইউসুফ।
তার ছোট একটা পরিবার, সেখানে রয়েছে
তার স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে।
এক ভাই, পাঁচ বোন।
ভাই বোনেরা পৃথক হয়ে পড়ে পিতার মৃত্যুর পরপরই।
বাবা- মা কেউ-ই বেঁচে নেই।
তায়্যেব ইউসুফ শৈশব হতেই ধর্মানুরাগী।
বাবার কড়া সাশনে প্রতিপালিত হওয়ায় ছোট থেকেই সে ন্যায় -নীতিপরায়ন।
সে যেমন সাহসী, তেমনি বলশালী।
বাবার কাজের পাশাপাশি সে পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন,পরম উৎসাহ নিয়ে।
ধর্মানুরাগ ও জ্ঞানের কল্যানে সে হয়ে উঠে দয়ালু,বিনম্র ও ধৈর্যশীল মহৎ গুণের অধিকারী।
সে যেমন অন্যায় কাজ করতোনা, তেমনি অন্যায় কে প্রশ্রয়ও দিতনা।
তাদের দিন ভালো ভাবেই যাচ্ছিল।
কিন্তু সষ্টা সময়ে সময়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন,তাকে যোগ্য করে তোলার জন্য।
তায়্যেবের ন্যায় পরায়নতার কারনে সমাজের কিছু ভাইরাস তাদের অন্যায় অপকর্মে স্বাধীন হতে পারছিলনা।
তাই তারা তার সাথে হিংসা ও শত্রুতা করতে লাগলো।
আবার স্বার্থপর চাচাতো ভায়েরা ও অন্যায় স্বার্থসিদ্ধি করার সুযোগ হতে বঞ্চিত হওয়ায় নানা ভাবে জুলুম-অত্যাচার করতো।
কিন্তু স্রষ্টার প্রতি তার অগাধ ভক্তি – ভরসা ও পরম ধৈর্য তাকে সমস্ত প্রতিকুলতায় শক্তি ও সাহস যোগাত।
সমাজের মোড়লের অন্যায় বিচারের প্রতিবাদ করায় তাকে একঘোরে করে রাখা হয়েছিল।
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।
তিন মাসেরও বেশি সে আটকাদেশ বহাল থাকেনি।
বরং এ ঘটনার পর সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তছনছ হয়ে পড়ে,মোড়ল তার মড়োলিপনা হারায় চিরতরে।
একদিনের ঘটনা, তায়্যেব ইউসুফ তার তালগাছ পরিষ্কার করার জন্য একজন শ্রমিককে কাজে নেয়।
তো ঘটনা ক্রমে শ্রমিকটা গাছের ডাল ফেলে পার্শ্ববর্তী এক কৃষকের ফসল নষ্ট করে এবং কৃষকের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে উভয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয়।
মারামারিতে শ্রমিক আহত হলে
তাদের বিচার কালে মোড়লরা তায়্যেবকে জরিমানা করে।
আসলে যদি ফসলের ক্ষতিপূরণ চাইতো, তায়্যেব কোন প্রতিবাদ করতোনা ; কিন্তু মারলো একজন আর জরিমানা দেবে সে, এমন অসম বিচার সে কেন মানবে!
সেদিন বিচার মজলিশে তায়্যেবকে অপমান ও লাঞ্ছিত করা হয়।
সে ছিল মনোঃখুন্ন হয়ে আল্লহর প্রতি ভরসা করে চরম ধৈর্য ধরে।
অপরদিকে মড়োল ও তার সভাসদ গন ছিল পাশবিক চেতনায় উদ্জীবিত, হিংসা প্রবৃত্তির মোহে।
আল্লাহ পাক চক্রান্ত কারীর চেয়ে বড় কৌশলী।
প্রায় মাস খানেক পরের ঘটনা, দৈবক্রমে মোড়লের ছোট ভায়ের স্ত্রী হোছট খেয়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলো।
দলে দলে লোকজন আসছে মৃত মহিলাকে দেখতে।
তায়্যেব ও গেল শোকাতুর মানুষদের সান্তনা দিতে।
সে লক্ষ করলো,মাস খানেক আগে যারা তার বিচারের সময় পাশবিক গুপ্ত উল্লাসে মত্ত ছিল, আজ সবাই ঐ মজলিসে উপবিষ্ট; কিন্তু সবার মাথা নত,মলিন মুখ সবার।
তায়্যেব সেদিনের খোদায়ী কর্ম প্রতিফল দেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো।
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে বিশ্ব যখন তীব্র খরা,ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়া প্রভৃতি পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, দাদপুর গ্রামেও তখন তীব্র পানি সঙ্কট।
বরেন্দ্র বহুমুখী প্রকল্প খাবার পানির সঙ্কট নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নেয়।
সরকারী সহায়তায় তারা ট্যাপ কল সেবা প্রদান শুরু করেন।
গভীর নলকুপের সাথে পানির ট্যাংক স্থাপন করে সমস্ত গ্রামে খাবার পানি সরবরাহ করে থাকেন।
দাদপুর গ্রামে ও তেমনি একটা সুযোগ আসে।
কিন্তু ট্যাংক স্থাপনের জন্য কেউ জমি ওয়াকফ করতে রাজি হয়না।
সবাই মিলে তায়্যেবকে জমি দিতে বলে।
সে তার ছেলের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করে।
যেমন বাবা, তেমন ছেলে।
তারা সানন্দে রাজি হয়ে যায়।
কথা ছিল সে অর্ধেক জমি দিবে, আর বাকি অর্ধেক দিবে অন্যজন।
অথচ তারা শেষ পর্যন্ত চক্রান্ত করে কেউ ই জমি দেইনি।
এমন কি একজনের জমির নিচ দিয়ে পাইপ আসবে, সেজন্য ৪,০০০/- টাকা নেয়।
সবাই বলে, তায়্যেব ঠকে গেল।
তার ছেলে তাকে সান্তনা দেয়,” বাবা চিন্তা করোনা,আল্লাহ পাক আমাদের কে সদকায়ে জারিয়ার মর্যাদা নসীব করেছেন।”
” দেখো বাবা! আল্লাহ পাক আমাদের জন্য এটাকে হাউজে কাউসার হিসেবে হাদিয়া দিয়েছেন।”
ছেলের কথায় তায়্যেবের মন আনন্দে ভরে যায়।
আল্লাহ পাক তার ছেলের কথাকেই সত্যে পরিনত করলেন।
ট্যাপ ড্রাইভার স্বেচ্ছায় স্বপ্রনোদিত ভাবে একদিন তাকে বলে, ” চাচা আপনি গ্রামের মানুষের এতবড় উপকার করলেন! আমি যতদিন এ কাজে থাকবো আপনার কাছে এক টাকাও বিল নেবোনা।”
বাস্তবিক, প্রতিটি পরিবারে যেখানে প্রায় ২০০/- টাকা করে বিল দিতে হয়,সেখানে তাদের কিছুই দিতে হয়না।
এ যেন দুনিয়াতেই হাউজে কাউছার।
আজ অনেকদিন হয়ে গেল, যে গ্রামবাসী একদিন তাদের প্রতি শত্রুতা করতো,যারা তাদের সমাজে আটক করেছিল।
আজ তারাই তায়্যেব ও তার সন্তানকে নিজেদের ধর্মীয় আহবায়ক ও নেতা বানিয়েছে।
তায়্যেব ইউসুফ গ্রামের জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন হয়ে আল্লাহর উত্তম বান্দা হওয়ার তাওফিক পেয়েছে।
আর তার ছেলে উক্ত মসজিদে ইমাম হিসেবে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করছে।
যুগে যুগে তায়্যেবদের কে মহান আল্লাহ এভাবেই ভালো কর্মফল প্রদান করে থাকেন।
তিনিই একমাত্র প্রতিদান দিবসের মালিক।
তাঁর উপরেই আমাদের ভরসা করা উচিৎ।
গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প