প্রাচীনকালের কাহিনী। এক বাদশা ছিল বেশ বুদ্ধিমান তবে একটু কঠোর। তার ছিল বহু চাকর বাকর। চাকরদের ওপর কিছুটা অত্যাচারই করতো রাজা। এই অত্যাচার এক বুদ্ধিমান চাকরের ভালো লাগতো না। এক রাতে তাই সে পালিয়ে গেল প্রাসাদ থেকে। কিন্তু কতদূর যাবে সে। প্রাসাদের চারদিকেই তো প্রহরীরা পাহারা দেয় রাতদিন। রাজার সেপাইদের হাতে যাতে ধরা না পড়ে সে কারণে ওই গোলাম নিরাপদ একটা জায়গায় গিয়ে লুকালো।
অল্প সময়ের মধ্যেই রাজার কানে খবরটা চলে গেল। রাজা ভীষণ ক্ষেপে গেছে এ খবর শুনে। তাই আদেশ দিলো সেপাইদের একটা দল যেন ওই গোলামকে খুঁজে বের করে তার সামনে হাজির করে। বাদশার প্রধান উজির বা মন্ত্রী আগে থেকেই এই গোলামটাকে সহ্য করতে পারতো না। ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল তার সাথে। তাই পলাতক গোলামকে খুঁজে বের করার জন্য যাদের ওপর দায়িত্ব পড়লো তাদের পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণভার মন্ত্রী নিজের হাতে নিলো। শহরের চার কোণে চারজন কমাণ্ডারকে পাঠালো কিছু সেপাইসহ। বলে দিলো কোনোভাবেই যেন গোলাম পালাতে না পারে। গোলামকে যে করেই হোক ধরে আনতে হবে। ধূর্ত এই মন্ত্রী জানতো, যদি কোনোভাবে ওই গোলামকে ধরে আনা যায় তাহলে তাকে হত্যা করার ব্যাপারে সহজেই বাদশাহকে রাজি করা যাবে। কেননা সবাই জানে বাদশা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল যে তার খেদমত করার কাজ ছেড়ে কেউ পালাবার চেষ্টা করলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। আর সেটাই যদি হয় তাহলে তার চোখের বালি বা পথের কাঁটা দূর হয়ে যাবে। এই ভেবে প্রধান উজির এই গোলামের পালানোর কারণে মনে মনে খুশিই হলো।
কিন্তু কেন উজির এত খুশি? কারণটা হলো এই গোলাম ছিল যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। বাদশার উপস্থিতিতে এই গোলাম বহুবার কঠিন অনেক সমস্যার সমাধান দিয়েছে যেটা প্রধান উজিরের পক্ষে সম্ভব হয় নি। এতে করে উজির খুবই লজ্জা পেয়েছে এমনকি একটা গোলামের কাছে তুচ্ছ বলে প্রমাণিত হয়েছে। অপরদিকে গোলামের মাথা উঁচু হয়েছে সবার সামনে। এইসব কারণে উজির মনে মনে এই গোলামকে সহ্য করতে পারতো না এবং সবসময় তার মৃত্যু কামনা করতো।
উজির তাই একটু বেশি আগ্রহের সাথে খোঁজাখুঁজির কাজে লাগলো। তার বাহিনী তন্ন তন্ন করে পুরো শহর খুঁজে বেড়ালো এবং শেষ পর্যন্ত পেয়েও গেল গোলামকে। মহা আনন্দের সাথে বেচারা গোলামকে হাজির করলো বাদশার সামনে। বাদশা কিন্তু অনেক আগে থেকেই জানতো এই গোলোমের সাথে তার উজিরের একটা রেষারেষি আছে। বিশেষ করে উজির চায় গোলামকে মেরে ফেলতে। বাদশা তাই উজিরের দিক ফিরে তাকে জিজ্ঞেস করলো: হে উজিরে আজম! তোমার মতে এই গোলামের কী শাস্তি হওয়া উচিত? তার সচেতনতা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য তাকে ছেড়ে দেবো মানে মাফ করে দেবো নাকি জল্লাদকে বলবো মাথাটা কেটে ফেলতে?
উজির আনন্দের সঙ্গে বললো: সে প্রাসাদের নিয়ম শৃঙ্ক্ষলা ভঙ্গ করে যে মারাত্মক কাজ করেছে মৃত্যু ছাড়া তার আর কোনো শাস্তি হতে পারে না। আপনিও আগেভাগেই প্রাসাদের সকল চাকরের উদ্দেশে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, কেউ যদি কখনো পালাবার চেষ্টা করে তাহলে তার মৃত্যু অবধারিত। এই গোলাম আপনার সেই হুঁশিয়ারির কথা জানার পরও পালিয়েছে। তার মানে সে নিজেও মৃত্যুবরণ করতে রাজি। আপনি যদি এখন তাকে হত্যা করার আদেশ দেন তাহলে অন্যান্য গোলামেরও উচিত শিক্ষা হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে তারাও আর কোনোদিন পালাবার চেষ্টা করবে না।
বাদশা কিন্তু এই বুদ্ধিমান এবং সচেতন গোলামকে মন থেকেই মারতে চাচ্ছিল না। কিন্তু উজিরের পরামর্শ শুনে এখন জল্লাদের দিকে তাকিয়ে হত্যার ইঙ্গিত দিলো। বাদশা আসলে চাচ্ছিলো মৃত্যুর ইশারা দেওয়ার পর গোলামের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা দেখতে।
গোলাম মৃত্যুর ফরমান শুনে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে উঠলো। তারপর বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো উজিরের দিকে। তারপর একটু সামনেএগিয়ে গিয়ে বাদশাকেবললো: হে বাদশা! আমি তোমার অনেক নিমক খেয়েছি। আমি চাই না খামোখা আমাকে হত্যার দায়ভার তোমার গর্দানে চাপুক আর পরকালে তোমাকে আল্লাহ জিজ্ঞেস করে: কেন একজন নিদোর্ষ গোলামকে হত্যা করেছিস? এই হত্যার কারণে তোমাকে শাস্তি দিক সেটা আমি কামনা করি না। একথা শুনে বাদশাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো: তার মানে তুই নিদোর্ষ?
গোলাম বললো: হ্যাঁ! অবশ্যই আমি নিদোর্ষ। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বাদশাহ বললো: বাদশার সেবা না করে পালানোর চেয়ে আর বড় অপরাধ কী আছে?
গোলাম বললো: হ্যাঁ! তা ঠিক। পালানোটা মস্ত বড় অপরাধ এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তবে আমি তোমার দৃষ্টিতে এবং তোমার উজিরের দৃষ্টিতে অপরাধী। কিন্তু আল্লাহর দরবারে অপরাধী নই। কেননা আমি এমন কোনো কাজ করি নি যে কাজের জন্য আল্লাহ আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবে। পালাতে চেয়েছি স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য। আল্লাহর দরবারে এটা তো কোনো অপরাধ নয়। আমি নিজেও মনে করি আমার কোনো অপরাধ নেই। সুতরাং আমাকে হত্যা করা হলে ওই হত্যার দায়ভার তোমার ঘাড়েই চাপবে। পরকালে এই হত্যার জন্য অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে তোমাকে।
গোলামের কথা শুনে বাদশাহ বুঝতে পারলো যে তার মাথায় কোনো একটা প্লান আছে। বাদশা গোলামকে তার প্লান নিয়ে অগ্রসর হয়ে যাবার সুযোগ দিলো। সে কারণে বললো: ঠিকাছে! মেনে নিলাম তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমারও তো অধিকার আছে ভুল করলে শাস্তি দেওয়ার,নাকি? আর আমার দৃষ্টিতে তুমি একজন অপরাধী। কেননা তুমি জানতে যে আমি হুঁশিয়ার করেছিলাম: কেউ যদি পালাবার চেষ্টা করে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। ঠিক না?
গোলাম ঠাণ্ডা মাথায় জবাব দিলো: হ্যাঁ! ঠিক। আমি জানতাম এবং সে কারণেই আমি চাই তুমি তোমার সিদ্ধান্ত থেকে এক পাও সরে না যাও! এটা তোমার অধিকার। তবে আমাকে হত্যা করার পেছনে একটা যৌক্তিক এবং সুস্পষ্ট কারণ দাঁড় করানো উচিত। যে কারণটা আল্লাহর সামনে পেশ করে বলতে পারবে এ কারণে তাকে হত্যা করেছি এবং তাতে আল্লাহও সন্তুষ্ট হবেন সেইসাথে আমাকেও তুমি….
বাদশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো: যৌক্তিক কারণ! তোমার দৃষ্টিতে এমন কী যৌক্তিক কারণ দাঁড় করানো যাবে যে কারণে তোমাকেও হত্যা করা যাবে আবার হত্যার দায়ভারও আমার ঘাড়ে চাপবে না?
গোলাম বললো: এটা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার না। আমার ওপর এর দায়িত্ব ছেড়ে দাও! আমি চিন্তাভাবনা করে এই সপক্ষে যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করবো। এমন যুক্তি দেব যার ওপরে আর কোনো যুক্তিই হতে পারে না। এমন যুক্তি খুঁজে বের করবো যে যুক্তি দিয়ে সবাই আমাকে হত্যা করা যথার্থ বলে মনে করে।
বাদশাহ বাহ্যত বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বললো: এতো প্যাঁচানোর দরকার নেই। তাড়াতাড়ি বলো কোন যুক্তিতে তোমাকে হত্যা করা বৈধ বলে গণ্য হতে পারে?
গোলাম বললো: হে মহান বাদশাহ! জ্ঞানী বাদশাহ! তুমি আমাকে তোমার এই উজিরকে হত্যা করার অনুমতি দাও!
বাদশাহ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো: উজিরে আজমকে হত্যা করবে? কিন্তু কেন?
উজির বিরক্ত হয়ে গোলামের দিকে তাকালো এবং রেগেমেগে নিজের ঠোঁট কামড়াতে শুরু করলো।
গোলাম বললো: আমি তোমার উজিরকে মেরে ফেললে আমি হত্যাকারী,খুনি হিসেবে সাব্যস্ত হবো। ফলে আমাকে হত্যা করা তোমার অধিকারে পরিণত হবে। কেসাস মানে উজিরকে হত্যার বদলা হিসেবে আমাকে হত্যা করবে।
বাদশাহ হেসে দিলো এবং উজিরকে জিজ্ঞেস করলো: তুমি কোনটা ভালো মনে করো!
উজির লজ্জায় মাথা নীচু করে রইলো। তারপর বললো: আমাকে আরও বড়ো কোনো বিপদে ফেলার আগেই এই গোলামকে আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ করে দিন! আসলে দোষ আমারই। আমি শত্রুতা করেছি তার সাথে। আমি সেই মহান মনীষীর কথাটা মনে রাখি নি: শত্রুর দিকে তীর ছুঁড়ে মারলে নিজেকে শত্রুর তীরের মুখেই ঠেলে দিতে হয়।*