আগেকার দিনে তো আজকালের মতো লেপ তোষকের এতো ছড়াছড়ি ছিল না। মানুষ জানতোই না কিংবা চিন্তাও করতো না যে, এ নিয়ে বাজার ঘাটেও আধুনিক ব্যবস্থাপনা বলে কিছু একটা থাকতে পারে। অর্থাৎ কারও প্রয়োজন পড়লেই বাজারে গিয়ে হরেক রকমের লেপ তোষক থেকে বাছাই করে পছন্দেরটা কিনে বাড়ি ফিরতে পারতো- এরকম ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু তখনও মানুষ ঘুমাত। তখনও মানুষের বিশ্রামের প্রয়োজন হতো। তখনও ঠিক এখনকার মতোই আবহাওয়ার তারতম্য ছিল। সে সময় কারও লেপ তোষকের প্রয়োজন পড়লে কিছু পশম আর কাপড় কিনে সেগুলো দিয়ে আসত লেপ সেলাইকারীর দোকানে মানে ধুনুরির কাছে। যেরকম সাইজের প্রয়োজন হতো সেরকম সাইজের লেপ বা তোষক তৈরি করে দিত সেলাইকারী। ফার্সি ভাষায় এই লেপ তোষক সেলাইকারীকে বলা হতো ‘হাল্লাজ’, বাংলায় বলে ধুনুরি। হাতে বানানো কাঠ আর রশি দিয়ে তৈরি ধনুকের মতো একটা কারিগরী যন্ত্র ‘ধুনচি’ দিয়ে তারা মানে হাল্লাজরা পশমকে পিটিয়ে পিটিয়ে নরম করতো এবং গিটগুলোকে খুলে ফেলত। নরম হয়ে গেলে পশমগুলোকে কাপড়ের বিশাল বস্তার মতো একটা ব্যাগের ভেতর ঢুকাত এবং সেলাই করত।
আজ আমরা গল্পে যে হাল্লাজ বা ধুনুরির কথা শুনব সে লেপ তোষক সেলাইয়ের কাজে নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য একটা গ্রামে যাবার চিন্তা করল। বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তুলা বা পশম ধুনার ধুনচি নিয়ে রাস্তায় পা বাড়াল। সময়টা ছিল শীতকাল। স্বাভাবিকভাবেই ঘরের বাইরের আবহাওয়া ছিল ভীষণ ঠাণ্ডা। রাস্তাঘাট ছিল একেবারে বরফে ঢাকা। বেচারা ধুনুরির ঘোড়া কিংবা খচ্চরের মতো কোনো বাহনই ছিল না। সুতরাং তাকে পায়ে হেঁটেই যাত্রা করতে হলো। নিজের গ্রাম ছেড়ে বেশ দূরে যাবার পর তার নজরে পড়ল একটা নেকড়ে। নেকড়েটা ধীরে ধীরে আসছিল তার দিকে। ধুনুরি নেকড়েকে দেখেই বুঝতে পারল সে ভীষণ ক্ষুধার্ত। কী করা যায় ভেবে কুল পাচ্ছিল না ধুনুরি। তার কাছে তো নেকড়ের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো কোনো হাতিয়ারও ছিল না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল একটা গাছে উঠে যাবে। নেকড়ে তো আর গাছে উঠে আক্রমণ করতে পারবে না! সুতরাং আত্মরক্ষা করা যাবে।
কিন্তু গাছ কোথায়! এদিক ওদিক যদ্দুর তার দৃষ্টি মেলার সুযোগ হয়েছে কোত্থাও কোনো গাছ দেখতে পেল না, পাতা-লতাহীন শুকনো একটা গাছও না। হায়রে কপাল! বেচারা ধুনুরির দুর্ভাগ্যই বলতে হবে! যেদিকেই চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। সাদা আর সাদা। যেন আকাশের সাদা মেঘগুলো সব জমিনে এসে পড়ে আছে। ধুনুরি মনে মনে ভাবল ‘আজ বুঝি জীবন বাতি নেভার সময় হয়েছে। আহা! হাতে যদি একটা শক্ত লাঠি কিংবা মুগুরও থাকতো তাহলেও তো নেকড়ের সাথে কিছুক্ষণ লড়তে পারা যেত’। লাঠির কথা মনে আসতেই তার নজর পড়ে গেল পশম ধুনার সেই হাতিয়ার ধুনচি’র ওপর। একবার ভাবল ওটা দিয়েই নেকড়ের ওপর হামলা চালাবে। ধুনচিটাকে একবার এহাতে আরেকবার ওহাতে নিয়ে পরীক্ষা করল। কিন্তু না, ওই ধুনচি দিয়ে নেকড়ের ওপর হামলা করা কিংবা নেকড়ের আক্রমণ প্রতিহত করা যাবে না বলেই মনে হলো তার। তাছাড়া নিজের কাজের হাতিয়ার বা সরঞ্জাম নেকড়ের সাথে লড়াইয়ের কাজে ব্যবহার করে নষ্ট করতে চাচ্ছিল না সে।
ধুনচি দিয়ে নেকড়ের ওপর হামলা করার চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিতে যাচ্ছিল অমনি দেখল খুব কাছে এসে গেছে নেকড়ে। ফলে কিচ্ছু করার ছিল না। ওই ধুনচিই এখন সম্বল এবং সেটা দিয়েই ধুনুরি নেকড়ের মাথায় হামলা চালানোর জন্য উপরে তুলল। তোলার সময় ধুনচির রশিতে ধুনুরির হাত লাগতেই অদ্ভুত একটা শব্দ হলো। নেকড়ে ওই শব্দ শুনে থমকে গেল। না, কেবল থমকেই যায় নি, পিছু হটে গেল। এরকম শব্দ সে এর আগে আর কখনো শোনে নি। ধুনুরি বিষয়টা খেয়াল করল এবং বুঝলো ধুনচির শব্দ শুনে নেকড়ে ভয় পায়। সাথে সাথেই সে মাটিতে বসে গেল এবং ধুনচি বাজাতে শুরু করল। নেকড়ে ভয় পেয়ে আরো পিছিয়ে গেল। ধুনুরি এবার একটু বিরতি দিল। শব্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষুধার্ত নেকড়ে আবারও ধুনুরির দিকে এগুতে লাগল। ধুনুরি আবারও তার ধুনচি বাজাতে শুরু করল। এ অবস্থা ঘণ্টাখানেক ধরে চলল। ধুনচি বাজাতে বাজাতে এক সময় ধুনুরি ক্লান্ত হয়ে গেল। ক্ষান্তি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেকড়ে একেবারে ধুনুরির কাছে এসে গেল। অগত্যা সে আবারও ধুনচি বাজাল।
ধুনচির বাং বাং শব্দ শুনলেই নেকেড়ে পেছনে চলে যায়। ধুনুরির তো করার মতো আর কিছুই ছিল না। সেজন্য সে একটানা ওই ধুনচিই বাজাতে লাগল। এতবেশি বাজাল যে একসময় নেকড়ে ওই বাং বাং শব্দে বিরক্ত হয়ে চলেই গেল। ধুনুরি প্রাণ ফিরে পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল এবং বাসায় ফিরে গেল। ধুনুরির স্ত্রী অপেক্ষায় কখোন তার স্বামী হাত ভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফিরবে। কিন্তু খালি হাতে ফিরতে দেখে বলল: শুভ প্রত্যাবর্তন! কী খবর তোমার! কারো কাজটাজ করো নি নাকি!
ধুনুরি বলল: ধুনচি বাজিয়েছি, কয়েক ঘণ্টা ধরে ধুনচি চালিয়েছি। তবে পারিশ্রমিক নিই নি তাই খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে।
স্ত্রী বললো: তুমি কার জন্য কাজ করেছ যে তোমাকে কোনো পারিশ্রমিক দিল না!
ধুনুরি বলল: নেকড়ের জন্য ধুনচিগিরি করেছি। হ্যাঁ, নেকড়ের জন্য! তার কোনো লেপও ছিল না তোষকও ছিল না।
স্ত্রী অবাক হয়ে ধুনুরির দিকে তাকিয়ে রইল। ধুনুরি পরে পুরো ঘটনাটা বৌ’কে খুলে বলল। নিজের জীবন বেঁচে যাওয়ায় সে আবারও আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলো।
পুরো ঘটনা শুনে ধুনুরির স্ত্রীও আল্লাহর শোকর আদায় করল। এই ঘটনার পর থেকে যখনই কেউ প্রচুর চেষ্টা প্রচেষ্টা চালায়, কাজকর্ম করে অথচ কোনো পারিশ্রমিক পায় না তার ক্ষেত্রে বলার প্রচলন শুরু হয়ে যায়: ‘নেকড়ের ধুনচি ছিল’।*