কীসে আনন্দ? যেখানে অন্তর খুশি

কীসে আনন্দ? যেখানে অন্তর খুশি

এক বৃদ্ধা মার এক ছেলে ছিল। একেবারে দীনহীন অবস্থা ছিল তাদের। একদির ছেলেটা মাকে বলল: এখানে তো কাজটাজ নেই। আমি বরং অন্য কোনো শহরে চলে যাই। হয়তো কাজ মিলতেও পারে। কাজকর্ম করে পয়সাপাতি কিছু হাতে এলে ফিরে আসবো। মা নিরূপায় হয়ে ছেলেকে আল্লাহর হাওলায় যেতে দিলো। সঙ্গে দিলো তাঁর সঞ্চিত সর্বশেষ মুদ্রাটি আর কিছু পানি রুটি। ছেলে যেতে যেতে পথে পড়লো একটা বাজার। ঐ বাজারে এক দরবেশের সাথে তার দেখা। দরবেশ চীৎকার করে বলছিল: কেউ কি নেই একটি মুদ্রার বিনিময়ে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা কিনে নেয়? কেউই দরবেশের কথা কানে তুলল না।

ছেলেটি মনে মনে বলল: আমার তো কিছুই নেই। যেই মুদ্রাটি আছে সেটা বরং এই দরবেশকেই দিয়ে দেই! আল্লাহ ভরসা! আল্লাহই রিযিকদাতা। ছেলেটি তার একমাত্র সম্বল মুদ্রাটি দরবেশকে দিয়ে বলল: এবার বলো..তোমার জীবনের কথা।

দরবেশ বলল: “কেউ তার অবস্থানে থেকে তুষ্ট নয়, সবাই ভাবে অন্যজনের পর্যায়ে গেলেই সুখ মেলবে। কিন্তু আমার মনে হয় মানুষের মন যেখানে তুষ্ট সেখানেই সুখ। স্থান কিংবা কাল নয় তুষ্টিটাই আসল”।

ছেলেটা আবার রওনা হয়ে গেল। যেতে যেতে পৌঁছলো এক প্রান্তরে। সেখানে গিয়ে দেখলো বহু মানুষ একটা কূপের চারপাশ ঘিরে আছে। সে জানতে চাইলো ব্যাপারটা কী! ওরা জানাল:

আমাদের কাফেলা এই কূপ থেকে পানি তোলার আশায় এখানে এসেছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে এখন সবাই তৃষ্ণায় কাতর। আমাদের সাথে ঘোড়া গাধা গরু ভেড়াগুলোও। পানির জন্যে দড়িবাঁধা বালতি ফেলেছি কূপের ভেতর। কিন্তু বালতিগুলো সবই গায়েব হয়ে গেল। ঐ বালতি তোলার জণ্যে একজনকে কূপে পাঠালাম তারও খবর নেই। জানি না কূপের ভেতরে কী আছে”!

একথা শুনে ছেলেটা মনে মনে বলল: এই তো সুযোগ পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীদেরকে নিজের যোগ্যতা দেখানোর। তাহলে হয়তো এই কাফেলায় একটা কাজ মিলেও যেতে পারে। কাফেলার দিকে ফিরে বলল: অনুমতি দিলে আমি গিয়ে দেখি…কূপের ভেতরে কী”! কাফেলার কারো তো আর সেই সাহস ছিল না..সবাই রাজি হয়ে গেল।

ছেলেটা কোমরে ভালো করে দড়ি বেঁধে নিলো এবং কূপে ঝাঁপ দিলো। যুবক কূপের দেয়ালে লেগে আস্তে আস্তে নীচে গেল পানি পর্যন্ত। ভেবেছিলো পানিতে ডুব দিয়ে বালতিগুলো খুঁজবে, এমন সময় বিশালদেহী কালো একটা দৈত্য উঠে এলো পানির ভেতর থেকে। ছেলেটা ভয় পেয়ে গেল। দৈত্যকে সে সালাম করলো। দৈত্য বিকট হাঁসি দিয়ে বলল: সালাম সালামতি আনে…তুই তো দেখছি আদব কায়দা জানিস। তোকে একটা প্রশ্ন করবো। যদি সঠিক জবাব দিতে পারিস, তাকে তোকে ফিরে যেতে দেব এবং কূপ থেকে পানি তুলতেও দেব। আর যদি উল্টাপাল্টা জবাব দিস তবে তোকেও আগেরজনের মতোই কূপের অন্ধকারে আটকে রাখব।

ছেলেটা কী আর করবে। অগত্যা মানতেই হলো। দৈত্যকে বলল: ঠিকাছে। প্রশ্নটা কী বলো! দৈত্য বলল: কোথায় সুখ বা আনন্দ থাকে? দরবেশের কথা ছেলেটার মনে পড়ে গেলো। বলল: “মন যেখানে খুশি থাকে। তা যে-কোনো স্থানেই হোক না কেন”। দৈত্য ভীষণ খুশি হলো। বলল: “তুই তো দেখছি বেশ অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী রে..। তোর আগে যারা এই কূপে এসেছিল তারা বলেছিলো ভূ-পৃষ্ঠের বাগ-বাগিচায়। অথচ আমি তো এখানে এই অন্ধকার কূপেই থাকি, এখানেই আমার আনন্দ। যা..বালতিগুলো নিয়ে যা। তিনটা আনারও দিলাম তোকে। ঘরে যাবার আগ পর্যন্ত এগুলো নিয়ে কারো সাথে আলাপ করবি না”।

বুড়ির যুবক ছেলেটা দৈত্যকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর পানির ভেতর থেকে বালতিগুলো তুলে পানিভর্তি করে নিলো। এরপর পাঠিয়ে দিলো উপরে। নিজেও কূপের ভেতর থেকে উপরে উঠে এলো। সবাই তো তখন কৌতূহলী হয়ে উঠলো। কী হলো..কূপের ভেতরের ঘটনা কী..ইত্যাদি..। যুবক ধীরে ধীরে কূপের ভেতরের ঘটনা খুলে বলল কাফেলার কাছে। তবে আনার সম্পর্কে কোনো কথা বলল না। কাফেলার লোকজন যুবককে ধন্যবাদ জানাল। যুবক সাথে ফিরে গেল নিজের শহরে। শহরে পৌঁছার পর কাফেলার লোকজন তাকে একটা গরু আর একটা দুম্বা উপহার দিয়ে বলল: “আমরা কিছুদিন তোমার শহরে আছি। ফিরে যাবার সময় তুমি চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারো এবং কাজ করতে পারো”। ছেলেটা খুশিমনে কাফেলার সাথে খোদা হাফেজি করে বাসায় ফিরে গেল।

বাসায় যেতেই মা ছেলেকে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে গেল। বলল: “খুব ভালো হয়েছে এসেছিস…কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি ভাবি নি… ভালোই হলো”…

ছেলে বলল: “মাগো! আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছে মা। এই অল্প সময়ের মধ্যেই আল্লাহর সাহায্যে একটা গরু এবং একটা দুম্বা পেলাম। কয়েকদিন পর কাফেলার সাথে সফরে যাবারও সুযোগ পাবো। তাদের সাথে কাজ করার জন্যে বলেছে আমাকে”।

রাতের বেলা মা-ছেলে একসাথে খাবার খেলো। মা ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন, তাই ঘুমিয়ে পড়লেন তাড়াতাড়ি। এই ফাঁকে ছেলে তার পকেট থেকে একটি আনার বের করলো এবং দুই টুকরো করে ফেললো। আনারটার ভেতরের দানাগুলো হীরার দ্যুতির মতোই জ্বলজ্বল করে উঠলো। ছেলে ভীষণ খুশি হয়ে গেল। ধরে দেখলো আসলেই হীরা। সে আর গেল না কাফেলার সাথে কাজ করতে।

কয়েকটা হীরার টুকরা নিয়ে সে গেল বাজারে। সেগুলো বিক্রি করে একটা দোকান কিনলো। কিছু পুঁজিও বানালো। তারপর শুরু করলো ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ। সেই থেকে মানুষ যেখানেই বাস করুক না কেন, যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, আয় উপার্জন যত কমই থাকুক না কেন, যত কষ্টেই কাটাক না কেন, তবু যদি সুখে শান্তিতে থাকে তাহলে এই প্রবাদটি উচ্চারণ করে: “সুখ কোথায়? অন্তর খুশি যেথায়”।

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত