অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক বাদশা ছিল সন্তানহীন। বাদশার স্ত্রী গর্ভবতী হতো ঠিকই কিন্তু জন্মের আগেই কেন যেন মারা যেত। বাদশা ডাক্তার কবিরাজ হেকিম বলতে আর কিছুই বাকি রাখে নি। যতরকমের চিকিৎসা ছিল সবই করিয়েছে। এমনকি যাদু টোনা ফকিরি কেরামতিও বাদ রাখে নি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। বাদশা অনেকটা হতাশই হয়ে পড়লো। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল বাদশা। সে মারা গেলে কে এই বাদশাহির মসনদ অলংকৃত করবে। কে এই বাদশাহি মুকুট মাথায় পরবে!
শেষবার যখন বাদশার স্ত্রী গর্ভবতী হলেন বাদশাহ তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন বাপের বাড়ি যাতে তার সেবাযত্নের কোনোরকম কমতি না হয়। যথাযথ যত্নআত্তির পর অবশেষে বাদশার স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। এই খবর শুনে বাদশাহ তো মহাখুশি। সাথে সাথে বাদশাহ তাঁর স্ত্রীর কাছে বার্তা পাঠালেন স্ত্রী যেন প্রাসাদে না এসে বাপের বাড়িতেই থাকে। কারণ হলো নবজাতকের ওপর যাতে কারও কুদৃষ্টি না পড়ে কিংবা কোনো বালা মুসিবতের মুখে না পড়ে।
এমনিতেই বাদশার এক মন্ত্রী ছিল খুবই শয়তান। সে সারাক্ষণ বাদশাকে মেরে ফেলার ধান্ধা করতো। তার টার্গেট ছিল বাদশাকে মেরে তার মসনদ এবং রাজপ্রাসাদ সে দখল করবে। এই দুষ্ট মন্ত্রী যখন শুনতে পেলো বাদশার স্ত্রীর এক পুত্র সন্তান হয়েছে অমনি বিরক্তিতে ভরে উঠলো তার মন। কেননা এখন তো বাদশাকে মেরে ফেললেও কোনো কাজ হবে না, সে যেই অসৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাবে না। বাদশাহ মারা গেলে তার ছেলে হবে বাদশাহ-এটাই নিয়ম। ফলে বদমাশ মন্ত্রী ভাবলো তার বাদশাহ হবার স্বপ্ন তো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রী মোটামুটি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো যে,যে করেই হোক বাদশাকে তার পথ থেকে সরিয়ে দিতেই হবে।
যেই কথা সেই কাজ, মন্ত্রী তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে একদিন বাদশার প্রাসাদে হামলা চালালো এবং বাদশাকে মেরে ফেললো। বাদশাহির আসন তো শূন্য থাকতে পারে না সুতরাং সে নিজেই বাদশার মসনদে আসীন হলো। এরপর কোনো একদিন কয়েকজনকে পাঠালো বাদশার স্ত্রী কাছে। লোকদের কাছে বাদশার নামে একটা জাল চিঠি দিলো বাদশার স্ত্রীকে দেওয়ার জন্য। চিঠিতে লেখা ছিল: আমি অসুস্থ! তাড়াতাড়ি প্রাসাদে ফিরে আসো! মন্ত্রীর লোকেরা ওই চিঠি নিয়ে বাদশার স্ত্রীর কাছে গেল। স্ত্রী ওই চিঠি পেয়ে তাড়াতাড়ি করে উটের পিঠে চড়ে বসলো এবং মন্ত্রীর পাইক-পেয়াদার সাথে প্রাসাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
প্রাসাদের পথে আসতে আসতে সন্ধ্যার কাছাকাছি একটা পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে খানিক বিশ্রাম নেওয়ার লক্ষ্যে যাত্রাবিরতি করলো তারা। তাঁবু খাটিয়ে ভেতরে বিশ্রাম নিতে গেল। দুষ্ট মন্ত্রী তার পেয়াদা সর্দারকে আগেই বলে দিয়েছিল পথিমধ্যেই যেন ‘কর্ম সাঙ্গ’ করে ফেলা হয় মানে বাদশার স্ত্রী আর সন্তানের শিরোচ্ছেদ করা হয়। সে কারণেই পাইক-সর্দার মাঝরাতে বাদশার স্ত্রীর তাঁবুতে ঢুকলো। বাদশার স্ত্রী সর্দারকে তাঁর তাঁবুতে ঢোকার মতো বেয়াদবিপূর্ণ আচরণ দেখে বুঝতে পারলো তার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। সর্দারের দিকে তাকিয়ে তাই বাদশার স্ত্রী বললো: কে তুই! বাদশার স্ত্রীর তাঁবুতে ঢোকার মতো এতো বড়ো দু:সাহস তোর কী করে হলো?
পেয়াদা-সর্দার একথা শুনে হেসে বললো: কে বাদশাহ আর কোন বাদশার স্ত্রী। তোমার স্বামী তো বহু আগেই নিহত হয়েছে। এখন তোমার স্বামীর জায়গায় মন্ত্রী হয়েছে বাদশাহ। আমরা তার আদেশেই এসেছি তোমাকে আর তোমার সন্তানকে হত্যা করতে।
বাদশার স্ত্রী এ কথা শুনেই তার সন্তানকে কোলে নিলো এবং তাঁবু থেকে বেরিয়ে পালালো। পেয়াদা সর্দার তার লোকজনকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো এবং বাদশার স্ত্রীর পেছনে দৌড়তে বললো। মহিলা যখন দেখলো পেয়াদারা তাকে ধরে ফেলবে, তখন সে একবার আকাশের দিকে তাকালো আরেকবার মাটির দিকে তাকালো। তারপর বাচ্চাটিকে ফেলে দিলো একটা উপত্যকায়। ততক্ষণে পেয়াদারা এসে গেল এবং বাদশার স্ত্রীকে হত্যা করলো। কিন্তু উপত্যকার নীচের দিকে আর গেল না। তারা ভেবেছিল একটা শিশু বাচ্চা! নিশ্চয়ই পাথরের ওপর পড়ে মারা গেছে।
বাদশার এক ভাই ছিল। এই ঘটনাবহুল সময়ে সে ছিল ভ্রমণে। ফিরে এসে যখন দেখলো দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে গেছে এবং মন্ত্রী তাকেও হত্যা করার পাঁয়তারা করছে, তখন সে নিহত বাদশার কয়েকজন সমর্থককে নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। নতুন বাদশা এ খবর শুনে একদল পেয়াদাকে পাঠালো তাকে খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু কাজ হলো না। তারা বাদশার ভাইকে খুঁজে পেল না। সুতরাং তার সাথে সন্ধিও হলো না, তাকে মারাও গেল না। কোনোরকম ষড়যন্ত্রেই কাজ হলো না।
দিনে দিনে বাদশার ভাইয়ের দলে আরো বেশি লোক হলো। শক্তিশালী হলো তার দল। একদিন তার বাহিনী সেই পাহাড়ে গিয়ে হাজির হলো যেখানে তার ভাইয়ের স্ত্রীকে মন্ত্রীর লোকেরা হত্যা করেছিল। সেখানে যাবার পর একজনের নজরে পড়লো চমৎকার একটা দৃশ্য: ছোট্ট ফুটফুটে একটি বাচ্চা সিংহের সাথে খেলা করছে। সে বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে তার চাচ্চুর হাতে দিলো। বাদশার ভাই দেখলো ওই বাচ্চার বাহুতে একটা তাবিজ বাঁধা আছে এবং তাতে কী যেন লেখা আছে। সে প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে পড়ে বুঝলো এই শিশু তার ভাইয়ের সন্তান। ভাইপো যেহেতু সিংহের দুধ খেয়ে বেড়ে উঠেছে সেজন্য তার নাম রাখা হলো শিরযদ। এই শিরযদ একেবারে সিংহের বাচ্চার মতোই হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে সে ঘোড়ায় চড়তে শিখলো। তীর মারা তলোয়ার চালানো সবই শিখলো সে।
এভাবে বাদশার ছেলের বয়স ১৫তে পৌঁছলো যখন তখন সে ছোটোখাটো একজন পালোয়ান। এই খবরটা ছড়িয়ে পড়লে বহু লোক এসে বাদশার ভাইয়ের হাতে হাত মিলালো এবং তারাও তলোয়ার চালনা শিখে এই দলে ভিড়লো। তার দল এখন আরও বেশি শক্তিশালী হলো। এদিকে বর্তমান বাদশাহ দেখলো ঘটনা তো অনেক দূর গড়িয়েছে। ভাবলো: কিছুতেই আর বাড়তে দেয়া যায় না। কিন্তু কী করে আগের বাদশার ছেলে আর ভাইকে দমাবে তা ভেবে কুল পাচ্ছিল না।
দুষ্টু মন্ত্রী যে এখন নতুন বাদশা হয়েছে সে তার মেয়ের জন্য উপভোগ্য আবহাওয়াময় একটা গ্রামে চমৎকার একটা বাড়ি বানালো। মেয়েটা সুন্দরী ঠিকই কিন্তু মনটা বাবার মতোই কুৎসিত এবং শয়তানিতে পূর্ণ ছিল। মেয়ের বাড়ির পাশেই একটা দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। একদিন শিরযাদ একাকি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গিয়ে পৌঁছলো ওই কেল্লার কাছে। ভীষণ ক্ষুধার্ত,পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিল সে। হঠাৎ আকাশের দিকে নজর পড়তেই দেখলো একটা পাখি উড়ছে। শিরযাদ তার ধনুকের ছিলায় একটা তীর লাগালো এবং ছুঁড়ে মারতেই পাখিটা আছড়ে পড়লো নয়া বাদশার মেয়ের বাড়ির উঠোনে। শিরযাদ সামনে এগিয়ে গিয়ে মোটা দড়ি দিয়ে তৈরি করা মইটাকে দুর্গের প্রাচীরের উপর ছুঁড়ে মারলো এবং সেই মই বেয়ে উপরে উঠতেই দেখলো ঝুলবারান্দার সামনে সুন্দরী এক মেয়ে বসে আছে।
ওই মেয়ে শিরযাদকে দেখেই হুড়মুড় করে পালিয়ে গেল। ঘরের দরোজা খুলে ভেতরে গিয়ে তাড়াতাড়ি তার বাবার কাছে একজন দূতকে পাঠিয়ে দিল। বলে পাঠালো বিন্দুমাত্র দেরি না করে যেন ছুটে আসে তার কাছে। শিরযাদ ওই মুহূর্তে খাবার খাচ্ছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে চোখ মেলতেই দেখতে পেল এক সমুদ্র লয়-লশকর এগিয়ে আসছে তার দিকে। সে হুট করেই বুঝতে পেল যে এটা ওই মেয়েটারই ষড়যন্ত্র। শিরযাদ মেয়েটার কাছে গিয়ে তাকে তলোয়ারের এক ঘায়ে মেরে ফেলল। এরপর দেয়াল টপকে বাইরে চলে গেল। ঘোড়ায় চড়ে হাতে তলোয়ার নিয়ে ধাওয়া করলো বাদশার সেনাদলকে। শিরযাদ একা তলোয়ার চালালো। কিন্তু বাদশার বাহিনীতে এতো বেশি সেনা ছিল যে কোনোভাবেই শেষ হচ্ছিল না। বাদশার সেনারা একসময় শিরযাদকে ঘিরে ফেলল। রণবীর অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে লড়াই করলো। যতক্ষণ তার দেহে শক্তি ছিল ততক্ষণ লড়লো।
একটা সময় নিস্তেজ হয়ে প্রায় মরণাপন্ন হয়ে পড়লো। এবার তো বাদশার সেনারা তাকে মেরেই ফেলবে। হঠাৎ করে দূর থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পেল শিরযাদ: হে ভাইপো আমার! ভয় পেও না! আমি এসে গেছি।
শিরযাদ চাচার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে সাহস পেল। এবার সেই সাহসের ওপর ভর করে আবারও বাদশার সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এমন যুদ্ধ সংঘটিত হলো যে সেইদিন পর্যন্ত এই বিশ্ব ওরকম যুদ্ধ চোখে দেখে নি কোনোদিন। বাদশার অসংখ্য সেনা নিহত যেমন হয়েছে তেমনি আহতও হয়েছে প্রচুর। আবার আটকও হয়েছে দলে দলে। অবশেষে শিরযাদ তার চাচাসহ বন্দি সিপাহিদের নিয়ে শহরে হামলা চালিয়ে জালেম বাদশাহকে হত্যা করলো এবং পুরো শহর দখল করে নিলো। শিরযাদ তার চাচাকে বাদশাহি দিয়ে নিজে প্রাসাদে গিয়ে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে শুরু করলো।
নতুন বাদশার মানে শিরযাদের চাচার দুই ছেলেসন্তান ছিল। তবু শিরযাদকে বাদশা নিজের দুই ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। এটা বাদশার নিজের সন্তানদের ভালো লাগতো না। তারা যখন এই কাণ্ড টের পেল শিরযাদের ব্যাপারে তাদের চোখে হিংসার লেলিহান আগুন জ্বলে উঠলো। বাদশা যখন তার ছেলেদের মনের অবস্থা বুঝতে পেল তখন শিরযাদসহ তাদের সবাইকে নিজের কাছে ডেকে এনে বললো: তোমরা তিনজনই আমার সন্তান। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি সাহসী এবং নির্ভীক তাকেই আমি বেশি ভালোবাসি। বলতে পারো তোমাদের মধ্যে কে বেশি সাহসী?
তিন ছেলেই নিজেকে বেশি সাহসী বলে চীৎকার করে উঠলো। এ অবস্থা দেখে বাদশাহ বললো: তোমরা তো দেখছি সবাই নিজেকে সাহসী বীর বলে দাবি করছো। ঠিক আছে! তোমাদের সাথে আমার একটা শর্ত আছে। তোমাদের মধ্যে যে সবার আগে এমন কোনো স্থান থেকে এমন একটা জিনিস নিয়ে আসতে পারবে যে স্থানে আমার ঘোড়ার পা পড়ে নি এবং যে জিনিসটি এর আগে আমি দেখি নি, সে হবে সাহসী বীর।#
বাবার শর্তের কথা শুনেই বড় ছেলে সামনে পা বাড়িয়ে মাটিতে চুমু খেয়ে সৌজন্য সম্মান প্রদর্শন করে দাঁড়িয়ে নিজের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করলো। বাদশাহ তার বড় ছেলের প্রস্তুতির অবস্থা দেখে তাকে পথ খরচা দিয়ে বললো: যাও! ছেলে তো বিপুল উদ্দীপনায় ঘোড়ায় চড়ে বসলো এবং রওনা হয়ে গেল। যেতে যেতে যেতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। তারপর রাত। আবার এলো দিন। এভাবে রাতের পর রাত দিনের পর দিন যেতে যেতে দুই মাস পেরিয়ে গেল। অবশেষে একদিন একটি এলাকা পার হবার সময় তার ঘোড়া হ্রেষাধ্বনি তুললো। সে ঘোড়াকে থামালো। হঠাৎ দেখলো একটা গাছের পাশে বড় একটা রুবি পাথর বা পদ্মরাগ মণি পড়ে আছে। ঘোড়া পিঠ থেকে নেমে সে খানিক চিন্তা করলো যে আমার বাবা যদি এই পথ অতিক্রম করতো তাহলে অবশ্যই এই মূল্যবাণ মণিটা তুলে নিতো।
আলতো হেসে মণিটা তুলে নিয়ে ঘোড়ায় চড়লো এবং ঘোড়ার গতিপথ উল্টো দিকে ফিরিয়ে প্রাসাদের দিকে রওনা হলো। এ খবর ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। এক কান দু’কান হতে হতে বাদশার কানে পৌঁছে গেল খবর। বাদশাহ তার দরবারের অভিজাত ব্যক্তিদের বললো তার ছেলেকে অভ্যর্থনা জানাতে যেন এগিয়ে যায়। ব্যাপক জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে বাদশাহর বড় ছেলে ফিরে এলো। পরদিন রাজ দরবারকে সুসজ্জিত করা হলো। দরবারের সবাই অভিজাত আনুষ্ঠানিক পোশাক পরে যে যার আসনে বসলো। বাদশাহর ছেলে যেই রুবি পাথর বা পদ্মরাগ মণিটা পেয়েছিল সেটা একটা সুসজ্জিত ট্রে-তে রাখলো এবং বাদশার হাতে দিলো।
বাদশাহ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললো: “এই চাবিটা নাও! শহরের পাশের পাহাড়ের নীচে একটা গূহা আছে। ওই গূহার ভেতর চল্লিশটি কক্ষ আছে। এই লাল রুবিটা নিয়ে এগারো নম্বর কক্ষে রাখবে”।
বাদশাহর ছেলে ভীষণ খুশিমনে গূহায় গেল এবং এগারো নম্বর কক্ষের দরোজাটা খুললো। দরোজা খুলেই সে দেখলো কক্ষটা লাল ইয়াকুত বা রুবি পাথরে পূর্ণ। ছেলের চেহারা থেকে এবার আনন্দের হাসিটা মিইয়ে গেল। সে বুঝতে পারলো তার বাবা তাকে ভালো একটা শিক্ষা দিয়েছে।
এবার মেজো ছেলের পালা। সেও একইভাবে তিনমাস মরুপ্রান্তর আর পাহাড় পর্বত পেরিয়ে এক বনে গিয়ে পৌঁছলো। সেই বনের একটি গাছে দেখলো চমৎকার ফল ধরে আছে। একটা ছিঁড়ে খেতে গিয়ে বুঝলো ওই ফলটা আসলে সোনার ফল। সে তাড়াতাড়ি ঘোড়ার পিঠে থাকা জিনটাকে পূর্ণ করলো ওই ফল দিয়ে। তারপর ফিরে গেল প্রাসাদে। বাদশাহ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললো: যাও! এগুলো গূহার একুশ নম্বর কক্ষে রেখে আসো! মেজো ছেলে সোনার ফলগুলো নিয়ে গূহার একুশ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখলো: ওই কক্ষটা সোনার ফলে ভর্তি।
শেষ পর্যন্ত ছোটো ছেলে শিরযাদের পালা এলো। শিরযাদ যথাযথ কুর্নিশ করে বললো: হে চাচা আমার! যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আপনার ঘোড়া নিয়ে যেতে চাই!
বাদশাহ আদেশ দিলো তার ঘোড়াটা যেন শিরযাদকে দেওয়া হয়। শিরযাদ ওই ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়ে গেল। কিছুটা পথ গিয়ে শিরযাদ ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিলো যাতে ঘোড়া তার ইচ্ছেমতো যেদিকে খুশি যেতে পারে। ঘোড়াও এদিক,ওদিক না তাকিয়ে তার মতো যেতে লাগলো। ছয় মাস এভাবে চললো ঘোড়া। সপ্তম মাসের প্রথম দিন ঘোড়া একটা জায়গায় গিয়ে হ্রেষা তুলে থামল এবং পায়ের ক্ষুর দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলো। এরপর পেছন ফিরে আবারও হ্রেষাধ্বনি তুললো এবং এমন অঙ্গভঙ্গি করলো যে শিরযাদ বুঝলো এই ঘোড়া ওই দাগের পর তার পা রাখে নি মানে আর সামনে যায় নি কখনো।
শিরযাদ ঘোড়ার লাগামে হাত রেখে তাকে ধীরে ধীরে সামনের দিকে নিয়ে গেল। কিছু পথ যাবার পর শিরযাদ এদিক ওদিক ভালো করে দেখলো। হঠাৎ তার নজরে পড়লো মাটির ওপর কিছু একটা বস্তু যেন জ্বলছে। ঘোড়া থেকে নেমে ভালো করে দেখলো শিরযাদ: একটা চেরাগ! কোনোরকম তেল ছাড়াই জ্বলছে এবং তার আলো চারদিকে ছড়াচ্ছে। শিরযাদ চেরাগটা হাতে নিয়ে দেখলো তার গায়ে লেখা রয়েছে: পৃথিবীতে এ ধরনের মাত্র দুটি চেরাগ রয়েছে।
শিরযাদ ভাবলো তার মানে এর একটি হয়তো তার চাচার সংগ্রহে আছে। সিদ্ধান্ত নিলো যতক্ষণ না অপর চেরাগটি দেখতে না পাবে ততক্ষণ ফিরবে না প্রাসাদে। আবারও ঘোড়ায় চড়ে পথ চলতে শুরু করলো সে। যেতে যেতে এক শহরে গিয়ে পৌঁছলো এবং একটা সরাইখানায় গিয়ে উঠলো রাতের বিশ্রামের জন্য।
মজার ব্যাপার হলো রাতে তার রুমে আরও এক মুসাফিরকে পাঠানো হলো। ওই মুসাফির তার ঘোড়ার জিন থেকে একটা চেরাগ বের করে জ্বালালো। শিরযাদ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো একইরকম মানে যেই চেরাগটা সে পেয়েছে সেই চেরাগের মতোই এটি।#
শিরযাদ ওই নতুন মুসাফিরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে শুরু করলো এবং এক পর্যায়ে সে তার জীবনের ঘটনাপঞ্জি মুসাফির বন্ধুর কাছে বর্ণনা করলো। সবশেষে চেরাগের বিষয়টাও বলে মুসাফিরকে বললো সে যেন ওর চেরাগটা বিক্রি করে তার কাছে। মুসাফির এই বিক্রির প্রস্তাব পেয়ে বললো: ঠিক আছে আমি তোমাকে চেরাগটা দেবো তবে তুমিও আমাকে একটা কিছু দেবে-ঠিক আছে?
শিরযাদ বললো: ঠিক আছে, তুমি যা চাও তাই দেবো।
মুসাফির বললো: এখান থেকে দৈত্যকেল্লার দূরত্ব এক মাসের। তাদের ওখানে অনেক সুন্দর সুন্দর কবুতর আছে। তুমি যদি সেখান থেকে এক জোড়া কবুতর আমাকে এনে দিতে পার তাহলে আমার চেরাগটা তোমাকে দিয়ে দেবো।
শিরযাদ বললো: সমস্যা নেই, এনে দেবো। বলো কীভাবে যেতে হবে সেখানে।
মুসাফির শিরযাদকে দৈত্যকেল্লার রাস্তা সুন্দর করে বাতলে দিলো। পরদিন ভোরেই শিরযাদ রওনা হয়ে গেল। টিলার পর টিলা আর উপত্যকার পর উপত্যকা পেরিয়ে কেল্লার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। কেল্লার কাছে যেতেই একটা আওয়াজ ভেসে এলো শিরযাদের কানে। শিরযাদ শব্দের উৎস খুঁজতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো পাহাড়ের ওপরে একটা সাদা পাখি বসে বসে ওভাবে ডাকছে। শিরযাদ দাঁড়িয়ে গেল।
পাখিটা তখন শিরযাদকে বললো: ‘হে মানব সন্তান! কে তোমাকে এই মৃত্যুর ঠিকানায় পাঠালো? এখানকার দৈত্যরা কবুতরগুলোকে তাদের বাবার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। তবে তুমি একটা কাজ করতে পারো। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করো। দৈত্যরা যখন গভীর ঘুমে থাকবে তখন যাও কেল্লার ভেতর’।
শিরযাদ ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলো এবং মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। তারপর গেলো কেল্লার প্রাচীরের কাছে। সেখানে যাবার পর আবারও সাদাপাখি ডেকে উঠলো। পাখি বললো: ‘লোভ করবে না শিরযাদ! মনে রাখবে এক জোড়ার চেয়ে বেশি নেবে না কিছুতেই’।
শিরযাদ প্রাচীর বেয়ে ভেতরে গেল এবং হামাগুড়ি দিয়ে গেল কবুতরের বাসার কাছে। সেখানে কবুতরগুলোকে দেখে তো হতবাক হয়ে গেল শিরযাদ। এতো সুন্দর কবুতর! শুধু দেখতেই মন চায় তার। ক্রলিং করে করে শিরযাদ এগিয়ে যায় সামনে একেবারে কবুতরগুলোর কাছে। এক জোড়া কবুতর সে নেয় কিন্তু লোভ সামলাতে না পেরে নিজের জন্যও এক জোড়া নেয়। কবুতরগুলো যেন এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল। একেবারে চীৎকার চেঁচামেচি করে দৈত্যদের জাগিয়ে দিলো তারা। শিরযাদ ধরা পড়ে গেল দৈত্যদের হাতে।
দৈত্যদের জিজ্ঞাসাবাদে শিরযাদ তার জীবনের পুরো ঘটনা খুলে বললো। শিরযাদের জীবন কাহিনী শুনে দৈত্যরা বললো: আমরা তোমাকে এখান থেকে এক জোড়া কবুতর তোমাকে দেব একটি শর্তে। শর্তটা হলো আমাদের জন্য আঙুর ফল নিয়ে আসবে। কেল্লার কাছেই যারা বসবাস করে তাদের মানে আমাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এক ঝুড়ি আঙুর নিয়ে আসবে। ওদের আঙুরগুলো খুবই মজার। ওরা খুব ভালোভাবে আঙুর গাছের যত্ন নেয়।
শিরযাদ আঙুর আনার জন্য ঘোড়ায় চড়ে। প্রতিবেশী দৈত্যদের এলাকায় পৌঁছে একটা জায়গায় গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। হঠাৎ সেই সাদা পাখি ডেকে ওঠে। পাখি বলে: “শিরযাদ! তুমি আমার কথা শোনো নি যে কারণে এখন বিপদে পড়েছো। এবার ভালো করে শোনো। আবারও বলছি লোভ করো না। এক ঝুড়ি আঙুরের বেশি নিও না,ইত্যাদি…”
শিরযাদ গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেয়াল পেরিয়ে ভেতরে গেল। ক্রলিং করে করে আঙুরের ঝুড়ির কাছে গিয়ে হাজির হল। চমৎকার সব আঙুর ভর্তি ঝুড়িতে পূর্ণ হয়ে আছে চারপাশ। শিরযাদ মনে মনে ভাবলো, আগে নিজে একটু স্বাদ নিই তারপর ঝুড়ি নেয়া যাবে। একটা আঙুর মুখে দিতেই আঙুরের স্বাদে বিমোহিত হয়ে টপাটপ খেয়ে ফেললো এক ঝুড়ি। কিন্তু শিরযাদের মতো পালোয়ানের জন্য এক ঝুড়ি আঙুর তো খুবই সামান্য। এক ঝুড়ি, দুই ঝুড়ি খেতে খেতে পাঁচ পাঁচটি ঝুড়ি সে সাবাড় করে দিলো।
কিন্তু পঞ্চম ঝুড়ির সর্বশেষ আঙুরটি হাতে নিতেই আগের খালি ঝুড়িগুলো আবারও পরিপূর্ণ হয়ে গেল আঙুরে। শিরযাদের তো ভিমরি খাওয়ার মতো অবস্থা। নিজের চাখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। শিরযাদ আরেকটি ঝুড়ি খেয়ে শেষ করতে না করতেই ঝুড়িটি আবার পূর্ণ হয়ে গেল আঙুরে।বিস্ময়ের পর বিস্ময়ে শিরযাদ কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত এক ঝুড়ি আঙুর হাতে নিয়ে ভাবলো: এতো কষ্ট করে এখানে যেহেতু এসেই পড়েছি তাহলে চাচা মানে বর্তমান বাদশার জন্য এক ঝুড়ি আঙুর নিয়ে গেলে তো মন্দ হয় না। এই ভেবে যে-ই দ্বিতীয় ঝুড়িতে হাত দিলো অমনি ঝুড়িগুলো চীৎকার করে উঠলো। মুহূর্তেই দৈত্যরা এসে পড়লো এবং শিরযাদকে ধরে ফেললো।
দৈত্যের হাতে ধরা,যায় কোথায়। শিরযাদকে তারা জেরা করতে শুরু করে দিলো। শিরযাদও আগের মতোই তার জীবন কাহিনী শোনালো দৈত্যদেরকে। দৈত্যদের প্রধান ছিল বেশ স্বাস্থ্যবান এবং হৃষ্টপুষ্ট। সে শিরযাদকে বললো: “ঠিক আছে! তোমার কাহিনী তো শুনলাম। তোমাকে এক শর্তে একটা ঝুড়ি দিতে পারি। শর্তটা হলো: এখান থেকে কাছেই এক সাদা দৈত্য বাস করে। তার খুব সুন্দরী একটা মেয়ে আছে। আমি ওই মেয়েকে ভালোবাসি। তুমি যদি ওই মেয়েকে আমার জন্য নিয়ে আসতে পারো তাহলে আমি তোমাকে এক ঝুড়ি আঙুর দেবো”। #
শিরযাদ ঘোড়ায় চড়ে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে দিতে চললো সাদা দৈত্যের প্রাসাদের দিকে। গন্তব্যে পৌঁছার একটু আগে আবারও সেই সাদা পাখি শিরযাদের মাথার উপরে ডেকে উঠলো। বললো: “হে লোভী মানুষ! আবারও তুমি মৃত্যুর ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছো। মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনো। সাদা দৈত্যের কন্যা ঘুমিয়ে আছে। প্রতি মাসে সে টানা এক সপ্তা ঘুমায়। সে ঘুমালে তার লম্বা চুলের চারটি বেণিতে চারটা বড় পেরেক মারা হয় যাতে তাকে কেউ ঘুম থেকে ওঠাতে না পারে। তোমার পক্ষে তাই কিছুতেই তাকে ওই পেরেক থেকে ছাড়ানো সম্ভব না। তবে হ্যাঁ, একটা উপায় আছে। সাদা দৈত্যের আস্তাবলে একটা ঘোড়া আছে চুয়াল্লিশটা পেরেক দিয়ে বাঁধা। কোনো পাখিও ওই ঘোড়ার গতির ধারে কাছে যেতে পারে না। তুমি ওই ঘোড়াকে যে-কোনোভাবেই হোক খুলে যদি তাকে নিয়ে যাও তাহলে মাটি থেকে মেয়েটিকে তুলে নিতে পারার একটা সম্ভাবনা আছে”।
সাদা পাখি আরও বললো: “তবে মনে রাখবে প্রথমবারে যদি মাটি থেকে ওই চারটি পেরেক ছাড়িয়ে মেয়েটিকে তুলতে না পারো তাহলে তোমার শরীরের হাঁটু পর্যন্ত পাথরে পরিণত হয়ে যাবে। দ্বিতীয়বারেও যদি না পারো তাহলে কোমর পর্যন্ত পাথর হয়ে যাবে আর তৃতীয়বারেও যদি ওই চারটি পেরেক তুলতে না পারো তাহলে তুমি মাথা থেকে পা পর্যন্ত পাথর হয়ে যাবে এবং সেখানেই পাথরের মূর্তি হয়ে পড়ে থাকবে”।
এইসব শুনে শিরযাদ গিয়ে পৌঁছলো সাদা দৈত্যের কেল্লায়। সময় নষ্ট না করে সোজা চলে গেল আস্তাবলে। সাদা পাখির কথা অনুযায়ী আস্তাবলে গিয়ে দেখলো ড্রাগনের মতো বিশাল এক ঘোড়াকে সত্যি সত্যিই বেঁধে রাখা হয়েছে।
শিরযাদ এক লাফে গিয়ে বসলো ড্রাগনের পিঠে। যে সব রশির মাথায় পেরেক মেরে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে, দ্রুত তার তলোয়ার গেলাফ থেকে বের করে খ্যাচ খ্যাচ করে রশিগুলো কেটে দিলো। ঘোড়াটি যখন দেখলো সে বন্ধনমুক্ত হয়ে গেছে, চেষ্টা করলো তার পিঠে চড়ে বসা সওয়ারিকে মাটিতে ফেলে দিতে। কিন্তু চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। বুঝলো এই সওয়ারি আগেকার অন্য কোনো সওয়ারির মতো নয়। ঘোড়া নিরুপায় হয়ে এবার শান্ত হলো আর শিরযাদ ঘোড়াকে নিয়ে চলে গেল সাদা দৈত্যের ঘুমন্ত কন্যার কাছে।
বলছিলাম সাদা দৈত্যের ঘুমন্ত কন্যার কাছে পৌঁছে গেল শিরযাদ। ওই কন্যাকে দেখে শিরযাদ তো অবাক, এতো সুন্দর, এতো রূপসী! শিরযাদ কোমরে হাত রেখে ভাবলো কিছুক্ষণ তারপর কন্যার কোমরে হাত রেখে মাটি থেকে তুলতে চাইলো। কিন্তু পারলো না এবং সাদা পাখি যেমনটা বলেছিল শিরযাদের হাঁটু পর্যন্ত পাথর হয়ে গেল। আবারও কন্যার কোমরে হাত রেখে তুলতে চাইলো। কন্যা একটু নড়েচড়ে উঠলো কিন্তু মাটি থেকে উঠলো না। এবার শিরযাদের কোমর পর্যন্ত পাথর হয়ে গেল। শিরযাদ তবু নাছোড়বান্দা। সে এবার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে বললো: ‘শপথ করে বলছি এবার যদি তোমাকে মাটি থেকে তুলতে না পারি তাহলে এই ঘোড়ার কোমর আমি ভেঙ্গে দেবো’।
এই বলে শিরযাদ আবারও মেয়ের কোমর ভালো করে জড়িয়ে ধরে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে টান দিলো এবং সফল হলো। দেওকন্যাকে ঘোড়ার পিঠে তুলতেই শিরযাদের শরীরের পাথর হয়ে যাওয়া অংশ আগের মতো হয়ে গেল। ঘোড়া ছুটলো তীর বেগে। পেছন থেকে শোনা গেল অদ্ভুত রকম হৈ-চৈয়ের শব্দ: ‘ও-ই! ধর ধর! আটক কর, কোনোভাবেই পালাতে দিস না’..ইত্যাদি। শিরযাদ আর পেছনে তাকালো না। ঘোড়া ছুটালো ভীষণ বেগে। কিছুক্ষণ পর আর কোনো হৈ-চৈ শোনা যাচ্ছিলো না। চলমান ঘোড়ার দ্রুত গতির মাঝে হঠাৎ সেই সাদা পাখি ডেকে উঠে বললো: ‘শিরযাদ! শোনো! এক ঘণ্টা পরে এই মেয়ে জেগে উঠবে এবং এমন জোরে চীৎকার দেবে যে পাহাড়-মরু পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। ওই শব্দে তোমার কানের পর্দা ফেটে যাবে’।
সাদা পাখি আরও বললো: তোমার উচিত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে গিয়ে মেয়েটাকে ভালো করে বেঁধে গাছের সাথে আটকে রাখা। আর একটা গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তে তুমি লুকিয়ে থাকবে। মনে রাখবে, যতক্ষণ ওই মেয়ে তার মায়ের দুধের কসম না খাবে ততক্ষণ তুমি গর্ত থেকে বের হবে না’। শিরযাদ ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সাদা পাখি যা যা বলেছিল তাই করলো। ঘণ্টাখানেক পর সত্যিই দেওকন্যা জেগে গেল এবং এতো জোরে চীৎকার দিলো যে গর্তের ভিতরে থেকেও শিরযাদ ভূকম্পন অনুভব করলো। মনে মনে সে বললো: কী সুন্দর মেয়ে! ও যদি আমার স্ত্রী হতো! কিন্তু প্রতি মাসে এক সপ্তাহব্যাপী ঘুমাবার পর যদি এভাবে চীৎকার দিয়ে ওঠে তাহলে তো শহরের কারও কানের পর্দা থাকবে না।
দেওকন্যা তার আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। সে বিলাপ করতে করতে বলতে লাগলো: কে তুমি ওখানে! বেরিয়ে আসো! আমার বন্ধন খুলে দাও! আমি এখন তোমারই। আমি যার নামে শপথ করতে বলো, করবো।
কিন্তু শিরযাদ পাখির কথামতো মায়ের নামে কসম না খাওয়া পর্যন্ত বেরুলো না। মায়ের নামে কসম খাওয়ার পর গর্ত থেকে বেরিয়ে শিরযাদ মেয়েকে মুক্ত করলো এবং ঘোড়ায় চড়িয়ে আবারও রওনা হলো।#
পথিমধ্যে আবহাওয়া গুমোট হয়ে এলো। হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল ঝড়-তুফান। এমন ভীষণ তুফান যে শিরযাদের মনে হলো এ মুহূর্তে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে যদি কোথায় আশ্রয় না নেয় তাহলে ঝড় তাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথায় আশ্রয় নেয়া যায় জায়গা খুঁজলো। চোখে পড়লো তার একটা কেল্লা। খুব বেশি দূরে নয়,কাছেই। ঘোড়াকে সে ওই কেল্লার দিকে ঘুরালো। কিন্তু যখন সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে চাইলো তখনই সেই সাদা পাখি এসে হাজির। সাদা পাখি এবার শিরযাদকে তার ধারালো নখ দিয়ে আঘাত করতে শুরু করলো। এমনভাবে নখ দিয়ে খোঁচালো যেন শিরযাদ ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে না পারে। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে আর নামলো না শিরযাদ। আর সাদা পাখি ঘোড়ার পিছে পিছে উড়ে যেতে লাগলো।
শিরযাদ বেচারা এই ঝড়-তুফানের ভেতরেই ঘোড়া নিয়ে ছুটলো। ধীরে ধীরে তুফান থেমে গেল এবং শিরযাদ আর দেওকন্যা কিছুটা স্বস্তি পেল। সাদা পাখিও এবার চলে গেল। কিছুটা পথ সামনে যাবার পর শিরযাদ দেখলো একটা কৃষিভূমিতে সোনার লাগাম আর মালা পরা একটা ঘোড়া আনমনে লেজ নাড়াচ্ছে আর চরে বেড়াচ্ছে। সাদা ডিমের খোসার মতোই দেখতে,একদম সাদা। দেওকন্যা বললো: ‘শিরযাদ! দেখো কী সুন্দর ঘোড়া! যদি এই ঘোড়াটাকে ধরে আনতে পারতাম তাহলে আমি ওই ঘোড়ার পিঠে চড়তাম! তাহলে তোমার আর কষ্ট হতো না। আমারও না!’
দেওকন্যার কথা শেষ না হতেই সাদা ঘোড়া হ্রেষা তুলে দৌড়ে এলো তাদের কাছে। শিরযাদ ঘোড়াটির লাগাম হাতে তুলে নিতে গেল ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও ওই সাদাপাখি বিজলির মতো এসে হাজির হলো। এসেই সে শিরযাদকে নখ দিয়ে আঘাত করতে লাগলো এবং ঘোড়াটিকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো।
সাদাপাখির এই আচরণে শিরযাদ বিরক্ত হলো। কিন্তু কিছুই বললো না। সে তার মতো যেতে লাগলো। যেতে যেতে এক সময় গিয়ে পৌঁছলো সেই দৈত্যের কেল্লার কাছে যে কেল্লার দৈত্য তাকে আঙুরের ঝুড়ি দেওয়ার জন্য শর্ত দিয়েছিল সাদা দৈত্যের কন্যাকে নিয়ে আসতে। সাদা পাখি এবার শিরযাদকে বললো: একটু ধৈর্য ধরো,একটু অপেক্ষা করো শিরযাদ! আমার মনে হচ্ছে তুমি এবং এই দেওকন্যা পরস্পরকে ভালবাসতে শুরু করেছো। তাহলে এই কন্যাকে তো কোনোভাবেই দৈত্যের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। এক কাজ করো! আমি এখন ঠিক এই দেওকন্যার মতো রূপ ধারণ করবো। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে দৈত্যের কাছে আর এই কন্যাকে এখানে রেখে যাবে।’
তাই করলো শিরযাদ। আর ওই দৈত্য এক ঝুড়ি আঙুর দিলো শিরযাদকে। আঙুর নিয়ে বেরিয়ে এসে শিরযাদ দেওকন্যাকে ঘোড়ায় চড়িয়ে ফিরে চললো দৈত্যকেল্লার দিকে।
যেতে যেতে প্রায় পৌঁছে গেল কবুতর পালা দৈত্যদের কেল্লায়। হঠাৎ করে সেই সাদা পাখি আবারও এলো। শিরযাদকে সে একইভাবে বললো: একটু অপেক্ষা করো! আঙুর রেখে তুমি আমাকে নিয়ে যাও দৈত্যের কাছে। বিস্ময়ের পর বিস্ময় নিয়ে শিরযাদ তাই করে। আঙুরের পরিবর্তে আঙুররূপি সাদাপাখি নিয়েই সে যায় দৈত্যের কাছে। দৈত্য শিরযাদকে এক জোড়া কবুতর দেয় এবং সেই কবুতর নিয়ে শিরযাদ রওনা হয় সরাইখানার দিকে যেখানে সে রেখে এসেছে মুসাফিরকে, যে মুসাফির তাকে চেরাগ পাবার জন্য কবুতরের শর্ত দিয়েছিল। এখানেও সে কবুতরের পরিবর্তে সাদা পাখিটাকেই দেয় মুসাফিরকে আর তার কাছ থেকে চেরাগটা নিয়ে যাত্রা করে প্রাসাদের দিকে।
শিরযাদের প্রাসাদে ফেরার কথা এক কান দু’কান হতে হতে তার চাচার কানেও পৌঁছে যায়। চাচা তার দরবারের অভিজাতদের নিয়ে শিরযাদকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যায়। শিরযাদ যা নিয়ে এসেছিলো সেদিকে বাদশাহর নজর পড়তেই শিরযাদকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো: শিরযাদ! বাছা আমার! তুমি সত্যিই বীর, নির্ভীক বীর!
বাদশার আদেশে শিরযাদ দেওকন্যাকে বিয়ে করলো। চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত এ উপলক্ষে জমজমাট উৎসব হলো। শিরযাদ যখন তার কক্ষে ঢুকলো সাদা পাখিও তার সঙ্গে গেল। পাখিকে দেখে শিরযাদ বিরক্ত হলো খুব। বাদশাহ সাদাপাখিকে তার কাছে ডেকে কারণ দর্শাতে বললো। পাখি বললো: শিরযাদ জিজ্ঞেস করো আমি তার কোনো ক্ষতি করেছি কিনা?
জবাবে শিরযাদ বললো: এই পাখিটা আমাকে ঝড়-তুফানের ভেতর একটু আশ্রয় নিতে দেয় নি। এমনকি স্বর্ণের লাগামসহ বিচিত্র সরঞ্জাম পরা চমৎকার একটি সাদা ঘোড়ার মালিক হতেও দেয় নি। গতরাতে আমাদের কক্ষে ঢুকে বিরক্ত করেছে।
সাদা পাখি এবার বললো: ঝড়ের মাঝে তোমাকে ঘোড়া থেকে নামতে দেই নি এজন্য যে ওই ঝড় ছিল স্বয়ং মেয়েটির বাবা। তুমি যতক্ষণ ঘোড়ার পিঠে ছিলে ততক্ষণ তার সাধ্য ছিল না তোমার কোনো ক্ষতি করে। তোমাকে মাটিতে নামাতে পারলেই সে তামাকে ধ্বংস করে দিতে পারতো। একথা বলেই সাদা পাখি দেওকন্যার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো: ঠিক বলেছি না? মেয়ে বললো: তুমি ঠিকই বলেছো।
পাখি আবারও বলতে লাগলো: ওই স্বর্ণ পরিহিত ঘোড়ার মালিক হতে দেই নি এজন্য যে ওটা আসলে ঘোড়া ছিল না, ও ছিল এই মেয়ের চাচা। ওই ঘোড়ার গায়ে যদি তোমার হাত পড়তো তাহলে তোমাকে সে মাটিতে ফেলে মেরেই ফেলতো। এই বলে পাখি আবারও মেয়ের অনুমোদন নিতে চাইলো। দেওকন্যা বললো পাখি যথার্থই বলেছে।
সাদাপাখি আবারও বলতে লাগলো: গতরাতেও আমি তোমার কক্ষে এজন্যই ছিলাম যে, এই মেয়ের ভাই একটা কালো সাপ হয়ে তোমার কক্ষে লুকিয়ে ছিল তোমাকে মারার জন্য। রাতে তুমি যখন ঘুমিয়েছিলে তখন আমি ওই সাপটাকে মেরেছি। এই হলো সেই মরা সাপ। এই বলে সাপটাকে দেখালো পাখি। মেয়েটা এবারও পাখির কথা সত্য বলে রায় দিলো।
এরপর ঘটলো আরও অবাক করা ঘটনা। পাখিটা বললো: আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো যে আমি একজনকে সারাজীবন সাহায্য করে যাবো। যাকে সাহায্য করবো সে যদি মানুষ হয় তাহলে তার স্ত্রী হবো নতুবা মারা যাবো। আমার এখন সময় ফুরিয়ে এসেছে এবং এখুনি আমি মারা যাবো। বলতে না বলতেই পাখিটার প্রাণ উড়ে গেল কোথায় কে জানে। শুধু তার দেহটা পড়ে থাকলো পাথর হয়ে। দরবারে উপস্থিত সবাই এই ঘটনা দেখে ভীষণ কষ্ট পেল। পাখির মৃত্যুতে সবাই কাঁদতে শুরু করে দিলো।