আমার বাবা

আমার বাবা

ম্যানেজার ; স্যার আপনি ফোন ফেলে গেছিলেন অফিস রুমে অনেক বার রিং হচ্ছিল।
,
এজাজ সাহেব ; ওহ মনেই ছিল না তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছিলাম।দিন ফোনটা দিন। দেখি কে কল করেছে।(ফোন হাতে নিয়ে এজাজ সাহেব)২১ বার একটা নাম্বার থেকে কল।অচেনা নাম্বার।কে হতে পারে।কল ব্যাক করে দেখি তো।(📲📲 দুঃখিত সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না)যাহ অফ বলছে ১০ মিনিট আগের মিস কল এখনি অফ।কে ছিল কেন এতো বার কল করেছে।এটা তো আমার প্রাইভেট। নাম্বার আউট লোক তো জানেনা কেউ।একটা এসএম এস ও দিয়েছে দেখি।দেখিতো কি এসএমএস।

,,,,এজাজ সাহেব চেয়ারে বসে টেবিলের উপর থেকে চশমা পরে নিলো। ইনবক্সে ঢুকে এসএমএস সিন করলো।
,
,
(sms টা ছিল এমন)
,
আসসালামু আলাইকুম,
কেমন আছো বাবা।(বাবা কথাটা দেখে একটু অবাক আর বিরক্ত হলো এজাজ সাহেব) আমি জানি তুমি আমার কথা মনে রাখোনি আর মনে করতে চাও ও না।২১ বার কল দিয়েছি কিন্তু হয়তো অচেনা নাম্বার বা কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে তুমি রিসিভ করোনি।আমার ২৫ বছর বয়সে এই ২ য় বার তোমার কাছে কিছু চাইবো আশা করি আগের বারের মতো তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিবে না বাবা।প্রথম বার যেদিন তোমার থেকে একটা স্যান্ডেল কিনে চেয়েছিলাম স্কুলে যাবার জন্য তখন আমার কেবল ১০ বছর বয়স ছিল।তুমি দাওনি কিনে।বলতে খারাপ লাগছে তবুও বলছি তুমি মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছিলে।টাকা কি আমি চুরি করে আনবো তোর জন্য।আমি ছোট ছিলাম তাই ভেবে ছিলাম তুমি মজা করছো।তাই আমি হেসে হেসে বলেছিলাম। কি যে বলো। চলো এখনি স্যান্ডেল কিনে দিবে আমার স্কুলে যাওয়া লাগবে।তুমি দিবে না তো কে কিনে দিবে তুমি তো আমার বাবা।আমার কথা গুলো পেছনে দাড়িয়ে শুনছিল মা।তুমি তখন বললে আমি তোর বাবা না এখান থেকে যা।
আমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম কথাটা শুনে।কাঁদো কাঁদো গলায় তোমায় আবার জিগালাম তাহলে কে আমার বাবা।তুমি বলেছিলে আমি কি জানি কে তোর বাবা। তোর মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।এখান থেকে যা কানের গড়ে প্যানপ্যান করিস না।পেছন থেকে মা এসে আমার হাতে বাইরে নিয়ে গেলো। আমার সাথে মা ও কেঁদে ফেললো। আমার একটাই দোষ ছিল আমি মেয়ে।প্রথম মেয়ের পর সবাই আশা করেছিল এবার ছেলে হবে কিন্তু আবার মেয়ে হয়। আর সেই মেয়ে আমি।বড় আপু ও তো মেয়ে কিন্তু তুমি তাকে অনেক ভালোবাসো।আর আমাকে দেখলেই রেগে যাও। তোমার কথা মতো তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নিলাম কিন্তু ভাগ্যে আল্লাহ কোনো সন্তান দিলো না বিয়ের ৫ বছরের মধ্যে তাই স্বামী, শশুর তারিয়ে দিলো। ফিরে সেই তোমার কাছেই গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ভার নিবে না বলে বাড়িতে উঠতে দাওনি।মা কে বলে দিয়েছিলে আমাকে যদি সে খাবার দেয় বা থাকতে দেয় তাহলে তুমি তাকে তালাক দিবে।মা না পারছিল আমাকে নিতে না পারছিল তারিয়ে দিতে।নিজেই মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসছিলাম।পেছন থেকে তুমি বলেছিলে আমি যেন আর কখনো তোমাদের কাছে না যায়।আমি বাজা, অলক্ষী আমার বাচ্চা হবে না।আর পরেও কেউ আমাকে বিয়ে করবে না।মনে হচ্ছিল তখন মরে যায়।কিন্তু তখনি মনে হলো এই দুনিয়া থেকে নিজ হাতে মরে গেলে পরকালেও জায়গা পাবো না।আমি আল্লাহ কে প্রশ্ন করবো কেনো তিনি আমাকে মেয়ে করে পাঠালেন।সেদিন না মরে ঢাকায় চলে এসছিলাম। কিছুটা লেখাপড়া জানা ছিল বলে এক কোম্পানিতে একটা ছোট চাকরি পেয়ে যায়।সততা আর কাজ ভালো করতাম দেখে চাকরির প্রমোশন হলো।১০ হাজার টাকার বেতন থেকে আস্তে আস্তে আমি এখন ৩৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি।এখানেই একজন কে ভালো লেগে যায়।আমার অতীতের সব কথা জানার পরেও সে আমাকে বিয়ে করে।বিয়ের ১ বছর পর আমি প্রেগন্যান্ট হই।আমার এতো খুশি লাগছিল যে মনে হচ্ছিল একবার দৌড়ে তোমাদের কাছে চলে যায়।একবার তোমাদের বলে আসি আমি বাজা না আমি অলক্ষী না। আমিও আর দশ জন মেয়ের মতো স্বাভাবিক। আমিও মা হতে পারবো।কিন্তু সত্যি বাবা আমি অলক্ষী আমার ভাগ্যে ভালো কিছু নেই।আমি যখন ৮ মাসের প্রেগন্যান্ট তখন আমার স্বামী রোড এক্সিডেন্ট করে মারা গেলো। ওর পরিবারে কেউ নেই ও এতিম ছিল।আজ ২ দিন হলো আমার একটা ছেলে হয়েছে।আমি হসপিটালে আছি।আমার পাশে কেউ নেই বাবা।নিজেকে সারা জীবন অসহায় লাগতো আজকেও তেমনি লাগছে।ডাক্তার বলেছে বাড়ির কাউকে ডাকতে।আমার শরীর ভালো নেই বাবা যে কোনো সময়ে আমি না ফেরার দেশে চলে যেতে পারি।আমার ছেলের এখন তোমরা ছাড়া আর কেউ নেই।প্লিজ বাবা তুমি একবার আসো । যদি আমার মেয়ে হতো তাহলে ভুলেও তোমাকে খবর দিতাম না।ছেলে হয়েছে তাই বলছি।আর ভয় নেই বাবা তোমার আমার ছেলের সমস্ত খরচ আমি দিবো। আমার আর আমার স্বামীর যতো টাকা আর সম্পত্তি সব তোমার নামে আমি করে দিয়েছি সেই টাকা দিয়ে তুমি আমার ছেলেকে মানুষ করবে।আমার কাছে খুব কম সময় বাবা প্লিজ তুমি আসো। আমি সব ঠিকানা দিয়ে দিলাম।আমার ছেলেকে নিয়ে যেও তুমি।জানিনা তুমি তোমার অলক্ষী মেয়ে ঝুম কে দেখতে পাবে কি না।
,,,,,,,
এসএমএস পরে এজাজ সাহেব অঝোরে কাঁদতে লাগলো। শুধু একবার জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নার আওয়াজ পেয়ে বাইরে থেকে ম্যানেজার আর কিছু স্টাফ ছুটে আসলো। এসে দেখে এজাজ সাহেব জ্ঞান হারিয়ে নিচে পরে আছে।সবাই ধরে ক্লিনিকে নিয়ে গেলো। একজন এজাজ সাহেবের স্ত্রী কে খবর দিলো। চোখ খুলে নিজেকে বেডে আবিষ্কার করে এজাজ সাহেব।তড়িঘড়ি করে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিলো এজাজ সাহেব আর মিসেস এজাজ।ঝুমের দেওয়া ঠিকানাতে গিয়ে হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে ঝুমের নাম্বারে কল দিলো এজাজ সাহেব।ওপাশ থেকে একজন ছেলে মানুষের কন্ঠ ভেসে এলো।
.
,,
আপনি কি এজাজ সাহেব। (ডাক্তার)
জ্বী আমি এজাজ রিসান ঝুমের বাবা। আমরা হসপিটালের সামনে আছি ঝুম কয় নাম্বার কেবিনে আছে। (এজাজ সাহেব)
স্যার আপনি কেবিনে না।৩ য় তলায় ১৩০ নাম্বার রুমে আসুন হিম ঘরে।(ডাক্তার)
কিহ,হিম ঘর হিম ঘরে কেনো।(এজাজ সাহেব)
আসলেই জানতে পারবেন (ডাক্তার)
,
,
নিজেকে সামলে নিয়ে ৩ য় তলায় ১৩০ নাম্বার রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো এজাজ সাহেব আর উনার স্ত্রী সিফা এজাজ।একজন লোক এসে কিছু পেপার উনার হাতে দিলো আর একটা বাচ্চাকে দিলো। মিসেস এজাজ বাচ্চা কে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো।
,,
,,
স্যার এখানে একটা সই করে দিন।আপনার মেয়ে ঝুম এজাজ ২ ঘন্টা আগে মারা গেছে।আর তিনি কিছু পেপারস রেখে গেছে আপনাদের দিবার জন্য।আর বলেছেন উনার কবর যেন উনার স্বামীর পাশে দেওয়া হয়।আর হ্যা উনি আরেকটা কথা বলেছেন। উনার ছেলের নাম করণ আপনাকে করতে বলেছে আর নামের শেষে এজাজ যুক্ত করতে বলেছে।(ডাক্তার)নিস্বপ্রাণ পাথরের মত দাঁড়িয়ে ডাক্তারের কথা শুনছিল এজাজ সাহেব।কিছু ক্ষণের জন্য ডুবে গেলো ২০ বছর আগের অতিতে।ঝুমকে যখন স্কুলে প্রথম দিন নিয়ে গেছিলো সেদিন স্কুলের স্যার নাম জিজ্ঞাস করেছিল ঝুমকে। ঝুম বলেছিল ওর নাম ঝুম এজাজ,আম্মুর নাম সিফা এজাজ,আপুর নাম ঝিল এজাজ আর আব্বুর নাম এজাজ রিসান।স্যার মুচকি হেসে ঝুমের গাল টেনে বলেছিল নাইছ নেম বেটা।
ডাক্তার সাহেবের ডাকে অতিত থেকে ফিরে এলো এজাজ সাহেব।চোখে পানি টলটল করছে।মিসেস সিফা বাচ্চাকে নিয়ে চেয়ারে পাগলের মত কাঁদছে। এজাজ সাহেব সই করে দিয়ে ঝুমের লাশ নিয়ে ওর স্বামীর পাশে দাফন করে বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। মেয়ের ছবিতে হাত রেখে কেঁদে চলেছে এজাজ সাহেব।
,
,
তুই যখন বেচে ছিলি তখন তোর অভাব বুঝতে পারিনি।কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমি কি হারিয়ে ফেলেছি।আমি জানি আমি তোর কাছে ক্ষমার যোগ্য না মা।প্লিজ তুই আমাকে মাফ করে দিস।(এজাজ সাহেব)
,,
৫ বছর পর
,,
আজ ঝুমের ১৪ ফেব্রুয়ারি।আজ ঝুমের ৫ ম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিদিনের মত আজকেও এজাজ সাহেব ঝুমের ছবির দিকে এক ধিনে তাকিয়ে আছে।
,,
,,
ও নানু ভাই নানু ভাই চলো চলো আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। (ঝুমের ছেলে)
,
হুম নানু কোথাও যাবে।(এজাজ সাহেব)
,
(গাল ফুলিয়ে)ভুলে গেছো আজ আমার স্কুলে প্রথম দিন।(ঝুমের ছেলে)
,
এই যাহ ভুলেই গেছি। চলো চলো নানু ভাই চলো।(এজাজ সাহেব)
,
,
স্কুলে প্রথম দিন আজ রিফাত এজাজের।ঝুমের কথা মত এজাজ সাহেব ঝুমের ছেলের নাম রেখেছে রিফাত এজাজ। রিফাতের মধ্যে ঝুমকে খুঁজে পায় এজাজ সাহেব।রিফাত কে জুড়ে এখন তার ভালো থাকা।
,
,
(কেউ ভাববেন না আমি নিজের বাবাকে খারাপ করে বলছি।এটা শুধু সেই ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করা বলা যারা একের অধিক কন্যা সন্তান হলে রাগ করে। স্ত্রীয়ের উপর অত্যাচার করে।)
,
…………………………………………..সমাপ্ত…………………………………………

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত