মীম যে আমার বন্ধু ছিল এটা আমি কোন দিন বলবো না । আমরা একই ক্লাসে পড়তাম । একই সাথে ক্লাস করতাম তবুও আমাদের মাঝে সব মিলিয়ে কতবার কথা হয়েছে সেটা সম্ভবত একটু হিসাব করলেই বলে দেওয়া যাবে । চার বছর এক সাথে অনার্স করার পর মীম এমবিএ করতে অন্য ইউনিভার্সিটিতে চলে গেল । আমি মাস্টার্স শেষ করে বের বের হয়ে এই কোম্পানীতে ঢুকলাম । তখনই আমার মীমের সাথে আবারও দেখা হল । দুজন আমরা একই সাথে ট্রেইনি হিসাবে যোগদান করেছি ।
তারপর থেকেই মীমের সাথে আমার কথা বার্তা শুরু । অফিস এবং অফিসের বাইরে । পুরো অফিস ভর্তি নতুন মানুষ । কাউকে চিনি না । পরিচিত বলতে কেবল মীম । মীমের বেলাতেও কথাটা সত্য ছিল । তাই আস্তে আস্তে মীমের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগলো । ওর সাথে আমার অনেক কথা হত । সময় গুলো ভালই কাটতো ।
মীম ঢাকাতে একাই থাকতো । চাকরীর কয়েকদিন পরেই ও নতুন বাসা নিলো অফিসের কাছেই । আগে হোস্টেলে থাকতো চাকরির পর নিজের বাসা । সারা দিন দৌড়াদৌড়ি করে বাসা ঠিক-ঠাক করে দিলাম । চেনার পরিচয় বলতে এখন আমিই আছি । ওর বাবা মা মাগুরা থাকতো । আমারও সাহায্য করতে খারাপ লাগতো না । আসলে আমার নিজেরও খুব একটা চেনা পরিচয় কেউ নেই আরও ভাল করে বলতে গেলে আমি ইচ্ছে করেই চেনা পরিচিত মানুষ গুলো থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে রেখেছিলাম ।
ইভার বিয়ের হয়ে যাওয়ার পরে আমি আমার বাসায় আর কোন দিন যাই নি । বাবাকে হাজার বার বলার পরও যখন বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ইভাদের বাসায় গেল না, তখন বাসার প্রতি একটা অন্য রকম অভিমান জমলো । ওর বিয়ের পর আর বাসাতে যাই ই নি কোন দিন । পড়া লেখা করা অবস্থাতেই নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলাম । তারপর কারো সাথেই ঠিক ঠাক মত পরিচয় নেই । বাকী জীবন একা একা থাকা অনেকটাই নিশ্চিত করে ফেলেছি এবং নিজের সাথে বোঝা পোড়াটা সেরে নিয়েছিলাম অনেক আগেই ।
কিন্তু মাঝে মাঝে মন যে কারো সঙ্গ চাইতো না সেটা আমি বলবো না । অবশ্য সেই মনকে গলা টিপে ধরতে আমার খুব একটা কষ্ট হয় নি । তবুও মানব মন বলে কথা । মাঝে মাঝে খুব বেশি হাপিয়ে উঠতাম । তাই আমার জীবনে মীমের আগমন ।
মীমের সাথে মেশার আরেকটা কারন ছিল যে মীমের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক ছিল । আমার আসলে এই দিকে যাওয়ার আর ইচ্ছে ছিল না । মীমের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক থাকায় মীম নিজেও আমার দিকে ঝুকে পড়বে না এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম । তাই ভাবলাম খানিক টা সময় যদি ওর সাথে কাটে কাটুক ।
সব কিছু ভালই চলছিলো । মাঝে মাঝে দুপুর বেলা মীমের বাসায় গিয়ে হাজির হতাম । কোন কোন দিন ওর মায়ের সাথে দেখা হয়ে যেত । মাঝে মাঝে ও মা কিংবা বাবা এখানে এসে থাকতো ওর সাথে । আন্টিও আমাকে ভালই জানতেন । তবে বেশির ভাগ সময় ও ফ্ল্যাটে একাই থাকতো । আমরা দুপুরের খাবারটা ওর ওখানে খেয়ে কিছু সময় গল্প করে আবারও অফিসের দিকে রওনা দিতাম ।
আমার আসলে কোন কিছু মনে হত না । অনেকেরই এরকম টা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এরকম একা একটা মেয়ের বাসায় যাওয়া কি ঠিক ! কিন্তু আমার কথা হল আমি যদি ঠিক থাকি তাহলে কে কি বলল তাতে কি যায় আসে । আর এই ব্যস্ত শহরে কে কার দিকে এতো খেয়াল দিয়ে বসে আছে ।
কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো একদিন । ফেসবুকের ফিল্টার্ড মেসেজ চেক করতে গিয়ে দেখলাম এক লোক আমাকে সেই ভাষা গালাগালাজ করেছে । তার ভেতরে একটা লাইন এমন আছে যে আমি নাকি অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিই ।
আমার মাথায় কিছুই ঢুকলো না । ফেসবুকে কিছু ছবি আপলোড দেওয়া আর মাঝে মাঝে কিছু দুয়েক লাইনের স্টাটাস ছাড়া আমি তেমন কিছুই কোন দিন করি নি । বাস্তবে জীবনে আরও না । তাহলে আমাকে এই কথা বলার মানে কি !
একবার মনে হল ইভার স্বামী হবে হয় তো । কিন্তু এই লোক আমাকে কিভাবে চিনবে আর ইভার বিয়ের পর থেকে তো আমি ওর সাথে তো আর কোন কোন প্রকার যোগাযোগ করার চেষ্টাও করি নি ।
তাহলে ?
আমি কি রিপ্লাই দেব সেটা চিন্তা করতে লাগলাম ।
নাকি ব্লক করে দেব ?
কিন্তু কৌতুহল হল । একটা মানুষ, যাকে আমি চিনি না জানি না আমাকে কেন খামোখা গাল গালাজ করবে ?
প্রোফাইলে গেলাম লোকটার ।
একজন মিউচুয়্যাল ফ্রেন্ড ।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সেই মিউচু্য়্যাল ফ্রেন্ডটা আর কেউ না, মীম ।
এবাউট ইনফোতে দেখলাম লোকটা থাকে আমেরিকাতে ।
আমার মোটেই বুঝতে কষ্ট হল না যে এই লোকটা কে । যদিও মীম কেবল আমাকে বলেছিলো একটা ছেলের সাথে তার পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তবে কোন দিন লোকটার ব্যাপারে আর কিছু বলে নি । এমন কি লোকটার নামও আমাকে বলে নি । আমিও এই বিষয়ে জানতে চাই নি ।
আমি লোকটার মেসেজের উত্তর দেওয়ার আগে মীমকে ফোন দিলাম । ও সব শুনে কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল
-তুমি কি এখন আমার বাসায় আসতে পারবে ?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ৯টার মত বাজে । আগামীকাল ছুটির দিন । তাই খুব একটা সমস্যার হওয়ার কথা না । আমি আর কোন কিছু না ভেবে মীমের বাসার দিকে রওনা দিলাম । যখন পৌছালাম তখন প্রায় ১০ টা বেজে গেছে ।
আমার মাথাতে কিছু ঢুকছে না তবে মীমকে কেমন যেন শান্ত মনে হল । টেবিলে রাতের খাবার দেওয়া ছিল । মীম বলল খেতে খেতে কথা বলি !
আমি খাওয়া শুরু করলাম । খাবারের মাঝে এক সময়ে মীম বলল
-আসলে শামীমকে আমি এমন কিছু বলেছি যে ও তোমাকে দোষী মনে করছে !
শামীম হচ্ছে সেই লোকটার নাম যে আমাকে ফেসবুকে গালী দিয়েছে । আমি খাবার মুখে নিতে নিতে বললাম
-কি এমন বলেছো ?
-আসলে আমি ওকে কোন দিন বিয়ে করতে চাই নি । অনেকটা বাবা জোর করেই শামীমের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলো অনেক আগে থেকে । আমি কোন দিন আমেরিকা যেতে চাই না । আমি এখানে থেকে নিজে কিছু করতে চাই ।
-তা তো বুঝলাম কিন্তু এর ভেতরে আমি এলাম কোথা থেকে ?
-আসলে …..।
মীম পাতের ভাত নিয়ে কিছু সময় নাড়াচাড়া করছিলো । ও যে কাজটা করেছে সেটা বলতে দ্বিধা বোধ করছে । আমি বললাম
-বল
-আমি বলেছি যে তোমার সাথে আমার কিছু চলছে !
-মানে ? কি চলছে ?
-মানে ……
এই কথাটা বলে মীম আমার দিকে তাকালো । তারপর মাথা নিচু করে বলল
-মানে তোমার সাথে প্রেম চলছে । তুমি আমাকে প্রোপোজ করেছো আর আমি মানাও করতে পারি নি । আর সেই সাথে আমার বাসায় তুমি নিয়মিত আসো !
শেষ কথাটা শুনে আমার গলায় ভাত আটকে গেল । সামনের গ্লাস থেকে পানি খেয়ে কোন মতে ভাতটা বুক দিয়ে নিচে নামালাম । শেষ লাইন টা দিয়ে মীম আসলে কি বুঝিয়েছে আমার সেটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না, অন্য কারো বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না । মীম নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক ভাবে ।
মীম কিছু সময় পরে আবার বলল
-তোমার সাথে আমার অনেক ছবি তোলা আছে । সেগুলো কিছু পাঠিয়েছি ।
আমি কি বলবো ঠিক বুঝলাম না । মীম মাথা নিচু করেই রইলো । আমি আবারও খাওয়াই মন দিলাম । খেতে খেতেই মনে হল মীম নিজের একটা ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য আমার নাম ব্যবহার করেছে । আমার অবশ্য কি বা যায় আসে । সব কিছু পরিস্কার হল । শামীম সাহেব কেন আমাকে গালী দিয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম । আমি বললাম
-তো এখন কি অবস্থা ? শামীম সাহেব কি বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে ?
মীম আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি রাগ কর নি ?
-নাহ ! একটু কনফিউজ ছিলাম । এখন ওকে । সমস্যা নেই । বিয়ে কি ভেঙ্গে গেছে ?
-হুম !
-খুশি তুমি ?
-খুব !
মীম হেসে উঠলো । আমিও হাসলাম ।
ঐদিন মীমের বাসা থেকে বের হতে হতে ১২টার মত বেজে গেল । আমি ভেবেছিলাম ঝামেলা মনে হয় এখানেই শেষ । কিন্তু আমি কি ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি সেটা আমি নিজেও জানতাম না তখনও । শুক্রবারে আর মীমের সাথে আমার দেখা হল না । কোন কথাও হল না। শনিবার সকালে মীমের ফোনেই আবার ঘুম ভাঙ্গলো । সকাল বললে ভুল হবে । দুপুরের দিকে । আমি ছুটির দিনে লম্বা ঘুম দেই ।
মীম বলল ওর বাসায় যেন এখনই আসি । আমার মনে হল দুপুরেরও মনে হয় ওর বাসায় দাওয়াত দিতেই ও ফোন দিয়েছে । ফ্রেশ হয়ে রওনা দিলাম । যখন মীমের বাসায় এসে হাজির হলাম তখন একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলাম । মীমের বসার ঘরে মীমের বাবা বসে আছে । এবং সেই সাথে আমার বাবা বসে আছে ।
আমার বাবা এখানে কেন ?
আমার মাথার ভেতরে কিছু ঢুকছে না । আমার বাবার তো এখানে আসার কথা না কোন ভাবেই । তাহলে এখানে কেন ?
আমাকে দেখে বাবা এগিয়ে এল । আমাকে খানিকটা জড়িয়ে ধরে বলল
-তুমি যে নিজের জীবন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছো এটাতেই আমি খুশি । মীমকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে ।
-মানে ?
আমি কোন উত্তর না পেয়ে কেবল বোকার মত তাকিয়ে রইলাম মীমের বাবা আর আমার বাবার দিকে । আমি কোন কথা না বলে বাড়ির ভেতরের দিকে হাটা দিলাম । ভেতরের ঘরে মীমের মা সাথে আমার নিজের মাও ছিল । মা আমাকে ধরে কত রকম কথা বলতে লাগলাম তবে আমার কানে কিছু ঢুকছে না । আমার চোখ খুজছে মীম কে । একটু পরেই আমি মীমকে দেখলাম ঘরে ঢুকতে । ওকে দেখতে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না । আমি সবাই কে ছাড়িয়ে মীমকে নিয়ে বারান্দায় চলে এলাম । বললাম
-কি হচ্ছে এসব ?
-আসলে আমি ভাবি নি এটা এমন দিকে যাবে ।
-কেমন দিকে ?
-শামীম আর ওর পরিবার নিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার সময় বাবাকে তোমার কথা বলেছে । আরও অনেক কথা !
আমি মীমের দিকে তাকিয়ে আছি । অনেক কথা বলেছে বলতে মীম কি বোঝাতে চেয়েছে বুঝতে পারলাম । মীম বলল
-আসলে কোন মেয়ের বাবাই এসব সহ্য করবে না ।
-তারপর ?
-বাবা এসে তোমার কথা জানতে চাইলো । তারপর ……….
তারপর কি হল আমি বুঝতে পারলাম । আর সেই সাথে মীম যে কোন কথা বলে নি সেটাও বুঝতে পারচি । ওর অবশ্য আমার ব্যাপারে সত্য কথা বলার কোন উপায় ছিল না । বললে হয়তো ওর বাবা বিশ্বাস করতো না । আর বিশ্বাস করলে তো আবার নতুন ঝামেলা শুরু হয়ে যেত । কিন্তু আমার বাবা মা এখানে কিভাবে এল ! আমি বললাম
-কিন্তু আমার বাবা মা এখানে কেন ?
মীম বলল
-আসলে একদিন তোমার মোবাইল থেকে আমি কয়েকদিন আগে তোমার মায়ের নাম্বার টা নিয়ে ছিলাম । মনে আছে ?
-আছে !
মীম আমার ফ্যামিলির সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানতো । ওর ইচ্ছে ছিল যেন আমার সাথে আমার ফ্যামিলির সম্পর্কটা আবার ঠিক হোক । তাই নাম্বার টা নিয়েছিল আমার মায়ের সাথে কথা বলার জন্য ।
-বাবা তোমার সাথে যোগাযোগ করার আগে তোমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন । তারপর আজকে সকালে তোমার বাবা এখানে হাজির । দুজন মিলে কি কথা বলেছে আমি জানি না । তবে দুজনেই এই সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছেন যে আমাদের বিয়ে হওয়া উচিৎ !
আমি কি বলবো আসলেই খুজে পেলাম না । মীমের দিকে তাকিয়ে মনে হল ও এই বিয়ে নিয়ে খুব খুশি ! আমি বললাম
-তুমি কিছু বললে না ? বললেন না সত্য টা ?
-মাথা খারাপ ? তাহলে বাবা আমাকে আবারও ঐ শামীমের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে !
-তাই বলে তুমি আমাকে ডুবাবে ?
মীম মুচকি হেসে বলল
-ঐ আমেরিকার থেকে তুমি অনেক ভাল । বড় কথা তোমার সাথে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং টা অনেক ভাল । তোমার সাথে বিয়ে হলে আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে না । আমরা একই সাথে জব করতে পারবো । আর তুমি বল আমার সাথে তোমার সময় ভাল যায় না ?
-যায় কিন্তু তার মানে ……
-আগে যেমন গিয়েছে সামনেও যাবে । বুঝছো ? এখন যা হচ্ছে হতে দাও তো
মীম আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই মীমের মা এসে বলল কাজী নাকি চলে এসেছে । এখনই ওকে তৈরি হতে হবে । আমি আমার মাকে হাসি মুখে এগিয়ে আসতে দেখলাম । মায়ের হাসি মুখ অনেক দিন পরে আবার দেখতে পেলাম । মা তো ধরেই নিয়েছিলো আমি হয়তো আর কোন দিন বিয়েই করবো না কিন্তু এই হঠাৎ করেই এভাবে আমার সাথে মীমের এরকম সম্পর্কের কথা শুনে ওনারা দুজনেই খুব খুশি হয়েছে নিঃসন্দেহে ।
একবার মনে হল সবার ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দেই । মীমের সাথে আমার কি হয়েছে কিংবা ওর সাথে আমার কেমন রিলেশন এটা সবাইকে জানিয়ে দেই কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল, থাকুক ।
কি দরকার ! যা হচ্ছে খারাপ তো না ! জীবনে কত দুর্ঘটনাই তো ঘটে !