গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এক দুপুর। বৃক্ষের শাখায়, পত্র-পল্লবে বাতাসের কোন স্পন্দন নেই। সূর্যও যেন ক্রোধে উন্মত্ত; জ্ঞাণশূণ্য হয়ে দিগ্বিদিক তাপ ছড়াচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় উনুনে চড়ানো মাংসের মতো সেদ্ধ হচ্ছিল নগর-মফস্বলের আইপিএস কিনতে অসমর্থ মানুষগুলো। এমনই এক দুপুরে সেমিজের ওপর পাতলা সুতি কাপড়ের ওড়না ভিজিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল সুরাইয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ভেজা কাপড় থেকে রীতিমত ভাপ বের হতে লাগল। কিন্তু বারান্দার গ্রিল ধরে দূরের ফুলে ফুলে ছেয়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এমন অসহ্য গরমের কথাও ভুলে গেল মেয়েটা। খর রৌদ্রে গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে গাছের মাথায় মাথায়। দাবানলের মতো সেই আগুন এক্ষুণি ছড়িয়ে পড়বে এ গাছে, ও গাছে।
ফুটে থাকা সেই আগুনের দিকে অদ্ভুত মাদকতায় তাকিয়ে ছিল সুরাইয়া। চোখ ফিরে আসতে চায়, তবু ফেরানো যায় না। সুরাইয়ার একবার মনে হল, ঠিক এরকম রঙের একটা শাড়ি যদি তার থাকত, তাহলে আজ সে ঐ শাড়িটাই পরত। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, এরকম রঙের একটা শাড়ি তো তার আছেই—সেই যে গেল বৈশাখে সাহিল উপহার দিয়েছিল, সেই শাড়িটা। কিন্তু সেই শাড়ির এমনই জংলী ছাপা যে, দেখলেই গা রি রি করে। পুরো শাড়ি জুড়ে বড় বড় লতানো ফুল, ঘন নীল রঙের। শাড়িটা সে যত্ন করে আলমারিতে রেখে দিয়েছে, ভাঁজের ভেতর সুগন্ধি কর্পূর ঢুকিয়ে। পরেনি কখনোই।
সাহিল একদিন জিজ্ঞেস করেছিল শাড়িটার কথা। কফি শপে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলেছিল, “নিম্মি, ঐ শাড়িটা পরলে না যে।“
নিম্মি সাহিলের দেয়া নাম। ছোটবেলায় সুরাইয়া নিমকি খেত খুব। পাড়ার সবাই তাকে ‘নিমকি’ বলে ক্ষ্যাপাত। সাহিল বলল, “তোমার নামটা ডাকতে একটুও আরাম হয় না। তারচে নিমকি অনেক ভাল”।
সুরাইয়া ক্ষেপে উঠতেই শুধরে নিয়ে বলল, “আচ্ছা যাও, নিমকি নয়, তোমাকে নিম্মি ডাকব।“
শাড়ির প্রসঙ্গ আনতেই সুরাইয়া মিথ্যে করে জানিয়ে দিয়েছিল যে, শাড়িটা সে গৃহ পরিচারিকা বিন্তিকে দিয়ে দিয়েছে। কাউকে দিতে হলে ভালো, নতুন শাড়িই দিতে হয় কিনা। উত্তর শুনে সাহিল বলেছিল, “হুঁ”। শুধুই একটা ‘হুঁ’। তাকে তখন ঝড়ের আগের নৈঃশব্দ্যের মতো গম্ভীর আর বিষাদ-আক্রান্ত দেখাচ্ছিল। সুন্দরও। কোন অভিযোগ সে করেনি, কোন অভিমানও দেখায় নি। কিন্তু সেই ছোট্ট ‘হুঁ’ তে সবই ছিল, যা কিছু প্রয়োজন ছিল। সুরাইয়া নিজেও জানে না, এই মিথ্যেটা সে কেন বলেছিল। নিশ্চয়ই পরবে না বলে নয়। কিন্তু অন্য কারনটা কী সেটাও সে আজ আর নিশ্চিত করে বলতে পারে না। সেই দুপুরে হঠাৎ সুরাইয়ার মনে হল, অভিমান লুকিয়ে রাখা সেই মুখশ্রী দেখার জন্যই হয়তো সেই মিথ্যেটা বলেছিল সে।
শাড়িটার কথা মনে হতেই হঠাৎই এক বাঁধ ভাঙা আবেগে তাড়িত হল সুরাইয়া। বারান্দা থেকে দৌড়ে দ্রুত ঘরের ভেতর চলে গেল সে। চাবি খুঁজে নিয়ে আলমারি খুলে শাড়িটা নামিয়ে আনল। সেটার গন্ধ শুঁকল, বুকে আঁকড়ে ধরে রাখল কিছুক্ষণ, এবং সবশেষে হালকা ইস্ত্রি করে ভাঁজের দাগগুলো মসৃণ করে নিয়ে আলনায় মেলে রাখল। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, সেদিন সেই শাড়িটা দেখে তার একটুও গা রি রি করল না।
সুরাইয়া মায়ের একটা মাড়হীন, পুরনো শাড়ি নিয়ে শাড়ি পরার কায়দা-কানুন রপ্ত করার চেষ্টা শুরু করল। ছোটবেলা থেকেই তার সমস্ত আগ্রহ বই কেন্দ্রিক। গৃহকাজ কিংবা সাজুগুজু কোন কিছুতেই সে তেমন করে মন দেয় নি কখনো। তাই তেমন পারদর্শিও নয় এসবে। মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের যে এরকমভাবে বেড়ে ওঠা একেবারেই মানানসই নয়, সেকথা শুনতে শুনতেই সে বড় হয়েছে। কিন্তু কারো কথাতেই কোন রকম কর্ণপাত না করে সে সবসময়ই এক রকম উদাসীন থেকেছে। সুরাইয়ার মা আসপারি বেগম বলেন, শাড়ি পরতে পারাও নাকি এক ধরনের শিল্প। অতীতে যতবারই সে এই শিল্প চর্চা করার চেষ্টা করেছে, ততোবারই তার মাথার মধ্যে গণিতের জটিল সমস্যার মতোই তালগোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু। শাড়ি পরার পর দেখা যায়, হয় পেছনের অংশ খুব উঁচুতে উঠে থাকে, আর কুচিগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খায়; নয় কুচিগুলো বেশি ওপরে উঠে থাকে আর পেছনের অংশ পায়ের নিচে চলে যায়। যদিও বা কখনো দুটি পাশ সমান করে পরে, কুচিগুলো যদিও বা মন দিয়ে গুছিয়ে নেয় কখনো, তবু সবগুলো কুচি থেকে অন্তত একটি কুচি যে ভাবেই হোক, নির্লজ্জের মতো বেরিয়ে পড়ে তাকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। এই সবকিছুই যেদিন ঠিক থাকে, সেদিন আঁচল ঠিকঠাক করতে করতেই গলদঘর্ম হতে হয় তাকে। কুচির পাশে ধুতির মতো হয়ে আলাদা করে যে ক’টি ভাঁজ পড়ে, তার কথা না হয় বাদই দেয়া গেল। শাড়ি পরার পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে গিয়ে সুরাইয়ার মনে হয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধও বুঝি পঞ্চ পান্ডবেরা এরচেয়ে কিছুটা সহজে জয় করতে পেরেছিল। সেদিন দুপুরে শাড়ি-পরিধান শিল্প রপ্ত করতে করতে সে আচমকা পড়ে গেল। একলা যে পড়ল তাও নয়। খাটের পাশে রাখা টুলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কাঁচের গ্লাসটাও পড়ল। ভাঙা কাঁচ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শব্দ শুনে আসপারি বেগম ছুটে এলেন রান্নাঘর থেকে; হাঁপাতে লাগলেন তিনি। আসপারি বেগমের সামান্যতেই বুক ধড়ফড় করে ইদানিং। অল্পতেই হাঁপাতে থাকেন। চৌকাঠে পা রাখতেই সুরাইয়া চেঁচিয়ে উঠল,
“মা, কাঁচ ভাঙা,,,”
আসপারি বেগম সেদিকে না তাকিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিস্মিত হয়ে।
“একী অবস্থা! গরমের মধ্যে গায়ে শাড়ি পেঁচিয়েছিস কেন?”
“এমনি, মা। সব কিছুতে এত কারণ খোঁজ কেন, বল তো?”
“কখনো তো শাড়ি পরার আগ্রহ দেখাস না!”
“আজ দেখিয়েছি। কোন সমস্যা আছে?”
“এত রেগে গেলে কী করে হবে? মেয়েদের এত রাগ থাকা ভালো না”।
এই কথায় সুরাইয়া আরো রেগে যেতে পারত। কিন্তু আজ সে রাগল না। হেসে ফেলল। তারপর কোমল সুরে জিজ্ঞেস করল,
“রাগ থাকলে কী হয়, মা? আমার বর কি আমাকে মারবে? মারলে আমিও মেরে দেব”।
বলেই আরও হাসতে লাগল। সাহিল তাকে মারছে আর সেও সাহিলকে মারার জন্য তেড়ে যাচ্ছে- এটা মনে করেই তার হাসি প্রাণবন্ত ঝর্ণার মতো উছলে বের হতে লাগল। সেই ছেলে এতই গোবেচারা যে, কিল দেয়ার বদলে খেয়েই ভূত হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি থেকে যায় তার। আসপারি বেগম ছিটিয়ে থাকা কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করতে করতে মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকালেন। কোথায় যেন একটা গোলমেলে ব্যাপার আছে বলে মনে হতে লাগল তাঁর। বিয়ে কিংবা বর সংক্রান্ত কোন কথা তো এভাবে তার মুখ দিয়ে বেরোয় নি কখনো! আজ হঠাৎ এসব কথা কেন বলছে? সুরাইয়ার মাথা ঠিক আছে তো?, ভাবলেন তিনি। আসপারি বললেন,
“ঐ নতুন শাড়িটা কবে কিনেছিস? দেখলাম না তো একবারও”।
সুরাইয়া আলনার দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মায়ের দিকে ফিরল আবার। বলল,
“ওটা আমার এক বন্ধু দিয়েছে, মা”।
আসপারী উৎসুক হলেন,
“ছেলে, না মেয়ে?”
সুরাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
“এত ফিরিস্তি টেনে হবেটা কী? বন্ধু বন্ধুই, জান না? এই শাড়িটা পরে আমি আজ সেই বন্ধুর বাড়িতে যাব। আজ তার জন্মদিন। তুমি শাড়িটা পরিয়ে দেবে সুন্দর করে?”
আসপারি বললেন, “দেব”। আর কোন বাক্য ব্যয় না করে তিনি ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো নিয়ে চিন্তিত মুখে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। সুরাইয়া মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
মা’কে মিথ্যে বলার জন্য দুঃখই হল তার। কারো জন্মদিনেই সে যাবে না। সে যাবে বিয়েতে। তার নিজের বিয়ে। সুরাইয়ার বাবা ভয়ংকর রাগী মানুষ। চালচুলোহীন সাহিলকে তাঁর মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এদিকে, সুরাইয়ার বড় বোন যেভাবে তার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছে, তাতে করে ছেলে পছন্দ হলে ঘাড় ধরে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেবে সবাই। সাত-পাঁচ ভেবে কাজী অফিসে গিয়েই বিয়েটা সেরে ফেলা স্থির করেছে সে। পরে আস্তে-ধীরে জানানো যাবে। যদি দেখে খুব তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে, তাহলে দুম করে বলে ফেলবে।
বেলা পড়ে যেতেই সুরাইয়ার বড় বোন শায়লা এসে হাজির হল। সঙ্গে তার দুই সন্তান- স্বদেশ আর প্রদেশ। সুরাইয়ার ভাষ্যমতে তারা মূর্তিমান আযাব। ধ্বংসাত্মক কোন খেলা ছাড়া তাদের অন্য কিছুতে তেমন আগ্রহ নেই। দুই ভাই প্রয়িনিয়ত একে অপরকে মারছে, হাতের কাছে ভঙ্গুর কিছু পেলেই আছাড় মারছে, খাবার খেতে দিলে একজন আরেকজনের গালে গালে ঘষে দিচ্ছে, মুখে পানি নিয়ে অন্যের গায়ে কুলকুচা করছে, ওয়ারড্রোবের ওপর থেকে খাটে লাফিয়ে পড়ছে, দরজার পর্দা ধরে টারজানের মতো লাফিয়ে এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে, হেন কুকর্ম নেই যা তারা করতে পারে না। দুই ভাইই পাটকাঠির মতো শুকনো, অথচ গায়ে ঠিক ‘আলীর বল’। কেউ যে তাদের ধরে একটু শাসন করে দেবে সেই উপায় নেই। কামড়ে, খামচে, চিমটে ঠিকই দৌড়ে পালাবে। সুরাইয়ার ভয়ংকর রাগী বাবাকেও তারা ভয় পায় না, এতই অকুতোভয়। ছেলেদের এই দুঃশাসন মায়ের চোখেই পড়ে না। তার নির্লিপ্ত ভাব-ভঙ্গী দেখে মনে হয়, তার দুই ছেলে দুই ক্ষুদে বীর। সুরাইয়ার বোনের সহ্যক্ষমতা গিনেজ রেকর্ডভুক্ত হওয়ার যোগ্য বলেই সুরাইয়ার ধারণা। সুরাইয়া বোনকে মুখ কালো করে অভ্যর্থনা জানাল। আজ বোনের আগমন তার কাছে উপদ্রবের মতোই মনে হচ্ছে। স্বদেশ-প্রদেশ থাকলে এম্নিতেই উপদ্রব, কিন্তু আজকের মনে হওয়া আলাদা করে আলাদা। কেন, সেটা আবারও আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেষ বিকেলে সুরাইয়া সাহিলকে ফোন করল,
“যেখানে থাকার কথা সেখানেই থাকবে, ঠিক আছে?”
“হুঁ”
“আমার আসতে একটু দেরী হতে পারে। বড় আপা এসেছেন। বকবক করেই চলেছেন”।
“ঠিক আছে”।
“কী ঠিক আছে!”
“আপা বকবক করছেন সেটা ঠিক আছে। এতদিন পর এসেছেন, বকবক তো করবেনই”।
“আপা মোটেও এত দিন পর আসেন নি। দুই দিন পর পর চলে আসেন”।
“ঠিকই তো আছে”।
“উফ, তোমার অভিধানে কি এই হুঁ, ঠিক আছে, আচ্ছা, এসব ছাড়া আর কিছু নাই?”
“কী শুনতে চাও? প্রেমের কথা?”
সুরাইয়া হেসে ফেলল। বলল,
“না, এখন সময় নাই হাতে। আমাকে রেডী হতে হবে। আমি যাই। তুমি আমার দেয়া পাঞ্জাবীটা পরে আসবে। আসবে তো?”
“আসব। আমি তোমার মতো উপহারের জিনিস কোন বিন্তিকে দিয়ে দিই নি”।
সুরাইয়া মুচকি হেসে বলল,
“তুমি লক্ষ্মী ছেলে, আর আমি অলক্ষ্মী মেয়ে”।
“আচ্ছা”।
সুরাইয়া বিরক্তি প্রকাশ করার জন্য ‘উফ’ শব্দ করে লাইন কেটে দিল। সাহিলের দেয়া শাড়িটা পরেই তো সে যাবে। শাড়িটা পরনে দেখলে সাহিল একইসাথে বিস্মিত হবে এবং মুগ্ধ হবে। সাহিলের সেই বহু অনুভূতিতে আচ্ছন্ন মুখ কেমন হবে দেখতে, সেটা কল্পনায় দেখার চেষ্টা করল সে। তার কতই না অবাক লাগছে পুরো বিষয়টি চিন্তা করতে। সেই দিনের ছোট্ট সুরাইয়া বড় হয়ে গেছে এতটা! এক অদ্ভুত ভাবালুতায় আক্রান্ত হল সুরাইয়া। হাত-মুখ ধুতে স্নানঘরে প্রবেশ করল সে। আয়নায় কিছুক্ষণ মন দিয়ে দেখল নিজেকে। ঐ কৃষ্ণচূড়া রঙের শাড়িটা পরলে কেমন লাগবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই ভাবতে লাগল। এও ভাবল যে, যেমনই লাগুক, সাহিল তো খুশি হবে। সাহিলের চমকিত মুখের ছবি কল্পনা করে সুরাইয়া দ্বিতীয়বারের মতো পুলকিত হল।
সুরাইয়া স্নানঘরে চলে যাবার পর শায়লা এবার মায়ের সঙ্গে বকবক করতে শুরু করল। স্বামী-সন্তান-শাশুড়ি’র নৈমিত্তিক গল্প, তবু যেন শেষ হয় না। সপ্তাহান্তে বাপের বাড়ি এসে পুরো সপ্তাহের বিবরণ পেশ করতে না পারলে তার খাদ্য ঠিকঠাক হজম হয় না বলে মনে হয়। মা-মেয়ে গল্পে এতই মগ্ন হয়ে গেলেন যে দুই ক্ষুদে বীরের দিকে তাদের মন দেয়ার একটুও সময় হল না। তারা ততোক্ষণে তাদের খালামণির শাড়িটি দেখে বিশেষভাবে পছন্দ করেছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওটাকে তারা লুঙ্গি বানাবে। এত বড় লুঙ্গি প্যাঁচানো অসম্ভব, তাই তারা সেটা কেটে ছোট করার সিদ্ধান্ত নিল। তাছাড়া, মানুষও তারা দু’জন। তারা শাড়িটি নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল, মা এবং নানীর চোখের আড়ালে। স্বদেশ যতক্ষণে ভাবল যে, লুঙ্গির ভাগ নানাকে এবং তাদের বাবাকে না দিলে বিরাট অন্যায় হয়ে যাবে, প্রদেশ ততোক্ষণে নানির সেলাই মেশিনের আশেপাশের অঞ্চল খুঁজে কাপড় কাটার ধারাল কাঁচিটি নিয়ে চুপিচুপি ভাইয়ের পাশে বসে গেল। তারপর দুই ভাই মিলে প্রসন্ন মুখে শাড়িটি কাটতে শুরু করল। প্রথমে তারা নানা এবং বাবার জন্য বড় করে দুই অংশ কেটে নিল। তারপর নিজেদের জন্য দুই অংশ নিল। পরে যখন বুঝল, বিভক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় ভুল হয়ে গেছে, তখন আবার নতুন করে কাট-ছাঁট করার কাজে মগ্ন হল।
সুরাইয়া স্নানঘর থেকে বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখের পানি শুষে নিতে নিতে সেই বারান্দার দিকেই গেল। তার কন্ঠে গুনগুন করে বাজছিল রবীন্দ্রনাথের গান, “প্রেমেরও জোয়ারে ভাসাব দোঁহারে,,,,”। তখনও কর্তন-কর্ম শেষ হয়নি। মুখ থেকে তোয়ালে সরিয়ে বারান্দার এক কোনে বসে শাড়ি কাটাকাটিতে কর্মরত দুই ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে সে বুঝেই উঠতে পারল না, ঠিক কী বলবে, কী বলা উচিত। সে চিৎকার করতে পারল না, রাগে কাঁপল না, মাথা ঘুরে পড়েও গেল না। তার শুধু মনে হল, কাপড় কাটার শব্দের মতো তিক্ত আর জঘন্য শব্দ আর কিছুই পৃথিবীতে নেই। মনে হল, কাঁচি দিয়ে শাড়ি নয়, কেউ তার হৃদয়টা অনেকগুলো খন্ডে ফালা ফালা করে ফেলল। একটিমাত্র কাঁচির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তার কানে হাজার হাজার কাঁচির ক্যাঁচ-ক্যাঁচ হয়ে বাজতে লাগল।