শেয়াল কিছুদিন হইতে কিছুই খাইবার পায় না। বর্ষাকালে সমস্ত দেশ পানিতে ভরা। গেরস্ত বাড়ি হইতে হাঁস-মুরগী ধরিয়া আনিয়া যে মাঠে লুকাইবে, সেই মাঠ এখন পানিতে ডুবুডুবু। না খাইয়া, না খাইয়া শেয়ালের পেট পিঠের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। কোথায় খাবার পাওয়া যায়? কুমীরের বাচ্ছাগুলি নদী দিয়া সাঁতার কাটিয়ে বেড়ায়। তাদের ধরিতে পারিলে বেশ মজা করিয়া খাওয়া যাইত; কিন্তু নদীতে নামিলেই কুমীর আসিয়া তাহাকে ট্যাং ধরিয়ে টানিয়া লইয়া গিয়া একবারে জলপান করিয়া ফেলিবে। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া শেয়াল এক ফন্দি বাহির করিল।
নদীর ধারে এক উচু টিলার উপরে ঝাউ গাছের ডাল পুঁতিয়া শেয়াল এক পাঠশালা খুলিল। ইঁদুর, মাকড়সা, আরশোলা, ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙ্গ হইল পাঠশালার পড়ুয়া। কয়েকটি জোনাকী ধরিয়া আনিয়া এক নাদা গোবরের সঙ্গে আটকাইয়া রাতের কালে পাঠশালা আলো করা হইল। মাথায় ভাঙ্গার হাঁড়ীর টুপি, বগলে পদ্মপাতার খুঙ্গীপুঁথি, কাঁধে গরুর খুঁটার কলম জগুঁজিয়া কাশ ডাটার লাঠি হাতে করিয়া শেয়াল লেজ চাপা দিয়া বসিয়া পড়াইতে আরম্ভ করিল।
ইঁদুর পড়ে চিকির মিকির চিক, আর দাঁত দিয়া ধান চিবায়। শেয়াল তাকে শিখাইয়া দেয়-কি করিয়া রাতের বেলা গেরস্তের গোলা কাটিয়া কালাই, মসুরী বাহির করিয়া আনিবে। বেড়ালকে ফাঁকি দিয়া কি করিয়া ঘরের কলাটা পেয়ারাটা লইয়া আসিবে।
মাকড়াসা তার পেটের ভিতরে হইতে সূতা বাহির করে, তারপর এডালে ওডালে সেই সূতা টানাইয়া সুন্দর জাল তৈরি করে। শেয়াল তাকে শিখাইয়া দেয় কিভাবে সেই জালের এক পাশে চুপটি করিয়া বসিয়া থাকিবে, কোনো পোকা উড়িয়া আসিয়া সেই জালে আটকা পড়িলে সে কি করিয়া এক লাফে যাইয়া পোকাটিকে ধরিয়া খাইবে।
আরশোলকে শিখাইয়া দেয় কি করিয়া সে দেয়ালের বা ঘরের চালার এক পাশে মরার মতো হইয়া চুপটি করিয়া থাকিবে। আর সেই পথে পিঁপড়ে বা ডাশ পোকা আসিলে এক লাফে যাইয়া তাহাকে ধরিয়া খাইবে। মাকড়সার জালের ধারেও সে চুপটি করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে। জালে কিছু আটকাইলে ঠোঁট দিয়া জাল টানিয়া আনিয়া সে পোকাটাকে খাইতে পারিবে, কিন্তু সাবধান! অত বড় দেহটা লইয়া সে যেন মাকড়াসার জালের উপর দিয়া না চলিতে যায়। তাজা হইলে জাল ছিড়িয়া সে মাটিতে পড়িয়া যাইবে।
ঝিঁঝিঁ পোকা ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ করিয়া গান গায়। কত রকমের সুরই তার জানা। সরু, মোটা, মিহি, চড়া কত ভাবেই সে গান করে। কিন্তু গান গাহিলেই তো তার পেট চলিবে না! শেয়াল তাহাকে শেখায়—অনেক রাতে যখন সবাই ঘুমাইয়া পড়ে তখন কি করিয়া চুপি চুপি উঠিয়া কপিগাছের নরম ডোগাগুলি খাইয়া যাইবে।
ব্যাঙ্গকে শেয়ায় কি করিয়া রাতে-দিনে ঘরের ভিতরে হইতে ঝোপের ভিতরে হইতে মশা-মাছি ধরিয়া খাইবে কিন্তু সাবধান! সাপে যেন না ধরে। যদি ধরে, তাবে সে এমন চিৎকার করিবে যে, সেই শব্দ শুনিয়া লোকে আসিয়া সাপটিকে মারিয়া ফেলিবে।
ইঁদুর, মাকড়সা, আরশোলা, ঝিঁঝিঁ পোকা, ব্যাঙ্গ সবাই শেয়াল পন্ডিতের পাঠশালায় পড়িয়া ভারি খুশী। এতো যেমন তেমন গুরুমশায় নয়! সকল জানোয়ারের চাইতে বেশী চালাক স্বয়ং শেয়াল পন্ডিত। টিকটিকি টিকটিক করিতে করিতে দেশ-বিদেশে এই পাঠশালার খবর বলে।
ইঁদুরের চিকির মিকির, ব্যাঙ্গের ঘঙর ঘঙর, আর ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ। পড়ুয়াদের পড়ায় সমস্ত কাশবন ওলট পালট। শোনা-শোনি শেয়ালের এই পাঠশালার খবর কুমীরেরও কানে গেল। কুমীর ভাবিল, তাই তো ইঁদুর, ব্যাঙ্গ, আরশোলা সকলের ছেলেমেয়েই শেয়ালের পাঠশালায় পড়িয়া কত কি শিখিয়া ফেলিল, আর আমার সাতটি ছেলে কেবল পানির মধ্যে সাঁতার কাটিয়া বেড়ায়, এখনও মাছটা-আঁশটা ধরিতে শিখিল না।
একদিন কুমীর তার সাতটি বাচ্ছাকে সঙ্গে করিয়া শেয়াল পন্ডিতের পাঠশালায় আসিয়া হাজির।
“শেয়াল মামা! বাড়ি আছ নাকি?”
শেয়াল বলিল, “একটু দূরে থাকিয়া কথা বল কুমীর-ভাগনে! তোমাকে দেখিয়া বড় ভয় পাই।”
কুমীর একগাল হাসিয়া বলিল, “মামা! বয় পাওয়ার কথা নয়! আমার সাতটি ছেলেকে তোমার পাঠশালায় ভর্তি করিয়া দিতে চাই।
ওরা বড় দুষ্ট। ওদের কিছ্য বিদ্যা শিখাইয়া দাও।”
খুশী হইয়া শেয়াল বলিল, “বেশ! বেশ!! ভাগনে, অল্পদিনেই আমি ওদের বিদ্যাদিগগজ করিয়া দিব।”
কুমীর তার সাতটি বাচ্ছাকে শেয়ালের পাঠশালায় ভর্তি করিয়া দিয়া গেল।
পরদিন শেয়াল কুমীরের সাতটি বাচ্চার একটিকে খাইয়া ভোরের নাস্তা করিল। দুপুর বেলা সেই কাশখাগ্রার বনের ধারে নদীতে ভুসুত করিয়া কুমীর আসিয়া ভাসান দিল।
“কি মাম, আমার বাচ্চারা কেমন লেখাপড়া করিতেছে?”
শেয়াল উত্তর করিল, “তারা পড়াশুনায় বেশ মনোযোগী। সাতটি দিন যাইতে দাও ভাগনে দেখিবে ওদের লেখাপড়ায় কত বড় করিয়া দিই।”
কুমীর বলিল, “ওদের কি একবার দেখিতে পারি না, মামা?
শেয়াল উত্তর করিল, “কেন দেখিতে পাইবে না ভাগনে? তুমি ওখানে থাক। আমি একে একে আনিয়া তাহাদের দেখাই।” এই বলিয়া শেয়াল একটি একটি করিয়া পা৬চটি বাচ্চাকে দেখাইয়া একটিকে দুইবার আনিয়া দেখাইল। বোকা কুমীর ভাবিল তার সাতটি বাচ্চাকে দেখিল।
এমনি করিয়া রোজ শেয়াল সকালে কুমীরের এক একটি বাচ্চা খাইয়া নাস্তা করে, আর কুমীর আসিলে একটি বাচ্চাকে বার বার দেখাইয়া তাহাকে বুঝায়। সাতদিনের দিন সকালে বাকী বাচ্চাটিকে খাইয়া শেয়াল পাঠশালার ঘর ভাঙ্গিয়া উধাও।
দুপুর বেলা কুমীর আসিয়া দেখিল, কোথায় মাস্টার, আর কোথায় তার পড়ুয়াদল। শুন্য কাশপাতার বন বাতাসে হেলিতেছে দুলিতেছে। কুমীর বুঝতে পারিল। নিজের বোকামির জন্য মাথায় থাপ্পড় মারিল। ছেলদের জন্য কাঁদিয়া বুক ভাসাইল। তারপর প্রতিজ্ঞা করিল, “শেয়াল! তুমি আর কোনোদিন নদীতে পানি খাইতে নামিবে না? নদীতে আসিলে ট্যাং ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া তোমায় উচিত শিক্ষা দিব।”
শেয়াল আর কুমীরের ভয়ে নদীতে নামে না। নদীর ধারে বালুর উপরে উঠিয়া কাঁকড়াগুলি দল বাঁধিয়া এদিকে-ওদিকে যায়। মাঝে মাঝে দাঁড়াইয়া রোদ পোহায়। কতদিন আর লোভ সামলান যায়! ক্ষুধায় পেট খাই খাই করিতেছে।
সেদিন যেই শেয়াল কাঁকড়া ধরিতে নদীর কিনারে আসিয়াছে, অমনি কুমীর ভুসুত করিয়া উঠিয়া শেয়ালের একটি ঠ্যাং ধরিয়া পানিতে টানিয়া লইয়া গিয়াছে। তারপর শেয়াল কুমীরে টানাটানি, হানাহানি করিতে করিতে তাহারা এক কাশবনের মধ্যে আসিয়া পড়িল। তখন শেয়াল তাড়াতাড়ি একটি কাশের ডাঁটা তুলিয়া লইয়া বলিল, “ভাগনে! ধরিল তো ধরিলে আমার লাঠিগাছা। আমার পা যদি ধরিতে তবেই আমাকে আটকাইতে পারিতে। এই যে আমার পা।” বলিয়া শেয়াল কুমীরের মুখের কাছ লাঠিখানা ধরিল। বোকা কুমীর শেয়ালের ঠ্যাং ছাড়িয়া দিয়া যেই লাঠিখানা ধরিয়াছে অমনি শেয়াল একলাফে যাইয়া বালুর চরায় উঠিল।
কুমীর তখন বলিল, “আচ্ছা শেয়াল! যাও। একদিন না একদিন তোমাকে পাইবই।”
ইহার পর কুমীর শেয়ালের খোঁজে এখানে ওখানে কতই ঘুরিয়া বেড়ায়। শেয়াল আর কুমীরের ভয়ে পানিতে নামে না।
সেদিন কুমীর করিল কি, বালুর চরার উপর যাইয়া মরার মতো শুইয়া রহিল। দূর হইতে শেয়াল তাহাকে দেখিয়া ভাবিল, হয়তো কুমীরটি মরিয়াই গিয়াছে। যদি মরিয়া থাকে তবে কুমীরের মাংস খাইয়া কিছুদিন আরামে কাটান যাইবে। কিন্তু তার আগে ভালোমতো জানিতে হইবে কুমীরটা সত্য সত্যই মরিয়াছে কি না।
শেয়াল কুমীরের কাছে আসিয়া বলিল, “কুমীরতা কি মরিয়াছে?
যদি মরিয়া থাকে তবে সে পা নাড়া দিবে।”
বোকা কুমীর তখন পা নাড়া দিল।
শেয়াল আবার বলিল, “কুমীর যদি সত্য সত্যই মরিয়া থাকে তবে সে হাত নাড়া দিবে।”
বোকা কুমীর আবার হাত নাড়া দিল।
শেয়াল বলিল, “বেশ বুঝিলাম কুমীরটা মরিয়া গিয়াছে। যাই বালুর চরা হইতে দাঁতে ধার দিয়া আসি। মরা কুমীরটা খাইতে হইবে।
কুমীর ভাবিল, শেয়াল একবার কাছে আসিলে হয়; ধরিয়া এক নিমেষে ওকে খাইয়া ফেলিব।” এই বলিয়া কুমীর চুপ করিয়া শুইয়া রহিল।
দাঁতে ধার দেওয়ার নাম লইয়া শেয়াল ওদিকে গেরস্ত পাড়ায় যাইয়া খবর দিল, “কি চাই, ডাঙ্গার উপর কুমীর আসিয়া শিয়া আছে।” গেরস্তরা সবাই কুমীরের উপর চটা। কুমীর কাহারও ছেলে খাইয়াছে, কাহারও মেয়ে খাইয়াছে। আর গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়া যে কত খাইয়াছে তাহার লেখা-জোখা নাই। তাহারা দল বাঁধিয়া লাঠি, সড়কি ইট পাটকেল লইয়া আসিয়া কুমীরটিকে মারিয়া ফেলিল।