সময় কি বাবা-ছেলেকে আলাদা করতে পারে

সময় কি বাবা-ছেলেকে আলাদা করতে পারে
নাহ্ এভাবে আর হাঁটা যাবে না খুব কষ্ট হচ্ছে, এত ভারি জিনিস কি আর একা বয়ে বেড়া যায়! রাস্তাটাও আজ ফাকা কিছুই নেই,অন্ততঃ একটা রিকশা পেলেও ভালো হতো, তাও পাওয়া গেলো না। যাক একটু বসে জিরিয়ে নেয়া যাক।দেখি ততক্ষণে কিছু পাওয়া যায় না-কি। যাক শেষ পর্যন্ত একটা রিকশা পাওয়া গেলো, বাসায় যাওয়া যাক। বাসায় এসেই দেখি চারুলতা দরজার খুলে অপেক্ষা করছে।
-এসো ভেতরে এসো। এত সময় লাগলো যে?
-রাস্তা তো অনেক দূরে, তাছাড়া সকাল সকাল কিছুই পাওয়া যায়নি। শেষে এক রিকশা করেই বাসা অব্দি আসলাম।
-হাত মুখ ধুয়ে নাও আমি নাশতা দিচ্ছি। আর এত এত জিনিস কেন, কি আছে এই বস্তার ভেতরে?
-নাশতা দিতে হবে না আমার ক্ষুধা নেই,
তুমি বরং বস্তটা খুলে সব বের করো আমি দেখি ছেলে মেয়ের ঘুম ভাঙলো কি-না। ছেলে মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আমি হাত মুখ ধুতে ওয়াশরুমে গেলাম। শুয়ে আছি এরই মধ্যে চারুলতা আসলো,
-কি হলো নাশতা করবে না?
-না ঘুম পাচ্ছে।
-তোমাকে এত উদাস লাগছে কেন? বাবা-মার কি কিছু হয়েছে?
-না হয় নি। তুমি ডাইনিং গিয়ে ওদের খাওয়াও আমি আসছি।
এই বলেই সেই পুরোনো সব দিনে ফিরে গেলাম প্রায় বছর দ’শেক পর গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি। শীতের সময় কুয়াশার কারণে কিছুই ঠিক মত চেনা যাচ্ছে না। মাত্র সকাল হয়েছে এখনো সূর্য্যি মামা উকি দেয়নি। কিছুক্ষণ স্টেশনেই বসে রইলাম, এরই মধ্যে দু’কাপ চা খাওয়া শেষ। চা খেতে অনেক কথায় ভাবলাম। বাবা কেমন আছেন, তার সেই উদ্যমী গর্জন কী এখনো আছে? বলিষ্ঠ দেহ কি সেই আগের মতই আছে। মা, ছোট ওরা সব কেমন আছে? বাবা কি এখনো সেই দোকানে চা খেতে খেতে আমার প্রসংগে কথা বলেন? বাবাকে যদি দোকানদার প্রশ্ন করে বসে;
-কি নজরুল মিয়া খুব তো বলেছিলে, ছেলে এলাকার মুখ উজ্জ্বল করবে একদিন। শেষে তো তোমার সম্মান টুকুও রাখলো না!!
তখন কি জবাব দেবে বাবা! নাকি মাথা নিচু করে ওখান থেকে ফিরে আসবে। আমার জন্যই বাবা আজ সবার উপহাসের সম্মুখীন। বাবা না হয় আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন! আমি কি আমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো? আচ্ছা! মানুষ নিজেকে নিজে কখনো ক্ষমা করতে পারে? বিবেক বোধ জাগ্রত হওয়া মানুষ গুলো বুঝি পারে না। আর মনুষ্যত্বহীন মানুষরা হয়তো এড়িয়ে চলে। এগুলো ভাবতে ভাবতে দেখলাম একটা ভ্যান গাড়ি এগিয়ে আসছে স্টেশনের দিকে। ওটাতে করেই নিজের জন্ম স্থানে ফিরলাম। মা তো প্রথম দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বহু দিন পর তার ছেলে তার কাছে ফিরে এসেছে। ঐ দিকে দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছেন কিছুটা দূরে। চোখে চোখ পড়তেই অন্য দিকে তাকালেন, আমিও আর চেয়ে থাকতে পারলাম না। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন;, -ভালো আছিস নয়ন?
-জ্বি বাবা ভালো আছি।
-বউমাকে সঙ্গে নিয়ে এলি না যে?
-আপনার ছোট নাতনি কিছুটা অসুস্থ বাবা। তাই সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারিনি। মিথ্যা বললাম। আমি জানি বাবা ঠিক বুঝতে পেরেছেন আমি যে মিথ্যে বলছি।
-ও আচ্ছা।
-কি শুরু করলে বলো তো!
ছেলেটা অত দূর থেকে এসেছে, আগে ঘরে যাক রেস্ট করুক তারপর না হয় সব শোনা যাবে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মা আমায় ঘরে নিয়ে গেলেন। বাবা-মা এবং ছেলের এই একটা তফাৎ, ছেলে বড় হবার পর বাবারা ছেলেদেরকে খুব একটা অধিকার নিয়ে বলতে পারে না। অথচ মায়েরা খুব সহজেই অধিকার খাটিয়ে অনেক কিছুই বলতে পারে। ছেলেরা একটু বড় হলেই বাবার কাছ থেকে দূরে যেতে থাকে। যখন ম্যাচিউরিটি একটা ভাব চলে আসে, তখন তো আরো দূরে। আর মেয়েদের দেখো! কেনো কিছু প্রয়োজন হওয়ার সাথে সাথেই বাবাকে বলে দেয় খুব সহজে অথচ ছেলেরা চাইলেও তা করতে পারেনা। কেনো কিছু প্রয়োজন হলে মায়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়। ছেলের ভালো কর্ম কিংবা খারাপ, যেটাই ঘটুক না কেন সর্বপ্রথম বাবাকেই কথা শুনতে হয়। সেবার খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলাম, বাড়িতে এসে দেখি হুলুস্থুল কান্ড, আমার জন্য একটা নতুন সাইকেল কিনেছেন বাবা। মাকে জিজ্ঞাসা করলাম;,
-মা এই নতুন সাইকেল কার?
-তোর বাবা তোর জন্য কিনেছেন। দেখ তো পছন্দ হয় কি-না!
ছোট থেকে দেখে আসছি, বাবা আমার জন্য কোনো জিনিস কিনলে, সেটা হবে বাজারের সেরা পণ্য। নতুন সাইকেল, নতুন স্কুল ব্যাগ, নতুন জুতা, গায়ের জামা সব নিয়ে এসেছেন। খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলাম, বাবা বাসায় ছিলেন না। আমি সেদিন অপেক্ষা করেছিলাম, বাবা আসার সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেটাই বোধহয় শেষ আলিঙ্গন হয়েছিলো আমাদের পিতা-পুত্রের। সেদিনের সেই উত্তাপ আমি আজও অনুভব করি। বাবা কানে কানে বলেছিলেন;,
-তুই অনেক বড় হবি বাবা অনেক বড়। কথাটা আমার এখনো মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ তীরের বেগে কানে বাজে, “তুই একদিন অনেক বড় হবি বাবা”। আজ আমি সত্যিই অনেক বড় হয়েছি, শুধু শারীরিক ভাবে নয়! ধন-দৌলতের দিক থেকেও।
আজ চাইলেও বাবার কাছে যেতে পারিনা, মন ভরে কথা বলা হয় না, একসাথে এক টেবিলে খাওয়া হয় না, রাতে ঘুমের মধ্যে কারো ডাক শুনে চমকে উঠে মজার মজার খাবার পাওয়া হয় না। ছেলেরা বড় হওয়ার দূরে যায় কেন? বাবার সাথে কথা বলতেও এত হীনমন্যতায় কেন পরতে হয়? আমার বাবাও মনে হয় দাদুর সাথে এভাবে চলেছে, দাদুও মনে হয় তার বাবার সাথে এভাবেই চলেছে।,এভাবেই বুঝি সমস্ত সৃষ্টি ধারাবাহিক ভাবে জীবন পরিচালিত করে সমাপ্তি টানে। কি নিদারুণ ভাবে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন তার সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে। ছেলেদের জন্য গোপনে মনের কোঠায় তীব্র ভাবে ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে বাবারা। ছেলে আর মেয়েদের মাঝখানে এখানেই একটা অদ্ভুত অমিল;, -মেয়েরা খুব সহজেই বাবা-মার সঙ্গে আচার আচরণ করতে পারে, আর ছেলে বেলায় করতে হয় মায়ের মাধ্যমে।
রেজাল্টের কিছু দিন পর, তখন মনে হয় নবম শ্রেণিতে উঠেছি মাত্র, জানুয়ারী মাস রোদ টুকুন বড্ড মিষ্টি লাগছে। এই দেশে জানুয়ারী মাসে সূর্যের দেখা তেমন একটা মেলে না। যদিও মেলে সেটা হয় বাদামি রঙের খোসায় মোড়ানো লাল টকটকে ডালিম ফলের মত। মুখে দিকেই অনাবিল এক স্বাদে মন ভেরে উঠে। রোদ পোহাতে পোহাতে নতুন সাইকেল নিয়ে আস্তে আস্তে স্কুলের দিকে যাচ্ছি, পাশের চায়ের দোকান থেকে পরিচিত এক গলার স্বর ভেসে আসলো, আমি একটু দাঁড়ালাম। এ তো বাবা এখানে বসে মনে হয় চা খাচ্ছেন। আমি সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বাবার কাছে যাচ্ছি। যদিও বকা দেবেন তবুও যেতেই হবে ভালো রেজাল্ট উপলক্ষে স্কুলের টিচারদের মিষ্টি খাওয়াতে হবে। সেই জন্যে টাকা লাগবে, আর টাকা নিতেই বাবার কাছে যাচ্ছি।
-কি নজরুল মিয়া পোলায় নাকি জেলা ফাস্ট হইছে এবারের পরীক্ষায়? চা দিতে দিতে দোকানদার বললেন।
– হ্যাঁ ভাই সাব।
আমার ছেলে খুব ভালো পড়াশোনা করে। মাশাল্লাহ্ এবারের রেজাল্টে আমি খুবই আনন্দিত। আশা করি একদিন অনেক বড় হবে, এলাকার মুখ উজ্জ্বল করবে। কথা গুলো যখন বাবা বলছিলেন, তখন গর্বে বাবার বুকটা প্রসস্থ কত খানি যে হয়েছিলো, সেটার পরিসীমা নির্ধারণ করা যাবে না। মুখে যে প্রসন্ন ছিলো, তা হাজার কোটি টাকার বিনিময়েও পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় ন।, আমি দূর থেকেও তা বেশ ভালো ভাবে টের পেয়েছিলাম।
-ছেলের ভালো পড়া লেখা করার জন্য শহরে পাঠানো দরকার! তা কোথায় পাঠাইতে যাও নজরুল মিয়া? বাবাকে উদ্দেশ্য করে আরেজন বললেন। এবার বাবাকে খুব গম্ভীর মনে হলো! বললেন;,
-ভাই খুব মুশকিলে আছি! বর্তমান যে সমাজ ব্যবস্থা কিছুই ভরসা পাইনা। দেখি কোথায় পাঠানো যায়। কথা আরো অনেক কথায় হলো আমাকে নিয়ে। বাবার ইচ্ছে, স্বপ্ন আমাকে বড় করবার আকাঙ্ক্ষা অনেক কথা। সব কথাতেই বাবা আমাকে জড়ানো। এর ফাঁকেই আমি উপস্থিত হলাম।
– কিরে নয়ন তুই এখন এখানে! স্কুলে যাসনি বাবা?বাবা আমাকে বললেন।
-যাচ্ছি বাবা। পথে যেতেই তোমার কথা শুনতে পেলাম তাই এখানে আসলাম। আর একটা কথাও বলার ছিলো!
-কি কথা বল?
– স্কুলে যে টিচারদের মিষ্টি খাওয়াতে হবে! তোমাকে অনেক বার বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি তো রাতে বাসায় ফেরো আবার ভোরে সকালে বেড়িয়ে পরো। ততক্ষণে তো আমি ঘুমিয়ে পরি আবার জেগে উঠেও তোমাকে পাই না। বলে দাঁড়িয়ে রইলাম।
-ও আমার তো মনেই ছিলো না! তোর স্কুলে আামকেও তো যাওয়া উচিৎ। চল আজ ফ্রী আছি বাপ ছেলে একসাথে যাই। সামনের বাজার থেকে মিষ্টি কিনে নেয়া যাবে।
-নজরুল মিয়া আমাদের মিষ্টি কই? ঠাট্টা সুরে একজন বললেন।
– রতন মিয়া সবাইকে আমার তরফ থেকে চা-বিস্কুট খাওয়াও আমি টাকা দেব। বাবা খুব খুশি খুশি মনে বললেন।
-আজ যেতে হবে না বাবা।সামনে আমাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠান হবে এবং সেরা রেজাল্টের জন্য সংবর্ধনা দেয়া হবে। তুমি বরং সেদিনই যেও, আমি স্কুলে যাই। বলে চলে আসলাম।
দিন পনের পরের কথা, স্কুলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হলো বাবা আসলেন অনেক রকম মিষ্টি হাতে নিয়ে। টিচাররা আমাকে নিয়ে খুব প্রসংশা করলেন। স্টেজের নিচের সামনের সারিতে বাবার জায়গা হলো। সংবর্ধনার শুরু হলো প্রথমে পবিত্র আল-কোর-আন তেলাওয়াত দিয়ে। হাম নাদ, গজল, দেশাত্মবোধক গান,নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি, ছোট নাটক, কৌতুক, আরো অনেক কিছু। একে বারে শেষে হলো সেরা রেজাল্টের জন্য জেলা পর্যায় থেকে সনদ পত্র প্রদান। যখন আমাকে সবার প্রথম ডাকা হলো, আমি বাবার চোখের দিকে তাকালাম একবার, দেখলাম অজস্র প্রসন্নতা তার সারা চোখে মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চোখ যেন বলছে;, আগামীর সাফল্য যেনো আকাশ চুম্বি হয়, শক্ত খুঁটি হয়ে আমি পাশেই আছি। সেই দিনই প্রথম আমি মাউথ পিচে কথা বলি। আমাকে বলা হয়ছিলো;, -ভালো রেজাল্ট কিভাবে করতে হয় সেটা একটু সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করো!
– আমার জীবনের সেরা টিচার আমার বাবা। জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য, সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছানোর সেরা প্রেরণা হলো আমার বাবা। সম্মান নিয়ে সমাজে বাস করার জন্য সেরা আদর্শ হলো আমার বাবা। যখন কথা গুলো বলছিলাম, বাবার চোখে তাকিয়ে দেখি অশ্রু কণা রূপার মত চিকচিক করছে। এইমপ্রথম বাবার চোখে পানি দেখলাম, সেটাও আবার অতিব আনন্দ অনুভূতির। আরো অনেক কথায় বললাম স্কুল, টিচার, সহপাঠীদের। কথা বলা শেষ করে যখন সনদটা বাবার হাতে দিয়ে বললাম;, সব তোমার কৃতিত্ব বাবা। বাবা আর জল ধরে রাখতে পারলেন না। আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। একে একে সব ধাপ সাফল্যের সহিত পার করলাম। আর আস্তে আস্তে বাবার সাথে দূরত্ব তৈরি হতে লাগলো। এবার শহরে যাবার পালা। এই প্রথম শহরে আসলাম। নিজের হস্টেল, ক্লাস রুম,নিয়ম-শৃঙ্খলা পড়াশোনা এসব বুঝে উঠতে উঠতে প্রথম বর্ষ শেষ হয়ে গেলো। মাঝে খেয়াল করাতাম এক জোড়া কালো চোখ আমাকে প্রচুর ভাবে দ্যাখে। গোল বর্ণ মুখ,লম্বা কেশ, খুব সাধারণ একজন মানুষ। হাঁটা-চলা, কথা বলা।
বিশেষ করে তার লম্বা ঘন কেশ আর কালো চোখ আমাকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করেছে। তার কালো চোখ যেনো অতল সমুদ্র আমি একবার তাকলেইসে চোখে ডুবে যাই, সাঁতরাতে থাকি, পাড় খুঁজতে থাকি সে সমুদ্রের যেনো পাড় নেই। সে যখন তাকিয়ে থাকে আমি তাকালেই সমুদ্র জোড়া ফিরিয়ে নেয়। কি অমূল্য এক অনুভূতি। এই করে করে দ্বিতীয় বর্ষও চলে গেলো। অবশ্য ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিলো। সপ্তাহে একটা ক্লাস একসাথে করূ হত। দ্বিতীয় বর্ষের শেষে তাকে একটা চিঠি লিখালম। চারুলতা, কেমন আছো! আশা করি খুব ভালো। তোমার সমুদ্র জোড়ায় কি আমার নাও ভাসাতে দিতে পারো? কালো কেশে বিলি কাটতে দিতে পারো! সদ্য ভেজা কেশে মাতাল হবার একটা সুযোগ কী আমি পেতে পারি? মানে বুঝতে চাইছো তো! আচ্ছা তবে শোনো, তোমার জীবনটা আমার সাথে কি বুড়ো অব্দি কাটানো যায় না?
ইতি,
আমি।
পুনশ্চঃ এটা প্রেম পত্র না, এটা পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির দলিল। এই চিঠির উত্তর পাইনি, এক বড় আপুর দ্বারা দিয়েছিলাম। শুনলাম চিঠিটা পড়ার পর নাকি সাবই খুব তামাশা করেছিলো তার পর চিঠিটা মুড়িয়ে ফেলে দিয়েছিলো। শোনার পর মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। তার পর আর তার সামনে কখনো যাইনি। এক বছর পর চতুর্থ বর্ষে ফিরতি চিঠি পেয়েছিলাম। সেইদিন যে কতটা খুশি হয়েছিলাম সেটা আর লিখে বোঝাতে পারবো না। পড়াশোনা সব শেষ করে ভালো একটা জব পেয়ে যাই। হঠাৎ একদিন চারুলতা একটি চিঠিতে বলল তার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে আমি কিছু না করলে তাকে আর আমি পাব না। সে আর আমার হবে না, এত সব স্বপ্ন-আশা, প্রতিশ্রুতি ভালোবাসা সব কিছুই হারাবে। হুট করে বিয়ে করে ফেলি। বাবা-মা কাউকেই জানাইনি। একদিন চারুলতা সহ বাড়িতে গেলাম, সবাই পছন্দ করলো মা খুব সহজেই মেনে নিয়েছে, ছোট খুব আনন্দিত। শুধু মানলেন না বাবা।
গর্জন দিয়ে উঠলেন চারুলতা প্রচন্ড ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে আমার হাত ধরে ছিলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। খুব রাগ নিয়ে বাড়ি থেকে সেদিন বেড়িয়ে এসেছিলাম। কোন দিক দিয়ে যে দশ বছর পেরিয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। ব্যস্ততায় ডুবে থাকলে সময় অনুভব কম হয়, যন্ত্রণার আঘাত ক্ষমতা খুব একটা কাজ করে না। কেবল রাত হলেই বাবার মুখটা জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠতো। রূপার মত অশ্রুতে চিকচিক করা চোখ দুটোর কথা খুব মনে হতো। ভাবতাম বাবা বুঝি আমাকে আর ক্ষমা করবেন না।
গত কয় দিন আগে বাবার চিঠি পেয়েছি। নামটা দেখেই মন হু হু করে উঠলো অজানা এক শিহরণ এসে মনকে ছুঁয়ে দিলো। চিঠিতে লেখা; নয়ন, কেমন আছিস বাবা! আশা করি বউমা নাতি-নাতনী সবাই ভালো আছে। বাবার উপর এত রাগ তোর, এত অভিমান জমিয়ে রেখেছিস? উপরে রাগটায় দেখলি! বাবার ভালোবাসা, সব দিয়ে আগলে রাখা,শিশু থেকে বড় করা, সব সাফল্যের খুঁটি এগুলো কি সবটায় ভুলে গিয়েছিলি? এই সবের অধিকার নিয়ে কী তোকে একটু বকতেও পারবো না? তোর সব কিছুতেই আমার ছোঁয়া। বিয়ে করেছিস বলে আমার কোনো রাগ ছিলো না, আমাকে বললেই পারতি। দেখতি কত আয়োজন করে তোর বিয়ে সম্পন্ন করতাম।
জানিস তোর জন্মের আগেই তোর দুটো ভাই-বোন হয়ছিলো তারা মাত্র তিন দিন পৃথিবীর মাঝে ছিলো তারপর মারা গিয়েছিলো। তুই হয়েছিলি তারও দু বছর পর। আমি তোকে আমার চোখের মণির মত করে বড় করেছি। তাই মিল রেখে নামটাও নয়ন রেখেছিলাম। ছোট বেলায় পিঠে করে ঘোড়া ঘোড়া খেলতে খুব পছন্দ করতিস বলে তোকে পিঠে করে মাইলের পর মাইল ঘুরিয়েছি। কোথাও গেলে কাঁধে ছাড়া কখনো হেঁটে নিয়ে যাইনি। যাক সে সব তোর মনে থাকবার কথাও না। তোরও তো ছেলে-মেয়ে হয়েছে এখন তো বুঝিস সন্তানের ভালোবাসা কতটা তীব্র হতে পারে! এসব কথা তোকে দুর্বল করার জন্য বলছি না বাবা। এমনিতেই আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে আর না। আমার ভুল হয়েছিলো বাবা, তোর জায়গা থেকে বোঝা উচিৎ ছিলো। যদি পারিস আমাকে ক্ষমা করে একবার এই বুড়ো বাপটাকে দেখে যাস।
ইতি,
তোর জন্মদাতা।
পুনশ্চঃ না আসলে ভাববো আমি তোর আদর্শ বাবা না। চিঠিটা পড়ার পর আমি আর স্থীর থাকতে পারিনি সাথে সাথে চারুলতাকে ডেকে বলেছিলাম। ছোট্ট বাচ্চার মত ওর বুকে মুখ গুঁজে অনেক কেঁদেছিলাম। বাবারা যে সন্তানদের জন্য এতটা ভালোবাসা রাখতে পারে বাবার দেয়া চিঠিটা না পেলে অজানায় থেকে যেত। সে দিনই অফিস থেকে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে বাবার কাছে চলে গিয়েছিলাম। মা খুব আদরের সাথে ক’দিন খাওয়ালেন। বাবা সারাক্ষণ আমার সাথে গল্প করে কাটালেন, দশ বছরের জমানো সব কথা বললেন। যেদিন চলে আসবো সেদিন বাবার মুখটা খুব ভার ছিলো। আসার দিনে অনেক জিনিস দিয়ে দিলো, আম, কলা,পেয়ারা,জাম্বুরা, নাড়ু,পিঠা, আরো অনেক জিনিস।পরো এক বস্তা ভর্তি। সন্ধ্যে নাগাদ ট্রেন আমি সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছি, মা চোখ মুছতে মুছতে কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বাড়ির সামনে ভ্যান গাড়ি আসলো। মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে ভ্যানে বসলাম। দেখি বাবাও আমার সাথে বসেছেন!
-আপনি কোথায় যাবেন?
-তোকে রেখে আসি।
-না না আপনার শরীর খারাপ আপনাকে যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো। কে শোনে কার কথা তবুও তিনি আমার সাথেই স্টেশন অব্দি আসলেন। ট্রেন ছেড়ে দেবে এমন সময় বললেন;,
– আবার আসবি তো বাবা?
মাত্র দশ বছরেই ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’ বলছিস বাবা! সময় কী কখনো বাবা- ছেলেকে আলাদা করতে পারে? ভালো থাকিস। বাবার চোখে আবার সেই রূপার মত অশ্রু চিকচিক করছে। আমি একটি কথাও বলতে পারলাম না। ইচ্ছে হলো হুমড়ি খেয়ে পায়ে পরে ক্ষমা চাই। একজন মধ্য বয়স্ক আর একজন বৃদ্ধ বয়স্ক মানুষের এমন কান্ড দেখলে সবাই হাসবে ভেবে আমার আর ক্ষমা চাওয়া হলো না। মানুষের অনেক কিছুই ইচ্ছে হয় কিন্তু বেচির ভাগ ইচ্ছেই প্রকাশ পায় না। আমার মাথায় কেবল একটা কথায় প্রতিধ্বনি হতে লাগলো ; মাত্র দশ বছরেই ‘তুমি’ থেকে আপনি বলছিস বাবা! সময় কী কখনো বাবা-ছেলেকে আলাদা করতে পারে?
গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত