একটি কলমের আত্মকাহিনী

একটি কলমের আত্মকাহিনী

সকাল থেকেই বুকটা দুরদুর করে কাঁপছে। দোকানি আজকে রফিকের কাছে আমার কথা কি জানি বলছিল। আজকে থেকে মনে হয় আমার আরামের দিন হারাম। আহারে কি সুন্দর এসি রুমে ছিলাম, না জানি কোন আজাবে যেতে হয়। এসি ছাড়া আমার আবার খুব সাফোকেশন হয়।এখন রফিকটাকে দেখে গা রিরি করছে। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে কেলাচ্ছে।বজ্জাত একটা, ভাল জিনিসের কদর বোঝেনা। আমাকেতো পাত্তাই দেয়না, মন চায় তোর নামে একটা মামলা ঠুকে দেই। আরে বাবা কলম হয়েছিতো কি হয়েছে, কলম বলে কি আমি মানুষ না। যার তার সাথে একসাথে মিশিয়ে রাখে। আমারতো একটা আত্মসম্মানবোধ আছে নাকি। সে যাই হোক, আজকে যদি আমাকে হস্তান্তর করা হয়, ভাল মানুষের হাতে পড়লে ভাল কিন্তু চোর-জোচ্চোরের হাতে পড়লেতো জীবন ঝামাতামা। সেইজন্য সকাল থেকে চোখ বড় বড় করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। সকালের দিকে মনটা ভাল থাকলেও এখন বড়ই বিরক্ত লাগছে। খুব ভোরের দিকে এক তরুণী এসে মিষ্টি সুরে বলল, ……

“কলম হবে?”

আহ, আমিতো শুনেই নড়েচড়ে বসলাম। মনের মধ্যে একটা প্রেম প্রেম ভাব জেগে উঠল। মনে মনে বলছিলাম প্লিজ প্লিজ প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও। কিন্তু হায় সে আরেক তরুন কলমের হাত ধরে আমার হৃদয় শুন্য করে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। নাহ, আমার ভাগ্য নেহাৎ-ই খারাপ, তা নাহলে আমার মত একটা ডেশিং কলম ভাত পায়না !! যাকগে, আবারও গালে হাত দিয়ে আশাহত হয়েও আশা নিয়ে বসে ছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর এলো ইয়ো ইয়ো টাইপ বদ মার্কা একটা ছেলে। নাউজুবিল্লাহ, এর হাতে পড়লেতো আমি একদিনেই ইন্তেকাল। মনোযোগ দিয়ে তার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম।নিশ্চই মাস্তান গোছের কেউ, হাতে পায়ে গলায় শিকল বাকলের মত কিজানি ঝুলছিল। এদিক ওদিক ঘুরে শেষমেশ একটা সিগারেট নিয়ে চলে গেল। আসলেই বদ। যাক বাবা তবু একটা গজবের হাত থেকে বাঁচা গেল। তখন মনে হচ্ছিল, ” সময় যেন কাটেনা, বড় একা একা লাগে।” আর ঠিক একটু পর-ই গোলাপি ফ্রক পরা একটা মেয়ে বেণী দোলাতে দোলাতে মায়ের হাত ধরে দোকানে ঢোকে। ইশ কি কিউট বাচ্চাটা, ইচ্ছে করছিল গাল দুটো টেনে দেই। ভীষণ চঞ্চল মনে হচ্ছে, ঘুরে ঘুরে এটা ধরছে তো ওটা ছাড়ছে। আমাকে এসে যদি একটু ধরত। ধরবে আর কি বজ্জাত রফিকটা হুট করে বলে উঠে,

…” এই এসব ধরবেনা।”

ইচ্ছে করছিল রফিক্যাটাকে ধরে দুই গালে দুইটা চড় লাগিয়ে দেই। কোন রকম বাকি কলমগুলোকে ঠেলেঠুলে সামনে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম আর ঠিক তখনই মনে হয় আমাকে বাচ্চাটার চোখে পড়েছে।

……”মা মা এই কলমটা কিনে দেও”
……”কলম তো তোমার দরকার নেই মামনি, বরং একটা পেন্সিল কিনে দেই।”
……”না না আমার এই কলমটা চাই।”

আমাকে আর তখন পায় কে, খুশিতে মন চাচ্ছিল একটু ডিস্কো নাচি। তারপর বাবুটা নরম তুলতুলে হাতে আমাকে এমন শক্ত করে ধরল, যেন একটু এদিক সেদিক হলেই আমি পড়ে যাব। মুঠোবন্দী করে নিয়ে এলো বাসায়। আজ থেকে এটাই আমার নতুন আবাস। প্রথমে বাচ্চাটা আমাকে একটা রুমে এনে রাখলো। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে রুমটাকে আগে দেখে নিলাম। বেশ ভালই লাগলো। বিশাল রুম, লাগোয়া বারান্দা। ভাল আলো বাতাস পাওয়া যাবে মনে হচ্ছে। রুমের ঠিক কর্নারে একটা বিছানা। বিছানার পাশে একটা ছোট্ট সাজবার আয়না। বাব্বা বাচ্চাটা বুঝি সাজুগুজুও করে।আর আমি বসে আছি আরেক কর্নারে একটা পড়ার টেবিলের উপর। পড়ার টেবিলের আতিপাতি সব দেখে নিলাম এক পলকে।এক দিকে ভালই হয়েছে ও আমাকে দিয়ে লেখালেখি করবেনা, পেন্সিল দিয়ে লিখে। আমারও আয়ু বাড়বে বেশিদিন।

খুট করে দরজার আওয়াজ শুনে নড়েচড়ে বসলাম, বাবুটা এসেছে মনে হল। হ্যাঁ, এসেই আমাকে চেপে ধরে একটা সাদা খাতা টেনে নিয়ে আঁকিবুঁকি শুরু করল। আঁকিবুঁকি করে পূর্ণতা লিখল মনে হয়।নিজের নাম লিখছে বোধহয়। বাহ নামটা তো চমৎকার। এরপর থেকে আমি সারাদিন পূর্ণতার সঙ্গী হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে নিজেকে খাবার টেবিলেও আবিস্কার করতাম। আর টেবিলে সব ইয়াম্মি ইয়াম্মি খাবার দেখে আমার জিভে পানি চলে আসতো। কিন্তু পূর্ণতা কিছুই খেতে চাইতনা। আর আমাকে যখন স্কুলে নিয়ে যেত, দেখতাম মাঝে মাঝে টিফিন বাক্স খুলে টিফিন বাইরে ফেলে দিত। কিছু বলতেও পারিনা, সইতেও পারিনা।আর একটা যন্ত্রণাদায়ক জিনিস হল রোজ রোজ ভোরে উঠে স্কুলে আসা। এই যেমন আজকে কলমদানিতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিলাম। বলা নেই কওয়া নেই, হ্যাঁচকা টানে নিয়ে পূর্ণতা আমাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। আর স্কুলে এসেও যে একটু আরাম করে ঘুমাব তারও জো নেই, একটু পরপর ব্যাগ থেকে বের করে আমার রুপ দেখে, বন্ধুদেরও দেখায়। অবশ্য ওর এই আহ্লাদিগুলো আমার বেশ লাগে। কখন যে স্কুল ছুটি হবে আর বাসায় যেয়ে একটু রেস্ট করব।

আর কিছুক্ষণ পর ছুটি হবে, পূর্ণতা একটা একটা করে বই ব্যাগে ঢুকিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু একি আমাকে তো ব্যাগে ঢুকাচ্ছেনা। ছুটিতো হয়ে গেল, পূর্ণতার কি হল আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে।

……”এই এই এই পূর্ণতা, আমাকে রেখে গেলেতো। পূর্ণতা ও পূর্ণতা আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ।”

চলেই গেল। মনে হল মাথায় আমার আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। এখন আমি কোথায় থাকব, পূর্ণতা কে পাব কোথায়। ধুলোয় মাখামাখি হয়ে এদিক ওদিক গড়াগড়ি খাচ্ছি আর পায়ের তলায় পিষ্ট হচ্ছি। চোখেমুখে শুধু অন্ধকার দেখি। হঠাৎ মনে হল কেউ একজন আমাকে তুলে উঠিয়েছে। উঠিয়ে ঝেরেঝুরে ব্যাগে ঢুকালো। তাও যদি যাওয়ার কোন জায়গা হয়। ব্যাগের মধ্যে কত শত জিনিসের মাঝে চিড়েচ্যাপটা হয়ে কোনরকম শুয়ে আছি। মানুষের পায়ের ধাক্কা খাওয়ার চেয়ে এটা ঢের ভাল। পূর্ণতা এখন কি করছে কে জানে। আমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছে হয়তো। আহারে কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছে মেয়েটা। কি আর করা এখন থেকে আমাকেও বন্দীদশায় থাকতে হবে। দম বন্ধ হয়ে আসছে থেকে থেকে।মনে হল কারো বাসায় এসেছি। যখন রাত নেমে এলো ব্যাগের ভিতর হাঁসফাঁস লাগছিল। সকাল হওয়ার আগে মনে হয় মরে ভুত হয়ে যাব। না, যাক সকাল পর্যন্ত বেঁচে আছি।তারপর হঠৎ কি হল, যেন ভুমিকম্প হচ্ছে। আমার পুরো শরীর টলে উঠছে। মাথা ঘুরছে ভনভন করে। ব্যাগের মালিক মনে হয় রিকশায় করে কোথাও যাচ্ছে। যে আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি সেই আমার আজ কি দশা।

শেষমেশ ভুমিকম্প থামলো আর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এসপার ওসপার পেড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা কাঁচের বাক্সে। একটু পরপর বাক্সের মধ্যে একটা দুইটা অনেকগুলো হাত এসে আমাকে একটা ঘুরানি দিয়ে কি জানি নিয়ে চলে যায়। আর পেয়েছি পেয়েছি বলে এমনভাবে চিৎকার দেয় যেন হারানো জিনিস খুঁজে পেয়েছে। এভাবে যদি একদিন পূর্ণতা এসে আমাকে নিয়ে যেত। দিন যাচ্ছে তো যাচ্ছে, কখনও বাক্স খালি হয় কখনও ভরে যায় কিন্তু আমি সেই যেভাবে ছিলাম সেভাবেই পড়ে থাকি। ইদানিং ভাল ঘুমও হচ্ছেনা। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে আড়মোড়া ভাঙতেই একটা নরম তুলতুলে হাত আমাকে চেপে ধরল। মানুষটার কাছে নিয়ে যেতেই দেখি এতো পূর্ণতা। আমাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরেছে। আহ কি শান্তি, কত দিন পর চির চেনা ঘ্রান, প্রিয় মুখ। বুকে চেপে ধরেই আমাকে বাড়ি নিয়ে চলল। আবারো মনে হচ্ছে আনন্দে ধেই ধেই করে নাচি। বাড়িতে পা দিয়েই একটা শান্ত বাতাসে মনটাই ভরে গেল। পূর্ণতা আমাকে বুকে চেপে ধরে ড্রয়ারের দিকে নিয়ে ভিতরে রেখে তালা বন্ধ করে দিল। আমি জানি এখানে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে, দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হবে। পূর্ণতা বোধহয় আমাকে এখান থেকে আর বের করবেনা।আমাকে হারানোর ভয় চেপে ধরেছে। তবুও ভাল, আমার বন্ধুটার সাথে আজীবন থাকতে পারব।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত