রিয়া একদৃষ্টিতে ওর বামহাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলির দিকে তাকিয়ে আছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে । এক ফোঁটা দুফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছে ওর কোলের ওপর। সেই কতক্ষন ধরে যাঁতির ভেতর হাত ঢুকিয়ে আঙ্গুল কেটে রক্ত বের করার চেষ্টা করছে ও। এতক্ষন চেষ্টার পর অবশেষে দুই তিনফোটা রক্ত বেরুল কনিষ্ঠাঙ্গুলি কেটে । আহা নরম পুষ্পকলির মত আঙ্গুলগুলো এখন প্রচন্ড ব্যথায় নীল হয়ে আছে!
ঘটনা অতি সাধারন । সন্ধ্যায় বাম হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে সে তার প্রানপ্রিয় স্বামী ফয়সালের ডান গালে থাপ্পড় মেরেছে । বেচারা কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে পাশের ফ্ল্যাটে চলে গেছে।
এরপর কয়েক হাজার বার ফোন দেয়া হয়েছে। একটু আগে ফোন মেসেজে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে রিয়া , তার প্রাণাধিক স্বামী ফিরে না এলে সে হাতের আঙ্গুল কেটে সুইসাইড করে ফেলবে ।
ঠিক হিন্দী সিরিয়ালে যেমন দেখায় নায়ক প্রচন্ড অভিমানে নায়িকাকে চড় মারার পর অনুতপ্ত হয়ে এই হাত মে খুন কার দেঙ্গে বলে কাঁচের বোতল ভেঙ্গে হাত কেঁটে ফালা ফালা করে ফেলে । সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনুতপ্ত মর্মাহত পতিপ্রেমী রিয়া শ্বাশুড়ির পানের বাটা থেকে যাঁতিটা নিয়ে এসেছে ।
এই হাত হ্যা হ্যা হ্যা এই বাম হাত দিয়ে সে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে থাপ্পড় মেরেছে । এই হাত , এই অস্পৃশ্য হাত সে রাখবেনা ।
ঠিক এই মুহুর্তে রিয়া বড়বড় চোখ মেলে ওর বাম হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলির দিকে তাকিয়ে আছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে দেখে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল ওর । ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে আল্লাহরে বলে ফিট হয়ে গেল সে ।
আধা ঘন্টা পর
রিয়ার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা । ফয়সাল মুখটুখ কালো করে বসে আছে । রিয়ার এক টন ওজনের মাথাটা ওর বুকের উপর চেপে বসে আছে । হাঁসফাস করছে ফয়সাল । দুজন এখন বেডরুমে । টিভিতে খেলা চলছে ।
-আর কখনো এমন করবানা ঠিকাছে ?
-আচ্ছা করবনা ।
ফয়সাল মিনমিন করে বলে ।
-বিশ দাও ।
ফয়সাল বিশ দিল ।
-চব্বিশ দাও
ফয়সাল চব্বিশ দিল ।
-ও মাই গড ! নয়টা বেজে গেছে বলোনি কেনো ?
রিয়া মাথা তুলে ঝট করে সোজা হয়ে বসল । ফয়সাল দোয়া ইউনূস পড়ছিল । আজ বেচারার দোয়া ইউনূস কাজে দিলনা ।
এই মুহুর্তে রিয়ার বাম হাতে ব্যান্ডেজ , ডান হাতে টিস্যু পেপার । টিভিস্ক্রিনে বিকট একটা কান্নার শব্দ করে সিরিয়াল শুরু হয়ে গেল । ওর প্রিয় সিরিয়াল হাম ইস জনমে তুমহারা পত্নী তুম উস জনমে হামারা সসুর । আজ এই সিরিয়ালের মহাএপিসোড । এই মুহুর্তে নায়ক বিষ খেয়ে মরে যাচ্ছে নায়িকা দৈব বলে খবর পেয়ে সিঁদুরের কৌটা নিয়ে আইসিইউতে ঢুকছে নায়ককে বিয়ে করার জন্য ।
রিয়ার নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে যাচ্ছে ।
বেদনায় মথিত হচ্ছে হৃদয়। কুমার কি পারবে জানবিকে ফিরে পেতে । টান টান মুহুর্ত ।
ঠিক এই সময় ফয়সাল মিনমিন করে উঠল , বিয়ে করিসনারে ভাই । তার চেয়ে সারাজীবন আইসিইউতে থাক ।
পাশের ফ্ল্যাট থেকে একটা চিত্কার ভেসে এলো ফোওওর ।
ফয়সালের কলজের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল ।
প্রেমিকা পত্নী হইলে তোমারই বেডরুমে বসিয়া তোমারই কেনা টিভিতে সারাদিন আয়েশপূর্বক সিরিয়াল দেখিবে , আর তুমি রিমোটে হস্ত ছোঁয়াইতে পারিবেনা । একটিবার হস্ত ছোঁয়াইলে তুলকালাম হইয়া যাইবে। সিরিয়াল দেখিতে দেখিতে উহারা পাষাণী হইয়া যায় । সিরিয়াল দিতে এক সেকেন্ড দেরি হইলে প্রানপ্রিয় পতিকে থাপড়াইতে তাহাদের বক্ষে বাঁধেনা । এই মহান উক্তিটি কোনো এক মহামতী বলে গিয়েছিল । কে যে বলেছে ফয়সালের ঠিক মনে পড়ছেনা ।
রাগে দুঃখে টিভিটা আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর ।
পাশের ফ্ল্যাট থেকে চিত্কার ভেসে আসছে । ছক্কাআআআ ..
বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল ফয়সালের । বাংলাদেশের খেলা চলছে ।
ফোওর ..
তড়াক করে লাফ দিতে গিয়ে আবার বসে যায় ও।
অতঃপর আশেপাশের চিত্কার শুনে খেলার প্রতিটা দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করতে থাকে ফয়সাল। আর বাস্তবে আপনার একান্ত অনুগত বাধ্যগত স্বামী হয়ে স্ত্রীর পাশে বসে একটি হিন্দী সিরিয়ালের হাজারতম মহাএপিসোড গিলতে থাকে ।