উদ্বাস্তু

উদ্বাস্তু

আজকাল এভাবেই করিম ভাই সভা সমিতি নিয়ে ব্যস্ত। লোকে তার বক্তৃতা শুনে হাততালি দেয়। সে বক্তৃতা শেষ করে পানের পিক ছুড়ে মারেন নর্দমায়। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ সে মহা খ্যাপা। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আজ রাতেই সেরে নিতে চায়। যে লোক ইসরায়েলিদের হাতে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের ভিটে বাড়ির রক্ষার কথা বলে সেই আবার উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। করিম ভাই মুখে ফিলিস্তিনিদের সমর্থক হলেও কাজে ইসরায়েলি।

গোবিন্দ ভৌমিকের মাথায় বাজ পড়েছে। থাক, করিম ভাইকে দিয়ে শুরু করি। বড় হতে হতে করিম ভাইয়ের সংসার এখন পাকা কাঁঠালের মত লাগে। চারিদিকে ভন ভন শব্দ আর হলুদ গন্ধে মাখা সংসার কষ্ট করে চেপে আছে এক ছাদের নিচে তবে যে কোন দিন সেটা ফেটে বেড়িয়ে আসতে পারে। পরিবার পরিকল্পনা সে কখনো মানতে চাইত না এখনতো মানা না মানা সমান কথা।
রাতের অন্ধকারে গোবিন্দ ভৌমিক উদ্বাস্তু হবে। তার ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনী কেউ বলতে পারবে না বাংলাদেশ তাদের দেশ। উদ্বাস্তুদের দেশ থাকে না শুধু থাকে সরকার আর রেশন কার্ড। জন্মভূমি বলে তাদের কিছু নেই আছে জন্মস্থান। অথচ সব উদ্বাস্তুই নিজ দেশে জন্ম নেয়। গোবিন্দ ভৌমিক কি কখনো ভেবেছিল তাকে উদ্বাস্তু হতে হবে। জীবন বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে হবে সীমানা ছেড়ে।

ইসরায়েলিদের কুশপুত্তলিকা জ্বালানো হল। প্রতিবাদে ফেটে উঠল জনতা। সমবেত জনতাকে উসকে দিল করিম ভাইয়ের অগ্নি বাক্য। করিম ভাই সরকার মানে না। আইন মানে না। বক্তৃতায় বলে; প্রধানমন্ত্রী কেন মিনমিন করে কথা বলেন। ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে তাকে সৈন্য পাঠাতে হবে। জাতিসঙ্ঘে এত সৈন্য পাঠিয়ে কি হবে যদি মুসলমান ভাইদের পাশে না থাকা যায়।

আজকাল এভাবেই করিম ভাই সভা সমিতি নিয়ে ব্যস্ত। লোকে তার বক্তৃতা শুনে হাততালি দেয়। সে বক্তৃতা শেষ করে পানের পিক ছুড়ে মারেন নর্দমায়। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ সে মহা খ্যাপা। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আজ রাতেই সেরে নিতে চায়। যে লোক ইসরায়েলিদের হাতে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের ভিটে বাড়ির রক্ষার কথা বলে সেই আবার উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। করিম ভাই মুখে ফিলিস্তিনিদের সমর্থক হলেও কাজে ইসরায়েলি।

গোবিন্দ ভৌমিক দেশ ছাড়তে চায় না। জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত না করার জন্য হাত জোর করে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছে গেল ক’দিন। স্কুল কলেজের সহপাঠীদের সাহায্যও কামনা করেছে। থানায় গিয়ে বসে থেকেছে দিন-রাত। থানার ওসি অবশ্য ভাল পরামর্শ দিয়েছেন তাকে। তিনি বলেছেন নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে নিতে। জমি জমা না হয় মীমাংসা করা গেল কিন্তু এতগুলো জীবনের মীমাংসা কি করে করবে সে। মঈদুল গেছে পার্টি অফিসে খবর দিতে। যে কোন দিন চলে আসবে সে। তবে ঢাকা থেকে এখনো একটা ফোন এলো না ওসি সাহেবের কাছে। ফারুক শেখ বলেছে রাতে তার ঘরে গিয়ে ঘুমাতে, ফারুকের মা বলেছে বাড়িতে সে গরুর মাংস আনা বন্ধ করে দেবে। কিছু লোক এগিয়ে এসেও পিছিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ নীরব থাকে নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। ঘটনা-স্থান সরাসরি করিম ভাই এর নজরবন্দি। গোবিন্দের ভিটা না পেলে সবার মাথার ওপর কি করে চাল তুলবে সে! করিম ভাই তাই জোট বেঁধে নেমেছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা দাঁড়িয়ে গেছে গোবিন্দের বিপক্ষে। জয়ী হলে করিম ভাই পাবে ভিটা বাড়ি। জলীল ভাই গোবিন্দের জমি। সগির পাবে পালের গরু। পুকুরটা নেবে কুদ্দুস ব্যাপারী।

যদি গোবিন্দ ভৌমিকের চেহারা করিম ভাইয়ের মত হত। করিম হত গোবিন্দ ভৌমিক। যেমন সাদা আর কালো। তাহলেও গোবিন্দ ভৌমিকদের সমস্যার কোন সুরাহা হত না হয়তো। কেননা ইহুদী ফিলিস্তিনিদের মত এখানেও ধর্ম বড়। আছে, তবুও একটা পার্থক্য আছে। ফিলিস্তিনিরা ইট খেলে পাটকেলটি মারতে জানে। পার্থক্য হল গোবিন্দরা হাতে ইট তুলতে জানে না। গোবিন্দের হাতে টুকরো টুকরো ইট ভাঙ্গা থাকলে ভাল হত কি মন্দ সে কথা ভাবার সময় নেই। আজ গোবিন্দ ভৌমিকের হাতে মাদুর ধরিয়ে দেবে করিম ভাই। জমির বদলে মাদুর। সব কিছু হয়তো রাতের অন্ধকারেই করা হবে। করিম ভাই আজও মিটিং এ যাবে। বাদ আসর তাল তলায় মিটিং;

প্রিয় ভাই ও বোনেরা। ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে সকলে এগিয়ে আসুন। ইহুদীদের দখল করা প্রতি ইঞ্চি জমি ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। ঘরবাড়ী থেকে উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে। জান মালের নিশ্চয়তা দিতে হবে। তা না হলে, আপনারাই বলেন কি করব আমরা। ডাকের জন্য সকলে প্রস্তুত ছিল। অপেক্ষার বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল তাদের তাই, শুভ সঙ্কেতে সুরে মিলিয়ে সকলে বলল ‘জিহাদ’ দশ বছর আগে গোবিন্দকে যখন অমলেষ দাদা এই দিনটির কথা বলেছিল, গোবিন্দ তখন অট্টহাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল অমলেষ দাদার ভবিষ্যৎবাণী। আজ যখন চুপিচুপি গোবিন্দই জয়দেবকে আসন্ন বিপদের কথা বলল, গোবিন্দের নিজের নয় বরং স্নেহ তুল্য জয়দেবের আসন্ন বিপদের কথা তখন কিন্তু জয়দেব অট্টহাসি দিতে পারল না। একরকম মেনেই নিলো গোবিন্দ ভৌমিক সত্য কথা বলছে। এভাবে হঠাৎ করে যমদূত এসে হাজির হবে কে জানত। জয়দেব নিচু হয়ে তাকায় সবুজ পল্লবে ছেয়ে থাকা মটরশুঁটির দিকে। কাল সকালে মটরশুঁটিগুলো মালিক বিহীন হবে। ওই হিজল গাছটির নিচে গিয়ে আর বসতে পারবে না তাই সে তাকিয়ে থাকে ডাল পালার দিকে। নদিতে কত বালু অথচ একটি বালুকণা লেগে থাকবে না জয়দেবের পায়ের গোড়ালিতে। বুকের ভেতর ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে জমাট বাঁধে। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ফাতেমার সাথে তার প্রণয়। তাকেও বলতে পারবে না তোমার জয় কোন মিথ্যে কথা বলেনি। ভালবাসায় ছিল না কোন প্রতারণা। ঘর বাঁধার সব পরিকল্পনাই সত্য হত যদি এই কলঙ্কের রাত না দেখতে হত। আজ রাতেই তাকে নিরুদ্দেশ হতে হবে গোবিন্দ ভৌমিকের সাথে। হামলাটা আজ রাতেই হতে পারে। ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ জাগিয়ে সেই আগুন লাগানো হবে গোবিন্দ এবং সম্ভবত প্রতিবেশী জয়দেব সরকারের বাড়ি। যেন, কোন কালে হিন্দু ইহুদি ভাই ভাই ছিল।

আজ মিটিং এ অতিরিক্ত মানুষের আগমন ঘটেছে। অনেকে লাঠি ছোড়া নিয়ে এসেছে তাল তলায়। অনেক মুখ অচেনা তাতে কি, পৃথিবীর তামাম দেশ থেকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। কিছু একটা করার জন্য তাদের হাত পা নিশপিশ করছে। এভাবে অন্যায় কাজ আর কতদিন দেখবে মানুষ। হাততালি থেমে গেলে করিম ভাই বলে; বিশ্বের মুসলমানদের উচিৎ ফিলিস্তিনি ভাইদের পাশে এসে দাঁড়ান যাতে নিজ ভূমিতে তারা স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে পারে।

ঝুপ করে রাতের অন্ধকার এসে হাজির। আজ বৃষ্টি হবে না। কোন এফএম ব্যান্ড বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয় নি। আজ দেখা দেবে না নক্ষত্রের রাত। সব কিছুই করিম ভাইয়ের পক্ষে। বাকি যতোটুকু অপেক্ষা সেটা রাত গভীর হবার জন্য।

গোবিন্দ ভৌমিকের জন্য পৃথিবীর দীর্ঘতম রাত আজ।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত