আমি তোমাকে কখনো ছোট করবো না মা, কখনো না

আমি তোমাকে কখনো ছোট করবো না মা, কখনো না

ছেলেটার জন্মের সময় খুব কষ্ট পেয়েছি। টানা দুই দিন লেগেছে আমার নাড়ী ছেঁড়া ধনকে পৃথিবীতে আনতে। জন্মের পর দাই বললো মরা ছেলে হয়েছে। মরা হলে তাই, বুকের ধনকে আমি কারো হাতে দেইনি। বুকের মধ্যে চেপে ধরেছিলাম। কয়েক মিনিট পর আমার ছেলেটা কেঁদে উঠেছিলো।

নাম রেখেছিলাম ইব্রাহিম। পাঁচটা মৃত সন্তানের পর ইব্রাহিম। ছেলেটাকে আমি কখনোও আমার চোখের আড়াল হতে দিতাম না। রাতে মায়ে ছেলেতে কতো আলাপ ! আমার মাথার নীচে হাত রেখে ঘুমাতো। পণ করেছিলো, আমাকে কখনো ছোট হতে দেবেনা, কখনো না।

বয়স যখন পনেরো হলো তখন দেখলাম ছেলেটা লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখছে। কবিতার জন্য আলাদা খাতাও আছে। আমি লিখতে-পড়তে পারিনা। মায়েদের অবশ্য লিখতে পড়তে জানতে হয়না। ছেলের চোখ দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম, প্রেমে পড়েছে আমার ইব্রাহিম। ওকে তাড়াতাড়ি থিতু করতে চাচ্ছিলাম। বাড়ির উঠোন নাতি নাতনী দিয়ে ভরে উঠবে…কতো স্বপ্ন!

ঠিক এই সময়টাতেই যুদ্ধ শুরু হলো। ইব্রাহীমকে একমুহুর্ত চোখের আড়াল করিনি তখন। মিলিটারী আসতে পারবে না এমন কোথাও চলে যেতে চাচ্ছিলাম, অনেক অনেক দূরে কোথাও। যেদিন আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা সেদিন নামাজ শেষ করে দেখি ঘরে নেই ইব্রাহীম। কেন জানিনা ওর কবিতার খাতাটা খোঁজা শুরু করলাম। কোথাও নেই খাতাটা।

ছেলেটা ওর কবিতাগুলো নিয়ে গেছে। শূন্য সেই বাড়িতে আমি চারটা মাস ওর অপেক্ষাতে থেকেছি। কখন আসে ছেলেটা বাড়িতে। লোকজন আমাকে জান নিয়ে পালাতে বলেছে। গোটা গ্রাম আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আমি পালাইনি। একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের দুর্বলতা মানায় না। আমি জানি ইব্রাহিম আসবে আমার কাছে। কারন এই ছেলেটা ছাড়া আমার কেউ নেইতো। আর ঐ যে মেয়েটা! ঐ মেয়েটার জন্যে কবিতা লিখতে হবে না? মেয়েটাকে আমি চিনি না কিন্তু জানি মেয়েটার জন্যে আমার ছেলেটার অনেক অনেক কবিতা লিখতে হবে।

একা বাড়িতে সময় কাটতো না। মাঝে মাঝে ইব্রাহীমের ফেলে যাওয়া জামা শুঁকতাম। ছেলেটার গায়ের গন্ধ ছিলো তো। ওর গায়ের গন্ধ বুকে নিয়ে আমি থাকতাম অপেক্ষায়।

এরপর এক রাতে অল্প বয়সী এক ছেলে আমার কাছে ইব্রাহীমের কবিতার খাতাটা নিয়ে হাজির। মুক্তিযোদ্ধা। ছেলেটা বললো আমার ইব্রাহীম তার সাথের মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে স্বেচ্ছায় শহীদ হয়েছে। শেষের অপারেশনটায় ঝামেলা হয়ে গিয়েছিলো। ঠিকঠাক কিছুই হয়নি। বোমায় উড়ে গিয়েছে আমার নাড়ী ছেঁড়া ধন ইব্রাহীম। ওর শরীরের কিছুই পাওয়া যায়নি।

হাতে খাতা ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটা বললো, শেল্টারে পাওয়া গেছে । খাতার কোনায় চাপ বাধা রক্ত। নাকের কাছে নিয়ে আমার ইব্রাহীমের গায়ের রক্তের গন্ধ শুঁকলাম। হাতে ছুঁইয়ে দিলাম কয়েকটা পাতার কবিতা। ঐ সময় আমি একফোঁটা কাঁদিনি। চাইনি সামনে দাঁড়ানো অল্পবয়সী ছেলেটা চোখের জলে দুর্বল হয়ে পড়ুক। নিচু গলায় বললাম, খাতার শেষে কি লেখা?

ছেলেটা বললো, “আমি তোমাকে কখনো ছোট করবো না মা, কখনো না”।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত