দুপুর ১২টা কি সাড়ে ১২টা বাজে। মৃদু হাওয়ার সাথে ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। ছাদের ডান পাশটা থেকে রাস্তাটা অনেক দূর দেখা যায়, নিচের চায়ের দোকানটাও। বা দিকের কাঠাল গাছটায় একটা ভেজা কাক পাতার আড়ালে বসে গা ঝাড়া দিচ্ছে। রাস্তার পাশের জননী টেইলার্স, নিবির টেলিকম সব দোকানগুলোতেই শাটার টানানো। অতঃপর চায়ের দোকানটাতে ভীড় জমে গেছে। এদের মধ্যে কেউই ক্রেতা নয়, বৃষ্টি থেকে আড়াল করার জন্য আশ্রয় নিয়েছে।
কলেজ পড়ুয়া দুই তরুন-তরুনী একই ছাতার নিছে হাটছে। দমকা হাওয়ায় ছাতাটা ওদের মাথার উপর থেকে খানিকটা সরে গেলো। মুখ দুটোর হাসি দেখলেই বোঝা যায় নতুন বন্ধুত্ব। কে জানে, বৃষ্টি আর আড়াল ভাগাভাগির সাথে সাথে প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভুতি টাও হয়তো ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। কথাটা ভেবে আমি একটু শব্দ করেই হেসে উঠলাম।
কেউ থম থম পায়ে সিড়ি দিয়ে ছাদের দিকে আসছে। এ বাড়িতে এমনও কেউ আছে যার এই দুপুরে বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে হয়েছে আমার মতো। গত ছ’মাসে কোনো বৃষ্টির দিনে ছাদে কাউকে কখনো দেখিনি আমি, অন্তত আমি ছাদে থাকাকালীন। আমি ছাদের দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। গুনগুন করতে করতে ছাদে প্রবেশ করলো রিনি।
আমি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, বৃষ্টিতে ভিজবেন? চমকে উঠলো সে , থেমে গেলো তার গুনগুনানি।
আমি আবার বললাম, ‘ভিজুন না! ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টিতে জ্বর বা সর্দি লাগবে না।’
রিনি মৃদু হাসলো। না মুচকি না! অস্বস্তি প্রকাশ পায় এমন হাসি দিয়েই থেমে গেলো সে। গত ছ’মাস এ বাড়িতে থেকে এতোটুকু বুঝেছি স্বভাবত রিনি সম্পুর্ন ইন্ট্রুভার্ট একটা মেয়ে। সেক্ষেত্রে আমার মতো একজন মানুষের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে অস্বস্তি লাগাটাই স্বাভাবিক। আমি বুঝতে পারছি তার পা দুটো চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ভয় পাবেন না, মশা মাছিও আমাকে ভয় পায়না, রসাত্মক ভঙ্গিতে বললাম আমি। ফিক করে হেসে ফেললো ও।
হাসতে হাসতে বললো, ‘নাহ! ভয় পাইনি। একা বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়েছিলাম। আপনি থাকবেন ভাবিনি।’
আচ্ছা তাহলে আমি চলে যাচ্ছি, বললাম আমি।
এতোটা ন্যাকামি না করলেও চলবে, রেলিংয়ের উপরে দুহাতে ভর দিতে দিতে বাকা ঠোটে জবাব দিলে রিনি। কিছুটা ধাক্কা খেলাম আমি, যতোটা চাপা স্বভাবের ভেবেছিলাম ততোটা সে নয়।
বৃষ্টিতে চায়ের আড্ডাটা ভালো জমে, তাইনা? কাঠাল গাছের দিকে একপলকেই তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো রিনি।
বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা খাওয়ার মজা আছে। তবে এমন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চা খাওয়াটা মনে হয় ভালো হবে না। বৃষ্টির পানির কারণে চিনি কম পরে যাবে, নিজের কথার সাথে অট্টহাসি যোগ করলাম আমি।
আপনি জানেন আপনার হিউমর মোটেও ভালো না, বিরক্তির সুরে বললো রিনি।
হুম, জানি। জবাব দিলাম আমি। বৃষ্টি আগের চেয়ে একটু কমলো মনে হচ্ছে। আমি তাকালাম রিনির দিকে, কাঠাল গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে ও।
“তোমার অশ্রু বৃষ্টিতে ভেজা কাক আমি,
তোমার চাওয়ায় পূর্ণ।
আমার রঙ ক্যানভাসে হিজিবিজি তুমি,
তোমাতেই আমি শুন্য।”
আমি তাকালাম রিনির দিকে। এই লাইনগুলো আমার লেখা কবিতারই। তবে আজ রিনির মুখে শুনে আমার কাছেই নতুন মনে হচ্ছে।
মিঃ অনিরুদ্ধ! খুব ভালো কবিতা লিখেন আপনি, বললো রিনি। হেসে জবাব দিলাম,ধন্যবাদ।
কাঠালগাছটায় ওই কাকটা দেখে আপনার কবিতাটা মনে পড়ে গেছিলো, চোখ দিয়ে কাঠাল গাছটার দিকে ইশারা করলো ও। আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বৃষ্টির শব্দ আরো বাড়লো মনে হচ্ছে।
গান গাইতে পারেন? জিজ্ঞেস করলো রিনি।
উহু! পারিনা।
রিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আগেই ভেবেছিলাম এই গুনটা নেই আপনার মধ্যে, গান গাওয়ার ব্যাপারটা আপনার সাথে ঠিক মেলে না। আপনি গাইতে পারলেও সেটা মানাতো না।এক নাগাড়ে কথাগুলো বললো রিনি।
কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমি হাসলাম।
বৃষ্টি পড়ছে! বৃষ্টির ঝুম ঝুম আওয়াজ হচ্ছে। শুধু বৃষ্টির শব্দ। আমরা দুজনও চুপ। আমার গাইতে ইচ্ছে করছে।
গাইলাম, ‘শুধু প্রেম জেগে থাক একই সূরে, মেঘেদের পাল তুলে যাবো দূরের খেয়ায়…….. এক লাইন গাওয়ার সাথে সাথেই হঠাৎ কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হলো বৃষ্টিও থেমে গেলো। রিনি চলে যাচ্ছে নিঃশব্দে, নির্বিকার ভাবে। আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। পিছু ফিরে তাকালো রিনি। স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো “বাধো মেঘবরণে আবেশে ভালোবেসে”।
ওর গলার স্বরটা একটু অন্য রকম মনে হয়েছিলো আমার।
এখন ছাদে আমি একা। রিনির কন্ঠে শোনা গানের লাইনটা এখনো আমার কানে বাজছে।
“বাধো মেঘবরণে আবেশে ভালোবেসে।”
শব্দটা নিজে আরেকবার উচ্চারণ করলাম, ভালোবেসে?