আই লাভ ইউ, ম্যান –৩

আই লাভ ইউ, ম্যান –৩

০১.

এক আজ আরেক শনিবার।

গল্পের তৃতীয় এবং শেষ অংশটুকু শোনাবে আজ রানা। সেই রকমই কথা ছিল।

কিন্তু ভয় পেয়েছে সোহানা। লক্ষ করেছে সে, দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই কেমন যেন বিষন্ন আর গম্ভীর হয়ে উঠছে রানা। মুখের দিকে তাকানো যায় না। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়েছে তার, রানাকে এই অতীত স্মৃতি রোমন্থনে বাধ্য করাটা কি সত্যিই উচিত হল? আশ্চর্য এক কাহিনী জানা যাচ্ছে বটে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে সে, নতুন করে চিনছে রানাকে, জানছে-কিন্তু গল্পটা বলতে গিয়ে কি যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে রানার মধ্যে, সেটাও তার নজর এড়ায়নি। ওকে কষ্ট দিতে রীতিমত খারাপ লাগছে তার এখন। অথচ শেষ পর্যায়ে এসে এখন…ঠিক কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সোহানা।

দুপুর দুটো। অফিস ছুটি।

আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে সোহানা। নিজের রুম থেকে রানা বেরুতেই ওকে অনুসরণ করল সে, ধরে ফেলল এলিভেটরের কাছে এসে। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি আমি, ভয়ে ভয়ে মৃদুকণ্ঠে বলল।

ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তাকে রানা। ধমক খাবার জন্যে মনে মনে তৈরি হয়ে গেল সোহানা। কিন্তু ওকে বিস্মিত করে দিয়ে মৃদু গলায় রানা শুধু বলল, এসো।

নিচে নেমে লাল ডাটসানে উঠল রানা। পাশের সিটে সোহানা উঠে বসতেই স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল গাড়ি। পথে কোন কথা হল না। একটা চাইনিজ রেস্তোরায় ঢুকে প্রায় নীরবেই লাঞ্চ সারল ওরা।

কি হয়েছে তোমার, রানা? খাবার থেকে হঠাৎ মুখ তুলে জানতে চাইল সোহানা।

সোহানার মুখের দিকে তাকাল না রানা। চেহারায় সেই বিষন্ন ভাবটা রয়েছে এখনও। মৃদু কণ্ঠে বলল, কিছু না।

ম্লান দেখাচ্ছে তোমাকে। কি যেন ভাবছ।

সোহানা, নিচু গলায় বলল রানা, তোমার মনে আছে, গল্পটা তোমাকে শোনাতে চাইনি আমি?

আছে।

অনেক চেষ্টা করেছিলাম এড়িয়ে যাবার?

হ্যাঁ।

কেন জানো?

কেন?

ভয়ে।

ভয়ে? ভুরু কুঁচকে উঠল সোহানার। কিসের ভয়?

জবাব দিল না রানা। গম্ভীর। আর কোন প্রশ্ন করতে সাহস পেল না সোহানা।

লাঞ্চ সেরে সোহানাকে নিয়ে সোজা বাড়িতে চলে এল রানা। মনে মনে স্থির করেছে, দুপুরেই শুরু করবে আজ, যেমন করে হোক আজই শেষ করতে হবে ওর গল্পটা, তারপর মুছে ফেলতে হবে সবকিছু মনের পর্দা থেকে।

কফি? জানতে চাইল সোহানা।

ইয়েস, থ্যাংকিউ।

বাড়ির সামনের খোলা বারান্দায় পাশাপাশি বসল ওরা সোফায়। পাশের টিপয়ে কফির কাপ, সামনে সুন্দর সবুজ ঘাসে ছাওয়া লন, সাজানো ফুলের বেড, শজনে আর কৃষ্ণচূড়ার ডালে ছোট ছোট পাখিদের ব্যস্ততা। রানার একটা হাত তুলে নিল সোহানা নিজের হাতে।

ভয় কেন, রানা?

ভয় লাগে, তার কারণ, সোহানার হাতে মৃদু চাপ দিল রানা, স্মৃতি বড় বেদনাদায়ক, সোহানা। পুরানো সেইসব দিনের কথা আমি স্মরণ করতে চাই না। কিন্তু একবার যখন শুরু করেছি, সব মনে পড়ে যাচ্ছে-এ যেন ঠিক খুঁচিয়ে পুরানো ক্ষতটাকে দগদগে করে তোলা।

রানার চোখেমুখে ব্যথার ছাপ উঠতে দেখে সোহানা বলল, তবে না হয়…

না, তা হয় না, এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল রানা। শুরু করার পর থেকে প্রতিটা খুঁটিনাটি সব মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। এখন যদি শেষ না করি, তুমি তো কষ্ট পাবেই, নিজেও কষ্ট পাব। শুরু করি তাহলে, কেমন?

আসছে সিডনি শেরিডান।

কেপটাউন থেকে ছয় দিন আগে রওনা হয়ে গেছে বুমেরাং। টেলিগ্রাম মেসেজটা পেয়ে ইচ্ছে হল এক্ষুনি ছুটে যাই কুলি পীক-এ, দিগন্তরেখায় চোখ বুলিয়ে দেখি বুমেরাং আসছে কিনা। কিন্তু নিজেকে শান্ত করলাম আমি, টেলিগ্রামটা রাফেলাকে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফ্রবিশার স্ট্রীটে চলে এলাম।

ঢ্যাঙা গোখলে রামাদীন তার ট্রাভেল এজেন্সির দরজা মাত্র খুলছে, মা এডির দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাবার সময় দেখতে পেলাম। কেনাকাটার একটা তালিকা সহ রাফেলাকে দোকানে ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে এগোচ্ছি আমি। জলকুমারীর ইনশিউরেন্সের টাকা বীমা কোম্পানিতে জমা দেয়নি বলে খুন করতে গিয়েও করিনি রামাদীনকে, এবং সেই থেকে ওর সঙ্গে দেখা নেই আমার।

ডেস্কের পেছনে বসে আছে ও। পরনে হাঙ্গরের চামড়ার স্যুট, নেকটাইয়ের গায়ে নারকেল গাছের সারি, সৈকত এবং দ্বীপবাসিনী এক যুবতীর নকশা ছাপা। ধূর্ত একটা হাসি লেপ্টে রয়েছে ঢ্যাঙার ঠোঁটে, যখন একা থাকে আপনমনে এই হাসিটাই হাসে সে। মাথা নিচু করে একটা পেপার-ওয়েট নাড়াচাড়া করছে, লাল পাথরটার গায়ে সাদা হরফে লেখা রয়েছে-ভারত মহাসাগরের মুক্তো সেন্ট মেরীতে স্বাগতম।

পায়ের আওয়াজ পেয়ে হাসিভরা মুখটা তুলল সে, কিন্তু আমাকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ চেহারাটা রক্তশূন্য হয়ে গেল তার, ঝুলে পড়ল মুখটা। আতঙ্কিত একটা চিৎকার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে, পায়ের ধাক্কায় ঠকাঠক নেচে চার হাত দূরে সরে গেল চেয়ারটা। আধপাক ঘুরেই পেছনের দরজার দিকে ছুটল সে। কিন্তু ততক্ষণে আমি ওর পথরোধ করে দাঁড়িয়েছি। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। পিছু হটছে, করুণ ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছে। ঠোঁট দুটো নড়ছে দ্রুত, ব-ব-ব-ব শব্দ বেরিয়ে আসছে শুধু। হাঁটুর পেছনে চেয়ারটা ঠেকল, ধপ করে বসে পড়ল তাতে। এতক্ষণে মৃদু হাসলাম আমি। অনুভব করছি, স্বস্তিতে এখন ও জ্ঞান হারাতে পারে।

কেমন আছ, মিস্টার কবিরাজ?

উত্তর দিতে চেষ্টা করল ঢ্যাঙা রামাদীন, কিন্তু গলা থেকে–ছাড়া আর কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। তবে প্রচণ্ড বেগে মাথা নাড়তে দেখে বুঝলাম খুব ভাল আছে সে।

তোমার কাছে একটু সাহায্য চাইতে এসেছি আমি।

জান দিয়ে দেব, হঠাৎ কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল ঢ্যাঙা রামাদীন, ফ্রবিশার স্ট্রীটের শেষ মাথা পর্যন্ত যে-কেউ শুনতে পাবে তার এই চিৎকার। শুধু মুখ ফুটে উচ্চারণ করুন, এক্ষুনি করে দেব আপনার সব কাজ, স্যার, মিস্টার রানা।

ধীরে ধীরে শান্ত এবং সুস্থ হয়ে উঠছে রামাদীন, কান পেতে শুনছে তিন বাক্স বিস্ফোরকের জন্যে আমার অনুরোধ। আমি থামার আগেই মাথা নাড়তে শুরু করল সে, বোঝাতে চাইছে আমার এই অনুরোধ রক্ষা করা তার সাধ্যের বাইরে। কোটরাগত চোখ দুটো গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, টুপ টুপ করে ঝরে পড়তে বাকি শুধু। জিভ আর টাকরা সহযোগে হতাশাব্যঞ্জক বিচিত্র শব্দ উৎপাদন করে চলেছে সে।

তার এসব ভাবভঙ্গি দেখেও না দেখার ভান করে আমি বললাম, হাতে একেবারেই সময় নেই। বড়জোর কাল দুপুর পর্যন্ত সময় দিতে পারি তোমাকে। ওই সময়ের মধ্যে তিন বাক্স ওই জিনিস চাই আমার। যদি দিতে না পার, তুমি আর আমি ইনশিউরেন্স প্রিমিয়ামের বিষয়টা নিয়ে আবার আলোচনায় বসব…

দশটা আঙুল খাড়া করে হাত দুটো নেতিবাচক ভঙ্গিতে নাড়ছিল রামাদীন, আমার কথা শেষ হবার আগেই হাত দুটো কোলের ওপর পড়ে স্থির হয়ে গেল। চেহারায় বুদ্ধি এবং সদিচ্ছার ভাব ফুটে উঠল আবার।

তার কোন প্রয়োজন নেই, স্যার, মিস্টার রানা। আপনি যা চাইছেন তা বোধহয় আমি জোগাড় করে দিতে পারব-কিন্তু, ভয় করছি, বড় বেশি দাম পড়ে যাবে জিনিসগুলোর।

কত?

এক একটা কেস তিনশো ডলারের কম তো নয়ই, আমাকে আঁতকে উঠতে না দেখে সম্ভবত ডাবল দামটা কম চাওয়া হয়ে। গেছে, তাই দ্রুত সংশোধন করে নিল নিজেকে, বলল, আন্দাজে বলছি। পাঁচশো ডলারও হতে পারে।

লিখে রেখো। ধারে কিনতে চাইছি আমি।

স্যার, মিস্টার রানা! কান্না-করুণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ঢ্যাঙা রামাদীন। আমাকে বাঁচতে দিন, প্লীজ! কেউ ধার চাইলে আমি লজ্জায় মরে যাই…।

চুপ করে থাকলাম আমি। কিন্তু পরিবর্তে ভুরু কুঁচকে চোখ দুটো পাকালাম, দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল দুটো উঁচু করলাম এবং গভীর ভাবে বাতাস টেনে ফোলাতে শুরু করলাম বুকটা।

ঠিক আছে, ঠিক আছে! ব্যগ্র ব্যস্ততার সঙ্গে দ্রুত বলল রামাদীন। ওসবের কোন দরকার নেই, স্যার, মিস্টার রানা। আপনি আমার সম্মানিত খদ্দের। আপনাকে ধার দেব না তো কাকে দেব? যখন যা দরকার হবে মুখ ফুটে বলবেন শুধু তাহলেই পেয়ে যাবেন। একটু বিরতি নিয়ে মনে মনে বোধহয় যাচাই করল প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কথা বলে ফেলছে কিনা, তারপর একটু হেসে বলল, তাহলে সেই কথাই রইল–আগামীকাল আপনি মালটা ডেলিভারি নেবেন, আর পরশু দিন দাম চুকিয়ে দেবেন।

কে বলেছে পরশু দিন টাকা দেব?

বলেননি? বিস্মিত দেখাল রামাদীনকে। তাহলে বোধহয় শুনতে ভুল হয়েছে আমার। ঠিক আছে, তার পরদিন…

এমাসের শেষ তারিখে পাবে, জানালাম ওকে। তার আগে চাইলে এক পয়সাও পাবে না।

বেশ তো, তাই হবে। না হয় আরও একমাস পরে দেবেন। আপনি তো আর টাকা মেরে দেবার মানুষ নন…।

চমৎকার! লোক তুমি ভালই, রামাদীন। শুধু পেচ্ছাব করে তাতে গড়াগড়ি খাবার একটা বদভ্যাস আছে, এই যা। যাই হোক, অনুরোধ রক্ষার জন্যে ধন্যাবাদ।

আপনার কাজ করে আনন্দ পাই, স্যার, মিস্টার রানা, আশ্বস্ত করল আমাকে ও। দারুণ আনন্দ পাই।

আর মাত্র একটা অনুরোধ, রামাদীন, বললাম ওকে। মনে মনে আঁতকে উঠল ও, টের পেলাম চেহারা দেখে, কিন্তু এক সেকেণ্ডের মধ্যেই অসম সাহসের সঙ্গে মুখে হাসি টানল।

আপনার অনুরোধে ঢেঁকি পর্যন্ত গিলতে পারি, স্যার, মিস্টার রানা।

অদূর ভবিষ্যতে সুইটজারল্যাণ্ডের জুরিখে একটা কার্গো পাঠাতে চাই আমি। আমাকে যেন কাস্টমসের ঝামেলায় পড়তে না হয়। কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছ?

পানির মত, স্যার…

লাশ পাঠাবার অভিজ্ঞতা আছে তোমার? জানতে চাইলাম।

চোখ কপালে উঠে গেল রামাদীনের। স্যার, ঠিক কি বলতে চাইছেন…

দ্বীপে বেড়াতে এসে কোন টুরিস্ট যদি, ধরো, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল, তার লাশটা ফেরত পাঠানো হয় কিনা? যদি হয়, কে পাঠায়?

আমি, একগাল হেসে বলল রামাদীন। কার্গো আনা-নেয়ার যাবতীয় বেসরকারী কাজ এই অধমকেই করতে হয়-মড়াকে মানুষ নয়, কার্গো হিসেবেই গণ্য করি আমি।

গুড! তাহলে কিভাবে কি করতে হয় সবই জানা আছে তোমার। একটা কাঠের তৈরি কফিনের ব্যবস্থা করে রাখ আমার জন্যে, ওটা কবে পাঠাতে হবে পরে তোমাকে জানাব আমি।

স্যার, মিস্টার রানা, আমি কি জানতে পারি ঠিক কি জিনিস রফতানি করতে চান আপনি?

তোমার লাশ নয় সেটা।

এটুকু জেনেই আমি সন্তুষ্ট, গম্ভীরভাবে বলল রামাদীন।

গাড়ি চালিয়ে দুর্গে চলে এলাম আমি। প্রেসিডেন্টের সেক্রিটারির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, মাননীয় প্রেসিডেন্ট বৈঠকে বসেছেন, তবে আমি যদি দুপুর একটায় তার অফিসে লাঞ্চ খেতে আসি তাহলে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে।

আমন্ত্রণটা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সময়টা কাটাবার জন্যে। কুলি পীক-এ উঠলাম যতদূর গাড়ি ওঠে, তারপর পায়ে হেঁটে পুরানো লুকআউট এবং সিগন্যাল স্টেশনের ধ্বংসাবশেষের দিকে এগোলাম। প্যারাপেটে বসে চুরুট ধরালাম একটা, দিগন্ত বিস্তৃত মহাসাগর আর সবুজ দ্বীপমালিকা দেখছি। এই সুযোগে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আর কর্ম পদ্ধতিগুলো খুঁটিয়ে আরেকবার বিশ্লেষণ করে নিচ্ছি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি আমি, জীবনের কাছ থেকে আপাতত তিনটে জিনিস চাওয়ার আছে আমার। দুনাম্বার জলকুমারী, রাফেলা এবং দ্বীপবাসীদের ভালবাসা। দ্বীপবাসীরা এমনিতেই যথেষ্ট ভালবাসে আমাকে, কিন্তু সেই ভালবাসা যদি হারাতে না চাই তাহলে দ্বীপের একটা উপকার করতে হবে আমাকে এবং বড় ধরনের একটা মহত্ত্বের পরিচয় দিতে হবে। দুনাম্বার জলকুমারী পেতে হলে প্রচুর নগদ টাকার দরকার হবে আমার। আর রাফেলা বার্ডকে পেতে হলে…এইখানে এসে হোঁচট খেল আমার চিন্তা। অনেকক্ষণ দুশ্চিন্তায় কাটালাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গড়াবে তা অনুমান করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলাম আমি। সাহসে বুক বাঁধো, রানা, নিজেকে পরামর্শ দিয়ে ফেলে দিলাম চুরুটটা। ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম।

গাড়ি নিয়ে দুর্গে ফিরে আসতেই সেক্রেটারি আমাকে জানাল মাননীয় প্রেসিডেন্ট আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন প্রেসিডেন্ট, অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে রিসেপশনে বেরিয়ে এসেছেন তিনি, আমার কাঁধে একটা হাত তুলে দেবার জন্যে পায়ের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে নাগাল পাবার চেষ্টা করছেন। তাকে সম্মান দেখিয়ে একদিকের কাঁধ যথাসম্ভব নিচু আর কাত করে রাখলাম আমি। তিনি আমাকে তার অফিসে নিয়ে এলেন।

রুচিসম্মতভাবে সাজানো অফিস কামরাটা বিশাল একটা হলরুমের মত। সিলিং থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি, দেয়ালে হাতির দাঁতের মোটা ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো ধোঁয়াটে তৈলচিত্র এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য। কাঁচের ডিম্বাকৃতি জানালাগুলো মেঝে থেকে উঠে সিলিং ছুঁয়েছে, সামনে দাঁড়ালে বন্দরটা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। কামরার মেঝেটা ইরানী কার্পেটে মোড়া।

জানালার সামনে ওক কাঠের কনফারেন্স টেবিলে সাজানো হল রাজকীয় লাঞ্চ। খেয়ে নয়, খাইয়ে তৃপ্তি পাবার দলে পড়েন। মাননীয় প্রেসিডেন্ট-সুতরাং আমার কোন প্রতিবাদে কান না দিয়ে অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়ে গেলেন তিনি। তিনজনের খাবার একা খেয়ে যখন শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে, তখন সবিনয়ে ক্ষমা চাইলাম আমি।

স্নেহ মাখা হাসির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আমাকে রেহাই দিলেন। বললেন, এবার, লক্ষ্মী ছেলে, বল দেখি, তোমার জন্যে কি করতে পারি আমি। বললাম।

.

বাড়ি ফিরে একটা চিরকুট পেলাম রাফেলার, বেগম রডরিকের সঙ্গে দেখা করতে গেছে সে। ঠাণ্ডা একটা বিয়ার নিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসলাম আমি। প্রেসিডেন্ট পিডলের সঙ্গে আমার আলোচনাটা আদ্যোপান্ত স্মরণ করলাম আরেকবার।

কোথাও কোন খুঁত নেই, ভাবলাম আমি। সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির কথা মনে রেখে সমস্ত ফুটো বন্ধ করতে পেরেছি আমি-শুধু একটা ছাড়া, গা বাঁচাবার জন্যে দরকার হলে ওটা ব্যবহার করব আমি।

.

মেইন ল্যাণ্ড থেকে রামাদীনস ট্রাভেল এজিন্সির ঠিকানায় বেলা। দশটার প্লেনে তিনটে কাঠের বাক্স এসে পৌঁছুল, সেগুলোর গায়ে রঙ দিয়ে লেখা-টিনজাত মাছ। নরওয়ের পণ্য।

টার্টল বে-তে ডেলিভারি নিলাম বাক্সগুলো। পিকআপের পেছনে তুলে ক্যানভাস দিয়ে ঢেকে রাখলাম।

মাসের শেষ তারিখ পর্যন্ত, তাহলে, বিদায় নেবার আগে স্মরণ করিয়ে দিল আমাকে ঢ্যাঙা রামাদীন, স্যার, মিস্টার রানা। আপনাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না, আমিই ঠিক সময়ে এসে হাজির হব।

কাবলিওয়ালার মত? না, তার দরকার নেই। টাকাটা আমিই তোমাকে দিয়ে আসব-সময় হলে।

ঢোক গিলে কি যেন বলতে গিয়েও বলা উচিত হবে না ভেবে নিঃশব্দে বিদায় নিল রামাদীন।

প্রয়োজনীয় সব জিনিস ইতিমধ্যে প্যাক করে ফেলেছে রাফেলা। আমার একটা পুরানো শার্ট আর রঙ চটা জিনস পরেছে ও, ঢোলা আর হাস্যকর দেখাচ্ছে। প্যাক করা জিনিসপত্রের বাক্সগুলো গাড়িতে তুলতে সাহায্য করলাম ওকে আমি। তারপর উঠে বসলাম পিকআপে।

এপথে আবার ধনী হয়ে ফিরে আসব আমরা, ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে আশ্বস্ত করলাম রাফেলাকে।

নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে পাইনগাছের নিচে মেইন রোডে বেরিয়ে এলাম আমরা, তারপর বাক নিয়ে উঠতে শুরু করলাম পাহাড় সারির দিকে।

পাহাড়ের গা বেয়ে পেঁচানো পথ ধরে শহর আর বন্দরের মাথায় উঠে এসেছি, এই সময় প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, গড ড্যাম ইট! সেই সঙ্গে অকস্মাৎ ব্রেক কষলাম। রাস্তার সঙ্গে প্রচণ্ড ঘষা খেয়ে পিছলে গেল গাড়ির চাকা, পেছনের পাইনঅ্যাপলের ট্রাকটা সংঘর্ষ এড়াবার জন্যে দ্রুত নেমে পড়ছে রাস্তা থেকে। ঝড়ের বেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ট্রাকটা, জানালা দিয়ে গলা বের করা ড্রাইভারের অগ্নিমূর্তি দেখতে পেলাম পলকের জন্যে।

ড্যাশবোর্ডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রাফেলা, নিজেকে সিধে করে নেয়ার সময় চেঁচিয়ে উঠল সে, কি, কি হয়েছে?

দিনটা মেঘমুক্ত উজ্জ্বল-বাতাস এত স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার যে। ছবির মতো লাগছে আশ্চর্য সুন্দর সাদা আর নীল ইয়টটাকে। গ্র্যাণ্ড হারবারের প্রবেশ মুখে মেইল শিপ এবং প্রমোদতরীর জন্যে নির্ধারিত এলাকায় নোঙর ফেলে বসে আছে ওটা।

ইয়টের গায়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে রঙচঙে অসংখ্য সিগন্যাল ফ্ল্যাগ। সাদা স্যুট পরা ক্রুরা রেইল ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তীরের দিকে। পানি কেটে ইয়টের দিকে ছুটছে হারবার টেণ্ডার, বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হারবার মাস্টার, কাস্টমস ইন্সপেক্টর এবং ডাক্তার ডানিয়েলকে।

বুমেরাং? জানতে চাইল রাফেলা।

বুমেরাং এবং সিডনি শেরিডান, জানালাম ওকে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে দ্রুত নিচে নামছি আবার।

কি করবে তুমি এখন? জানতে চাইল রাফেলা।

আর যাই করি, ওরা যখন তীরে উঠবে আমি তখন সেন্ট মেরীতে থাকছি না।

পাহাড় থেকে নেমে প্রথম বাসস্টপের কাছে গাড়ি দাঁড় করালাম আমি। রাফেলাকে গাড়িতে রেখে কনফেকশনারি অ্যাণ্ড জেনারেল স্টোরে গিয়ে উঠলাম। ব্যবসাটা রডরিকের এক মামার। আমাকে দেখে কোন প্রশ্ন করল না সে, ঘাড় নেড়ে ভেতরের কামরায় যাবার অনুমতি দিল। শুধু ফোন করার প্রয়োজন হলেই এখানে আসি আমি।

রডরিকের নিজের ফোন নেই, কিন্তু পাশের বাড়িতে আছে। আমার কণ্ঠস্বর শুনে রডরিককে ডেকে আনল তারা।

রডরিক, ওকে বললাম আমি, মেইল শিপ মুরিংয়ে ওই ভাসমান ব্রথেলটা আমাদের জন্যে কোন সুখবর বয়ে নিয়ে আসেনি।

আমি কি বলতে চাইছি তা বুঝতে এক সেকেণ্ডের বেশি লাগল না রডরিকের। সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইল সে, বলে দাও কি করতে হবে।

ছুট লাগাও। পানির ক্যানগুলো স্ট্যাম্প নেট দিয়ে ঢেকে ফেল, যেন মাছ ধরতে যাচ্ছ। সাগরে বেরিয়ে এসে ঘুরপথে চলে এসো টার্টল বে-তে। সৈকত থেকে মালপত্তর তুলব আমরা হোয়েলবোটে। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে রওনা দেব গানফায়ার রীফের দিকে।

দুঘন্টার মধ্যে বে-তে পৌঁছাচ্ছি, বলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সে।

দুঘন্টা নয়, এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল রডরিক। ওর এই সময় জ্ঞানের জন্যে ভালবাসি ওকে আমি। সময় উল্লেখ করে আসবে বলে যদি কথা দেয়, ওর কথার ওপর সারা জীবনের সঞ্চয় বাজি ধরা যায়।

সূর্য ডোবার পর অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। হোয়েলবোট নিয়ে যখন রওনা দিলাম তখন একশো গজ দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। টার্টল বে থেকে বেরিয়ে দ্বীপ থেকে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে এসেছি, এই সময় চাঁদ উঠল আকাশে।

তারপুলিনের নিচে রাখা একটা জেলিগনাইটের বাক্সের ওপর বসে রাফেলা আর আমি বুমেরাংয়ের উদয় সম্পর্কে আলোচনা করছি।

সিডনি শেরিডান কি করবে এখন? জানতে চাইছে রাফেলা।

পকেট ভর্তি টাকা দিয়ে তার ছেলেছোকরাদেরকে তথ্য সংগ্রহের জন্যে পাঠাবে, বললাম আমি। দোকান এবং বারগুলোয় ঢুকে পশ্ন করবে ওরা-কেউ মাসুদ রানাকে দেখেছ?

উত্তরে কি বলবে সবাই?

উত্তর দেবার জন্যে লাইন দেবে দ্বীপবাসীরা, বললাম আমি। প্রথমে ওরা দুঃখের সঙ্গে জলকুমারীর দুর্ভাগ্য বর্ণনা করবে। তারপর বলবে, বেচারা মাসুদ রানা তার ক্রু রডরিকের হোয়েলবোট ভাড়া নিয়ে সী-শেল খোঁজার জন্যে ডাইভ দিয়ে বেড়ায় এখন। এর মধ্যে কেউ একজন ওদেরকে ঢ্যাঙা রামাদীনের কাছে যেতে বলবে আরও তথ্যের জন্যে। এবং ঢ্যাঙা রামাদীনকে ওরা যদি যথেষ্ট সালাম দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারে, গড় গড় করে বলে দেবে সে।

এরপর কি করবে সিডনি শেরিডান?

সেভার্নে ডুবে আমি মারা যাইনি বুঝতে পেরে হার্টে একটু ব্যথা অনুভব করতে পারে সে। ব্যথাটা কমলে টার্টল বে-তে আমার আস্তানা সার্চ করার জন্যে লোক পাঠাবে। ওখানে মস্ত একটা শূন্যতা ছাড়া কিছুই পাবে না সে। এরপর প্রিয়তমা লোরনা পেজ তাকে পথ দেখিয়ে বিগ গাল আইল্যাণ্ডের জলসীমায় নিয়ে। যাবে, মুঘল সম্রাটদের ব্যাঘ-সিংহাসন উদ্ধারের আশায়। ওখানে দুটো দিন কাটবে ওদের। তারপর বুঝতে পারবে ভোরের আলোর বেলটা ছাড়া ওখানে কিছু ছিল না এবং নেই।

তারপর?

তারপর? তারপর সম্ভবত উম্মাদ হয়ে উঠবে সিডনি। সম্ভবত প্রিয়তমাকে কিছু নির্যাতনও সইতে হতে পারে। এরপর ঠিক কি ঘটবে, আমি জানি না। শুধু জানি, চোখের আড়ালে থেকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কর্নেল গুডচাইল্ডের শখের ধন-সম্পদ উদ্ধার করতে হবে আমাদেরকে।

.

পরদিন স্রোতের মতিগতি সুবিধের না হওয়ায় সকালের শেষ। ভাগের আগে চ্যানেলে ঢুকতে পারা গেল না। এই সময়টুকু হাতে পেয়ে সুবিধেই হল, প্রস্তুতিপর্বের কিছু কাজ বাকি ছিল, সেগুলো সেরে নিতে পারলাম আমরা।

জেলিগনাইটের বাক্স খুলে দশটা হলুদ স্টিক বের করে নিলাম আমি। বাক্সটা বন্ধ করে বাকি দুটোর সঙ্গে, ক্যাম্পের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে, বেলেমাটির নিচে পুঁতে রাখলাম। এরপর রডরিককে বিস্ফোরক সরঞ্জামগুলো সাজিয়ে এবং চেক করে নিতে বললাম।

এটা-সেটা দিয়ে হাতে তৈরি একটা ব্যবস্থা, কিন্তু এর সাহায্যে অনেকবার বিস্ফোরণ ঘটাতে সফল হয়েছি আমরা। সরঞ্জাম বলতে সাধারণ একটা সুইচবক্সের ভেতর নাইনভোল্টের দুটো ট্রানজিস্টার ব্যাটারি, চার রীল হালকা ইনসুলেটেড কপার অয়্যার এবং চুরুটের একটা বাক্স ভর্তি ডিটোনেটর। প্রতিটি সিলভার টিউব যত এবং সতর্কতার সঙ্গে তুলো দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। বাক্সে বাছাই করা কিছু পেন্সিল আকৃতির টাইম ডিলেড ডিটোনেটরও রয়েছে।

এগুলো নিয়ে কাজ করার সময় রাফেলা আর ল্যাম্পনিকে সরিয়ে দিলাম আমরা। ইলেকট্রিক ডিটোনেটরগুলো হাতে তৈরি টার্মিনালে বেঁধে আটকে নিলাম অত্যন্ত সাবধানে।

শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করার নিয়মটা পানির মত সহজ, কিন্তু একজন বুদ্ধিমান লোক যখন জিনিসটা ব্যবহার করতে যায় তখন তার স্নায়ুর ওপর হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করে। এমন কি এক নাম্বারের একটা গাধাও তারের সংযোগ ঘটিয়ে বোতামে চাপ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এর কাছ থেকে ষোলো আনা কাজ নিপুণভাবে আদায় করার কৌশল রপ্ত করা অত সহজ নয়। নিখুঁত বিস্ফোরণ ঘটানো সাংঘাতিক কঠিন কাজ, তাই এটা একটা শিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

আধ-বাক্স জেলিগনাইটের বিস্ফোরণ হজম করে মাঝারী আকারের একটা গাছকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমি। গাছটা তার সব পাতা আর উল্টোদিকের কিছু ছাল হারিয়েছিল শুধু। কিন্তু মাত্র একটা স্টিকের অর্ধেকটা দিয়ে ওই গাছটাকেই আমি রাস্তার ওপর আড়াআড়ি ভঙ্গিতে ধরাশায়ী করতে পারি, তাতে যানবাহন চলাচলের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়বে রাস্তাটা। শুধু তাই নয়, গাছটা থেকে একটা পাতাও খসবে না। ঠাট্টা বা গর্ব করছি না, এ ব্যাপারে নিজেকে আমি একজন শিল্পী বলে মনে করি। এ ব্যাপারে যতটুকু জানি আমি, তার সবটুকু শিখিয়েছি রডরিককে। বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর ওর দুর্বলতা জন্মগত, কিন্তু কায়দা কানুন যতই শেখাই, শিল্পী ও কোনদিনও হতে পারবে না। গোটা ব্যাপারটাকে হালকা ভাবে নেয় ও, মজার একটা বিষয় বলে মনে করে। ডিটোনেটর নিয়ে কাজ করার সময় আনন্দে প্রলাপ বকতে শুরু করে দেয়।

দুপুরের খানিক আগে পুলে ঢুকে পজিশন নিলাম আমরা। পানিতে আমি একা নামলাম, সঙ্গে নিলাম শুধু একটা নেমরড এয়ার স্পিয়ার গান। স্পিয়ার গানের মাথার দিকটা আমার নিজের ডিজাইনে তৈরি। শেষ প্রান্তটা সূচের মত ছুঁচালো, এবং প্রথম ছয়। ইঞ্চি সরু ইস্পাতের কাটায় ভর্তি। তীক্ষ্ণ-মুখো মোট চব্বিশটা খুদে কাটা রয়েছে ওখানে, ওগুলোর পেছনে ক্রস-চিত্রে ভঙ্গিতে আটকানো হয়েছে একটা চার ইঞ্চি লম্বা ইস্পাতের রড, যাতে আমি যখন স্পিয়ার গানের অপর প্রান্তটা ধরে থাকব তখন যেন আহত প্রাণীটা পিছলে এসে আমাকে আঘাত করতে না পারে। গানের সঙ্গে রয়েছে পাঁচশো পাউণ্ড টেস্টের নীল নাইলনের লাইন, এই লাইনের একটা বিশ ফুট লম্বা লুপ রয়েছে ব্যারেলের নিচে।

ফিন পরা পা দিয়ে প্যাডেল করে নেমে এলাম বেঢপ ভাবে। ফুলে থাকা ভোরের আলোর খোলের কাছে। গানপোর্টের পাশে এক জায়গায় দাঁড়ালাম আমি, চোখে অন্ধকার সইয়ে নেবার জন্যে। পাতা দুটো বুজে থাকলাম কয়েক সেকেণ্ড।

চোখ খুলে সাবধানে উকি দিয়ে তাকালাম চারকোণা অন্ধকার গহ্বরটার ভেতর, আমার সামনে বাড়িয়ে ধরেছি স্পিয়ার গানের ব্যারেলটা।

মস্ত চাকার মত কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে গানপোর্টের ভেতর মোরে ঈলটা-কালো, চকচকে আর পিচ্ছিল দেখাচ্ছে তাকে। আমার সাড়া পেয়ে নড়ে উঠল সে, পঁাচ ছাড়াচ্ছে শরীরের। হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে পিছিয়ে যাচ্ছে, ভীতিকর অসমান হলুদ দাঁতগুলো বের করে ভয় দেখাচ্ছে আমাকে। তার চোখ দুটো কালো আর উজ্জ্বল, অন্ধকারে বিড়ালের চোখের মত জ্বলজ্বল করছে।

সাপের মত ঈল মাছটা আমার উরুর সমান চওড়া, লম্বায় সাত ফুটের কম না। দাঁত বের করে আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে যখন, তার ডরসাল ফিনের ঢেউখেলানো ঝুঁটি শক্ত আর খাড়া হয়ে উঠছে প্রচণ্ড রাগে।

ইতিমধ্যে গানপোর্টের পাশ থেকে বেরিয়ে এসে চারকোণা মুখের সামনে দাঁড়িয়েছি আমি। সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্যস্থির করার চেষ্টা করছি, কিন্তু মাথাটা আরেকটু তুলে একদিকে সামান্য একটু ঘোরানো পর্যন্ত বারবার ঢোক গিলে অপেক্ষা করছি আমি। গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে আমার। মাত্র একটা শট ছুঁড়তে পারব আমি, সেটা যদি জায়গা মতো লেগে ওটাকে কাবু করতে না পারে, এক নিমেষে উড়ে চলে আসবে আমার দিকে। ছোবল মেরে ডিঙি নৌকার কাঠের কিনারা দাঁত দিয়ে কামড়ে ভেঙে ফেলতে দেখেছি আমি আহত একটা মোরে ঈলকে। ওর ওই ধারাল দাঁত রাবার স্যুট আর মাংস ছিঁড়ে অনায়াসে পৌঁছে যাবে হাড়ের কাছে।

মন্থর ছন্দে দুলছে মাছটা, ফণা তোলা কেউটের মত নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছে আমার হাবভাব। লক্ষ্যভেদ করার জন্যে দূরত্বটা আরও কমিয়ে আনতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু একবার যখন ওর চোখে পড়ে গেছি, ওর দিকে এগোবার চেষ্টা করা স্রেফ বোকামি হবে এখন।

আরও কয়েক সেকেণ্ড পর প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। আক্রমণের দ্বিতীয় লক্ষণ প্রকাশ পেতে দেখলাম ওর মধ্যে। গলাটা অকস্মাৎ ফুলিয়ে মাথাটা সামান্য একটু ঘোরাল ও, ফলে মুখের একটা পাশ দেখতে পেলাম এতক্ষণে আমি।

বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে, তার কারণ এর আগে একবার মাত্র খেলাচ্ছলে অস্ত্রটা ব্যবহার করেছি আমি। ট্রিগার টেনে ধরতেই প্রচণ্ড হিস করে উঠল গ্যাস, সশব্দে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে গেল প্লাঞ্জারটা, ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে দিল স্পিয়ারটাকে। লম্বা একটা রেখা তৈরি করে ছুটছে স্পিয়ার, চাবুকের মত দুলছে পেছনে লাইনটা।

মাছটার খুলির একটু পেছনে কান আকৃতির কালো একটা। দাগের ওপর লক্ষ্য স্থির করেছি, লক্ষ্যভেদ করলাম দুই ইঞ্চি ডান দিক ঘেঁষে, দেড় ইঞ্চি ওপরে। কেউ যেন বোতামে চাপ দিয়ে ইলেকট্রিক চরকিটাকে ঘুরিয়ে দিল, বিদ্যুৎগতিতে কয়েকবার পাক খেল মোরে ঈল। মোচড় খেয়ে লম্বা শরীরটা কয়েক জায়গায় গোল রিঙ-এর মত কুণ্ডলী পাকিয়ে গেল, রিঙগুলো চোখের পলকে ছুটোছুটি করছে গোটা গানপোর্ট জুড়ে। গানটা ফেলে ফিন দিয়ে পেড়াল মেরে সামনে এগোলাম দ্রুত। চঞ্চলভাবে আঁকি। খাচ্ছে স্পিয়ারের হাতলটা, কয়েকবার চেষ্টা করে সেটাকে মুঠোয় ধরতে পারলাম আমি। কাঁটা বসানো স্পিয়ারের মাথার সঙ্গে মোটা চামড়া আর রাবারের মত পেশী আটকে গেছে-হাতল ধরে। পিছিয়ে আসছি আমি, টেনে বের করে আনছি ওকে ওর আশ্রয় থেকে।

নিঃশব্দ আক্রোশে মুখ হাঁ করে রয়েছে ঈলটা, রিঙ-এর জট খুলে গেল, প্রচণ্ড আক্ষেপে মোচড় খাচ্ছে শরীরটা ঝড়ে পড়া একটা যুদ্ধ জাহাজের মত।

মাথাটা সরিয়ে নিতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই প্রচণ্ড একটা ঝাপটা খেলাম লেজের, ধাক্কা লেগে মুখ থেকে সরে গেল। মাস্কটা। নাক এবং চোখে পানি ঢুকে গেছে। কয়েক সেকেণ্ড। কিছুই দেখতে পেলাম না। মাথা ঝাঁকাচ্ছি। ঈলটা প্রচণ্ড শক্তিতে। আছাড় খাচ্ছে এলোপাতাড়ি ভাবে। স্পিয়ারের হাতলটা ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইছে মুঠো থেকে। এক হাতে মাস্কটা আবার জায়গা মত বসিয়ে নিয়ে ওপর দিকে উঠে আসতে চেষ্টা করছি আমি। কোন বাধাই পাচ্ছি না, আমার সঙ্গে সঙ্গে স্পিয়ারের কাঁটাবহুল মাথায় আটকে থাকা ঈলটা দিব্যি উঠে আসছে। দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে আসছে আমার। এই সময় দেখলাম ঈলটা অদ্ভুত এক মোচড় দিয়ে পেছন দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে তার মাথা, ভীতিকর হ করা মুখের ভেতর স্পিয়ারের ধাতব অংশটা নিয়ে চোয়াল দুটো বন্ধ করছে। ইস্পাতের গায়ে দাঁত ঘষা খাওয়ার শব্দ পাচ্ছি। আমি। পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে ইস্পাতের রডটা, আবার খপ করে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে নিচ্ছে সেটা। কামড়ে ধরা জায়গাগুলোর ছাল উঠে গেছে, উজ্জ্বল রূপালী দাগ ফুটে উঠেছে।

আমার শিকারটা উঁচু করে ধরে পানির ওপর ভেসে উঠলাম আমি। সাপের মত সামুদ্রিক দানবটাকে পানির ওপর মোচড় খেতে আর আড়মোড়া ভাঙতে দেখে আতঙ্কে তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল রাফেলার গলা থেকে। কিন্তু আনন্দে আর আহ্লাদে আটখানা হল রডরিক।

বাপজানের কাছে চলে এসো, লোভে চকচক করে উঠল রডরিকের চোখ দুটো, ঝুঁকে পড়ে স্পিয়ারটা ধরে হোয়েলবোটে তুলে নিল ঈলটাকে ও। মুখের মাংস ভাঁজ খেয়ে উল্টে যাচ্ছে, বুলডগের মত কুৎসিত দেখাচ্ছে চেহারাটা-ওর সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য এই মোরে ঈল। গানের সঙ্গে বাইন মাছটার ঘাড় চেপে রেখে বেইট নাইফ দিয়ে নিপুণভাবে বিশাল দানবটার ধড় থেকে মুণ্ডটা আলাদা করে ফেলল ও, ঝপাৎ করে পানিতে পড়ল সেটা।

মিস রাফেলা, ম্যাডাম, অত্যন্ত সম্মান দেখিয়ে বলল রডরিক, আপনিই প্রথম এ স্বাদ গ্রহণ করবেন। জীবনে ভুলতে পারবেন না।

মাগো! শিউরে উঠল রাফেলা। রক্তাক্ত বীভৎস প্রাণীটার কাছ থেকে আরও একটু পিছিয়ে গেল সে।

আর দেরি নয়, জেলিগনাইট নিয়ে এসো, তাড়া দিলাম আমি।

ক্যারি-নেটটা ধরিয়ে দিল আমার হাতে ল্যাম্পনি। ইনসুলেটেড রীল হাতে নিয়ে পানিতে নামল রাফেলা, নিচে নামার সময় তার ছাড়ছে ও।

সোজা গানপোর্টের কাছে নেমে এলাম আমি। ভেতরে ঢুকে জায়গাটা আরেকবার পরীক্ষা করে নিলাম। পেছনের প্রবাল। টুকরোর স্কুপের সঙ্গে শক্তভাবে আটকে গেছে কামানের ব্রীচ। বিস্ফোরণ ঘটাবার জন্যে দুটো জায়গা বেছে নিলাম আমি। ধাক্কা খাইয়ে একপাশে সরিয়ে দিতে চাই কামানটাকে, চাই প্রকাণ্ড একটা হাতুড়ির মত ঘা মেরে প্রবালের সঙ্গে জমাট বেঁধে আটকে যাওয়া একটা প্ল্যাঙ্ক ভেঙে ফেলুক। একই সঙ্গে প্রবাল জঞ্জালের। প্রাচীরটা ভাঙবে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ, গানডেকে ঢোকার পথটা। উন্মুক্ত হয়ে যাবে তাতে।

জেলিগনাইটের টুকরো দুটো দুজায়গায় শক্তভাবে বেঁধে দিলাম তার দিয়ে। রাফেলার কাছ থেকে লাইনের শেষ প্রান্ত নিয়ে সাইড কাটার দিয়ে চেঁছে কপার অয়্যার বের করলাম, সেটা আটকে দিলাম টার্মিনালের সঙ্গে।

সব ঠিক আছে কিনা খুঁটিয়ে আরেকবার দেখে নিয়ে বেরিয়ে এলাম গানপোর্ট থেকে খোলের ওপর। পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে রাফেলা, কোলের ওপর পড়ে রয়েছে রীলটা। ফেলে রাখা স্পিয়ার গানটা তুলে নিয়ে সিগন্যাল দিলাম ওকে। উঠতে শুরু করলাম আমরা।

হোয়েলবোটে উঠে এসে দেখি একটা খেলনার মত ব্যাটারি সুইচবক্স নিয়ে গলুইয়ে বসে আছে রডরিক। ইতিমধ্যে তার সংযোগের কাজও সেরে ফেলেছে ও। এখন আরও কদর্য। দেখাচ্ছে ওকে, তার মানে বিস্ফোরণ ঘটাবার এই সুযোগটাকে ঈল মাছ খেতে পাওয়ার চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক বলে মনে করছে ও। এখন যদি সুইচবক্স ছেড়ে উঠে আসতে বলি ওকে, কোন সন্দেহ নেই, আমার সঙ্গে মারামারি বাধিয়ে দিতেও দ্বিধা করবে না ও।

দিই ফাটিয়ে, মাসুদ?

দাও, মৃদু কণ্ঠে বললাম ওকে। কিন্তু যা ভেবেছি, তাই। একচুল নড়ছে না রডরিক, মুখে অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুইচবক্সের বোতামটার দিকে। তারপর বোতামটার গায়ে একটা কালো মোটা আঙুলের ডগা ছোয়াল সে। আঙুলটা আলতোভাবে বোতামের গায়ে বুলাচ্ছে। তার এই আদরের ঘটা দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, এবং বিরক্তি প্রকাশ করে কোন লাভ নেই জেনে চুপ করে আছি, অপচয় হতে দিচ্ছি কয়েকটা মূল্যবান সেকেণ্ড।

শেষ পর্যন্ত ঝোকটা সামলাতে পারল না রডরিক, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল বোতামটা।

অকস্মাৎ মাথাচাড়া দিয়ে কেঁপে উঠল পুলের পানি, ধাক্কা খেয়ে দুলে উঠল হোয়েলবোট। কিছুক্ষণ পর রাশ রাশ বুদবুদ ভেসে উঠল পানির ওপর। স্যুটের ট্রাউজারটাও এবার পরে নাও, রাফেলা, ওকে বললাম আমি।

কেন? তর্ক জুড়ে দিল ও। তোমার কি ধারণা বিস্ফোরণের ফলে পানি গরম হয়ে গেছে?

দস্তানা এবং জুতোও পরতে হবে, রাবারের ফুল প্যান্টটা নিজের পায়ে গলিয়ে নিয়ে আবার বললাম ওকে। খোলটা যদি ভেঙে গিয়ে থাকে, এবারের ডাইভেই ভেতরে ঢুকব আমরা। চোখা কিছুর সঙ্গে ঘষা লাগতে পারে, তাই সাবধান হবার দরকার আছে।

তর্ক করার পুরোপুরি ইচ্ছে থাকলেও হাতে কোন যুক্তি নেই দেখে অবশেষে আমার কথা মেনে নিল রাফেলা। সামনে একরাশ কাজের বোঝা দেখতে পাচ্ছি আমি-ওকে ট্রেনিং দিয়ে আমার ঘর করার উপযুক্ত করে তুলতে বেশ সময় লাগবে, ভাবলাম।

আণ্ডারওয়াটার টর্চ জেনি বার আর হালকা নাইলনের এক কয়েল লাইন চেয়ে নিলাম ল্যাম্পনির কাছ থেকে। ওদিকে টাইট রাবার প্যান্টটা টানাটানি করে ওপরে তুলতে হিমশিম খাচ্ছে রাফেলা। শেষপর্যন্ত হার মানল ও, অসহায়ভাবে তাকাল ল্যাম্পনির দিকে। বিশ্বস্ত ক্রীতদাসের মত এগিয়ে এসে ওকে সাহায্য করছে ল্যাম্পনি। কাজটা শেষ হতেই বোতাম আটকে নিল রাফেলা, আমার দিকে ফিরে বলল, রেডি।

পানিতে নেমে অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছি, এই সময় ঝাপসা নীল গভীরে চিৎ হয়ে ভেসে থাকা প্রথম মরা মাছের দেখা পেলাম আমরা। বিস্ফোরণে কয়েক হাজার মাছ হয় মারা গেছে, নয়ত অবশ অচেতন হয়ে গেছে, এদের মধ্যে রয়েছে কড়ে আঙুলের সমান চুনো থেকে শুরু করে দুই হাত লম্বা ডোরাকাটা স্ন্যাপার আর রীফ-ব্যাস। হত্যাযজ্ঞের নমুনা দেখে বিষাদে ভরে উঠল। মনটা, কিন্তু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে যত মাছ মেরেছি তা একটা ব্লুফিন টানির একদিনের খোরাকও নয়।

ঝক ঝক মরা মাছের ভেতর দিয়ে নামছি আমরা, অন্ধকার রাতের আকাশে নিষ্প্রভ তারার মত চারদিকে হঠাৎ জ্বলে উঠছে মাছদের চোখ। পুলের তলাটা বালু-কণা আর অন্যান্য জঞ্জালের। গুড়োয় ঘোলা দেখাচ্ছে। বাঁশঝাড়ের মাথার এক জায়গায় গভীর একটা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে বিস্ফোরণের ফলে, সেটার ভেতর দিয়ে নামছি আমরা।

নজর বুলিয়েই বুঝলাম যা চেয়েছিলাম তাই ঘটেছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় খোল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে কামানটা, গানপোর্টের প্রাচীন চোয়াল থেকে পোকায় খাওয়া দাঁতটা সম্পূর্ণ উপড়ে নিয়েছে। ছিটকে এসে কামানটা পুলের মেঝেতে পড়েছে। সঙ্গে করে নিয়ে আসা প্রবাল জঞ্জালের মাঝখানে।

গানপোর্টের ওপরের ঠোঁট ভেঙে যাওয়ায় গর্তটা আরও বড় হয়েছে, একজন মানুষ ওখানে এখন সিধে হয়ে দাঁড়াতে পারবে। গর্তটার ওদিকে টর্চের আলো ফেললাম, কিন্তু ভাসমান জঞ্জালের গুড়ো আর বালুকণা ভর্তি ঘোলা পানিতে দৃষ্টি চলে। এই ময়লা থিতিয়ে পড়তে আরও সময় নেবে। কিন্তু অতক্ষণ ধৈর্য ধরতে রাজি নই আমি। খোলের মাথায় বসে সময় আর এয়ার রিজার্ভের হিসেব মেলাচ্ছি। এর আগে দুবার ডাইভ দেয়ায় এবার ডিকমপ্রেশনের জন্যে অতিরিক্ত সময় দিতে হবে আমাদেরকে, সেকথা মনে রেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, হাতে আমাদের এখনও নিরাপদ সতেরো মিনিট সময় রয়েছে। রিস্টওয়াচের সুইভেল রিঙটা সেট করে ভোরের আলোর ভেতরে ঢোকার প্রস্তুতি নিলাম আমি।

রাফেলাকে জায়গা ছেড়ে নড়তে নিষেধ করে নাইলন লাইনের শেষ প্রান্তটা বাধলাম ছিটকে পড়া কামানের সঙ্গে, তারপর পেছনে লাইন ছাড়তে ছাড়তে আবার উঠে এলাম গানপোর্টের খোলা মুখের কাছে। নিষেধ মানেনি রাফেলা, গানপোর্টের ভেতর দিয়ে ঢুকে খোলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে ও। রেগেমেগে হাত নেড়ে বেরিয়ে আসতে বলছি ওকে, কিন্তু জেদের বশে পাল্টা হাত নেড়ে পরিষ্কার জানাচ্ছে, আমার কথা শুনতে রাজি নয় ও। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে কারাতের একটা মারের ভঙ্গি দেখিয়ে হুমকি দিতে হল ওকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে এল বটে, কিন্তু স্লেটে লিখতে ভুলল না–এই অন্যায়ের বিচার করবে রডরিক।

সাবধানে গানপোর্টের ভেতর ঢুকছি আমি, ঘোলা পানিতে তিন ফুটের বেশি দৃষ্টি যাচ্ছে না। বিস্ফোরণের ফলে কামানের পেছন দিকে যে বাধাটা ছিল সেটার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। একটা ফাঁক দেখতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে হলে আরও বড় করতে হবে ওটাকে। জেনি বার-এর সাহায্যে ধ্বংসস্তুপের বড় কয়েকটা টুকরো সরাবার পর দেখলাম ভারি গান ক্যারেজটাই আসলে প্রধান বাধা তৈরি করছে।

সদ্য বিস্ফোরণে ধসে পড়া স্থূপে কাজ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক, জানার কোন উপায়ই নেই কিসের ওপর স্থির হয়ে আছে গোটা ব্যাপারটা, আঙুলের একটু ছোয়া বা পানির একটু ধাক্কায় হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর নেমে আসবে কিনা।

কাজ করছি ধীর-স্থির ভাবে, আমার শিড়দাঁড়ার নিচের দিকের। শেষ গিটে তালু দিয়ে বারবার অসহিষ্ণু চাপ দিচ্ছে রাফেলা, কিন্তু গ্রাহ্য করছি না। একবার টুকরো কয়েকটা প্ল্যাঙ্ক নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি, রাফেলা দ্রুত আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার স্লেটে লিখল-আকারে ছোট আমি! ছোট শব্দটার নিচে দুটো রেখা টেনেছে ও, যাতে জোড়া বিস্ময়বোধক চিহ্নটা আমার নজর এড়িয়ে না যায়। উত্তরে আবার কারাতের কোপ দেখালাম ওকে। পরিষ্কার দেখলাম মাস্কের ভেতর মুখ ভেঙচাচ্ছে ও।

এর মধ্যে জায়গাটা মোটামুটি পরিষ্কার করে ফেলেছি, ঢোকার পথে এখন একমাত্র বাধা ভারী গান ক্যারেজটা, গান ডেকের প্রবেশপথে আড়াআড়ি ভাবে একটু কাত হয়ে ঝুলছে সেটা। এর বিরুদ্ধে জেনি বারটার করার কিছুই নেই। হয় আমাকে ফিরে গিয়ে জেলিগনাইট নিয়ে আসতে হয় আগামীকাল, নয়ত একটা ঝুঁকি নিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারি এখনই একবার।

রিস্টওয়াচে চোখ রেখে জানলাম বারো মিনিট খরচ করে ফেলেছি এরই মধ্যে। তাছাড়া, এবারে নিচে নেমে অন্যান্য বারের তুলনায় কিছু বেশি বাতাস টানছি আমি। তবু ঠিক করলাম এখনই একটা চেষ্টা করে দেখব।

টর্চ আর জেনি বার রাফেলাকে দিয়ে আবার ঢুকলাম গানপোর্টে। গান ক্যারেজের ওপরের প্রান্তের নিচে কাঁধ ঠেকালাম, পা নেড়ে চেড়ে খুঁজে নিলাম শক্ত একটা জায়গা। বুক ভরে শ্বাস নিলাম, তারপর চাপ দিতে শুরু করলাম কাঁধ দিয়ে।

ধীরে ধীরে চাপ বাড়াচ্ছি, আমার পা আর পিঠের পেশী লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে। মুখ আর গলায় রক্ত উঠে এসে গরম করে তুলেছে চামড়া, অনুভব করছি, কোটর ছেড়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে চোখ দুটো। একচুল নড়ছে না গান ক্যারেজটা। নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বুক ভরে নিলাম বাতাসে, আবার চেষ্টা করলাম, এবার টিম্বার বীমে আমার সবটুকু শক্তি দিয়ে চাপ দিলাম।

কাঁধে প্রচণ্ড চাপ, তারপরই ঢিল অনুভব করলাম। কাজ হয়েছে। ভারসাম্য হারিয়ে পেছন দিকে ডিগবাজি খেলাম আমি, হুড়মুড় করে সশব্দে নেমে আসছে আমার ওপর প্রবাল জঞ্জাল।

পতনের শব্দ থামল এক সময়। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ঘিরে রেখেছে আমাকে। প্রবাল গুড়ো আর পচা কাঠের ঘন কাদার ঘোলা পানিতে আলো ঢুকতে পারছে না। নড়তে চেষ্টা করলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে পায়ের আঙুল থেকে মাথার খুলি পর্যন্ত হিম হয়ে গেল ভয়ে। কিসে যেন আটকে গেছে আমার একটা পা, নড়াতে পারছি না। উন্মত্তের মত ছুঁড়তে চেষ্টা করছি পা-টা। আতঙ্কে ভোতা হয়ে গেছে আমার অনুভূতি, ছয়বার পা ছোড়ার পর আবিষ্কার করলাম এর আগেই কপাল গুণে মুক্ত হয়ে গেছে পাটা। গান ক্যারেজটা সিকি ইঞ্চির জন্যে ছুঁতে পারেনি আমার পা, পড়েছে আমার রাবার সুইমিং ফিনের ওপর। জুতো থেকে টেনে বের করে নিলাম পা, অন্ধকারে পথ হাতড়ে ফাঁকটা দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে।

খবরের জন্যে ব্যগ্রভাবে অপেক্ষা করছে রাফেলা। স্লেটে লিখলাম-পথ হয়েছে!! শব্দ দুটোর নিচে দুটো রেখা টানলাম। গানপোর্টের দিকে হাত তুলল ও, ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইছে। রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। আরও দুমিনিট আছে হাতে। মাথা কাত করে সায় দিলাম, ওকে পেছনে নিয়ে এগোলাম আবার গানপোর্টের দিকে।

টর্চের আলোতেও আঠারো ইঞ্চির বেশি দেখতে পাচ্ছি না। তবে সদ্য তৈরি ফাঁকটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। বেশ বড়ই হয়েছে সেটা, এয়ার বটল বা ব্রিদিং হোস কোথাও আটকাল না, সহজভাবে ঢুকতে পারলাম।

ভোরের আলোর ডেক আর কম্প্যানিয়নওয়ের গোলক ধাঁধায় পথ হারাতে চাই না, তাই পেছনে নাইলন লাইন ছেড়ে এগোচ্ছি আমি। লাইন ছুঁয়ে আমাকে অনুসরণ করছে রাফেলা, আমার পায়ের আঙুলে, গোড়ালিতে ওর হাতের স্পর্শ পাচ্ছি।

গান ক্যারেজের ওদিকে পানির ঘোলাটে ভাব একটু কম। ফাঁকটা গলে গান ডেকের নিচু, চওড়া একটা চেম্বারে এসে। পৌঁছুলাম আমরা। রহস্যময় আর ভৌতিক লাগছে পরিবেশটা, আমাদের চারদিকে বেঢপ আকৃতির কি সব দেখতে পাচ্ছি। কোনটা চিনতে পারছি, বেশির ভাগই চেনা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় গান ক্যারেজটা দেখতে পেলাম আমি। বাক এবং কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অথবা স্তুপ হয়ে রয়েছে ক্যানন বলগুলো। আর সব জিনিস অনেকদিন পানিতে ভিজে তাদের চেহারা বদলে নিয়েছে, চেনা যাচ্ছে না।

ধীর গতিতে এগোচ্ছি সামনে, আমাদের ফিনের ঝাপটায় আবর্জনা আর কাদার ঘূর্ণি তৈরি হচ্ছে পানিতে। এখানেও আমাদের সামনে ভাসতে দেখছি মরা মাছ। তবে কিছু লাল রীফ ক্রেফিশ চোখে পড়ছে, আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে প্রকাণ্ড মাকড়সার মত হামাগুড়ি দিয়ে জাহাজের নিচের দিকে ভেসে যাচ্ছে।

আমাদের মাথার ওপর ডেকের গায়ে টর্চের আলো ফেললাম। আমি, লোয়ার ডেক আর হোল্ডগুলোয় ঢোকার পথ খুঁজছি। জাহাজটা উল্টে থাকায় এর যে ড্রয়িংটা দেখেছি আমি সেটার সঙ্গে মিলিয়ে পথ খুঁজে নিতে একটু বেশি সময় লাগছে আমার।

ভেতরে ঢোকার মুখ থেকে পনেরো ফুট এগিয়ে ফোক্যাসলের মইটা দেখতে পেলাম আমি, আরেকটা চৌকো গর্ত দেখতে পাচ্ছি মাথার ওপর। ফাঁকটা গলে উঠে আসছি, বুদ বুদগুলো রূপালী, তরল পারদের মত বাল্কহেড আর ডেকিং ঘেঁষে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। পচে ঘন কাদা হয়ে আছে মইটা, ছোঁয়া লাগতে না লাগতে খসে পড়ছে, লোয়ার ডেকে যাবার সময় আমার মাথার চারপাশে স্থিরভাবে ভাসছে টুকরোগুলো।

সরু একটা প্যাসেজ দিয়ে এগোচ্ছি আমরা, দুদিকে সার সার দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজাগুলো দিয়ে ভেতরে ঢোকার অদম্য ইচ্ছা জাগছে আমার। এগুলো সম্ভবত অফিসার্স মেস এবং প্যাসেঞ্জার কেবিন। ভেতরে ঢুকে চমকপ্রদ অনেক কিছু আবিষ্কার করার ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রেখে লম্বা ডেকের শেষ প্রান্তে একটা বড় বাল্কহেডের সামনে এসে থামলাম। এটা সম্ভবত ফরওয়ার্ড হোল্ডের বাইরের দেয়াল, ডেক ভেদ করে নেমে গেছে জাহাজের পেটের কাছে।

যতটুকু এগিয়েছি তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে টর্চের আলো ফেলে রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। নিরাপদ সময়ের পরও চার মিনিট পার করে দিয়েছি বুঝতে পেরে অন্যায় একটা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম, প্রতিটি সেকেণ্ড আমাদেরকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এয়ার বটল খালি হয়ে যাবার ভীতিকর বিপদের দিকে। শুধু তাই নয়, এর ফলে ডি-কমপ্রেশনের জন্যে বিরতিগুলো সম্পূর্ণ করতেও পারব না, ফলে রক্তে বুদ বুদ সৃষ্টি হওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকিয়ে নিতে হবে আমাদেরকে।

খপ করে রাফেলার একটা হাত ধরলাম আমি, রিস্টওয়াচ দেখিয়ে বিপদের সিগন্যাল দিলাম ওকে। সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বটা বুঝল ও, দ্রুত অনুসরণ করল আমাকে। খোলের ভেতর দিয়ে গাইডিং লাইন ধরে গানপোর্টের দিকে ফিরে আসছি আমরা। এরই মধ্যে ডিমাণ্ড ভালভের আড়ষ্টতা অনুভব করছি, বটল খালি হয়ে আসায় বাতাস যোগান দিতে ইতস্তত করছে।

বাইরে বেরিয়ে এসে ওপরে তাকাবার আগে প্রথমে আমার পাশে রাফেলা এসে পৌঁছেছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে জেনে নিলাম। তারপর মুখ তুলে ওপর দিকে তাকিয়েই ছ্যাঁৎ করে উঠল আমার বুক। আতঙ্কে গলায় বাতাস আটকে গেল, আমার তলপেটের ভেতর কেউ যেন গরম তেল ঢেলে দিয়েছে।

গানফায়ার ব্রেক-এর পুল রক্তাক্ত একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিস্ফোরণে নিহত কয়েক টন মাছ টেনে এনেছে ঝাঁক ঝাঁক গভীর পানির কিলার শার্ককে। মাংস আর রক্তের গন্ধ, সেই সঙ্গে স্বজাতিদের অস্থিরভাবে সাতার কাটার খবর পানির ভেতর। দিয়ে পেয়ে গেছে ওরা, দল বেঁধে ছুটে চলে এসেছে নির্বিচার নির্মমতায় মেতে ওঠার জন্যে। এই নির্দয়তার পেছনে বুদ্ধি। বিবেচনার ছিটেফোঁটাও নেই, তাই একে বলা হয় ফিডিং ফ্রেঞ্জি। এ এক ধরনের উন্মত্ত অবস্থা, তিন দিনের খাবার একবারে খেয়ে নিয়েও সামনে যা পায় তাই গোগ্রাসে গিলে নিতে থাকে-যতক্ষণ। খাবার দেখতে পায় চোখের সামনে। এর কোন বিরাম নেই।

তোমার মনে আছে, বাটু ফারেঙ্গির সেই ড্রাগন স্পটে কি হয়েছিল অবস্থাটা? অনেকটা সেই রকম। কিন্তু তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ভয়ঙ্কর।

দ্রুত রাফেলাকে টেনে নিয়ে পিছিয়ে এলাম গানপোর্টের ভেতর। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছি পানির আলোকিত সিলিংয়ের গায়ে বিশাল আকৃতিগুলোর দ্রুত আনাগোনা।

অপেক্ষাকৃত ছোট হাঙ্গরের ঝাঁকের ভেতর কমপক্ষে দুডজন কুৎসিত হিংস্র রক্তলোলুপ, ভয়ঙ্কর জানোয়ার দেখতে পাচ্ছি; যেগুলোকে দ্বীপবাসীরা আলবাকোর শার্ক বলে। শরীরটা ব্যারেলএর মত, অর্থাৎ মাঝখানটা মোটা, পেছনে এবং সামনেটা ক্রমশ সরু। মুখ আর নাক গোল, পেটটা ঝুলে পড়া, চওড়া নিঃশব্দ হাসি মাখা চোয়াল। কদাকার উন্মত্ত দানবের মত ছুটোছুটি করছে ওরা, শক্তিশালী লেজ ঝাপটাচ্ছে, মুখগুলো বিদ্যুৎচালিত যান্ত্রিক মেশিনের মত দ্রুত আর ঘন ঘন খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে-মাছ, রক্ত, আঁশ, মাংশের টুকরো আর কণা, ক্ষুধার্ত রাক্ষসের মত কিছুই বাদ দিচ্ছে না, গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে সব। যতদূর জানি এরা সাংঘাতিক লোভী আর বোকা, উদরস্থ করার উন্মাদনায় মেতে থাকে না যখন তখন এক আধটু ভয় দেখালেই পিছু হটে যায়। কিন্তু এখন নিজেদের ভালমন্দ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ওরা, লোভে উত্তেজিত আর অন্ধ হয়ে আছে, একবার ঘটালে আর রক্ষা নেই। কিন্তু শুধু এই দুই ডজন হলে তবু আমি ডি-কমপ্রেশনের জন্যে মাঝে মাঝে বিরতি নিয়ে ওপরে উঠে যাবার কল্পনাতীত ঝুঁকিটা প্রাণ বাজি রেখে হলেও নিতাম।

আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে এরা নয়, অন্য দুটো প্রসারিত আকৃতি, যারা নিঃশব্দ রাজসিক ভঙ্গিতে দ্রুত টহল দিয়ে তুমুল আলোড়ন তুলছে পানিতে। এদেরকে দেখেই হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে আমার। গভীরভাবে দুফাঁক করা চওড়া লেজের একটা মাত্র শক্তিশালী ঝাপটায় বাঁক নিচ্ছে ওরা, তাতে ছুঁচালো নাক লেজের প্রায় ডগা ছুঁই ছুঁই করছে, তারপর সমস্ত শক্তি আর গর্বিত ঈগলের সাবলীল ভঙ্গিতে উড়ে চলছে আরেকদিকে।

এই ভয়ঙ্কর মাছের যে-কোন একটা যখন সামনে খাবার দেখে থামছে, আধখানা চাঁদ আকৃতির প্রকাণ্ড মুখটা খুলে যাচ্ছে, ভেতরে দেখা যাচ্ছে আগে-পিছে অসংখ্য দাঁতের সারি, দাঁতগুলো চওড়া আর লম্বা, বাইরের দিকে ছড়ানো।

জোড়াটা একই আকৃতির, নাক থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত তেরো-চোদ্দ ফুট লম্বা, ডরসাল ফিনের দেড় হাত উঁচু ফলাটা খাড়া হয়ে আছে। পিঠের চওড়া অংশের রঙ স্লেট পাথরের মত, পেটটা তুষারের মত ধবধবে সাদা আর ঝকঝকে লেজ আর ফিনের কিনারাগুলোর রঙ গাঢ় কালো। একটা মাত্র কামড়ে একজন মানুষকে দুটুকরো করতে পারে এরা এবং টুকরো দুটো একটা মাত্র ঢোকে গিলে নিতে পারে।

গানপোর্টের মুখ থেকে উঁকি মারছি, ব্যাপারটা ওদের। একজনের চোখে পড়ে গেল। এক নিমেষে লেজ ঝাপটে আধ পাক ঘুরে গেল সে, স্যাঁত করে নেমে এল আমাদের মাথার কাছে, কয়েক ফুট ওপরে থেমে বুদ্ধি পাকাচ্ছে। আঁতকে উঠে গানডেকের অন্ধকার গহ্বরের আরও ভেতরে পিছিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তার আগেই দেখলাম আরেকবার লেজ ঝাপটা দিয়ে বাক নিচ্ছে বিশাল আকৃতিটা, উঠে যাচ্ছে খাড়াভাবে, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বাইরে বেরিয়ে থাকা চোখা পুরুষাঙ্গটা।

এদেরকে ভয়ঙ্কর হোয়াইট ডেথ শার্ক বলে, পানির নিচে। এরাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী।

অল্প বাতাস নিয়ে ডি-কমপ্রেশনের জন্যে জরুরী বিরতি সহ পানির ওপর উঠে যাওয়ার চেষ্টা করা এখনও সম্ভব, কিন্তু হোয়াইট ডেথের উপস্থিতে ঝুঁকিটা নিলে আমার মৃত্যুর জন্যে শুধু নির্বুদ্ধিতাকেই দায়ী করা হবে।

কিন্তু নিজের কথা একবারও ভাবছি না এখন, আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা রাফেলাকে নিয়ে। আমিই ওকে নিয়ে এসেছি, ওকে বাঁচাবার দায়িত্বটাও আমারই। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিতে হলেও নিতে হবে আমাকে। শুধু ওর জন্যে, তা নইলে এই ঝুঁকি নেবার কথা চিন্তা পর্যন্ত করা যায় না।

স্লেটে দ্রুত আঁচড় কেটে লিখলাম-অপেক্ষা কর! বন্দুক আর বাতাস আনার জন্যে ওপরে যাচ্ছি আমি।

মেসেজটা পড়েই দ্রুত প্রচণ্ডভাবে মাথা ঝাঁকাল রাফেলা, জরুরী ভঙ্গিতে হাত আর মুখ নেড়ে বাধা দিতে চেষ্টা করছে আমাকে। কিন্তু ইতিমধ্যে হারনেসের কুইক রিলিজ বাকল-এর পিন টেনে খুলে ফেলেছি আমি, শেষবার বুক ভরে বাতাস টানলাম, তারপর স্কুবা সেটটা ঠেলে দিলাম রাফেলার হাতে। ওয়েট-বেল্টটা ফেলে দিয়ে হালকা করে নিলাম নিজেকে, খখালের। গা ঘেঁষে ঝুপ করে নেমে গেলাম নিচের দিকে।

উল্টে পড়ে থাকা জাহাজের আড়ালে যতটা সম্ভব গা ঢাকা দিয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে এগোচ্ছি প্রবাল প্রাচীরের দিকে। পেছনে রেখে যাচ্ছি আমার জীবনের প্রথম প্রেম-রাফেলাকে। প্রাণপণ চেষ্টা করব, কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু জানি না আবার ওর কাছে ফিরে আসতে পারব কিনা। শেষ যেটুকু বাতাস ছিল তার সবটুকু রেখে যাচ্ছি ওর কাছে, সংযমের সঙ্গে খরচ করলে পাঁচ কি ছয় মিনিট সরবরাহ পাবে ও। আর আমার রয়েছে শুধু ফুসফুসের বাতাসটুকু, এইটুকুর ওপর ভরসা করে পেরোতে হবে আমাকে শত্রু এলাকা।

প্রাচীরের কাছে পৌঁছেছি আমি, উঠতে শুরু করেছি প্রবাল ঘেঁষে, আশা করছি আমার কালো রঙের স্যুটটা এর রঙের সঙ্গে মিশে যাবে, প্রবালের দিকে পেছনে ফিরে, খোলা পুলের দিকে মুখ করে রয়েছি আমি, সামনে দেখতে পাচ্ছি বিশাল আকৃতিগুলো দ্রুত বাঁক নিচ্ছে, ডাইভ দিচ্ছে, চক্কর মারছে।

বিশ ফুট উঠেছি আমি, পানির চাপ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার ফুসফুসের ভেতর ক্রমশ বাড়ছে বাতাসের প্রচণ্ড চাপ। ভেতরে চেপে রাখা সম্ভব নয়, সে-চেষ্টা করলে ফুসফুসের টিস্যুগুলো ছিঁড়ে যাবে। ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসতে দিলাম কিছু রূপালী বুদবুদকে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো একটা হোয়াইট ডেথ শার্কের চোখে পড়ে গেল।

একপাক গড়িয়ে বাঁক নিল সে, দ্রুত এবং ঘন ঘন লেজের বাড়ি মেরে তীরের মত সোজা ছুটে আসছে আমার দিকে।

মরিয়া হয়ে প্রাচীরের ওপর দিকে চোখ বুলালাম। ছয় ফুট ওপরে পচন ধরা প্রবালের গায়ে ছোট একটা গুহা দেখতে পেলাম আমি। ডাইভ দিয়ে গুহাটার ভেতর ঢুকেছি, সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক স্নান রঙের মত আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেল হাঙ্গরটা, বাক নিল, তারপর পিছু হটে আমি আরও পেছনে সরে যাবার আগেই আবার স্যাৎ করে ছুটে গেল গুহার সামনে দিয়ে। অন্ধকারের ভেতর আমাকে দেখতে না পেয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল সে, পাক খেয়ে ছুটল ঝরা পাতার মত ডিগবাজি খেতে খেতে নেমে আসা একটা মরা স্ন্যাপারের দিকে, গপ করে মুখে পুরে নিয়ে ছোট্ট একটা ঢোক গিলে চালান করে দিল সেটা ভেতর দিকে।

বাতাস থেকে অক্সিজেন হজম করে নিয়ে আমার ফুসফুস। দুটো লাফাচ্ছে এখন। রক্তে কার্বন-ডাইঅক্সাইড তৈরি হচ্ছে। অ্যানোক্সিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছি আমি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। গুহার নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এলাম, প্রাচীর ঘেঁষে একটা মাত্র সুইমিং ফিনের সাহায্যে আবার উঠতে শুরু করেছি ওপর। দিকে।

ওঠার সময় ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে আবার রূপালী বুদবুদ ছাড়ছি, জানি আমার শিরাগুলোতেও নাইট্রোজেন সাংঘাতিক দ্রুত চাপমুক্ত হচ্ছে, একটু পরই জিনিসটা গ্যাসে পরিণত হয়ে বুদবুদ সৃষ্টি করবে রক্তে। মাথার ওপর পানির সিলিংটাকে ধাবমান আয়নার। মত দেখাচ্ছে, তার গায়ে ঝুলছে চুরুট আকৃতির হোয়েলবোটটা। দ্রুত উঠছি আমি, মাঝখানের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। নিচের দিকে তাকালাম আবার। আমার কাছ থেকে অনেক নিচে এখনও দেখতে পাচ্ছি হাঙ্গরের ঝকগুলো বাঁক নিচ্ছে, ডাইভ দিচ্ছে, পাক খাচ্ছে, ছুটছে দ্রুতগতিতে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে ফাঁকি দিতে। পেরেছি আমি ওদের চোখকে।

তীব্র ব্যথা শুরু হয়েছে আমার ফুসফুসে, মাথার খুলিতে বাড়ি মারছে রক্তের চাপ। এই সময় সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রাচীরের আশ্রয় ছেড়ে খোলা পানিতে বেরিয়ে হোয়েলবোটের দিকে যাত্রা শুরুর সময় হয়েছে আমার।

প্রাচীরের গায়ে পায়ের ধাক্কা মেরে হোয়েলবোটের দিকে রওনা দিলাম আমি। রীফ-এর কাছ থেকে একশো গজ দূরে। ওটা। অর্ধেক দূরত্ব নির্বিগ্নে পেরিয়ে এসে নিচের দিকে তাকালাম একবার। যা দেখলাম তার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম আমি তবু লাফিয়ে উঠল কলজেটা।

একটা হোয়াইট ডেথ শার্ক দেখতে পেয়েছে আমাকে। এখনও ধাওয়া করতে শুরু করেনি। কিন্তু পাক খেয়ে বাঁক নেবার ভঙ্গির মধ্যে বিদ্যুৎগতি ব্যস্ততা লক্ষ করেই বুঝে নিলাম কপালে কি আছে আমার। যা ভেবেছি তাই। প্রচণ্ড বেগে আমার দিকে ছুটে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু।

নীল গভীরতা থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এভাবে ওকে ছুটে আসতে দেখলে অন্য কোন পরিবেশে বিস্ময়ে হতভম্ব, স্থির পাথর হয়ে যেতাম আমি। এক্ষেত্রে ঠিক উল্টো প্রতিক্রিয়া হল আমার। আতঙ্ক নতুন শক্তি যুগিয়ে দিল আমাকে, আরও দ্রুত উঠে যাচ্ছি আমি হোয়েলবোট লক্ষ করে।

তাকিয়ে আছি নিচের দিকে। এগিয়ে আসতে দেখছি শার্কটাকে। আমার দিকে যত এগিয়ে আসছে ততই বাড়ছে ওর আকার। ওর শরীরের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য জ্বলজ্বল করছে আমার চোখে। মুখের সামনেটা শূয়রের মত, সেখানে লম্বা দুটো ফাটল দেখা যাচ্ছে-ও-দুটো নাকের ফুটো। চোখ দুটো সোনালী, কিন্তু মণি দুটো কালো, তীর-চিত্রে মাথার মত দেখতে। চওড়া নীল পিঠ, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ভীতিকর ডরসাল ফিনের ফলাটা।

নিচ থেকে পানির গা ছুঁড়ে বেরিয়ে এলাম-এত দ্রুত যে আমার কোমর পর্যন্ত উঠে এসেছে শূন্যে। বাতাসে পাক খেয়ে ঘুরে গিয়েই হাত চালালাম। বোটের শক্ত গানেলের গায়ে বাড়ি খেল হাতটা। আঙুলগুলো বাকা করে ধরে ফেলেছি গানেল। সবটুকু শক্তি দিয়ে সামনের দিকে টেনে আনলাম শরীরটা। পা দুটো গুটিয়ে তুলে ফেললাম আমার চিবুকের নিচে।

ঠিক সেই মুহূর্তে আঘাত হানল হোয়াইট ডেথ।

আমার চারদিকের পানি বিস্ফোরিত হল, পানি ভেদ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল সে। ধাক্কাটা অনুভব করলাম-কর্কশ, খরখরে চামড়ার সঙ্গে আমার পায়ের স্যুট ঘষা খেয়ে ছিঁড়ে গেল। তারপরই হোয়েলবোটের খোলের গায়ে ধাক্কা খেল সে, প্রচণ্ড সংঘর্ষে নিমেষে একদিকে কাত হয়ে গেল বোটটা।

ঝাঁকি খেয়ে দুলছে হোয়েলবোট, চমকে উঠে হতভম্ব হয়ে গেছে রডরিক আর ল্যাম্পনি। বিদ্যুৎগতিতে শরীরটা টেনে গুটিয়ে। নিয়েছিলাম, কিন্তু শার্কটাও দিক বদলে নিতে পেরেছিল শেষ। মুহূর্তে। একটুর জন্যে ব্যর্থ হয়েছে সে, ধাক্কা খেয়েছে খোলের সঙ্গে।

এখন আরেকটা মরিয়া চেষ্টায় পা ছুঁড়ে আর লাফ দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে গানেল টপকালাম আমি, হোয়েলবোটের তলায়। দড়াম করে পড়ে গেলাম।

ওখানে শুয়ে হাঁপাচ্ছি, প্রিয় মিষ্টি বাতাস গিলে ফুসফুসের তীব্র। ব্যথা দূর করছি। হালকা তুলোর মত লাগছে মাথাটা, কড়া মদের নেশার চেয়েও বেশি আচ্ছন্নতা বোধে আক্রান্ত হয়েছি আমি।

একটা চিৎকার ঢুকছে আমার কানে। গলাটা চিনতে পারছি। রডরিকের। চারদিক থেকে ভেসে আসছে তার বিকট চিৎকার আমার দুই কানে।

মিস রাফেলা কোথায়? ওই শার্কটা মিস রাফেলাকে ধরেছে?

গড়িয়ে চিৎ হলাম আমি, অস্বাভাবিক দ্রুত বাতাস টানতে গিয়ে হাঁপাচ্ছি আর ফোঁপাচ্ছি।

স্পেয়ার লাঙস! এক নিঃশ্বাসে বললাম আমি। নিচে, গানপোর্টে মারা যাচ্ছে রাফেলা। ওর বাতাস দরকার।

লাফ দিয়ে বোতে পড়ল রডরিক, হ্যাঁচকা টানে ক্যানভাস শীটটা সরিয়ে দুই হাত দিয়ে ধরল অতিরিক্ত স্কুবা সেটটা।

ল্যাম্পনি! হুঙ্কার ছাড়ল সে, জনি পিল বের কর! একটা মার্কিন স্পাের্টস গুডস ক্যাটালগ দেখে এই কপার অ্যাসিটেট পিল আনিয়ে রেখেছি আমি, বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে শার্ক তাড়াবার জন্যে এর নাকি জুড়ি নেই। এখনও যাচাই করা হয়নি এর কার্যকারিতা। রডরিকের কাছ থেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই জোটেনি এর কপালে। দেখা যাক, বলল রডরিক, জিনিসটা কোন কম্মের কিনা।

মাতালের মত টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম আমি, ওকে বললাম, সমস্যা শুধু ওকে নিয়ে নয়, রডরিক। বড় সাহেব গিজগিজ করছে পুলে, তাদের সঙ্গে নিচে বড় লাট রয়েছে দুজন। তাদের একজনই ধাওয়া করেছিল আমাকে।

নতুন সেটে ডিমাণ্ড ভালভ ফিট করছে রডরিক। তুমি সোজা উঠে এসেছ, মাসুদ?

মাথা ঝাঁকালাম আমি। আমার বটল দুটো রাফেলাকে দিয়ে এসেছি। গানপোর্টে অপেক্ষা করছে ও।

তুমি পঙ্গু হতে শুরু করবে, মাসুদ? মুখ তুলে আমার চোখে তাকাল রডরিক, ওর চেহারায় উদ্বেগ লক্ষ করছি আমি।

আবার আমি মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ, রডরিক, এলোমেলো ভাবে পা ফেলে এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম আমার ট্যাকল বক্সটার কাছে ঢাকনি তুলে ভেতরে তাকালাম। এক্ষুনি আবার তাড়াতাড়ি নেমে যেতে হবে আমাকে-বুদবুদ সৃষ্টি হবার আগেই আবার চাপ ফেলতে হবে রক্তে। এক্সপ্লোসিভ হেড-এর বাণ্ডিলটা তুলে নিলাম বাক্স থেকে।

একটা দশ ফুট স্টেইনলেস স্টীল স্পিয়ারের শ্যাফটের সঙ্গে স্কু দিয়ে আটকাবার ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিটি হেডের। স্ট্রাপ দিয়ে বাণ্ডিলটা উরুর সঙ্গে বেঁধে নিচ্ছি দ্রুত। মোট বারোটা হেড, ভাবছি, আরও থাকলে ভাল হত। প্রতিটি হেড-এর এক্সপ্লোসিভ চার্জ একটা বারো-গজ শটগান শেলের সমান। হাতলের একটা ট্রিগার দিয়ে চার্জটা ফায়ার করতে পারব আমি। হাঙ্গর মারার ভাল একটা অস্ত্র এটা।

স্কুবা সেটের একটা আমার পিঠে হারনেস দিয়ে বেঁধে দিল রডরিক। আমার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসেছে ল্যাম্পনি, জনি পিলের ফুটো করা প্লাস্টিক কনটেইনারগুলো বেঁধে দিচ্ছে আমার গোড়ালিতে।

আরেকটা ওয়েট-বেল্ট দরকার আমার, বললাম ওদেরকে। একটা ফিনও ফেলে রেখে এসেছি নিচে। অতিরিক্ত একটা সেট। আছে…

কথা শেষ করতে পারলাম না। আমার বাম হাতের কনুইয়ে আগুন-ধরা প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলাম। নিজের অজান্তে তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল আমার গলা থেকে, হাতটা নিজে থেকেই কনুইয়ের কাছে ভাঁজ হয়ে গেল, ছেড়ে দেয়া স্প্রিংয়ের মত ঝন্টু করে উঠে এসে বাড়ি মারল আমার বুকে। রক্তের ভেতর দিয়ে এগিয়ে বুদবুদগুলো নার্ভ আর গ্রন্থিতে গুতো মারতে শুরু করেছে।

মাসুদ মচকে যাচ্ছে! একটা হাহাকার ধ্বনি বেরিয়ে এল রডরিকের গলা থেকে। সুইট মেরি, মাসুদ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে! লাফ দিল ও। মোটরের কাছে গিয়ে পড়ল। প্রবাল প্রাচীরের দিকে তাক করল বোট। একটা ঝাঁকি খেয়ে ছুটতে শুরু করল। সেটা। তাড়াতাড়ি সার, ল্যাম্পনি, চেঁচিয়ে বলল সে, এক্ষুনি। ওকে পানিতে নামিয়ে দিতে হবে।

তীব্র, অসহ্য ব্যথাটা আঘাত করল আবার, এবার আমার ডান পায়ে। কিছু ধরে তাল সামলাবার সময়ও পেলাম না আমি, অকস্মাৎ ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটুটা, হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম দুর্বল শিশুর মত। এগিয়ে এসে আমার কোমরে দ্রুত বেঁধে দিচ্ছে ল্যাম্পনি ওয়েট বেল্টটা। আমার অসাড়, পঙ্গু পায়ে সুইমিং ফিনটা ঢুকিয়ে দিল ও।

রীফের কাছাকাছি এসে মোটর বন্ধ করল রডরিক। ছুটে গলুইয়ে আমার কাছে চলে এল সে। হাঁটু মুড়ে বসল আমার সামনে। মাউথপীসটা আমার ঠোঁটের মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে এয়ার বটলের ছিপি খুলে দিল দ্রুত।

ঠিক আছে, মাসুদ? বাতাস টেনে বুক ভরে নিলাম আমি,। ওর প্রশ্নের উত্তরে মাথা ঝাঁকালাম একবার।

হামাগুড়ি দিয়ে বোটের কিনারায় চলে গেল রডরিক।

পাঁচ সেকেণ্ড নড়ল না ও। পুলের পানি পরীক্ষা করছে। ঠিক আছে, মাসুদ, আশ্বাসের সুরে জানাল আমাকে, বড় লাট জনি অন্য কোনদিকে চলে গেছে।

হালকা একটা বস্তার মত দুহাত দিয়ে আমাকে শূন্যে তুলে নিল রডরিক। তারপর ধীরে ধীরে বোট আর প্রবাল প্রাচীরের মাঝখানের পানিতে নামিয়ে দিল।

আমার বেল্টের সঙ্গে অতিরিক্ত স্কুবা সেটটা আটকে দিল ল্যাম্পনি, তারপর আমার হাতে ধরিয়ে দিল দশ ফুট লম্বা স্পিয়ার গানটা। ভাবছি, হাত থেকে এটা ফেলে না দিই!

মিস রাফেলাকে ওখান থেকে তুলে আনতে হবে-তোমার মনে আছে, মাসুদ? বলল রডরিক।

একটা মাত্র পা ছুঁড়ে পানির নিচে ডুব দিলাম আমি।

পেশী আর হাড়ের সংযোগে প্রচণ্ড ব্যথা সত্ত্বেও পানিতে ডুব দিয়ে সবচেয়ে আগে ভয়ে ভয়ে খুঁজছি হোয়াইট ডেথের বিশাল উড়ন্ত আকৃতিটাকে। একটাকে দেখতে পেলাম আমি, কিন্তু অনেক নিচে সেটা, এক ঝাঁক আলবাকোর হাঙ্গরের মাঝখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

প্রাচীরের আশ্রয় ঘেঁষে একটা পা ছুঁড়ে দিগভ্রান্ত একটা জলজ পোকার মত নেমে যাচ্ছি আমি। ত্রিশ ফুট নামার পর একটু একটু করে কমতে শুরু করল ব্যথা। পানির চাপে রক্তপ্রবাহে গজিয়ে ওঠা বুদবুদগুলো আকারে ছোট হয়ে আসছে। হাত এবং পায়ের সাড়া পাচ্ছি এখন, কাজে লাগাতে পারছি ওগুলো।

আরাম পেয়ে স্বস্তির পরশ অনুভব করছি শরীরে, হতাশার জায়গায় নতুন উৎসাহ আর আশায় ভরে উঠেছে বুক, আগের চেয়ে অনেক দ্রুত নেমে আসছি আমি। প্রচুর বাতাস রয়েছে সঙ্গে, অস্ত্র রয়েছে। অন্তত লড়ার একটা সুযোগ পাব আমি এখন।

নব্বই ফুট নিচে নেমে এসেছি আমি, এখানে সেখানে দেখতে পাচ্ছি পুলের তলার কিছু কিছু অংশ। ধোঁয়াটে নীল গভীরতা থেকে উঠে আসতে দেখছি রাফেলার বুদবুদগুলোকে, ও এখনও বাতাস পাচ্ছে বুঝতে পেরে পুলক অনুভব করলাম শরীরে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই বাতাস শেষ হয়ে যাবে ওর, কিন্তু পুরো। চার্জ করা নতুন এক সেট স্কুবা রয়েছে আমার সঙ্গে। আমাকে শুধু। এটা নিয়ে ওর কাছে পৌঁছতে হবে।

দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছি, এই সময় একটা আলবাকোর শার্ক দেখে ফেলল আমাকে। এদিকেই আসছিল, আমাকে দেখে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন তার শরীরে। অনেক দূর থেকে আসছে, ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে আকুতিটা। ইতিমধ্যেই কয়েক মন মাছ খেয়ে বেঢপভাবে ফুলিয়ে নিয়েছে পেটটা, কিন্তু সীমাহীন খিদে তাতে। মেটেনি। চওড়া লেজ দিয়ে পেডাল করে, ভীতিকর নিঃশব্দ হাসিমুখে তীরবেগে ছুটে আসছে আমার দিকে।

পিছিয়ে এলাম দ্রুত। পানিতে স্থির ভাবে ভাসছি। আমার ঠিক পেছনেই রয়েছে প্রাচীরের গা। শার্কের দিকে মুখ করে রয়েছি আমি, কিন্তু এখন আর আগের মত ভয়ে মরে যাচ্ছি না। এক্সপ্লোসিভ হেড পরানো স্পিয়ারটা বাড়িয়ে দিয়েছি সামনের দিকে। ধীরে ধীরে ফিন দিয়ে পেডাল করে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে রেখেছি, আমার চারদিকে ঘন মেঘের মত ছড়িয়ে পড়ছে। শার্ক তাড়াবার পিল থেকে উজ্জ্বল নীল রঙের ডাই।

কাছে চলে এসেছে আলবাকোর। ওর মুখে আঘাত করার জন্যে তাক করে ধরেছি স্পিয়ারটা। কিন্তু নীল ডাইয়ের মেঘের গায়ে মাথা আর নাকের ছোঁয়া লাগতেই চোখের পলকে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল সেটা, ভয় আর হতাশায় ঘন ঘন লেজের বাড়ি মেরে দিক বদলাচ্ছে। নাকের ফুটো, চোখ আর মুখ পুড়ে গেছে ওর কপার অ্যাসিটেট লেগে। চমকে গিয়ে আধপাক ঘুরে পিটটান দিল ও।

পিলগুলো সাংঘাতিক কাজ দেয়, বুঝতে পেরে খুশি হয়ে উঠল মনটা। আবার আমি দ্রুত নিচের দিকে নেমে যেতে শুরু করেছি। বাঁশ-বাগানের মাথার ওপর পৌঁছে গেছি। ত্রিশ ফুট নিচে

দেখতে পাচ্ছি রাফেলাকে। গানপোর্টের মুখে অপেক্ষা করছে। আমার জন্য। মুখ তুলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নিজের এয়ার বটল শেষ করে আমার দুটো ব্যবহার করছে এখন। কিন্তু বুদবুদের প্রচুর উত্থান দেখে বুঝতে পারছি আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড বাতাস পাবে ও, তারপরই নিঃশেষ হয়ে যাবে সব বাতাস।

প্রবাল প্রাচীরের আশ্রয় ছেড়ে এবার ওর দিকে এগোচ্ছি আমি। আমাকে উদ্দেশ্য করে পাগলের মত হাত নাড়ছে ও, দেখে হুঁশ হল আমার। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই লম্বা নীল টর্পেডোর মত হোয়াইট ডেথকে আমার দিকে তেড়ে আসতে দেখলাম আমি।

বাঁশ-ঝাড়ের উঁচু মাথা ঘুরে আসছে বড়লাট, চোয়ালের এক কোণে আটকে রয়েছে দেড় হাত লম্বা একটা থেঁতলানো মাছ, সম্ভবত কোন আলবাকোর হাঙ্গরের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাকে আরও সুস্বাদু খোরাক মনে করে ছুটে আসছে সে, মাছটাকে গিলে নেবার অবসর পায়নি। আমাকে পেটে ঢোকাতে হলে মুখের পথটা পরিষ্কার করা দরকার, সম্ভবত সে-কথা ভেবেই প্রকাণ্ড মুখটা খুলল সে, এক ঢোকে গিলে নিল মাছটাকে, সাপের ছড়ানো ফণার মত ধবধবে সাদা দাঁতের সারি দেখতে পেলাম আমি।

ওর দিকে মুখ করে তৈরি হয়ে আছি আমি। ঠিক যখন আঘাত হানতে যাচ্ছে ও, ফিন দিয়ে ঘন ঘন পেডাল করে দ্রুত পিছিয়ে আসছি আর বু ডাইয়ের ঘন স্মােক স্ক্রিন ছাড়ছি দুজনের মাঝখানে।

লেজের প্রচণ্ড কয়েকটা বাড়ি মেরে শেষ কয়েক গজ তীরবেগে পেরিয়ে এল সে। ব্লু ডাইয়ের ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠল, আমার দিক থেকে ঘুরে যাচ্ছে আরেক দিকে। কিন্তু পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাবার সময় তার লেজের একটা ভারি ঝাপটা লাগল। আমার কাঁধে। একবার, দুবার, বারবার ডিগবাজি খাচ্ছি আমি সেই ধাক্কায়। দিগভ্রান্ত অবস্থা এখন আমার। তাল সামলে নিজের চারদিকে দ্রুত তাকাচ্ছি। প্রথমেই দেখতে পেলাম আমার শত্রুকে। নাছোড়বান্দা হোয়াইট ডেথ চক্কর মারছে আমাকে ঘিরে।

চল্লিশ ফুট দূরে রয়েছে সে। আমার চারদিকে টহল দিচ্ছে। পুরো শরীরটা একটা বিশাল যুদ্ধ-জাহাজের মত লম্বা লাগছে আমার চোখে। মেঘমুক্ত আকাশের মত গাঢ় নীল দেখাচ্ছে ওর গায়ের রঙ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার যে এই দানবরা এটার চেয়ে দ্বীগুণ বড় হয় আকারে। সেই ধাড়ীগুলোর তুলনায়। এটা এখনও শিশু-সেজন্য ধন্যবাদ দিলাম আমার ভাগ্যকে।

সরু স্টীল স্পিয়ারের ওপর এত যে ভরসা করেছিলাম, হঠাৎ সেটাকে ফালতু একটা খেলনা বলে মনে হচ্ছে আমার। হাঙ্গরটার ঠাণ্ডা হলুদ চোখে ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি আমি, চোখ গরম করে দেখছে আমাকে সে। মাঝে মাঝে মোটা পাপড়ি নেড়ে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে চোখ টিপছে আমাকে। চোয়ালের আড়ষ্টতা কাটাবার ভঙ্গিতে প্রকাণ্ড মুখটা খুলল একবার, আমার মাংসের স্বাদ কেমন হবে ভেবে যেন নিঃশব্দে হাসছে।

বিরতি নেই, সেই একই দূরত্বে, একই গতিতে, আমাকে। মাঝখানে রেখে চক্কর মারছে সে। ওর সঙ্গে ঘুরে যাচ্ছি আমি, ওর। অনায়াস সাবলীল গতির সঙ্গে তাল রাখার জন্য উন্মত্তের মত। পেডাল করছি ফিন দিয়ে।

ঘুরছি, এই ফাঁকে বেল্ট থেকে স্পেয়ার লাঙটা খুলে আমার বা কাঁধের হারনেসের সঙ্গে আটকে নিলাম। স্পিয়ারের হাতলটা বগলের নিচে শক্ত ভাবে এঁটে বসিয়ে নিয়েছি, মাথার দিকটা তাক করে রেখেছি উড়ন্ত দানবটার দিকে। নিঃসন্দেহে জানি, ওর যা। সাইজ, তাতে মুখে এক্সপ্লোসিভ স্পিয়ার দিয়ে আঘাত করলে ওকে শুধু খেপিয়ে তোলাই হবে, মারাত্মক ভাবে আহত করা বা ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। সুফল পেতে হলে ওর ব্রেনে আঘাত করতে হবে আমাকে।

প্রচণ্ড রাগ আর খিদে অস্থির করে তুলেছে ওকে। ব্লু ডাইয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা হয় ভুলে গেছে ও, নয়ত গ্রাহ্য করছে না। আঘাত করার জন্যে তৈরি হয়েছে ও, মুহূর্তটা স্পষ্ট চিনতে পারলাম আমি। লেজটা যেন শক্ত হয়ে গেল ওর, সেটা দিয়ে এক দফায় কয়েকটা প্রবল ঝাপটা মারল।

আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে, বুকের সঙ্গে সেঁটে ধরে রেখেছি স্কুবা সেটটা। অকস্মাৎ এক ঝটকায় এবং চোখের পলকে দিক বদল করল হাঙ্গরটা, চওড়া বৃত্ত ভেঙে সোজা ছুটে আসছে আমার দিকে।

মুখটা খুলে যাচ্ছে ওর, দুই চোয়ালের মাঝখানে মস্ত একটা গহ্বর দেখতে পাচ্ছি, চ্যাপ্টা আর ছুঁচালো ডগার দাঁত সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যখন লাগতে যাচ্ছে আঘাতটা, এক সেকেণ্ড বাকি থাকতে, স্কুবার জোড়া স্টীল বটল সামনের দিকে ঠেলে দিলাম আমি, ঢুকিয়ে দিলাম গহ্বরটার ভেতর।

সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল দুটো বন্ধ করল হাঙ্গরটা, বটল জোড়া আমার হাত থেকে ছুটে গেল, প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে একপাশে ছিটকে পড়লাম স্রোতে পড়া গাছের পাতার মত।

আবার যখন তাল সামলে নিজের চারদিকে তাকাচ্ছি, বিশ ফুট দূরে দেখতে পেলাম হাঙ্গরটাকে। ধীর গতিতে এগোচ্ছে, কিন্তু ইস্পাতের বটল দুটোকে নিয়ে সাংঘাতিক ব্যস্ত সে। বাচ্চা কুকুর যেভাবে স্যাণ্ডেল চিবায়, ঠিক সেইভাবে বটল জোড়ার ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছে বড়লাট।

কামড়ে জোর পাওয়ার জন্যে মাথা ঝাঁকাচ্ছে হাঙ্গরটা, এর এক একটা ঝাঁকিতে মাংসের বড় বড় টুকরো ছিঁড়ে নিতে অভ্যস্ত সে, কিন্তু এক্ষেত্রে তার বদলে রঙ করা ধাতব বোতলে গভীর দাগ তৈরি হচ্ছে শুধু।

সুযোগটা দেখতে পাচ্ছি আমি, এটাই আমার শেষ এবং একমাত্র সুযোগ। দ্রুত পেডাল করে ধূমকেতুর মত ওর চওড়া। নীল পিঠের ওপর উঠে এলাম, ওর দিকে নামতে শুরু করে ঘষা খেলাম লম্বা ডরসাল ফিনের সঙ্গে। পেছনের উঁচু আকাশ থেকে একটা হানাদার ফাইটার প্লেনের মত যেখানে ওর দৃষ্টি চলে না সেখানে নেমে যাচ্ছি।

নাগালের মধ্যে এসেই স্টীল স্পিয়ারের এক্সপ্লোসিভ হেডের ডগাটা ওর ঢেউখেলানো নীল খুলিতে চেপে ধরলাম শক্ত করে, ঠাণ্ডা এবং ভীতিকর হলুদ দুই চোখের ঠিক মাঝখানে। স্পিয়ারের হাতলে স্পিঙ বসানো ট্রিগারে আঙুল পেঁচিয়ে রেখেছি আগেই, এখন সেটা টেনে দিলাম শুধু।

কড়াক শব্দে কানের পর্দা কেঁপে উঠল আমার, মুঠোর ভেতর জোর একটা ঝাঁকি খেল স্পিয়ারটা। চমকে ওঠা বন্য ঘোড়ার মত পেছন দিকে লাফ দিল হাঙ্গরটা। ভাগ্য ভাল যে বিশাল শরীরের। সঙ্গে হালকাভাবে মৃদু একটু ধাক্কা খেলাম আমি, তবু তাতেই ছিটকে পড়লাম দূরে, ডিগবাজি খেলাম পর পর গোটা তিনেক। তাল সামলে নিতে আগের বারের চেয়ে এবার কম সময় লাগল আমার। তাকিয়ে দেখি, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে বড়লাট। বিধ্বস্ত ব্রন থেকে আক্ষেপের ঢেউ এসে মসৃণ চামড়ার নিচের পেশীগুলোকে মোচড় খাওয়াচ্ছে। গুটিয়ে যাচ্ছে তাল তাল মাংস, ফুলে ফেঁপে উঁচু ঢিপির মত আকার নিচ্ছে, পর মুহূর্তে থরথর করে কেঁপে উঠে সমান হয়ে যাচ্ছে শরীরের সঙ্গে। সেই সঙ্গে গোটা শরীর দুমড়ে মুচড়ে, বেঁকেচুরে যাচ্ছে।

দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করেছে এবার সে, ডাইভ দিয়ে নেমে। যাচ্ছে নিচের দিকে, বন বন করে ঘুরছে লম্বা শরীরটা। তীরবেগে। সোজা ছুটে গিয়ে পুলের পাথুরে মেঝেতে ধাক্কা খেল সংঘর্ষে প্রচণ্ডভাবে থেঁতলে গেল মুখটা। ড্রপ খেল, ঝুঁকির সঙ্গে উঠে এল খানিকটা, তারপর অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে কাত হতে শুরু করল।

লেজের ওপর ভর দিয়ে রয়েছে হাঙ্গরটা এখন। একটা মস্ত স্তম্ভ যেন। স্তম্ভটা ছোট ছোট লাফ দিয়ে দ্রুত এবং ঘন ঘন জায়গা বদল করে যাচ্ছে অবিরাম।

সসম্মান দূরত্ব রেখে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। স্কু খুলে বিস্ফোরিত হেডটা ফেলে দিয়ে তার জায়গায় তাজা হেড ফিট করে নিয়েছি স্পিয়ারে।

হোয়াইট ডেথের দুই চোয়ালের মাঝখানে রাফেলার জোড়া এয়ার বটল দুটো আটকে রয়েছে এখনও। ওটা আমি হারাতে পারি না। দৃষ্টি দিয়ে এখনও ওর অনিশ্চিত, চঞ্চল গতি অনুসরণ করে যাচ্ছি আমি। অবশেষে এক জায়গায় স্থির হল ও। নাক ঠেকে আছে পুলের শক্ত মেঝেতে, খাড়া হয়ে ভাসছে চওড়া লেজের সাহায্যে। ধীর, সতর্ক ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছি ওর দিকে আমি। ওর খুলিতে আরেকবার ঠেকালাম স্পিয়ারের ডগাটা।

কড়াক করে শব্দ হতেই লাফ দিয়ে পিছিয়ে এলাম আমি, ভয়ে ঢোক গিললাম একবার। কিন্তু হাঙ্গরটা নিজে থেকে নড়ছে না আর বিস্ফোরণের ধাক্কায় একবার শুধু ঝাঁকি খেয়েছে শরীরটা। কিন্তু এরপর সেটা আর খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকছে না। মন্থর গতিতে ঘুরছে, আর কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে পুলের মেঝেতে। এগিয়ে গিয়ে দুহাত দিয়ে স্কুবাটা ধরে টান মারলাম। কর্কশ কয়েকটা ধাতব শব্দ করে গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল সেটা।

সঙ্গে সঙ্গে সেটটা পরীক্ষা করলাম আমি। এয়ার হোসগুলো ফুটো হয়ে গেছে কয়েক জায়গায়, গভীর কামড়ের দাগ ছাড়া তেমন কোন ক্ষতি হয়নি বটল জোড়ার।

রাফেলা, রাফেলা-ওর নাম জপছি মনে মনে, দ্রুত উঠছি বাঁশঝাড়ের মাথার দিকে।

ওপর থেকে কোন বুদবুদ দেখতে পাচ্ছি না। বুকটা ধড়াস করে উঠল। বাঁশঝাড়ের মাথার গর্ত দিয়ে নামার সময় দেখতে। পাচ্ছি রাফেলাকে। শেষ স্কুবা সেটটাও খালি হয়ে গেছে ওর, খুলে ফেলে দিয়েছে সেটা ও। বাতাস নেই, বাতাস নিচ্ছে না-ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে রাফেলা।

একটু একটু করে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবার মত এই রকম বিপদেও মাথা ঠিক রেখেছে ও, পানির ওপর উঠে যাবার আত্মহত্যাপ্রবণ চেষ্টা করছে না। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ও। মারা যাচ্ছে, কিন্তু বিশ্বাস হারায়নি আমার ওপর।

রাফেলার পাশে এসে থামলাম আমি, আমার নিজের মাউথপিসটা খুলে দিলাম। শ্লথ হয়ে গেছে ওর নড়াচড়া, শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত-মাউথপিসটা ধরল, কিন্তু ধরে রাখতে পারল না, পিছলে বেরিয়ে এল হাত থেকে। ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে সেটা, এঁকেবেঁকে বেরিয়ে আসছে বাতাস। খপ করে ধরে ফেলে টেনে নামিয়ে আনলাম সেটাকে রাফেলার মুখের কাছে, পরিয়ে দিলাম দ্রুত।

বাতাস টানতে শুরু করেছে ও। বুকটা উঠছে আর পড়ছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শক্তি আর আশা ফিরে পেল ও। সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে এলাম আমি। খালি একটা সেট থেকে ডিমাণ্ড ভালভ খুলে নিলাম। ক্ষতিগ্রস্ত সেটের ডিমাণ্ড ভালভের সঙ্গে বদল করলাম এটা। রাফেলার পিঠে বেঁধে দেবার আগে আধ মিনিট বাতাস টানলাম নতুন চার্জ করা সেটটা থেকে। তারপর ওর কাছ থেকে ফিরিয়ে নিলাম আমার মাউথপিস।

পানির নিচে যেটা না থাকলেই নয় সেই বাতাস রয়েছে এখন আমাদের কাছে। দীর্ঘ বিরতি নিয়ে উঠে যাবার জন্যে যথেষ্ট। রাফেলার চোখে চোখ রেখে অভয় দিয়ে হাসলাম আমি। ম্লান একটু হাসি দেখলাম ওর ঠোঁটের কোণে। স্পিয়ার থেকে বিস্ফোরিত হেডটা ফেলে দিয়ে তাজা হেড ফিট করে নিলাম আমি। তারপর আবার একবার গানপোর্টের নিরাপদ আশ্রয় থেকে উঁকি দিয়ে তাকালাম পুলের খোলা পানির দিকে।

বেশির ভাগ মরা আর অচেতন মাছ চালান হয়ে গেছে। হাঙ্গরদের পেটে, ঝাঁক বেঁধে ফিরে গেছে হাঙ্গররাও। রক্তঘোলা পানিতে বড়সড় দুএকটা আকৃতি দেখা যাচ্ছে শুধু, সাংঘাতিক লোভী ওরা, এখনও পানিতে তোলপাড় তুলে খোরাক খুঁজছে। তবে চলাফেরার ভঙ্গিতে আলসেমি ফুটে রয়েছে ওদের। রাফেলাকে নিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা এখনই করা যেতে পারে।

রাফেলার একটা হাত ধরলাম আমি, একটু চাপ দিয়ে অভয় দিলাম ওকে। মৃদু চাপ দিয়ে সাড়া দিল ও। ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম গানপোর্ট থেকে।

বাঁশ-বনের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দ্রুত চলে এলাম আমরা প্রবাল প্রাচীরের কাছে।

প্রাচীরের দিকে পেছন ফিরে পরস্পরের হাত ধরে পাশাপাশি রয়েছি আমরা, ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছি পুলের ওপর দিকে।

আলোর রেশ আরেকটু যেন বাড়ল। এক সময় মুখ তুলে ওপর দিকে তাকালাম আমি। ওপরে, অনেক উঁচুতে চুরুটের মত একটা আকৃতি অস্পষ্টভাবে, ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি। উৎসাহ এবং সাহস বেড়ে গেল আমার। চিনতে পারছি হোয়েলবোটটাকে।

ষাট ফুটের মাথায় ডি কমপ্রেশনের জন্যে থামলাম আমরা। একটা পেটমোটা আলবাকোর শার্ক আমাদের পাশ কেটে সাতরে গেল, কিন্তু নজর দিল না এদিকে-দূরে ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, স্পিয়ারটা নামিয়ে নিলাম আমি।

দূরত্ব চল্লিশ ফুট থাকতে দ্বিতীয়বার ডি-কমপ্রেশনের জন্যে থামলাম। ঝাড়া দুই মিনিটের বিরতি এখানে। আমাদের রক্তের নাইট্রোজেনকে ফুসফুসের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে ক্রমশ বেরিয়ে যেতে দিচ্ছি। এরপর রওনা হলাম বিশ ফুট দূরত্বে পরবর্তী বিরতিতে থামার জন্যে।

উঁকি দিয়ে রাফেলার ফেস-মাস্কের ভেতর তাকালাম একবার, আমাকে উদ্দেশ্য করে চোখের মণি দুটো একপাক ঘোরাল ও, হাসল। সাহস এবং শক্তি দুটোই ফিরে পেয়েছে ও ইতিমধ্যে। সবকিছু ঠিকঠাক মত চলছে এখন। প্রচুর বাতাস রয়েছে আমাদের সঙ্গে। হোয়েলবোট বেশি দূরের ব্যাপার নয় আর। ধারে কাছে কোন বিপদও দেখতে পাচ্ছি না। বলা যায় প্রায় বাড়িতে পৌঁছে গেছি, চুমুক দিচ্ছি চায়ের কাপে-আর মাত্র বারো মিনিটের ব্যাপার।

হোয়েলবোটটাকে এত কাছে দেখাচ্ছে, আমি যেন স্পিয়ারটা দিয়ে ছুঁতে পারি ওটাকে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি রডরিক আর ল্যাম্পনির দুটো মুখ কিনারা থেকে ঝুঁকে পড়েছে, কখন আমরা পানির গা ছুঁড়ে উঠব তার জন্যে অধীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছে।

ওদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে আরেকবার সতর্কতার। সঙ্গে নিজেদের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি আমি। আমার দৃষ্টিসীমার সর্বশেষ প্রান্তে, যেখানে ঘোলা আর ঝাপসা পানি নিচ্ছিদ্র গাঢ় নীলে পরিণত হয়েছে, কি যেন নড়তে দেখলাম আমি। সন্দেহের একটা ছায়াও হতে পারে, ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হল আসাযাওয়া করছে ছায়াটা…চোখের ভুল হলে তা কেন মনে হবে? পরিষ্কার নয় এখনও কিছু, তবু ভয়ে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল আমার।

পানিতে স্থিরভাবে ঝুলছি। সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠেছি আরেকবার। খুঁজছি, বুঝতে চাইছি-আর ওদিকে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। সেকেণ্ড আর মিনিটগুলো।

আবার চলে গেল ছায়াটা, এবার পরিষ্কার দেখা দিয়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে এক নজর দেখতে পেলাম, কিন্তু অসম্ভব দ্রুত গতি। আর আকৃতির আভাস লক্ষ করে বুঝতে পারলাম ওটা আলবাকোর শার্ক নয়। ক্যাম্পফায়ারের চারদিকে ছায়ায় টহলরত একটা হায়েনার আকৃতি আর আক্রমণোদ্যত একটা সিংহের আকৃতির মধ্যে যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়, এক্ষেত্রেও সে ধরনের পার্থক্য দেখতে পেয়েছি আমি।

অকস্মাৎ পানির ধোঁয়াটে নীল পর্দা ভেদ করে বেরিয়ে এল দুনাম্বার হোয়াইট ডেথ শার্ক। সে এল ঝড়ের বেগে আর নিঃশব্দে, পঞ্চাশ ফুট দূর দিয়ে চলে গেল, যেন আমাদেরকে দেখেও গুরুত্ব দিতে চাইছে না। যেতে যেতে প্রায় আমাদের দৃষ্টিসীমার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেল, মনে হল এই বুঝি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা মাত্র ঝটকায় আধপাক ঘুরেই ফিরে আসতে শুরু করল তীরবেগে আগের পথ ধরে। এই একই ভঙ্গিতে বারবার যাওয়া আসা করছে খাঁচায় বন্দী বাঘের মত।

ভয় পেয়ে আমার গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেল রাফেলা। কয়েকবার হাত ঝাড়া দিতেও মুঠো আলগা করল না ও। ওর দিকে তাকিয়ে মাথা কঁকালাম আমি। এবার ছেড়ে দিল আমার হাত।

পায়চারি করছে যেন হোয়াইট ডেথ। পরের বার ফেরার সময় সে তার আসা-যাওয়ার গতিপথ বদল করল, বিরাট একটা বৃত্ত রচনা করে ছুটছে এখন, চক্কর মারতে শুরু করেছে আমাদেরকে মাঝখানে রেখে। লক্ষণ খারাপ। আক্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি এটা তার। এরপর আর একবার মাত্র দিক বদল করবে সে।

ঘুরছে তো ঘুরছেই, চক্কর মারার মধ্যে কোন বিরাম নেই। সারাক্ষণ হলুদ, ক্ষুধার্ত চোখ দুটো দিয়ে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।

আচমকা অন্য একটা বিষয় দৃষ্টি কেড়ে নিল আমার। ওপর থেকে ধীর গতিতে নামছে কি সব। কাছে নেমে এল সেগুলো, এবার চিনতে পারলাম। জনি পিলের প্লাস্টিক কনটেইনার, ডজনখানেকের কম হবে না। আমাদের বিপদ আঁচ করতে পেরে রডরিক নিশ্চয়ই পুরো বাক্সটা উল্টে দিয়েছে কিনারা থেকে। নাগালের মধ্যে দিয়ে নেমে যাচ্ছে একটা, হাত বাড়িয়ে খপ করে। ধরলাম সেটা, গুঁজে দিলাম রাফেলার হাতে।

হু হু করে নীল ডাই ছাড়ছে ওটা রাফেলার হাত থেকে। আবার আমি পুরোপুরি মনোযোগ দিলাম হোয়াইট ডেথের দিকে। বু ডাই দেখতে পেয়ে একটু ঘাবড়ে গেছে হাঙ্গরটা, সতর্ক হয়ে একটু কমিয়ে এনেছে গতি, কিন্তু এখনও মাঝখানে আমাদেরকে রেখে চক্কর দিয়ে চলেছে সে, মুখ ভরা নিঃশব্দ হাসি নিয়ে তাকিয়ে। আছে আমাদের দিকে।

দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম রিস্টওয়াচে। আরও তিন মিনিট বিরতি নিলে তারপর ওপরে ওঠা নিরাপদ হবে। তবে আমার আগে রাফেলাকে ওপরে পাঠাবার ঝুঁকিটা আমি নিতে। পারি। ওর রক্তে এখনও একবারও বুদবুদ সৃষ্টি হয়নি সুতরাং আর এক মিনিট বিরতি নিয়ে ওপরে উঠে গেলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না ওর।

এইবার একটু একটু করে বৃত্তটাকে ছোট করে আনছে হোয়াইট ডেথ। এত কাছে ও, এত বেশি কাছে যে ওর চোখের কালো ছুঁচালো মণি দুটোর গভীরতা দেখতে পাচ্ছি আমি, পড়তে পারছি কুৎসিত মতলবটা।

দ্রুত আরেকবার চোখ বুলালাম রিস্টওয়াচে। এক মিনিট পেরোয়নি এখনও, কিন্তু আর দেরি না করে রাফেলাকে ওপরে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ওর কাঁধে চাপড় মেরে ওপরের। দিকে জরুরী ভঙ্গিতে ইঙ্গিত করলাম আমি।

ইতস্তত করছে রাফেলা। তর্জনী খাড়া করে ওপর দিকটা দেখালাম ওকে আবার। নির্দেশটা মেনে নিল ও। উঠতে শুরু করল ওপর দিকে।

ঠিক যেভাবে উচিত, ধীর গতিতে উঠে যাচ্ছে রাফেলা। কিন্তু ওর ঝুলন্ত পা দুটো পানিতে বাড়ি মারছে আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে। আমাকে অগ্রাহ্য করে রাফেলার সঙ্গে একই ভাবে ধীর গতিতে উঠে যাচ্ছে হাঙ্গরটাও।

ওদের দুজনেরই নিচে এখন আমি। দ্রুত পেডাল করে একপাশে সরে যাচ্ছি, এই সময় দেখতে পেলাম হোয়াইট ডেথের লেজে শক্ত একটা ভাব এসে গেছে। আক্রমণের পুর্ব-লক্ষণ এটা।

হোয়াইট ডেথের ঠিক নিচে পৌঁছেছি, কিন্তু দম ফেলার ফুরসত পেলাম না, দেখলাম রাফেলাকে আঘাত হানার জন্যে ঘুরে যাচ্ছে সে। উন্মত্তের মত পা ছুঁড়ে আরও একটু উঠে এলাম আমি। নরম তুলতুলে গলায় স্পিয়ার হেডটা ঢুকে যেতেই চাপ দিলাম ট্রিগারে।

দেখতে পেলাম ঝাঁকি খেল ওর গলার সাদা মাংস, পলকের জন্যে একটা ফাটল দেখতে পেলাম সেখানে আমি। লেজের কয়েকটা বিদ্যুৎগতি বাড়ি মেরে অকস্মাৎ পিছিয়ে গেল সে, প্রায় খাড়াভাবে রকেটের মত উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। পানির গা ছুঁড়ে শূন্যে বেরিয়ে গেল তার সম্পূর্ণ শরীর, পর মুহূর্তে দড়াম করে আছড়ে পড়ল ফেনা আর বুদবুদের উঁচু বেদীর ওপর।

প্রচণ্ড উত্তেজনা আর উদ্বেগে আমার মাথার খুলি ফেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি রাফেলা তার মাথা ঠাণ্ডা রেখে অলস ভঙ্গিতে উঠে যাচ্ছে হোয়েলবোটের দিকে। পানির গা ফুড়ে নেমে এল বিশাল দুটো কালো থাবা রাফেলাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে।

পানিতে ফিরে এসেই লাটিমের মত দ্রুত পাক খেতে শুরু করেছে হাঙ্গরটা, সেই সঙ্গে আবার বৃত্ত রচনা করে ঘুরছে। চারদিকে। ঝক ঝক মৌমাছি ছেকে ধরেছে যেন তাকে, তীব্র যন্ত্রণায় আর আক্রোশে উন্মাদ হয়ে গেছে। বারবার চোয়াল দুটো খুলছে আর ঝপ করে বন্ধ করে ফেলছে সে।

কালো দুই থাবার নাগালে পৌঁছে যাচ্ছে রাফেলা। মোটা কলার মত আঙুলগুলো রাফেলার আঙুলের ফাঁকে ঢুকে গেল, ইস্পাতের হুকের মত সেগুলো আটকে নিয়ে বিস্ময়কর শক্তির এক টানে পানি থেকে তুলে নিল ওকে।

এখন শুধু আমাকে নিয়ে সমস্যা। আরও কয়েক মিনিট পানিতে থাকতে হবে আমাকে। তারপর রাফেলাকে অনুসরণ করে বোটে উঠে যাবার চেষ্টা করতে হবে। বিস্ফোরণের ধাক্কাটা কাটিয়ে। উঠছে হাঙ্গরটা। এখন আর সে লাটিমের মত পাক খাওয়াচ্ছে না নিজের শরীরটাকে। কিন্তু বৃত্ত ধরে চক্কর মারার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে আরও।

প্রতিটি চক্করের সঙ্গে বৃত্তটাকে ছোট করে আনছে সে।

পরবর্তী এক মিনিটে তিনবার রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। ডিকমপ্রেশনের জন্যে যথেষ্ট বিরতি নেয়া শেষ করেছি, এখন পানির ওপর উঠে গেলে আমার কোন ক্ষতি হবে না।

সামান্য একটু উঠলাম আমি। হাঙ্গরটার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে থামলাম। শরীর মচকাবার তীব্র যন্ত্রণা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার। আর যাই করি, দ্রুত ওপরে উঠে যেতে রাজি নই আমি। ধীরে ধীরে উঠছি।

কিন্তু আরও কাছে, কাছ থেকে আরও কাছে সরে আসছে। হোয়াইট ডেথ।

হোয়েলবোটের দশ ফুট নিচে আরেকবার থামলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ করল হাঙ্গরটা, খানিক আগে গলার কাছে। ভীতিকর বিস্ফোরণের কথা মনে পড়ে গেছে তার। চক্কর মারা বন্ধ। করে স্নান পানিতে চুপচাপ স্থির পাথর হয়ে গেছে সে, পেকটোরাল। ফিনের চওড়া ছুঁচালো ডানার ওপর ভর দিয়ে ঝুলছে পানিতে।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। নিঃশব্দে। দুজনের মাঝখানে পনেরো ফুট ব্যবধান। কারও চোখে পলক নেই কয়েক সেকেণ্ড।

কিন্তু পরিষ্কার অনুভব করছি, প্রকাও নীল পশুটা চূড়ান্ত আঘাত করার জন্যে তৈরি হতে শুরু করেছে।

স্পিয়ার ধরা হাতটা যতদূর সম্ভব বাড়িয়ে দিলাম আমি ওর দিকে। হালকা ভাবে পেডাল করছি ফিন জোড়া দিয়ে। ধীর গতিতে এগোচ্ছি ওর দিকে। ভয়ে কাঁপছে বুক, হার্টবিট বেড়ে গেছে আমার। কিন্তু নিজেকে এই বলে ভরসা দিচ্ছি, এখন যদি তেড়েও আসে ও, ওর দিকে তাক করা স্পিয়ারের ডগার সঙ্গে ধাক্কাটা খাবে আগে। আরেকবার আহত হবে।

কিন্তু তাকিয়ে আছে শুধু, তেড়ে আসছে না। এমন আশ্চর্যভাবে স্থির হয়ে আছে, যেন চোখ মেলে ঘুমাচ্ছে ও। ওর মুখের নিচে নাকের লম্বা ফাটলের এক ইঞ্চির মধ্যে পৌঁছে গেছে স্পিয়ারের মাথায় পরানো এক্সপ্লোসিভ হেড।

ট্রিগার টিপে দিলাম আমি।

বিস্ফোরণের কড়াক শব্দে কানের পর্দা নড়ে উঠল আমার। চমকে উঠে পিছিয়ে যাচ্ছে হোয়াইট ডেথ, একটা গড়ান দিয়ে উন্মত্ত গতিতে বাঁক নিতে শুরু করেছে। স্পিয়ারটা ফেলে দিয়েই প্রাণপণে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছি আমি।

আহত সিংহের মত খেপে উঠেছে হোয়াইট ডেথ, আঘাতগুলোর তীব্র যন্ত্রণা তাড়া করছে ওকে। প্রকাণ্ড একটা নীল পাহাড়ের মত পিঠ নিয়ে আর বিশাল গুহার মত মুখটা হাঁ করে ধাওয়া করেছে আমাকে সে। জানি, এবার ওকে কোনভাবে ফেরানো যাবে না।

আমার মাথার ওপর কালো দুটো বিশাল থাবা দেখতে পাচ্ছি। কি যে ভাল লাগল রডরিককে! ডান হাতটা মাথার ওপর তুলে দিলাম ওর একটা থাবার দিকে। আর মাত্র কয়েক ফুট দূরে হাঙ্গরটা, তীরবেগে এই শেষ দূরত্বটুকু পেরিয়ে আসছে সে। অনুভব করছি আমার কব্জিতে পেঁচিয়ে যাচ্ছে রডরিকের লোহার মত আঙুলগুলো। টান আমাকে! আমার সমস্ত অস্তিত্ব নিঃশব্দ আবেদনে কেঁপে উঠল।

পরমুহূর্তে আমার চারদিকে বিস্ফোরিত হল পানি। হাতে প্রচণ্ড একটা টান অনুভব করলাম আমি, একই সঙ্গে হাঙ্গরটা পানি। দুফাঁক করে আমার কাছে পৌঁছে গেল। পানিতে প্রচণ্ড একটা আলোড়ন উঠল, কিন্তু সেই আলোড়নের ধাক্কাটা পুরোপুরি অনুভব করার আগেই দেখলাম হোয়েলবোটের ডেকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছি আমি-হোয়াইট ডেথের খোলা চোয়ালের ভেতর থেকে। ছিনিয়ে এনেছে আমাকে রডরিক।

তোমার খুব নেওটা ওরা, মাসুদ, তিক্ত, ঝাঁঝালো গলায় বলল রডরিক, চমৎকার পোষ মানিয়েছ!

মাথা তুলে দ্রুত চারদিকে তাকালাম রাফেলার খোজে। ভিজে, রক্তশূন্য মুখে স্টার্নে বসে আছে ও। ঠিক আছ তুমি, রাফেলা? জানতে চাইলাম আমি।

কথা বলতে পারল না, একদিকে শুধু একটু কাত করল। মাথাটা।

উঠে দাঁড়ালাম আমি। হারনেসের রিলিজ পিন খুলে স্কুবার ভারমুক্ত হচ্ছি। রডরিক, ডাক দিয়ে দ্রুত বললাম ওকে, জেলিগনাইটের একটা স্টিক রেডি কর-তাড়াতাড়ি।

মাস্ক আর ফিন খুলে ফেলে হোয়েলবোটের কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে পুলের দিকে তাকালাম আমি। এখনও আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করেনি বড়লাট। আক্রোশে আর হতাশায় উন্মাদ হয়ে গেছে। সে, হোয়েলবোটকে মাঝখানে রেখে চক্কর মারছে অবিরাম। পানির গা ভেদ করে তুলে দিয়েছে সে তার ডরসাল ফিনের সবটুকু দৈর্ঘ্য। আমি জানি, ইচ্ছে করলেই তো মেরে শূন্যে তুলে দিতে পারে সে হোয়েলবোটটাকে, সে শক্তি তার আছে।

ওকে তাড়াও! রানা, যেভাবে পার ওকে বিদায় কর! কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রাফেলা।

ভয় নেই, তাড়াচ্ছি, আশ্বাস দিলাম রাফেলাকে।

হোয়াইট ডেথের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি আমি, কিন্তু তার আগে কিছু একটা দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে ওকে, যাতে আমি তৈরি হবার আগেই আক্রমণ করে না বসে।

ল্যাম্পনি, মোরে ঈল আর একটা বেইট-নাইফ দাও আমাকে, চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।

ঠাণ্ডা, পিচ্ছিল ঈলের ধড়টা ল্যাম্পনির হাত থেকে নিলাম। প্রায় দশ পাউণ্ড ওজনের এক টুকরো মাংস কেটে ছুঁড়ে দিলাম পুলের পানিতে। বাঁক নিয়ে চোখের পলকে ছুটে এল টুকরোটার দিকে হোয়াইট ডেথ, গতি এতটুকু মন্থর না করে খোলা চোয়ালের ভেতর ঢুকিয়ে নিল সেটা। হোয়েলবোটের খোলের সঙ্গে ঘষা খেল পাশ কেটে বেরিয়ে যাবার সময়। টালমাটাল অবস্থা হল বোটের। আমরা সবাই ঝাঁকি খেলাম।

তাড়াতাড়ি কর, রডরিক, চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। মাংসের আরেকটা টুকরো ছুঁড়ে দিলাম হাঙ্গরটাকে। পানিতে সেটা পড়তে পড়তে খপ করে মুখে পুরে নিল সে। এবার পিঠ নিচু করে বেরিয়ে গেল খোলের নিচ দিয়ে-কিন্তু আবার ধাক্কা লাগল, প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠল বোট। টলে উঠলাম আমরা, আর তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার বেরিয়ে এল রাফেলার গলা থেকে। ডাইভ দিয়ে পড়ল ও, বোটের গানেল ধরে ঝাকুনি সামলাচ্ছে।

রেডি, বলল রডরিক।

ঈলের দুই ফুট লম্বা একটুকরো মাংস দিলাম রডরিককে আমি, টুকরোটার সঙ্গে ব্যাগের মত ঝুলছে নাড়িভুড়ির একটা অংশ। স্টিকটা ভরো এর ভেতর, রডরিককে বললাম। তারপর মুড়ে বেঁধে দাও।

নিঃশব্দে হাসতে শুরু করেছে রডরিক। খুব পছন্দ হয়েছে প্ল্যানটা আমার, মাসুদ, জানাল সে।

পানির দানবটাকে মাংসের টুকরো দিয়ে ভুলিয়ে রাখছি আমি, ওদিকে আরেক টুকরো মাংসের ভেতর জেলিগনাইট ঢুকিয়ে নিখুঁত একটা প্যাকেট তৈরি করছে রডরিক। ইনসুলেটেড তামার তার বেরিয়ে এসেছে ওটার ভেতর থেকে। প্যাকেটটা আমার হাতে তুলে দিল রডরিক।

তারের এক ডজন লুপ তৈরি করলাম আমার বাঁ হাতে, রডরিককে বললাম, জুড়ে দাও এবার।

এক মুহূর্ত পর রডরিক জানাল, রেডি আমি। নিঃশব্দে হাসছে ও।

মাংস আর এক্সপ্লোসিভের প্যাকেটটা হোয়াইট ডেথের চক্কর মারার পথের ওপর ছুঁড়ে দিলাম আমি। গতি বেড়ে গেল হাঙ্গরটার, নীল চকচকে চওড়া পিঠটা ভেসে উঠল পানির ওপর। চোয়াল দুটো খুলে যাচ্ছে। পরমুহূর্তে প্যাকেটটা সেঁধিয়ে গেল উন্মুক্ত গহ্বরের ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে বোটের কিনারা থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে শুরু করল তামার তার। রীল থেকে আরও কিছুটা ছাড়াচ্ছি আমি।

গিলে নিতে দাও, পরামর্শ দিলাম আমি রডরিককে। পেটের ভেতর পৌঁছুতে দাও।

মস্ত ঘাড় নেড়ে সায় দিল রডরিক।

পাঁচ সেকেণ্ড পর আবার বললাম, ঠিক আছে, রডরিক, এবার। বিদায় কর বড়লাটকে।

ফিন তুলে পানির ওপর ভেসে উঠছে হোয়াইট ডেথ। দিক বদলে আবার চক্কর মারা শুরু করতে যাচ্ছে, আধখানা চাদের মত। মুখের কোণে দেখা যাচ্ছে তামার তার।

সুইচ টিপে দিল রডরিক। হাঙ্গরটার পেটটা লাল একটা তরমুজের মত বিস্ফোরিত হল। স্তম্ভের আকৃতি নিয়ে খাড়া হয়ে গেল রক্তাক্ত মাংসের কণাগুলো, পানি থেকে শূন্যে পঞ্চাশ ফুট পর্যন্ত সোজা উঠে গিয়ে ছড়িয়ে যেতে শুরু করল চারদিকে। বৃষ্টির মত ঝম ঝম করে নেমে এল রক্ত আর মাংস পুলের পানিতে। হোয়েলবোটেও আছড়ে পড়ল কিছুটা।

ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া হাঙ্গরের খোলসটা পানির ওপর ঝুঁকি খাচ্ছে, তারপর গড়িয়ে চিত হয়ে গিয়ে ডুবে যেতে শুরু করল।

গুড বাই, বড়লাট জনি আপটেইল, উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। ল্যাম্পনি। আর পানির দিকে তাকিয়ে কদাকার, বীভৎস করে তুলল রডরিক তার বিকট চেহারাটাকে-হাসি আসছে।

চল, ফেরা যাক এবার, বললাম আমি, সামুদ্রিক ঢেউ এরই মধ্যে রীফ টপকাতে শুরু করে দিয়েছে। ভয় হচ্ছে, একটু অন্যমনস্ক হলেই হোয়েলবোট থেকে ছিটকে পড়ে যাব আমি পানিতে।

সাফ-সুতরো হয়ে নিজেদের গুহায় বসে আমরা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছি, এই সময় মৃদু গলায় বলল রাফেলা, আমার প্রাণ রক্ষার জন্যে তোমাকে আমার ধন্যবাদ দেয়া উচিত…।

না, ডারলিং, তার কোন দরকার নেই। কতটুকু কৃতজ্ঞ তুমি কাজে দেখাও।

সানন্দে রাজি হল রাফেলা। আধ ঘন্টার মধ্যেই কৃতজ্ঞ করে ফেলল আমাকে ও।

গানফায়ারের রীফকে ভয় করতে শুরু করেছে রডরিক আর ল্যাম্পনি। সামুদ্রিক ভূত আর পেত্নীদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওদের বিশ্বাস এত বেশি দৃঢ় যে ব্যর্থ হব জেনে ওদের সে-বিশ্বাস কখনও আমি ভাঙার চেষ্টা করিনি।

আমাদেরকে একের পর এক দুর্ঘটনা আর মন্দ ভাগ্যের শিকার হতে দেখে রাফেলাও কেমন যেন ঘাবড়ে গেছে, রডরিক আর ল্যাম্পনির প্ররোচনায় সে-ও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। অলৌকিক শক্তির ওপর। ওদের ধারণা, গান ফায়ার রীফ একটা অভিশপ্ত জায়গা।

আমার কি মনে হয়, জানো? হাসির সঙ্গে কথাটা বলছে বটে রাফেলা, কিন্তু এর সবটাই কৌতুক নয়। মনে হয়, নিহত মুঘল রাজকুমাররা গুপ্তধনের পিছু নিয়ে গান ফায়ার রীফে চলে এসেছে, নিজেদের ধন-সম্পদ পাহারা দিচ্ছে ওরা… রোদ ঝলমলে এই। উজ্জ্বল সকালেও ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল রডরিক আর ল্যাম্পনির। বড়লাট জনি আপটেইল জোড়া, গতকাল যাদেরকে মেরেছি আমরা, জানো কারা ওরা? ওরাই সেই নিহত মুঘল রাজকুমার, ছদ্মবেশ নিয়ে ওদের আত্মারা হাঙ্গর সেজে ছিল…

রডরিকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পচা এক ডজন বালিহাঁস দিয়ে নাস্তা করেছে সে। দ্রুত ক্রস চিহ্ন আঁকল নিজের বুকে।

মিস রাফেলা, অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে বলল ল্যাম্পনি, দয়া করে এ-ধরনের অশুভ কথা আপনি আর মুখে আনবেন না।

আনবেন না! ল্যাম্পনিকে সমর্থন করে বলল রডরিক।

আরে, তোমরা ব্যাপারটা এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন! আমি তো ঠাট্টা করছিলাম, প্রতিবাদের সুরে বলল রাফেলা।

এ-ধরনের ঠাট্টা দয়া করে আর কখনও করবেন না। আমরা ভূত পেত্নী-এই সব বিশ্বাস করি, শুধু তাই নয়, ওদেরকে সম্মান দিই, শ্রদ্ধা করি।

তাই নাকি! রাফেলা আহত হয়েছে, তাই একটু বিদ্রুপের সুরে বলল কথাটা।

আপনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এসব আপনি বিশ্বাস করেন না, বলল ল্যাম্পনি। বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমরা। জানি, ওরা আছে। আমাকে একটা পেত্নী একবার…

ধাক্কা দিয়ে একটা কবরের ভেতর ফেলে দিয়েছিল, ল্যাম্পনির হয়ে কথাটা শেষ করলাম আমি। গল্পটা জানা আছে আমার। ল্যাম্পনি আর রডরিকের মুখে অমন একশোবার এ গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার ধারণা, অন্ধকারে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল ও কবরটার ভেতর।

আর রডরিকের পেছনে প্রায় এ বছর ধরে লেগেছিল একটা। ভূত সুযোগ পেলেই সে…

রডরিকের বুকে পেচ্ছাব করে দিত, এবারও ল্যাম্পনির হয়ে কথাটা শেষ করলাম আমি। এ-গল্পটাও ওদের মুখ থেকে শুনতে হয়েছে আমাকে। রডরিক যখন বছরের মধ্যে দশ মাস মদ খেয়েল্যাম্পনির ভাষায় গরুর লাদার মত-পড়ে থাকত, তখনকার ঘটনা এটা। নেশা ভাঙার পর প্রায়ই নাকি এই ভূতের প্রস্রাব আবিষ্কার করত সে তার বুকে-শার্টটা ভিজে সপসপে হয়ে থাকত, আর সে কি দুর্গন্ধ! আমার ধারণা, মদ খেয়ে বেহুঁশ অবস্থায় বমি করে শার্টটা ভিজিয়ে রাখত রডরিক।

যাই হোক, চ্যানেল ধরে এগোবার পথে আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হল না। ওরা তিনজনেই অস্বাভাবিক গম্ভীর।

অবশেষ রীফের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছুলাম আমরা। হোয়েলবোটটাকে পুলের এক জায়গায় স্থির করল রডরিক।

বোতে বসে আছি আমি। ওরা তিনজন একসঙ্গে মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। ওদের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে মনে মনে হাসলাম আমি, বুঝলাম তিনজনই আতঙ্কিত হয়ে ভাবছে কাকে সঙ্গে নিয়ে পানির নিচে নামতে চাইব আমি আজ। গতকালকের ঘটনা দগদগে ঘায়ের মত জ্বলজ্বল করছে ওদের স্মৃতিতে।

আমি একাই নামছি, বললাম ওদেরকে। স্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে বসল তিনজনই।

আমি না হয় যাই তোমার সঙ্গে, স্রেফ ভদ্রতার খাতিরে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল রাফেলা।

পরে, বললাম ওকে। প্রথমে আমি দেখে আসি হাঙ্গর আছে কিনা। যে-সব জিনিস ফেলে রেখে এসেছি কাল, সেগুলোও নিয়ে আসব আমি।

অত্যন্ত সাবধানে নামলাম। বোটের নিচে ঝুলে থাকলাম পাঁচ মিনিট, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছি পুলের গভীর প্রদেশ পর্যন্ত ভীতিকর বিশাল আকৃতি-গুলোর কোন আভাস পাওয়া যায় কিনা। রাতের জোয়ার এসে পানি বদলে দিয়েছে পুলের, আগের পানির সঙ্গে ভেসে গেছে মরা মাছের সব রক্ত আর মাংস কণা। স্পিয়ার, খালি স্কুবা সেট, নষ্ট ডিমাণ্ড ভাল নিয়ে পানির ওপর ফিরে এলাম আমি। পুলে হাঙ্গর নেই শুনে আজ এই প্রথম হাসল আমার ক্রুরা।

ওদেরকে উৎসাহিত করার জন্যে বললাম, ঠিক আছে, আজই আমরা হোন্ডটা ভাঙতে যাচ্ছি।

তুমি খোলের ভেতর দিয়ে ঢুকতে চাও, মাসুদ? জানতে চাইল রডরিক।

খোল ভাঙতে হলে এক জোড়া প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে, বললাম আমি। তা আমি চাই না। প্যাসেঞ্জার ডেক দিয়ে হোল্ডের কুয়ায় ঢুকতে চাই। সহজে ওদেরকে বোঝাবার জন্যে ব্যাখ্যা করার সঙ্গে সঙ্গে স্লেটে একটা নকশা আঁকছি আমি। জাহাজটা উল্টে গেছে, তার মানে জায়গা বদল করেছে তার কার্গো। ওই বাল্কহেডের ঠিক পেছনে গাদা হয়ে আছে সব। এখানটায় যদি ফাটল সৃষ্টি করতে পারি, এক এক করে সব কার্গো কম্প্যানিয়নওয়ে দিয়ে টেনে আনতে পারব আমরা।

ওখান থেকে গানপোর্ট অনেক জটিল আর দুরের পথ, মাথায় সী ক্যাপ তুলে ন্যাড়া গম্বুজটা চিন্তিত ভঙ্গিতে চুলকাচ্ছে রডরিক।

গানপোর্ট আর গানডেক মইয়ের কাছে দুটো কপিকল তৈরি করে নেয়া যায়।

মেলা কাজ, বিষন্ন দেখাচ্ছে রডরিককে।

ঠিক, বললাম আমি। তাই হোল্ডে ঢোকার পথ হয়ে গেলে তোমাকে দরকার হবে ওখানে আমার। রাফেলার দিকে তাকালাম আমি। এক্সপ্লোসিভ সেট করার কাজে সাহায্য দরকার আমার, তোমাকে নিয়ে যেতে চাই আমি।

আসলে গতকালের ভয়টা থেকে বের করে আনতে চাই ওকে আমি। কুয়ার দেয়াল ভেঙে আজ আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাব। বিস্ফোরণের পরপরই পানিতে নামতে যাবার মত ভুল আর আমরা করছি না। রাতের মধ্যে মরা মাছ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে জোয়ারের স্রোত। কাল আবার ফিরে আসব আমরা।

নিঃশব্দে মাথা কাত করে রাজি হল রাফেলা।

পানিতে নেমে গানপোর্ট দিয়ে ভোরের আলোর ভেতর ঢুকলাম আমরা। প্রথমবার এসে নাইলন লাইন বেঁধে রেখে গিয়েছিলাম, সেটাই আমাদেরকে গাইড করে গানডেক, সেখান থেকে কম্প্যানিয়ন ল্যাডার ধরে প্যাসেঞ্জার ডেক, তারপর টানেলের ভেতর দিয়ে ফরওয়ার্ড হোল্ডের বেঢপ ভাবে ফুলে থাকা বাল্কহেডের সামনে নিয়ে এল।

বাল্কহেডের কোণে এবং মাঝখানে ছয়টা হাফস্টিক জেলিগনাইট পেরেক দিয়ে আটকালাম আমি। রাফেলা টর্চের আলো ফেলে সাহায্য করল আমাকে।

হোয়েলবোটে ফিরে এসে আমরা যখন স্কুবা গিয়ার খুলছি, এই সময় বিস্ফোরণ ঘটাল রডরিক। বিস্ফোণের ধাক্কাটা জাহাজের খোলই বেশিরভাগ হজম করে নিল, পানির ওপর ক্ষীণ একটা স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই টের পেলাম না আমরা।

তখুনি পুল ত্যাগ করলাম আমরা। সামনে একটা অলস দিন, তাই দেখে খুব খুশি রাফেলা। আবার আগামীকাল ফিরব আমরা, ইতিমধ্যে আজকের মরা মাছগুলোকে জোয়ারের স্রোত এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

বিকেলে আমি আর রাফেলা দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে এলাম পিকনিক করতে। এক ঝুড়ি ভর্তি খাবারদাবার নিয়ে এসেছি আমরা, তার সঙ্গে রয়েছে এক বোতল স্কচ হুইস্কি আর এক বোতল শ্যাম্পেন। এসবের সঙ্গে যোগ হল বালি খুঁড়ে বের করা বড় আকারের স্যাণ্ড ক্ল্যাম। এগুলো জলজ লতাপাতা দিয়ে মুড়ে আবার আমি বালিতে পুঁতে রাখলাম, তার ওপর কাঠ জড়ো করে একটা আগুন জ্বালল রাফেলা।

সূর্য নেমে এল দিগন্তরেখার ওপর। ওদিকে মুখে তোলার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে ক্ল্যামগুলোও। শ্যাম্পেন, খাবার, অস্তগামী সূর্যের টকটকে লাল আভা আর ঠাণ্ডা বাতাস নরম একটা প্রতিক্রিয়া ঘটাল রাফেলার ওপর। ওর চোখে এসে বাসা বাঁধল ঝলমলে স্বপ্নেরা, গায়ের সোনা রঙ গলতে শুরু করেছে। আর। আকাশ থেকে লালিমার শেষ রেশটুকু মুছে নিয়ে সূর্য পথ করে দিল ইয়া বড় এক মানসপ্রিয়া চঁাদকে।

সমস্ত বিশ্ব চরাচর মুগ্ধ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। কি বিশাল আকাশ! সেখানে এরই মধ্যে অনন্তের পথে চোখ জ্বেলে রওনা হয়েছে তারার দল। আর মাটির পৃথিবীতে আমরা দুজন দুজনের হাতে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে অপলক তাকিয়ে আছি, বুকে জ্বলছে নির্বাক অনন্ত প্রেম। কিছু বলতে চাইল রাফেলা, কিন্তু সন্ধ্যার কোমল সৌন্দর্য বিহ্বল করে ফেলেছে ওকে, গলা বুজে গেছে ওর। আর আমি, এই মহান সৌন্দর্যের অপার মহিমা এক বিন্দু নষ্ট করতে চাই না বলে কথা বলার কোন চেষ্টাই করলাম না।

প্রকৃতির অমিয় সুধা আকণ্ঠ পান করে নেশাগ্রস্ত মাতালের মত উঠে দাঁড়ালাম আমরা, খালি পায়ে ভিজে বালির ওপর দিয়ে হেঁটে ফিরে আসছি হাত ধরাধরি করে ক্যাম্পের দিকে। সৌজন্যের সঙ্গে আমাদেরকে পথ দেখাচ্ছে হলুদ চাঁদটা।

.

পরদিন সকালেই পুলে পৌঁছুলাম আমরা। হোয়েলবোট থেকে কপিকল সরঞ্জাম নামালাম রডরিক আর আমি। গানডেকে সেগুলো রেখে খোলের ভেতর ঢুকলাম আমরা।

কুয়ার বাইরের গায়ে ফিট করা বিস্ফোরক ডেকিং আর প্যাসেঞ্জার কেবিনের বাল্কহেডগুলো ধসিয়ে দিয়েছে, লম্বা। প্যাসেজটার চারভাগের এক ভাগ চাপা পড়ে গেছে তাতে।

রডরিককে কপিকল তৈরির কাজে লাগিয়ে দিয়ে ভেসে চলে এলাম আমি সবচেয়ে কাছের কেবিনটায়। বিধ্বস্ত, ফাটল ধরা প্যানেলিংগুলো দেখে নিলাম টর্চের আলো ফেলে। আর সব জায়গার মত কেবিনের ভেতরেও মোটা জলজ উদ্ভিদের পিচ্ছিল স্তর জমেছে, তবে এর নিচে সাধারণ ফার্নিচারের আকারগুলো চিনতে পারছি আমি।

ডেক অর্থাৎ মেঝেতে হাজারটা জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এখানে সেখানে থামছি আমি, এটা সেটা তুলে পরীক্ষা করছি। চীনামাটির ভাঙা প্লেট রূপোর তৈরি মল, চুলের কাটা, কসমেটিক পট, সেন্ট বটল, ছোটখাট ধাতব জিনিস, এবং ভাঁজ করা মসৃণ কাদা যেগুলো এককালে কাপড় ছিল-এই সব দেখার ফাঁকে রিস্টওয়াচে টর্চের আলো ফেললাম আমি। ওপরে ওঠার সময় হয়েছে আমাদের, এয়ার বটল বদলাতে হবে। ঘুরতে যাচ্ছি, এই সময় চারকোণা একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার। টর্চের আলো ফেলে এগিয়ে গেলাম সেটার দিকে। কাদা আর শ্যাওলার স্তর সরিয়ে হাতে তুলে নিলাম জিনিসটা। কাঠের একটা বাক্স। আকারে পোর্টেবল ট্রানজিসটার রেডিওর চেয়ে বড় নয়। কিন্তু ঢাকনাটা মাদার-অব-পার্ল আর টরটয়েজ শেল দিয়ে সুন্দর কারুকাজ করা। বাক্সটা বগলদাবা করে বেরিয়ে এলাম আমি। কপিকল তৈরি শেষ করে গানডেক মইয়ের পাশে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে রডরিক।

হোয়েলবোটের পাশে ভেসে উঠে বাক্সটা ধরিয়ে দিলাম আমি ল্যাম্পনির হাতে।

একেবারে খালি হাতে ফিরে আসনি, সেজন্যে ধন্যবাদ! একটু বিদ্রুপের সুরে কথাটা বলে আমাদের জন্যে কফি তৈরি করতে বসল রাফেলা।

নতুন স্কুবা বলে আমাদের জন্যে ডিমাণ্ড ভালভ চার্জ করছে। ল্যাম্পনি, একটা চুরুট ধরিয়ে বাক্সটা নিয়ে বসলাম আমি।

সময় আর লোনা পানি বাক্সটার ক্ষতি করতে কিছু বাকি রাখেনি। ওপরের ছাল পচে কাদা হয়ে গেছে। রোজউডে চিড় ধরেছে, তালা আর আঙটা ক্ষয়ে গেছে অর্ধেক।

গলুইয়ে আমার পাশে এসে বসল রাফেলা, সাগ্রহে তাকিয়ে আছে বাক্সটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল ও, বলল, কি বল তো এটা? লেডিস জুয়েল বক্স। খোল, রানা। দেখি কি আছে ভেতরে।

তালার ভেতর একটা স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে চাপ দিতেই আঙটা খুলে গেল, লাফিয়ে উঠে ঢাকনিটা চলে গেল পেছন দিকে।

ওমা! চোখ দুটো বিস্ফারিত করে বিস্মিত আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল রাফেলা। তার হাতটাই সবার আগে ঢুকে গেল বাক্সের ভেতর, প্রকাণ্ড একটা লকেট সহ মোটা চেইন তুলে নিয়ে বেরিয়ে এল হাতটা। কম করেও আট ভরি সোনার ওটা।

বাক্সের ভেতর সবাই এখন হাত ভরছে। সোনা আর নীলা পাথর দিয়ে তৈরি কানের একজোড়া দুল বের করে আনল। ল্যাম্পনি, সেটা তার পুরানো তামার ইয়াররিঙ জোড়াকে কান থেকে হটিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করল। ওদিকে প্রায় এক পাউণ্ড ওজনের একজোড়া ব্রেসলেট আর দশ ভরি ওজনের একটা নেকলেস নিয়েছে রডরিক, নেকলেসটা গলায় পরে হাসছে সে।

আমার বেগমকে মানাবে এটা, মন্তব্য করল সে।

উচ্চ-মধ্যবিত্ত কোন এক গৃহিণীর ব্যক্তিগত গহনাগাটির বাক্স এটা, কোন অলঙ্কারই খুব একটা বেশি দামী নয়, কিন্তু সংগ্রহের। সংখ্যা এবং প্রত্যেকটির নির্মাণ সৌন্দর্য অতুলনীয়। বলাই বাহুল্য, বেশিরভাগ অলঙ্কার দখল করে নিল মিস রাফেলা, তবে ওদের কাড়াকাড়ি থেকে সাদামাঠা একটা সোনার ওয়েডিং ব্যাণ্ড কোনরকমে ছিনিয়ে নিতে পারলাম আমি।

ওটা দিয়ে কি করবে তুমি? রুখে উঠে জানতে চাইল। রাফেলা, বাক্সের ছোট্ট একটা জিনিসও হাতছাড়া করতে রাজি নয় ও।

কি করব তা আমার মনই জানে, বললাম ওকে। তবে শেষ পর্যন্ত এটা তোমার ভাগেই পড়বে। কথাটা শেষ করে ভুরু নাচিয়ে হাসলাম আমি, কিন্তু হাসির তাৎপর্যটুকু বৃথা গেল, কারণ এরই মধ্যে আমার ওপর আগ্রহ হারিয়ে আবার বাক্সটার দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ ঢেলে দিয়েছে রাফেলা। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াচ্ছে।

রডরিকের দিকে চোখ পড়তে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। প্রকাও কালো-পাহাড়টা বাঙালী নববধূর মত গহনায় ঢাকা পড়ে গেছে। পানিতে আবার ওকে নামাতে ঝামেলা পোহাতে হল আমাকে, কিন্তু প্যাসেঞ্জার ডেকে একবার আমরা নামতেই ধ্বংস স্কুপের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে দানবের মত কাজে লেগে গেল সে।

কপিকল আর আমাদের দুজনের মিলিত শক্তি দিয়ে প্যাসেজ থেকে ধসে পড়া প্যানেলিং আর টিম্বার বাল্ক সরালাম আমরা, সব গানডেকে নিয়ে এসে একধারে জড়ো করে রাখলাম।

ফরওয়ার্ড হোল্ডের কুয়ার কাছে যখন পৌঁছুলাম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে আমাদের এয়ার সাপ্লাই। কুয়ার ভারি প্ল্যাঙ্কের দেয়াল বিস্ফোরণের ধাক্কায় ভেঙে গেছে, গর্তের ভেতর দেখা যাচ্ছে নিরেট মালপত্রের কালো আকৃতি।

পরদিন বিকেলে হোল্ডে ঢুকলাম আমরা। আশা করিনি আমাদের সামনে কাজের এতবড় একটা পাহাড় রয়েছে। হোল্ডের কার্গোগুলো লোনা পানিতে একশো বছরের বেশি ডুবে রয়েছে। নব্বই ভাগ কনটেইনার পচে খসে পড়েছে, ভেতরের জিনিসগুলো কালো এবং শক্ত কাদায় পরিণত হয়েছে। এই কাদার সঙ্গে জড়িয়ে এবং গেঁথে রয়েছে লোহার কনটেইনার, ধাতব এবং পচনশীল নয় এমন সব জিনিসপত্র। এসব উদ্ধার করার জন্যে এই কাদা খুঁড়তে হবে আমাদেরকে।

কাজে হাত দিতে না দিতে দেখা দিল আরেক সমস্যা। কাদার ঢিপি একটু ছুঁলেই সঙ্গে সঙ্গে কালো রঙের জঞ্জাল মেঘের মত উঠছে পানিতে, সেই মেঘগুলোকে ভেদ করতে পারছে না। টর্চের আলো, ফলে গাঢ় অন্ধকার ঘিরে ধরছে আমাদেরকে।

বাধ্য হয়ে শুধু হাতের স্পর্শ দিয়ে কাজ করছি আমরা। অস্বস্তিকর পরিবেশ, কাজও এগোচ্ছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। কাদার ভেতর নিরেট কিছু হাতে পড়লেই সেটাকে আমরা টেনে টুনে বের করে আনছি, তারপর ঠেলেঠুলে প্যাসেজ দিয়ে নিয়ে এসে কপিকলের সাহায্যে গানডেকে নামাচ্ছি, তারপর পরীক্ষা করে দেখছি জিনিসটা কি আনলাম। ভেতরের জিনিস বের করার জন্যে কখনও আমাদেরকে কন্টেইনারের বাকিটুকু ভেঙে ফেলতে হচ্ছে।

পরীক্ষা করে দেখার পর যেগুলো ফালতু বা অল্প মূল্যের। সেগুলোকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি কাজের জায়গাটা পরিষ্কার রাখার জন্যে। প্রথম দিন কাজের শেষে আমরা মাত্র একটা জিনিস উদ্ধার করলাম যেটাকে হোয়েলবোটে তুলব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শক্ত কাঠের একটা বাক্স, ওপরটা চামড়া দিয়ে আর কোণগুলো মোটা পিতলের পাত দিয়ে মোড়া। আকারে বড় একটা কেবিন ট্রাঙ্কের মত।

বাক্সটা এত ভারী যে দুজনে ধরেও সেটাকে আমরা তুলতে। পারলাম না। শুধু ওজন লক্ষ্য করেই প্রচণ্ড আশা জাগল আমার। বিশ্বাস করতে শুরু করেছি এর ভেতর বাঘ সিংহাসনের একটা অংশ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বাক্সটা উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতীয় গ্রামের একজন ছুতোর মিস্ত্রি আর তার ছেলেদের তৈরি বলে মনে হয় না, তবে বোম্বে থেকে জাহাজে তোলার আগে সিংহাসনটা নতুন করে প্যাক করাও হয়ে থাকতে পারে।

এই বাক্সে সিংহাসনের কোন অংশ যদি থাকে, পানির মত সহজ হয়ে যাবে আমাদের বাকি কাজ। তখন আমরা জানতে পারব ঠিক কি ধরনের আরও বাক্স খুঁজছি আমরা। কপিকল আর নিজেদের গায়ের জোর খাটিয়ে গানডেকে, সেখান থেকে গানপোর্টে বের করে আনলাম আমরা বাক্সটাকে। ওপরে ওঠাবার সময় খুলে বা ভেঙে যেতে পারে, তাই একটা নাইলনের কার্গো নেট দিয়ে জড়িয়ে ফেলা হল ওটাকে। এরপর নেটের সঙ্গে বাঁধলাম ক্যানভাসের কয়েকটা এয়ারব্যাগ। সেগুলো আমাদের এয়ার বটলের বাতাস দিয়ে ভরা হল।

তোলার সময় দরকার মত এয়ারব্যাগের বাতাস কমিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে সোজা হোয়েলবোটের দিকে কোর্স কন্ট্রোল করছি আমরা। ভেসে উঠলাম হোয়েলবোটের পাশে, ল্যাম্পনি আমাদেরকে ছয়টা নাইলন স্লিং ধরিয়ে দিল, সেগুলো দিয়ে বাক্সটা বেঁধে তারপর বোটে উঠলাম।

এত বেশি ওজন বাক্সটার, বোটের কিনারা দিয়ে সেটাকে তোলার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল আমাদের। আমরা তিনজন মিলে টেনে তুলতে গেলেই বোট কাত হয়ে যাচ্ছে, যে-কোন মুহূর্তে উল্টে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত একটা মাস্তুল খাড়া করতে হল, সেটাকে আমরা ডেরিক হিসেবে ব্যবহার করলাম। অগত্যা বাধ্য হয়ে পানি থেকে উঠে ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে এসে বোটে নামল বাক্সটা। এক মুহূর্ত দেরি না করে হোয়েলবোটে ঘুরিয়ে নিল রডরিক, দ্বীপে ফিরছি আমরা। জোয়ারের ফোলা, ফাঁপা স্রোত পিছু নিয়েছে আমাদের।

রক্তের ভেতর টগবগ করে ফুটছে প্রচণ্ড কৌতূহল, রাফেলা একটা প্রস্তাব দিতেই আমরা সবাই চিৎকার করে তাকে সমর্থন করলাম। ঠিক হল, বাক্সটাকে গুহার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে না, তার আগে সৈকতেই খুলে দেখতে হবে কি আছে ওটার ভেতর।

জেনি বারের সাহায্যে ঢাকনাটাকে আক্রমণ করল রডরিক। ওর ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে রয়েছে পাশাপাশি রাফেলা আর ল্যাম্পনি। ঢাকনির তালাটা প্রকাণ্ড, কিন্তু লোনা পানিতে অনেকদিন পড়ে থাকায় ক্ষয়ে গেছে পিতল। প্রথমদিকে খুব সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ করল সেটা রডরিকের অত্যাচার, তারপর। দুটুকরো হয়ে ভেঙে গেল। ঢাকনিটা তুলল রডরিক।

সঙ্গে সঙ্গে হতাশার একটা ধাক্কা অনুভব করলাম বুকে। দেখতে পাচ্ছি, সিংহাসন নেই এর ভেতর। কিন্তু রাফেলা যখন হাত ঢুকিয়ে ভেতর থেকে একটা গোল থালা বের করে এনে পরীক্ষা করতে শুরু করল, টনক নড়ে গেল আমার–বুঝলাম, অত্যন্ত দামী একটা সম্পদ পেয়ে গেছি আমরা।

প্রথম দর্শনেই থালাটাকে সোনার তৈরি বলে মনে হল আমার। বাক্সের ভেতর আশ্চর্য সুন্দরভাবে তৈরি করা র‍্যাক থেকে একটা প্লেট ছোঁ মেরে তুলে নিলাম আমি, নেড়েচেড়ে দেখে বুঝলাম সোনা নয়, এগুলো রূপোর তৈরি, তবে সোনার প্রলেপ। দিয়ে পালিশ করা হয়েছে।

সোনার প্লেটিং থাকায় একশো বছর ধরে চেষ্টা করেও লোনা পানি সেটটার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি হাতে ধরা প্লেটটার দিকে। একজন অভিজ্ঞ রৌপ্যকারের সারা জীবনের সাধনার ফসল এই অপূর্ব সুন্দর শিল্পকর্ম, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আমার মনে। প্লেটের মাঝখানে এই সেটের মালিকের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রতিক চিহ্ন ফুটে এবং ফুলে রয়েছে, আর কিনারা বরাবর গায়ে গা ঠেকিয়ে রয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য-বনভূমি, হরিণ, মুসলমানী পোশাক পরা শিকারি শাহজাদা এবং পাখি।

প্রায় দুই পাউণ্ড ওজন হবে আমার হাতের এই প্লেটের, সেটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে বাক্সের ভেতর থেকে এক এক করে বের করলাম বাকিগুলো। বাক্সটা অস্বাভাবিক ভারী লাগছিল, তার কারণ বোঝা গেল এখন। সেটে রয়েছে ছত্রিশ জন। মেহমানকে পরিবেশন করার জন্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত ডিশ, প্লেট, আর কাটলারি। হাত ধোঁয়ার গামলা, স্যুপের গামলা, মাছের প্লেট, ডেজার্টের গামলা, বোন আর সাইড প্লেট, ওয়াইন কুলার, ডিশ কাভার, হরেক রকম পেয়ালা-সবগুলোয় ফুটে রয়েছে একই প্রতীক চিহ্ন আর প্রাকৃতিক দৃশ্য। সার্ভিং ডিশগুলো এক একটা বাচ্চাদের বেদিং টাবের মত বড়।

লেডিস অ্যাও জেন্টলমেন, ওদেরকে বললাম আমি, তোমাদের চেয়ারম্যান হিসেবে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে এই আশ্বাস আমি দিচ্ছি যে আমাদের অভিযান এরই মধ্যে লাভের মুখ দেখতে পেয়েছে।

স্কিপারের নেশা হয়েছে, সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল ল্যাম্পনি। চকচকে কিছু ডিশ আর প্লেটের কি আর এমন মূল্য হতে পারে শুনি?

মুঘল সম্রাটদের মাত্র কয়েকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপোর ডিনার সেটের মধ্যে এটা একটা, ওদেরকে জানালাম আমি। এটা একটা অমূল্য সম্পদ।

কত? জানতে চাইল রডরিক। সন্দেহের দোলায় দুলছে সে।

গুড গড, তা আমি জানব কিভাবে! কার হাতে তৈরি এবং কে মালিক ছিল তার ওপর নির্ভর করছে এর গুরুত্ব আর অ্যান্টিক ভ্যালু। খোদ কোন একজন সম্রাটের হতে পারে এটা। সেক্ষেত্রে এর মূল্য হবে কল্পনাতীত। আবার এটা একজন সিপাহশালারের জিনিসও হতে পারে, হতে পারে কোন রাজকুমারের। সেক্ষেত্রেও প্রচুর অ্যান্টিক ভ্যালু রয়েছে এর।

রডরিকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ওর কাছে যেন আমি এক মুঠো হলুদ বালি সোনার গুঁড়ো হিসেবে বিক্রি করার চেষ্টা করছি।

কত? প্রশ্নটা আবার করল সে।

অ্যান্টিক কেনাবেচা করে এমন একটা প্রতিষ্ঠান, ধর, এক লাখ পাউণ্ড দিয়ে সাগ্রহে কিনতে চাইবে।

কে পাগল? জানতে চাইল রডরিক। সিরিয়াস দেখাচ্ছে ওকে। যারা অ্যান্টিকের ব্যবসা করে? নাকি তুমি?

কথাটা সত্যি রডরিক, আমার হয়ে উত্তর দিল রাফেলা। রানা বরং বেশ একটু কমিয়ে বলছে। এর দাম আরও অনেক বেশি।

নিজের বিচার বুদ্ধি এবং সৌজন্য বোধ, এই দুই শক্তির মাঝখানের ফাটলে আটকা পড়ে গেছে এবার রডরিক। রাফেলাকে মিথ্যেবাদিনী বলা অভদ্রতা হয়ে যায়, ওদিকে নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে এই সামান্য জিনিসের দাম এক লাখ পাউণ্ড হতে পারে। শেষ পর্যন্ত মধ্যপন্থা অবলম্বন করল সে-স্রেফ বোবা বনে গেল।

তবে, নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে আমরা সবাই টেনে হিঁচড়ে বাক্সটাকে যখন গুহার দিকে নিয়ে যাচ্ছি, ওর আচরণের মধ্যে সতর্কতা এবং শ্রদ্ধা লক্ষ করলাম আমি। পানির ক্যানগুলোর পেছনে রাখলাম আমরা। তখুনি আমি ছুটে গিয়ে নিয়ে এলাম আনকোরা নতুন একটা হুইস্কির বোতল।

সিংহাসন যদি নাও পাই, ওদেরকে জানালাম আমি, আমার। মনে কোন খেদ থাকবে না।

ঢক ঢক করে গ্লাসের হুইস্কিটুকু শেষ করে বলল রডরিক, এক লাখ পাউণ্ড…হতেও পারে। দুনিয়ায় পাগল-ছাগলের তো আর কোন অভাব নেই।

ওই হোল্ড আর কেবিনগুলো আরও সাবধানে দেখতে হবে আমাদেরকে। কিছু যদি হাতের ছোঁয়া এড়িয়ে যায়, মূল্যবান জিনিস থেকে বঞ্চিত হব আমরা।

ঠিক তাই, আমাকে সমর্থন করে বলল রাফেলা। রূপপার ডিশ আর প্লেটের চেয়ে ছোট জিনিসগুলোরও সাংঘাতিক অ্যান্টিক

ভ্যালু রয়েছে। কিছুই ওখানে ফেলে রেখে আসা চলবে না।

সমস্যা হল একটু ছোঁয়া লাগলেই কাদার মেঘ সব অন্ধকার। করে দিচ্ছে, নিজের নাকের ডগা পর্যন্ত দেখতে পাই না, অসন্তুষ্ট হয়ে বলল রডরিক।

হুইস্কি ঢেলে ওর গ্লাসটা আরেকবার ভরে দিয়ে বললাম আমি, আচ্ছা, রডরিক, তোমার সেজো কাকার একটা সেন্ট্রিফিউগাল ওয়াটার পাম্প আছে, মাঙ্কি বে-তে, জানো তো?

আছে। কেন?

ওটা তার কাছ থেকে কদিনের জন্যে ধার চেয়ে আনতে পারবে তুমি?

চোখ মুখ পাকিয়ে গভীরভাবে দুশ্চিন্তা করছে রডরিক। একটু পর মুখ তুলে বলল। তোমার নাম করে চাইলে দেবে। কিন্তু কি হবে ওটা দিয়ে?

একটা ড্রজ পাম্প হিসেবে ব্যবহার করতে চাই ওটাকে আমি, দুপায়ের মাঝখানে মাটির ওপর একটা নকশা এঁকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিচ্ছি ওদেরকে। পাম্প। হোয়েলবোটে সেট করব আমরা, স্টিম হোসটা নেমে যাবে ভোরের আলোর ভেতরএইভাবে, আঙুল দিয়ে একে দেখালাম ওদেরকে। হোল্ড পরিষ্কার করার জন্যে ওখানে ওটাকে একটা ভ্যাকিউম ক্লিনার হিসেবে ব্যবহার করব আমরা-কাদা, আর তার সঙ্গে টুকিটাকি সব জিনিস টেনে তুলে আনবে বোটের ওপর…

হেই, স্কিপার, দারুণ বুদ্ধি বের করেছ! সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহ দেখাল ল্যাম্পনি। তারপর আমরা কাদা থেকে খুঁটে তুলে নিতে পারব যা কিছু মূল্যবান বলে মনে হবে…

হ্যাঁ, বললাম আমি।

আরও এক ঘন্টা আলোচনা করে মূল ধারণার গলদগুলো দূর করলাম আমরা। এতক্ষণ অসীম শক্তির পরিচয় দিয়ে কোনরকমে উৎসাহ দেখানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পেরেছে রডরিক, কিন্তু শেষ দিকে নিজেকে চেপে রাখতে পারল না সে, ছোট্ট করে মন্তব্য করল, হ্যাঁ, এতে কাজ হতেও পারে।

যাও তাহলে, পাম্পটা নিয়ে এসো।

গলাটা আর একটু ভিজিয়ে নিই, অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাঙল রডরিক।

অর্ধেক খালি বোতলটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম আমি, বললাম, এটা সঙ্গে করে নিয়ে যাও, তাতে সময় বাঁচবে।

একলাখ পাউণ্ড, বিড় বিড় করে বলল রডরিক, উঠে দাঁড়াল সে। কি জানি, হতেও পারে!

ব্যাপারটা নিয়ে এখনও সশব্দে মাথা ঘামাচ্ছে ও, বুঝতে পেরে অবাক হলাম আমি।

ওভারকোট নিয়ে আসার জন্যে গুহার ভেতর গিয়ে ঢুকেছে রডরিক। রাফেলা বলল, কারও চোখে যাতে পড়ে না যায় সেব্যাপারে ওকে তুমি সাবধান করে দেবে না?

রডরিক আমার চেয়ে অনেক বেশি সাবধানী, জানালাম ওকে।

পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম আমি আর রাফেলা। হাতে সারাদিন কোন কাজ নেই, আর দ্বীপটায় শুধু আমরা আছি, কথাটা মনে পড়তেই অদ্ভুত এক পুলক অনুভাব করলাম শরীরে। রডরিক আর ল্যাম্পনি বিকেলের আগে ফিরবে না।

ব্রেকফাস্ট সেরে দুই সারি পাহাড়ের মাঝখানে ঝুলন্ত বারান্দা ধরে হেঁটে নেমে এলাম আমরা সৈকতে।

অগভীর পানিতে ছুটোছুটি করে খেলছি আমরা। রাফেলা আমাকে, আমি রাফেলাকে লক্ষ করে মুঠো মুঠো বালি ছুঁড়ছি। রীফের বাইরের পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে বুম বুম বোমা ফাটাচ্ছে ঢেউগুলো, সেই ভারী বিস্ফোরণের গুরুগম্ভীর আওয়াজ ছাপিয়ে উঠছে রাফেলার তীক্ষ্ণ, মিষ্টি, খিলখিল হাসি, আর কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না আমি। স্রেফ কপালগুণে মুখ তুলে ওপর দিকে একবার তাকাতেই দ্বীপের পেছন দিক থেকে হালকা প্লেনটাকে ছুটে আসতে দেখলাম আমি।

দৌড়াও! ঝট করে মুখ নামিয়ে রাফেলার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। কিন্তু ও মনে করছে আমি ঠাট্টা করছি। দ্রুত হাত তুলে আকাশের প্লেনটাকে দেখালাম ওকে। দৌড়াও। পাইলট যেন আমাদেরকে দেখতে না পায়।

এক মুহূর্ত ইতস্তত করল রাফেলা। কিন্তু বিপদের গুরুত্বটা বুঝতে পেরে পর মুহূর্তে সমস্ত সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে দিল ও, বিবস্ত্র অবস্থায় ছুটে উঠে এল পানি থেকে।

ওকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি আমি, বালির ওপর দিয়ে উঠে যাচ্ছি সৈকতের ওপর দিকে। এতক্ষণে কানে আসছে ইঞ্জিনের শব্দ। ঝট করে ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছন দিকে তাকালাম। দ্বীপের দক্ষিণ দিকের পাহাড়টার একেবারে গা ছুঁয়ে আড়াআড়িভাবে ছুটে আসছে প্লেনটা, লম্বা সৈকতের ওপর পৌঁছে একটু দিক বদলে সোজা এগোচ্ছে এখন আমাদের দিকে।

কুইক! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। আমার আগে রয়েছে রাফেলা। লম্বা ভিজে পায়ে সন্ত্রস্ত হরিণীর মত ছুটছে ও, কালো এলো চুল খোলা পিঠের ওপর নিতম্বের কাছে ঝাপটা মারছে ঘন ঘন।

আবার পেছন দিকে তাকালাম আমি। এখনও এক মাইল দূরে রয়েছে প্লেনটা, কিন্তু এগিয়ে আসছে সোজা আমাদের দিকে। দেখতে পাচ্ছি, ডবল ইঞ্জিনের একটা প্লেন ওটা, তুষার সাদা প্রবাল বালির বিস্তৃতির দিকে ঝুলে পড়ছে একটু।

গতি মন্থর না করেই ঝুঁকে পড়ে, ছোঁ মেরে তুলে নিলাম আমাদের খুলে রাখা কাপড়চোপড়। তারপর শেষ কয়েক গজ পেরিয়ে এসে একটা ধরাশায়ী নারকেল গাছের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। ঝড়ের দিনে পড়ে গেছে এই গাছ, সব পাতা ঝরে গেছে তার, কিন্তু মাথা নিচু করে কাণ্ডের নিচে গা ঢাকা দিতে কোন অসুবিধে হল না আমাদের। হাঁপাচ্ছে রাফেলা, বসে থাকতে না পেরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল ও। বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে আমিও লম্বা হলাম ওর গা ঘেঁষে।

এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ওটা একটা ডবল ইঞ্জিনের সেসনা প্লেন। লম্বা সৈকতের ওপর দিয়ে সোজা ছুটে এল, তীরবেগে উড়ে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। পানিরেখার বড়জোর বিশ ফুট ওপর দিয়ে। ফিউসিলেজটা হলুদ রঙ করা, সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে-Africair, চিনতে পারলাম প্লেনটাকে, সেন্ট মেরীর এয়ারপোর্টে বার ছয়েক এর আগে দেখেছি আমি, হয় ধনী ট্যুরিস্টদেরকে নামিয়ে দিয়েছে, নয়ত তুলে নিয়েছে। Africair-এর হেড অফিস মেইন ল্যাণ্ডে, এটা একটা প্লেন চার্টার কোম্পানি। এরা ঘন্টা হিসেবে ভাড়া খাটায় নিজেদের প্লেন। ভাবছি, কে ভাড়া করেছে সেসনাটাকে?

প্লেনের সামনের সিটে দুজন লোককে দেখতে পেয়েছি আমি। একজন নিঃসন্দেহে পাইলট, আরেকজন আরোহী। সগর্জনে আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় আমাদের দিকে ফেরানো ছিল ওদের মুখ দুটো। দ্রুত গতির জন্যেই মুখ দুটো ভাল করে দেখতে পাইনি আমি, তাই চিনতে পারার প্রশ্ন ওঠে না। তবে, দুজনেই শ্বেতাঙ্গ।

খাড়ির ওপর পৌঁছে যথাসম্ভব কম এলাকা জুড়ে একটা চক্কর। দিয়ে বাঁক ঘুরল সেসনা, তারপর আবার ফিরে আসতে শুরু করল সোজা আমাদের দিকে।

এবার মাথার আরও কাছ দিয়ে উড়ে গেল প্লেনটা, মুহূর্তের জন্যে পাইলটের পাশে বসা আরোহীর চোখে চোখ আটকে গেল আমার-মনে হল, চিনি আমি লোকটাকে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারব না।

সৈকতের ওপর দিয়ে খানিকদূর এগিয়ে বাঁক নিল সেসনা, কোর্স বদলে নিল মেইন ল্যাণ্ডের দিকে। তার চলে যাবার সাবলীলতার মধ্যে বিজয়ীর একটা ভঙ্গি ফুটে উঠেছে, কিছু আবিষ্কার করে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যাচ্ছে সে।

হামাগুড়ি দিয়ে গাছের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি আর রাফেলা, ভিজে শরীরে লেপ্টে থাকা শুকনো পাতার টুকরো আর বালি পরিষ্কার করছি।

তোমার কি মনে হয়, আমাদেরকে দেখে ফেলেছে ওরা? সসঙ্কোচে জানতে চাইল রাফেলা।

রোদ লেগে জোড়া আয়নার মত ঝকঝক করছিল তোমার পাছা দুটো-ওরা কানা নাকি?

স্থানীয় জেলে বলে ভুল করতে পারে আমাদেরকে ওরা।

ওর দিকে তাকালাম আমি, ওর মুখের দিকে নয়, তারপর নিঃশব্দে হাসলাম। জেলে? তা যদি মনে করে থাকে তাহলে এখনও ওরা মাথা ঘামাচ্ছে সমস্যাটা নিয়ে।

সমস্যা? কিসের সমস্যা?

ওরা ভাবছে, জেলের বুকে অমন বড় বড় ও দুটো কি?

মাসুদ রানা, তুমি একটা ইয়ে, মানে, তুমি একটা জানোয়ার, বলল রাফেলা। ঠাট্টা নয়, রানা, সত্যি বল তো, কি ঘটতে যাচ্ছে এরপর?

তা আমিও জানতে চাই, ডারলিং, জানতে পারলে খুব খুশি হতাম, বললাম ওকে। রূপোর ডিশ আর প্লেটগুলো সঙ্গে করে সেন্ট মেরীতে নিয়ে গেছে রডরিক আর ল্যাম্পনি, কথাটা মনে পড়ে যেতে একটু স্বস্তি বোধ করছি আমি। ওরা সম্ভবত ইতিমধ্যেই টার্টল বে-তে আমার বাড়ির পেছনের মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলেছে সেগুলো। ভাবছি, এখন যদি অভিযান এবং উদ্ধার পর্ব ত্যাগ করতে হয়, তাতেও আমাদের লোকসান নেই।

প্লেনটা চেহারা দেখিয়ে যাওয়ায় আমাদের সবার মনে একটা জরুরী ভাব সেঁধিয়ে গেছে। এখন আমরা নিঃসন্দেহে জানি, গোণা-গুণতি মাত্র অল্প কয়েকটা দিন রয়েছে আমাদের হাতে। যা করার ঝটপট করে ফেলতে হবে।

সমান অস্বস্তিকর আরেকটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে রডরিক।

দক্ষিণ দ্বীপমালিকার আশপাশে একনাগাড়ে পাঁচ দিন ঘুর ঘুর করেছে বুমেরাং। কুলি পীক থেকে অনেকেই প্রায় প্রতিদিন দেখতে পেয়েছে তাকে, দেখে মনে হয়েছে কি করছে তা নিজেরই। যেন জানা নেই তার। প্রকাণ্ড মুখের ভাঁজগুলো খুলে সমান হয়ে গেছে রডরিকের, তার মানে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে সে। সংবাদটাকে। তারপর হঠাৎ করে সোমবারে আবার সে ফিরে এসে নোঙর ফেলেছে গ্র্যাণ্ড হারবারে। টমসন আমাকে জানাল, বুমেরাং-এর মালিক আর তার বেগম হোটেলে গিয়েছিল লাঞ্চ খেতে, সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ফ্রবিশার স্ট্রিটে চলে আসে।

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল আমার, ঢ্যাঙা রামাদীনের কথা মনে পড়ে যেতে ভুরু কুঁচকে উঠল। তারপর?

গোখলে রামাদীনের সঙ্গে তার অফিসে এক ঘন্টা কাটায় ওরা, বলল রডরিক। মিস্টার রামাদীন ওদেরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেয় বন্দরে, সেখান থেকে ওরা বুমেরাং-এ ফিরে যায়। এর একটু পরই বুমেরাং নোঙর তুলে রওনা হয়ে যায়।

এইটুকুই সব?

হ্যাঁ, বলল রডরিক। না, আর একটু আছে। বন্দর থেকে মিস্টার রামাদীন সোজা ব্যাংকে চলে আসে, নিজের সেভিংস অ্যাকাউন্টে জামা দেয় পনেরোশো ডলার।

তা তুমি জানলে কিভাবে?

আমার বোনের মেঝো মেয়ে ব্যাংকে চাকরি করে।

কুৎসিত একদল পোকা আমার তলপেটের চারদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছে অনুভব করলেও, মুখে খুশির ভাব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাম আমি। বললাম, যাই হোক, মন খারাপ করে কোন লাভ নেই। এসো, পাম্পটা জোড়া লাগাবার কাজটা সেরে ফেলা যাক। কালকের জোয়ারটা ধরতে চাই আমি।

ওয়াটার পাম্পটা ধরাধরি করে গুহায় বয়ে নিয়ে এলাম আমরা। কাউকে কিছু না বলে একা আবার ছোট্ট বে-তে হোয়েলবোটের কাছে ফিরে গেল রডরিক। খানিকপর যখন ফিরে এল, ওর হাতে ক্যানভাসে মোড়া লম্বা একটা প্যাকেট দেখতে পেলাম আমি।

ওটা কি, রডরিক? জানতে চাইলাম আমি।

একটু ইতস্তত করল রডরিক, সঙ্কোচের সাথে প্যাকেটটা খুলল।

এফ. এন কারবাইন আর তার সঙ্গে এক ডজন স্পেয়ার ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছে রডরিক। ভাবলাম কাজে লাগতে পারে এটা, ব্যাখ্যা করল সে।

কারবাইনটা ওর কাছ থেকে নিয়ে জেলিগনাইটের বাক্সগুলোর সঙ্গে মাটির নিচে পুঁতে রাখলাম। ওকে বললাম, কাজটা মন্দ করনি।

.

রাত জেগে গ্যাস লণ্ঠনের আলোয় কাজ করছি আমরা। মাঝরাতের পর পাম্প আর ইঞ্জিনটা বয়ে নিয়ে এলাম হোয়েলবোটের কাছে। ভারী টিম্বারের তৈরি একটা মেকশিফট মাউন্টিং-এর সঙ্গে বেঁধে সেটাকে আমরা বোটে তুললাম। বোটের ঠিক মাঝখানে রাখলাম সেটাকে। পাম্প নিয়ে আমি আর ল্যাম্পনি সকালবেলাও কাজ করছি, এরই মধ্যে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে হোয়েলবোট ছেড়ে দিয়েছে রডরিক।

পুলে পৌঁছে আধঘন্টা স্থির হয়ে থাকল হোয়েলবোট, তারপর শেষ হল আমাদের কাজ। জোড়া লাগানো হয়ে গেছে, এখন আমরা পরীক্ষা করতে পারি পাম্পটা।

রডরিক, রাফেলা আর আমি পানির নিচে এলাম। কালো, মোটা সাপের মত হোস পাইপটা ধরাধরি করে গানপোর্টের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। হোল্ডের কুয়ায় নিয়ে গিয়ে জায়গা মত। ওটাকে বসাতে প্রচুর সময় আর খাটনি গেল আমাদের। রডরিকের কাঁধে চাপড় মেরে ইঙ্গিতে ওকে ওপর দিকটা দেখালাম আমি। ফিন দিয়ে পেডাল করে জাহাজের খোল থেকে বেরিয়ে পানির ওপর উঠে গেল সে।

বেশ খানিকপর হোয়েলবোট থেকে পাম্পের ইঞ্জিনে স্টার্ট। দিল রডরিক, অস্পষ্ট গুঞ্জন আর হোসের গায়ে মৃদু কাঁপুনি অনুভব। করে তা টের পেলাম আমরা।

হোল্ডে ঢোকার মুখে কাঠের মোটা একটা থাম রয়েছে, সেটাকে বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে স্থির করে রেখেছি নিজেকে, দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছি হোস পাইপের শেষ প্রান্তটা। কার্গোর কালো স্তুপের দিকে ফেলে রেখেছে রাফেলা টর্চের আলো। হোসের খোলা মুখটা ধীরে ধীরে সেদিকে ঘোরালাম আমি।

সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম বুদ্ধিটা কাজে দেবে, জঞ্জালের খুদে টুকরোগুলোকে চুম্বকের মত টেনে নিচ্ছে হোস পাইপটা, চোখের পলকে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সব পাইপের মুখের ভেতর। শক্তিশালী একটা স্রোতের মত পাইপে ঢুকছে পানি, ফলে আশপাশে ছোট ছোট ঘূর্ণি সৃষ্টি হচ্ছে।

ইঞ্জিনের ক্ষমতা আর পানির গভীরতার কথা মনে রেখে হিসেব কষে বুঝলাম ঘন্টায় ত্রিশ হাজার গ্যালন পানি টানছে। পাম্পটা। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই কাজের জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেললাম আমি, এখন আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি বেশ কিছুদূর পর্যন্ত। স্কুপে জেনি বার ঢুকিয়ে বড় বড় টুকরো আলাদা করে নিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছি আমাদের পেছন দিকের প্যাসেজে।

ভারী একটা কেস সরাবার জন্যে মাত্র একবার কপিকলটা ব্যবহার করতে হল আমাকে, তাছাড়া বাকি সময় হোস আর জেনি। বার দিয়েই কাজ সারতে পারছি।

প্রায় পঞ্চাশ কিউবিক ফুট কার্গো সরাবার পর ওপরে উঠে আমাদের এয়ার বটল বদলাবার সময় হল। প্যাসেঞ্জার ডেকে হোসটাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে পানির ওপর উঠে আসতেই বিজয়ীর সম্মান দেখিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হল আমাদেরকে। ল্যাম্পনি আনন্দে লাফাচ্ছে, এমন কি রডরিক পর্যন্ত হাসছে।

হোয়েলবোটের চারদিকের পানি জঞ্জাল আর আবর্জনার কণায় ঘোলাটে নোংরা হয়ে গেছে। পাম্পের আউটলেট দিয়ে রেরিয়ে আসা ছোট ছোট নানান জিনিস একটা বালতিতে তুলেছে ল্যাম্পনি, সেটা প্রায় ভরে গেছে এরই মধ্যে। উঁকি দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলাম বোতাম, চুলের কাটা, আঙটি, খুদে গহনা, পদক, সেই সময়কার রূপো আর সোনার মুদ্রা-কাচ, ধাতু আর হাড়ের বিচিত্র একটা সংগ্রহ।

কাজের জায়গায় এখুনি আবার ফিরে যাবার জন্যে অস্থিরতা অনুভব করছি আমি নিজেও, আর রাফেলা তো অধৈর্য হয়ে উঠে আমাকে ঘাড় ধরে নামাতে চাইছে-শেষ পর্যন্ত মাত্র দুটো টান দিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চুরুটটা খয়রাত করে দিতে হল রডরিককে। আবার আমরা পানির নিচে নেমে এলাম।

কাজে হাত লাগাবার পনেরো মিনিট পর বড়সড় একটা বাক্সের কিনারা দেখতে পেলাম স্যুপের ভেতর। এ-ধরনের বাক্স আগেও দেখেছি আমরা, এবং পেছন দিকে সরিয়ে রেখেছি। এটার ওপরের কাঠ পাটখড়ির মত নরম হয়ে গেলেও লোহার পাত আর বড় বড় পেরেক দিয়ে আটাকান বলে প্রথম টুকরোটা টেনে হিঁচড়ে খুলতে বেশ সময় লেগে গেল। প্ল্যাঙ্কটা আমাদের পেছন দিকে সরিয়ে দিলাম আমি। পরের প্ল্যাঙ্কটা সহজেই বেরিয়ে এল। নিচে দেখা যাচ্ছে বিশৃক্সখল ভাবে গুঁজে রাখা ভিজে খড়। হাত ভরে এর খানিকটা বের করে আনলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের টানে হোসের মুখের কাছে গিয়ে আটকে গেল সেগুলো। তবে এক সেকেণ্ড পরই পথ করে নিয়ে ঢুকে গেল পাইপের ভেতর। হোসটা আবার পানি টানতে শুরু করেছে।

বাক্সটার ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অন্যদিকে কাজ শুরু করতে যাচ্ছি, কিন্তু আমাকে বাধা দিচ্ছে রাফেলা। তার দাবি, বাক্সটার ওপর আরও সময় ব্যয় করি আমি। রেগে গেছে আমার ওপর ও, হাত নেড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। যখন দেখল ওর। আবদারে কান দিচ্ছি না, টর্চের আলো অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল সে।

অগত্যা ওকে সন্তুষ্ট করার জন্যেই বাক্সটার দিকে আবার ফিরলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো ফেলল সেটার দিকে রাফেলা।

বাক্সের ভেতর থেকে অল্প করে টেনে বের করছি খড়, আবার। যাতে পাইপের মুখ বন্ধ করে না দেয়। ইঞ্চি ছয়েক গভীর গর্ত। হবার পর খড়ের ফাঁক-ফোকরের ভেতর প্রথম চোখে পড়ল ধাতব। পদার্থের ধোঁয়াটে কয়েকটা বিন্দু। তলপেটের গভীরে প্রত্যাশায় কাঁপুনি এই প্রথম অনুভব করছি আমি। ব্যগ্র ব্যস্ততার সঙ্গে আরেকটা প্ল্যাঙ্ক ভেঙে সরিয়ে দিলাম পেছন দিকে। ফাঁকটা বড় হওয়ায় আরও সহজে খড় বের করতে পারছি এখন।

ভেতর দিকে স্তরে স্তরে চেপে বসে আছে খড়, সেগুলো আমি। অত্যন্ত ধীরে যত্নের সঙ্গে একটু একটু করে বের করে আনছি। স্বপ্নের মধ্যে একটা মুখ ধীরে ধীরে ফুটে ওঠার মত আত্মপ্রকাশ করছে জিনিসটা।

প্রথমে জটিল কারুকাজ করা এক টুকরো ধাতুর সোনালি আভা ঝিকমিক করে উঠল। পেছন থেকে আমার ঘাড়ের ওপর প্রায় চড়ে বসে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে রাফেলা, আমার কাঁধটা পাঁচ আঙুল দিয়ে খামচে ধরল ও।

একটা মুখের আভাস দেখতে পাচ্ছি, ঠোঁট জোড়া মুখ। ব্যাদানের ভয়াবহ ভঙ্গিতে প্রসারিত, ভেতরে দেখা যাচ্ছে এই বড়। বড় সোনালি দাঁত আর বাঁকানো একটা তলোয়ারের মত বিশাল জিভ। উঁচু, চওড়া কপালটা আমার কাঁধের মত বড় চকচকে হলুদ খুলির সঙ্গে প্রায় সেঁটে রয়েছে কান দুটো। চওড়া দুই ভুরুর ঠিক মাঝখানে দেখতে পাচ্ছি একটা মাত্র খালি গর্ত, অক্ষিগোলক। আরেকটা চোখের অভাব জানোয়ারটার চেহারার মধ্যে একটা অন্ধ বীভৎস ভাব এনে দিয়েছে, এটা যেন পৌরাণিক যুগের কোন দেবতা, অভিশাপে পড়ে চেহারা এবং বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

প্রকাণ্ড, আর অপূর্ব সুন্দর করে গড়া বাঘের মাথাটার দিকে তাকিয়ে ভক্তি মেশানো ভয় আর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছি আমি। কেমন যেন একটা ভীতিকর ঠাণ্ডা অনুভূতি আমার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসছে, নিজের অজান্তে চারদিকের অন্ধকারে দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম মুঘল রাজকুমারদের অতৃপ্ত আত্মারা ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কিনা।

কাঁধের মাংসের ভেতর রাফেলার আঙুলের নখ সেঁধিয়ে যাচ্ছে, ব্যথ্যা পেয়ে কাঁধটা ঝকালাম আমি, আবার ফিরে তাকালাম সোনার মূর্তির দিকে। কিন্তু ভয় আর বিস্ময় আমাকে এমনভাবে আড়ষ্ট করে ফেলেছে যে ওটার দিকে একটানা কয়েক সেকেণ্ডের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারছি না আমি। বাধ্য হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি, জোর করে নিজের কাঁধে চাপিয়েছি ওটার চারপাশ থেকে জঞ্জাল সরাবার কাজটা।

যত্নের সঙ্গে কাজ করছি আমি, জানি এর কোথাও একটু আঁচড় লাগলেই ঝপ করে অনেক নেমে যাবে এর মূল্য, হানি ঘটবে এর অতুলনীয় সৌন্দর্যের।

আমাদের কাজের সময় উতরে গেল, পিছিয়ে এসে উন্মোচিত মাথা আর কাঁধের দিকে তাকালাম আমরা। টর্চের আলো লেগে প্রতিবিম্বগুলো সোনালি তীর-এর মত অন্ধকার গহূরের সমস্ত দিকে ছুটে যাচ্ছে, ঝলমলে আলো অদ্ভুত একটা পবিত্রতা এনে দিয়েছে পরিবেশে।

অটুট নিস্তব্ধতা আর গভীর অন্ধকারে ওকে রেখে ঘুরে দাঁড়ালাম আমরা, জাহাজের খোল থেকে বেরিয়ে এসে উঠতে শুরু করলাম। ওপর দিকে। যেন অন্য এক জগৎ থেকে ফিরছি আমরা।

আমাদেরকে দেখেই রডরিক বুঝতে পারল অর্থপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু তখুনি কোন প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকল সে। হোয়েলবোটে উঠলাম আমরা। নিঃশব্দে স্কুবা গিয়্যার নামাচ্ছি শরীর থেকে। তারপর একটা চুরুট ধরিয়ে কড়া আর লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া নিলাম বুক ভরে, ভিজে চুল থেকে মুখ বেয়ে সাগরের লোনা পানির ধারা নামছে, সেগুলো মুছে ফেলার ঝামেলায় যাচ্ছি না। আমাদেরকে লক্ষ করছে রডরিক। ওদিকে আমাদের কাছ থেকে একটু সরে গেছে রাফেলা, একা বসে। গোপন কি যেন ভাবনাচিন্তায় মগ্ন।

পেয়েছ, মাসুদ? অবশেষে জানতে চাইল রডরিক।

ওপর-নিচে একবার মাথা ঝকালাম আমি। হ্যাঁ, রডরিক, রয়েছে ওটা ওখানে, আমার কণ্ঠস্বর কাঁপা কাঁপা আর খসখসে, নিজেই অবাক হয়ে গেলাম নিজের গলা শুনে।

ধনুকের ছিলার মত উত্তেজনায় টান টান পরিবেশটা টের পায়নি এতক্ষণ ল্যাম্পনি, আমাদের গিয়ারগুলো সামলে রাখছিল ও, আমার কথা শেষ হতেই ঝট করে মুখ তুলে তাকাল। কিছু বলার জন্যে মুখটা খুলল ও, কিন্তু তারপর সেটা ধীরে ধীরে বন্ধ করে ফেলল শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশটা অনুভব করতে পেরে।

হঠাৎ যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে আমাদের। কথা না বলে নড়াচড়া করছি। ব্যাপারটা এরকম হবে তা আমি আশা করিনি। রাফেলার দিকে তাকালাম আমি। বুঝতে পারছে ও, আমি ওর দিকে তাকিয়েছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের দিকে তাকাল না ও। কিন্তু আমি নজর ফেরাচ্ছি না অনুভব করে শেষ পর্যন্ত। তাকাল আমার চোখে। ওর চোখে কি এক চকচকে আলো দেখতে পেলাম আমি। আলোটা আমি ঠিক চিনতে পারলাম না। এটা ভয়, বিস্ময় অথবা লোভেরও প্রতিবিম্ব হতে পারে।

চল ফেরা যাক, রানা, চাপা স্বরে বল রাফেলা।

রডরিকের দিকে ফিরে মাথা কাত করলাম আমি। ইঞ্জিন থেকে হোসটা খুলে হোয়েলবোটের কিনার থেকে পানিতে ফেলে দিল ও, কাল আবার পুলের মেঝে থেকে তুলে নেব আমরা।

গিয়ার দিয়ে বোটের বো ঘুরিয়ে নিল চ্যানেলের দিকে রডরিক।

গলুইয়ে আমার পাশে এসে বসল রাফেলা। ওর কাঁধে একটা হাত তুলে দিলাম আমি, কিন্তু দুজনের কেউ কোন কথা বলছি না।

সূর্যাস্তের সময় আমাদের ক্যাম্পের ওপরে চূড়ায় উঠে পাশাপাশি বসলাম আমি আর রাফেলা। রীফ-এর দিকে তাকিয়ে দেখছি সাগর থেকে মুছে যাচ্ছে দিনের আলো।

কেমন যেন অপরাধী লাগছে নিজেকে আমার, ফিসফিস করে বলল রাফেলা। আমি যেন কি এক ভয়ঙ্কর নিষিদ্ধ কাজ করে বসেছি।

হ্যাঁ, বললাম আমি, কি বলতে চাইছ বুঝতে পারছি।

ওটা…ওটা যেন রক্ত-মাংসের জ্যান্ত একটা কিছু। কি আশ্চর্য, ভেবে দেখ, এত থাকতে আমরা ওর মাথাটাই আগে আবিষ্কার করলাম-প্রচণ্ড রাগে বিকৃত হয়ে ওঠা একটা মুখ হঠাৎ দেখতে পেলাম আমরা। শিউরে উঠল ও, কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল। অথচ অদ্ভুত একটা তৃপ্তিও অনুভব করছি, জানো, ব্যাপারটা ঠিক ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না তোমাকে আমিতার কারণ দুটো অনুভূতি পরস্পরবিরোধী, অথচ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে আমার ভেতর।

আমি বুঝতে পারছি। আমার অবস্থাও তাই।

কি করবে এখন, রানা? ওটা নিয়ে কি করতে চাও তুমি?

মূল্য, ক্রেতা এসব বিষয়ে এই মুহূর্তে আলাপ করতে সায় দিচ্ছে না মন, তাতে যেন গোটা পরিবেশের পবিত্রতা নষ্ট করে দেয়া হয়, তাই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে রাফেলাকে বললাম, চল, নিচে যাই। ডিনার নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে ল্যাম্পনি।

পেটের খালি জায়গাটা গরম আর সুস্বাদু খাবারে ভরে নিয়ে আগুনের ধারে সবার সঙ্গে গোল হয়ে বসেছি আমি, আমার এক হাতে হুইস্কির গ্লাস, আরেক হাতে জ্বলন্ত চুরুট। এতক্ষণে ঘটনাটা। বর্ণনা করার একটা আগ্রহ অনুভব করছি নিজের মধ্যে।

কিভাবে আবিষ্কার করেছি ওটা তা ব্যাখ্যা করার পর ভীতিকর সোনার মাথাটার বর্ণনা দিলাম আমি। নিঃশব্দে শুনল ওরা।

কাঁধ পর্যন্ত মুক্ত করেছি মাথাটা আমরা। আমার ধারণা, ওখানেই শেষ হয়েছে এই অংশটা। খাজ কাটা দাগ দেখেছি। সম্ভবত পরবর্তী অংশটা ওখানে জোড়া লাগবে। কাল আমরা পানির ওপর তুলে আনব ওটাকে, কিন্তু কাজটা খুব জটিল। কপিকল দিয়ে সেফ টেনে, তুলে নেয়া চলবে না। একচুল নড়াবার আগে ভাল করে দেখে নিতে হবে কোথাও একটু আঁচড়, যেন না লাগে।

একটা পরামর্শ দিল রডরিক, সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম আমরা। আলোচ্য বিষয়, ক্ষতির যথাসম্ভব কম ঝুঁকি নিয়ে মাথাটাকে কি করে ওপরে তোলা যায়।

আমরা আশা করতে পারি গুপ্তধনের পাঁচটা বাক্সই এক সঙ্গে, এক জায়গায় রাখা হয়েছিল। সম্ভবত এই হোল্ডেই বাকি বাক্সগুলো পেয়ে যাব আমরা। বাক্সগুলো দেখতেও একই রকম হবার কথা…

শুধু পাথরগুলো কাঠের বাক্সে নেই, আমাকে বাধা দিয়ে বলল রাফেলা। কোর্ট-মার্শালে দাঁড়িয়ে সুবাদার রাম পানাত সাক্ষী দেয়ার সময় কি বলেছিল মনে নেই তোমার? লোহার একটা আয়রন সেফে আছে পাথরগুলো।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে আমার।

সেটা দেখতে কেমন, খুলতে পারা যাবে কিনা… রডরিক কিছু বলতে যাচ্ছিল।

কাল জানতে পারব, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল রাফেলা।

পরদিন সকালে মাথায় ঝম ঝম বৃষ্টি নিয়ে সৈকতে পৌঁছুলাম আমরা। মেঘগুলো একেবারে পাহাড় চূড়ার কাছে নেমে এসেছে, ঘন কালো উঁচু বাঁধের মত দেখাচ্ছে ওগুলোকে, দিগন্তরেখার নিচ থেকে ভাঁজ খুলে আরও আসছে স্তরের পর স্তর, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় ঢল বইয়ে দিচ্ছে দ্বীপের গায়ে।

সাগরের বুকে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়েই বিস্ফোরিত হচ্ছে, পানির কণা তারের সাদা একটা জালের মত ঢেকে রেখেছে। সাগরের শরীর। কয়েকশো গজ পর বাকি সব অস্পষ্ট, ঝাপসা।

হোয়েলবোট থেকে পানি ছেচে কূল করতে পারছে না ল্যাম্পনি। বোটের সব কিছু ভিজে সপসপে হয়ে গেছে, পানির ঢল গড়াচ্ছে প্রতিটি জিনিসের ওপর। স্টার্নে দাঁড়িয়ে আছে রডরিক, বৃষ্টির বর্শা থেকে বাঁচার জন্যে চোখ দুটো ঢেকে রেখেছে হাত দিয়ে। চ্যানেল ধরে এগোচ্ছি আমরা।

প্রবাল প্রাচীরের পাশে উজ্জ্বল কমলা রঙের বয়াটা পানির পিঠে লাফালাফি করছে এখনও। সেটাকে ধরে লাইনে টেনে বোটে তুললাম আমরা হোস পাইপের শেষ প্রান্তটা। পাম্পের মাথার সঙ্গে জোড়া লাগানো হল সেটা। একই সঙ্গে নোঙরের কাজ করছে হোসটা, হোয়েলবোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল রডরিক।

পানিতে নেমে বৃষ্টির খোঁচা থেকে বাঁচা গেল। ঝাপসা নীলের ভেতর দিয়ে পুলের নিচে নেমে এলাম আমি আর রাফেলা।

আভাসে হুমকি আর প্রকাশ্যে কিছু ঘুষ দিয়ে আমি আর। রডরিক শেষ পর্যন্ত আদায় করতে পেরেছি ল্যাম্পনির কাছ থেকে। তার শখের কম্বলটা। পানিতে একবার ভালভাবে ভেজার পর আমাদের সঙ্গে সেটা খুব দ্রুত নেমে এল নিচে। ভাঁজ করে, রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছি ওটাকে আমি, তাই গানডেকে ঢোকাতে কোন অসুবিধে হল না। গানডেকে নামিয়ে, সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার ডেকে নিয়ে এসে বাঁধন খুলে ভাঁজ মুক্ত করলাম। কম্বলটা। তারপর রাফেলাকে নিয়ে চলে এলাম হোল্ডে, এখানে। দেখতে পেলাম ঠিক যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম সেভাবেই রয়েছে বাঘের মাথাটা-একটা মাত্র অন্ধ চোখের কোটর নিয়ে আক্রোশে মুখ ভেঙচাচ্ছে, টর্চের আলোয় দৃশ্যটা দেখে নিজের অজান্তেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল আমার।

দশ মিনিটের চেষ্টায় খড়ের আশ্রয় থেকে বের করে আনা গেল মাথাটাকে। যা ভেবেছিলাম, কাঁধের কাছেই শেষ হয়েছে। অংশটা, কিনারাটা নিখুঁত ভাবে খাজ কাটা, পরিষ্কার বোঝা যায় সিংহাসনের পরবর্তী অংশের আরেক প্রস্থ খাজের সঙ্গে খাপে খাপে এঁটে যাবে।

মাথাটা ধরে একদিকে কাত করে আরেকটা ব্যাপার আবিষ্কার করলাম আমি। কেন যেন ধরে নিয়েছিলাম মূর্তিটা নিরেট সোনা নিয়ে তৈরি, কিন্তু এখন দেখছি তা নয়, ভেতরটা ফাঁপা।

এক ইঞ্চি পুরু সোনা দিয়ে গড়া হয়েছে মূর্তিটা, ভেতর দিকটা খরখরে আর উঁচু-নিচু। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এও বুঝলাম যে নিরেট সোনা হলে এটার ওজন হত কয়েক টন, আর তাজমহলের মত কীর্তি নির্মাণ করার সাধ্য রয়েছে যাদের তাদের পক্ষেও নিরেট সোনার এতবড় একটা সিংহাসন তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। একটা ব্যাপার। ধাতুর ছাল এত পাতলা হওয়ায় স্বভাবতই কাঠামোটা খুব শক্তিশালী হয়নি, সেজন্যে মাথাটা এরই মধ্যে এক। জায়গায় আহত হয়েছে।

ঘাড়ের একদিকের নিচু কিনারায় চোট লেগেছে, কিনারা টুকু চটে গেছে এক জায়গায়। ভারতীয় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গোপন পরিবহনের সময়, নাকি সাইক্লোনের মুখে পড়ে ভোরের আলো যখন জীবন-মরণ যুদ্ধ করেছিল তখন এই দুঃখজনক ঘটনাটা ঘটেছে-নিশ্চিতভাবে এখন আর কিছু বলার উপায় নেই।

হোল্ডের ভেতর পা রাখার জন্যে শক্ত একটা জায়গা বেছে নিলাম আমি, তারপর মাথাটার ওজন পরীক্ষা করার জন্যে ঝুঁকে পড়লাম ওটার দিকে। একটা শিশুকে দুহাতের ওপর তুলে নেবার ভঙ্গিতে ধরলাম মাথাটা। ধীরে ধীরে একটু একটু করে গায়ে জোর বাড়িয়ে তুলে নিচ্ছি ওটাকে। উঠে আসছে-বুঝতে পেরে বিস্মিত হচ্ছি না, আনন্দ অনুভব করছি।

সন্দেহ নেই, সাংঘাতিক ভারী মূর্তিটা, শক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে গায়ের সবটুকু জোর খাটিয়ে তবেই তুলতে পেরেছি-তবে, সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে এত ভারী নয় যে তোলা অসম্ভব। আমার সতর্ক অনুমান, তিনশো পাউণ্ডের বেশি হবে না এটার ওজন। ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছি আমি। রাফেলা আমাকে টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাচ্ছে। দুপা এগিয়ে ডেকে বিছানো মোটা কম্বলের ওপর ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ে নামিয়ে রাখলাম মূর্তিটা। ধাতুর তীক্ষ্ণ কিনারাগুলো দাঁত বসিয়ে দিয়েছে আমার হাতে, আর ওজনের চাপে টনটন করছে পেশীগুলো। হাত দুটোর যত্ন নেবার ফাঁকে সাগ্রহে কষে ফেললাম অঙ্কটা।

তিনশো পাউণ্ড। ষোলো আউন্সে এক পাউণ্ড। তার মানে চার হাজার আটশো আউন্স। এক আউন্স যদি পাঁচশো হয়, চার হাজার আটশো আউন্সে কত হয়? চব্বিশ লক্ষ টাকা! এটা শুধু একটা অংশ, শুধু মাথাটার মূল্য। সিংহাসনের আরও তিনটে অংশে রয়েছে। সেগুলো সম্ভবত এটার চেয়ে বেশি বড় আর ভারী। এরপর রয়েছে পাথরগুলো। সব যোগ করলে যোগফল দাড়াবে মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত। এখানেই শেষ নয়, যোগফলের সঙ্গে যোগ হবে শিল্পগুণ আর ঐতিহ্যের মূল্য-দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে সিংহাসনের সামগ্রিক মূল্যমান।

নিজেকে ক্ষান্ত করলাম আমি, এখন হিসেব করার সময় নয়। বাঘের মাথাটা কম্বল দিয়ে মুড়ছে রাফেলা, সেটাকে রশি দিয়ে বাঁধতে ওকে সাহায্য করলাম। কপিকলের সাহায্য নিয়ে কম্প্যানিয়নওয়ে মইয়ের কাছে নামিয়ে আনলাম বোঝাটাকে আমরা, ওখান থেকে আবার কপিকলের সঙ্গে বেঁধে ধীরে ধীরে গানডেকে নামিয়ে দিলাম।

গানপোর্টের অল্প পরিসর দিয়ে বোঝাটাকে বাইরে বের করে আনতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। দুজন ধরেছি ওটাকে, এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে এগোচ্ছে রাফেলা, আর পিছু হটছি আমি। অবশেষে কোথাও ধাক্কা না খেয়ে বেরিয়ে আসতে পারলাম। নাইলন কার্গো নেটের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম বোঝাটাকে, এয়ারব্যাগে বাতাস ভরে সেগুলোও নেটের সঙ্গে বাধার কাজ শেষ। করলাম। তারপর আবার আমাদেরকে হোয়েলবোটের ওপর মাস্তুল খাড়া করতে হল বোঝাটাকে ওপরে তোলার জন্যে।

হোয়েলবোটে নিরাপদে তুলে আনার পর বাঘের মাথাটাকে ঢেকে রাখতে হবে, মাথার দিব্যি দিয়ে এ-ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি। করেনি কেউ। তাই আবার আমার আর রাফেলার এবং এই প্রথম। রডরিক আর ল্যাম্পনির নয়ন সার্থক করার জন্যে কম্বলের ঘোমটা। সরিয়ে দিয়ে মাথাটাকে উন্মুক্ত করলাম আমি।

ঘোমটা খোলার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কদাকার পাহাড়ের গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিল রডরিক। আর ল্যাম্পনি নিশ্চলক চোখে আমার হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিল।

কম্বলটা সরে গিয়ে মাথাটা বেরিয়ে পড়তেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল রডরিক। আমরা সবাই দেখলাম, চিৎকার করে কেঁদে ফেলতে যাচ্ছে সে। তারপরই তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেলাম ল্যাম্পনির। পরমুহূর্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দেখলাম কান্নার ছাপটা রডরিকের মুখে হাসির ছাপে পরিণত হচ্ছে।

আনন্দ এবং লোভ চকচক করছে ওদের দুজনের চোখে। এই কদিনের অবরুদ্ধ উত্তেজনা বাধ ভাঙা বন্যার মত বেরিয়ে আসছে ওদের গলা থেকে। ঝাড়া দেড় মিনিট বিচিত্র, দুর্বোধ্য ধ্বনি সহযোগে প্রলাপ বকল রডরিক, চোখ উল্টে গেল ওর, মুখের মাংস ভাজের ওপর ভাঁজ খেল, এমন ঘন ঘন হাঁপাচ্ছে যেন পাঁচ মাইল দৌড়ে এসেছে, আর ল্যাম্পনি খুশিতে বারবার দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকছে নিজের, সারা শরীর কাঁপছে প্রচণ্ড উত্তেজনায়, ঝম ঝম বৃষ্টির সঙ্গে ধুয়ে যাচ্ছে ওর চোখের পানি।

বুদ্ধি করে, এই উৎসব মুহূর্তের কথা মনে রেখেই আমার গিয়ার ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছি স্কচ হুইস্কির একটা বোতল। উদার হস্তে সবার গ্লাস ভরে দিলাম আমি। এখন ওদের সঙ্গে হাসছে রাফেলাও, আমিও বাদ যাইনি।

এক সময় খালি গ্লাসটা পাশে নামিয়ে রেখে রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। আরেকবার ডাইভ দেব আমরা, সিদ্ধান্ত নিয়ে বললাম আমি। পাম্পটা আবার তুমি চালু করতে পার, রডরিক।

এখন আমরা জানি ঠিক কোথায় তল্লাশি চালাতে হবে। যে বাক্সটায় মাথাটা ছিল সেটার বাকি অংশ ভেঙে সরিয়ে ফেলার পর পেছনের ফাঁকটায় আরেকটা একই আকৃতির বাক্স দেখতে পেলাম আমি। সামনে এগোবার আগে হোস পাইপটা সেদিকে বাড়িয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে নিলাম।

এর আগে জেনি বার দিয়ে প্রথম বাক্সের বাকি অংশ ভাঙার জন্যে ঠোকাঠুকি করতে গিয়ে আমি সম্ভবত পেছনের বাক্সটার পচা প্ল্যাঙ্কগুলো আলগা করে ফেলেছিলাম, এবার হোস পাইপের একটু ছোঁয়া লাগতেই ভারী একটা পাঁচিলের মত ভেঙে পড়ে গেল কয়েকটা প্ল্যাঙ্ক। দ্রুত পিছিয়ে আসতে পারলাম বলে দুর্ঘটনা এড়াতে পারলাম, কিন্তু কাদায় এমনই ঘোলা হয়ে গেল পানি যে সম্পূর্ণ অন্ধের মত হাতড়াচ্ছি আশপাশটা, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

অন্ধকারে রাফেলাকে খুঁজছি আমি, আমাকেও খুঁজছে ও–আমাদের একটা করে হাত পরস্পরকে ছুঁয়েই শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। একটু চাপ দিয়ে আশ্বাস দিয়ে জানাল রাফেলা আহত হয়নি ও। আবার আমি হোসপাইপ ঘুরিয়ে ঘোলা পানি পরিষ্কার করতে লেগে গেলাম।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেশ খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এল পানি, নতুন কার্গোটার আকৃতি দেখতে পাচ্ছি। পাশে রাফেলাকে নিয়ে টর্চের আলোয় পথ দেখে হোল্ডের আরও ভেতরে ঢুকলাম আমরা।

কাঠের বহিরাবরণটা প্রায় অর্ধেক খসে পড়ে গেছে, আর। ভেতরে দেখতে পাচ্ছি চুপচাপ স্লান চেহারা নিয়ে বসে রয়েছে লোহার সিন্দুকটা। মরচে ধরে প্রায় ঝুরঝুরে বালির মত হয়ে গেছে সিন্দুকের বাইরের দেয়ালটা, হাত দিতেই খরখরে খড়িমাটির মত লাল আয়রন অক্সাইডের গুঁড়ো খসে পড়ল।

কেসটার দুদিকে ভারী দুটো আঙটা রয়েছে, এককালে এদুটো অনায়াসে ঘোরানো যেত, কিন্তু এখন সিন্দুকের মরচে ধরা গায়ের সঙ্গে শক্ত ভাবে আটকে গেছে। তবু আঙটার ভেতর হাত ঢোকাতে পারলাম আমি, অনেক টানা-হ্যাচড়া করে বাক্স আর। কাদার ভেতর থেকে বের করে আনলাম। জঞ্জাল সরিয়ে অনায়াসে শূন্যে তুলে নিলাম ওটাকে। আমার অনুমান, সব মিলিয়ে দেড়শো পাউণ্ডের কাছাকাছি হবে এটার ওজন, তার বেশি নয়। এই ওজনের বেশির ভাগটাই দখল করে রেখেছে লোহা, সন্দেহ নেই।

প্রকাণ্ড বাক্সটার তুলনায় এটা খুবই ছোট একটা বোঝা, জাহাজের ভেতর থেকে এটাকে বের করে আনতে কোন অসুবিধেই হল না আমাদের। একটা মাত্র এয়ার ব্যাগের সাহায্যে। সহজে তুলেও আনা গেল পানির ওপর।

বিপদের নোটিস নিয়ে গানফায়ার রীফ-এর পাঁচিল টপকাচ্ছে। স্রোত আর সাদা ফেনা, আমরা যখন সিন্দুকটা তুলতে চেষ্টা করছি হোয়েলবোট তখন এলোপাতাড়ি দুলছে, অস্থির ভাবে বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাইছে। বো-এর কাছে ক্যানভাস ঢাকা স্কুবা-বটলের ওপর রাখলাম ওটাকে আমরা। ইতিমধ্যে মোটর থেকে হোস খুলে ফেলে দেয়া হয়েছে পানিতে, ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বোটের নাক ঘুরিয়ে নিতে দেরি করল না রডরিক।

উত্তেজনার চরমে রয়েছি এখনও আমরা, মদের বোতলটা দ্রুত হাত বদল হচ্ছে আমাদের মধ্যে।

এখন রীতিমত একজন ধনী লোক তুমি, রডরিক, চিৎকার করে বললাম ওকে আমি। কি রকম লাগছে তোমার?

বোতলটা থেকে দুঢোক গিলে নিয়ে প্রথমে বিষম খাওয়া থেকে রক্ষা করল নিজেকে, তারপর খকখক করে কিছুক্ষণ কেশে নিয়ে নিঃশব্দে হাসল রডরিক।

বলল, আগের মতই আছি আমি, ম্যান। কোন পরিবর্তন নেই।

কিন্তু এভাবে এড়িয়ে যেতে দিল না ওকে রাফেলা, জেদের সুরে জানতে চাইল ও, তোমার ভাগটা কি করবে তুমি, রডরিক?

হ্যাঁ, বল, জানতে চাইলাম আমি, এই অগাধ সম্পদ কি কাজে লাগাবে তুমি?

ভাগটা তোমরা আমাকে অনেক দেরি করে দিলে, ম্যান, রডরিকের কদর্য চেহারায় বিষাদের ছায়া ফুটে উঠল। এই ভাগটা যদি আজ থেকে পনেরো-বিশ বছর আগে পেতাম, হ্যাঁ, তখন এটা কাজে লাগত বটে। বোতল থেকে আরেক ঢোক খেল সে। এই-ই আসলে হয়। যখন তুমি যুবক, তখন শত চেষ্টা করলেও পাবে না। আর যখন বুড়ো হতে চলেছ তখন না চাইতেই পেয়ে যাবে। তোমাদের বেলায় অবশ্য উল্টোটা ঘটেছে।

তোমার বক্তব্যটা কি, ল্যাম্পনি? জানতে চাইল রাফেলা।

কোঁকড়ানো লম্বা চুল ভিজছে ল্যাম্পনির, দুহাত দিয়ে মুখের দুপাশ থেকে সেগুলো সরাল সে। কিন্তু চুপ করে আছে, যেন শুনতেই পায়নি রাফেলার প্রশ্ন। কি হল, বল! তাড়া লাগাল রাফেলা। তুমি তো এখনও যুবক, নিশ্চয়ই কোন স্বপ্ন আছে তোমার?

নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে ফিক করে হেসে ফেলল ল্যাম্পনি। বলল, মিস রাফেলা, সেই থেকে এখানে বসে ওই কথাই ভাবছিলাম এতক্ষণ। ইতিমধ্যেই একটা তালিকা তৈরি করেছি যেটা এখান থেকে সেন্ট মেরী, সেন্ট মেরী থেকে এখানে, তারপর আবার সেন্ট মেরীতে গিয়ে পৌঁছবে-এত লম্বা।

সৈকত থেকে গুহায় দুবার যাওয়া-আসা করতে হল আমাদেরকে বাঘের মাথা আর লোহার সিন্দুকটা বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। একটা গুহা আমরা স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার করছি, তাতে ঢুকিয়ে দিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানো হল ওগুলোকে।

একটা হ্যাক-স আর জেনি বার নিয়ে সিন্দুকটার তালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি আর রডরিক। কাজটা সহজ তো নয়ই, বরং সাংঘাতিক কঠিন লাগছে। মরচের নিচে আশ্চর্য শক্ত হয়ে গেছে লোহা। প্রথম আধঘন্টায় তিনটে হ্যাকস ব্লেড ভাঙলাম আমরা। আর রাগের মাথায় আমার মুখ থেকে যেসব গালিগালাজ। বেরিয়ে এল সেগুলো প্রচুর হাসির খোরাক হয়ে উঠল রাফেলার জন্যে। কিন্তু একটু পর ওই একই জিনিস লজ্জায় লাল করে তুলল ওর মুখের চেহারা। আমার সহকর্মীদের উৎসাহ বাড়াবার জন্যে ওকে একটা হুইস্কির বোতল খুঁজে আনতে পাঠিয়ে দিলাম আমি।

বিশ্রাম নেবার পর নতুন উদ্যমে কাজে হাত দিলাম আবার আমরা। মূল তালাটা এতবড় আর মোটা যে সেটা ভাঙার চেষ্টাই করছি না আমরা। সিন্দুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দুপাশের তিনটে তিনটে মোট ছয়টা রডের সঙ্গে ঝুলছে সেটা, এই রডগুলোকে কেটে ফেলে তালাটাকে আলাদা করতে হবে আমাদেরকে। কাজটা সাংঘাতিক কঠিন। মাত্র দুটো রড কাটতেই সন্ধ্যা উতরে গেল। পরিশ্রম বিবেচনা করে আরেকবার বিরতি ঘোষণা করলাম আমি।

কফির জায়গা আজ পুরোপুরি দখল নিয়েছে স্কচ হুইস্কি, এতে সবচেয়ে বেশি খুশি রডরিক। সবার চেয়ে বেশি ঢালছে সে গলায়, আরও দাবি করছে। আলোচনার সময় সবার পরামর্শ চাইলাম আমি, ল্যাম্পনি বলল, হাফস্টিক জেলিগনাইট ব্যবহার করলে কেমন হয়, স্কিপার?

সত্যি, কেমন হয়? দ্রুত জানতে চাইল রডরিক, বিস্ফোরণ ঘটাবার লোভে চকচক করছে চোখ দুটো ওর।

এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে নিরাশ করলাম ওদেরকে আমি।

আসলে আমাদের একটা ওয়েল্ডিং টর্চ দরকার, বলল ল্যাম্পনি।

চমৎকার! এতটা বিরক্ত বোধ করছি যে বিদ্রুপ না করে পারলাম না। সবচেয়ে কাছের ওয়েল্ডিং সেটটা এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে রয়েছে-কথা খুঁজে পেলে না আর?

দুটো গ্যাস লণ্ঠন জ্বলছে গুহার ভেতর, সিন্দুকটাকে ঘিরে বসে আছি আমরা। সোনার মাথাটা সম্মানের উঁচু একটা আসনে বসে হিংস্র ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। গুহার পেছনের দিকে দেয়ালের একটা শেলফে তুলে রেখেছে ওটাকে রডরিক। আমরা সবাই হতাশ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি, একা সিন্দুকটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে রাফেলা, কি যেন আবিষ্কার করতে চাইছে ও।

অবাক কাণ্ড, সত্যি সত্যি সিন্দুকটা খোলার একটা উপায় আবিষ্কার করে ফেলল ও।

দুভাবে খোলা যায় সিন্দুকটা, এটা কিভাবে যেন বুঝতে পারে রাফেলা। ঢাকনির গায়ে একই মাপের পাশাপাশি এবং কয়েক সারি খাঁদ রয়েছে, খাদের ওপর রয়েছে লোহার সেতু। সবগুলো সেতুকে পেঁচিয়ে এগিয়ে গেছে একটা রড, রডটা ঢাকনির কিনারার কাছে একটা গর্তের ভেতর ঢুকে গেছে। এই গর্তের ভেতর দিকের দেয়ালে একটা ছোট্ট ফুটো আবিষ্কার করেছে। রাফেলা। আঙুল দিয়ে স্পর্শ করেই বুঝলাম এটা একটা চাবির গর্ত।

কিন্তু চাবি পাব কোথায়! দুই ইঞ্চি লম্বা একটা পেরেক গর্তটার ভেতর ঢোকালাম আমি, জানি এতে কাজ হবে না, কিন্তু পেরেকটা একটু ঘোরাতেই খট করে শব্দ বেরিয়ে এল ভেতর থেকে, সঙ্গে সঙ্গে সব কটা সেতু মাঝখান থেকে দুভাগ হয়ে গিয়ে খাদের ওপর থেকে দুপাশে সরে গেল। এরপর বাঁকানো রডটাকে খাদ থেকে তুলে ফেলতে কোন অসুবিধেই হল না।

ঢাকনিটা এখন তুলে ফেলা যেতে পরে। কিন্তু ইচ্ছা করে। দেরি করছি আমি, সবাইকে আরও কিছু উত্তেজনা উপভোগ করার সুযোগ দিচ্ছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসল রাফেলা। তিন সেকেণ্ডের বেশি যদি দেরি কর, তোমার। বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনব আমি…।

আমরা আপনাকে সমর্থন করব, জানিয়ে দিল রডরিক।

আর ল্যাম্পনি সেকেণ্ড গুণতে শুরু করে দিল, এক…দুই…

ঢাকনিটা তুললাম আমি। একটা দুর্গন্ধ ঢুকল নাকে। ঢাকনির উল্টোদিকের গায়ে সেঁটে আছে গাঢ় রঙের পচা কাপড়। সিন্দুকের ভেতর দেখতে পাচ্ছি কাপড়ের একটা স্তর, ভিজে নিরেট একটা হঁটের মত দেখাচ্ছে। স্তরটা সিন্দুক থেকে বের করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এটার নিচে একই ধরনের আরেকটা কাপড়ের নরম স্তর রয়েছে।

সাবধানে, রানা! সর্তক করে দিয়ে বলে উঠল আমার ঘাড়ের। ওপর থেকে রাফেলা। কাপড়গুলো শুধু ঢাকনি নয়, ওগুলোই প্যাকেট-ভেতরে কিছু আছে। সরবে তুমি? নরম হাতে নাড়াচাড়া করা দরকার ওগুলো। উদারচিত্তে সুযোগটা দান করলাম ওকে আমি। একটু সরে জায়গা ছেড়ে দিলাম।

হাত নাড়ার জায়গা করার জন্যে দুপাশ থেকে সবাইকে সরিয়ে দিল রাফেলা, আলতোভাবে ধরে সিন্দুকের ভেতর থেকে তুলে আনল ওপরের ভিজে কাপড়ের স্তরটা।

প্রত্যেকটি সুতো দিয়ে বাঁধা, ছুঁতে না ছুঁতেই ছিঁড়ে যাচ্ছে সুতোগুলো। প্রথম প্যাকেটটা হাতে নিয়েছে রাফেলা, এক সেকেণ্ড পরই কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেল সেটা। মোনাজাতের ভঙ্গিতে দুই হাত এক করে ভেঙে যাওয়া পার্সেলটা ধরে আছে ও, সেটাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল সিন্দুকের পাশে ভাঁজ করা তারপুলিনে। পার্সেল থেকে বেরিয়ে পড়েছে খুদে আকৃতির অসংখ্য শক্ত জিনিস, দিয়াশলাই শলাকার মাথার চেয়ে একটু বড় থেকে শুরু করে পাকা আঙুরের সমান পর্যন্ত আছে। প্রতিটি কাগজ দিয়ে মোড়া, কাপড়ের মতই পচে গেছে। এর একটা বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে তুলে নিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে ঘষল রাফেলা, পচা কাগজ কাদার মত সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল বড় একটা নীল পাথর, চৌকো করে কাটা, মাত্র একটা দিক পালিশ করা।

স্যাফায়ার? জিজ্ঞেস করল ও। ওর হাত থেকে পাথরটা নিলাম আমি, গ্যাস লণ্ঠনের আলোয় পরীক্ষা করে দ্বিমত প্রকাশ করলাম।

না। এটা সম্ভবত ল্যাপিজ লাজুলাই। নীল কাগজের কণা এখনও লেগে রয়েছে পাথরটার গায়ে, পাথরের রঙ তাতে একটু নীলচে দেখাচ্ছে। কাগজের মোড়কে কালি দিয়ে কিছু লিখে রেখেছিল কর্নেল গুডচাইল্ড, যাতে পাথরগুলো আলাদাভাবে চেনা যায়, অর্থাৎ সিংহাসনের নির্দিষ্ট জায়গায় পাথরগুলো যাতে আবার বসাতে কোন অসুবিধে না হয়।

এখন আর তা সম্ভব হবে না, বলল রাফেলা।

ঠিক বলতে পারছি না, বললাম আমি। কাজটা কঠিন হতে পারে, কিন্তু একেবারে অসম্ভব হবে বলে মনে করি না। চেষ্টা করলে পাথরগুলো নির্দিষ্ট খোপে বসিয়ে দিতে পারব।

প্লাস্টিকের কিছু প্যাকেট আনতে পাঠালাম ল্যাম্পনিকে। কাগজে মোড়া একটা করে পার্সেল বের করছে রাফেলা, তালুতে রেখে প্রতিটা পাথর ঘষে পরিষ্কার করছি আমরা, আর সেই পার্সেলের সমস্ত পাথর একটা আলাদা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে রাখছি।

তাড়াহুড়োর কাজ নয় এটা, সবাই মিলে দুঘন্টা খাটনি দেবার পর বারোটা প্যাকেটে কয়েক হাজার অমূল্য পাথর ভরতে পারলাম আমরা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ল্যাপিজ লাজুলাই, ক্রাইসো বেরিল, টাইগারস আই, গারনেট, ভারডাইট, এমিথিস্ট। আরও ছয়টা প্লাস্টিকের প্যাকেট ভরেছি আমরা, কিন্তু এই পাথরগুলো পরিচিত নয় আমাদের।

পচা কাগজের শেষ স্তর থেকে একটা পার্সেল বের করছে রাফেলা, দেখেই বুঝলাম আমরা, এটার ভেতর বড় পাথরগুলো রয়েছে। রাফেলার হাত থেকে নিয়ে মোড়কটা খুললাম আমি, গ্যাস লণ্ঠনের আলোয় সবুজ তারার মত জ্বলজ্বল করছে আমার হাতে অনেকগুলো বড় আকৃতির এমারেল্ড। রুদ্ধ হয়ে গেছে আমাদের সবার নিঃশ্বাস, মুগ্ধ চোখে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে। আছি পাথরগুলোর দিকে।

ধীরে ধীরে তারপুলিনের ওপর নামিয়ে রাখলাম আমি। এমারেল্ডগুলো। সিন্দুক থেকে শেষ পার্সেলটা বের করার জন্যে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে রাফেলা। অপেক্ষাকৃত ছোট একটা মোড়ক বের করে আনল ও। কাগজের পচা কাদা সরিয়ে দিতেই ছ্যাৎ করে উঠল আমার বুক। মোড়কে এই একটাই পাথর রয়েছে।

অঞ্জলির মাঝখানে ধরে আছে পাথরটা রাফেলা। হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে ওর।

এটাই সেই গ্রেট মুঘল ডায়মণ্ড? কথাটা কানে ঢোকার পর আবিষ্কার করলাম শব্দগুলো আমার গলা থেকেই বেরিয়েছে।

মুরগির ছোট একটা ডিমের মত আকার পাথরটার। কয়েকশো বছর আগে এর যে বর্ণনা দিয়েছিল ব্যাপ্টিস্ট তাভেরনিয়ের তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।

একটু আগে পর্যন্ত যে-সব পাথর নাড়াচাড়া করেছি আমরা সেগুলোর সমস্ত উজ্জ্বলতা এক করলেও এই একটা পাথরের উজ্জ্বলতার কাছে তা ম্লান, নিশ্ৰুভ বলে মনে হবে। মাত্র একটা সূর্যের উদয় যেমন গোটা আকাশের সমস্ত তারার উজ্জ্বলতা ম্লান। করে দেয়, এ-ও যেন ঠিক তেমনি।

কাঁপা হাত দুটো ধীরে ধীরে ল্যাম্পনির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে রাফেলা। পাথরটা ধরে পরীক্ষা করার সুযোগ দিতে চাইছে তাকে ও। কিন্তু বিদ্যুৎবেগে নিজের হাত দুটো সরিয়ে নিল ল্যাম্পনি, মুঠো করা হাত দুটো পিঠের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে, এখনও পাথরটার দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ফারিত, মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে।

গোটা শরীরের সঙ্গে ডায়মণ্ড ধরা হাত দুটো এবার রডরিকের দিকে ঘোরাল রাফেলা, বাড়িয়ে ধরল তার দিকে, কিন্তু রডরিকও গ্রেট মুঘল ছুঁতে রাজি হল না। গম্ভীর ভাবে বলল সে, মিস রাফেলা, আপনি মাসুদকে দিন ওটা। ওর অধিকার সবার আগে।

রাফেলার হাত থেকে নিলাম ওটা। এমন অপার্থিব একটা আগুনের ছোঁয়া এত ঠাণ্ডা লাগছে অনুভব করে আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি। উঠে দাঁড়ালাম, ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি বাঘটার দিকে। লণ্ঠনের আলোয় ঝলমল করছে সোনা রঙ। প্রচণ্ড আক্রোশে মুখ ব্যাদান করে আছে বাঘটা, তার খালি কোটরে ঢুকিয়ে দিলাম আমি ডায়মণ্ড।

খাপে খাপে বসে গেল ডায়মণ্ডটা, বেইট-নাইফ দিয়ে সোনার হুকগুলো ঘুরিয়ে বসিয়ে দিলাম জায়গা মত। এই হুকগুলো প্রায় একশো বছর আগে কর্নেল গুডচাইল্ড সম্ভবত বেয়োনেটের ডগা দিয়ে খুলেছিল।

পিছিয়ে এলাম আমি, ওদের চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ। পাচ্ছি। চাপা গলায় ফিসফিস করছে ওরা। গর্তে চোখটা ফিরে আসায় সোনার জানোয়ারটা জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। তার চেহারা আর ভঙ্গির মধ্যে এখন শুধু অন্ধ আক্রোশ নয়, তার সঙ্গে প্রচণ্ড শক্তির একটা ভাব ফুটে উঠেছে। এই বুঝি তার বিকট গর্জনে সমস্ত গুহাটা থরথর করে কেঁপে উঠল।

পিছিয়ে এসে সিন্দুকের পাশে সবার সঙ্গে বসলাম আমি। সবাই মুখ তুলে তাকিয়ে আছি সোনার মাথাটার দিকে।

রডরিক, ভাই আমার, আমার প্রাণের বন্ধু! তোমার নামটা হৃদয়ে সোনার হরফে যদি লিখে রাখতে চাও-এই সুযোগটা হাতছাড়া কোরো না।

মুখের মাংস ভাঁজ খেয়ে চেহারাটা কদাকার হয়ে গেল রডরিকের, সঙ্গে সঙ্গে সাগ্রহে জানতে চাইল সে, কি করতে হবে আমাকে, মাসুদ?

স্রেফ হুইস্কির বোতলটা বাড়িয়ে দাও এদিকে, বললাম আমি।

একবার নিস্তব্ধতা ভেঙে যাওয়ায়, সবাই যেন নিজেদের কণ্ঠস্বর ফিরে পেল, একজন আরেকজনকে থামিয়ে দিয়ে কথা। বলে উঠতে চাইছে। বেশিক্ষণ কাটল না, শুকনো গলা ভেজাবার জন্যে হুইস্কির আরেকটা বোতল বরাদ্দের জন্যে অনুরোধ করতে হল আমাকে, আমার আবেদন সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্জুর করল রাফেলা।

সেদিন অনেকরাত পর্যন্ত চালিয়ে গেলাম আমরা। এমন কি রাফেলা বার্ডেরও নেশা হল একটু। বৃষ্টিতে ভিজে নিজেদের গুহায় ফেরার সময় আমার গায়ে হেলান দিয়ে আছে ও।

সত্যি তুমি আমাকে নষ্ট করে ফেলছ, মাসুদ রানা, হোঁচট খেয়ে আমাকে নিয়ে পড়ে যাচ্ছিল রাফেলা, কোনমতে সামলে নিয়ে বলল ও। এই প্রথম মদ খেয়ে টলছি আমি।

নষ্টের দেখেছ কি, এই তো সবে শুরু, ওকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বললাম আমি। একটু পরই দিচ্ছি তোমাকে নষ্টামীর পরবর্তী ট্রেনিং।

কেন যেন ভয় করছে আমার, রানা, হঠাৎ প্রসঙ্গ এবং গলার সুর বদলে আমাকে চমকে দিল রাফেলা।

কিসের ভয়, রাফেলা?

ভাবছি, বুমেরাং আর সিডনি শেরিডানের কথা মনে পড়ে যাওয়াতে ভয় পাচ্ছে রাফেলা। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়।

অপ্রত্যাশিতভাবে সম্পূর্ণ নতুন প্রসঙ্গে কথা বলছে ও।

ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে যদি কোনদিন আমাদের মধ্যেও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়…দোষ যারই হোক, ধর আমিই না হয় দায়ী-তখন কি তুমি পারবে আমাকে ক্ষমা করতে?

হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন, রাফেলা? সাবধানে জানতে চাইলাম আমি।

একটু বেশি খেয়েছি তো, তাই আজেবাজে চিন্তা ঢুকছে মাথায়-ভুলে যাও, রানা।

ভাবছি, আসলেই কি তাই? রাফেলার ভয়টার পেছনে কি নিরেট কোন ভিত নেই? আজেবাজে বলে যেটাকে চেপে যেতে চাইছে তা কি সত্যি তাই?

আমি বিশ্বাস করি না।

রাত শেষ হবার আগেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। পাশে শুয়ে আছে রাফেলা, একই মাপের মৃদু নিঃশ্বাস পতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি ওর। আলগোছে উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে। ঠাণ্ডা লাগছে, তাই শর্টস আর উলেন জার্সি পরে নিলাম।

গুহার বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি পশ্চিমা বাতাসে ভাঙন ধরেছে মেঘের স্তরে। কখন যেন থেমে গেছে বৃষ্টি, মেঘের ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বলে তারা, তাদের আলোয়। চোখের সামনে হাত তুলে রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। তিনটে। বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে।

পেচ্ছাব করে ফিরে যাবার সময় দেখলাম আমাদের স্টোররুমে আলো জ্বলছে, গ্যাস লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। ফেরার পথে গুহার ভেতর ঢুকব বলে মুখের সামনে দাঁড়িয়েছি। খোলা সিন্দুকটা যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানেই পড়ে রয়েছে, বাঘের অমূল্য মাথাটাও রয়েছে জায়গা মত, তার কপালে আগুনের মত জ্বলছে গ্রেট মুঘল। আচমকা একটা আতঙ্কের ঢেউ বয়ে গেল আমার শরীরে। চোর সবখানেই আছে, সাবধানের মার নেই-হঠাৎ আশঙ্কাটা অস্থির করে তুলল। আমাকে।

গুপ্তধন যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা নিরাপদ কোথাও সরিয়ে ফেলতে হবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। কাল সকালে নয়, এখনই। মদের নেশা কাটেনি আমার, মাথাটা ব্যথা করছে, কিন্তু এ কাজটা আমি ফেলে রাখতে পারি না। তবে একার কাজ নয়। এটা, সাহায্য লাগবে আমার।

ওদের গুহার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় একবার ডাকতেই ডোরা কাটা পাজামা পরে নিঃশব্দে বুনো একটা ভালুকের মত বেরিয়ে এল রডরিক তারার আলোয়। সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে ও, কিন্তু ঘুমের লেশমাত্র নেই চোখে। আমার ডাক শুনেই সতর্ক, হুঁশিয়ার হয়ে উঠেছে-নিমেষে ছুটে গেছে মদের নেশা।

আমার ভয়ের কথাটা বললাম ওকে। ঘোঁৎ করে একটা চাপা হুঙ্কার ছাড়ল ও, তারপর আমার সঙ্গে রওনা হল স্টোরেজ গুহার দিকে। পাথর ভর্তি প্লাস্টিক প্যাকেটগুলো এক এক করে সিন্দুকে ভরলাম আমরা, ঢাকনিটা বন্ধ করে নাইলনের রশি দিয়ে জড়িয়ে বাঁধলাম। একটা ক্যানভাস তারপুলিন দিয়ে সোনার মাথাটাকে মুড়ে ফেলল রডরিক। বোঝা দুটো কাঁধে তুলে নিয়ে নারকেল বাগানের দিকে রওনা হলাম দুজন। এরপর আবার ফিরে আসতে হল গ্যাস লণ্ঠন আর কোদাল নিয়ে যাবার জন্যে।

লণ্ঠনের আলোয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাজ করছি আমরা। জেলিগনাইট আর স্পেয়ার ম্যাগাজিনসহ এফ. এন কারবাইনটা যেখানে রয়েছে সেখান থেকে কয়েক ফুট দূরে বেলে-মাটি খুঁড়ে দুটো অগভীর গর্ত তৈরি করলাম আমরা। বোঝা দুটো গর্তের ভেতর নামিয়ে মাটি চাপা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপর অত্যন্ত সাবধানে জায়গাটা থেকে আমাদের উপস্থিতির সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার কাজে আধঘন্টা সময় ব্যয় করলাম।

এখন তুমি খুশি, মাসুদ? অবশেষে কথা বলল রডরিক।

হ্যাঁ, রডরিক, এখন আমি খুশি। এবার তুমি যাও, সোজা বিছানায় ফিরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম দাও।

নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে হাতে লণ্ঠন নিয়ে ফিরে যাচ্ছে রডরিক, একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না ও।

এখন আর চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে না আমার, মাটি কাটার খাটনি দিতে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে মাথাটা, জেগে উঠেছে শরীরের ভেতর রক্ত। গুহায় ফিরে গিয়ে সকাল না হওয়া পর্যন্ত রাফেলার পাশে চুপচাপ শুয়ে জেগে থাকার কোন মানে হয় না।

নির্জন আর গোপন একটা জায়গা দরকার এখন আমার। নিবিষ্ট মনে কিছু চিন্তা করতে চাই। যে জুয়া খেলায় জড়িয়ে রয়েছি আমি সেই খেলার পরবর্তী চাল কি হবে তা এখন ভেবে বের করা দরকার আমার। নিচু পাহাড় সারির মাঝখানে ঝুলবারান্দাগুলোর কথা মনে পড়তে সে-পথে পা বাড়ালাম আমি। ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করেছি, এই সময় বাকি মেঘগুলোকে ঝেটিয়ে নিয়ে গেল বাতাস, হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল হলুদ চাঁদটা। পূর্ণ যুবতী হতে এখনও ছয়দিন বাকি ওর। ঝুলবারান্দা থেকে সবচেয়ে কাছের একটা চূড়ায় উঠলাম আমি। বাতাসের ধাক্কা লাগবে না এমন একটা জায়গা বেছে বের করে বসলাম। একটা চুরুট থাকলে ভাল হত, মাথাটা আরও হালকা হলে খুশি। হতাম-কিন্তু এসব নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই কোন।

আধঘন্টা পর দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম-এ পর্যন্ত যা উদ্ধার করা গেছে তা সিডনি শেরিডানের নাগালের বাইরে সরিয়ে ফেলতে হবে। সুযোগ আর সময়ের অপেক্ষায় আছে ওরা, যে-কোন মুহূর্তে হানা দিতে পারে। তার আগেই সাবধান হওয়া উচিত আমার। ঠিক করলাম, ভোরের আলো ফুটলেই বাঘের মাথা আর সিন্দুকের পাথর হোয়েলবোটে তুলে নিয়ে রওনা হয়ে যাব সেন্ট মেরীর উদ্দেশে। সতর্কতার সঙ্গে তৈরি করা আমার প্ল্যান অনুসারেই। ওগুলোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব।

পরে আরও অনেক সময় পাব আমরা গানফায়ার রীফে ফিরে এসে পুলের তলা থেকে বাকি যা আছে উদ্ধার করার।

সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে যেতে স্বস্তির পরশে শরীর আর মন হালকা। হয়ে গেল আমার। নতুন উদ্যমে পরবর্তী বৃহত্তম ধাধা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করলাম আমি।

মিস রাফেলা বার্ড। অকুণ্ঠচিত্তে নিজের কাছে স্বীকার করলাম, হ্যাঁ, ওকে আমি ভালবাসি। কথাটা যখন মেনে নিচ্ছি, অদ্ভুত এক স্বর্গীয় পুলক অনুভব করলাম শরীরে। কিন্তু পরমুহূর্তে মনে পড়ল, ভালবাসি ঠিক, কিন্তু ওকে আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। এখনও আমার কাছে মস্ত একটা ধাঁধা হয়েই রয়েছে ও। আর কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ের প্রস্তাব দেব ওকে আমি। যা কিছু আমার কাছে সাবধানে গোপন করে রেখেছে ও, তখন সবই প্রকাশ হয়ে পড়বে। ওর চোখের নীল গভীরে ওই কালো ছায়া কিসের, জানতে চাই আমি। ওকে ঘিরে রয়েছে এমন আরও অনেক রহস্যের উত্তর চাই।

এতক্ষণে আলো ফুটছে পুব আকাশে। মহাসাগরের কালো। কর্কশ শরীর আলোর ছোঁয়ায় কোমল চেহারা ফিরে পাচ্ছে। আড়ষ্ট। ভঙ্গিতে পাথর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি, বাতাসের তোড়ের মুখে বেরিয়ে এসে ধীর পায়ে নামছি নিচের দিকে।

চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে বাতাস। পথ হারিয়ে যাতে অন্যদিকে চলে না যাই তার জন্যে মাঝে-মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখে নিচ্ছি সামনেটা। অনেকটা নিচে দেখা যাচ্ছে আমাদের ক্যাম্প এলাকা।

বাতাসের চাপে আরেকবার দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। নিচের দিকে, দূরে তাকিয়ে আছি। খাড়ির একটা বাহু দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে। ভোরের আলো ভাল করে ফোটেনি এখনও, তবু বে-র খোলা বাহুর দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম নিঃশব্দে গুটি গুটি এগিয়ে আসছে একটা কালো ছায়া, দুঃস্বপ্নের মত, ভয়ঙ্কর।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার সময় ছায়াটার বো-এর কাছে পানি ছলকে উঠতে দেখে বুঝতে পারলাম নোঙর ফেলা হল। বাতাসে ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে সেটা, লম্বা শরীরের একটা পাশ পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছি এখন। এখন আর কোন সন্দেহ নেই আমার। বুমেরাংই।

আমার হুঁশ ফেরার আগেই ইয়ট থেকে একটা বোট নামানো হয়ে গেল। দ্রুত সৈকতের দিকে এগিয়ে আসছে সেটা।

ছুটতে শুরু করলাম আমি।

.

পথের ওপর আছাড় খেয়ে পড়লাম একবার, কিন্তু চূড়া থেকে মাথা নিচু করে ছুটে নামার তীব্র গতি এগিয়ে নিয়ে এল আমাকে, মাত্র একটা গড়ান দিয়ে স্প্রিঙের মত আবার আমি খাড়া হয়ে গেছি, দৌড়ের মধ্যে রয়েছি এখনও, ঢিমে হয়ে পড়েনি গতি।

একটা বিস্ফোরণের মত ঢুকলাম ওদের গুহায়। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছি। চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, গলার দুপাশের রগগুলো ফুলে উঠল আমার, ওঠ, রডরিক, ওঠ! এরই মধ্যে সৈকতে পৌঁছে গেছে ওরা!

হাত-পা ছুঁড়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল ওরা। এলোমেলো হয়ে রয়েছে ল্যাম্পনির মাথার চুল, চোখে পিচুটি আর ঘুম ঘুম ভ্যাবাচ্যাকা ভাব। কিন্তু রডরিক স্থির, সতর্ক আর প্রস্তুত।

রডরিক, দ্রুত বললাম ওকে, যাও, মাটির নিচ থেকে আমাদের সবেধন নীলমণিটাকে নিয়ে এসো। কুইক, ম্যান! নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে ওরা।

কথা বলছি, এরই মধ্যে পোশাক পাল্টে শার্ট আর প্যান্ট পরে নিয়েছে ও, কোমরে কষে বেঁধে নিচ্ছে বেল্টটা। গুহা থেকে ভোরের ম্লান আলোয় ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে, পেছন থেকে চিৎকার করে বললাম, এক মিনিটের মধ্যে তোমার পিছু নিচ্ছি আমি।

ল্যাম্পনির কাঁধ ধরে ঝাঁকালাম ওকে। বোকার মত তাকিয়ে থেকো না। ঘুম থেকে জাগো! আমি চাই মিস রাফেলার ভার। নেবে তুমি, বুঝতে পারছ?

কাপড় পরা শেষ হয়েছে ওর, আমার প্রশ্নের উত্তরে কাত করল মাথাটা।

এসো, প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি আমাদের গুহার দিকে, ল্যাম্পনিকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছি আমি। বিছানা থেকে। তুলে দাঁড় করিয়ে দিলাম রাফেলাকে। কাপড় পরতে শুরু করেছে। ও, কি করতে হবে বুঝিয়ে দিচ্ছি ওকে দ্রুত।

তোমার সঙ্গে ল্যাম্পনি যাচ্ছে। এক ক্যান খাবার পানি নেবে তোমরা। কোথাও না থেমে সোজা চলে যাবে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে। তার আগে পাহাড় সারির মাঝখানের কার্নিস পেরিয়ে গা ঢাকা দিয়ে নেবে। চূড়ায় উঠে যেখানে ফার্স্ট মেট বারলোর লেখাটা দেখেছিলাম, সেই চিমনিতে লুকিয়ে থাকবে। বুঝতে। পারছ কোন জায়গাটার কথা বলছি?

পারছি, রানা, ঘাড় কাত করে বলল রাফেলা।

ওখান থেকে নড়বে না। কোন পরিস্থিতিতেই নিচে নামবে না। বা ওপরে উঠে মুখ দেখাবে না। মনে থাকবে?

কোমরে শার্ট খুঁজছে রাফেলা, আবার ঘাড় কাত করল সে।

মনে রেখ, এই লোকগুলো খুনী। এখন আর ব্যাপারটা পিকনিক বা খেলা নয়। আমরা একদল হিংস্র নেকড়ের সামনাসামনি হয়েছি।

হ্যাঁ, রানা-আমি জানি।

যাও তাহলে, জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম ওকে। একটু ইতস্তত করে বললাম, আবার দেখা হবে।

দ্রুত বেরিয়ে গেল ওরা গুহা থেকে। পাঁচ গ্যালনের পানি ভর্তি ক্যানটা কাঁধে তুলে নিয়েছে ল্যাম্পনি, তার পেছনে দৌড়াচ্ছে ভীত-সন্ত্রস্ত রাফেলা। নারকেল বনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল দুজন।

হালকা হ্যাভারস্যাকে দ্রুত কয়েকটা জিনিস ভরে নিলাম আমি। এক বাক্স চুরুট, দিয়াশলাই, বিনকিউলার, পানির বোতল, ভারী একটা জার্সি, এক প্যাকেট চকলেট, টর্চ-এইসব। বেইটনাইফের খাপসহ বেল্টটা বেঁধে নিলাম কোমরে, হ্যাভারস্যাকের স্ট্র্যাপটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে আমিও, নারকেল সারির ভেতর দিয়ে রডরিকের পথ অনুসরণ করে সৈকতের দিকে যাচ্ছি।

পঞ্চাশ গজ দৌড়েছি, এই সময় গুলি হল। ভোরের নিস্তব্ধতাকে টুকরো করে দিল একটা পিস্তল, একটা চিৎকার ঢুকল কানে, তারপর আবার একটা গুলির আওয়াজ। আমার সরাসরি সামনের দিক থেকে আসছে এসব। খুব কাছাকাছি কোথাও থেকে।

দৌড় থামিয়ে একটা নারকেল গাছের গুড়ির পেছনে গা ঢাকা দিয়ে বসে পড়েছি আমি। উঁকি দিয়ে যেদিকটায় আলো দেখছি সেদিকে তাকিয়ে আমি। প্রথমে আওয়াজটা ঢুকল কানে। কেউ ছুটে আসছে। তারপর অস্পষ্ট আলোয় দেখতে পেলাম মূর্তিটা। সোজা আমার দিকেই চলে আসছে। দ্রুত খাপ থেকে টেনে নিচ্ছি বেইট-নাইফটা।

কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিলাম, তারপর মৃদু কণ্ঠে ডাকলাম, এদিকে!

বিনন করে ঘুরে গেল আমার দিকে ছুটন্ত মূর্তিটা। দ্রুত তালে, তবে খুব কম শব্দ করে হাঁপাচ্ছে রডরিক। এফ. এন। রাইফেল আর ক্যানভাসে মোড়া স্পেয়ার ম্যাগাজিনের প্যাকেটটা নিয়ে এসেছে ও। আমাকে দেখতে পেয়ে গতি মন্থর না করেই কাছে চলে এল, একটা ঝাঁকি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আচমকা।

ওরা দেখে ফেলেছে আমাকে, রুদ্ধশ্বাসে বলল ও। বেজন্মারা অনেক লোক।

ওর কথা শেষ হবার আগেই গাছের ফাঁকে আরও নড়াচড়া লক্ষ্য করলাম আমি। ওই আসছে, চাপা গলায় সতর্ক করে দিলাম ওকে। চল যাই।

নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে দিতে চাই রাফেলাকে, তাই পাহাড় সারির মাঝখানের পথটা এড়িয়ে গেলাম, সরাসরি ছুটছি দক্ষিণ দিকে। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের পানিতে ডোবা আগাছা আর কাদার বিস্তৃতির দিকে যাচ্ছি।

দেখে ফেলল আমাদেরকে ওরা। আলোছায়ায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো, ওদের সামনে দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে ছুটছি আমরা-চেঁচিয়ে উঠল একজন। চিৎকারটা থামার আগেই কাছেপিঠে থেকে পাঁচটা গুলির শব্দ হল, গাছের ফাঁকে পিস্তলের মাজলে আগুনের ঝলক দেখতে পেলাম। আমাদের মাথার ওপর গিয়ে ছুটে গিয়ে একটা বুলেট নারকেল গাছের গায়ে বিধল। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি আমরা, কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের চেঁচামেচি অস্পষ্ট হয়ে এল আমাদের পেছনে।

পানিতে ডোবা আগাছার কিনারায় পৌঁছেছি আমরা, চটচটে কাদা এড়াবার জন্যে বাঁক নিয়ে একই গতিতে দৌড়াচ্ছি। পাহাড় সারির প্রথম ঢালের গোড়ায় এসে থামলাম, দম নিচ্ছি, কান খাড়া করে শুনছি। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে উজ্জ্বল আলো। একটু পরেই সূর্য উঠবে, তার আগে গা ঢাকা দিতে চাই আমি।

জলমগ্ন কাদার দিক থেকে হঠাৎ একটা হৈ-চৈ ভেসে এল। চেঁচামেচির মধ্যে পরিষ্কার টের পাচ্ছি হতাশার সুর। সামনে কাদা দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে ওরা, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারছে না আবার আমরা অন্য পথ ধরে দ্বীপের ভেতর দিকে চলে এসেছি। যে-পথে এসেছে সেই পথ ধরে ফিরে যেতে হবে ওদেরকে, ভাবছি আমি, নিঃশব্দে হাসছি।

সব ঠিক আছে, রডরিক, নিচু গলায় বললাম আমি। চলো। কথাটা শেষ করেছি, কিন্তু এখনও পা বাড়াইনি, এই সময় অন্য দিক থেকে নতুন একটা আওয়াজ ভেসে এল কানে।

অনেক দূর থেকে আসছে বলে ভোতা লাগছে শব্দগুলো কানে। আসছে দ্বীপের সাগর তীরের দিক থেকে, পাহাড় সারি টপকে। কিন্তু চিনতে ভুল হয়নি আমার, ফড়ফড় করে কাপড় ছেড়ার একটানা পরিচিত শব্দ-অটোমেটিক রাইফেলের গুলিবর্ষণ।

স্তব্ধ পাথর হয়ে গেছি আমি আর রডরিক। একই আওয়াজ আরেকবার হল। সাবমেশিনগানের লম্বা বিস্ফোরণ, সন্দেহ নেই। তারপর আবার সব চুপচাপ। তবু আরও তিন কি চার মিনিট একই জায়গায় সজাগ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এসো, মৃদু গলায় বললাম আমি। আর দেরি করা চলে না। ঢাল বেয়ে দ্রুত উঠে যাচ্ছি দক্ষিণ প্রান্তের শেষ চূড়াটার দিকে।

পথে আর কোন চেঁচামেচি বা গোলাগুলির আওয়াজ পেলাম, কিন্তু যে-কোন মুহূর্তে গুলির আশঙ্কায় কুঁকড়ে আছে মনটা। সরু কার্নির্স ধরে সাবধানে ছুটছি, বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছি রডরিক ঠিক মত অনুসরণ করতে পারছে কিনা। অবশেষে গভীর ফাটলের ভেতর ঢুকে পড়লাম আমরা। রাফেলার সঙ্গে এখানেই দেখা করবার ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের।

একটু শব্দ নেই। পাথর ছাড়া চিহ্ন নেই আর কিছুর। জায়গাটা অস্বাভাবিক নির্জন। অমঙ্গল আশঙ্কা করে দুর্বল হয়ে পড়ল আমার শরীর। উত্তর পাব না এই ভয়ে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছি চোখে। তবু মৃদু গলায় ডাকলাম, রাফেলা? তুমি। আছ, ডারলিং?

অটুট নিস্তব্ধতাই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়ে বাজল আমার কানে। উত্তর জানা হয়ে গেছে আমার। চরকির মত আধপাক ঘুরে তাকালাম রডরিকের দিকে।

আমাদের অনেক আগে রওনা দিয়েছে ওরা। অনেক আগেই এখানে পৌঁছে যাবার কথা ওদের, খানিক আগে শোনা অটোমেটিকের আওয়াজ নতুন অর্থ বহন করছে এখন।

হ্যাভারস্যাক থেকে বিনকিউলারটা বের করে চোখে তুলে ফাটল দিয়ে তাকালাম। খুব বেশি দূর দেখতে পাচ্ছি না, ফুলে। ওঠা পাহাড়ের গায়ে বাধা পাচ্ছে দৃষ্টি।

বিপদে পড়েছে ওরা, দ্রুত ফিরলাম রডরিকের দিকে। এসো। চলো যাই, কি হয়েছে ওদের দেখে আসি।

কার্নিস থেকে ভাঙা টুকরো আলগা পাথরের রাজ্যে নেমে এলাম আমরা। যদি হোঁচট খাই বা পায়ের চাপে আলগা পাথর পিছলে যায়, গড়িয়ে একেবারে নিচে পড়ব, রক্তারক্তি দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। রাফেলার নিরাপত্তার কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি, কিন্তু পাহাড় থেকে সৈকতের দিকে নামার সময় সম্ভাব্য সবরকম সতর্কতা বজায় রাখছি। নিচের বনভূমি বা সৈকত থেকে কেউ আমাদেরকে দেখে ফেলতে পারে, মনে রেখেছি সেসম্ভাবনাটাও।

দুই পাহাড় সারির মাঝখানের একটা ফাঁকে পা দিতেই সামনে দেখতে পেলাম লম্বা সৈকত, বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। একদিকে, আরও দূরে দেখা যাচ্ছে গানফায়ার রীফ-এর আভাস।

সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়েছি আমরা। রডরিকের হাত ধরে দ্রুত টেনে নিয়ে এসেছি আড়ালে।

গানফায়ার রীফের ফাঁকটাকে নাগালের মধ্যে রেখে চ্যানেলের মুখে প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে একটা ক্রাশ বোট, দেখেই চিনতে পারলাম ওটাকে আমরা। জিনবালা বে থেকে এসেছে আমার পুরানো বন্ধু হুমায়ুন দাদা। সৈকত থেকে ক্রাশবোটে ফিরছে ছোট একটা মোটর বোট, তাতে খুদে মূর্তি দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো।

সর্বনাশ, রডরিক! হতাশা চেপে রাখতে পারলাম না আমি। বুদ্ধি খেলিয়ে প্ল্যানটা করেছে ওরা। সিডনি শেরিডান দল পাকিয়েছে হুমায়ুন দাদার সঙ্গে। এখানে পৌঁছতে সেজন্যেই এত দেরি হয়েছে ওদের। সিডনিকে দ্বীপে পাঠিয়ে দিয়ে হুমায়ুন দাদা চ্যানেল পাহারা দিচ্ছে, যাতে আগের বারের মত এবার আমরা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারি।

সৈকতেও লোক পাঠিয়েছে হুমায়ুন দাদা, বলল রডরিক। ওর লোকেরাই মেশিনগানের গুলি চালিয়েছে একটু আগে। কিন্তু বোট নিয়ে আবার তারা ফিরে যাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।

কেন ফিরে যাচ্ছে তা ভাবতে গিয়ে আশঙ্কায় মাথাটা ঘুরে গেল আমার।

মিস রাফেলা আর ল্যাম্পনি-ওদেরকে কি…তুমি কি মনে কর ওরা পালিয়ে যেতে পেরেছে? নাকি হুমায়ুন দাদার লোকেরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে?

বিনকিউলার চোখে তুলে মোটর বোটের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। বাইরে খাড়ির ঘোলা পানি কেটে ক্রাশবোটের দিকে এগোচ্ছে সেটা। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না কিছু, বললাম রডরিককে। বোটের পেছনে ভোরের সূর্য উঠছে, পানিতে পড়া রোদের প্রতিবিম্ব ধাধিয়ে দিচ্ছে আমার চোখ, বিনকিউলার দিয়েও বোটের লোকজনদেরকে আলাদা ভাবে চিনতে পারছি না। হয়ত বোটেই রয়েছে ওরা, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না আমি।

আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। আরও ভাল এবং উঁচু। জায়গা থেকে মোটর বোর্টটাকে দেখতে চাই। রোদের মধ্যে হাঁটছি, নিশ্চয়ই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আমাকে ওরা।

চেনা আগুনের ঝলকটা দেখতে পেলাম, গানম্মোকের লম্বা। সাদা পালক বেরিয়ে এল ক্রাশবোটের বো-তে বসানো কুইকফায়ারার থেকে। তীব্রগতি ঈগলের ডানা বাতাস কেটে যাবার সময় যে শব্দটা হয়, শুনতে পাচ্ছি পরিষ্কার-ছুটে আসছে কামানের শেল।

শুয়ে পড়! চেঁচিয়ে উঠে ডাইভ দিলাম আমি, আলগা। পাথরের বুকের ওপর আছাড় খেয়ে পড়লাম।

কাছেই বিস্ফোরিত হল শেলটা। জ্বলে উঠেই চোখ ধাধিয়ে দিয়ে নিভে গেল একটা আগুন, মুখ আর হাতে আঁচ অনুভব। করলাম আমি। ইস্পাতের টুকরো আর পাথর কুচির ঝক ছুটে গেল আমাদের চারদিকে। লাফ দিয়ে সটান উঠে দাঁড়ালাম আমি। চেঁচিয়ে বললাম, দৌড়াও!

পাঁচ পা এগিয়ে দিগন্তরেখার নিচে আড়াল নিচ্ছি, এই সময় দ্বিতীয় শেলটা এসে গেল আমাদের ওপর। মাথার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে ছুটে যাচ্ছে, দুজনেই মাথা নিচু করে নিলাম আমরা।

কব্জি থেকে রক্ত মুছছে রডরিক, দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ঠিক আছ?

ছাল উঠে গেছে একটু, ও কিছু না।

রডরিক, ওদের খবর নেবার জন্যে নিচে যাচ্ছি আমি। তুমি এখানে অপেক্ষা কর আমার জন্যে, একসঙ্গে দুজনের ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না।

অযথা মুখ খরচা করছ। আমিও যাচ্ছি। চলো।

রাইফেলটা তুলে নিয়ে অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে নামতে। শুরু করল রডরিক। ওকে অনুসরণ শুরু করে ভাবছি এফ. এটা ওর কাছ থেকে চেয়ে নেব কিনা। এই গুরুতর পরিস্থিতিতে চোখ বন্ধ করে গুলি করার পদ্ধতি কোন কাজে দেবে না এখন। কিন্তু ওটা চাইলে মন খারাপ হয়ে যাবে ওর।

ধীর গতিতে নামছি আমরা। আড়াল থেকে বেরুচ্ছি না কখনও, সামনে পা ফেলার আগে যতদূর সম্ভব দেখে নিচ্ছি। আগে। গোটা দ্বীপ স্তব্ধ হয়ে আছে। বাতাস আর নারকেল পাতার খসখস শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনছি না।

প্রশস্ত একটা ঢাল বেয়ে নামছি, রাফেলা আর ল্যাম্পনির পায়ের দাগ দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম, তারপর দাগ অনুসরণ করে দ্রুত এগোলাম। ওদের ছুটন্ত পায়ের দাগ বালি ছড়ানো মাটিতে গভীর গর্ত সৃষ্টি করেছে। রাফেলার পায়ের ছাপ সরু, আর ল্যাম্পনির খালি পায়ের ছাপগুলো বড় বড়। ঢাল বেয়ে এগুলো অনুসরণ করে যাচ্ছি। আচমকা এক জায়গায় থেমে গেছে

ওরা, এখানে পানির ক্যানটা ফেলে গেছে ল্যাম্পনি, তারপর হঠাৎ বাঁক নিয়ে দুজনে পাশাপাশি ছুটে গেছে ষাট গজের মত।

ওখানে আমরা পেলাম ল্যাম্পনিকে।

বালির ওপর পড়ে আছে। ঘুমাচ্ছে। ওর এই ঘুম ভাঙায় সেসাধ্য নেই কারও। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি, তাকিয়ে আছি ল্যাম্পনির দিকে, কিন্তু চোখের সামনে অন্য সব দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি আমি। ল্যাম্পনিকেই দেখছি, কিন্তু এ ল্যাম্পনি বোটের দড়িদড়া ধরে ঝুলছে, আমার ব্যাগ আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে রাফেলার হাত থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিচ্ছে তার ব্যাগ, গ্রেট মুঘল তার দিকে বাড়িয়ে দেয়ায় ভয়ে পেছনে লুকিয়ে ফেলছে মুঠো পাকানো হাত দুটো, শালা বস বলে চেঁচিয়ে উঠছে, আঁটো প্যান্ট পরে হৈ-হুল্লোড় করছে মেয়েদের সঙ্গে লর্ড নেলসনে। কাঁদছি না আমি, কিন্তু অনুভব করছি কাঁদতে পারলে বেঁচে যেতাম। হেভি ক্যালিবারের তিনটে বুলেট খেয়েছে ও। গায়ের মোটা শার্ট ছিঁড়ে বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় বড় বড় গর্ত রেখে গেছে বুলেটগুলো।

প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে, কিন্তু প্রায় সবটুকুই শুষে নিয়েছে বালি। থকথকে রক্তের স্তরটা ইতিমধ্যে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, আর চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে পোকা-মাকড়, প্রথম দলটা এরই মধ্যে ক্ষতগুলোর মুখে জায়গা দখলের জন্যে ঠেলাঠেলি শুরু করে। দিয়েছে নিজেদের মধ্যে।

দৃষ্টি দিয়ে রাফেলার পায়ের দাগ অনুসরণ করছি আমি। বিশ পা এগিয়েছে ও, তারপর বোকা মেয়েটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে এসেছে আবার ল্যাম্পনির কাছে, হাঁটু গেড়ে বসেছে ওর পাশে। মস্ত ভুলটা এখানেই করেছে রাফেলা, সেজন্যে প্রচণ্ড রাগ হল ওর ওপর আমার। বিপদের সময় এধরনের বোকামি না করলে বোধহয় পালাতে পারত।

হাঁটু গেড়ে বসে রাফেলা ল্যাম্পনির দিকে ঝুঁকে ছিল, এই অবস্থায় ওকে ধরেছে ওরা, টেনে নিয়ে গেছে নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে সৈকতের দিকে। হিঁচড়ে নিয়ে যাবার লম্বা দাগ দেখতে পাচ্ছি বালিতে। বালির কোথাও কোথাও গভীর গর্ত দেখতে পাচ্ছি, এইসব জায়গায় পা আটকে ওদেরকে বাধা দিতে চেষ্টা করছে রাফেলা।

গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দিয়ে এগোচ্ছি আমি। গাছের শেষ সারিগুলোর পেছনে চলে এসেছি। নিচের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে সাদা বালি। ওদের পায়ের চিহ্ন অনুরসণ করে সৈকতে তাকালাম। মোটরবোটটা যেখানে থেমেছিল, এখনও। সেখানে বালির ওপর তার কীল-এর দাগ রয়েছে।

সব বুঝতে পারছি। মোটরবোটে তুলে ক্রাশবোটে নিয়ে গেছে ওরা রাফেলাকে। তাকিয়ে আছি, এই সময় নোঙর তুলে বাক নিতে শুরু করল হুমায়ুন দাদার ক্রাশবোট। কোর্স লক্ষ্য করে বুঝতে পারছি খাড়ির ভেতর দিকে বুমেরাঙের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছে ওটা।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে আসব, মুহূর্তের জন্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কি থেকে কি হয়ে গেল, ভাবতে গেলেই অপরাধবোধে জর্জরিত হচ্ছি। এর সবটুকুর জন্যে আমি দায়ী। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল আমার। রাফেলা আর ল্যাম্পনিকে চোখের আড়াল করা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। হু-হু করছে বুকটা।

যাই হোক, এখন আর পাথরে মাথা ঠুকলেও ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। বরং মাথাটারই এখন সবচেয়ে বেশি যত্ন নিতে হবে–কারণ, বুদ্ধির খেলা শুরু হয়ে গেছে। ভুলের আর কোন অবকাশ নেই। বুদ্ধি দিয়ে বাঁচতে হবে আমাদেরকে, বুদ্ধি দিয়ে উদ্ধার করতে হবে রাফেলাকে, আর বুদ্ধি দিয়েই কড়ায়-গণ্ডায় প্রতিশোধ নিতে হবে ল্যাম্পনি হত্যার-এর কোনটাই কোনটার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ধীর পায়ে ফিরে এলাম রডরিকের কাছে। কারবাইনটা একপাশে নামিয়ে রেখেছে রডরিক, ল্যাম্পনির শরীরটা দুহাতে নিয়ে বসে আছে বালির ওপর। ওর প্রকাণ্ড কাঁধের ওপর রয়েছে ল্যাম্পনির মাথা। দুলছে রডরিক। চঞ্চল, ছটফটে বাচ্চাকে মা যেন বুকে নিয়ে আদরের চাপড় মারছে, ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছে। নিঃশব্দে কাঁদছে রডরিক, চোখের পানির মোটা ধারা গাল বেয়ে চিবুক থেকে ঝর ঝর করে পড়ছে ল্যাম্পনির কোকড়ানো চুলে।

রাইফেলটা নিঃশব্দে তুলে নিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিজেদের চারদিকে তাকাচ্ছি আমি। ওদের পাহারা দিচ্ছি, আর আমার এবং নিজের তরফ থেকে ল্যাম্পনির জন্যে কাঁদছে রডরিক। চোখের পানি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওর দুঃখ, সেজেন্য ঈর্ষা হচ্ছে আমার। ল্যাম্পনিকে ওর মতই ভালবাসতাম তো, কিন্তু তবু রডরিকের মত কাঁদতে পারছি না, তাই অন্তরের গভীর অন্তস্তলে প্রচণ্ড ভাবে খোঁচাচ্ছে ধারালো চোখা কি যেন।

রডরিক, অবশেষে মৃদু কণ্ঠে বললাম ওকে, ওঠো, চলো যাই।

ল্যাম্পনিকে দুহাতের মধ্যে নিয়েই উঠে দাঁড়াল রডরিক।

পাহাড় সারি বরাবর পথ ধরে ফিরে আসছি আমরা।

কাঁধ-সমান উঁচু ঝোপ-ঝাড়ের মাঝখানে ফাঁকা একটু জায়গা দেখে পছন্দ হল আমার। জায়গাটায় ঘাস রয়েছে দেখে খুশি হল রডরিকও। খুব গভীর করে কবর খুঁড়লাম না দুটো কারণে। এক, খালি হাত দিয়ে মাটি খোড়া কঠিন। দুই, আমাদের মধ্যে একজনও কেউ যদি বেঁচে থাকি, এখান থেকে তুলে সেন্ট মেরিতে, জুডিথের কাছে নিয়ে যাব আমরা ল্যাম্পনিকে।

আমার বেইট-নাইফ দিয়ে গাছের ডালপালা আর পাতা কেটে জড়ো করলাম। কবরের তলায় সমান করে ডাল ফেলে, তার। ওপর বিছিয়ে দিলাম পাতাগুলো। তারপর ধরাধরি করে কবরে নামালাম আমরা ল্যাম্পনিকে। ওর গায়ে মাটি চাপা দিতে হাত। উঠল না আমাদের। তাই আবার ডাল কেটে নিয়ে এলাম আমি। কবরের ওপর আড়াআড়িভাবে ফেলা হল সেগুলো, তার ওপর আবার বিছালাম গাছের পাতা। এরপর মাটি ফেলে উঁচু করলাম কবরটাকে।

হাতের তালু দিয়ে চোখ আর গাল থেকে পানি মুছে উঠে দাঁড়াল রডরিক।

রাফেলাকে ধরে নিয়ে গেছে ওরা, শান্তভাবে বললাম ওকে। ক্রাশবোটে হুমায়ুন দাদার কাছে রয়েছে এখন ও।

মিস রাফেলা আহত হয়েছেন? জানতে চাইল রডরিক।

মনে হয় না-এখনও অন্তত নয়।

কি করতে চাও তুমি এখন, মাসুদ? জিজ্ঞেস করল ও।

আমার হয়ে উত্তর দিল একটা তীক্ষ্ম হুইসেলের শব্দ।

বহুদূর ক্যাম্পের দিক থেকে এল আওয়াজটা। খানিকটা উঠে। পাহাড়ের ওপর থেকে দ্বীপের নিচের দিকে তাকাতেই খাড়ির ভেতর-বাহুটা দেখতে পেলাম।

আগে যেখানে দেখেছিলাম সেখানেই রয়েছে বুমেরাং, আর তীর থেকে একশো গজের মধ্যে নোঙর ফেলেছে জিনবালা ক্রাশবোট। দখল করে নিয়েছে ওরা আমাদের হোয়েলবোটটা, সৈকতে লোকজন নামাবার কাজে ব্যবহার করছে সেটাকে।

লোকগুলো ইউনিফর্ম পরা, সশস্ত্র। সৈকতে নেমেই ছড়িয়ে পড়ল সবাই, নারকেল বনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। হোয়েলবোট দ্রুত ফিরে যাচ্ছে আবার বুমেরাঙের দিকে।

বিনকিউলার চোখে তুলে বুমেরাঙের দিকে তাকাতেই ঘটনার পরিবর্তন লক্ষ করলাম। সাদা গলা-খোলা একটা শার্ট আর বু স্ন্যাকস পরে রয়েছে সিডনি শেরিডান, মই বেয়ে হোয়েলবোটে নামছে সে, অনুসরণ করছে লোরনা পেজকে। লোরনার চোখে গাঢ় রঙের সান গ্লাস, সোনালি চুলের ওপর হলুদ স্কার্ফ জড়িয়েছে, পরনে এমারেল্ড গ্রীন স্ন্যাক স্যুট। ওদেরকে চিনতে পারা মাত্র আমার তলপেটের ভেতর কেমন যেন কিলবিল করে উঠল।

এরপর যা ঘটছে, দেখে হকচকিয়ে গেলাম আমি। লণ্ডনের কার্জন স্ট্রীটে দাঁড়িয়ে যে লাগেজগুলো রোলস রয়েসে তুলতে দেখেছিলাম, সেগুলো শেরিডানের দুজন পাণ্ডা ডেকে নিয়ে এসে জড়ো করছে। তারপর এক এক করে সব লাগেজ নামানো হল হোয়েলবোটে।

ইউনিফর্ম পরা একজন নাবিক বুমেরাঙের ডেকে দাঁড়িয়ে স্যালুটের ভঙ্গিতে একটা হাত তুলল চোখের পাশে, উত্তরে বাতাসে হাত ঝাপটা মেরে বিদায় দিল তাকে শেরিডান।

বুমেরাঙের কাছ থেকে রওনা দিয়ে ক্রাশবোটের দিকে এগোচ্ছে হোয়েলবোট। এদিকে শেরিডান, তার রক্ষিতা, বডিগার্ড আর মালপত্তর যখন ক্রাশবোটের ডেকে উঠছে ওদিকে তখন নোঙর তুলে নিয়ে বে-এর মুখের দিকে ঘুরে গিয়ে দৃঢ় ভঙ্গিতে চ্যানেলের গভীর পানির দিকে এগোতে শুরু করেছে বুমেরাং।

চলে যাচ্ছে বুমেরাং, বিড়বিড় করে বলল রডরিক। কেন?

চলেই যাচ্ছে বুমেরাং, ঠিক ধরেছ তুমি। কেন? ওটাকে আর। শেরিডানের দরকার নেই, তাই। নতুন ইয়ার জুটেছে ওর, তার বোটে থেকেই কাজ সারবে ও। বুমেরাং পুষতে রোজ হাজার পাউণ্ড খরচ।

আবার আমি বিনকিউলার ঘোরালাম ক্রাশবোটের দিকে। সিডনি আর তার প্রেরণার উৎস কেবিনে ঢুকছে।

সম্ভবত আরও একটা কারণ আছে বুমেরাংকে বিদায় করে দেবার।

আরও একটা কারণ, মাসুদ?

ওদের কাজগুলো যত কম লোকের সামনে সম্ভব সারতে চায় ওরা।

ঠিক, বুঝতে পারছি কি বলতে চাইছ, মাথা ঝাঁকাল রডরিক।

বুঝলে, রডরিক, আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে চাইছে ওরা, তুলনা করলে যেন মনে হয় ল্যাম্পনিকে দয়া করেছে।

বোট থেকে নামিয়ে আনতে হবে মিস রাফেলাকে, মাসুদ, ল্যাম্পনির মৃত্যুর বেমক্কা ধাক্কা সামলে উঠছে রডরিক, কাজের দিকে খেয়াল ফিরে আসছে। কিছু একটা করতে হবে আমাদেরকে, মাসুদ।

ইচ্ছাটা ভাল, রডরিক, মানি আমি। কিন্তু নিজেরা খুন হয়ে গিয়ে রাফেলার খুব একটা কাজে লাগতে পারব না আমরা, পারব কি? আমার বিশ্বাস, গুপ্তধন ওরা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত রাফেলা নিরাপদেই থাকবে।

ওর প্রকাণ্ড মুখটা উদ্বিগ্ন একটা বুলডগের মত ভাঁজ খেয়ে গেল।

আমরা কি করতে যাচ্ছি, মাসুদ?

দৌড়ানো ছাড়া আপাতত করার কিছুই নেই আমাদের।

ঠিক কি বলছ?

কান পাতো, শোনো… বললাম ওকে।

আবার দূর থেকে ভেসে এল হুইসেলের আওয়াজ, তার সঙ্গে বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে এল অস্পষ্ট কিছু কণ্ঠস্বর।

আমাদের পেছনে ডালকুত্তা লেলিয়ে দিয়েছে ওরা, মৃদু কণ্ঠে বললাম আমি। দ্বীপটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করেছে দলটা।

চল নিচে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়ি, চাপাস্বরে হুঙ্কার ছাড়ল রডরিক, এফ. এনটা কক্ করল দ্রুত। ওদেরকে দেবার জন্যে আমার কাছে একটা খবর আছে ল্যাম্পনির তরফ থেকে।

বোকার মত কথা বোলো না রডরিক, সাবধানে, ভয়ে ভয়ে বললাম ওকে আমি। জানি, একবার বেঁকে বসলে ওকে সামালানো আমার কাজ নয়। যা বলছি শোনো। সংখ্যায় ওরা কত, জানতে চাই আমি। তারপর, সুযোগ পেলে, ওদের একজনের ঘাড় মটকে কেড়ে নিতে চেষ্টা করব আমরা তার অস্ত্রটা। সুযোগের সন্ধানে থাকো, রডরিক, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পরার ইচ্ছাটাকে চেপে রাখো আপাতত। খুব সাবধানে পা ফেলবে তুমি, বুঝতে পেরেছ? লক্ষ্যভেদ করার ব্যাপারে ওর হাস্যকর ব্যর্থতার কথা ওকে আর স্মরণ করিয়ে দিলাম না।

ঠিক আছে, মাসুদ, আমাকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়ে বলল রডরিক।

পাহাড় সারির এদিকে থাকছ তুমি। টপকে ওপারে গিয়ে আমিও খুঁজব সুযোগ। সম্মতি দিয়ে মাথা কাত করল রডরিক। ক্রাশবোটের কামান যেখানে শেল ছুঁড়েছিল সেইখানে দেখা করব। আমরা দুঘন্টা পর।

ডালকুত্তাদের নাকের ডগায় থাকতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না আমার। ভয় তাড়াবার জন্যে পরস্পরের নাম ধরে ডাকাডাকি করছে ওরা, এগোবার মধ্যে গা-ঢাকা দেবারও কোন চেষ্টা নেই। ধীর গতিতে খুব সাবধানে সামনে বাড়ছে।

আমার এদিকে সংখ্যায় ওরা নয়জন। সাতজনই কৃষ্ণাঙ্গ, পরনে ন্যাভাল ইউনিফর্ম, হাতে এ. কে. ফরটিসেভেন অ্যাসল্ট রাইফেল। বাকি দুজন সিডনি শেরিডানের লোক। এদের পরনে সাদা স্যুট, হাতে স্মল আমর্স। এদের একজনকে চিনতে পারলাম, অনেকদিন আগে দেখেছি, রোভার গাড়িটা চালাচ্ছিল। আরেকজন জোড়া ইঞ্জিন সেসনার পাইলট।

মাথা গোনার কাজ শেষ করে ওদের দিকে পেছন ফিরে। দৌড়ে চলে এলাম জলার বাঁকের কাছে। অনুমান করছি, এই বাধাটার কাছে পৌঁছে ঘাবড়ে গিয়ে আরও ছড়িয়ে পড়বে দলটা, সে-সময় নিঃসঙ্গ একজনকে বাগে পেতেও পারি।

লম্বা গলার মত এক চিলতে জমি কাদার ওপর দিয়ে এগিয়ে গেছে, বুক সমান উঁচু ঘাস আর ম্যানগ্রোভ ঝোপে ঢাকা। কিনারা ধরে খানিকদূর এগিয়ে সামনে গলাটার ওপর আড়াআড়িভাবে পড়ে থাকা একটা নারকেল গাছ দেখতে পেলাম, মরা পাতা আর উঁচু ঘাসের ভেতর প্রায় অদৃশ্য হয়ে আছে। ওত পেতে অপেক্ষা করার জন্যে এমন জায়গা আর হয় না।

গাছের আড়ালে শুয়ে পড়লাম আমি। বেইট-নাইফটা বেল্টের খাপ থেকে বের করে হাতে ধরে আছি। মনে মনে শাণ দিচ্ছি ওটাতে। সুযোগ পেলেই ছুঁড়ে মারব।

ধীর কিন্তু সমান গতিতে আসছে ওরা। চেঁচামেচিটা কাছে চলে এসেছে। কিন্তু জলাটার সামনে আসতে এখনও এক-দেড় মিনিট সময় লাগবে ওদের।

আগে গেলে বাঘে খায়, কথাটা জানা নেই লোকটার। খসখস শব্দ শুনে তাকাতেই দেখি ঝোপের একটা অংশ দুলছে। সোজা। আমার দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা।

আমার কাছ থেকে বিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাড়া পাবার আশায় হাঁক ছাড়ল সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে। ঠাণ্ডা স্যাতসেঁতে মাটির সঙ্গে চেপে রেখেছি মুখটা, মরা ডালপালা আর শুকনো পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছি। ঝোপের ছোট্ট একটা ফাঁকে তার পায়ের গোড়ালি আর হাঁটুর নিচ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। পরনে মোটা বু সার্জের ট্রাউজার, মোজা ছাড়া ভোতা চেহারার সাদা স্নিকার রয়েছে পায়ে। পা ফেলছে, প্রতিবার দেখা যাচ্ছে জুতোর ওপর আফ্রিকার কালো চামড়া।

লোকটা ক্রাশবোটের একজন নাবিক বুঝতে পেরে খুশি হয়ে উঠল মনটা, নিশ্চয়ই ওর কাছে অটোমেটিক রাইফেল আছে।

ধীরে একটু গড়ান দিয়ে ছুরি ধরা হাতটা মুক্ত করে নিলাম। দুই সেকেণ্ড এই কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এরপর কানের এত কাছ থেকে আবার হাঁক ছাড়ল লোকটা, যে লাফ দিয়ে উঠল শরীরের পেশী। আরেকটু হলে নিজের অজ্ঞাতে আওয়াজ বেরিয়ে যাচ্ছিল গলা থেকে। অনেকটা দূর থেকে পাল্টা সাড়া দিল কেউ।

নরম বালিতে শব্দ পাচ্ছি ওর পায়ের। এখনও সোজা আমার দিকে আসছে।

হঠাৎ একটা ঝোপ এড়িয়ে বেরিয়ে এল ও। সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছি ওকে। আমার কাছ থেকে দশ পা দূরে।

ন্যাভাল ইউনিফর্ম রয়েছে পরনে, মাঝখানে ছোট্ট লাল পমপম লাগানো ব্লু ক্যাপ মাথায়, স্ট্র্যাপের সঙ্গে ঝুলছে কোমরের কাছে ভয়াল চেহারার সাবমেশিন-গানটা। একহারা চেহারার লম্বা এক ছোকরা, বড়জোর বিশ বছর হবে বয়স। মুখটা নিভাঁজ, কিন্তু ভয়ে ঘেমে ভিজে আছে। কালো আঁধার মুখের ওপর চোখ দুটো অস্বাভাবিক সাদা আর উজ্জ্বল।

দেখে ফেলল আমাকে। আঁতকে উঠল, কিন্তু একটু সময় নষ্ট না করে বিদ্যুৎগতিতে ঘোরাচ্ছে আমার দিকে মেশিনগানটা। কিন্তু সেটা ওর ডানদিকের কোমরের কাছে ছিল, ঘুরিয়ে আমার দিকে আনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল ওর নিজের শরীরটাই। গলার নিচে দুই কলারবোন যেখানে মিলেছে, ছোট্ট গর্তটায় লক্ষ্যস্থির করছি আমি। মাথার ওপর তুলে ফেলেছি হাত। ছুঁড়ে দিচ্ছি ছুরিটা।

ছুরিটা ছেড়ে দেবার আগের মুহূর্তে জোর একটা ঝাঁকি দিলাম কব্জিতে, দ্রুত ডানা ঝাপটে পাখির মত লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল সেটা হাত থেকে। ঘঁাচ করে বিধল গিয়ে ঠিক জায়গায়। দুই। কলারবোনের মাঝখানে সবটুকু সেঁধিয়ে গেছে ছুরির ফলা, গলার নিচে শুধু বেরিয়ে আছে ওয়ালনাট কাঠের হাতলটা।

মুখ খুলে ফেলেছে লোকটা, জিভের ওপর দিয়ে পেছনের লালচে দেয়াল দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। চিৎকার করতে চেষ্টা করছে ও, কিন্তু কোনরকম শব্দ বেরুচ্ছে না, কারণ সবগুলো ভোকাল কর্ডে পোচ দিয়েছে ছুরির ফলাটা-এবং ঠিক এটাই চেয়েছিলাম আমি।

আশ্চর্য মন্থর গতিতে হাঁটু ভেঙে ক্রমশ নিচু হয়ে যাচ্ছে লোকটা, মুখ করে রয়েছে আমার দিকে। হাঁটুর ওপর দাঁড়িয়ে। রয়েছে এখন। দুপাশে ঝুলছে হাত দুটো। বড় একটা নীল মাছি ওর মাথাটাকে দুবার চক্কর দিয়ে ফিরে এসে বসল ছুরির হাতলের ওপর। কাঁধের স্ট্র্যাপের সঙ্গে এখনও ঝুলছে কারবাইন।

সোজা আমার চোখে তাকিয়ে আছে ও। যেন চিরকালের জন্যে আটকে গেছে আমাদের দৃষ্টি। মুখটা এখনও খোলা। এরপর হঠাৎ একটা ঝাঁকি খেয়ে কাঁপতে শুরু করল সে, নাক আর মুখ দিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত আর লাল বুদবুদ, ঝপ করে বসে পড়ল মাটিতে, সেজদার ভঙ্গিতে নেমে এল মাথাটা বালির ওপর।

উঠে দাঁড়িয়েছি আমি, মাথা নিচু করে চলে এসেছি লোকটার কাছে। মারা গেছে কিনা পরীক্ষা করা দরকার মনে করছি না। দুহাতে ধাক্কা দিয়ে চিৎ করে দিলাম তাকে, ছোট্ট একটা টানে। গলা থেকে বের করে নিলাম ছুরিটা। ওর শার্টের আস্তিনে ঘষে মুছে নিলাম ফলার রক্ত।

দ্রুত স্ট্রাপসহ কারবাইন আর বেল্টে আটকানো স্পেয়ার ম্যাগাজিনের বাণ্ডিলটা খুলে নিলাম আমি। টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এলাম ওকে কাদার মধ্যে, বুকে একটা হাঁটু ঠেকিয়ে চাপিয়ে দিয়েছি শরীরের ভার। ধীরে ধীরে থকথকে মোটা কাদার স্তর চারদিক থেকে উঠে এসে ঢেকে দিচ্ছে শরীরটাকে। প্রথমে মাথাটা ডুবে গেল কাদার ভেতর, তারপর সম্পূর্ণ শরীর। স্পেয়ার ম্যাগাজিনের বাণ্ডিলটা কোমরে গুঁজে তুলে নিলাম সাবমেশিনগান, ছুটলাম বাকের দিকে।

ডালকুত্তারা জলার কিনারায় এসে পৌঁছুবার আগেই ঘুরপথে ছুট দিয়ে ওদের পেছনে চলে এসেছি আমি। এখনও দৌড়াচ্ছি, ক্রমশ সরে যাচ্ছি ওদের পেছন দিকে, এই ফাঁকে চেক করে নিচ্ছি এ. কে. ফরটিসেভেন। ম্যাগাজিনটা পুরো আছে এখনও, ব্রীচটাও লোডেড। স্ট্র্যাপটা আমার বাঁ কাঁধে আটকে নিলাম, কোমরের কাছে বাগিয়ে ধরে আছি অটোমেটিক কারবাইন।

শতিনেক গজ এগিয়ে থামলাম আমি, গা-ঢাকা দিলাম একটা নারকেল গাছের আড়ালে। থকথকে কাদা ভর্তি জলার মধ্যে বিপদে পড়েছে ডালকুত্তারা, ঘন ঘন হুইসেল আর খ্যাপাটে চেঁচামেচি শুনে তাই মনে হচ্ছে আমার। ওদিকে যেন ফাইনাল খেলা চলছে ফুটবল লীগ-এর।

দিক বদলে এখন আমি দ্রুত আড়াআড়িভাবে দ্বীপটাকে পেরোচ্ছি, দক্ষিণ প্রান্তের চূড়ার দিকে, সেখানে কথা হয়েছে দেখা হবে আমার সঙ্গে রডরিকের। নিচের সারির শেষ ঢালটা পেরিয়ে নারকেল গাছের বাগান থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ঘন হয়ে জন্মেছে এদিকে বুনো ঝোপ-ঝাড়, গা ঢাকা দিয়ে আরও দ্রুত এগোতে পারছি সহজেই।

ঢালটা থেকে নেমে এসেছি, উঠতে শুরু করেছি আরেকটা ঢাল বেয়ে। মাথার দিকে প্রায় অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে গেছি, ছলকে উঠল বুকের রক্ত আনকোরা নতুন একটানা বিস্ফোরণের আওয়াজে।

চাবুকের ঘায়ে বাতাস কাটার মত গর্জে উঠল এফ, এন কারবাইনটা, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল এ. কে. ফরটিসেভেনের প্রচণ্ড দমকা ঝড়।

বিস্ফোরণের দৈর্ঘ্য আর প্রচণ্ডতা লক্ষ করে বুঝলাম কয়েকটা অটোমেটিক তাদের ম্যাগাজিনের পুরোটা ছুঁড়েছে। তারপরই গুমোট নিস্তব্ধতা জমাট বাধল, টু-শব্দ নেই কোথাও।

এত করে নিষেধ করার পরও নিজেকে সামলাতে পারেনি রডরিক, বুঝতে পারছি। রেগে গেছি, কিন্তু সেই সঙ্গে পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠেছি এই ভেবে যে না জানি কি ভয়ঙ্কর বিপদে জড়িয়ে ফেলেছে ও নিজেকে। একটা ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই, নাকের ডগার কাছে লক্ষ্যস্থির করে থাকলেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে ও।

হাঁটা বাদ দিয়ে ছুটতে শুরু করেছি আমি। সোজা নয়, কোনাকুনি উঠে যাচ্ছি ওপর দিকে, যেদিক থেকে শব্দটা পেয়েছি। ঝোপের ভেতর থেকে বিস্ফোরণের মত বেরিয়ে এলাম। রডরিককে জীবিত দেখতে পাব কিনা ভেবে উদ্বিগ্ন। সরু একটা প্যাসেজ দেখতে পাচ্ছি, দুই পাঁচিলের মাঝখানে ঢুকে সোজা ত্রিশ। গজ পেরিয়ে উঠে এলাম ঢালের মাথায়, আর একটু হলেই লোকটার দুই হাতের মাঝখানে সেঁধিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। উল্টোদিক থেকে ছুটে আসছে সে, আমারই মত ঝড়ের বেগে।

একই লাইনে এর পেছনে রয়েছে আরও ছয়জন। শেষ লোকটা রয়েছে ত্রিশ গজ পেছনে, নিরস্ত্র, তাজা রক্তে ভিজে গেছে জ্যাকেটটা।

আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে আছে ওদের সবার চোখ, স্বয়ং আজরাইল যেন তাড়া করেছে ওদেরকে।

সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম, রডরিকের গুলি এড়িয়ে পালিয়ে আসা দল এটা। নিশ্চয়ই এমন কিছু দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে এদের যে ভয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকাবার সুযোগ খুঁজছে। সম্ভবত কোন অলৌকিক উপায়ে লক্ষ্যভেদ করতে সমর্থ হয়েছে রডরিক, অনুমান করতে পারছি।

মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধতে যাচ্ছিল, অথচ আতঙ্কে অন্ধ দলটা দেখতেই পায়নি আমাকে। সেফটি ক্যাচ অন করলাম আমি, পিঠ বাঁকা করে ঝুঁকে পড়লাম সামনের দিকে। কোমরের কাছ থেকে কারবাইনটা নাকের সামনে তুলে এনেছি। ওদের হাঁটু লক্ষ্য করে ব্যারেলটা ঘোরালাম একদিক থেকে আরেক দিকে। এ. কে. ফরটিসেভেনের বর্ষণ এত দ্রুত যে পা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে আশা করা যায় লোকটা পড়ে যাবার সময় আরও তিন কি চারটে গুলি খাবে শরীরে।

একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল ওরা সবাই, রক্তাক্ত গায়ে গায়ে ধাক্কা খেয়ে, জড়াজড়ি করে পড়ে গেল একই সঙ্গে।

চার পর্যন্ত গোনা শেষ করে ট্রিগার চেপে ধরা আঙুলটা ঢিল করে নিলাম আমি, লাফ দিয়ে প্রায় খাড়া নেমে যাওয়া একটা বিচ্ছিন্ন ঢালের কিনারা লক্ষ্য করে ডাইভ দিলাম। গড়িয়ে নেমে এলাম পনেরো ফুট নিচের প্রায় সমতল বালির ওপর, ঝাঁকি দিয়ে খাড়া হয়েই ঝড়ের বেগে ছুটছি আবার। পেছনে একটা সাবমেশিনগান তড়পাচ্ছে, কিন্তু আমাকে আড়াল দিয়ে রেখেছে ঘন ঝোপ, তাছাড়া এদিকে কোন বুলেট আসছে না। যতদূর বুঝতে পারছি, আচমকা এই হামলা চালিয়ে দুই কি তিনজনকে বিদায় করে দিতে পেরেছি আমি, বাকি সবাই আহত হয়েছে। যাই হোক, ভাবছি আমি, ওদের মধ্যে কেউ যদি বেঁচে ফিরতেও পারে ক্রাশবোটে, দ্বীপে ফিরতে আর সাহস পাবে না। ছোট দুটো হামলায় জিতেছি আমরা, কিন্তু ওদের হাতে এখনও আটকা রয়েছে রাফেলা। তার মানে ওদের পজিশন সব দিক থেকে ভাল। রাফেলা যতক্ষণ থাকবে ওদের হাতে ওরাই নিজেদের ইচ্ছা মত সুতো টেনে পুতুল নাচাবে।

লোকটা অমর, দিব্যি বহাল তবিয়তে চূড়ার কাছাকাছি মাথাউঁচু একগাদা পাথরের আড়ালে বসে আছে, অপেক্ষা করছে। আমার জন্যে।

জেসাস, ম্যান! চাপা গলায় হুঙ্কার ছাড়ল ও। তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বুড়ো হয়ে গেলাম-কি করছিলে এতক্ষণ, মাসুদ?

যেখানে ফেলে রেখে এসেছিলাম সেখান থেকে আমার হ্যাভারস্যাকটা তুলে নিয়ে এসেছে রডরিক। দুটো ছিনতাই করা এ. কে. ফরটিসেভেন আর স্পেয়ার ম্যাগাজিনগুলোর পাশে পড়ে রয়েছে সেটা। পানির বোতলটা বাড়িয়ে ধরল আমার দিকে ও, এতক্ষণে টের পেলাম আমার গলা আর বুক শুকিয়ে কারবালার ময়দান হয়ে গেছে। কিন্তু মাত্র তিন ঢোক পানি বরাদ্দ করলাম। নিজেকে।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, মাসুদ, খুবই দুঃখিত আমি। তোমার নিষেধ অমান্য করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল আমাকে। পিকনিকে আসা ছেলেমেয়েদের মত দল বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা, যীশুর কসম, লোভ সামলাতে পারিনি। দুজনকে সঙ্গে সঙ্গে খতম করেছি, বাকিরা মুরগির বাচ্চার মত পালিয়েছে-সোজা আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছিল।

হুঁ, বললাম ওকে। ঢালে ওঠার সময় দেখা হয়েছে ওদের সঙ্গে আমার।

গুলির আওয়াজ শুনেছি। একটু পরেই যেতাম তোমার খোঁজে।

পাথরের ওপর ওর পাশে বসলাম আমি। হ্যাভারস্যাক থেকে চুরুট বের করে ধরালাম দুজন। অখণ্ড নিস্তব্ধতাটুকু উপভোগ করছি, কিন্তু রডরিক সমস্যার কথা পেড়ে নষ্ট করল সেটা।

ওদের লেজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি আমরা। ফিরে আসবে বলে মনে করি না। কিন্তু ওদের কাছে এখনও মিস রাফেলা রয়েছে, ম্যান। তার মানে ওরাই জিতেছে।

ওদেরকে গুণেছ, রডরিক?

চুরুটের লাল মাথার দিকে তাকিয়ে আছে। ও, বলল, দশজন। দুজনকে বাদ দাও। আরেক জনের হাত উড়িয়ে দিয়েছি বগলের কাছ থেকে, সে-ও বাদ। সাতজন।

হ্যাঁ, বললাম আমি। সাতজনকেই দেখেছি আমি। ধরো, এই দলে চারজনের বেশি নেই। ওদিকে রয়েছে আরও আটজন। এরা বারোজন ছাড়াও ক্রাশবোটে রয়েছে সাত কি আটজন। তার মানে আরও বিশটা রাইফেলের সঙ্গে লড়তে হবে আমাদেরকে।

ক্যাপটা তুলে কামানো গম্বুজটায় আদর করে একবার হাত বুলাল রডরিক। ঘাবড়াই না, চেহারাটাকে কদাকার করে তুলে বলল ও।

সবচেয়ে নতুন সাবমেশিনগানটা বেছে নিলাম আমি, সঙ্গে থাকল পাঁচটা পুরো ম্যাগাজিন। বাকিগুলো পাথরের একটা ফাটলে লুকিয়ে রাখলাম। আরও দুঢোক করে পানি খেয়ে নিয়ে উঠলাম আমরা। রডরিককে পেছনে নিয়ে সাবধানে পাথরের ওপর দিয়ে এগোচ্ছি, সামনের দিকে ঝুঁকে মাথা নিচু করে আছি, নিচ থেকে কেউ যাতে আকাশের গায়ে দেখতে না পায় আমাদেরকে। পরিত্যক্ত ক্যাম্পের দিকে ফিরে যাচ্ছি আমরা।

যেখানে দাঁড়িয়ে প্রথম আসতে দেখেছিলাম বুমেরাংকে সেখান থেকে দ্বীপের পুরো উত্তর এলাকাটার ওপর চোখ বুলাচ্ছি। যা ভেবেছিলাম, সিডনি শেরিডান আর হুমায়ুন দাদা তাদের লোকজনকে ডেকে নিয়েছে দ্বীপ থেকে। ছোট মোটর বোট আর রডরিকের হোয়েলবোট, দুটোই ভিড়েছে ক্রাশবোটের গায়ে। ডেকের ওপর লোকজনের ছুটোছুটি, ব্যস্ততা দেখতে পাচ্ছি। আহতদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ওরা, কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি কেবিনের ভেতর উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছে হুমায়ুন দাদা আর সিডনি শেরিডান।

ক্যাম্পে ফিরছি আমি, রডরিক, বললাম ওকে। দেখে আসি আমাদের জন্যে কিছু রেখে গেছে কিনা। বিনকিউলারটা ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে। তুমি এখান থেকে পাহারা দেবে আমাকে। পরপর তিনটে গুলি মানে ওয়ার্নিং সিগন্যাল।

ঠিক আছে, সহজেই রাজি হল রডরিক। চোখে বিনকিউলার তুলে তাকাল ক্রাশবোটের দিকে। ঘুরে দাঁড়াতে যাব, এই সময় চোখ থেকে নামিয়ে নিঃশব্দে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ও বিনকিউলারটা।

কিছু জিজ্ঞেস না করে ওর হাত থেকে নিলাম ওটা, চোখে তুলে তাকাতেই দেখতে পেলাম বিশাল চেহারার হুমায়ুন দাদাকে, কেবিন থেকে বেরিয়ে ব্রিজের দিকে এগোচ্ছে সে।

সাদা ইউনিফর্ম পরে আছে হুমায়ুন দাদা, রোদ লেগে। ঝিকমিক করছে তার প্রকাণ্ড বুক ভর্তি পদকগুলো। তার সঙ্গে। রয়েছে কয়েকজন ক্রু, পিঁপড়ের মত ঘিরে রেখেছে তাকে, দরকার হলেই যাতে সাহায্য সেবায় লাগতে পারে।

ব্রিজে উঠছে হুমায়ুন দাদা, ক্রুরা তাকে সাহায্য করছে। ওপরে উঠে থামল সে, বিশাল একটা হাত বাড়িয়ে দিল একদিকে। তার হাতে একটা ইলেকট্রিক বুলহর্ন ধরিয়ে দেয়া হল। ঘুরে তীরের দিকে মুখ করে দাঁড়াল হুমায়ুন দাদা, মুখের। সামনে তুলল বুলহর্নটা। দেখতে পাচ্ছি, বড় কালো ঠোঁট জোড়া নড়ছে তার।

এক মুহূর্ত পরই তার কণ্ঠস্বর ভেসে এল আমাদের কানে।

মাসুদ রানা। আশা করি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ তুমি। শুধু তোমার সম্মানে আজ সন্ধ্যায় একটা বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন। করেছি আমরা। ক্রাশবোটটা দেখা যায় এমন এক জায়গায় দয়া করে থেকো তুমি। অ্যামপ্লিফায়ারের মধ্যে দিয়ে তার কণ্ঠস্বর। ভরাট আর কর্কশ হয়ে বাজছে কানে। কথা দিচ্ছি, তোমার জন্যে অনুষ্ঠানটা মনোমুগ্ধকর হবে। সন্ধ্যা নটায় এই জাহাজের আফটার ডেকে হবে অনুষ্ঠানটা। দারুণ রোমাঞ্চকর ব্যাপার, রানা। সুযোগটা হারিয়ো না।

ক্রুদের একজনকে বুলহর্নটা দিয়ে নিচে নেমে গেল প্রকাণ্ডদেহী হুমায়ুন দাদা।

রাফেলার কোন ক্ষতি করতে যাচ্ছে ওরা, বিড় বিড় করে বলল রডরিক, কোলের ওপর শুইয়ে রাইফেলটার গায়ে হাত বুলাচ্ছে।

নটার সময় জানতে পারব, ক্রাশবোটের দিকে চোখ রেখে বললাম আমি। দেখতে পাচ্ছি, ডেক থেকে মোটরবোটে নামছে বুলহর্ন হাতে নিয়ে একজন অফিসার। মোটরবোট ছেড়ে দিল একজন ক্রু, দ্বীপটাকে ঘিরে মন্থর গতিতে ঘুরতে শুরু করল সেটা। হুমায়ুন দাদার তরফ থেকে আমাকে দাওয়াত করছে ওরা। দর্শক হিসেবে আমাকে পাবার জন্যে সাংঘাতিক ব্যগ্র মনে হচ্ছে হুমায়ুন দাদাকে।

ঠিক আছে, রডরিক, রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। এখনও কয়েক ঘন্টা সময় আছে হাতে। ক্যাম্পে যাচ্ছি, তুমি পাহারায় থাক।

ক্যাম্পটা চরম অবহেলার সাথে তছনছ করা হয়েছে। গুহাগুলোর ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ভাঙাচোরা সরঞ্জাম, অর্ধভুক্ত খাবার। দামী জিনিসগুলো সঙ্গে করে নিয়ে গেছে ওরা। তবু কিছু জিনিস দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে ওদের।

কাজে লাগতে পারে এমন কিছু সাজ-সরঞ্জামের সঙ্গে পাঁচ ক্যান ভর্তি ফুয়েল অন্য এক জায়গায় লুকিয়ে রাখলাম আমি। ওখান থেকে সাবধানে নেমে ঝোপের কাছে এসে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে স্বস্তির সাথে দেখলাম সিন্দুক আর বাঘের মাথাটা যেখানে রয়েছে তার ওপরের মাটিতে কোথাও একটু আঁচড়ও পড়েনি।

পাঁচ ক্যান পানি, তিন টিন শুকনো বীফ আর দুই টিন ভেজিটেবল নিয়ে উঠে এলাম আমি। কোন কথা নয়, আগে আমরা খাওয়া সারলাম।

যদি পার খানিকটা ঘুম দিয়ে নাও, রডরিককে বললাম আমি। সামনে কঠিন একটা রাত আসছে। দুনিয়ার ঝড়ঝাপ্টা বয়ে যাবে আজ রাতে।

হু করে চাপা হুঙ্কার ছেড়ে প্রকাণ্ড কালো একটা ভল্লুকের মত। কর্কশ ঘাসে পিঠ দিয়ে চিৎ হল ও, একটু পরই মৃদু এবং নিয়মিত নাক ডাকার শব্দ পেলাম ওর।

চুরুট ধরিয়ে বুদ্ধি পাকাচ্ছি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না কিছু। একে একে তিনটে চুরুট ধ্বংস করলাম। তারপর সূর্য যখন দিগন্তরেখা ছুঁচ্ছে, মাথায় খেলে গেল বুদ্ধিটা। একেবারে সহজ, অথচ দারুণ এক কৌশল পেয়ে গেছি আমি-এত সহজ বলেই তীব্র সন্দেহ হল আমার, তাই আরও দুবার গোটা ব্যাপারটা গোড়া থেকে আগা। পর্যন্ত ভেবে দেখে পরীক্ষা করে নিলাম।

ইতিমধ্যে নেতিয়ে পড়েছে বাতাস। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারদিকে এখন গাঢ় অন্ধকার। জিনিয়াস মনে হচ্ছে নিজেকে, বুদ্ধিটার কোথাও একটু গলদ নেই। নিঃশব্দে হাসছি এখন।

ক্রাশবোটের সব কটা পোর্টে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে, এক জোড়া ফ্লাড লাইট আলোকিত করে রেখেছে আফটার ডেকটাকে। খালি একটা স্টেজের মত দেখাচ্ছে সেটাকে।

রডরিকের ঘুম ভাঙালাম আমি, তারপর খেতে বসলাম।

চল বীচে যাই, বললাম ওকে। ওখান থেকে ভাল দেখা যাবে।

ব্যাপারটা ফাঁদ হতে পারে, মাসুদ, মৃদু গলায় স্মরণ করিয়ে দিল আমাকে ও।

আমার তা মনে হয় না। দ্বীপে কেউ নেই ওদের। তাছাড়া ওরাই শক্তিশালী পক্ষ, এখনও ওদের হাতে রাফেলা রয়েছে। এধরনের কৌশল খাটাবার দরকার পড়ে না ওদের।

ম্যান, একটু যদি ক্ষতি করে ওরা মেয়েটার…, নিজেই চুপ করে গেল রডরিক। উঠে দাঁড়াল ও। বলল, ঠিক আছে, চলো যাওয়া যাক।

ঝোপের আড়ালে আবডালে থেকে খুব সতর্কতার সঙ্গে নামছি আমরা। রাইফেল কক্ করে নিয়েছি দুজনেই, আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে রেখেছি ট্রিগার।

রাতটা নিঝুম, পরিবেশটা নির্জন। সৈকতের কিনারায়, গাছের শেষ সারির পেছনে থামলাম আমরা। মাত্র দুশো গজ দূরে ক্রাশবোট। একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে চোখে বিনকিউলার তুলে তাকালাম ওটার দিকে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব, এত কাছে চলে এল ওটা। একজন ক্রু সিগারেটের প্যাকেট বের করল পকেট থেকে, প্যাকেটের গায়ের লেখাগুলো পরিষ্কার পড়তে পারছি আমি।

সত্যি, ভয় লাগছে আমার। ঠিক কি করতে যাচ্ছে হুমায়ুন দাদা কল্পনা করতে গিয়ে আরও বাড়ছে ভয়টা, তার ইচ্ছাটাকে আন্দাজ দিয়েও ছুঁতে পারছি না আমি।

চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে নিচু গলায় বললাম রডরিককে, রাইফেল বদল করি এসো।

লম্বা ব্যারেলের এফ. এনটা আমাকে দিল ও, আমার কাছ থেকে নিল এ. কে. ফরটিসেভেন। লক্ষ্যভেদ করার বিশেষ গুণ রয়েছে এফ-এন-এর, ক্রাশবোটের ডেকে গুলি ছুঁড়তে হলে সেটা দরকার আমার। রাফেলা যতক্ষণ অক্ষত থাকবে ততক্ষণ ওদেরকে শায়েস্তা করার কোন ব্যবস্থা নিতে পারব না আমি, একথা ঠিক। কিন্তু ওর যদি কোন ক্ষতি করে ওরা-ও একা যাতে না ভোগে তার ব্যবস্থা যেভাইে হোক করতে হবে আমাকে।

নারকেল গাছটার পাশে বসে অ্যাডজাস্ট করে নিলাম রাইফেলের সাইট, লক্ষ্যস্থির করেছি একজন ডেক গার্ডের কপালের ওপর ঘামের ফোটায়। জানি এখন এই জায়গায় বসে থেকে লোকটার মগজ উড়িয়ে দিতে পারি আমি।

সন্তুষ্ট হয়ে কোলের ওপর নামিয়ে রাখলাম রাইফেলটা। অপেক্ষা করছি।

জলা থেকে প্রথম ঝকের মশাগুলো আগেই এসে পৌঁছেছে, আমাদের মাথাটাকে ঘিরে উড়ছিল এতক্ষণ, এবার হাতে আর মুখে বসতে শুরু করেছে। খুদে বেলুনের মত রক্তে ফুলে উঠছে। এক একটা, জ্বালা অনুভব করছি, কিন্তু চড়-চাপড় মেরে তাড়াতে। পারছি না ওদেরকে। একটা চুরুট ধরাতে পারলে ভাল হত, কিন্তু। ঝুঁকিটা নেয়া চলে না এখন।

ধীরে ধীরে এগোচ্ছে সময়। যত দেরি হচ্ছে ততই একের পর এক নতুন ভয় ঢুকেছে মনে। অবশেষে, নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট আগে, ক্রাশবোটের ওপর একটা ব্যস্ততা লক্ষ করলাম।

কেবিন থেকে আবার বেরিয়ে এসেছে হুমায়ুন দাদা। মই বেয়ে উঠতে তাকে সাহায্য করছে নাবিকরা। ব্রিজ রেইলের কাছে তার নির্দিষ্ট চেয়ারটায় বসল সে, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে নিচের আফটার ডেকের দিকে তাকাল। দরদর করে ঘামছে সে, দুই বগলের কাছে ভিজে গেছে ইউনিফর্ম জ্যাকেট। অপেক্ষার সময়টা সম্ভবত আমাদের কাছ থেকে লুট করা স্কচ খেয়ে কাটিয়েছে সে।

তার দুপাশে দাঁড়ানো ক্রু আর নাবিকদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করছে হুমায়ুন দাদা। হাতির পিঠের মত দুই কাঁধ আর ফুলে। থাকা মস্ত পেটটা কাঁপছে হাসির দমকে।

মই বেয়ে এবার উঠে আসছে সিডনি শেরিডান, লোরনা পেজকে অনুসরণ করছে সে।

সাপের মত ঠাণ্ডা একটা ভাব রয়েছে সিডনির চেহারায়। অত্যন্ত দামী কাপড়ের স্যুট পরেছে সে, দাঁড়াল সবার কাছ থেকে একটু সরে। তেমন যেন আগ্রহ নেই এসবে তার উৎসাহিত বোধ। করার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে সে যেন একমাত্র বয়স্ক লোক, মনে হচ্ছে আমার, একঘেয়ে আর একটু তিক্ত দায়িত্ব পালন করতে এসেছে।

ঠিক উল্টো ভাব দেখছি লোরনার চেহারায়। এই প্রথম যেন বাড়ির বাইরে ছেলে-বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে এসেছে সে, ছটফট করছে উত্তেজনায়, কি এক প্রত্যাশায় চকচক করছে চোখ দুটো।

কারণে অকারণে খিলখিল করে হাসছে লোরনা, মুখ আর হাত নেড়ে অনর্গল কথা বলছে হুমায়ুন দাদার সঙ্গে। কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই সে। চঞ্চল ভাবে এদিক যাচ্ছে, ওদিক যাচ্ছে-আগুপিছু করছে বারবার-উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না কোনমতে। একবার সে রেইলের ওপর ঝুঁকে নিচের খালি ডেকের দিকে তাকাল। কিছু একটা কল্পনা করে উত্তেজনা বেড়ে গেল তার, শক্তিশালী গ্লাস দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি গাল দুটো লাল হয়ে গেছে-রুজ নয় ওগুলো।

লোরনার দিকে তাকিয়ে আছি, তাই নিচে কি ঘটছে টের পাইনি। হঠাৎ নিঃশ্বাস আটকে ফেলল রডরিক, চঞ্চল ভাবে নড়ে উঠল ওর শরীরটা, পরমুহূর্তে আঁতকে ওঠার শব্দ করল ও। দ্রুত নিচের ডেকে তাকালাম আমি।

ওখানে দেখতে পাচ্ছি রাফেলাকে, দুজন ইউনিফর্ম পরা নাবিকের মাখঝানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা দুজন দুটো হাত ধরে রেখেছে রাফেলার, মাঝখানে ছোট্ট আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে।

আজ সকালে তাড়াহুড়ো করে পরা সেই পোশাকটাই রয়েছে রাফেলার পরনে, চুলগুলো কাকের বাসার মত জটিল একটা স্তুপ হয়ে রয়েছে মাথায়, মুখে ব্যথা আর প্রচণ্ড ক্লান্তির ছাপ। অনিদ্রার কালো ছোপ দেখতে পাচ্ছি চোখের নিচে-কিন্তু এক মুহূর্ত পরই ভুলটা ভাঙল আমার-ওগুলো আঁচড় আর ক্ষতের দাগ। রাগের ঠাণ্ডা শিহরণের সাথে দেখছি ঠোঁট দুটো বেঢপ ভাবে ফুলে আছে ওর, যেন মৌমাছি কামড়েছে। নাকের দুপাশেও আঁচড়ের দাগ দেখতে পাচ্ছি।

রাফেলাকে ওরা মারধোর করেছে। এখন যখন খুঁজছি, ওর নীল শার্টে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগও ধরা পড়ছে আমার দৃষ্টিতে। এই সময় একজন গার্ড চরম অসম্মানের সাথে ওর গায়ে হাত দিয়ে ওকে তীরের দিকে ঘুরিয়ে দিল, এখন দেখতে পাচ্ছি একটা হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা রয়েছে ওর, সেটার ওপর কালচে দাগটা শুকনো রক্ত নাকি অ্যান্টিসেপটিক মলমের দাগ, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

ক্লান্ত আর অসুস্থ দেখাচ্ছে রাফেলাকে, সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। রাগটা আমার সমস্ত বিবেচনাবোধকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত জায়গা দখল করে নিচ্ছে মাথার ভেতর, অনুভব করতে পারছি আমি। রাফেলার এই করুণ অবস্থার জন্যে যারা দায়ী তাদেরকেও ওর মত যন্ত্রণার ভাগ দেবার জন্যে তৈরি হয়ে গেছি প্রায় নিজের অজান্তেই। কোল থেকে তুলেছি রাইফেলটা। নিজেকে প্ররোচিত করছি মনে মনে। ওদের ওপর প্রচণ্ড ঘৃণায় হাত দুটো কাঁপছে আমার। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে সামলে নিলাম নিজেকে। চোখের পাতা চেপে বন্ধ করে আছি, নিজেকে শান্ত করার জন্য গভীর একটা শ্বাস টানলাম। সময় এবং সুযোগ আসবে, জানি আমি-এখন কিছু করে বসলে সেটার সম্ভাবনাই শুধু নষ্ট করা হবে, লাভ হবে না কিছুই।

আবার চোখ খুলে বিনকিউলার দিয়ে তাকালাম আমি। দেখি, হুমায়ুন দাদা তার মুখের সামনে তুলে ধরেছে ইলেকট্রিক বুলহর্নটা।

শুভ সন্ধ্যা, রানা, আমার পরম বন্ধু! তোমার সম্মানে আমাদের বিচিত্রানুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আমি শিওর, এই সুন্দরী মেয়েটিকে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না তোমার। লম্বা করে হাত নেড়ে রাফেলাকে দেখাল হুমায়ুন দাদা, আর রাফেলা অসুস্থ, মন্থর ভঙ্গিতে মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। ওকে আমরা জেরা করেছি। অপ্রীতিকর কৌশল দুএকটা ওর ওপর ব্যবহার করতে হয়েছে বলে দুঃখিত, রানা-সিনসিয়ারলি বলছি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত জেনেছি, আমি আর আমার বন্ধু-বান্ধবরা যে সম্পদ সম্পর্কে আগ্রহী সেটা কোথায় আছে তা ওর জানা নেই। ও বলছে, তুমি কোথাও লুকিয়ে রেখেছ। থামল হুমায়ুন দাদা, সঙ্গে সঙ্গে একজন ক্রু তার হাতে ধরিয়ে দিল একটা তোয়ালে, সেটা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিল সে।

তারপর আবার বলল, তোমার এই সঙ্গিনীর সঙ্গে আমার কোন ঝগড়া নেই-ওর ওপর কোন লোভও নেই। কিন্তু ওর গুরুত্ব আর মূল্য সম্পর্কে আমি পূর্ণ সচেতন। বিনিময় ব্যবসাতে হাতে এই রকম পুঁজি থাকলে লোকসানের কোন ভয় থাকে না। ঠিক কিনা, রানা, পরম বন্ধু? তুমি রাজি? বিনিময়ের জন্যে সমান গুরুত্ব আর মূল্যের পুঁজি তোমার কাছেও তো রয়েছে। রাজি? তবে সবুর, এখনই কোন সিদ্ধান্ত নিয়ো না। আসল অনুষ্ঠান শুরুই হয়নি এখনও-আগে সেটা দেখো।

দ্রুত, বিরক্তির সঙ্গে হাত নাড়ল হুমায়ুন দাদা। সঙ্গে সঙ্গে নাবিক দুজন ধরল রাফেলাকে, একরকম ঠেলতে ঠেলতেই নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল ওকে।

রাফেলা চলে যেতে বুকটা খালি হয়ে গেল আমার। জানি না আর কোনদিন দেখতে পাব কিনা ওকে।

খালি ডেকে উঠে এল হুমায়ুন দাদার চারজন লোক। এদের সবার কোমর থেকে ওপরের অংশটা উদোম, মসৃণ কালো চামড়ার নিচে ঢেউ জেগে রয়েছে পেশীর।

চারজনের হাতে একটা করে ছোট কুঠার রয়েছে, হাতলগুলো কাঠের, আধ হাতের একটু বেশি লম্বা। কুঠারের ফলাগুলো মোটা ইস্পাতের, আলো লেগে চকচক করছে, কিনারার দিকটা চওড়া আর ধারাল-প্রত্যেকটা চার ইঞ্চি লম্বা, ইঞ্চি দুয়েক চওড়া। খোলা ডেকের চারকোণে নিঃশব্দে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল ওরা।

এবার দুজন গার্ড একজন লোককে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল খোলা ডেকে, ফাঁকা মাঝখানটায় দাঁড় করাল তাকে। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা রয়েছে লোকটার। তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে গার্ড দুজন। তাদের দুজোড়া হাত হঠাৎ অলস ভঙ্গিতে মাঝখানে দাঁড়ানো লোকটাকে ধরে ঘোরাতে শুরু করল। লাটিমের মত।

বুলহর্নের মধ্যে দিয়ে ভেসে এল হুমায়ুন দাদার ভারী আর। কর্কশ কণ্ঠস্বর।

কি, চিনতে পারছ ওকে, রানা?

ক্যানভাস দিয়ে তৈরি জেলখানার ওভারঅলস পরে রয়েছে লোকটা। সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে সে, গার্ড দুজনের হাত দুটো এখন দ্রুত হয়ে উঠেছে। পড়ে যেতে চাইছে লোকটা, পরিষ্কার ফাঁকি দেবার মতলব। কিন্তু গার্ড দুজনের দুই জোড়া হাত তাকে পড়ে যেতে দিচ্ছে না। ঘোরাচ্ছে অবিরাম। লোকটার গায়ের রঙ সাদা ফ্যাকাসে, চোখ দুটো গর্তে ঢোকা, সোনালি জট। পাকানো চুল নেমে এসেছে মুখের ওপর, মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

প্রায় সব কটা দাঁত হারিয়েছে লোকটা, সম্ভবত নির্মম ঘুসি মেরে উপড়ে ফেলা হয়েছে মাড়ি থেকে।

পারছ, রানা? হো হা হো হা করে খানিক হাসল হুমায়ুন দাদা। চিনতে পারছ? এর পেশা ছিল লোকজনকে ধরে ঠেঙানো আর কয়েদ করা। দুর্ভাগ্য আর বলে কাকে, ওর নিজের কপালেও তাই জুটেছে।

এতক্ষণে লোকটাকে চিনতে পেরে আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি। জলকুমারী থেকে বাইরের দিকের খাঁড়িতে ফেলে দিয়েছিলাম ওকে, গানফায়ার রীফের চ্যানেল ধরে হুমায়ুন দাদাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসার সময়।

হ্যাঁ, ও হচ্ছে ইন্সপেক্টর পিটার টালি, ভেসে এল হুমায়ুন দাদার কণ্ঠস্বর। এই শালা বানচোতই ডুবিয়েছে আমাকে। আমাকে যারা ডোবায় তাদেরকে আমি পছন্দ করি না, রানা। আর আমি যাদেরকে পছন্দ করি না তাদের কপালে খারাবি আছে, এ তো জানা কথা। কি সেই খারাবি? তা তোমাকে স্রেফ নমুনা হিসেবে দেখাবার প্রয়োজন হতে পারে মনে করেই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা। এই ধরনের প্রদর্শনী সাংঘাতিক কাজে দেয় রানা। চোখে না দেখলে মানুষ শাস্তির নির্মমতা ঠিক বুঝতে পারে না। বিশ্বাস কর, তোমার স্বার্থেই ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাতে চাই আমি।

মুখ আর ঘাড় থেকে ঘামের স্রোত মোছার জন্যে আরেকবার বিরতি নিল হুমায়ুন দাদা। একজন লোকের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে শেষ করল রঙিন মদটুকু।

গার্ড দুজনও একটু বিশ্রাম নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর এই সুযোগে দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে পিটার টালি হুমায়ুন দাদার দিকে। আতঙ্কের রেখা আর ভাঁজ পেঁচিয়ে গিয়ে কদাকার হয়ে উঠেছে মুখের চেহারা। ঠোঁট দুটো নড়ছে তার, বোঝা যাচ্ছে, করুণা ভিক্ষা চাইছে। ঠোঁটের দুই প্রান্ত বেয়ে নেমে আসছে থুথু আর লালা।

বন্ধুবর রানা, তুমি রেডি? এবার তাহলে শুরু করতে পারি আমরা? হো হা করে হাসল হুমায়ুন দাদা।

একজন গার্ড বড় একটা কালো কাপড়ের ব্যাগ পরিয়ে দিল টালির মাথায়, গলা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেল তার। ফিতেটা টান করে গলার চারদিকে এঁটে বেঁধে দিল গার্ড। তারপর ওরা দুজন মিলে টেনে দাঁড় করাল টালিকে।

বাচ্চাদের একটা খেলা, তাই না, রানা? কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি হুমায়ুন দাদার। এর নাম কানামাছি খেলা, তুমি জানো। অনুষ্ঠানটাকে তোমার স্বার্থে রোমাঞ্চকর করার জন্যে খেলার ধরন একটু পাল্টেছি আমরা।

ভিজে যাচ্ছে টালির ক্যানভাস ট্রাউজারের সামনেটা, চরম আতঙ্কে খালি হয়ে যাচ্ছে ওর ব্লাডার। বোঝা যাচ্ছে, জিনবালা জেলে থাকার সময় এই খেলা দেখেছে সে।

বন্ধু রানা, আমি চাই তোমার কল্পনাশক্তিকে একটু খাটাও। এই নোংরা জীবটাকে দেখ না, ওর জায়গায় দেখতে চেষ্টা কর তোমার প্রিয় সঙ্গিনীকে। দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে হুমায়ুন দাদা। একজন ক্রু তার দিকে আবার বাড়িয়ে দিল তোয়ালেটা।

হাত তুলে প্রচণ্ড একটা থাবড়া মারল লোকটাকে হুমায়ুন দাদা। ছিটকে পড়ল লোকটা, ডিগবাজি খেয়ে রেলিংয়ের সঙ্গে গিয়ে ধাক্কা খেল। শান্তভাবে কথা বলে চলেছে হুমায়ুন দাদা, যেন কিছুই হয়নি। কল্পনা কর, রানা, তোমার সঙ্গিনী এই অবস্থায় কি রকম আতঙ্ক বোধ করবে, চিন্তা কর।

গার্ড দুজন আবার নিজেদের মাঝখানে ঘোরাতে শুরু করেছে টালিকে। খেলার মধ্যে ছেলেরা ঠিক এইভাবেই একজনকে ধরে ঘোরায়। কোন বিরতি নেই, ওরা তাকে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ঘুরিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা টালির অস্পষ্ট চিৎকার আর গোঙানি শুনতে পাচ্ছি।

হঠাৎ গার্ড দুজন টালিকে রেখে পিছিয়ে এল দ্রুত। এবার। এগিয়ে আসছে অর্ধনগ্ন চারজন লোক। তাদের একজন হাতের কুঠারটা উল্টো করে ধরে টালির শিরদাঁড়ার শেষ গিঁটে হাতল চেপে রেখে সামনের দিকে জোরে একটা ধাক্কা মারল।

একটা ঝাঁকি খেল টালি, টলতে টলতে এগোল সামনের দিকে। সামনে কুঠার নিয়ে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে আরেকজন, টালির পেটে হাতল দিয়ে গুতো মারবে সে।

বারবার হাতলের গুঁতো খেয়ে আগুপিছু করছে টালি। পড়ে যাবে, সে উপায় নেই তার। হাঁটু ভাঁজ খাবার আগেই তোর ঠেলায় শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে যাচ্ছে তার, ছুটে যাচ্ছে সামনের দিকে, পরমুহূর্তে সামনে বা পাশ থেকে আরেকটা গুতো খাচ্ছেএই ভাবে চলছে তো চলছেই। অবশেষে একজন তার কুঠারটা সিধে করে ধরে মাথার পেছনে তুলল, তারপর গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে নামিয়ে আনল সেটা টালির পাঁজরে। ঘ্যাঁচ করে গেঁথে গেল ফলাটা। এটা সমাপ্তি টানার একটা ইঙ্গিত।

ডেকে পড়ে গেছে টালি। চারজন ভিড় করে দাঁড়িয়েছে তার ওপর। তাদের হাতের কুঠারগুলো উঠছে আর নামছে, উঠছে আর নামছে-ভীতিকর একটা ছন্দের তালে তালে। কুঠারের কোপগুলো পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি খাঁড়ির এপার থেকে-ঘ্যাচ-ঘ্যাচ, ঘ্যাচঘ্যাচ…দ্রুত।

পালা করে একটু পর পর ক্লান্ত হয়ে পিছিয়ে আসছে ওরা। টালির শরীরটা দলা পাকিয়ে পড়ে আছে ডেকের ওপর। ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে তার হাড়গোড়।

নিষ্ঠুর, তুমি বলবে, রানা-কিন্তু সাংঘাতিক ফলপ্রসূ, এ-কথা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে।

বর্বর কাণ্ডটা অসুস্থ করে ফেলেছে আমাকে। আমার পাশ থেকে বিড়বিড় করছে রডরিক, ও মানুষ নয়, দানব, আতঙ্কে সরল স্বীকারোক্তি বেরিয়ে এল ওর গলার ভেতর থেকে, আমার ভয় লাগছে, মাসুদ।

কাল দশটা পর্যন্ত সময় দিচ্ছি তোমাকে, রানা, যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে হুমায়ুন দাদার। ঠিক সকাল দশটায় নিরস্ত্র অবস্থায় আপোসের মনোভাব নিয়ে আমার কাছে আসবে তুমি। আমার সাধ্যমত খাতির করব তোমাকে। আমরা দুজন, তুমি আর আমি, গল্পগুজব করব, কাঁধে হাত রেখে পায়চারি করব, হাসি-ঠাট্টা করব-বিশ্বাস কর, দারুণ জমবে দুই পরম বন্ধুতে। তারপর কিছু ব্যাপারে একমত হব আমরা। কিছু বিনিময় করব। তারপর বন্ধুত্ব বজায় রেখে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেব আমরা। তুমি রাজি রানা?

ক্রুরা টালিকে নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, তা দেখার জন্যে চুপ করে আছে হুমায়ুন দাদা। দুই কব্জিতে নাইলনের রশি বেঁধে ক্রাশবোটের মাস্তুলের মাথার কাছে তুলে ঝুলিয়ে দেয়া হল টালিকে। টপ টপ করে রক্ত ঝরছে ঘেঁতলানো শরীরটা থেকে। মুখ তুলে ওপর দিকে তাকিয়ে দৃশ্যটা গোগ্রাসে গিলছে লোরনা। পেজ। মাথাটা পেছন দিকে নুয়ে পড়েছে তার, সোনালি চুলগুলো। ঝুলছে পিঠ বরাবর। পরিষ্কার দেখতে পেলাম জিভের লাল ডগা বের করে নিচের ঠোঁটটা চেটে নিল সে।

আর যদি রাজি না হও, রানা, শেষ কথাটার খেই ধরে শুরু করল আবার হুমায়ুন দাদা, ঠিক কাল দুপুরে এখন যেখানে। ঝুলতে দেখছ টালিকে সেখানে ঝুলতে দেখবে তোমার বান্ধবীকে। চিন্তা কর, রানা। তাড়াহুড়ো কোরো না, প্রচুর সময় রয়েছে তোমার হাতে। ভাল করে ভেবে দেখ ব্যাপারটা।

হঠাৎ নিভে গেল ফ্লাড লাইট দুটো। উঠে দাঁড়াল প্রকাণ্ড দানবটা। অনুচরদের সাহায্য নিয়ে মই বেয়ে নামছে সে। তাকে অনুসরণ করছে লোরনা পেজ আর সিডনি শেরিডান। মই বেয়ে নামার সময় বারবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে লোরনা ঝুলন্ত মাংসপিণ্ডটাকে। কিন্তু ভুরু কুঁচকে রয়েছে সিডনি শেরিডানের, কি যেন ভাবছে সে।

আমি অসুস্থ বোধ করছি, মাসুদ, বিড় বিড় করে বলল রডরিক।

কাটিয়ে ওঠ, বললাম ওকে। কারণ সামনে আমাদের গাধার খাটুনি রয়েছে।

রডরিককে পেছনে নিয়ে নিঃশব্দে নারকেল গাছ তলায় চলে এলাম আমি। পালা করে মাটি কেটে গর্ত খুঁড়ছি আমরা, একজন সব সময় কাছেপিঠে পাহারায় থাকছি। ক্রাশবোট থেকে কারও চোখে পড়ে যেতে পারি। সেই ভয়ে আলো জ্বালিনি। কাজের সময় চরম সতর্কতা বজায় রেখেছি যাতে লোহার সঙ্গে লোহার ঠোকাঠুকি। লেগে শব্দ না হয়।

বিস্ফোরণের সরঞ্জাম আর বাকি জেলিগনাইটের বাক্স, তারপর আরেক জায়গায় মাটি খুঁড়ে মরচে ধরা সিন্দুকটা বের করলাম আমরা। অনেক ভেবে বেছে বের করা নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বয়ে নিয়ে এলাম এগুলো। প্রায় খাড়া একটা ঢালের নিচে জায়গাটা। ঢাল-এর পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে মাটি ফুলে-ফেঁপে ভাঁজ খেয়ে আছে, সেটা ঝোপ আর বুনো লম্বা ঘাসে ঢাকা।

এর নিচে সিন্দুকটার জন্যে একটা গভীর গর্ত খুঁড়ছি আমরা। নরম মাটির নিচে পানি দেখতে পেয়ে থামলাম। সিন্দুকটা নতুন করে প্যাক করা হল, পুঁতে দেয়া হল এই সদ্য তৈরি করা গর্তে। ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে রডরিক, পঞ্চাশ ফুট উঠে ঝোপ আর ঘাসের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কি করতে হবে ওখানে জানে ও।

নিচে আমি একা, কিন্তু বসে নেই। সাবমেশিনগানটা রি-লোড করে আমার পুরানো একটা শার্ট দিয়ে জড়িয়ে নিলাম সেটা, সঙ্গে রেখেছি পুরো পাঁচটা ম্যাগাজিন। সবচেয়ে কাছের একটা নারকেল গাছের পাশে, এক ইঞ্চি বালির নিচে শুইয়ে কবর দিলাম এগুলোকে। জায়গাটার পাশ দিয়ে একটা অগভীর নালা এগিয়ে গেছে। ঢাল বেয়ে বৃষ্টির পানি নেমে এসে তৈরি করেছে এটা। এই শুকনো নালা আর নারকেল গাছ থেকে সদ্য পোতা সিন্দুকটার দূরত্ব চল্লিশ গজের মত, যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্ব বলে অনুমান করছি আমি। নালাটা দুই ফুটের একটু বেশি গভীর, গা ঢাকা দেবার কাজে লাগবে।

মাঝরাতের পর উঠে এল চাঁদ, তার আলোয় পরীক্ষা করে নিচ্ছি আমাদের আয়োজন। ঢালের ওপর থেকে ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দেয়া অবস্থায় নিচে আমাকে দেখতে পাচ্ছে কিনা তা যাচাই করে নিচ্ছে রডরিক। নারকেল গাছ আর নালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। চাদের আলোয় ঝোপের বাইরে বেরিয়ে এসে হাত নাড়ল ও। নিঃশব্দে ঢাল বেয়ে ওর কাছে উঠে এলাম আমি। ওর লুকাবার জায়গা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম আয়োজনটা।

আগুন আড়াল করে চুরুট ধরালাম আমরা, জ্বলন্ত ডগা মুঠোর ভেতর নিয়ে ধোঁয়া টানছি। এই ফাঁকে প্ল্যানটা সম্পর্কে রডরিককে আরও পরিষ্কার ধারণা দেবার জন্যে আলোচনা করছি।

আমার প্ল্যানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করছে সময় আর ইঙ্গিত। এ-ব্যাপারে একচুল এদিক-ওদিক হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেজন্যেই ভয় পাচ্ছি। পরপর তিন বার গোটা ব্যাপারটা। পুনরাবৃত্তি করালাম রডরিককে দিয়ে। আপত্তি না তুলে প্রতিবার রিহার্সেল দিল ও। আমি এখন সন্তুষ্ট। চুরুট নিভিয়ে ফেললাম আমরা, বালির নিচে পুঁতে দিলাম সেগুলো। তারপর ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এসে নারকেল গাছের শুকনো লম্বা কাঠি আর পাতা দিয়ে ঝাড়ু দিলাম জায়গাটা, আমাদের উপস্থিতির কোন চিহ্ন রাখলাম না।

আমার প্ল্যানের প্রথম অংশটা পূরণ হয়েছে। এরপর বাঘের মাথা আর অবশিষ্ট জেলিগনাইটের কাছে ফিরে এলাম আমরা। নতুন আরেক গর্তে লুকালাম আমরা সোনার মাথাটাকে। তারপর আমি পুরো এক কেস জেলিগনাইট নিয়ে কাজে বসলাম, বিস্ফোরণের জন্যে তৈরি করলাম ওটাকে।

এক্ষেত্রে বিস্ফোরণের জন্যে ইলেকট্রিসিটি বা ইনসুলেটেড ওয়্যার ব্যবহার করতে পারব না আমি, কাজ আদায় করতে হবে টাইমপেন্সিল ডিটোনেটর দিয়ে। এই হালকা কিন্তু মেজাজী জিনিসটাকে সাংঘাতিক অপছন্দ করি আমি। এর কাজের পদ্ধতি হল-মোটা একটা তার খেতে খেতে এগোয় অ্যাসিড, তারের শেষ মাথায় একটা হাতুড়ি থাকে, একটা পাউডার ক্যাপে বাড়ি মারতে উদ্যত। অ্যাসিড তার খেয়ে শেষ করলেই হাতুড়ির বাড়ি পড়ে পাউডার ক্যাপে, অমনি সেটা বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের সময় কমানো বাড়ানো নির্ভর করে অ্যাসিডের শক্তি আর ওয়্যারটা কত মোটা তার ওপর।

এই ব্যবস্থার মধ্যে সবরকম গোলমালের বীজ রয়েছে। ওয়্যারে গোলমাল থাকতে পারে, অ্যাসিড তার কাজে দেরিও করতে পারে আবার তাড়াতাড়িও সেরে ফেলতে পারে। একটু এদিক-ওদিক হলেই প্রচুর সময়ের হেরফের হয়ে যাবে, অথচ এক সেকেণ্ড আগে-পরে বিস্ফোরণ ঘটলে আমার গোটা প্ল্যানটাই হিতে বিপরীত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে পুরোমাত্রায়। যাই হোক, এক্ষেত্রে বাছবিচার করার কোন অবকাশ নেই আমার। সাত ঘন্টা দেরিতে বিস্ফোরিত হবে এমন একটা পেন্সিল বেছে নিলাম আমি, জেলিগনাইটের সঙ্গে ব্যবহার করার জন্যে এটাকেও তৈরি করে নিলাম।

লুটেরাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে আমার পুরানো অক্সিজেন রিব্রিদিং আণ্ডারওয়াটার সেটটা। ব্যবহার করার প্রশ্নে টাইম পেন্সিলের চেয়ে এটাও কোন অংশে কম মারাত্মক নয়। অ্যাকুয়ালাঙ কমপ্রেসড এয়ার ব্যবহার করে, কিন্তু রিব্রিদিং সেটটা প্রতিটি নিঃশ্বাসের কার্বন-ডাই অক্সাইড ফিল্টার করে নিয়ে নির্ভেজাল অক্সিজেন ফেরত পাঠায় ব্যবহারকারীর ফুসফুসে। কিন্তু গভীর পানিতে খাটি অক্সিজেন নেয়া মারাত্মক ঝুঁকির ব্যাপার, ওটা কার্বন-মনোক্সাইডের মতই বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে। তেত্রিশ ফুট পানির নিচে খাটি অক্সিজেন টানলে যে-কেউ মারা যাবে। এই সেট নিয়ে পানিতে নামতে হলে দুঃসাহস দরকার। কিন্তু এর একটা মস্ত সুবিধেও আছে। এ থেকে বুদবুদ বেরোয় না, ফলে পানির ওপর থেকে ডুবুরীর অস্তিত্ব টের পাবার কোন উপায় নেই কারও।

সৈকতে ফিরে আসার সময় তৈরি করা জেলিগনাইট কেস আর রাইফেলটা বয়ে নিয়ে এল রডরিক। রাত তিনটের পর পানিতে নেমে অক্সিজেন সেটটা পরীক্ষা করে নিলাম আমি, তারপর রডরিকের হাত থেকে জেলিগনাইট নিয়ে ওটা কতখানি ভেসে উঠতে চায় যাচাই করলাম। কয়েক পাউণ্ড সীসার ওজন যোগ করতেই বাঞ্ছিত ফল পাওয়া গেল, এখন ওটাকে পানির ভেতর দিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে কোন অসুবিধে হবে না।

বে-র ভোঁতা একটা শিং-এর আড়াল থেকে পানিতে নেমেছি। আমি। উঁচু বালির ঢিবি আর নারকেল গাছ আমাকে আড়াল করে রেখেছে ক্রাশবোট থেকে।

লম্বা, ক্লান্তিকর সাঁতার কাটছি আমি। শিংটাকে ঘুরে বে-তে বেরিয়ে আসতে হল আমাকে, এরই দূরত্ব প্রায় এক মাইল। বিস্ফোরক টেনে নিয়ে আসা আরেক বিচ্ছিরী হাঙ্গামার ব্যাপার। ধস্তাধস্তি করে প্রায় এক ঘন্টা এগোবার পর স্বচ্ছ পানির ভেতর দিয়ে আমার মাথার ওপর ক্রাশবোটের ঝলমলে আলো দেখতে পেলাম।

পানির তলার কাছাকাছি থেকে নিঃশব্দে এবং মন্থর গতিতে এগোচ্ছি সামনের দিকে। সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক হয়ে আছি। খুঁড়ির নিচে ধবধবে সাদা বালি, স্বচ্ছ পানির ওপরও উজ্জ্বল চাঁদের আলো পড়েছে-ওপর থেকে বিশ ফুট নিচে আমার কাঠামোটা। উঁকি দিলেই পরিষ্কার দেখতে পাবে যে-কেউ ক্রাশবোট থেকে।

ক্রাশবোটের ছায়ায় ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি, ধীরে ধীরে চলে এলাম খোলের নিচে। এখানে যতক্ষণ আছি, ওদের চোখে ধরা পড়ার কোন ভয় নেই আমার। কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে ভাগিয়ে দিলাম ক্লান্তিটাকে, তারপর বেল্ট থেকে নাইলন। স্লিংগুলো বের করে নিয়ে জেলিগনাইটের কেসের সঙ্গে আটকালাম।

রিস্টওয়াচ দেখলাম। চারটে বেজে দশমিনিট হয়েছে।

টাইম পেন্সিলের কাঁচের অ্যাম্পুল ভেঙে পথ খুলে দিলাম অ্যাসিডের, এখন ওটা ধীরেসুস্থে খেতে শুরু করেছে ওয়্যারটাকে। বিস্ফোরকের কেসের গায়ে ওর জন্যে তৈরি করা খোপে ঢুকিয়ে দিলাম পেন্সিলটাকে। কমবেশি সাত ঘন্টা পর দুশো পাউণ্ড এরিয়াল বোমার শক্তি আর গতি নিয়ে বিস্ফোরিত হবে আমার টাইম বম্ব।

খড়ির তলা ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠছি এখন আমি ক্রাশবোটের খোলের দিকে। বোটের গায়ে দাড়ির মত ঝুলছে পিচ্ছিল লতাপাতা, সার সার সেঁটে আছে অসংখ্য শুক্তি। এমন একটা জায়গা পাওয়া গেল না যেখানে কেসটা শক্ত করে বাঁধতে পারি। বাধ্য হয়ে রাডারের ফলাটাই বেছে নিতে হল।

সবটুকু নাইলনের রশি দিয়ে ওটার সঙ্গে বাঁধলাম কেসটা, কাজ শেষ করে টেনেটুনে পরীক্ষা করে বুঝলাম, ক্রাশবোট তুমুল গতিতে তার সবটুকু দ্রুততা নিয়ে ছুটতে শুরু করলেও পানির তোড়ে এই শক্ত বাধন ছিড়তে পারবে না।

সন্তুষ্ট হয়ে আবার নেমে এলাম খাঁড়ির তলায়। ধীরে ধীরে, সন্তর্পণে ফিরে আসছি আমি। সঙ্গে বোঝা নেই, তাই দ্রুত ফিরে আসতে পারছি। সৈকতে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে রডরিক।

কাজ শেষ করেছ, মাসুদ? জিজ্ঞেস করল ও, অক্সিজেন সেটটা খুলতে সাহায্য করছে আমাকে।

হ্যাঁ, বললাম ওকে। এখন একমাত্র ভরসা পেন্সিলটার ওপর।

এত ক্লান্ত আমি, নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে টলতে টলতে এগোচ্ছি। গতরাতে ঘুমিয়েছি কি ঘুমাইনি, আর তারপর থেকে এখন পর্যন্ত দুই চোখের পাতা এক করার সুযোগ পাইনি।

এবার রডরিককে পাহারায় রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। মনে হল পরমুহূর্তে জেগে উঠলাম। রডরিকের ধাক্কায় ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে দেখি সকাল সাতটা। ইতিমধ্যে ফুটে উঠেছে দিনের আলো।

ক্যান থেকে বের করে ঠাণ্ডা ব্রেকফাস্ট সারলাম আমরা। সারভাইভাল কিট থেকে এক মুঠো হাই-এনার্জি গ্লুকোজ ট্যাবলেট বের করে পানিতে গুলিয়ে চালান করে দিলাম পেটে। ঘড়ি দেখছি বার বার।

বেল্টের খোপ থেকে বেইট-নাইফটা বের করে মুঠোর ভেতর। থেকে ছুঁড়ে দিলাম সবচেয়ে কাছের নারকেল গাছটার দিকে। গেঁথে গিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে সেটা।

এর মানে কি? বিড়বিড় করে জানতে চাইল রডরিক। যতই ঘনিয়ে আসছে সময় ততই মন খারাপ করে ফেলছে ও। মুখের চেহারা অস্বাভাবিক সরল আর নির্ভজ-এমন গম্ভীর হতে এর আগে দেখিনি কখনও ওকে।

ওর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছি আমি। চেহারায় সহজ আর উদ্বেগশূন্য ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। খালি হাত দুটো দুদিকে মেলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বললাম, দেখ-কোন অস্ত্র নেই আমার কাছে।

তুমি রেডি, মাসুদ? আবার বিড়বিড় করে জানতে চাইল রডরিক।

দাঁড়িয়ে পড়েছি আমরা দুজন। তাকিয়ে আছি একজন। আরেকজনের দিকে। অনেকটা অপ্রতিভ, বোকার মত। কোন কথা বলল না রডরিক। আমাকে ও কখনই শুভেচ্ছা জানাবে না, জানি আমি। ওর ধারণা, বিদায় বেলা শুভেচ্ছা উচ্চারণ করলে অশুভ শক্তির দৃষ্টিও আকৃষ্ট করা হয়।

পরে দেখা হবে, বিড় বিড় করে বলল রডরিক।

ঠিক আছে, রডরিক, আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম ওর। দিকে।

হাতটা ধরে চাপ দিল রডরিক, তারপর ঘুরে দাঁড়াল, হাঁটার পথে ঝুঁকে পড়ে তুলে নিল এফ. এন কারবাইনটা, গাছের ভেতর দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে।

যতক্ষণ দেখতে পাচ্ছি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। একবারও পেছন ফিরে দেখল না ও আমাকে।

আমি নিজেও এবার ঘুরে দাঁড়ালাম। নরম বালির ওপর দিয়ে হেঁটে নামছি সৈকতে।

গাছের শেষ সারিটা পেছনে রেখে সৈকতে বেরিয়ে এসেছি আমি। আরও এগিয়ে পানির কিনারায় দাঁড়ালাম। পানির ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছি ক্রাশবোটের দিকে। স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করলাম মাস্তুলের সাথে ঝুলন্ত লাশটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছি। ডেকে ঘোরাফেরা করছে সেন্ট্রিরা, কিন্তু কেউ দেখতে পায়নি এখনও আমাকে। দশটা বেজে এক মিনিট পেরিয়ে যেতে মাথার ওপর হাত তুলে নাড়ছি হাত দুটো, হ্যালো হ্যালো করে চিৎকার করছি। তিন সেকেণ্ড পর ক্রাশবোটে সাংঘাতিক দৌড়-ঝাপ শুরু হয়ে গেল।

সিডনি শেরিডান আর লোরনা পেজ উদয় হল রেইলের কাছে, দুজনে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অনর্গল কথা বলছে লোরনা, ওর ঠোঁট নড়া দেখে বুঝতে পারছি। সাংঘাতিক উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ অনুভব করছে ও। শেরিডান গম্ভীর। ওদিকে হুড়োহুড়ি করে নামছে ছয়জন লোক হোয়েলবোটে। এক মুহূর্ত পর দ্রুত ছুটে আসতে শুরু করল সেটা সৈকতের দিকে।

তীরে এসে বোট ভিড়তে না ভিড়তে লাফ দিয়ে নেমে এল হুমায়ুন দাদার ছয়জন অনুচর, দ্রুত চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল আমাকে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে এ. কে. ফরটি সেভেন, ব্যগ্রতার সঙ্গে নলগুলো চেপে রেখেছে আমার পিঠ আর তলপেটের ওপর।

মাথার ওপর হাত তুলে দিয়েছি আমি, চেহারায় বিষন্ন ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, একজন পেটি অফিসার চেক করছে আমাকে। আমার কাছে কোনরকম অস্ত্র নেই দেখে সম্ভবত বেজার। হল সে, আমার শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানে একটা হাত রেখে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল হোয়েলবোটের দিকে। আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, তাই আছাড় খেয়ে পড়লাম না। কিন্তু পেটি অফিসারের আচরণটাকে অবাধ লাইসেন্স হিসেবে ধরে নিয়ে অতি উৎসাহী তার এক লোক প্রচণ্ড একটা গুঁতো চালাল রাইফেলের নল দিয়ে আমার কিডনি লক্ষ্য করে। গুঁতোটা ছয় ইঞ্চি ওপরে খেলাম, সেজন্যে ভাগ্যকে ধন্যবাদ।

আবার কেউ সুযোগ নেবে, এই ভয়ে দ্রুত পা চালিয়ে। হোয়েলবোটে উঠে পড়লাম আমি, ভিড় করে উঠে এল আমার সঙ্গে ওরাও, মেশিনগানের নলগুলো আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঠেকিয়ে রেখেছে।

ক্রাশবোটে যখন উঠছি, আমাকে উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ল সিডনি শেরিডান, আবার দেখা হল, কেমন! নিষ্ঠুর দেখাচ্ছে ওর ঠোঁটের বাকা হাসিটা। আমি জানতাম!।

জানতে মানে? তোমার তো ধরে নেবার কথা সেভার্নের পানিতে ডুবে মরেছি আমি।

বুমেরাং থেকে তুমি যখন লাফ দিয়ে পড়লে, তখন খুশিই হয়েছিলাম, হাসছে শেরিডান। আসলে ভোরের আলো ঠিক কোথায় ডুবে আছে সে-ব্যাপারে পরিষ্কার কোন ধারণা ছিল না আমাদের। লোরনা জায়গাটা চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ ছিল আমার। তাই গাইড হিসেবে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হত আমাকে। যখন পালিয়ে গেলে, ভাল করে আর খুঁজলাম না। ধরে নিয়েছিলাম নির্দিষ্ট জায়গায় আবার পাওয়া যাবে তোমাকে। তুমি যে অত সহজে মরবে না, সে তো জানা কথা।

কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, আমার পেছনে দাঁড়ানো লোকটাকে নিঃশব্দে ইশারা করল শেরিডান। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলাম দুই শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানে, ডেকের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে এসেছি ছিটকে। প্রচণ্ড রাগে আগুন ধরে গেল শরীরে, দাঁতে দাঁত চেপে সামলাতে চেষ্টা করছি নিজেকে। রাফেলার কথা মনে। করতেই সহ্য করার একটা শক্তি পেলাম মনের ভেতর।

সাদামাঠা ক্যানভাস কুশনে মোড়া নিচু একটা কাউচে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে কমাণ্ডার হুমায়ুন দাদা, কাউচ-এর চারদিক থেকে উপচে পড়ছে তার শরীর। ইউনিফর্ম জ্যাকেটটা খুলে রেখেছে সে, তার পাশের বাল্কহেডের সঙ্গে একটা হুকে ঝুলছে সেটা সবগুলো পদক সহ। পরে রয়েছে শুধু একটা ঘামে ভেজা আস্তিন ছাড়া ধূসর রঙের ভেস্ট। এই সাত-সকালেও তার হাতে মদের গ্লাস দেখতে পাচ্ছি আমি।

এই যে, রানা, পরম বন্ধু-নাকি চরম শত্রু? কয়লার তৈরি বিশাল একটা মূর্তির মত দেখাচ্ছে ওকে, নিঃশব্দে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। আছ কেমন? সব খবর ভাল? মানসিক অবস্থা? আমার ওপর রাগ করে নেই তো?

জোর করেও হাসতে পারলাম না আমি। ওর সঙ্গে বিদ্রুপ বিনিময় করব, মনের সে-অবস্থা নেই। আমি আর রাফেলা কতটুকু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আটকা পড়েছি সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভুল ধারণা নেই আমার। উত্তেজনা আর ভয়ে টান টান হয়ে আছে স্নায়ু।

আমার বিশ্বস্ত বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে, কেবিনে ঢুকছে সিডনি শেরিডান আর লোরনা, ইঙ্গিতে ওদেরকে দেখিয়ে আমাকে বলছে হুমায়ুন দাদা, তোমার সম্পর্কে আশ্চর্য সব গল্প শুনেছি আমি, রানা। বিশ্বাস কর, তুমি যে এতবড় প্রতিভা আর এমন করিৎকর্মা পুরুষ, আগে তা বুঝিনি আমি।

ধন্যবাদ, হুমায়ুন, বললাম ওকে। সত্যিই তুমি নিরেট একটা ইট ভরে রেখেছ মাথার ভেতর। কিন্তু পরস্পরের প্রশংসা করার সময় পরে আরও পাওয়া যাবে। কাজের কথায় আসা যাক। এবার, কি বল?

খাটি কথা! সায় দিয়ে মাথা দোলাল হুমায়ুন দাদা। লক্ষ্মী ছেলে, কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না! শেষ মন্তব্যটা করল সিডনির দিকে তাকিয়ে।

বাঘ-সিংহাসনটা তুলেছ তুমি, রানা, অকারণ রূঢ় কণ্ঠে বলল শেরিডান। আমরা জানি।

এদিক-ওদিক মাথা দোলালাম আমি। পুরোটা নয়, অংশ বিশেষ। বাকি অংশগুলো নেই ওখানে। যতটুকু ছিল, হ্যাঁ, তুলেছি।

ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম তোমার কথা, বলল সিডনি। এবার বল কি উদ্ধার করেছ?

বাঘের মাথাটা। সোনার তৈরি। প্রায় তিনশো পাউণ্ড ওজন।

দ্রুত অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল শেরিডান আর হুমায়ুন দাদা।

আর?

প্রশ্নটা করল সিডনি এবং ওর চোখের পাতা নড়ে উঠতে দেখেই বুঝলাম নির্যাতনের সময় যতটুকু জানে তার প্রায় সবটুকু ওদেরকে বলে দিয়েছে রাফেলা। এর জন্যে ওকে দোষ দিতে পারি না। এটাই আশা করেছিলাম আমি।

আর রয়েছে জুয়েলের সিন্দুকটা। সিংহাসন থেকে খুলে সব পাথর রাখা হয়েছিল এই সিন্দুকটায়।

তারপর? লোভ আর জেদের সুরে জানতে চাইল সিডনি। ডায়মণ্ডটা-গ্রেট মুঘল?

পেয়েছি আমরা ওটাও, মৃদু কণ্ঠে, যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিলাম আমি।

ফিস ফিস করছে ওরা, হাসছে, পরস্পরকে সায় দিয়ে মাথা নাড়ছে ঘন ঘন।

কিন্তু, ওদেরকে জানালাম, কোথায় আছে সেটা তা শুধু একা আমি জানি।

সঙ্গে সঙ্গে মুখের হাসি নিভে গেল ওদের। টান টান হয়ে উঠল পেশী, বোবা হয়ে গেছে দুজনেই। একচুল নড়ছে না আর কেউ।

এবার বিনিময় ব্যবসা করার মত কিছু রয়েছে আমার কাছে, সিডনি। তুমি আগ্রহী?

আমরা আগ্রহী, রানা-সাংঘাতিক আগ্রহী, শেরিডানের হয়ে উত্তর দিল হুমায়ুন দাদা।

গুপ্তধন প্রায় দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে আসায় আমার দুই শত্রুর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে টের পাচ্ছি আমি।

আমার দাবি, রাফেলা বার্ডকে চাই আমি।

রাফেলা বার্ড? দাবিটা শুনে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল শেরিডান, তারপর এমন কৌতুক বোধ করল যে হাসির দমকে খকখক্ করে কাশতে শুরু করে দিল সে। হাসি আর কাশি থামিয়ে বলল সে, যতটা ভেবেছিলাম তুমি তার চেয়ে আরও অনেক বড় বোকা, রানা।

মেয়েটার কোন গুরুত্ব নেই আমাদের কাছে-আমরা ওর ব্যাপারে আগ্রহী নই, গ্লাসে চুমুক দিয়ে মদটুকু নিঃশেষ করল হুমায়ুন দাদা, গ্লাসটা ছুঁড়ে দিল শূন্যে। ডেকে পড়ার আগেই একজন ক্রু লুফে নিল সেটা। ওকে তুমি ফিরিয়ে নিতে পার, রানা।

দ্বীপ থেকে চলে যাবার জন্যে আমার হোয়েলবোট, ফুয়েল আর পানি চাই আমি।

ন্যায্য দাবি, রানা, খুবই ন্যায্য দাবি, হাসছে শেরিডান। যেন গোপন মতলবটা স্মরণ করছে এই মুহূর্তে।

আর বাঘের মাথাটা চাই আমি।

সঙ্গে সঙ্গে হাসির বিস্ফোরণ ঘটল কেবিনের ভেতর।

রানা! রানা! এখনও হাসছে হুমায়ুন দাদা, অথচ দুঃখে কাতর ভঙ্গিতে নিজের কপাল চাপড়াচ্ছে হাত দিয়ে।

রানা লোভী! ফেঁড়ন কাটল লোরনা।

রানা বোকা!

কি আশ্চর্য! আমি কি কিছুই পেতে পারি না? ডায়মণ্ডটা নিচ্ছ তোমরা, প্রায় পঞ্চাশ পাউণ্ড ওজনের একগাদা মূল্যবান পাথর দিচ্ছি… যতটা সম্ভব আহত আর অভিমানের সুরে দরকষাকষির অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছি, ওদের চোখে এটাই স্বাভাবিক মনে হবে। ..এসবের তুলনায় মাথাটা তো কিছুই নয়। এক গ্রেট মুঘলই ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ লাখ ডলারে বেচবে তোমরা, আর মাথাটা বিক্রি করে টেনেটুনে খরচটা শুধু উঠবে আমার।

তুমি খুব কঠিন পাত্র, রানা, নিরাশ ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক প্রকাণ্ড মাথাটা দোলাচ্ছে হুমায়ুন দাদা। অবশ্য কঠিন জিনিসকে তুলোর মত নরম করার সমস্ত কৌশল জানা আছে আমার।

এ থেকে তাহলে কি পাচ্ছি আমি? জানতে চাইলাম আমি।

দুটো জীবন পাচ্ছ-তোমার আর তোমার বান্ধবীর। আর এই দুটো পেয়েই সুখী ও কৃতজ্ঞ বোধ করতে হবে তোমাকে, নিচু গলায় কথাগুলো বলল শেরিডান। ওর চোখে তাকিয়ে মনে মনে শিউরে উঠলাম আমি, অদ্ভুত একটা শীতলতা রয়েছে ওর দৃষ্টিতে, সাপের মত। গুপ্তধন একবার ওকে দেখিয়ে দেবার পর কি করবে ও তা লেখা রয়েছে সেখানে পরিষ্কার।

কিন্তু তোমাদেরকে আমি বিশ্বাস করব কিভাবে? অসহায় চোখে তাকালাম প্রথমে হুমায়ুন দাদা, তারপর শেরিডানের দিকে।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল শেরিডান। তোমার আর কোন উপায় নেই, রানা।

রানা, বলল হুমায়ুন দাদা, আমাদেরকে তুমি বিশ্বাস করবে নাইবা কেন? তোমাদেরকে খুন করে সম্ভাব্য কি লাভ পেতে পারি আমরা?

লোকসানটাই বা কোথায়? ভাবলাম আমি। কিন্তু একটু চিন্তা করার ভান করে মাথা নাড়লাম, বললাম, ঠিক আছে। আর কোন উপায় যখন নেই।

আবার ওরা হাসি খুশি হয়ে উঠল। চোখে-চোখে ভাব বিনিময় হচ্ছে। একজন ক্রুর বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে হুইস্কি ভরা গ্লাসটা নিয়ে নিঃশব্দ স্যালিউটের ভঙ্গিতে কপালের পাশে তুলল সেটাকে হুমায়ুন দাদা। ড্রিঙ্ক, রানা? আদরের সুরে আমন্ত্রণ জানাল সে।

সকালের দিকে অভ্যাস নেই, হুমায়ুন, জানালাম ওকে। তবে রাফেলাকে এখন দেখতে পেলে খুশি হব আমি।

নিজের একজন লোককে ইঙ্গিত করল হুমায়ুন দাদা। যাও নিয়ে এসো ওকে।

ফুয়েল আর পানি থাকবে হোয়েলবোটে, সেটা তোমরা সৈকতে রাখবে আমাদের জন্যে, জেদের সুরে স্মরণ করিয়ে দিলাম আমি।

রাজি হয়ে মাথা কাত করল হুমায়ুন দাদা, নিজের আরেকজন লোককে ইশারায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে বলল।

আমরা যখন সৈকতে যাব, মিস রাফেলাও থাকবে আমাদের সঙ্গে। সিন্দুক আর বাঘের মাথা আমি তোমাদেরকে দেখিয়ে দেবার পর ওগুলো সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে তোমরা, পালা করে দুজনের দিকে তাকালাম আমি। দ্বীপে আমাদেরকে তোমরা রেখে যাবে অক্ষত অবস্থায়-রাজি?

অবশ্যই, রানা, নিরস্ত্র ভঙ্গিতে হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে দিল হুমায়ুন দাদা। তোমার সঙ্গে আমরা সবাই একমত।

ভয় পাচ্ছি, আমার চোখের অবিশ্বাস ওদের দৃষ্টিতে ধরা না পড়ে যায়। ফাঁকি দেবার জন্যে ঘাড় ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়েছি, কেবিনের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখলাম রাফেলাকে। সুখ আর স্বস্তির একটা পরশ অনুভব করছি শরীরে।

কিন্তু রাফেলার দিকে ভাল করে তাকাতেই দপ্ করে আগুন জ্বলে উঠল আমার সারা গায়ে।

ফুলে রয়েছে রাফেলার ঠোঁট দুটো। রানা, অতি কষ্টে, বিকৃত উচ্চারণে বলল ও, তুমি এসেছ-ওহ্ গড, তুমি এসেছ! টলমল করছে রাফেলা, আমার দিকে ছুটে আসতে চাইছে-কিন্তু শরীরের শক্তিতে কুলাচ্ছে না ওর। এক পা এগিয়ে তাল সামলাতে চেষ্টা করছে ও।

গালের দুদিকেই দগদগে ক্ষত রয়েছে ওর, দেখে মনে হচ্ছে একদিকের চোয়ালের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চোখের নিচে আঁচড়ের দাগগুলো ভূতুড়ে ভাব এনে দিয়েছে চেহারায়। নাকের ফুটো দুটোর কিনারায় এঁটে বসে আছে শুকনো রক্ত। ওর এই দুর্দশা দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি, আলিঙ্গনের মধ্যে নিয়ে এসে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখলাম ওকে।

সকৌতুক কৌতূহলের সঙ্গে আমাদেরকে দেখছে ওরা। ওদের দৃষ্টির স্পর্শ পাচ্ছি আমি শরীরে। চোখ খুলেছি, কিন্তু আমার চোখে খুনের নেশাটা ওদেরকে দেখতে দিতে চাই না বলে ঘাড় ফিরিয়ে দুজনের কারও দিকে তাকাচ্ছি না।

দ্রুত নিজেকে সামলে নিলাম আমি। ঠিক আছে, ওদের দিকে ফিরে বললাম আমি, চলো, ঝামেলাটা সেরে ফেলা যাক।

দুঃখিত, রানা-তোমাদের সঙ্গে সৈকতে যেতে পারছি না আমি, কোচে বসে থেকেই বলল হুমায়ুন দাদা। ছোট বোটে ওঠানামা, গায়ে রোদ নিয়ে বালির ওপর হাঁটাহাঁটি, এসব আমার ধাতে নেই। আমি তোমাকে এখান থেকেই শুভ বিদায় জানাব, রানা, আবার সে ইঙ্গিতে শেরিডান আর লোরনাকে দেখাল, আমার বন্ধুরা আমার প্রতিনিধি হিসেবে যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে। আর, মনে রেখো, আমার নিজের বারোজন লোক যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে-ওরা সবাই অস্ত্র আর আমার নির্দেশ বহন করবে। বুঝলাম হুমায়ুন দাদার প্রচ্ছন্ন হুমকিটা শুধু আমাকে উদ্দেশ্য করেই নয়।

গুডবাই, হুমায়ুন। আবার হয়ত দেখা হবে আমাদের।

আমার তা মনে হয় না, রানা, তৃপ্তির সঙ্গে একটা ঢোক গিলে বলল হুমায়ুন দাদা। হাতের প্রকাণ্ড আর লালচে তালু দিয়ে বাতাসে একটা থাবা মেরে আমাকে বিদায় জানাল সে।

মোটর বোটে আমার পাশে বসল রাফেলা। আমার গায়ে হেলান দিয়ে আছে ও। শীতার্ত পাখির ছানার মত কাঁপছে। ওর কাঁধের ওপর হালকা করে একটা হাত তুলে দিয়েছি আমি, ওর মাথাটাকে রাখতে দিয়েছি আমার কাঁধে।

কয়েকবার চেষ্টা করল রাফেলা, কিন্তু যা বলতে চাইছে তা উচ্চারণ করতে পারছে না। ওর ঠোঁটের কাছাকাছি নামালাম মুখটা, কানটা এগিয়ে দিলাম।

ওরা আমাদেরকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছে, রানা, ফিসফিস করে বলল ও। তুমিও তা জানো, তাই না?

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম আমি। রাফেলার হাতের ব্যাণ্ডেজের ওপর আঙুল বুলিয়ে নরম গলায় জানতে চাইলাম, তোমার হাতের কি অবস্থা?

চকিতে সিডনির পাশে বসা স্বর্ণকেশী লোরনার দিকে তাকাল রাফেলা। শিউরে উঠল ও, ফিস ফিস করে বলল, লোরনা…লোরনা আমাকে… কথাটা শেষ করতে পারল না।

চোখ বড় বড় করে চেয়ে রয়েছে লোরনা, পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েছে। পাশে বসা শেরিডানের মুখের কাছে মুখ নিয়ে চাপা উত্তেজনার সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে সে। সামনে থেকে পেছন দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে ফিতের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে চুল, বাতাসে সেগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে না। প্রচুর সময় আর যত্ন নিয়ে প্রচুর। কসমেটিকস ব্যবহার করেছে মুখে, নানান রঙ ঝলমল করছে সেখানে। আগুনের মত জ্বলছে লাল লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট দুটো। রূপালী সবুজ ব্যবহার করেছে চোখের পাতায়, একই রঙের টানা ভুরু এঁকেছে বন-বিড়ালী চোখের ওপর।

ওরা কয়েকজন শক্ত করে ধরে রেখেছিল আমাকে-আর একটা একটা করে লোরনা আমার আঙুলের নখ উপড়েছে, আবার শিউরে উঠল রাফেলা।

ছোট্ট, হালকা শব্দ করে হেসে উঠল লোরনা। সোনালী ডানহিল লাইটার জ্বেলে ওর সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে শেরিডান।

সিংহাসনটা কোথায় জানতে চাইছিল ওরা-আমি উত্তর দিতে না পারলেই লোরনা প্লায়ার্স দিয়ে একটা করে নখ উপড়ে নিচ্ছিল আমার। রানা, মাংস থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার সেই শব্দ এখনও আমি শুনতে পাচ্ছি… প্রায় নিঃশব্দে কেঁপাচ্ছে রাফেলা। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছি আমি।

শান্ত হও, রাফেলা, ভুলে যেতে চেষ্টা করো, অনুনয়ের সুরে ফিস ফিস করে বললাম ওকে। আমার আরও একটু কাছে সরে এল ও। আমার কাছ থেকে শক্তি সাহস আশা ভরসা এইসব পেতে চাইছে ও। এদিকে মাথার ভেতরটা বিস্ফোরিত হবার আগেই প্রচণ্ড রাগটাকে আবার ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করছি আমি।

তীরে এসে ভিড়ল মোটরবোট। সৈকতে নেমে রাফেলার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি, আমাদেরকে ঘিরে রয়েছে সশস্ত্র সেন্ট্রিরা।

ঠিক আছে, রানা? হাত বাড়িয়ে অল্প দূরে নোঙর করা হোয়েলবোটটা দেখাল আমাকে শেরিডান। ফুয়েল ঢেলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে ট্যাঙ্কগুলো। যথেষ্ট পানিও তুলে দেয়া হয়েছে। সোনাদানাগুলো কোথায় দেখিয়ে দাও-তারপর চলে যেতে পারবে তোমরা। শেরিডান যেন মাটির মানুষ, সরল শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল সে।

কিন্তু ওর পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে-ঠিক শিয়াল যেভাবে মুরগীর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভাবছি, কে জানে আমাদের জন্যে কি ধরনের নিষ্ঠুর ব্যবস্থা মনে মনে ঠিক করে রেখেছে ও। আমাদের প্রয়োজন ফুরোলে, সন্দেহ নেই, ওর হাতে আমাদেরকে তুলে দেবে শেরিডান, এ ব্যাপারে কথাবার্তা হয়ে গেছে ওদের মধ্যে।

আশা করি ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে খামোকা সময় নষ্ট করবে না তুমি, রানা।

লক্ষ করছি, সঙ্গে করে নিজের চারজন লোককেও নিয়ে এসেছে শেরিডান। তারা নিঃশব্দ ইঙ্গিত পেয়ে ইতিমধ্যেই প্রায় ঘিরে ফেলে পাহারা দিচ্ছে তাকে। এদের প্রত্যেকের হাতে পিস্তল রয়েছে। একজনকে চিনতে পারছি-রোভার গাড়িটার ড্রাইভার।

হুমায়ুন দাদার তরফ থেকে রয়েছে একজন পেটি অফিসারের অধীনে দশজন আফ্রিকান নিগ্রো ক্রু। টের পাচ্ছি, আমার শত্রুরা ইতিমধ্যেই দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে, দুই দলের মধ্যেই নিঃশব্দে বেড়ে উঠছে উত্তেজনা। কৌশলে প্রতিপক্ষ দলের দুজন লোককে অকেজো করে দিল শেরিডান। মোটরবোট পাহারা দেবার জন্যে এই দুজনকে সৈকত ছেড়ে কোথাও যেতে নিষেধ করল সে।

এরপর আমার দিকে ফিরল আবার। চলো, রানা। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো।

নারকেল গাছগুলোকে এড়িয়ে এঁকেবেঁকে উঠছি আমরা। কনুই ধরে হাঁটতে সাহায্য করছি রাফেলাকে আমি। টলছে ও, এলোমেলোভাবে পা ফেলছে আর হাঁপাচ্ছে। গুহাগুলোর কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই ক্লান্তি, ব্যথা আর দুর্বলতায় নিঃশব্দে ফোঁপাতে শুরু করল।

আহা রে, পেছন থেকে প্রলম্বিত লয়ে সুর করে বলল, লোরনা, ঢং দেখে বাচি না!

শক্ত হয়ে গেল রাফেলার কাঁধের পেশী, কিন্তু কিছু বলতে চেষ্টা করল না ও। আমিও হজম করলাম ব্যাপারটা।

পেছনে সশস্ত্র লোকদের নিয়ে ঢালের নিচের কিনারা ধরে। এগোচ্ছি আমরা। পথে একবার মাত্র চুপিসারে তাকালাম রিস্টওয়াচের দিকে। ক্রাশবোটের নিচে জেলিগনাইট বিস্ফোরিত হতে এখনও আধ ঘন্টা বাকি।

সিন্দুক কোথায় পোঁতা আছে তা ওদেরকে দেখিয়ে দেবার আগে একটু অভিনয় করতে হল আমাকে। সবচেয়ে কাছের গাছটার পাশ থেকে পা গুণে গুণে এগোলাম আমি, এক জায়গায় থেমে বাঁক নিলাম, আবার সামনে বাড়লাম কয়েক পা। এখানে। দাঁড়িয়ে পায়ের দিকে তাকালাম, যেন চারপাশের মাটি পরীক্ষা করছি। সামনে থেকে উঠে গেছে ঢালটা, পঞ্চাশ ফুট ওপরে ভাঁজ খাওয়া মাটি ঢাকা পড়ে রয়েছে ঘন ঝোপ আর লম্বা ঘাসে-এসব কল্পনার চোখে দেখছি আমি, মুখ তুলে সেদিকে তাকাবার ঝুঁকি নিচ্ছি না।

পায়ের সামনের মাটি আঙুল দিয়ে দেখালাম সিডনিকে। পিছিয়ে সরে আসতে শুরু করে বললাম, এখানে খুঁড়তে বল।

চারজন ক্রু তাদের একজন সহকর্মীর কাছে অস্ত্রগুলো জমা রাখল, সঙ্গে নিয়ে আসা ছোট ভাঁজ করা আর্মি-টাইপ। কোদালগুলো জোড়া লাগাচ্ছে দ্রুত।

এমনিতেই নরম মাটি, তার ওপর এর আগে নাড়াচাড়া করা হয়েছে, আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে গভীর করে তুলছে ওরা গর্তটাকে।

ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে ও, ইঙ্গিতে রাফেলাকে দেখিয়ে শেরিডানকে বললাম আমি, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না-কোথাও বসতে হবে ওকে।

ঝট করে আমার দিকে তাকাল সিডনি শেরিডান। আমার কোন মতলব আছে কিনা, চোখের লেখা পড়ে বুঝতে চাইছে।

দ্রুত চিন্তা করছে শেরিডান। দৌড়ে পালিয়ে যাবে রাফেলা, সে শক্তি নেই ওর, বুঝতে পারছে সে। হুমায়ুন দাদার আরও দুজন লোককে দূরে সরিয়ে দেবার অর্থাৎ অকেজো করে দেবার মস্ত একটা সুযোগ এটা। এইসব ভাবছে সে, তার মুখের চেহারা দেখে পরিষ্কার ধরতে পারছি আমি।

পেটি অফিসারের সঙ্গে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলল সে। তারপর আমার দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকাল ছোট্ট করে।

রাফেলার হাত ধরে সবচেয়ে কাছের নারকেল গাছটার দিকে পা বাড়ালাম আমি। অগভীর নালার পাশে, গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসলাম আমরা। পাশাপাশি হেঁটে এসেছে দুজন সশস্ত্র গার্ড। দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দুপাশে।

বসে এখন আরাম পাচ্ছে রাফেলা। আমার রুমালটা দিলাম ওকে। ধীরে ধীরে কপাল আর মুখ থেকে ঘাম মুছছে ও। এখন আর তত জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে না।

ঢালের ওপর দিকে আলগোছে একবার চোখ বুলালাম আমি। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ছে না ওখানে। তবে, আমি জানি উত্তেজনায় ব্যর্থ হয়ে একদৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখছে রডরিক। দুজন গার্ড ছাড়া বাকি সবাই গর্তের ভেতর দাঁড়ানো চারজন লোকের চারদিকে ভিড় করে রয়েছে, আশায় আর উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠেছে ওদের সবার পেশী।

আমাদের দুজন গার্ডকেও কুরে খাচ্ছে কৌতূহল। বারবার ঘাড় ফিরিয়ে চল্লিশ গজ পেছনের ভিড়টার দিকে তাকাচ্ছে ওরা।

সিন্দুকের গায়ে লোহার কোদালের বাড়ি লাগল-ক্ল্যাঙ্ক শব্দটা। পরিষ্কার ভেসে এল আমার কানে। পরমুহূর্তে উল্লাসে চেঁচিয়ে। উঠল গর্তের চারদিক থেকে ওরা সবাই। হৈ-চৈ-এর সঙ্গে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল ওরা, একজন আরেক জনের কনুই ধরে। পেছন দিকে টানছে, গর্তের ভেতরটা ভাল করে দেখার সুযোগ খুঁজছে। আমাদের গার্ড দুজনও দূর থেকে তাকিয়ে আছে। ওদিকে, ঘুরে গেছে ওরা, পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছে আমাদের দিকে।

শেরিডান ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল দুজন ক্রুকে, গর্তের ভেতর। মাটি কাটছে যারা তাদের পাশে নামল সে লাফ দিয়ে। ওর চিৎকার শুনতে পাচ্ছি আমি, ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি কর! দড়ি এনে বাঁধ একটাকে, তারপর সবাই মিলে টেনে তোল। সাবধান, কিছু যেন নষ্ট না হয়!

গর্তের দিকে ঝুঁকে রয়েছে স্বর্ণকেশী লোরনাও। নিখুঁত পরিস্থিতি। এর বেশি আমি কিছু আশা করতে পারি না।

ডান হাতটা তুলছি আমি। ধীরে ধীরে কপালটা মুছছি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে। জানি, আমার দিকে তাকিয়ে আছে রডরিক। দেখতে পাচ্ছে সিগন্যালটা।

কপাল থেকে ঝট করে নামিয়ে নিলাম হাতটা। রাফেলাকে আঁকড়ে ধরেছি, ওকে সঙ্গে নিয়ে কাত হয়ে পড়ে গিয়েই দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছি অগভীর নালাটার দিকে।

হতভম্ব হয়ে গেছে রাফেলা। নালার ভেতর আশ্রয় নিতে দেরি হয়ে যাবে এই ভয়ে নির্মমভাবে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছি ওর সঙ্গে আমি। আহত শরীরের ওপর চাপ, ধাক্কা আর গুঁতো খাচ্ছে ও, ব্যথায় গোঙাচ্ছে।

বিন করে একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল আমাদের দিকে গার্ড দুজন। ঘোরার মধ্যেই তুলে ফেলেছে সাবমেশিনগান, গুলি করতে যাচ্ছে। অগভীর নালা কোন আড়ালই দিচ্ছে না আমাদেরকে।

খোদার দোহাই, রডরিক, এখন! আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে আমার চোখ, চেয়ে আছি একজোড়া মেশিনগানের গভীর কালো নলের ফুটোর দিকে, ঝাঁপিয়ে পড়েছি রাফেলার ওপর আমার শরীর দিয়ে ওকে ঢেকে রাখার জন্যে। বড়জোর এইটুকুই ওর জন্যে করতে পারি, আমাকে শেষ করে তারপর ওর গায়ে বিধুক বুলেটের ঝাঁক।

সেই মুহূর্তে, সেই মারাত্মক সর্বশেষ মুহূর্তে খিলখিল করে হেসে উঠল লোরনা, আগুনের আঁচের মত কানের পর্দায় এসে লাগছে তার হাসি, ঝাঁক ঝাঁক বুলেটের ধাক্কায় ঝাঁকি খাবার জন্যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তৈরি হয়ে গেছি আমি। আর সেই মুহূর্তে, সেই প্রিয় মুহূর্তে ইলেকট্রিক ব্যাটারি ব্লাস্টারের নবটা টিপে দিল রডরিক। আগের রাতে সাবধানে লুকিয়ে রাখা ইনসুলেটেড ওয়্যার বেয়ে নেমে আসছে বিদ্যুৎ। সিন্দুকে ঠাসা রয়েছে হাফ কেস জেলিগনাইট-আমার আর রাফেলার নিরাপত্তার কথা ভেবে যতটুকু বিস্ফোরক ভরা সম্ভব সবটুকু ভরে রেখেছি ওতে। প্রচণ্ড আওয়াজ করে ফাটল বোমাটা।

সিন্দুকটা বিস্ফোরিত হওয়ায় রডরিকের নিঃশব্দ হাসি কল্পনা করতে পারছি আমি। গর্তের গায়ে ধাক্কা খেয়ে, গর্তটাকে আরও বড় করে তুলে সিন্দুকসহ সবকিছু উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। গর্তের কিনারায় যারা দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ বাদ গেল না। বন বন করে পাক খাচ্ছে চামড়া ছেলা রক্তাক্ত লোকগুলো, ডিগবাজি খাচ্ছে শূন্যে-উঠে যাচ্ছে এখনও ওপর দিকে। ওদেরকে ছাড়িয়ে একশো ফুট পর্যন্ত উঠে গেছে ধুলো আর বালির খাড়া একটা স্তম্ভ।

মাটির প্রচণ্ড কাঁপনে ঠোকাঠুকি খেলাম আমি আর রাফেলা, পরমুহূর্তে আমাদের দিকে ছুটে এল শক ওয়েভ। এক ধাক্কায় চিৎ করে ফেলে দিল গার্ড দুজনকে, শরীরের কাপড় ছিঁড়ে দিয়ে গেছে।

আমার কানের পর্দা দুটো ফেটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। কিন্তু রাফেলার কান দুটো হাত দিয়ে চেপে রেখেছিলাম, তাই বেঁচে গেছে ওরগুলো।

ধুলোবালির নিচে চাপা পড়ে গেছি আমরা। গড়িয়ে নেমে এলাম রাফেলার ওপর থেকে, ব্যগ্র উন্মত্ততার সঙ্গে নালার বেলে মাটি খুঁড়ছি নখ দিয়ে। সাবমেশিনগানের গায়ের সঙ্গে আটকে গিয়ে আঙুলের একটা নখ প্রায় উল্টে গেল আমার। ভ্রূক্ষেপ না করে বালির নিচ থেকে টেনে বের করে নিলাম অস্ত্রটা, জড়িয়ে থাকা শার্টটা খুলে ফেলে দ্রুত উঠে দাঁড়াচ্ছি হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে।

আমার কাছের গার্ড দুজনেই বেঁচে রয়েছে। একজন বসে বসে টলছে, কানের পর্দা ফেটে গেছে তার, জুলফি বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে রক্তের ধারা। আরেকজন হামাগুড়ি দিচ্ছে। ছোট্ট করে দুবার ট্রিগার টিপে শেষ করলাম ওদেরকে, দৃষ্টিপথে বাধা হয়ে রয়েছে দেখে ব্যারেলের গুতো মেরে বসে থাকা লোকটাকে বালির ওপর তাড়াতাড়ি পড়ে যেতে সাহায্য করলাম।

এবার তাকালাম গর্তের চারদিকে ছড়ানো মাংসপিণ্ডের ভাঙাচোরা স্তূপের দিকে।

ওখানে মন্থর গতিতে মোচড় খাচ্ছে মাংসপিণ্ড, নরম গোঙানির শব্দ উঠছে। নালা থেকে উঠে এলাম আমি, থরথর করে কাঁপছি। মুখ তুলে তাকাতেই ঢালের ওপর দেখতে পাচ্ছি রডরিককে, পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আরেক কালো পাহাড়। গলার দুপাশের রগগুলো ফুলে উঠেছে ওর, চিৎকার করে কি যেন বলছে, কিন্তু কানের ভেতর ঝন ঝন শব্দে একনাগাড়ে বাজছে বিস্ফোরণের সেই প্রচণ্ড আওয়াজ, আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না আমি।

দাঁড়িয়ে আছি এখানে, নিজে থেকেই সামনে পিছনে মৃদু দোল খাচ্ছে শরীরটা, হতভম্ব বোকার মত তাকাচ্ছি চারদিকে। ধীরে ধীরে উঠে বসছে রাফেলা, দেখতে পাচ্ছি আমি। আমার পাশে এসে দাঁড়াল ও। হাত রাখল আমার একটা কাঁধে। স্বস্তির শীতল পরশ অনুভব করলাম শরীরে ওর কণ্ঠস্বর অস্পষ্টভাবে আমার কানে আসছে বুঝতে পেরে।

বিস্ফোরিত জায়গার দিকে তাকালাম আবার। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলাম আমি আর রাফেলা।

মানুষেরই একটা মূর্তি ওটা, সব কাপড়চোপড় এবং বেশিরভাগ গায়ের ছাল শরীর থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। কাঁচা, রক্তঝরা একটা ভীতিকর বস্তু। কাঁধের খোপ থেকে বেরিয়ে এসেছে আধখানা হাতের হাড়, এক চিলতে রক্তাক্ত মাংসের সঙ্গে ঝুলছে সেটা শরীরের পাশে। ধীরে ধীরে গর্তের ভেতর থেকে উঠে আসছে সে, যেন প্রাচীন কবর থেকে উঠে আসছে গলিত লাশ।

গর্তের ওপর উঠে এক সেকেণ্ডের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকল সে স্থির হয়ে, এতক্ষণে শেরিডানকে চিনতে পেরে আবার একবার শিউরে উঠলাম আমি। এই রকম প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে গেছে ও, তা যেন আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু তার চেয়েও অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আমার দিকে সোজা হেঁটে আসছে ও।

মাটিতে ঘষে ঘষে পা ফেলছে ও, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, ক্রমশ কাছ থেকে আরও কাছে চলে আসছে জ্যান্ত একটা আতঙ্কের মত। এখন আমি দেখতে পাচ্ছি, অন্ধ হয়ে গেছে ও। দুই চোখের কোটর ভরাট হয়ে গেছে বালিতে। এক ইঞ্চি চামড়া নেই ওর মুখে। সুন্দর চুল সহ খুলির ওপর থেকে মাথার সবটুকু ছাল গায়েব হয়ে গেছে।

অস্পষ্ট কিন্তু একটানা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পাচ্ছি রাফেলার, ভয়ে আমার পিঠের মাংস আঁকড়ে ধরেছে ও, মুখ লুকাচ্ছে আমার দুই শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানে।

ধীরে ধীরে তুললাম সাবমেশিনগানটা। বুলেটের সরল রেখা শেরিডানের বুক ভেদ করে বেরিয়ে গেল। মৃত্যু এসে বাঁচিয়ে দিল ওকে।

আচ্ছন্নবোধটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি এখনও। চারদিকে ঘাড় ফিরিয়ে নিজের তৈরি হত্যাযজ্ঞটা দেখছি, এই সময় আমার কাছে পৌঁছুল রডরিক। আমার একটা হাত চেপে ধরেছে ও। শুনতে পাচ্ছি ওর চিৎকার, তুমি ঠিক আছ, মাসুদ? নিঃশব্দে মাথাটা একদিকে কাত করলাম আমি, তাই দেখে আবার চেঁচিয়ে উঠল রডরিক, হোয়েলবোট! যেভাবে হোক ওটাকে হাতছাড়া করা চলবে না আমাদের।

রাফেলার দিকে ফিরলাম আমি, দুহাতে মুখ ঢেকে এখনও ফোঁপাচ্ছে ও। গুহায় ফিরে যাও তুমি। ওখানে অপেক্ষা কর আমার জন্যে, বললাম ওকে। নিঃশব্দে ঘুরে দাড়াল ও।

এদের ব্যাপারে আগে নিশ্চিত হওয়া যাক, বিড় বিড় করে বললাম রডরিককে। ওকে পাশে নিয়ে হাড়গোড় আর মাংসের স্তূপের দিকে এগোলাম আমি। ওরা সবাই মারা গেছে নয়ত মারা যাচ্ছে। মাটিতে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে লোরনা পেজ। লেস দিয়ে তৈরি আণ্ডার-ওয়্যারটা ছাড়া শরীরের আর সব কাপড় ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে, শুধু কোমরের কাছে রক্ত আর দলা পাকানো মাংসের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে এক টুকরো সবুজ স্ল্যাক স্যুটের কাপড়। একটা হাঁটু ভেঙে গেছে ওর, সাদা হাড়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে আসছে এখনও রক্তের স্রোত।

বিস্ফোরণটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে লোরনার পরিপাটি করে যত্ন নেয়া চুলের সাজ এখনও অটুট হয়ে রয়েছে, শুধু পাউডারের মত মিহি বালির গুঁড়ো সাদা করে দিয়েছে চুলগুলোকে। ওকে নিয়ে মহা এক কৌতুক সৃষ্টি করেছে মৃত্যু-বিস্ফোরণের ধাক্কায় সিন্দুক থেকে বেরিয়ে এসে ব্লু ল্যাপিজ লাজুলির একটা টুকরো সেঁধিয়ে গেছে লোরনার কপালের ঠিক মাঝখানে, হাড়ের সঙ্গে শক্ত ভাবে আটকে রয়েছে সেটা। ভাবছি, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিশ্চয়ই কোন ভাবে কয়েকটা পাথর সিন্দুকের ভেতর রয়ে গিয়েছিল।

লোরনার নিজের চোখ দুটো বন্ধ হয়ে রয়েছে, কিন্তু কপালের মাঝখানে মূল্যবান তৃতীয় চোখটা অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

একজনও বেঁচে নেই, বিড় বিড় করে বলল রডরিক।

হ্যাঁ, ওর সঙ্গে একমত হয়ে ছিঁড়ে আনলাম মেয়েটার ওপর আটকে যাওয়া আমার চোখের দৃষ্টি। বিজয়ের উল্লাস বা প্রতিশোধ গ্রহণের তৃপ্তি অনুভব করছি না লক্ষ করে আশ্চর্য হচ্ছি আমি। প্রতিশোধ চরিতার্থের অনুভূতি মিষ্টি তো নয়ই, বরং সম্পূর্ণ বিস্বাদ, রডরিককে অনুসরণ করে সৈকতের দিকে যাবার সময় ভাবছি।

বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমি, কান দুটো পরিষ্কার হয়ে এলেও শরীরের বল শক্তি ফিরে পাচ্ছি না। রডরিককে দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখার জন্যে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে। প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে আশ্চর্য হালকাভাবে হেঁটে যাচ্ছে ও, আর ভারী বোঝার মত কষ্ট করে নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি আমি।

গাছের শেষ সারি পেছনে রেখে সৈকতে বেরিয়ে এলাম আমরা। আমার কাছ থেকে দশ পা সামনে রয়েছে রডরিক। সৈকতের কিনারায়, ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম আমি।

যেখানে দেখে গিয়েছিলাম সেখানেই ভাসছে হোয়েলবোট, কিন্তু বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনার পর কোনরকম ঝুঁকি না নিয়ে মোটরবোট নিয়ে রওনা হয়ে গেছে গার্ড দুজন। এরই মধ্যে ক্রাশবোটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা। একজন আমাদেরকে দেখতে পেয়েই মেশিনগানের গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। কিন্তু ওটার নাগালের অনেক বাইরে আমরা, তাই গা ঢাকা দেবার কোন চেষ্টা করলাম না। তবে গুলির শব্দ শুনে ক্রাশবোটের বাকি ক্রুরা সৈকতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল আমাদেরকে। লাফ দিয়ে ছুটল তারা বো-তে ফিট করা কুইক ফায়ারার কামানের দিকে।

বিপদ হল দেখছি, ঘোঁত ঘোঁত করে উঠল রডরিক।

প্রথম শেলটা আমাদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে ছুটে গেল, পেছনের নারকেল গাছে লেগে বিস্ফোরিত হল সেটা, চারদিকে এ্যাপনেল ছুটোছুটি করার শব্দ পেলাম আমরা।

দ্রুত পিছিয়ে এসে গাছের আড়ালে শুয়ে পড়েছি আমি আর রডরিক, বালির উঁচু ঢেউ-এর নিচে নামিয়ে রেখেছি মাথা।

এরপর কি? জানতে চাইল রডরিক।

হরে দরে সমান সমান, বললাম ওকে। কামানের পরবর্তী দুই রাউণ্ড গোলা আমাদের পেছনের গাছের মাথায় প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হল। কিন্তু তারপরই কয়েক সেকেণ্ড আর কোন আওয়াজ নেই। মাথা তুলে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি কামানের লম্বা ব্যারেলটা দ্রুত অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে ওরা।

পরবর্তী শেলটা হোয়েলবোটের পাশে অগভীর পানিতে পড়ল, পানির একটা খাড়া স্তম্ভ লাফ দিয়ে উঠল ওপর দিকে। বাচ্চার বিপদ দেখে রাগে সিংহী যেমন গর্জে ওঠে, সেই রকম বিকট একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল রডরিকের গলার ভেতর থেকে।

ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করছে ওরা হোয়েলবোট… প্রকাণ্ড কালো শরীরটা রাগে কাঁপছে, ওর মুখের কথা শেষ হবার আগেই এসে পড়ল পরবর্তী শেলটা, সৈকতের ওপর পড়ে চারদিকে মেঘ ওড়াল সাদা বালির।

আমাকে দাও ওটা, দ্রুত বললাম ওকে, ওর হাত থেকে ছো মেরে কেড়ে নিলাম এফ-এন কারবাইনটা, আরেক হাত বাড়িয়ে ধরিয়ে দিয়েছি ওকে শর্ট ব্যারেলের এ. কে. ফরটি সেভেন। ওর কাঁধ থেকে হ্যাভারস্যাকের স্ট্রাপটা খসিয়ে নিচ্ছি। লক্ষ্যভেদ করার জন্যে এই মুহূর্তে যে নিপুণতা দরকার তা নেই ওর।

নোড়ো না এখান থেকে, বললাম ওকে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মাথা নিচু করে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি বে-এর বাকটার দিকে। বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠেছি আমি। একছুটে চলে এসেছি বে-এর বাকে, শিং-এর মাথায়। এখান থেকে নোঙর ফেলা ক্রাশবোটের দূরত্ব সবচেয়ে কম। বালির ওপর ডাইভ দিয়ে পড়লাম আমি। এফ. এনের লম্বা ব্যারেলটা ঠেলে দিলাম সামনের দিকে।

গান ক্রুরা এখনও হোয়েলবোটের ওপর টার্গেট প্র্যাকটিস করছে। ওটাকে ঘিরে বারবার লাফ দিয়ে উঠছে বালি আর পানি। কামানের সামনের প্রতিরোধ প্লেটের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে গান ক্রুরা, ঘাড় ফিরিয়ে পাশের দিকে তাকালেই দেখতে পাবে আমাকে।

এফ. এনের ফায়ার সিলেক্টর সিঙ্গেল শটের ঘরে ঠেলে দিলাম আমি, গভীর কয়েকটা শ্বাস টেনে দৌড়ে আসার হাঁপানিটুকু দূর করে নিলাম। গান-লেয়ার পেডাল মেরে কামানের ব্যারেল একদিক থেকে আরেকদিকে সরাচ্ছে, হাতল ঘুরিয়ে প্রয়োজন মত সেটাকে উঁচু-নিচু করে নিচ্ছে-গান সাইটে চোখ রাখার ফুটোর ওপর নরম প্যাডে চেপে ঠেকিয়ে রেখেছে কপালটা।

সাইটে চোখ রেখে লক্ষ্যস্থির করলাম ওর কানের পাশে, ট্রিগার টিপে বের করে দিলাম একটা বুলেট। সিট থেকে ছিটকে পড়ে গেল লোকটা। ছেড়ে দেয়া এইমিং হ্যাণ্ডেলটা ধীরে ধীরে ঘুরছে,আর অলস ভঙ্গিতে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে কামানের ব্যারেলটা।

হতচকিত দুজন গান-লোডার বোকার মত তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। ব্যারেল ঘুরিয়েই আরও দুটো গুলি ছুঁড়লাম ওদের দিকে। পাথরের মূর্তি দুটো জ্যান্ত হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে, লাফ দিয়ে পড়ল ডেকের ওপর, সেখানে থেকে গড়িয়ে চলে গেল আড়ালে। পাশ থেকে খোলা ব্রিজ লক্ষ্য করে পর পর গুলি করলাম তিনটে, অফিসার আর নাবিকরা এ ওর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল সেখান থেকে। মোটরবোটটা ভিড়েছে ক্রাশবোটের পাশে, সেদিকে আরও তিনটে গুলি করে গার্ড দুজনকে পড়িমড়ি করে ডেকে উঠে পড়তে সাহায্য করলাম, এরাও চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ডেক থেকে। মোটরবোটটাকে বেঁধে রেখে যায়নি ওরা, ক্রাশবোটের পাশ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে সেটা।

এফ. এনের ম্যাগাজিন বদল করলাম আমি। সাবধানে। লক্ষ্যস্থির করে বোটের কাছাকাছি দিকের প্রত্যেকটা পোর্টহোলের ভেতর একটা করে বুলেট ঢুকিয়ে দিচ্ছি। প্রতিটি গুলি ছোড়ার পরপরই কাঁচ ভাঙার শব্দ পাচ্ছি আমি।

ব্যাপারটা সহ্যের অতিরিক্ত বাইরে বলে মনে হল হুমায়ুন। দাদার, নোঙর তুলে ফেলার শব্দ শুনে বুঝলাম সুমতি হয়েছে তার। পানির নিচে ঘুরতে শুরু করেছে ক্রাশবোটের প্রপেলারগুলো, সাদা ফেনা নিয়ে উথলে উঠছে পানি। খাড়ির মুখের দিকে ঘুরে যাচ্ছে ক্রাশবোট।

আমার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে বোটটা, অবিরাম গুলির মধ্যে রেখেছি ওটাকে, যাতে বিদায় নিতে দেরি না করে। নোংরা কিন্তু মোটা একটা ক্যানভাস দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে ব্রিজটাকে, জানি পেছনেই মাথা নিচু করে শুয়ে আছে হেলসম্যান। ক্যানভাস ফুটো করে একের পর এক বেরিয়ে যাচ্ছে আমার গুলি, ওর পজিশন আন্দাজ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না বুঝতে পেরে আবার মনোযোগ দিলাম পোর্টহোলগুলোর দিকে, আশা করছি বুলেটগুলো খোলের ভেতর ছুটোছুটি করে কিছু একটা ক্ষতি করবে।

দ্রুত বাড়ছে ক্রাশবোটের স্পীড। শিং ঘুরে আড়ালে চলে যাচ্ছে সে। উঠে দাঁড়ালাম আমি, হাতের ঝাপটা মেরে কাপড় থেকে বালি ঝাড়লাম। তারপর রাইফেলটাকে রি-লোড করে নিয়ে ছুটলাম নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে।

দ্বীপের উত্তর প্রান্তের একটা ঢালের মাথায় চড়ে দেখি প্রায় মাইলখানেক দূরে, গভীর পানির চ্যানেলে চলে গেছে ক্রাশবোট। আফ্রিকা মেইনল্যাণ্ডের দিকে ছুটছে সে। সবুজাভ সাগরের বুকে ছোট সাদা একটা আকৃতির মত দেখাচ্ছে তাকে।

এফ. এনটা বগলদাবা করে মাটির ওপর বসে পড়লাম, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রাশবোটের চলে যাওয়া দেখছি। রিস্টওয়াচের কাটা বলছে এগারোটা বেজে সাত মিনিট হয়েছে। উদ্বেগের সঙ্গে ভাবতে শুরু করেছি, ক্রাশবোটের স্টার্নের নিচে জেলিগনাইট আছে, না নেই? পানির তোড়ে বাঁধন ছিঁড়ে গিয়ে থাকলে-নেই।

জলমগ্ন আউটার রীফ পেরোচ্ছে ক্রাশবোট। একটু পরই খোলা ইনশোর পানিতে ঢুকবে সে। ঢেউ সরে গেলেই প্রতিবার কদর্য চেহারা নিয়ে দেখা দিচ্ছে প্রবাল প্রাচীরের মাথাগুলো, পরমুহূর্তে পরবর্তী ঢেউটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে সাদা ফেনায় পরিণত করছে।

ছোট সাদা আকৃতিটা চুপচাপ বিস্ফোরিত হল। অনেক দূর থেকে দেখছি, তাই খুঁটিনাটি কিছুই ধরা পড়ছে না চোখে, আর বাতাস উল্টোদিকে বইছে বলে কোন শব্দই এল না এদিকে। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল পানি, খুদে বোটটাকে ঢেকে ফেলল সম্পূর্ণ। অস্ট্রিচ পাখির একটা পালকের মত দেখাচ্ছে-নরম আর। হালকা, বাতাসে দুলছে। যতটা ওপরে ওঠার উঠে ঝুঁকে পড়ছে নিচের দিকে, দ্রুত হারিয়ে ফেলছে আকৃতি, তারপর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়ল উত্তাল সাগরে, পানির সঙ্গে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল। সাগরের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ক্রাশবোট, তার কোন চিহ্নই আর দেখতে পাচ্ছি না আমি।

জানি জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে রক্তের গন্ধ পেয়ে দল বেঁধে ছুটে আসবে আলবাকোর হাঙ্গর। কিন্তু ক্রাশবোটের একজনকেও জীবিত পাবে না ওরা। বিস্ফোরণের পরে ওদের কারও বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। হুমায়ুন দাদার প্রকাণ্ড শরীরটা কল্পনা করে ক্ষীণ একটু দুঃখ বোধ করলাম আমি। অত বড় আকৃতি আগে কখনও দেখিনি, ভবিষ্যতেও আবার দেখব কিনা সন্দেহ। কলকাঠি নেড়ে এমন একটা বিস্ময়কর নমুনাকে ধ্বংস করে দিয়েছি দুনিয়ার বুক থেকে, দুঃখ সেখানেই। জানি, অন্য কিছু করার ছিল না আমার, তবু।

নিজের সঙ্গে কৌতুক করছি, হঠাৎ বুঝতে পেরে, আপন মনে হেসে ফেললাম আমি। উঠে দাঁড়ালাম। দ্রুত হেঁটে নেমে আসছি গুহার দিকে।

.

লুটপাট করার সময় আমার মেডিক্যাল কিটটা ভেঙে রেখে গেছে ওরা, তবে রাফেলার নখ উপড়ানো আঙুলগুলো ধুয়ে ড্রেস করে দেবার মত যথেষ্ট ওষুধ ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পাওয়া গেল গুহার মেঝে থেকে। মাংসের ভেতর থেকে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে তিনটে নখ। আমার ভয়, শিকড়গুলোও বুঝি নষ্ট হয়ে গেছে, নতুন করে আর নখ গজাবে না। কিন্তু রাফেলাও এই একই আশঙ্কা প্রকাশ করায় সেটা আমি হেসেই উড়িয়ে দিলাম। যথেষ্ট ভুগেছে ও, এরপর আর মন খারাপ করে দিতে চাই না।

ওর ক্ষতগুলোর যত্ন নেয়ার পর দুটো পেইনকিলার ট্যাবলেট খেতে দিলাম ওকে। গুহার পেছন দিকে বিছানা পেতে শুইয়ে দিলাম।

চোখ বোজো, বললাম ওকে আমি, হামাগুড়ি দেয়ার ভঙ্গিতে ঝুঁকে আছি ওর ওপর। কপালে হালকাভাবে চুমু খেলাম। ঘুমুতে চেষ্টা কর। রওনা হবার সময় ডেকে নেব তোমাকে।

দরকারী কাজগুলোয় এরই মধ্যে হাত লাগিয়েছে রডরিক। হোয়েলবোটটা পরীক্ষা করেছে ও। আপনেল লেগে কয়েক জায়গায় শুধু ফুটো হয়ে গেছে সেটা, বাকি সব ঠিক আছে। টুলকেস থেকে পুডিং বের করে ফুটোগুলো বন্ধ করলাম আমরা। বোটটা সৈকতে রেখেই ফিরে এলাম দুজন।

গর্তের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হাত-পা ধড় ও মুণ্ডু। এক এক করে সেগুলো আমরা সাজালাম গর্তের ভেতর। মৃতদের ওপর রাগ থাকতে নেই, তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম ধড় আর মুণ্ডুর সঙ্গে যার যার হাত-পাগুলো এক করে রাখতে। তারপর বালি চাপা দিয়ে ভরাট করে দিলাম গর্তটা।

আরেকটা গর্ত খুঁড়লাম আমরা। এর ভেতর রয়েছে বাঘ সিংহাসনের সোনার মাথাটা। চওড়া কপালে শোভা পাচ্ছে বিরাট গ্রেট মুঘল। বহু কষ্টে ধরাধরি করে নিয়ে আসছি সেটাকে, ওজনের ভারে নুয়ে পড়েছি আমরা।

হোয়েলবোটের তলায় কুশন দিয়ে মুড়ে রাখলাম মাথাটা। পাথর ভর্তি প্লাস্টিকের একটা প্যাকেট কিভাবে কখন যেন ছিঁড়ে গেছে, আরেকটা প্যাকেটে ভরলাম সেগুলো। সোনার মাথাটার কাছে রাখলাম ওগুলো। স্যাফায়ার আর এমারেল্ডের প্যাকেটগুলো ভরে নিলাম আমার হ্যাভারস্যাকে।

এরপর গুহায় ফিরে এসে সমস্ত অক্ষত ইকুইপমেন্ট আর মালপত্তর উদ্ধার করে জড়ো করলাম এক জায়গায়। এসব বেঁধেছেঁদে বয়ে নিয়ে হোয়েলবোটে তুলতে বেলা শেষ হয়ে গেল। মালপত্রের স্কুপের ওপর এফ. এন কারবাইনটা নামিয়ে রেখে পিছিয়ে এলাম আমি। ভীষণ ক্লান্তি বোধ করছি। একটু বিশ্রাম নিতে পারলে হত। কিন্তু না, এই অভিশপ্ত দ্বীপ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যাওয়াই ভাল।

ঠিক আছে, রডরিক? চুরুট ধরাচ্ছি আমরা, এতক্ষণে নিস্তব্ধতা ভাঙলাম আমি। এবার বোধহয় রওনা হতে পারি আমরা, কি বল?

চুরুটে মস্ত একটা টান দিয়ে একমুখ নীল ধোঁয়া ছাড়ল রডরিক। মুখটা অস্বাভাবিক নির্ভাজ আর সরল দেখাচ্ছে। একটা কাজ শুধু বাকি রয়েছে, মৃদু কণ্ঠে বলল ও। যাই, ল্যাম্পনিকে তুলে নিয়ে আসি।

নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে আছি ওর দিকে আমি। তাই দেখে আবার বলল ও, এখানে ওকে কিভাবে রেখে যাই? এমন নির্জন জায়গা, ওর ভাল্লাগবে না। সেন্ট মেরীর কবরস্থানে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে থাকতে পারলে খুব খুশি হবে ও।

সন্ধ্যা নামছে। দ্রুত ঘন হয়ে উঠছে অন্ধকার। খানিকটা ক্যানভাস নিয়ে একাই রওনা হয়ে গেল রডরিক। ওর দিকে তাকিয়ে আছি একদৃষ্টিতে, দ্রুত অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল ও।

নড়ছি না আমি। বসে বসে চুরুটটা শেষ করলাম। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উঠে দাঁড়ালাম, রাফেলাকে নিয়ে আসার জন্যে ফিরে যাচ্ছি আবার গুহায়।

গাঢ় ঘুম সহজে ভাঙতে চায় না, কিন্তু একবার ভাঙতেই পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠল রাফেলা। কি হয়েছে, রানা? উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চাইল ও।

আর কিছু হবার নেই, বললাম ওকে। চলো, রওনা হবার সময় হয়েছে আমাদের।

রাতে ঠাণ্ডা পড়বে সাগরে, তাই আমার একটা জার্সি পরিয়ে দিয়েছি রাফেলাকে। আরও দুটো পেইনকিলার ট্যাবলেট খাইয়ে সৈকতে নিয়ে এলাম ওকে।

চারদিক অন্ধকার। এক হাতে টর্চ, আরেক হাতে রাফেলাকে ধরে আছি। পৌঁছে গেছি প্রায়, বালির ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি ওকে নিয়ে। এমনি সময়ে হঠাৎ কেন যেন দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। নিজেরই অজ্ঞাতে কি যেন একটা বিচ্যুতি ধরা পড়েছে চোখে। বুঝতে পারছি, কোথাও কিছু একটা ঘটে গেছে। মালপত্তর ভরা হোয়েলবোটের ওপর টর্চের আলো ফেললাম দ্রুত।

সঙ্গে সঙ্গে ধড়াস করে উঠল বুক, গোলমালটা টের পেয়ে গেছি। গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে আমার।

রাফেলা! চরম উত্তেজনা চেপে রেখে ফিস ফিস করে বললাম ওকে, পানিতে নেমে গা ডুবিয়ে থাকো, যতক্ষণ না আবার উঠতে বলি আমি।

হাঁটু ভাঁজ করে দ্রুত বসে পড়ল রাফেলা। আমার কণ্ঠস্বর শুনে বিপদ আঁচ করতে পেরেছে ও। হোয়েলবোটের খোলের পাশে নেমে গেল ও, পানির ওপর শুধু মুখটা তুলে রেখেছে।

উদভ্রান্তের মত নিজের চারদিকে তাকাচ্ছি আমি, একটা অস্ত্র দরকার আমার, যে-কোন ধরনের। স্পিয়ারগানের কথা মনে পড়ছে, কিন্তু সেটা ফুয়েল ক্যানের নিচে চাপা পড়ে আছে। আমার বেইট-নাইফটা এখনও গাঁথা রয়েছে নারকেল গাছের গায়ে–এতক্ষণ সেটার কথা মনেই পড়েনি। টুলবক্সে রয়েছে…

মাত্র এইটুকই চিন্তা করার সময় পেলাম আমি।

হ্যাঁ, কারবাইনটা আমিই নিয়েছি। ঠিক আমার পেছনের অন্ধকার থেকে ভেসে এল ভরাট, গম্ভীর কণ্ঠস্বর। আমি স্তব্ধ। পাথর। খবরদার! পেছন দিকে তাকিয়ো না বা নোড়ো না।

রাইফেলটা হোয়েলবোট থেকে নিয়ে নিশ্চয়ই নারকেল গাছের কাছে ফিরে গিয়েছিল ও, ওখানে গা ঢাকা দিয়ে শুয়ে ছিল অন্ধকারে। নিঃশব্দ পায়ে এখন চলে এসেছে আমার পিঠের কাছে।

পেছন দিকে না ঘুরে টর্চটা দাও আমাকে-স্রেফ কাঁধের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দাও।

নিঃশব্দে তাই করলাম আমি। ঝুঁকে পড়ে টর্চটা তুলে নিচ্ছে, ওর পায়ের চাপে ভাঁজ খাচ্ছে বালি, শুনতে পাচ্ছি শব্দটা।

ঠিক আছে, ঘোরো এবার-সাবধানে, ধীরে।

ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। টর্চের শক্তিশালী আলো ফেলল ও আমার চোখে। চোখ দুটো ধাঁধিয়ে গেল আমার। তবু অস্পষ্টভাবে ওর প্রকাণ্ড কালো শরীরটার কাঠামো দেখতে পাচ্ছি টর্চের পেছনে।

সাঁতার খুব উপভোগ করেছ, তাই না? জিজ্ঞেস করলাম ওকে। আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছি, শুধু ছোট একটা সাদা আণ্ডারপ্যান্ট পরে রয়েছে ও। ওর বিশাল, ফোলা পেট আর বেঢপ পা দুটো আলোর আভায় চকচক করছে-গায়ের পানি এখনও শুকায়নি।

ঠাট্টা কোরো না। তোমার রসিকতা শুনলে গা চুলকায় আমার, রানা, ভরাট গলায় বলল হুমায়ুন দাদা। হঠাৎ, কিন্তু অনেক দেরিতে, মনে পড়ল আমার-অতিরিক্ত মোটা লোক আশ্চর্য হালকা হয়ে যায় সাগরের লোনা পানিতে, তাই তার শক্তিও অনেকটা বেড়ে যায়। তাছাড়া, সাঁতরাবার সময় জোয়ার এসে পড়ায় প্রচুর সাহায্য পেয়েছে ও। কিন্তু তবু প্রায় দুমাইল উত্তাল সাগর পেরিয়ে ফিরে আসা অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। তারচেয়ে বিস্ময়কর লাগছে, এমন প্রচণ্ড বিস্ফোরণের পর ও বেঁচে আছে কিভাবে?

শুরু বোধহয় তলপেট থেকেই করতে হয়, নাকি? আবার কথা বলছে হুমায়ুন দাদা। দেখতে পাচ্ছি, রাইফেলের স্টকটা সে তার বাঁ হাতের কনুইয়ের উল্টোদিকে ঠেকিয়ে রেখেছে। ওই হাতেই ধরে রয়েছে টর্চটা, আলো ফেলেছে আমার চোখের ওপর। শুনেছি ব্যথাটা ওখানেই নাকি সবচেয়ে বেশি লাগে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে আছি আমরা। সশব্দে গভীর, লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ছে হুমায়ুন দাদা, আর বিদুৎগতিতে চিন্তা করছি আমি কিভাবে ওর মনোযোগ সরানো যায় অন্য দিকে। এফ. এনের ব্যারেলটা খপ করে ধরার জন্যে শুধু আধ সেকেণ্ডের একটা সুযোগ চাই আমি।

নাক মলা কান মলা খেয়ে, মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে মাফ চাইবে না তুমি, আমি জানি-নাকি তা-ও চাইবে? প্রাণ কি তোমার কাছে অতটা প্রিয়? জিজ্ঞেস করল ও।

চুপ করে আছি আমি। একটু বাতাস নেই কোথাও, কিন্তু কানের পাশে তীব্র ঝড়ের শব্দ শুনছি।

না, তা তুমি চাইবে না। সব জায়গায় সব সময় বড় থাকতে চাও তুমি। ছোট হওয়া তোমার ধাতে নেই। কিন্তু, যদি মাফ চাইতে-পেতে না বটে, কিন্তু দারুণ উপভোগ করতাম আমি সেটা। তার মানে, বঞ্চিত করছ আমাকে তুমি। কি আর করা, দুঃখটা থাকল। কিন্তু মেয়েটা? ও যদি নাকে খত্ দেয়, হাঁটু গেড়ে মাফ চায়-তোমার সম্মানে শক্ত ঘা লাগবে, কি বল? কিন্তু ভেবে দেখ, তা যদি করে ও, হয়ত মাফ করেও দিতে পারি ওকে। তুমি বিদায় নাও, ও থাকুক। কেমন হবে সেটা? নিজের রসিকতায় হো হা শব্দে অট্টনাদ ছাড়ল সে।

হঠাৎ থেমে গেল হাসিটা। সময় নষ্ট করছি, বলল ও। চুকিয়ে ফেলা যাক ঝামেলা। তুমি রেডি?

ঠিক এমনি সময়ে আমরা দুজনেই আওয়াজ পেলাম রডরিকের।

হুমায়ুন দাদার সব কথা শুনতে পেয়েছে ও, বুঝলাম। আধ সেকেণ্ডের একটা সুযোগ খুঁজছিলাম, ও-ও পরিষ্কার বুঝে নিয়েছে–আর সময় নেই, লোকটার মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে না পারলে এক সেকেণ্ড পর লাশে পরিণত হব আমি, ওর প্রিয় মাসুদ। তাই ধুপধাপ পা ফেলে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে রডরিক। হুমায়ুনের কাছে পৌঁছান ওর পক্ষে সম্ভব হবে না-আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ও নিজেও তা জানে।

অন্ধকার ফুড়ে তীরবেগে ছুটে আসছে রডরিক। এক ঝটকায় রাইফেল ঘুরিয়ে রডরিকের ওপর তাক করল হুমায়ুন দাদা। যেন দেখতেই পায়নি রডরিক, মহাসাগরের ঢেউয়ের মত ভ্রুক্ষেপ না করে ধেয়ে আসছে সে।

বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনলাম আমি, বিজলীর মত আগুনের লম্বা জিভ বেরিয়ে গেল মাজল থেকে। কিন্তু তারও আগে প্রকাণ্ড কালো লোকটার দিকে অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছি আমি। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, পড়ে গেল রডরিক। রাইফেলটা এবার আমার দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে হুমায়ুন দাদা।

এফ. এনের ব্যারেল ঘষা খেল আমার গায়ে, ধাক্কা দিয়ে ওটাকে পাশ কাটালাম, পরমুহূর্তে হুমায়ুন দাদার বুকের ওপর দড়াম করে পড়লাম কাঁধ দিয়ে।

একটা তীব্রগতি সাত টনী ট্রাকের মত ছুটে এসে ধাক্কা মেরেছি ওকে, পাঁজরগুলো ভেঙে পেটের ভেতরে সেঁধিয়ে যাবার কথা। কিন্তু চর্বি আর মাংসের মোটা স্তর প্রচণ্ড সংঘর্ষটাকে পাত্তাই দিল না, বেমালুম হজম করে নিল-এমন কি নিজের জায়গা ছেড়ে একচুল নড়ল না পর্যন্ত হমায়ুন দাদা। বরং রিবাউন্স খেয়ে আমিই পিছিয়ে এসেছি একটু। লাভের মধ্যে আমার গায়ের ধাক্কা লেগে টর্চ আর কারবাইনটা পড়ে গেছে ওর হাত থেকে। অটল এক বিশাল থামের মত সটান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। এখনও তাল সামলে উঠিনি আমি, কার সঙ্গে লেগেছি অনুমান করতে পেরে ভয়ে শিউরে উঠছি, এই সময় হাত বাড়িয়ে আমাকে আলিঙ্গনের ভেতর মুড়ে নিল হুমায়ুন দাদা।

দুহাত দিয়ে মাটি থেকে তুলে নিল আমাকে ও, টেনে তুলছে উঁচু আর নরম বুকে। ওর আলিঙ্গনের মধ্যে আমার দুটো হাতই আটকা পড়ে গেছে, আর ওপরদিকে তুলে নিচ্ছে বলে পা দুটো ওর শরীরের কোথাও পেঁচিয়ে নেবার সুযোগ পাচ্ছি না।

এক অদ্ভুত শক্তির ফাঁদে চাপা পড়ে গেছি আমি। তেমন জোর খাটাচ্ছে না লোকটা, অনায়াসে ধরে আছে আমাকে, অবলীলায় ওপরদিকে তুলে নিচ্ছে, কিন্তু লোকটার আসুরিক শক্তি অনুভব করে অবিশ্বাসের ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে আমার ভেতর। নিষ্ঠুর, কঠিন একটা শক্তি নয়-এর বিশাল ব্যাপকতা এতই বেশি যে মনে হচ্ছে এর যেন কোন শেষ-সীমা নেই, অনেকটা সাগরের ফুলে-ফেঁপে ওঠা জোয়ারের চাপের মত, ভয়ঙ্কর, প্রাকৃতিক-যেন এই শক্তির বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই, গা এলিয়ে দেয়া ছাড়া।

হাঁটু আর কনুই দিয়ে চেষ্টা করছি আমি, তো আর বাড়ি মেরে ওর নরম কিন্তু অচ্ছেদ্য বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে চাইছি, কিন্তু একটা আঘাতও নিরেট কোথাও লাগছে না বা লোকটাকে একচুল টলাতে পারছে না। ধীরে ধীরে আমার চারদিকে এটে বসা ঘেরটা আরও ছোট হয়ে আসছে, বিশাল পাইথনের মত চাপ দিয়ে পিষে ফেলছে আমাকে। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, এই ভাবে চাপ বাড়িয়ে আমাকে পিষে মেরে ফেলার শক্তি রয়েছে লোকটার গায়ে। হাড় ভাঙার মট মট শব্দ পাবার আশায় উৎসুক হয়ে আছে ওর কান দুটো। দাঁতে দাঁতে চেপে ফাঁক করে রেখেছে ঠোঁট দুটো-মনে হয় হাসছে।

প্রচণ্ড আতঙ্কে মরিয়া হয়ে উঠেছি আমি। পিঠ, ঘাড়, কাঁধ আর উরুর পেশী মোচড় দিয়ে উন্মত্ত চেষ্টা করছি আলিঙ্গন ঢিলে করার। আরও জোর খাটাচ্ছে ও, ফোস ফোস করে দমকা বাতাসের মত বেরিয়ে আসছে হুইস্কির গন্ধ মেশানো নিঃশ্বাস। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে ক্রমে, উঁচু হচ্ছে বিশাল দুই কাঁধ। প্রচণ্ড চাপে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে গেছে আমার পিঠ, একটু পর মট করে ভেঙে যাবে শিরদাঁড়াটা।

পেছন দিকে সরিয়ে নিয়ে এসেছি মাথাটা, মুখ খুলে রয়েছি। হঠাৎ দুই সারি দাঁতের মাঝখানে ওর চওড়া নাকটাকে নিয়ে মুখ বন্ধ করলাম। সবটুকু শক্তি দিয়ে কামড়াচ্ছি ওটাকে, পরিষ্কার টের পাচ্ছি ওর নাকের মাংস আর নরম হাড় ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে আমার দাঁতগুলো। উষ্ণ, নোনতা রক্তের বন্যায় ভরে উঠছে মুখের ভেতরটা। এখন আমি শুধু কামড়াচ্ছি না, মাথা নেড়ে এদিক-ওদিক ঝটকা মারছি, কুকুরের মত টেনে ছিঁড়ে আনতে চেষ্টা করছি নাকটাকে।

আক্রোশ আর যন্ত্রণায় অসহ্য কষ্ট পাচ্ছে লোকটা, মুখের ভেতর থেকে ভোতা গর্জন বেরিয়ে আসছে। আমার শরীর পেঁচিয়ে রাখা হাত দুটো ঢিল হয়ে গেল। বুঝতে পারছি, এবার একহাতে আমার চুল, অপর হাতে চিবুক ধরতে চাইবে হুমায়ুন দাদা, এক ঝটকায় মট করে ভেঙে দিতে চেষ্টা করবে আমার ঘাড়টা।

হাত দুটো মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার শরীরে, মোচড় দিয়ে কাত হয়ে গেলাম একপাশে, শক্ত ভিজে বালিতে নামিয়ে দিয়েছি দুটো পা, যাতে ওর ভারসাম্য নষ্ট করে কোমর দিয়ে ধাক্কা মারতে পারি। নাকের যন্ত্রণায় এতই অস্থির হয়ে রয়েছে ও, যে ধাক্কাটা কিভাবে কোত্থেকে এল, টেরই পেল না। মাংস ছিঁড়ে নাকের অর্ধেকটা রয়ে গেল আমার মুখের ভেতর, আমার পিঠের ওপর দিয়ে বিশাল শরীরটা ডিগবাজি খেয়ে ধড়াশ করে পড়ল বালিতে, চিত হয়ে।

থোঃ করে মুখের ভেতর থেকে কুৎসিত মাংসের টুকরোটা ফেলে দিলাম আমি। ড্রাকুলার মত ঠোঁটের দুই কোণ বেয়ে গড়িয়ে নামছে রক্তের ধারা। মুখের ভেতর রক্তের নোনা স্বাদভ্রূক্ষেপ করলাম না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই ফিরলাম ওর দিকে।

বিশাল ব্যাঙের মত পা ভাঁজ করে বালিতে পিঠ দিয়ে পড়ে আছে হুমায়ুন দাদা, দুই হাতে চেপে রেখেছে চোখের নিচ থেকে ঠোঁটের ওপর পর্যন্ত। আঙুলের ফাঁক দিয়ে সড়সড় করে নেমে আসছে রক্ত-অন্যদিকে মুখ করে বালিতে পড়ে থাকা জ্বলন্ত টর্চের ম্লান আলোয় চিকচিক করছে ধারাগুলো, কালো দেখাচ্ছে।

জানি, এক্ষুণি আবার উঠে দাঁড়াবে লোকটা, উঠে দাঁড়ালেই সর্বনাশ-হাতাহাতিতে পারব না আমি ওর সঙ্গে; তাই কোন সুযোগ না দিয়ে ছুটে গিয়ে প্রচণ্ড একটা লাথি মারলাম ওর ফুটবলের মত মাথায়। ঝাঁকি খেল মাথাটা, এবং হুঁশ ফিরে এল। দ্বিতীয় লাথিটা মারতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেলাম আমি। সাঁৎ করে উঠে বসেছে হুমায়ুন দাদা, চোখের পলকে সরে গেছে মাথাটা যেখানে ছিল সেখান থেকে।

শূন্যে লাথি মেরে তাল হারিয়ে ফেলেছি, পড়ে গেলাম। পড়েই দুই গড়ান দিয়ে সরে গেলাম কিছুটা দূরে। আছড়ে-পাছড়ে উঠে রাইফেলের দিকে এগোবার চেষ্টা করতে গিয়ে আড়চোখে লক্ষ করলাম উঠে দাঁড়িয়েছে হুমায়ুন দাদা, ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে আমার ওপর। চট করে শুয়েই চিৎ হলাম আমি, হাঁটু দুটো ভাঁজ করে নিলাম। ছোট্ট একটা গর্জন ছেড়েই ডাইভ দিল বিশাল পাহাড়। ইতিমধ্যেই পা দুটো তুলে ফেলেছি শূন্যে। মস্ত থলথলে ভূঁড়িতে দুই পা বাধিয়ে ওরই গতিবেগকে কাজে লাগিয়ে আমার। শরীরের ওপর দিয়ে পার করে দিলাম ওর শরীরটা, শেষ মুহূর্তে প্রাণপণ শক্তিতে ছুঁড়লাম পা দুটো। মাথা নিচু পা উঁচু এই রকম প্রায়-খাড়া অবস্থায় শূন্য থেকে নেমে এল সে ভেজা বালির ওপর।

একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম অদ্ভুত কায়দায় শরীরটাকে রিঙের মত গোল করে ফেলেছে হুমায়ুন দাদা, কোথাও চাপ বা চোট না খেয়ে বালির ওপর একটা ডিগবাজি দিয়েই উঠে দাড়াল আমার দিকে পেছন ফিরে। চট করে ঘুরল আমার দিকে, এবং ঘুরতে গিয়েই চোখ পড়ল ওর রাইফেলটার ওপর। ওটার কাছে পৌঁছতে হলে ওকে ডিঙিয়ে ওপাশে যেতে হবে আমার। লাফিয়ে শূন্যে উঠে ওর বুকের ওপর কারাতে কিক মারলাম একটা। টলে উঠল, কিন্তু ধরাশায়ী হল না দানব, বরং আমি মাটিতে পা ছোয়াবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার ধরে ফেলল জাপটে। এবার আমার নাক-মুখ চেপে রেখেছে নিজের বুকের সঙ্গে।

জুডো-ল্যাঙ মারলাম, পড়ল পাহাড়, কিন্তু আমাকে ছাড়ল না। এক ফোঁটা বাতাসের জন্যে ছটফট করছি আমি ওর বুকে মুখ খুঁজে। উপায়ন্তর না দেখে ঢালের দিকে গড়ান দিলাম। একবার আমি ওপরে, একবার হুমায়ুন দাদা, গড়াচ্ছি আমরা, নেমে যাচ্ছি ঢালু সৈকত থেকে পানির দিকে। এরই ফাঁকে খামচে তুলে নিয়েছি আমি ওর একটা চোখ, জুডো হোল্ডে ধরে মটকে দিয়েছি বাম হাতের দুটো আঙুল, ভেঙে দিয়েছি ডান হাতের কব্জি। আমার নিজেরও যে পাঁজরের একটা হাড় চিড় খেয়েছে টের পাইনি তখন মরণ-যুদ্ধে রত অবস্থায়।

জড়াজড়ি করে নেমে এলাম আমরা খাঁড়ির উষ্ণ, অগভীর। পানিতে। কপাল খারাপ, প্রথমে তলে পড়লাম আমি। শরীরের সমস্ত ওজন চাপিয়ে দিয়েছে আমার ওপর। যেন বিশাল এক জলহস্তী। পানির নিচের চলমান বালিতে হাত-পা-হাঁটু বাধিয়ে যে জোর করব তার উপায় নেই-শক্ত কিছুই পাচ্ছি না, যার ওপর ভর দিয়ে জোর খাটাব। মস্ত বেকায়দায় পড়ে গেলাম।

পানির নিচে ডুবে রয়েছি, একটু বাতাসের জন্যে ছটফট করছি, চোখের সামনে নাচানাচি করছে অসংখ্য আগুনের ফুলকি। চেষ্টার ত্রুটি করছি না, কিন্তু কোন ফল হচ্ছে না-শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে আমার। বুঝলাম জ্ঞান হারাচ্ছি।

শব্দটা চাপা আর ভোঁতা লাগল আমার কানে। তখনও চিনতে পারিনি, ভাবছি, শরীরের কোন হাড়টা ভাঙল। পিঠের ওপর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছি। হঠাৎ একটা ঝাঁকি খেল হুমায়ুন দাদা, স্থির পাথর হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অনুভব করছি, কেন যেন হঠাৎ শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে তার, চেপে বসা ভারটা গড়িয়ে নেমে গেল আমার ওপর থেকে।

কাশছি, গোগ্রাসে গিলছি বাতাস, সেই সঙ্গে উঠে বসছি আমি। চুল থেকে নেমে এসে চোখ দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে লোনা পানি। পড়ে যাওয়া টর্চের আলোয় দেখতে পাচ্ছি পানির কিনারায় হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে রাফেলা বার্ড। ওর ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হাতে এখনও রয়েছে রাইফেলটা, ম্লান রক্তশূন্য মুখে ভীতির ছাপ।

আমার পাশে অগভীর পানিতে উপুড় হয়ে ভাসছে হুমায়ুন দাদা, জাঙ্গিয়া পরা বিশাল কালো শরীরটা চকচক করছে ডলফিন মাছের মত। উঠে দাঁড়ালাম ধীরে ধীরে, কাপড়চোপড় থেকে হুড়হুড় করে পানি ঝরছে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে রাফেলা। মানুষ হত্যা করে আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে গেছে ও।

ওকে আমি…রানা…আমি…ওহ্ গড! বিড় বিড় করে প্রলাপ বকছে রাফেলা।

ডারলিং, দম ফেলার ফাঁকে বললাম ওকে, এই মাত্র জীবনের সবচেয়ে ভাল কাজটা করেছ তুমি। ওকে পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছি আমি, যেদিকে শুয়ে রয়েছে রডরিক।

উঠে বসার চেষ্টা করছে রডরিক, নিজের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে।

থামো, রডরিক, নড়াচড়া কোরো না, ধমক দিলাম ওকে, ঝুঁকে পড়ে তুলে নিলাম টর্চটা। তাজা রক্তে ভিজে রয়েছে ওর শার্ট, বোতাম খুলে মুক্ত করলাম ওর চওড়া কালো বুক।

নিচে এবং বাঁ দিকে, কিন্তু লেগেছে ফুসফুসে। গভীর কালো গর্তটা থেকে প্রতি নিঃশ্বাসের সঙ্গে বুদবুদ বেরিয়ে আসতে দেখছি। বুলেটের অনেক রকমের জখম দেখেছি আমি, নিজেকে এ-ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করতে পারি। মন খারাপ হয়ে গেল আমার, জখমটা ভাল না।

তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার মুখ লক্ষ্য করছে রডরিক। কি মনে হচ্ছে? ব্যগ্র গলায় জানতে চাইল ও। খারাপ? খুব খারাপ? ব্যথা নেই কিন্তু।

আরে না, গম্ভীর ভাবে বললাম ওকে। এখন থেকে যতবার বিয়ার খাবে তুমি, এই গর্ত দিয়ে কুল কুল করে সব বেরিয়ে আসবে।

নিঃশব্দে হাসছে ও। উঠে বসতে সাহায্য করলাম ওকে আমি। পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবার গর্তটা নিখুঁত আর পরিষ্কার। এফ. এন লোড করা ছিল নিরেট অ্যামুনিশনে, ঢোকার গর্তের চেয়ে বেরিয়ে যাবার গর্তটা সামান্য একটু বড়। হাড়গোড়ের সঙ্গে ঘষা খায়নি কোথাও বুলেটটা।

মেডিকেল চেস্টে এক জোড়া ফিল্ড ড্রেসিং পাওয়া গেল, ওকে হোয়েলবোটে উঠতে সাহায্য করার আগে ক্ষতটা বেঁধে দিলাম আমি। একটা কম্বল বিছিয়েছে রাফেলা, তার ওপর শুইয়ে ওর গলা পর্যন্ত চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিলাম আমি।

ল্যাম্পনিকে ভুলে যেয়ো না, ফিস ফিস করে বলল রডরিক।

ক্যানভাসের লম্বা বাণ্ডিলটা ফেলে রেখে এসেছে রডরিক সৈকতে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওটার সামনে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ল্যাম্পনিকে তুলে নিয়ে এলাম বোটে। ধীরে ধীরে শুইয়ে দিলাম একপাশে। শক্ত হয়ে গেছে শরীরটা।

পানিতে নেমে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি হোয়েলবোট। কোমর পানি পর্যন্ত নেমে এলাম, তারপর কিনারা টপকে উঠে পড়লাম ওপরে। একটু যেন ব্যথা লাগল বুকের পাঁজরে। আঙুল বুলিয়ে বুঝলাম চোট লেগেছে হাড়ে। ইঞ্জিন চালু করছি। এখন আমার একমাত্র চিন্তা উপযুক্ত চিকিৎসার জন্যে রডরিককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এখান থেকে সেন্ট মেরী অনেক দূর আর অনেক দেরির পথ।

ফ্লোরবোর্ডে রডরিকের পাশে বসেছে রাফেলা, ওর আরামের জন্যে যৎসামান্য যা করার আছে সাধ্যমত করছে সে।

আর এক বুক একাকীত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি স্টার্নে, দুই মোটরের মাঝখানে-গভীর পানির চ্যানেল ধরে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি বোটটাকে ফুল স্পীডে।

তারপর বাঁক নিয়ে দক্ষিণমুখো কোর্স ধরলাম আমি। মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে আকাশ ভর্তি ঠাণ্ডা সাদা তারা। হঠাৎ বাতাস ছেড়েছে, কানের দুপাশে হা-হুতাশ আর হাহাকার শুনতে পাচ্ছি। অন্ধকার উত্তাল সাগরে নিঃসঙ্গ এক নাবিক আমি, বয়ে নিয়ে চলেছি মৃত, মৃত্যুপথযাত্রী আর আহতের বোঝা-বড় বেশি আদরের আর প্রিয় বোঝা এসব আমার।

প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে এগোচ্ছি আমরা, এই সময় বোটের পাটাতনে বিছানো চাদরের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল রাফেলা। আমার দিকে আসছে।

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। কি খবর নিয়ে আসছে জানি না।

তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে রডরিক, শান্তভাবে বলল রাফেলা, তারপর হঠাৎ ঝোঁকের বশে সামনের দিকে ঝুঁকে ঠাণ্ডা বরফ ভাল হাতটা দিয়ে আমার মুখ ছুঁল ও। ফুঁপিয়ে উঠতে গিয়ে শব্দটাকে চাপা দিল, বলল, রানা-ও বোধহয় চলে যাচ্ছে।

নড়ছি না। কথা বলছি না। শুধু তাকিয়ে আছি রাফেলার মুখের দিকে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না কিছু।

যাও, আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল রাফেলা, ফিস ফিস করে বলল, ও ডাকছে তোমাকে।

আসছি আমি, রডরিক, বিড় বিড় করে বললাম, বলার পর হুঁশ হল কিছু একটা বলেছি।

যাও! আমাকে দেরি করতে দেখে চাপা স্বরে প্রায় ককিয়ে উঠল রাফেলা।

এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। ভীষণ ভয় করছে আমার। কিভাবে যাই আমি রডরিকের সামনে! কিভাবে সহ্য করব…

নিজেকে সামলে নিলাম আমি। হুইলটা রাফেলাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, ওই ওদিকে বড় দুটো তারা দেখতে পাচ্ছ? সোজা ও-দুটোর মাঝখান দিয়ে নিয়ে চল বোট। রডরিক যেখানে শুয়ে আছে সেদিকে পা বাড়ালাম আমি।

প্রথম কিছুক্ষণ মনে হল আমাকে চিনতে পারছে না রডরিক। হাঁটু গেড়ে বসলাম ওর পাশে, পানির নরম কলকল শব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। তারপর হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল ও। তারার আলো লেগে চিকচিক করে উঠল চোখ দুটো। চিবুক একটু তুলে তাকাল আমার দিকে। ওর দিকে ঝুঁকে পড়লাম আমি। আমাদের মুখের মাঝখানে কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান।

নিঃশব্দে হাসছে রডরিক। প্রাণ ফিরে পেলাম ধড়ে আমি। কি ভাবছ, মাসুদ? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ও। কণ্ঠস্বরে পরিষ্কার কৌতুকের সুর টের পেলাম আমি। আরে না, মিস্টার মাসুদ রানা, ডাক পড়লেও তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না আমি। জানি, তুমি আমাকে যেতে দেবে না। দেবে, মাসুদ? শেষ দিকের কথাগুলো মুখের ভেতর জড়িয়ে গেল ওর।

নিঃশব্দে এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে জবাব দিলাম ওকে। বুঝতে পারছি, আমার মনটা হালকা করতে চাইছে ও। চাইছে, আমি যেন মুষড়ে না পড়ি।

অনেক বড়-বড় মাছ ধরেছি আমরা, তাই না, মাসুদ? ফিস ফিস করে বলল ও। শেষ মুহূর্তে আমার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চাইছে।

সদ্যোজাত শিশুর মত ভাষাহীন লাগছে নিজেকে আমার। বলার মত একটা কথাও খুঁজে পাচ্ছি না আমি।

সেই যে যেবার মোজাম্বিক স্রোতে ছয়টা মারলিন ধরলাম দুই দিনে-মনে আছে? অস্পষ্ট গলায় বলছে রডরিক। ইস্, কি সাংঘাতিক মজা হয়েছিল সেবার! রোদ ঝলমলে দিন ছিল সেসব, বাতাসের সঙ্গে গলা চড়িয়ে সারা দিন গান গাইছিলাম বলে কি বকুনিটাই না দিয়েছিলে তুমি আমাকে-আহা, সেসব দিন! কী সুন্দর ছিল! মাসুদ, যদি আবার মাছ ধরতে যাও…আমার কথা…তারপর…

রডরিক, আবার আমরা মাছ ধরব, হঠাৎ ভাষা খুঁজে পেয়েছি, কথাটা বলার পর আবিষ্কার করলাম আমি। আবার আমরা একটা মনের মত সুন্দর বোট কিনতে পারব। আগামী মউসুমে তুমি আর আমি আবার মাছ মারতে যাব-অনেক বড় বড় মাছ-দারুণ মজা হবে… বলতে বলতে থেমে গেলাম।

তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম আমরা। একসময় টের পেলাম আমার হাত ধরার জন্যে হাতড়াচ্ছে ও। ওর হাতটা ধরলাম আমি, ধরে আছি শক্ত করে। শক্ত দড়িদড়া নাড়াচাড়া করে শক্ত কড়া পড়ে গেছে ওর হাতে, কর্কশ ছোঁয়া পাচ্ছি আমি।

মাসুদ, এখন পরিষ্কার নয় ওর কণ্ঠস্বর, ওর মুখের কাছে মাথা নামিয়ে ঠোঁটে কান ঠেকিয়ে রেখেছি আমি, শুনতে পাচ্ছি, বলব বলব করে যে কথাটা কক্ষনও কোনদিন বলা হয়নি, সেই কথাটা আজ তোমাকে বলতে যাচ্ছি আমি। ইউ আর এ গুড বয়, মাসুদ। আই লাভ ইউ, ম্যান। আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালবাসি আমি তোমাকে।

আমিও, রডরিক, বললাম।

কিছুক্ষণের জন্যে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে থাকল ও, তারপর ঢিল পড়ল ওর মুঠোয়। ওর পাশে বসে আছি আমি, ধীরে ধীরে মস্ত কর্কশ থাবাটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে আমার মুঠোর ভেতর, আর অন্ধকার সাগরের বুকে একটু একটু করে ফুটছে নতুন ভোরের আলো।

.

কালো শোকের পোশাক পরে সন্ধ্যা নামছে ঢাকার বুকে। ভেজা চোখের মত আকাশের গায়ে মিট মিট করছে দুএকটা তারা।

মাসুদ রানার বাংলো। বাগান থেকে রজনী গন্ধার সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে, গন্ধে উন্মনা হয়ে উঠছে বাতাস। অন্ধকার বারান্দায় বসে আছে ওরা। নড়ছে না কেউ, বা কথা বলছে না।

বাংলোর নিচু পাঁচিলের ওপারে খোলা মাঠ দেখা যাচ্ছে, খানিক আগেও ছেলেমেয়েদের ছুটোছুটি আর চেঁচামেচিতে মুখর ছিল পরিবেশটা, এখন আবছা অন্ধকারে অবহেলিত, পরিত্যক্ত বসনের মত পড়ে আছে মাঠটা। কিন্তু সন্ধ্যার কালিমা নেমে। আসতে দেখে সবাই যখন যে যার ঘরে ফিরে যায় তখনও একজন বসে থাকে ওখানে। কোনদিন তাকে দেখা হয়নি রানার। অন্ধকার মাঠে গভীর রাত পর্যন্ত বসে থাকে সে। কিসের পাগল কে জানে! তবে বোঝা যায়, নিঃসঙ্গ। রোজ মাঝরাত পর্যন্ত একটাই ধ্যান। তার, করুণ সুরে বাঁশের বাঁশি বাজানো। আজও বাজাচ্ছে। সুরেলা বিলাপ শুনে স্তব্ধ হয়ে আছে প্রকৃতি।

টপ টপ করে দুফোঁটা পানি ঝরে পড়ল রানার চোখ থেকে। মুখটা আরেক দিকে ফিরিয়ে নিয়ে কড়ে আঙুল দিয়ে হালকা ভাবে মুছে নিল দুই চোখের কোণ।

আবছা অন্ধকারে সোহানার দিকে ফিরল রানা। দেখল অঝোর ধারায় দুই চোখ বেয়ে নেমে আসছে পানি। রানার দিকে তাকাল না ও। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাথরুমের দিকে।

চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে আবার ফিরে এসে বসল সোহানা রানার পাশের চেয়ারে। রানার একটা হাত তুলে নিল নিজের হাতে। আলতো করে হাত বুলাচ্ছে-যেন সান্ত্বনা দিতে চায়, ভুলিয়ে দিতে চায় রানার সব দুঃখ।

অনেকক্ষণ কথা বলল না কেউ। দূরে বাজছে বাঁশের বাঁশি। গাঢ় হয়ে গেছে চারদিক। জ্বলজ্বল করছে আকাশ ভরা অসংখ্য তারা। তারপর? একসময় মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল সোহানা।

এখানেই আমার গল্প শেষ, সোহানা, বলল রানা।

শেষ? কিন্তু তারপর কি হল? রাফেলা বার্ড-শেষ পর্যন্ত কি কথা হল ওর সঙ্গে তোমার? আর সেই সোনার মাথা, গ্রেট মুঘলওগুলো কি করলে তুমি?

অন্যমনষ্ক হয়ে উঠেছে রানা।

সে-সব কি আরও দুঃখের, রানা? মৃদু কণ্ঠে বলল সোহানা।

পাশের টিপয় হাতড়ে চুরুটের বাক্স আর লাইটারটা তুলে নিল রানা। না, আসল গল্প এখানেই শেষ, সোহানা। এর পরেরটুকু তেমন কিছু নয়। সেটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত হার-জিতের কাহিনী। এখন সে-কাহিনীর কোন আবেদন নেই। তুচ্ছ বলে মনে হয়।

কিন্তু, তা সে যত তুচ্ছই হোক, তুমি যখন জড়িত, তার মানে আমিও জড়িত-শেষটুকু শুনতেই হবে আমাকে।

চুরুট ধরিয়ে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়ছে রানা। বেশ, রাজি হল ও। শোনো তবে।

নিঃসঙ্গ সেই পাগলটা পুরিয়া-ধানেশ্রী ছড়াচ্ছে মাঠে।

দুজন হাত ধরাধরি করে গিয়েছিলাম আমরা, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম কবর দুটোর পাশে, আমার বন্ধুদেরকে ওরা শুয়ে দিচ্ছিল।

ওখান থেকে রাফেলাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমি চলে গেলাম দুর্গে, ওখানে প্রেসিডেন্ট গডফ্রে পিডল আর ইন্সপেক্টর টমসনের সঙ্গে দুঘন্টা কাটালাম।

পরবর্তী তিন সপ্তাহ টার্টল-বে ছেড়ে বড় একটা বেরোইনি আমি বা রাফেলা।

মন্থর আর শান্ত লাগছে সময়টা। ক্ষতগুলো শুকাচ্ছে, কিন্তু বড় ধীরে ধীরে।

মনের চেয়ে শরীরের ক্ষতগুলো তাড়াতাড়ি শুকাল। এক দিন সকালে রাফেলার হাতের ড্রেসিং বদলাচ্ছি, ক্ষতের গোড়ার দিকে সাদা বীজ দেখতে পেলাম, বুঝলাম আবার নখ গজাতে শুরু করেছে। সরু লম্বা হাতগুলোকে সুন্দর করে তোলার জন্যে আবার। নখ হবে ওর-সেজেন্য স্বস্তি আর কৃতজ্ঞ বোধ করলাম আমি।

দিনগুলো সুখের নয়, স্মৃতিগুলো এখনও বড় বেশি তাজা। বিশাল পাহাড়ের মত নিঃশব্দে বুকে চেপে বসে আছে শোক। কথা বলি না, শুধু থেকে থেকে বুক ছোট করে দিয়ে বেরিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস। প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর। আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুরা নেই, কিন্তু আমি রয়েছি-সেজন্যে কেমন যেন স্বার্থপর মনে হয় নিজেকে, তাতে শতগুণ বেড়ে যায় যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে চমকে উঠে ভাবি, ভারি পা ফেলে ওই তো আসছে রডরিক! তারপর মনে পড়ে যায়।

এসব ছাড়াও আরেক সমস্যা ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আমার আর রাফেলার মাঝখানে। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে পরিষ্কার সঙ্কট রয়েছে একটা। ওর আচরণে তার আঁচ পাচ্ছি। সারাক্ষণ ম্লান মুখে কি যেন ভাবছে ও। সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে, কিন্তু নিতে না পেরে সাংঘাতিক কষ্ট পাচ্ছে একা-একা। সেজন্যেই হঠাৎ অকারণে বদমেজাজী হয়ে উঠলেও ক্ষমা করে দিচ্ছি ওকে, কিছু মনে করছি না। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না ও। প্রায়ই হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে, ঘন্টার পর ঘন্টা সৈকতে গিয়ে বসে থাকছে একা, মাথা নিচু করে কি সব চিন্তা করছে।

এই সঙ্কটের মুখোমুখি এক সময় আমাদেরকে হতেই হবে, তাই আর বেশি দেরি না করে এক সন্ধ্যায় কথা পাড়লাম আমি। সেন্ট মেরীতে ফেরার পর এই প্রথম উদ্ধার করা গুপ্তধনের কথা পাড়লাম ওর কাছে।

বাড়ির সামনের উঁচু উঠানের নিচে রয়েছে ওগুলো। বারান্দায় পাশাপাশি বসেছি আমরা, হাতে হুইস্কির গ্লাস, মাঝেমধ্যে চুমুক দিচ্ছি। কথাগুলো নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছে রাফেলা।

আমি চাই আমার আগেই জুরিখে পৌঁছে যাও তুমি। এয়ারপোর্টের কাস্টমস থেকে কফিন বাক্সটা ছাড়িয়ে নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করবে, গাড়ি নিয়ে সোজা চলে যাবে রেড অক্স হোটেলে। এই হোটেলটা বেছে নিয়েছি, কারণ, ওখানে একটা আণ্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং গ্যারেজ আছে। তাছাড়া, হেড পোর্টারের সঙ্গে জানাশোনা আছে আমার। ওর নাম হ্যাক্স। প্ল্যানটা ওকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছি আমি। কিভাবে কি করতে হবে সব বলে দেবে ও তোমাকে। সদ্য স্বামীহারা বিধবার অভিনয় করতে হবে তোমাকে এয়ারপোর্টে। পরে হোটেলের গ্যারেজের ভেতর তোমার গাড়ি থেকে ব্যাংকের গাড়িতে তুলে নেয়া হবে কফিন বাক্সটা। তার আগে অবশ্য আমার ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে তুমি। ব্যাংকের হেড অফিসে বাঘের মাথাটা নিয়ে যাবার জন্যে ওরা একটা আর্মার্ড কার পাঠিয়ে দেবে।

আগেই সব ঠিকঠাক করে রেখেছ, তাই না?

হ্যাঁ, গ্লাসে আরেকটু হুইস্কি ঢেলে নিলাম আমি। আমার ব্যাংকের নাম ফ্যালে এট ফিলস। ম্যানেজার এম. জেংকিনসকে আমার নাম আর অ্যাকাউন্ট নাম্বার বললেই বিশেষ খাতির পাবে ওর কাছ থেকে তুমি। খরিদ্দারদেরকে ডেকে সোনার মাথাটা দেখাবার জন্যে ওর সঙ্গে আলোচনা করে ব্যাংকের ভেতর একটা প্রাইভেট কামরার ব্যবস্থা করে রাখবে তুমি… খুঁটিনাটি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি রাফেলাকে, গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে ও। সবশেষে ওর প্লেনের টিকেট আর ট্রাভেলার্স চেক বইটা বের করলাম আমি।

রিজার্ভেশনগুলোও সেরে ফেলেছ এর মধ্যে? বিস্ময়ে প্রায় চমকে উঠল রাফেলা। আমাকে ওপর নিচে মাথা নাড়তে দেখে আবার জানতে চাইল, কখন যাচ্ছি আমি?

কাল দুপুরের প্লেনে।

আর তুমি কখন যাচ্ছ?

কফিনের সঙ্গে একই প্লেনে-তিন দিন পর, শুক্রবারে। বি. ও. এ. সি-র একটা ত্রিশ মিনিটের ফ্লাইটে যাব। হাতের সব কাজ সেরে আমার জন্যে অপেক্ষা করার সময় পাবে তুমি।

রাতটা ঠাণ্ডা আর জ্যোছনায় ভরা। এমন রাতেই জেগে থাকতে হয়, প্রেমে পড়তে হয়, কিন্তু তবু লক্ষ করলাম রাফেলার মুখে বিষাদের ছায়া আরও গাঢ় হয়ে ফুটেছে, যেন বিদায়ের আশঙ্কায় মন খারাপ করে আছে ও।

ভোর অন্ধকার থাকতে ওকে নিয়ে সাঁতার কেটে বে-এর মুখে চলে এলাম, আমাদের পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হল ওখানে। প্রায় অর্ধেকটা সকাল ডলফিনদের পিঠে চড়ে কাটালাম আমরা। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে এলাম সৈকতে।

পুরানো পিকআপে তুলে নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলাম রাফেলাকে আমি। যাবার পথে প্রায় সারাক্ষণ চুপ করে আছে ও, কিন্তু হঠাৎ কি যেন বলার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল।

কি বলতে চাইছে, ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। বক্তব্যটা যেন ওর নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়। প্রচুর ইতস্তত করে শেষ করল এই ভাবে …ধরো কখনও যদি আমাদের মধ্যে কিছু ঘটে, মানে…তুমি নিশ্চয়ই জান কোন জিনিসই চিরস্থায়ী নয়, তাই না…

থামলে কেন?

না, থাক-কিছু না আসলে। পরস্পরকে আমরা ক্ষমা করার চেষ্টা করব, যদি তেমন কিছু ঘটে-এই আর কি। এর বেশি কিছু বলল না ও।

এয়ারপোর্ট ক্যারিয়ারের কাছে দ্রুত ছোট্ট করে চুমো খেল আমাকে ও, আমার কাঁধে দুই হাত রেখে এক সেকেণ্ড প্রায় ঝুলে থাকল, তারপর হঠাৎ ব্যস্ততার সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। অপেক্ষারত প্লেনের দিকে এগোচ্ছে ও। মই বেয়ে ওপরে ওঠার সময় পেছন ফিরে তাকাল না একবারও, হাতও নাড়ল না।

টার্টল বে-তে একা ফিরে এলাম আমি।

ও নেই, তাই গোটা বাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। অদ্ভুত এক শূন্যতা বোধ ঘিরে রেখেছে আমাকে, অস্থিরভাবে এ-ঘর থেকে সে-ঘরে পায়চারি করছি। ভাবছি, এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছে। আমাকে ছেড়ে-প্রথমে ল্যাম্পনি, তারপর রডরিক… তারপর?

গভীর রাত। মশারির ভেতর মস্ত বিছানায় শুয়ে আছি আমি। ভাবছি, আর কোন উপায় নেই বলেই এত বড় ঝুঁকি নিতে হচ্ছে আমাকে। মনে মনে গোটা ব্যাপারটা আরেকবার স্মরণ করলাম। সন্দেহ নেই, ঝুঁকিটা ভয়ঙ্কর। কিন্তু এ-ঝুঁকি নেয়া একান্ত প্রয়োজন। অন্তরের অন্তস্তল থেকে জানি, এখানে অর্থাৎ আমার জীবনে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে রাফেলাকে। ওকে ছাড়া বেঁচে থাকব, কিন্তু সে বেঁচে থাকায় কোন স্বাদ পাব না। অনেকগুলো ব্যাপার আমার কাছ থেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ওকে, কিন্তু আমিও নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে কাছে টানব ওকে-দুই শক্তির এই টাগ অফ ওঅরে জিততে আমাকে হবেই। অবশ্য সিদ্ধান্তটা ওকেই নেবার সুযোগ দেব আমি, কিন্তু সিদ্ধান্তটা যাতে আমার অনুকূল হয় তার জন্যে ওকে প্রভাবিত করার সম্ভাব্য সব কৌশল কাজে লাগাব।

সকালে রামাদীনস্ ট্রাভেল এজেন্সিতে এলাম আমি। তর্ক, টাকা এবং প্রতিজ্ঞা বিনিময়ের পর আমার পিকআপে কফিন বাক্সটা তুলে দিল ঢ্যাঙা রামাদীন। বাক্সটার দুদিকে তামার হাতল ঝকঝক করছে, ভেতরটা লাল ভেলভেট দিয়ে মোড়া। ক্যানভাস দিয়ে মুড়ে টার্টল বে-তে নিয়ে এলাম ওটাকে।

ধীরে-সুস্থে ভরাট করলাম বাক্সের ভেতরটা। তারপর স্ক্রু এঁটে বন্ধ করে দিলাম ঢাকনি। এখন এটার ওজন পাঁচশো পাউণ্ডের কম নয়।

সন্ধ্যার পর শহরে ফিরে এলাম আমি। কয়েকটা কাজ সারতে দেরি হল অনেক। লর্ড নেলসনে ঢুকলাম। প্রায় বন্ধ করার সময় হয়ে এসেছে ওদের। এক চুমুক হুইস্কি খাবার সময়ও পেলাম না, জিনিসপত্র গোছগাছ করে নেবার জন্যে গাড়ি চালিয়ে ফিরে এলাম টার্টল বে-তে।

পরদিন দুপুরে, রাফেলা বার্ডের সঙ্গে আয়োজিত সময়ের ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগে, মেইনল্যাণ্ডগামী একটা প্লেনে চড়ে বসলাম আমি। সন্ধ্যায় বি. ও. এ. সি-র নাইরোবি ফ্লাইট ধরলাম।

পুরো একদিন আগে পৌঁছেছি জুরিখে, তাই এয়ারপোর্টে কাউকে আশা করিনি আমি। কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনের ঝামেলা দ্রুত শেষ করে বিশাল অ্যারাইভাল হলে বেরিয়ে এলাম। পরিকল্পনার এলোমেলো সুতোগুলো শক্ত করে বেঁধে নেবার আগে লাগেজ চেক করে নিলাম। তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম, পরদিন একটা বিশ মিনিটে ফিরতি ফ্লাইট পাব একটা। আমার পরিকল্পনার সঙ্গে খাপে খাপে মিলে গেল ব্যাপারটা। মাত্র একটা টিকেট বুক করলাম আমি।

অনুসন্ধান ডেস্কে সুইস এয়ারের ড্রেস পরা সুন্দরী মেয়েটা খুব ব্যস্ত, সুতরাং দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আমি। যখন দেখলাম ও একা, এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর সামনে।

লম্বা সময় নিয়ে ব্যাখ্যা দিলাম ওকে। প্রথম দিকে আমার অনুরোধ জেদের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করল ও। কিন্তু নরম সুরে, চোখ টিপে, মেয়ে পটাবার হাসিটা মুখে লটকে নিয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার পর ওকেও বারবার খিলখিল করে হেসে উঠতে হল। এরপর একদম পানির মত সহজ হয়ে গেল ব্যাপারটা।

কালও তুমি এখানে ডিউটিতে থাকবে তো? ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলাম আমি।

হ্যাঁ, মশিয়ে, থাকব-চিন্তা কোরো না তুমি।

ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মত শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম আমরা। একটা ট্যাক্সি নিয়ে অল্প দূরের জুরিখ হলিডে ইনে চলে এলাম রাত কাটাবার জন্যে। একটা ড্রিঙ্কের অর্ডার দিয়ে শাওয়ার সারলাম, তারপর আরাম করে বসলাম টেলিভিশনের সামনে।

পরদিন দুপুরের খানিক আগে এয়ারপোর্টে একটা কাফেতে বসে আছি আমি, মুখের সামনে দৈনিক পত্রিকা মেলে ধরে পড়ার ভান করছি। আসলে কাগজটার ওপর দিকে উঁকি মেরে তাকিয়ে আছি অ্যারাইভাল হলের দিকে। আমার ব্যাগ এবং টিকেট চেক করানো হয়ে গেছে এরই মধ্যে, বাকি শুধু কয়েক পা হেঁটে ডিপারচার লাউঞ্জ পেরিয়ে বিদায় নেয়া।

আজ সকালে কেনা ধূসর রঙের একটা স্যুট পরে আছি আমি, এতই ঢিলেঢালা যে আরেকজন লোককে এর ভেতর লুকিয়ে নিতে পারব অনায়াসে। মাসুদ রানা এ-ধরনের জোব্বা পরে প্রকাশ্যে বেরুতে পারে তা দেখেও কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে, আমার আকৃতি বদলে নিয়েছি হোটেলের তোয়ালেগুলোকে প্যাড হিসেবে শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় জড়িয়ে বেঁধে নিয়ে। শুধু তাই নয়, চুল ছেঁটে অর্ধেক করে নিয়েছি আমি, আর সাদা ট্যালকম পাউডার ছড়িয়ে পনেরো বছর বাড়িয়ে নিয়েছি বয়সটা। সোনার ফ্রেমের চশমা পরে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতে পারিনি আমি।

একটা সাত মিনিটে টার্মিনাল ভবনের মেইন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল রাফেলা বার্ড। উলের তৈরি সাদা কালো ডোরাকাটা স্যুট পরে আছে ও, লম্বা একটা কালো লেদার কোট চড়িয়েছে তার ওপর, এর সঙ্গে মিল রেখে মাথায় বসিয়েছে সরু কার্নিসের লেদার হ্যাট। এই পোশাকে একটু বেশি স্মার্ট আর খুব কাজের মেয়ে বলে মনে হচ্ছে ওকে। গাঢ় রঙের সানগ্লাস দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে রেখেছে ও, কিন্তু মুখের চেহারায় অদ্ভুত অপরিচিত একটা কাঠিন্য দেখতে পাচ্ছি আমি। দৃঢ়, লম্বা পা ফেলে ট্যুরিস্টদের ভিড় ঠেলে এগোচ্ছে ও।

যা ভয় করেছিলাম তাই, আমার আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে, বুঝতে পেরে নিমেষে অসুস্থ বোধ করছি আমি, হাতে ধরা পত্রিকাটা কাঁপছে একটু একটু। ওর পাশে এবং এক হাত পেছনে থেকে ওকে অনুরসণ করছে ছোটখাট কিন্তু শক্তিশালী একজন বয়স্ক লোক, পরনে নিখুঁত পোশাক, মুখে গাম্ভীর্য এবং সঙ্গে পিস্তল-কোটের পকেটটা ফুলে রয়েছে দেখে বুঝতে পারছি এই লোকটার সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমাকে রাফেলা বার্ড, ওর নাকি আঙ্কেল। আঙ্কেল বার্ডের মাথায় সুতির একটা ক্যাপ রয়েছে, হাতে রয়েছে একটা ভাঁজ করা ওভারকোট। পূর্ণ সজাগ লোকটা, শিকারির ধূর্ততা ফুটে রয়েছে চোখে-মুখে। তার একটু পেছনে রয়েছে আরও চারজন সশস্ত্র যুবক।

শয়তান পাজি মেয়ে! বিড়বিড় করে বললাম আমি। কিন্তু সেই সঙ্গে আবার একথাও ভাবছি, ব্যাপারটা এত বেশি তিক্ত লাগছে কেন! অনেক আগেই তো এসব জানা হয়ে গেছে আমার।

রাফেলা এবং তার পাঁচজন পুরুষ সঙ্গী হলের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ডিয়ার আঙ্কেল বার্ড দ্রুত আর বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে নির্দেশ দিচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি। নিরেট নির্ভেজাল পেশাদার লোক, আমার জন্যে হলটাকে যেভাবে চারদিক থেকে বন্ধ করে ফেলল তা দেখেই পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছে। বেরিয়ে যাবার প্রত্যেকটি দরজায় এবং অ্যারাইভাল গেটে লোক দাঁড় করাল সে।

শান্তভাবে দাঁড়িয়ে শুনছে রাফেলা বার্ড, মুখের চেহারায় কোন ভাবের ছাপ নেই, চোখ দুটো সানগ্লাসে আড়াল করা। আঙ্কেল বার্ড তাকে কিছু বলতেই ঝট করে মাথা ঝাঁকাল সে, সঙ্গী চারজন নিজেদের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবার পর ঘুরে অ্যারাইভাল গেটের দিকে মুখ করল ওরা দুজন। দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।

আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে, এবার পালাও, রানা! ভেতর থেকে শুভবুদ্ধি ব্যাকুলভাবে সতর্ক করছে আমাকে। এই সর্বনেশে খেলায় মেতো না। এরা আরেক দল নেকড়ে। পালাও, রানা, পালাও!

ঠিক তখই পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম থেকে একটা ফ্লাইট ছাড়ার ঘোষণা দেয়া হল। এটা আমার ফেরার ফ্লাইট, যে ফ্লাইটের টিকেট কেটে রেখেছি। আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি আছে প্লেনটা টেকঅফ করতে। টিকেটধারীদেরকে ডিপারচার লাউঞ্জে যেতে বলা হচ্ছে।

টেবিল ছেড়ে উঠলাম আমি। সস্তাদরের ঢোলা স্যুটটা টেনেটুনে ঠিক করে বসিয়ে নিলাম গায়ে, তারপর বেরিয়ে এলাম কাফে থেকে। কোনদিকে না তাকিয়ে দ্রুত চলে এসেছি অনুসন্ধান ডেস্কের সামনে। সুইস এয়ারের ড্রেস পরা মেয়েটা দেখেও চিনতে পারল না আমাকে, পরমুহূর্তে চোখ দুটো বিস্ফারিত আর মুখটা ঝুলে পড়ল ওর।

সময় বুঝে সেই মোহন হাসিটা ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। প্রচণ্ড কৌতুকে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি সামলাচ্ছে ও। এর সবটুকু আমার বেশভূষার কৃতিত্ব।

সব শেষের বুদটা, ফিস ফিস করে বলল ও। ডিপারচার গেটের সবচেয়ে কাছের সারির শেষ বুদটা।

চোখ টিপে ধন্যবাদ জানালাম ওকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত এগোচ্ছি। টেলিফোন বুদে ঢুকে রিসিভার তুলে কথা বলার ভান করছি, কিন্তু আঙুলের চাপ দিয়ে কানেকশন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছি আমি। কাঁচের দরজা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরের হলের দিকে।

সুইস এয়ারের ড্রেস পরা মেয়েটা কথা রেখেছে। লাউডস্পীকারে ওর যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি।

অ্যাটেনশন, প্লীজ। মিস রাফেলা বার্ড, আপনি দয়া করে অনুসন্ধান ডেস্কে রিপোর্ট করুন।

কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি এগিয়ে গিয়ে ডেস্কের সামনে দাঁড়াল রাফেলা, কথা বলছে মেয়েটার সঙ্গে। হাত তুলে মেয়েটা আমার পাশের বুদটা দেখাল ওকে। ঘুরে দাঁড়াল রাফেলা। সোজা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। বুদের সারিগুলো আঙ্কেল বার্ড এবং সঙ্গীদের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে ওকে।

ওর লম্বা পায়ের চারদিকে ঢেউ খেলছে লেদার কোট, প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে দোল খাচ্ছে কাঁধের কাছে চকচকে কালো চুল। হাতের ক্ষত ঢেকে রাখার জন্যে কালো চামড়ার দস্তানা পরেছে ও। আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার এই মুহূর্তে কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।

আমার পাশের বুদে ঢুকে ফোনের রিসিভারটা তুলল ও। দ্রুত আমার নিজের রিসিভারটা ক্রেডলে রেখে বুদ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ওর বুদের দরজা খুলছি, চরম বিরক্তির সঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকাল ও।

ঠিক আছে, মহিলা-পুলিস-কেন তোমার মাথা ভাঙব না তার উপযুক্ত কারণ দর্শাও, বললাম ওকে।

বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে রাফেলা। স্যাঁত করে একটা হাত উঠে গেল মুখের কাছে। তুমি! আঁতকে উঠল ও। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা।

আসল রাফেলা বার্ডের খবর বল আগে। কি হয়েছিল তার? জানতে চাইছি আমি। বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে উঠতে সাহায্য করল ওকে আমার প্রশ্ন।

মারা গিয়েছিল। আমরা তার লাশ পাই-প্রায় চেনার উপায় ছিল না-শহরতলীর একটা জঙ্গলে।

সিডনি শেরিডান আমাকে বলেছিল সে তাকে খুন করেছে, বললাম আমি। কিন্তু কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি। তারপর ঝুঁকি নিয়ে যখন ক্রাশবোটে গেলাম তোমাকে উদ্ধার করে আনার জন্যে, তখনও শেরিডান হেসেছিল। আমি তোমাকে রাফেলা বলে ডাকায় আমাকে সে বোকা বলে টিটকারি দেয়, ঠোঁট বাঁকা করে হাসছি আমি। মিথ্যে বলেনি সে-তাই না? বোকাই ছিলাম আমি।

চুপ করে আছে ও, আমার চোখে তাকাতে পারছে না। কথা বলে যাচ্ছি আমি, আমার অনুমানগুলো সত্য কিনা যাচাই করে নিচ্ছি।

তার মানে রাফেলা বার্ড মারা গেলে তোমার ডিপার্টমেন্ট খবরটা চেপে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, আর তোমাকে পাঠায় বার্ডদের বাড়িতে ওত পেতে বসে থাকার জন্যে। আশা করছিলে, খুনীরা নবাগতার পরিচয় জানার জন্যে ওখানে ফিরে আসবে আবার। অথবা অন্য কোন স্বার্থ-সন্ধানী দল ওখানে ঢুঁ মারতে এসে তোমাদেরকে পথ দেখাবে। তোমার ডিপার্টমেন্ট এ-কাজের জন্যে তোমাকেই বেছে নিল কেন? কারণ, তুমি একজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত পুলিস ডাইভার। ঠিক কি না?

ঘাড় কাত করল রাফেলা। এখনও তাকাতে পারছে না আমার দিকে।

কিন্তু মস্ত একটা ভুল করে ফেলে ওরা। কংকোলজি সম্পর্কে তোমাকে কিছু জ্ঞান দান করা উচিত ছিল ওদের। তা যদি দিত, তাহলে তুমি সেই ফায়ার কোরালটা ধরতে যেতে না, আমিও বিরাট একটা ঝামেলা থেকে বাঁচতাম।

আমার অপ্রত্যাশিত উদয় হতভম্ব করে দিয়েছিল ওকে, কিন্তু এরই মধ্যে বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে ও। এখন ওর সময় হয়েছে হুইসেল বাজিয়ে আঙ্কেল বার্ড আর সঙ্গীদের ডাকার, তাই যদি করতে চায় ও।

মুখটা অন্য দিকে একটু ঘুরিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ও। তামাটে সোনালী মুখে রক্তের লালচে আভা ফুটে উঠেছে।

প্রথম রাতে তুমি টেলিফোন করেছিলে, ভেবেছিলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। তুমি তোমার সুপিরিয়র অফিসারকে রিপোর্ট করছিলে যে এক বোকা পা দিয়েছে ফাঁদে। তোমাকে আমার সঙ্গে অভিনয় চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। আর, ওহ্ গড, কি খেলাই না খেললে তুমি আমার সঙ্গে!

অবশেষে আমার দিকে তাকাল ও। নীল চোখের পাতা ঝুলে পড়ছে, যেন আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বলতে চাইছে, আমাকে এভাবে দুষো না। জোড়া লাগানো ঠোঁটের পেছনে শব্দগুলো যেন ফুটছে, কিন্তু সেগুলো আটকে রেখেছে ও, বেরুতে দিচ্ছে না।

সেজন্যেই নিরোর দোকানে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়েছিলে তুমি আমাকে, যাতে প্রতিবেশীরা কেউ তোমাকে দেখতে না পায়। সেজন্যেই শেরিডানের লোকেরা গ্যাসের আগুনে তোমার আঙুল পোড়াতে এসেছিল। তোমার পরিচয় জানতে চেয়েছিল ওরা, কেননা ওরা জানত তুমি রাফেলা বার্ড হতে পার না। ওরাই তো খুন করেছিল রাফেলা বার্ডকে।

এখন আমি চাইছি কথা বলুক ও। ওর মৌনতা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে আমার স্নায়ুতে।

আঙ্কেল বার্ডের পদটা কি? ইন্সপেক্টর?

চীফ ইন্সপেক্টর।

ওকে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল আমার।

সবই যখন জানো, নতুন করে এসব কথা তুলছ কেন তুমি? জানতে চাইল ও।

প্রথম দিকে কিছুই জানতাম না, শুধু সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু যখন নিশ্চিতভাবে জানলাম তখন নিরেট বোকার মত তোমার প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছি।

আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে নিজেকে আলিঙ্গন করল রাফেলা, আমি যেন আঘাত করেছি ওকে। কিন্তু নির্মমভাবে বলে যাচ্ছি আমি।

ভেবেছিলাম আমরা দুজন একসঙ্গে এমন কিছু করেছি যার ফলে আমার সম্পর্কে কিছু ভাল অনুভূতি হবে তোমার মধ্যে। আমার সমস্ত জীবনের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা বলে কেউ যখন কাউকে ভালবাসে সেই ভালবাসার কথা ভুলে থাকা যায় না।

আমি একজন পুলিস, দুজনের ব্যবধানটা আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছে ও, আর তুমি একজন খুনী।

এমন একজনকেও আমি খুন করিনি যে প্রথমে আমাকে খুন করতে চায়নি, পাল্টা ওর চোখে আঙুল দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিলাম ওকে, ঠিক যেভাবে হুমায়ুন দাদাকে খুন করেছ তুমি।

প্রচণ্ড আঘাতের মত লাগল কথাটা ওকে, প্রায় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মত অবস্থা হয়েছে ওর। নিজের চারদিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন একটা ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে।

তুমি একটা চোর, আবার হামলা করল ও।

একটু ইতস্তত করে মেনে নিলাম আমি, হ্যাঁ-কিন্তু চোর ছিলাম অনেকদিন আগে। তারপর থেকে সৎ থাকার জন্যে অমানুষিক পরিশ্রম করছি আমি। আমি একজন সৎ মানুষ, একথা এখন গর্ব করে বলতে পারি।

না, পার না, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল রাফেলা। বাঘ-সিংহাসনের মাথা, গ্রেট মুঘল…এগুলো কোন্ অধিকারে তুমি নিজের কাছে রেখেছ?

না, মাদাম, মৃদু কণ্ঠে বললাম আমি। নিঃশব্দে হাসছি। তুমি ভুল করছ।

কি বলতে চাও? কফিনে করে কি এসেছে তাহলে?

টার্টল বে-র পাঁচশো পাউণ্ড নির্ভেজাল ভিজে বালি। ওগুলো দেখে তোমার মনে পড়বে কিভাবে ওখানে সময়টা কাটিয়েছিলাম আমরা।

সোনার মাথা-কোথায় সেটা?

সেটার ওপর আইনসম্মত অধিকার রয়েছে যার তাকেই দিয়ে এসেছি।

কে…কার কথা বলছ তুমি?

দ্বীপবাসীদের কথা বলছি-তাদের প্রতিনিধি প্রেসিডেন্ট গডফ্রে পিডলের কাছে রয়েছে এখন সব।

তুমি দিয়ে দিয়েছ? অবিশ্বাসে চোখ বড় বড় করে তাকাল রাফেলা। তারপর অন্য একটা ভাব এসে অবিশ্বাসটুকু মুছে ফেলতে শুরু করল ওর চোখ থেকে। কেন, রানা, কেন?

বললাম না, সৎ থাকার জন্যে অমানুষিক পরিশ্রম করছি আমি। আবার আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছি। তারপর হঠাৎ দেখলাম স্বচ্ছ পানির পাতলা, সূক্ষ্ম একটা স্তর জমছে ওর গাঢ় নীল চোখে।

আর তুমি এখানে এসেছ-আমি কি করব তা জানা সত্ত্বেও?

তোমাকে সত্যিই ভালবাসি, তাই আমি চেয়েছি পথ বেছে নেবার একটা সুযোগ যেন পাও তুমি, বললাম আমি। ওর চোখের নিচের পাতায় পানির ফোঁটাগুলো মুক্তোর মত ঝুলছে। ওকে বলছি, এখন এই বুথ থেকে বেরুব আমি। হল পেরিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাব। কেউ যদি হুইসেল না বাজায়, পরবর্তী ফ্লাইট ধরে এখান থেকে চলে যাব। পরদিন প্রবাল প্রাচীর পেরিয়ে যাব সাঁতার কেটে, দেখব ডলফিনরা আসে কিনা। তোমার জন্যে অপেক্ষা করব আমি…বেশ অনেকদিন।

কিন্তু পুলিস তোমাকে ওখানেও শান্তিতে থাকতে দেবে না, রানা।

দেবে। যা কিছু ঘটেছে তার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে রাজি হয়েছেন প্রেসিডেন্ট পিডল। তিনি কথা দিয়েছেন, আমাকে রক্ষার জন্যে যা যা করা এবং বলা দরকার সব তিনি করবেন এবং বলবেন। সেন্ট মেরিতে কেউ আমাকে ছুঁতে পারবে না।

আবার আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছি। তারপর নিঃশব্দে হাসলাম আমি। একটা কথা বলা হয়নি তোমাকে। সুখবর। তোমার জন্যে কিনা জানি না। কিন্তু আমার জন্যে বটে। প্রেসিডেন্ট আমার জন্যে একটা বোটের অর্ডার দিয়েছেন। হুবহু জলকুমারীর মত হবে সেটা। বো-এ সোনার হরফে লেখা থাকবে নামটা-জলকুমারী। এই দেখ অফিশিয়াল অর্ডার। পকেট থেকে প্রেসিডেন্টের সীলমোহর করা চিঠিটা বের করে দেখালাম ওকে। বললাম, আশা করছি মাস তিনেকের মধ্যেই পাব। ওটা দ্বীপবাসীদের ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে আমার জন্যে উপহার।

নির্বিকার তাকিয়ে আছে রাফেলা। চোখ দুটো কি ঝিক্ করে উঠল? ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ঘুরে দাঁড়িয়ে বুদের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম আমি। ধীর কিন্তু দৃঢ় পায়ে হাঁটছি ডিপারচার গেটের দিকে। এই সময় লাউডস্পীকারে আবার আমার ফ্লাইট ছাড়ার ঘোষণা শুরু হল। আমার সমস্ত জীবনের সবচেয়ে লম্বা পদচারণা এটা, প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে বুকের খাঁচায় বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। কেউ আমাকে বাধা দিল না। আমিও পেছন ফিরে তাকাবার ঝুঁকি নিইনি।

প্লেনে বসে ভাবছি, কি আশ্চর্য, আরও কত কথা বলার ছিল রাফেলাকে, অথচ সব ভুলে গেলাম কিভাবে! ওর আসল নামটা পর্যন্ত জানা হয়নি আমার!

.

তারপর, রানা? তারপর কি হল? উত্তেজনায় কাঁপছে সোহানার কণ্ঠস্বর, ব্যগ্রভাবে জানতে চাইছে, চুপ করে গেলে কেন? বল! তারপর কি হল?

তারপর? তারপর…রাজপুত্র দেখল, সেই বিশাল গাছে হাজার হাজার চড়ুই পাখি বসে রয়েছে। একটা পাখিকে রাজপুত্র পশ্ন করল, পাখি, তুমি রাজকন্যেকে এই পথ দিয়ে যেতে দেখেছ? নিঃশব্দে হাসছে রানা, পাখিটা কোন জবাব না দিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। রাজপুত্র তখন আরেকটা পাখিকে ওই একই প্রশ্ন করল। সেই পাখিটাও ফুড়ুৎ-চলল এইভাবে।

ঠাট্টা না, প্লীজ, রানা, তোমার পায়ে পড়ি, বল কি হল তারপর।

ফুড়ুৎ!

রানা! কেঁদে ফেলবে যেন সোহানা।

ফুড়ুৎ!

তুমি…তুমি এমন শয়তান লোক জানলে…

কি আশ্চর্য, সব পাখি উড়ে না গেলে আমার কিছু করার আছে, তুমিই বল? কিন্তু সোহানা নাকের জলে চোখের জলে ভাসতে যাচ্ছে দেখে দয়া হল ওর, বলল, আচ্ছা, বেশ, কি জানতে চাও বলো?

রাফেলা…সে…কি সেন্ট মেরিতে ফিরে এল?

সে যদি আসত তাহলে তুমি আজ এখানে আমার পাশে কেন?

এল না! কেমন যেন নিরাশ হল সোহানা। কিন্তু, কেন, রানা? সে-ও তো ভালবেসেছিল তোমাকে। তবে এল না কেন?

আমি চোর, খুনী, এ কথাটা ভুলতে পারেনি ও। লণ্ডনে যে ডায়মণ্ড কেলেঙ্কারির সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ফেলেছিল পুলিস, খুনের আসামী হিসেবে পরোয়ানা বের করেছিল গ্রেফতারের আমার সেই অপরাধ কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেনি ও। হাজার হোক পুলিস তো। নীতির বেড়া ভেঙে আমাকে মেনে নিতে পারেনি। একটু থেমে আবার বলল রানা, একটা কথা বললেই সব মেনে নিত ও, আমি জানতাম। কিন্তু সে কথা আমি বলিনি ওকে।

কি কথা, রানা?

আমি যে পি. সি. আই-এর একজন এজেন্ট, এই কথাটা। জানি, বললেই আমার সবকিছু পানির মত পরিষ্কার হয়ে যেত ওর কাছে। ও বুঝত, আমিও এক ধরনের পুলিসই, ব্যক্তিগত স্বার্থে বা লোভে পড়ে কিছুই করিনি আমি, করেছি দেশের স্বার্থে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে। কিন্তু হোক না প্রথম প্রেম, বিদেশিনীর কাছে অফিশিয়াল সিক্রেট ভাঙা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। ব্যাপারটা বিয়ের পর্যায়ে গেলে ওপরঅলার অনুমতি নিয়ে হয়ত জানাতাম, কিন্তু তার আগে জানাবার কথা কল্পনাও করিনি। তুমি হয়ত জান, প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখেও আজ পর্যন্ত কোথাও কারও কাছে আমি আমাদের কোন সিক্রেট আউট করিনি-এই জন্যেই আমি মাসুদ রানা।

শ্রদ্ধার দৃষ্টি ফুটে উঠল সোহানার চোখে। দেশের স্বার্থে কতবড় ত্যাগ স্বীকার করেছে রানা, ভাবতে গিয়ে বিস্ময়ে অভিভূৎ না হয়ে পারল না সে।

আচ্ছা, নতুন জলকুমারী পেয়েছিলে?

হ্যাঁ।

কোথায় এখন সেটা?

আছে। কোথায় জিজ্ঞেস কোরো না। অফিশিয়াল সিক্রেট।

আর বাঘ সিংহাসনের বাকি অংশ? পরে গানফায়ার রীফ থেকে সেগুলো উদ্ধার করেছিলে?

আমি নিজে যাইনি আর-নকশা এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, ওরাই ব্যবস্থা করেছিল তোলার।

আর, শেরিডানের ব্যাপারে লণ্ডনে যে-সব তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলে…।

ও, হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রানা, জুরিখ থেকে দ্বীপে ফিরে আসার সাতদিনের মধ্যেই ঢাকা থেকে টেলিগ্রাম এসে হাজির। ডেকে পাঠিয়েছেন মেজর জেনারেল।

ফিরে এলে?

রাফেলার জন্যে আরও তিন হপ্তা অপেক্ষা করে শেষে ফিরেই এলাম।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল রানা। তারপর মৃদু হাসল, আশ্চর্য হালকা লাগছে, সোহানা। এতদিনের চেপে রাখা কথাগুলো কাউকে বলতে পেরে ভারমুক্ত হয়ে গেল বুকটা। যাই হোক, কেমন লাগল বল তো গল্পটা?

দারুণ, অপূর্ব, তুলনাহীন, উচ্ছ্বসিত প্রশংসার বিস্ফোরণ বেরিয়ে এল সোহানার উজ্জ্বল মুখ থেকে। হাসল সে-ও, ভাগ্যিস তুমি লিখতে জানো না!

যেন একটা ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠল রানা, আরেকটু হলে পড়ে যাচ্ছিল দাঁতের ফাঁক থেকে চুরুটটা। তারমানে? লিখতে জানি না?

গল্প লেখার কথা বলছি, গো। যদি পারতে, না খেয়ে মারা যেত বেচারা কাজী আনোয়ার হোসেন। তোমারটা ছেড়ে কেউ আর তার লেখা পড়তে যেত না।

তাই নাকি? এতই ভাল বলেছি? তাহলে তো তোমাকে আরও গল্প শোনাতে হয়!

আরও গল্প? সত্যিই? আরও আছে?

অ-নে-ক।

[সমাপ্ত]

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত