বিয়ের পর এই প্রথম বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি বরিশালে। ছোটবেলা থেকে খুলনাতে বড় হওয়া আমার। শ্বশুরবাড়ি ঢুকতেই সবার চিল্লাচিল্লি “এ দেইক্কা যা সবাই জাইদ্যার বউ আইছে” আমি জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললাম “দেইক্কা?” ও মুচকি হেসে বললো “দেখে” গ্রামের মানুষজন বুঝোইতো! কথাবার্তা আঞ্চলিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমিও হেসে বললাম “আচ্ছা। কিন্তু জাইদ্যা? এটা আবার কে?” জাহিদ হাহা করে হেসে বললো “জাহিদ থেকে জাহিদ্যা সেখান থেকে জাইদ্যা।”
আমি সামনে এগোতেই একদল পিচ্চি পাচ্চারা আমার আশেপাশে ঘিরে হাঁটতে থাকলো, আর বারবার আমাকে দেখতে লাগলো, ওদের সবার মুখে হাসি লেগে আছে। বাসায় ঢুকে শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে সালাম করতেই শ্বাশুড়ি বললো “থাউক, অইছে এইসব না হইরা তুমি মোর বোহে আও” আমি জাহিদের দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকাতেই ও এসে বললো মা’কে জড়িয়ে ধরার কথা বললো। আমি শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলাম। আশেপাশের লোকজনের থেকে কিছু কথপোকথন কানে আসতে থাকলো “বউগ্যা তো ম্যালা ভাল্চিনায়”
-হয় ব্যাডা একছের ভাল দেহায়। “চোউক দুগ্গা ভাসা ভাসা বড় বড়, নাকগোউ লোম্ফা আছে, চামড়াডা দুদের নাহান সাদা।”
-হয়। ক্যা মোগো জাইদ্যারে কি কম ভালো দেহায় নাহি?
“না হেইয়াও ঠিক কইছো।” আমি শুধু তাকিয়ে সবার দিকে মুচকি হেসে যাচ্ছি। আসলে আমি আদৌ বুঝতেছি না এরা আমার প্রশংসা করছে নাকি গালি দিচ্ছে। যাই হোক। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। শ্বাশুড়ি বললো বউমা “বাইগুনদ্যা আশের আন্ডা রানছি হেইয়া আগে দিমু নাকি নাহোইলের দুইদ্যা চিঙ্গোইর মাছ ঝোল হরছি হেইয়া দিমু?” আমি কিছু বলার আগেই জাহিদ বললে “মা ও হাঁসের ডিম, বেগুন, নারিকেলের দুধ, চিংড়ি মাছ সবই খায়। তুমি দাও যেটা তোমার ইচ্ছা।”
বিকেলে জাহিদের কাজিন মুন্নির সাথে ওদের বাসার পিছনে ঘুরতে গেলাম এমন সময় জাহিদের এক চাচি এসে বললেন “ঐ মুন্নি দেহিস আবার মাতার উফ্রে যেন টরহি না পড়ে, নাহোইল গাছের নিচে খারাইস না, আর বাগানের মইদ্যে দাউর, গ্যারা-গোরা, নাহোইলের বাইলতা, সুবারির খোল পাইলে টোহাইয়া লইয়া আইস। ক্যালা গাছের ফ্যাতরাইদ্দা রানতে গেলে খালি ধোমা অয়, ঐদ্যা জাল ধরান যায় নাহি!”
প্রতি উত্তরে মুন্নি বললো “আচ্ছা পাইলে লইয়া আমু আনে।” নাহ্! এদের কোনো কথা’ই আমি বুঝছি না। জাহিদটাও সারাদিন আমার কাছে থাকে না। এখানে সেখানে তার কাজ থাকে। ওর’ই বা কি দোষ। প্রায় ছয় মাস পর বাড়িতে এসেছে কাজ তো থাকবেই। আমাদের বিয়েটা দুই পরিবারকে না জানিয়ে হয়েছে। জাহিদ ভালো একটা জব করে, বিয়ের পর আমরা ভালো আছি দেখে বাবা-মা মেনে নিলেন দুই মাস হলো। জাহিদের পরিবারকেও জাহিদ বুঝিয়ে ম্যানেজ করেছে৷ তারপর আমাকে নিয়ে এলো বেড়াতে এ বাড়িতে।
কিন্তু এদের ভাষা কি করে বুঝবো আমি। প্লে স্টোরে, গুগলে সার্চ করলাম বরিশালের ভাষাটা বাংলায় অনুবাদ করা যায় কিনা। কিন্তু কোনো এ্যাপ্স বা কোনো সিস্টেম খুঁজে পেলাম না। কি আর করা! যা আছে কপালে। ভাষা না জানি কিন্তু তামিল, কোরিয়ান, চাইনিজ মুভির মত এদের অঙ্গভঙ্গি দেখে বুঝতে তো পারবো কিছুটা কি বলতে চাচ্ছে। আমার শ্বাশুড়ি তার মত এক বয়স্ক মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন “বউমা, হোনো ইনি অইলো তোমার খালা হাউরি। মোর হাইজ্যা বুইন। জাইদরে তো ছোডকাল অইতে পাইল্যা পুইষ্যা হে’ই বড় বানাইছে।”
আমি মনে মনে মিলাতে লাগলাম “আমার খালা হাউরি। হাউরি মানে কোনো একটা সম্পর্কের নাম। সে আমার শ্বাশুড়ির হাইজ্যা বুইন। বুইন হলো বোন। মানে শ্বাশুড়ির বোন হয় সম্পর্কে আর আমার খালা শ্বাশুড়ি। কিন্তু হাইজ্যাটা কি! এটা মনে হয় খালা শ্বাশুড়ি বলার পরে বলতে হয়।” আমি বললাম “খালা শ্বাশুড়ি হাইজ্যা ভালো আছেন আপনি?” সে ধমকের সুরে উত্তর দিলো “ঐ মাতারি হাইজ্যা কইতে কইছে কেডা তোমারে? আর এরোহোম খালা শা-শ্বু-ড়ি না কইয়া খালাম্মা কইলেই তো অয়। তোমাগো শহরের মাইয়াগো এই এক বদইভ্যাস কেডা কি অয় কইতে পারেনা।” আমি বুঝতে পারলাম তিনি রেগে গেছেন। ভালো কিছু বলেন নি। আমি মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম। সে জিজ্ঞেস করলো “তোমরা কয় ভাই বুইন?”
-জ্বী দুই বোন। “তুমি ডাঙ্গর?”
-না আমরা কেউ ডাঙ্গর না তো। আমার নাম হীমা আর ছোট বোনের নাম সীমা। “ডাঙ্গর বোঝো নাই? এডা অইছে তোমাগো দুইজনের মইদ্যে বয়সে কেডা বড় হেইয়া!”
-ও! আমি বড়।
আমি উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতেই দেখি আমার শ্বাশুড়ি রান্নাঘরে থাকা আমার ননদকে উদ্দেশ্য করে বলছেন “এ ভোলাইল্লি ক্যা? মরইন্না চিউক্কোর চিরহাইতেছো। অইছে কি?” ননদ বললো “ভোলাইছি কি খালি খালি, কইছি ডাইলে নুন দেছো না দেবা?”
-এ ছেমরি তুই হেইয়া এট্টু ডাইল উডাইয়া মোহে দিয়া দ্যাকলেই তো পারতি। মুই উমাইন্না মুরহাডারে আদার খাওয়াইতে ছেলাম। এলহা এলহা কত কাম পারা যায়, হেই পিন্নে তোরে ওস্সাঘরে বওয়াইয়া থুইয়া গেলাম।
আমি হা করে তাদের কথপোকথন গিলছিলাম। সব মাথার উপর দিয়ে গেল। জাহিদ থাকলেও কিছু কথা মাথার ভিতরে ঢুকতো। সন্ধ্যায় জাহিদের বড় ভাইয়ের পিচ্চি ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমি ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম পাঁচটা ফলের ও ফুলের নাম বলোতো? একজন বললো “হবরি, কাডাল, ক্যালা, কোমলা, কোম্বা। গান্দা ফুল, বেলি ফুল, হাপলা ফুল, জবা ফুল, বকুল ফুল” অন্যজন উঠে বললো আমি পাঁচটা পশু আর পক্কির নাম কই? আমি বললাম “হ্যাঁ বলো।”
-কুত্তা, বিলই, ছাগল, গরু, মইষ। আর পক্কি অইলো ‘হালিক, কাউয়া, কইতোর, দোয়েল, বুলবুইল্যা।
আমি হাসি দিয়ে চমৎকার বলে চুপ হয়ে গেলাম। এসব অদ্ভুদ ফল, ফুল, পশু, পাখি বাংলাদেশে আছে আর আমি জানতাম না! পাশের বাসার এক ভাবি এসে আমাকে আস্তে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন “কাইব্যানে কয় টাহা লিকছেলেন?” আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম “কই নাতো, কোনো টাকা লিখি নি তো।” সে বললো “আস্সোভাহানাল্লাহ্ হেইলে বিয়া ক্যামনে অইলে?”
-বিয়া হয়েছে তো। আমি তো জাহিদের বউ। “হেইয়াইতো জিগাইলাম”
-ও।
তিনি বিরক্তির ভঙ্গিতে চলে গেলেন। আমার জাঁ এসে বললেন “হীমা লও নাইয়া আই। দুহারে খাওয়ার ওক্ত অইয়া গেছে। বেইন্যাহাল অইতে একছের কাম আর কাম। খাইয়া এট্টু হুমু।” আমি শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম “আচ্ছা।” পুকুরে গোসল করার সময় ভাবি জিজ্ঞেস করলেন “হাতোর জানো?” আমি হ্যাঁ বলবো নাকি না বলবো বুঝছিলাম না৷ বললাম এটা দেখতে কেমন? সবাই হাহা করে হেঁসে দিলো।
সাতদিনে আঞ্চলিকতায় পিষে আমিও অনেকটাই রপ্ত করেছি এমন একটা চিন্তা’ই আমার মাথায় বসবাস করলো। চলে যাওয়ার সময় আমার শ্বশুড় আমাকে বললেন “পেরথম ফির আইলা, কেমন কি লাগজে জানিনা, এইয়ার পর যহন মন চায় তহন আবা, আর আইলে ম্যালাদিনের লইগ্যা আবা আর লগে হইরা তোমাগো বাড়ির হক্কুলডিরে লইয়া আবা।” জাহিদ উত্তর দেওয়ার আগেই আমি হাসি দিয়ে বললাম “আচ্ছা বাবা, আপনিও পেরথমফির হক্কুলডিরে লইয়া খুলনা আবা, ম্যালাদিনের লইগ্যা পেরথম ফির যহন মন চায় তহন আবা এইয়ার পর কেমন কি লাগজে জানিনা।”
এই প্রথমবার আমি ওদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললাম, যাওয়ার সময় তো বলতেই হয়। সস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে খুশি খুশি চোখে পাশে তাকাতেই দেখি জাহিদ মুখ চেপে ধরে অট্টহাসিতে ফেটে যাচ্ছে, আমার শ্বাশুড়ির চোখ মাথার উপর, শ্বশুড় থ হয়ে আছেন, বাকি সবাই মুখ চেপে হেসেই যাচ্ছে। আমি লজ্জা কাটাতে বলে উঠলাম “মুই আসলে বোজদে পারিনি, কি কইতে গিয়া কি বলে ফেলেছি” এবার আর জাহিদের হাসি যেন থামে না।