দূরের ডাক
পরীক্ষার পর লম্বা ছুটিটা যখন প্রায় একঘেয়ে হয়ে এসেছে, সেইসময় হঠাৎ সুদূর বর্মা মুলুক থেকে ছোটকাকার একখানি চিঠি এল। কাকা লিখেছেন :
প্রিয় সলিল,
জানি না, পরীক্ষার পর দিনগুলো তোমার কেমন কাটছে। এখানে সমুদ্র, বন, জঙ্গল অনেক কিছুই আছে। একা একা আর ভাল লাগছে না, তাছাড়া কতদিন তোমাদের দেখিনি। যদি পারো আমার এখানে একবার ঘুরে যেও।
ইতি,
তোমার শুভার্থী,
কাকা।
কাকার চিঠিটা পেয়ে তখনি বিদেশে যাবার আনন্দে মনটা যেন নেচে উঠল আমার। তক্ষুনি দৌড়ে গিয়ে থিয়েটারের ভঙ্গিতে মা’কে বললাম –
” দাও মাগো সন্তানেরে বিদায়,
চলে যাই লোকালয় ত্যজি…..”
……. ” কি ছেলেমানুষি করিস সলিল?” বললেন মা।
……..” এই দ্যাখো মা, কাকার চিঠি”, বলতে বলতে মা’কে দেখালাম চিঠিখানা, ” সামনের সোমবারেই আমি রওনা হব”।
……. ” কোথায়? ”
…….” কাকার কাছে। বর্মা মুলুকে”।
লক্ষ্য করলাম, মায়ের মুখটা হঠাৎ যেন কালো হয়ে গেল। কাকার কাছে যাব এতে অমত করার কিছু নেই ; কিন্তু তবু মায়ের মন, কিসের আশঙ্কায় যেন তখনিই মন থেকে সায় দিতে পারলেন না।
যাই হোক, সেদিনই সুবিধামতো সময় মায়ের কাছ থেকে মত নিয়ে দিনস্থির করে ফেললাম।
বর্মায় কাকার ছিল হীরা, পান্না, চুনি, মুক্তো – এইসবের প্রকাণ্ড ব্যবসা। হীরেপান্নার ব্যবসার চেয়েও তিনি বেশী ভালবাসতেন দুষ্প্রাপ্য মণি-মুক্তো সংগ্রহ করতে। এটা ছিল তাঁর জীবনের নেশা! তাঁর এই অপরূপ নেশার কথা আমি বাবার কাছেই শুনেছিলাম; কিন্তু সেই নেশা যে কি প্রচণ্ড ছিল, তা পরে নিজের জীবনে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি।
কাকাবাবু একা মানুষ, আজ পর্যন্ত বিয়ে-থা করেননি। দিনরাত নানারকম পুঁথিপত্র পড়তেন, আর পাহাড় পর্বত, ঝোপঝাড় তছনছ করে অনেক কিছুর অনুসন্ধান করে বেড়াতেন।
কাজেই আমার এই কাকাটি তাঁর এই অপরূপ স্বভাবের জন্য বর্মা দেশের সর্বত্রই ভালোরকম পরিচিত ছিলেন।
কালো পাথরের মূর্তি
আমি বর্মায় তাঁর বাড়িতে এসে পৌঁছনোর পর কাকাবাবু বললেন, “এসেছ তাহলে সত্যি সত্যি? যাক, আমি তো ভেবেছিলাম, তোমরা আমায় ভুলেই গেছ। ছুটিটা এখানেই এনজয় কর”।
দিনকতক খুব এখানে ওখানে ঘুরে, দেখে-শুনে বেড়ালাম।
কাকার বাড়িতে একটা বিরাট লাইব্রেরী ছিল। সেখানে হীরে, পান্না, চুনি,মণি, মুক্তো, পান্না সন্মন্ধীয় বই-ই ছিল বেশী। দিনের বেশীরভাগ সময় নিজের ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতেন, তারপর বাড়ি ফিরে বাকি সময়টুকু ঐ লাইব্রেরীতেই নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন। সেই পান্না আর মুক্তোর ইতিবৃত্তের মধ্যে তিনি যে কি রস পেতেন, তা তিনিই জানেন! এক-একদিন এমন হতো যে তিনি নাওয়া খাওয়া পর্যন্ত ভুলে যেতেন; এমন ছিল তাঁর নেশা!
বাড়িতে একজন বর্মী চাকর নিযুক্ত ছিল, তার নাম – টাঙ্গা। লোকটা যেমনি লম্বা তেমনি চওড়া। তার মাথার চুলগুলো কদম ফুলের মতো ছোট করে ছাঁটা! একটা হাফ প্যান্ট আর একটা হাফ শার্ট – এই ছিল তার পোশাক। লোকটার গায়ে ছিল অসীম ক্ষমতা ; তাই আদর করে কাকা তার নাম রেখেছিলেন – ‘ ভীম’। অসুরের মতো যেমন ছিল তার ক্ষমতা, বুদ্ধিও ছিল তেমনি অগাধ।
সামান্য চাকর হলে কি হবে, কাকাবাবু তাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি বলতেন, ” টাঙ্গা কেবল আমার পরিচারক নয়, সে আমার পরমবিশ্বাসী দেহরক্ষক। ওর বুদ্ধির দৌলতে কতবার যে দুরন্ত মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে ফিরে এসেছি – সেসব কথা মনে পড়লে আজও আমার চোখে জল এসে যায়”।
পথঘাট থেকে শুরু করে দুর্গম অরণ্য – সব ছিল ওর নখদর্পণে। দীর্ঘকাল কাকার কাছে থেকে টাঙ্গা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাটা পুরোপুরি না হলেও অনেকখানিই আয়ত্ত্ব করে ফেলেছিল।
…………………………………………………………………….
হাতে কোনও কাজকম্ম না থাকায় বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে বসে চুপটি করে রাস্তায় লোক চলাচল দেখছি। কাকা সকালেই ব্যবসার কাজে বেরিয়েছেন। দুপুরের আগে ফিরবেন না।
টাঙ্গাকে বললাম, ” এক কাপ কফি দিয়ে যা”।
আজ দিন দুই হতে আবার আকাশটাও মেঘলা মেঘলা। মেঘলা দিনের অলস মূহুর্তগুলো যেন কাটতেই চায় না!
এমন সময় দেখি, ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড় পরা একটা লোক গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে এদিকওদিক তাকাতে লাগল। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে লোকটার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম।
বারান্দার কাছে এগিয়ে আমায় তার দিকে এগোতে দেখে লোকটা আরও একটু এগিয়ে এলো। জিজ্ঞাসা করলাম, ” কি চাই?”
অদ্ভুত ভাষায় লোকটা যেসব কথা বলল আমি তার এক বর্ণও বুঝতে পারলাম না। এমন সময় গেটের দিকে চেয়ে দেখি, কাকা আসছেন। বললাম, ” কাকা, এই লোকটা কি বলছে, কিছু বোঝা যাচ্ছে না”।
কাকা এবার লোকটার দিকে ফিরে বললেন, ” কি চাই?”
উত্তরে লোকটা আগের মতোই অচেনা ভাষায় কি যেন বলল।
এবার কাকাও তারই মতো ভাষায় ভাঙা ভাঙা ভাবে কি যেন জিজ্ঞেস করলেন লোকটাকে। তার সাথে আরও দু-চারটে কথাবার্তার পর কাকা লোকটাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন, আমিও সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ঘরে ঢুকলাম। লোকটা তখন তার শতচ্ছিন্ন ময়লা প্যান্টের ভেতর হাত গলিয়ে একটা ন্যাকড়ার পুঁটলির মতো কি যেন বের করে আনল।
সেই ন্যাকড়ার পুঁটলি খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা ছোট্ট কালো পাথরের মূর্তি। মূর্তিটির গায়ে ছোট-বড় অনেকগুলো রক্তের মতো লাল টুকটুকে চুনি বসানো। অত বড় চুনি আমি জীবনেও দেখিনি!
মূর্তিটা দেখতে অনেকটা বাঁদরের মতো এবং সেটাকে দুটো সাপ দুদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। সেই সাপ দুটোর চোখেও মস্ত মস্ত দুটো করে চুনি বসানো, এবার সেই চুনি চারটেই আকারে খুব বড়!
আমি কাকার মুখের দিকে তাকিয়ে কতকটা বিস্মিত ভাবেই বললাম, “কি সুন্দর জিনিস!”
আমার কথার উত্তর না দিয়ে কাকা তখনও একমনে চুনিগুলো দেখছিলেন, তারপর সেই অদ্ভুত ভাষায় লোকটির সাথে আবার কথাবার্তা শুরু করলেন। বোধহয় দাম সন্মন্ধেই কথা হতে লাগল দুজনের মধ্যে। আরও খানিকক্ষণ কাকার সাথে কিসব কথাবার্তা হলো লোকটার! তারপর দেখলাম, মূর্তিটা নিয়েই লোকটা চলে গেল।
বিষের তীর
লোকটা চলে গেলে আমি কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, ” লোকটা কে?”
কাকা বললেন, ” ও লোকটা কে, তা ঠিক জানি না। তবে ও মূর্তিটা আমার কাছে বেচতে এসেছিল। কার কাছে ও শুনেছে, আমি জ্যুয়েলের স্পেশালিষ্ট এবং জ্যুয়েলের ব্যবসা করি”।
” তবে ও ওটা নিয়ে আবার চলে গেল কেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
…… “ও যা দাম চাইছিল, অত টাকা এখন আমার ঘরে নেই। ওকে বলে দিলাম, আজ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে রেখে দেব, কাল সকালে যেন এসে নিয়ে যায়…..” বলতে বলতে কাকা লাইব্রেরী ঘরের দিকে চলে গেলেন।
আমিও উঠে পড়লাম।
পরদিন সকালে কাকা আর দোকানেই বেরোলেন না, ঘরেই বসে রইলেন। ক্রমে সকাল গিয়ে দুপুর এলো, দুপুর গিয়ে বিকেল এলো তারপর একসময় সাঁঝের আঁধারও ঘনিয়ে এল পৃথিবীর বুকে, কিন্তু লোকটা আর এলো না। কাকা চিন্তিত মুখে লোকটার পথ চেয়ে বারান্দায় ঘনঘন পায়চারি করতে লাগলেন।
…… ” লোকটা বোধহয় আর এলো না!” আমি বললাম।
…… ” না, সে আসবেই, আর আমার মতো এত টাকা সে কোথায়ই বা পাবে? তাকে আসতেই হবে”।
রাত ক্রমশ গভীর হলো। আস্তে আস্তে রাস্তার লোকজন ও কোলাহল – রাত্রির স্তব্ধতায় মিলিয়ে যেতে লাগল।
ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম – রাত এগারোটা বেজে গেছে। লোকটার ফিরে আসা সন্মন্ধে আমি হতাশ হয়ে গেলাম। কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তিনিও লোকটার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর মুখে একটা হতাশা আর বিষন্নতার ছাপ! বোধহয় অত ভালো ভালো চুনিগুলো হাতছাড়া হয়ে গেল, এইজন্যেই!
এইভাবে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে রাত বারোটা বেজে গেল। এমন সময় অদূরে রাস্তায় একটা গোলমাল শোনা গেল, এবং গোলমালটা ক্রমেই যেন বাড়তে লাগল!
…..” ব্যাপার কি?”
দেখার জন্য আমি আর কাকা দুজনেই ছুটে গেলাম রাস্তায়।
আমাদের বাড়ি থেকে হাত পঁচিশ দূরে…. কতগুলো লোক একটা জায়গা ঘিরে জট পাকাচ্ছিল। আমরা এগিয়ে গেলাম।
কে একজন বলছিল, ” লোকটা হঠাৎ পড়ল, আর তখনি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল”।
……” কে মারা গেল?….কে?”
লোকগুলোকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটা লোক রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দেখলে মনে হয়, বুঝি রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমিয়েই পড়েছে।
কাকা এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে চিৎ করে দিতেই আমি আর কাকা-দুজনেই একসাথে চমকে উঠলাম। ল্যাম্পপোস্টের আলো যেটুকু তার মুখে এসে পড়ছিল, তাতে তাকে চিনতে এতটুকু কষ্ট হলো না।
এ সেই কালকের লোকটা, যে কাকার কাছে সেই অদ্ভুত মূর্তিটা বিক্রি করতে এসেছিল। এরই আজ আসবার কথা ছিল এবং এরই আসার অপেক্ষায় কাকা এতক্ষণ একবার ঘর একবার বার করছিলেন।
হ্যাঁ, এ সেই লোকটাই, সন্দেহ নেই।
লোকটাকে দেখে আমার মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে রইল অনেকক্ষণ। কিন্তু কাকাবাবু যেন চট করে নিজেকে সামলে নিলেন মনে হলো।
তিনিও বিস্মিত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর বিস্ময় কেবল মূহুর্তের জন্য। তিনি সম্ভবত তখনিই নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেলেছিলেন।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” সলিল! তুমি লোকটার পায়ের দিকটা ধরো, আমি মাথার দিকটা ধরছি; একে আমাদের বাড়ি নিয়ে চলো”।
এই বলে তিনি ভিড়’টাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” আপনারা কেউ দয়া করে যদি একজন ডাক্তার ডেকে দেন! লোকটি সত্যিই মরেছে কিনা একটিবার ভাল করে দেখা উচিত”।
লোকটাকে ধরাধরি করে আমি আর কাকা বাড়িতে নিয়ে এলাম।
একটা বেঞ্চের ওপর লোকটাকে শুইয়ে, কাকা লোকটার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে আগের দিনের সেই পুঁটলিটা বের করে আনলেন। পুঁটলিটা খুলতেই উজ্জ্বল আলোয় মূর্তিটার গায়ের চুনিগুলো সাপের চোখের মতো ঝকঝক করে উঠল। কাকা তাড়াতাড়ি মূর্তিটা নিজের জামার পকেটে রেখে দিলেন।
খানিক পরেই ডাক্তার এলেন।
ভাল করে দেখে ডাক্তার বললেন, ” হ্যাঁ, লোকটা সত্যিই মারা গেছে! কিন্তু একটা জিনিস ভারী আশ্চর্য মনে হচ্ছে! লোকট মারা গেল কিসে? কোথাও এতটুকু ক্ষতের চিহ্ন পর্যন্ত নেই!……অদ্ভুত মৃত্যু!”
অনেক অনুসন্ধানের পর একটা জিনিস দেখা গেল। লোকটার ঘাড়ের কাছে ছোট্ট একটা লোহার শলার মতো কি যেন বিঁধে আছে! ডাক্তার সেটা টেনে বের করে হাতের মধ্যে নিয়ে আলোর কাছে তুলে ধরলেন।
একটা ছোট্ট তীর। ছুঁচের চেয়েও তীক্ষ্ণ তার ডগা!
ডাক্তার তীরটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, ” লোকটা তবে হার্টফেল করে মরেনি! লোকটাকে খুন করা হয়েছে। এই বিষাক্ত তীর দিয়েই একে খুন করা হয়েছে!”
…..” খুন করা হয়েছে!” কাকা আর আমি দুজনেই একসাথে চমকে উঠে বললাম।
ইতিমধ্যে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ আসতেই মৃতদেহটাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো।
পুলিশ আমাদের আর ডাক্তারের থেকে যতটা সম্ভব জেনে নিয়ে মৃতদেহটা মর্গে পাঠিয়ে দিয়ে চলে গেল।
নিশীথে আগন্তুক
প্রায় চোখের সামনে এমন একটা হত্যাকান্ড হতে দেখে কাকা এবং আমি-দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
রাত গভীর হলেও কিছুতেই আমাদের চোখে ঘুম এলো না। আমরা দুজনেই লাইব্রেরী ঘরে বসে হতভাগার শোচনীয় মৃত্যুর ব্যাপারে আলোচনা করতে লাগলাম।
কাকাবাবু বললেন, ” এখন বুঝতে পারছি সলিল, লোকটার কেন এখানে আসতে দেরী হচ্ছিল”।
আমি কাকাবাবুর মুখের পানে তাকাতেই তিনি আবার বললেন, ” সম্ভবত লোকটা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল যে তার পেছনে শত্রু লেগেছে। তাই যে সময়ে সে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার থেকে একটু দেরী করে আসবে, এই-ই স্থির করেছিল। কিন্তু এমনই তার ভাগ্য যে তার এত চেষ্টাও বিফলে গেল। আমার বাড়ির কাছে আসামাত্র বেচারাকে প্রাণ দিতে হলো!”
এই সমস্ত ব্যাপার দেখে ও কাকাবাবুর কথা শুনে আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এই গভীর রাতে কেনই বা এই গো-বেচারা লোকটি বিষাক্ত তীরের আঘাতে জীবন খোয়াল, আর কেনই বা অন্য লোক তার অনুসরণ করছিল?
তবে কি লোকটা চোর ছিল? তাহলে তাকে পুলিশে কেন দেওয়া হলো না? হত্যা করার কি দরকার ছিল?
অসম্ভব সব কল্পনা আমার মাথায় চেপে বসতে লাগল। এই বীভৎস হত্যালীলার কোনও সূত্র আবিষ্কার করতে না পেরে মনে মনে দুঃখিত হলাম।
হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কাকাবাবু বলে উঠলেন, ” যাই হোক সলিল, আমার বরাত নেহাত ভাল, তাই ঠিক সময়েই লোকটার কাছে পৌঁছেছিলাম। নইলে আমার হাতে আর মূর্তিটা আসত না। ভাগ্যিস, বুদ্ধি করে সেইসময় ওর পকেট থেকে মূর্তিটা বের করে নিয়েছিলাম। জানো সলিল, আমার সন্দেহ হয়েছিল আগেই। লোকটাকে দেখামাত্র আমার মনে হয়েছিল যে, ওর পকেটেই হয়তো মূর্তিটা আছে। তাই ওর বডিটা বাড়ির মধ্যে আনার জন্য অত ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম”।
মূর্তি পাওয়ার আনন্দে কাকাবাবু অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলেন।
হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ” কিন্তু একটা বিষয়ে বড্ড সন্দেহ হচ্ছে, সলিল! সন্দেহটা কি জানো? বিপক্ষদলের কেউ একে খুন করে গেল বটে, কিন্তু কই, কেউ তো ওর পকেট হাতড়ে মূর্তিটা সরাবার চেষ্টা করল না! মূর্তিটাই যদি ওদের কাঙখিত জিনিস হয়ে থাকে, তবে সেটা ফেলে গেল কেন?”
এমন একটা সন্দেহ আমার মনেও হয়েছিল। কিন্তু তখনো তার জবাব খুঁজে পাইনি।
কাকা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ” মূর্তিটার পেছনে নিশ্চয়ই কোনও ইতিহাস আছে, সলিল! কিন্তু কি সেই ইতিহাস? ”
সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া টেবিল-ল্যাম্পটার নীচে মূর্তিটাকে রেখে, চেয়ারে হেলান দিয়ে কাকা একটা চুরুট টানতে লাগলেন। উজ্জ্বল আলোয় চুনিগুলো দপদপ করে আগুনের মতো জ্বলতে লাগল।
তাদের উজ্জ্বলতা এত তীব্র যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
কাকাবাবু মূর্তিটার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে চুরুট টানতে লাগলেন। লোকটার এই খুন হওয়ার ব্যাপারটা তাঁকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে সন্দেহ নেই।
…………………………………………………………………….
সেই রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না আমার। বার বার ঘুরেফিরে সেই অদ্ভুত মূর্তিটা আর লোকটার অদ্ভুতভাবে খুন হওয়ার ব্যাপারটাই আমার মনের মধ্যে ঘুরেফিরে বেড়াতে লাগল।
চিন্তা করতে করতে কখন একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; হঠাৎ একসময় অত্যন্ত গরম বোধ হওয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেল!
গভীর রাত।
খোলা জানলা দিয়ে রাতের আঁধার-মাখা আকাশের খানিকটা দেখা যাচ্ছিল। কিসের একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দ যেন কানে ভেসে এলো আমার!
কিসের শব্দ? – কান খাড়া করে রাখলাম!
সহসা জানলাটার দিকে চোখ পড়তেই আমার শরীরের সব রক্ত যেন জল হয়ে গেল!
দুটো আগুনের ভাটার মতো গোল গোল চোখ সেই অন্ধকারে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে!
শরীরের প্রতি লোমকূপ বেয়ে ভয়ের একটা স্রোত শিরশির করে নেমে গেল! আপনা থেকেই চোখের পাতাদুটো নেমে এলো।
ভয়ে আর আতঙ্কে মনে হলো, একসাথে হাজার কণ্ঠস্বর যেন আমার গলার কাছে ছুটে আসছে! কিন্তু বৃথাই। এতটুকু শব্দ গলা দিয়ে বেরোল না।
কে যেন দুহাতে আমার গলা টিপে ধরেছে……!
একজোড়া চোখ আমার চোখের সামনে আগুনের ভাঁটার মতো দপদপ করছে আঁধারে…….
চোখদুটো ধীরেধীরে জানলার ওপর দিকে উঠছে!আগন্তুক কে?
….. কে?
সেই রাতের আঁধারে এতক্ষণে অস্পষ্টভাবে মনে হলো, একটা প্রকাণ্ড ঝাঁকড়া চুলওয়ালা মাথা!
রাতের আঁধারে তার কুৎসিত বীভৎসতা যেন এক শ্মশানচারী প্রেতের মতোই ভীতি জন্মাচ্ছিল আমার মনে! ক্রমে-ক্রমে, চোখের সামনে সেই রাতের আঁধারে অস্পষ্ট ভাবে একটা প্রকাণ্ড মূর্তি ভেসে উঠল!
এত বিশাল দেহ কি কখনো মানুষের হতে পারে? – অসম্ভব!
মূর্তিটা ধীরেধীরে জানলা বেয়ে ঘরের মেঝেয় এসে দাঁড়াল…..ক্রমশ আমার খাটের সামনে…..আমার চোখের সামনে…..ভীষণ এক মূর্তিমান আতঙ্কের মতো!
সেই ভীষণ মূর্তি নিঃশব্দে, পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগোতে লাগল। দরজার খিলটায় সে সবেমাত্র হাত দিয়েছে, এমন সময় আঁধার রাতের অখণ্ড নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে গর্জে উঠল পিস্তল – গুড়ুম!
পরক্ষণেই সেই ভীষণ আগন্তুক এক লাফে জানলার কাছে এসে, চোখের পলকে রাত্রির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গে ওপাশের খাট থেকে লাফ দিয়ে, কাকাবাবুও জানলার কাছে ছুটে এলেন।
চিৎকার করে ডাকলেন, ” টাঙ্গা…..টাঙ্
গা….!”
আমিও ততক্ষণে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে জানলার কাছে ছুটে গেলাম।
জানলাটা মাটি থেকে প্রায় কুড়ি ফুট ওপরে। কাকা নীচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছিলেন অন্ধকারে।
অন্ধকারেই তিনি আরও গোটা দুই গুলি ছুঁড়লেন, তারপর দরজা খুলে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। সাথে সাথে আমিও গেলাম।
কাকার ডাকে ও রিভলবারের শব্দে টাঙ্গারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, একটা আলো হাতে সে’ও এসে জুটল।
যে জানলাটা দিয়ে সেই দানবের মতো জীবটা লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়েছিল, তার নীচে কাকাবাবুর ফল-ফুলের বাগান। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, জানলার ঠিক নীচেই, সেই জায়গাটায় ওপর থেকে কিছু ভারী জিনিস পড়ার চিহ্ন তখনো স্পষ্ট।
আগন্তুক তবে লাফিয়ে পড়েই অদৃশ্য হয়েছে!
আলো নিয়ে আমরা সমস্ত বাগানটা খুব ভাল করে খুঁজলাম; কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। যে এসেছিল, সে ওপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ার জন্য, নীচের মাটিটাকে একটু ধসিয়ে দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও চিহ্নই রেখে যায়নি। নীচের ঘরগুলো একবার ভাল করে দেখে আমরা ওপরতলায় ফিরে এলাম।
দেখা গেল, দরজার কাঠ খানিকটা ফুটো করে গুলি চলে গেছে। দানবটার গায়ে মোটেও লাগে নি।
কাকা বললেন, ” অন্ধকারে তাগটা ঠিকমতো হয়নি, তাই বেঁচে গেল!”
তারপর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ” তুমিও বুঝি টের পেয়েছিলে?”
আমি তখন তাঁকে আগাগোড়া সবকিছু খুলে বললাম।
কাকা বললেন, ” দেখ সলিল, আজ ১৫/১৬ বছর এখানে আছি, আমার বাড়িতে একটা চোরের উপদ্রব পর্যন্ত হয়নি। কাজেই আজকের এই ব্যাপারটা বড়ই ঘোরালো মনে হচ্ছে”।
কাকা নিশ্চয়ই আশা করেছিলেন যে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলব। কিন্তু আমি আর কি বলব? পুরো ব্যাপারটা আমায় আগাগোড়া এত বিস্মিত করেছিল যে আমার আর কিছু বলতে ভাল লাগছিল না। প্রথম থেকে পুরো ঘটনাগুলো একের পর এক যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল আমার কাছে। প্রথমত – কালো পাথরের সেই অদ্ভুত মূর্তি….দ্বিতীয়ত-ঐ লোকটার অমন অতর্কিতভাবে প্রকাশ্য রাজপথে খুন হয়ে যাওয়া…..তৃতীয়ত – রাতের আঁধারে ওই দানবের আবির্ভাব!
বিচ্ছিন্ন এই ঘটনাগুলো আমার নিদ্রাহীন চোখের কোল জুড়ে ভেসে বেড়াতে লাগল। বাকি রাতটুকুতে আর ঘুমই এল না। চেয়ারে বসে বসেই রাত কেটে গেল। একসময় রাতের আকাশ ভোরের আলোর ছোঁয়া লেগে ফিকে হলো।
আমি মুখ-হাত ধুয়ে চায়ের টেবিলে এসে বসলাম, খানিক পরে কাকাবাবুও আমার পাশে এসে আর একখানা চেয়ার দখল করলেন।
টাঙ্গা চা দিয়ে গেল – আমরা চা পানে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
এইসময় খবরের কাগজওয়ালা এসে একখানা কাগজ দিয়ে যেতেই আমি কাগজখানা টেনে নিলাম।
দেখলাম , গত রাতের ঘটনাটা বেরিয়েছে, সেইসঙ্গে একটু সম্পাদকীয় মন্তব্য।
দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মতো সুন্দর ভাবে সাজিয়ে লেখা সংবাদটি :
বিষের তীরে! বিষের তীরে! বিষের তীরে!!!
গতকাল রাত্রে প্রকাশ্য রাজপথে এক পথিক অতর্কিতভাবে হঠাৎ বিষের তীরের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে। এরূপ মৃত্যু সংবাদে শহরবাসী বিচলিত হয়েছে। পুলিশ রিপোর্টে জানা গেছে – প্রায় আট দশ বছর আগে এই শহরে একজন ইংরেজ ভ্রমণকারী ও তাঁর দুই সহকারী এমনি আকস্মিকভাবে বিষের তীরে প্রাণ দেন। সেইসময়েও এই শহরে এই নিয়ে যথেষ্ট চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল, আবার এতদিন পর কোথা থেকে সেই বিষের তীরের আগমন হলো!
কে বা কারা যে এইভাবে বিষাক্ত তীরের সাহায্যে সবার অলক্ষ্যে প্রকাশ্য রাজপথে এই ভীষণ হত্যালীলা করে বেড়ায়, সে বিষয়ে পুলিশ একটু ভাল করে তদন্ত করে দেখলেই ভাল হয়।
সংবাদটা আমি কাকা’কে আগাগোড়া পড়ে শোনালাম।
কাকা তাঁর চা-পান শেষ করে কাগজটা নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে চলে গেলেন।
পাথরের দেবতার ইতিহাস
সারাদিন আর সেদিন কাকার দেখা পাওয়া গেল না। সেই যে সকালবেলা তিনি লাইব্রেরী ঘরে ঢুকলেন, তারপর বেরোলেন সেই রাত্রি নয়টার সময়। মাঝখানে শুধু টাঙ্গা গিয়ে এক কাপ কফি দিয়ে এসেছিল।
অন্ধকারে চুপটি করে বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে বসেছিলাম। পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখি, কাকা এদিকেই আসছেন।
কাছে এসে বললেন, ” সলিল! সবটা না হলেও ব্যাপার অনেকটা তরল হয়ে এসেছে। মূর্তিটার ইতিহাস কিছু কিছু জেনেছি। আর ঐ গতকালের খুন এবং বিষের তীরের ব্যাপারটাও অনেকটা বোধহয় পরিষ্কার হয়ে এসেছে ” – বলতে বলতে কাকা আমার সামনেই একটা চেয়ারে বসে চুরুট টানতে লাগলেন।
কাকা বলতে লাগলেন, ” প্রায় আট-দশ বছর আগে বিখ্যাত ইংরেজ পর্যটক মিঃ ওয়াল্টার, বর্মা দেশের উত্তর -পশ্চিম কোণে তাঁর দুজন অনুচর নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে এক অরণ্য পরিবেষ্টিত দুর্গম দেশে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে ‘ থুয়া’ সম্প্রদায় নামে একদল আদিম অধিবাসী থাকে। হ্যাঁ, primitive tribe! হয়তো তারা কোচিনদেরই একটা শাখা হবে। ঐ পাথরের মূর্তিটা হচ্ছে ঐ সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতার প্রতিমূর্তি! ঐ মূর্তির গঠনগত কারুকৌশলে মুগ্ধ হয়ে ওয়াল্টার সাহেব কৌশলে মূর্তিটা চুরি করে নিয়ে পালিয়ে আসেন। কিন্তু দেশে ফেরার পথে এই শহরেই তাদের হাতে…..অর্থাৎ ঐ ‘ থুয়া’ সম্প্রদায়ের হাতে প্রাণ দেন।
আমার মনে হয়, ওই ‘ থুয়া’ সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন জানতে পারল, যে তাদের দেবতা চুরি গেছে, তারা তক্ষুনি অনুসন্ধান করতে শুরু করে, এবং ওই ইংরেজকে সন্দেহ করে তাঁর অনুসরণ করে এসে তাঁকে খুন করে! কিন্তু মূর্তিটা বোধহয় তারা হাত করতে পারেনি, কিংবা কোনও কারণে সক্ষম হয়নি। এইটুকুই তাঁর ডায়েরী থেকে পুলিশ যা পেয়েছিল, তাই-ই কাগজে তুলে দিয়েছিল।
হ্যাঁ, ভাল কথা – সেই ওয়াল্টার সাহেবের একটা এইদেশীয়, অর্থাৎ কোচিন চাকর ছিল। ওয়াল্টার খুন হবার পর সেই চাকরটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে নাকি ওয়াল্টারের জিনিসপত্র নিয়ে কোথায় পালিয়ে যায়!
গতকাল যে লোকটা খুন হয়েছে, সে আর কেউ নয় সলিল, সে ছিল ওয়াল্টার সাহেবের সেই কোচিন দেশীয় ভৃত্য! এতদিন সে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু সে বেচারাও এতদিন পর সেই ‘ থুয়া’ সম্প্রদায়ের হাতেই শেষটায় প্রাণ দিলে। কেননা, ‘ থুয়া’রা আজও তাদের দেবতাকে উদ্ধারের জন্য ছায়ার মতো সর্বত্র খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার মনে হয় যতদিন না তারা তাদের দেবতাকে হাতের মুঠোর মধ্যে পাচ্ছে, ততদিন এমনি করে সর্বত্র ঘুরে বেড়াবে এবং তার জন্য যত রকমের নিষ্ঠুরতাই করতে হোক না কেন, তারা পিছপা হবে না কখনওই।”
একটু থেমে কাকাবাবু ফের বলতে লাগলেন, ” ওয়াল্টারের ডায়েরী থেকে জানা গেছে, ঐ দেশে নাকি আরও অদ্ভুত অদ্ভুত সব মূর্তি আছে এবং তাদের গঠনশৈলীও অসাধারণ! এবং প্রত্যেকটা মূর্তিকেই তারা দেবতাজ্ঞানে পূজো করে থাকে। কিন্তু ওয়াল্টার সাহেব বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি বলে শুধু ওই একটি মূর্তি ছাড়া আর কোনও মূর্তি আনতে পারেননি”, বলতে বলতে কাকাবাবু পকেট থেকে মূর্তিটা বের করলেন।
ইতিমধ্যে টাঙ্গা একটা আলো জ্বালিয়ে টিপয়ের ওপর রেখে গিয়েছিল। কাকা মূর্তিটা টেবিলের ওপর রাখলেন। উজ্জ্বল আলোয় মূর্তিটার গায়ের চুনিগুলো থেকে উজ্জ্বল আলোর ছটা বেরোতে লাগল।
কাকা বললেন, ” দেখো সলিল, এই মূর্তিটা পরীক্ষা করে আমার আরও একটি বিষয়ের সমাধান হয়ে গেছে। ওই কোচিন দেশীয় চাকরটাকে যারা খুন করে গেল, তারা ওর পকেট হাতড়ে মূর্তিটা কেন নিয়ে গেল না, এ ব্যাপারে একটা মস্ত খটকা আমায় বড্ড বেশী ভাবিয়ে তুলেছিল। মূর্তিটা হাত করাই তো তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল! তাহলে সেরকম কোনও চেষ্টা তারা করল না কেন, এতক্ষণ আমি এই প্রশ্নের কোনও মীমাংসা করতে পারিনি। কিন্তু এখন তা-ও পরিষ্কার হয়ে গেছে”।
” কি হলো তার মীমাংসা? ” সাগ্রহে প্রশ্ন করলাম কাকাকে।
কাকাবাবু বললেন, ” শোনো তবে। এই মূর্তিটার তলায় একখানা কাগজে একটা ঠিকানা লেখা ছিল। আমার ধারণা হল, এ সেই মৃত লোকটার ঠিকানা ; কাজেই তখনি একটা লোক পাঠিয়ে আমি ঐ ঠিকানায় সবকিছু জানতে চেষ্টা করলাম। তা সেই লোকটা ফিরে এসে বলল, ঐ ঠিকানায় একটা কোচিন দেশীয় লোক ছিল বটে কিন্তু গত সন্ধের পর থেকে সে নিখোঁজ!
শুধু তাই নয় সলিল, লোকটা যখন খুন হয়, তার পরেই নাকি কয়েকটা অতি কদাকার মানুষ হঠাৎ তার ঘরে এসে হামলা চালিয়ে যায়। কিছু যেন তারা খুঁজতে এসেছিল; কিন্তু না পাওয়ায় ঘরের জিনিসপত্রের ওপরেই তাদের গায়ের ঝাল মিটিয়ে গেছে।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে, খুনী’রা ওই লোকটার ঠিকানা জেনে গিয়েছিল; কিন্তু লোকটা জীবিত থাকতে তো আর তার কাছ থেকে মূর্তিটা উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। তাই আগে শত্রুটাকে নিকেশ করে তারপর তার ডেরায় হানা দিয়েছিল মূর্তিটা উদ্ধার করতে। কিন্তু বেচারাদের সমস্ত পরিশ্রমই পণ্ডশ্রম হলো। তারা জানত না যে, যখন তারা লোকটাকে খুন করে তখন লোকটার কাছেই ছিল মূর্তিটা। ”
একটানা বলার পর থামলেন কাকাবাবু। তাঁর মুখে একটা বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু আমার তা মোটেও ভাল লাগল না। আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। একটা আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় আমি শিউরে উঠলাম।
আমি বললাম, ” কিন্তু কাকাবাবু, এখন তো তারমানে আমরা নিজেরাই বিপদাপন্ন। ওই লোকগুলো যখন দেখল যে শিকারকে বাগে পেয়ে হত্যা করেও মূর্তিটা পাওয়া গেল না, তখন নিশ্চয়ই তারা আর চুপ করে বসে নেই। লোকটার বডিটাকে আমাদের বাড়িতে আনা হয়েছিল, সেখান থেকেই মর্গে গেল – নিশ্চয়ই তারা জানতে পেরেছে। তাই আমার মনে হচ্ছে, এখন তাদের পুরো সন্দেহ আমাদের ওপর। আর সেজন্যই গতকাল কেউ এসেছিল আমাদের ঘরে মূর্তিটার খোঁজে…..। এখন কোনওরকমে ওরা যদি মূর্তিটা পেয়ে যায়, তাহলে আমাদের বিপদ কেটে যাবে ; কিন্তু যদি ওরা জানতে পারে, যে মূর্তিটা আমাদের কাছেই আছে আর আমরা তা ফেরত দিচ্ছি না, তাহলে জেনে রাখো কাকা, আমরা এখন কেউই নিরাপদ নই। একথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি”।
কাকাবাবু একটু কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ” তোমার অনুমান হয়তো ঠিক।ওদেরই কেউ হয়তো গত রাতে মূর্তিটার খোঁজেই আমাদের বাড়ি হানা দিয়েছিল, হয়তো আবারও আসবে। এমনকি ভয়ানক কোনও বিপদের সম্মুখীন হওয়াও আমাদের পক্ষে এখন আর অসম্ভব নয়; কিন্তু তাই বলে কি ঘরদোর বন্ধ করে কাপুরুষের মতো জীবন কাটাব? সে আমার ধাতে সহ্য হবে না সলিল, আর তা আমি করবও না…..!”
একটু থেমে ফের তিনি বললেন, ” আমি কি করেছি জানো? আমি ওয়াল্টার সাহেবের ডায়েরী থেকে বর্ণনা অনুযায়ী একটা রাস্তার মানচিত্র এঁকে ফেলেছি…..এই দেখো “, বলতে বলতে তিনি পকেট থেকে একটা পেন্সিলে আঁকা মানচিত্র বের করে হাতের ওপর মেলে ধরলেন এবং বললেন, ” এই মূর্তির গায়ে যে চুনি দেখছ, এত বড় আকারের চুনি পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ! এই চুনির খোঁজ করতে আমি সেই দেশে যাব যেখানে ওয়াল্টার সাহেব গিয়েছিলেন…..তা সে যত দূরদেশই হোক না কেন আর যত বিপদসঙ্কুলই হোক না কেন!”
কাকাবাবুর এই কথায় আমার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল। কাকা যে খেয়ালী তা জানতাম কিন্তু সে যে এমন অদ্ভুত, তা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। একটা লোক যে শুধু শুধু নিজের মৃত্যুকে কাছে ডেকে নিয়ে আসতে পারে, এ কথা আমায় কেউ বললেও বিশ্বাস করতাম না”।
কাকা বললেন, ” আমি আর দু-একদিনের মধ্যেই সেই অজানা দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব ঠিক করেছি; তুমি এর পরের মেলেই কলকাতা ফিরে যেও। তবে যে-কটা দিন আমরা এখানে আছি, একটু সাবধানে থাকতে হবে। ওরা ওদের দেবতাকে উদ্ধারের সবরকম চেষ্টা করবে”।
এমন সময় টাঙ্গা এসে বলল, ” টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে”।
রাত তখন অনেক হয়েছিল, বোধহয় এগারোটা কি বারোটা। আমরা উভয়েই চিন্তিত মনে খাবার ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।রাতের আঁধারে
নাঃ, ঘুম বোধহয় আর আসবে না!
গতরাতে অমন একটা ঘটনার পর আজ রাতে আমরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম। আজ রাতে আমিও একটা গুলিভরা পিস্তল মাথার কাছে নিয়ে শুয়েছিলাম। বলা যায় না, সেই দানব যদি আবার হামলা করতে আসে!
নানারকম দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় আমার চোখে ঘুম বলতে গেলে আর নেই-ই। কত কি ভাবছি….কোথায় কতদূরে আমার সেই বাংলাদেশ…. মা,বাবা,ভাই,বোন…..আর কোথায় আমি বর্মা মুলুকে প্রাণ হাতে করে রাতের প্রহর গুনছি।
হঠাৎ একটা ‘ খুট’ শব্দে আমার কান দুটো সজাগ হয়ে উঠল। মনে হলো শব্দটা যেন বন্ধ জানলাটার দিক থেকেই এল। চোখ-কান খাড়া করে আমি সেই অন্ধকারে তাকিয়ে রইলাম।
এবার মনে হলো, বাইরে থেকে কে যেন খড়খড়িটা খোলবার চেষ্টা করছে! একটা খসখস শব্দ! কোনও একটা রুক্ষ খসখসে জিনিস কাঠের ওপর দিয়ে ঘষটে টেনে নিয়ে গেলে যেমন শব্দ হবে, এ-ও অনেকটা সেরকম।
বালিশের পাশ থেকে রিভলভার ও টর্চটা বের করে, একহাতে রিভলভার ধরে অন্য হাতে টর্চটা টিপলাম।
টর্চের আলোটা জানলার বদ্ধ কপাটের ওপর গিয়ে পড়তেই ভয়ে আমার সর্বশরীর হিম হয়ে গেল। একটা কুৎসিত বলিষ্ঠ হাত খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ভেতরের জানলার ছিটকিনিটাই বোধহয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
চোখের পলকে হাতটা তাগ করে রিভলভার টিপলাম। রাত্রির অন্ধকারের বুকে পিস্তলের গর্জন ঝনঝন করে উঠল!
পিস্তলের আওয়াজের সাথে সাথেই সেই হাতখানি অদৃশ্য হয়ে গেল। কাকার ঘুমও ভেঙে গিয়েছিল। তিনি ” কি? কি?’ বলতে বলতে ওধারের খাট থেকে ছুটে এলেন।
উত্তেজনায় ও আতঙ্কে আমি তখনও হাঁফাচ্ছিলাম।
কাকা আলোটা জ্বেলে বললেন, ” কি সলিল? ব্যাপার কি?”
…..” আজও! আজও সে এসেছিল কাকা!”
…..” কে? কে?”
…….” গত রাতে যে এসেছিল! ”
বালিশের তলা থেকে পিস্তলটা নিয়ে কাকা তক্ষুনি ছুটছিলেন, আমি তাঁকে বাধা দিয়ে বললাম, ” কোথায় যাচ্ছেন? সে কি আর এতক্ষণে আছে?”
আমার কথায় কাকা ফিরে এলেন।
…..” তাইতো সলিল! কিন্তু একবার দেখলে হতো না?”
….” না, তার দরকার নেই! কিন্তু একটা কথা আমার মনে হচ্ছে , ওদের জিনিস ওদের কাছে ফিরিয়ে দিলেই বোধহয় ভাল হবে”।
…..” তুমি কি বলছ, সলিল? এমন মূল্যবান জিনিস হাতে পেয়ে কেউ ছেড়ে দেয়? এই মূর্তি যে দেশ থেকে পাওয়া গেছে, সেখানে খোঁজ করলে হয়তো আরও কত না জানি বহুমূল্য সব জিনিস দেখতে পাব! এমন সব বিশাল এবং অমূল্য চুনি দেখতে পাওয়া যাবে, তা সভ্য জগতে নিয়ে এসে দেখালে একেবারে হুলুস্থুল পড়ে যাবে! আমাকে সে দেশে যেতেই হবে সলিল!”
একটু থেমে তিনি বললেন, ” ওয়াল্টার ক্রমাগত তিন-চার মাস ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেই দেশের সন্ধান পেয়েছিলেন; কেননা তিনি সেই দেশটার সন্ধান আগে থেকে জানতেন না, তাই তাঁর অত দেরী হয়েছিল; কিন্তু আমার তো তা হবে না। আমি তাঁর চাইতে ঢের কম সময়েই সেই দেশে পৌঁছে যাব। তখন……. ”
বাধা দিয়ে আমি এবার বললাম, ” কিন্তু আপনি কি মনে করেন, ওয়াল্টার সেখানে গিয়ে যে ব্যবহারটা করে এসেছেন, এর পরও আর কোনও বিদেশীকে ‘থুয়া’রা তাদের প্রাণ থাকতে সে-দেশে পা দিতে দেবে? যারা দশ বছর ধরে এমনি ছায়ার মতো একটা মূর্তির পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়াতে পারে এবং লোকের চোখের সামনে এমনি নৃশংসভাবে হত্যালীলা চালাতে পারে, তারা কি খুব সহজ জাত?”
আমার কথায় কাকা এবার বেশ একটু চিন্তিত হয়ে গেলেন। বললেন , ” কথাটা নেহাত মন্দ বলো নি সলিল! আমায় ভাবতে দাও”।
কাকা ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন।
নকল মূর্তি
পরদিন সকালে কাকা আমায় ডেকে বললেন, ” উপায় একটা হয়েছে সলিল!”
…..” কি?”
…..” ঠিক ওইরকম দেখতে আরেকটা মূর্তি তৈরি করে আনব। আমি একটু বেরোচ্ছি, তুমি সাবধানে থেকো। আমি ফিরে এসে তোমার কলকাতায় ফেরার বন্দোবস্ত করে ফেলব। কারণ, পাঁচ ছ’দিনের মধ্যেই আমি যাত্রা করব”।
বলে ব্যস্ত পায়ে কাকা বেরিয়ে গেলেন।
নাঃ, কাকা লোকটা বড্ড একরোখা…… যা ধরবেন তিনি তা করবেনই।
ছেলেবেলা থেকেই বারবেল ও মুগুর ভেঁজে শরীরটা আমার নেহাত ভেতো বাঙালীর মতো ছিল না। দুটো চারটে ঘুঁষি দেবার ক্ষমতা যেমনি ছিল, তেমনি খেতেও পারতাম ঘুঁষি দু-চারটে।
দুঃসাহসিক কাজ করতে আমার মন্দ লাগত না। এতে এমন একটা মাদকতা আছে যে মনের ভেতর কেমন একরকম আনন্দের নেশা জাগিয়ে তোলে।
একটা অনিশ্চিত ভয় ও ভাবনার দোলায় মনটা দুলতে লাগল। মনে মনে শেষমেশ ঠিক করলাম, যা থাকে কপালে, কাকার সঙ্গে আমায় যেতেই হবে।
কিন্তু কাকা কি সঙ্গে নিতে চাইবেন? দেখা যাক!
দুপুরের দিকেই কাকা ফিরলেন। বললেন, ” অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। কালকের মধ্যেই মূর্তিটা তৈরি হয়ে যাবে বলেছে! আজকের রাতটা….তা এমন কিছু ভয়ের কারণ আজ রাতে আর নেই! আজ ওরা বিশ্রাম করতেও পারে!”
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেখলাম, সমস্ত বাড়িটার মধ্যে যেন একটা দানব তাণ্ডব করে গেছে! সবচেয়ে বেশী আক্রোশ যেন কাকার লাইব্রেরি ঘরটার ওপর। ঘরের সব জিনিস, বইপত্র লণ্ডভণ্ড।
সব দেখে কাকা হাসতে হাসতে বললেন, ” থাক, আগামীকাল আর বেচারাদের হতাশ হতে হবে না”।
সন্ধের দিকে কাকা আমায় তাঁর লাইব্রেরি ঘরটায় ডেকে পাঠালেন।
……” দেখো দেখি সলিল, এর মধ্যে কোনটা আসল মূর্তি?”
দেখলাম, ঠিক একইরকম দেখতে দুটো মূর্তি সামনে টেবিলের ওপর বসানো। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও আমি মূর্তি দুটোর ভেতর এতটুকু প্রভেদ বের করতে পারলাম না।
কাকা হাসতে লাগলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, ” এরকম একই দেখতে মূর্তি কি করে বানালেন?”
…..” নকল! নকল! আগাগোড়াই নকল, মায় ঐ মূর্তি থেকে চুনিগুলো – সব নকল! তবে এতখানি ঠকাবার ইচ্ছে আমার ছিল না। আমার লক্ষ্য তো ওদের দেবতার মুর্তিটা নয়, আমার লক্ষ্য চুনি। কিন্তু চুনিগুলো কিছুতেই মূর্তিটা থেকে তোলা গেল না, কি করব! নইলে চুনিগুলো মূর্তির গা থেকে খুলে নিয়ে ওদের আসল মূর্তিটা অন্তত ফিরিয়ে দিতাম”।
কাকার চাল ঠিক খেটে গেল। গভীর রাত্রে আমাদের অজান্তেই নকল মূর্তিটা অপহৃত হয়ে গেল!
কাকা হাসতে হাসতে বললেন, ” কিন্তু মনে হয় না বেশীদিন এই ফাঁকি গোপন থাকবে। ওরা যে মূহুর্তে জানতে পারবে, ওটা ওদের দেবতার আসল মূর্তি নয়, একটা মিথ্যে মূর্তি নিয়ে এসেছে, তখনিই ওরা আবার ছুটে আসবে। তবে খুব শিগগীর এই ফাঁকি ধরতে পারবে বলে মনে হয় না……যাই হোক, এখন কিছুদিনের জন্য আমরা নিশ্চিন্ত। এর মধ্যে যতটা সম্ভব আমি কাজ এগিয়ে নেব। দেখা যাক, বুদ্ধির যুদ্ধে কাদের হার আর কাদের জিত হয়!”
কাকা যখন শুনলেন , আমিও তাঁর অভিযানের সঙ্গী হতে চাই, তখন তিনি বেশ খুশিই হলেন। বললেন, ” বেশ তো সলিল, চলো না! দেখো, সেখানে গিয়ে তুমি ঠকবে না”…. কিন্তু পরক্ষণেই আবার বললেন, ” কিন্তু এ ব্যাপারে প্রতি পদে পদে বিপদ। এভাবে দাদাকে না জানিয়ে……….”
কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছের কাছে কাকার কোনও আপত্তিই ধোপে টিকল না। প্রবল স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল সব। আমিও কাকার সঙ্গে যাব, এটাই ঠিক হলো।
অচেনা পথে
যাত্রার অত্যাবশ্যকীয় যোগাড়যন্ত্র করতে করতে কোথা দিয়ে যে ক’টা দিন কেটে গেল, তা খেয়ালই করলাম না।
হ্যাঁ, এ-কটা দিন আমাদের নির্বিবাদেই কেটে গেল। ঐ দেশীয় পথঘাট চেনে, এমন একজন সুদক্ষ লোক যোগাড় করা হয়েছিল, দশ পনেরো জন ঐদেশীয় কুলি, টাঙ্গা, কাকা ও আমি – এই ক’জনকে নিয়ে ছোটখাটো দলটা গড়ে নেওয়া হলো। গোটাছয়েক দু’নলা বন্দুক, যথেষ্ট পরিমাণ গুলি, এছাড়া প্রত্যেকের কাছে একখানা ছোরা, একটা টর্চ ও একটা করে রিভলভার দেওয়া হয়েছিল, অবশ্য কুলীদের হাতে কোনও অস্ত্র দেওয়া হয়নি।
একদিন শেষ রাতে যখন রাতের আকাশটা সবে ভোরের আলোর ইশারায় সাড়া দিতে শুরু করেছে, তখন আমরা সেই অচিন দেশের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
গাড়ি চলা যতদূর সম্ভব ছিল, ততদূর পর্যন্ত গিয়ে আমরা হাঁটাপথ ধরলাম।
পথ ক্রমে দুর্গম হতে আরম্ভ করল। চারদিনের দিন আমরা এক গভীর বনের মধ্যে এসে পড়লাম।
এত গভীর বন যে, দিনের বেলাতেও ভালো করে দৃষ্টি চলে না। ঘন সন্নিবিষ্ট গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দিয়ে সূর্যের দু একটা রশ্মি উঁকি মারছিল।
দিনের বেলাতেই মৃত্যুর মতো এক অখণ্ড স্তব্ধতা!
এ যেন কোন এক নিঝুমের দেশ! পৃথিবীর সকল গুঞ্জন -কলরব যেন সহসা এখানে এসে পথ হারিয়ে মৌন হয়ে গেছে! যেদিকে চোখ যায়, শুধু ছোটবড় নানারকম গাছ আর লতা-পাতা!
সেই বনের মধ্য দিয়ে অতি সঙ্কীর্ণ পথ….যেমন দুর্গম, তেমনি অপরিসর! একবারের বেশী চলা একেবারেই অসম্ভব। আমাদের পথ-প্রদর্শনকারী আগে-আগে, আর আমরা এক লাইন বেঁধে তার পিছু পিছু।
জায়গায় জায়গায় বন এত ঘন হয়ে এসেছে যে পথ চলা রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠল!
সন্ধের দিকে বনের একটা জায়গায় এসে আমরা তাঁবু খাটালাম।
সারাদিন চলে চলে বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল, কোথাও শুয়ে খানিকটা জিরোতে পারলে বুঝি বা এ অবসাদ, এ ক্লান্তি কমবে!
টাঙ্গা টিনের কাপে করে কফি এনে দিল। গরম গরম কফিতে চুমুক দিতেই প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল!
সকলেই খুব শ্রান্ত; খাওয়া দাওয়ার পর জনা দুই কুলিকে আগুনের কাছে পাহারায় বসিয়ে বাকি সবাই ঘুমোতে গেলাম।
পরের দিন ঘুম ভাঙল কাকার ডাকে –
….” সলিল, ওঠো! ওঠো! ”
কিছু খেয়েদেয়ে আবার সবাই গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
এমনি করে ক্রমাগত চলতে চলতে আমরা এক বিশাল অরণ্যের মাঝে এসে পড়লাম। সামনে এক প্রকাণ্ড পাহাড়।
কাকা বললেন, ” আর আমাদের গন্তব্যস্থান খুব বেশীদূর নয়। আর হয়তো দু-চারদিনের মধ্যেই মিঃ ওয়াল্টার বর্ণিত সেই চুনির দেশে গিয়ে পৌঁছবো। আমার মনে হয়, ব্যাটারা বোধহয় এখনো আমার ফাঁকি ধরতে পারেনি। যাক, বাকি পথটুকুও তাহলে আমরা নির্বিঘ্নেই অতিক্রম করতে পারব।”
সারাদিন পথ চলার পর সন্ধের দিকে আবার এক জায়গায় তাঁবু খাটালাম।
আর ওদিকে রাতের ঘন কালো অন্ধকার, চাঁদের পর্দা টেনে, নির্জন নিস্তব্ধ বনভূমির পাতায়-পাতায়, শাখায়-শাখায় পায়ে পায়ে নেমে আসতে লাগল।
মানুষ চুরি
গভীর রাত্রি।
নিশুতি রাতের গম্ভীর আবহাওয়াটাকে দীর্ণবিদীর্ণ করে কোথায় একটা বন্যপশু বারে বারে হাঁক দিচ্ছিল! ঝিঁঝির একঘেয়ে বিশ্রী গোঙানির আর বিরাম নেই।
মাঝেমাঝে সরসর করে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কাদের যেন চলাচলের ইশারা পাওয়া যাচ্ছিল! হঠাৎ আমাদের তাঁবুর কাছে বাইরে একটা ভারী পায়ের শব্দ ধীরেধীরে এসে থেমে গেল!
কান পেতে শব্দটাকে আরও ভাল করে শোনবার জন্য পড়ে রইলাম।।সহসা একটা তীক্ষ্ণ শিস কানে ভেসে এলো।
নিঃশব্দে মাথার তলা থেকে টর্চটা নিয়ে বাঁ হাতে রিভলভারটা ধরে পা টিপে টিপে তাঁবুর দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম।
বাইরের আগুনটা প্রায় নিবু নিবু হয়ে এসেছে। সেই নিভন্ত আগুনের ভেতর থেকে একটা রক্তাভ আগুনের তীক্ষ্ণ আভা চতুর্দিকে বনভূমির মাঝেমাঝে লাল কালো আলো আঁধারের পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে!
যে কুলিটাকে প্রহরী করে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, তাকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না!
কাঠের টুলটা শূন্য! বন্দুকটা পাশেই পড়ে!
সহসা সেই আবছা আলো আঁধারে সামনের বনের দিকে নজর পড়তেই আমার শরীরের সমস্ত রক্তবিন্দু একসাথে তরতর করে শরীরের প্রতি শিরা উপশিরা দিয়ে বয়ে গেল!
একজোড়া আগুনের মতো বড় বড় চোখ, ক্ষুধার্তের মতো সামনের দিকে চেয়ে আছে!
তার পাশেই কুৎসিত দর্শন বীভৎস একটা লোক – মাথায় তার পালক চড়ানো টুপি। আবছা আলো আঁধারে তার মাথার পালকগুলো যেন তীক্ষ্ণ সঙিনের ডগার মতো ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল।
লোকটা দুর্বোধ্য ভাষায় একবার গর্জন করে কি যেন বলল, পরক্ষণেই শন শন করে একটা তীর আমাদের তাঁবুর দিকে ছুটে এলো!
তারপর?
তারপর মূহুর্তের মধ্যে সেই চোখদুটো পাতার আড়ালে লুকিয়ে গেল একটা বিভীষিকা জাগিয়ে রেখে।
প্রথমটা আমি খুবই হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে খুবই অল্পক্ষণের জন্য! তারপর তীরটা কুড়িয়ে নিলাম। দেখি, তার ডগায় কি একখানা চিঠি জুড়ে দেওয়া!
চিঠি? – চমকে গেলাম।
তখনই তাড়াতাড়ি খুলে ফেললাম – কিন্তু একবর্ণ বুঝতে পারলাম না। এমনি সব গোল গোল হিজিবিজি লেখা!
এত কান্ড যে হয়ে গেছে, কাকা এর কিছুই জানতেন না; তিনি তখনো ঘুমিয়ে!
কিন্তু ঐ অসভ্য লোকটার গর্জনে আর আমার পায়ের খসখসানিতে বোধহয় তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তিনি তখনই সেখানে ছুটে এলেন।
…… ” কি? কি ব্যাপার সলিল?”
আমি তখন তাঁকে সংক্ষেপে ঘটনাগুলো বলে, চিঠিখানা তাঁর হাতে দিলাম।
চিঠিখানা পড়তে পড়তে তাঁর সারা মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ” কি হয়েছে কাকাবাবু? আপনি ওটা পড়তে পারছেন?”
চিঠিখানার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তিনি বললেন, ” হ্যাঁ, পড়তে পারছি বৈকি! এই চিঠি….বর্মী ভাষায় লেখা।
এতে আমাদের শাসানো হয়েছে সলিল! আমি চিঠির সবটা তোমায় বাংলায় তর্জমা করে বলছি। এতে লেখা আছে :
‘ ওরে বোকা বাঙালি!
ভালো চাস তো এখনো আমাদের দেবমূর্তি ফিরিয়ে দে। নইলে তোদের সর্বনাশ করে ছাড়বো! আজ নিয়ে গেলাম তোদের একটা সেপাইকে। এমনি করে দলের সব ক’টাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলব। তোদেরও প্রাণ নিয়ে ফিরতে হবে না!
যদি বাঁচতে চাস, কালই আমাদের দেবতাকে ফিরিয়ে দিবি! তাঁবুর বাইরে শালগাছটার গোড়ায় রেখে দিস। নইলে……বুঝলি তো?’
– রংমু সর্দার”
আমাদের দলের মধ্যে একজনকে এমনি করে সহসা অপসৃত হতে দেখে, সকলেই যেন একটু বিষন্ন ও শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল।
সারাদিন এখানে সেখানে কুলি’টার খোঁজ করা হলো। তারপর সন্ধ্যা নামার আগে একটা প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে চারদিকে সবাই গোল হয়ে বসল। স্থির হলো, আজ রাতের পাহারা আরেকটু কড়া করে হবে।মুখোমুখি
সেরাতের পাহারাটা একটু বেশীই রকম কড়া করা হলো। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অদূরে ক্ষুধার্ত নেকড়ের হিংস্র ডাক কানে এসে বাজছিল। কোথায় একটা বন্য পোকা ট্রি ট্রি করে একটানা বিশ্রী শব্দ করছিল।
মাঝেমাঝে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কাদের যেন চলাফেরার খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
ঘুম কিছুতেই এলো না।
দু’চোখের পাতা এক করলেই নানারকম অদ্ভুত সব দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে লাগল।
শেষ রাতের দিকে বোধহয় একটু তন্দ্রা এসেছিল, একটা অস্পষ্ট কোলাহলে সেটাও ভেঙে গেল। ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসলাম।
কি ব্যাপার?
হন্তদন্ত হয়ে তাঁবুর বাইরে এসে শুনি , কুলিদের মধ্যে আরও একজনকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না! রাতের প্রথম দিকে পাহারা দিয়ে সে নাকি তাঁবুতেই ঘুমোতে গিয়েছিল।
কি আশ্চর্য! দু-দুটো জলজ্যান্ত কুলি এভাবে চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেল! আর তাদের কোথাও পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না!
কিন্তু প্রতি রাতে একজন একজন করে এভাবে যদি গায়েব হয়ে যেতে থাকে, তাহলে দু-একদিনের মধ্যেই যে ব্যাপারটা শক্ত হয়ে দাঁড়াবে, সন্দেহ নেই।
মনে মনে ঠিক করলাম, আজ দুপুরে আমি নিজেই একবার নিরুদ্দেশ লোকগুলোকে খুঁজতে বেরোব।
যাওয়া আমাদের সেদিনও স্থগিত রইল।
যাওয়া স্থগিত রইলো বটে, কিন্তু কাজ যে বেশীদূর এগোবে, তা-ও মনে হলো না! কারণ সত্যি বলতে কি আমার মনের ভেতর কেবলই উঁকি দিচ্ছিল রংমু সর্দারের সেই চিঠিখানা!
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পাহাড়টার তলায় এসে পড়েছিলাম। ওপর থেকে একটা ঝর্না কল-কল-ছল-ছল করে পাহাড়ের গা বেয়ে দুষ্টু মেয়ের মতোই লাফাতে লাফাতে নেমে আসছিল। ভাবলাম, পাহাড়ের তলদেশে আশেপাশে একটু খোঁজ করে দেখব।
সারাদিন হাঁটতে হাঁটতে বড়ই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
সঙ্গের ফ্লাস্ক থেকে খানিকটা জল ঢেলে খেতে যাব, সহসা পাহাড়ের ওপর দিকে নজর পড়তেই আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে এল।
একটা হলদে রঙের বিশ্রী, চ্যাপ্টা মুখ! আর তারই ঠিক চোখের তলা দিয়ে একখানা বিরাট পাথর – পাহাড়ের গা বেয়ে সশব্দে আমার দিকে ছুটে আসছে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কিন্তু পরমূহুর্তে আমার স্তব্ধভাব কাটিয়ে আমি একপাশে সরে যেতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে আর হয়ে উঠল না।
একখানা চলন্ত ইঞ্জিনের মতো পাথরখানা বিপুল শব্দে আমার দিকে গড়িয়ে এলো। হতবুদ্ধি আমি – প্রায় আড়ষ্ট ও স্তব্ধভাবে ওটার আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।
পাথরখানা তার উঁচুনিচু চলতি পথের আবর্তনে হঠাৎ একদিকে একটু ঘুরে গেল; তার সামান্য একটু ছোঁয়াতেই তার ভীষণতার সাড়া দিয়ে গেল। সেই সামান্য একটু ছোঁয়াতেই আমি ছিটকে পড়ে ভূমিসাৎ হলাম।
প্রথমটায় আমি ভয়ে, বিস্ময়ে, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তখনই স্পষ্ট অনুভব করলাম, একটা লোহার মতো শক্ত হাত – সাঁড়াশির মতো সজোরে আমার গলা টিপে ধরেছে!
হিমানীর মতো সেই কঠিন হাতের স্পর্শ যেমন শীতল, তেমনি ইস্পাতের মতোই কঠিন।
উহ, প্রাণটা বুঝি বেরিয়ে গেল!
প্রাণপণ চেষ্টায় হাতের বাঁধন শিথিল করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথা- বৃথাই আমার চেষ্টা।
সেই সাঁড়াশির মতো আঙুলগুলো ক্রমে আমার গলার ওপর চেপে বসতে লাগল।
আমি ক্ষুদ্র শিশুর মতোই নিস্তেজ এবং অসহায় অবস্থায় সেই মৃত্যুদানবের হাতে নিজেকে সঁপে দিলাম।
একজন পূর্ণবয়স্ক লোক যেমন একটা শিশুকে অক্লেশে মাথার ওপর তুলে নিতে পারে, সেই দানব সদৃশ লোকটাও আমাকে তার মাথার ওপর তুলে নিল!
স্পষ্টই বুঝলাম – দানবটা প্রকৃতই কোনও দানব। সেটা নিশ্চয়ই কোনও মানুষ নয়। গরিলা টাইপের প্রকাণ্ড লোমশ কোনও জীব। তার হাত দুখানা লোমশ এবং মোটা।
একবার তাকিয়ে দেখেছিলাম, গরিলাটার সঙ্গে একটা চ্যাপ্টামুখ হলদেটে কুশ্রী লোকও আছে – সম্ভবত সে-ই ওর মনিব।
নিজের অসহায় অবস্থা ভাল করেই বুঝে নিলাম! কে জানে আমার অদৃষ্টে কি আছে! আমি যে কোথায়, কিভাবে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছি, কেউ তা জানতেও পারবে না!
কেউ জানবে না কে আমায় নিয়ে গেল আর কোথায় নিয়ে গেল!
আমার আগে যে দুজন অপসৃত হয়েছে, তাদের যেমন একবার খোঁজাখুঁজি হয়েছিল, আমার বেলাতেও তাই হবে; তারপর – তারপর সব চুপ!
নিশীথে আবার হানা
গরিলাটা বা দানবটা আমায় কাঁধে করে যে পথ দিয়ে ছুটছিল, সেই পথটা যেমন দুর্গম তেমনি অন্ধকার।
একে রাত, তাও আবার বনজঙ্গল, ঝোপঝাড় ভেদ করে আমাদের চলার রাস্তা। কাজেই আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ।
দানব আর সেই লোকটা আমাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এসে একটা রাস্তার সংযোগে এসে খানিকক্ষণ দাঁড়াল। সেখানে দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। লোকটা খানিকক্ষণ কি ভেবে সেই দুটো রাস্তার একটিকে বেছে নিয়ে চলতে লাগল – দানবটাও তাকে অনুসরণ করল।
অন্ধকার! ভীষণ অন্ধকার! তবু আমার মনে হতে লাগল, এ পথের সবকিছুই আমার পরিচিত!
দূরে একটা আলো দেখা গেল। কাছে আসতেই বোঝা গেল, আলোটা একটা প্রকাণ্ড অগ্নিকুন্ড!
বনের মধ্যে অগ্নিকুন্ড! তবে কি?…….
হ্যাঁ, তাই-তো বটে। এ যে আমাদেরই তাঁবু।
দানব আর তার মনিব কি আমাদের তাঁবুর সামনে দিয়েই আমাকে নিয়ে যাচ্ছে? হয়তো তাদের গন্তব্যস্থানে যাবার এটাই একমাত্র পথ।
একটা গোপন আনন্দে তখনিই মনটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল আর সেইসঙ্গে জেগে উঠল একটা দুষ্ট মতলব।
তাঁবুর অগ্নিকুন্ডটা দেখা গেলেও তাঁবুটা তখনো খুব কাছে নয়। ওরা যতটা সম্ভব তাঁবুটাকে বাঁ-য়ে রেখে রাস্তা থেকে অনেকটা দূর দিয়ে আমায় নিয়ে দৌড়চ্ছিল।
যাই হোক, আমি আচমকা মরিয়া হয়ে, আমার দেহের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে চিৎকার করে উঠলাম –
” টাঙ্গা! টাঙ্গা! কাকাবাবু! মেরে ফেলল আমায়! ধরে নিয়ে গেল….!”
ঠিক সেইসময় তাঁবুর পাহারাওয়ালার বন্দুক গর্জে উঠল – গুড়ুম! গুড়ুম!
সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চিৎকার ভেসে এল – ” দাদাবাবু! দাদাবাবু! ”
টাঙ্গার গলা!
দানব আর লোকটা সহসা আমায় দড়াম করে কাঁধ থেকে ফেলে অন্ধকার বনপথে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল!
আবার শোনা গেল টাঙ্গার গলা – ” দাদাবাবু! দাদাবাবু…! ”
আমি আবারও চিৎকার করে উঠলাম – ” আমি এইখানে! এই যে….!”
এরপর খানিকক্ষণ কেবল মশাল নিয়ে বনের মধ্যে ছোটাছুটি! তারপর সবাই মিলে আমায় তাঁবুতে নিয়ে গেল।
খানিকটা সুস্থ হয়ে আমি টাঙ্গাকে জিজ্ঞেস করলাম, ” কাকাবাবু কই রে টাঙ্গা? তাঁকে তো দেখছি না! তিনি কি এখনো ঘুমোচ্ছেন?”
তাই তো! এতক্ষণ কাকাবাবুর দিকে কারোর হুঁশই ছিল না। তখনিই খোঁজ! খোঁজ! কিন্তু কোথায় কাকাবাবু?
কাকা তো নেই!
তিনি তাঁর তাঁবুতেই নেই!
কাকা’র তাঁবুর ভেতর গিয়ে দেখলাম, তাঁবুর একদিকটা একটা তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং সম্ভবত সেখান দিয়েই কাকা’কে চুরি করে নিয়ে গেছে।
তাঁর শূন্য শয্যাটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে; তাঁর জামাকাপড়, স্যুটকেস সবকিছু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। তাছাড়া, তাঁবুর আর প্রত্যেকটি জিনিস ঠিক যেমনটি ছিল, তেমনই আছে, নেই শুধু – কাকা।
হায়-হায়! অ্যাদ্দিনে তারা তাদের দেবতার কিনারা করল! এবার সত্যিই তারা মূর্তিটা পাবে।
দুঃখ ও বেদনায় সহসা আমার দু’চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এলো। সেই শূন্য তাঁবুর মাঝে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অশ্রুজলে আমার বুক ভেসে যেতে লাগল।
কিন্তু ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারলাম পরদিন সকালে।
এইভাবে পর-পর কয়েকজনের আকস্মিক অন্তর্ধানে কুলিদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য পড়ে গেছে।
আঁধারে ভূত দেখলে মানুষের যেরকম অবস্থা হয়, এদের অবস্থাও অনেকটা সেইরকম হলো। সকলের মধ্যেই একটা স্পষ্ট বিদ্রোহের ভাব।
বিকেলের দিকে তাঁবুর মধ্যে টাঙ্গাকে ডেকে এনে পরামর্শ করতে লাগলাম।
” কি করা যায়, টাঙ্গা?”
….” ওরা তো আর এক পা’ও এগোতে চাইছে না, দাদাবাবু! ”
…..” কিন্তু কাকা! কাকার সন্ধান না করে আমি তো ফিরব না টাঙ্গা!”
……” তোমার যেমন কাকা, আমারও তেমনি বারো-তেরো বছরের মনিব, বাবু! আমিই বা কোন মুখে একা ঘরে ফিরে যাব?”
টাঙ্গার দু’চোখে জল টলটল করতে লাগল, আমারও চোখের কোণ ভিজে উঠল। বললাম, ” ওরা ফিরে যেতে চায় যাক, টাঙ্গা! আমরা দুজনে কাকাকে খুঁজে বের করব। পৃথিবীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত যাব; যেখানে তাঁকে পাই, খুঁজে আনবই!”
অত:পর
প্রতিদিনকার মতো আজও আমাদের নিরানন্দ দলটির চোখের সামনে দিয়ে রাত্রির জমাট অন্ধকার পায়ে-পায়ে নেমে এলো!
পরপর তিন রাত্রে তিনজন অপহৃত হলো; না জানি আজ আবার কার পালা!
সকলের মনেই বেশ একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে!
না জানি আজ আবার কাকে যেতে হয়! কার যাবার সময় হলো! অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে তার চারপাশে সকলে গোল হয়ে বসে! কারও মুখেই একটি কথা নেই!
বোবা রাত্রির অন্ধকার ; বোবা আগুনের আলো আর তার মাঝে আমরাও বুঝি-বা বোবা হয়ে গেছি!
সে রাতে আর কারও চোখে ঘুম এলো না, এবং আমাদের চোখের সামনেই বিনিদ্র ভয়াবহ রাত্রির অবসান হলো। রাতের আঁধার কেটে গিয়ে ভোরের আলোয় বনভূমি আবার শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে উঠল।
মুখে যতই বলি না কেন, কাকাবাবুর খোঁজ করতে গেলে যে বিপদের সামনে দাঁড়াতে হবে, তা ভাবতেই ভয়ে আমার গা শিরশির করে উঠছে, সমস্ত লোমকূপ খাড়া হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু তাই বলে কাকাবাবুকে চিরকালের মতো হারিয়ে এই নির্জন অরণ্য থেকে আবার মা-বাবার কোলে ফিরে যাব – কাপুরুষের এত বড় নির্লজ্জ উদাহরণ দিতে মন সায় দিল না।
হয়তো কাকাবাবুর খোঁজ করতে গেলে আর জীবনেও মা-বাবার মুখ দেখতে পাবো না! হয়তো চিরদিনের মতো বাংলাদেশের মুখ দেখা আর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা হবার পথ বন্ধ হয়ে যাবে!
তা যাক! কিন্তু কাকাবাবুকে ফেলে যাওয়া অসম্ভব!
এইভাবে যতকিছু অমঙ্গল কল্পনা থাকতে পারে, এই নির্জন বনের মাঝে আমার ঘাড়ে তা ভূতের মতো চেপে বসতে লাগল।
এই নিশীথ রাত্রে অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার বনভূমিতে তাঁবুর মধ্যে টাঙ্গা ও আমি – দুজনে দুজনার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম।
কাকাবাবুর দুরদৃষ্ট
দানবটা কাকাবাবুর ঘুমন্ত শরীরটা কাঁধে ফেলে সেই নির্জন অরণ্যের মাঝ দিয়ে চলতে লাগল। যমদূতের মতোই সে তার ভারী ভারী পা ফেলে, কাঁটা ঝোপের ওপর দিয়েই জোরে জোরে চলতে আরম্ভ করল।
কাকাবাবু সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। দানবদেহের দোলানিতে আর উন্মুক্ত হাওয়ায় তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। তিনি চেয়ে দেখলেন, কালো কালো বিরাট দৈত্যের মতো দু’পাশের গাছগুলো তাঁর পাশ দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে!
ব্যাপারটা বুঝতে তাঁর দেরী হলো না। তিনি বুঝলেন, যেভাবে তাঁর কুলিরা অদৃশ্য হয়েছে, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে আজ তাঁকেও দানবদের নিমন্ত্রণ খেতে যেতে হচ্ছে!
তাঁর সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল, এই শীতেও তিনি ঘেমেনেয়ে উঠলেন। যে অভিযান করতে একদিন তিনি হাসিমুখে বেরিয়েছিলেন। তার ফল যে এতদূর গড়াবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি!
নির্জন অরণ্য ক্রমশ অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে লাগল। গাছগুলো যেন অন্ধকারের মুখোশ পরে হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে লাগল।
এর পরিণাম যে কি ভীষণ, কল্পনা করতেই তাঁর মাথা ঘুরে যাচ্ছিল!
কিন্তু মূহুর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলেন তিনি।
তখনি তাঁর নজর পড়ল হাতের দিকে! একটা বুদ্ধি খেলে গেল তাঁর মাথায়। তাঁর যে হাতটা দানবের কাঁধ থেকে ঝুলে পড়েছিল, সেইটে মুখের কাছে এনে তিনি একটা কাজ করে ফেললেন।
এই সময়টুকুর মধ্যেই দানবটা বুঝতে পারল – তাঁর কাঁধে চড়ে যে অতিথি আজ তাদের আসর জমাবার জন্য যাচ্ছে, সে হয়তো তাদের নিমন্ত্রণটা অগ্রাহ্য করার জন্য একটু ছটফট আরম্ভ করেছে!
দানবটা এই বুঝে কাঁধ থেকে কাকাবাবুকে নামাল। নামাতেই তার মুখের দিকে চেয়ে কাকাবাবুর মাথাটা যেন ঘুরে উঠল!
একটা বীভৎস, লোমশ কদাকার মুখ, দৈত্যের মতো সমস্ত দাঁতগুলো বের করে হাসতে শুরু করেছে! কাকাবাবু বুঝলেন, এটা একটা বিশাল গরিলা। একটু আগে আগে চলেছে তার চালক বা মনিব। সে-ও একটা বীভৎস, হিংস্র বুনো মানুষ। সাফল্যের হাসিতে তারও মুখখানা উজ্জ্বল।
নিকষ কালো অন্ধকারে সেই নির্জন বনের মাঝে অসভ্যের সেই উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল বন্য মুখের হাসি দেখে কাকাবাবু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না।
তাঁর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। নির্জন প্রকৃতির কোলে আস্তে আস্তে তাঁর মাথা লুটিয়ে পড়ল।
ঐ কি তবে সেই চুনির দেশ?
খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করব, ভাবছি। টাঙ্গা বলল, ” আপনি এখানে একটু দাঁড়ান দাদাবাবু! আমি একটু ঘুরে এদিকওদিক দেখে আসি। পথ নিশ্চয়ই একটা আছে, খুঁজে দেখতে হবে”।
টাঙ্গা দেখতে গেল, আর আমি সেখানে একলা দাঁড়িয়ে রইলাম।
টাঙ্গা অনেকক্ষণ পরে ফিরল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ” কি? কিছু হলো?”
সে বলল, ” হ্যাঁ, পথের খোঁজ একটা পাওয়া গেছে কিন্তু খুব সুবিধের হবে না”।
…..” কেন?”
টাঙ্গা বলল, ” এখান থেকে আধ মাইলটাক দূরে, খালের ধারে একটা বড় গাছ আছে। সেই গাছের গায়ে একধরনের বুনো লতা জড়ানো আছে। সেই লতা টেনে নিয়ে গিয়ে ওপারে আরেকটা গাছের ডালের সাথে বাঁধা – ঐ লতা ধরে ঝুলতে ঝুলতে ওপারে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই”।
আমি বললাম, ” চলো, তাই ধরেই খাল পার হবো। এ আর কষ্ট কি!”
কিন্তু মুখে যা বলেছিলাম, কাজের বেলায় সেটা করা খুব কঠিন বলেই মনে হলো!
গাছের ওপর উঠে টাঙ্গাই আমার আগে লতা ধরে ঝুলে পড়ল! খালের ওপর দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে সে ওপারে চলে গেল!
এইবার আমার পালা! ঈশ্বরের নাম নিয়ে আমিও লতা ধরে ঝুলে পড়লাম!
খালের মাঝামাঝি এসে নীচের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো ভয়ে বুজে এলো। দশ-বারোটা কুমীর একেবারে ঠিক আমার তলায় এসে হাঁ করে ওপর দিকে তাকিয়ে আছে!……একবার হাত ফস্কে পড়লে আর ক্ষমা নেই!
এই দৃশ্য দেখে আপনা থেকে আমার হাতদুটো যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল!
টাঙ্গা ওপারে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিতে লাগল, ” আর একটুখানি বাকি, দাদাবাবু। চলে আসুন”।
কিভাবে যে তারপর মন শক্ত করে লতা ধরে ঝুলতে ঝুলতে এপারে চলে এলাম, আমি নিজেও জানি না।
খানিক বিশ্রাম করে আবার আমাদের চলা শুরু হলো। বনের ভেতর আরও কিছুটা এগোতেই পাতার ফাঁকে ফাঁকে বাঁশের চালা নজরে পড়ল।
আমি টাঙ্গার হাত ধরে সেদিকে আঙুল দেখিয়ে, চাপা গলায় বললাম, ” ওই দ্যাখো। আমাদের আর এগোন উচিত হবে না। বিপদ যদি এসে পড়ে, তাহলে বাঁচা দায় হবে”।
টাঙ্গা বলল, ” তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি একবার গাছে উঠে চারদিকটা একবার দেখে নিই”।
টাঙ্গা একটা উঁচু গাছে উঠে পড়ল।
আমি সেইসময় চারপাশটা একটু ঘুরেফিরে দেখছি, সহসা ‘সট’ করে একটা শব্দ শুনে চমকে চেয়ে দেখি, একটা তীক্ষ্ণ বর্শা আমার সামনে একটা গাছের গায়ে এসে বিঁধে গেল। পরক্ষণেই চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা মুখ, এবং তার পাশে আরও একটা – যেমন কুৎসিত, তেমনি বীভৎস! আর সেই মুখের সাথে চার জোড়া চোখের ভীষণ চাহনি!
নিমেষে তারা আমায় কাঁধে ফেলে বনপথ ধরে এগিয়ে চলল, আর আমি নির্জীব হয়ে তাদের মুঠোর মধ্যে পড়ে রইলাম।
অনেকটা পথ হেঁটে তারা আমায় একটা খোলা জায়গায় এনে নামাল।
আমাকে কাঁধ থেকে নামাতেই চারপাশ থেকে ভীষণদর্শন অনেকগুলো লোক এসে আমায় ঘিরে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে মেয়ে-পুরুষ সবাই ছিল। প্রত্যেকেই প্রায়-উলঙ্গ। তাদের সবার গলায় চুনির মালা।
ছোটবেলায় ঠাকুরমার ঝুলিতে যেসব রাক্ষস খোক্কসের গল্প পড়েছিলাম, এরা বুঝি তারাই! গল্প বইয়ের পাতা যেন সজীব হয়ে উঠে আজ আমার চোখের সামনে ধরা দিয়েছে!
কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ যেন কার আসার সাড়া পেয়ে ভিড়টা যেন একটু পাতলা হয়ে গেল! একটা ভীষণদর্শন জোয়ান, তাগড়া লোক এসে আমার সামনে দাঁড়াল। সে আমায় একবার ভাল করে দেখে, যে দুটো লোক আমার দু’হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অদ্ভুত ভাষায় কি যেন বলল! বলতেই লোকদুটো আবার আমায় কাঁধের ওপর তুলে নিল।
তারা আমায় একটা ঘরের মধ্যে এনে ফেলল, তারপর একরকম লতা দিয়ে আমার হাত ও পা ভাল করে বেঁধে দিল একটা খুঁটির সাথে। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
কিছু ভাববার মতো মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না, শুধু চুপচাপ চোখ বুজে পড়ে রইলাম।
সহসা একটা ডাক কানে এল, “সলিল!”
চমকে উঠলাম। কে? কে ডাকে? আরে! এ যে কাকার গলা! তবে কি?….তবে কি?…….
হ্যাঁ, এ তো কাকাই। এ তো তাঁরই গলা।
এত দুঃখেও আমার যা হয়নি, এখন এই আনন্দের মাঝখানে তাই হলো। আমার দু’চোখের কোল ভিজে উঠল।
……” কাকা!…. কাকাবাবু!”
……” এই তো, তোমার পাশের ঘরেই আমি। কেবল মাঝখানে একটা পুরনো ভাঙা বেড়া”।
শব্দ লক্ষ্য করে ফিরে চেয়ে দেখি, সত্যিই পাশের ঘরে কাকা আমারই মতো বন্দি! ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে কিছুমাত্র অসুবিধে হলো না।
বিপদে মিলন
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ” আচ্ছা সলিল, তুমি এখানে এলে কি করে?”
উত্তরে আমি – টাঙ্গা কিভাবে আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো, তাই বললাম।
আমি বললাম, ” তোমার দস্তানাকে ধন্যবাদ, কাকাবাবু! তাতেই আমাদের পথ চিনতে একটুও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু কাকাবাবু, তুমি কি করে পথের মাঝে দস্তানা ফেলে রাখলে?”
কাকাবাবু বলে উঠলেন, ” যখন দেখলাম, গরিলাটা আমায় পিঠে করে নিয়ে ছুটছে, তখুনি বুঝলাম, গায়ের জোরে এর সাথে এঁটে ওঠা অসম্ভব। কাজেই নিজের চেষ্টায় আমার মুক্তিলাভ সম্ভব হবে না। কিন্তু কেউ বুঝবে কি করে যে আমায় কোন পথ দিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
হঠাৎ চোখে পড়ল আমার হাতের দস্তানার দিকে। ঈশ্বরের আশীর্বাদে, দস্তানার বোতামগুলো খোলাই ছিল। দাঁত দিয়ে তাড়াতাড়ি দস্তানাটায় টান দিতেই সেটা খুলে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর সুযোগ বুঝে আরেকটা হাতের দস্তানাও খুলে আরেক জায়গায় ফেললাম।
এখানে আসা অবধি আমি এইরকম বন্দি হয়ে আছি। এরা আমায় খেতে দিয়েছে বটে, কিন্তু আমায় নিয়ে শেষটায় কি করবে, এখনো জানতে পারিনি।”
এই পর্যন্ত বলে কাকাবাবু একটু থামলেন।
তারপর বিহ্বলভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – ” কেন তুই দেশে ফিরে গেলি না সলিল? এ মরণের মুখে কেন ঝাঁপ দিলি?”
……” তোমাকে একা ফেলে কেমন করে কোন মুখে দেশে ফিরতাম, কাকাবাবু? ”
…..” টাঙ্গা কোথায়?”
….” সে’ও আমার সঙ্গে এসেছে। এখনো যদিও ধরা পড়েনি, তবে সে-ও ধরা পড়বে”।
কাকাবাবু বললেন, ” সেই রাত্রেই আমাকে ওরা তাঁবু থেকে নিয়ে আসে! আমার বেল্টের ভেতর যে ওদের দেবতার মূর্তিটা লুকনো আছে, তা ওরা কেমন করে জানি না, জেনে যায়। আমাদের তাঁবুতে দু’রাত জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেও কিছু পায়নি। তাই পরে আমাকেই চুরি করে নিয়ে আসে”।
……” সেই মূর্তিটা কোথায় এখন?”
……” আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে! জানি না, ওদের এখন মতলব কি! ওদের দেবমূর্তিটাকে তো ওরা পেয়ে গেছে, তবু আমার মনে হয়, ওরা আমাদের মেরেই ফেলবে!”
……” মেরেই যদি ফেলবে তো এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে কেন?”
…..” তাও তো বোঝা যাচ্ছে না! দেখা যাক কি হয়”।
প্রতি মূহুর্তে আমরা টাঙ্গাকে প্রত্যাশা করতে লাগলাম, এই বুঝি সে-ও এলো! কিন্তু সে আর এলো না! নিদারুণ কারাগৃহে দেখতে দেখতে রাতের আঁধার নেমে এলো।
এরইমধ্যে একসময় এসে ওরা আমাদের কিছু ফল খাইয়ে গিয়েছিল।
অন্ধকারের ভেতর দুজনে মড়ার মতো পড়ে আছি। শুধু দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
খোলা একটা ছোট্ট জানলা দিয়ে একটুখানি ম্লান চাঁদের আলো ঘরের মধ্যে এসে একটা অস্পষ্ট আলো আঁধারির সৃষ্টি করেছে।
অজানা ভবিষ্যৎ আমাদের সামনে এগিয়ে আসছে; তার রূপ যে কত ভীষণ, কত ভয়াবহ, তা কল্পনা করতে নিজেই শিউরে উঠলাম।
স্বল্প আঁধারে কাকাবাবুর মুখ না দেখা গেলেও বেশ বুঝতে পারলাম, তাঁর চোখও শুকনো নেই। তিনি নিশ্চয়ই নিজের ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছেন।
আমারও চোখ জলে ভরে গেল – কেন এই অ্যাডভেঞ্চারের শখ জাগলো আমাদের মনে? এর নেশা যে কিভাবে আমাদের মরণের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তা ভাবতে ভাবতে ক্রমশ আমার মাথা গুলিয়ে যেতে লাগল। এখনি হয়তো চোখের ওপর নেমে আসবে কালো পর্দা, এখুনি হয়তো আসবে মৃত্যু! জীবনের সমস্ত আশা-ভরসা নিমেষে শেষ হয়ে যাবে। এ পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বই আর থাকবে না।
যতই ভাবি, ততই শরীর এলিয়ে আসে। ক্লান্তিতে অবসাদে একে শরীর অবসন্ন, তার ওপর নানারকম বীভৎস চিন্তা।
ধীরেধীরে কখন তন্দ্রার মোহে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, হঠাৎ দরজা খোলার খুটখাট শব্দে ছাঁৎ করে তন্দ্রা ভেঙে গেল।
জেগে যা দেখলাম, সমস্ত শরীর হিম হয়ে এল।
চোখ মেলতে দেখি, যমদূতের মতো চারজন লোক এসে প্রথমে খুঁটি থেকে কাকাবাবুকে খুলল, তারপর আস্তে আস্তে একটা বাঁশের খাটের সঙ্গে কাকাবাবুকে বাঁধল।
কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি- শক্ত দড়ির বাঁধনে তাঁর দেহের সমস্ত শিরা উপশিরা স্ফীত হয়ে উঠেছে। এইভাবে ঘন্টাখানেক থাকলে যে কি পরিণাম হবে, তা ভাবতে পারলাম না।
” মাগো!” বলে আমি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।মশানে
জ্ঞান ফিরতে দেখি – আমাকে আর কাকাবাবুকে ঘিরে অসংখ্য উলঙ্গ নরনারী নৃত্য করতে আরম্ভ করেছে। সে কি ভীষণ, সে কি তাণ্ডব সেই নৃত্য!
আমাদের হাত-পা কাঠের খুঁটির সাথে বাঁধা! সম্ভবত আজই আমাদের কিছু একটা হবে।
দূরে জ্বলছে লেলিহান আগুন-তারই পাশে স্থাপিত রয়েছে সেই মূর্তি – যার জন্য আমাদের এই দুরবস্থা।
চেয়ে দেখলাম, তখনও মূর্তিটার মাথায় দপদপ করে চুনিগুলো জ্বলছে, আর মূর্তিটাকে জড়িয়ে থাকা সাপদুটো যেন কুটিল নয়নে সেদিকে তাকিয়ে হাসছে!
কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি – এখনো একদৃষ্টে লোভাতুর নয়নে বিগ্রহটার দিকে তাকিয়ে আছেন!
কি ভীষণ এই মানুষগুলো! তেমনি ভীষণ তাদের এই দেবমূর্তি!
এই অসভ্য পিশাচের দল আজ বহু বৎসর পরে ফিরে পেয়েছে তাদের বাঞ্ছিত ইষ্টদেবতা। তাই আনন্দে তারা আজ মশগুল হয়ে পড়েছে।
একপাল উলঙ্গ ছেলে ওদিকে মূর্তিটার সামনে নাচছে – অন্যপাশে বিপুল উলঙ্গ নরনারী ভিড় করে সেই লেলিহান অগ্নিশিখার ওপর কি যেন ঢালছে!
হয়তো এইরকমই এদের পূজা-পদ্ধতি।
চুপ করে এই বীভৎস দৃশ্য দেখা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ই ছিল না।
হঠাৎ দেখি, সর্বাঙ্গে পালক পরা আর গলায় অসংখ্য কড়ির মালায় সজ্জিত বিরাটকায় দৈত্যের মতো একটা লোক এসে আমাদের কাছে দাঁড়ালো।
কি ভীষণ কুৎসিত তার চেহারা! কালো ভাঁটার মতো চোখদুটো আমাদের মুখের ওপর রেখে তাদের ভাষায় কি যেন বলল।
সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের মতো ঢাক-ঢোলের আওয়াজে জায়গাটা যেন ভেঙে পড়বার উপক্রম হলো।
যে লোকটা আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, বোধহয় সে-ই ছিল ওদের পুরোহিত।
বুঝতে পারলাম, আজ এই আদিম অসভ্যরা মেতে উঠেছে ওদের প্রতিহিংসাবৃত্ত
ি চরিতার্থ করতে। যে দেবতাকে ওরা সুদীর্ঘ দিন হারিয়েছিল – তাকে আজ ওরা ফিরে পেয়েছে।
তাই আজ ওরা ওদের দেবতাকে রক্ত-অর্ঘ্য দেবে। রক্ত! মানুষের জমাট রক্ত!
ওদের বিশ্বাস, ওদের দেবতা তাতে তৃপ্ত হবে-আর খুশি হয়ে এই অসভ্য নিষ্ঠুর বর্বরগুলোকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করবে।
ক্রমশ বুঝতে পারছি, এইবার – এইবার হারাতে হবে আমাদের এই জীবন।
চোখের জলে ভিজে গেল সারা বুক – মনে পড়ে গেল সেই কোন সুদূরে মা আর বাবা’কে।
ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া কোনও উপায়ই খুঁজে পেলাম না।
চুপ করে বন্দি অবস্থায় দাঁড়িয়ে যখন ভাবছি, হঠাৎ দেখি দুটো লোক কাকাবাবুকে বাঁধন থেকে খুলে তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়ে সেই আগুনের সামনে একটা খুঁটিতে বাঁধলো। খুঁটিটার হাত দুয়েক দূরেই সেই লেলিহান অগ্নিশিখা হাঁ করে লকলকে জিভ বের করে যেন কাকাবাবুকে খাবার উপক্রম করছে।
মনে হলো, একবার চিৎকার করে ডাকি – ঈশ্বর! প্রভু! এ আজ আমাদের কি পরীক্ষা! জীবন মরণ নিয়ে এ কি খেলা, প্রভু?
কিন্তু তারপর যে দৃশ্য দেখলাম – তাতে আর কথা বলবার ক্ষমতা রইল না আমার! ভয়ে কণ্ঠরোধ হয়ে গেল!
আমাকেও তারা আগুনের কাছে আরেকটা খুঁটিতে ধরে নিয়ে গিয়ে বাঁধল। উঃ! কি অসহ্য উত্তাপ!
মনে হলো – এইভাবে মিনিট পনেরো থাকলেই জ্বলন্ত হাপরের মাঝে যেভাবে লোহা গলে যায়, ঠিক সেভাবেই আস্তে আস্তে গলে যাবে আমাদের এই শরীর।
মিনিট দুই বাদে দেখি, আমাদের দুজনেরই সামনে তীক্ষ্ণ বল্লম উঁচু করে সাত আটটা লোক তাদের ভাষায় অসভ্য উদ্দাম সুরে গান গাইতে গাইতে ঘুরছে!
এইবার….. এইবার…..
বুঝতে বাকি রইল না, এইবার বুকে লুটিয়ে পড়বে আমাদের শেষ নিশ্বাস- এই নির্জন অরণ্যের মাঝে শেষ হয়ে যাবে সভ্যজগতের দুটো মানুষ – কেউ তাদের খোঁজ দিতে পারবে না। বেশ বুঝতে পারছি, নেমে আসছে ধীরেধীরে মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ।
তারপর সব শেষ।
বোঝবার সব ক্ষমতা তখন আমার শেষ হয়ে গেছে।অপূর্ব মুক্তি
জ্ঞান যখন হলো তখন দেখি – একটা অন্ধকার ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি।
তবে কি- মরিনি? না এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম?
নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম, নিশ্বাস বইছে ধীরেধীরে।
কিন্তু একটু আগে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে এলাম কি করে? মাথাটা গুলিয়ে গেল, কিছুতেই বুঝতে পারলাম না।
দূরে যে কাকাবাবু আছেন, মৃদু নিশ্বাসের শব্দে তা বেশ বুঝতে পারলাম।
খানিক আগে যে বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম,কিভাবে সেখান থেকে রক্ষা পেলাম, তা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। শুধু এইটুকু মনে পড়ল, আমি যেন তখন একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
এসব যখন ভাবছি, তখন সহসা খুট করে একটা আওয়াজ কানে এলো। তারপরেই একটা চাপা আওয়াজ – ” বাবু! বাবু!”
……কে? এ যে টাঙ্গার গলা।
…..” বাবু, জেগে আছেন?”
…..” কে? টাঙ্গা?”
কাকাবাবুর কণ্ঠস্বর বুঝতে পারলাম এবার।
……” হ্যাঁ, বাবু”, টাঙ্গা বলল, ” চুপ করে থাকুন এখন “।
সেই অস্পষ্ট আলো আঁধারেই হাতড়ে হাতড়ে সে আমাদের দুজনের হাত ও পায়ের বাঁধন ছুরি দিয়ে কেটে দিল। আমরা মুক্ত হলাম।
আবার সেই চাপা কণ্ঠস্বর – ” আস্তে আস্তে আমার পেছনে আসুন, ওরা টের পেলে তিনজনকেই মরতে হবে”।
টাঙ্গার পেছন পেছন ছুটতে লাগলাম। আগে আগে টাঙ্গা পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।
মুক্তি পেতেই মনে হলো, ‘ ঈশ্বর! তুমি আছো! বিশ্বের সমস্ত স্থানেই তুমি আছো। আমার ডাক যে তোমার কানে পৌঁছেছে প্রভু! তাইতো টাঙ্গাকে এখানে পাঠালে!’
দৌড়তে আর পারছিলাম না – খানিকদূর যেতেই বসে পড়লাম। ওদিকে চেয়ে দেখি, কাকাবাবুও বসে পড়েছেন।
টাঙ্গা আস্তে আস্তে বলে উঠল – ” বাবু! বাবু! আর একটু পা চালিয়ে ঐ খালের কাছ পর্যন্ত চলুন – তারপর একটা নিরালা জায়গা আমার সন্ধানে আছে, সেইখানে বসবেন”।
কথা বলতে বলতে খানিকটা মাখন আর রুটি সে আমাদের খেতে দিল।
খেয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। পথ যেন আর ফুরোয় না! একটু করে এগোই, আর পেছন ফিরে তাকাই কেউ আসছে কিনা দেখতে।
টাঙ্গা আমার ভাবগতিক দেখে বলল – ” দাদাবাবু, তোমার কোনও ভয় নেই। আজ আর ওরা আমাদের পেছনে আসবে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত”।
খালের কাছাকাছি আসতেই আমি পিছিয়ে পড়লাম। কাকাবাবুর তখনো একটু শক্তি ছিল।
টাঙ্গা আমার কাছে এসে হাত পাগুলো বেশ ভালো করে টিপে দিতে লাগল।
সে বলল – ” কোনওরকমে এই খালটা তোমায় পার হতেই হবে, দাদাবাবু, নইলে ফের বিপদ হবে”।
টাঙ্গার কথায় বিপদের আভাস পেয়ে, আবার মনে জোর করে সাহস ও বল সঞ্চয় করে, সেই কুমীর-ভরা খাল কোনওরকমে লতার দড়ির সাহায্যে পার হলাম। দেখলাম – লতার দড়িগুলো আমরা পার হবার পর টাঙ্গা তার ছুরি দিয়ে কেটে দিল, শত্রুপক্ষের লোকেরা যাতে সহজে আর আমাদের ধরতে না পারে।
খাল পার হওয়ামাত্র সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে পড়ল।
টাঙ্গা একটা নিভৃত জায়গা দেখিয়ে বলল, ” বাবু, দাদাবাবু, এইখানে একটু বিশ্রাম করে নিন।”
বিশ্রাম নিতে নিতে কৃতজ্ঞতার সুরে টাঙ্গাকে বললাম, ” টাঙ্গা, এ যাত্রা শুধু তোমার জন্যই বাঁচলাম। কিন্তু তুমি ওখানে পৌঁছলেই বা কি করে? আর এমন কি ঘটল যে ওদের হাত থেকে আমরা বেঁচে গেলাম?”
টাঙ্গা শুধু আকাশের দিকে দু’হাত ওপরে তুলে বলল, ” সবই তাঁর হাত। জানতে যখন চাইছ, তখন বলছি, শোনো :
টাঙ্গার বিবৃতি
টাঙ্গা বলতে শুরু করল,
” খোকাবাবু, তোমায় রেখে যেই গাছের ওপর উঠেছি, দেখলাম ওরা তোমায় ধরে নিয়ে গেল। আমিও চুপিচুপি চললাম ওদের অনুসরণ করে….
তোমায় ওরা একটা ঘরে বন্দি করে রেখে দিল। আমি সেই ঘরের পাশেই একটা জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে রইলাম। মাঝেমাঝে দেখছিলাম, ওরা তোমায় নিয়ে কি করে। আমি যে জায়গায় লুকিয়ে ছিলাম, সেই জায়গাটা ছিল খুবই নিরালা; তবুও কি কষ্টে যে আমি ওদের নজর বাঁচিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম, তা একমাত্র আমি জানি আর ‘ তিনি’ই জানেন।”
বলতে বলতে টাঙ্গার চোখে জল এসে গেল।
” তারপর শোনো খোকাবাবু, খানিকক্ষণ বাদে দেখি, জনা আষ্টেক লোক, দুটো বাঁশের খাটের সঙ্গে কি যেন বেঁধে নিয়ে কোথায় চলল। ভাল করে নজর করতেই বুঝতে পারলাম, ওরা নিয়ে চলেছে তোমায় আর বাবু’কে………
তোমাদের ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, দেখার জন্য আমিও ওদের অনুসরণ করলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। কিছুক্ষণ পর দেখি – ওরা একটা জায়গায় নিয়ে এল তোমাদের, যেখানে ওদের দেবতার সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন, তারই সামনের খুঁটিতে তোমাদের দুজনকে পিছমোড়া করে বাঁধল; জনাকয়েক লোক তোমাদের ঘিরে বল্লম উঁচিয়ে ঘুরতে লাগল! তখনি বুঝলাম, আজ ওরা দেবতার কাছে তোমাদের বলি দেবে! তার মিনিট দুই যেতে না যেতেই দেখি, ওদের পুরোহিত আর তার গোটা কয়েক সঙ্গী মিলে কড়ি খেলতে বসে গেল। এই কড়ি-খেলা দেখে মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলাম, ” মুখ তুলে চেয়ো প্রভু!”…
তার কিছুক্ষণ বাদেই – যা প্রার্থনা করছিলাম, তাই ঘটল…..
দেখলাম, কড়িগুলো সব চিত হয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল সব উৎসব নৃত্য। লোকজন কিরকম যেন হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে তারা তাদের মূর্তির পানে চেয়ে রইল। আর তখুনি তারা তোমাদের আগুনের কাছ থেকে নিয়ে আবার ঘরে বন্দি করে রাখল।
কাকাবাবু আর আমি সবিস্ময়ে টাঙ্গার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমাদের সে ভাব দেখে টাঙ্গা বলে উঠল – ” কি দাদাবাবু! কিছু বুঝতে পারলে না তো? তবে শোনো। এই কড়ি-খেলার ইতিহাসটা শোনো। ”
হাঁ করে আমি আর কাকাবাবু টাঙ্গার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। টাঙ্গা বলে চলল :
……” এদের সমস্ত ব্যাপার আমি গোড়া থেকেই জানতাম। এই কড়ি-খেলার নিয়মকানুনও আমার জানা। জানোই তো, দেবতার ওপর এদের অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস। ওরা যে জিনিস দেবতাকে নিবেদন করবে, তার আগে – সেই জিনিস দেবতা নেবেন কিনা, সে ব্যাপারে দেবতার কাছ থেকে মত চেয়ে নেয়।
দেবতাকে কোনও ভেট দিতে গেলে, তার আগে দেবতার মত জানার জন্য কড়ি খেলার প্রচলন আছে ওদের মধ্যে। যদি খেলায় সমস্ত কড়িগুলোই চিত হয়ে পড়ে, তবে ওরা মনে করে, দেবতা এই ভেট নেবেন না। তখন তারা সেদিনের মতো দেবতাকে সেই ভেট দেয় না। তাদের বিশ্বাস, তাদের পূজোয় নিশ্চয়ই কিছু খুঁত আছে, তাই দেবতা ভেট নিতে চাইছেন না……
সেজন্যই, বুঝলে দাদাবাবু, গত রাতে তোমাদের বেলায় সব কড়ি চিত হয়ে পড়েছিল, তাই তারা সেদিনের মতো তোমাদের বলি স্থগিত রেখেছিল, আর আবার তোমাদের নিয়ে গিয়ে ঘরে বন্দি করেছিল।”
আমি বললাম, ” তাহলে বন্দি করে রাখার প্রয়োজন কি ছিল?ছেড়ে দিলেই পারত!”
সে কথায় টাঙ্গা বলল, ” না, তোমাদের আজকে আবার রাত্রে নিয়ে যাওয়া হতো সেই দেবতার সামনে; আবার কড়ি খেলা হতো। আজও যদি সব কড়ি চিত হয়ে পড়ত, তা হলে আজ তোমাদের বদলে ওই পুরোহিতের রক্ত নিয়ে তাদের দেবতার পূজো হত”।
টাঙ্গার কথায় চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ” আচ্ছা টাঙ্গা, যদি গত রাত্রে কড়িগুলো সব চিৎ হয়ে না পড়ত? তাহলে? ”
টাঙ্গা এবার কেঁদে ফেলল। বলল, ” তা কি হয় দাদাবাবু? তোমার মতো ছেলেমানুষ আর বাবুর মতো সরল লোককে কি ঈশ্বর এত বড় শাস্তি দিতে পারেন?”
কাকাবাবুর মুখের পানে চেয়ে দেখি, তাঁর চোখেও তখন অফুরন্ত জল। আমার চোখেও জল এসে গেল।
তিনজনেই নীরব।
সকলেই মাটিতে মাথা ঠুকে ঠুকে ওপরওয়ালাকে স্মরণ করতে লাগলাম।
টাঙ্গার মুখের কথা শেষ হয়ে গেলেও আমাদের তখনো মোটেও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। পরিশ্রান্ত দেহে টাঙ্গার অ্যাডভেঞ্চারের কথায় সকলেই যেন একটু স্বস্তি অনুভব করছিলাম।
সকলেই নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নতুন সূর্য -মাথায় তার সোনার মুকুট – দিকে দিকে তার সোনার স্পর্শ…..
তারই সোনালি আলোয় পৃথিবী ক্রমশ সোনার রঙে রঙিন হয়ে উঠছে। অপরূপ হয়ে উঠছে নিবিড় এই অরন্য।
হঠাৎ টাঙ্গা বলে উঠল, ” আর দেরী নয় বাবু। ব্যাটারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে যে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে তাদের শত্রু। তখন আবার আমাদের নতুন বিপদের মধ্যে পড়তে হবে।”
টাঙ্গার কথায় টনক নড়ল আমাদের। ওঠার জন্য তৈরি হতে লাগলাম।
প্রত্যাবর্তন
সবই হলো! সুদূর বর্মায় এসে যে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় আজ এত বড় বিপদের মুখোমুখি হতে হলো, দৈবক্রমে যদিও টাঙ্গার কৌশলে আর ওপরওয়ালার দয়ায় মুক্তি পেলাম, কিন্তু যেজন্য এতদূর এত পরিশ্রম করে আসা, সবই বুঝি বিফল হলো!
কোথায় বা চুনি? আর কোথায় বা সেই চুনি-পান্নার দেশের অগণিত গুপ্ত রত্নরাশি?
আমি হতাশভাবে বললাম, ” টাঙ্গা….টাঙ্গা! এখান থেকে চলে যেতে মন চাইছে না। কত আশা নিয়ে আমরা এই দূরদেশে এসেছিলাম। কিন্তু এই চুনির দেশ থেকে আমাদের একেবারে যে রিক্তহস্তে ফিরে যেতে হচ্ছে!”
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কাকাবাবু কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু টাঙ্গার দিকে তাকাতেই আমরা একেবারে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
……” এ কি! এ তুমি কোথায় পেলে টাঙ্গা?”
টাঙ্গার হাতে খুব বড় আকারের রক্তলাল একটা চুনি!
কাকাবাবু টাঙ্গার হাত থেকে ছোঁ মেরে চুনি’টা কেড়ে নিয়ে বললেন, ” এত বড় চুনি তো আমি জীবনেও দেখিনি – পৃথিবীতে এত বড় চুনি আছে কিনা সন্দেহ! হয়তো নেই-ই!”
কাকাবাবুর হাতে চুনিটা ভোরের সূর্যের আলোয় ঝকমক করে জ্বলছিল – রক্তের মতো রঙ তার। সূর্যকিরণ পড়ায় মনে হলো, চারদিকের বনভূমি যেন চুনি থেকে বিকিরিত আলোয় ঝকঝকে ঝলমলে হয়ে উঠেছে!
” এ তুমি কি করে পেলে টাঙ্গা?”
…….” কি আর বলব দাদাবাবু, আপনাদের ঘরে বন্দি করে রেখে সেই দানবগুলো দূরে তাদের এক দেবতার কাছে পূজো দিতে ছুটল। দলে দলে তারা সেখান থেকে চলে গেল। তারপর আমার মনে হলো – তুলে নিই ঐ মূর্তিটা। কিন্তু কি জানি কেন মনে হলো, এতে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। আপনাদের ওপর ঈশ্বর যে কৃপা করলেন, আমার এই কাজের ফলে হয়তো এবার সত্যি সত্যিই বিপদই হতে পারে আপনাদের। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল, মূর্তিটার বেদীর ঠিক নীচে জ্বলজ্বল করছে এই চুনিটা….তাড়াতাড়ি সেটা তুলে নিয়ে আপনাদের ঘরের দিকে ছুটলাম। বাবু, এ হলো চুনী-পান্নার দেশ। আমাদের দেশে রাস্তায় যেমন কাঁকর দেখতে পাওয়া যায়, এখানে সেরকম জঙ্গলে, গুহায়, অলিতে গলিতে, পথেঘাটে চুনি-পান্না পড়ে থাকে!”
আনন্দে আমি আর কাকাবাবু তখন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি।
আমি বলে উঠলাম, ” চলো টাঙ্গা, আর দেরী করে লাভ নেই”।
আমার কথায় কাকাবাবু ও টাঙ্গা দুজনেই চাঙ্গা হয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।
দিকে দিকে তখন ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের কিরণ – নীরব নিস্তব্ধ প্রকৃতির মৌনবুকে আলোর রাশি ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা আমাদের ক্যাম্পের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। তখনো আমার মনে হচ্ছিল, আবার ফিরে যাই সেই চুনির দেশে আর লুঠ করে নিয়ে আসি রাশিরাশি চুনি……!
কিন্তু তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য…..আগুনের সামনে সেই বর্বরদের উলঙ্গ নৃত্য…..সেই ভীষণদর্শন পুরোহিত…. সেই বল্লম উঁচিয়ে চক্রাকারে আমাদের ঘিরে ঘোরা…..আগুনের অসহ্য তাপ…..!
আর ভাবতে পারলাম না। জোরে জোরে পা চালিয়ে এগোতে লাগলাম। পেছন ফিরে মাঝেমাঝে দেখছিলাম। না, ভয় নেই, কাউকে দেখতে পারছিলাম না। সম্ভবত আমাদের পালানোর ব্যাপারে তারা নিজেদেরই দোষী মনে করেছে। মনে করেছে, কুপিত হয়ে হয়তো দেবতাই আমাদের সরিয়ে ফেলেছে। নইলে সামান্য মানুষদুটো তাদের খপ্পর থেকে পালাল কি করে?
এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে ছুটছি আর মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি, আজ রাতে যেন সেই পুরোহিতের রক্তে মূর্তিটা রঞ্জিত হয়ে উঠেছে আর বিগ্রহটা আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে!……
কিন্তু পরমূহুর্তেই ছুটে যাচ্ছে সব অলীক কল্পনা……
সামনে চড়াই উৎরাইপূর্ণ মাঠ…..আর আমরা তা-ই পার হবার জন্য ছুটছি…..কেবলই ছুটছি…..
উপসংহার
এভাবে দিনের পর দিন চলতে চলতে, আমরা একদিন এসে পৌঁছলাম রেঙ্গুন শহরে।
সেখান থেকে একদিন আমরা জাহাজে চেপে বসলাম। টাঙ্গা এখানেই রয়ে গেল কাকাবাবুর বাড়ি দেখাশোনা করতে।
টাঙ্গা আমাদের জাহাজে তুলে দিতে এলো। জাহাজের বাঁশি বেজে উঠল…. চেয়ে দেখি, টাঙ্গার চোখে জল!
বলল,….. ” দাদাবাবু, আবার এসো ভাই! তোমাদের ছাড়া আমার দিন চলা!”
টাঙ্গা কথা শেষ করতে পারল না, অদম্য কান্নার বেগ তার কন্ঠরুদ্ধ করে দিল, সে নীরবে শুধু আমার হাতের মুঠোর ভেতর গুঁজে দিল সেই জ্বলজ্বলে প্রকাণ্ড চুনিটা।
…..” এ কি করলে টাঙ্গা? এটা দিয়ে দিলে কেন?” জিজ্ঞেস করলাম।
…..” এটা তোমারই জিনিস, দাদাবাবু “।
জেটি থেকে জাহাজে ওঠবার সিঁড়ি সরিয়ে নেবার জন্য তৈরি হচ্ছে খালাসীরা।
টাঙ্গা শুধু বলল, ” এটা আমি তোমাকেই দিয়ে দিলাম, খোকাবাবু! আর সময় নেই, যাও জাহাজে গিয়ে ওঠো!”
আস্তে আস্তে কোনওকিছু না বলে আমরা জাহাজে এসে উঠলাম। আমরা বলতে আমি আর কাকাবাবু। দেখি, জেটি থেকে আস্তে আস্তে আমাদের জাহাজ দুলে দুলে চলতে শুরু করেছে….
টাঙ্গা তখনো জেটিতেই দাঁড়িয়ে!
অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম, আমরা চলে যাওয়াতে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তার বুক। মনে পড়ে গেল সেই ভীষণ অরণ্য….সেই দুর্গম পাহাড়ের বনের ভেতর অসভ্যদের আস্তানা…..তাদের সেই দেবমূর্তির কুপিত চক্ষু!
চোখ বুজে ফেললাম। বেশ বুঝতে পারলাম, আমার জামার ওপর চোখের জল পড়েছে।
টাঙ্গা যে আমাদের কতখানি আপনজন হয়ে উঠেছিল, আজ তা বুঝতে পারলাম প্রথম!
কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁরও চোখ ভিজে উঠেছে জলে!
রেলিঙটা ধরে চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম; ধীরেধীরে চোখের ওপর থেকে অস্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল শহরটা।
কাকাবাবু এসে পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, ” আজ দীর্ঘ উনিশ বছর পর বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছি সলিল! ভেবেছিলাম, আর হয়তো কোনওদিন দেশের মুখ দেখতে পাবো না!”
বলতে বলতে তাঁর দুচোখের কোণ টলমল করে উঠল।
আমি বললাম, ” কাকাবাবু! জীবন তো আমাদের শেষই হয়ে গিয়েছিল! দেশের ছবি আর সূর্যের আলো আমাদের জীবন থেকে তো সেদিনই মিলিয়ে গিয়েছিল! কেবল তোমার ওই পরম বিশ্বাসী টাঙ্গা, আর ওপরওয়ালার দয়া – এই জন্যেই আমরা জীবনে ফিরতে পেরেছি”।
কাকাবাবু বললেন, ” একদম ঠিক বলছ, সলিল। কড়িখেলায় সেদিন একটু এদিকওদিক হলেই আমাদের জীবনের ওপর যবনিকা পড়ে যেত সেই মূহুর্তে! ”
আমি বললাম ” অসভ্যদের যে দেবতার জন্য ওয়াল্টার সাহেবের প্রাণ গেছে, তার চাকরটার প্রাণ গেছে, সেই দেবতার সম্মুখ থেকে আমরা প্রাণ নিয়ে ফিরেছি – এ কি কম আশ্চর্যের কথা! ঈশ্বর সেদিন আমাদের সঙ্গে না থাকলে, আজ আমরা কোথায় থাকতাম…..!
কাকাবাবু, বিষের তীরে প্রকাশ্য রাজপথে সেদিন ওই লোকটা মরার পর থেকেই আমাদের মনে হচ্ছিল, একটা ভয়ানক বিপদ আমাদের ঘাড়ে চেপে বসছে…….”
……” হ্যাঁ, পেয়ে বসেছিল নিশ্চয়ই”, কাকাবাবু বললেন, ” আর যা বসেছিল, তা বিষের তীরই বটে। এ কথা আমি জোর গলায় বলতে পারি!”
খানিক থেমে ফের তিনি বললেন, ” চুনির লোভ আমার ভেতরে বিষের তীরের মতোই গেঁথে গিয়েছিল, সলিল। একটা দুর্জয় নেশায় আমি যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম। চুনির নেশা আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা – এই দুটোই বিষের তীরের মতো, যার বিষ আমার বুকে তীব্রভাবে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল; আর তারই ফলে আজ আমাদের এত লাঞ্ছনা! ”
নীচের ইঞ্জিন ঘর থেকে ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে আসছিল। শোনা যাচ্ছিল খালাসিদের চিৎকার, চেঁচামেচি, গোলমাল!
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলাম। সবকিছুই তখন আমার এত ভাল লাগছিল! মনে হচ্ছিল, দীর্ঘ নির্বাসনের পর যেন আমরা মানুষের জগতে ফিরে এসেছি “।
( সমাপ্ত)