কড়া রোদ বাহিরে,প্রচন্ড গরম!
এই অসহ্য গরমেও চেনা শহরটা মানুষের ভীড়ে কোলাহল পূর্ণ!সবাই যার যার কর্ম ব্যস্ততায় এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে।ছয় বছরের ছোট্ট জিহাদ অবাক চোখে সবকিছু দেখছে।কিভাবে মানুষগুলো ওর পাশ দিয়ে দ্রুত হেটে চলে যাচ্ছে কিন্তু ওর দিকে একটুও তাকাচ্ছে না,যেন ও এখানে দাড়িয়ে আছে সেটা কেউ দেখতেই পাচ্ছে না।ময়লা পুরানো প্যান্ট আর ছেড়া গেঞ্জি পরিহিত কাউকে দেখার প্রয়োজনও তাদের নেই।ভালোভাবে যদি তারা কেউ ওর দিকে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো ওর শুকনো মুখখানি আর দুচোখ ভরা আকুতি।
–
-ছার দুইডা টাহা দিবেন?
-ওই ফকিরের বাচ্চা তোর হাত সরা,গাড়ির গ্লাস টা নষ্ট হয়ে যাবে।
-(হাত নামিয়ে)স্যার দেন না দুইডা টাহা,আইজ দুইদিন ধইরা না খাইয়া আছি ছার,মা অসুস্থ, ঔষুধও কিনতে হইবো।
-যা ফকিরের বাচ্চা দুর হো।টাকা কি গাছে ধরে নাকি?
-দেন না ছার(কেদেঁ দিয়ে)।
-যা বলছি, নাইলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো ছোটলোক কোথাকার।
–
এটা কোনো বাংলা ছবির দৃশ্য নয়,এটা এক ক্ষুদার্থ ছেলের খাবার কেনার জন্য কিছু টাকার জন্য করা আকুতি ছিলো শহরের গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ানো মানুষরূপী কিছু অমানুষের কাছে। কিন্তু সেই মানুষগুলোও অসহায় জিহাদের কথা শুনেই ধমক দিয়ে গাড়ির গ্লাস লাগিয়ে দেয়। ছোট্ট জিহাদ মৃদ্যু কন্ঠে বারবার আকুতি করতে থাকে। কিন্তু ওর কথাগুলো শোনে না এসি গাড়িতে বসে থাক লোকগুলো।ওর বাড়িয়ে দেওয়া ছোট্ট দুটি হাত কারো পছন্দ হয়নি। তার মৃদ্যু কন্ঠে বলার ভঙ্গি কারো সহ্য হয় নি। সাহায্য পায় নি,কিন্তু অবহেলা ঠিকই পেয়েছে জিহাদ।
–
আজ দুদিন ধরে না খেয়ে আছে জিহাদ।বাবাকে কখনো দেখেনি জিহাদ,ওর জন্মের আগে ই ওদের ছেড়ে চলে গেছে।মা অসুস্থ থাকায় কাজে যেতে পারে নি,তাই ঘরে চুলাও জ্বলে নি,চার বছরের ছোট বোন টা ক্ষুদার জ্বালায় কাঁদছে।মা নীরবে চোখের জ্বল ফেলছে। জিহাদ কখনো কাজ করে নি,ওর আশেপাশের ছেলেমেয়েগুলো হয় টোকাই এর কাজ করে,না হয় ফুল বিক্রি করে।কিন্তু ওর মা কখনো ওকে এসব করতে দেয় নি,গরীব হলেও ছেলেকে মানুষ করতে চান উনি।কিন্তু গরীবের কি এসব করা সাজে।ওদের জীবনটা যুদ্ধ করে ই কাটাতে হয়।মায়ের অসুস্থতা আর ছোটবোনের কান্না দেখে আর স্থির থাকতে পারে নি জিহাদ।তাই বাইরে এসেছে সবার মুখের খাবার জোটাতে।
—
কিন্তু খাবার কিনতে যে টাকা লাগবে।যা ওর কাছে নেই।অনেক ক্ষুদা লেগেছে ওর,কিন্তু টাকার জন্য খাবার কিনতে পারছে না।কয়েক টা দোকানে গিয়ে খাবার চাইলে দোকানি যখন টাকা চায় আর জিহাদ মুখ ছোট করে জবাব দেয় “টাকা নেই”তখন দোকানি দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়।জিহাদ অনেক কাকুতিমিনতি করে কিন্তু মন গলে না কারো,একটু খাবার চায় ও।দোকানে বসে থাকা লোকগুলো দেখেও না দেখার ভান ধরে থাকে,একটা ছোট্ট ছেলের কান্না তাদের কানে পৌছে না,তাদের মনকে নাড়া দেয় না,মূর্তির মতো তারা চেয়ে থাকে আর নিজেদের মত খেয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট ছেলেটার আকুতি ও কান্না তাদের স্পর্শ করছে না।কয়েক দোকান ঘুরেও তাই খাবার পায় নি জিহাদ। খাবার কিনতে হলে টাকা লাগবে তাই টাকা জোগাড় করার চিন্তা করে জিহাদ।
ছোট্ট জিহাদ তাই হাত পাতে সেই মানুষগুলোর কাছে। নিজের জন্য নয়,মা আর বোনের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য।কিন্তু কেউ ওকে সাহায্য করে না,ফিরেও তাকায় না।ওর ছলছল চাহনি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে না।ছোট্ট জিহাদ বেশী কিছু তো চায় না চায় অল্প কিছু টাকা,যা দিয়ে তার মা বোনের ক্ষুদা নিবারন করা যাবে।কিন্তু সেই মানুষগুলো ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়,ফিরেও তাকায় না অসহায় একটা বাচ্চার দিকে।মানবতা জাগ্রত হয় না তাদের মনে।
–
এভাবে দুপুর হয়ে যায়। খিদেয় পেট জ্বলছে জিহাদের। শরীরে আর শক্ত অবশিষ্ট নেই,কোনমতে হাটতে হাটতে একটা পার্কে এসে পৌছায় জিহাদ।পার্কের গাছের নীচে গিয়ে বসে পড়ে। খিদেয় শুকিয়ে গেছে ওর চোখের জল।কান্নাও করতে পারছে না।চোখ বুজে শুয়ে আছে এমন সময় শুনতে পায় কেউ ওকে ডাকছে…
–
-তুই জিহাদ না।(ছেলেটা)
-হ,কিন্তু তুমি কে?
-আমারে চিনোস না? আমি নাদিম, তোগো বস্তিতেই থাহি,তোর ঘরের দুঘর পরে ই আমাগো ঘর।কিন্তু তুই এইহানে বইসা আছোস কেন?
-(ছলছল চোখে)আইজ দুইদিন হইলো না খাইয়া আছি,মা অসুস্থ, ছোডো বইনডাও না খাইয়া আছে।কতজনের তে টাহা চাইলাম কিন্তু কেউ দিলো না,দুরদুর করে তাড়াইয়া দিসে (কেদেঁ দিয়েছে)।
-এই দুনিয়ার অনেক মানুষগুলো এমুন ই রে,হেরা আমাগো সাহায্য করবার চায় না কিন্তু নিজেগো লাইগ্গা ঠিক ই খরচ করে।সবাই রে বইলা বেড়ায় আমি মানবতাবাদী,কিন্তু হের বাড়ির কাজের মাইয়াডারে একটু ভুল করলে হাত তুলতে ভাবে না।এরা মানুষ নামের অমানুষ।
—ভাই অনেক ক্ষুদা লাগসে।
—আইচ্ছা চল দেহি কি করা যায় তোর লাইগ্গা।
–
সমাজের বড় মানবতাবাদী মানুষগুলো যা করে নি,বস্তিতে বাস করা নাদিম তা করে দেখিয়েছিলো। সেদিন জিহাদকে খাবার ই কিনে দেয় নি,ওর মায়ের জন্য ঔষধও কিনে দিয়েছিলো।নাদিম কখনো কাগজ কুড়াতো তো কখনো ফুল বিক্রি করতো।যতদিন না জিহাদের মা সুস্থ না হয় ততদিন জিহাদকে তার সাথে কাজ করার কথা বলে।এতে যা পাবে তা দিয়ে অন্তত খাবারের টাকা তো জুটবে।তাই জিহাদ রাজি হয়ে যায়।
–
সেদিন কাজ শেষ করে টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো জিহাদ,নাদিম আগে ই চলে গিয়েছে।হঠাৎ খেয়াল করে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হচ্ছে।আমাদের এই সমাজের নিয়মগুলো বড্ড অদ্ভুত।চাইলে দিতে চায় না,কিন্তু বেশী টা ফেলে দেয়ার সময় কোন সমস্যা হয় না। জিহাদ ডাস্টবিনের কাছে যায়,ফেলা দেয়া খাবারগুলো দেখে জিভে পানি এসে যায় ওর।রোজ পেয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া ওর মতো গরীবদের জন্য ধনীদের বিলাসিতা করে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্টগুলো রাজভোগের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।তাই দেরী না করে খাবারগুলো একটা পলিথিনে ভরে হাসিমুখে বাসার দিকে হেটে চলে জিহাদ।ওর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।
–
বাসায় গিয়ে দেখে ওর ছোট বোনকে বসিয়ে রেখে শুয়ে আছে ওর মা। ছোট বোনটি কান্নাকাটি করছে। মা অসুস্থ থাকায় কোলেও নিতে পারছে না।বোনের কান্না দেখে ছুটে চলে যায় বোনের কাছে। গিয়ে সেই কুড়িয়ে আনা খাবার গুলো সামনে দেয় জিহাদ ।খাবারগুলো দেখে বোনের কান্না বন্ধ হয়ে যায়।বোনকে খাইয়ে অবশিষ্ট খাবারটুকু জিহাদ আর তার মা পরম তৃপ্তিভরে খায়।হোক না এগুলো ফেলে দেয়া খাবার,হোক না এগুলো ডাস্টবিন থেকে আনা উচ্ছিষ্ট।তবুও তো এগুলো খাবার, যা দিয়ে পেটের আগুন তো নেভানো যায়। খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে জিহাদ।কাল আবার কাজে বের হতে হবে,ওর মতো মানুষগুলোকে জীবন সংগ্রামে লড়াই করে বাঁচতে হয়।
–
কিছু কথাঃ-গল্প টা কাল্পনিক,কিন্তু বাস্তবতা নিয়ে ই গল্প।এমনটা আমাদের আশেপাশে অহরহ ই ঘটছে। কতটা কষ্টে বসবাস করছে জিহাদের মতো মানুষগুলি সেটা আমরা বুঝেও না বুঝার ভান করি।তাদের সাহায্য করতে কিছু মানুষরূপী অমানুষদের আত্মসম্মান আঘাত লাগে। তাদের কে বলছি সময় সবার এক রকম থাকে না।যাকে দেখে নাক ছিটকাচ্ছেন আজ যদি তার জায়গায় আপনি থাকতেন তাহলে? গরীবকে টাকা দিতে গেলে তাড়িয়ে দেন কিন্তু ক্লাব,পার্টি আর বারে গিয়ে টাকা উড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না। আবার বড় গলায় বলেন আমি মানবতাবাদী।আমি বলবো আপনি একজন প্রতারক, একজন ভন্ড। জিহাদের মতো মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয় না,ভালোবেসে অল্প একটু সাহায্য করলে ই এরা খুশি হয়ে যায়, যা আপনি ওই পার্টি,ক্লাব ও বারে গিয়ে পাবেন না।সাহায্য করে দেখুন ই না,দেখবেন আপনার মন টা আত্মতৃপ্তি তে ভরে গেছে,নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গর্ববোধ হবে আপনার।আপনি সাহায্য করুন,আপনার দেখাদেখি আরেকজনও করবে।সর্বশেষ এটা ই বলবো মানুষ মানুষের জন্য।