আশেপাশের চৌদ্দ গজে কেউ থাকার কথা না ! নির্জন গলিতে শুধু রাস্তার কুকুরগুলো আরামকরে শহুরে জোছনা খাচ্ছে। আমি কান খাড়া করি। শব্দ ! আবার, ওই তো ! ওই যে শব্দটা !!
একটা গোঙ্গানির শব্দ কি ?
মানুষের ?
কুকুরগুলোর ?
‘কুত্তার বাচ্চা কুত্তা !’ দেড় কেজি ওজনের একটা গালি দিয়ে তেড়ে যাই সামনের দিকে।‘চিনস আমারে ? হান্দায়া দিমু এক্কেবারে’। আমার হাতে কিছু নেই, আমি আতিপাতি করে খুঁজতে থাকি একটা কিছু। একটা ইটের টুকরো হলেও চলবে। চোখগুলো গেলে দিলে শান্তি লাগতো। ইশ, যদি কয়েকটাকে বেঁধে ইচ্ছে মতো সকাল পর্যন্ত পেটাতে পারতাম!
‘গেছে গা তো, চাইয়া রইসস কোনদিকে ?’, আমার ভিতরটা বলে উঠে। চোখগুলো আরেকটু বড় বড় করতেই দেখি শেষ নেড়িটাও দৌড়ে কানা গলির ওপাশে গিয়ে গজরাচ্ছে।
শহর চুপ। গলি চুপ। ল্যাম্পপোস্ট চুপ। নেড়িগুলো চুপ। আমিও তো চুপ, কিন্তু গোঙ্গানির শব্দটা তো থামে না।
‘কোন মাতারি রে ?’ থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম। ‘ বইয়া বইয়া কান্দস কেন ?’
গোঙ্গানি থামে। হঠাৎ খসখস শব্দ হয়। কাগজে কাগজ ঘষার শব্দ। বেশ কিছুক্ষন, থেমে থেমে। উৎস ধরে আমি এগুতে থাকি। একটা ডাস্টবিন। পেছনে জমাট নর্দমা। তীব্র গন্ধটা নাকে আসতেই মনে হলো এই মুহূর্তে মগজটা কে যেন ফালি ফালি করে দিল।
‘বাঁচাও! বাঁচাও !!’ একটা গলা শোনা যায়।
-‘কে ভাই ?’ গলাটা বাড়িয়ে দেই।
-‘আমি, আমি। খুব অন্ধকারে আছি, বাঁচাও।’ বাচ্চা বাচ্চা গলাটা বলে উঠে।
-‘আরে বেক্কল, আকাশে চান্দ উঠসে দেখসো না ? আন্ধার কই ?’ মেজাজটা আবার গরম হয়ে যায়। ‘কয় পেগ গিলসত হারামী ?’
– ‘এখানে অনেক অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না। আমাকে আলোর কাছে নিয়ে যাবে?’ ওপাশ থেকে ভেসে আসে কথাগুলো।
– ‘দেখ ভাই, আমিও এই মাত্র গিল্লা আইসি।’ খেক খেক করে হেসে ফেলি। ‘ সইরা বয়, ডাস্টবিনে কি করস? বাইর হইয়া আয়।’
– শ্বাস নেওয়া যায় না ! দম বন্ধ হয়ে আসছে। আর দুর্গন্ধটা!
– আরে বলদ ড্রেনের সামনে বইয়া আর কিয়ের গন্ধ পাইবি ?
– ‘ফুলের গন্ধ নাকি অনেক আমুদে, আমার গায়ে একটু মাখিয়ে দিবে?’ অন্ধকার থেকে এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছে কণ্ঠটা।
আমার আর সহ্যসীমা কুলায় না। ডাস্টবিনের পাশে কি ভেবে যেন এতক্ষন বসে ছিলাম। এক লাফে সামনে যাই। ভিতর থেকে শুয়োরটাকে বাইরে বের করে আনা উচিত বোধহয়।
এমন সময় হঠাৎ মাথার উপর যেন অনেকগুলো আলো এসে পড়ে। চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই দেখি ঠিক পেছন থেকে টর্চ জ্বালিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন।
-‘বড়বাড়ির মদখোরটা না ?’ মাথার পেছনে টর্চের গোড়ার সপাৎ একটা বাড়ি পড়ে। তীব্র ব্যাথায় চিৎকার করে উঠার সামর্থ্যটা হারিয়ে ফেলি। ‘এইখানে কি করে এতক্ষন?’ কন্ঠটা ফিসফিসিয়ে কাকে যেন জিজ্ঞেস করে।
– ডাস্টবিনের পাশে বসে ছিল ওস্তাদ। এতক্ষনে দ্বিতীয়জনের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।
– কি করে দেখি। প্রথমজনের টর্চের আলো আমার মাথার পেছন থেকে সোজা সামনে নোংরা আবর্জনার স্তূপের উপর গিয়ে পড়ে।
একটা নবজাতক।
মৃতদেহের ছোট্ট হাতটা একটু আগেই বোধহয় কুকুরগুলো চাবিয়েছে।
মাথার পেছনের ব্যাথাটা এতক্ষনে কমে গেছে অনেকখানি। এবার গলাটা ছিঁড়ে আমার ভীষণ চিৎকারটা বেড়িয়ে যেতে থাকে……..
পেছনে ছুঁয়ে যায় জোছনা খাওয়া পোড়া শহরটাকে !